» » » সপ্তদশ কল্প : লালা বুকচাঁদ

বর্ণাকার

ভূবনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়

হরিদাসের গুপ্তকথা
প্রথম খণ্ড

সপ্তদশ কল্প : লালা বুকচাঁদ

দুর্গাবাড়ী-দর্শনের সাতদিন পরে আপনার বাসাঘরে আমি একাকী বোসে আছি, বেলা অপরাহ্ণ এমন সময় সেইখানে একটী লোক এলেন। দিব্য গৌরবর্ণ, বেশ মোটাসোটা, গায়ে চাপকান, চড়ীদার পায়জামা, কাণে বীরবৌলী, কপালে রক্তচন্দনের দীর্ঘ ফোঁটা, দিব্য কেয়ারীকরা গোঁফ, কাণের দুপাশে ছোট ছোট গালপাট্টা, মাথায় সবুজবৰ্ণ পাগড়ী, বয়স অনুমান ৪০/৪৫ বৎসর। লোকটী এসেই আমারে হিন্দীভাষায় জিজ্ঞাসা কোল্লেন, “সিদ্ধেশ্বর বাবু, কাঁহা?”—আমিও তখন অল্প অল্প হিন্দী শিখেছিলেম, হিন্দীতেই উত্তর কোল্লেম, “আদালতে একটা মামলা আছে, সিক্রোলে গিয়েছেন, ফিরে আসতে সন্ধ্যা হবে; সন্ধ্যার আগেও আসতে পারেন।”

আমার কথা শুনে সিদ্ধেশ্বরবাবুর অপেক্ষায় সেই লোকটী আমার ঘরে আমার কাছেই বোসলেন। কে আমি, কোথা থেকে এসেছি, কতদিন কাশীতে আছি, কাজকর্ম্ম কি করি, লোকটী আমাকে এই সব কথা জিজ্ঞাসা কোত্তে লাগলেন। যেমন যেমন প্রশ্ন, সংক্ষেপে সংক্ষেপে আমি সেই ভাবেই উত্তর দিলেম। কাজকর্ম্ম কিছুই করি না, এই কথা শুনে গম্ভীরভাব ধারণ কোরে লোকটী বোল্লেন, “নিষ্কর্ম্মা বোসে আছ? কাজকর্ম্ম কিছুই নয়? এ কেয়া তাজ্জব কী বাত!”

একটু চুপ কোরে থেকে আমি আবার বোল্লম, “কাজকর্ম্ম কোথাও মিলছে না, নূতন এসেছি, সকলের সঙ্গে জানাশুনা হয় নাই, কোথায় কাজকৰ্ম্ম পাওয়া যায়, তাও ঠিক জানি না, কাজে কাজেই নিষ্কর্ম্মা থাকতে হয়েছে।”

লোকটী আপশোষে করতালি দিয়ে বোল্লেন, “হায় হায় হায়! বাঙ্গালী কেবল চাকরী চাকরী কোরেই হায়রাণ হয়! চাকরী না পেলেই হাত-পা গুটিয়ে জড়ভরত হয়ে বোসে থাকে! এই জন্যই বাঙ্গালীর কপালে ভাল হয় না। কারবারে বাঙ্গালীর মতি নাই, উৎসাহ নাই, সাহস নাই, সেই জন্যই বাঙ্গালী কষ্ট পায়।”

লোকটীর কথায় আমি বড় লজ্জা পেলেম; লজ্জার সঙ্গে একটু উৎসাহও অন্তরে অন্তরে উদয় হলো। যে লোকের সঙ্গে কথা, সে লোক অবশ্যই বাণিজ্যপ্রিয়, বাণিজ্যে লিপ্ত, লক্ষণেও বুঝলেম, কথার ভাবেও বুঝলেম। কারবারে আমারও বিশেষ অনুরাগ, নিরাশ্রয়, নিঃসম্বল, নিঃসহায়, সেই জন্যই সুবিধা ঘটে না। তখন আমার হাতে কিছু টাকা ছিল, উৎসাহে উৎসাহে নম্রস্বরে লোকটীকে আমি বোল্লেম, ‘আমি বাঙ্গালী, আমার সহায়-সম্পদ কিছুই নাই, জানাশুনা আপনার লোক কেহই নাই, তীর্থদর্শনের অভিলাষে কাশীধামে আমার আসা; দাসত্বের প্রতি আমার ঘৃণা আছে; কিন্তু অর্থাভাবে আর পৃষ্ঠপোষক সহায়ের অভাবে কোন কারবারে প্রবৃত্ত হোতে পারি না। কোন সদাশয় ব্যবসায়ী ভদ্রলোক যদি আমার প্রতি দয়া করেন, তা হোলে আমি—”

আমার সকল কথা না শুনেই, একটু মুখ ভারী কোরে, লোকটী একটু থেমে থেমে বোল্লেন, “তাই তো! গোড়ায় কিছু টাকা না থাকলে, কোন কারবারেই সুবিধা ঘটে না, শুন্যভাগী থাকলে এক রকম চোলতে পারে বটে, কিন্তু সে কাজে পরিশ্রম বেশী, দায়িত্বও বেশী; তুমি বালক, ততটা ভারবহন কোত্তে পারবে না। কোন রকমে কিছু টাকা যদি যোগাড় কোতে পার, তা হোলে এক প্রকার উপায় হোতে পারে। আমি কারবারী লোক, কাশী, প্রয়াগ, পঞ্জাব এবং কলিকাতায় আমার নানা রকম কারবার চলে; আমি তোমাকে একজন অংশী কোরে নিতে পারি। এখানে আজ আমি যাঁর তত্ত্বে এসেছি, সেই সিদ্ধেশ্বরবাবু সম্প্রতি আমার একজন অংশী হয়েছেন, মাসে মাসে তাঁর বিলক্ষণ দশ টাকা আয় হোচ্ছে; তুমি যদি সেই রকমে আমার অংশী হোতে পার, তা হোলে তোমারও অল্পশ্রমে অধিক আয় হোতে পারে, সুখে-স্বচ্ছন্দে দিনগুজরাণের সুবিধা হয়।”

একটু পূর্ব্বেই অন্তরে উৎসাহের উদয় হয়েছিল, আরও উৎসাহ পেলেম; আগ্রহে আগ্রহে লোকটীকে আমি বোল্লেম, “কিছু টাকা আমার কাছে আছে, তাতে যদি আপনার অভিপ্রায়মত কার্য্য চলে, তা হোলে—”

এবারেও লোকটী ধৈর্য্য রাখতে পাল্লেন না, আমার অসমাপ্ত বাক্যে বাধা দিয়ে তৎক্ষণাৎ জিজ্ঞাসা কোল্লেন, “কত টাকা?”—আমি উত্তর কোল্লেম, “দেড় হাজার।”

যেন তাচ্ছল্যভাবে একটু মুচকে হেসে লোকটী বোল্লেন, “ছেলেবুদ্ধিতে ছেলেখেলার কথাই আগে যোগায় : দেড় হাজার টাকাতে কি বড় কারবারের অংশী হওয়া যায়? আচ্ছা, বালক তুমি, তোমার কথা শুনে তোমার উপর আমার স্নেহ হোচ্ছে, সেই দেড় হাজার টাকাতেই আপাততঃ আমি তোমাকে কারবারে নামাব; আগামী শুক্রবার বেলা দশটার পর টাকাগুলি নিয়ে আমার কুঠীবাড়ীতে আমার সঙ্গে তুমি সাক্ষাৎ কোরো। সিদ্ধেশ্বরবাবু আমার কুঠীর ঠিকানা জানেন, তাঁকেও আমি বোলে যাব, তিনি তোমাকে সঙ্গে কোরে নিয়ে যাবেন।”

এই সব কথা হোচ্ছে, সিদ্ধেশ্বরবাবু এলেন; মহাজনকে আমার ঘরে দেখে অগ্রে আমার ঘরেই প্রবেশ কোল্লেন। “রাম রাম” নমস্কার বিনিময়ের পর উভয়ে একসঙ্গে পাশের ঘরে চোলে গেলেন; আমার সাক্ষাতে তাঁদের তখন কিছু কথাবার্ত্তা হলো না।

আমি একাকী হোলেম। একাকী হোলেই চিন্তার অবসর ভাল পাওয়া যায়, চিন্তা আমার নিত্য-সহচরী, চিন্তাকে আহ্বান কোল্লেম। চিন্তার সঙ্গেই আমার কথোপকথন। এক বাসায় থাকা, সিদ্ধেশ্বরবাবুর সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল। সিদ্ধেশ্বরবাবু বঙ্গদেশের পূৰ্ব্ব অঞ্চলের লোক, জাতিতে বঙ্গজ কায়স্থ, বয়স অনুমান ৩৫/৩৬ বৎসর; বেশ মিষ্টভাষী, সদালাপী, ব্যবহারে বোধ হয়, উদারপ্রকৃতি; চেহারাও বাবুর মত, পরিচ্ছদগুলিও বাবুর মত, খরচপত্রও বাবুর মত। এক একদিন তিনি আমাকে নিমন্ত্রণ করেন, আমিও মাঝে মাঝে তাঁদের নিমন্ত্রণ করি, অল্পদিনে দুজনে বেশ সদ্ভাব হয়েছিল। তিনি যদি মধ্যবর্ত্তী হয়ে ঐ মহাজনের সঙ্গে আমার মিশ খাইয়ে দেন, তা হোলে ভালই হবে, এইরুপ আশা জন্মিল।

আধঘণ্টা পরে সেই হিন্দুস্থানী মহাজনটী সিদ্ধেশ্বরবাবুর ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন, মুখখানি বেশ প্রফুল্ল প্রফুল্ল দেখলেম, আমার ঘরের চৌকাঠের বাহিরে দাঁড়িয়ে প্রসন্নবদনে বল্লেন, “ঠিকঠাক হয়ে গেল; বাবুকে আমি সব কথা বোলে গেলেম; যেয়ো, মনে রেখো শুক্রবার।”

আমি নমস্কার কোল্লেম, তিনি একবার আপনার কপালের কাছে অঙ্গুলি তুলে চঞ্চলচরণে চোলে গেলেন। আমি উৎকণ্ঠিত হোলেম; কতক্ষণে কাজের কথা শুনবো, সেই উৎকণ্ঠায় ঘরের ভিতর পাইচারী কোত্তে লাগলেম। সিদ্ধেশ্বরবাবু আমার ঘরে আসবেন, সেই সব কথা বোলবেন, অপেক্ষা কোত্তে না পেরে আমি নিজেই তাঁর ঘরে চোলে গেলেম। আমারে দেখেই একটু হেসে মিহি আওয়াজে তিনি বোল্লেন, “কি হরিদাস! কারবার কোরবে? মহাজন হবে?—আচ্ছা, আচ্ছা, বহুৎ আচ্ছা! এই বয়সে তোমার এমন সৎপ্রবৃত্তি হয়েছে, শুনে আমি খুসী হোলেম। শুক্রবার আমি তোমাকে কুঠীতে নিয়ে যাব, যা যা কোত্তে হয়, বন্দোবস্ত কোরে দিব; লোকটী খুব ভাল, তার কারবারে আমিও একজন অংশী, আমাদের সঙ্গে যোগ দিলে তোমার ভালই হবে। মহাজন একটু ‘কিন্তু’ রেখে গিয়েছেন; কম টাকা তোমার, আপাততঃ বেশী লাভ পাবে না। তা হোক, ক্রমশই সুবিধা হয়ে আসবে। মহাপুরুষেরা বলেন, শনৈঃ পৰ্ব্বতলঙ্ঘনম্।”

যে কথায় যে উত্তর দিতে হয়, সেইভাবে সকল কথার আমি উত্তর কোল্লেম; কথাপ্রসঙ্গে আরও পাঁচরকম কথা এসে পোড়লো, কথায় কথায় জানলেম, সেই মহাজনটীর নাম লালা বুলকচাঁদ।

রাত্রি ছয় দণ্ডের সময় আমি আপনার ঘরে এলেম, আহারাদি কোরে যথাসময়ে শয়ন কোল্লেম, শীঘ্র নিদ্রা এলো না। ভাবনার সঙ্গে নিদ্রার বড় বিরোধ। সুভাবনাতেও শীঘ্র নিদ্রা আসে না, কুভাবনাতেও আসে না। দুর্ভাবনা আমি অনেক ভেবেছি, ভাবনার আগুনে চিত্ত আমার অহরহঃ পুড়ে পুড়ে গিয়েছে, আজ রাত্রের ভাবনাটী কিছু শুভ। বিদ্যাশিক্ষার অগ্রে এদেশের শিশুদের যেমন হাতে-খড়ি হয়, আমারও সেইরূপ কারবারে হাতেখড়ি; বাণিজ্য-লক্ষ্মীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হবে; অল্প টাকায় একটা বড় কারবারের অংশী হব; কাশীর একজন বড় মহাজনকে বন্ধু পাব; হৃদয়ে পরমানন্দ। সংসারে থাকতে গেলে টাকার সঙ্গে বন্ধুত্ব রাখতে হয়;—চিরদিন আমি গরিব, টাকার মুখ আমি কখনো দেখি নাই; আমার হাতে এখন দেড় হাজার টাকা। বড়লোকের হস্তে দানপ্রাপ্তি। দাতা হেলেন নরহরিবাবু আর মোহনলালবাবু। মনে মনে তাঁদের উভয়কে নমস্কার কোরে আপনাকে আপনি কৃতার্থ বোধ কোল্লেম। এই ভাবে থাকতে থাকতে নিদ্রা এলো, আমি ঘুমালেম। অনেক দিনের পর কাশীধামে এই রাত্রে আমার সুখের নিদ্রা। আজ আমার প্রতি নিদ্রাদেবীর বড়ই অনুগ্রহ।

সুখের রজনী সুপ্রভাত। কাশীর প্রভাত আনন্দময়। ভক্তের মুখে ঘন ঘন অন্নপূর্ণা-বিশ্বেশ্বরের নাম, গঙ্গাস্নানের যাত্রীর মুখে গঙ্গাদেবীর স্তব, দণ্ডী-সন্ন্যাসীর মুখে বম বম বববম শ্রীমধুরধনি, ভক্তমাত্রেই পূজার আয়োজন ভক্তিমান। আমিও গঙ্গাস্নান কোল্লেম, আমিও দেবদেবী দর্শন কোল্লেম, আমিও জয় বিশ্বেশ্বর জয় অন্নপূর্ণা গান কোল্লেম; হৃদয়ে ভক্তি-সিন্ধু উথলিল। আমার ভক্তিদর্শনে আকাশে সূর্য্যদেব মৃদু মৃদু হাস্য কোল্লেন। শীতকালে সূর্যের হাস্য মৃদু হয়, বিশেষতঃ প্রভাতে; অতএব আমি সূৰ্য্যমণ্ডলে মৃদুহাস্য দর্শন কোল্লেম।

আজ মঙ্গলবার। তিন দিন পরে বুলকচাঁদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবার দিনস্থির। বঙ্গদেশে শারদীয়া মহামায়ার আগমনে ভক্তজনের তিনটী দিন যেমন শীঘ্র শীঘ্র চোলে যায়, আমারও এই তিনটী দিন—মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি, এই তিনটী দিন সেইরুপ শীঘ্র শীঘ্ন চোলে গেল। শুক্রবারের প্রভাত। সকাল সকাল স্নান-আহার সমাপন কোরে, সঞ্চিত ব্যাঙ্কনোটগুলি সঙ্গে নিয়ে একখানি এক্কাগাড়ী ভাড়া কোরে, সিদ্ধেশ্বরবাবুর সঙ্গে আমি বুলকচাঁদের কুঠীতে উপস্থিত হোলেম। মস্ত একখানা বাড়ী। লোকজন অনেক যাওয়া আসা কোচ্ছে, অনেক লোকের মুখে অনেক রকম কথা, সমস্ত লোক হিন্দুস্থানী, একখানি বাঙ্গালীর মুখও দেখতে পেলেম না। নীচের তালায় ছোট একটী ঘরে আমারে বোসিয়ে, সম্মুখে হস্তবিস্তার কোরে সিদ্ধেশ্বরবাবু বোল্লেন, “কৈ তোমার টাকা? দাও, টাকাগুলি আমার হাতে দাও, খাতায় জমা দিয়ে একটু পরেই রসীদ এনে দিচ্ছি। কোথাও তুমি যেয়ো না, কাকেও কিছু, বোলো না, চুপ কোরে বোসে থাকো, কেহ যদি জিজ্ঞাসা করে, আমার নাম কোরো না; শীঘ্রই আমি ফিরে আসছি।”

বাবুর হস্তে ১৫ খানি নোট সমর্পণ কোরে, উপদেশমত চুপটী কোরে, সেই ঘরে আমি বোসে থাকলেম। বাবু অন্যদিকে চোলে গেলেন। যে ঘরে আমি বোসলেম, সে ঘরে তখন একটীমাত্র লোক ছিল, দেখতে দেখতে আরও পাঁচ সাতজন এসে সেইখানে গোলমাল কোত্তে লাগলো। সকলেই হিন্দুস্থানী; প্রায় সকলেই চাপকানপরা, পাগড়ী বাঁধা, দুই একজনের খালি গা। তাদের কথাবার্ত্তা শুনে লক্ষণটা বড় ভাল বোধ হলো না। তিন চারিজন ভুড়িওয়ালা লোক সেইখানে বোসে বাসে গাঁজা সেজে খেলে, রকমারিস্বরে উচ্চ উচ্চ আওয়াজে গান ধোল্লে, এক একবার বম মহেশ্বর বোলে হেসে উঠলো। আমি অবাক! প্রায় এক ঘণ্টা বোসে আছি, সিদ্ধেশ্বরবাবু ফেরেন না, দেড়ঘণ্টা হয়, তখনো আসেন না; দশটার সময় এসেছিলেম, দু-ঘণ্টা অতীত হলো, বারোটা বেজে গেল, তখনো পর্য্যন্ত দেখা নাই! বড়ই অস্থির হোলেম। একবার ভাবলেম, উঠে গিয়ে তত্ত্ব নিয়ে আসি, আবার ভাবলেম, উঠে যেতে বারণ, বিশেষতঃ কোন দিকের কোন ঘরে তাঁরা আছেন, উপরে কি নীচে, তাও ঠিক জানি না, কোথায় গিয়ে অন্বেষণ কোরবো, খুঁজেই হয় তো পাব না; এই সব আলোচনা কোরে সেখান থেকে উঠলেম না, সমভাবেই বোসে থাকলেম। মন কিন্তু ক্রমশই চঞ্চল।

নীরবে একধারে আমি বেসে আছি, লোকেরা হয় তো এতক্ষণ আমাকে দেখতে পায় নাই, আপনাদের আমোদেই—আপনাদের কথাতেই আপনারা মত্ত ছিল, দেখেও হয় তো দেখে নাই, এই সময় হঠাৎ একজন ভুড়িওয়ালা লোক আমার দিকে এগিয়ে এসে, কটমটচক্ষে চেয়ে, গর্জ্জন কোরে বোল্লে, “তুই ছোঁড়া কে রে? এখানে বোসে বোসে তুই কি কোচ্ছিস? উঠে যা! দূর হয়ে যা! আমাদের ঘরে তোর কি দরকার? কোথাকার পাপ! দূর হয়ে যা!”

লোকটার গভীরগর্জ্জনে আমার সৰ্ব্বাঙ্গ কেঁপে উঠলো; মনেও বড় ভয় হলো; ভয়ে ভয়ে বিনম্রস্বরে বোল্লেম, “আমি একটী বাবুর সঙ্গে এসেছি, বুলকচাঁদ মহাজনের কাছে আমাদের বিষয়কর্মের কথা আছে, বাবু আমাকে এইখানে রেখে তাঁর সঙ্গে দেখা কোত্তে গিয়েছেন, এখনি আসবেন, তিনি এলেই—”

লোকটা অকস্মাৎ রেগে উঠে, এক হ্যাঁচকাটানে আমার হাত ধোরে তুলে, রক্তচক্ষু পাকল কোরে, ঘড়ি বেঁকিয়ে, আরও অধিকগর্জ্জনে বোলতে লাগলো, “দূর হয়ে যা! কোথাকার বাবু? কোথাকার বুলকচাঁদ? এখানে তারা থাকে না। এটা আমাদের বাড়ী, আমাদের ঘর, আমরাই এখানকার কর্ত্তা, বুলকচাঁদ ফুলকচাঁদকে আমরা চিনি না, কোথাকার কে তুই, এখনি বেরিয়ে যা! সহজে না গেলে ধাক্কা দিয়ে বাহির কোরবো, ঘুষী মেরে মুণ্ড ঘুরিয়ে দেবো!” এই সব কথা বোলতে বোলতে সেই লোক আমাকে জোরে জোরে ঠেলে ঠেলে দরজা পৰ্য্যত নিয়ে এলো; যে কথা আমি বোলছিলেম, তা আর বোলতে দিলে না; তার সঙ্গীলোকেরাও সেই রকম গর্জ্জন কোত্তে কোত্তে তার সঙ্গে এসে যোগ দিলে।

আমি ঠক ঠক কোরে কাঁপতে লাগলেম। কোন কথাই তারা শুনে না, কোন কথাই বোলতে দেয় না, কেবল রেগে রেগে আমাকে গালাগালি দেয় আর জোরে জোরে ধাক্কা মারে! কিছুই শুনে না, তথাপি আমি বার বার মিনতি কোরে বোলতে লাগলেম, “কেন তোমরা আমাকে মারো? কেন আমাকে তাড়িয়ে দাও? কোন দোষ আমি করি নাই, বুলকচাঁদবাবুর কুঠী, সিদ্ধেশ্বরবাবু আমাকে এনেছেন, তোমরা দয়া কর, সিদ্ধেশ্বরবাবু এলেই আমি বেরিয়ে যাব, আর এক মুহূর্ত্তও এখানে থাকবো না।

দলের ভিতর একজন কিছু ভালমানুষ ছিল, সেই লোকটী ঐ দুরন্ত লোকগুলাকে একটু থামিয়ে, আমার মুখে সমস্ত বৃত্তান্ত শ্রবণ কোল্লে। শুনে তার যেন কিছু কষ্ট বোধ হলো; আমাকে একটু সোরিয়ে এনে দুঃখ প্রকাশ কোরে বোল্লে, “সব ফক্কিকার! সমস্তই মিথ্যা! এ বাড়ী বুলকচাঁদের নয়, কোন কারবারের কুঠী-বাড়ীও নয়, বুলকচাঁদ নামে কোন মহাজনও এ সহরে নাই, এ বাড়ীটা সৌখীনলোকের খেলাঘর; দিবারাত্রি এখানে জুয়াখেলা হয়; একটা লোক এখানে মাঝে মাঝে আসে বটে, তার নাম বুলকচাঁদ; সে লোকটা জুয়াড়িদলের একজন দালাল; নিজেও একজন জুয়াড়ী : তুখোড় জয়াড়ী; পাড়ায় পাড়ায় ঘরে ঘরে নূতন নূতন শীকার ধোরে আনে; তোমার মতন ছোকরা শীকার তার হাতে প্রায়ই পড়ে। কেন তুমি তার সঙ্গে মিশতে গিয়েছিলে? কেন তার সাক্ষাতে টাকার কথা বোলেছিলে? টাকার কথা বলাতেই তোমার এই দশা ঘেটেছে! টাকাগুলি তোমার গিয়েছে! ধড়ীবাজ বূলকের খর্পরে পোড়েছে, আর উদ্ধার হবে না! তুমি ঘরে যাও! ঘরে গিয়ে বোসে বোসে কাঁদো! একটা বাঙ্গালী সেই বুলকের সঙ্গে আসে বটে, সেটাও বুলকের পেটাও দালাল; তারা দুজনে মিলে তোমার টাকাগুলি ফাঁকী দিয়েছে। আর কেন এখানে বৃথা কষ্ট পাও? বিদায় হও! সন্ধ্যা হোলেই বিপদ ঘোটবে!”

আমি কেঁদে ফেল্লেম। দারুণ শীতেও দরদরধারে আমার অঙ্গে ঘাম ঝরতে লাগলো, পিপাসায় কণ্ঠ শুষ্ক হয়ে এলো, লোকেরা আমার ধোরে রেখেছিল, ঘরের বাহির কোরে দিয়ে যখন হাত ছেড়ে দিলে, তখন আমি কাঁপতে কাঁপতে একখানা পাথরের উপর বোসে পোড়লেম। যে লোকটী মিষ্টকথা বোলেছিল, মিষ্টকথায় প্রবোধ দিয়ে হতাশ কোরে দিয়েছিল, কেঁদে সে লোকটীর পায়ে ধোরে কাতরবচনে বোল্লেম, “সিদ্ধেশ্বরবাবু গেল কোথা? টাকা পাই না পাই, একবার তার সঙ্গে দেখা কোরে যাওয়া আমার ইচ্ছা। বুলকচাঁদ কি এখন এ বাড়ীতে আছে? আপনি যদি দয়া কোরে একবার সংবাদ দেন কিম্বা আমারে সঙ্গে কোরে তাদের কাছে নিয়ে যান, তা হোলে চক্ষের জলে আমি তাদের পাষাণ-অঙ্গ অভিষিক্ত কোরে আসি!

যখন ১২টা বেজেছিল, তখন আমার জ্ঞান ছিল, তার পর খোট্টাদের হুড়াহুড়িতে, চীৎকারধ্বনিতে, ধমকানীতে আমি এক প্রকার জ্ঞানশূন্য হয়েছিলেম; যখন শুনলেম, জুয়ার আড্ডা, যখন শুনলেম, আমার টাকাগুলি জুয়াচোরে ফাঁকী দিলে, তখন আমি পাগল হয়েছিলেম; বেলা শেষ হয়ে এসেছিল, সূৰ্য্যদেব অস্তে যাচ্ছিলেন, কিছুই জানতে পারি নাই; সন্ধ্যা হয়, সিদ্ধেশ্বর এলো না, তখন নিশ্চয় বুঝলেম, জুয়ারীই হোক, গাঁজাখোরই হোক, যে সব কথা এরা বোল্লে, সমস্তই সত্য। যে লোকটীকে শেষের কথাগুলি আমি বোল্লেম, বড় একটা হাই তুলে, সহানুভূতি জানিয়ে, সেই লোকটী বল্লে, “হায় হায়! ছেলেমানুষ, ছেলেবুদ্ধি, এখনও দেখা করবার ইচ্ছা! হায় হায়! এ বাড়ীটার চারিদিকে চারিটা দরজা। কে কখন কোন দিক দিয়ে আসে, কোন দিক দিয়ে যায়, কেহই জানতে পারে না। যার সঙ্গে তুমি এসেছ বোলছো, সে লোক কখন কোন দরজা দিয়ে পালিয়ে গিয়েছে, কে তার সন্ধান কোরবে? বুলকচাঁদের কথা। বুলকচাঁদ দিনমানে আসে না, রাত্রে আসে; তাও আবার ঠিক নাই, সকল রাত্রে দেখা দেয় না। আজ একটা শীকার কোরেছে,—একটা কি কটা, তারাই জানে, কি কোরে বলা যাবে, শীকার যখন কোরেছে, তখন আজ আর এখানে তাদের পদাপর্ণ হবে কি না, সে পক্ষে সম্পূর্ণই সন্দেহ। তুমি ঘরে যাও। তাদের সঙ্গে আজ আর তোমার দেখাসাক্ষাৎ হবে না!”

হতাশ হয়ে কাঁদতে কাঁদতে আমি বাসাবাড়ীতে ফিরে চোল্লেম। আর তখন এক্কাগাড়ীর ভাড়া জুটলো না, সন্ধ্যাকালে পদব্রজেই চোল্লেম। তখনো আমার মনে মনে আশা, সিদ্ধেশ্বরকে পাওয়া যাবে। এক বাড়ীতেই থাকা হয়, বাসা ছেড়ে কোথায় পালাবে। সিদ্ধেশ্বরকে পাওয়া গেলেই টাকার কিনারা হোতে পারে। বুলকচাঁদকে দরকার নাই। সিদ্ধেশ্বরের হাতেই আমি টাকা দিয়েছি, সিদ্ধেশ্বরকে পেলেই হয় তো টাকা পাব। আকাশ-কুসুম আশা আমাকে তখন ঐ কথাই বোলে দিলে। হতাশ প্রাণের চমৎকার সান্ত্বনা! আশাকে লোকে নিন্দা করে, কিন্তু আমি তো বলি, আশাদেবী করুণাময়ী। আশা যাদের সফল হয় না, তারাই বলে, আশা পিশাচী। সফল বিফল উভয় অবস্থাতেই আশাকে আমি দেবী-কল্পনায় পূজা করি। আশাদেবী সংসারে কত শত লোককে নিতান্ত দুঃসময়েও প্রাণে বাঁচিয়ে রাখেন, মহাশোকেও প্রবোধ দান করেন; এমন উপকারিণী আশাকে পিশাচী বলা অধর্মের কথা।

আশাকে সহচরী কোরে বাসায় এসে আমি পৌঁছিলেম। অগ্রেই সিদ্ধেশ্বরাবাবু ঘরে। ঘর পরিষ্কার। একগাছি ঝাঁটা পর্য্যন্তও ঘরে নাই। সমস্ত আসবাবপত্র তিরোহিত! এ কার্য্য কখন হলো? আমাকে সঙ্গে কোরে সিদ্বেশ্বর আজ সকালে যখন এক্কায় আরোহণ করে, তখন কি ঘরের জিনিস ঘরে ছিল না? না থাকাই সম্ভব? সোমবার রাত্রে বুলকচাঁদের আবির্ভাব হয়েছিল, আমার কাছে টাকা পাবার পরামর্শও সোমবারে, সুতরাং মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি তিন দিন সময় ছিল; সেই তিন দিনের ভিতরেই সিদ্ধেশ্বর আপন অভিসন্ধি সিদ্ধ কোরে নিয়েছে, বাসার সমস্ত জিনিসপত্র সোরিয়ে ফেলেছে, বাড়ীওয়ালাকে ফাঁকী দিয়েছে, আমার তো একেবারেই সৰ্ব্বনাশ! আমি এখন যে ফকির, সেই ফকির! আবার আমি পথে দাঁড়ালেম! ঐ দেড় হাজারের উপর যা কিছু ছিল, কলিকাতা থেকে কাশীতে পৌঁছিবার নৌকাভাড়া আর কাশীর খরচপত্র সমস্তই ফুরিয়ে গিয়েছে, দু-একটী টাকা সম্বল থাকা সম্ভব, কিন্তু তাতেই বা কি হবে? বাসার জিনিসপত্র বিক্রয় কোল্লে নগদ কিছু পাওয়া যায়, কিন্তু তা হোলেই বা থাকি কিরূপে? ঘর রাখতে পারবো না; কোথা থেকে ভাড়া দিব? ঘর না থাকলে জিনিসপত্রই বা থাকে কোথা? বিধাতা আমার ভাগ্যে এক আঁচোড়ে যা কিছু লিখে দিয়েছেন, শিশুকাল থেকেই সেই সকল ফল ফলে আসছে! চিরজীবন আমি নিরাশ্রয়—নিঃসম্বল! বিধাতার লিখন কখনো কি খণ্ডন হোতে পারে? দুটী দাতালোক দয়া কোরে এই অভাগারে দেড় সহস্র মুদ্রা প্রদান কোরেছিলেন, অভাগার কাছে সে দেড় সহস্র কত দিন থাকতে পারে?—ভোগেও এলো না, খরচও কোল্লেম না, কোন সংকার্য্যে এক পয়সা দানও কোল্লেম না; জুয়াচোরে ঠকিয়ে নিলে। এখন যাই কোথা? থাকি কোথা? খাই কি?

লালা বুলকচাঁদ! উঃ! কি ভয়ঙ্কর লোক! মহাজন সেজে দেখা দিলে, সিদ্ধেশ্বরের সঙ্গে আলাপ, এই পরিচয় দিলে, সিদ্ধেশ্বর তার কারবারের একজন অংশী, আমিও একজন অংশী হব, কতই যেন ভালমানুষ হয়ে, কতই যেন উপকারী বন্ধু সেজে, আমারে এই রকম আশ্বাস দিলে, শেষকালে কি না, আমারে এক কালে পথের ভিকারী কোরে ছেড়ে দিলে! লালা বুলকচাঁদ! নামটাও শুনতে ভয়ঙ্কর! বোধ হয়, ওটা তার সত্যনাম নয়; যেরুপ স্বভাবের লোক, তাতে কোরে সে লোক যে সত্যনামে পরিচয় দেবে, এমন তো মনে লয় না, বুলকচাঁদ নামটা হয় তো জালনাম! লালা বুলকচাঁদ নানা স্থানের বড় বড় কুঠীর বড় মহাজন! উঃ! ভয়ানক বাটপাড়! কাশীর জুয়ার আড্ডার দালাল! আমার মত হতভাগা ভালমানুষ পেলেই দালাল-গিরীর চড়ান্ত পরিচয় দেয়। ভারী তুখোড় লোক! এত বড় সহরের ভিতর এত বড় জুয়ারী-ব্যবসা চালায়, অবাধে স্বচ্ছন্দে চালায়, কেহই ধরে না, কেহই কিছু বলে না, শান্তিরক্ষক নামে যাদের পরিচয়, তারাও এই রকম লোকের সঙ্গে বন্ধুত্ব রাখে, অসাধারণ আশ্চর্য্য ব্যাপার!

বড় বড় জুয়ারীতে—বড় বড় জুয়োচুরি-শীকারে এক একটা ঘাই থাকা দরকার! কাশীতে বুলকচাঁদের কারবারে ঘাই ছিল সিদ্ধেশ্বর। একটা সিদ্ধেশ্বর অথবা বেশী সিদ্ধেশ্বর, সে কথা প্রকাশ পেলে না, কিন্তু বেশী থাকাই সম্ভব। থাকে থাকুক, সে সকল গণনা করা আমার কাৰ্য্য নয়, কিন্তু সিদ্ধেশ্বরটা গেল কোথায়? কাশী ছেড়ে কোথাও যাবে না, এমন মজা কোথাও পাবে না, আমাকে ভিকারী কোরে, একটা আস্তানা ছেড়ে, আর একটা নতুন আস্তানায় ভর কোরেছে, ইহাই নিশ্চয়। যেখানে বুলকচাঁদ, সেইখানেই সিদ্ধেশ্বর, ইহাও নিশ্চয়। দুজনের চেহারা মনে রেখে, মনের কষ্টে অনাহারে সেই বাসাতেই আমি নিশাযাপন কোল্লেম। থেকে থেকে জুয়াচোরের কথাই মনে পড়ে, নিদ্রা আসে না, নিদ্রা এলো না, জাগরণেই রজনীপ্রভাত।