নবাবি আমলে মুর্শিদাবাদ
বাংলার ইতিহাস তথা উপমহাদেশের ইতিহাসকে জানতে চাইলে মুর্শিদাবাদকে বাদ তো দেয়া যাবেই না, বরং এ শহরটার গুরুত্ব অনেক অনেক বেশি। এ শহরের পরাজয় দিয়ে বাংলা তথা ভারতবর্ষে শুরু হয়েছিল ইংরেজদের শাসন।
মুর্শিদাবাদ নগরী। এক করুণ-রঙিন ইতিহাস লগ্ন হয়ে আছে সে নগরীর পরতে পরতে। নবাব মুর্শিদকুলি খান ১৭০৪ সালে এই নগরীর পত্তন করেন। সে হিসেবে ২০০৪ সালে মুর্শিদাবাদের তিনশো বছর পূর্ণ হল। এ উপলক্ষেই বর্তমান গ্রন্থের অবতারণা। মুর্শিদাবাদ সংক্রান্ত বেশির ভাগ প্রামাণিক গ্ৰন্থই একশো বছর বা তার আগে লেখা। গত কয়েক দশকেও এই নগরী নিয়ে বেশ কিছু বই ও কয়েকটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু তার সবগুলিতেই মুর্শিদাবাদের খণ্ড খণ্ড চিত্র, সামগ্রিক চিত্র ঠিক কোথাও পাওয়া যায় না।
মুর্শিদাবাদের তিনশো বছর পূর্তি উপলক্ষে এর ইতিহাসের প্রতি, বিশেষ করে স্বাধীন নবাবি আমলে এই শহরের প্রসঙ্গে, নতুন ভাবে দৃষ্টিপাত করার প্রয়োজন আছে। লেখক প্ৰায় চার দশক ধরে ইউরোপের বিভিন্ন আর্কাইভসে যে-সব নতুন তথ্যের সন্ধান পেয়েছেন, তার ভিত্তিতে নবাবি আমলে মুর্শিদাবাদের এই সার্বিক ইতিহাস রচনা করেছেন। লেখক এই সত্যের প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন, নবাবি আমলই মুর্শিদাবাদের স্বর্ণযুগ। মুর্শিদাবাদে তিন বণিকরাজার কার্যকলাপ, পলাশির ষড়যন্ত্র ও বিপ্লব কেন হল, তার সম্পূর্ণ নতুন ব্যাখ্যা, এ নগরীর বেগমদের সম্বন্ধে আকর্ষণীয় বিবরণ এবং মুর্শিদাবাদের শিল্প, বাণিজ্য, অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও স্থাপত্যের আকরভিত্তিক বিশ্লেষণ গ্রন্থটির অন্যতম আকর্ষণ।
এ শহর, সিরাজ-উদ-দৌলা, মীরজাফর, জগৎশেঠ ইত্যাদি অনেককে নিয়ে অনেক তথ্য অনেক গুজব আছে। এমনকি এমন কিছু বইও আছে যেখানে লেখা আছে, ইংরেজরা আসলে বাংলা দখল করতে চায়নি। ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে না চাইতেও সেটা হয়ে গেছে। এ বইতে অধ্যাপক সুশীল চৌধুরী সেসব গুজবকে অসংখ্য রেফারেন্স দিয়ে নাকচ তো করেছেনই সঙ্গে ইতিহাস, সমাজব্যবস্থা, মুর্শিদাবাদের উত্থান ইত্যাদি নানা দৃষ্টিকোণ দিয়ে তৎকালীন রাজনৈতিক অবস্থাটা বোঝানোর চেষ্টা করেছেন।
অধ্যাপক সুশীল চৌধুরী বাংলার স্বাধীন নবাবি আমলের রাজধানী মুর্শিদাবাদের রাজনীতি নিয়ে লিখেছেন। যে রাজনীতির ঘটনাপ্রবাহ পুরো ভারতবর্ষের ইতিহাসের বাঁক বদলে দিয়েছিল।
আওরঙ্গজেব তাঁর বিশ্বস্ত দেওয়ান করতলব খাঁকে হায়দরাবাদের দেওয়ানের পদ থেকে নিয়ে এসে বাংলা সুবার রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব দেন। তখন রাজধানী জাহাঙ্গীরনগর এবং সুবাদার সম্রাট আওরঙ্গজেবের নাতি আজিম-উস-শান। রাজস্বসহ আরও নানা ইস্যুতে আজিমের সাথে দ্বন্দ্ব তৈরি হয় করতলব খাঁর। বলা হয়, করতলব খাঁকে হত্যার পরিকল্পনা করেন আজিম-উস-শান। চৌকস করতলব খাঁ সম্রাটের প্রিয়ভাজন ছিলেন। কারণ দাক্ষিণাত্যের যুদ্ধে বিধ্বস্ত আওরঙ্গজেবের তখন পয়সার প্রধান উৎস বাংলা সুবা। সেই বাংলা থেকে কোটি কোটি টাকা রাজস্ব পাঠান করতলব খাঁ।
বুদ্ধিমান করতলব খাঁ রাজস্ব বিভাগ ও কর্মচারীদের নিয়ে মকসুদাবাদে চলে এলেন। ইতোমধ্যে সম্রাট খুশি হয়ে করতলব খাঁকে মুর্শিদকুলি খান উপাধি দিয়েছেন। বাদশাহের অনুমতিক্রমে মখসুদাবাদের নামকরণ করলেন করলেন মুর্শিদাবাদ। ১৭১৭ সালে বাংলার রাজধানী হয়ে গেল মুর্শিদকুলির মুর্শিদাবাদ।
মুর্শিদকুলি খানের উত্থানের কাহিনি বিস্ময়কর। তিনি জন্মেছিলেন হিন্দু বামুনের ঘরে। ছোটবেলায় ক্রীতদাস হিসেবে তাকে কিনে নেন একজন ইরানি ব্যবসায়ী। এই ব্যবসায়ী রাজস্বব্যবস্থা ভালো বুঝতেন। আবারও, হাতবদল হয় মুর্শিদকুলির মালিকানা। এবার একজন ফারসি অভিজাতের অধীনস্থ হন তিনি। আরও ভাল ভাবে শেখার সুযোগ হয় খাজনা আদায়ের কাজকর্ম। এভাবেই রাজস্ব বিভাগে দক্ষতা অর্জন করেন মুর্শিদকুলি। যা পরবর্তীতে তার জীবনে চরম সৌভাগ্য বয়ে এনেছিল।
মুর্শিদকুলি বুদ্ধিমান শাসক ছিলেন। তিনি জানতেন দিল্লির বাদশাকে নজরানা দিয়ে তুষ্ট করলেই চলবে। তিনি রাজস্বব্যবস্থাকে ঢেলে সাজান। তার আমলে বাংলার বড় বড় পদ-পদবিধারী প্রায় সকলেই ছিলেন হিন্দু। মুর্শিদকুলি মনে করতেন রাজস্ব আদায়ে মুসলমান কর্মীরা ফাঁকি দিতে পারে। তাই তিনি হিন্দুদের নিযুক্ত করেছিলেন। তার আমলে বাংলার উনিশটি বৃহৎ জমিদারির আঠারোটি ছিল হিন্দু জমিদারদের। অর্থাৎ, বাংলায় ধনাঢ্য মানুষ বেশির ভাগ হিন্দু সম্প্রদায়ের ছিল। তাহলে মুসলমানদের আর্থিক দুরবস্থার জন্য ব্রিটিশরা কতখানি দায়ি তা নিয়ে আরও আলাপ-আলোচনা হতে পারে। কারণ নবাবি আমলেই দেখা যাচ্ছে, ধন-সম্পদের মালিকানায় হিন্দু সম্প্রদায় এগিয়ে।
মুর্শিদকুলি জাহাঙ্গীরনগর থেকে মুর্শিদাবাদে চলে আসার সময় সেখানকার কিছু সম্পদশালী বণিক পরিবারকে নিয়ে আসেন। এদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ছিল জগৎশেঠ (এটি কোনো নাম নয়, উপাধি)। রাজস্থানের এই পরিবারটি সরকারের তথা নবাব মুর্শিদকুলির পৃষ্ঠপোষকতায় লাখ লাখ টাকা উপার্জনের সুযোগ পায়। একজন ইংরেজি ব্যবসায়ী উল্লেখ করেছেন, সেই আমলে জগৎশেঠের বার্ষিক আয় ছিল ৫৬ লাখ টাকা! পুরো উত্তর ভারতের আর্থ-বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রক এই পরিবারটি প্রয়োজনে বাংলার নবাবসহ দিল্লির বাদশাকে টাকা ধার দিত এবং বাংলা সরকারের টাকশালের দায়িত্বে ছিল।
উঁমিচাদ আরও একজন ধনবান ব্যবসায়ী। ঐতিহাসিকরা এদের মার্চেন্ট কিং বা বণিক রাজা বলে অভিহিত করেছেন। এরা ব্যবসায়ী হলেও রাজার মতো জীবনযাপন করতেন। পরোক্ষভাবে সুবা এরাই পরিচালনা করতেন। যে-কোন সিদ্ধান্ত যা তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থের প্রতিকূলে যেতে পারে, এমন কোন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতার বাংলার কোন নবাবের ছিল না। মুর্শিদকুলি থেকে আলিবর্দি পর্যন্ত সকল নবাব এই বণিক রাজাদের তোয়াজ করে চলতেন। কিন্তু প্রথমবারের মত এসব বণিকরাজকে বিনা চ্যালেঞ্জে মেনে নিতে অস্বীকার করেন তরুণ নবাব সিরাজ।
সিরাজউদ্দৌলা নবাব হওয়ার পর ইংরেজরা প্রথামাফিক নজরানা পাঠায়নি। যখন তিনি যুবরাজ, একবার কোম্পানির কাশিমবাজার কুঠি পরিদর্শনে গেলে তাকে যথাযোগ্য সম্মান দেখায়নি কোম্পানির কর্তারা। উপরন্তু, সম্রাট ফররুখশিয়ারের দেওয়া বিনা শুল্কে ব্যবসা করার ফরমানের অপব্যবহার করে ইংরেজরা কর ফাঁকি দিচ্ছিল এবং আলিবর্দির জীবদ্দশায় তারা দুর্গ নির্মাণের কাজ শুরু করে। যা ছিল নিষিদ্ধ। মোটকথা, কিছু সমস্যা আলিবর্দির আমলেই তৈরি হয়েছিল। যা তিনি সমাধান করেননি বা করতে চাননি। সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে গিয়েই সিরাজ কোম্পানিকে নিজের দুশমনে পরিণত করে।
সিরাজকে একদল ঐতিহাসিক চূড়ান্ত মন্দ লোক হিসেবে দেখাতে চান। বুঝাতে চান তরুণ সিরাজ ছিল অপরিপক্ব ও অযোগ্য। কিন্তু সুশীল চৌধুরী দেখিয়েছেন সিরাজ যথেষ্ট বুদ্ধিমান শাসক ছিলেন। তিনি বুঝতেন কোম্পানিকে শায়েস্তা করতে ব্যর্থ হলে কোম্পানি তাকে শায়েস্তা করবে। মির জাফরকে বিশেষ ভরসা তিনি করতেন না। তাই দেখতে পাই পলাশির প্রান্তরে মীর মদনের মৃত্যু হলে বাধ্য হয়ে তিনি মীর জাফরের পায়ের সাথে নিজের মুকুট রেখে তার সাহায্য চান। অনভিজ্ঞতাই হয়তো সিরাজের কাল হয়েছে।
বহিঃস্থ শত্রু চিহ্নিত করতে সফল সিরাজ ব্যর্থ হন ঘরের শত্রু যেমন– বড় খালা ঘসেটি বেগম, রায় দুর্লভ, উমিচাঁদ ও জগৎশেঠের ষড়যন্ত্র বুঝতে। এমনকি ফরাসিদের সাথে মিত্রতার সর্বোচ্চ ফায়দা তুলতে সিরাজের ব্যর্থতা তার পরাজয় ত্বরান্বিত করেছে।
মুর্শিদাবাদের বেগমদের নিয়ে লিখেছেন সুশীল চৌধুরী। তখনকার রাজনীতিতে নারীদের বুদ্ধি কীভাবে বাংলার ইতিহাসকে বদলে দিয়েছিল তার কিছু বর্ণনা পেয়েছি। বিশেষত, মীর জাফরের মুন্নি বেগম তো অতুলনীয়, যাকে ক্লাইভের মতো ব্যক্তি ‘মা’ উল্লেখ করে চিঠি লিখেছিল!
উৎসর্গ
আমার ছোটভাই
অকালপ্রয়াত সলিলকান্তি চৌধুরীর
স্মৃতির উদ্দেশে
ঋণ স্বীকার
এই বই লেখার ব্যাপারে আমার স্ত্রী, মহাশ্বেতা, আমাকে নানাভাবে সাহায্য করেছেন। তাঁর সাহায্য ছাড়া এটা লেখা সম্ভব হত না। বহরমপুরের ‘ইতিহাস পরিক্রমা’ মুর্শিদাবাদ সংক্রান্ত অনেকগুলি ছবি দিয়ে কৃতজ্ঞতাভাজন হয়েছেন। অধ্যাপক গৌতম ভদ্র কিছু তথ্য দিয়ে সাহায্য করেছেন। তাঁকে ধন্যবাদ। এ বইয়ের জন্য ন্যাশন্যাল লাইব্রেরি ও ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়্যালের কর্তৃপক্ষ কিছু ছবি ব্যবহার করবার অনুমতি দিয়ে বাধিত করেছেন। শ্রীমতী সুস্মিতা দুধোরিয়া কিছু তথ্য সংগ্রহ করতে আমাকে সাহায্য করায় উপকৃত হয়েছি। এই বইয়ের ব্যাপারে শ্রী শ্রীরাম সিং এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করে আমার অনেক উপকার করেছেন। আনন্দ পাবলিশার্স অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে বইটি প্রকাশনার ব্যবস্থা করায় আমি কৃতজ্ঞ।
সংকেত সূচি
BPC | Bengal Public Consultations |
Beng. Letters Recd. | Bengal Letters Received |
C & B Abstr. | Coast and Bay Abstracts |
DB | Despatch Books |
Fact. Record | Factory Records |
FWIHC | Fort William-India House Correspondence |
HB | Hughli to Batavia |
Home Misc. | Home Miscellaneous |
HR | Hoge Regering van Batavia |
OC | Original Correspondence |
Orme Mss. | Orme Manuscripts |
Mss. Eur. | European Manuscripts |
NAI | National Archives of India |
VOC | Verenigde Oost-Indische Compagnie |
Journals | |
BPP | Bengal Past and Present |
CHJ | Calcutta Historical Journal |
IESHR | Indian Economic and Social History Review |
IHR | Indian Historical Review |
JAS | Journal of Asian Studies |
J. As. S | Journal of Asiatic Society |
JEH | Journal of Economic History |
JESHO | Journal of the Economic and Social History of the Orient |
MAS | Modern Asian Studies |