ভূবনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়
হরিদাসের গুপ্তকথাপ্রথম খণ্ড
পঞ্চম কল্প : দালালী ইস্তাহার
ঘনশ্যাম হঠাৎ আমাকে জিজ্ঞাসা কোল্লেন, “কেমন ছোকরা! এখানকার কাজকর্ম্মের ধরণ-ধারণ সব দেখলে শুনলে? অনেক লোক এখানে অনেক রকম কাজ করে, বেশ দশ টাকা রোজগার করে; কোন কাজে তোমার মন যায়, সেইটী জানবার জন্যই এই বাড়ীতে তোমায় আনা। সেদিন একটা বিশেষ জরুরী কাজের খাতিরে হঠাৎ তাড়াতাড়ি আমাকে স্থানান্তরে চোলে যেতে হয়েছিল, সকল কথা তোমাকে বোলে যেতে পারি নাই, মুন্সীর উপরেই ভার দিয়ে গিয়েছিলেম;—কেমন, কি রকম বুঝলে? কোন কাজে তোমার ইচ্ছা হয়?”
আমি চুপ কোরে থাকলেম। কি উত্তর দিব?—কাঁইবীচির কারবার, নাম শুনেই অরুচি জন্মে,—ভয়ানক জুয়াচুরি ফন্দী বোলেই বিশ্বাস হয়। সে কারবারে আমার মত বালকের প্রবৃত্তি আসতেই পারে না, সকলেই এটা বুঝতে পাচ্ছেন। তা ছাড়া—লোহা পেটা, কাঠ কাটা, ভেড়া কাটা, তক্তা চেরা, কাপড় কাচা, এ সকল কার্য্য ভদ্রলোকের নয়; কাজেই আমি মাথা হেঁট কোরে নীরব হয়ে থাকলেম।
ভাব দেখে গম্ভীর হয়ে, গম্ভীরবদনে একটু হেসে, গম্ভীরস্বরে ঘনশ্যাম বোল্লেন, ‘হাঁ হাঁ, বুঝা গেছে, ও সব কাজে তোমার মন যাবে না, লেখাপড়ার কাজটাই তুমি ভালবাস। আচ্ছা, লেখো দেখি, কেমন লিখতে পার দেখি।”
কথা বোলতেও যতক্ষণ, কাজ কোত্তেও ততক্ষণ। দুইখানা বড় বড় সাদা কাগজ আর দোয়াত-কলম আমার সম্মুখে ধোরে দিয়ে, পুনৰ্ব্বার গম্ভীরস্বরে তিনি বোল্লেন, লেখো! যা যা আমি বলি, ঠিক ঠিক লিখো। সাবধান! খবরদার! ভুল কোরো না, ঠিক ঠিক লিখে যাও!
উপদেশগুলি আমি মনেই রাখলেম; উত্তর কোল্লেম না। তিনি এক এক কোরে বোলতে লাগলেন, আমি সাবধান হয়েই লিখতে লাগলেম।
“পরমার্থবিদ্যা”
“পরমেশ্বরকে প্রত্যক্ষ জানিয়া, চন্দ্রসূর্য্যাদি নবগ্রহকে এবং ইন্দ্রাদি দশদিক্পালকে সাক্ষী রাখিয়া, এতৎ ইস্তাহারপত্র দ্বারা সৰ্ব্বসাধারণ জনগণকে আহ্বান করা যাইতেছে, সপ্তাহের মধ্যে জ্ঞানদর্পণে যাঁহারা বিষ্ণুমূর্ত্তিদর্শন করিতে বাসনা রাখেন, তাঁহারা প্রত্যেক মাসের প্রথম রবিবারে দামোদরে প্রাতঃস্নান করিয়া বর্দ্ধমানের পরমার্থ-কুটীরে শ্রীশ্রীসাধুসেবক ঘনশ্যাম সরস্বতীর নিকটে আগমন করিবেন। চিত্রকূটপৰ্ব্বতের সাধু মহাপুরুষের নিকট অনিৰ্ব্বচনীয় জ্ঞানদর্পণ লাভ করা হয়েছে। দর্পণের জ্যোতিতে দিনমানে সূর্য্যরশ্মি মলিন হয়। সেই দর্পণে ভক্তিপূর্ব্বক নয়ন অৰ্পণ করিলে চক্রগদাপদ্মধারী নবঘনশ্যাম চতুর্ভুজ বিষ্ণুমূর্ত্তি দর্শন করিতে পাইবেন। তেমন মূর্ত্তি কেহ কখনও আবিষ্কার করিতে পারে নাই, কস্মিনকালে পারিবেও না। আসুন—আসুন—আসুন! অদ্ভুত ব্যাপার! অদ্ভুত ব্যাপার! অদ্ভুত ব্যাপার! সে মূর্ত্তি দর্শন করিলে ভবধামে আর জন্ম লইতে হইবে না। দর্শনী কেবল এক টাকা পাঁচ আনা মাত্র। এই ইস্তাহার-প্রেরণের ডাকমাশুল অগ্রিম ছয় পয়সা। প্যাকিং খরচা আমার নিজের।”
এই ইস্তাহার আমি লিখলেম। হাত কাঁপতে লাগলো; সর্ব্বশরীরে ঘাম হলো। তত বড় ভয়ানক দাগাবাজীর অক্ষরগুলো আমার হাত দিয়ে বেরুলো, তাই ভেবে মনে মনে বিস্তর অনুতাপ কোল্লেম। কাগজখানা আমার হাত থেকে টেনে নিয়ে, ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দুই তিনবার দেখে দেখে, ইস্তাহারওয়ালা ঘনশ্যাম প্রফুল্লবদনে বোল্লেন, “বেশ হয়েছে। দিব্বি হয়েছে! অক্ষরগুলি যেন মণিমুক্তার হারের মতন শোভা পাচ্ছে! বেশ ছোকরা তুমি! আচ্ছা, ইস্তাহারের অক্ষর তো বেশ হলো, এখন একখানা দরখাস্ত লেখো দেখি। দরখাস্তের অক্ষর যদি এই রকম হয়, তা হোলে আমি তোমাকে খুব বড় একটা নীলকুঠীতে বড় একটা চাকরী কোরে দিব। আমার শ্বশুরের পিসতুতো ভগ্নীপতির মেজো কাকা সেই কুঠীর সৰ্ব্বেসর্ব্বা দেওয়ানজী।”
ইচ্ছা হলো উঠে পালাই, কিন্তু কায়দায় পোড়ে গেছি, কোথায় যাব? গুরুঠাকুরাণী আমাকে অমনি অমনি বিদায় কোরে না দিয়ে এমন ভয়ঙ্কর লোকের হাতে গছিয়ে দিলেন কেন, কিছুতেই বুঝতে পাল্লেম না। ভাবছি, ঘনশ্যাম আবার আদর কোরে বোল্লেন, “কি হে! ভাবছ কি? ধর না! দরখাস্তখানা লিখে ফেলো!”
কাজে কাজেই তাই। আর একখানি কাগজ আমার হাতে দিয়ে কর্ত্তা বোলতে লাগলেন, “লেখো—মহামহিম শ্রীল শ্রীযুক্ত দাতালোক মহাশয় বরাবরেষু।—বিধাতার নিগ্রহে দূরদৃষ্টক্ৰমে গত ১৭ই চৈত্র তারিখে নিশাকালে আমার গৃহে হঠাৎ অগ্নি লাগিয়া সৰ্ব্বনাশ হইয়া গিয়াছে। সাতখনি ঘর, পাঁচটী গাই গরু, মায় বাছুর, এক জোড়া বলদ, আটটী পরিবার, তিনটী বিড়াল, একটী প্রাচীন কুক্কর, আর ঘরের সমস্ত আসবাবপত্র নিঃশেষে ভস্ম হইয়াছে। আমি এককালে নিঃসম্বল ও নিরাশ্রয় হইয়াছি। দেশের বড় বড় রাজা, মহারাজা দেওয়ান, নবাবু খাঁ সাহেব, রায় সাহেব, রায় বাহাদুর এবং মহামান্য জমিদার মহোদয়গণের নামে রেজিষ্টারী করিয়া এক একখানি দরখাস্ত পাঠাইয়াছি। এক্ষণে মহাশয়ের নামডাক শুনিয়া দ্বারস্থ হইয়াছি। মহাশয়ের তুল্য দাতা আমাদের এ অঞ্চলে নাই। অতএব প্রার্থনা এই যে, গরিবের প্রতি দয়া করিয়া আশ্রমনির্ম্মাণের ও ভরণপোষণের ও গোবধের প্রায়শ্চিত্তের খরচাগুলি দান করিলে চরিতার্থ হইব। এই পূণ্যফলে মহাশয় পুরুষানুক্রমে স্বর্গবাসী হইবেন। আমার দরখাস্তের মধ্যে যদি কোন মিথ্যাকথা লেখা থাকে, এমন সন্দেহ করেন, তাহা হইলে পাতিয়ালার মহারাজকে পত্র লিখিলে অনিৰ্ব্বচনীয়রূপে সে সন্দেহ ভঞ্জন হইয়া যাইবেক। কেননা, আমার পিতামহের এক শ্বশুরের কনিষ্ঠ ভ্রাতার ভ্রাতুষ্পুত্র পাতিয়ালার রাজসংসারে পূর্ব্বে মুহুরীগিরী চাকরী—”
ঘৃণায় কলমটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আমি উঠে দাঁড়ালেম। ঘর থেকে বেরিয়ে যাই, এইরূপ লক্ষণ বুঝতে পেরে কৰ্ত্তা তখন একটু উগ্রস্বরে বোল্লেন, “কি হে ছোকরা! তুমি এমন বেয়াদব কেন? লিখতে বোল্লেম একখানা দরখাস্ত, লিখতে লিখতে অমন কোরে ক্ষেপে উঠলে কেন? ঘাড়ে ভূত চাপলো না কি?”
আমি উত্তর কোল্লেম, “আজ্ঞা, আমাকে আপনি ক্ষমা করুন, ও রকম দরখাস্ত লেখা আমার কর্ম্ম নয়। ছেলেবেলা থেকে গুরুগৃহে আমি ধর্ম্মশাস্ত্র অধ্যয়ন কোরেছি, ধর্ম্মশাস্ত্রে যে সকল কার্য্য নিষিদ্ধ, তাহাই আপনি—”
শেষ পর্য্যন্ত না শুনেই কর্ত্তা একটু হাস্য কোরে বেল্লেন, “আচ্ছা, আচ্ছা, বুঝতে পেরেছি। ঘুম পেয়েছে। আচ্ছা, আজ ঐ পর্য্যন্তই থাক, কল্য আবার দেখা যাবে। যাও, শয়ন কর গে।”
আমি যেন বাঁচলেম। মুন্সীর ঘরে শয়ন কোত্তে যাচ্ছি, পশ্চাতে ডেকে কৰ্ত্তা আবার বোল্লেন, “আর দেখ, খুব ভোরে উঠো; ভোরে তোমাকে আমার দরকার আছে; বিশেষ দরকার : ভুলো না।” :
পশ্চাতে একবার চেয়ে দেখলেম, কিন্তু কথা কইলেম না, সরাসর মুন্সীর ঘরে চোলে গেলেম। কৰ্ত্তা তার পর কি কোল্লেন, কোথায় থাকলেন, কিছুই জানলেম না। আমি শয়ন কোল্লেম। শয়নের অগ্রেই দুর্ভাবনা জুটেছিল, শয্যা গ্রহণ করবামাত্র সেই ভাবনার পরিপাক। কি ভয়ানক লোক! বিষ্ণুদর্শনের ইস্তাহার! গৃহদাহের দরখাস্ত! সর্ব্বৈব মিথ্যা! এমন লোক সংসারে স্বচ্ছন্দে বিচরণ কোরে বেড়ায়, মহাজনের বেশ ধারণ কোরে স্থানে স্থানে কারবার করে, কেহই ধরে না, কেহই কিছু বলে না, স্বচ্ছন্দে ফাঁকে ফাঁকে এড়িয়ে যায়, এটাও তত বড় আশ্চর্য্য ব্যাপার! উঃ! উপাধি আবার সরস্বতী! হায় হায়! মা সরস্বতী আর আশ্রয় করবার স্থান পান নাই!
ভাবতে ভাবতে নিদ্রা এলো, আমি ঘুমিয়ে পোড়লেম। খানিক পরে দরজা ঠেলে লোকেরা আমাকে ডাকাডাকি কোতে লাগলো, গোলমালে আমি জেগে উঠলেম, দরজা খুলে বেরুলেম। সম্মুখেই কর্ত্তা। তিনি আমার একখান হাত ধোরে উপর থেকে নামিয়ে নিয়ে এলেন, ফটক পার হয়ে যখন আমরা রাস্তায় এলেম, তখন ঘোর অন্ধকার। ভোর নয়, রাত্রি তখন অনেক ছিল। সেই অন্ধকারে কর্ত্তা আমাকে কত দূরে নিয়ে গেলেন, ঠিক অনুমান কোত্তে পাল্লেম না।
যখন প্ৰভাত হলো, তখন দেখলেম, ঘনশ্যামের আর একরকম বেশ। মহাজনী পাগড়ী নাই, চাপকান নাই, বদনে সে গাম্ভীর্য্য নাই, নূতন ভেক!—সব নূতন! পরিধানে একখানা অল্প বহরের থানকাপড়, কাঁধে একখানা গামছা, মস্তকের কেশ রূক্ষ, বগলে এক তাড়া কাগজ; বদন বিষন্ন; চলনটাও একটু বাঁকা বাঁকা। লোকে দেখে মনে করে একটা পা খোঁড়া।
ভঙ্গী দেখে আমার মনে আর একটা সন্দেহ দাঁড়ালো। নূতন কি একটা দাগাবাজ মতলবে এই লোক আজ বেরিয়েছে। কি ফ্যাসাতেই আমাকে ফেলবে, মনে বড় ভয় হলো, ভয়ে ভয়ে মুখটী বুজে কাঁপতে কাঁপতে তার সঙ্গে সঙ্গে আমি চোল্লেম। লোকটা আমার ডান হাতখানা খুব শক্ত কোরে ধোরে রইলো।
হেঁটে হেঁটেই চোলেছি। কতদুর চোলেছি, একটুও বিরাম পাচ্ছি না। পথে পথে ঘনশ্যাম আমাকে কত রকমের কত কথাই শিখিয়ে দিতে লাগলো, শুনে শুনে কেবল আমার ভয়, সংশয় আর ঘৃণাই বেড়ে বেড়ে উঠলো। বেলা এক প্রহর হয়ে গেল। এই সময় আমরা একটা লোকাকীর্ণ গঞ্জের মধ্যে প্রবেশ কোল্লেম। বোধ হলো যেন সহর গঞ্জটা পার হয়ে গৃহস্থপল্লী পাওয়া গেল। সেইখানে ঘনশ্যাম আমাকে নানা প্রকার উপদেশ দিয়ে বার বার সাবধান হোতে বোল্লে। কিছুই আমার ধারণা হলো না।