ভূবনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়
হরিদাসের গুপ্তকথাপ্রথম খণ্ড
অষ্টাদশ কল্প : এরাই কি তীর্থবাসী?
আজ শনিবার। নিয়মমত গঙ্গাস্নান কোল্লেম, দেবদর্শন কোল্লেম, মনের দুঃখে আহার কোল্লেম না; অন্নপূর্ণা-পুরীতে আমি উপবাসী থাকলেম! বাসাঘরে চাবী দিয়ে, রাস্তায় বেরিয়ে, মন্দিরের দিকে চেয়ে, করযোড়ে জগন্মাতার উদ্দেশে সাশ্রু-লোচনে ডাকলেম, “মা অন্নপূর্ণে! শিব যখন ত্রিভুবনপরিভ্রমণ কোরে কোথাও কিছু ভিক্ষা পান নাই, এই কাশীধামে অন্নপূর্ণারূপিণী হয়ে, তুমি তখন ক্ষুধাতুর বিশ্বনাথকে অন্নদান কোরেছিলে মা! আজ আমি এই ক্ষুদ্র জীব, তোমার এই পূণ্যক্ষেত্রে উপবাসী রয়েছি, আমার প্রতি মা তোমার দয়া হলো না।”—তারস্বরে অন্নপূর্ণাকে ডাকলেম আর এই কথাগুলি বোল্লেম। মা অবশ্যই আমার কাতরোক্তি শুনলেন, কিন্তু উত্তর দিলেন না। আমার শুনা ছিল, কাশীতে কেহ উপবাসী থাকে না; পুরীমধ্যে অথবা অন্নছত্র অথবা গৃহস্থের দ্বারে উপস্থিত হোলেই উদর পূর্ণ হয়। শুনা ছিল বটে, কিন্তু সেরূপ চেষ্টা কিছুই কোল্লেম না; কিছুই ভাল লাগলো না; ভবিষ্যৎ-ভাবনায় ক্ষুধা-তৃষ্ণাও যেন উড়ে গেল; পথে পথেই বেড়াতে লাগলেম। অন্যমনস্ক, কোথায় কি হোচ্ছে, কোন দিক দিয়ে কারা সব চোলে চোলে যাচ্ছে, কোন দিকে কি কলরব হোচ্ছে, কোন দিকে চক্ষুও নাই, কোন দিকে কর্ণও নাই; বরাবর সিক্রোলের দিকে চোলে যাচ্ছি। এক একবার সূর্য্যপানে চেয়ে দেখছি, সূৰ্য্যও যেন আমার সঙ্গে সঙ্গে চোলেছেন, এইখানে বোধ হোচ্ছে। আমার কষ্ট দেখে দেখে দেব দিবাকর ক্রমশঃ রক্তবর্ণ ধারণ কোল্লেন, আর কষ্ট দেখতে পারেন না বোলেই যেন পশ্চিমাচলের অন্তরাল লুক্কায়িত হবার উপক্রম কোল্লেন। আমি তখন অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে একটা বৃক্ষতলে বোসে পোড়লেম। বেলা অবসান, সন্ধ্যা প্রায় সমাগত, দিনমানে বরং অধিক ভাবনা ছিল না, রাত্রিকালে কি হবে, কোথায় খাব, বাসাবাড়ী চাবী দেওয়া আছে, সেখানে ফিরে গিয়েই বা কি কোরবো, দ্বিতীয় প্রভাতেই বা কি উপায় হবে, বাসাঘরের ভাড়াই বা কোথা থেকে শোধ দিব, কি ভরসাতেই বা বাসা রাখবো, এই সকল ভাবনাতেই প্রাণ আকুল! ভাবনা-সাগরের পার নাই! অকুলপাথার ভাবনা!
রাস্তার দিকে চেয়ে বেসে আছি, বাঙ্গালীটোলার যে সকল ভদ্রসন্তান সিক্রোলে চাকরী করেন, তাঁরা সব দলে দলে ঘরে ফিরে আসছেন, আমোদপ্রমোদে পরপর কত রকম গল্প কোচ্ছেন, কেহই আমার দিকে ফিরে চাইলেন না; অদৃষ্ট যার বিগুণ, তার প্রতি সকলেই বুঝি নিষ্ঠুর, এই ভাবনাই তখন আমার মনে উদয় হলো। ঠিক ভাবলেম, কি ভুল ভাবলেম, মনের আবেগে সেটা তখন বুঝতেই পাল্লেম না। ইচ্ছা ছিল না কাঁদবার, তবু কেন জানি না, আপনা হোতেই চক্ষু-দুটী অশ্রুপর্ণ হয়ে এলো, গণ্ডস্থল প্লাবিত কোরে অশ্রুধারা প্রবাহিত হলো; উদাস অন্তরে এক জায়গায় বোসে বোসেই আমি কাঁদলেম। আমার চক্ষের জল তখন কেহই দেখলে না।
সম্মুখ দিয়ে অনেক লোক চোলে গেল, দুই একজন এক একবার আমার দিকে চেয়ে; চেয়ে দেখলেম, তামাসা মনে কোরে কেহ কেহ হাসলে, কেহ কেহ গম্ভীরভাব ধারণ কোরে মুখ ফিরালে। আমার দুঃখে কেহ দুঃখিত হলো কিম্বা কারো প্রাণে দয়া এলো, এমন লক্ষণ কিছুই বুঝা গেল না।
সন্ধ্যা হয়। ক্রমশই লোকজনের চলাচল কম। আমি তখন সেখান থেকে উঠে আসি আসি মনে কোচ্ছি, এমন সময় একটী বাবু এসে আমার সম্মুখে দাঁড়ালেন। মুখ তুলে চেয়ে দেখি, দিব্য সুশ্ৰী পুরুষ, দিব্য পরিচ্ছদ পরিধান, মুখে যেন স্বাভাবিক দয়ামায়া সমঙ্কিত। কি জানি, কার উপদেশে দর্শনমাত্রই সেই বাবুটীর প্রতি আমার ভক্তির সঞ্চার হলো। বাবুর সঙ্গে কেহই ছিল না, তিনি একাকী। পথের ধারে একাকী বোসে আমি রোদন কোচ্ছি, তাই দেখে যেন কাতর হয়ে স্নিগ্ধস্বরে তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা কোল্লেন, “বালক! তুমি কে? কোথা থেকে এসেছ? পথে বোসে এমন কোরে কাঁদছো কেন? তোমার হয়েছে কি?”
দুই হস্তে নেত্রমার্জ্জন কোরে তৎক্ষণাৎ আমি উঠে দাঁড়ালেম। উত্তর আমার মুখস্থই ছিল, যত সংক্ষেপে পাল্লেম, আত্মপরিচয় নিবেদন কোল্লেম। পরিচয় কিছুই নয়, পরিচয় আমি জানিই বা কি, বাল্যজীবনের বড় বড় ঘটনাগুলি এক এক কোরে তাঁরে জানালেম; শেষের সম্বল গত কল্য জুয়াচোরে ঠকিয়ে নিয়েছে, সেই কথাটী বোলে তাঁর মুখপানে চেয়ে রইলেম; সেই সময় আমার চক্ষে পুনরায় দরবিগলিত অশ্রুধারা!
শিবনেত্রে আমার আপাদমস্তক নিরীক্ষণ কোরে মিষ্ট-মিষ্ট-বাক্যে বাবু বোল্লেন, “হায় হায়! এমন ঘটনা হয়েছে। কাশীর লোক যে কোন ভাবে চলে, সহজে বুঝে উঠা অত্যন্ত কঠিন। অচেনা লোককে ততটা বিশ্বাস করা তোমার ভাল হয় নাই। আচ্ছা, যা হবার, হয়ে গিয়েছে, জুয়াচোরে নিয়েছে, সে টাকা আর পাওয়া যাবে না। তুমি আমার সঙ্গে এসো, এখানে আমার বাড়ী আছে, পরিবারলোকজন সব এইখানে, আমার বাড়ীতেই তুমি থাকবে, কোন কষ্ট হবে না, যাতে তোমার ভাল হয়, আমি চেষ্টা পাব। বাসাটা ছেড়ে দাও, বৃথা কেন একটা ঝঞ্ঝাট বাড়ানো? খরচপত্রেরও অভাব। আপাততঃ আমি তোমাকে কিছু টাকা দিব, কল্য প্রাতঃকালেই বাড়ীভাড়া চুকিয়ে দিয়ে পরিষ্কার হয়ে বেরিয়ে এসো। এখন চল আমার সঙ্গে।”
আমি যেন হাতে স্বর্গ পেলেম। তাদৃশ বিপদে যিনি অভয় দেন, যিনি আশ্রয় দেন, তিনি পিতৃতুল্য; পিতৃজ্ঞানে বাবুকে প্রণাম কোরে, আমি তাঁর সঙ্গে সঙ্গে চোল্লেম।
মহল্লা সোণাপুর, দিব্য একখানি বাড়ী; তেতালা চকবন্দী। পাথরের বাড়ী, এ কথা বলাই বাহুল্য। বাড়ী দু-মহল। বাবু আমাকে সদরবাড়ীর একটী ঘরে বসিয়ে, একজন চাকরকে যথাকৰ্ত্তব্য উপদেশ দিয়ে, বাড়ীর ভিতর চোলে গেলেন; আমাকে বোলে গেলেন, “বোস হরিদাস, শীঘ্রই আমি আসছি।”—আমি বোসে থাকলেম। একটু পরে সেই চাকর এক গাড়ু জল, একখানি গামছা, একখানি কাপড় আর কিছু জলখাবার এনে দিলে, হাত-পা ধুয়ে কাপড় ছেড়ে আমি জল খেলেম; শরীরটা অনেক সুস্থ বোধ হলো।
প্রায় আধঘণ্টা পরে বাবু বৈঠকখানায় এসে বোসলেন, পাঁচ হাত তফাতে একটু জড়সড় হয়ে আমি বোসে থাকলেম। বাবু জিজ্ঞাসা কোল্লেন, “তোমার নামটী আমি শুনেছি, কিন্তু তোমার জাতি কি?”—এইবার বিষম বিভ্রাট! জাতি-জন্ম কিছুই আমি জানি না, বলি কি। একটা কথা স্মরণ হলো। মোহনলালবাবু বলেছে, অমরকুমারীর সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়েছে; অমরকুমারী রক্তদন্তের কন্যা; রক্তদন্ত বলে, সে আমার মামা হয়; মোহনলালবাবু কায়স্থ, তিনি অবশ্যই স্বজাতির কন্যাকেই বিবাহ কোরেছেন, তবেই বুঝে নিতে হলো, চেহারায় রাক্ষস-বানরের মত হোলেও জাতিতে রক্তদন্তটা কায়স্থ; মামা যদি কায়স্থ, তবে আমিও অবশ্য কায়স্থ; এই সিদ্ধান্তে উপস্থিত হয়ে সেই ভাবেই আমি উত্তর কোল্লেম। বাবুর মুখখানি বেশ প্রসন্ন হলো। রাত্রি প্রায় দশটা পর্য্যন্ত বাবুর সঙ্গে আমি অনেক রকম গল্প কোল্লেম; ভূতপ্রেতের গল্প নয়, রাক্ষসপিশাচের গল্প নয়, রাজপুত্র-কোটালের পত্রের রুপকথা নয়, আমিই আমার গল্প। পথে তাড়াতাড়ি গোটাকতক কথা বোলেছিলেম, এই সময় আমূল-বৃত্তান্ত দস্তুরমত বর্ণনা কোল্লেম। স্থির হয়ে শুনে শুনে বাবু মহা বিস্ময়াপন্ন হোলেন; পুনরায় আশ্বাস দিয়ে, অভয় দিয়ে, আমার ভাল করবার অঙ্গীকার কোল্লেন।
অনিশ্চিত জাতির পরিচয় যা-ই হোক, বাড়ীতে পাঁচক ব্রাহ্মণ ছিল, আহারে দ্বিধা থাকলো না, একসঙ্গে আহারাদি কোল্লেম, পরিতোষরুপে ভোজন করা হলো। বৈঠকখানার একটী নির্দ্দিষ্ট কক্ষে আমি শয়ন কোল্লেম। কখনই আমি চিন্তাশূন্য থাকি না, বিশেষতঃ সেই দিন আমার টাকাগুলি জুয়াচোরে নিয়েছে, পূর্ব্বে অত টাকা দেখি নাই, দাতালোকে দিয়েছিলেন, সেইগুলি গেল, বড়ই কাতর হোলেম।
নিরুপায়! এখন এই নূতন আশ্রয়ে যদি কিছু সুবিধা হয়, আবার আমি টাকার মুখ দেখবো, ভবিষ্যৎ আশায় আপনা আপনি এইরুপ সান্ত্বনা পেলেম; রাত্রি দুই প্রহরের পর নিদ্রা, ঊষাকালেই নিদ্রাভঙ্গ।
প্রভাতে বাবুর প্রথম কাৰ্য্য আমার বাসা তোলা। ভাড়া কত বাকী ছিল, আমার মুখে শুনে, একজন লোক সঙ্গে দিয়ে, সেই বাসায় আমায় পাঠালেন, টাকাগুলিও আমার হাতে দিলেন। আমি সেখানে পৌঁছে, বাড়ীওয়ালার সঙ্গে সাক্ষাৎ কোরে ভাড়াগুলি চুকিয়ে দিলেম, দুঃখের কথা বোল্লেম। সিদ্ধেশ্বরের উদ্দেশে তিনি বিস্তর গালাগালি দিলেন; লোকটা সে বাড়ীতে ছয় মাস ছিল, একমাসেরও ভাড়া দেয় নাই, গোপনে গোপনে জিনিসপত্র সোরিয়ে গা-ঢাকা হয়েছে! জুয়াচোরলোকের ধর্ম্মই ঐরুপ!
আমার জিনিসপত্রগুলি সঙ্গে নিয়ে বাবুর প্রেরিত লোকের সঙ্গে আবার আমি বাবুর বাড়ীতে এলেম। সে দিন রবিবার, বাবু আফিসে যাবেন না, অনেক বেলা পর্য্যন্ত বাবুর কাছে বোসে পূণ্যধাম বারাণসী-ক্ষেত্রের অনেক রকম ভয়ানক ভয়ানক গল্প শুনলেম। কথাপ্রসঙ্গে বাবু, একটী নিশ্বাস ফেলে বোল্লেন, “তুমি ত তুমি, কাশীর চোরেরা কত শত বড় বড় পাকা পাকা বিষয়ী লোককে অদ্ভুত কৌশলে ঠকায়, তার সংখ্যা হয় না; এখন অবধি তুমি খুব সাবধানে থেকো; অচেনা লোকের কোন ছলনায় ভুলো না।”—অদৃষ্টের উপর নিভর কোরে আমি নীরব থাকলেম।
আহারান্তে বিশ্রামের পর বাবু আমাকে সঙ্গে কোরে দুই একজন বন্ধুর বাড়ীতে বেড়াতে গেলেন, বন্ধুদের কাছেও আমার পরিচয় দিলেন, তাঁরাও সকলে আমার দুঃখে দুঃখ প্রকাশ কোল্লেন। যাতে আমি একটা কাজকর্ম্ম পাই, যাতে আমি পরের গলগ্রহ না হয়ে একরকম সুখে থাকতে পারি, এই অল্পবয়সে যাতে আমি আলস্যে আলস্যে বৃথা সময় নষ্ট না করি, সকলেই এইরূপ অভিপ্রায় প্রকাশ কোল্লেন। আমাকে দেখে আমার অবস্থা শুনে, বাবুর বন্ধুরা আমাকে দয়ার পাত্র বিবেচনা কোরে স্নেহ প্রদর্শন কোল্লেন, কথাবাৰ্ত্তার ভাবে আমি সেটা বুঝতে পাল্লেম।
সন্ধ্যার পর বাড়ীতে ফিরে এসে কিয়ৎক্ষণ বিশ্রামের পর বাবু আমায় জিজ্ঞাসা কোল্লে, “হরিদাস! তুমি ইংরেজী জান?”—চিন্তা কোরে আমি উত্তর কোল্লেম, “আজ্ঞে, কিছু কিছু শিখেছি। কোন বিদ্যালয়ে পাঠ করা হয় নাই, একজন দয়াময় আশ্রয়দাতা বাড়ীতে শিক্ষক নিযুক্ত কোরে কিছু কিছু শিক্ষা দিয়েছিলেন; ভূগোল, ব্যাকরণ, গণিত, ইতিহাস, সরলপাঠ কিছু কিছু আমি শিক্ষা কোরেছি; তৎপূর্ব্বে হুগলি জেলার এক অধ্যাপকের টোলে সংস্কৃত অধ্যয়ন কোরেছি, অবস্থা প্রতিকূল, অধিক দূর অগ্রসর হোতে পারি নাই; ঐ পর্য্যন্তই আমার শিক্ষা।”
পার্শ্বে কয়েকখানি ইংরেজী পুস্তক সাজানো ছিল, তন্মধ্যে একখানি হাতে কোরে নিয়ে বাবু আমাকে পাঠ কোত্তে দিলেন। দেখলেম, সেখানি রোমরাজ্যের ইতিহাস। রোমের ইতিহাস আমার পড়া ছিল না, তথাপি আমি আবৃত্তি কোল্লেম, এক একটী মানুষের নাম উচ্চারণে বেধে বেধে গেল, হাসতে হাসতে বাবু সেগুলি বোলে বোলে দিলেন, দ্বিতীয়বারে আমিও সুধরে নিতে পালেম। তার পর বাঙলা-ব্যাখ্যার আদেশ। ভাবলেম, এইবারেই ঠেকাঠেকি? একে তো অল্পবিদ্যা, তাতে আবার অপঠিত পুস্তক, অর্থ করা সহজ নয়। ছোট ছোট কথার অর্থ বুঝতে পাল্লেম, ইতিহাসের পাঠ, ভাবটাও অনেক দূর পরিগ্রহ হলো, বড় বড় কথার মানে জেনে নিয়ে, একরকমে খানিকদূর আমি ব্যাখ্যা কোল্লেম। আমার ব্যাখ্যা শুনে বাবু সন্তুষ্ট হোলেন; তাঁর মুখের ভাব দেখে আমি বুঝলেম, ব্যাখ্যাতে বড় একটা ভুল হলো না।
অল্পক্ষণ চুপ কোরে থেকে গম্ভীরবদনে—গম্ভীর অথচ প্রসন্নবদনে বাবু আমাকে বোল্লেন, “তোমার হাতের ইংরেজী-লেখা কেমন, কল্য আমাকে দেখিও; দোয়াত, কলম, কাগজ এইখানেই থাকলো, রাত্রে যদি অবসর পাও, কষ্ট যদি না হয়, বেশ পরিষ্কার কোরে এক পাতা লিখে রেখো, কল্য যখন আমি আফিসে যাব, আমাকে দিয়ো।”
যথাসময়ে নৈশ আহার সমাপ্ত হলো, বাবু বাড়ীর ভিতর শয়ন কোত্তে গেলেন, আমি আমার নির্দ্দিষ্ট শয়নকক্ষে কাগজ-কলম নিয়ে বোসে গেলেম। কি লিখি? সেই রোমের ইতিহাস। এক বাঘিণী দুটী শিশুকে স্তন দান কোরেছিল, এই কথা যেখানে লেখা, সেই পাতাটী আমি নকল কোল্লেম, প্রায় পঁচিশ ছত্র লিখলেম; চিহ্নগুলি যেখানে যেমন, অর্থ বোধ হয়েছিল কি না, ঠিক ঠিক দিয়ে দিলেম। কেতাবখানি এক কোণে চাপা দিয়ে, সেই কাগজখানি বাতাসের মুখে রেখে আমি শয়ন কোল্লেম। এক ঘুমেই রাত্রিপ্রভাত।
সোমবার। বেলা দশটার পূর্ব্বে আফিসের কাপড় পোরে বাবু যখন উপর থেকে নেমে আসেন, রাত্রের লেখা সেই কাগজখানি হাতে কোরে আমি তখন তাঁর সম্মুখে গিয়ে দাঁড়ালেম, কাগজখানি সম্মুখে ধোল্লেম। পূর্ব্বকথা স্মরণ কোরে, একটু হেসে তিনি বোলে উঠলেন, “ওহো! লিখেছ? বেশ বেশ!”—একটু থোমকে দাঁড়িয়ে, অক্ষরগুলির প্রতি একটু দৃষ্টিপাত কোরে, আবার তিনি হাসতে হাসতে বোল্লেন, “আচ্ছা!”
আচ্ছা বোলেই কাগজখানি পকেটে রেখে, বাবু সরাসর নেমে এলেন, চাকরদের যাকে যা বোলতে হয়, উপদেশ দিয়ে বাড়ী থেকে বেরিয়ে গেলেন। আহারান্তে আমি বাবুর বৈঠকখানায় বোসে একখানি ইংরেজী পুস্তক পাঠ কোত্তে লাগলেম। বেলা যখন তিনটে, সেই সময় একটী ভদ্রলোক সেই বৈঠকখানায় এসে দর্শন দিলেন। কল্য বৈকালে যে কয়েকটি বন্ধুর সঙ্গে বাবু সাক্ষাৎ কোরেছিলেন, এই ভদ্রলোকটী তাঁদেরই মধ্যে একজন। আমিও তাঁরে চিনলেম, তিনিও আমাকে চিনলেন। আমি ইংরেজী পুস্তক পাঠ কোচ্ছি দেখে, আমার কাছে বসে তিনি দুটী একটী কথা জিজ্ঞাসা কোত্তে লাগলেন, বিনম্রবচনে আমিও উত্তর দিতে লাগলেম। শেষকালে তিনি বোল্লেন, “তুমি বেশ বুদ্ধিমান, তোমার চেহারাও ভাল, রমণবাবুর কাছে কিছুদিন যদি তুমি থাকো, নিশ্চয়ই তোমার ভাল হবে।” পরিচয়ে জানলেম, সেই ভদ্রলোকটীর নাম রসিকলাল পিতুড়ী, বয়স প্রায় ২৭/২৮ বৎসর, একটী ইংরেজী স্কুলে শিক্ষকের কাৰ্য্য করেন, কোন কাৰ্য্য উপলক্ষে সাতদিনের ছুটী পেয়েছেন, বাহিরে কোথাও যান নাই, বাড়ীতেই আছেন, তিনি আমাদের বাবুর একজন অন্তরঙ্গ বন্ধু।
সেই রসিকবাবুর মুখেই শুনলোম, আমাদের বাবুর নাম রমেন্দ্রনাথ মিত্র, নিবাস বঙ্গদেশ। সাত বৎসর হলো কাশীতে এসেছেন, প্রথম প্রথম ভাড়াটে বাড়ীতে বাস কোত্তেন, এখন এই বাড়ীখানি কিনেছেন, সপরিবারে এই বাড়ীতেই থাকেন; বৎসরান্তে অল্পদিনের জন্য একবার দেশে যান, শীঘ্রই ফিরে আসেন। বাবুর আর দুটী সহোদর আছেন, তাঁরাও সঙ্গে এসেছেন, তাঁদেরও পরিবার আছে। বাবু এখানকার জজ-আদালতের সেরেস্তাদার, মাসিক বেতন ২০০৲ টাকা, সেরেস্তায় তাঁর বিলক্ষণ প্রতিপত্তি; বর্ত্তমান জজ-সাহেব তাঁরে খুব ভালবাসেন, শীঘ্রই বেতনবৃদ্ধি হবে, জজ-সাহেব এইরুপ আভাষ দিয়ে রেখেছেন।
রমেন্দ্রবাবর দুই বিবাহ, দুটী পত্নীই এই বাড়ীতে আছেন; তাঁরা ব্যতীত দুটী ভ্রাতৃবধু, দুটী সহোদরা ভগিনী, একটী পিসীমা আর পিসীমার দুটী কন্যা; তাঁরা সকলেই এই বাড়ীতে আছেন। রমেন্দ্রবাবু সুশিক্ষিত, তাঁর দুই বিবাহের কারণ কি, রসিকবাবু আমার সে সন্দেহও মিটিয়ে দিলেন। প্রথম পত্নীর সন্তান হয় নাই, সেই জন্য দ্বিতীয়বার দার-পরিগ্রহ। প্রথমার বয়ঃক্রম প্রায় ৩০ বৎসর। দ্বিতীয়াটীর বয়ঃক্রম ১৭/১৮ বৎসর মাত্র; সেটী এ বাড়ীতে নূতন-বৌ নামে পরিচিত। বাবুর মা নাই, পিসীমাই এখানে গৃহিণীর কাৰ্য্য করেন। বৌগুলির ততটা স্বাধীনতা নাই, কিন্তু বড় বউটী যা যখন বলেন, পিসীমা তাতে অমত কোত্তে পারেন না। পিসীমার কন্যা-দুটীর বিবাহ হয়েছিল, দুটীই এখন বিধবা। বড়টীর বয়স ২৪/২৫ বৎসর, ছোটটী বিংশতিবর্ষের ন্যূনবয়স্কা। ভাই তিনটীর মধ্যে রমেন্দ্রবাবুই জ্যেষ্ঠ, মধ্যম রামশঙ্কর, কনিষ্ঠ মতিলাল। বাড়ীতে তিনজন চাকর, একজন পাচক ব্রাহ্মণ, দুজন দাসী আর একজন গঙ্গাজলতোলা ভারী। পোষ্য অনেকগুলি। মেজোবাবু আর ছোটবাবু রামনগরে চাকরী করেন, বড়বাবুই তাঁদের চাকরী কোরে দিয়েছেন।
রসিকবাবুর মুখে এই সকল পরিচয় আমি অবগত হোলেম। বাবুর ভাইদুটী রামনগরে চাকরী করেন, রামনগর কোথায়, রামনগর কেমন জায়গা, রামনগরে কি কি আছে, উদ্দীপ্ত কৌতূহলে এই কথা আমি জিজ্ঞাসা কোল্লেম। রসিকবাবু বল্লেন, “কাশীর গঙ্গাপারেই রামনগর। রামনগরে একজন রাজা আছেন, তিনিই কাশীরাজনামে বিখ্যাত। রাজকার্য্য-নিৰ্ব্বাহের নিমিত্ত সেখানেও অনেক কার্য্যালয় আছে, দোকান আছে, বাজার আছে, বাড়ী আছে, অনেক লোক সেখানে চাকরী করে। গঙ্গাতীরে হাজার হাজার গাধা চরে, ধোপারা দলবদ্ধ হয়ে এক এক পাটা খাড়া কোরে সারি সারি গঙ্গাজলে কাপড় কাচে; গাধারা সেখানকার বোপাদেরই সম্পত্তি।”
রামনগরের এইরূপ বর্ণনা কোরে রসিকলাল বাবু আরও বোল্লেন, “রামনগর-সম্বন্ধে একটা চমৎকার পৌরাণিক রহস্য আছে। বিশ্বেশ্বর একবার বেদব্যাসকে কাশী থেকে দূরে কোরে দিয়েছিলেন; শিবের উপর রাগ কোরে ব্যাসমুণি ঐ রামনগরে নূতনকাশী পত্তন করবার বাসনা কোরেছিলেন। কবিবর ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গলগ্রন্থে ব্যাসের সঙ্কল্পের এইরূপ বর্ণনা আছে:—
‘আমাকে কাশীতে, না
ভূতনাথ কাশীবাসী।
সেই অভিমানে, আমি এইখানে,
কবির দ্বিতীয় কাশী॥’
ব্যাসদেব এই সঙ্কল্পে রামনগরে কাশী প্রতিষ্ঠার কল্পনায় যোগাসনে বসেন। কাশীতে তারকব্রহ্মনামে জীবকে শিব মুক্তি দেন, ব্যাসদেবের নূতন কাশীতে তারকব্রহ্মনামের প্রয়োজন থাকবে না, শিবের কৃপার অপেক্ষা থাকবে না, মরণমাত্রেই জীবগণ মোক্ষলাভ কোরবে। ব্যাসের বাসনা পূর্ণ হলে কাশীনাথের কাশীধামের মহিমা কম হবে কিম্বা আসলেই মাহাত্ম্য থাকবে না, এই বিঘ্ন সন্দেহ কোরে সৰ্ব্ববিঘ্ননাশিনী জগজ্জননী অন্নপূর্ণা জরাজীর্ণা ভিকারিণীবেশে ব্যাসদেবকে ছলনা করেন। দুইবার ভগবতী জিজ্ঞাসা করেন, ‘এখানে মরিলে কি হয়?’—দুইবার যোগাসনস্থ ব্যাসদেব উত্তর দেন, এখানে মরিলে সদ্য মোক্ষ হয়। তৃতীয়বার দেবী যখন ঐরুপ প্রশ্ন করেন, যোগভঙ্গের আশঙ্কায় ক্রোধান্ধ হয়ে ব্যাস তখন বোলে ফেলেন, ‘গর্দ্দভ হইবে বুড়ি এখানে মরিলে।’
দেবী বোল্লেন, “তথাস্তু।” তদবধি রামনগরের নাম ব্যাসকাশী, সাধুভাষায় গর্দ্দভবারাণসী। প্রবাদ এইরুপ যে, যে সকল পাপীলোককে কাশীছাড়া করবার জন্য কালভৈরব তাড়া করেন, সেই সকল পাপীলোক গঙ্গা পার হয়ে ব্যাস-কাশীতে গিয়ে মরে, মরণমাত্রেই গাধা হয়; সেই কারণে এখনো রামনগরে গাধার সংখ্যা অত বেশী!”
ব্যাসকাশীর বর্ণনা শুনে আমি হাস্য কোল্লেম। এদিকে সন্ধ্যাও হয়ে এলো, রসিকবাবু বাড়ী গেলেন, ঠিক সন্ধ্যার সময় আর দুটী নূতন বাবু বৈঠকখানায় এসে দাঁড়ালেন। বৈঠকখানায় বাবুর বিছানার ধারে আমাকে দেখেই খানিকক্ষণ তাঁরা অবাক হয়ে আমার পানে চেয়ে রইলেন, আমিও নিৰ্ব্বাকে একদৃষ্টে তাঁদের পানে চেয়ে থাকলেম। একটু পরেই একটী বাবু, কিছু রুক্ষ্মস্বরে আমাকে জিজ্ঞাসা কোল্লেন, “কে তুমি? কোথা থেকে এসেছ?” অপ্রতিভ না হয়েই নির্ভয়ে আমি উত্তর কোল্লেম, “আমি হরিদাস, বড়বাবু আমাকে এনেছেন, এইখানেই আমি আছি, এইখানেই আমি থাকবো।”
উভয়ে মুখ-চাহাচাহি কোরে দুই তিনবার বক্রনয়নে আমার দিকে কটাক্ষপাত কোল্লেন, বোধ হলো যেন বিরক্ত হোলেন। সেখানে আর তাঁরা বোসলেন না, বিড় বিড় কোরে বোকতে বোকতে মস মস শব্দে বাড়ীর ভিতরের দিকে চোলে গেলেন।
ঘরের সেজে বাতী জ্বালবার জন্য সেই সময় একজন চাকর একটা লণ্ঠন হাতে কোরে সেইখানে এলো, বাতী জ্বেলে দিলে। সে যখন ফিরে যায়, তখন আমি তারে জিজ্ঞাসা কোল্লেম, “এইমাত্র যে দুটী বাবু এসেছিলেন, তাঁরা কে?” চাকর উত্তর কোল্লে, “বাবুর ভাই মেজোবাবু আর ছোটবাবু।”
তখন আমি বুঝতে পাল্লেম; তথাপি পুনরায় জিজ্ঞাসা কোল্লেম, “তিন দিন আমি রয়েছি, শনিবার রবিবার ঐ বাবু-দুটীকে দেখি নাই কেন?” চাকর বোল্লে, “সকল দিন আসেন না; রামনগরে কাজ করেন, সেইখানেই থাকেন। বড়বাবু বেজার হন; বাইরে বাইরে রাতকাটানো, বড়বাবু ভালবাসেন না, কতদিন বারণ কোরেছেন, বাবুরা শুনেন না, প্রায়ই মাঝে মাঝে দেখা দেন না, বিশেষত শনিবার রবিবার।”
এই পর্য্যন্ত বোলেই, মুখ ফিরিয়ে একটু হেসে চাকরটী বেরিয়ে গেল। হাসি আমি দেখতে পেলেম, কিন্তু হাসির ভাব কিছু বুঝতে পাল্লেম না; বাতীর কাছে সোরে বোসে আবার আমি পুস্তকপাঠে মন দিলেম।
রাত্রি যখন সাতটা, সেই সময় বড়বাবু বাড়ী এলেন; অগ্ৰেই বৈঠক খানায়। আমি পুস্তকপাঠে নিবিষ্টচিত্ত, তাই দেখে বাবুর মুখখানি সহসা প্রফুল্ল হলো, প্রফুল্লবদনে তিনি আমাকে বোল্লেন, “বড়ই তুষ্ট হোলেম। মিছে কাজে কালক্ষয় না কোরে তুমি যে একাকী বোসে বোসে পড়াশুনা কোচ্ছো, খুব ভাল; এই রকম আমি ভালবাসি। দেখ হরিদাস, কাল থেকে আমার সঙ্গে তোমায় বেরুতে হবে; তোমার চাকরী হয়েছে; তোমার সেই লেখাখানি দেখে সাহেবেরা পছন্দ কোরেছেন, আমার সেরেস্তাতেই তুমি বোসবে, আমিই তোমাকে কাজকর্ম্ম দেখিয়ে দিব, শিখিয়ে দিব, সহজ সহজ কাজ, তা তুমি বেশ পারবে, কিছুই কঠিন বোধ হবে না। এখন আপাততঃ মাসে মাসে কুড়ি টাকা পাবে, কাজকর্ম্মের দাঁড়া-দস্তুর শিক্ষা হোলে ক্রমশঃ বেতন বাড়বে।”
পুস্তকখানি মুড়ে রেখে, দাঁড়িয়ে উঠে, বাবুকে আমি নমস্কার কোল্লেম। “আপনি মহৎলোক, আপনি সদাশয়, গরিবের প্রতি আপনার বিশেষ দয়া, বিশেষ অনুগ্রহ, আপনার অনুগ্রহে আমি সংসারের অকূল সাগরে পার পেলেম, চিরদিনের জন্য উপকারঋণে আমি ঋণী হয়ে থাকলেম, হৃদয়ের আনন্দবেগে এই সকল কথা বোলে তাঁর কাছে আমি কৃতজ্ঞতা জানালেম। মৃদু হেসে, আমার মস্তকে হস্তার্পণ কোরে, হৃষ্টবচনে বাবু বোল্লেন, অত কথা আমাকে কিছুই বোলতে হবে না, আমি তোমাকে পুত্রের মত পালন কোরবো, দু-দিনেই আমি তোমার সদ্গুণের পরিচয় পেয়েছি। বেশ ছোকরা তুমি; বেশ বুদ্ধি তোমার; পূৰ্ব্ব পূৰ্ব্ব দুর্ঘটনার কথা ভুলে গিয়ে, সুস্থির হয়ে আমার কাছে থাকো, মন দিয়ে কাজকর্ম্ম কর, লেখাপড়ার আলোচনা রাখ, ভবিষ্যতে ভাল হবে। এখানে তোমার কিছুমাত্র অযত্ন হবে না, ঘরের ছেলের মত থাকবে, স্বচ্ছন্দে বাড়ীর ভিতর যাবে আসবে, মেয়েদের সকলকেই আমি বোলে দিব, সকলেই তোমাকে আদর-যত্ন কোরবে; আদর করবার বস্তু তুমি, ভালবাসবার সামগ্রী তুমি, সকলেই তোমাকে ভালবাসবে, কারোর কাছে তোমার অনাদর হবে না।”
উত্তম অবসর পেয়ে, কুণ্ঠিতভাবে মুখখানি নীচু কোরে, মৃদুস্বরে তৎক্ষণাৎ আমি বোল্লেম, “মেজোবাবু এসেছেন, ছোটবাবু এসেছেন, দুজনেই এই ঘরে আসছিলেন : আমি তাঁদেরে চিনতেম না, উঠে দাঁড়াই নাই, কর্কশস্বরে দুই একটা কথা আমাকে জিজ্ঞাসা কোরে আমার সামান্য উত্তর শুনেই তাঁরা বিরক্ত হয়ে চোলে গেলেন; ঘরে বোসলেনও না, আমার সঙ্গে আর কথাও কইলেন না।”
গম্ভীরবদনে বাবু বোল্লেন, “তাদের ঐ রকম স্বভাব, তুমি কিছু মনে কোরো না। আমি তাদের বোলে দিব, চেনাশুনা হোলে আর সে রকম মেজাজ দেখাবে না। এখন তুমি পড়, আমি আসছি।”
এই কথা বলে বাবু অন্দরমহলে প্রবেশ কোল্লেন, আমি আবার পুস্তকখানি খুলে আরব্ধ পাঠে মনোনিবেশ কোল্লেম।
আধঘণ্টা পরে বাবু এলেন। আমার চাকরী-সম্বন্ধে কতকগুলি উপদেশ দিয়ে বাবু বোল্লেন, “দিন দিন এখানে বাঙ্গালীর সংখ্যা অধিক হোচ্ছে। যাদের মাথার উপর শাসনকৰ্ত্তা নাই, অভিভাবক নাই, তারা প্রায় সকলেই দুষ্কর্ম্মেরত। কেহ কেহ চাকরী করে, কেহ কেহ বেকার। অনেকে মনে করে, অল্প লেখাপড়া জানলেই পশ্চিমদেশে চাকরী হয়; কথাটা কতক পরিমাণে সত্য, কিন্তু কার্য্যে নিযুক্ত হয়ে যারা রীতিমত কাজকর্ম্ম শিক্ষা কোত্তে পারে, অল্প লেখাপড়ায় তাদের ততটা আটকায় না, যারা কর্ম্মস্থলে গিয়ে কেবল রোজসই কোরে আসে, বেশী দিন তাদের চাকরী থাকে না। যারা বেকার, তারা বাড়ী থেকে আসবার সময় মা-বাপের সিন্দুক-বাক্স ভেঙে যা কিছু আনে, তাতেই এখানে বাবুয়ানা কোরে দিন কাটায়; তাও দিনকতক মাত্র; শেষে অনন্ত দুর্গতি! একে কুক্রিয়াসক্ত, তার উপর নিঃসম্বল, কেশেল লোকের সঙ্গে মিশে অর্থ-লালসায় নানা কুক্রিয়ায় প্রবৃত্ত হয়; এক একদিন এক এক বাঙ্গালীর বাসায় বাসায় ভিক্ষা কোরে উদরপোষণ করে, এক একদিন উপবাসে কাটায়, তথাপি বদখেয়ালী বাবুগিরী ছাড়ে না। সাবধান, সে প্রকার লোকের সঙ্গে খবরদার তুমি মিশো না, মুখোমুখি দেখা হোলে বাক্যালাপও কোরো না; দুদিনে চরিত্র নষ্ট হয়ে যাবে, চাকরীটীও হারাবে, আমিও তোমাকে বিশ্বাস কোত্তে সন্দেহ কোরবো। তোমার স্বভাব ভাল, সেই জন্যই অগ্রে উপদেশ দিয়ে রাখলেম; ভুলো না, সাবধানে থেকো।”
নতবদনে আমি উত্তর কোল্লেম, “আজ্ঞা, বদলোকের সঙ্গে সংস্রব রাখা কখনই আমার অভ্যাস নয়, কখনই আমি আপনার আজ্ঞার অবাধ্য হব না।” বাবু বোল্লন, “হাঁ, তা হোলেই ভাল হয়।”
কথা হোচ্ছে, এমন সময় সেই দুটী বাবু এলেন। বাবুর সহোদর। বড়বাবু তাঁদের সম্বোধন কোরে, আমার দিকে অঙ্গুলিনির্দ্দেশে মিষ্টবাক্যে বোল্লেন, “দেখ, এই ছেলেটীর নাম হরিদাস, গরিব, চেহারা দেখেই বুঝতে পাচ্ছো, ভদ্রলোকের ছেলে, আমাদের স্বজাতি, চলনসই লেখাপড়া জানে, চরিত্র খুব ভাল, আমাদের আদালতে এই বালকের জন্য আমি একটী চাকরী স্থির কোরেছি, কাল থেকে সঙ্গে কোরে নিয়ে যাব। তোমরা হরিদাসকে অযত্ন কোরো না, কটুকথা বোলো না, ভয় দেখিও না, ঘরের ছেলের মতন সদয়চক্ষে দর্শন কোরো।”
আমার দিকে চেয়ে চেয়ে বাবু-দুটী তখন বড়দাদার কথাতেই সম্মতি জানালেন; আমি সেই সময় তাঁদের উভয়ের মুখের দিকে চাইলেম; দেখলেম, ছোটবাবু একটু একটু হাসছেন, মেজোবাবুর মুখখানি ভারী ভারী; সেই ভারিত্বের সঙ্গে যেন কিছু বিরক্তিভাব অঙ্কিত বোধ হলো।
বাবু-দুটীর সঙ্গে সে রাত্রে আমার কোন প্রকার কথাবার্ত্তা হলো না। ছোটবাবু একবার উঠে, একটা আলমারী থেকে লাল চামড়াবাঁধা একখানা কেতাব আর খানকতক কাগজ বাহির কোরে, বড়বাবুর বালিশের ধারে বোসলেন; একখানা কাগজ বড়বাবুকে দেখালেন। মস্তকসঞ্চালন কোরে বড়বাবু বোল্লেন, “হ, আচ্ছা, ঐ রকম হোলেই চোলবে।” ছোটবাবু তখন ঘাড় বেঁকিয়ে মেজোবাবুর দিকে চাইলেন; তার পর দুজনেই একসঙ্গে বাড়ীর ভিতর চোলে গেলেন; কাগজগুলি আর কেতাবখানি ছোটবাবুর হাতেই থাকলো। একটু পরে বড়বাবুর সঙ্গে আমিও অন্দরে প্রবেশ কোল্লেম। যথাসময়ে আহার করা হলো, নিদ্রায় রজনীপ্রভাত।
নূতন চাকরী, সকাল সকাল আহার কোরে বড়বাবুর সঙ্গে আমি আদালতে গেলেম। কি আমার কাৰ্য্য, বড়বাবু দেখিয়ে দিলেন, হুঁসিয়ার হয়ে সমস্ত দিন আমি কাজ কোল্লেম। কাজ কেবল নকল করা আর মাঝে মাঝে লম্বা লম্বা ফর্দে অঙ্কমালা ঠিক দেওয়া। আফিস বন্ধ হবার অগ্রে বড়বাবু স্বয়ং আমার লেখাগুলি আর অঙ্কগুলি দর্শন কোল্লেন, প্রসন্নবদনে মন্তব্য দিলেন, “ঠিক।”
সেই দিন থেকেই আমার চাকরী হলো। ছুটীর সময় বড়বাবু আমাকে সাহেবের কাছে নিয়ে গেলেন, সাহেবকে আমি সেলাম কোল্লেম, সাহেবের সঙ্গে বড়বাবুর কি কি কথা হলো, সব আমি বুঝতে পাল্লেম না, ভাবে বুঝে নিলেম, আমার পক্ষে অনুকূল।
আমরা বাড়ী এলেম। সেদিন বড়বাবু আমার উপর বেশী সন্তুষ্ট। সেই দিন থেকে অন্দরে একটী ঘরে রাত্রে আমার শয়নের বন্দোবস্ত হলো। ভাগ্যদেবতাকে ধন্যবাদ দিয়ে সে রাত্রে আমি নিরুদ্বেগে নিদ্রাসুখ অনুভব কোল্লেম। বোধ হলো যেন, জন্মাবধি তেমন সুখে একদিনও আমি ঘুমাই নাই।
ক্রমে ক্রমে বাড়ীর মেয়েদের সঙ্গে আমার বেশ জানাশুনা হলো, সকলেই আমাকে বেশ ভালবাসলেন। বড়বাবুর পূর্ব্ববাক্য সার্থক। বড়-বৌটীকে আমি মা বলি, নূতন-বৌটীকে ছোট মা, বাবুর ভগ্নী-দুটীকে পিসীমা, বাবুর পিসীমাকে দিদিমা, মেজো-বৌকে আর ছোট-বৌকে কাকীমা, বাবুর পিসীমার মেয়ে-দুটীকে বড়পিসী, ছোটপিসী, এই রকম সম্পর্ক ধোল্লেম; সম্পর্কানসারে তাঁরাও আমার প্রতি বেশ স্নেহ-যত্ন দেখাতে লাগলেন। দিন দিন সে সংসারে আমার বেশী বেশী আদর।
একমাস আমার চাকরী করা হলো। কার্য্যালয়ে আমি খোসনামী পেলেম। সেখানে যাঁরা যাঁরা চাকরী করেন, তাঁদের সঙ্গেও বেশ আলাপ-পরিচয় হলো, মনের সুখেই আমি থাকলেম। সোণাপুরা মহল্লায় অনেকগুলি বাঙ্গালীর বাস; বড়বাবুর পরিচয়ে রবিবারে রবিবারে তাঁদের এক একজনের বাড়ীতে আমি যাই, বাড়ীর ছেলেদের সঙ্গে আলাপ হয়, কর্ত্তারাও আমার পরিচয় পান, সে সকল বাড়ীতেও আমার অনাদর হয় না। পূণ্যক্ষেত্র বারাণসীধাম আমার যেন চিরদিনের পরিচিত, জন্ম-কর্ম্ম সকলই যেন কাশীতে, দিন দিন আমার এই রকম জ্ঞান হোতে লাগলো।
নূতন আশ্রয়ে দুই মাস অতীত, দুই মাস চাকরী। বড়বাবুর মধ্যম সহোদরের নাম রামশঙ্কর, কনিষ্ঠের নাম মতিলাল, এ কথা পূর্ব্বেই বলা হয়েছে; সকল দিন তাঁরা বাড়ীতে আসেন না, রামনগরে থাকেন, মাঝে মাঝে আসেন, তাঁদের সঙ্গে আমার বেশী ঘনিষ্ঠতার অবসর ঘটে না; যখন যখন দেখা হয়, আমি তাঁদের কাকাবাবু বোলে সম্মান জানাই। ছোটবাবু আমার সঙ্গে কথা কন, হাসির কথা হোলে হাসেন, কিন্তু মেজোবাবু যেন আর এক রকম। দৈবাৎ তিনি আমাকে এক একটা কাজের হুকুম করেন, হকুম আমি তামিল করি, তিনি কিন্তু তুষ্ট হন না; মুখ যেন সৰ্ব্বদাই ভার ভার। মুখ দেখে মনে হয়, এই বাবুটীর মনে মনে বেজায় অহঙ্কার।
যে বাড়ীতে দশ দিন থাকতে হয়, কথায় কথায় সেই বাড়ীকে “আমাদের বাড়ী” বলাই প্রায় সকল লোকের অভ্যাস। আমাদের বাড়ীর উত্তরাংশে একটী ভদ্রলোকের একখানি বাড়ী। দুই বাড়ীর মধ্যস্থলে আড়াই হাত ওসারের একটী ক্ষুদ্র রাস্তামাত্র ব্যবধান। এক বাড়ীর ছাদে দাঁড়ালে দ্বিতীয় বাড়ীর ছাদের লোকের সঙ্গে বেশ কথাবার্ত্তা কওয়া যায়। চেঁচাতে হয় না; মৃদুকথোপকথনেও পরস্পরের বিলক্ষণ সুবিধা আছে। এ বাড়ীতে আমি দুমাস আছি, একদিনও ছাদে উঠি নাই। এক রবিবার অপরাহ্নসময়ে অজ্ঞাত কৌতূহলে একাকী আমি সদরবাড়ীর ছাদে উঠলেম। সদরেও সিঁড়ি আছে, অন্দরেও সিঁড়ি আছে, আমি কিন্তু সদরের সিঁড়ি দিয়ে উঠেছিলেম। দুই মহলে দুই সিঁড়ি বটে, কিন্তু সদর অন্দরের ছাদগুলি সব একটাল; মাঝে মাঝে আর ধারে ধারে ছোট ছোট আলসে। ছাদগুলি দিব্য পরিষ্কার।
বসন্তকাল। বেলা প্রায় শেষ, রবিরশ্মি প্রায় নিষ্প্রভ, সুশীতল দক্ষিণানিল প্রবাহিত, সময় অতি সুখময়। গগনবিহারী বিহঙ্গকুল গগনাঙ্গনের নিম্নদেশে শ্রেণীবদ্ধ হয়ে বাতাসে উড়ে যাচ্ছে, মাথার উপর নির্ম্মল নীলবর্ণ আকাশমণ্ডল শোভা পাচ্ছে, ইতস্ততঃ উচ্চ নিম্ন শত শত অট্টালিকা নয়নগোচর হোচ্ছে, বড় বড় মন্দিরের চূড়া সৰ্ব্বসৌধ অতিক্রম কোরে যেন গিরিশৃঙ্গের ন্যায় বিরাজিত রয়েছে, দূরে তরলতরঙ্গ ভাগীরথী যেন অস্থিরগামিনী বৃহৎ ভুজঙ্গিনীর ন্যায় দেখা যাচ্ছেন, ছাদের উপর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এই সকল শোভা আমি দেখছি, দেখছি আর পাইচারী কোরে বেড়াচ্ছি, এমন সময় হঠাৎ দেখতে পেলেম, দ্বিতীয়বাড়ীর ছাদের উপর একটী নারীমূর্ত্তি। সে মূর্ত্তি এতক্ষণ সেখানে ছিল না, অল্পক্ষণের মধ্যেই যেন শুক্লপক্ষের সন্ধ্যাকালের তরল মেঘঢাকা চন্দ্রের ন্যায় আশু এসে উদয় হয়েছে। পরমাসুন্দরী নারীমূর্ত্তি! পরিধান একখানি ময়ূরকণ্ঠী চেলী, বুকে সবুজবর্ণ কাঁচুলী, কাঁচুলীর উপর দুহালী সোণার হার, গলায় সোণার উপর ডায়মনকাটা চিক, দুহাতে দুগাছি সোণার বালা, দুকাণে দুটী নীলমণিদল, নাসিকায় একটী গজমুক্তার নোলক, এই পর্য্যন্ত অলঙ্কার; মস্তকে আবরণ নাই, কবরী নাই, পৃষ্ঠদেশে ভুজঙ্গাকার বিলম্বিতপৃষ্ঠ-বেণী। চমৎকার রূপ; সৌখীন বসনভূষণে সেই রূপের আরো চমৎকার খোলতা হয়েছে। নিখুঁত রূপ, উজ্জল শ্যামবর্ণ; দোষের মধ্যে একটু কোলকুঁজো। বয়স কত, ঠিক অনুমান কোত্তে পাল্লেম না, কিন্তু অঙ্গসৌষ্ঠবে পূর্ণযুবতী। হাতে একখানি গোলাপী ফলদার রেশমী রুমাল, সুন্দরী সেই রুমালখানি মুখের কাছে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে হাওয়া খাচ্ছেন। আমি যদি কবি হোতেম তা হোলে কল্পনাবলে বোলতে পাত্তেম, মুখখানি পদ্মফুল, চঞ্চলহস্তে পদ্মিনী সেই রুমাল দিয়ে ভ্রমর তাড়াচ্ছেন।
কে এই সুন্দরী? পর্ব্বে কখনো দেখি নাই, ঐ বাড়ীতে কারা থাকে, ঠিক পাশের বাড়ী হোলেও তা আমার জানা ছিল না, রমণীকে দেখে আমার বিস্ময়বোধ হলো। রমণীর লজ্জা নাই। আমি যেন বালক, আমাকে দেখে লজ্জা না আসতে পারে, কিন্তু এ সময় অন্যান্য বাড়ীর অনেক পুরুষ ছাদে উঠেছে, তথাপি লজ্জা নাই! রমণী স্বচ্ছন্দে অনাবৃতবদনে রুমাল সঞ্চালন কোত্তে কোত্তে, থেকে থেকে নৃত্য-ভঙ্গীতে খোলাছাদে পরিক্রমণ কোচ্ছেন। আমিও পরিক্রমণ কোচ্ছিলেম, মূর্ত্তিদর্শনে নিস্পন্দ হয়ে এক জায়গায় থোমকে দাঁড়ালেম। কি জানি কেন, আমার দিকে দৃষ্টিপাত হবামাত্র রমণীও থোমকে দাঁড়ালেন। ক্ষণেকের জন্য উভয়ের চারি চক্ষু সমসূত্রে মিলিত হয়ে গেল। যে চক্ষু এতক্ষণ খঞ্জনপক্ষীর ন্যায় নেচে নেচে চতুর্দ্দিকে ঘুরে বেড়াচ্ছিল, আমাকে দেখে সেই উজ্জ্বল চক্ষু তখন চিত্রচক্ষুর ন্যায় অচঞ্চল; মূর্ত্তিও অচলা।
আমার লজ্জা এলো। কি আমি দেখছি, কেনই বা দেখছি, কেনই বা দাঁড়িয়ে আছি, অন্তরে অকস্মাৎ এই ভাবের উদয়। মনে মনে আপনাকে আপনি ধিক্কার দিয়ে, চারিদিকে চেয়ে, উপর থেকে নেমে আসবার উপক্রম কোচ্ছি, বাধা পোড়ে গেল। যে ছাদে সেই রমণীমূর্ত্তি, সেই ছাদের সিঁড়ির দরজা উন্মুক্ত হলো, একটী প্রাচীন স্ত্রীলোক ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে সেই অচলা মূর্ত্তির কাছে দাঁড়ালো। পরিচ্ছেদের অপারিপাট্য দেখে স্থির কোল্লেম, পরিচারিকা।
কেবল কি তাই? অহো! এ কি আশ্চর্য্য! এ বৃদ্ধ এখানে কোথা থেকে এলো? এই মূর্ত্তি কোথায় আমি পূর্ব্বে দেখেছি; সত্যই কি এই সেই? দুই তিনবার আড়ে আড়ে চেয়ে চেয়ে দেখলেম, স্মৃতিকে আকর্ষণ কোরে উত্তমরুপে নিরীক্ষণ কোল্লেম. আকর্ষণে পূৰ্ব্বস্মৃতি জেগে উঠলো; সন্দেহ হোচ্ছিল, ঠিক মনে কোত্তে পাচ্ছিলেম না, সে সন্দেহ ঘুচে গেল; তখন আমি নিশ্চয় বুঝলেম, ঠিক সেই! নিশ্চয়ই এই বুড়ী সেই কামিনীর মা;—কলিকাতার বিশ্বেশ্বরবাবুর বাড়ীর চাকরাণী সেই কামিনীর মা।
এ বুড়ী এখানে কেমন কোরে এলো? কামিনীর মা এখানে কি কোত্তে এসেছে? কার সঙ্গে এসেছে? বিশ্বেশ্বরবাবুর পরিবারেরা কেহ কী কাশীধামে এসেছেন? এই বাড়ীতেই কি তাঁরা বাসা কোরে রয়েছেন? এই সুন্দরী যুবতী তবে কে? এ যুবতী সেখানকার কি এখানকার? কামিনীর মা কলিকাতার চাকরী ত্যাগ কোরে একাকিনী কাশীবাসিনী হোতে এসেছে, এই বাড়ীতেই চাকরী পেয়েছে, এটাও একবার মনে ভাবলেম, কিছুই ঠিক কোত্তে পালেম না।
আর সেখানে সে ভাবে অধিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা ভাল নয়, সন্ধ্যা হবারও বিলম্ব নাই, কটাক্ষে আর একবার মাত্র তাদের উভয়ের দিকে দৃষ্টিপাত কোরেই উপর থেকে আমি নেমে এলেম। বড়বাবু ইতিপূর্ব্বে বেড়াতে বেরিয়েছিলেন, তিনি ফিরে এসেছেন; বৈঠকখানায় প্রবেশ কোরেই তাঁরে আমি দেখতে পেলেম। অন্তরে ভয়ের সঞ্চার হলো। আমি ঘরে ছিলেম না, না জানি, বাবু রাগ কোরে কি বলেন, সেই ভয়। বাবু তখন অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে কি একটা জিনিস অন্বেষণ কোচ্ছিলেন, সম্মুখে চেয়ে আমাকে দেখেই জিজ্ঞাসা কোল্লেন, “কোথা গিয়েছিলে হরিদাস?”
সত্য আমি গোপন কোল্লেম না। অন্তরের ভয়কে অন্তরে রেখে স্পষ্টই আমি বোল্লম, “ছাদে উঠেছিলেম; ছাদের উপর থেকে নগরের শোভা বেশ দেখা যায়, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাই আমি দেখছিলেম। একদিনও আমি ছাদে উঠি নাই, মনের উল্লাসে আজ আমি দেখলেম, দৃশ্য বড় চমৎকার!”
মৃদুহাস্য কোরে বড়বাবু বোল্লেন, “হাঁ হাঁ, উপর থেকে দূরের শোভা দেখায় ভাল : শেষবেলায় যেদিন যেদিন অবকাশ পাবে, এক একবার ছাদের উপর বেড়িয়ে এসো; তাতে উপকার আছে; কৃত্রিম শোভা অপেক্ষা প্রকৃত শোভা উপরে দাঁড়িয়ে অনেক দেখা যায়। বোসো; আজ একটা নূতন খবর আছে! আমার এক বন্ধুর বাড়ীতে একটী বাবু এসেছেন, তাঁর পরিবার সঙ্গে আছে, বাবুটী জমিদার। তিনি এখানে দশটাকা খরচপত্র কোরবেন। দণ্ডীভোজন, সন্ন্যাসীভোজন, সধবাভোজন, কুমারীভোজন, কাঙ্গালীভোজন, বৃষভোজন, এই রকম অনেক কাজ করা সেই বাবুটীর পরিবারের বাসনা। খুব সমারোহ হবে। অন্যদিন হোলে আমরা থাকতে পারবো না, এই জন্য আমি বোলে এলেম, আগামী রবিবার। তুমিও আমার সঙ্গে যেয়ো; ও সব কাণ্ড কখনো দেখ নাই, দেখে শুনে রাখবে। আরো এক কথা। প্রথমদিন তুমি আমার কাছে বীরভূমের নাম কোরেছিলে, যে বাবুটী এসেছেন, তাঁদেরো বাড়ী বীরভূম। বাবুকে দেখে যদি তুমি চিনতে পার—না, সে কথায় এখন কাজ নাই, রবিবার আসুক, যা হয়, সেইদিন দেখা যাবে।”
সে দিনের কথোপকথন এই পর্য্যন্ত। বীরভূমের বাবু কাশীধামে এসেছেন, পুজো দিবেন, সৎকাজ কোরবেন, কথা ভাল, কিন্তু কোন বাবুটী? যিনি আমাকে সঙ্গে কোরে কলিকাতায় নিয়ে গিয়েছিলেন, তিনি যদি হন, তবে তো ভালই হবে; যা আমার মনে আছে, জিজ্ঞাসা কোরে জেনে নিব, নূতন যা কিছু, আমি জানি, যা কিছু জানতে পেরেছি, তাও একটু একটু জানাবো। বীরভূম আমার পক্ষে দুই প্রকার;—শঙ্কাপ্রদ আর আনন্দাপ্রদ। যে কারণে শঙ্কা, যে কারণে আনন্দ, পাঠকমহাশয় তা অবগত আছেন, এখানে পুনরুক্তি নিষ্প্রয়োজন।
সোমবার। নিয়মিত সময়ে আমরা কর্ম্মস্থলে গেলেম, নিয়মমত কাজকর্ম্ম কোল্লেম, বৈকালে একটা ঘর থেকে আমি বেরিয়ে আসছি, হঠাৎ দেখি, দুজন লোক আর একটা ঘর থেকে বেরিয়ে, সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাচ্ছে; ঘাড় নেড়ে নেড়ে কত রকম কথা কোচ্ছে, মাঝে মাঝে তুড়ি দিয়ে দিয়ে হাসছে, একজনের বগলে একতাড়া কাগজ। লোক-দুটীর কেবল পশ্চাদ্ভাগ আমি দেখতে পেলেম, মুখ দেখতে পেলেম না; দেখবার জন্য ততটা আগ্রহও জন্মিল না;—সরকারী আদালত, কত লোক আসছে, কত লোক যাচ্ছে, খোঁজ-খবরে আমার দরকার কি? আমি তো ভাবলেম, দরকার কি, কিন্তু যেদিন যেটী ঘোটবার, সেদিন সেটী ঘোটবেই ঘোটবে। সিঁড়িতে নামতে নামতে সেই দুজনের মধ্যে একজন মুখখানা ঘুরিয়ে একবার এদিক ওদিক চাইলে; মুখখানা দেখেই আমি শিউরে উঠলেম। সেদিকে আমার নজর পোড়েছিল, আমার দিকে তার নজর পোড়েছিল কি না, বোলতে পারি না, তবু আমি ভয়ে ভয়ে একটা কপাটের আড়ালে গা- ঢাকা হয়ে দাঁড়ালেম। লোকটার পৃষ্ঠদর্শনে অগ্রেই একটু সন্দেহ জন্মেছিল, কিন্তু কত লোকের পৃষ্ঠে কুব্জ থাকে, কুব্জলোক দেখে ততটা আমি ভ্রূক্ষেপ করি নাই; মুখ দেখে ভয় হলো। লোকটা সেই বীরভূমের বিকট বানরাকার রক্তদন্ত!
লোকটা কি সৰ্ব্বব্যাপী? বর্দ্ধমানে আমি ছিলেম, আমার মামা সেজে ঐ লোকটা সেইখানে গেল, আবার দেখলেম, সেই লোক বীরভূমে; কলিকাতায় আমি পালিয়ে গেলেম, সেখানেও সেই লোক; আবার দেখছি, সেই লোক এই কাশীতে! কি ব্যাপার? আমার সঙ্গে ঐ লোকের কি লোহা-চুম্বকসম্বন্ধ? যেখানে আমি যাই, সেইখানেই রক্তদন্ত! এ কি আশ্চর্য্য ঘটনা! লোক যদি আমার ইষ্টানিষ্টের সংস্রবশূন্য থাকতো, তা হোলে তো কোন কথাই ছিল না, তা তো নয়, ভাড়াকরা গুণ্ডা এনে বীরভূমে আমার প্রাণবিনাশের চেষ্টা পেয়েছিল! ঐ লোকের সঙ্গে আমার কি যে শত্রুতা, আকাশ-পাতাল ভেবেও কিছু ঠিক কোত্তে পারি না।
রক্তদন্ত কাশীতে? তবে তো আমার আর কাশীধামে থাকা হয় না! কি জানি, কখন কোথায় ঐ দুরন্তলোকের খর্পরে পোড়ে যাব, হয় তো গলা টিপে ধোরে নিয়ে যাবে, না হয় তো মেরেই ফেলবে! কাশীতে আর থাকা হলো না! বিশ্বেশ্বর কেন এমন কোল্লেন?
ভাবছি, তারা দুজনে সেই রকম গল্প কোত্তে কোত্তে ক্রমে ক্রমে আমার চক্ষের অন্তর হয়ে গেল, আদালতের সীমার মধ্যেই আর থাকলো না। রক্তদন্তের বগলেই কাগজের তাড়া ছিল, শেষের সিঁড়ি থেকে সে যখন নামে, তখন সেই তাড়ার ভিতর থেকে খানকতক কাগজ সোরে পোড়লো; আমি দেখতে পেলেম, কিন্তু রক্তদন্ত সেটা জানতে পাল্লে না; পশ্চাতেও আর চাইলে না; অন্যমনস্কভাবে সটান বাহিরের দিকে চোলে গেল। তারা আমার চক্ষের অন্তর হবার পর আমি চুপি চুপি গিয়ে সেই কাগজ কখানা কুড়িয়ে নিলেম; কিসের কাগজ, সেখানে আর দেখলেম না, চারিদিক চেয়ে চেয়ে চাপকানের পকেটেই রেখে দিলেম। সবেমাত্র রেখেছি, সেরেস্তা বন্ধ কোরে বড়বাবু সেই সিঁড়ির ধারে এসেই আমাকে দেখতে পেলেন; দেখেই জিজ্ঞাসা কোল্লেন, “এখানে তুমি? আমি তোমাকে অন্বেষণ কোচ্ছিলেম। চল, আফিস বন্ধ হয়েছে, চল, বাড়ী চল।”
আমরা বাড়ী চোল্লেম। সারাপথ মনটা আমার ছমছমে; দৃষ্টি চঞ্চল। চলি চলি, চারিদিকে চাই; কোন দিকে সেই রাক্ষসটা দাঁড়িয়ে আছে কি না, চঞ্চলনয়নে বার বার চেয়ে চেয়ে ভয়ে ভয়ে তাই আমি দেখি। আমি পশ্চাতে ছিলেম, বড়বাবু আমার চঞ্চলভাব দেখতে পেলেন না, জানতেও পাল্লেন না। বাড়ীর নিকটে পৌঁছে বড়বাবু আমাকে বোল্লেন, “হরিদাস! তুমি বাড়ী যাও, যে বাড়ীতে সেই বীরভূমের বাবুটী এসেছেন, সেই বাড়ীতে আমি একবার যাব, যাবার কথা আছে, একবার দেখা কোরে শীঘ্রই চোলে আসবো; তুমি বাড়ী যাও।”
বড়বাবু বন্ধুর বাড়ীতে গেলেন, আমি বাড়ী এলেম। ঠিক সন্ধ্যাকাল। বৈঠকখানায় বাতী জ্বোলেছে; আফিসের কাপড় ছেড়ে, পকেট থেকে সেই কাগজ-কখানি বাহির কোরে সেজের আলোর কাছে আমি বোসলেম। বড়বাবু উপস্থিত নাই, আমার পক্ষে সেটা তখন একরকম ভালই হলো; দুষ্টলোকের দলীলপত্র নির্জ্জনে দর্শন করাই ভাল। খুলে দেখলেম, খণ্ড খণ্ড ৮/১০ খানা কাগজ। কোন কাজের নয়। তিনখানা দরখাস্তের খসড়া, দুখানা চিঠির মুসাবিদা, চারিখানা দাগধরা ছেঁড়া ছেঁড়া দুর্গন্ধ সাদা কাগজ; কেবল একখানি রক্তদন্তের নামের ক্ষুদ্রচিঠি। কৌতূহলবশে মনোযোগ দিয়ে সেই চিঠিখানি আমি পাঠ কোল্লেম। চিঠিতে লেখা ছিল
“জটাধর।
অনেক দিন তোমার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় নাই, এখন তুমি কোথায় আছ, কি করিতেছ, তোমার বেতনের টাকা কোন ঠিকানায় পাঠাইব, এই পত্রের উত্তরে তাহা লিখিও। হরিদাসকে কোথাও যদি দেখতে পাও, তাহা হইলে তাহার প্রতি আর তুমি কোন প্রকার দৌরাত্ম করিও না, ভয় দেখাইও না, মুখোমুখি সাক্ষাৎ হইলে মিষ্টকথা বলিয়া আদর করিও। তাহার পর যাহা যাহা করিতে হইবে, বিবেচনা করিয়া যথাসময়ে তাহা আমি তোমাকে জানাইব, ইতি।”
ইতির পর যেখানে সন-তারিখ ছিল, পত্ৰলেখকের দস্তখৎ ছিল, সে জায়গাটা ছিঁড়ে গিয়েছে, লেখকের নাম আমি জানতে পাল্লেম না। না পাল্লেও সেই লোকটা যে আমার ভাল চেষ্টা করেন, পত্রের আভাষে তা কতকটা আমি বুঝতে পাল্লেম। ভাল চেষ্টা করেন, তাও কিন্তু ঠিক নয়। রক্তদন্তের নাম জটাধর, দাঁতের বিকৃতি দেখে আমি নাম রেখেছি রক্তদন্ত। রক্তদন্ত আমার উপর দৌরাত্ম করে, পত্ৰলেখক সেটা জানেন; না জানলে নিষেধ কোরবেন কেন? পত্রের আভাষে আরো বুঝা গেল, ঐ পত্ৰলেখকের হকুমমতই যেন রক্তদন্ত চলে, বলে, কাজ করে; হকুম তামিলের জন্যই রক্তদন্ত তাঁর কাছে বেতন পায়। সমস্যা বড় কঠিন। লোকটী তবে কে? দস্তখৎ ছেঁড়া, নির্ণয় করবার উপায় নাই। যা-ই হোক, আপাততঃ আমার পক্ষে মঙ্গল, রক্তদন্তকে দেখে আর আমাকে এখন ভয় পেতে হবে না। ধন্য বিশ্বেশ্বর! রক্তদন্তের ভয়ে বিশ্বেশ্বরপুরী পরিত্যাগ কোরে স্থানান্তরে পালিয়ে যাবার সঙ্কল্প কোচ্ছিলেম, রক্ষা পেলেম, এখন আমাকে কাশী ছেড়ে পালাতে হবে না।
উল্লাসে উল্লাসে প্রস্থান-সঙ্কল্প পরিত্যাগ কোল্লেম, আসলে সন্দেহ থাকলেও মন অনেকটা প্রবুদ্ধ হলো। চোঁতা কাগজগুলো ছিঁড়ে ছিঁড়ে দূরে কোরে টেনে ফেলে দিয়ে কেবল সেই ক্ষুদ্র চিঠিখানি আমি যত্ন কোরে তুলে রাখলেম।
নির্জ্জনে আপন মনে এই কাজগুলি আমি সমাধা কোল্লেম। মনের চিন্তা মনেই থাকলো, অন্য কাজে তখন মনোনিবেশ কোত্তে পাল্লেম না; চুপ কোরে বেসে আছি, মিছামিছি একটা কাজের অছিলা কোরে বৈঠকখানার চাকরটী আমার কাছে এসে দাঁড়ালো। চাকরের নাম যজ্ঞেশ্বর; বয়স প্রায় ৫০/৫৫ বৎসর। বাবুরা যখন কাশীবাস করেন নাই, তার দশবৎসর পূর্ব্বাবধি যজ্ঞেশ্বর তাঁদের দেশের বাড়ীর পুরাতন চাকর। বড়বাবু তাকে সকল কার্য্যেই বিশ্বাস করেন, যথেষ্ট ভালও বাসেন। মেজোবাবুকে আর ছোটবাবুকে যজ্ঞেশ্বর “তুমি তুমি” বলে কথা কয়, বেচাল দেখলে ধমকও দেয়; ছোটবাবু চুপ কোরে থাকেন, মেজোবাবু চোটে চোটে উঠেন; যজ্ঞেশ্বর গ্রাহ্য করে না। আমার উপর যজ্ঞেশ্বরের স্নেহ বোসেছে; ঘনিষ্ঠভাবে আমাকেও “তুমি” বলে, আদরের “তুমি” সম্ভাষণ আমার কাণে বেশ মিষ্ট লাগে।
বাবু বৈঠকখানায় থাকলেও কোন কাজের কথা বলবার আবশ্যক হোলে যজ্ঞেশ্বর বেপরোয়া জাজিমের উপর এসে বসে, বিশেষ কথা থাকলে বাবুর গা ঘেঁসেও বসে, বাবু তাকে কিছুই বলেন না। ঐ রাত্রে যজ্ঞেশ্বর আমার গা ঘেঁসে বোসে চুপি চুপি বোলতে লাগলো, দেখ হরিদাসবাবু! বাবু তোমাকে ভালবাসেন, তোমার অসাক্ষাতে লোকের কাছে কত প্রশংসা করেন, বাড়ীর মেয়েরাও তোমার গুণের কথা বাবুর কাছে বলেন, বাবু খুসী হন। ছোট বাবুও তোমার উপর তুষ্ট, কিন্তু মেজোবাবুর ভাবটা যেন কেমন কেমন। কোন মন্দকাজ তুমি কর না, কোন লোকের কথাতেও তুমি থাকো না; তবু যেন তোমার উপর মেজোবাবুর কেমন রাগ রাগ ভাব। আজ তিনি অনেক বেলা থাকতে বাড়ী এসেছেন, ছোটবাবু আসবেন না, সেখানকার এক বন্ধুর বাড়ীতে নাচ আছে, রাত্রে সেইখানে তাঁর নিমন্ত্রণ, তিনি আজ রাত্রে আসবেন না, মেজোবাবুরও নিমন্ত্রণ ছিল, কি একটা কথা নিয়ে ছোটবাবুর সঙ্গে বকাবকি কোরে তিনি চোলে এসেছেন; সেই রাগের ঝালটা বাড়ীর ভিতর মেয়েদের কাছে ঝাড়া হোচ্চে। স্পষ্ট কারো নাম কোচ্চেন না, আঁচে আঁচে ঠোকোর দিয়ে যাচ্চেন। দাদার উপরেই যেন বেশী ঝাল। মেয়েগুলি সকলেই এক জায়গায় জমা হয়েচেন, কথার উপর কথা কওয়া কারোর সাধ্য নয়। চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে মেজোবাবু বোলচেন, ‘সংসারটা একেবারে ছারেখারে দিলে! হিসেব নাই। ওজন নাই! নিকেশ নাই! কেবল বাজেখরচ, কেবল বাজেখরচ! একজন মনিষ রোজগার করে, দশজনে কেবল বেসে বোসে খায়! মামার শালা, খুড়শ্বশুরের সম্বন্ধী, ছোটখুড়ীর সম্পর্কের মাসী-পিসী, মামীশাশুড়ীর নাতনী, পাড়ার পুঁটীপিসীর দেওরপো, এই সকল পরগাছা জুটে অনেক লোকের সংসার মাটী করে। আমাদেরও প্রায় সেই দশা হয়ে এসেচে! দাদা আমার যেন দাতাকর্ণ! বিদেশে আসা গিয়েছে, এখানকার খরচপত্র অনেক, দশ টাকা হাতে থাকলে অসময়ে কাজে লাগে, সে দিকে ভ্রূক্ষেপ নাই! এখানেও পরগাছার বংশবৃদ্ধি! ভাবনা নাই, চিন্তা নাই, কিসে কি দাঁড়াবে, ভুলে একবার সেটা মনে করাও নাই। চাকরী—চাকরী—চাকরী! আরে, চাকরীর আবার বড়াই কি? চাকরী ত তালগাছের ছায়া, কখন আছে, কখন নাই, কে জানে? দাদা আমার চাকরীর গুমোরেই মত্ত। দেলদরিয়া! ছোট ভাইটীকেও সেই রকম বানিয়ে তুলচেন! আমি মাঝে মাঝে এক একটা কথা বলি, সেই জন্যই আমি অবাধ্য, সেই জন্যই আমি গোঁয়ার। আমার একটা কথাও ভাল লাগে না! খোসামুদে লোকগুলো হাত তুলে বলে, রমণবাবুটী আশুতোষ, ভোলা মহেশ্বর! সেই কথা শুনে দাদা আমার একেবারে ভোলানাথ হয়ে গঙ্গাজলে গোলে যান! লোকগুলোরই বা আক্কেল কি? একটা ঘর নষ্ট হয়ে যায়, একটা সংসারে আগুন জ্বলে, সেই আগুনে বাতাস দেয়! বলে কি না, দশজনের ভরণপোষণ করা বড় ভাগ্যের কথা! আরে, আমি যখন ফকির হয়ে বেড়াবো, তখন আমার ভাগ্যের কথা কোথায় থাকবে? পরিবারের পাঁচজনে খায় পরে, সুখে থাকে, এটা কার ইচ্ছা নয়? যার যেমন ক্ষমতা, সে সেই রকমে সংসার চালায়। এত উৎপাত কার ঘরে? এত পরগাছা কে পুষতে পারে? ধৰ্ম্মের ঘরে কুঠের অভাব নাই! আমাদের ঘরটা তাই হয়েছে। অমুক এলো, অমুক থাকলো, অমুকের শালীর মেয়ে, শালীর ছেলে, শালীর বৌমা এসে সংসার আলো কোরে তুল্লেন! থাকলে সব ভাল, না থাকলে দেয় কে? দাদা আমার সবার উপর ইস্কাবনের টেক্কা! কোথা থেকে একটা ছোঁড়া ধোরে নিয়ে এসেছেন, আমরা মায়ের পেটের ভাই, আমাদের চেয়ে সে ছোঁড়াটার বেশী আদর! ঘিয়ের বাটী, ক্ষীরের বাটী, রুইমাছের মুড়ো, নিত্য বরাদ্দ। উঃ! রাগে আমার সৰ্ব্বাঙ্গ জ্বোলে যায়! বাড়ীর ভিতর মেয়েমহলে সেই ছোঁড়াটার শোবার ঘর! উচক্কা উচক্কা বৌ-ঝি যাদের ঘরে, তারা কি পথের লোককে ধোরে এনে বাড়ীর ভিতর শুতে দেয়? যেদিন আমার খপ্পরে পোড়বে, সেই দিন দেখাবো, একবার মজাখানা!’—এই রকম কত কথাই যে ঠেস দিয়ে দিয়ে মেজোবাবু বোলচেন, মুখে আনতে ঘৃণা হয়। একটা দেয়ালের আড়ালে দাঁড়িয়ে আমি সেই সব কথা শুনছিলেম, অনেকক্ষণ আমার দিকে চক্ষু পড়ে নাই, আমি যেমন সেখান থেকে বেরিয়ে সদরে আসবার জন্য মাঝের দরজা পর্য্যন্ত এসেছি, সেই সময়ে আমাকে দেখেই একেবারে আগুন-অবতার! ‘তুই বেটা এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে কি শুনছিলি? থাক, বেটা থাক! বড় বাড় বেড়েচে! জুতো মেরে তাড়াবো! সব আমি জানতে পেরেছি! তুই বেটাও সেই হতভাগা ছোঁড়া বেটার গোলাম হয়েচিস! আরো যে কত রকম গালাগালি, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে স্থির হয়ে শুনতে পাল্লেম না, মনের ঘৃণায় গুম হয়ে বেরিয়ে এলেম। ঝড় এখনো থামে নাই, এখনো ভয়ানক গর্জ্জন হোচ্চে? বড়বাবু বাড়ী এলে সব কথা আমি বোলে দিব; মেয়েদের মুখেও শুনতে পাবেন, তবু যদি মেজোবাবু আমাকে সেই রকম গালাগালি পাড়ে, আমি না হয় চাকরী ছেড়ে দেশে চোলে যাবো, আর আমার কি হবে? দেখ হরিদাসবাবু, তুমি কিন্তু একটু সাবধানে থেকো; মেজোবাবুর সঙ্গে বেশী ঘনিষ্ঠতা কোত্তে যেয়ো না, তার কথায় বেশী উত্তর কোরো না, গোঁয়ার গোবিন্দি-লোক, কি কথায় কি হবে, কখন কি কোরে বোসবে, তোমার জন্য আমার বড় ভয় হয়। আর একদিন আমি—”
যজ্ঞেশ্বরের কথা শেষ হতে না হতেই চৌকাঠের কাছে বড়বাবু। কোঁচার কাপড়ে চক্ষু মুছে, যজ্ঞেশ্বর তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ালো, অন্যদিকে চেয়ে, বাবুর পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেল। বাবু ঘরে এলেন; এসেই আমারে জিজ্ঞাসা কোলেন, “যজ্ঞেশ্বর এখানে বোসে বোসে কি কোচ্ছিল?”
আমি উত্তর কোল্লেম, “মেজোবাবু বাড়ীর ভিতর কি বকাবকি কোচ্ছেন, অনেক রকম ঝঙ্কার, আমার উপরেও ঠেস ঠাস অনেক; আমি এ বাড়ীতে আছি, আপনি অনুগ্রহ করেন, সেটা তিনি সইতে পারেন না। যজ্ঞেশ্বর আড়ালে দাঁড়িয়ে সেই সব কথা শুনেছিল, সেই অপরাধে যজ্ঞেশ্বরকে তিনি যা ইচ্ছা তাই বোলে গালাগালি দিয়েছেন; যজ্ঞেশ্বর কাঁদতে কাঁদতে আমার কাছে সেই সব কথা বোলছিল।”
বাবু আর তখন বৈঠকখানায় বোসলেন না, আমারেও আর কিছু জিজ্ঞাসা কোল্লেন না, আপন মনে দুই একটা অস্পষ্ট কথা বোলতে বোলতে বাড়ীর ভিতর চোলে গেলেন। যজ্ঞেশ্বর তখন অন্যঘরে প্রবেশ করে নাই, বারান্দাতেই দাঁড়িয়ে ছিল, তৎক্ষণাৎ আমার কাছে আবার এলো; দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই বোলতে লাগলো, “বেশ কোরেচো, বোলে দিয়েছো; বাড়ীর ভিতর যে সব কাণ্ড হয়, সব কথা বাবুর কাণে উঠে না, পিসীমা এক একদিন এক একটা কথা বলেন, সে সব কথা ভেসে যায়, বাবু গুম হয়ে চুপ কোরে শুনেন, রা কাড়েন না।” বোলতে বোলতে যজ্ঞেশ্বর ধীরে ধীরে বোসলে; আবার চুপি চুপি বোলতে লাগলো, “বাবুর কিন্তু ধন্নি বরদাস্ত! ভাল-মন্দ কোন কথাতেই কথা নাই। ভাই-টাকে খুব ভালবাসেন, ছোট ভাইটী কথার বাধ্য, মেজোটী কিন্তু সৰ্ব্বক্ষণ তেরিয়া। যে দিক দিয়ে যা হোক, সব খরচ বড়বাবুর; ভায়েরা যা কিছু রোজগার করেন, আপনাদের সখের খরচেই তার অর্ধেক উড়ে যায়, বাকী অর্ধেক হয় তো জমা থাকে, সংসারে এক পয়সাও সাহায্য করেন না, বড়বাবুও সাহায্য চান না। ছোটবাবু বরং এক একটা ক্রিয়াকর্ম্মের সময় কিছু কিছু দেন, মেজোবাবু চক্ষু বুজে থাকেন। ঐ রকম গায়ের জ্বালা। কৰ্ত্তার আমোল থেকেই আমি আছি, এই সংসারের উপর আমার বড় মায়া, এই বাড়ীকে আমি আপনার বাড়ী মনে করি, ঘরের কথা প্রকাশ কোত্তে নেই, বড় দুঃখেই বোলতে হয়, মেজোবাবুর স্বভাব-চরিত্র একেবারে খারাপ হয়ে গিয়েছে। ছোটবাবুটীরও বদখেয়ালী আছে, কিন্তু সে সব বাহিরে বাহিরে; মেজোবাবুর কাণ্ড-কারখানা কথার কথা নয়; ঘরের ভিতর—না না, কি কেলেঙ্কার কি কেলেঙ্কার! সে সব কেলেঙ্কারের কথা মুখে আনলে প্রাচিত্তির কোত্তে হয়! বেশী দিন তুমি যদি এ বাড়ীতে থাকো, ক্রমে ক্রমে তুমিও অনেক জানতে পারবে। আমি সে দিন—”
কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে শঙ্কিতচিত্তে আমি বোলে উঠলেম, “না বাপু, সে সব কথা আমি শুনতে চাই না, জানতেও চাই না; সে সব কথা তুমি আমার কাছে বোলো না। কে কোথা থেকে শুনবে, একে আর হয়ে যাবে! একে তো মেজোবাবু আমার উপর চটা, তাতে যদি আবার ঘরের কুচ্ছকথা আমি শুনতে চাই কি জানতে চাই, তা যদি তিনি জানতে পারেন, এই আশ্রয়টী আমি হারাবো; কাশীতে থাকবার আর স্থান পাব না; তুমি চুপ কর। যিনি যা ভাল বুঝেন, তিনি তাই করেন, ভালকাজে ভাল হবে, মন্দকাজে পাপের ফল ভোগ কোত্তে হবে, আমার মত গরিবের সে সব কথায় থাকবার দরকার কি? ওসব কথা ছেড়ে দাও; আমি একটা কথা তোমাকে জিজ্ঞাসা করি, আমাদের পাশের বাড়ীতে কারা থাকে, তা কি তুমি জানো? ঐ উত্তরদিকের বাড়ীখানা, ছাদে উঠলে যে বাড়ীর ছাদের অন্ধিসন্ধি বেশ দেখা যায়, ছাদের লোকগুলিকেও স্পষ্ট স্পষ্ট দেখা যায়, সেই বাড়ীর কথাই আমি বোলছি। জানো কি?”
যজ্ঞেশ্বর একটু হাসলে। প্রশ্নের উপর প্রশ্ন দিয়ে আমাকেই জিজ্ঞাসা কোলে, “কেন গো? সে বাড়ীর খোঁজ-খবরে তোমার কি দরকার?”
অপ্রস্তুত না হয়েই আমি উত্তর কোল্লেম, “দরকার এমন কিছুই নয়, তবু বাড়ীর কাছে বাড়ী, ছাদে যদি কোন দিন উঠি, কিছু যদি দেখতে পাই বুঝে রাখবো, এইমাত্র কথা। একদিন আমি উঠেছিলেম, দুটী স্ত্রীলোককে আমি দেখেছি, একজনের বয়স কম, আর একজন বুড়ী। সেই বুড়ীকে যেন আমি কোথায় দেখেছি, তাকে যেন আমি চিনি, এই রকম বোধ হলো; সেই জন্যই জিজ্ঞাসা কোচ্ছি, ও বাড়ীতে কারা থাকে?”
একটী নিশ্বাস ফেলে যজ্ঞেশ্বর বোল্লে, “দেখেছো? রোজ রোজ তাদের আমি দেখি। কত রকম ভাব-ভঙ্গী, কত রকম হাসি-তামাসা, কত রকম চক্ষের খেলা, দেখে দেখে আমি পালিয়ে পালিয়ে আসি; ভাব-ভঙ্গী কিছুই বুঝতে পারি না। বাড়ীখানি অনেক দিন খালি ছিল, তুমি এখানে আসবার মাসখানেক আগে কলিকাতার একটী বাবু ঐ বাড়ীতে এসে রয়েছেন, কুড়িটাকা ভাড়া দেন, পরিবার কজন, তা আমরা জানতে পারি না, বাবুটীর নামও জানি না, মাঝে মাঝে তিনি ছাদে উঠেন, তাতেই চেহারাখানা দেখতে পাই; চেহারাখানা বাবুলোকের মত, কিন্তু কে কি বৃত্তান্ত জানবার সুবিধা হয় না। অনুমানে লাগে, কেবল এক পরিবার ভিন্ন আর কেহ সঙ্গে নাই; সঙ্গিনী ঐ বুড়ী।”
আর আমি কোন কথা জিজ্ঞাসা কোল্লেম না, যতটুকু শুনলেম, তাতেও কিছু বুঝতে পাল্লেম না। বাড়ীর ভিতর ভারী একটা গোলমাল উঠলো, যজ্ঞেশ্বর ছুটে গেল, আর বারান্দায় দাঁড়িয়ে কাণ পেতে শুনতে লাগলেম; দুই তিনজনের গলার আওয়াজ। তা উপলক্ষে গণ্ডগোল, স্পষ্ট বুঝা গেল না, আমিও বাড়ীর ভিতর যাই যাই মনে কোচ্ছি, দ্রূতপদে বড়বাবু উপরে এসে উঠলেন। তখনো কাপড় ছাড়া হয় নাই, সৰ্ব্বশরীরে ঘর্ম্ম,—ঘৰ্ম্মজলে গাত্রবস্ত্র পরিসিক্ত, বদন রক্তবর্ণ। ভাব দেখে আমি বুঝলেম, ব্যাপার গুরতর। বৈঠকখানাতেই কাপড় ছাড়া হলো, যজ্ঞেশ্বর একখানি শুল্ক তোয়ালে দিয়ে গাত্র মার্জ্জনা কোরে দিলে, বাবু অনেকক্ষণ নীরব হয়ে একটা তাকিয়ার কাছে বোসে রইলেন। এই সময় সদরবাড়ীতেও চীৎকারশব্দ। কে একজন চীৎকার কোত্রে কোত্তে বাড়ী থেকে ছুটে বেরিয়ে গেল। পরে শুনলেম, মেজোবাবু। তিনি আর সে রাত্রে বাড়ীতে ফিরে এলেন না, বড়বাবুও তত্ত্ব নিলেন না, অসুখে অসুখেই রাত্রিটা কেটে গেল। কি সুত্রে কি প্রকার কলহ, আমি আর সেটা জানবার জন্য আগ্রহ প্রকাশ কোল্লেম না। সূত্রের আভাষটা যজ্ঞেশ্বরের মুখে পূর্ব্বেই কতক কতক শনা হয়েছিল, অনুমানে সিদ্ধান্ত কোল্লেম, আমাকে উপলক্ষ কোরেই ভাই ভাই কলহ। কলহে বড়বাবু অনভ্যস্ত, মেজোবাবুই বেশী কথা বোলেছেন, বেশী গোল কোরেছেন, তাতে আর সন্দেহ থাকলো না।
প্রভাতে বাড়ীর ভিতর মেয়েদের কাছে শুনলেম, মেজোবাবু এ সংসার থেকে পৃথক হবেন, পরিবার নিয়ে স্বতন্ত্র থাকবেন, বড়বাবুর টাকায় বাড়ী, তবুও অংশমত বাড়ীর তৃতীয়াংশের মূল্য আদায় কোরবেন, কারো সঙ্গে আর কোন সংস্রব রাখবেন না। লক্ষণও সেইপ্রকার। মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি, শনি এই পাঁচ দিনের মধ্যে মেজোবাবু আর একদিনও বাড়ী এলেন না, কোন সংবাদও পাঠালেন না।
রবিবার। আজ সেই বীরভূমের বাবুর তীর্থোৎসব। কোন বাড়ীতে তিনি এসে উঠেছেন, ঠিক আমার জানা হয় নাই, শুনেছিলেম, কেবল বড়বাবুর এক বন্ধুর বাড়ীতেই সেই সমারোহ হবে। আহারাদির পর বড়বাবু আমাকে সঙ্গে কোরে সেই বন্ধুর বাড়ীতে নিয়ে গেলেন। দণ্ডীভোজন, কাঙ্গালীভোজন আর কুমারীভোজন। পাঠকমহাশয়ের স্মরণ থাকতে পারে, রসিকলাল পিতুড়ী নামে একটী বাবু, আমার কাছে একদিন আমাদের বড়বাবুর পরিবারবর্গের পরিচয় দিয়েছিলেন, এই বাড়ীখানি সেই রসিকবাবুর। বাড়ীতে একটা ক্রিয়াকাণ্ড উপস্থিত হোলে, বাড়ীর লোকেরা, বিশেষতঃ কর্ত্তাপক্ষের পুরুষেরা অত্যন্ত ব্যস্ত থাকেন, উপরে নীচে, ভিতরে বাহিরে, এ ঘর ও ঘর ছুটাছুটি করেন, নিমন্ত্রিত লোকের আদর-অভ্যর্থনা করেন, ছোট বড় কর্ম্মচারিলোকের উপর গলাবাজী করেন; রসিকবাবু আজ সেইরপ ব্যস্ত। বড়বাবু আমাকে একটী ঘরে পাঁচজনের কাছে বসিয়ে রেখে কাৰ্য্যান্তরে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন, রসিকবাবুর সঙ্গে এক একটা কার্য্যের পরামর্শ কোচ্ছিলেন, ঘরের ভিতর থেকে এক একবার আমি তাঁদের উভয়কেই দেখতে পাচ্ছিলেম। যে ঘরে আমি, রসিকবাবু সেই ঘরের সম্মুখ দিয়ে দুই তিনবার হন হন কোরে চোলে গিয়েছেন, এক একবার ঘরের দিকেও চেয়েছেন, আমার প্রতি ততটা লক্ষ্য করেন নাই; বোধ হয় তখন তিনি আমাকে চিনতেই পারেন নাই।
একদিনের দেখা, খানিকক্ষণের পরিচয়, চিনতে পারা ততটা সম্ভবও ছিল না, তিনি আমাকে চিনতে পারেন নাই। একঘণ্টা পরে, বোধ হয় বড়বাবুর মুখে শুনে, রসিকবাবু সেই ঘরে এসে আমাকে দেখলেন, তখন চিনতে পাল্লেন; প্রসন্নবদনে বোল্লেন, “হরিদাস! তুমি এসেছ, বড়ই সন্তুষ্ট হলেম, নানা কাৰ্য্যে আমি ব্যস্ত, এতক্ষণ তোমাকে দেখতে পাই নাই, এখানে তুমি কেন বোসেছ, তুমি ছেলেমানুষ, সদরবাড়ীর ভিড়ের ভিতর তুমি কেন? এসো, বাড়ীর ভিতর এসো, কুমারীভোজন আরম্ভ হয়েছে, দেখবে এসো।”
আমার মন তখন অন্যদিকে ছিল। রসিকবাবুকে দেখবো, কুমারীভোজন দেখবো, আমি তখন আশা করি নাই; আমার প্রধান আশা কর্ম্মকর্ত্তাকে দেখা। বীরভূমের জমীদার, তিনি আমার পরিচিত কি অপরিচিত, তিনি আমার সেই অকারণ-বন্ধু, নরহরিবাবু কি না, সেইটী জানবার জন্যই আমার চিত্ত ব্যাকুল ছিল, তখন সুবিধা হলো না; রসিকবাবু ডাকলেন, তাঁর সঙ্গে অন্দরমহলে গেলেম। কেবল মেয়েমানুষের ভিড়। হরেক রকম কাপড়পরা, রকমারি গহনা গায়, রকমারি খোঁপাবাঁধা, শতাধিক মেয়েমানুষ। এ বাড়ীর ভিতরমহলটাও চকবন্দী; চারিদিকে টানা বারান্দা, প্রত্যেক বারান্দায় সারি সারি কার্পেটের আসন পাতা, প্রত্যেক আসনের কাছে কাছে পুষ্পচন্দনের রেকাব, আসনের সম্মুখে সম্মুখে পরিষ্কার ধাতুপাত্রে বিবিধ মিষ্টান্ন, দক্ষিণপার্শ্বে এক একটী জলপাত্র। দশজন স্ত্রীলোক একধারে কুমারীগণের পদপ্রক্ষালন কোরে দিচ্ছে, কুমারীরা বাতকম্পিত পদ্মফুলের মত হেলে দুলে এক একখানি আসনে গিয়ে বোসছে। কপাল পর্য্যন্ত ঘোমটা ঢাকা, অষ্টালঙ্কারে ভূষিতা, বারাণসী শাড়ীপরা, একটী শ্যামবর্ণা, সুন্দরী যুবতী গলবস্ত্র হয়ে প্রত্যেক কুমারীর পাদপদ্মে পুষ্পদান, গলদেশে মাল্যদান আর ললাটে রক্তচন্দনের তিলকদান কোরে করপুটে প্রণাম কোচ্ছে। অর্চ্চনাকাৰ্য্য সমাপ্ত হলো, কুমারীরা ভোজনকার্য্যে মনোযোগ দিল। চকের একটী ঘরের দরজার ধারে দাঁড়িয়ে আমি কুমারী ভোজন দেখতে লাগলেম।
বড় বড় কুমারী। হিন্দুস্থানী কুমারীও আছে, বাঙ্গালী কুমারীও কতকগুলি আছে। বঙ্গদেশে যাজ্ঞবল্ক্য ঋষির বচনপ্রমাণে দশ বৎসরের অধিকবয়স্কা বালিকাগণকে কুমারী বলা হয় না, কাশীতে দেখলেম, বিংশতিবর্ষের ননবয়স্কা কুমারী একটীও নাই; হিন্দুস্থানী কুমারীদের দলে তদপেক্ষা আরো অধিকবয়স্কা রমণীও অনেক। আমার মনের কথার মিলনে সে সকল কুমারীর যদি পরিচয় হয়, তা হোলে আমার মনের অভিধান অনুসারে ব্যাখ্যা হওয়া উচিত, তারা সব প্রৌঢ়া কুমারী। অনুমানে আসে, কেহ কেহ একপুত্রবতী, কেহ কেহ দুই বা ততোধিক সন্তানের গর্ভধারিণী, সূক্ষ্মদর্শকের নয়নে বক্ষঃস্থলের নিম্নভাগের গঠনে কেহ কেহ গর্ভবতী!
কুমারীদের কারো মুখে ঘোমটা নাই। না থাকার দুই কারণ। বিবাহের অগ্রে আমাদের দেশে ঘোমটা দিবার রীতি নাই, এই এক কারণ, দ্বিতীয় কারণ, সে মজলীসে যুবা অথবা প্রৌঢ়পুরুষ একজনও ছিল না। আমার মত বয়সের আট দশজন বালকের সঙ্গে কতকগুলি স্ত্রীলোক সেখানে পরিবেশনকার্য্যে নিযুক্ত; সুতরাং ঘোমটা নিষ্প্রয়োজন। বালিকারাও কুমারী, যুবতীরাও কুমারী, প্রৌঢ়ারাও কুমারী; অভাবের মধ্যে প্রবীণা প্রাচীন। সধবা কুমারী থাকা সম্ভব হয় না, নিতান্ত অসম্ভবও মনে করা যায় না। সধবার চিহ্ন সীমন্তে সিন্দুর; যে সকল সধবার কুমারীপূজাগ্রহণে আকাঙ্ক্ষা থাকে, তারা স্বচ্ছন্দে অল্পক্ষণের জন্য ললাটের সিন্দুরবিন্দুগুলিকে বিদায় কোরে দিতে পারে; এরূপ প্রক্রিয়ায় সধবাকুমারী জানা যায় না; বিধবা-কুমারী ধরবার তো কোন সম্ভাবনাই নাই; কেন না, বিধবারা সিঁদুরের ধার ধারে না, সিঁদুরের উৎপাতও রাখে না।
সব মুখগুলি খোলা। একজায়গায় দাঁড়িয়ে যতগুলি মুখ দেখা যায়, কুভাবপরিশূন্য-নয়নে সবমুখগুলি আমি ভাল কোরে দেখলেম। সুন্দরী কুমারী, অসুন্দরী কুমারী, মনে মনে দুই শ্রেণীতে বিভক্ত কোল্লেম; কলসীর উপর কলসী, তার উপর কলসী, গঙ্গাজলপূর্ণ তিন তিন কলসী মাথায় নিয়ে, কাশীর ঘাটের অগন্তি সিঁড়ি ভেঙে, যে সকল গজেন্দ্রগামিনী খোট্টা-মহিলা অক্লেশে গৃহস্থলোকের বাড়ী বাড়ী গঙ্গাজল যোগান দেয়, তাদেরও কেহ কেহ এই কুমারীর দলে আছে, দুই একখানা মুখ দেখে তাও আমি চিনতে পাল্লেম। একে একে চেয়ে চেয়ে দেখতে দেখতে দুখানি মুখের দিকে আমার চঞ্চলনয়ন অকস্মাৎ সমধিক আকৃষ্ট হলো। আমি চোমকে উঠলেম!
এরাও কি কাশীধামের কুমারী? কি আশ্চর্য্য! মোহনলালবাবু একজন মানীলোক, মান্যগণ্য ধনবান লোক, একজন উপরত প্রসিদ্ধ লোকের জামাতা, তিনি কিরুপে এই গহিত কাৰ্য্যে অনুমতি দিলেন? এ তো দেখছি অমরকুমারী! ভেলুয়া-চটীতে মোহনলালবাবু আমাকে বোলেছিলেন, অমরকুমারী নয়, সেই কন্যাটীকে সম্প্রতি তিনি বিবাহ কোরেছেন। বিবাহটা হয় তো সত্য হোতে পারে, কিন্তু অমরকুমারী নয়, এটা তো আমার কিছুতেই বিশ্বাস হয় না;—তখনও হয় নাই, এখনো হোচ্ছে না। অমরকুমারী নিশ্চয়। আমি যখন অমরকুমারীকে দেখি, তখন অমরকুমারী সত্যই কুমারী ছিলেন; পিতা গরিব, কোন গতিকে কাশীতে এসে, অমরকুমারী আপনাদের দেশস্থ লোকের কুমারী-পুজায় কুমারী হোতে এসেছেন, এটা তত দোষের কথা নয়; কিন্তু সত্য যদি বিবাহ হয়ে থাকে, তবে এটা নিতান্তই জঘন্য কাৰ্য্য। অমরকুমারীর মন আমি বুঝেছি, সরলতাও জেনেছি, সৎশিক্ষার পরিচয়ও পেয়েছি, এমন জঘন্য কার্য্যে সেই অমন সরলচরিত্রা অমরকুমারীর প্রবৃত্তি হবে, এমন তো কখনই বিশ্বাস হয় না। তবে কি মোহনলালবাবু আমার কাছে মিথ্যাকথা বোলেছেন? তাই হয় তো ঠিক হবে। মিথ্যাকথা; বিবাহের কথাটা একান্তই মিথ্যা!
অমরকুমারীকে আমি দেখলেম, অমরকুমারী আমাকে না দেখেন, সেজন্য সাবধান হোলেম; কপাটের আড়ালে একটু সোরে দাঁড়ালেম। পূর্ব্বে বোলেছি, দুখানি মুখ। একখানি তো অমরকুমারীর, আর একখানি কার? তা আমি জানি না। কার মুখ, তা আমি জানি না বটে, কিন্তু যার মুখ, তারে আমি একদিন দেখেছি;—এই কাশীধামেই দেখেছি। সেই সুন্দরী কিসের লোভে এখানে কুমারী হোতে এসেছে? যখন আমি দেখেছিলেম, তখন দামী দামী অলঙ্কার-বস্তু অঙ্গে ছিল, এখনো দেখছি সেই রকম; তবে এ সুন্দরী এমন ভাবে দানবাড়ীতে কেন বেড়ায়? আরো এক কথা বাঙ্গালীর মেয়ে, এত বয়স পর্য্যন্ত কুমারী আছে, এটাই বা কি? এত কুমারী একত্র, এদের মধ্যে ঐ রকমের আরো কত আছে অথবা সকলেই ঐ রকম, তাই বা আমি কিরুপে জানবো? সকলে একরকম নয়, এমন কথাই বা কে বোলতে পারে? কাশী একেবারে মেয়েলোকের পুরী নয়, যে সকল মেয়েলোকের মাথার উপরে পুরুষ অভিভাবক আছে, সেই সকল পুরুষেরাই বা কোন লজ্জায় এমন সব সধবাবিধবা সুন্দরীগুলিকে ঠাঁটঠমোকে কুমারী সাজিয়ে পাঠায়? খোট্টামহলে কি রকম চলে না চলে তা আমার বিশেষ জানা নাই, কিন্তু বাঙ্গালীমহলে এ কি? একদিন একটী লোক আমাকে বলেছিল, “কাশীর বাঙ্গালীদলে অনেকগুলি বহুরুপী; দেশে যারা ছাগল ছিল, ধরা পড়াতে কিম্বা পড়বার আশঙ্কাতে সেই সকল ছাগল কাশীতে এসে বাবু হয়েছে!”
সত্যই কি তাই? পূণ্যবানের ভান কোরে তারাই কি সব কাশীবাসী? দেশের ছাগল কাশীর বাবু; দেশের ছাগলী কাশীর কুমারী, কাশীর সধবা; কাশী-রঙ্গভূমির এ রঙ্গ লোমহর্ষণ! ধন্য কাশীরাম! ধন্য বিশ্বেশ্বর! ধন্য মহিমা! মরণেই মুক্তি! মরণের অগ্রে এই সব কাশীবাসী যেন সশরীরে শিবলোকে প্রস্থান কোচ্ছে, ভূতনাথের অনুচর সেজে তালে-বেতালে নৃত্য কোচ্ছে, রঙ্গভঙ্গ দেখে শুনে তাই যেন আমার মনে হয়! বোলেছি, একটী সুন্দরী কুমারীকে একদিন আমি কাশীতেই দেখেছি, সত্য সত্য কুমারী কি না, বিশ্বেশ্বর জানেন; কিন্তু আমি দেখেছি। কোথায় দেখেছি, সেই কথাটী আবার বলি। আমাদের বাড়ীর পাশের বাড়ীর ছাদের উপর। যৌবনভার- মন্থরা, পীনোন্নত-পয়োধরা, রেশমী-রুমালহস্তা, চঞ্চল-কুরঙ্গনেত্রা সুরঙ্গিণী। সেই সুরঙ্গিণীই এই কাৰ্য্য-বাড়ীর একটী পবিত্র কুমারী।
বাহবা বাহবা বাহবা! বিশ্বেশ্বরের প্রসাদে এই পবিত্র মুক্তিক্ষেত্রে কত রকম তামাসাই যে হয়, কাশীবাসীরাই সেই সকল তামাসার নিত্য-দর্শক, নিত্য নিত্য নূতন নূতন রসভোগী! কাশী আমি ছাড়বো না। রক্তদন্ত কাশীতে এসেছে, রক্তদন্তকে দেখে আমার ভয় হয়েছিল, রক্তদন্তের ভয়ে কাশী ছাড়বার ইচ্ছা হয়েছিল, সে ভয়টা ঘুচে গিয়েছে;— সেই ছেঁড়া চিঠিখানা আমাকে সে ভয় থেকে আপাততঃ পরিত্রাণ কোরেছে। কাশী আমি ছাড়বো না, কতদূরে এই সকল রঙ্গের সমাপ্তি, সেটা আমি দেখবোই দেখবো।
সে সব দেখা তো ভবিষ্যতের কথা, এখন—এই আজ আমার কি দেখবার সাধ? বীরভূমের জমীদার। যাঁর দৌলতে কুমারী-রঙ্গ দর্শন, তাঁরে আমি কখন দেখতে পাবো, সেই ব্যাকুলতা সৰ্ব্বক্ষণ আমার অন্তরে। কুমারীভোজন সমাপ্ত হলো, রসিকবাবু এসে আমাকে কিছু জল খেতে দিলেন, রসিকবাবুর স্ত্রীর সঙ্গে আমি দেখা কোল্লেম। স্ত্রীটী দিব্য প্রসন্নমুখী, সন্তান হয় নাই; কিন্তু দেখায় যেন দুই তিন পুত্রের জননী, রসিকবাবুর চেয়ে যেন আট দশ বৎসরের বড়। পিতুড়ীর ঘরে “বর বড় কি কোনে বড়,” এই মন্ত্রের যে তো সার্থকতা আছে, এই ভাবটা একবার মনে এলে;—যেমন এলো, তেমনি আবার ডুবে গেল। স্ত্রীটী কিছু স্থূলাঙ্গী, সেই জন্যই বোধ হয়, বড় দেখায়, সেই জন্যই হয় তো পুত্রবতী মনে হয়।
রসিকবাবু আমাকে সদরবাড়ীতে নিয়ে এলেন, সদরবাড়ীর লোক তখন অনেক পাতলা হয়ে গিয়েছে, একটা ঘরের সম্মুখে আমাদের বড়বাবু একটী লোকের সঙ্গে হেসে হেসে কথা কোচ্ছিলেন, সেই লোকটা দীর্ঘাকার, স্থূলাঙ্গ, বুকে অনেক চুল, শ্যামবর্ণ, গলায় তুলসীমালার সঙ্গে ছোট ছোট মাদুলী, চোমরা গোঁফ, ক্ষুদ্র চক্ষু, টানা ভ্রূ, বাবরী চুল, মাঝখানে সিঁতিকাটা, কথা শুনে বুঝতে পাল্লেম, স্বর বড় কর্কশ। আমি তাঁদের নিকটে গিয়ে দাঁড়ালেম, একটু হেসে বড়বাবু আমাকে জিজ্ঞাসা কোল্লেন, “কি হরিদাস! কুমারীভোজন দেখা হলো?”
আমার হাসি পেলে। মাথা হেঁট কোরে মৃদু হেসে উত্তর কোল্লেম, “আজ্ঞে হাঁ।” যে লোকটীর সঙ্গে বড়বাবুর কথা হোচ্ছিল, সেই লোকটী আমার দিকে একবার চাইলেন, আমিও তাঁর মুখের দিকে তাকালেম, বোধ হলো, যেন চিনেছি, চেনা মুখ, মনটা কেমন তর্কে উঠলো। সেই সময় বড়বাবু আমাকে বোল্লেন, “যাঁর কথা তোমাকে আমি বোলেছিলেম, ইনিই সেই বাবু, বীরভূমের জমীদার—নাম কানাইলাল বাবু।”
তর্কের উপর তর্ক। চেহারা দেখে যা অনুমান কোরেছিলেম, নাম শুনে সেই অনুমানটা নিশ্চয়তায় পরিণত হলো। শিষ্টাচারের অনুরোধে হাত তুলে আমি কানাইবাবুকে নমস্কার কোল্লেম, অন্তরে কিন্তু বিজাতীয় ঘৃণা। কলিকাতার জোড়াসাঁকোর বাড়ীতে ঐ মূর্ত্তি আমার একবারমাত্র দেখা, ঐরূপ কর্কশস্বরে এই কানাই আমাকে বিদায় কোরে দিয়েছিলেন। কানাইবাবুর স্বভাবের পরিচয় বীরভূমের বাণেশ্বরবাবুর চাকরদের মুখে শুনা হয়েছিল, মাতুলকন্যার রসের নাগর! সেই কথা স্মরণ হওয়াতেই এই লোকের প্রতি অকস্মাৎ আমার ঘৃণা।
আমার কাছে কানাইবাবুর পরিচয় দিয়ে, বড়বাবু সংক্ষেপে সংক্ষেপে কানাইবাবুর কাছেও আমার পরিচয় দিয়ে দিলেন। কানাইবাবু আর একবার আমার দিকে চাইলেন, কথাও কইলেন না, চিনতেও পাল্লেন না। তিনি বাবুলোক, আমি গরিব, একদিন একবার পলকমাত্র দেখা, আমি চিনে রেখেছিলেম, তিনি কেন আমার চেহারা মনে কোরে রাখবেন? বীরভূমে তাঁরে আমি দেখি নাই; নাম শুনেছিলেম, কার্য্য শুনেছিলেম, কলিকাতায় একবার দেখেছিলেম, এই পর্য্যন্ত কথা। তাঁর সম্বন্ধে কি কি আমি জানি, তিনি সে কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারেন নাই।
কানাইবাবু ব্যস্ত, বড়বাবুর কাছে বিদায় নিয়ে তিনি কাৰ্য্যান্তরে অন্যদিকে চোলে গেলেন। বড়বাবু আমারে আর একটা ঘরে নিয়ে বসালেন, তিনি নিজেও সেখানে বোসলেন। সে ঘরে তখন অন্য কেহ ছিল না। নির্জ্জন পেয়ে বড়বাবুকে আমি জিজ্ঞাসা কোল্লেম, “ঐ উনিই কি একা এসেছেন কিবা আর কোন জমীদার সঙ্গে আছেন?” বড়বাবু বোল্লেন, “পুরুষের মধ্যে উনি একাকী, পরিবার সঙ্গে আছেন।” আর কোন কথা আমি জিজ্ঞাসা কোল্লেম না। বেলা গেল, রসিকবাবুর সঙ্গে দেখা কোরে বড়বাবুর সঙ্গে আমি বাড়ী চোলে এলেম। সেই রাত্রে আমার অনেক ভাবনা। দুটী ভাবনা প্রধান। কানাইবাবু বীরভূমের জমীদার, এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা। যতদূর আমি জানি, তাতে কোরে বুঝা যায়, কাশীতে উনি পালিয়ে এসেছেন। সঙ্গে একটী স্ত্রীলোক আছে, তারেই পরিবার বোলে পরিচয় দিয়েছেন। যে স্ত্রীলোকটী বারাণসী শাড়ী পোরে কুমারীগুলিকে ফুল-চন্দন দিলেন, ফুলের মালা পরালেন, তিনিই বোধ হয় পরিবার। আমি যে রাত্রে রক্তদন্তের বাড়ী থেকে নারীবেশে পলায়ন করি, পথে বেরিয়েই ধরা পড়ি, সেই রাত্রে কানাইবাবুর মামার বাড়ীতে আমার বাস হয়; যারা আমাকে ধোরেছিল, তাদের ভুল। কানাইবাবু এখন যারে পরিবার সাজিয়ে কাশীতে এনেছেন, সেই মেয়েটী বাড়ী থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল, নারীবেশে আমিই বুঝি সেই, তাই ভেবেই লোকেরা আমাকে ধরে। মেয়েটী কানাইবাবুর মাতুলকন্যা, সেই মাতুলকন্যার প্রেমাসক্ত কানাইবাবু; তিনিই তাকে কুপথগামিনী করেন; নিশ্চয় বুঝলেম, সেই মাতুলকন্যাই এই পরিবার! আর একটা কথা। কানাইবাবু বাল্যাবধি মামার বাড়ীর অন্নদাস; জমীদার অথবা জমীদারপুত্র হোলে কদাচ মাতুলের গলগ্রহ হয়ে থাকতেন না। কাশীতে কানাইবাবু একজন ছদ্মবেশী ভূমিশূন্য ভণ্ড ভূস্বামী, এই পরিচয় ঠিক। বীরভূমে গুপ্তভাবে মাতুলের ঘরজামাই হয়েছিলেন। বাড়ীর ভিতর বেশী দিন ঘরজামাই থাকা চোলবে না, প্রকাশের ভয়ে নায়ক-নায়িকা একে একে তফাৎ হয়ে পড়েন। প্রথমে হয় তো নায়িকাটীকে কলিকাতায় আনা হয়েছিল, তার পর নিরাপদ হবার জন্য পরিবার-পরিচয়ে কাশীতে আনা হয়েছে। ইহার মধ্যেও একটা প্রশ্ন আছে। কানাই যদি জমীদার নয়, তবে কাশীর উৎসবে এত সমারোহ করবার টাকা পেলে কোথা? এ প্রশ্নের উত্তরটা কিছু কঠিন হোলেও আমার অনুমানে অতি সহজ। যে লোক মামার ভাতে মানুষ হয়ে মামার মেয়েকে ঐ ভাবে দখল কোত্তে পারে, তার অসাধ্য কৰ্ম্ম কি আছে? নিশ্চয়ই মামার টাকা চুরি কোরে এনেছে; তীর্থস্থানে বাবুগিরীর টাকাগুলি নিশ্চয়ই চুরিকরা টাকা। এ রহস্য প্রকাশ হবে না, এমন কথাও নয়; পাপকর্ম্ম কত দিন চাপা থাকে? একদিন না একদিন অবশ্যই প্রকাশ হবে। আমি যদি মনে করি, নরহরিবাবুকে চিঠি লিখে অচিরেই ধোরিয়ে দিতে পারি। পারি বটে, কিন্তু কাজ কি? ধর্ম্ম আছেন, দশদিন পরে হোক, একমাস পরে হোক অথবা বর্ষ পরেই হোক, ধর্ম্মের ঢাক বাজবেই বাজবে।
দ্বিতীয় ভাবনা অমরকুমারী। কাশীর কুমারীদলে অমরকুমারী। আমি কুমারীভোজের আসরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মুখের দিকে চেয়ে থাকলেম, আমার দিকেও কতবার চক্ষু পোড়লো, তথাপি অমরকুমারী আমাকে চিনতে পাল্লেন না। ভেলুয়া-চটীতে জ্বলন্ত আগুনের মুখ থেকে যখন আমি উদ্ধার করি, তখনো অমরকুমারী আমাকে চিনতে পারেন নাই। ভাব কি? চেনালোকের সঙ্গে দেখা হোলে, মুখের কথায় না হোক, ভাবভঙ্গী দ্বারাও কিছু কিছু প্রকাশ পায়; কিন্তু কিছুই না। ভাব কি? সরলার ততটা হিতানুরাগ, ততটা দয়া, আত্মীয়তা কোথায় গেল? সত্য কি অমরকুমারী এত অল্পদিনে আমাকে একেবারে ভুলে গেলেন? মোহনলালবাবু, অমরকুমারীকে বিবাহ কোরেছেন, আমি কাশীতে আসবো, অমরকুমারীকে নিয়ে তিনি প্রয়াগে যাবেন, এইরূপ কথা ছিল, অমরকুমারী তবে কার সঙ্গে কাশীতে এসেছেন? বিবাহিতা বালিকা কার মন্ত্রণায় কুমারী সেজেছেন? ভাবলেম অনেক, কিছুই ঠিক কোত্তে পাল্লেম না। মোহনবাবুও হয় তো এখানে এসে থাকবেন, অনুমানে কেবল এইটুকু অবধারণ করা গেল।
অপরাপর চিন্তা এ ক্ষেত্রে পাঠকমহাশয়ের প্রীতিকরী না হোতে পারে, তাই ভেবে এখন সে সব প্রকাশ কোল্লেম না। রজনী প্রভাত হলো, প্রভাতসূৰ্য্য দেখা দিলেন, যথাসময়ে অস্ত গেলেন, আবার রাত্রি এলো, আবার উষা দেখা দিল, আবার সূৰ্য্যোদয়, আবার অস্ত। এই প্রকারে সপ্তাহকাল সূর্য্যের উদয়াস্ত আমি দশন কোল্লেম। আবার রবিবার। এক রবিবার ছাদে উঠেছিলেম, নূতনমূর্ত্তি দর্শন কোরেছি, আর একবার দেখে আসি, এইরূপ মনে হলো, কিন্তু সাহস কোত্তে পাল্লেম না; কিসে কি হবে, কে কি বলবে, এই শঙ্কায় মনের ইচ্ছাকে মনে মনেই চেপে রাখলেম।