» » দূর্গেশনন্দিনী

বর্ণাকার

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

দূর্গেশনন্দিনী

গ্রন্থপরিচয়

বাংলা সাহিত্যের নবজাগরণের পথিকৃৎ-কর্মী বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। বঙ্কিমচন্দ্রের জন্ম ১৮৩৮ সালের ২৬ শে জুন, অধুনা চব্বিশ পরগণা জেলার অন্তর্গত নৈহাটির কাঁঠালপাড়া গ্রামে। বাবা যাদবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন মেদিনীপুরের কলেক্টর। নিয়মমাফিক পড়াশোনা শুরু বাবার কর্মস্থল মেদিনীপুর জেলার এক ইংরেজি স্কুলে। পরে কাঁঠালপাড়ায় ফিরে হুগলি কলেজে। ১৮৫৬ সালে বঙ্কিমচন্দ্র আইন পড়বার জন্য প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন এবং ১৮৫৭তে সেখান থেকে প্রথম বিভাগে এন্ট্রান্স পরীক্ষা পাশ করেন। ১৮৫৮ সালে সদ্য প্রতিষ্ঠিত কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বি.এ.পরীক্ষায় বঙ্কিমচন্দ্র দ্বিতীয় বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করেন। আইন পড়া শেষ হওয়ার আগেই যশোরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কলেক্টরের চাকরি পান।

বঙ্কিমী সাহিত্যের বিশেষত্ব এককথায় তার রসায়নে। বৌদ্ধিক রসের সঙ্গে সাহিত্য রসের এমন মিশেল পরবর্তী বাংলা সাহিত্যেও বিরল। না বললেও বোঝা যায়; সমসাময়িক জাতীয়তাবাদের ঝোড়ো হাওয়ায় বাংলা-বাঙালির সাংস্কৃতিক ইতিহাসের নির্মাণকল্পে বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর সাহিত্য-রচনার সমস্ত শক্তি ঢেলে দিলেও, তাঁর মননসঞ্জাত রসই বাংলা সাহিত্যকে প্রথম আধুনিকতার আলো দেখিয়েছিল। এককথায় বলতে গেলে, একদিকে উপন্যাসের কাব্য অন্যদিকে প্রবন্ধ তথা গদ্যের বিজ্ঞান, তার সঙ্গে কিছু গান, কবিতা ও ভারতবর্ষ – সব মিলিয়েই বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।

দুর্গেশনন্দিনী বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত প্রথম বাংলা উপন্যাস। ১৮৬৫ সালের মার্চ মাসে এই উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়। দুর্গেশনন্দিনী বঙ্কিমচন্দ্রের চব্বিশ থেকে ছাব্বিশ বছর বয়সের রচনা। এই উপন্যাস প্রকাশিত হওয়ার পর বাংলা কথাসাহিত্যের ধারায় এক নতুন যুগ প্রবর্তিত হয়। ষোড়শ শতাব্দীর শেষভাগে উড়িষ্যার অধিকারকে কেন্দ্র করে মোঘল ও পাঠানের সংঘর্ষের পটভূমিতে এই উপন্যাস রচিত হয়। তবে এটিকে সম্পূর্ণরূপে ঐতিহাসিক উপন্যাস মনে করা হয় না। কোনো কোনো সমালোচক এই উপন্যাসে ওয়াল্টার স্কটের আইভানহো উপন্যাসের ছায়া লক্ষ্য করেছেন। বঙ্কিমচন্দ্রের জীবদ্দশায় এই উপন্যাসের তেরোটি সংস্করণ প্রকাশিত হয় এবং ইংরেজি ও অন্যান্য ভারতীয় ভাষাতেও এটি অনূদিত হয়।

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ‘দূর্গেশনন্দিনী’ উপন্যাস তাঁর অগ্রজ শ্যামাচরণ চট্টোপাধ্যায়কে উৎসর্গ করেন।

আখ্যানবস্তু: দিল্লীশ্বরের প্রধান সেনাপতি অম্বররাজ মানসিংহের পুত্র কুমার জগৎ সিংহ বিষ্ণুপুর থেকে মান্দারণ যাত্রাকালে ঝড়ের কবলে পড়ে শৈলেশ্বর মহাদেবের মন্দিরে আশ্রয় নেন। সেখানে ঘটনাচক্রে মান্দারণ দুর্গাধিপতি জয়ধর সিংহের একমাত্র পুত্র মহারাজ বীরেন্দ্র সিংহের স্ত্রী বিমলা ও তাঁর কণ্যা দুর্গেশনন্দিনী তিলোত্তমার সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। পরস্পর পরস্পরের প্রকৃত পরিচয় গোপন রাখলেও জগৎসিংহ ও তিলোত্তমা পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট হন। পরে পাঠান সেনাপতি ওসমান খাঁ সুকৌশলে মান্দারণ দুর্গ অধিকার করে ও বীরেন্দ্র সিংহ এবং তাঁর স্ত্রী বিমলা ও কণ্যা তিলোত্তমাকেও বন্দী করে। কুমার জগৎ সিংহও বন্দী হন। যদিও পাঠান নবাব কতলু খাঁর বিচারে বীরেন্দ্র সিংহকে হত্যা করা হয়। নিহত বীরেন্দ্র সিংহের স্ত্রী বিমলা পাঠান নবাব কতলু খাঁকে হত্যা করে পতি হত্যার প্রতিশোধ নেয়। পাঠানেরা কুমার জগৎ সিংহের মাধ্যমে অম্বররাজ মানসিংহ তথা দিল্লীশ্বরের সঙ্গে সন্ধি করেন। অন্যদিকে কতলু খাঁর কন্যা নবাবজাদী আয়েষা জগৎ সিংহের প্রেমে পড়েন। আয়েষার প্রণয়ী পাঠান সেনাপতি ওসমান একথা জানার পর ক্রোধে কুমার জগৎ সিংহের সঙ্গে দ্বন্দ্বযুদ্ধে অবতীর্ণ হন। পরিশেষে মান্দারণ পুনরায় স্বাধীন হয় ও দিল্লীশ্বরের প্রধান সেনাপতি অম্বররাজ মানসিংহের মাধ্যমে মহারাণী বিমলার হস্তে রাজ্যপাঠ হস্তান্তরিত হয় এবং মহাধুমধামের সাথে কুমার জগৎ সিংহ ও দুর্গেশনন্দিনী তিলোত্তমার মিলন ঘটে।

দূর্গেশনন্দিনী রচনার ইতিহাস: বঙ্কিমচন্দ্রের ভ্রাতুষ্পুত্র শচীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মতে, ১৮৬২ সালে চব্বিশ বছর বয়সে বঙ্কিমচন্দ্র দুর্গেশনন্দিনী উপন্যাস রচনার কাজে হাত দেন। ১৮৬৩ সালে খুলনায় ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের কার্য নির্বাহকালে উপন্যাস রচনার কাজ সমাপ্ত হয়।

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কনিষ্ঠ সহোদর পূর্ণচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় দূর্গেশনন্দিনী উপন্যাস রচনার প্রেক্ষাপট বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, ‘আমাদের খুল্লপিতামহ একশত আট বৎসর বয়ঃক্রম পর্য্যন্ত জীবিত ছিলেন। …তাঁহার নিকট বঙ্কিমচন্দ্র ও আমরা সকলে গল্প শুনিতাম। যাহা শুনিতাম তাহা বঙ্গালার ইতিহাসের অন্তর্গত; উহা প্রায়ই বঙ্গের মুসলমান রাজত্বের অবসানের কথা। …তাঁহার নিকট বঙ্কিমচন্দ্র প্রথম গড়মান্দারণের ঘটনা শুনিয়াছিলেন; যদিও ঐ ঘটনা আকবর শাহা বাদশাহের সময় ঘটিয়াছিল, তথাচ তিনি উহা জানিতেন। সেকারের প্রাচীনেরা মুসলমান বাদশাহদিগের সময়ের অনেক ঘটনা জানিতেন। আমাদের মেজঠাকুরদাদার মধ্যে মধ্যে বিষ্ণুপুর অঞ্চলে যাতায়াত ছিল। মান্দারণ গ্রাম জাহানাবাদ ও বিষ্ণুপুরের মধ্যস্থিত। ঐ অঞ্চলে মান্দারণের ঘটনাটি উপন্যাসের ন্যায় লোকমুখে কিম্বদন্তী রূপে চলিয়া আসিতেছিল। মেজঠাকুরদা উহা ঐ স্থানে শুনিয়াছিলেন, এবং মান্দারণের জমিদার গড় ও বৃহৎ পুরী ভগ্নাবস্থায় দেখিয়াছিলেন। তাঁহারই মুখে প্রথম শুনি যে, উড়িষ্যা হইতে পাঠানেরা মান্দারণ গ্রামের জমিদারের পুরী লুটপাট করিয়া তাঁহাকে ও তাঁহার স্ত্রী ও কন্যাকে বন্দী করিয়া লইয়া যায়, রাজপুতকুলতিলক কুমার জগৎসিংহ তাঁহাদের সাহার্য্যার্থে প্রেরিত হইয়া বন্দী হইয়াছিলেন। এই গল্পটি বঙ্কিমচন্দ্র আঠার ঊনিশ বর্ষ বয়ঃক্রমে শুনিয়াছিলেন। তাহার কয়েক বৎসর পরে ‘দূর্গেশনন্দিনী’ রচিত হইল।” (বঙ্কিম-প্রসঙ্গ, পৃ. ৪৯-৫০)।

পূর্ণচন্দ্র আরও বলেন যে, ‘দূর্গেশনন্দিনী’র পাণ্ডুলিপি ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের জামাতা সুবিজ্ঞ তারাপদ চট্টোপাধ্যায় এবং বিখ্যাত সমালোচক ক্ষেত্রনাথ ভট্টাচার্য্যকে পাঠ করিতে দিয়াছিলেন। ক্ষেত্রনাথ এই উপন্যাসখানির মধ্যে ভাবী সাহিত্য-সম্রাটের সন্ধান পান এবং ভবিষ্যদ্বানী করেন যে, বঙ্কিম ভবিষ্যতে উৎকৃষ্টতর উপন্যাস লিখিতে সক্ষম হইবেন। (প্রাগুপ্ত)

বঙ্কিমচন্দ্রের ‘দূর্গেশনন্দিনী’ (১৮৬৫) ষোড়শ শতাব্দীর শেষভাগে (১৫৮০ থেকে ১৫৯০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে) মোগল শাসনের বিরুদ্ধে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার পাঠান-বিদ্রোহ এবং মোগল-পাঠানের সংঘর্ষের পটভূমিকায় রচিত। এই বিদ্রোহ দমন করেন মোগল-সম্রাট আকবরের অন্যতম সেনাপতি অম্বরাধিপতি মানসিংহ।

‘দূর্গেশনন্দিনী’ উপন্যাসের কাহিনীসূত্র বঙ্কিমচন্দ্র পেয়েছিলেন তাঁর খুল্লপিতামহের কাছ থেকে। “… তাঁহার নিকট বঙ্কিমচন্দ্র প্রথম গড়মান্দারণের ঘটনা শুনিয়াছেন, যদিও ঐ ঘটনা আকবর শাহা বাদশাহের সময় ঘটিয়াছিল তথাচ তিনি উহা জানিতেন। সেকালে প্রাচীনেরা মুসলমান বাদশাহদিগের সময়ের অনেক ঘটনা জানিতেন। আমাদের মেজঠাকুরদার মধ্যে মধ্যে বিষ্ণুপুর অঞ্চলে যাতায়াত ছিল। মান্দারণ গ্রাম জাহানাবাদ ও বিষ্ণুপুরের মধ্যস্থিত। ঐ অঞ্চলে মান্দারণের ঘটনাটি উপন্যাসের ন্যায় লোকমুখে কিম্বদন্তী রূপে চলিয়া আসিতেছিল। মেজঠাকুরদা উহা ঐ স্থানে শুনিয়াছিলেন, এবং মান্দারণের জমিদারের গড় ও বৃহৎ পুরী ভগ্নাবস্থায় দেখিয়াছিলেন। তাঁহার মুখে প্রথম শুনি যে, উড়িষ্যা হইতে পাঠানেরা মান্দারণ গ্রামের জমিদারের পুরী লুটপাট করিয়া তাঁহাকে ও তাঁহার স্ত্রী ও কন্যাকে বন্দী করিয়া লইয়া যায়, রাজপুত কূলতিলক কুমার জগৎ সিংহ তাঁহাদের সাহায্যার্থে প্রেরিত হইয়াছিলেন। এই গল্পটি বঙ্কিমচন্দ্র আঠার-উনিশ বর্ষ বয়ক্রমে শুনিয়াছিলেন। তাহার কয়েক বৎসপর পরে ‘দূর্গেশনন্দিনী’ রচিত হইল।”

খুল্লপিতামহের কাছে পাওয়া কাহিনী সূত্রের সঙ্গে চার্লস স্টুয়ার্টের ‘হিস্ট্রি অব বেঙ্গল’ থেকেও বঙ্কিমচন্দ্র দূর্গেশনন্দিনী উপন্যাসের উপাদান সংগ্রহ করেছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর উপন্যাসে স্টুয়ার্টের বর্ণনার হুবহু অনুবাদ প্রদান করেছিলেন।

বঙ্কিমচন্দ্র স্টুয়ার্টের ইতিহাস এবং কিংবদন্তীর উপর নির্ভর করে ‘দূর্গেশনন্দিনী’ রচনা করেন। এই উপন্যাস রচনাকালে ‘দূর্গেশনন্দিনী’র সময়কার অনেক ঐতিহাসিক তথ্যই অজ্ঞাত ছিল। পরবর্তীকালে নবাবিষ্কৃত তথ্যাদির নিরিখে ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার আমাদের জানিয়েছেন— “বঙ্কিমচন্দ্রের ‘দূর্গেশনন্দিনী’তে সত্য ইতিহাস কতটুকু আছে? মানসিংস, জগৎসিংহ, কুৎলু খাঁ, খ্বাজা ইসা, উস্‌মান— ইঁহারা সকলেই ঐতিহাসিক পুরুষ এবং সে যুগে বঙ্গের ঠিক সেই স্থলে বাস করিতেন। ইহাও সত্য ইতিহাস যে, জগৎসিংহ অগণিত পাঠানদের নিকট পরাজিত হইয়া এক দূর্গে আশ্রয় লন এবং তাহার কিছুদিন পরেই কুৎলু খাঁর মৃত্যু হওয়ায় তাঁহার দেওয়ান খ্বাজা ইসা কুৎলুর বালক পুত্রদের রাজ্য বাঁচাইবার জন্য মানসিংহের সহিত দেখা করিয়া বহুমূল্য উপঢৌকন দিয়া সন্ধি করেন। ইহা ভিন্ন ‘দূর্গেশনন্দিনী’র আর সব কথা কাল্পনিক। এই সন্ধিতে জগৎ সিংহ মধ্যস্থ ছিলেন না। তবে, বঙ্কিম কি বাকী সব ঐতিহাসিক দৃশ্যপট নিজ কল্পনা হইতে সৃষ্টি করিয়াছেন? আয়েষা, তিলোত্তমা, বিমলা সকলেই কাল্পনিক। এ কথা পাঠক সহজেই ধরিয়া ফেলিবেন; এবং তাহাতে কিছু আসে যায় না। কিন্তু জগৎ সিংহের আহত হওয়া, কুৎলুর দূর্গে আবদ্ধ থাকা, এবং তাহার দ্বারা কুৎলুর মরণকালে সন্ধিভিক্ষা করা, এই শাখাপল্লবগুলি ইতিহাসের বাহিরে হইলেও বঙ্কিমের নিজকল্পনায় সৃষ্টি নহে। এগুলি আসিয়াছে ঐতিহাসিক নামজাদা একজন ঘোর কাল্পনিক সাহেবের লেখা হইতে, তিনি কাপ্তান এলেকজাণ্ডার ডাও (Alexander Dow)। এই সাহেবটি ফিরিস্তার রচিত হিন্দুস্থানের ইতিহাস ইংরেজীতে প্রায়শঃ অনুবাদ করিয়া দিতেছেন বলিয়া এবং নিজ গ্রন্থের নামপত্রে ফিরিস্তার নাম সংযোগ করিয়া দিয়া অপর্য্যাপ্ত মেকী কথা চালাইয়াছেন, যাহা ফিরিস্তাতেও লেখেন নাই; এমন কি, কোনও পারসিক লেখকের পক্ষে সেরূপ লেখাও সম্ভব ছিল না।

ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার রচিত ‘দূর্দেশনন্দিনী’ উপন্যাসের ‘ঐতিহাসিক ভূমিকা’র অন্যত্র তিনি লেখেন— “মানসিংহের পুত্র কুমার জগৎ সিংহ মদিরামত্ত অবস্থায় কৎলু খাঁর সেনাপতি বাহাদুর খাঁ কর্তৃক পরাজিত ও আহত হইয়া বিষ্ণপুরের রাজা বীরহাম্বিরের যত্নে সেই রাজধানীতে পলাইয়া গিয়া বাঁচেন, ইহা সত্য ঘটনা— এবং ইহা আবুল ফজল বর্ণনা করিয়াছেন।”

পক্ষান্তরে স্টুয়ার্টের ইতিহাসে বলা হয়েছে, ধরপুরে আফগানরা জগৎসিংহের কাছে পরাজিত হয়ে সন্ধির জন্য আলোচনার ভান চালিয়ে যায়, যা জগৎসিংহ ধরতে পারেননি, এবং সেই সুযোগে গোপনে কৎলু খাঁকে সংবাদ পাঠিয়ে অতিরিক্ত সৈন্য আনানো হয়। ফলে জগৎসিংহ পরাজিত ও বন্দী হন। পাঠানদের হাতে জগৎসিংহের বন্দীত্বের যে বিবরণ স্টুয়ার্ট দিয়েছেন ‘আকবর নামা’ অনুসারে তা সঠিক নয়। কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্র পাঠানদের হাতে জগৎসিংহের বন্দীত্বের সূত্রটিকে অত্যন্ত সুকৌশলে ‘দূর্গেশনন্দিনী’ উপন্যাসে কাজে লাগিয়েছেন। এই সূত্র ধরেই জগৎসিংহ ও তিলোত্তমার প্রণয় কাহিনীর সঙ্গে আয়েষা ও ওসমান যুক্ত হওয়ায় ‘দূর্গেশনন্দিনী’ উপন্যাসটি বর্তমান রূপ পরিগ্রহ করেছে। তাই অনৈতিহাসিক হলেও এই সূত্রকে অবহেলা করা যায় না। আবার ঐতিহাসিক বিচ্যুতির জন্য বঙ্কিমচন্দ্রকেও দায়ী করা যায় না। কারণ, প্রথমতঃ দূর্গেশনন্দিনীর রচনার সময় পর্যন্ত ‘আকবরনামা’র কোন ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয়নি এবং ফারসি না জানায় বঙ্কিমচন্দ্র মূল গ্রন্থটিও পড়তে পারেন নি। দ্বিতীয়তঃ তিনি তাঁর সময় কালে আধুনিক পদ্ধতিতে রচিত স্টুয়ার্টের বাংলাদেশের ইতিহাস যথাযথভাবে অনুসরণ করেছেন। সুতরাং তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে ইতিহাসের বিকৃতি ঘটিয়েছেন, এই কথা বলা যায় না।

এই উপন্যাসে তিলোত্তমা, বিমলা, আয়েষা, অভিরাম স্বামী প্রভৃতি চরিত্র অনৈতিহাসিক। দাউদ খাঁ, মনাইম খাঁ, খাঁ আজিম, শাহবাজ খাঁ, সৈদ খাঁ প্রভৃতি ঐতিহাসিক চরিত্র। কিন্তু উপন্যাসের প্রথম খণ্ডের তৃতীয় পরিচ্ছেদে এই সব ঐতিহাসিক চরিত্রের নামোল্লেখ ভিন্ন উপন্যাসের কাহিনী মধ্যে তাঁদের কোনো ভূমিকা নেই।

মোগল-পাঠান সংঘর্ষের পটভূমিকায় রচিত ‘দূর্গেশনন্দিনী’ উপন্যাস। মোগল পক্ষের প্রধান দিল্লী সম্রাট আকবরের বিখ্যাত সেনাপতি মানসিংহ। তাঁর রণকৌশল ও বাহুবলে বঙ্গদেশ থেকে কাবুল পর্যন্ত মোগল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত হয়। উপন্যাসের প্রথম খণ্ডের তৃতীয় পরিচ্ছেদে দারুকেশ্বর নদীতীরে শিবির সংস্থাপন করে সাইদ খাঁর জন্য প্রতীক্ষা এবং চতুর্থ পরিচ্ছেদে ‘নবীন সেনাপতি’ নির্বাচন করে পাঠানদের গ্রাম-লুণ্ঠন ও প্রজাপীড়ন প্রতিরোধ ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে আমরা তাঁর বিচক্ষণতার পরিচয় পাই,— যা বঙ্কিমচন্দ্র যথার্থ দক্ষতায় উপস্থাপিত করেছেন। তবে এই উপন্যাসে বিমলা কর্তৃক কতলু খাঁ হত্যা ঘটনাটি অনৈতিহাসিক।

দুর্গেশনন্দিনী উপন্যাসের দ্বিতীয় খণ্ডে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কতলু খাঁর কন্যা আয়েষার ও মানসিংহ পুত্র জগৎসিংহের প্রেমকাহিনী বর্ণনা করেছেন। এই কাহিনীর ঐতিহাসিক ভিত্তি একেবারে না থাকলেও এতে মুসলিম সম্প্রদায় এতে বঙ্কিমচন্দ্রকে মুসলিম বিদ্বেষী হিসেবে বিবেচনা করেছেন। যাই হোক, আমরা প্রথম খণ্ডের পরিচিতিতে জানিয়েছি কী বঙ্কিমচন্দ্র এই কাহিনী নিজের মনগড়া ভাবে সৃষ্টি করেননি। তিনি ইংরেজ ঐতিহাসিক আলেকজাণ্ডার বো-র লেখায় প্রভাবিত হয়ে এই কাহিনীর সৃষ্টি করেছিলেন, কেননা আকবরনামা তখনও ইংরেজিতে অনূদিত হয়নি এবং বঙ্কিমচন্দ্র ফারসি ভাষা জানতেন না বিধায় আসল সত্য ছিল তাঁর অজ্ঞাত। আধুনিক ঐতিহাসিকেরা একে অনৈতিহাসিক ঘটনা বলেই বিবেচনা করেন।

দূর্গেশনন্দিনী উপন্যাসে কতলু খাঁর কন্যা আয়েষা (বঙ্কিম আয়েশা বানান এভাবেই লিখেছেন) ট্র্যাজিক হিরোইন। মানসিংহ পুত্র জগৎসিংহের প্রেমে পড়েন আয়েষা। এই প্রেমের কারণে কতলুখাঁর সেনাপতি ওসমানের প্রেম প্রত্যাখ্যান করেন আয়েষা। এদিকে জগতসিংহ ভালবাসে বীরেন্দ্রসিংহের কন্যা তিলোত্তমাকে। আয়েষার সঙ্গে জগতসিংহের মিলন বঙ্কিম দেননি। কিন্তু সে ভালবাসাকে গভীরে সন্মান ও শ্রদ্ধায় উভয়ে সম্মত তা দেখিয়েছেন।