ভূবনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়
হরিদাসের গুপ্তকথাপ্রথম খণ্ড
উনবিংশ কল্প : কোথাকার পাপ কোথায়?
বড়বাবু প্রতি রবিবার বৈকালে বেড়াতে যান, সন্ধ্যার পর ফিরে আসেন। আজ রবিবার। বেলা পাঁচটা বাজবার পূর্ব্বেই তিনি বেরিয়ে গিয়েছেন, বৈঠকখানায় আমি একাকী আছি। মেজোবাবু আর বাড়ী আসেন না, ছোটবাবুও দু-তিনদিন আসেন নাই, বাড়ীতে তখন আমি একাকী। রবিবার হোলেই আমার ইংরেজী আলোচনার অবসর হয়, একখানি ইংরেজী পুস্তক পাঠ কোত্তে আরম্ভ কোরেছি, মন কিন্তু উতলা; কত রকমের কত কথাই মনে আসছে, ক্ষণে ক্ষণে অন্যমনস্ক হোচ্ছি, পুস্তকপাঠে একাগ্র হোতে পাচ্ছি না, অর্থবোধের সমন্বয় থাকছে না, এক একবার অক্ষরগুলিও যেন ছেড়ে ছেড়ে যাচ্ছি, এত অন্যমনস্ক। কিছুই ভাল লাগছে না। পুস্তকখানি মুড়ে রাখলেম, উঠে একবার বারান্দায় এলেম; আবার ঘরের ভিতর প্রবেশ কোল্লেম, কি জানি, কেমন এক প্রকার অস্থিরতা আমাকে আক্রমণ কোল্লে; যজ্ঞেশ্বরকে ডাকলেম; যজ্ঞেশ্বর এলো; আমার কাছে এসে বোসলো। খানিকক্ষণ নীরবে আমি তার মুখপানে চেয়ে থাকলেম, কি কথা বোলবো, যজ্ঞেশ্বর কিছুই অনুমান কোতে পাল্পে না। আরও খানিকক্ষণ চুপ কোরে থেকে মৃদুস্বরে আমি বোল্লেম, “যজ্ঞেশ্বর। আজ কদিন আমি তোমাকে একটী কথা বোলবো বোলবো মনে কোচ্ছি, বোলতে পাচ্ছি না, কথাটী তুমি রাখবে কি? কথাটী তুমি শুনবে কি? কারো কাছে কিন্তু এখন সে কথাটী প্রকাশ কোরো না; নিতান্ত গোপনীয়কথা নয়, তবু যেন ভয় করে! তুমি ভালমানুষ, তোমার মুখে বেশী কথা নাই, পরের কথা পরকে বলা তোমার স্বভাব নয়, বেশ আমি জানতে পেরেছি, সেই জন্যই তোমাকে বলা। কারো কাছে কিছু, এখন প্রকাশ কোরো না।”
বুঝতে না পেরে অল্প অল্প হেসে, যজ্ঞেশ্বর তখন বোল্লে, “কথা তো তোমার কিছুই নয়, কেবল গৌর-চন্দ্রিমাই শুনচি, কেবল বার বার আমাকে সাবধানই কোচ্চো; প্রকাশ কোরো না, প্রকাশ কোরো না, এই কথাই তো বোলচো, আসলকথাটা কি, ভেঙে চুরে খোলস কোরেই বল, আমার মুখে কেহই কিছু শুনতে পাবে না, ভয় নাই, তুমি বল।”
পুনৰ্ব্বার সাবধান কোরে চুপি চুপি আমি বোল্লেম, “জানোই তো, সে দিন আমি ছাদে উঠেছিলেম, যা যা দেখেছি, তোমার সাক্ষাতে বোলেছি, তুমিও কতদিন দেখেছো, কে তারা, ভদ্রলোকের মেয়ে, লজ্জা-সরম নাই, এমন কোরে ছাদে ছাদে চেয়ে চেয়ে কেন বেড়ায়, কেন সে অঙ্গভঙ্গী কোরে রুমাল ঘুরায়, সন্ধানটা একবার নিতে পার?”
ভ্রূ কুঞ্চিত কোরে হাসতে হাসতে যজ্ঞেশ্বর বোল্লে, “ও বাপ! তোমার পেটে এত বিদ্দে! কাদের মেয়ে, কেন বেড়ায়, কেন ভঙ্গী করে, সে সব খবর নিয়ে তুমি কি কোরবে? বাড়ীর সকলে তোমায় ভাল বলে, আমরাও দেখি, কোন দিকে তোমার উঁচু দৃষ্টি নাই, স্বভাব ঠাণ্ডা, ও সব খোঁজখবর তুমি কেন রাখতে চাও? ছি! লোকে জানতে পাল্লে নিন্দে হবে, বড়বাবু রাগ কোরবেন, মেয়েরা সব হাসবে, অমন কর্ম্ম কোরো না; ও সব কথা আমায় বোলো না; কাশীজায়গা, তীর্থস্থান, কত আসে, কত যায়, কে কোথায় থাকে, কে তার খবর রাখে? আমার মুখে প্রকাশ হবে না বটে, কিন্তু কোন রকমে লোকে যদি কিছু জানতে পারে, তা হোলে ভারী একটা গোলমাল বেধে যাবে?”
একটু অপ্রতিভ হয়ে, সন্দিগ্ধ বক্তার মুখের দিকে চেয়ে, অসঙ্কোচে আমি বোল্লেম, “না না, সে কথা বোলছি না, আমার কথার ভাবটা তুমি বুঝতে পাচ্ছো না, আগে শোনো, তার পর ভালমন্দ বিচার কোরো। সেই যে বুড়ী আছে, তাকে যেন আমি চিনি চিনি মনে হয়; কলিকাতায় তাকে যেন আমি দেখেছি। তুমিও সে দিন বোলেছে, কলিকাতার এক বাবু, সম্প্রতি ঐ বাড়ী ভাড়া নিয়েছে, এই কথা শুনেই আমি মনে কোরেছি, ঐ বুড়ী তবে সেই বুড়ী। দেখ যজ্ঞেশ্বর! মন্দকাজ আমি জানি না, মন্দকথাও আমি শিখি নাই, মন্দভাবও আমার মনে আসে না; তা যদি হতো, তবে আমি তোমার কাছে এ সব কথা বোলতেম না। কথাটা হোচ্ছে এই যে, কোন কৌশলে সেই বুড়ীর সঙ্গে যদি তুমি একবার আমার দেখা কোরিয়ে দিতে পার, তা হোলে আমি বৃত্তান্তটা জেনে নিই। আর কিছুই না। ঐ বুড়ী যদি সেই বুড়ী হয়, তবে আমার একটা গুহ্যকথা জানা হোতে পারে। বুড়ীটা সেখানে যে বাড়ীতে থাকতো, সেই বাড়ীর সম্বন্ধে আমার মনে একটা সন্দেহ আছে, বিষম সন্দেহ! বুড়ীকে একবার নির্জ্জনে পেলে সেই সন্দেহভঞ্জনের চেষ্টা পাই। আরো শোনো। এ বাড়ীতেও না, ও বাড়ীতেও না, তফাতে একটা বিজনস্থানে,—কোন দেবালয়ের নিকটে দেখাসাক্ষাৎ হোলেই ভাল হয়। তুমি না হোলে সুবিধা হবে না, সেই জন্যই তোমাকে বলা। বুড়ী যদি সহজে তোমার সঙ্গে যেতে না চায়, লোভ দেখিও, বুড়ীদের লোভ বেশী, টাকার লোভ পেলেই তখনি রাজী হবে।”
পূৰ্ব্বভাব পরিত্যাগ কোরে যজ্ঞেশ্বর তখন বোল্লে, “এই তোমার কথা? সে কাজ আমি বেশ পারবো। বুড়ী তো ঘরের ভিতর আটক থাকে না, রাস্তায় যায়, বাজারে যায়, গঙ্গাস্নান করে, ঠাকুরদর্শনে যায়, সব জায়গায় বেড়ায়; এইবার দেখা পেলেই আমি ধোরবো; আমাদের বাড়ীর একটী ছোট ছেলে তোমার সঙ্গে দেখা কোত্তে চায়, এই কথা বোলবো। যেখানে দেখা হবে, জায়গা ঠিক কোরে তোমাকে সংবাদ দিব।”
আমি সন্তুষ্ট হোলেম। “অন্যদিন সময় হবে না, রবিবার বৈকালে দেখা কোরবো, এই কথাই বলে রেখো, আমাকে সঙ্গে নিয়ে সেই সময়ে সেইখানে তুমি যাবে, বুড়ীও সেইখানে থাকবে, তা হোলেই ঠিক হবে।”—যজ্ঞেশ্বরকে এই কথা বলে আবার আমি পুস্তক নিয়ে বোসলেম; যজ্ঞেশ্বর বেরিয়ে গেল। সন্ধ্যার পর বড়বাবু এলেন, আমাকে যা কিছু বলা তাঁর প্রয়োজন ছিল, সেই সব কথা বল্লেন; আমিও দুটী একটী কথা বোল্লেম, অন্যমনে আমার কথাগুলি শুনে বাবু হঠাৎ আমাকে জিজ্ঞাসা কোল্লেন, “কদিনের ঝঞ্চাটে একটা কথা আমার মনে হয় নাই, রসিকবাবুর বাড়ীতে উৎসবটা তুমি কেমন দেখেছ? মাঝে মাঝে তুমি বীরভূমের নাম কর, কানাইবাবুটীকে তুমি কি চিনতে পেরেছ?”
প্রথম কেনই বা মিথ্যাকথা বোলবো, সাফ সাফ সত্যকথাই বোল্লেম। প্রশ্নের উত্তর দিলেম, “উৎসব বেশ হয়েছিল, কিন্তু কুমারীগুলি আমার চক্ষে যেন সত্য সত্য কুমারী ঠেকলো না। আমাদের দেশে অত বড় বড় কুমারী হয় না, বিশেষতঃ হিন্দুর গৃহে।”—উচ্চ হাস্য কোরে বড়বাবু বোল্লেন, “কাশীর কুমারী ঐ রকম! কেবল কাশীই বা কেন, অনেক তীর্থে গর্ভবতী, পুত্রবতী কুমারী অনেক দেখা যায়!”
মাথা নীচু কোরে আমিও একটু হাসলেম। তার পর দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর। সেই উত্তরে নিয়ে আমি বোল্লেম, “কানাইবাবুকে বীরভূমে আমি দেখি নাই, কলিকাতায় একদিন দেখেছিলেম। তাঁকে আমি চিনতে পেরেছি, তিনি আমাকে চিনতে পারেন নাই। বেশীকথা আপনাকে আমি আর কি বোলবো, বাবুটী বড় সহজবাবু নন। কাশীতে যদি কিছু, বেশী দিন থাকেন, বিশেষ পরিচয় প্রকাশ পাবে। একটুখানি আমি বলে রাখি। কানাইবাবু জমীদার নন; মাতুল জমীদার; মাতুলের নাম বাণেশ্বরবাবু। আর—আর—আর—”
শীঘ্র বোলতে পাল্লেম না, বোলতে বোলতে থেমে গেলেম। চকিতনেত্রে আমার মুখপানে চেয়ে ত্বরিতস্বরে বড়বাবু জিজ্ঞাসা কোল্লেন, “আর কি হরিদাস? থামলে কেন? বল না,—কানাইবাবু আর কি?”
মাথা হেঁট কোরে তখন আমি বোল্লেম, “আর—কানাইবাবুর পরিবারটী বিয়েকরা পরিবার নয়, নিঃসম্পকীয়া নায়িকাও নয়,—ঐ পরিবারটী কানাইবার মাতুল-কন্যা!”
স্কন্ধ কম্পিত কোরে, বিস্ময়ে শিউরে উঠে, বড়বাবু বলে উঠলেন, “রাম। রাম! রাম! বল কি হরিদাস? এটা কি তুমি ঠিক জানো?”
বোলেছি সত্যকথা, জেরার মুখে আরো সত্য প্রকাশ কোত্তে হলো; কানাইবাবু, যে প্রকৃতির লোক, তাঁর গুণের কথা স্পষ্ট কোরে ব্যাখ্যা করাই ভাল। মনে মনে এই রূপ স্থির কোরে স্পষ্ট স্পষ্ট আমি বোল্লেম, “আজ্ঞে হ্যাঁ, ঠিক আমি জানি। মাতুলের আশ্রিত অন্নদাস, মাতুল-কন্যাকে হরণ কোরে কোথায় লুকিয়ে রেখেছিলেন, নিজে সাধু সেজে বাড়ীর ভিতর গলাবাজী কোচ্ছিলেন, সেই সময় আমি কিরূপে সে বাড়ীতে উপস্থিত হই, সে কথা পূর্ব্বে আপনাকে বোলেছি। সে রাত্রে সেখানে কানাইবাবুকে আমি দেখি নাই, কলিকাতায় একবার দেখা, তখন বোধ হয়, মাতুল কন্যাটীকে অন্য বাড়ীতে রেখেছিলেন, তার পর এখন জমীদার সেজে, সেই কন্যাটীকে পরিবার সাজিয়ে নিয়ে কাশীধামে এসেছেন। রসিকবাবুর বাড়ীতে যে কন্যাটী ভক্তিমতী হয়ে কুমারী-পূজা কোল্লেন, সেই কন্যাটীই কানাইবাবুর মাতুল-কন্যা, আমার এইরূপ বিশ্বাস। পরিচয়ে জমীদার, উৎসবের খরচপত্রও জমীদারের মত, টাকাগুলিও বোধ হয় মাতুলের; দাতার অসাক্ষাতে দানপ্রাপ্তি। অধিক আর আমি কি বোলবো, সময়ে প্রকাশ পাবে।”
পুনরায় তিনবার রামনাম উচ্চারণ কোরে বড়বাবু বোল্লেন, “তাই ত! কানাইবাবু তবে তো সাধারণ লোক নয়! ধর্ম্মশীল জমীদার বটে! অন্নপূর্ণা-বিশ্বেশ্বর মাথায় থাকুন, কাশী বড় ভয়ানক স্থান! কাশীতে ঐ রকমের জমীদার, ঐ রকমের পরিবার অনেক পাওয়া যায়! পাঁচ সাতটা আমি জানি, মাতুলকন্যা, পিতৃব্য-কন্যা, মাসী-পিসী, বিমাতৃকন্যা, এমন কি, যুবতী বিমাতা পর্য্যন্ত এখানে অনেক বাবুর পরিবার। এখানকার সমাজে তাঁর প্রকাশ্যরূপে বেশ চোলে যাচ্ছেন। তাঁরা এখানে মান্যগণ্য সামাজিক ভদ্রলোক! তুমি বালক, তোমার কাছে বেশী বলা লজ্জার কথা, সে সব তোমার শুনেও কাজ নাই, পূর্ব্বে তোমাকে সাবধান কোরে রেখেছি, আবার সাবধান কোরে দিচ্ছি, এখানকার অজানা লোকের সঙ্গে কদাচ তুমি কোন সংস্রব রেখো না। ঐ রকমের অনেক কানাইবাবু কাশীর মাঝে মাথা উঁচু কোরে বুক ফুলিয়ে চোলে বেড়ায়! সাবধান!”
কানাই-নাটকের যবনিকা এইখানে পতিত হলো, পুনর্ব্বার পট-উত্তোলনের আবশ্যক হবে কি না, সেটা এখন ভবিষ্যতের গর্ভগত। যজ্ঞেশ্বরের কাছে আজ আমি যে নাটকের নান্দীপাঠ কোরে রেখেছি, সে অভিনয়টা কি রকম দাঁড়ায়, সাতদিন পরেই জানতে পারা যাবে। অমরকুমারীকে নিয়ে নাটক হবে না, অমরকুমারী আমার বিস্তর উপকার কোরেছেন, সাধারণ উপকার নয়, অমরকুমারী আমার জীবনদায়িনী। অমরকুমারী কাশীতে; এটাই বা কিরুপ সঙ্ঘটন? অমরকুমারী এসেছেন, একাকিনী আসেন নাই, মোহনবাবুও এসেছেন; কিন্তু আছেন কোথায়? একবার দর্শন পেলে ভাল হোতো।
আমারে অন্যমনস্ক দেখে বড়বাবু জিজ্ঞাসা কোল্লেন, “ভাবছো কি হরিদাস? তীর্থস্থানের মহিমা জানবার তোমার অনেক বাকী। ও সব কিছু মনে কোরো না, এখানকার কাণ্ডই প্রায় ঐ প্রকার।”
এই সব কথা বোলে বড়বাবু দুটী দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ কোল্লেন। দেখলেম, তাঁর মুখখানি যেন বিবর্ণ, যেন চিন্তাযুক্ত। সে রকম চিন্তাযুক্ত তাঁকে আমি আর একদিনও দেখি নাই। পুনরায় এক নিশ্বাস ফেলে তিনি বোল্লেন, “এখনকার কালে নিরুদ্বেগে সংসারধর্ম্ম করা প্রায় কারো ভাগ্যে ঘোটে উঠছে; হিংসা, দ্বেষ, বাদাবাদি, কলহ, নিন্দা, আত্মবিচ্ছেদ, একটা না একটা যেন লেগেই আছে। ঐ সব উৎপাত থেকে তফাৎ হবার আশায় দেশ ছেড়ে আমি এখানে এসেছি, এখানেও সুখ পাচ্ছি না। তিনটী ভাই একসঙ্গে মিলে মিশে ছিলেম, সে সুখেও বঞ্চিত হোতে হলো। রামশঙ্কর সেই সেদিন মিছামিছি বচসা কোরে বাড়ী থেকে বেরিয়ে গিয়েছে, তদবধি আর বাড়ী এলো না; লোক দিয়ে বোলে পাঠাচ্ছে, সে আর আমার সঙ্গে এক সংসারে থাকবে না, মুখদেখাদেখি পর্য্যন্ত রাখবে না, বাড়ীর অংশের মূল্য নিয়ে, রামনগরে নূতন বাড়ী বানাবে, পরিবার নিয়ে সেইখানেই বাস কোরবে। কথাটা শুনে মন আমার বড়ই খারাপ হয়ে গিয়েছে। ভাই-দুটীর সঙ্গে কখনো আমি অসদ্ব্যবহার করি নাই, দোষ কোল্লেও কটু কথা বলি নাই, তবু এই বিচ্ছেদটা ঘোটলো। মন্ত্রী জুটেছে। জানতে পেরেছি, সেই মন্ত্রীটী আমাদের দেশের লোক। সম্পর্কে আমাদের মামা হন, মহাভারতের শকুনিমামা! বৃদ্ধ হয়েছেন, তথাপি এখনো মনের ভিতর ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর মার-পেঁচ খেলে! হিংসায় হিংসায় অন্তরটা জরজর! কারো ভাল দেখতে পারেন না; ঘর ভাঙবার গুরুমশাই! তাঁরই মন্ত্রণায় রামশঙ্করটা আজকাল উঠছে বোসছে। আমাদের বাঙলাদেশটা ইদানীং অনেক রকমে অধঃপাতে গিয়েছে। আচারব্যবহার উড়ে উড়ে যাচ্ছে, লোকের কথায় সেটা যেন কালের ধর্ম্ম, কিন্তু ভাই ভাই পৃথক হবার উপদ্রবটা বেজায় বেড়ে উঠেছে। ভাই ভাই বিরোধে এক একটা সংসার ছারখার হয়ে যাচ্ছে, কেহ যেন সেটা গ্রাহ্যই করে না। গতিক যে রকম দেখছি, আমরা যদি দেশে থাকতেম, কুমন্ত্রীর কুমন্ত্রণায় এতদিনে কবে ঘরবাড়ী সব বাঁটোয়ারা হয়ে যেতো। দেশে আজকাল বাঁটোয়ারার ভারী ধূম! “ভাই ভাই ঠাঁই ঠাঁই, এই কথাটার বড় আদর! ঠাঁই ঠাঁই হবার ঘোর তুফানে কত কত বোনেদী সংসার ডুবে ডুবে যাচ্ছে, স্নেহমমতা ভেসে ভেসে যাচ্ছে, দিন দিন এক এক পরিবারের বলয় হোচ্ছে, হাতে হাতে ফলাফল দেখেও লোকের হুঁস হোচ্ছে না। দশজন একত্রে এক সংসারে থাকলে সব রকমে সুখে থাকা যায়, এখনকার লোকে বলে, সেটা বিষম ভুল! বিবাহিতা স্ত্রী এখন পরিবার, সেই পরিবারকে নিয়ে স্বতন্ত্র থাকাই পরম সুখ। ভাই ত ভাই, অনেক দূরের কথা, জন্মদাতা পিতা আর গর্ভধারিণী মাতাকেও পরিবারের সংসারে স্থান দিতে অনেকে নারাজ! সেই সকল কুলক্ষণ দেখে আমি কাশীতে সোরে এলেম,—আনন্দকাননে জুড়াবার ঠাঁই, বড় আশায় অন্নদার ক্রোড়ে জুড়াতে এলেম, এখানেও সেই বিপত্তি! হাঁ, এমন হোতে পারে, ভাই-দুটীর রোজগারের টাকা আমি গ্রহণ করি, আমার খরচ বেশী, তাঁদের খরচ কম, টাকা তাঁদের জমে না, একসঙ্গে থাকলে ক্ষতি হয়, কাজে কাজে পৃথক হবার ইচ্ছা বলবতী হয়ে উঠে। এখানে তো তা নয়, কোন ভায়ের রোজগারের একটী পয়সাও আমি গ্রহণ করি না, অথচ সকলকে আমি সমানচক্ষে দর্শন করি। তবু কেন এমনটা ঘোটলো? রামশঙ্কর পৃথক হবে! দুদিন পরে হয় তো মতিলালটীও বেঁকে দাঁড়াবে। হায় হায়! আমার ধর্ম্মের সংসারে এমন প্রতিকূল ঘটনা কেন হয়?”
এই সব কথা বোলে বড়বাবু আর একটী বিশাল দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ কোল্লেন। আমারও হৃদয়ে বেদনা লাগলো। সে রাত্রে আর অন্য কাৰ্য্য কিছুই হলো না, আহারাতে চঞ্চলা নিদ্রায় রজনী অবসান।
সোমবার। যথাসময়ে আহারান্তে আমরা আদালতে গেলেম; গিয়ে শুনলেম, সেই দিন গঙ্গাস্নানের কি একটা যোগ, আদালত বন্ধ। একটী বাবু, মির্জাপুর থেকে সেই আদালতে চাকরী কোত্তে আসেন। কাশীতে তাঁর বাসা আছে, পাঁচ সাত দিন ছুটী পেলে মির্জাপুরে যান। মির্জাপুরে বিন্ধ্যাচল। অনেক দিন অবধি বিন্ধ্যাচল-দর্শনে আমার অভিলাষ ছিল, সেই দিন সেই বাবুটী মির্জাপুরে যাবেন, সেই কথা শুনে আমিও তাঁর সঙ্গে যাবার অভিপ্রায় জানালেম। বাবুটী বোল্লেন, “কল্য তোমাকে আদালতে আসতে হবে, এক দিনে বিন্ধ্যাচলে যাওয়া আসা হয় না, অতি কম পাঁচদিনের ছুটী না পেলে তোমার মনোরথ সিদ্ধ হবে না। আমি একমাসের বিদায় নিয়েছি, শনিবার দুটী মঞ্জুর হয়েছে, আজ আমি চোলে যাব, একমাস আসবো না।”
বিন্ধ্যাচল-দর্শনের অভিলাষ আমার আরো বেড়ে উঠলো, বড়বাবুকে সেই অভিলাষ জানিয়ে সাত দিনের ছুটী চাইলেম। বড়বাবুই সেরেস্তার কৰ্ত্তা, তিনি আমাকে ছুটী দিলেন, মির্জাপুরের বাবুর সঙ্গে আমি নৌকাযোগে বিন্ধ্যাচল দেখতে চোল্লেম। সেদিন গেল, রাত্রি গেল, পরদিন সন্ধ্যার পূর্ব্বে মির্জাপুরে পৌঁছিলেম। রাত্রী সেই বাবুর বাড়ীতেই থাকা হলো, পরদিন বিন্ধ্যাচল-দর্শন। সঙ্গী সেই বাবুটী আর একটী পাণ্ডা। বিন্ধ্যাচল অনেক দূর পর্য্যন্ত বিস্তৃত; অধিক উচ্চ নয়, কিন্তু খুব লম্বা। পুরাণে বর্ণিত আছে, বিন্ধ্যাচল ক্রমে ক্রমে কলেবর বৃদ্ধি কোরে গগনস্পর্শী হোতে যাচ্ছিল, অগস্ত্যমনি উপস্থিত হয়ে পৰ্ব্বতের সেই উচ্চাভিলাষ ব্যর্থ কোরে দিয়েছেন। পৰ্ব্বত নতশিরে শায়িতভাবে অগস্ত্যকে প্রণাম করে। অগস্ত্য বলেন, “যতদিন আমি ফিরে না আসি, ততদিন এই ভাবেই থাকো, উঠো না।” বিন্ধ্যাচল তদবধি সেই অবস্থাতেই শুয়ে আছে। অগস্ত্য আর সেখানে ফিরে এলেন না, বিন্ধ্যগিরিও আর মস্তক উন্নত কোত্তে পাল্লেন না। যে দিন এই ঘটনা হয়, সেদিন একটী মাসের প্রথম দিবস। ঐ ঘটনার স্মরণার্থ মানুষেরা আজিও মাসের প্রথম দিবসে কোথাও যাত্রা করে না; ঐ দিনের যাত্রাকে অগস্ত্যযাত্রা বলা হয়। যাত্ৰানিষেধের হেতু এই যে, অগস্ত্য যেমন গেলেন, আর এলেন না, অগস্ত্যদিবসে অর্থাৎ মাসের প্রথমদিবসে যারা কোথাও যাত্রা করে, সেইরূপে তারাও আর ফিরে আসে না।
বিন্ধ্যাচলে অনেক দেবদেবীর প্রতিমূর্তি আছে, তন্মধ্যে তিনটা প্রধান;— বিন্ধ্যবাসিনী, যোগমায়া আর ভোগমায়া। ত্রিকোণাকারে এই তিনটী পীঠস্থান, সেই কারণে এই স্থানকে ত্রিকোণমণ্ডল বলা হয়। বিন্ধ্যবাসিনীর মন্দির উপরিভাগে, যোগমায়া ভোগমায়া গহ্বরমধ্যে। যোগমায়ার এক নাম মহাকালী। মূর্ত্তি অতি ভয়ঙ্করী! অবয়ব দেখা যায় না, কেবল একখানা পাথরের প্রকাণ্ড মূখ হাঁকরা, মুখে সিঁদুর মাখা, চক্ষের দুটী গহ্বনমাত্র দৃষ্ট হয়, আর কিছু না। যাত্রীলোকেরা সেই মুখে দুগ্ধ-গঙ্গাজল প্রভৃতি প্রদান করে, সে সকল বস্তু কোথায় যায়, কিছুই দেখা যায় না। পৰ্ব্বতের নিম্নে এক কালীমূর্ত্তি আছে, লোকে বলে, পূর্ব্বে পূর্ব্বে সেই কালীর কাছে নরবলি হোতো, এখন হয় না। দেবদেবীগুলিকে আমি প্রণাম কোল্লেম, পাণ্ডারা কিছু কিছু দর্শনী নিলে। পাণ্ডা ব্যতীত অনেক যোগী-সন্ন্যাসী স্থানে স্থানে চক্ষু মুদে বোসে আছেন, তাঁদের কাছে দর্শনী দিতে হয় না। পৰ্ব্বতের পার্শ্বে বহুদূরবিস্তৃত একটা প্রান্তর, একধারে একটা ঝরণা, সেই ঝরণার জল অতি নির্ম্মল। স্থানে স্থানে নিবিড় জঙ্গল, স্থানে স্থানে পুষ্পকানন; নানা জাতি পুষ্প প্ৰস্ফুটিত হয়ে স্থানটীকে আমোদিত করে।
বিন্ধ্যাচল দর্শন করা হলো, দুদিন আমি মির্জাপুরে থাকলেম। সাত দিনের ছুটী, তথাপি আমি বিলম্ব কোল্লেম না, নৌকাযোগে শনিবার বৈকালে কাশীতে ফিরে এলেম। যজ্ঞেশ্বরের সঙ্গে কথা ছিল, রবিবার বৈকালে সেই বুড়ীর সঙ্গে দেখা করা হবে, সেই জন্যই শীঘ্র শীঘ্র ফিরে আসা।
অগ্রেই আমি বাড়ী এলেম। সন্ধ্যার পর বড়বাবু এলেন; এসেই আমাকে সহাস্যবদনে জিজ্ঞাসা কোল্লেন, “এসেছ হরিদাস? বেশ হয়েছে। বিন্ধ্যাচল কেমন দেখলে?”
যা যা আমি দেখেছিলেম, সংক্ষেপে সংক্ষেপে বর্ণনা কোল্লেম; বড়বাবু খুসী হোলেন। তার পর বাড়ীর ভিতর থেকে ফিরে এসে বৈঠকখানায় বোসে, বাক্স থেকে একখানি চিঠি বাহির কোরে, আবার তিনি হাসতে হাসতে আমাকে বোল্লেন, “আমার একটী বন্ধু আসছেন, এই চিঠি লিখেছেন, বন্ধুটীর নাম মোহনলাল ঘোষ, বর্দ্ধমানজেলায় নিবাস, খুব ভাললোক, খুব বড়মানুষ, তাঁর সঙ্গে আলাপ হোলে তুমি সুখী হবে। এই সেই চিঠি, এই লও, চিঠিখানি পড়।”
মনে তখন আমার কি ভাবের উদয় হলো, আমিই জানতে পাল্লেম, কিছুই প্রকাশ কোল্লেম না, বাবুর হাত থেকে নিয়ে চিঠিখানি আমি পাঠ কোল্লেম। চিঠিতে লেখা ছিল:—
প্রিয় রমেন্দুবাবু।
আমি সপরিবার প্রয়াগধামে আসিয়াছি। ইতিমধ্যে একদিন কোন কাৰ্য্যোপলক্ষে কাশীতে গিয়াছিলাম, ব্যস্ততা প্রযুক্ত তোমার সহিত সাক্ষাৎ করিয়া আসিতে পারি নাই, এই সপ্তাহের মধ্যেই পুনরায় বিশ্বেশ্বর-দর্শনে যাইব, একমাস কাশীতে থাকিবার ইচ্ছা আছে, এইবার তোমার সহিত সাক্ষাৎ করিয়া সন্তোষ লাভ করিব। তোমার বাড়ীর পরিবারগণকে আমার প্রিয়সম্ভাষণ জানাইও, ঈশ্বরের নিকটে আমি তোমাদের সকলের কুশল প্রার্থনা করি। আমার শরীর এখন একপ্রকার ভাল আছে, সাক্ষাতে সকল কথা কহিব ও শুনিব ইতি সন ১২৫৮ সাল, ১৩ই ফাল্গুন।
বশম্বদ
শ্রীমোহনলাল ঘোষ।”
পত্রখানি আমি পাঠ কোল্লেম। অকস্মাৎ মনে কেমন একটা সংশয় এলো। দুই তিনবার সেই চিঠির অক্ষরগুলি ভাল কোরে দেখলেম; ক্রমশই সংশয়টা প্রবল। আমার সংশয়ভাব বড়বাবু যাতে বুঝতে না পারেন, সেইরূপে সাবধান হয়ে থাকলেম। হঠাৎ কি একটা কার্য্যে বড়বাবু শশব্যস্তে বাড়ী থেকে একবার বেরিয়ে গেলেন, সেই অবসরে আমি অন্দরমহলে প্রবেশ কোরে, আমার শয়নঘর থেকে একখানি পত্রিকাখণ্ড হাতে কোরে নিয়ে আবার বৈঠকখানায় এসে বোসলেম। মোহনলালবাবুর চিঠিখানি সেইখানেই খোলা পোড়ে ছিল, আমি যেখানি আনলেম, সেখানিও সেইখানে খুলে রাখলেম; পাশাপাশি দুখানি চিঠি।
ঠিক তাই! সংশয়ে সংশয়ে ইতিপূৰ্ব্ব যা আমি ভেবেছিলেম, ঠিক তাই!
অক্ষরে অক্ষরে ঠিক মিলন; দুখানি চিঠিই এক হস্তের লেখা। এ কি আশ্চর্য্য সম্মিলন! মোহনলালবাবুর চিঠির সঙ্গে আমার রক্ষিত চিঠিখানির অক্ষরে অক্ষরে ঠিক মিলন, এ কি আশ্চর্য্য সঙ্ঘটন! আমার রক্ষিত চিঠিখানি কোন চিঠি, সে কথাও পাঠকমহাশয়কে জানাই। আদালতের সিঁড়ির উপর রক্তদন্তের বগল থেকে যে কখানা কাগজ পোড়ে গিয়েছিল, সেই সকল কাগজের ভিতর যে ক্ষুদ্র পত্রিকা আমি পেয়েছিলেম, যে পত্রিকায় দস্তখতের জায়গাটা ছিঁড়ে গিয়েছিল, যে পত্রিকা সাবধানে যত্ন কোরে আমি রেখেছিলেম, সেই পত্রিকা। দুই পত্রিকার অক্ষর ঠিক একরকম! কেমন হলো! মোহনলালবাবুই কি তবে রক্তদন্তকে সেই চিঠি লিখেছিলেন? আমার উপর রক্তদন্ত অর উপদ্রব না করে, সেই চিঠিতে এইরুপ উপদেশ। রক্তদন্ত আমার উপর দৌরাত্ম্য করে, মোহনবাবু কি সেটা জানতেন? না জানলেই বা নিষেধ করবার মানে কি? রক্তদন্তের সঙ্গে কি মোহনবাবুর পূর্ব্বাবধি যোগাযোগ ছিল? তাঁর উপদেশেই কি রক্তদন্ত আমাকে ধোরে নিয়ে গিয়েছিল? তাই তো সম্ভব বোধ হোচ্ছে! মোহনবাবুর কাছে রক্তদন্ত বেতন পায়; রক্তদন্তটা মোহনবাবুর চাকর! কি কার্য্যের জন্য চাকর? আমাকে নষ্ট করবার জন্যই কি? রক্তদন্ত আমাকে প্রাণে মারবার চেষ্টা পেয়েছিল, সে চেষ্টাটাও কি মোহনবাবুর উপদেশে? কেমন উপদেশ? তাঁর কাছে আমি কোন অপরাধে অপরাধী? কোন কালে কবে আমি তাঁর কি অনিষ্ট কোরেছি? আমি বেঁচে থাকলে মোহনবাবুর কোন অভীষ্টসিদ্ধির ব্যাঘাত হোতো? কিছুই তো বুঝতে পাচ্ছি না। আচ্ছা, তাই যদি হয়, তবে আবার আমার প্রতি তিনি সদয় হলেন, রক্তদন্তকে নিবারণ কোল্লেন, ইহারই বা ভাব কি? একটা কারণ আমার মনে আসছে। অমরকুমারীকে অগ্নিকুণ্ড থেকে আমি উদ্ধার কোরেছিলেম, মোহনবাবুর বাক্য প্রমাণে অমরকুমারী তাঁর নববিবাহিতা পত্নী; আমি অমরকুমারীর প্রাণরক্ষা কোরেছি, সেই উপকারের বিনিময়ে মোহনবাবু আমাকে হাজার টাকা পুরস্কার দিয়েছিলেন, সেই উপকার স্মরণ কোরেই হয় তো রক্তদন্তকে ঐ ভাবে পত্র লেখা। স্থির কোল্লেম এই রকম, কিন্তু আমার প্রতি মোহনবাবুর বৈরভাব কেন জন্মেছিল, অনেক ভেবে চিন্তে সেটা কিছুই স্থির কোত্তে পাল্লেম না।
বড়বাবু এখনি ফিরে আসবেন, এই দস্তখৎশূন্য পত্রিকা তাঁকে আমি এখন দেখাবো না, এই সঙ্কল্পে সেখানি তখন আমি গোপন কোরে রাখলেম। একটু পরে বড়বাবু ফিরে এলেন, এসেই আমারে বোল্লেন, “হরিদাস! মোহনলালবাবু আসছেন, তাঁর সঙ্গে আমি তোমার পরিচয় কোরিয়ে দিব, তিনি অমায়িক ভদ্রলোক, আলাপ থাকলে তোমার অনেক উপকার হবে।”
মনোভাব আমি গোপন কোরে রাখতে পাল্লেম না। পত্রের কথা গোপন কোরে সাদাকথায় কেবল এইটুকু বোল্লেম, “মোহনলালবাবুকে আমি চিনি। কাশীতে আসবার পূর্ব্বে আমার বাল্যজীবনে যে যে ঘটনা হয়েছিল, আপনার অনুগ্রহপ্রাপ্তির সময় যে সব কথা অতি সংক্ষেপে আপনাকে আমি বোলেছি, সে সব কথা বোধ হয়, আপনার স্মরণ থাকতে পারে। বর্দ্ধমানে একটা জুয়াচোরের হাত থেকে পরিত্রাণ পেয়ে, যে বাড়ীতে আমি আশ্রয় প্রাপ্ত হই, সে বাড়ীর কর্ত্তার নাম আপনাকে আমি বলি নাই; সেই কৰ্ত্তার একটী জামাই আছেন, তিনি অপব্যয় করেন, দফায় দফায় শ্বশুরের কাছে টাকা চান, সে সব কথা বোলেছি, জামাইবাবুটীরও নাম করি নাই। সেই জামাই ঐ মোহনবাবু। সেই বাড়ীতেই মোহনবাবুর সঙ্গে আমার দেখাসাক্ষাৎ হয়েছিল, তার পরেও একবার পথের চটীতে দেখা হয়েছিল; অনেকপ্রকার কথা হয়েছিল। তিনিও আমাকে জানেন, আমিও তাঁকে চিনি।
প্রফুল্লবদনে বড়বাবু বোল্লেন, “তবে তো আরো ভালই হলো। পূর্ব্বে জানাশুনা আছে, তার উপর আমার অনুরোধ হবে, পরিচয়টা পাকা হয়ে দাঁড়াবে। তিনি আমার বন্ধুলোক, বড়মানুষ, তুমিও সুশীল, সচ্চরিত্র, ঘনিষ্ঠতা হোলে তুমি তাঁর প্রসন্নতা লাভ কোত্তে পারবে, সকল দিকে ভালই হবে।”
ভয়, সন্দেহ, ঘৃণা, এই তিন একত্র হয়ে আমার চিত্তকে তখন অত্যন্ত আকুল কোরে তুল্লে; বড়বাবুর কথাগুলি শুনলেম, কিন্তু কোন উত্তর দিলেম না। মন যেন আমারে বোল্লে, “মোহনবাবু ভয়ানক লোক, তাঁর সঙ্গে বেশী ঘনিষ্ঠতা কোরো না, ভাল হবে না। মনের উপদেশে বড়বাবুর আহ্লাদের কথায় উত্তরদান কোত্তে আমি সঙ্কুচিত হোলেম।
শনিবার রাত্রে এই পর্য্যন্ত আমাদের নির্জ্জন কথোপকথন। প্রকাশযোগ্য অন্য কোন নূতন ঘটনা সে রাত্রে সঙ্ঘটিত হয় নাই।
রবিবার বৈকাল। বড়বাবু যেমন বন্ধুর বাড়ী যান, সেইরূপে বাড়ী থেকে বেরিয়ে গেলেন, যজ্ঞেশ্বর আমার কাছে এলো। চেয়ে দেখলেম, যজ্ঞেশ্বরের মুখে মৃদু মৃদু হাস্য খেলা কোচ্ছে, আমিও মৃদু মৃদু হাস্য কোল্লেম। যজ্ঞেশ্বর বোল্পে, “সব ঠিক; প্রস্তুত হও; বিলম্ব করা হবে না, সন্ধ্যার মধ্যেই ফিরে আসতে হবে।”
প্রস্তুতই আমি ছিলেম, বৈঠকখানার দরজা বন্ধ কোরে যজ্ঞেশ্বরের সঙ্গে আমি বাড়ী থেকে বেরুলেম। কোথায় যাচ্ছি, কেহ কিছু জানতে পাল্লে না। ছোট ছোট গলী পার হয়ে যজ্ঞেশ্বর আমাকে একটা পল্লীর দিকে নিয়ে চোল্লো। সে পল্লীতে পূর্ব্বে একদিনও আমি যাই নাই। দিবাশেষে বসন্তের শীতল বাতাস ধীরে ধীরে প্রবাহিত হোচ্ছিল, বায়ুস্পর্শে আমি সুখানুভব কোচ্ছি, পল্লীর দুই ধারে নূতন নূতন দৃশ্য দর্শন কোচ্ছি, নয়ন পুলকিত হোচ্ছে। নূতন দৃশ্যাবলীর মধ্যে এক দৃশ্য আমার চক্ষে খুব নৃতন।
সারি সারি দোতালা বাড়ী, রাস্তার দিকে বারান্দা; সুসজ্জিতা সুন্দরী সুন্দরী অনেকগুলি কামিনী সেই সকল বারান্দা আলো কোরে বোসে আছে; বারান্দায় এক একখানি চৌকি পাতা, চৌকির উপর গদীপাতা বিছানা, গদীর উপর তাকিয়া, তাকিয়ার কোলে কামিনী। পার্শ্বে দীর্ঘ দীর্ঘ নলশোভিত রূপার আলবোলা। কামিনীরা পেশোয়াজ পরা, বক্ষে কাঁচুলি, কারো কারো বিচিত্র আস্তিনযুক্ত আংরাখা, তার উপর বিচিত্রবর্ণের ওড়না, জামার উপর উজ্জ্বল উজ্জ্বল অলঙ্কার, নাসিকায় মুক্তার নোলক দোদুল্যমান, কর্ণে বিবিধকার কর্ণভূষা, কপালে সিঁথির সঙ্গে গাঁথা সোণার ঝাঁপা, কোলে কোলে মুক্তার ঝালোর, মস্তকের কেশপাশ ললাটের অর্দ্ধাংশ পর্য্যন্ত পেটেপাড়া, পৃষ্ঠভাগে বৃহৎ চক্রাকার খোঁপাবাঁধা, এক একটী কবরী মনোহর পুষ্পমাল্য বিজড়িত; নয়নে অঞ্জন, ওষ্ঠে মিসি, হস্তে আতরমাখা এক একখান রুমাল, আলতাপরা পায়ে মোটা মোটা গোল মল; অপরুপ খোলতা। অধিকাংশই হিন্দুস্থানী, কতক কতক বাঙ্গালী, বসন-ভূষণে শীঘ্র প্রভেদ করা যায় না। সকলেই হিন্দুস্থানী বেশভূষা, সকলেরই একপ্রকারে কেশবিন্যাস; চমৎকার শোভা! বর্ণ বিবিধ;—কতক গৌরাঙ্গী, কতক শ্যামাঙ্গী, কতক কৃষ্ণাঙ্গী। যেগুলি গৌরাঙ্গী, সেগুলিকে যেন চিত্রকরা পরীবালা অথবা সুরবালা বোলে ভ্রম হয়। যজ্ঞেশ্বরকে জিজ্ঞাসা কোরে পরিচয় পেলেম, ঐ সকল বিলাসিনী কামিনীদের সাধারণ উপাধি বাইজী। হিন্দুস্থানীও বাইজী, বাঙ্গালীও বাইজী; কেবল উপাধিতে বাইজী নহে, সকলেই সুনিপুণা নৰ্ত্তকী। বাইজীরা সৰ্ব্বপ্রকার যন্ত্রসঙ্গীতে ও কণ্ঠসঙ্গীতে সুশিক্ষিতা। এ মহলে যবনী বারাঙ্গনারা স্থান পায় না; সিক্রোলের পথে যবনী গণিকাদের একচেটে বাহার। তারাও নৃত্য-গীত-বাদ্যে যশস্বিনী।
সিক্রোলের দিকে আমরা গেলেম না। হিন্দুস্থানী বাইমহলের একপ্রান্তে একটী শিবালয়; মন্দিরের ধারে খানিক দূর পর্য্যন্ত সরু সরু রেল দেওয়া;; রেলের ভিতর দরোয়ানের ঘরের ন্যায় একটী ক্ষুদ্র কক্ষ, সেই কক্ষমধ্যে আমরা প্রবেশ কোল্লেম। সেই বুড়ী; যার সঙ্গে সাক্ষাৎ কোত্তে আমার যাওয়া, সেই কক্ষে সেই বুড়ী মৌনভাবে উপবিষ্টা। নিকটে উপবিষ্ট হয়ে, বুড়ীর দুহাতে দুটী টাকা দিলেম, মুখপানে চেয়ে জিজ্ঞাসা কোল্লেম, “তুমি কি আমাকে চিনতে পাচ্ছে?”—সটান আমার মুখের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে, বুড়ী একটু ইতস্ততঃ কোরে বোল্লে, “চিনতে?—তোমাকে?—আমি?—হ্যাঁ হ্যাঁ, চিনেচি বটে! সেই বাড়ীতেই বুঝি তুমি থাকো? একদিন তুমি ছাতে উঠেছিলে, আমি তোমাকে দেখেছিলেম।”
কথা ঘুরিয়ে আবার আমি প্রশ্ন কোল্লেম, “এখানে একদিন দেখেছে, পূর্ব্বে আর কোথাও আমাকে দেখেছ কি না, মনে হয়?”
আবার আমার মুখপানে তাকিয়ে তাকিয়ে, কি যেন পূর্ব্বকথা স্মরণ কোরে, ঘাড় নেড়ে নেড়ে, গুঞ্জনস্বরে বুড়ী উত্তর কোল্লে, “হ্যাঁ হ্যাঁ, ঠিক ঠিক, মনে পোড়েচে; কলিকাতায় দেখেচি। তুমি বুঝি সেই হরিদাস? তুমি বুঝি জোড়াসাঁকো-পাড়ার প্রতাপবাবুদের বাড়ীতে থাকতে? এখানে কবে এসেচো?”
একটু হেসে আমি বোল্লেম, “হ্যাঁ গো কামিনীর মা, আমিই সেই হরিদাস, তিনমাস হলো কাশীতে এসেছি। তোমাকে আজ আমি একটী কথা জিজ্ঞাসা কোত্তে চাই। ঠিক ঠিক উত্তর দিও, ভয় নাই কিছু, কারো কাছে কোন কথা প্রকাশ হবে না, নির্ভয়ে তুমি সত্যকথা বল। সেই সুন্দরী মেয়েটী সেই বাড়ীর ছাদে রুমাল হাতে কোরে বেড়াচ্ছিল, সে মেয়েটী কে?”—শঙ্কিত-সন্দিগ্ধ নয়নে বুড়ী তখন যজ্ঞেশ্বরের দিকে চাইলে। মনের ভাব বুঝতে পেরে, যজ্ঞেশ্বরকে আমি একবার বাইরে যেতে বোল্লেম। ঘর থেকে যজ্ঞেশ্বর বেরিয়ে গেল। আবার আমি প্রশ্ন কোল্লেম, “সে মেয়েটী কে?”
হাতে টাকা পেয়েছিল, মনে উল্লাস হয়েছিল, আমিও ছেলেমানুষ, লজ্জা অকারণ, বুড়ী তখন চুপি চুপি বোল্লে, “কেন?—তুমি কি তারে জানো না? আমার মনিববাড়ীতে কতবার তুমি গিয়েচো এসেচো, তারে কি তুমি দেখ নাই? বাবুর ছোটমেয়ে,—সৌদামিনী। সৌদামিনীকে তুমি কি সে বাড়ীতে দেখ নাই?”
আমি সুযোগ পেলেম। আসলকথা বেরিয়ে পোড়েছে। সৌদামিনীকে চিনি আর না-ই চিনি, নাম শুনা ছিল, চেনা-অচেনা আমার দরকার ছিল না, যেটা আমার মনের কথা, সেইটী জানাই দরকার, তৎক্ষণাৎ আমি উত্তর কোল্লেম, “সে বাড়ীর অন্দরে তো আমি যেতেম না, মেয়েদের চিনে রাখবো কিরূপে? আচ্ছা, কামিনীর মা, সৌদামিনী এখানে কার সঙ্গে এসেছে? কর্ত্তাবাবু এসেছেন কি?”
একটু যেন কেঁপে কেঁপে কম্পিতকণ্ঠে কামিনীর মা বোল্লে, “সে কথা আমি বোলতে পারবো না, সে কথা তুমি কেন জিজ্ঞাসা কর?”
আমি। আমার দরকার আছে। আরো দুটী টাকা আমি তোমাকে দিচ্ছি, সত্য বল, কার সঙ্গে তোমরা এসেছ?
কামি।—(টাকা গ্রহণ করিয়া) জয়হরিবাবুর সঙ্গে।
আমি।—জয়হরিবাবু কে?
কামি।—তা আমি বোলবো না।
আমি।—কেন বোলবে না? ভয় কি? তীর্থে এসেছো, এখানে মিথ্যাকথা বোলতে নাই, সত্যকথা বল। সত্যকথায় দোষ কি?
কামি।—আবার তুমি কোলকেতায় যাবে, বাবুদের সঙ্গে দেখা হবে, ছেলেবুদ্ধিতে গল্প কোরবে, আমার চাকরী থাকবে না। বুড়বয়েসে আমি কোথায় যাবো?
আমি।—চাকরীর ভাবনা কি? আমি তোমাকে চাকরী দিব। চাকরী কোত্তে না হয়, তারো উপায় কোরে দিতে পারবো; তুমি সত্যকথা কও। জয়হরিবাবু কে?
কামি।—দেখো বাছা, যেন প্রকাশ হয় না, আমার মাথাটী যেন খেয়ো না; জয়হরিবাবু সেই পাড়ার একটী লোক; বেণের ছেলে, বাপের অনেক টাকা আছে, সাধ কোত্তে তীর্থদর্শনে এসেছে।
আমি।—বেণের ছেলের সঙ্গে সৌদামিনী কেন এলো? ব্রাহ্মণের ঘরের যুবতী মেয়ে কি বেণের ছেলের সঙ্গে তীর্থে আসে?
কামি।—এই আমার মাথা খেলে! অতো কথা আমি বোলতে পারবো না।
আমি।—বোলতেই হবে। যদি না বল, তবে আমি আজ বিশ্বেশ্বরবাবুর নামে চিঠি লিখে সব কথা জানাবো; ঢাকে কাঠী পোড়ে যাবে!
কামি।—(অপোবদনে নীরব)।
আমি।—আচ্ছা, কামিনীর মা, সে কথা এখন থাক, আর একটা কথা জিজ্ঞাসা করি। সেই যে সন্ন্যাসীটা তোমাদের বাড়ীতে কাটা পোড়েছিল, সেই যে যার নাম রমাই-সন্ন্যাসী, সেই সন্ন্যাসীটাকে খুন কোরেছে কে?
কামি। (সভয়ে) আমি তার কি জানি? আমি চাকরাণী, ঘরসংসারের কাজকৰ্ম্ম করি, খুনোখুনির খবর আমি কি কোরে জানবো? অতগুলো পুলিশের লোক এলো, তারা কিছু কিনারা কোত্তে পাল্লে না, আমি কেমন কোরে জানবো?
আমি।— কেমন কোরে জানবে?— বোলবো? বলি? বলি তবে?—ও কামিনীর মা! তুমি বুঝি মনে কোচ্ছো, কিছুই আমি জানি না? খুনের পর তুমি আমাদের বাড়ীতে গিয়ে গিন্নীর কাছে যে সব কথা বলে এসেছে, তার অর্দ্ধেক কথা আমি শুনেছি। যখন তুমি বল, আমি তখন পাশের ঘরের দরজার ধারে দাঁড়িয়ে ছিলেম, তোমরা আমাকে দেখতে পাও নাই, তোমার অনেক কথা আমি শুনেছি। এখন গোপন কোল্লে চোলবে না; মিথ্যা ঢাকবে না; সত্যকথা বল। সত্যের বিনাশ নাই;—মিথ্যা বোল্লেই বিপদ হবে! বল, কে খুন কোরেছে?
অনেক তত্ত্ব আমি জানতে পেরেছি, অনেক কথা আমি শুনেছি, তাই শুনে কামিনীর মা যেন একটু ভয় পেলে; ভয়ের সঙ্গে যেন কিছু বিস্ময়ভাব, সেটাও আমি বুঝতে পাল্লেম। হেঁটমুখে মাথা চুলকে চুলকে বুড়ী তখন বোলতে লাগলো, “ও বাবা! এই একরত্তি ছেলে তুমি, তোমার ফিকিরফন্দী এতো? এতো বুদ্ধি তুমি ধরো? লুকিয়ে লুকিয়ে গেরস্থবাড়ীর মেয়েদের কথা তুমি শোনো। ও বাবা! সাবাস ছেলে তুমি?”
অধিকক্ষণ ধৈর্য্য রাখতে না পেরে, চঞ্চলস্বরে আমি বোল্লেম, “তোমার মুখে আমি সাবাসি শুনতে চাই না! বুদ্ধির দৌড়, ফিকিরফন্দী, এ সকল কথাও তোমার মুখে শোনবার ইচ্ছা নাই; যে কথাটা জিজ্ঞাসা কোচ্ছি, বাজেকথা ছেড়ে দিয়ে সেই কথারই উত্তর দাও;—সন্ন্যাসীকে খুন কোরেছে কে?”
কামিনীর মা তখন ভেবে চিন্তে, গলা কাঁপিয়ে কাঁপিয়ে, আমতা আমতা কোরে বোলতে লাগলো, “তা—তা—তা—শুনেছ যখন, তখন আর—তা—বোলো বাছা কারু কাছে,—বোলবো কি, সৌদামিনীর স্বভাব ভাল নয়। সন্নিসীর সঙ্গে—”
এই পর্য্যন্ত বোলতে বোলতে বুড়ীটা থেমে গেল। আমি বিরক্ত হোলেম। রাগ প্রকাশ কোত্তেও পারি না, রাগের সময় নয়, রাগ কোল্লে কাজ হবে না, তথাচ একটু উগ্রস্বরে বোল্লেম, “তাতে আমি কি বুঝবো? আমি জিজ্ঞাসা কোচ্ছি, সন্ন্যাসীকে খুন কোরেছে কে? তুমি আরম্ভ কোল্লে, সন্ন্যাসীর সঙ্গে সৌদামিনী! ওটা তো একরকম বাজেকথা। ও কথায় আমি কি বুঝবো? যেটা কাজের কথা, যেটা আসলকথা, সেইটে আমি শুনতে চাই, সেই কথাই বল।”
আবার মাথা চুলকে চুলকে একটু থেমে থেমে বুড়ী আরম্ভ কোল্লে, “সেই কথাই তো বোলচি। সৌদামিনীর স্বভাব ভাল নয়; সন্নিসীর সঙ্গে সৌদামিনীর গলা গলা ভাব হয়েছিল; সন্নিসী তারে ছেলে হবার ওষুধ দেবে, ভাতার-সোয়াগী কোরে দেবে, এই রকম লোভ দেখায়; যাগ-যজ্ঞি কোরে দেবে, মাদুলী পরাবে, এই রকম অনেক কথা বলে; রেতের বেলায় যাগ-যজ্ঞিও আরম্ভ হয়।”
আমি।— তা তো হয়, তা তো শুনেছি; ছেলেকরা সন্ন্যাসীরা যুবতী মেয়েদের কাছে ঐ ভাবের নানা কথা বলে, তা আমি জানি; তার ভিতর খুনোখুনি কাণ্ড কেন এলো? সৌদামিনীই কি তবে সেই সন্ন্যাসীকে কেটে ফেলেছে?
কামি।—(দন্তে রসনা কর্ত্তন করিয়া) ও মা! এ কি কথা গো! না না, সৌদামিনী কাটবে কেন? আর একজন। সেই—
আমি।—বল, বল, থামো কেন? আর একজন কি? কে সে আর একজন?
কামি।—ও বাবা! তাও বোলতে হবে?
আমি।—তাই তো আমি শুনতে চাই। খুনের তদারকের দিন থেকে সেই রকম সন্দেহই আমার মনে মনে গাঁথা রয়েছে। কে সেই আর একজন?
কামি।—আর একজন সেই রাত্রে অন্ধকারে সৌদামিনীর ঘরের ভিতরে আসে। রাতে আমার ভালরকম ঘুম হয় না, পাঁচ সাত বছর আমি প্রায় অর্দ্ধেক রাত জেগে কাটাই; একটা লোক এলো, আমি জানতে পাল্লেম; সন্নিসী যেখানে যজ্ঞি কোত্তে বোসেছিল, সৌদামিনী সেইখানে ছিল; সেখানে আলো ছিল; যে লোক এলো, চুপি চুপি ঘর থেকে বেরিয়ে, সেই লোকটা একখানা বটী হাতে কোরে তাদের দুজনের পেছনে এসে দাঁড়ালো; তখন আমি তারে চিনতে পাল্লেম। একটু পরেই সন্নিসীর গলায় এক কোপ! রক্তগঙ্গা! সৌদামিনী অকস্মাৎ ভয় পেয়ে একবার চেঁচিয়ে উঠেছিল, লোকটার দিকে মুখ ফিরিয়ে তখনি আবার থেমে গেল; কাঁপতে লাগলো। লোকটী কিন্তু সেখানে আর দাঁড়ালো না, রক্তমাখা বটীখানা ফেলে রেখে দেখতে দেখতে ছুটে পালালো।
আমি।—ও কামিনীর মা! ফিকিরফন্দীর কথা তুলে তুমি আমারে সাবাসি দিচ্ছেলে, তুমি যে দেখছি, ফিকিরফন্দীতে তোমার মাথার চুলের চেয়েও বেশী পাকা! চুলগলি ছোট ছোট মল্লিকাফুলের মতন ধপধপে সাদা হয়ে গিয়েছে, ফন্দী-ফিকিরের বুদ্ধিটুকু তার চেয়েও বেশী পেকে-জবাফুলের মতন লাল হয়ে উঠেছে। প্রশ্ন এড়াবার ফিকির তুমি বেশ জানো! কিন্তু কামিনীর মা! মনে রেখো, বজ্ৰবাঁধনে ফস্কা গেরো! নাচতেছ ভালো, পাক দিচ্ছ এলো এলো! যতই ফিকির খাটাও, আমাকে তুমি ভুলাতে পারবে না। বোলছো সব কথা, আসলনামটা চেপে চেপে যাচ্ছো। ‘আর একজন, একটী লোক, সেই লোকটী’ এই রকম ছাঁটা ছাঁটা ছাড়া ছাড়া কথা ‘রাত্রে তোমার ঘুম হয় না, দিনের বেলা হয়!’ এইমাত্র ঘুমের ঘোরে একেবারে বোলে ফেলেছ, লোকটাকে তুমি চিনতে পেরেছিলে। তবে আর ঢাক ঢাক গুড় গুড় কেন রাখো দিদি! নামটা বোলে ফেলো! আমিও নিশ্চিন্ত হই, তুমিও বাঁচো!—বলে ফেলো!
আর কামিনীর মা চেপে রাখতে পাল্লে না; নিজের কথাতেই নিজেই ধরা পোড়লে; সামলাতে না পেরে শেষকালে বোলে ফেল্লে, “সব কথাই যখন বোলেছি, তখন আর ঢাক ঢাক গুড় গুড় কি? কে সেই লোক, এত কথা শুনে তা কি তুমি বুঝতে পারি নি? পোড়াকপালী সৌদামিনী যার সঙ্গে কাশীতে এসেছে, সেই লোক!—আমাদের বাড়ীর পাশের বাড়ীর সেই জয়হরি বড়াল!”
আমি চমকালেম না; বুড়ীর মুখে যখন শুনেছি, বাড়ীর লোকজন কেহই আসেন নাই, সৌদামিনী একটা বেণের ছেলের সঙ্গে কাশীদর্শনে এসেছে কিম্বা কাশীবাসিনী হোতে এসেছে, তখনি বুঝেছি, সেই বেণের ছেলেটাই সৌদামিনীর পরকালের কালভৈরব; তাই আমি বুড়ীর কথায় চমকালেম না; বেশ ঠাণ্ডা থেকেই বুড়ীকে আবার জিজ্ঞাসা কোল্লেম, “জয়হরি বড়াল রাত্রিকালে কেমন কোরে গৃহস্থ ভদ্রলোকের অন্দরমহলে ঢুকেছিল? কোন পথ দিয়ে গিয়েছিল?”
বুড়ী অম্লানবদনেই বোল্লে, “রোজ রাত্রে যাওয়া-আসা কোত্তো, পথ, ঘাট, অন্ধিসন্ধি সব তার জানা ছিল। বাড়ীর পাশেই তাদের বাড়ী, মাঝখানে ছোট গলী; বড় জোর তিনহাত তফাৎ; ছাতে ছাতে সমান, ছাতে ছাতে বড় একখানা তক্তা ফেলে পার হয়ে আসতে; সারারাত সৌদামিনীর ঘরে মদ খেতো, রঙ্গভঙ্গ কোত্তো, ভোরবেলা চোলে যেতো; আপনাদের ছাতে গিয়ে, সেই তত্তাখানা আর একদিকে সোরিয়ে রেখে দিতো। তক্তা তো তক্তা, কিসের তক্তা, তাদের বাড়ীর লোকেরা সেটা কিছু মনে কোত্তো না, সন্দেহও রাখতো না।”
আমি।—ভাল, বুঝলেম। আচ্ছা, সৌদামিনীকে জয়হরি ভালবাসে, তা পথে যাওয়া-আসা কোতো, মন্দকথা নয়; সন্ন্যাসীটীকে কাটলে কেন? সৌদামিনীর মঙ্গলের জন্যই যজ্ঞ কোচ্ছিল, সৌদামিনীর ছেলে হবার সুবিধা হোচ্ছিল, জয়হরি তারে কেটে ফেল্লে কেন?
কামি।—কেটে ফেল্পে গায়ের জ্বালায়!
আমি।—কি রকম?
কামি।—রকম ভাল। ছেলেমানুষ তুমি, সে সব রকমসকম কি বুঝবে? ছেলে হবার যজ্ঞি, জয়হরি সেটা ভাবলে না; জয়হরি মনে কোল্লে, ছেলে করবার জন্যই হয় তো যজ্ঞি হোচ্চে, অম্নি গায়ের জ্বালা ধোরে গেল, সেই জ্বালাতেই বটীর কোপ!
আমি।—সম্ভব বটে। আচ্ছা, সৌদামিনী কাশী এলো, কৰ্ত্তা কিছুই বোল্লেন না?
কামি।—পালিয়ে এসেছে। সন্নিসীখুন, রোজ রোজ বাড়ীতে পুলিশের লোকের আমদানী, পাড়ার লোকেরাও নানা রকম হৈ চৈ লাগালে, জয়হরি সৌদামিনীকে মন্তন্না দিলে, রাত্তিরযোগে দুজনে পালিয়ে এসেছে।
আমি।— তুমি তাদের সঙ্গে এলে কেন?
কামি।—ছাড়লে না। সৌদামিনী যা যা কোত্তো, সব আমি জানতেম। জয়হরির সঙ্গেও যা, সন্নিসীর সঙ্গেও যা, সব আমি জানতেম; খুনটাও আমি দেখেছিলেম; সৌদামিনী তা জানতে পেরেছিল, সেইজন্য আমাকে শুদ্ধ সোরিয়ে ফেলা ইচ্ছা হলো। এই গেল এক কথা, আরো একটা ঘরোয়া কথা। ছেলেবেলা থেকে পোড়াকপালীকে আমি বড় ভালবাসতেম, পোড়াকপাল আমার, ঐ সব কাণ্ড-কারখানা দেখেও ভালবাসার মায়াটা কাটাতে পারি নি, পালাবার সময় সৰ্ব্বনাশী যখন আমার হাতে ধোরে কাঁদতে লাগলো, “তুই না গেলে আমি সেখানে থাকতে পারবো না, তোরে না দেখলে একমাসও আমি বাঁচবো না,” এই সব কথা যখন বোলতে লাগলো, তখন আর আমি মায়ার দায়ে কথা এড়াতে পাল্লেম না, কিছুতেই ওরা ছাড়লো না, কাজেই আসতে হলো।
আমি।—আচ্ছা, সৌদামিনী আবার কি বাড়ী ফিরে যাবে?
কামি।—মরণ দশা! আর কি ফিরে যেতে পারে? কোন লজ্জায় আবার লোকের কাছে ঐ কালামুখ দেখাবে? আর যাবে না। যে কদিন বাঁচে, এইখানেই থাকবে।
আমি।—আচ্ছা, সৌদামিনী এখানে জয়হরির সঙ্গে কি সম্পর্কে আছে? লোকের কাছে কি রকম পরিচয় দেয়?
কামি।—বিয়েকরা সোয়ামী।
আমি।—উত্তম পরিচয়! সোয়ামীকে ঘরে রেখে সৌদামিনী আবার কুমারী সেজে অন্য বাড়ীতে পূজাভোগের নিমন্ত্রণেও যায়! কাশীধামের মাহাত্ম বেশ! আচ্ছা কামিনীর মা, তুমি কি চিরদিন ওদের কাছেই থাকবে?
কামি।—না থেকে আর কোথায় যাবো? আমার কেউ নেই, কোথাও যাবার জায়গাও নাই। যে কদিন বাঁচি, ওদের কাছেই থাকবো, যা করেন বাবা বিশ্বেশ্বর।
আমি।—আচ্ছা কামিনীর মা, আমি যদি তোমারে কোন ভাল জায়গায় রেখে দিতে পারি, সেখানে তুমি যেতে রাজী আছ? বৃদ্ধবয়সে পাপের সংসর্গে আর কেন থাকবে? পাপের অন্ন কেন খাবে? কি বল?
কামি—আঃ! তা হোলে তো বেঁচে যাই! প্রাতঃপাক্কে চিরজীবী হও, রাজা হও, কোথায় তুমি আমারে নিয়ে যেতে চাও?
আমি।—নিয়ে যেতে চাই না কোথাও, কাশীতেই থাকতে পাবে, ভদ্রলোকের বাড়ীতেই থাকবে, কিছুই কষ্ট হবে না। যে বাড়ীতে আমি আছি, সেই বাড়ীতেই রাখতে পাত্তেম, কিন্তু সৌদামিনী জানতে পারবে; সে বাড়ীতে রাখা হোতে পারে না। সে বাড়ীর বড়বাবুর সঙ্গে কাশীর অনেক বড় বড় লোকের আলাপ, তাঁরে অনুরোধ কোরে তোমার জন্য আমি একটা উত্তম আশ্রয় ঠিক কোরে দিব।
কামিনীর মা সম্মত হলো। আমিও শুনে সন্তুষ্ট হোলেম। ইতিমধ্যে আর একদিন অন্য কোন স্থানে তার সঙ্গে আমার দেখা হবে, সেই দিন সমস্ত বন্দোবস্ত ঠিকঠাক করা যাবে, এইরুপ স্থির হয়ে থাকলো।
সন্ধ্যা হবার অতি অল্প বিলম্ব। কামিনীর মা বেরিয়ে গেল, আমিও যজ্ঞেশ্বরের সঙ্গে রাস্তায় বেরুলাম। সে সময় পূৰ্ব্বকথিত বাইজীগুলির আরো অধিক নয়নমোহিনী শোভা। এক এক বারান্দায় সেতার-বেহালাযোগে সমধুরকণ্ঠে সুরলহরী হিল্লোলিত হোচ্ছি, শ্রবণে শ্রবণ-মন বিমুগ্ধ হয়, অল্পক্ষণ একপাশে দাঁড়িয়ে একটী গীতের অর্দ্ধেকটুকু আমি শুনলেম, শেষ পর্য্যন্ত শোনবার অবকাশ হলো না। বড়বাবু সন্ধ্যার পরেই ফিরে আসেন, সন্ধ্যার পূর্ব্বেই বাড়ী যাওয়া আবশ্যক, সঙ্গীতশ্রবণের আশাকে মনোমধ্যে গুপ্ত রেখে যজ্ঞেশ্বরের সঙ্গে আমি বাড়ীর দিকে চোলে এলেম।
বস! এই পর্য্যন্ত আমার সে দিনের দৌত্যকাৰ্য্য সমাধান। পাঠকমহাশয় জিজ্ঞাসা কোত্তে পারেন, দৌত্যকাৰ্য্য সমাধা কোল্লেম, আমি কাহার দূত?— কোন মনুষের দূত আমি নই, এ ক্ষেত্রে এ কার্য্যে আমি ধর্ম্মদেবের দূত।
এ দৌত্যকার্য্যের পরিণাম কি হবে? আমিও তাই ভাবছি। অজ্ঞাত খুনের আসামীটা কে, সন্ধানটী জানা হলো, কি উপলক্ষে কি রকমে খুন, সেটাও একপ্রকার জানা হলো, তার পর? মনে মনে ভাবলেম, তার পর আমি কি কোরবো? পুলিশে সংবাদ দিয়ে আসামীকে ধরিয়ে দেওয়া, তাই বা কি প্রকারে হয়? সাক্ষী কোথায়? সাক্ষীর মধ্যে একটা স্ত্রীলোক আবার সামান্য চাকরাণীমাত্র; একটা চাকরাণীর সাক্ষ্যবাক্যে একটা লোকের প্রাণ যাওয়া বিচারকেরও বিবেচনায় কখনও যুক্তিযুক্ত বোধ হবে না। আরো একটা সন্দেহ আছে। কামিনীর মা আমার কাছে যে সব কথা বোল্লে, জজের কাছে সেই সব কথা বোলবে কি না? না বলাই অধিক সম্ভব। সংবাদ দিয়ে আমিই তখন ফ্যাসাদে পোড়বো। সন্ন্যাসী আমার কেউ ছিল না, জয়হরিও আমার শত্রু নয়, জয়হরির ফাঁসী হোলে রমাই সন্ন্যাসী বেঁচে উঠবে না, কাজ কি তবে বৃথা ফ্যাঁসাদ ডেকে আনা? বড় বড় বদমাসলোককে শাস্তি দেওয়া ধর্ম্মানুসারে কর্ত্তব্য বটে, কিন্তু ইংরেজী আইনের কূট-চক্রের গতি যে প্রকার, সে গতিতে একাধিক প্রত্যক্ষ সাক্ষীর মুখে ঠিকঠিক প্রমাণ না হলে সত্য অপরাধীরাও বেকার খালাস পায়, উলটে আবার সত্যসংবাদদাতার বিপদ পড়ে। দূর হোক, এখন আর সে উৎপাতে কাজ নাই। এর পর যদি অন্য কোন সূত্র প্রকাশ পায়, তখনকার কর্ত্তব্য তখন স্থির করা যাবে। এইরূপ স্থির কোরে মনের ভাব মনেই চেপে রাখলেম, যজ্ঞেশ্বরকেও কিছু জানতে দিলেম না।
ঠিক সন্ধ্যার সময় আমরা বাড়ীতে পৌঁছিলেম, বড়বাবু তখনো ফিরে আসেন নি। মেজোবাবু পৃথক হবেন, যাতে কোরে সেই অপ্রিয় ঘটনা না ঘটে, সেই বিষয়ের উপায়নির্দ্ধারণের জন্য মধ্যস্থ নির্ব্বাচনে তিনি ব্যস্ত, ফিরে আসতে রাত্রি প্রায় দশটা বেজে গেল। সে রাত্রে তাঁর সঙ্গে আমার আর অন্য কথা কিছুই হলো না।
সেই সপ্তাহের শুক্রবার সন্ধ্যার পর আমাদের বাড়ীর দরজার সম্মুখে একখানা গাড়ী লাগলো; একটী ভদ্রলোক সেই গাড়ী থেকে নেমে সরাসর বৈঠকখানায় উঠে এলেন। সম্মুখেই আমি ছিলেম, দেখেই চিনলেম, মোহনলালবাবু। আমারে সেইখানে দেখে, বিস্ময় প্রকাশ কোরে তিনি জিজ্ঞাসা কোল্লেন, “হরিদাস! তুমি এখানে?” নম্রভাবে আমি উত্তর কোল্লেম, “আজ্ঞা হাঁ, এই বাড়ীতেই আমি আছি, বড়বাবু যথেষ্ট স্নেহ করেন, এখানকার আদালতে তিনি আমার একটী চাকরী কোরে দিয়েছেন, কুড়িটাকা বেতন হয়েছে, এখানে আমি বেশ আছি।”
আমার কথাগুলি শুনে মোহনবাবু একটু আহ্লাদ প্রকাশ কোরে বোল্লেন, “বেশ হয়েছে! শুনে আমি তুষ্ট হোলেম। রমেন্দ্রবাবু আমার পরম বন্ধু, তোমার জন্য তাঁকে আমি বিশেষ কোরে বোলে দিব। এইখানেই তুমি থাকো, ছেলেবুদ্ধিতে আর কোথাও চোলে যেয়ো না, থাকতে থাকতে আরো ভাল হবে।”
আমি নমস্কার কোল্লেম। বড়বাবু তখন সেখানে ছিলেন না, একটু পরেই বাড়ীর ভিতর থেকে বেরিয়ে এলেন; এসেই মোহনবাবুকে দেখে প্রফুল্লবদনে কুশলবার্ত্তা জিজ্ঞাসা কোল্লেন, যথাসময়ে পত্র প্রাপ্ত হওয়া গিয়েছে, সে কথাও বোল্লন। আনুষঙ্গিক বিশ্রম্ভালাপে কিয়ৎক্ষণ অতিবাহিত হলো, তাঁরা উভয়ে পাশাপাশি হয়ে বোসলেন, আমি একটু তফাতে বোসে থাকলেম।
মোহনলালবাবুর বদন বিষন্ন। প্রথমাবধি সেই বিষন্নতা আমি লক্ষ্য কোরেছিলেম, কারণ কিছু অনুভব কোত্তে পারি নাই। মুখপানে চেয়ে বড়বাবু তাঁরে জিজ্ঞাসা কোল্লেন, আপনাকে এমন চিন্তাযুক্ত দেখছি কেন? এ রকম বিমর্ষভাব কখন তো দেখি নাই? সৰ্ব্বক্ষণ হাসিখুসী, সৰ্ব্বক্ষণ প্রসন্নতা, সৰ্ব্বক্ষণ আমোদ-আহ্লাদ, আজ কেন এমন ম্রিয়মাণ? হয়েছে কি? শরীরে কি কোন অসুখ আছে?”
অম্লানবদনে মোহনবাবু উত্তর কোল্লেন, “আমার নিজের শরীরে কোন অসুখে হয় নাই, আমার পরিবারটী অত্যন্ত পীড়িত। আজ তিনদিন হলো, আমরা কাশীতে এসেছি, এসে অবধি তিনি শয্যাগত; ভয়ানক জ্বর; ঘোর বিকার সেই জন্য এই তিনদিন আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ কোত্তে পারি নাই, আজ একটু ভাল আছেন, চিকিৎসকেরা বোলছেন, এই রূপ যদি থাকে, আর কোন উপসর্গ না হয়, তা হলে আরাম হোতে পারেন; তথাপি একুশ দিনের কমে সম্পূর্ণ ভরসা করা যায় না।
বড়বাবু দুঃখ প্রকাশ কোল্লেন, আরাম হবেন বোলে প্রবোধ দিলেন; মোহনবাবু নিশ্বাসত্যাগ কোল্লেন। মোহনবাবুর নূতন বিবাহের কথা বড়বাবু জানতেন না, মোহনবাবুও ভাঙলেন না, আমি কিন্তু বুঝতে পাল্লেম, নূতন পরিবার। আমার চিত্ত বিচলিত হলো, আহা! আহা! অমরকুমারীর শক্ত পীড়া! ভয়ঙ্কর জ্বর-বিকার! আমার একবার দেখা করা অবশ্য কর্ত্তব্য। এরূপ আমি ভাবলেম, কিন্তু উপযাচক হয়ে মোহনবাবুর কাছে সে ভাবটা ব্যক্ত কোত্তে পাল্লেম না। অমরকুমারী আমার কত বড় উপকারিণী, মোহনবাবু জানেন না, আমি যদি হঠাৎ তাঁর সাক্ষাতে বলি, আপনার পরিবারকে আমি দেখতে যাব, সেটা একটু দোষের কথা হয়; তাই ভেবেই কিছু বোলতে পাল্লেম না, প্রাণ কিন্তু ব্যাকুল হলো; আপন মনে ইতস্ততঃ কোত্তে লাগলেম।
মানুষের মনের ব্যাকুলতা মানুষে বুঝতে পারে না, অন্তর্যামী জানতে পারেন। আমার প্রতি তখন অন্তর্যামী যেন সদয় হোলেন; আশা পূর্ণ হবার সুযোগ উপস্থিত হলো। বিদায়কালে মোহনলালবাবু আমার দিকে চেয়ে কি একটু চিন্তা কোরে বোল্লেন, “চল হরিদাস, তুমিও আমার সঙ্গে চল; যে বাড়ীতে আমি রয়েছি, সেই বাড়ীখানি দেখে আসবে, আবশ্যক হোলে একাকীও যেতে পারবে, আবশ্যক হবে, মাঝে মাঝে তোমাকে যেতে হবে, তাও আমি জানতে পাচ্ছি, চল।”
মন আমার যা চায়, তাই আমি পেলেম; বড়বাবুর অনুমতি নিয়ে, পূৰ্ব্বকথিত শকটারোহণে মোহনবাবুর বাসাবাড়ীতে আমি গেলেম। যে ঘরে রোগী, সে ঘরে আমারে নিয়ে যেতে মোহনবাবু কোন প্রকার দ্বিধা রাখলেন না; ঘরে আগুন লাগার কথাটা তাঁর মনে ছিল, সেই কারণেই আমি অমরকুমারীর রুগ্ণ-শয্যাপার্শ্বে অবাধে যেতে পেলেম।
অমরকুমারী শয্যাশায়িনী! পদতলে ধাত্রীরূপিণী একটী দাসী। অমরকুমারীর সেই পদ্মফুলের মত মুখখানি মলিন হয়ে গিয়েছে, স্থানে স্থানে যেন কালিমারেখা অঙ্কিত হয়েছে, সেই কুরঙ্গ-নেত্ৰ-দুটী যেন জলভরে ছলছল কোচ্ছে, পূরন্ত কপোলে চক্ষের কোল বোসে গিয়েছে, মুখখানি বিশুদ্ধ; পার্শ্বে উপবেশন কোরে, ললাটে করস্পর্শে জানলেম, গাত্রে বিষম উত্তাপ! খানিকক্ষণ মুখপানে চেয়ে চেয়ে, একটু হেঁট হয়ে, ধীরে ধীরে আমি জিজ্ঞাসা কোল্লেম, “অমরকুমারি এখন তোমার কি রকম যাতনা হোচ্ছে?”
দুই তিনবার জিজ্ঞাসা কোল্লেম, একটীও উত্তর পেলেম না। অমরকুমারীর চক্ষু যেন চিত্রিত চক্ষের ন্যায় আমার মুখের দিকে স্থির, মুখে কিন্তু কথা নাই; কোনদিন যে পরিচয় ছিল, সেই সুস্থির-নয়নে সে প্রকার কোন লক্ষণই অনুভূত হলো। পুনরায় কথা কইলেম, অমরকুমারী কথা কইলেন না। পুনরায় আমি তাঁর উত্তপ্ত ললাটে হস্তস্পর্শ কোল্লেম, ধীরে ধীরে একখানি হস্ত উত্তোলন কোরে অমরকুমারী আমার হাতখানি সোরিয়ে দিলেন, কেমন যেন উদাসীনভাবে মুখখানি অন্যদিকে ফিরিয়ে নিলেন। আমি অপ্রতিভ হোলেম, প্রাণে কেমন বেদনা লাগলো। মনে কোল্লেম, মিথ্যা মায়ায় অমরকুমারী আমারে ভুলে গিয়েছেন। আগুনের মুখ থেকে যখন উদ্ধার করি, তখন চিনতে পারেন নাই, এখনও চিনতে পাল্লেন না। এই রকম ভাবছি, সেই সময় অমরকুমারী বামহস্তের অঙ্গলিগুলি অল্পে অল্পে সঞ্চালন কোরে, সঙ্কেতে আমারে সেখান থেকে উঠে যেতে বোল্লেন। নিতান্ত ক্ষুণ্ণমনে শয্যার উপর থেকে আমি নেমে এলেম। মোহনলালবাবু একটু দূরে একখানি চেয়ারে বসে ঐ সব কার্য্য দেখলেন, কিছুই বোল্লেন না। তার পর অন্য ঘরে নিয়ে গিয়ে তিনি আমারে কিছু জল খেতে দিলেন। আর আমার জলখাওয়া! অমরকুমারী আমারে চিনতে পাল্লেন না, বিষাদের বহ্নি হৃদয়ে প্রজ্বলিত, মোহনবাবুর মনস্তুষ্টির নিমিত্ত একখানি গজা মুখে দিয়ে, এক গ্লাস জল খেয়েই আমি উঠে পোড়লেম। রাত্রে সেইখানে থাকবার জন্য মোহনবাবু আমারে অনুরোধ কোল্লেন, বড়বাবু উদ্বিগ্ন হবেন, এইরুপ ওজর কোরে, সে অনুরোধে আমি উপেক্ষা কোল্লেম; কাজে কাজেই আর একখানা ভাড়াটে গাড়ী ডাকিয়ে এনে, গাড়োয়ানকে ঠিকানা বোলে দিয়ে, রাত্রি এক প্রহরের পর মোহনবাবু আমারে যথাস্থানে পাঠিয়ে দিলেন।
আমার অপেক্ষায় বড়বাবু বাস্তবিক তখনো বৈঠকখানায় ছিলেন, বিমর্ষবদনে নিকটস্থ হয়ে তাঁরে আমি বোল্লেম, “সত্য সত্য মোহনবাবুর পরিবারের পীড়া বড় শক্ত! তিনদিনের মধ্যে স্বর্ণবর্ণ যেন কালী হয়ে গিয়েছে, চক্ষু বোসে গিয়েছে, চক্ষে ঝাপসা ধোরেছে, চাউনিও যেন ফ্যালফেলে! আহা! গতিক বড় ভাল বোধ হলো না! এত অল্পবয়সে—”
শুনতে শুনতে অন্যমনস্কভাবে আমাকে থামিয়ে দিয়ে, সবিস্ময়ে বড়বাবু বোলে উঠলেন, “মোহনবাবুর সঙ্গে পূর্ব্বে কি তোমার দেখাশুনা ছিল? তাঁর পরিবারকে পূর্ব্বে কি তুমি দেখেছিলে? স্বর্ণবর্ণ, কালীবর্ণ, এত অল্পবয়সে, এ সব তোমার কি রকম কথা? মোহনবাবুর পরিবারের বর্ণ স্বর্ণবর্ণ নয়, তিনি শ্যামাঙ্গী, তাঁর বয়সও অল্প নয়, ত্রিশ বত্রিশ বৎসরের কম হবে না; তুমি এ সব নূতনকথা কোথা থেকে এনেছ?”
তৎক্ষণাৎ আমি উত্তর কোল্লেম, “আজ্ঞা না, নূতনকথা নয়, সত্যকথাই আমি বোলছি। মোহনবাবুর বড় পরিবারটী সঙ্গে আসেন নাই, এটী নূতন পরিবার। বাবুর মুখেই আমি শুনেছি, তিনি দ্বিতীয়বার দারপরিগ্রহ কোরেছেন; বীরভূমজেলায় নূতন পরিবারের পিত্রালয়। এ পরিবারটীর বয়েস অল্প, দিব্য গৌরাঙ্গী, চমৎকার সুন্দরী। মোহনবাবুর সঙ্গে আমার জানাশুনা আছে। প্রথম-দর্শন বর্দ্ধমানে, তার পর ভেলুয়াচটীতে। নূতন পরিবারটীকে সেই চটীতেই আমি দেখেছিলেম। আহা! অঙ্গে সবে যৌবনের অঙ্কুর, চমৎকার রূপ। বিশ্বেশ্বর করুন, আরাম হোন; সেটীর কিছু ভালমন্দ হোলে মোহনলালবাবুর প্রাণে বিষম আঘাত লাগবে!”
বড়বাবু একটা দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ কোল্লেন; আকাশপানে চেয়ে মৃদুমন্দবচনে বল্লেন, “না না, অমঙ্গল আশঙ্কা কোত্তে নাই; অবশ্যই; আরাম হবেন। মোহনলালবাবু ধৰ্ম্মপরায়ণ, পরোপকারী, বন্ধুবৎসল, অমায়িক ভদ্রলোক; কখনো তিনি কারো কোন অনিষ্ট করেন নাই, তাঁর মন্দ কেন হবে? ধৰ্ম্মই ধার্ম্মিককে রক্ষা করেন; পরিবারটী অবশই আরাম হবেন। তাঁদের সঙ্গে তোমার জানাশুনা আছে, শুনে আমি সন্তুষ্ট হোলেম। তুমি তাঁদের মঙ্গল চাও, তাঁদের কষ্টে তুমি কাতর হও, এতো অল্পবয়সে এরূপ মহত্ত্ব তোমার, এ লক্ষণেও তোমার প্রতি আমি পরিতুষ্ট।”
কথাগুলি শুনলেম, ভালমন্দ কিছুই বোল্লেম না। বড়বাবুর মুখের প্রশংসাগীত একপ্রকার, আমার প্রাণের নবসঙ্গীতের সুর অন্যপ্রকার। সে রাত্রে আহারান্তে যখন শয্যায় শয়ন কোল্লেম, তখন আমার হৃদয়তন্ত্রীতে সেই সুর বেজে উঠলো। মোহনবাবু ধার্ম্মিক, পরোপকারী, অমায়িক, কখনো তিনি কারো মন্দ করেন নাই, সে সুরের সঙ্গে আমার প্রাণের সুরের মিলন হলো না। কেন হলো না, সে হেতুবাদ সময়তরে প্রকাশ হবে, এখন আমার অন্যচিন্তা প্রবলা। অমরকুমারী বাঁচবেন না! বড়বাবুকে বোল্লম বিকারের লক্ষণ, চক্ষে ঝাপসা; সেই কথাই ঠিক। অগ্নিকাণ্ডের সময় আগুনভেল্কীতে আমারে চিনতে না পারা ততটা আশ্চর্য্যবোধ হয় নাই, এখন যে অমরকুমারী আমারে চিনতে পাল্লেন না, ইহাই বড় তাজ্জব ব্যাপার। বিছানার উপর পাশ ঘেঁসে বোসলেম, মুখের কাছে মুখ নিয়ে গেলেম, স্পষ্ট স্পষ্ট কথা কোইলেম, তবু অমরকুমারী আমারে চিনলেন না! অমরকুমারী কি এতই নিষ্ঠুরা?—না—না—না, অমরকুমারীকে নিষ্ঠুরা মনে করাও আমার অকৃতজ্ঞতা! অমরকুমারী দয়ার প্রতিমা! অমরকুমারী আমার জীবনদায়িনী! সেই দয়াময়ী অমরকুমারী কখনই নিষ্ঠুরা হোতে পারেন না। বিকারের ধর্ম্ম। ঘোর-বিকারাচ্ছন্ন রোগীরা মানুষ চিনতে পারে না,—মাতাপিতা, পুত্রকন্যা প্রভৃতি স্বজনবর্গকেও চিনতে পারে না, আসন্নকালে এই লক্ষণ দেখা দেয়। চক্ষে জল পড়ে! অমরকুমারীর সেই লক্ষণ! অমরকুমারীর সেই অবস্থা! অমরকুমারীর আসন্নকাল! ঘোর বিকার। অমরকুমারী বাঁচবেন না! এই চিন্তায় সমস্ত রজনী আমি ছটফট কোল্লেম, একটীবারও চক্ষের পাতা বুজতে পাল্লেম না!
প্রভাতে গাত্রোত্থান কোরে অগ্রেই আমি অমরকুমারীকে দেখতে গেলেম। তখনো সেই ভাব! অমরকুমারী আমারে চিনতে পাল্লেন না! চক্ষের জল মুছতে মুছতে আমি ফিরে এলেম। উপযুপরি তিনদিন সকাল বিকাল দুটী বেলা অমরকুমারীকে আমি দেখতে যাই, কেঁদে কেঁদে ফিরে আসি। দিন দিন বিকারের বৃদ্ধি! বড়বাবু নিত্য নিত্য সংবাদ লন, আমার মুখে অবস্থা শুনে শুনে অত্যন্ত কাতর হন, নিত্য নিত্য আমি অফিসে যাই, কাজকর্ম্ম করি, কিন্তু কাজের দিকে মন থাকে না। আফিসের লোকেরা বুঝতে পারে, বড় বাবুর নিজের লোক আমি, সেই জন্য কেহ কিছু বলে না।
একদিন সন্ধ্যার পর বৈঠকখানায় কেবল আমি আর বড়বাবু। আমারে সৰ্ব্বক্ষণ অন্যমনস্ক দেখে, মোহনবাবুর পরিবারের জন্য আমি কতির, সেই ভাবটা বুঝতে পেরে, বড়বাবু আমারে জিজ্ঞাসা কোল্লেন, “হরিদাস। মোহনবাবুর বিপদে যে রকম কাতরতা তুমি দেখাও, তাতে কোরে বোধ হয়, তাঁদের সঙ্গে তোমার অতি নিকট-সম্বন্ধ। আচ্ছা, বল দেখি, কি সূত্রে মোহনবাবুর সঙ্গে তোমার মিলন হয়েছিল?”
প্রকাশ কোরবো না, মনে কোরে রেখেছিলেম, কিন্তু সে সঙ্কল্প রক্ষা কোত্তে পাল্লেম না; বাবুর প্রশ্নে যখন সূত্র পর্য্যন্ত টান পোড়লো, তখন আর কি প্রকারে চেপে রাখি? পাল্লেম না; পাঁজী-পুথি খুলে সূত্ৰগ্ৰন্ধি শিথিল করবার মন্ত্র আওড়াতে বাধ্য হোলেম। প্রথমেই বোল্লেম, “বর্দ্ধমানে প্রথম দেখা। এই কাশীধামে আপনার সঙ্গে যেদিন আমার প্রথম সাক্ষাৎ, সেই দিন আমার বাল্যজীবনের ঘটনাবলীর সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিয়েছিলেম, সেই পরিচয়ের মধ্যে কতকগুলি গুহ্যকথা আমি গোপনে রেখেছিলেম; আজ আপনি সূত্র পরিজ্ঞাত হবার ইচ্ছা প্রকাশ কোল্লেন, তখন সেই গুপ্তকথাগুলি কাজেই আমারে প্রকাশ কোত্তে হলো। যদি কিছু অপ্রিয় বোধ হয়, দয়া কোরে আমার অপরাধ আপনি মার্জ্জনা কোরবেন। মোহনবাবুর গুণকীৰ্ত্তন করবার সময় সেদিন আপনি বোলেছেন, মোহনবাবু ধার্ম্মিক, অমায়িক, পরোপকারী ভদ্রলোক; হোতে পারে, কথায় বার্ত্তায় বন্ধুলোকের কাছে সে সকল গুণের পরিচয় তিনি দিতে পারেন, কিন্তু আমি যতদূর জানতে পাচ্ছি, সেই প্রমাণে বোলতে পারি, ব্যবহারে বিপরীত। পূর্ব্বে আপনারে আমি বোলেছি, বর্দ্ধমানে ঘোরবিপদে যিনি আমারে আশ্রয় দেন, তাঁর একটী জামাই আছেন; জামাইটী অত্যন্ত অপব্যয়ী, আমার আশ্রয়দাতা সেই জামাইকে সৎপথে আনবার জন্য স্বকৃত উইলে বিষয়ের অংশের কথা ব্যক্ত করেন, জামাই যদি ক্রমাগত বেশী টাকা নষ্ট করেন, উইলের ক্রোড়পত্রে তিনি সেগুলি বাদ দিয়ে যাবেন, এ কথাও বলেন, যে সিন্দুকে উইল ছিল, সেই জামাইকে সেই সিন্দুকটীও দেখান; কিছু দিন পরে একরাত্রে বিছানার উপর কর্ত্তা কাটা পড়েন। এ সব কথা আপনাকে বোলেছি, কিন্তু সেই জামাইটীর নাম বলি নাই। সেই জামাই এই মোহনবাবু। শ্বশুরের খুনের পর সেই উইলের পাঠ আমি নূতনরকম শ্রবণ করি। সেই বাড়ীতেই মোহনবাবুকে আমি চিনি। তাঁর শ্বশুরের মৃত্যুর পর তাঁরই কাছে আমি আশ্রয় চাই, সেই সময় একটা লোক আমার মামা সেজে গিয়ে মোহনবাবুর সম্মুখ থেকেই আমারে ধোরে নিয়ে যায়। সেই লোকের ডাকনাম রক্তদন্ত, আসল নাম জটাধর। লোকটা বড় ভয়ঙ্কর। শৈশবাবধি যত কষ্ট আমি পেয়েছি, এখন জানতে পেরেছি, সেই জটাধর ওরফে রক্তদন্তই সেই সকল কষ্টের মূল। রক্তদন্তের সঙ্গে মোহনবাবুর যোগাযোগ ছিল, সেটাও আমি এখন বুঝতে পেরেছি। মোহনলালবাবু ধার্ম্মিক, কি রকম ধার্ম্মিক?—নিরামিষাশী বক যেমন ধার্ম্মিক, হিতোপদেশের বিড়াল যেমন ধার্ম্মিক, স্বর্ণকঙ্কণহস্ত পঙ্কপতিত ব্যাঘ্র যেমন ধার্ম্মিক, আমার এখনকার বিশ্বাসে ঐ মোহনবাবুটীও সেইরকম ধার্ম্মিক!”
দুই কর্ণে অঙ্গুলি দিয়ে বড়বাবু বলে উঠলেন, “এ কি হরিদাস, পাগলের মত এ সব কথা তুমি কি বোলছ? ওটা তোমার ভুলবিশ্বাস। মোহনলালবাবু যথার্থই ধার্ম্মিকলোক, আমি তার প্রমাণ পেয়েছি।”
একটু উচ্চকণ্ঠে তৎক্ষণাৎ আমি বোলে উঠলেম, “আমিও বিশেষ প্রমাণ দিতে পারি। এই দেখুন!”—ত্বরিতস্বরে এই কটী কথা বোলেই আমি উঠে দাঁড়ালেম; একটা আলমারী খুলে, একখানা কেতাব বাহির কোরে নিয়ে বাবুর কাছে এসে বোসলেম। আদালতের সিঁড়িতে যে চিঠিখানা আমি কুড়িয়ে পেয়েছিলেম, সেইখানা আর প্রয়াগ থেকে মোহনলালবাবু আমাদের বড়বাবুকে সম্প্রতি যে চিঠিখানা লিখেছেন, সেইখানা, ঐ দু-খানা চিঠিই আমি ঐ কেতাবের ভিতর যত্ন কোরে রেখে দিয়েছিলেম; বাহির কোরে দেখিয়ে সাগ্রহবচনে বোল্লেম, “দেখুন, এ দুখানা চিঠি এক হাতের লেখা কি না?”
চিঠি দুখানা হাতে কোরে নিয়ে, অক্ষরগুলি মিলিয়ে মিলিয়ে ভাল কোরে দেখে বড়বাবু বোল্লেন, “হাঁ, এক হাতের লেখা; কিন্তু কি তা?”
“কি তা?”—বিস্ফারিতনেত্রে বড়বাবুর মুখের দিকে চেয়ে তৎক্ষণাৎ আমি পুনরক্তি কোল্লেম, “কি তা? এই দেখুন, একখানাতে দস্তখৎ আছে, একখানার দস্তখৎ ছেঁড়া। দুখানাই মোহনবাবুর হাতের লেখা। ছোট চিঠিখানা তিনি জটাধরকে লিখেছিলেন। জটাধর আর আমার উপর কোন দৌরাত্ম্য না করে, ঐ চিঠিতে সেইরূপ উপদেশ। মোহনবাবুর উপদেশে জটাধর আমার উপর অশেষবিধ দৌরাত্ম্য কোরেছে, তা না হোলে এত দিনের পর ঐ চিঠি লিখে জটাধরকে তিনি নিষেধ কোরবেন কেন? সেই জন্যই বোলছি, বক, বিড়াল, ব্যাঘ্র যেমন ধার্ম্মিক, ঐ মোহনলালবাবুটীও সেইরকম ধার্ম্মিক!”
সৰ্ব্বনাশ! সবেমাত্র ঐ কথাগুলি আমি বলেছি, তখনি তখনি রক্তমুখে গর্জ্জন কোত্তে কোত্তে মোহনলালবাবু সেই ঘরের ভিতরে এসে উপস্থিত? কখন এসে ঘরের বাহিরে তিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন, আড়াল থেকে আমার ঐ সব কথা শুনেছেন, কথা শেষ হবামাত্র ক্রোধে অগ্নিশর্ম্মা হয়ে দর্শন দিলেন! আমি কাঁপতে লাগলেম। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আরক্তনেত্রে আমার দিকে চেয়ে, ভীষণগর্জ্জনে তিনি বোলতে লাগলেন, “কি হে ছোকরা! বড়ই যে শাস্ত্রজ্ঞানের পরিচয় দিচ্ছ? বক, বিড়াল, ব্যাঘ্রের মত ধাৰ্মিক আমি? ছেলেমুখে বুড়োকথা? যতদূর মুখ না, ততদূর কথা? জ্যাঠা ছেলের এত বড় স্পর্দ্ধা! আচ্ছা, আচ্ছা! থাকো তুমি! কি বোলবো, আমার বন্ধুর কাছে রয়েছিস, তা না হোলে এখনি আমি তোকে এক লাথিতে যমের বাড়ীর পথ দেখিয়ে দিতেম!”
জোড়াবাতীর আলোতেও আমি তখন চতুর্দ্দিক অন্ধকার দেখলেম! সৰ্ব্বাঙ্গে থরহরি কম্প! ভয়ে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বড়বাবুর পশ্চাতে গিয়ে লুকালেম। চিঠি দু-খানা বালিশের কাছেই পোড়ে থাকলো।
সান্ত্বনাবাক্যে মোহনবাবুকে ঠাণ্ডা করবার জন্য বড়বাবু মধ্যবর্ত্তী হয়ে বোলতে লাগলেন, “বামুন মহাশয়! থামুন, ছেলেমানুষ, বুঝতে পারে নাই, কি কথা বোলতে কি কথা বোলতেছিল, আপনার মত বিজ্ঞলোকের অতটা রাগ করা উচিত হয় না; আমার অনুরোধে হরিদাসকে আপনি ক্ষমা করুন। আপনি মহৎলোক, আপনার স্বভাব-চরিত্র এ বালক বিশেষ জানে না, বালকের কথা মনে কোরে, ক্ষমা করাই সাধুলোকের কর্ত্তব্য।”
একটু যেন শান্ত হয়ে, অল্পগর্জ্জনে মোহনবাবু বোল্লেন, “দেখুন না, আস্পর্ধাটা একবার দেখুন না! অসাক্ষাতে নিন্দা করা কত বড় দুষ্টবুদ্ধির কাজ, একবার ভাবুন না! গরিব বোলে দয়া করি, দেখা হোলে ভালকথা বলি, আপনার আশ্রয়ে রয়েছে, দেখে আমি তুষ্ট হয়েছিলেম, আপনাকে অনরোধ কোরবো ভেবেছিলেম, নিমখারামীটা একবার দেখুন না! হাতের লেখা মিলাতে বোসেছিল! হাতের লেখা কি দু-তিনজনের একরকম হোতে পারে? দেখি—দেখি, কি রকম অক্ষর?—বোলতে বোলতে ব্যস্তহস্তে সেই চিঠি-দুখানি তিনি তুলে নিলেন, দুখানা চিঠিতেই তাচ্ছীল্যভঙ্গীতে একবার চক্ষু দিলেন, দিয়েই অম্নি তাসখেলার মজলীসের চীৎকারের মত চীৎকার কোরে বোলে উঠলেন, “এখানা তো দেখছি জালচিঠি;—দস্তখৎ-ছেঁড়া বজ্জাতী জালচিঠি!” বলেই তৎক্ষণাৎ মোমবাতীর উজ্জ্বল শিখার উপরে ধোরে সেই ছোট চিঠিখানা তিনি জ্বালিয়ে দিলেন, ফরফর কোরে জ্বোলে উঠে চক্ষের নিমেষে সে কাগজখানা ভস্ম হয়ে গেল! বড়বাবুও অবাক, আমিও অবাক।
চিঠিখানা ভস্ম হলো, তখনো মোহনবাবুর রাগ থামিল না; আড়ে আড়ে আরক্তচক্ষে আমার দিকে চেয়ে বড়বাবুকে তিনি বোল্লেন, “কোথাকার একখানা ছেঁড়া চিঠি রাস্তা থেকে কুড়িয়ে এনে, আমার চিঠির সঙ্গে মিলিয়ে, আমাকে বকধার্ম্মিক বোলে বাহাদুরী দেখাচ্ছিল! এই বয়সে এত ফিসলেমী বুদ্ধি ধরে, বয়স হোলে না জানি কি হবে! হয় হবে, আপনিই মারা যাবে, আমার তাতে কি?”
মিষ্টবাক্যে বড়বাবু বোল্লেন, “ও সব কথায় আর কাজ নাই; বালক, না বুঝে দৈবাৎ একটা কথা বোলে ফেলেছে, কথাটা আপনি ভুলে যান। তুচ্ছকথার আন্দোলনে কোন ফল নাই। আপনার পরিবারটী কেমন আছেন?”
“আজ একটু ভাল আছে।”—উগ্রস্বর একটু নরম কোরে মোহনবাবু বোল্লেন, “আজ একটু ভাল আছে। চিকিৎসক বোলে গিয়েছেন, আজ রাত্রেই জ্বরত্যাগ হবে; ভয় নাই। আমার বড় দুর্ভাবনা হয়েছিল, এই আশ্বাসবচনে মনটা একটু সুস্থ হোচ্ছিল, কোথাকার পাপ কোথায়! মিছামিছি একটা বাজেকথা নিয়ে, বাজেকথা তুলে, ছোঁড়াটা অনর্থক আমাকে ক্ষেপিয়ে তুল্লে!”
শেষের কথায় কর্ণপাত না কোরে সময়মত উল্লাসে বড়বাবু বোল্লেন, “আহা, বিশ্বেশ্বর তাই করুন, বৌমাটী আরাম হোন! আপনি দ্বিতীয়বার দারপরিগ্রহ কোরেছেন, এটা আমি জানতেম না, হরিদাসের মুখেই শুনলেম। তা একরকম মন্দ হয় নাই, বিষয়ী লোক আপনি, বিষয়বিভব বিস্তর, বংশও বড়, পুত্র-সন্তান না থাকাটা ক্ষোভের বিষয় বটে। প্রথমা স্ত্রীর সন্তান হবার সময় অতীত হয়ে গেলে দ্বিতীয় স্ত্রীর পাণিগ্রহণ করা শাস্ত্রের অভিপ্রেত।”
এই কথার পর বড়বাবুকে ডেকে নিয়ে, মোহনলালবাবু পাশের একটী ঘরে প্রবেশ কোল্লেন, আমি জড়সড় হয়ে পূৰ্ব্বস্থানেই বোসে থাকলেম। বোধ হয়, তাঁদের কি গোপনীয়কথা ছিল, নির্জ্জনে সেই সকল কথা বলাকওয়া হয়ে গেল, বড়বাবু বৈঠকখানায় ফিরে এলেন, মোহনবাবু আর সেদিকে এলেন না, অন্যদিকের বারান্দা পার হয়ে, উপর থেকে নেমে গেলেন; দরজায় গাড়ী ছিল, চক্রঘর্ষণের শব্দে বুঝতে পাল্লেম, তিনি চোলে গেলেন। যখন এসেছিলেন, তখন আমরা নানাকথায় অন্যমনস্ক ছিলেম, গাড়ীর শব্দ শুনতে পাই নাই।
কবিরা আর দার্শনিক পণ্ডিতেরা রজনীকে গর্ভবতী বলেন। রজনীর গর্ভে কি কি নিহিত থাকে, প্রভাতে কি কি প্রসূত হয়, পূর্ব্বে তাহা কিছুই অনুমানে আনা যায় না। শুভ অশুভ, দুই পক্ষেই একধারা। যে রজনীতে মোহনবাবুর মুখের ঝড়ে আমি উড়ে যাচ্ছিলেম, সেই রজনীপ্রভাতে এক নির্ঘাত সমাচার আমাদের কর্ণে প্রবিষ্ট হলো। মোহনবাবুর পরিবারটী রাত্রি আড়াই প্রহরের সময় ইহ-সংসার পরিত্যাগ কোরে গিয়েছেন। চিকিৎসকের একটী কথা সত্য, একটী কথা মিথ্যা। “ভয় নেই” কথাটী সত্য হলো না, সত্য হলো জ্বরত্যাগ। সেই জ্বরত্যাগের সঙ্গে সঙ্গেই প্রাণত্যাগ!
বাবু মোহনলালের প্রাণে অবশ্য আঘাত লেগেছিল, যাঁদের সঙ্গে মোহনলালের জানাশুনা, এই অশুভ সংবাদে তাঁরাও অবশ্য শোকাকুল হয়েছিলেন, কিন্তু আমার প্রাণে সেই ভীষণ শোকবজ্র যতটা বাজলো, তাঁদের মধ্যে কারো হৃদয়ে বোধ হয়, ততটা বাজলো না। বীরভূমের অমরকুমারীর সঙ্গে দু-দিন আলাপ কোরে আমি সুখী হয়েছিলম, অমরকুমারী আমারে ভালবেসেছিলেন, সেই জন্যই কি সৰ্ব্বাপেক্ষা আমার হৃদয়ে বেশী শোক?—না, সে জন্য নয়। রক্তদন্ত আমারে প্রাণে মারবার জন্য গুণ্ডা যোগাড় কোরেছিল, দয়াবতী অমরকুমারী সেই সন্ধান জানতে পেরে, মেয়েমানুষ সাজিয়ে, আমারে গোপনে বাড়ী থেকে বাহির কোরে দিয়েছিলেন, নারীবেশেই আমি পলায়ন কোরেছিলেম, পলায়নেই পরিত্রাণ পেয়েছিলেম, আপন প্রাণকে সঙ্কটাপন্ন কোরে স্নেহময়ী অমরকুমারী আমার প্রাণরক্ষা কোরেছিলেন, সেই অমরকুমারী এখন আর পৃথিবীতে নাই! এই কারণেই আমার বেশী শোক। আর একটা প্রাণে আমার অপেক্ষাও বেশী শোক। সেই শোকাতুরা দুঃখিনী অমরকুমারীর অভাগিনী জননী! নিদারুণ রোগযন্ত্রণায় কাতরা, দুরন্ত রক্তদন্তের নিষ্ঠর পীড়নে প্রপীড়িতা সেই অভাগিনী যখন দূরদেশে এই নিদারুণ সংবাদ শ্রবণ কোরবেন, তখন তাঁর যন্ত্রণাদগ্ধ ক্ষীণদেহে জীবনবায়ু আর অধিকক্ষণ প্রবাহিত হবে, কিছুতেই তো আমার এমন বিশ্বাস হয় না। অমরকুমারী নাই! এ শোক আমার অসহ্য। একটী প্রবোধ, অমরকুমারীর কাশীপ্রাপ্তি; অল্পদিনে মায়াসংসার পরিত্যাগ কোরে, মায়াময় ক্ষুদ্রকলেবর পরিত্যাগ কোরে, মায়াময়ী অমরকুমারী অমরবাঞ্ছিত শিবপ্রাপ্ত হোলেন!
সংসারে শোকের বেগ দিন দিন কমে, দিন দিন পুরাতন হয়, বাবু মোহনলাল এক সপ্তাহের মধ্যেই অমরকুমারীকে ভুলে গেলেন। লোকের মুখে শুনলেম, কাশীর বাইজীমহলের একটী সুন্দরী নর্ত্তকীকে সঙ্গিনী কোরে মনের আনন্দে তিনি কাশীধাম পরিত্যাগ কোরে গিয়েছেন। সে সংবাদে আমার আনন্দ হলো। সত্যঘটনা জেনে, সত্যকথা বোলে, অকারণে আমি তাঁর বিষনয়নে পোড়েছি, কাশীতে তিনি থাকলে সৰ্ব্বদা আমার প্রাণে ভয় থাকতো, সে ভয়টা কিছু দিনের জন্য দূর হয়ে গেল। সে অংশে মনে আমি একটু শান্তি পেলেম, কিন্তু অমরকুমারীকে ভুলতে পাল্লেম না।
এই ঘটনার পর একমাস অতীত। আমি চাকরী করি, নূতন নূতন বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে আলাপ করি, একরকমে দিন কেটে যায়। একরাত্রে এক বন্ধুর বাড়ীতে বাইনাচ। বন্ধু আমারে নিমন্ত্রণ কোরেছিলেন। বড়বাবুর অনুমতি নিয়ে আমি নাচ দেখতে গিয়েছিলেম। বড়বাবু যান নাই। নাচের মজলীসে বেশী লোক ছিল না, যাঁর বাড়ীতে নাচ, তাঁর নিজের বিশেষ পরিচিত বিশ-পঁচিশটী বন্ধু নিয়েই মজলীস। বাবুটীর বাড়ী কলিকাতায়। সাত আট মাস পূর্ব্বে তিনি কাশীতে এসেছেন, পরিবার সঙ্গে নাই, টাকা আছে, বাইমহলে কিছু বেশী প্রতিপত্তি। একঘণ্টা মাত্র নাচ, রাত্রি দশটার মধ্যেই মজলীসভঙ্গ। বাবুর নাম নীরেন্দ্রবাবু, জাতিতে সদ্গোপ, বয়স অল্প, চেহারা ভাল। যে ঘরে তিনি বসেন, সেই ঘরে আমারে নিয়ে গেলেন, আর তিনটী বন্ধু সেইখানে ছিলেন, তাঁদের সঙ্গেও আমার আলাপ হলো। নূতন আলাপ। নীরেন্দ্রবাবু তাঁদের সঙ্গে আমার পরিচয় কোরে দিলেন। সেই তিনটী নূতন বন্ধুর মধ্যে একটী দিব্য সুশ্রী, ফুট গৌরবর্ণ, গঠন মাঝারি, বক্ষঃস্থল পূরন্ত, হস্তপদ মোলায়েম, গলাটী কিছু খাটো, চিবুক একটু সরু, কপাল চওড়া, চিবুকের আর কপালের পরিমাণে মুখখানি যেন ত্রিকোণ দেখায়; চক্ষু দুটী বড় বড়, নাসিকা দীর্ঘ, দিব্য গোঁফ; বয়স অনুমান ২৫/২৬ বৎসর।
বাবুটীর সঙ্গে আলাপ কোরে আমি নিতান্ত অসুখী হোলেম না, কিন্তু তাঁর চাউনির ভঙ্গীতে কেমন এক প্রকার বিরুপ লক্ষণ অনুভূত হলো। কথা কন, হাসেন, সকল কথায় তর্ক ধরেন, মাঝে মাঝে স্ত্রীলোকের কটাক্ষের ন্যায় ইতস্ততঃ দৃষ্টিনিক্ষেপ করেন। ক্ষুদ্র মজলীসে রসিকতাও বেশ চোল্লো। ঐ বাবুটীর সঙ্গে আমার ভাসা ভাসা আলাপ হলো বটে, কিন্তু তাঁর নামটী আমি জানতে পাল্লেম না।
জলযোগের আোজন হলো। ঘরে আমরা পাঁচজন। চারিজনে আঁখিঠারাঠারি, আমার দিকে ইঙ্গিত। চারিজনে একবার উচ্চ হাস্য কোরে উঠলেন; আমি হাসলেম না। হাস্যের কোন কারণ উপস্থিত ছিল না, হাসি এলো না। চারিজনে একসঙ্গে সেখান থেকে একবার উঠে গেলেন, আমি একাকী বোসে রইলেম; একটু পরেই তাঁরা ফিরে এলেন; চারিজনেরই মুখ-চক্ষু লাল। তাঁরা যখন আমার কাছে এসে বোসলেন, তখন আমি কেমন এক প্রকার তীব্র গন্ধ অনুভব কোল্লেম। কারণ অনুমান কোত্তে অক্ষম হোলেম না, কিন্তু যেন কিছুই জানলেম না, কিছুই বুঝলেম না, এই ভাবে চুপ কোরে থাকলেম। যে বাবুটীকে আমি সৰ্ব্বাপেক্ষা সুশ্রী দেখেছিলেম, যে বাবুটীর চাউনি বাঁকা বাঁকা, সেই বাবুটী আমারে নিতান্ত পাড়াগেয়ে স্থির কোরে, ঠেস দিয়ে দিয়ে বিদ্রূপ আরম্ভ কোল্লেন, পরস্পর নানা প্রকার ঠাট্টা-তামাসা চোল্লো। আমি বুঝতে পাল্লেম, সেই বাবুটীই কিছু বেশী রসিক, মজলীসী ভাষায় ইয়ারলোক।
সেই বাবুটীকে লক্ষ্য কোরে নীরেন্দ্রবাবু আমারে বোল্লেন, “দেখ হরিদাস, আমাদের এই বন্ধুটী দিব্য সদ্বক্তা; কথায় কথায় সকলকে হাসান, মাতান, আমোদিত করেন। বেশ আমদে লোক। কলিকাতার ছেলে কি না, এই রকম হওয়াই চাই; বাবুটীর সঙ্গে তুমি আলাপ রেখো, মাঝে মাঝে দেখা কোরো, কথা শুনে সুখী হবে; দিনকতক ঘনিষ্ঠতা হোলে তুমিও বেশ চালাক-চতুর হয়ে উঠবে। বাবুটীর নাম তুমি মনে কোরে রেখো; ইনি হোচ্ছেন, জয়হরি; বাবু সৰ্ব্বত্রই জয় জয়কার!”
আমার মনটা ঝাঁৎ কোরে উঠলো। মনের সন্দেহ গোপন কোরে রেখে অম্লানমুখে আমি বোল্লেম, “কথাবার্ত্তা শুনে আমিও সন্তুষ্ট হয়েছি, বাবুটী চমৎকার লোক। আলাপ কোরে আমি তুষ্ট হোলেম; বাবুর উপাধিটী কি?”
যিনি পরিচয় দিয়ে দিচ্ছেলেন, তিনি বোল্লেন, “উপাধি বটব্যাল;— শ্রোত্রিয় ব্রাহ্মণ; জাত্যংশে শ্রেষ্ঠ না হোলে কি স্বভাবচরিত্র এত ভাল হয়?”
আর আমি অন্য পরিচয় জিজ্ঞাসা কোল্লেম না, মনে মনে ভাবলেম, কথাই ত বটে! জাত্যংশে শ্রেষ্ঠ না হোলে এমন ঘটনা কেন হবে? ধোরেছি ঠিক, বটব্যালেরা চলিত কথায় বড়াল; এই সেই জোড়াসাঁকোর জয়হরি বড়াল। কামিনীর মা এখানে থাকলে ঠিক সনাক্ত কোরে দিতে পাত্তো, তদ্ভাবে আমার মন এখন নামের উপর সনাক্ত কোল্লে। সময় উপস্থিত হোলে ফলাফল জানা হবে।
জলযোগের আয়োজন হয়েছিল, বাবুদের মদ খাবার হুজগে দেরী পোড়ে গিয়েছিল, সকলে এই সময় পাশের ঘর থেকে ফিরে এসে লুচি-মাংস ইত্যাদি চৰ্ব্বচোষ্য ভক্ষণ কোল্লেন, আমি কেবল অক্ষুধার ছল কোরে দুটী সন্দেশ খেয়ে জল খেলেম। রাত্রি দুই প্রহর অতীত। একজন লোক সঙ্গে দিয়ে নীরেন্দ্রবাবু আমারে বাড়ীতে পাঠিয়ে দিলেন। বাড়ীর সম্মুখে গিয়েই দেখি, সদরদরজা খোলা, বাড়ীর ভিতর ভারী গোলমাল, সকলেই জেগে আছে, বড়বাবুও জেগে আছেন, চাকরেরা ছুটাছুটি কোরে বেড়াচ্ছে। ব্যাপার কি, তত রাত্রি পর্য্যন্ত কেনই বা দরজা খোলা, কেনই বা গোলমাল, প্রথমে কিছুই বুঝতে পাল্লেম না; তার পর শুনলেম, বাবুর পিসীমার ছোট-মেয়েটী সন্ধ্যার পর থেকে অদৃশ্য। কে একজন লোক বাবুর পিসীমার ডান-হাতের পাঁচটী আঙ্গুল কেটে দিয়ে, মেজো-বৌমার গায়ের অলঙ্কারগুলি খুলে নিয়ে, তাঁর গলাতেও রক্তপাত কোরে পালিয়ে গিয়েছে; সেই ঘটনার পর থেকেই নবীনকালীকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বাবুর পিসীমার ছোটমেয়েটীর নাম নবীনকালী। অনুসন্ধানের জন্য চারিদিকে লোক বেরিয়েছে, কেহই কোন সন্ধান কোত্তে পাচ্ছে না।
বাড়ীতে চোর এসেছিল, গহনা চুরি কোরেছে, দুটী স্ত্রীলোককে আঘাত কোরেছে, কেহ কেহ এইরূপ অনুমান কোচ্ছে; সে অনুমান যদি ঠিক হয়, মেয়েটী তবে কোথায় গেল? কাশীর চোরেরা কি গৃহস্থলোকের বাড়ীর মেয়েছেলে চুরি করে?
রাত্রের মধ্যে কিছুই সন্ধান পাওয়া গেল না, বাবুর পিসীমা সারারাত্রি রোদন কোল্লেন; মেজো-বৌমা কাঁদতে কাঁদতে কত রকম কথা বল্লেন, বৃথা কথা, বৃথা রোদন, নবীনকালী ফিরে এলো না। নবীনকালী বিধবা, নবীনকালী যুবতী, রাত্রিকালে নবীনকালীর পলায়ন, কলঙ্কের কথা, সেইজন্য বড়বাবু চেপে গেলেন, কেহ কিছু প্রকাশ না করে, ভয় দেখিয়ে সাবধান কোরে সকলকে নিষেধ কোরে দিলেন।
আবার একটা রবিবার এলো। আমার মনের ভিতর জয়হরি বড়াল ক্রীড়া কোচ্ছিল; স্বর্ণবণিক জয়হরি বড়াল কাশীতে ব্রাহ্মণ সেজে আছে, সে কথাটাও স্থির বুঝেছিলেম। নানা সন্দেহে ব্যাকুলিত হয়ে অপরাহ্ণকালে আমি একবার ছাদে উঠলেম। সে দিনও সেই সুন্দরী যুবতী সেই রুমাল হাতে কোরে ছাদে ছাদে চরণবিহার কোচ্ছিল। সেদিন আর সে মূৰ্ত্তি আমার পক্ষে নূতন নয়, পরিচয়েও অচেনা নয়, সেই সৌদামিনী। চক্ষে চক্ষে যখন মিলন হলো, তখনো চক্ষু ফিরিয়ে নিলে না, একটু লজ্জার লক্ষণও বুঝা গেল না, বরং নিনিমেষে একদৃষ্টে আমার মুখপানে চেয়ে রইলো, ওষ্ঠপ্রান্তে অল্প অল্প হাস্যরেখাও দেখা দিলে। আমি চক্ষু ফিরিয়ে নিলেম।
স্ত্রীলোকের লজ্জা হলো না, আমি লজ্জা পেলেম; অন্যদিকে চাইতে চাইতে শীঘ্র শীঘ্র নেমে এলেম। জয়হরিকে বিচারের হস্তে সমর্পণ করা আমার ইচ্ছা। শুনেছিলেম, রমাই সন্ন্যাসীর হত্যাকাণ্ডের তদন্তাবসানে এক ইস্তাহার প্রকাশ হয়েছিল, সেই খুন সম্বন্ধে যে কেহ কোন সংবাদ দিতে পারবে, যাতে যাতে খুনী আসামীর সন্ধান হয়, উপযুক্ত পুলিশ-কর্ম্মচারীর নিকটে তেমন সংবাদ জানাতে পারবে কিম্বা সন্তোষকর প্রমাণ সহ খুনী আসামীকে ধোরিয়ে দিতে পারবে, হুজুর হোতে তাকে একহাজার টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে, সেই ইস্তাহারের এইরুপ মৰ্ম্ম।
যতদূর আমার জানা-শুনা হলো, তাতে কোরে আমি সন্ধানটা বোলে দিতে পারি, কিন্তু সন্তোষকর প্রমাণ দুষ্প্রাপ্য। কোন গতিকে সৌদামিনীকে যদি বশীভূত কোত্তে পারা যায়, তা হোলে বোধ হয়, একরকম কিনারা হোতে পারে; কিন্তু সৌদামিনীকে বশীভূত করবার উপায় কি? নিমন্ত্রণ কোরে বাড়ীতে আনা, সেটা ঠিক উপায় নয়; বিশেষতঃ নবীনকালীর নিরুদ্দেশে বাড়ীর সকলে মহা উদ্বিগ্ন, এ সময় একটা দুশ্চরিত্রা কামিনীকে বাড়ীতে আনবার অনুরোধ করা কোনমতেই হোতে পারে না। কি করা যায়? একটা দুরাচার খুনেলোক বিনা দণ্ডে অব্যাহতি পায়, জেনে শুনে চুপ কোরে থাকাও ভাল হয় না। দুষ্টলোকে খোলসা থাকলে তার দ্বারা আরো অনেক লোকের প্রাণ-মান সঙ্কটাপন্ন হবার সম্ভাবনা, বোরিয়ে দেওয়াই উচিত; কি উপায়ে ধরা হয়, নিত্য নিত্য সেইপ্রকারের উপায়ই আমি চিন্তা কোতে লাগলেম।
কোথাকার পাপ কোথায়? সংসারে নিঃসম্পর্ক সামান্য একজন বালক আমি, আমার চক্ষেই বা সে সকল পাপ কেন পতিত হয়? বীরভূমের পাপ রক্তদন্ত, সে পাপ গেল কলিকাতায়; কলিকাতা থেকে আমি পালিয়ে এলেম, সে পাপ এলো কাশীতে! আমার সম্বন্ধে মোহনলালবাবুও এক পাপ; অমরকুমারীকে বিসর্জ্জন দিবার জন্য সে পাপ এসেছিল কাশীতে! কলিকাতার পাপ সৌদামিনী, খুনে-পাপী জয়হরি বড়াল, আমার অশান্ত চিত্তকে আরো অশান্ত করবার জন্য সে পাপ এলো কাশীতে! কাশীধাম কি ইদানী নানা পাপের আশ্রয়খান হয়ে পোড়েছে? লোকের মুখে যে রকম শুনতে পাওয়া যায়, সে প্রমাণে ঐরুপ কলঙ্কই যেন সত্য বোধ হয়। বাঙ্গালীদলের বেশী কলঙ্ক। জাতিতে জাতিতে, জাতিতে বিজাতিতে, সম্পর্কে সম্পর্কে, সম্পর্কে নিঃসম্পর্কে, বাঙ্গালী নর-নারী পাপলিপ্ত হোলেই নিরাপদের আশাতে কাশীতে পালিয়ে আসে; মাতুলের ঔরসে ভগিনী-পুত্রী, পিতৃব্যের ঔরসে ভ্রাতৃকুমারী, ভ্রাতার ঔরসে বিমাতৃকুমারী, ভাগিনেয়ের ঔরসে মাতুলানী, জামাতার ঔরসে শ্বশ্রুঠাকরাণী, শ্বশরের ঔরসে যুবতী পুত্রবধু গর্ভবতী হলেই কাশীধামে পালিয়ে আসে! গর্ভগুলি নষ্ট কোত্তে হয় না, কাশীর পবনের প্রসাদে বংশরক্ষা হয়! কেহ কেহ জোড়া জোড়া আছে, কেহ কেহ ছাড়া ছাড়া! সামান্য একটা প্রবাদ আছে, কাশীপুরী পৃথিবী-ছাড়া; মহাদেবের ত্ৰিশূলের উপর কাশী। পৃথিবীর পাপ কাশী স্পর্শ করে না। এই প্রবাদে যাদের বিশ্বাস, পৃথিবীর সেই সকল পাপী কাশীধামে পালিয়ে এসে মনের সাধে নূতন নূতন পাপ করে। শাস্ত্রকথা তারা মনের কোণেও স্থান দেয় না। বেদব্যাসের শাপ আছে, অন্যস্থানে যে সকল পাপ অনুষ্ঠিত হয়, কাশীবাসী হোলে সে সকল পাপ ধংস হয়ে যায়। কিন্তু কাশীতে যারা পাপ করে, তাদের পাপ অবিনাশী; মহাপ্রলয়কাল পর্য্যন্ত সে পাপের ক্ষয় হয় না; কাশীর পাপে অনন্তকাল নরকভোগ! ঋষিবাক্যানুসারে জ্ঞানের পাপ আর তীর্থের পাপ অক্ষয় হয়ে থাকে; তীর্থের পাপীরা এই সকল শাস্ত্রবাক্যে আদৌ ভ্রূক্ষেপ রাখে না, সাধুবাক্যে বধির হয়ে নিরন্তর নূতনপাপে রত হয়! অনেক দেখে শুনে এই কারণেই আমি বোলছি, কোথাকার পাপ কোথায়!
আবার রবিবার। অপরাহ্নে যজ্ঞেশ্বরকে নির্জ্জনে পেয়ে আমি জিজ্ঞাসা কোল্লেম, “বাড়ীর ভিতর সে সব কাণ্ডকারখানা কি? গহনা চুরি, আঙ্গুল কাটা, মেজোবৌমার গলায় অস্ত্রাঘাত, নবীনকালীর পলায়ন, ব্যাপারখানা কি?”
যজ্ঞেশ্বর উত্তর কোল্লে, “ব্যাপার আমার মাথা আর মণ্ডু! আর একদণ্ডও এ বাড়ীতে থাকতে আমার ইচ্ছে নেই। কেবল বড়বাবুটীর মুখ চেয়ে আছি, কিন্তু আর সহ্য হয় না! পূণ্যের সংসারে পাপ প্রবেশ কোরেচে, আর মঙ্গল নেই!”
ভাবার্থ কিছুই বুঝতে না পেরে আবার আমি জিজ্ঞাসা কোল্লেম, “চোর প্রবেশ কোরেছিল, দৌরাত্ম কোরে গিয়েছে, সংসারের অপরাধ কি?”
কপালে এক চাপড় মেরে যজ্ঞেশ্বর বোল্লে, “চোর এসেছিল না হাতী এসেছিল! ঘরের চোরেই সৰ্ব্বনাশ কোল্লে! সে সব কথা তোমার শুনে কাজ নেই! মেয়েটা যে কোথায় গেল, সেই কথাটাই বড় শক্ত!”
জানবার জন্য আমার আগ্রহ হয়েছিল, যজ্ঞেশ্বরের পরিতাপবাক্যে সেই আগ্রহের সঙ্গে সন্দেহ বেড়ে গেল; বিশেষ নিৰ্ব্বন্ধ জানিয়ে বার বার জিজ্ঞাসা কোতে লাগলেম। চক্ষে জল এনে যজ্ঞেশ্বর শেষকালে বল্লে, “পিসীমাকে কাটতে গিয়েছিল, তিনি হাত তুলে কাটারিখানা ধোত্তে গিয়েছিলেন, গলাটী বেঁচে গিয়েছে, প্রাণ বেঁচে গিয়েছে, আঙ্গুল পাঁচটী কেটে গিয়েছে মেজোবৌকে কাটতে গিয়েছিল, ধর্ম্মে ধর্ম্মে রক্ষা হয়েছে, গহনার উপর দিয়েই আপদ চুকেচে। সে সব যা হোক, ছুঁড়ীটা এ কি কোল্লে!”
আবার আমি জিজ্ঞাসা কোল্লেম, “লোকটা কে মেয়েদের উপর আক্রোশ কেন? কার উপর তুমি সন্দেহ কর?”
পুনরায় মস্তকে করাঘাত কোরে যজ্ঞেশ্বর উত্তর কোল্লে, “সন্দেহ আবার কিসের? লোকটা আবার কে? ঘরের শত্রুই ঘর মজালে! প্রকাশ কোরো না এ কথা, এ সংসারে ভদ্রস্থ নেই! পথৃক হবি পৃথক হ, এ সব কেলেঙ্কার করা কেন বাপু? দেশ ছেড়ে বিদেশে এসে এই সব ঢলাঢলি, একে কি আর জাত-কুল রক্ষা হবে? ঘরের ঢেঁকি কুমীর হয়েছে। প্রাণ পর্য্যন্ত টানাটানি!”
সাপে যেমন গর্জ্জন করে, সেই রকমে ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলতে ফেলতে যজ্ঞেশ্বর আমার কাছ থেকে উঠে গেল; ভিতরের কথা কিছুই ভাঙলে না। আভাষেই আমি বুঝলেম, মেজোবাবুরই ঐ কৰ্ম্ম! নবীনকালীর নিরুদ্দেশের মূলেও মেজোবাবু! বাপের সহোদরা ভগ্নীর কন্যা! কি ভয়ানক লোক।
মন বড় অস্থির হলো। রামশঙ্করের উপর বিজাতীয় ঘৃণা জন্মিল। আর আমার এ বাড়ীতে থাকা হয় না; কোন দিন কি ঘটে, কোন দিন আমারে কে কি বলে, আমার উপরে মেজোবাবুর রাগ, কোন দিন আমার নামেই বা কি কলঙ্ক রটায়, মানে মানে এই বেলা প্রস্থান করাই ভাল।
কাশীর নাম পূণ্যক্ষেত্র, কাশীক্ষেত্রে এত পাপ! বাবা বিশ্বেশ্বর এ পাপের ভার কেমন কোরে সহ্য করেন? অনেক বাড়ীতেই অনেক গোল! রসিকবাবুটীকে প্রথম প্রথম ভাল বোলে বোধ হয়েছিল, ক্রমে ক্রমে জানতে পাল্লেম, তিনিও কম পাত্র নন। তাঁর স্ত্রীটীকে আমি দেখেছি, রসিকের চেয়ে তিনি বয়সে বড় ভেবেছিলেম, মেয়েমানুষ বেশী মোটা হোলে অল্পবয়সেও বড় দেখায়, সেইজন্যই বুঝি ঐ রকম, তাই আমি ভেবেছিলেম, কিন্তু তা নয়, কাণাঘূষায় শুনেছি, সেই মোটা গৃহিণীটী রসিকবাবুর মাতুলানী! জননীর কনিষ্ঠ সহোদরের কুললক্ষ্মী! সে রকম রসিকবাবু কাশীধামে কত আছে, ঠিক করা যায় না। যার মুখে শুনেছিলেম, স্বদেশে যারা ছাগল ছিল, কাশীতে তারা বাবু সেই লোকের কথাই ঠিক। সবগুলি ছাগল না হোক অনেকগুলি তাই-ই বটে!
কিছুই ভাল লাগলো না; তখন বেলা ছিল, মনের চাঞ্চল্যে একবার ছাদে গিয়ে উঠলেম। বেড়াচ্ছি, যে বাড়ীর ছাদে সৌদামিনী বেড়ায়, এক একবার সেই দিকে চেয়ে চেয়ে দেখছি, কেহই নাই। অন্য অন্য ছাদেও দুটী পাঁচটী রঙ্গিনী হাওয়া খাচ্ছিলো, দুবার আমি তাদের দিকে চাইলেম না, একবার চেয়েই অন্যদিকে মুখ ফিরালেম। আর একবার উত্তরদিকে চেয়ে দেখি, সেই ছাদে সৌদামিনী। সে দিন সৌদামিনীর হাতে রুমাল ছিল না, রুমালের বদলে মস্ত একটা ফুলের তোড়া। আমি বেড়াচ্ছি, মাথা হেঁট কোরেই বেড়াচ্ছি, হঠাৎ আমার মাথার উপর কি একটা জিনিস এসে উড়ে পোড়লো, মাথায় ঠেঁকেই আমার পশ্চাদ্ভাগে পায়ের কাছে পোড়ে গেল, চেয়ে দেখি ফুলের তোড়া! সৌদামিনীর হাতে যে তোড়াটা ছিল, সেই তোড়ই আমার পদতলে!
একবার মনে কোল্লেম, ছোঁবো না; আবার ভাবলেম, ফুলের তোড়ার কি দোষ? কটাক্ষে একবার সৌদামিনীর দিকে চাইলেম। সৌদামিনী তখন স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আমাদের ছাদের দিকে চেয়ে মৃদু মৃদু হাসছিল। ভাবভঙ্গী ভাল নয়, আর তখন ছাদে থাকা ভাল নয়, তাই ভেবে, ফুলের তোড়াটী হাতে কোরে নিয়ে, দ্রুতগতিতে ছাদ থেকে আমি নেমে এলেম। অন্তঃকরণ অস্থির হলো।
বৈঠকখানা নির্জ্জন, একধারে বোসে তোড়াটী আমি ভাল কোরে দেখতে লাগলেম। তিন বর্ণের ফুল; শ্বেতবর্ণ, পীতবর্ণ, রক্তবর্ণ; ফুলগুলির নীচে নীচে সবুজবর্ণের ছোট ছোট পাতা। ফুলগলি সুগন্ধ; স্তবকে স্তবকে সজ্জাও সুন্দর। নাসিকাগ্রে ধীরে ধীরে সঞ্চালন কোরে কোরে ফুলগুলির সুগন্ধ আমি আঘ্রাণ কোচ্ছি, ফুলের ভিতর থেকে একখানি কাগজ বিছানার উপর সোরে পেড়িলো; কাগজখানা মণ্ডলাকারে মোড়ককরা।
অন্তরে কৌতূহল প্রদীপ্ত হয়ে উঠলো। মোড়কটী আমি খুল্লেম; দেখলেম, মণ্ডলাকারে লেখা একখানি পত্রিকা; অক্ষরগুলি গোলাপী;—আলতার জলে সুচিত্রিত। স্বাক্ষর ছিল না;—বেনামী পত্রিকা।
অনিচ্ছায় সেই পত্রিকাখানি আমি পাঠ কোল্লেম। সম্বোধন নাই। কে কারে লিখছে, দুই-ই অপ্রকাশ। প্রথমেই লেখা আছে, “তুমি কে?”—তার পর লেখা আছে, “তোমারে আমি তিরস্কার করিতে পারি।” তিরস্কার করিতে পারে, এমন কথা যে লেখে, যাকেই লিখুক, যেই লিখুক, যে পত্রিকার আরম্ভে তিরস্কার, সে পত্রিকা কোন প্রকার মন্দ অভিপ্রায়ে লিখিত নয়, সে লেখক অথবা লেখিকা মন্দভাব মনে রাখে না, এইটকু আমার অনুমানে এলো; কেবল অনুমান নয়, সিদ্ধান্তও সেই রকম দাঁড়ালো। পত্রিকাখানি আমি আদ্যোপান্ত পাঠ কোল্লেম। লজ্জাকে অন্তরে রেখে আমি অনুরোধ করি, পাঠকমহাশয়ও পাঠ করুন।
“তুমি কে? তোমারে আমি তিরস্কার করিতে পারি। কেন তুমি আমারে দেখা দাও? আমার নয়নের পিপাসা পরিতৃপ্ত হইতে না হইতে কেন তুমি আমার নয়নপথ হইতে অন্তর হইয়া যাও? তোমার চক্ষু আমারে কেন দগ্ধ করে? আমি তোমার কাছে কি অপরাধ করিয়াছি? কেন আমারে যন্ত্রণা দাও? তুমি চোর! কেন তুমি আমার হৃদয়গৃহে সিঁধ কাটিয়া প্রাণ চুরি করিয়াছ? উত্তর দাও; নতুবা আমি তোমারে উচিতমত শাস্তি দিব।”
আমার হাত কেঁপে উঠলো; পত্ৰখানা আর আমি হাতে কোরে রাখতে পাল্লেম না বড়বাবুর বড় তাকিয়াটার উপরে ছুড়ে ফেলে দিলেম। আমারেই লিখেছে, সৌদামিনীই লিখেছে, তাতে আর সন্দেহ রাখতে পাল্লেম না। উত্তর চায়; উত্তর না দিলে শাস্তি দিবে, এই ভয় দেখিয়ে রেখেছে। কথা বড় ভয়ানক! করা যায় কি? স্বাক্ষর নাই কার নামে কার কাছে উত্তর পাঠাই? চিন্তা কোচ্ছি, কোথা থেকে বাতাসের সঙ্গে যেন একটা কণ্ঠস্বর এসে আমার কাণের কাছে উপদেশ দিলে, “উত্তর দাও, স্বাক্ষর চাও; সে স্বাক্ষর তোমার একটা বিশেষ অভীষ্ট সিদ্ধ হবে।”
উপস্থিত বুদ্ধির সহায়তায় সেই বাতাসবাণীর মর্ম্ম আমি তৎক্ষণাৎ বুঝতে পাল্লেম। স্বাক্ষর যদি আসে, সেই স্বাক্ষরের আখ্যা হবে একটী সুশাণিত বাণ। সেই বাণে জয়হরি পক্ষী বিদ্ধ হবে;—একবাণেই বিঁধে ফেলবো।
উত্তর দিব। কি উত্তর দিব? প্রেম-পত্রিকা। কখনো আমি প্রেম-পত্রিকা দেখি নাই; প্রেম-পত্রিকার কি রকম উত্তর দিতে হয়, তাও আমি শিখি নাই, তবু আমি উত্তর দিব। উত্তরে লিখবো কি?—কবি যেমন কল্পনার উপদেশে অনেক মিথ্যাকথাকে সত্য-সাজে সাজান, আমার কবিত্বশক্তি নাই, কল্পনা আমার কাছে আসবেন না, দয়া কোরে সদুপদেশ দিবেন না, তবু আমি অভীষ্টসিদ্ধির বাসনায় গুটীকতক মিথ্যাকথাকে সত্য-সাজে সাজাবো।
তখনো বেলা ছিল। বড়বাবু তখন আসবেন না, কুৎসিত কাব্যরচনায় আমার তখন বাধা হবে না, সেই ভরসায় তৎক্ষণাৎ কাগজ-কলম নিয়ে আমি বোসলেম। আলতার উত্তরে আলতা হোলেই হোতো ভাল, কিন্তু আলতা তখন দুর্লভ, সুতরাং কালীই আমার অবলম্বন; কালী দিয়েই আলতার উত্তর দিব। যা করেন মা কালী।
সুশিক্ষা নাই, কল্পনা নাই, প্ৰেমশাস্ত্রে পাণ্ডিত্য নাই, সাদাকথায় উত্তর লিখলেম। দোষাংশ বিস্মৃত হয়ে, মিথ্যারচনার অপরাধ মার্জ্জনা কোরে, পাঠকমহাশয় আমার এই পত্রিকাখানিও একবার পাঠ করুন।
‘আকাশের দেবতা অকস্মাৎ আমার হস্তে একটী ফলের তোড়া প্রদান করিয়াছেন। ফুলের তোড়া আমার হস্তে একখানি প্রেম-পত্রিকা অৰ্পণ করিল। পত্রিকা পাঠ করিতে করিতে আমার সৰ্ব্বশরীর শিহরিল, প্রেম-পুলকে ক্ষুদ্রকলেবর রোমাঞ্চিত হইল, আজ আমি অকস্মাৎ প্রেমানন্দ-সাগরে ভাসিলাম। তুমি আমারে তিরস্কার করিয়াছ, সে তিরস্কার আমার ভাগ্যে পুরস্কার। তোমারে আমি দর্শন করি, জ্ঞান হয়, যেন নয়নপটে পূর্ণচন্দ্র। চন্দ্র যখন অদৃশ্য হন, আমার নয়নপথে তখন মেঘোদয় হয়; সেই মেঘে আমি দেখিতে পাই, একটী সৌদামিনী।—হাঁ, সৌদামিনী! তুমিই কি সেই সৌদামিনী? তাহা যদি হও, তবে তো তোমার মিথ্যা তিরস্কার। তোমার প্রাণ আমি চুরি করি নাই। চাঁদের প্রাণ চুরি করা যায় না, সৌদামিনীর প্রাণও চুরি করা যায়। সৌদামিনী। আমার নাম তুমি জান না, আমার নাম হরিদাস; হরিযুক্ত আর একটী নাম তোমার প্রিয়; সৰ্ব্বদা সেই হরির জয় তুমি গাও। সন্ন্যাসীরা সেই জয়কে পরাজয় করিতে পারেন না। জয়কে যদি তুমি বিসৰ্জ্জন করিতে পার, পূর্ণাক্ষরে তোমার নিজের স্বাক্ষর করিয়া, জয়-পরাজয়ের সকল কথা যদি তুমি আমারে লিখিয়া জানাইতে পার, তাহা হইলে বিশ্বেশ্বর তোমার মনের অভিলাষ পূর্ণ করিবেন। দোহাই বিশ্বেশ্বর, সত্যকথা একটীও গোপন করিও না, গোপন করিলে গোপন থাকিবে না; বিশ্বের অন্তর্যামী, সমস্ত তিনি জানিতে পারিতেছেন। কোন কথা যদি তুমি গোপন কর, তাহা হইলে ফুলের তোড়ার সেই পত্রখানি আমি তোমার বর্ত্তমান বণিক-স্বামীকে দেখাইব, বিশ্বেশ্বরের সন্ন্যাসিগণের হস্ত হইতে কোন ক্রমেই পরিত্রাণ পাইতে পারিবে না। সাবধান! এই পত্রের উত্তর লেখা হইলে এই পত্রখানি ভস্ম করিয়া ফেলিও। অদ্য অধিক লিখিলাম না, তোমার উত্তর প্রাপ্ত হইলে মনের কথা জানাই।” পত্রখানি আমি দুই তিনবার পাঠ কোল্লেম, মনে মনে হাসলেম, ‘মনস্কামনা পণ কর’ বোলে বিশ্বেশ্বরের উদ্দেশে প্রণিপাত কোল্লেম। পত্রিকা তো প্রস্তুত হলো, পাঠাই কিরূপে? এখনো যদি সৌদামিনী সেইখানে থাকে, নিজেই দৌত্য নির্ব্বাহ কোরবো, এইরুপ স্থির কোরে, পত্রখানি সেই ফুলের তোড়ার মধ্যে রেখে, তোড়াটী হাতে কোরে নিয়ে, সুর্য্যাস্তের পূর্ব্বেই আবার আমি ছাদে উঠলেম।
সবাই জানে, সৌদামিনী চপলা, সৌদামিনী ক্ষণপ্রভা, সৌদামিনী অস্থিরা, কিন্তু আমি দেখলেম, সুস্থিরা সৌদামিনী। যেখানকার সৌদামিনী, চিত্রপ্রতিমার ন্যায় ঠিক সেইখানেই দাঁড়িয়ে আছে। মুখের দিকে না চেয়েই, ফুলের তোড়াটা সৌদামিনীর মস্তক লক্ষ্য কোরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে, সৌদামিনীগতিতে আমি ছুটে পালালেম, বৈঠকখানার দরজায় এসে নিশ্বাস ফেল্লেম।
পূর্ব্বে একটী কথা বোলতে ভুল হয়েছে। মির্জাপুরের যে বাবুটীর সঙ্গে আমি বিন্ধ্যাচল দর্শনে গিয়েছিলেম, বড়বাবুর দ্বারা অনুরোধ কোরিয়ে প্রাচীন কামিনীর মাকে আমি সেই বাবুর বাড়ীতে রাখিয়ে দিয়েছি, তার জায়গায় সৌদামিনী আর একজন নূতন দাই1 নিযুক্ত কোরেছে। জয়হরির সঙ্গে সৌদামিনীর এখন কি প্রকার ভাব, সেটা আমি জানতে পারি না, কুলকলঙ্কিনীদের ভাবভক্তি জানবারও কোন আবশ্যক ছিল না, বিধাতার বিধানসূত্রে, পাপীলোকের দণ্ডবিধানের কল্পনায় অগত্যা আমি আজকাল সেই আবশ্যকতা অনুভব কোচ্ছি। প্রতীক্ষা—পরিণাম।
নূতন দাই আমার কাছে অপরিচিতা, চেহারা পর্য্যন্ত অচেনা, তার দ্বারা কোন প্রকার সন্ধান পাওয়া অসম্ভব। জয়হরিকে আমি দেখেছি; যে বাড়ীতে সৌদামিনী সে বাড়ীতে দেখি নাই, যে বাড়ীতে দেখা, পাঠকমহাশয় ইতিপূর্ব্বে সেটী জানতে পেরেছেন। জয়হরিকে এখন আমার প্রয়োজনও হোচ্ছে না; জয়হরির সঙ্গে সৌদামিনীর পূর্ব্বসম্বন্ধ ঠিক আছে কি না, সেইটকু জানাই এখন আমার দরকার। সৌদামিনীর পত্রের উত্তর দিয়েছি, তদুত্তরে নূতনকথা কি কি জানতে পারি, সে উত্তরে জয়হরির নামের কোন উল্লেখ থাকে কি না, সে উল্লেখে জ্ঞাতব্য তত্ত্ব আমি কিছু বুঝতে পারি কি না, এইবার জানা যাবে। সৌদামিনী আমার পত্রের উত্তর দিবে কি না, সেটাও একটা সংশয়ের কথা। প্রথমপত্রের আভাষ যে প্রকার, তাতে বোধ হয়, নিশ্চয়ই উত্তর পাওয়া যাবে। উদ্বিগ্নচিত্তে আমি সেই উত্তরের প্রতীক্ষায় থাকলেম।
কাশীর বাসীন্দা কত, উপনিবেশী কত, সাময়িক যাত্রীসংখ্যাই বা কত, সেগুলি নিরুপণ করা আমার মত বালকের অসাধ্য। অনেক দেশের লোক কাশীতে আসে, কাশীতে থাকে, কাশীতে আছে, এ কথা আমি শুনেছি, রকম রকম লোক স্বচক্ষেও আমি দেখেছি, দর্শনে মনে হয়, খোট্টাই বেশী; কিন্তু বাঙ্গালীর সংখ্যা যে নিতান্তই অল্প, এমনটী মনে করা যায় না; দিন দিন আরো বাঙ্গালীর সংখ্যা বৃদ্ধি হয়ে আসছে; সংখ্যায় অধিক না হোলে বাঙ্গালীটোলা নামে স্বতন্ত্র একটা স্থান থাকতো না। হায় হায়! আমি বাঙ্গালী, কাশীধামের আমদানী বাঙ্গালীপরিবারের কলঙ্কের কথা শুনে আমার প্রাণে বেদনা হয়। কাশীতে যাঁরা ভাল আছেন, বিশ্বেশ্বরের কৃপায় তাঁরা সুখে থাকুন, যারা যারা ভ্রষ্টাচার হয়ে পড়েছে অথবা স্বদেশে ভ্রষ্টাচার হয়ে বিশ্বেশ্বরধামে আশ্রয় নিয়েছে, তাদের ভাগ্যে যে কি আছে, তাদের দশা যে কি হবে, সেই ভাবনা আমার মনে নিরন্তর।
রবিবার না হলে ছাদে উঠতে আমার ইচ্ছা হয় না, অবসর হয় না, ভরসাও হয় না। সৌদামিনীর পত্রের উত্তর প্রদান কোরে সাতদিন আমারে চিন্তাযুক্ত থাকতে হলো। এই সাতদিনের মধ্যে আরো কত কি নূতন নূতন কাণ্ড আমি দেখলেম, কত কি শুনলেম, সংস্রবশূন্য বিবেচনায় সে সকল কথা প্রকাশ করা নিষ্প্রয়োজন মনে কোল্লেম। মোহনলালবাবু কাশী থেকে চোলে গিয়েছেন, এই কথাই আমি জানতেম, কিন্তু এই সাতদিনের মধ্যে একদিন তাঁরে আমি মণিকর্ণিকার ঘাটের কাছে দেখেছি। ভ্রূপর্য্যন্ত পাগড়ীবাঁধা জমাট কৃষ্ণবর্ণ গুণ্ডাধরণের একটা লোকের সঙ্গে গঙ্গাতীরে তিনি বেড়াচ্ছিলেন; দেখে আমার ভয় হয়েছে। কেবল তাঁরে দেখে ভয় নয়, ভয়ের কারণ আরো আছে। তিনি যখন কাশীতে আছেন, তখন বোধ হয়, রক্তদন্তটাও কাশীছাড়া হয় নাই। চিঠিখানা ভস্ম হয়ে গিয়েছে, মোহনবাবু আমার উপর জাতক্রোধ হয়েছেন, মোহনবাবুর বেতনভোগী গণ্ডা সেই রক্তদন্ত; যদিও ইতিমধ্যে রক্তদন্তকে আর আমি দেখি নাই, কিন্তু হয় তো রক্তদন্ত কাশীতেই আছে; আমারে দেখতে পেলে সে আর আমার প্রতি দয়া প্রকাশ কোরবে না; যে পত্রের ভরসায় সেই রাক্ষসের হাতে আমি একটু দয়ার আশা কোরেছিলেম, আগুনে দগ্ধ হয়ে সেই পত্র এখন বিপরীত ফল প্রসব কোচ্ছে! একজন সন্ন্যাসী আমাকে বোলেছিলেন, পৰ্ব্বতারণ্যে এমন একপ্রকার ফল আছে, সে ফল ভক্ষণ কোল্লে সপ্তাহকাল ক্ষুধা-তৃষ্ণা থাকে না, কিন্তু অগ্নি-সংস্পর্শে সেই ফল বিষতুল্য হয়। মোহনবাবুর লিখিত সেই স্বাক্ষরশূন্য পত্রখানি আমার পক্ষে অনুকূল হয়েছিল, অগ্নি-সংস্পর্শে বিষতুল্য হয়ে উঠেছে! আর আমার বেশীদিন কাশীধামে থাকা হবে না। একস্থানে নিরাপদে বাস আমার ভাগ্যলিপির মর্ম্ম নয়; সংসারে নানাস্থানী করবার অভিপ্রায়েই যেন বিধাতা আমারে সৃজন কোরেছেন, ঘটনাচক্রের আবর্ত্তনে আবর্ত্তনে এইরূপ সিদ্ধান্তই যেন আমার মনে আসে। কাশী ছেড়ে আমাকে পালাতে হলো। পালাবো, কিন্তু জয়হরির মহাপাপের একটা হেস্তনেস্ত করবার উপায় না কোরে পালাতে আমার মন চায় না। দেখি, সৌদামিনী কিরূপ উত্তর দেয়।
আর কোন নূতনলোকের সঙ্গে আমি আলাপ করি না, কার্য্যালয় ছাড়া আর কোন স্থানে আমি যাই না; বড়বাবুর সঙ্গে যাই, বড়বাবুর সঙ্গেই ঘরে আসি, ভয়ে ভয়ে পথের চারিদিকে চোমকে চোমকে চাইতে চাইতে যাই আসি। এই ভাবেই দিন যায়। বাড়ীতেও নির্ভয়ে থাকি না; মেজোবাবু যে রকম কাণ্ড আরম্ভ কোরেছেন, কখন কি ঘটে, কখন কি বিপদ উপস্থিত হয়, সেই ভয়ে আমি কাঁপি। আমার উপর মেজোবাবুর বড় রাগ, কোন দিন কোন কৌশলে আমারে তিনি কোন বিপদে ফেলেন, সৰ্ব্বক্ষণ সে ভয়টাও আমার মনে জাগে। এ বাড়ীতেও আমি আর নিরাপদ নই।
সাতদিন অতীত। রবিবার আগত। সুর্য্যদেব আকাশে থাকতে থাকতেই আমি ছাদে। সৌদামিনীর স্থানে সৌদামিনী নাই। অন্যমনস্ক হয়ে ছাদের উপর আমি বেড়াচ্ছি, এক একবার সেই দিকে চেয়ে চেয়ে দেখছি, সৌদামিনী এলো না। মনে কোল্লেম, আমার চিঠি পেয়ে রাগ কোরেছে, আসবে না, পত্রের উত্তরও দিবে না।
ভাবছি, এমন সময় দেখি, আমাদের ছাদের সিঁড়ির কাছে একটী গোলক; বেশ চিত্রবিচিত্র করা, সুডৌল অতিসুন্দর একটী গোলক। দ্রূত সেই দিকে অগ্রসর হয়ে, কৌতুহল-কৌতুকে সেই গোলকটী আমি হাতে কোরে নিয়েই দ্রুত গতিতে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলেম; বৈঠকখানায় এসে বোসলেম। কেহ কোথাও নাই। দিব্য সুবিধা। সাবধানে-সন্তর্পণে গোলকটীর মাঝামাঝি দুখানা কোরে ভাঙলেম। ঠিক তাই। গোলকের গর্ভেই গুপ্তলিপি। বঙ্গ-মহিলারা যেমন গুপ্তধনের ব্রত করে, সন্দেশের মধ্যে, চন্দ্রপুলির গর্ভে যেমন সিকি, আধলি, টাকা রেখে ব্রাহ্মণকে দান করে, এ কৌশলটীও ঠিক সেই রূপ;—গোলকের গর্ভে গুপ্তলিপি। রক্তবর্ণ পত্রিকা, কৃষ্ণবর্ণ অক্ষর। মোড়ক খুলে সেই গুপ্তলিপি আমি পাঠ কোল্লেম। মূলপত্রিকা আর উত্তরপত্রিকা পাঠকমহাশয় দর্শন কোরেছেন, তৃতীয়বারের এই প্রত্যুত্তরপত্রিকাখানিও দর্শন করুন।
“হরিদাস! তোমার নাম হরিদাস? হা হা, নামটী বড়ই মিষ্ট লাগিল, বড়ই তুষ্ট করিল। তোমার সুললিত পত্রখানি আমি পাঠ করিলাম। তিনবার পাঠ করিয়াছি। তিনবার সেই পত্রের উপর অশ্রুপাত করিয়াছি। তুমি বুঝি মনে করিতেছ, পত্র পাঠ করিয়া আমি কাঁদিয়াছি? না হরিদাস! আমি কাঁদি নাই, আমার সে অশ্রু; রোদনের অশ্রু নয়,—আনন্দের অশ্রু, প্রেমানন্দের অশ্রুধারা!
হরিদাস! তুমি কেবল রবিবারে একটীবার মাত্র আমারে দেখা দাও। রবিদেব শীঘ্র শীঘ্র অস্তাচলে চলিয়া যান, আর আমি তোমারে দেখিতে পাই না। কেন হরিদাস, অন্যদিন কি তুমি আমারে দেখা দিতে পার না? কেন পার? দিও,—এখন অবধি সকল বারেই এক একবার তুমি আমারে দেখা দিও।
দিও দেখা, প্রাণসখা, এ মম মিনতি।
হরিদাস! বড় আশ্চর্য্য কথা! তুমি আমার নাম জান! বিধাতার অনুগ্রহ। বড় আশ্চর্য্য কথা! আমার ভাগ্যের অনেক কথাই তুমি জান! বয়স তোমার অল্প, কিন্তু কাব্যালঙ্কারে তুমি অলঙ্কৃত। পিতৃগৃহে অনেকদিন আমি রামেশ্বর বিদ্যালঙ্কারের নিকটে কাব্যশাস্ত্র অধ্যয়ন করিয়াছি, কি বলিব, কাব্যশাস্ত্রে তোমার যেমন অধিকার, বিদ্যালঙ্কার মহাশয়েরও ততদূর অধিকার ছিল না। রূপকে রূপকে জয়পরাজয়ের ধুয়া ধরিয়া আমার উপর তুমি যেরূপ শ্লেষবাণ সন্ধান করিয়াছ, তাহা পাঠ করিয়া আমি চমৎকৃত হইয়াছি! ভয় নাই হরিদাস, ভয় নাই! সে পাপ আমি বিদায় করিয়া দিয়াছি। অজ্ঞানে আমি সেই পাপিষ্ঠের প্রতি অনুরাগিণী হইয়াছিলাম, তাহার স্বভাবচরিত্র অগ্রে আমি জানিতে পারি নাই। তুমি সন্ন্যাসীর কথা তুলিয়াছ, সন্ন্যাসীরা অনুসন্ধান করিয়া বেড়াইতেছে, পুলিশের সঙ্গে তাহাদের যোগাযোগ হইয়াছে, এ কথা আমিও শুনিয়াছি। আমার প্রাণে ভয় হইয়াছে। জয়হরি যখন আমারে কাশীতে লইয়া আসিবার মন্ত্রণা করে, তখন শীঘ্র আমি সম্মত হই নাই; শেষকালে জয়হরি আমারে ভয় দেখায়। আমার ঘরে সন্ন্যাসীর মাথা কাটা, আমি কলিকাতায় থাকিলে পুলিশের হাতে ধরা পড়িব, মহা বিপদ ঘটিবে, এই প্রকার নানা কথা। সে সকল কথা আমি পত্রে লিখিয়া জানাইতে ভয় করি; তোমার সহিত সাক্ষাৎ হইলে সকল কথা বলিব।
জয়হরির কথায় ভয় পাইয়া তাহার সঙ্গে আমি কাশীতে আসিয়াছিলাম। এখানে আনিয়া জয়হরি আমাকে অবজ্ঞা করিতে আরম্ভ করিল, প্রতারণা খেলিতে লাগিল। এখানে না কি অনেক রকম বাইজী থাকে, তাহাদের পাঁচজনের সঙ্গে জয়হরি মিলিয়া গেল; সকল দিন তাহারে আমি দেখিতে পাইতাম না; এক একরাত্রে মদ খাইয়া আসিয়া আমাকে প্রহার করিত; ‘তুই সেই সন্ন্যাসীটাকে কাটিয়া ফেলিয়াছিস, পুলিশ তোরে ধরিতে আসিতেছে,’ এই সব কথা বলিয়া কতই হাঙ্গামা করিত। আমার বাপের বাড়ীর এক দাসী আমার সঙ্গে ছিল, আমার আদেশে সন্ধানে সন্ধানে থাকিয়া সেই দাসী জানিয়া আসিয়াছিল, একটা বাইজীর নাম চন্দ্রকলা। আমি সেই চন্দ্রকলাকে একদিন বাড়ীতে আনাইয়াছিলাম, চন্দ্রকলা আমার সাক্ষাতে অনেক কথা বলিয়া গিয়াছে, দেখা হইলে সে সব কথাও আমি তোমাকে বলিব। রমাইসন্ন্যাসীকে খুন করিয়াছে কে? সে কথা কেবল আমি জানি আর আমার সেই দাসীটী জানে; আর কেহ জানে না। সেই দাসী এখন এখান হইতে পলাইয়া গিয়াছে; কোথায় গিয়াছে, তাহা আমি জানি না। তুমি এখন জানিয়া রাখ, খুন করিয়াছে, জয়হরি বড়াল। নিজে খুন করিয়া আমাকে ফাঁসাইতে চায়, বড় ভয়ানক লোক, ক্রমে ক্রমে বুঝিতে পারিয়া তাহাকে আমি তাড়াইয়া দিয়াছি। পাপকর্ম্মের কি ফল, তাহা এখন আমি বুঝিতে পারিয়াছি।
বাবা বিশ্বেশ্বরকে প্রণাম করি, মা অন্নপূর্ণাকে প্রণাম করি, দিনপতি সূর্য্যদেবকে প্রণাম করি, মনের কপাট খুলিয়া অকপটে আমি বলিতেছি, আর আমার পাপকর্ম্মে মতি নাই। প্রথম পত্রে তোমারে আমি যে সব কথা লিখিয়াছিলাম, সে সব কেবল তোমার মন-পরীক্ষার জন্য; বাস্তবিক একজন পুরষমানুষের সহায়তা না পাইলে, দুষ্টলোককে দমন করিবার উপায় করা যায় না, সেইজন্য তোমার সঙ্গে দেখা করতে আমার অভিলাষ। বিদেশে আসিয়াছি, অপরপুরুষের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা দোষের কথা; অনুতাপ আসিয়াছে বালক-বুদ্ধিতে লোভে পড়িয়া যদি তুমি দেখা দাও, সেই জন্যই সেই সব কথা আমার লেখা। কোন সন্দেহ করিও না, সত্য বলিতেছি হরিদাস! পাপকর্ম্মে আমার আর মতি নাই; কোন সন্দেহ করিও না; একটীবার দেখা দিও। পাপের ফল আমি বিলক্ষণ ভোগ করিয়াছি; জয়হরি বড়াল আপনার পাপের ফল ভোগ করে, এখন কেবল আমার এই ইচ্ছা। তুমি বুঝিয়াছিলে, আমার প্রথম-পত্ৰখানি প্রেম-পত্রিকা; সত্যই সেই রকম ভাব। আমার হাসি পায়। তোমার মুখ দেখিয়া আমি বেশ বুঝিতে পারিয়াছিলাম, তোমার চরিত্র নির্ম্মল, কোন প্রকার ছলের কুহকে তুমি ভুলিবে না, তাহাও আমি বুঝিয়াছিলাম, কেবল পরীক্ষার জন্যই প্রেম-ভাবের কথাগুলি রচনা করিয়াছিলাম। সে সব কিছুই নহে, সে সব তুমি ভুলিয়া যাও; একটীবার দেখা দিও, দুষ্টশাসনের পরামর্শ করিব। আবার আমি বলিতেছি, পাপকর্ম্মে আমার আর মতি নাই; মায়ের পেটের ভাই যেমন স্নেহের সামগ্রী, সেই ভাবে তোমাকে আমি বিশুদ্ধ দৃষ্টিতে দর্শন করি। আর বেশী কি লিখিব? এ কথার উপর আর কি কোন সন্দেহের কথা আছে? আর কি আমার উপর তোমার কোন প্রকার সন্দেহ আসিতে পারে? কোন সন্দেহ রাখিও না, একটীবার দেখা দিও। এই বাড়ীতে আসিতে যদি ইচ্ছা কর, যখন ইচ্ছা, স্বচ্ছন্দে আসিও; এ বাড়ীতে আসিতে যদি সাহস না হয়, কোথায় দেখা হইবে, লিখিয়া জানাইও, দাসী সঙ্গে করিয়া আমি সেইখানেই যাইব।
শ্ৰীমতী সৌদামিনী দেবী।”
বাহবা বাহবা! চমৎকার দলীল আমার হস্তে! সর্ব্ববিধির বিধাতা, সর্ব্বনিয়মের নিয়ন্তা, সৰ্ব্বকার্য্যের ফলদাতা, সৰ্ব্বপাপের সাক্ষী-শাস্তা, সর্ব্বময় মহাপুরুষ যিনি, তাঁহারে নমস্কার, জয়হরি বড়ালের দণ্ডবিধানের চমৎকার দলীল আমার হস্তে!
সৌদামিনী দেখা কোত্তে চায়। আছে কি দেখা করার প্রয়োজন?—হানিই বা কি? পত্রিকা বলে, পাপকর্ম্মে আর মতি নাই। অনুতাপিনী পাপিনীর সঙ্গে দেখা করাতে দোষ কি? দেখা না কোল্লেও আসল কাজের কোন বিঘ্ন হবার সম্ভাবনা দেখছি না। দুটী সাক্ষী মিলে গেল। দুজনেই প্রত্যক্ষ সাক্ষী। এক সাক্ষী কামিনীর মা, এক সাক্ষী সৌদামিনী। উত্তম জোগাড় হয়েছে। যত্ন কোরে পত্রখানি আমি আপনার কাছেই রাখলেম, গবাক্ষপথ দিয়ে ভগ্নগোলকের খণ্ড-দুখানি রাস্তায় ফেলে দিলেম; ঘরে আর কোন চিহ্নই থাকলো না। আমি একপ্রকার নিশ্চিন্ত হোলেম।
দুদিন গেল। সৌদামিনীর সঙ্গে দেখা কোল্লেম না, পত্রের উত্তরও দিলেম না। এদিকে আমাদের মেজোবাবুটী অকস্মাৎ নিরুদ্দেশ। চারি পাঁচদিন মেজোবাবু বাসাছাড়া; কর্ম্মস্থলেও থাকেন না, বাসাতেও না। কেহই আর তাঁর দেখা পান না। কোথায় গিয়েছেন, কেহই কিছুই জানে না, কেহই কিছু, বলে না।
বড়বাবু মহা উদ্বিগ্ন। এ উদ্বেগের অপেক্ষা নবীনকালীর নিরুদ্দেশের উদ্বেগটা আরও অধিক। নবীনকালী যুবতী, নবীনকালী বিধবা, রাত্রিকালে অদৃশ্য, উদ্বেগটা অধিক হবারই কথা। বাড়ীর সকলেই ভাবনায় ব্যাকুল। সকলেরই বদন বিষন্ন, কারো মুখে হাসি নাই, দুই একটা কথা ভিন্ন কারো মুখে বেশীকথা নাই, কারো মনে ফূৰ্ত্তি নাই, বাড়ী যেন বিষাদ-মেঘে সমাছন্ন। বড়বাবুর আফিসে যাওয়া বন্ধ হয় না, আমিও তাঁর সঙ্গে দস্তুরমত আফিসে যাই, নামমাত্র কাজকৰ্ম্ম করি, মন কিন্তু সৰ্ব্বদাই চঞ্চল। একদিন বড়বাবু সকাল সকাল কাজকর্ম্ম সমাধা কোরে চোলে এসেছেন, বাড়ী আসবার সময় আমি একা। আসছি, রাস্তার ধারে সারি সারি গোটাকতক গাছ। তখনো রৌদ্র ছিল, গাছের ছায়ায় ছায়ায় মৃদুগতিতে আমি চোলে আসছি, অন্য কোন দিকেই দৃষ্টি রাখছি না। দিনকতক আমি অত্যন্ত অন্যমনস্ক। কেন অন্যমনস্ক, এ প্রশ্নের কৈফিয়ৎ দিতে হবে না; সাংসারিক ঘটনাবলী যাঁরা জানেন, তাঁরা সকলেই আমার মনের ভাব বুঝতে পাচ্ছেন। আসছি, অনেক দূর এসেছি, এক জায়গায় হঠাৎ আট দশজন লোক কি একটা পদার্থকে বেষ্টন কোরে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে হা-হুতাশ কোচ্ছে, একটু তফাৎ থেকে আমি দেখলেম। মনের ভিতর আতঙ্কই থাকুক, দুর্ভাবনাই থাকুক অথবা এক ফূর্ত্তিই থাকুক, ঘটনার তত্ত্ব অন্বেষণ করবার ইচ্ছাটা আমার সৰ্ব্বদাই বলবতী থাকে;—লোকেরা কেন সে রকম হা-হতাশ কোচ্ছিল, জানবার জন্য পায়ে পায়ে সেই দিকে আমি অগ্রসর হলেম; নিকটে গিয়ে দেখলেম, পদার্থটা নির্জীব নয়, একটা মানুষ;—ঘাসের উপর চিৎপাৎ হয়ে শুয়ে পোড়ে আছে, দুজন লোক দুপাশে বোসে শুশ্রূষা কোচ্ছে;—একজন বাতাস দিচ্ছে, আর একজন জল ঢালছে। মানুষটা অজ্ঞান। তখনো পর্য্যন্ত আমি তার চেহারাটা ভাল কোরে দেখতে পাই নাই, একজনকে জিজ্ঞাসা কোরে জানলেম, পথে চোলতে চোলতে অকস্মাৎ পোড়ে গিয়েছে, পোড়েই মূর্চ্ছা গিয়েছে, মুখ দিয়ে গাঁজা ভাঙছে, অস্পন্দ, অসাড়;—জ্ঞান নাই, কিন্তু প্রাণ আছে। কেহ বোলছে মৃগীরোগ, কেহ বোলছে সর্পাঘাত, কেহ বোলছে সর্দ্দিগর্ম্মি। সম্মুখের দুজন লোকের মাঝখানে দাঁড়িয়ে উঁকি মেরে আমি দেখলেম, কি ব্যাপার। দেখেই অম্নি পেছিয়ে দাঁড়ালেম, আতঙ্কে শিউরে উঠলেম, আর সেখানে দাঁড়ালেম না;—ধীরে ধীরে চোলছিলেম, ছুট দিলেম; ছুটে ছুটে হাঁপিয়ে উঠলেম;—শীত এলো;—শীতে আমার সর্ব্বাঙ্গ কাঁপতে লাগলো;—তথাপি ছুটছি; কাঁপছি আর ছুটছি;—পশ্চাদ্দিকে আর চেয়ে দেখছি না। কেন এত ভয়? মানুষটা অজ্ঞান হয়ে পোড়ে আছে, তাই দেখেই কি আমি ভয় পেলেম?—তা নয়; মুখ দিয়ে গাঁজা ভাঙছে! মোরবে না কি?—মরে তো ভাল হয়। এখনি যদি মরে, মরার ভয়ে কি ভয় পেলেম?—তাও নয়। তবে কি? লোকটা কে?—লোকটা সেই আমার বিভীষিকা রক্তদন্ত!—এ পাপটা এখনো কাশীতে আছে! তবে তো আমার রক্ষা নাই, মোহনবাবুর নূতন রাগ,—এ লোক যদি বাঁচে, এবারে আর কোনো প্রকারেই রক্ষা নাই। তাই ভেবেই আমার ভয়, তাই ভেবেই আমি ছুটে পালাচ্ছি;—অস্পন্দ অসাড়, এখনি ছুটে এসে আমাকে ধোত্তে পারবে না, তবুও আমি ভয় পেয়ে ছুটে পালাচ্ছি। দৌড়ে দৌড়ে হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে বাড়ীতে এসে পৌছিলেম।
বড়বাবু তখনো বাড়ীতে আসেন নাই। বৈঠকখানায় প্রবেশ কোরে, খানিকক্ষণ পাখার বাতাস খেয়ে, একটু সুস্থ হয়ে, কাপড় ছেড়ে, ভিতরদিকের বারান্দায় গিয়ে আমি দাঁড়ালেম; আবার তখনি তখনি ঘরে ফিরে এলেম; আবার বারান্দায় গেলেম, আবার ফিরে এসে ঘরের ভিতর প্রবেশ কোল্লেম। বুকের ভিতর ভয়ের সঙ্গে চিন্তাতরঙ্গের খেলা। রক্তদন্ত কাশীতে আছে! হয় তো চোলে গিয়েছিল, মোহনবাবু হয় তো চিঠি লিখে আবার ওটাকে এখানে আনিয়েছেন। মরে তো ভালই হয়; বাঁচে যদি, তবে আর এবার আমার নিস্তার থাকবে না। মরুক, বাঁচুক, যা-ই হোক, আমি আর কাশীতে থাকবো না। বড়বাবুর সঙ্গে দেখা না হোলেও আজিই আমি পালাবো!
সঙ্কল্প স্থির। দোয়াত, কলম, কাগজ সম্মুখে এনে ব্যগ্রহস্তে দুখানা চিঠি লিখলেম; একখানা পুলিশের নামে, একখানা বড়বাবুর নামে। পুলিশের চিঠিখানা আমার কাছেই থাকলো, বড়বাবুর চিঠিখানা বিছানার উপর তাকিয়ার নীচে রাখলেম। পুলিশে লিখলেম, কলিকাতার বিশ্বেশ্বরবাবুর বাড়ীর সন্ন্যাসী-হত্যার কথা, হত্যাকারী জয়হরি বড়ালের সন্ধানের কথা, সৌদামিনীর ঠিকানার কথা, কামিনীর মার মনিববাড়ীর কথা। এই সকল কথার আনুসঙ্গিক যে যে কথা লেখা আবশ্যক, সংক্ষেপে সংক্ষেপে সে কথাগুলিও লিখলেম; সৌদামিনীর দ্বিতীয় চিঠিখানার নকলও পুলিশের চিঠির খামের মধ্যে রেখে দিলেম। বড়বাবুর চিঠিতে লিখলেম:
‘মহাশয়!
আপনার দয়ার আশ্রয়ে আমি পরমসুখে ছিলাম, বিধাতা বাদ সাধিলেন। আর আমি কাশীতে থাকিতে পারিলাম না। অকারণে আমার কতকগুলা শত্রু কাশীতে আসিয়াছে, রাস্তার ধারে অদ্য আমি একজনকে দেখিয়া আসিয়াছি, সে লোক অতি ভয়ঙ্কর, তাহার কবলে পড়িলেই আমার প্রাণ যাইবে; অতএব আমি অদ্যই কাশীধাম পরিত্যাগ করিলাম, মহাশয়ের সহিত সাক্ষাৎ করিবার জন্য অপেক্ষা করিতে পারিলাম না, এ অপরাধ ক্ষমা করিবেন। ভগবান বিশ্বেশ্বর আপনার পরিবারবর্গের মঙ্গলবিধান করুন। আমার শুভদিন সমাগত হইলে পুনরায় মহাশয়ের চরণ দর্শন করিয়া কৃতজ্ঞতা জানাই। অদ্য বিদায় হইলাম।
আশ্রিত শ্রীহরিদাস।”
চিঠি-দুখানি লেখা হোলে একবার আমি অন্দরমহলে প্রবেশ কোল্লেম। রমেন্দ্রবাবুর জ্যেষ্ঠা পত্নীকে বোল্লেম, মা! আপনার কাছে আমার যে টাকাগুলি গচ্ছিত আছে, হঠাৎ বিশেষ প্রয়োজন, দয়া কোরে সেইগুলি আমারে প্রদান করুন। কি প্রয়োজন, কি বৃত্তান্ত, কিছুই জিজ্ঞাসা না কোরে স্নেহময়ী দয়াবতী তৎক্ষণাৎ আপনার বাক্স খুলে আমার টাকাগুলি আমার হাতে দিলেন, তাঁরে প্রণাম কোরে আমি বাহির হয়ে এলেম। এইখানে বলা উচিত, আমার বেতনের টাকাগুলি মাসে মাসে গৃহিণীর কাছেই আমি জমা রাখতেম, আমি চাইতেম না, তথাপি মাসে মাসে আমার নিজ খরচের নাম কোরে কিছু, কিছু, তিনি আমারে দিতেন, সেইগুলি আমি নিজের কাছে রাখতেম।
বন্দোবস্ত ঠিকঠাক। কাৰ্য্যান্তরে যজ্ঞেশ্বরও সে সময়ে কোথায় গিয়েছিল, যজ্ঞেশ্বরের কাছেও বিদায় লওয়া হলো না, ঠিক গোধূলিলগ্নে সজলনয়নে সেই সখাশ্রম থেকে আমি বেরুলেম। পুলিশের চিঠিখানি কাশী-পুলিশের ঠিকানায় নিজেই আমি ডাকঘরের ডাকবাক্সে দিলেম। চিঠিতে আমি নাম স্বাক্ষর করি নাই, সৌদামিনীর চিঠির স্থানে স্থানে আমার নাম লেখা ছিল, নকলে সেগুলি আমি বাদ দিয়েছিলেম। সৌদামিনীর আসল চিঠি আমার কাছেই থাকলো। পুলিশের চিঠিখানি বেনামী।
উদ্দেশে অন্নপূর্ণা-বিশ্বেশ্বরকে প্রণাম কোরে কাশীর গঙ্গায় আমি নৌকা আরোহণ কোল্লেম। কাশীতে আমার স্থান হলো না। কত লোক কাশীতে আছে, ‘অন্নপর্ণা সকল লোককেই অন্ন দেন, সকলেই নিরাপদে থাকে, আমি নিরাপদে কাশীধামে স্থান পেলেম না। কালভৈরব আমারে তাড়ালেন না, কৰ্ম্মদোষে যারা পাতকী, কালভৈরব সেই সকল পাতকীলোককেই তাড়ান; আমার কর্ম্মদোষ ছিল না, কালভৈরব আমাকে তাড়ালেন না, দুরাচার, নিষ্ঠুর, পিশাচ রক্তদন্তই আমার ভাগ্যে কালভৈরব!