ভূবনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়

হরিদাসের গুপ্তকথা
প্রথম খণ্ড

ষোড়শ কল্প : কাশীধাম

কোথায় আমি যাব, অপরে কি জানবে, নিজেই আমি জানি না। কিছুই ঠিক নাই। ঠিক নাই, অথচ আমি কলিকাতার নূতন আশ্রয়টী পরিত্যাগ কোল্লেম! মনে বড় ভয়, কখন কোথায় কি বিপদ ঘটে, কখন দুৰ্বিপাকে বৈরিহস্তে ধরা পড়ি, সেই ভয়ে প্রতিজ্ঞা কোল্লেম, স্থলপথে যাব না, জলপথেই বরাবর দূরদেশে চোলে যাব। জানা ছিল, বড়বাজারের ঘাটে সৰ্ব্বক্ষণ নৌকা পাওয়া যায়; ভোরে ভোরে ভোঁ ভোঁ কোরে ছুটে ছুটে বড়বাজারের ঘাটে পৌঁছিলেম। যে সকল নৌকা পশ্চিম অঞ্চলে যায়, তারি একখানা ভাড়া কোরে আমি পশ্চিমদেশে চোল্লেম। দাঁড়ী-মাঝীরা বদর বদর মন্ত্রে নৌকা ছেড়ে দিলে। আট দাঁড়ে অতি দ্রুত তরণীখানি গঙ্গা-তরঙ্গে ছুটে ছুটে চোল্লো। বাগবাজারের সীমা যখন ছাড়িয়ে গেল, পূৰ্ব্বগগনে সূৰ্য্যদেব তখন অল্পে অল্পে উঁকি মাত্তে লাগলেন।

গঙ্গার দুধারে যে সকল স্থান, মাঝীকে জিজ্ঞাসা কোরে সেই সকল স্থানের নাম জেনে নিতে লাগলেম। যে স্থানগুলি প্রসিদ্ধ, সেইগুলির নাম মনে থাকলো, ছোট ছোট গ্রামের নাম মনে কোরে রাখতে পাল্লেম না। বালী, শ্রীরামপুর, বৈদ্যবাটী, চন্দননগর ছাড়িয়ে হুগলীতে নৌকা পৌঁছিল। বেলা এগারটা। চন্দননগরে একবার নেমেছিলেম, ছোট সদর, কিন্তু মন্দ নয়। চন্দননগরের নাম ফরাসডাঙ্গা; এই স্থানটী ফরাসীদের অধিকারে; এখানে ইংরেজের আইন-কানুন চলে না, লোকের মুখে শুনলেম, ইংরেজের অধিকারে নরনারীহত্যা, চুরি-ডাকাতী, জালিয়াতী ইত্যাদি বড় বড় অপরাধ কোরে যারা ফরাসডাগায় আশ্রয় লয়, ফরাসী গবর্ণরের অনুমতি ব্যতিরেকে ইংরেজী পুলিশ সে সকল অপরাধীকে গ্রেপ্তার কোত্তে পারে না। আরও শুনলেম, ফরাসী অধিকারে বাঙ্গালী গৃহস্থ প্রজারা অনেক প্রকার সুখে আছে।

হুগলীতে উত্তীর্ণ হয়ে স্নানাহার সমাপন কোল্লেম, দাঁড়ী-মাঝীরাও স্নানাহার কোরে নিলে; গঙ্গায় তখন ভাটা; জোয়ার আরম্ভ হোলে নৌকা-ছাড়া হবে, মাঝীরা আমাকে এই কথা জানালে; জোয়ার আসবার বিলম্ব আছে। এক প্রকার হলো ভাল। হুগলীটী প্রাচীন কুঠী, প্রাচীন সহর, বেড়িয়ে বেড়িয়ে সেখানকার বাজার হাট আমি দেখলেম। বেশী বিলম্ব হবে বোলে আদালতগুলি দেখা হলো না। সুখের আসা নয়, সখের যাত্রা নয়, দুরন্ত রাক্ষসের ভয়ে কলিকাতা পরিত্যাগ। পরিহিত বস্ত্র শীতকালের গাত্রবসু আর টাকাগুলি ব্যতীত দূরপথে ভ্রমণের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিছুই সঙ্গে ছিল না, হুগলীর বাজারে লেপ, তোষক, বালিশ আর কয়েকখানি তৈজসপত্র কিনে নিলেম; বেলা যখন আড়াইটে, সেই সময় নৌকাছাড়া হলো।

দিবারাত্রি নৌকা চোলতে লাগলো; অষ্ট প্রহরের মধ্যে অল্পক্ষণ মাত্র বিরাম ক্রমশঃ শান্তিপুর, কালনা, কাটোয়া ইত্যাদি স্থান অতিক্রম কোরে অনেক দূরে গিয়ে পোড়লেম। শান্তিপুরে নেমেছিলেম; শান্তিপুর একটী সুবিখ্যাত গণ্ডগ্রাম; সহর বোল্লেও সাজে। শান্তিপুরে বহুলোকের বাস; হাটবাজারও বেশ গুলজার; সেখানে দেখবার জিনিস অনেক আছে। শুনলেম, কার্ত্তিকমাসে রাসের সময় শান্তিপুরে মহাসমারোহ হয়। কালনাতেও নেমেছিলেম; সেখানে বর্দ্ধমানের মহারাজের অনেকগুলি দেবালয় আছে; সারি সারি অনেক মন্দির; এখানকার প্রধান বিগ্রহ লালজী। অতি সুন্দর নবরত্নমন্দির লালজী বিরাজমান। লালজীর সেবা ও লালজীর বাড়ীর অতিথিসেবার বন্দোবস্ত অতি উত্তম।

ক্রমে ক্রমে অনেক স্থান ছাড়িয়ে গেলেম। দূরে যেন কৃষ্ণবর্ণ মেঘমালা নয়নগোচর হলো। নৌকা যতই অগ্রসর হয়, ততই দেখি, সেই মেঘমালা যেন অনেক দুরে। মেঘের গায়ে গায়ে যেন কত রকম পাখী বোসেছে, ছোট ছোট গাছপালা রয়েছে, এই রকম অনুমান কোল্লেম। মেঘের গায়ে পাখী, মেঘের গায়ে গাছ, তবে তো মেঘ নয়; তবে ওটা কি? ক্রমশই নিকটবর্তী। তখন দেখলেম, সত্যই মেঘ নয়, উচ্চ উচ্চ ভূমিস্তূপ, প্রস্তরস্তূপ; যেগুলিকে ছোট ছোট গাছপালা মনে কোরেছিলেম, সত্যই সেগুলি বড় বড় বৃক্ষলতা; কতকগুলি পুষ্পবৃক্ষে নানাবর্ণের পুষ্প প্রস্ফুটিত হয়ে রয়েছে যেগুলিকে পাখী মনে কোরেছিলেম, সেগুলি গরু, বাছুর, ছাগল, ভেড়া ইত্যাদি গৃহপালিত পশু; তারা সেইখানে নির্বিঘ্নে চরা কোরে বেড়াচ্ছে। মাঝীকে জিজ্ঞাসা কোরে জানলেম, রাজমহলের পাহাড়। গরু-বাছুরেরা পাহাড়ে উঠে চোরে চোরে বেড়ায় সেটা আমার জানা ছিল না, আমার চক্ষে আশ্চর্য্য বোধ হলো, কিন্তু শুনলেম, পাহাড় অঞ্চলের পশুজাতির ঐরূপ শিক্ষা, ঐরূপ অভ্যাস।

কলিকাতার বড়বাজারের ঘাট থেকে কদিনে রাজমহলে নৌকা পৌঁছেছিল, সেটা আমার ঠিক মনে নাই; শীঘ্র শীঘ্র কাশী যাব, ইহাই আমার আকিঞ্চন; রাজমহলে নেমে পাহাড়গুলি ভাল কোরে দেখা হলো না। নৌকা চোল্লো। সাহেবগঞ্জ, ভাগলপুর, মুঙ্গের, পাটনা ছাড়িয়ে পোড়লেম। ভাগলপুর ছাড়িয়ে একটা পাহাড় দেখা গিয়েছিল, সে পাহাড়টার নাম জাংরের পাহাড়; —জলের মাঝখানে যেমন দ্বীপ থাকে, এটাও প্রায় সেইরূপ; বোধ হয় যেন, জলের ভিতর থেকেই পাহাড় উঠেছে। প্রবাদ এইরুপ যে, জহ্নুমুনি এইখানে গঙ্গা পান কোরেছিলেন। তদবধি গঙ্গার একটী নাম জাহ্নবী।

পাটনা সহরটী অতি সুন্দর। পাটনার প্রাচীন নাম পাটলীপুত্র। এই স্থান থেকে গণ্ডকী নদীর মোহানা দেখা যায়। পাটনার পর দানাপুরে, আরা, বক্সার, তার পর গাজীপুর। গাজীপুরের গোলাপ অতি প্রসিদ্ধ। কৌতুকে কৌতুকে কত স্থান দেখতে দেখতে চোল্লেম : আটদিন পরে কাশীর ঘাটে নৌকা পৌঁছিল।

পথের একটী ঘটনার কথা এইখানে বোলে রাখা অতি আবশ্যক। কলের গাড়ী যখন ছিল না, অনেক যাত্রী তখন হাঁটাপথে যেতো; সঙ্গতিমান লোকেরা নৌকাযোগে যেতেন। পথের স্থানে স্থানে এক একটা চটী ছিল। চটী মানে ছোট ছোট পান্থনিবাস। তিনদিকে বেড়া, একদিক খোলা, মাথার উপর চাল। খোপে খোপে চৌকা। যাত্রীরা দলে দলে সেই সকল চটীতে আশ্রয় নিতো, রন্ধনাদি কোত্তো, অনেকে রাত্রিকালেও চটীর ভিতর শুয়ে থাকতো। তখনকার তীর্থযাত্রিগণের পথে অনেক ভয় ছিল; চোরের উপদ্রবে সকলেই সদাসৰ্ব্বদা শঙ্কিত হয়ে থাকতো; খুব সাবধানে থাকলেও অনেকে চোরের দৌরাত্ম থেকে পরিত্রাণ পেতো না। সেই কারণেই একসঙ্গে দল বেঁধে থাকা, রাত্রিজাগরণ করা নিতান্ত আবশ্যক হতো। তাতেও নিস্তার ছিল না। ঘুমিয়ে পোড়তো, চোরেরা চুপি চুপি তাদের ঘটী, বাটী, কাপড়, তল্পী, বাক্স ইত্যাদি চুরি কোরে নিয়ে পালাতো। মানুষ-চোর ব্যতীত ঠাঁই ঠাঁই কুকুরচোর ছিল। আট দশজন যাত্রী গায়ে গায়ে রাত্রিকালে নিদ্রাগত, মাথার নীচে তল্পী, তাদৃশ স্থলেও কুকুরেরা নিঃশব্দে চুপি চুপি গিয়ে ঘুমন্ত লোকের মাথার তল্পী চুরি কোরে নিয়ে যেতো; কেহই কিছু জানতে পাত্তো না, কারো অঙ্গে কুকুরের হাত-পা ঠেকতো না; কুকুরেরা এত সাবধান। মানুষ-চোরেরা সেই সকল কুকুরকে ঐ রকমের চুরি করা শিক্ষা দিত। কুকুরের বুদ্ধি ভাল, যা শিখাও, তাই শিখে; চোরেরা মনিব, সৰ্ব্বদাই সেই বিদ্যা শিক্ষা দেয়, চুরি শিখে সুশিক্ষিত হয়ে কুকুরেরাও বিলক্ষণ চোর হয়ে উঠতো।

তীর্থপথের চোর সাধারণ ডাকাত অপেক্ষাও অধিক সাহসী। দিনমানেও যাত্রিদের সঙ্গে সরপট কথা কোয়ে জিনিস চুরি কোত্তো। পিতলের তসলায় যাত্রীরা রন্ধন কোচ্ছে, চোর গিয়ে লাঠী হাতে কোরে সম্মুখে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা কোত্তো, “তসলা তেরা কি মেরা?” যারা জানতো, তারা উত্তর দিতো, “তেরা।” —চোর তখন সেখান থেকে চোলে যেতো; নূতন যাত্রী তাদের কাণ্ডকারখানা জেনে যদি উত্তর কোত্তো, “এ তসলা মেরা,” তা হোলে চোর তৎক্ষণাৎ লাঠী মেরে আগুনের উপর থেকে তসলাটা ফেলে দিয়ে, হাতে কোরে নিয়ে গজেন্দ্রগমনে চোলে যেতো, দেখলে বোধ হতো, যেন একজন রাজা কি নবাব। কারো কথায় কর্ণপাত কোত্তো না, বুকে একটুভয়ও রাখতো না।

সেই রকমের একটা চটীতে আমি একদিন উত্তীর্ণ হয়েছিলেম। সেই চটীর নাম ভেলুয়া চটী। রন্ধনাদি কোরে সেইখানে আমি আহার করি, অন্যান্য যাত্রীরাও ভিন্ন ভিন্ন স্থানে ভিন্ন ভিন্ন ঘরে আহারাদি করে। যাত্রী সে দিন বড় কম ছিল না। ঘর একখানা নয়, তফাৎ তফাৎ বিশ পঁচিশখানা ঘর। চটীর বন্দোবস্ত দেখবার জন্য অনেকক্ষণ আমি সেইখানে ছিলেম; বেড়াতে বেড়াতে সন্ধ্যা হয়ে যায়; সন্ধ্যাকালে নৌকার দিকে ফিরে আসছি, সাত আটখানা নৌকা সেইখানে নঙ্গর করা ছিল, ভয় ছিল না, নির্ভয়ে আপন মনে আমি চোলে আসছি, হঠাৎ দেখি, চটীর উত্তরদিকের একখানা কুটীরে দাউ দাউ কোরে আগুন জ্বোলছে, কে একজন সেই আগুনের ভিতর থেকে পরিত্রাহি চীৎকার কোচ্ছে। “কে আছ গো! বাঁচাও গো! প্রাণ যায় গো! পুড়ে মোলেম গো! রক্ষা কর গো!” এই রকম চীৎকার—এই রকম আর্ত্তনাদ! কণ্ঠস্বরে বুঝলেম, বামাকন্ঠ! কোন স্ত্রীলোক সেই ঘরে আছে, ঘরে আগুন লেগেছে, বাহির হোতে পাচ্ছে না, আশে পাশে জনকতক লোক হৈ হাই শব্দে ছুটাছটি কোচ্ছে, আগুনের কাছে কেহই এগুতে পাচ্ছে না। স্ত্রীলোকের ক্রন্দন, স্ত্রীলোকের প্রাণ যায়, আমার প্রাণ কেমন অস্থির হয়ে উঠলো; গঙ্গার দিকে যাচ্ছিলেম, ফিরে দাঁড়ালেম; যে দিকে আগুন, উর্দ্ধশ্বাসে সেইদিকে ছুটলেম। সম্মুখদিকে বেশী আগুন, সেই ভয়ে লোকেরা অগ্রসর হোতে পাচ্ছিল না; আগুনের ভেল্কীতে লোকেরা কেবল জল জল কোরে চেঁচাচ্ছিল। আমার তখন একটা উপস্থিতবুদ্ধি যোগালো, লোকেরা যে দিকে গোলমাল কোচ্ছিল, সে দিকে না গিয়ে তফাৎ দিয়ে ঘুরে ঘরের পশ্চাদ্দিকে উপস্থিত হলেম। সম্মুখদিকে আগুন লেগেছিল, পশ্চাতে তখনও আগুন ধরে নাই, তাই দেখে আমার একটু সাহস হলো। পরমেশ্বরের কৃপা! পলক ফেলবার অবসর রাখলেম না, নাসিকাতে নিশ্বাস ফেলবার অবকাশ দিলেম না, গাত্রবস্ত্রগুলি খুলে তফাতে টেনে ফেলে, এককাপড়ে কোমর বেঁধে, এক লাথিতে ঘরের বেড়া ভেঙে ঘরের মধ্যে প্রবেশ কোল্লেম; কোন দিকেই না চেয়ে স্ত্রীলোকটীকে কোলে কোরে নিয়ে ভোঁ কোরে বেরিয়ে পোড়লেম, স্ত্রীলোকটীর মুখের দিকে চাইলেম না, লম্ফে লম্ফে দশ হাত তফাতে এসে দম রাখলেম।

আমিও বেরিয়েছি, ওদিকে উত্তরে হাওয়ায় ঘরখানা সমস্ত জ্বোলে উঠে হু হু শব্দে; চতুর্দ্দিকে আগুনের হল্কা ছড়াতে লাগলো। পাছে অন্যান্য ঘরে লেগে যায়, সেই আশঙ্কায় চটীর লোকেরা কলসী কলসী জল এনে তফাৎ থেকে ছুঁড়ে ছুঁড়ে ছড়াতে আরম্ভ কোল্লে; ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলে আমিও একটু ঠাণ্ডা হোলেম। যেটীকে উদ্ধার কোরে আনলেম, সেটীকে ঘাসের উপর শুইয়ে রেখে দুই হাতে সৰ্ব্বাঙ্গের ঘাম মুছতে লাগলেম।

অগ্রহায়ণমাস শেষ হয়ে গিয়েছে, বিলক্ষণ শীত, সে অঞ্চলে আরো বেশী, তথাপি আমার সৰ্ব্বশরীরে ঘর্ম্মধারা। কারে আমি বাঁচিয়েছি, কিছুই জানি না, তখনো তাঁর মুখের দিকে আমি চেয়ে দেখি নাই; অন্ধকার রাত্রি, ঘুট ঘুটে অন্ধকার; ঘরজ্বলা আগুনের আলোতে এতক্ষণের পর সেই স্ত্রীলোকটীর মুখপানে আমি চাইলেম। চেয়েই অমনি অকস্মাৎ চোমকে উঠে মনের আবেগে অস্ফুট চীৎকার কোরে উঠলেম। স্ত্রীলোকটী অজ্ঞান;—অঙ্গের কোন স্থানে অগ্নিস্পর্শ হয় নাই, কাপড়েও আগুন ধরে নাই, কিন্তু চৈতন্যশূন্য! চক্ষু-দুটী বিমুদিত!

কি আশ্চর্য্য ব্যাপার! বিধাতা আমাকে এই সময় এখানে এনে পরম উপকারসাধন কোরেছে, এই কথা স্মরণ কোরে, উদ্দেশে বিধাতাকে নমস্কার কোল্লেম। ঘন ঘন বক্ষঃস্থল কম্পিত হোতে লাগলো। সন্দেহে সন্দেহে স্ত্রীলোকটীর নাসিকায় হস্ত দিয়ে বুঝলেম, নিশ্বাস আছে, মরে নাই, মূর্চ্ছা। পুনরায় এক নিশ্বাস ফেলে জগদীশ্বরকে প্রণিপাত কোল্লেম। তখন আমার অমঙ্গল-আশঙ্কা দূর হলো। স্ত্রীলোকটীর মুখে, কপালে, মস্তকে বারবার হস্ত স্পর্শ কোরে, হেঁট হয়ে ভাল কোরে, সেই মুখখানি আবার দেখলেম। প্রাণে আমার তখন কতই উৎসাহ, কতই আনন্দ, কতই উচ্ছ্বাস, সে কথা আমি বোলতে পারি না। একদিকে আনন্দ, অন্যদিকে কিন্তু বিপুলে সন্দেহ।

লোকেরা কলসী কলসী জল ঢেলে ঘরের অগ্নিনিৰ্ব্বাণের চেষ্টা কোচ্ছিল, জলাহুতি পেয়ে অগ্নি ক্রমশই প্রবল হোচ্ছিল, ডেকে ডেকে চীৎকার কোরে আমি লোকগুলিকে বোলতে লাগলেম, “ওগো, এইখানে একটু জল আন, আমাকে একটু জল দাও, স্ত্রীলোকটী অচেতন, বাঁচাও, বাঁচাও, শীঘ্র বাঁচাও!”— আমার কথাগুলি যেন বাতাসে উড়ে গেল, কেহই শুনতে পেলে না; কিম্বা হয় তো শুনতে পেয়েও গ্রাহ্য কোল্লে না। তখন আমি কি করি, যত্নের দেহ অযত্নে ফেলে রেখে গঙ্গা পর্য্যন্তও যেতে পারি না, কি করি, নিজের কোমরের কাপড় খুলে ধীরে ধীরে সেই চন্দ্রমুখে বাতাস কোত্তে লাগলেম। একটু পরে দুটী পদ্মচক্ষু যেন অল্প অল্প নিমীলিত হলো; আনন্দে আমার অন্তরাত্মা যেন নেচে উঠলো; আদরে তারস্বরে ডাকলেম, “অমরকুমারী!”

অমরকুমারী অল্প অল্প চেয়েছিলেন, আমার কথা শুনে, একটীবার আমার দিকে চেয়েই তখনি আবার চক্ষু বুঝলেন; দীর্ঘ দীর্ঘ নেত্রপল্লবে পদ্মফুলদুটী ঢাকা পোড়ে গেল। আমি শুশ্রূষা কোচ্ছি, চৈতন্য প্রাপ্ত হয়েও অমরকুমারী কেন এমন হলেন, এইরূপ ভাবছি, এমন সময় দেখি, সেই জলন্ত ঘরের কাছে একটী ভদ্রলোক ছুটে এলেন; তাঁর মুখে হাহাকার ধ্বনি, অঙ্গবস্ত্র শিথিল। আমার দিকে অঙ্গুলিসঙ্কেতে একজন লোক সেই ভদ্রলোকটীকে কি কথা বোল্লে, তিনি তৎক্ষণাৎ দ্রুতপদসঞ্চারে আমাদের কাছে এসে উপস্থিত হোলেন। তফাৎ থেকে একটু একটু আমি চিনতে পেরেছিলেম, নিকটে এলে স্পষ্টই চিনলেম, মোহনলালবাবু। ঘটনার কথা একনিশ্বাসে তাঁর কাছে আমি বর্ণনা কোল্লেম, সাদরে আমার মস্তক স্পর্শ কোরে, আরক্তবদনে মিষ্টবচনে তিনি বোল্লেন, “খুব বাহাদর! খুব বাহাদুর! তুমি আমার পরম উপকার কোরেছ! এখানে তুমি কেমন কোরে এলে?”

যেমন কোরে এসেছিলেম, সংক্ষেপে সংক্ষেপে পরিচয় দিলেম, শুনে তিনি ম্লানবদনে একটু হাস্য কোল্লেন। ঘরখানা ওদিকে ভস্মসাৎ হয়ে গেল, এদিকে অমরকুমারীর মূর্চ্ছাভঙ্গ হলো, আমার দিকে পৃষ্ঠ রেখে, মোহনবাবুর দিকে মুখ ফিরিয়ে, অমরকুমারী উঠে বোসলেন। মোহনবাবুকে সম্বোধন কোরে আমি বোল্লেম, “এখনো ভয়ের ঘোর আছে : অমরকুমারী আমারে চিনতে পাচ্ছেন না।”

বিস্ফারিতনেত্রে একদৃষ্টে আমার মুখপানে চেয়ে সবিস্ময়ে মোহনবাবু বোল্লেন, “এ কি হরিদাস? ইহারে কি তুমি চেনো? ইহারে কি তুমি আর কোথাও দেখেছ?”

আমার মনের ভিতর তখন যেন চপলার খেলা হয়ে গেল। যেমন আলো এলো, সঙ্গে সঙ্গে তখনি তেমনি অন্ধকার। অমরকুমারী আমারে চিনতে পাচ্ছেন না, আমি যদি বলি চিনি, সেটা তো ভাল কথা হবে না। যে জায়গায় দেখাশুনা, সেটা আমার পক্ষে অনুকূল স্থান নয়, সে সব কথা যদি প্রকাশ করি, কিসে কি হবে, চেপে যাওয়াই ভাল; তাই ভেবেই চেপে গেলেম; মোহনবাবুর প্রশ্নে কেবল এইটকুমাত্র উত্তর দিলেম, “আজ্ঞা হাঁ, এই রকমের একটী বালিকাকে আমি দেখেছি, তাঁর নাম অমরকুমারী।”

হাস্য কোরে মোহনবাবু বোল্লেন, “তোমার ভুল হোচ্ছে। এর নাম অমরকুমারী নয়। এটী আমার নূতন পরিবার। সন্তান হলো না বোলে দ্বিতীয়বার আমি এটীকে বিবাহ কোরেছি। আগুনের মুখ থেকে তুমি এটীকে রক্ষা কোরেছ, আমি তোমার কাছে উপকৃত হয়েছি, এখন তুমি যাবে কোথায়?”

আমি উত্তর কোল্লেম, “কাশী যাব। আমি কারো শত্রু নই, জন্মাবধি কখনো কারো কোন অনিষ্ট করি নাই, অকারণে দেশে আমার অনেক শত্রু হয়েছে, দেশে আর থাকবো না, কাশীবাসী হয়ে অন্নপূর্ণা-বিশ্বেশ্বর দর্শন কোরবো, কাশীর ঘাটে নিত্য গঙ্গাস্নান কোরবো, অন্নপূর্ণা-বিশ্বেশ্বরের পবিত্র নাম কীর্ত্তন কোরবো, এই আমার বাসনা। কাশীনাথ যদি কাশীতে আমাকে জায়গা না দেন, তা হোলে গঙ্গা পার হয়ে সন্ন্যাসীর মত তীর্থে তীথে পর্য্যটন কোরে বেড়াবো।”

পুনৰ্ব্বার হাস্য কোরে মোহনবাবু বোল্লেন, “ছেলেমানুষ! ও রকম কাজ কি কোত্তে আছে? শিশুকালে সন্ন্যাস! বোকা ছেলে। চল আমার সঙ্গে, আমি প্রয়াগে যাচ্ছি, আগে প্রয়াগে চল, তার পর আমিই তোমাকে সঙ্গে কোরে কাশীতে নিয়ে যাব। দেশে তোমার কে এমন শত্রু হয়েছে? কেনই বা শত্রু হবে? কেহই শত্রু হয় নাই। ওটা তোমার মনের স্বপ্ন; ও সকল মিথ্যা স্বপ্ন মন থেকে দূর কোরে দাও; চল আমার সঙ্গে; আমার নৌকা আছে, একসঙ্গে সেই নৌকাতেই বেশ যাওয়া যাবে।”

পূর্ব্বাপর চিন্তা না কোরেই আমি উত্তর কোল্লেম, “আজ্ঞা না, আমার নৌকা আছে, ভগবান বিশ্বেশ্বর আমার চিত্তকে আকর্ষণ কোরেছেন, অগ্রেই আমি কাশী যাব। আপনি যদি একান্তই আমারে প্রয়াগে নিয়ে যেতে চান, সেটা আপনার অনুগ্রহ কিন্তু বিশ্বেশ্বর-দর্শনের অগ্রে কিছুতেই আমি যেতে পারবো না, দয়া কোরে ক্ষমা কোরবেন।”

মোহনবাবু বিস্তর জেদাজেদি কোল্লেন, ভাল করবার আশ্বাস দিয়ে বিস্তর অনুরোধ কোল্লেন, তথাপি আমি সম্মত হোলেম না। শেষকালে তিনি আমাকে সঙ্গে কোরে আপনার নৌকায় নিয়ে গেলেন, নাক পর্য্যন্ত ঘোমটা দিয়ে অমরকুমারীও আমাদের সঙ্গে সঙ্গে চোল্লেন। দুই একবার আমি মোহনবাবুর অলক্ষিতে অমরকুমারীর দিকে কটাক্ষপাত কোরেছিলেম, অমরকুমারী কিন্তু একবারও আমার পানে ফিরে চাইলেন না। আমার আশ্চর্য্য বোধ হলো। এত অল্পদিনে অমরকুমারী আমাকে ভুলে গেলেন, এককালে চিনতেই পাল্লেন না, ব্যাপারখানা কি?

নৌকায় আমরা আরোহণ কোল্লেম, প্রাসঙ্গিক অপ্রাসঙ্গিক দুটী পাঁচটী কথার পর মোহনলালবাবু একটী বাক্স খুলে আমার হাতে খানকতক ব্যাঙ্কনোট দিলেন; বোল্লেন, “হরিদাস! আজ তুমি আমার যে উপকার কোরেছ, তার যোগ্য পুরস্কার আমি দিতে পাল্লেম না, এই নোট-কখানি গ্রহণ কর, যৎকিঞ্চিৎ নিদর্শন, আমাকে তুমি মনে রেখো, তোমার ঠিকানা লিখে নিচ্ছি, যখন কিছু অভাব হবে, চিঠি লিখে আমাকে জানিও, তৎক্ষণাৎ আমি সাহায্য কোরবো।”

নোট-কখানি ফিরিয়ে দিবার উপক্রম কোরে, ম্লানবদনে আমি বোল্লেম, “উপকার আমি বিক্রয় করি না; অগ্নিকুণ্ডে স্ত্রীহত্যা হোচ্ছিল, আমি রক্ষা কোরেছি, সেটা আমার কর্তব্যপালন; কর্তব্যপালনের পুরস্কার আমি চাই না। আপনার নোট আপনিই রাখুন, আমার প্রয়োজন নাই।”

একদৃষ্টে আমার মুখপানে চেয়ে, যেন একটু বিস্ময় বোধ কোরে, মোহনবাবু বোল্লেন, “না না, সে জন্য বোলছি না, উপকার-বিক্রয়ের কথা নয়। তবে কি না, তুমি ছেলেমানুষ, বিদেশে এসেছ, তীর্থস্থানে যাচ্ছ, তীর্থে অনেক প্রকার খরচপত্র আছে, টাকাগুলি সঙ্গে রাখ, সময়ে উপকারে আসবে।”

বার বার অস্বীকার কোল্লেম, বিশেষ আগ্রহ জানিয়ে বার বার তিনি অনুরোধ কোল্লেন, আমি গ্রহণ কোরবো না, জোর কোরে তিনি গোছিয়ে দিবেনই দিবেন, দৃঢ়সঙ্কল্প, কাজেই আমারে গ্রহণ কোত্তে হলো। আবার মোহনবাবু আমাকে প্রয়াগে নিয়ে যাবার জন্য আকিঞ্চন পেলেন, অনেক রকম হেতুবাদ দিয়ে, অসম্মতি জানিয়ে, আড়ে আড়ে অমরকুমারীর দিকে চাইতে চাইতে নৌকা থেকে আমি নেমে এলেম, অনতিদূরেই আমার নিজের নৌকা নোঙ্গরকরা ছিল, সেই নৌকায় আরোহণ কোল্লেম। রাত্রি তখন নয়টা কি দশটা। রাত্রেও নৌকা চলে; দাঁড়ী-মাঝীরা নোঙ্গর তুলে ভগবানের নাম কোরে, নৌকা খুলে দিলে, গঙ্গাবক্ষে নাচতে নাচতে নৌকাখানি দ্রুতবেগে ছুটে চোল্লো।

এটা কাশীতে পৌঁছিবার পূর্বের ঘটনা। নৌকায় বোসে বোসে আমি চিন্তা কোত্তে লাগলেম, এটা হলো কি! অমরকুমারী আমাকে চিনতে পাল্লেন না। অমরকুমারীই নিশ্চয়। সেই মুখ, সেই চক্ষু, সেই চুল, সেই বর্ণ, সেই গঠন, সব ঠিক; সাত আটমাসে আমার এতই কি দৃষ্টিভ্রম হওয়া সম্ভব? কখনই না। অমরকুমারী নিশ্চয়। মোহনবাবু বোল্লেন, অমরকুমারী নয় আর একজন; ঐ কন্যাটীকে তিনি বিবাহ কোরেছেন। বিবাহটা সম্ভব হোলেও হাতে পারে, কেন না, অমরকুমারীকে আমি অবিবাহিতা দেখে এসেছি, বিবাহ হওয়া বিচিত্র নয়; কিন্তু অমরকুমারী ভিন্ন ঐ কন্যা আর একজন, ইহা তো কোন ক্রমেই বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে না। অবিকল একরূপ চেহারা, একরুপ ভঙ্গী, একরূপ বয়স, ইহা কিরূপে সম্ভবে? সংসারে আকার-অবয়বে এমন চমৎকার মিলন নিতান্তই বিরল। আচ্ছা, অমরকুমারী আমাকে চিনতে পাল্লেন না কেন? মোহনবাবু কাছে ছিলেন, সেই জন্যই কি গোপন করা? সেই জন্যই কি উদাসীনভাব?

এই চিন্তার পর আর এক চিন্তা। রক্তদন্তের কথা যদি সত্য হয়, সত্য যদি রক্তদন্ত আমার মামা হয়, সত্য যদি অমরকুমারী সেই রক্তদন্তের কন্যা হন, তবে তো অমরকুমারী আমার মাতুলকন্যা। বাবু মোহনলাল সেই অমরকুমারীকে বিবাহ কোরেছেন, তাঁর নিজের মুখের পরিচয় এইরুপ; আচ্ছা, এ যোগাযোগ কি প্রকারে ঘোটলো? রক্তদন্তের সঙ্গে কি মোহনবাবুর পূর্বে জানাশোনা ছিল? তা যদি হয়, তবে বর্দ্ধমানে রক্তদন্ত যখন আমাকে ধোত্তে গিয়েছিল, সেটাও তো বেশী দিনের কথা নয়, তখন কেন মোহনবাবু সেই রক্তদন্তকে চিনতে পারেন নাই? একটা কদাকার কুব্জাঙ্গ অপরিচিত লোকের হাতে কেনই বা আমাকে তখন ছেড়ে দিয়েছিলেন? অনেক ভাবলেম, কিছুই মীমাংসায় আনতে পাল্লেম না। অন্য মীমাংসা এলো না, কিন্তু যাঁরে আমি আগুনের মুখ থেকে উদ্ধার কোরেছি, সেই বালিকাটী যে নিশ্চয়ই সেই সরলা, সুশীলা, স্নেহময়ী অমরকুমারী সে পক্ষে কিছুমাত্র সংশয় থাকলো না।

কাশীর ঘাটে নৌকা পৌঁছিল। গঙ্গা থেকে কাশীধামের দৃশ্য অতি চমৎকার। অর্ধচন্দ্রাকার বিশ্বেশ্বরক্ষেত্র অগণিত সৌধ-মন্দিরে আলো কোরে রয়েছে। নৌকায় বোসে বোসে সেই দৃশ্য আমি দর্শন কোল্লেম, ভক্তিভাবে করপুটে কাশীপুরীকে নমস্কার কোল্লেম, উদ্দেশে কাশীশ্বর-কাশীশ্বরীকে প্রণিপাত কোল্লেম, শরীর রোমাঞ্চিত হলো।

নৌকার জিনিসপত্ৰগুলি তীরে উত্তোলন কোরে নৌকার ভাড়া চুকিয়ে দিলেম। কোথায় তখন যাব, অন্তরে সেই ভাবনার আবির্ভাব। জনকতক পাণ্ডা এসে আমাকে ছেঁকে ধোল্লে। সকলেই বলে, আমার সঙ্গে এসো; হাত ধোরে টানাটানি। একজন উত্তরসাধক আমার দরকার, আমি একজন পাণ্ডাকেই বরণ কোল্লেম। সে একখানি গাড়ী ভাড়া কোরে আমার জিনিসগুলি একটা ঠিকানায় পৌঁছে দিবার বন্দোবস্ত কোত্তে লাগলো। আমি সেই অবসরে গঙ্গাতীরে দাঁড়িয়ে মা গঙ্গার শোভা দর্শন কোত্তে লাগলেম। গঙ্গা এখানে উত্তরবাহিনী। জোয়ার-ভাটা আছে কি না, বুঝা গেল না, কিন্তু তরঙ্গ-বেগ অত্যন্ত প্রবল; অল্পজলে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা অতি বলবান পুরুষেরও অসাধ্য। একদিকেই স্রোতের টান। নৌকা থেকে যখন আমি উত্তীর্ণ হোলেম, তখন প্রাতঃকাল, শত শত নরনারী মনের আনন্দে ভাগীরথী-সলিলে স্নান-আহ্নিক কোচ্ছেন, ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতেরা উচ্চকণ্ঠে ভাগীরথীর স্তবপাঠ কোচ্ছেন, ছোট ছোট বালকেরা অভ্যাসবশে সেই স্রোতে সাঁতার দিতে দিতে এক একটা চাতালের উপর লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে; চারিদিকে চক্ষু ঘুরিয়ে সেই সকল আমি দেখতে লাগলেম। সারি সারি অনেক ঘাট। সকল ঘাটেই উচ্চ উচ্চ সিঁড়ি। ঘাট যেমন অসংখ্য, সিঁড়িও তদ্রূপ অসংখ্য। সচরাচর ঘাটের সিঁড়ি যেমন ক্রমান্বয়ে ঢালুভাবে নীচে নামে, কাশীর গঙ্গার ঘাটের সিঁড়ি সে রকম নয়; উপর থেকে ঠিক নিম্নদিকে ঋজুভাবে ধাপ গাঁথা; সে সকল সিঁড়ি দিয়ে নামা-উঠা নূতনলোকের পক্ষে নিতান্তই দুঃসাধ্য; ধাপে ধাপে পা কাঁপে নীচের দিকে চাইতে ভয় হয়। স্নানের ঘাটের দুই ধারে রুলীওয়ালা পাণ্ডা। বাঁশের ছাতা মাথায় দেওয়া, নাকে তিলক কাটা, বুকে কপালে চন্দনমাখা, লম্বা লম্বা মালা গলায় দীর্ঘ দীর্ঘ পাণ্ডাদের মূর্ত্তি-দর্শনে ভক্তির উদ্রেক হয়; পাণ্ডাদের ভিতর হিন্দুস্থানীও আছে, উৎকলবাসীও আছে। উৎকলবাসীরা গঙ্গাস্নান কোরে, লম্বা চুলে খোঁপা বেঁধে, বড় বড় পান খেয়ে, গাল ভারী কোরে বোসেছে, পানের পিক গালের দু-ধারে যেন রক্তধারা গড়াচ্ছে, সে মূর্ত্তি-দর্শনে হৃদয়ে ভক্তি আনয়ন করা কিছু জোরের কাজ, অতি ভক্তি ব্যতিরেকে তাদৃশ পাণ্ডাগণকে প্রণামী দিতে ইচ্ছা হয় না। কি করা যায়, একজন পাণ্ডা আমার কপালে রুলী পরালে, তারে আমি কিঞ্চিৎ প্রণামী দিলেম, সে আমার মাথায় একটা ফল ছুইয়ে, অস্ফুট মন্ত্রোচ্চারণে আশীর্ব্বাদ কোল্লে, আমি চুপটী কোরে দাঁড়িয়ে রইলেম। সাধারণ পাণ্ডা ছাড়া কাশীতে আর দুই শ্রেণীর পাণ্ডা আছে, তাদের উপাধি যাত্রাওয়ালা আর গঙ্গাপুত্র। তারা যাত্রীগণকে তীর্থ দর্শন করায়, দর্শনী আদায় কোরে, বাসাবাড়ী ঠিক কোরে দেয়, দাসী-চাকর নিযুক্ত করবার বন্দোবস্ত করে, যাত্রীদের কাছে বকসীস পায়। একজন পাণ্ডা আমার জন্য একখানি বাসাবাড়ী ঠিক কোরে দিলে, জিনিসপত্রগুলি সেই বাড়ীতে তুলিয়ে দিলে, আর আর যা কিছু আমার প্রয়োজন, সমস্তই সেই পাণ্ডার দ্বারা সংগৃহীত হলো।

দশাশ্বমেধঘাটে আমি স্নান কোল্লেম। স্নানের পর পাণ্ডাদের যেরুপ দস্তুর আছে, সেই রকমে আমাকে সাজিয়ে দিয়ে তীর্থদর্শনে নিয়ে চোল্লো। প্রথমেই বিশ্বেশ্বরের মন্দির : দ্বারে ঢুণ্ঢিগণেশ। অগ্রে ঢুণ্ডিগণেশকে প্রণাম কোরে বিশ্বেবরের মন্দিরে প্রবেশ কোল্লেম। মন্দিরে লিঙ্গরূপী বিশ্বেশ্বর বিরাজমান; লিঙ্গটী একটু পশ্চিমে হেলা। প্রবাদ এইরুপ যে, কালাপাহাড়ের ভয়ে আসল বিশ্বেশ্বর জ্ঞানবাপীতে ডুবে লুকিয়ে আছেন, নকল বিশ্বেশ্বর মন্দিরমধ্যে বিরাজ কোচ্ছেন। শিবলিঙ্গের মস্তকে গঙ্গাজল-বিল্বদল অর্পণ কোরে আমি সাষ্টাগে প্রণাম কোল্লেম। তার পর জ্ঞানবাপী। একটা চতুষ্কোণ কুণ্ড; কুণ্ডের জল বেলপাতায় ঢাকা; যাত্রীরা সেই জলে আতপচাল আর বিল্বপত্র নিক্ষেপ করে; পচাপাতায় কুণ্ডের জল দুর্গন্ধ। যাত্রিগণকে ভক্তিভাবে সেই জল পান কোত্তে হয়। একজন পাণ্ডা বৃহৎ একগাছা লাঠী দিয়ে বিল্বপত্র সরাচ্ছে, পাড়ের উপর তুলে ফেলছে, ষাঁড়েরা মনের আহ্লাদে সেই সকল বিল্বপত্র ভক্ষণ কোচ্ছে। আমি জ্ঞানবাপীর জল এক গণ্ডূষে পান কোরে মাথায় হাত মুছলেম, অন্তরে ভক্তি না এলেও বাহ্যভক্তিভাবে করযোড়ে বাপীকে নমস্কার কোল্লেম।

তার পর অন্নপূর্ণার মন্দির। পাণ্ডা আমাকে সেই মন্দিরে নিয়ে গেল। অসম্ভব লোকের ভিড়। “হর হর বিশ্বেশ্বর! জয় মা অন্নপূর্ণা!” এককালে বহু রসনায় ইত্যাকার ধ্বনিতে মন্দির প্রতিধ্বনিত। মানুষের ভিড়ের সঙ্গে বহুসংখ্যক ষাঁড়ের ভিড়; দীর্ঘ দীর্ঘ শৃঙ্গবিশিষ্ট স্থূলাঙ্গ প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড ষাঁড়, দেখলেই ভয় হয়, ষাঁড়েরা কিন্তু কাহাকেও কিছু বলে না। পাণ্ডার সঙ্গে আমি মন্দিরে প্রবেশ কোরে অন্নপূর্ণা দর্শন কোল্লেম। দুই প্রকার প্রণামী; আসলমূর্ত্তি যারা দর্শন কোত্তে যায়, পুজকেরা দরজা বন্ধ কোরে স্বতন্ত্র প্রণামী নিয়ে সেই মুক্তি দেখায়। শুনেছিলেম, অন্নপূর্ণা স্বর্ণ-প্রতিমা, বাস্তবিক তা নয়, পাথরের প্রতিমা, এক হস্তে থালি, এক হস্তে হাতা; সম্মূখে করযোড়ে সদাশিব। মুখটী অতি সুন্দর, দর্শনমাত্র ভক্তির উদয় হয়; মূর্ত্তি দর্শন কোরে রোমাঞ্চিতকলেবরে ভক্তিভাবে সাষ্টাঙ্গে আমি প্রণিপাত কোল্লেম।

মন্দির-দুটী সুনিপুণ স্থপতি-হস্তে বিনির্ম্মিত। বিশ্বেশ্বরের মন্দিরটীর অর্দ্ধাংশ স্বর্ণময়। পাণ্ডার মুখে শুনলেম, পঞ্জাবের মহারাজ রণজিৎ সিংহ ঐ মন্দিরটী আদ্যোপান্ত স্বর্ণমণ্ডিত করবার ইচ্ছা কোরেছিলেন, অর্ধাংশ মণ্ডিত হবার পর মহারাজ রণজিৎ পরলোকযাত্রা করেন, সুতরাং তদবধি ঐরূপ অর্দ্ধসমাপ্ত অবস্থাতেই রয়ে গিয়েছে। অন্নপূর্ণার মন্দিরের তিন রকম রং : কতক শ্বেতবর্ণ, কতক রক্তবর্ণ, কতক কৃষ্ণবর্ণ। শোভা রমণীয়।

পূৰ্ব্বে এমন শুনা ছিল, কাশীপরী স্বর্ণময়ী পঞ্চক্রোশী। এটী কিন্তু কবি-কল্পনা। কাশীপুরী স্বর্ণপুরী নহে, প্রস্তরপরী; এখানকার সমস্ত গৃহই প্রস্তরনির্মিত। মন্দিরদর্শন কোরে বেরিয়ে আমি চতুর্দ্দিকেই শিবলিঙ্গ দর্শন কোত্তে লাগলেম। কোথাও মন্দিরের ভিতর প্রতিষ্ঠিত শিবলিঙ্গ, কোথাও প্রাচীরের ধারে অনাবৃত স্থানে বিল্বপত্রে ঢাকা শিবলিঙ্গ, কোথাও বা এক জায়গায় রাশীকৃত শিবলিঙ্গ। এত শিব কোথাও নাই; গণনা কোরে সংখ্যা করা যায় না; সকল শিবের পূজাও হয় না। শিবলিঙ্গ ব্যতিরেকে স্থানে স্থানে আরও অনেক দেব-দেবীর প্রতিমূর্তি আছে, একে একে সেগুলিও আমি দর্শন কোল্লেম। বেলা দুই প্রহরের পূর্বে পাণ্ডা আমারে নির্দ্দিষ্ট বাসাবাড়ীতে নিয়ে গেল, যথাসময়ে একজন ব্রাহ্মণ অন্নপূর্ণার ভোগের প্রসাদ আমার বাসায় এনে দিলেন, ব্রাহ্মণকে যথাসম্ভব অর্থ দান কোরে আমি প্রসাদ পেলেম। সে দিন আর কোথাও বেরুলেম না; সন্ধ্যার পর অন্নপূর্ণা-বিশ্বেশ্বরের আরতি দেখে অন্তঃকরণ পুলকিত হলো।

বাঙ্গালীটোলায় আমার বাসা হয়েছে। যখন আমি গিয়েছিলেম, তখন কাশীতে অনেক বাঙ্গালীর বাস হয়েছে; বাঙ্গালীটোলা প্রায় বাঙ্গালীতেই পরিপূর্ণ; দোতালা, তেতালা, চৌতালা, অনেক বাড়ী; একতালা বাড়ী প্রায়ই দেখা গেল না : সকল বাড়ীই পাথরে গাঁথা; গায়ে গায়ে বাড়ী; কলিকাতা সহরে অসংখ্য বাড়ী আমি দেখেছি, তুলনায় বোধ হয়, সেখানকার অপেক্ষাও কাশীর বাড়ীগুলি বেশী গিঞ্জি গিঞ্জি। কাশীধামের—বিশেষতঃ বাঙ্গালীটোলার রাস্তাগুলি অতি সঙ্কীর্ণ; গঙ্গাতীরের রাস্তা ব্যতীত অন্য কোন গলীতে প্রায়ই গাড়ী যায় না; অতি কষ্টে পাল্কী যায়, এক একটা গলীতে পাল্কীও যেতে পারে না। এত সঙ্কীর্ণ যে, দুইজন মানুষ পাশাপাশি চোলে যেতেও কষ্ট হয়; অন্যদিক থেকে একটা ষাঁড় চোলে এলে সে গলীর গন্তব্য পথ বন্ধ হয়ে যায়। এই কারণেই বাঙ্গালীটোলা সৰ্ব্বদা অপরিষ্কার দেখায়। আমি শীতকালে গিয়েছিলেম, গলী-রাস্তাগুলি তত দুর্গম বোধ হলো না, কিন্তু লোকের মুখে শুনলেম, বর্ষাকালে অত্যন্ত কাদা হয়, অনেক লোক গলীতে গলীতে আছাড় খেয়ে কর্দ্দমাক্ত-শরীরে ঘরে ফিরে আসে।

আমার বাসাটী মন্দ হয় নাই। দোতালা বাড়ী, উপর-নীচে অনেকগুলি ঘর, দু-দিকে দুটী সিঁড়ি; উপরের ঘরগুলি দিব্য পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। সকল ঘরেই লোক আছে; আমার জন্য দুটী ঘর নির্দ্দিষ্ট ছিল;—একটী ঘরে শয়ন, একটী ঘরে রন্ধন। বেশ আরামেই ছিলেম। অন্যান্য ঘরে যারা যারা ছিল, তাদের দু-একজনের সঙ্গে সেইখানে আমার আলাপ হয়, তারাও বাঙ্গালী, কিন্তু বহুদিন পশ্চিমে থাকাতে তারা হিন্দীকথা বেশ শিখেছিল, অবকাশকালে আমিও তাদের কাছে হিন্দীভাষা শিক্ষা কোত্তে আরম্ভ কোল্লেম।

একমাস আমার কাশীবাস হলো। কাশীর মহিমা বিচিত্র। এখানে ভাল মন্দ উভয় শ্রেণীর লোক আছে। ভক্তিযোগে তীর্থবাসী, তেমন লোক অতি কম, নানা লোক নানা ব্যপদেশে কাশীবাস কোচ্ছে; নূতন-পরিচিত লোকগুলির নিকটে যে রকম শুনলেম, তাতে আমার কতক কতক আতঙ্কও হলো, কতক কতক ঘৃণাও জন্মিল।

গৃহস্থলোক ছাড়া উদাসীনলোকের ভক্তি বেশী, এই কথাই লোকে বলে; কিন্তু একমাস কাশীবাস কোরে যত দূর আমি জানলেম, তাতে কোরে সেই সাধারণ উক্তির সার্থকতা আমি স্বীকার কোত্তে পাল্লেম না। দণ্ডী, সন্ন্যাসী, ভৈরবী, ভৈরব, পাণ্ডা প্রভৃতি তীর্থবাসী লোকেরা বাহিরে যে প্রকার ভাব দেখায়, অন্তরের ভাব সে ভাবের সঙ্গে মিলে না, বিপরীতভাবের সুক্ষ্ম পরিচয় বিলক্ষণ প্রাপ্ত হওয়া যায়। রক্তবস্ত্রের পাগড়ী বাঁধা, রক্তবস্ত্র ঢাকা, বাঁশের কঞ্চীর দণ্ড হাতে যে সকল লোক ধ্যানযোগে চক্ষু বুঁজে বিশ্বেশ্বরের মন্দিরে, অন্নপূর্ণার মন্দিরে ধারে ধারে বসে থাকে, এক একবার “বোম কেদার, বোম বিশ্বেশ্বর!” বোলে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে উঠে, পূণ্যসঞ্চয় করবার জন্য যাত্রীলোকেরা নিমন্ত্রণ কোরে, ভক্তিভাবে যাদের ভোজন কোরিয়ে দক্ষিণা দেন, সেই সকল লোকের তীর্থোপাধি দণ্ডী। বিশেষ বিশেষ প্রমাণে আমি জানতে পেরেছি, সেই সকল দণ্ডীর ভিতর দুজন পাঁচজন ছদ্মবেশী গুণ্ডা থাকে। কাশীর গুণ্ডা সৰ্ব্বত্র বিখ্যাত, গুণ্ডার হাতে অসাবধান নূতন যাত্রিদের প্রাণ পর্য্যন্ত সঙ্কটাপন্ন হয়। টাকার লোভে ডাকাতেরা মানুষ মারে, কিন্তু আমি শুনলেম, কাশীর গণ্ডারা একখানি লাল গামছার লোভও সংবরণ কোত্তে পারে না; ‘মারি তো হাতী লুটি তো ভাণ্ডার,’ এই উপদেশ গুণ্ডাদের কাছে অমান্য, অগ্রাহ্য। পথিক যাত্রীলোকের কাছে ধন-দৌলত আছে কি নাই, গুণ্ডারা সেটা আদৌ বিবেচনা করে না, তাগে বাগে পতনে পেলেই রুল কসায়! কেবল মানুষ মারা আর মানুষের অর্থ অপহরণ করা গুণ্ডাদের কার্য্য নয়; দুরন্তলোকেরা বৈরনির্য্যাতনের বাসনায় সঙ্গোপনে গণ্ডা ভাড়া করে, গুণ্ডারা সেই অর্থলোভে নির্দোষ নিরীহ লোকের সৰ্ব্বনাশ কোরে থাকে; জাতিকুল পর্য্যন্ত স্বচ্ছন্দে নষ্ট করে!

অনেক আমি দেখলেম; ভক্ত দেখলেম, দণ্ডী দেখলেম, সন্ন্যাসী দেখলেম, ভৈরবী দেখলেম, কুমারী দেখলেম, ভেকধারী শৈব দেখলেম, গৃহস্থ দেখলেম, তীর্থবাসী দেখলেম, নুতন নুতন যাত্রীও দেখলেম, কিছুই দেখতে বাকী রাখলেম না। পাণ্ডারা তো যাত্রীলোকের নিত্য-সহচর, পাণ্ডা দেখবার জন্য চেষ্টা কোত্তে হয় না, সময় খুঁজতে হয় না, সৰ্ব্বসময়েই পাণ্ডাদের গতিক্রিয়া বিলক্ষণ দেখা যায়। সমস্তই আমি দেখলেম। দিন দিন নূতন নূতন কাণ্ড দেখে, নূতন নূতন গল্প শুনে, শান্তির পরিবর্তে ক্রমশই আমার ঘৃণা ও শঙ্কার মাত্রা বেড়ে বেড়ে উঠলো।

আরও একমাস। এই দুই মাসে এই পূণ্যক্ষেত্রের গূহ্যরহস্য আমি অনেক জানতে পাল্লেম। যে সকল বিদেশী লোক মুক্তিকামনায় কাশীধামে চিরদিন বাস করবার সঙ্কল্প কোরে কাশীবাসী হয়ে আছেন, কাশীতে জীবনান্ত হোলে মোক্ষ হয়, মোক্ষদাতা মহাদেব স্বয়ং মুমূর্ষুর কর্ণমূলে তারকব্রহ্মনাম শুনিয়ে দেন, মৃতজীব শিবত্ব প্রাপ্ত হয়; জীবের দক্ষিণকর্ণে মহেশ্বর তারকব্রহ্মমন্ত্র দেন, এই জন্য যাঁরা যাঁরা কাশীতে মরেন, বিশ্বেশ্বরের কৃপায় মরণকালে তাদের দক্ষিণকর্ণটী উপরদিকে থাকে; কেবল মানুষের নয়, গো, অশ্ব, কুকুর, বিড়াল, গর্দভ ইত্যাদি সমস্ত জীবজন্তুরও ঐ রকম। মরণের স্থানাস্থানও বিচার নাই, অস্তাকুড়ে মৃত্যু হোলেও শিবত্বপ্রাপ্তি নিঃসন্দেহ; এই বিশ্বাসে অনেক লোক কাশীবাসী, তন্মধ্যে বঙ্গবাসীর সংখ্যা কিছু অধিক।

বাসাবাড়ীতে আমি থাকি; বাসার লোকের রীতিচর্য্যা যত দূর পারি, আলোচনা করি, একজনেরও চরিত্রের প্রতি শ্রদ্ধা জন্মে না। যাঁরা যাঁরা পুত্রপরিবার নিয়ে গৃহবাসী হয়ে আছেন, তাঁদের ব্যবহার বাস্তবিক কিরূপ, সেটা আমি ঠিক জানতে পারি না। কত দিন আমি কাশীতে থাকবো, সেটাও নিশ্চয় কোরে বোলতে পারি না। গৃহস্থ-ব্যবহার অবগত হবার নিমিত্ত বড়ই ইচ্ছা হলো; কি প্রকারে কৃতকার্য্য হওয়া যায় তারই উপায়, তারই সুবিধা অন্বেষণ কোত্তে লাগলেম; ঘরে বোসে সে কার্য্য সিদ্ধ হয় না, প্রত্যহ পল্লীতে পল্লীতে পরিভ্রমণ কোত্তে আরম্ভ কোল্লেম।

এখানকার দোকানদারেরা সকলেই খোট্টা, বাঙ্গালী দোকানদার প্রায় একজনও দেখলেম না। খোট্টামহলে বড় বড় গদিয়ান মহাজনও আছে, তারা নানা রকম বড় বড় কারবার করে, কারবারে তাদের বিলক্ষণ লাভও হয়। এক এক দিন আমি এক একজন মহাজনের সঙ্গে সাক্ষাৎ কোরে কারবারের কথা তুলেছিলেম, চাকরীতে আমার প্রবৃত্তি ছিল না, কারবার করবার ইচ্ছা ছিল, সেই জন্য কারবারী লোকের কাছে কারবারের কথা তুলেছিলেম। কত টাকা আমার আছে, একজন মহাজন সেই কথা আমাকে জিজ্ঞাসা কোরেছিলেন, যা আমার সম্বল, সেই কথা আমি বোলেছিলেম, শুনে তিনি হো হো শব্দে হাস্য কোরেছিলেন।

পূর্ব্বে আমি বোলতে ভুলেছি, নৌকাতে মোহনলালবাবু আমাকে যে কখানি নোট দিয়েছিলেন, সে সময় গণনা করা হয় নাই, তার পর গণনা কোরে দেখি, দশখানি; প্রত্যেক নোট ১০০৲ টাকা, দশখানিতে হাজার টাকা। বীরভূমের নরহরিবাবু দিয়েছিলেন ৫০০৲ টাকা, এই হলো দেড় হাজার; তা ছাড়া কলিকাতায় প্রতাপবাবুর বাড়ীতে সাতমাসে জলপানী পেয়েছিলেম ৩৫৲ টাকা, বকসীস পেয়েছিলেম, ৬৫৲ টাকা। এই ষোল-শ টাকার মধ্যে নৌকাভাড়া আর খোরাকী ইত্যাদিতে ৫০৲ টাকা খরচ হয়েছিল, বাকী টাকায় বড় কারবার চলতে পারে না, মহাজনের মুখে শুনে দিনকতক আমি হতাশ হয়েছিলেম। তার পর যে ঘটনা হয়, একটু পরেই প্রকাশ পাবে। এখন নগরভ্রমণের কিঞ্চিৎ ফলাফল প্রকাশ করি।

বাঙ্গালীটোলার প্রায় একক্রোশ দূরে সিক্রোল। সিক্রোলে ইংরেজলোক বাস করেন। কাশীর আদালতগুলি সিক্রোলে অবস্থিত। সেখানকার রাস্তাঘাট প্রশস্ত, দিব্য পরিষ্কার। বাঙ্গালীরা সাহেবলোককে ম্লেচ্ছ বলেন, কিন্তু সাহেবলোকের বাসস্থানগুলি, সাহেবপল্লীর রাস্তাগুলি নিরপেক্ষচক্ষে দর্শন কোল্লে বাঙ্গালীকেই সে অংশে বরং ম্লেচ্ছ বোলে মেনে নিতে হয়। ইংরেজটোলা দেখলেম, ময়দান দেখলেম, উদ্যান দেখলেম, আদালত দেখলেম, অন্তরে আনন্দোদয় হলো। একদিন দেখলেম বরুণা-অসিসঙ্গম। এই দুটী নদী ভাগীরথীর শাখা; এই দুই নদীর নামেই কাশীর দ্বিতীয় নাম বারাণসী।

একদিন দুর্গাবাড়ী দর্শন কোল্লেম। দুর্গাবাড়ীতে দশভুজা দুর্গামূর্ত্তি প্রতিটি নিত্য পূজা হয়, বলিদান হয়, ভোগ হয়, অনেক লোক প্রসাদ পায়। অন্নপূর্ণা-বিশ্বেশ্বরের সন্নিধানে যেমন ষাঁড় অনেক, দুর্গাবাড়ীতে সেইরূপ বানর অনেক। যাত্রীরা দুর্গাবাড়ীতে প্রবেশ করবার সময় সেই সকল বানরকে দুটী দুটী ছোলা দেয়, বানরেরা তুষ্ট থাকে, যাত্রিগুলিকে কিছু বলে না; যারা কিছু খাদ্যসামগ্রী না দেয়, তাদের আঁচড়ায়, কামড়ায়, কাপড় ছিড়ে দেয়, উৎপাত করে। দুর্গাবাড়ীতেও অনেক প্রকার দেবদেবীর প্রতিমূর্ত্তি প্রতিষ্ঠিত আছে। কাশীর বাঙ্গালীটোলায় যাঁরা ছাগমাংসভক্ষণে ইচ্ছা করেন, তাঁরা দুর্গাবাড়ী থেকেই প্রসাদী মাংস আনিয়ে থাকেন।