» » অষ্টম অধ্যায় : সমাজ, অর্থনীতি ও সংস্কৃতি

বর্ণাকার

নবাবি আমলে মুর্শিদাবাদের ইতিহাস আলোচনা করতে গেলে অবধারিতভাবে ওই অঞ্চলের সমাজ, অর্থনীতি ও সংস্কৃতির কথা এসে পড়বে। এই সব দিকগুলির সম্যক বিশ্লেষণ প্রয়োজন কারণ আমরা দেখতে পাব, এই সব দিক থেকেই মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজার অঞ্চল বেশ কিছু বিশেষত্ব ও নতুনত্বের দাবি করতে পারে এবং সে দাবি খুবই যৌক্তিক। সপ্তদশ শতকে যে সব বৈশিষ্ট্য মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজার অঞ্চলের তথা বাংলার ইতিহাসে দেখা যায়, অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে তাতে অনেক পরিবর্তন আসে। সেগুলি সমাজ, অর্থনীতি ও সংস্কৃতিতে বিশেষভাবে প্রতিফলিত।

সমাজ
নবাবি যুগে মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজারের সমাজের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য, বহু জাতি ও বহু ধর্মাবলম্বী মানুষের সমাবেশ। এরকম ঠিক এর আগে কখনও দেখা যায়নি। মুর্শিদকুলি যখন ১৭০৪ সালে দেওয়ানি কার্যালয় ঢাকা থেকে সরিয়ে মখসুদাবাদে (মুর্শিদাবাদে) নিয়ে আসেন তখন ওই দপ্তরের সঙ্গে যুক্ত সব কর্মচারী মুর্শিদাবাদে চলে আসে, সঙ্গে আসে বেশ কিছু ব্যাঙ্কার-মহাজন ও সওদাগর—এদের মধ্যে ছিল বিভিন্ন প্রদেশের বিভিন্ন জাতি ও ধর্মের মানুষ। তারপর যখন মুর্শিদকুলি ১৭১৬/১৭ সালে বাংলার সুবাদার পদেও নিযুক্ত হলেন এবং মুর্শিদাবাদই বাংলার নতুন রাজধানী হল, তখন ঢাকা থেকে সব রাজকর্মচারী এবং অমাত্য ও অভিজাতবর্গও মুর্শিদাবাদে এসে বসবাস শুরু করল। এদের মধ্যে বিভিন্ন জাতি ও ধর্মাবলম্বী মানুষ ছিল। তা ছাড়া নতুন সুযোগের সন্ধানে বহু ব্যবসায়ী-সওদাগর-মহাজনও ভারতবর্ষ ও এশিয়ার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসে মুর্শিদাবাদে আস্তানা করল। এদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য আর্মানি বণিকগোষ্ঠী। এমন কী তারা মুর্শিদাবাদের সৈয়দাবাদে নিজেদের একটি উপনিবেশও (কলোনি) স্থাপন করে। মুর্শিদকুলির রাজস্ব ও শাসনসংক্রান্ত সংস্কারের ফলে একদিকে যে নতুন এক বাণিজ্যিক শ্রেণি এবং অন্যদিকে এক মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব হয়, তাদের অধিকাংশের আবাসস্থলও ছিল মুর্শিদাবাদ। তাছাড়া তখন বিভিন্ন ইউরোপীয় কোম্পানির অন্যতম বাণিজ্যকেন্দ্রও ছিল মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজার অঞ্চলে। তাই নবাবি আমলে মুর্শিদাবাদের সমাজকে ‘কসমোপলিটান’ (cosmopolitan) বললে অত্যুক্তি হবে না।

বলা বাহুল্য, সামাজিক স্তরবিন্যাসে মুর্শিদাবাদের সমাজে সর্বোচ্চ ছিল অভিজাত শ্রেণি। মুর্শিদাবাদ সুবে বাংলার রাজধানী হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই মুর্শিদাবাদ অভিজাতবর্গ ও তাদের আশ্রিত ব্যক্তিদের বাসস্থল হয়ে ওঠে। রিয়াজ-উস-সলাতিনের লেখক গোলাম হোসেন লিখেছেন, মুর্শিদকুলি থেকে আলিবর্দি পর্যন্ত বাংলার নবাবদের নীতি ছিল দেশ বিদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অভিজাতদের আমন্ত্রণ করে মুর্শিদাবাদে নিয়ে আসা।১ তার সঙ্গে নবাবি আমলে মুর্শিদাবাদের সৌন্দর্যায়নের জন্য যে প্রচেষ্টা হয়েছিল, তাতে প্রায় সব নবাবই যুক্ত ছিলেন। ফলে অনেক অভিজাত ব্যক্তি মুর্শিদাবাদে পদার্পণ করেন। এ সব নানা কারণে মুর্শিদাবাদে অভিজাত শ্রেণির বহু মানুষের সমাবেশ হয়। এই অভিজাতরা সাধারণত দুই সম্প্রদায়ের, হিন্দু ও মুসলমান। মুসলমানদের মধ্যে বিশেষ করে শিয়া সম্প্রদায়। বস্তুতপক্ষে, মুর্শিদাবাদের মুসলমানদের মধ্যে শিয়াদেরই ছিল প্রাধান্য। ফারসি ইতিহাস তারিখ-ই-মনসুরীর লেখক মন্তব্য করেছেন: ‘in Murshidabad the Shias, are, by the blessing of God, the reigning sect’.২ অন্যদিকে মুর্শিদকুলি বাঙালি হিন্দু ছাড়া আর কাউকে রাজস্ববিভাগে নিযুক্ত করতেন না, ফলে প্রচুর হিন্দু রাজকর্মচারী মুর্শিদাবাদে বাস করত।৩ এ প্রসঙ্গে এটাও বলা দরকার যে, মুর্শিদকুলির সংস্কারের ফলে যে নতুন ব্যাঙ্কার-ব্যবসায়ী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব হয় তাদের অধিকাংশই হিন্দু। তাই মুর্শিদাবাদের দরবারে হিন্দুদের যে বিশেষ সামাজিক ও রাজনৈতিক গুরুত্ব ছিল তা অস্বীকার করা যায় না।

মুর্শিদাবাদের সমাজে ও শ্রেণিবিন্যাসে অভিজাত শ্রেণির পরই ছিল ব্যবসায়ী-ব্যাঙ্কার ও বাণিজ্যিক শ্রেণির স্থান। এদের অনেকে দেশ বিদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এসে মুর্শিদাবাদের সমাজে জায়গা করে নিয়েছিল। ১৭৩০-এর দশকে নবাব সুজাউদ্দিনের সময় জৈন কবি নিহাল সিংহ মুর্শিদাবাদে আসেন এবং তাঁর ‘বংগাল দেশ কী গজল’ কবিতায় গঙ্গাতীরবর্তী রাজধানীর ও ব্যবসায়কেন্দ্রের যে বর্ণনা দিয়েছেন তাতে মুর্শিদাবাদের ব্যবসায়ী-বাণিজ্যিক শ্রেণির পরিষ্কার চিত্র পাওয়া যায়। তিনি লিখেছেন:৪

বসতী কাসমবাজার, সৈদাবাদ খাগড়া সার।

রহতে লোক গুজরাতীক, টোপীবাল জেতী জাতীক।

আরব আরমনী আংগরেজ, হবসী হুরমজী উলাংদেজ।

সীদী ফরাসীস আলেমান সৌদাগর মুর্গল পাঠান।।

শেঠী কুংপনী কী জোর দমকে লাগে লাখ কিরোর।

অর্থাৎ কবি নিহাল কাশিমবাজার, সৈয়দাবাদ ও খাগড়ায় বিভিন্ন বণিকগোষ্ঠীর উপস্থিতির দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন কারণ এটা মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজার অঞ্চলের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল। আর এই বণিকগোষ্ঠীর মধ্যে হরেক দেশ ও জাতির লোক—গুজরাটি, আরব, আর্মানি, ইংরেজ, হাবসি, হুরমজি অর্থাৎ পার্সি, ওলন্দাজ (ডাচ), সিদ্দি, ফরাসি ও পাঠান-মোগল।

শুধু তাই নয়, সমসাময়িক ইউরোপীয় পর্যবেক্ষক ও ফরাসি নথিপত্রেও মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজারে বিভিন্ন প্রান্তের বহু সওদাগরগোষ্ঠীর কার্যকলাপের কথা সবিস্তারে বলা হয়েছে। ফরাসি সূত্র থেকে জানা যায় যে এ অঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্যে গুজরাটি, আর্মানি, মিরজাপুরি, গোরখপুরি প্রমুখ বণিকগোষ্ঠী খুবই সক্রিয় ছিল।৫ মুর্শিদাবাদের ‘পাচোত্রা’ দারোগার দপ্তরে শুল্ক জমার হিসেব থেকে দেখা যায়, লাহোর এবং মুলতান থেকে আসা ব্যবসায়ীরা পণ্য রফতানি বাবদ শুল্ক জমা দিত।৬ ইংরেজ কোম্পানির উচ্চপদস্থ কর্মচারী উইলিয়াম বোল্টস লিখেছেন:৭

A variety of merchants of different nations and religions, such as Cashmeerians, Multanys, Patans, Sheikhs, Sunniasys, Paggayahs, Betteas and many others used to resort to Bengal.

এই সব সওদাগরদের মধ্যে অনেকেই মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজারে তাদের বসতি স্থাপন করেছিল এবং স্থায়ীভাবেই এখানে বসবাস করত। বিশেষ করে যে সব সওদাগর পরিবার রাজস্থান, গুজরাট বা উত্তর ভারত থেকে আসত। তারা মুর্শিদাবাদের স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে গিয়েছিল। এর প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত অনেক মারওয়ারি পরিবার। জগৎশেঠরা এসেছিল মারওয়ারের নাগর থেকে অষ্টাদশ শতকের একেবারে গোড়ার দিকে। মুর্শিদকুলির সঙ্গে এই পরিবারের মানিকচাঁদ মুর্শিদাবাদে আসেন এবং তারপর থেকে এঁরা মুর্শিদাবাদের স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে যান। তেমনি দুধোরিয়া পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা হুজুরীমল কাপড়ের ব্যবসা করতে রাজস্থানের বিকানির থেকে এসে মুর্শিদাবাদে স্থায়ী আস্তানা করেন।৮ এরকম আরও অনেক দৃষ্টান্ত আছে।

এ সব বড় বড় সওদাগর ছাড়াও মুর্শিদাবাদে অনেক ছোট ছোট ব্যবসায়ীর অস্তিত্ব ছিল, যারা নানা রকমের ব্যবসা-বাণিজ্যে লিপ্ত থাকত। এরকম একটা গোষ্ঠী ‘সন্ন্যাসীরা’। এরা একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের লোক। সদানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষ্য অনুযায়ী (খুব সম্ভবত পলাশির সময়কার অবস্থা বর্ণনা প্রসঙ্গে) কয়েকশো সন্ন্যাসী মুর্শিদাবাদ থেকে মিরজাপুরে কাঁচা রেশম রফতানি করত এবং বছরে ওই রফতানির পরিমাণ ছিল এক হাজার মণ।৯ এর পাশাপাশি মুর্শিদাবাদে অন্য একটি ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর দেখা মেলে— তারা হচ্ছে খাদ্যশস্যের ব্যবসায়ী। মুর্শিদাবাদ একটি শহর, তাই তার বাসিন্দাদের জন্য প্রচুর খাদ্যশস্যের প্রয়োজন হত। ১৭৮৩-৮৪ সালের একটি আনুমানিক হিসেব অনুযায়ী মুর্শিদাবাদে রোজ ৫,০০০ হাজার মণ খাদ্যশস্যের প্রয়োজন ছিল।১০ তা যদি হয়, মধ্য অষ্টাদশ শতকে শস্যের চাহিদা আরও বেশি হওয়াটা স্বাভাবিক কারণ ১৭৭০ সালের দুর্ভিক্ষের পর এবং কোম্পানির দেওয়ানি লাভ ও কলকাতায় প্রায় সব অফিস-কাছারি নিয়ে যাওয়ায় মুর্শিদাবাদের লোকসংখ্যা ১৭৮৩-৮৪ সালে বেশ কমে যায়। যা হোক, আমাদের আলোচ্য সময়ে দৈনিক ৫,০০০ মণ খাদ্যশস্যের প্রয়োজন হত ধরে নিলেও এই বিশাল পরিমাণ খাদ্যশস্য সরবরাহ করত বিশেষ একটি গোষ্ঠী—যারা খাদ্যশস্যের ব্যবসায়ে লিপ্ত ছিল। সে হিসেবে মুর্শিদাবাদে এদের একটি বিশিষ্ট ভূমিকা ছিল।

এই খাদ্যশস্য ব্যবসায়ীদের সম্বন্ধে নীচে উদ্ধৃত একটি বর্ণনা পাওয়া যায়:১০

All the grain business is carried on by four tribes, the Cuyar, Buccali, Ujinea and Moorcha. They are managed by a few of the most rich and opulent of each tribe and no instance will ever occur of their underselling each other or ever deviating from the plans of combination

ব্যবসায়ী গোষ্ঠীগুলির নাম দেখে অনুমান করা যায় যে এরা মূলত রাজস্থানের বাসিন্দা ছিল। ‘মুরচা’ ও ‘কুয়ার’রা সম্ভবত উত্তর-পশ্চিম রাজস্থানের শৈখাবতীর লোক, ‘উজিনিয়ারা’ উজ্জয়নের ব্রাহ্মণ। ওপরের উদ্ধৃতি থেকে খাদ্যশস্য ব্যবসায়ী গোষ্ঠীগুলির কিছু কিছু বৈশিষ্ট্যের পরিচয় পাওয়া যায়। এগুলি হল, এদের গোষ্ঠীগত সংহতি এবং গোষ্ঠীগুলির ওপর দলপতি বা সর্দারের কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণক্ষমতা। এরা খাদ্যশস্য মজুত করত ভগবানগোলাতে—সেখানে তাদের অনেকগুলি গোলা ছিল। বলা বাহুল্য, সুযোগ বুঝে, বিশেষ করে মুর্শিদাবাদে খাদ্যশস্যের অভাব দেখা দিলে, ব্যবসায়ীরা শস্যের দাম বাড়িয়ে দিত এবং প্রচুর মুনাফা করে নিত।১১

মুর্শিদাবাদের ব্যবসায়ীরা একটি মিশ্র বা ‘হেটেরোজেনাস’ গোষ্ঠী—এদের মধ্যে একদিকে বড় বড় সওদাগর, ব্যাঙ্কার, অন্যদিকে ছোটখাট ব্যবসায়ী, যাদের মধ্যে খাদ্যশস্যের ব্যবসায়ী, সন্ন্যাসী ও ছোট ছোট ব্যাপারী (peddlers) সবাই ছিল। ব্যাঙ্কার মহাজনদের মধ্যে বাঙালি, অবাঙালি সবাই অন্তর্ভুক্ত। অবাঙালিদের মধ্যে বিশেষ করে গোষ্ঠী, জ্ঞাতি এবং জাতপাতের প্রশ্ন বড় করে দেখা যেত। এদের মধ্যে অনেকেই ছিল ওসওয়াল (Oswal) সম্প্রদায়ের জৈন। এদের কাজ কারবার দেখার জন্য এরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নিজেদের সম্প্রদায় ও গোষ্ঠীর লোকদেরই নিযুক্ত করত। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ জগৎশেঠরা। শেঠদের গোমস্তারা সবাই তাঁদের নিজেদের আত্মীয়, জ্ঞাতি বা সম্প্রদায়ের লোক।১২ এটা অবশ্য আর্মানিদের ক্ষেত্রে আরও বিশেষ করে প্রযোজ্য। তারা নিজেদের আত্মীয়স্বজন, জ্ঞাতিগোষ্ঠীর লোক ছাড়া কাউকেই প্রায় গোমস্তা বা এজেন্ট নিযুক্ত করত না। বাংলায় আর্মানিদের কাজকর্মের বিশ্লেষণ করলে এটা স্পষ্টভাবে বোঝা যায়।১৩ সামাজিক দিক থেকে এ সব ব্যবসায়ীরা নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার চেষ্টা করত। এদের বিয়ে, সাদি, সামাজিক মেলামেশাও নিজেদের গোষ্ঠী এবং সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকত, ধর্মীয় ব্যাপারে তো বটেই। সবাই প্রায় নিজেদের মহল্লাতেই বসবাস করত।

অভিজাত শ্রেণি, ব্যবসায়ী-সওদাগর ছাড়া মুর্শিদাবাদের অন্য যারা বাসিন্দা, তাদের মধ্যে অন্যতম, যারা বৃত্তিমূলক (professional) কাজে নিযুক্ত ছিল। আবার এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশ হচ্ছে শাসন, রাজস্ব ও আইন বিভাগে মাঝারি ও নীচের দিকের কর্মচারী। মুর্শিদাবাদ নিজামতে, দেওয়ানিতে, সদর দেওয়ানি আদালতে, ফৌজদারি আদালতে এবং অন্যান্য সরকারি দপ্তরে মাঝারি ও নিম্নস্তরে বহু কর্মচারী নানা পদে অধিষ্ঠিত ছিল। সাধারণভাবে বেশির ভাগ দপ্তরেরই প্রধান পদে মুসলমান কর্মচারী, বাকি সব পদে বেশিরভাগই হিন্দু কর্মচারী থাকত। কবি ভারতচন্দ্র নবাব ও রাজাদের দরবারের নিচুতলার কর্মচারী ও বিভিন্ন বৃত্তিধারী লোকজনের তালিকা দিয়েছেন। তাতে বৈদ্য, হস্তগণনাকারী, লেখক, খাজাঞ্চি, উকিল, ‘বাজে জমি’ দপ্তরের প্রধান, সময়রক্ষক, নাকিব, এমন সব বৃত্তিমূলক ব্যক্তির নাম আছে। এদের স্ত্রীরা এদের সম্বন্ধে যে বর্ণনা দিয়েছে, তা থেকে স্পষ্ট যে এদের বেশির ভাগই হিন্দু।১— এই তালিকা থেকে অনুমান করা যায় যে পেশাদারি লোকদের আয় ও তাদের সামাজিক মর্যাদায় বেশ তারতম্য ছিল।

বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের কর্মচারী ছাড়াও বিভিন্ন পেশায় লিপ্ত বহু লোকের আবাস ছিল মুর্শিদাবাদে। এদের মধ্যে বৈদ্য ও কবিরাজরা সমাজে বেশ মর্যাদা ভোগ করত। উচ্চপদস্থ মুসলমান কর্মচারীদের কাছে এদের খুব কদর ছিল এবং মুসলমান হেকিমের চেয়ে এদের চিকিৎসার ওপর তাদের ভরসা ছিল অনেক বেশি।১৫ এ ছাড়া মুর্শিদাবাদের সমাজে হিন্দু পুরোহিত, মুসলমান মোল্লা, মৌলভি ও অন্যান্য ধর্মগুরুরা বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সিয়রের লেখক গোলাম হোসেন খান লিখেছেন যে মুর্শিদাবাদের নবাবরা এদের মুর্শিদাবাদে এসে বসবাস করার জন্য আহ্বান জানাতেন এবং তাদের নানারকম উপহার ও সুযোগ সুবিধা দিতেন।১৬ ভারতচন্দ্র তার সময়কার বাদশাহি/রাজকীয় নগরীর অধিবাসীদের পেশাগত যে বর্ণনা দিয়েছেন, মুর্শিদাবাদ সম্বন্ধে তা প্রযোজ্য। তিনি লিখেছেন:১৭

কায়স্থ বিবিধ জাতি দেখে রোজগারি।

বেনে মণি গন্ধসোনা কাঁসারি শাঁখারি।।

গোয়ালা তামুলী তিলি তাঁতী মালাকার।

নাপিত বারুই কুরী কামার কুমার।।

আগরি প্রভৃতি আর নাগরী যতেক।

যুগি চাষা ধোবা চাষা কৈবৰ্ত্ত অনেক।।

সেকরা ছুতার নুড়ী ধোবা জেলে গুঁড়ী।

চাঁড়াল বাগদী হাড়ী ডোম মুচী শুঁড়ী।।

কুরমী কোরঙ্গা পোদ কপালি তিয়র।

কোল কলু ব্যাধ বেদে মালী বাজিকর।।

এ ছাড়া অবশ্য দিনমজুর ও অন্য খেটেখাওয়া মানুষও ছিল মুর্শিদাবাদে। মনে হয় কাজকর্মের সন্ধানে এরা আশপাশের গ্রামাঞ্চল থেকেই আসত। নবাবের সৈন্যবাহিনীতে প্রচুর সাধারণ সৈন্যও ছিল। নবাবি আমলে অনেক স্থানীয় ব্যক্তিকেও সৈন্যবাহিনীতে নেওয়া হত। রিয়াজের লেখক জানিয়েছেন যে আলিবর্দির যে সব সৈন্যের মুর্শিদাবাদে বাড়ি তারা ঘরে ফেরার জন্য উদ্‌গ্রীব হয়ে থাকত। সুতরাং আমরা বলতে পারি মুর্শিদাবাদের সমাজে অভিজাত থেকে শুরু করে সাধারণ স্তরের মানুষও পাশাপাশি বাস করত এবং সমাজ ছিল বহু জাতি, বর্ণ, গোষ্ঠী ও ধর্মাবলম্বীর এক সংমিশ্রণ।

অর্থনীতি
নবাবি আমলে মুর্শিদাবাদের অর্থনৈতিক অবস্থা বেশ উন্নত ছিল, এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়। সপ্তদশ শতকে, বিশেষ করে এই শতকের দ্বিতীয়ার্ধে, বাংলা থেকে দিল্লি, আগ্রা ও উত্তর ভারতের অন্যত্র যে ধন নিষ্ক্রমণ হত, তা নবাবি আমলে সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। মুর্শিদকুলি আসার আগে পর্যন্ত বাংলার সুবাদার ও উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী, সবাই মুঘল বাদশাহি পরিবারের লোক বা মুঘল দরবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত বলেই ওই পদে নিযুক্ত হতেন। সুবাদার শাহ সুজা (১৬৩৯-৬০) ছিলেন মুঘল সম্রাট শাহজাহানের পুত্র। আরেক সুবাদার, শায়েস্তা খান (দুবার, ১৬৬৪-৭৮ এবং ১৬৭৯-৮৮) ছিলেন সম্রাট ঔরংজেবের পিতৃব্য এবং অন্য এক সুবাদার আজিম-উস-শান (১৬৯৭-১৭১২) ছিলেন ঔরংজেবের পৌত্র। অন্য সুবাদাররাও অনেকেই মুঘল দরবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছিলেন। এঁরা, বিশেষ করে মুঘল পরিবারের সদস্যরা, বাংলা ছাড়তে চাইতেন না কারণ এখানে ধনসম্পদ আহরণের অফুরন্ত সুযোগ। তাই মুঘলনীতির ব্যতিক্রম করে তাঁরা তিন বছরের অনেক বেশি সময় বাংলায় সুবাদার হিসেবে থেকে গেছেন। এঁরা বাংলা থেকে যে ধনসম্পদ আহরণ করতেন তার সবটাই প্রায় বাংলার বাইরে দিল্লি, আগ্রা ও উত্তর ভারতে নিয়ে যেতেন। ফলে বাংলা থেকে এই ধন নিষ্ক্রমণের ধারা সপ্তদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বেশ প্রকট হয়ে উঠেছিল। এই সব সুবাদার, মনসবদাররা কী পরিমাণ ধন আহরণ করে বাংলার বাইরে নিয়ে যেতেন তার একটা ধারণা করা যেতে পারে কয়েকজনের দৃষ্টান্ত থেকে। শায়েস্তা খান ১০ বছরে ৯ কোটি টাকা, খান জাহান বাহাদুর খান এক বছরে ২ কোটি এবং আজিম-উস-শান ৯ বছরে ৮ কোটি টাকা নিয়ে গেছেন।১৮

নবাবি আমলে বাংলা, অবশ্যই মুর্শিদাবাদ থেকে, এই বিপুল ধন নিষ্ক্রমণ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। এখন আর সুবাদাররা দিল্লি থেকে নিযুক্ত মনসবদার নন, মুর্শিদকুলি বাংলায় প্রায় স্বাধীন নিজামত প্রতিষ্ঠা করেছেন। দিল্লি থেকে বাংলায় মুঘল মনসবদার বা অন্য উচ্চপদস্থ কর্মচারী পাঠানও এখন বন্ধ হয়ে গেল। স্থানীয় বাসিন্দারাই এখন নিজামতের সব পদে নিযুক্ত হল। ফলে বাংলা থেকে ধন নিষ্ক্রমণের প্রশ্নই রইল না। নবাবরা বা উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারীরা বাংলায় ধন আহরণ করা বন্ধ করে দিলেন ঠিক তা নয়। যা ধনসম্পদই তাঁরা আহরণ করে থাকুন না কেন, তা বাংলাতেই থেকে গেল, তাতে বাংলার ধনসম্পদই বৃদ্ধি পেল। ১৭৪০-এর দশকের প্রথম দিক পর্যন্ত নবাবরা বাংলা থেকে প্রতি বছর ১ কোটি ৩০ লক্ষ টাকার মতো রাজস্ব দিল্লিতে পাঠাতেন। তা ছাড়া বাংলার প্রায় সব নবাবই প্রচুর অর্থ ব্যয় করে মুর্শিদাবাদে নানা প্রাসাদ, মসজিদ, সমাধিভবন প্রভৃতি নির্মাণ করেন। এ সবকিছু করেও নবাবরা যে পরিমাণ ধনসম্পদ সঞ্চয় করেছিলেন, তা দেখে অবাক হতে হয়।

পলাশিতে নবাব সিরাজদ্দৌলাকে পরাভূত করে ইংরেজরা মুর্শিদাবাদের কোষাগারে গিয়ে নবাবের সঞ্চিত ধনসম্পদ দেখে হতবাক হয়ে গিয়েছিল। শুধুমাত্র সোনা-রুপো নিয়ে ওখানে সঞ্চিত অর্থের পরিমাণ ছিল ২ কোটি টাকা। ক্লাইভ লিখেছেন যে নবাবের কোষাগারে ঢুকে অবাক বিস্ময়ে তিনি দেখলেন, সোনা ও হিরে-জহরত দুধারে স্তূপীকৃত হয়ে আছে।১৯ আমরা আগেই বলেছি, তারিখ-ই-মনসুরীর লেখক জানিয়েছেন যে নবাবের হারেমে লুকোনো যে ধনসম্পদ ছিল, সোনা, রূপো, হিরে, জহরত মিলে তার মূল্য কম করে ৮ কোটি টাকা।২০ আর মুজাফ্‌ফরনামার লেখক করম আলির ভাষ্য অনুসারে, সিরাজদ্দৌলা ঘসেটি বেগমকে মোতিঝিল প্রাসাদ থেকে বিতাড়িত করে সেখান থেকে হীরে জহরত বাদ দিয়েই নগদ ৪ কোটি টাকা ও ৪০ লক্ষ মোহর বাজেয়াপ্ত করেছিলেন। শুধু তাই নয়, ১ কোটি টাকা মূল্যের সোনা, রুপোর নানা বাসনপত্রও সিরাজ মোতিঝিল থেকে উদ্ধার করেছিলেন।২১ এসব তথ্যে হয়তো কিছুটা অত্যুক্তি আছে কিন্তু তা হলেও এ থেকে কিছুটা অনুমান করা যেতে পারে।

নবাব, মনসবদার বা অন্যান্য অভিজাতবর্গ শুধু নয়, নবাবি আমলে ব্যাঙ্কার-মহাজন-সওদাগর প্রভৃতি শ্রেণি প্রচুর ধনসম্পদ আহরণ ও সঞ্চয় করেছিল। এর প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত জগৎশেঠ পরিবার। সামান্য মহাজন থেকে তাঁরা ভারতবর্ষ তথা এশিয়ার সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যাঙ্কার হয়ে ওঠেন। তাঁদের বার্ষিক আয়ের পরিমাণ বছরে প্রায় ৫০ লক্ষ টাকা, আর ব্যবসার মূলধনই ছিল কম করে ৭ কোটি টাকা, কারও কারও মতে ১৪ কোটি টাকা।২২ জগৎশেঠরা ছাড়াও মুর্শিদাবাদে তখন আরও দু’জন বণিকরাজা ছিলেন, উমিচাঁদ ও খোজা ওয়াজিদ। এঁদের সম্পদের বা সঞ্চিত অর্থের কোনও তথ্য পাওয়া যায় না, তবে তা যে বেশ ভাল পরিমাণের হবে সেটা অনুমান করা যায়। কারণ উমিচাঁদ সোরা, আফিং-এর প্রায় একচেটিয়া ব্যবসা করতেন। তা ছাড়াও ছিল তাঁর টাকা লেনদেনের ব্যবসা। খোজা ওয়াজিদ বিহারের অর্থনীতি প্রায় কব্জা করে নিয়েছিলেন, সোরা এবং আফিং-এর ব্যবসাও ছিল তাঁর কুক্ষিগত। এ ছাড়া তিনি সমুদ্রবাণিজ্যেও লিপ্ত ছিলেন, তাঁর কমপক্ষে ৬টি বাণিজ্যতরী ছিল। এ সব তথ্য থেকে অনুমান করা যায় যে মুর্শিদাবাদের বণিকরাজারা প্রচুর ধনসম্পদের অধিকারী ছিলেন।

বণিকরাজারা ছাড়াও মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজার অঞ্চলে বহু ব্যাঙ্কার-মহাজন, সওদাগর এসে ভিড় জমিয়েছিল। নবাবি আমলে এখানকার কাঁচা রেশম ও রেশমিবস্ত্রের ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল তুঙ্গে। এ সব পণ্যের চাহিদা শুধু ভারতবর্ষ ও এশিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে নয়, ইউরোপেও ছিল প্রচুর। ফলে শিল্পবাণিজ্যের তখন রমরমা। জৈন কবি নিহাল সিংহ লিখেছেন, বালুচরে কাঁসার হাট বসে, সেখানে অনেক রকম ভাল ভাল বাসন বিক্রি হয়। বহু ঘর তাঁতিরও বাস সেখানে, তারা নানারকমের কাপড় বোনে। কাশিমবাজার, সৈয়দাবাদ ও খাগড়ায় অনেক লোকের বাস, বিভিন্ন দেশের, জাতির ও ধর্মের। রেশমের ও রেশমি বস্ত্রের কারবার জমজমাট। দিল্লির সঙ্গেই যেন মুর্শিদাবাদ টেক্কা দেয়—‘জৈসা দিল্লিকা বাজার, তৈসা চৌক গুলজার’।২৩ বাজারে টাকার অঢেল আমদানি, ধারের কোনও অসুবিধেই নেই। বাজারে যে টাকার অভাব নেই, টাকার আমদানি যে বৃদ্ধি পেয়েছিল, তা ১৭৪০ সালের একটি ঘটনা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়। ইউরোপীয় কোম্পানিগুলি তাদের রফতানি পণ্য কেনার জন্য বাংলার টাকার বাজার থেকে প্রায়ই টাকা ধার করতে বাধ্য হত এবং তারা ধার করত প্রধানত জগৎশেঠদের কাছ থেকে। সুদের হার ছিল শতকরা ১২ টাকা। এ হার কমাবার জন্য কোম্পানিগুলি অনেক চেষ্টা করেছিল কিন্তু বিফল হয়। ১৭৪০ সালে ইংরেজরা মুর্শিদাবাদে জগৎশেঠদের কুঠিতে গিয়ে সুদের হার কমাবার জন্য আবার অনুনয় বিনয় করে। জগৎশেঠ সেটা মঞ্জুর করেন এবং পরের দিন থেকে সুদের হার শতকরা ১২ টাকা থেকে নেমে শতকরা ৯ টাকা হয়ে যায়। এটা টাকার বাজারে জগৎশেঠদের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণের প্রমাণ সন্দেহ নেই। তবে সঙ্গে সঙ্গে এটাও মনে হয় তখন বোধ হয় বাজারে টাকার আমদানি ছিল প্রচুর, ধার সহজলভ্য। তাই হয়তো জগৎশেঠরা এক কথায় সুদের হার কমিয়ে দেন।২৪

এ প্রসঙ্গে নবাব আলিবর্দির সময়, ১৭৪২ থেকে ১৭৫১ পর্যন্ত, প্রায় প্রতি বছর যে মারাঠা আক্রমণ হয়েছে, মুর্শিদাবাদ তথা বাংলার অর্থনীতিতে তার কতটা প্রভাব পড়েছিল তা আলোচনা করা প্রয়োজন। আমরা আগেই বলেছি, মারাঠা আক্রমণের ফলে বাংলার অর্থনীতি কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল তাতে কোনও সন্দেহ নেই। তবে এই আক্রমণের ফলে বাংলার অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল এমন বক্তব্য সঠিক বলে মনে হয় না। অর্থনীতি যেটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল তা সাময়িক এবং কয়েকটি জায়গায় সীমাবদ্ধ। এর কোনও দীর্ঘকালীন প্রভাব মুর্শিদাবাদ তথা বাংলার অর্থনীতিতে পড়েনি। মারাঠারা বছরের একটা নির্দিষ্ট সময়, মোটামুটি একটা নির্দিষ্ট পথেই বাংলায় লুঠতরাজ করতে আসত। ওই সব অঞ্চলের কৃষক-তাঁতি-কারিগর প্রমুখ বর্ষার আগে, মারাঠারা চলে গেলে, নিজেদের কাজকর্ম শুরু করে দিত আবার শীতকালে, মারাঠারা আসার আগে, তাদের ফসল/উৎপাদন সব গুছিয়ে নিয়ে অন্যত্র চলে যেত। মুর্শিদাবাদের ক্ষেত্রে দেখা যায় মারাঠা আক্রমণের ভয়ে জগৎশেঠ ও অন্যান্য ব্যাঙ্কার-মহাজন-সওদাগররা কিছুদিন মুর্শিদাবাদ ছেড়ে নিরাপদ জায়গায় চলে যেতেন এবং মারাঠাদের মুর্শিদাবাদ আক্রমণের সম্ভাবনা চলে গেলে আবার তাঁরা মুর্শিদাবাদে ফিরে আসতেন। মাঝে মাঝে তাঁদের অনুপস্থিতিতে বাজারে টাকার অভাব দেখা দিত কিন্তু সেটা একেবারেই সাময়িক। জগৎশেঠ এবং অন্যান্যরা মুর্শিদাবাদে ফিরে এলে ব্যবসা-বাণিজ্যে আবার রমরমা দেখা দিত, বাজারে টাকারও কোনও অভাব থাকত না। মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজার অঞ্চলে মারাঠা আক্রমণের ফলে যে কোনও অর্থনৈতিক বিপর্যয় হয়নি তার প্রমাণ, এ সময়েও ওই অঞ্চল থেকে বিপুল পরিমাণ কাঁচা রেশম ও রেশমি কাপড় রপ্তানি হয়েছিল। যে অর্থনীতিতে ওই পরিমাণ পণ্য উৎপাদিত হতে পারে, তা মারাঠা আক্রমণে বিপর্যস্ত হয়েছিল এ কথা বলা যায় না।২৫

নবাবি আমলে মুর্শিদাবাদের সাধারণ লোকের অবস্থা মোটামুটি ভালই ছিল মনে হয়। প্রথমে দেওয়ানি কার্যালয় ও পরে রাজধানী স্থানান্তরিত হওয়ায়, এবং মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজারে কাঁচা রেশম ও রেশমি কাপড়ের ব্যবসার জন্য ওই অঞ্চলে কাজকর্ম এবং আয়ের পথও বেশ সুগম হয়। তা ছাড়াও নবাবদের নানা স্থাপত্যকর্মের ফলে বহু লোকের কর্মসংস্থান হয়। আসলে মুর্শিদকুলি অভিজাতবর্গ, দেশি সওদাগর, বিদেশি বণিক, হিন্দু কর্মচারী ও জবরদস্ত জমিদারদের সামলে ও তাদের নিয়ে বাংলায় নিজামতের যে কাঠামোটি তৈরি করেন এবং পরে অন্য নবাবরা যেটা বজায় রেখেছিলেন তাতে সলিমুল্লা, গোলাম হোসেন প্রমুখ ঐতিহাসিকরা সুবে বাংলাকে ‘দার-উল-আমন’ বলতে দ্বিধা করেননি। আর এই ‘দার-উল-আমনে’র রাজধানী হিল মুর্শিদাবাদ। হয়তো সাধারণ লোকের কথা ভেবেই মুর্শিদকুলি বাংলা থেকে চাল রফতানি বন্ধ করে দেন এবং সে কারণেই সম্ভবত চালের দাম অনেক কমে যায় ও তাতে সাধারণ মানুষের খুব সুবিধা হয়। রিয়াজের লেখক গোলাম হোসেন বলেছেন এ সময় মুর্শিদাবাদে চালের দাম ছিল টাকায় ৫ থেকে ৬ মণ, যদিও সলিমুল্লা লিখেছেন, টাকায় ৪ মণ। সে অনুপাতে অন্যান্য জিনিসপত্রের দামও ছিল সস্তা। ফলে, গোলাম হোসেন সলিম জানাচ্ছেন, তখন মাসে এক টাকা খরচ করলেই লোকে পোলাও, কালিয়া খেতে পারত। এটা হয়তো অত্যুক্তি, যদিও এ থেকে অনুমান করা যায় যে সাধারণ লোকের অবস্থা বেশ স্বচ্ছলই ছিল।২৬

নবাব সুজাউদ্দিনের সময়েও মুর্শিদাবাদ তথা বাংলার আর্থিক অবস্থা বেশ উন্নতই ছিল। সিয়রের লেখক ঐতিহাসিক গোলাম হোসেন খান সুজাউদ্দিনের শাসনকাল সম্বন্ধে লিখেছেন যে বাংলা তখন ‘came to enjoy so much prosperity as to exhibit everywhere an air of plenty and happiness’.২৭ ১৭৮৯ সালে ইংরেজ কোম্পানির রাজস্ববিভাগের কর্মচারী, জন শোর (John Shore), মন্তব্য করেছেন যে আলিবর্দির শাসনকালের শেষ কয়েকবছর বাদ দিয়ে মুর্শিদকুলি থেকে মীরকাশিমের রাজত্বকালের মধ্যে, একমাত্র সুজাউদ্দিনের সময়েই দেশের উন্নতিসাধন করাটা মুর্শিদাবাদের নিজামতের প্রধান লক্ষ্য ছিল।২৮ কবি নিহাল সিংহ এই সময় মুর্শিদাবাদে আসেন এবং সুজাউদ্দিনের রাজত্বকালে পৌরাণিক রাম রাজ্যের লক্ষণ দেখতে পান: ‘নাহি জোর অর জুলম্যাঁন, নাঁহি বাটমৈ বটপার, নাঁহি চোর চেটকবার।’ তাই সকল প্ৰজাই সুখী। দুঃখীর দেখা পাওয়াও ভার হয়ে ওঠে। ‘ইহবিধ রহৈ রেয়ত সুখী, দেখা কোউ নাঁহি দুঃখী’।২৯

নবাব আলিবর্দি খানের আমলে মুর্শিদাবাদ তথা বাংলার অর্থনৈতিক অগ্রগতি কিছুটা ব্যাহত হয়েছিল সন্দেহ নেই তবে সেটা সাময়িক। ১৭৫১ সালে মারাঠাদের কাছ থেকে শান্তি কেনার পর আলিবর্দি সর্বশক্তি ও মনপ্রাণ দিয়ে রাজ্যের উন্নতিসাধনে উঠে পড়ে লাগেন। তিনি যে এ কাজে যথেষ্ট সফল হয়েছিলেন তার প্রমাণ তাঁর রাজত্বের শেষ দিকে মুর্শিদাবাদ শহরের বিস্তৃতি ও শ্রীবৃদ্ধিতে দেখা যায়। মুজাফ্‌ফরনামার লেখক করম আলি লিখেছেন যে আলিবর্দির শাসনকালের শেষদিকে মুর্শিদাবাদ শহর প্রচুর বিস্তার লাভ করে— দৈর্ঘ্যে ২৪ মাইল, প্রস্থে ১৪ মাইল তখন শহরের আয়তন। তা ছাড়াও অনেক ধনী ও সম্ভ্রান্ত ব্যবসায়ী, ব্যাঙ্কার শহরের প্রান্তে তাদের বাগানবাড়ি তৈরি করে।৩০ নগরায়ণের এই যে চিত্র, তা থেকে আর্থিক শ্রীবৃদ্ধি ও অগ্রগতির প্রমাণ পাওয়া যায়। পলাশির পর রবার্ট ক্লাইভ প্রথম মুর্শিদাবাদ দেখে বিস্ময়ে হতবাক। তিনি মন্তব্য করেছেন যে মুর্শিদাবাদ লন্ডনের মতোই বিরাট, প্রচুর লোকবসতি এবং লন্ডনের মতোই ধনী শহর। তফাত শুধু এই যে লন্ডনের চেয়ে মুর্শিদাবাদে অনেক বেশি ধনী লোক যাদের ধনসম্পদ লন্ডনের যে কোনও ধনী বাসিন্দার চাইতে অনেক অনেক বেশি।৩১

সংস্কৃতি ও হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক
নবাবি আমলে মুর্শিদাবাদকে বহু জাতি, বিভিন্ন র্ধম ও বর্ণের মানুষের মিলনক্ষেত্র বললে বোধ হয় অত্যুক্তি হবে না। মুর্শিদাবাদে প্রথম দেওয়ানি ও পরে রাজধানী স্থানান্তরিত হওয়ার ফলে দেশবিদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিভিন্ন জাতি ও ধর্মের মানুষ মুর্শিদাবাদে এসে ঠাঁই নেয়। আবার মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজার কাঁচা রেশম ও রেশমিবস্ত্রের প্রধান উৎপাদন ও বাণিজ্যকেন্দ্র হওয়ায় বিভিন্ন জাতি ও সম্প্রদায়ের সওদাগর-ব্যাঙ্কার-মহাজন এসে ভিড় জমায় এখানে। এদের মধ্যে একদিকে যেমন ছিল হিন্দু-জৈন ব্যাঙ্কার-মহাজন-সওদাগর, অন্যদিকে তেমনই দেখা যায় তার সঙ্গে ছিল শিয়া মুসলমান সম্প্রদায়। এরকম একটি জায়গায় বহু জাতি, বহুবর্ণ ও বহু ধর্মাবলম্বীর সমাবেশ ইতিহাসে খুবই বিরল। এর জন্য অবশ্য মূলত মুর্শিদাবাদের নবাবদের উদারনীতিই অনেকটা দায়ী। সব ধর্ম ও জাতি সম্পর্কে সহনশীলতা ও উদারতা মুর্শিদাবাদের নবাবদের একটা প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল। ফলে মুর্শিদাবাদে নবাবদের আমলে যে কৃষ্টি ও সংস্কৃতি দেখা যায়, তা যে কোনও শহরের পক্ষেই গর্বের বিষয়।

আসলে মুর্শিদকুলির সময় থেকে মুর্শিদাবাদের নবাবরা উদারতা ও সহনশীলতার নীতি অনুসরণ করেন। হয়তো তাঁদের ধারণা ছিল এতেই রাষ্ট্রের মঙ্গল ও উন্নতি হবে। তাই নিজেরা শিয়া মুসলমান হয়েও সুন্নি মুসলমান, হিন্দু বা অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের প্রতি তাঁরা কোনও বৈষম্যমূলক আচরণ করেননি। মুর্শিদকুলির সময় থেকেই হুগলি ও মুর্শিদাবাদ শিয়াদের বড় উপনিবেশ হয়ে ওঠে। বাংলায় জগৎশেঠ পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা মানিকচাঁদ জৈন সম্প্রদায়ভুক্ত হয়েও মুর্শিদকুলির ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও পরামর্শদাতা হয়ে ওঠেন। মূলত তাঁরই আকর্ষণে মানিকচাঁদ তাঁর সঙ্গে ঢাকা ছেড়ে মুর্শিদাবাদ চলে আসেন। পলাশির আগে পর্যন্ত এই জগৎশেঠ পরিবারই মুর্শিদাবাদ নিজামতের সবচেয়ে বড় সমর্থক ও হিতাকাঙক্ষী বলে পরিচিত ছিল। আবার মুসলমান হয়েও মুর্শিদকুলি শাসনবিভাগের প্রায় সর্বত্র, বিশেষ করে রাজস্ববিভাগে, হিন্দুদেরই নিয়োগ করেছিলেন। এর পেছনে হয়তো তাঁর মূল উদ্দেশ্য ছিল রাষ্ট্রের স্বার্থ—রাজস্ব আদায়ে যাতে কোনও রকমের গাফিলতি না হয়। কিন্তু তা হলেও এর ফলে নবাবি আমলে একটি ধারার (tradition) সৃষ্টি হয়— হিন্দুরা শুধু সাধারণ কর্মচারী নয়, অনেক উচ্চপদেও নিযুক্ত হয়। বলতে গেলে নবাবি আমলে রাষ্ট্রের শাসনযন্ত্রে হিন্দুদেরই ছিল প্রায় একচ্ছত্র প্রাধান্য।

তা বলে মুর্শিদাবাদে শুধু শিয়া, সুন্নি বা হিন্দুদের বাস ছিল তা নয়। ছিল আরও অনেক জাতি ও ধর্মের মানুষের। আমরা আগেই বলেছি, মুর্শিদাবাদ-কাশিমবাজার অঞ্চলে আরব, আর্মানি, ইংরেজ, হাবসি, পার্সি, ওলন্দাজ, সিদ্দি, ফরাসি, পাঠান, মোগল, গুজরাটি, পাঞ্জাবি, লাহোরি, মুলতানি— সবাই এসে জড়ো হত নানা কাজে, ব্যবসায় কেনাবেচা করতে, বিশেষ করে রেশম ও রেশমিবস্ত্র সংগ্রহ করতে। ফলে এত বিভিন্ন জাতি ও ধর্মের লোক পাশাপাশি থাকার ফলে পরস্পরের মেলামেশা ও আদানপ্রদানের মাধ্যমে একটি ‘কসমোপলিটান’ (cosmopolitan) সংস্কৃতির উদ্ভব হয় মুর্শিদাবাদে। একদিকে হিন্দু ও জৈন মন্দির, মুসলমান মসজিদ অন্যদিকে আর্মানি ও খ্রিস্টানদের গির্জা—সবকিছুর সহাবস্থান। কবি নিহাল সিংহ লিখেছেন, মুর্শিদাবাদে ভাল ভাল দেবমন্দির ও ধর্মশালা আছে, তার গা ঘেঁষেই উঠেছে সুন্দর সব মসজিদ ও মিনার। অসংখ্য যতী, যোগী, ভক্ত, প্রভৃতি নানা বেশে এখানে স্বচ্ছন্দে ঘুরে বেড়ায়।৩২

আছ দেহরে পোষাল, সিবকৈ ধাম অরু ধ্রুমশাল,

মসজিদ মুনারে মকাম, ক্যা ক্যা বনৈ হৈ কমঠান,

জোগী জতী নাথ অলেখ, জংগম ভকত নানা ভেখ?

এদিকে ধর্মনিষ্ঠ নবাব মুর্শিদকুলি শহরে মাদ্রাসা ও বাজার বা কাটরা পাশাপাশি খুলে দেন। নবাবি মুর্শিদাবাদে লক্ষ্মী ও সরস্বতীর আরাধনা একসঙ্গে শুরু হয়। উৎসবের দিনে মাহিনগর, লালবাগ প্রভৃতি এলাকায় প্রজানির্বিশেষে খাওয়ানো, দান খয়রাত চলত, এলাকাগুলিও জমজমাট হয়ে পড়ত। আরেকদিকে নবাব সাহেব নিজের হাতে কোরান নকল করতেন আর সেই কোরান বিলি করা হত নামজাদা জায়গায়—মক্কা, মদিনা ও কারবালায়, এবং বাংলার পাণ্ডুয়ায়, গাজিসাহেবের আস্তানায়। নিজে শিয়া হয়েও মুর্শিদকুলি সুন্নি আলিমদের সঙ্গে ‘বহস’ করতে ভালবাসতেন। সব মিলে মুর্শিদাবাদ সব ধর্ম ও সংস্কৃতির এক মিলনক্ষেত্র হয়ে উঠেছিল। এ ধারা পলাশি পর্যন্ত অব্যাহত ছিল।

নবাবি আমলে মুর্শিদাবাদের নানা পালাপর্বণ, উৎসব, সমারোহে বিভিন্ন ধর্ম সংস্কৃতির সমন্বয় চোখে পড়ে। মহরমের সময় ভাটিয়ালি গায়করা শোকগাথা গাইত।৩৩ শিয়া ও সুন্নি মুসলমানরা একই মসজিদে পাশাপাশি নমাজ পড়ত। হিন্দুদের হোলি উৎসবে মুসলমানরাও যোগ দিত। শুধু সাধারণ প্রজা নয়, নবাবরাও হোলি উদযাপন করতেন। নবাব শহমৎ জঙ্গ (ঢাকার নবাব নওয়াজিস মহম্মদ খান) শওকত জঙ্গের (তিনি তখন পাটনা থেকে এসেছিলেন) সঙ্গে মুর্শিদাবাদের মোতিঝিল প্রাসাদে সাতদিন ধরে হোলি উৎসব পালন করেন। এমন কী সিরাজদ্দৌল্লা ইংরেজদের সঙ্গে আলিনগরের চুক্তি (ফেব্রুয়ারি ১৭৫৭) সম্পাদন করেই তাড়াতাড়ি মুর্শিদাবাদ ফিরে তাঁর প্রাসাদ হীরাঝিলে হোলির উৎসবে মেতে ওঠেন।৩৪ শুধু তাই নয়, নবাবরা প্রচুর অর্থব্যয় করে হিন্দুদের দেওয়ালি উৎসবও পালন করতেন।৩৫ মুর্শিদাবাদে মারাঠাদের তৈরি মন্দিরের পাশাপাশি তৈরি হয়েছিল আলিবর্দির মসজিদ। এরকম আরও অনেক দৃষ্টান্ত আছে। বরানগরের মন্দিরচত্বর এবং মাস্তিরাম আওলিয়ার আখড়া সামনাসামনি অবস্থান করছিল। এই এলাকাতেই রানি ভবানী শ্যাম রায়ের মন্দির তৈরি করেন। বেরাভাষা বলে মুর্শিদাবাদের শিয়াদের একটি প্রাচীন উৎসব আসলে হিন্দুদের গঙ্গাপূজার মুসলিম সংস্করণ।৩৬

হিন্দু মুসলিম এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যেও মুর্শিদাবাদে সম্প্রীতি বজায় ছিল। নবাবি আমলের মুর্শিদাবাদে এদের মধ্যে কোনও সাম্প্রদায়িক সংঘাতের দৃষ্টান্ত পাওয়া দুষ্কর। এই দুই সম্প্রদায় বাংলায় বহুদিন ধরে সৌহার্দ্যের মধ্যে পাশাপাশি বাস করে এসেছে। এডওয়ার্ড সি. ডিমক [Edward C. Dimmock, Jr.] একটি মননশীল প্রবন্ধে দেখিয়েছেন যে মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য পড়ে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে পরস্পরের প্রতি কোনওরকম ‘গভীর বিদ্বেষে’র পরিচয় পাওয়া যায় না।৩৭ শুধু তাই নয়, অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি এই দুই ধর্মসংস্কৃতির সমন্বয় প্রক্রিয়া চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছিল। এ সময় মুসলমানরা হিন্দুমন্দিরে পুজো দিচ্ছে আর হিন্দুরা মুসলমানদের দরগাতে সিন্নি দিচ্ছে— এটা ছিল অত্যন্ত স্বাভাবিক ঘটনা। এই দুই ধর্ম আর সংস্কৃতির মিলন প্রচেষ্টা থেকেই সত্যপীরের মতো নতুন ‘দেবতা’র জন্ম— যে ‘দেবতা’ হিন্দু মুসলমান উভয়েরই উপাস্য। কবি ভারতচন্দ্রের ‘সত্যপীর’ কবিতা এ মিলন প্রক্রিয়ার প্রকৃষ্ট প্রতিফলন।৩৮ মুর্শিদকুলির সমসাময়িক রামেশ্বর ভট্টাচার্যের ‘সত্যনারায়ণ’ কাব্যে ‘এরপর আমি রহিম এবং রাম দুজনের উপাসনাই করব। রাম এবং রহিম ঈশ্বরের দুই নাম—মক্কাতে তিনি রহিম আর অযোধ্যায় রাম’৩৯ এমন কথা আছে। এরকম অভিব্যক্তিই দেখা যায় মধ্য-অষ্টাদশ শতকের মুসলিম কবি ফৈজুল্লা’র সত্যপীর কবিতায়— ‘যে রাম, সেই রহিম’।৪০ ভারতচন্দ্রেও প্রায় তারই অনুরণন: ‘পুরানের মত ছাড়া কোরাণএ কি আছে। ভাবি দেখ আগে হিন্দু মুসলমান পাছে।’৪১ বাংলার অন্যান্য অঞ্চলের মতো নবাবি আমলের মুর্শিদাবাদেও এই ধারা অব্যাহত ছিল। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি মুর্শিদাবাদের নাগরিক জীবনের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল।

সূত্রনির্দেশ ও টীকা
১. রিয়াজ-উস-সলাতিন, quoted in Gautam Bhadra, ‘Social Groups and Relations in the Town of Murshidabad’, Indian Historical Review, 1976, p. 313.

২. তারিখ-ই-মনসুরী, Journal of the Asiatic Society of Bengal, pt. 1, (1869), p. 100.

৩. সলিমুল্লা, তারিখ-ই-বংগালা, f. 36-37, quoted in Abdul Karim, Murshid Quli, p. 68.

৪. সুকুমার সেন, বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস, পৃ. ৩০৬-৩১০৷

৫. L’Achney to Chevalier, 27 May 1768, quoted in Gautam Bhadra, ‘Social Groups and Relations’, p. 315.

৬. Ibid., p. 315.

৭. William Bolts, Considerations, p. 200

৮. J. H. T. Walsh, History of Murshidabad, p. 246.

৯. সদানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিবৃতি, Board of Trade—Commercial, 13 March 1789, quoted in Gautam Bhadra, ‘Social Groups and Relations’, p. 323.

১০. Pott’s letter to Governor General, 12 Feb., 15 Feb., Board of Revenue, quoted in Gautam Bhadra, Ibid., p. 323. পট এরকম বর্ণনা লেখেন ১৭৮৮ সালে কিন্তু এটা তিন চার দশক আগের অবস্থা সম্বন্ধেও সমান প্রযোজ্য কারণ এইটুকু সময়ের ব্যবধানে অবস্থার বিশেষ হেরফের হয়েছিল বলে মনে হয় না।

১১. Gautam Bhadra, ‘Social Groups and Relations’, p. 324.

১২. জগৎশেঠদের জন্য দেখুন, S. Chaudhury, From Prosperity to Decline, pp. 109-116.

১৩. আর্মানিদের জন্য, S. Chaudhury, ‘Trading Network of a Traditional Diaspora— Armenians in Bengal Trade, c. 1600-1800’, paper presented at the XIIIth International Economic History Congress, Buenos Aires, July 2002.

১৪. ভারতচন্দ্র, গ্রন্থাবলী, পৃ. ২৮৮-৯২।

১৫. Tapan Raychaudhuri, Bengal under Akbar and Jahangir, p. 198.

১৬. সিয়র, ২য় খণ্ড, পৃ. ৭০

১৭. ভারতচন্দ্রের গ্রন্থাবলী, পৃ. ২২৯।

১৮. J. N. Sarkar, ed., History of Bengal, vol. II, p. 413; S. Chaudhury, Trade and Commercial Organization, pp. 210, 239, 247.

১৯. Brijen K. Gupta, Sirajuddaullah, p. 126-এ উদ্ধৃত।

২০. তারিখ-ই-মনসুরী, trans. H. Blockmann, JAS, no. 2, 1867, pp. 95-96.

২১. মুজাফ্‌ফরনামা, J. N. Sarkar, ed., Bengal Nawabs, p. 72.

২২. Willam Bolts, Considerations, p. 158; J. H. Little, Jagatseth, p. XVII.

২৩. সুকুমার সেন, বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস, পৃ. ৩০৬-৩১০।

২৪. S. Chaudhury, From Prosperity to Decline, p. 112.

২৫. Ibid, pp. 112-13; 299-302.

২৬. রিয়াজ, পৃ. ২৮০-৮১

২৭. সিয়র, ১ম খণ্ড, পৃ ২৮০।

২৮. Minute of Sir John Shore, W. K. Firminger, ed., Fifth Report, vol. II p. 9.

২৯. সুকুমার সেন, বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস, পৃ. ৩০৬-৩০৭।

৩০. মুজাফ্‌ফরনামা, J. N. Sarkar, ed., Bengal Nawabs, p. 58.

৩১. J. H. little, House of Jagatseth, p. 2.

৩২. সুকুমার সেন, বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস, পৃ. ৩০৬, ৩০৯।

৩৩. তারিখ-ই-মনসুরী, Journal of the Asiatic Society of Bengal, pt. 1 (1869), pp. 100-111.

৩৪. Karam Ali, Mazaffarnamah, ff. 86a-86b; J. N. Sarkar, ed., Bengal Nawabs, pp. 49, 72.

৩৫. সিয়র, ৩য় খণ্ড, পৃ. ১৪৪, Gautam Bhadra, ‘Social Groups and Relations’ p. 335-এ উদ্ধৃত।

৩৬. তারিখ-ই-মনসুরী, quoted in Gautam Bhadra, ‘Social Groups and Relations’, p. 335.

৩৭. Edward C. Dimmock, K, Jr., ‘Hinduism and Islam in Medieval Bengal’, in Rachel van M. Baumer, ed., Aspects of Bengali History and Society, p. 2.

৩৮. D. C. Sen, Bengali Language, pp. 396-97; ভারতচন্দ্র, সত্যপীরের কথা।

৩৯. রামেশ্বর ভট্টাচার্য্য, সত্যনারায়ণ, এন. এন. গুপ্ত সম্পাদিত, পৃ. ১১।

৪০. আহমদ শরীফ, মধ্যযুগের সাহিত্যে সমাজ ও সংস্কৃতির রূপ, পৃ. ৪২৩।

৪১. ভারতচন্দ্রের গ্রন্থাবলী, পৃ. ৪০২।