ভূবনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়
হরিদাসের গুপ্তকথাপ্রথম খণ্ড
বিংশ কল্প : নূতন বন্ধু;—কামরূপদর্শন
নৌকায় আরোহণ কোল্লেম। ভাগীরথী আপন মনে উত্তরমুখে ছুটেছেন, মহাবিপদে আমি নিপতিত, কাতর-হৃদয়ে আমার অবস্থার কথা তাঁরে আমি জানালেম। ভাগীরথীর দ্রব-হৃদয় আমার দুঃখে আর অধিক দ্রবীভূত হলো না, আমার কাতরবচনে দ্রবময়ী দেবী কিছুই উত্তর দিলেন না, আপন বেগে আপনিই নেচে নেচে আপন পথে চোলে যেতে লাগলেন। আমি এখন যাই কোথা? মাঝীকে বোলেছিলেম, প্রয়াগে যাব। নৌকায় বোসে বোসে ভাবলেম, প্রয়াগে হয় তো মোহনলালবাবু আছেন, সেখানে গেলে হয় তো আমি তাঁর চক্ষে পোড়বো, আবার একটা নূতন বিপদ উপস্থিত হবে। বাতাস তখন উত্তরদিকে ফিরেছিল; মলয়পর্ব্বতের বাতাস, সুখীজনের সুস্থ শরীরকে সুশীতল করে, আমার পক্ষে মলয়ানিল সুখপ্রদ বোধ হলো না; কেন না, আমি অসুখী। বাতাসের দয়া আছে। আমি অসুখী হোলেও পবন যেন আমার কাণে কাণে পরামর্শ দিলেন, “তুমি প্রয়াগতীর্থে যাও; যে লোকের ভয়ে তোমার মন বিচলিত হচ্ছে, সে লোক এখন প্রয়াগে নাই, বাঙলাদেশে চোলে গিয়েছে।”
বাতাসের কথায় আমি ভরসা পেলেম; মনেও প্রত্যয় জন্মিল, ঐ কথাই ঠিক। কাশীর বাইজীকে সহচরী কোরে মোহনলালবাবু দেশেই ফিরে গিয়েছেন; যদিও নিজদেশে নিজবাড়ীতে না গিয়ে থাকেন, সহচরী-সঙ্গে সখের রাজধানী কলিকাতায় গিয়েছেন, এইটীই সম্ভব; প্রয়াগে নাই। তবে আমি প্রয়াগেই যাব। কর্ণধারকে পূর্ব্বে সেইরূপ উপদেশ দেওয়াই ছিল, যথাসময়ে প্রয়াগের ঘাটে নৌকা পৌঁছিল, আমি অবতীর্ণ হোলেম। প্রয়াগ একটী পূণ্যতীর্থ; গঙ্গা-যমুনা-সরস্বতী সঙ্গম। গঙ্গাজল শ্বেতবর্ণ, যমুনার জল নীলবর্ণ। গঙ্গায় জোয়ারভাটা নাই, শুদ্ধ সময়ে সময়ে জলের হ্রাস-বৃদ্ধি আছে। যমুনা সৰ্ব্বদা সমভাব। যমুনাতীরে কেল্লা। একজন পাণ্ডা আমারে অধিকার কোরেছিল, তার সঙ্গে আমি দর্শনীয় পদার্থগুলি দর্শন কোল্লেম। মন্দির অনেক। মন্দিরগুলি স্তম্ভে স্তম্ভে খিলানকরা, দেখতে অতি সুন্দর। কেল্লার নিকটে প্রকাণ্ড মহাবীরের প্রতিমূর্ত্তি; স্কন্ধে রাম-লক্ষ্মণ, করতলে দুটী পৰ্ব্বত। কেল্লার ভিতর গহ্বরমধ্যে অক্ষয়বট। অন্ধকার গহ্বরে আমি অক্ষয়বট দর্শন কোল্লেম। পত্ৰগুলি শ্বেতবর্ণ। তার পর অপরাপর দেবদেবী-দর্শনে। সঙ্গমের প্রায় দুই ক্রোশ দূরে অনন্তনাগের প্রতিমূর্ত্তি; অনন্ত-নাগের সহস্র ফণা। নিকটে ভরদ্বাজমুনির আশ্রম; আশ্রমের অদূরে বড় বড় উদ্যানমধ্যে অনেক সাধুপুরুষে বাস করেন। প্রয়াগধাম অতি পবিত্র। মুসলমান-রাজার আমলে প্রয়াগের নাম হয়েছে এলাহাবাদ।
আমার সঙ্গে অতি অল্পই টাকা ছিল, সামান্য একখানি ঘর ভাড়া নিয়ে তিনদিন তিনরাত্রি আমি প্রয়াগবাস কোল্লেম। প্রয়াগে অনেকে মস্তকমুণ্ডন করে, আমি কিন্তু কোন নাপিতের সঙ্গে সাক্ষাৎ কোল্লেম না। আমার শুনা ছিল, তীর্থে তীর্থে বিস্তর বদমাসলোক থাকে; একটা জুয়াচোরের পাল্লায় আমি পোড়েছিলেম, সঙ্গে অধিক টাকা ছিল না, সেইটা জানতে পেরে জুয়াচোরটা আমারে অল্পে অল্পে ছেড়ে দিয়েছিল।
টাকার অভাব, সঙ্গে কেহ নাই, প্রয়াগ থেকে কোথা যাব, সেই তিনদিন কেবল আমি সেই চিন্তাই কোরেছিলেম। চিন্তায় কোন ফল হয় নাই, দৈবানুগ্রহে একটী শুভসংযোগ সংঘটিত। তৃতীয়রজনী-অবসানে চতুর্থ দিবসের প্রাতঃকালে আমি সঙ্গমঘাটে স্নান কোত্তে গিয়েছি, অনেক লোক সেই ঘাটে স্নান কোচ্ছিলেন, সকলেই আমার চক্ষে নূতন। আমি যখন স্নান কোরে উঠলেম, সেই সময় একটী ভদ্রলোক আমার দিকে চাইতে চাইতে নিকটে এসে উপস্থিত হোলেন। বাঙালী ভদ্রলোক; লোকটীর চেহারা দিব্য সুন্দর; উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ, গঠন কিছু দীর্ঘ, বেশী মোটাও নয়, নিতান্ত কাহিলও নয়, মুখখানি প্রসন্ন; কণ্ঠদেশে সোণার তারে গাঁথা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রুদ্রাক্ষমালা, দক্ষিণবাহুতে স্বর্ণ নির্ম্মিত একখানি ইষ্টকবচ; বয়স অনুমান পঞ্চাশ বৎসর। সঙ্গে একটী লোক; চেহারায় আর পরিচ্ছদে বোধ হলো চাকর।
ভদ্রলোকটী খানিকক্ষণ আমার মুখের দিকে চেয়ে, কি জানি কি ভেবে, মিষ্টবচনে আমারে জিজ্ঞাসা কোল্লেন, “প্রয়াগেই কি তুমি থাকো?”
ভয়ই থাক, ভাবনাই থাক, কিম্বা একটু স্ফূর্ত্তিই থাক, ভদ্রলোকের কাছে সৰ্ব্বক্ষণ আমি সপ্রতিভ। প্রশ্ন শ্রবণমাত্রই প্রশান্তনয়নে প্রশ্নকর্ত্তার মুখপানে চেয়ে সুস্থিরকণ্ঠে আমি উত্তর কোল্লেম, “আজ্ঞা না, এখানে আমি থাকি না, কোথাও আমি থাকি না, আমার থাকবার স্থান নাই।”
উত্তরশ্রবণে বিস্ময় প্রকাশ কোরে সেই ভদ্রলোকটী একবার ভ্রূ কুঞ্চিত কোল্লেন, গম্ভীরবদনে বোল্লেন, “বড় আশ্চর্য্য কথা! কোথাও তুমি থাকো না? কোথাও তোমার থাকবার স্থান নাই? এটা তোমার কি প্রকার কথা?”
তাঁর মুখের ভাব দেখে আমি যেন বুঝলেম, লোকটী আমারে পাগল মনে কোল্লেন, যা-ই মনে করুন, চুপ কোরে না থেকে সত্য সত্য গুটীকতক আত্মপরিচয় তাঁরে আমি জানালেম, জানিয়েই বিনা জিজ্ঞাসায় শীঘ্র শীঘ্র বোল্লেম, “বাঙলাদেশে আমি থাকতেম আমার নাম হরিদাস।”
এইবার সেই লোকটীর মুখের ভাব পরিবর্ত্তিত হলো। ভাব দেখে আমি বুঝলেম, পূৰ্ব্বসংশয়টা, পূর্ব্ববিস্ময়টা অথবা পূর্ব্ববিশ্বাসটা দূর হয়ে গেল; আমার প্রতি যেন তাঁর একটু দয়া জন্মিল। সদয়বচনে তিনি আমায় বোল্লেন, “আচ্ছা, তুমি আমার সঙ্গে এসো, নিকটেই আমার বাসা, সেইখানে গিয়ে সকল কথা আমি শুনবো।”
আমি বোল্লেম, “তিনদিন হলো, আমি এখানে এসেছি, ছোট একটী বাসা নিয়েছি, সে বাসায় আমার কিছু কিছু জিনিসপত্র আছে, সেখানে ফিরে না গেলে—”
বোলছিলেম, বাধা দিয়ে তিনি বোল্লেন, “সে ব্যবস্থা পরে হবে, এখন তুমি আমার সঙ্গে আমার বাসায় চল।”—আর আমি দ্বিরুক্তি কোল্লেম না, তিনি দক্ষিণমুখে অগ্রসর হোলেন, কতক উল্লাসে, কতক সন্দেহে আমি অনুগামী; আমাদের পশ্চাতে চাকরটী।
অদূরেই তাঁর বাসা। সেই বাসায় আমরা উপস্থিত হোলেম। বাড়ীখানি দোতালা, দিব্য পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, একমহল। উপরের একটী ঘরে আমারে তিনি নিয়ে গেলেন; স্নান কোরে সিক্তবস্ত্রে আমি গিয়েছিলেম, চাকরকে বোলে আমার জন্য একখানি শুষ্কবস্ত্র আনিয়ে দিলেন। আমি কাপড় ছাড়লেম। চাকর আমারে কিছু মিঠাই এনে দিলে, জল খেয়ে, বাবুর আদেশে বাবুর কাছে বিছানার উপর আমি বোসলেম। বেলা অধিক হয় নাই, বাবু আমারে উপর্য্যুপরি অনেকগুলি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা কোল্লেন। যে কথাগুলি বলবার নয়, যেগুলি বলবার দরকার ছিল না, সেইগুলি ছাড়া তাঁর সকল প্রশ্নের ঠিক ঠিক উত্তর আমি প্রদান কোল্লেম; বিনা প্রশ্নেও নিজের অবস্থাকাহিনী অল্প অল্প জানালেম; শুনে তিনি খানিকক্ষণ চুপ কোরে থাকলেন, তার পর বোল্লেন, “অদ্ভুত ঘটনা বটে! তোমার মত বালকের এমন ঘটনা হয়, এমন আমি কোথাও শুনি নাই; উপকথায় লেখা থাকতে পারে, কিন্তু সত্যজীবনে বাঙালী বালকের এমন অবস্থা ঘটে, তোমার মুখে এই আমি নূতন শুনলেম। আচ্ছা, থাকো,—আমার কাছেই তুমি থাকো, আমি তোমার ভরণপোষণের সুব্যবস্থা কোরে দিব, যেখানে আমি যাব, তুমি আমার সঙ্গে থাকবে, তার পর আমি তোমারে আমার স্বদেশে নিয়ে যাব। বেশ ছোকরা তুমি, তোমার উপর আমি বিশেষ সন্তুষ্ট হয়েছি, আমার কাছেই তুমি থাকো।”
যিনি অনাথবন্ধু, সংসারে তিনি চিরদিন অনাথের সহায়, নিরুপায়ের উপায়। আমি একটী আশ্রয় অন্বেষণ কোচ্ছিলেম, একটী আশ্রয় পাবার প্রত্যাশায় লালায়িত হোচ্ছিলেম, সেই অন্তর্যামী অনাথবন্ধু আমার প্রতি কৃপা কোরে এই নূতন আশ্রয়টী মিলিয়ে দিলেন। বাবুর আশ্বাসবাক্যে আশ্বস্ত হয়ে তাঁর কাছেই আমি থাকলেম।
বাবুটী ব্রাহ্মণ, নাম দীনবন্ধু চট্টোপাধ্যায়, নিবাস মুর্শিদাবাদ, সেখানকার এক বনিয়াদী-বংশে তাঁর জন্ম, ধনসম্পত্তিও প্রচুর, অল্পক্ষণের মধ্যে এই তত্ত্বগুলি আমার জানা হলো। আমি আনন্দিত হোলেম।
বেলা প্রায় দেড়প্রহর অতীত। বাসায় রসুইব্রাহ্মণ ছিল, রন্ধনাদি সমাপ্ত হোলে বাবুর অনুরোধে সেইখানে আমি আহার কোল্লেম। বৈকালে সেই চাকরটীকে সঙ্গে দিয়ে বাবু আমারে বাসায় পাঠালেন, তিন দিনের ভাড়া শোধ কোরে দিয়ে, জিনিসপত্রগুলি নিয়ে, সন্ধ্যার পর্ব্বে বাবুর বাসায় আমি ফিরে এলেম।
পাঁচদিন সেই বাবুর বাসায় আমার থাকা হলো। পাঁচদিনে বাবু আমার চরিত্রের পরিচয় পেলেন, লেখাপড়ার পরিচয় পেলেন, দেশভ্রমণের কতক কতক পরিচয়ও পেলেন; পেলেন না কেবল বংশপরিচয়। ধর্ম্মানুরাগে আর বিদ্যানুরাগে বাবুটী বঞ্চিত ছিলেন না, পাঁচদিনে সে পরিচয়টীও আমি পেলেম। আমার প্রতি তাঁর স্নেহ জন্মিল, আমিও তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাবান হোলেম।
পাঁচদিনের পর বাবু আমারে বোল্লেন, “অনেকগুলি তীর্থ আমি দর্শন কোরেছি, সম্প্রতি কামরূপদর্শনের অভিলাষ হয়েছে, কামাখ্যাদেবী সেখানকার অধিষ্ঠাত্রী দেবতা। আসামপ্রদেশে কামরূপতীর্থ-সম্বন্ধে অনেক আশ্চর্য্য কথা শুনা যায়; সেই তীর্থদর্শনে শীঘ্রই আমি যাব। তুমি কি আমার সঙ্গে সেখানে যেতে ইচ্ছা কর? তোমারে সঙ্গে লওয়া আমার ইচ্ছা। কামরূপ কিন্তু এখান থেকে অনেক দূর।”
অনেক দূর, এই কথা শুনে আমার ইচ্ছা বলবতী হলো। যতদূরে যেতে পারি, ততই আমি নিরাপদে থাকবো, শত্রুরা শীঘ্র আমার সন্ধান পাবে না, সেই জন্যই ইচ্ছা বলবতী। ইচ্ছাকে পুরোবৰ্ত্তিনী কোরে, উল্লাসে উল্লাসে বাবুকে আমি বোল্লেম, “নূতন নূতন তীর্থদর্শনে আমার বড় সাধ, আপনি যদি অনুগ্রহ কোরে সঙ্গে নিয়ে যান, আমি চরিতার্থ হব।”
বাবু সন্তুষ্ট হলেন। তিন দিন পরে কামরূপযাত্রার আয়োজন। নৌকাযোগেই আমরা যাত্রা কোল্লেম। বাবুর সেই চাকরটী আমাদের সঙ্গে থাকলো; পাচক ব্রাহ্মণ ঠিকালোক, সে আমাদের সঙ্গে থাকলো না। ক্রমাগত জলপথে স্থলপথে কত দিনে আসামে আমরা পৌঁছিলেম, ঠিক মনে হয় না।
কামরূপে আমরা উপস্থিত হোলেম। আসামের একটী প্রধান নগর গৌহাটী। গৌহাটীর তিনমাইল দূরে কামরূপ। কামাখ্যাদেবী এখানে বিরাজিতা, এই কারণে কামরূপের দ্বিতীয় নাম কামাখ্যা। দেবীর অধিষ্ঠানের একটী পৌরাণিক প্রবাদ যে, দক্ষযজ্ঞে দক্ষমূখে শিবনিন্দা-শ্রবণে দক্ষকুমারী সতী-দেবী প্রাণত্যাগ করেন, দক্ষযজ্ঞভঙ্গের পর মহাদেব সতী-দেহ মস্তকে ধারণ কোরে উন্মত্তের ন্যায় নানাস্থানে পরিভ্রমণ করেন, বিষ্ণুচক্রে সেই দেহ একান্ন খণ্ডে বিখণ্ডিত হয়ে ভিন্ন ভিন্ন স্থানে পতিত হয়; যেখানে যেখানে সতী-অঙ্গ নিপতিত, সেই সেই স্থানে এক এক নামে এক একটী দেবী আছেন, মহাকাল মহেশ্বর ভিন্ন ভিন্ন মুর্ত্তিতে ভিন্ন ভিন্ন নামে সেই সেই স্থানে ভৈরবরূপে বিরাজমান; সেই একান্ন স্থান একান্নপীষ্ঠ। সতীর একাঙ্গ কামরূপে পতিত হয়েছিল, এই পীঠের দেবীর নাম কামাখ্যা। অম্বুবাচীর সময় সেখানে খুব ঘটা হয়।
কামরূপ একটী প্রাচীন তীর্থ। কি কারণে এই তীর্থের নাম কামরূপ, সে সম্বন্ধেও একটী প্রবাদ প্রচলিত আছে। হরকোপানলে কামদেব ভস্ম হয়েছিলেন, এই স্থানে পুনরায় স্বরুপ প্রাপ্ত হন, সেই জন্যই এই স্থানের নাম কামরূপ! এ প্রবাদের সত্যাসত্যতা ভূতকালের গর্ভগত।
এখানকার সকলের মুখেই শুনা যায়, অন্যান্য দেশেও বলে, কামরূপকামাখ্যায় মায়াবিদ্যার বড়ই প্রাদুর্ভাব ছিল; কামাখ্যার ডাকিনীরা আশ্চর্য্য মায়াবিনী; মন্ত্রবলে তারা অন্যস্থানের স্থাবরপদার্থ কামাখ্যায় নিয়ে যেতে পাত্তো। গাছচালা ডাকিনী একটা প্রসিদ্ধ কথা। অন্যদেশের পুরষ কামাখ্যায় এলে আর স্বদেশে ফিরে যেতে পাত্তো না; এখানকার মায়াবিনীরা সেই সকল পুরষকে ভেড়া বানিয়ে রাখতো। ভেড়া বানিয়ে রাখা এ কথাটার তাৎপর্য্য বোধ হয়, জাদুমন্ত্রে ভুলিয়ে ভুলিয়ে বশীভূত কোরে রাখা। এখানকার লোকের মুখে আরো শুনা যায়, মায়াবিনীরা স্বেচ্ছাক্রমে পশুপক্ষীর রূপধারণ কোত্তে পাত্তো। এখনো পারে কি না, অপরাপর মায়ার খেলা এখনো চলে কি না, তার কোন প্রমাণ পাওয়া গেল না; কিন্তু ঐ সকল কথা যে একেবারেই মিথ্যা, এমনও বোধ হয়। কারণ, বঙ্গদেশের বাজীকরেরা,—ভানুমতীরূপিণী বেদিনীরা যেমন ভোজরাজার দোহাই দেয়, আত্মারাম সরকারের দোহাই দেয়, সেইরূপ কামরূপকামাখ্যার আজ্ঞার দোহাই দিয়ে অনেক আশ্চর্য্য আশ্চর্য্য ইন্দ্রজাল প্রদর্শন করে। জাদুবিদ্যার প্রাদুর্ভাব কামাখ্যায় ছিল, এ কথা অস্বীকার করা যায় না; যতটা গুজোব, ততটা সত্য নয়, এইরূপ অনুমান হয়।
কামাখ্যাদেবীর মন্দিরটী অতি সুন্দর। একটা পৰ্ব্বতের উপর মন্দিরটী সংস্থাপিত। মন্দিরের প্রথম-নিৰ্মাণ-সম্বন্ধে একটা অলৌকিক কিম্বদন্তী আছে। বিষ্ণু যখন বরাহমূর্ত্তি ধারণ করেন, সেই সময় সেই বরাহের ঔরসে পৃথিবীর গর্ভে এক অসুরের জন্ম হয়, সেই অসুরের নাম নরকাসুর। এখানকার প্রাচীন রাজবংশ বিলুপ্ত হবার পর নরকাসুর রাজা হয়। নরকাসুর স্বভাবতঃ অত্যন্ত রিপুপরায়ণ ছিল; কথিত আছে, ষোড়শ সহস্র সুন্দরী কন্যাকে বলপূৰ্ব্বক হরণ কোরে এখানকার কর্ম্মনাশা নামে একটা ক্ষুদ্র পৰ্ব্বতের গহ্বরমধ্যে লুকিয়ে রেখেছিল। সেই নরকাসুর একদা মূর্ত্তিমতী কামাখ্যাদেবীকে দর্শন কোরে, কামমোহিত হয়ে, তাঁরে বিবাহ কোত্তে চায়। দেবী তারে বলেন, “তুমি যদি একরাত্রের মধ্যে আমার মন্দির, নাটমন্দির, সরোবর, পুষ্পেদ্যান, প্রশস্ত বত্ম প্রস্তুত কোরে দিতে পার, তা হোলে আমি তোমাকে পতিত্বে বরণ কোত্তে সম্মত আছি; তোমার কার্য্য সমাপ্ত হবার অগ্রে, যদি রজনীপ্রভাত, হয়, তা হলে তোমার অস্তিত্বলোপ হবে।
নরকাসুর মহা প্রতাপশালী নরপতি ছিল, সে তৎক্ষণাৎ বিশ্বকর্ম্মাকে স্মরণ কোল্পে, বিশ্বকর্ম্মা হাজির হলেন। অসুর তাঁরে দেবীকথিত প্রাসাদাদি-নির্ম্মাণের আজ্ঞা দিল; বিশ্বকর্ম্মা আজ্ঞাপ্রাপ্তি মাত্র কার্য্য আরম্ভ কোরে দিলেন। দেবী দেখলেন, বিপত্তি। বিশ্বকর্ম্মার কার্য্য, রজনীপ্রভাত হোতে হোতেই সে কাৰ্য্য সমাপ্ত হয়ে যাবে, অসুরবিনাশ হবে না। যাতে ব্যাঘাত ঘটে, দেবী তখন সেই উপায় অবলম্বন কোল্লেন; যে সকল ঊষাপক্ষীর কলরবে প্রভাত সূচিত হয়, রাত্রি অবশিষ্ট থাকতে থাকতে সেই সকল পক্ষীকে তিনি কলরব করবার আদেশ দিলেন; পক্ষীগণ কলরব কোরে উঠলো। রজনী প্রভাত বিবেচনা কোরে, বিশ্বকৰ্মা সেই সময় অন্তরে অন্তরে হেসে, কাৰ্য্য বন্ধ রেখে স্বস্থানে প্রস্থান কোল্লেন; অসুরের ইষ্টসিদ্ধি হলো না, দুরাচার সেইখানেই দেবীর রোষানলে ভস্ম হয়ে গেল।
এখানকার লোকেরা বলে, বর্ত্তমান মন্দিরের নিম্নাংশ বিশ্বকর্ম্মানির্ম্মিত। দেবদ্বেষী কালাপাহাড় এই মন্দিরের কিয়দংশ নষ্ট কোরে দেয়, অনন্তর কোচবিহার-রাজবংশের আদিপুরুষ মহারাজ নরনারায়ণ ঐ মন্দিরের উপরাংশ নির্ম্মাণ কোরিয়ে দেন, সেই মন্দির এখনো বৰ্ত্তমান আছে। যে পৰ্ব্বতের উপর মন্দির, সেই পৰ্ব্বতে আরোহণ করবার চারিটী পথ। চারি পথের চারি ফল। উত্তরের পথ দিয়া অরোহণ কোলে যাত্রীলোকের মুক্তিলাভ হয়, পশ্চিমের পথে রাজ্যলাভ হয়, পূৰ্ব্বদিকের পথে ধনলাভ হয়, দক্ষিণের পথে মত্যুলাভ হয়। এই কারণে গৃহস্থলোকেরা দক্ষিণের পথে পদার্পণ করেন না; সাধু-সন্ন্যাসীরা দক্ষিণপথের এই নিষেধ অমান্য করেন।
এখানকার পাণ্ডারা অতি ভদ্রলোক। যাত্রীলোকের উপর তারা কোন প্রকার পীড়ন করে না, ইচ্ছাপূর্ব্বক যে যা দেয়, তাতেই তারা সন্তুষ্ট। যাত্রীলোকের প্রতি পাণ্ডাদের উত্তম যত্ন; যাত্রীগণকে যত্নপূৰ্ব্বক দেবদেবী দর্শন করায়, যত্নপূৰ্ব্বক আপনাদের বাড়ীতে নিয়ে গিয়ে রাখে, পাণ্ডাদের প্রসাদে যাত্রীলোকের কোন প্রকার কষ্ট হয় না। আমরা একটী পাণ্ডার বাড়ীতে আশ্রয় লয়েছিলেম। পাণ্ডাদের বাড়ীগুলি দিব্য পরিষ্কার।
এখানে অনেকগুলি কুণ্ড আছে। প্রধান কুণ্ডের নাম সৌভাগ্যকুণ্ড। মন্দিরের প্রবেশ করবার পূর্ব্বে সৌভাগ্যকুণ্ডে স্নান কোত্তে হয়। লোকে বলে, দেবরাজ ইন্দু আপন বজ্ৰাস্ত্র দ্বারা এই কুণ্ডটী খনন কোরে দিয়েছেন। কুণ্ডস্নানের ফলশ্রুতি পারলৌকিক মঙ্গলে পরিকীৰ্ত্তিত; সৌভাগ্যকুণ্ডে স্নান কোল্লে উর্দ্ধ-নিম্ন দশ দশ পুরুষ উদ্ধার প্রাপ্ত হয়; পাণ্ডাদের মুখে নূতন ফলশ্রুতি, স্নানফলে ভাগ্যহীন লোকের সৌভাগ্যের উদয় হয়ে থাকে; এটী ইহকালের ফল। সৌভাগ্যকুণ্ডের অদূরে গঙ্গাকুণ্ড, বরাহকুণ্ড, অনন্তকুণ্ড, অগ্নিকুণ্ড আর লোহিত্যকুণ্ড।
প্রথমতঃ সৌভাগ্যকুণ্ডে স্নান কোরে সমীপবর্ত্তী গণেশমূর্ত্তির পুজো করা আবশ্যক; গণেশ-পূজার পর মন্দিরে প্রবেশ। সম্মুখেই কামাখ্যাদেবীর প্রতি মূর্ত্তি। পাণ্ডারা বলেন, এই মূর্ত্তির নাম ভোগমূর্ত্তি। প্রকাশ্যরূপে সেই মূর্ত্তির পুজা হয়। সেই মুত্তির পূৰ্ব্বদিকে একটী গহ্বর; পাথরের সিঁড়ি দিয়ে সেই গহ্বরে প্রবেশ কোত্তে হয়; সেই গহ্বরে পীঠস্থান। সে স্থান ঘোর অন্ধকারে আবৃত্ত; দিবারাত্রি সেখানে ঘৃত-প্রদীপ জ্বলে। দুই স্থানেই পূজা হয়। পীঠস্থানে গঙ্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী, বটুকভৈরব, নরনারায়ণ, অন্নপূর্ণা ও চামুণ্ডাদেবী আছেন। পূজা সমাপ্ত হবার পর মন্দিরপ্রদক্ষিণের নিয়ম আছে। মন্দিরের প্রবেশদ্বারের সম্মুখে একটা বৃহৎ জয়ঘণ্টা ঝুলছে; বাহিরে আসবার সময় সেই জয়ঘণ্টা বাজাতে হয়। আমরা দর্শন কোল্লেম, পুজো দিলেম, প্রণাম কোল্লেম, ঘণ্টা বাজালেম, শেষকালে মন্দিরপ্রদক্ষিণ কোরে বাহিরে এসে দাঁড়ালেম।
এখানে কুমারীর ভিড়। “বাবু একটী পয়সা, বাবা একটী পয়সা, মা একটী পয়সা,” এই রকম প্রার্থনা। সহজপ্রার্থনাও নয়, টানাটানিও আছে। কুমারী কম নয়; আমরা দেখলম, প্রায় অর্দ্ধ সহস্র। সকলকেই একটী একটী পয়সা দিয়ে আমরা বেরুলেম। যাত্রীরা পূণ্যকামনায় কুমারীভোজন করায়। কাশীতে দণ্ডী-ভোজনের যেরুপ ফল, কামাখ্যায় কুমারীভোজনেও সেইরুপ ফল, শুনা গেল।
কামাখ্যার অতি নিকটে একটা পৰ্ব্বতের উপর ভুবনেশ্বরীদেবীর মন্দির। এই স্থানে প্রকৃতির বিচিত্ৰশোভা নয়নগোচর হয়। এই স্থানে একজন ব্রহ্মচারী আছেন, কত দিন আছেন, কেহ বোলতে পারে না। ভুবনেশ্বরীর পাণ্ডারাও দিব্য শান্ত। অন্যান্য তীর্থের পণ্ডাদের যেরুপ দৌরাত্ম শুনা যায়, কামাখ্যার পাণ্ডাদের সেরপ দৌরাত্ম কিছুই নাই।
একদিন আমরা কামরূপ থেকে গৌহাটীতে বেড়াতে এলেম। গৌহাটীতেও অনেক দেবদেবীর মূর্ত্তি আছে। ব্রহ্মপুত্ৰতীরে স্বয়ম্ভু উমানন্দের মন্দির। শিবরাত্রির সময় এখানে একটা মহা মেলা হয়। সহরের মধ্যে শুক্রেশ্বর, উগ্রতারা, মঙ্গলচণ্ডী ও নবগ্রহের প্রতিমূর্ত্তি বিদ্যমান। সহরের প্রায় তিন ক্রোশ দূরে বশিষ্ঠদেবের আশ্রম। লোকের মুখে শুনা গেল, বশিষ্ঠাশ্রমে ব্রাহ্মণেরা ত্রিকালীন সন্ধ্যাবন্দনা কোল্লে আর তাঁদের নিত্য সন্ধ্যাবন্দনাদি কোত্তে হয় না, কোটিজন্ম সন্ধ্যাবন্দনা না করার পাপও এই ফলে ক্ষয় হয়ে যায়। আর একটী আশ্চৰ্য্য দেখা গেল। সন্ধ্যা, ললিতা ও কান্তা, এই তিন নামে তিনটী স্রোত এখানে ক্রমাগত অবিরাম প্রবাহিত; কোথা থেকে এই স্রোত চোলে আসছে, এ পর্য্যন্ত কেহ কিছু নির্ণয় কোত্তে পারে নাই।
একদিন আমরা গৌহাটীতে থাকলেম, তার পর আবার কামরূপে ফিরে গেলেম। দীনবন্ধুবাবুর চাকরটীর নাম যুধিষ্ঠির। বয়সে প্রায় বৃদ্ধ, কিন্তু বেশ বলিষ্ঠ, কাজকর্ম্মে সবিশেষ নিপুণ, কথাবার্ত্তাও ভদ্রলোকের মত, এদিকে আবার ধর্ম্মভীরু; কিন্তু ভূত-প্রেত-দানা-দৈত্যের গল্পে তার বড় আমোদ। যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে আমার বেশ ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল; যখন কোন কাজকর্ম্ম না থাকতো, বাবু যখন নিকটে না থাকতেন, সেই সময় যুধিষ্ঠির আমার কাছে বোসে বোসে অনেক রকম পুরাতন রূপকথা বোলতো; ভূতের গল্প, রাক্ষসের গল্প, যক্ষের গল্প, পরীর গল্প, তালপত্রের খাঁড়া, পক্ষীরাজ ঘোড়া, ছাঁদন-বাঁধনের দড়ী ইত্যাদি অনেক রকম নূতন নূতন কথা তার মুখে আমি শুনতেম; শুনতেম আর হাসতেম; হাসির কথাই বেশী, সেই জন্যই হাস্য।
বাবু একদিন একাকী কামাখ্যা-মন্দিরে সন্ধ্যাকালে আরতি দেখতে গিয়েছিলেন, পাণ্ডার বাড়ীতেই আমাদের বাসা, বাসার একটী ঘরে আমি আর যুধিষ্ঠির। কোন গল্পের ভূমিকা না কোরে, যুধিষ্ঠির আমাকে জিজ্ঞাসা কোল্লে, “কামরূপে আমরা কি কোত্তে এসেচি? এটা তো ডাকিনীর দেশ। এখানকার মাগীরা সকলেই ডাকিনী, দেশে আমরা ঐ কথাই শুনি, কিন্তু একটাও ডাকিনী তো এখানে চক্ষে দেখতে পেলেম না; ডাকিনীরা তবে থাকে কোথায়? অন্যদেশের পুরুষমানুষ কামিখ্যেয় এলে ভেড়া হয়, সে সব ভেড়াই বা কোথায় থাকে? যে সকল ভেড়া মাঠে চরে, পূর্ব্বে তারা মানুষ ছিল, এমন কোন চিহ্ন দেখা যায় না, সে সব মানুষ-ভেড়া তবে কোথায় চরে?”
প্রত্যয় অপ্রত্যয়, এই দুইটী সংশয়ের কথা। আমি বিশ্বাস করি না, অনেক লোকে বিশ্বাস করে, এ সমস্যার মীমাংসা কি প্রকারে হয়? যুধিষ্ঠিরের প্রশ্নে অনেকক্ষণ আমি চুপ কোরে থাকলেম। কামরূপের স্ত্রীলোকেরা মায়াজালে বিদেশী পুরুষগণকে বিমুগ্ধ কোরে রাখে, মায়ায় যারা বদ্ধ হয়, তারা আর দেশে ফিরে যায় না, যেতেও পায় না, এই কথাটা কতক পরিমাণে বিশ্বাসযোগ্য। পূর্ব্বে যেমন ছিল, এখন তেমন নাই, পাণ্ডারা এই কথা বলে। তারা আরো বলে, এখনো যে সকল বিদেশী পুরুষ একান্ত কামমোহিত, কামরূপের সুন্দরী সুন্দরী মেয়েমানুষ দেখে, লোভে পোড়ে তারাই বাঁধা পোড়ে যায়। মনে মনে এই সব আলোচনা কোচ্ছি, হঠাৎ একটা শ্লোক আমার মনে পোড়ে গেল। কাশীর আদালতে একজন কেরাণীর মুখে একদিন আমি সেই শ্লোকটা শুনেছিলেম। লোকটা প্রাচীন কি আধুনিক, সত্যচরিত্রদর্শী কোন কবির রচনা কিম্বা কোন রহস্যপ্রিয় নিন্দাকারী লোকের কুবুদ্ধি-রচনা, সে কথা আমি বোলতে পারি না, কিন্তু শ্লোক শুনে শুনে অনেক লোকে আমোদ করে। শ্লোকটা এই :—
“সধবা বিধবা নাস্তি, নাস্তি নারী পতিব্রতা।
হংসা পারাবতা ভক্তা, কামরূপনিবাসিনা॥”
এই শ্লোকের উপর আশুপ্রত্যয় রেখে, যুধিষ্ঠিরের প্রশ্নে আমি উত্তর কোল্লেম, “গল্প-কথা অনেক রকম হয়। ভেল্কীবাজী চক্ষে দেখা যায়, দেখে দেখে আশ্চর্য্যজ্ঞান হয়, কিন্তু কিছুই সত্য হয় না। কামরুপের স্ত্রীলোকেরা মায়াবিদ্যা জানে, এটা সত্য হোতে পারে, মায়ার কুহকে কামুক পুরুষগণকে ভুলিয়ে ভুলিয়ে রাখা, এটাও সত্য হোতে পারে, কিন্তু দ্বিপদ মনুষ্যকে চতুষ্পদ মেষরূপে পরিণত করা কখনই সত্য হোতে পারে না। কোন কোন লোকের মুখে আমি শুনেছি, কামরূপে ব্যভিচার কিছু প্রবল, এখানে পতিব্রতা সতী কম; সধবাও ব্যভিচারে রত হয়, বিধবারাও ব্যভিচারে রত হয়। তীর্থযাত্রীদলের ভিতর সুপুরুষ দর্শন কোল্লে এখানকার দুশ্চারিণীরা সেই সকল পুরুষকে হস্তগত করবার চেষ্টা করে, সম্ভবতঃ এই কথাই সত্য; সত্যডাকিনী কিম্বা সত্যভেড়া অসম্ভব কথা। মানুষেরা পশু হয়, পাখী হয়, বৃক্ষ হয়, পশুরা মানুষের মত কথা কয়, এ সকল অলৌকিক ব্যাপারে আমার বিশ্বাস হয় না।”
যুধিষ্ঠিরের মুখখানি একটু শুষ্ক শুষ্ক বোধ হোতে লাগলো; তার কথায় আমি যদি সায় দিতে পাত্তেম, রং দিয়ে দিয়ে তার মনের কথা যদি আমি বোলতে পাত্তেম, তা হোলে যুধিষ্ঠির আমোদ পেতো, এইরূপ ভাব আমি বুঝতে পাল্লেম। আমোদ পেলে না বোলে বেচারা ক্ষুণ্ণ না হয়, এই ভেবে শেষকালে আমি বোল্লেম, “দেখ যুধিষ্ঠির, আমরা এখানে অল্পদিন এসেছি, ডাকিনীরা কোথায় থাকে, সন্ধান জানতে পারি নাই, বাবু যদি আর মাসখানেক এখানে থাকেন, তা হোলে চেষ্টা কোরে কোরে একদিন একটা মায়াডাকিনী আমি তোমারে দেখাব।”
আহ্লাদে বদন বিকাশ কোরে, আহ্লাদের স্বরে যুধিষ্ঠির বোলে উঠলো, “দেখিও দাদা, দেখিও! ডাকিনী দেখতে আমার বড় সাধ! ডাকিনী দেখবার আশাতেই এখানে আমার আসা। সে আশা যদি না থাকতো, তা হোলে এই বৃদ্ধবয়সে কখনই আমি বাবুর সঙ্গে এ দেশে আসতে রাজী হোতেম না। দেখিও দাদা, দেখিও; বেশী না পারো, একটা ডাকিনী তুমি আমাকে দেখিও! কামরূপ-কামিখ্যায় এসে ডাকিনী না দেখে যদি অমনি অমনি ফিরে যাই, দেশে গিয়ে তবে গল্প কোরবো কি? দেশের লোকে আমাকে বোলবেই বা কি? তারা হয়তো মনে কোরবে, মানুষের আকারে আমি ভেড়া হয়ে রোয়েছি, সেইজন্য কিছু বোলতে পাল্লেম না। বড়ই লজ্জা পাব। দাদা, সে লজ্জা আমি রাখবার জায়গা পাব না। দেখিও তুমি, তোমার সোণার দোত-কলম হবে, পঞ্চাশ টাকা মাইনে হবে, তুমি রাজা হবে, দয়া কোরে একটা ডাকিনী আমাকে দেখিও তুমি!”
মনে মনে হেসে তারে আমি কিছু বোলবো বোলবো মনে কোচ্ছি, এমন সময় গম্ভীরবদনে সে আবার তাড়াতাড়ি বোলতে লাগলো, “কি বোলছিলে তুমি? বাবুর কথা? বাবু যদি এখানে বেশীদিন থাকেন, সেই কথা? সে জন্য ভাবনা নাই। বাবু আমার আশুতোষ; যা যখন আমি বলি, দুই ঠোঁট একত্র না কোরে, বাবু আমার তাই শুনেন, তাই করেন; আমার উপর বাবুর খুব অনুগ্রহ। তুমি বোলচো মাসখানেক, আমি তাঁকে ছমাস এখানে রাখতে পারবো, কোন ভাবনা নাই। তুমি যদি—”
বাবু এসে উপস্থিত। ব্যস্তসমস্ত হয়ে যুধিষ্ঠির আমার কাছ থেকে উঠে পালালো। সহাস্যবদনে বাবু আমারে জিজ্ঞাসা কোল্লেন, “পাগল এখানে কি কোচ্ছিল? রুপকথা বোলছিল বুঝি? কেবল রুপকথা! কেবল রুপকথা! একজন শুনিবার লোক পেলেই যুধিষ্ঠির অমনি রূপকথার জাহাজ খুলে দেয়। তাই বুঝি হোচ্ছিল?”
বাবু বোসলেন। অবকাশ পেয়ে আমি উত্তর কোল্লেম, “আজ্ঞা না, রুপকথা হেচ্ছিল না; যুধিষ্ঠির এখানে একটা ডাকিনী দেখতে চায়!”
উচ্চহাস্য কোরে বাবু বোল্লেন, “ভারী পাগল! যেটা যখন খেয়াল ধরে, অল্পে ছাড়ে না! তুমি কি বোলেছ? ক্ষেপিয়ে দিয়েছ বুঝি?”
নতমস্তকে আমি উত্তর কোল্লেম, “আজ্ঞা না, ক্ষেপাই নাই, স্তোক দিয়ে রেখেছি; একদিন একটা ডাকিনী দেখাবো, এইরুপ আশ্বাস দিয়ে ঠাণ্ডা কোরেছি। বোলেছি, শীঘ্র দেখা যায় না, একমাস এখানে থাকলে একটা ডাকিনী ধরা যেতে পারে।”
“মনসার কাছে ধূনার গন্ধ!”—পূৰ্ব্ববৎ হাস্য কোরে বাবু বোল্লেন, “মনসার কাছে ধূনার গন্ধ!—সত্যই তবে তুমি ক্ষেপাকে ক্ষেপিয়ে দিয়েছ!”—এই কথা বোলেই বাবু সহসা গম্ভীরভাব ধারণ কোল্লেন; গম্ভীরবদনে একটু একটু গুর্জ্জন কোরে বোল্লেন, “কথা বড় মিথ্যা নয়; ডাকিনী এখানে আছে! পাঁচ সাতটা ডাকিনী এই মাত্র আমাকে পেয়ে বোসেছিল! আরতি দেখে মন্দির থেকে আমি বেরিয়ে আসছি, বাহিরে যেখানে কুমারীরা দাঁড়ায়, সেইখানে পাঁচ সাতজন যুবতী পয়সা পয়সা কোরে আমার পথ আগলেছিল। পয়সা আমি দিতে গেলেম তারা খিলখিল কোরে হেসে আমার দিকে চক্ষু ঘুরাতে আরম্ভ কোল্লে! ঠাট-ঠমক, ভাব-ভঙ্গী, বক্রকটাক্ষ নূতন প্রকার! যতই এগিয়ে এগিয়ে আসি, চারিদিক বেষ্টন কোরে তারাও আমার সঙ্গে সঙ্গে ছুটে ছুটে আসে। বিপাকে ঠেকলেম! সাতজন;—সম্মুখে দুজন, দুপাশে দুজন দুজন চারজন, পশ্চাতে একজন। সকলেই যুবতী, সকলেই রূপবতী, সকলের চক্ষেই অনেক দূর পর্য্যন্ত কাজলের রেখা টানা, সকলের মাথায় এক প্রকার নূতন ধরণের খোঁপাবাঁধা, অঙ্গে বিচিত্র বসন, খোঁপাঘেরা ফুলের মালা, গায়ে কিছু কিছু গহনাও আছে; মনের ভাব ভাল নয়। পথে আমি একা ছিলেম না, আরো আট দশজন যাত্রীও আরতি দেখে বেরিয়েছিলেন। সকলের অগ্রেই আমি ছিলেম, তাঁরা কিছু পশ্চাতে ছিলেন, ডাকিনীরা আমারে ঘিরে ফেলেছে, আমাকে ধীরে ধীরে চোলতে হোচ্ছিল, যাত্রীরা পাশ কাটিয়ে চোলে যাবার পথ পাচ্ছিলেন না, পেলেও হয়তো তামাসা দেখবার জন্য ধীরে ধীরে আসছিলেন, আমি এক রকম সঙ্কটাপন্ন! পয়সা দিতে চাই, গ্রহণ করে না, সিকি দিতে চাইলেম, তবুও না; কেবল ফিক ফিক কোরে হাসে, কটাক্ষ হানে, আমার পথ আটকায়! কি যে তাদের মতলব, স্পষ্ট আমি বুঝতে পাল্লেম না। এই সময় সম্মুখদিক থেকে দুজন পাণ্ডা আমাদের নিকটে এসে উপস্থিত হোলেন। সে দুটী পাণ্ডা দিব্য সুশ্রী, দিব্য স্থূলাকার, দিব্য শান্ত। আমাকে তদবস্থ দর্শন কোরে তাঁদের মধ্যে একজন আসামের চলিতভাষায় উগ্রস্বরে কি গোটাকতক কথা বোল্লেন, ডাকিনীরা তখন কেমন এক রকম ভয় পেয়ে, আমাকে ছেড়ে অন্যদিকে ছুটে পালালো;—পয়সাও নিলে না, আমার দিকে আর ফিরেও চাইলে না। আমি পরিত্রাণ পেলেম।”
বাবুর কথা শুনে আমি হাসতে পাল্লেম না, তাঁর মুখের দিকেও ভাল কোরে চাইতে পাল্লেম না, কিন্তু তিনি রহস্যচ্ছলে গণিকাদলকেই ডাকিনী বোল্লেন, সেটা আমি বেশ বুঝতে পাল্লেম। ডাইনী, ডাকিনী, রাক্ষসী, পেত্নী ইত্যাদি যে সকল কুৎসিত কুৎসিত উপাধি আছে, চক্ষে না দেখলেও সে সকল উপাধিধারিণীকে ভয়ঙ্করী মনে হয়। রাক্ষসী পেত্নী কি রকম, এখনকার দিনে সে দুই মূর্ত্তি দেখা যায় না; ডাইনী ডাকিনীর আকৃতি বিভিন্ন নয়; সাধারণ স্ত্রীলোকেরা যেমন, তাদের আকৃতিও সেই প্রকার; কেবল কাৰ্য্য দ্বারা তাদের পরিচয় হয় মাত্র; কার্য্যশ্রবণে ভয়ের সঞ্চার হয়ে থাকে। বাবুর কথায় আমি কোন উত্তর দিলেম না, বাবুও আর সে প্রসঙ্গ তুল্লেন না।
সত্য সত্য একমাস আমাদের কামরুপে থাকা হলো। যুধিষ্ঠির মাঝে মাঝে আমারে উস্কে উস্কে দেয়, ডাকিনীদর্শনের একান্ত আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করে, অন্যপ্রকার কথায় আমি তাকে প্রবোধ দিয়ে রাখি। একদিন বোল্লেম, “ডাকিনী আছে, ডাকলে তারা আসে না, যেখানে সেখানে বেড়ায়ও না, তাদের সব স্বতন্ত্র স্বতন্ত্র আড্ডা আছে; যখন তাদের ইচ্ছা হয়, তখন তারা লোকালয়ে দেখা দেয়।” আড্ডার নাম শুনে যুধিষ্ঠির পলকশূন্যনয়নে আমার মুখের দিকে চেয়ে রইলো, বোধ হলো যেন একটু একটু কাঁপলো।
একদিন বৈকালে আমাদের বাসাঘরে বাবুর কাছে আমি বসে আছি, যুধিষ্ঠির অন্যান্য কাজে এদিক ওদিক ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে, এমন সময় ঝম ঝম শব্দে দুজন স্ত্রীলোক হাসতে হাসতে আমাদের সম্মুখে এসে দাঁড়ালো। পাঁচরঙা ঘাগরা পরা, বুকে কাঁচুলি, গলায় মালা, নাকে কাণে সাদা সাদা গহনা, কপালে টীপুলি, চক্ষে কাজল, এলোকেশী; সম্মুখদিকের দীর্ঘ দীর্ঘ কেশ কাণের দুপাশ দিয়ে বুকের নীচে পর্য্যন্ত ঝুলছে, মুখের আধখানা সেই চলে ঢাকা পোড়ে গিয়েছে, দেখতে মন্দ নয়।
ভাষাশিক্ষায় আমার বড় অনুরাগ। বাঙলাদেশে বাঙলাশিক্ষা, টোলবাড়ীতে কিছু কিছু সংস্কৃতশিক্ষা, বর্দ্ধমানে সর্ব্বানন্দবাবুর বাড়ীতে কতক কতক ইংরেজীশিক্ষা, কাশীতে চলনসই হিন্দিশিক্ষা, কামরূপে এসে কামরূপীদের কথা শুনে, এক একজন বাঙালী কামরূপীর উমেদারী কোরে ব্যাখ্যা শুনে, আসামী ভাষা কিছু কিছু আমি শিক্ষা কোরেছি। অনেক কথা বুঝতে পারি, ছোট ছোট দু-পাঁচটা কথা বোলতেও পারি, বাঙলা অক্ষরে পুঁথিলেখা কিছু কষ্টে ছত্র ছত্র পাঠ কোত্তেও পারি। বস্তুতঃ একমাসে যতটুকু হোতে পারে, তার চেয়ে বরং কিছু বেশী আমি শিখতে পেরেছি। যে দুটী স্ত্রীলোক আমাদের বাসায় এলো, চোক-মুখ ঘুরিয়ে মৃদু মৃদু হেসে, তাদের মধ্যে একজন আপনাদের জাতি ভাষায় বোল্লে, “খেলা দেখবে বাবু?”
সাজগোজ দেখে আমি মনে কোরেছিলেম, নর্ত্তকী, কথা শুনে মনে কোল্লেম, খেলা দেখাবে। কি রকম খেলা? না দেখলে বলা যায় না। কৌতুকে, আগ্রহে, কৌতুহলে, নীরবে বাবুর মুখপানে আমি চাইলেম। বাঙলাদেশের বাজীকরী বেদিনীদের যেমন সাজ, ঐ দুটী স্ত্রীলোকের সজ্জাতে তার কতক কতক ছায়া ছিল; তাই দেখে আমি মনে কোল্লেম, ইন্দ্রজালের খেলা; এরা কোন প্রকার আশ্চৰ্য্য আশ্চর্য্য ইন্দ্রজাল আমাদের দেখাবে। ইতিপূর্ব্বে যুধিষ্ঠিরকে যে কথা আমি বলেছিলেম, দৈবগতিকে সেই কথা যেন দৈববাণীর মত ফোলে গেল। ডাকলে ডাকিনী আসে না, ইচ্ছা হোলে আপনা হোতেই আসে, সেই স্তোকের কথাটাই ঠিক হলো; আপনা হোতেই একজোড়া ডাকিনী হঠাৎ এসে উপস্থিত।
দুজনেই দীর্ঘাকার, কিছু রোগা, মুখে লম্বা, নাক চ্যাপ্টা, কপাল চওড়া, দাঁত সাদা, একটু বড় বড়, বর্ণ শ্যামোজ্জ্বল, মুখে হাসি হাসি। দেখলে ভয় হয় না, কিন্তু আকারের দীর্ঘতায় ডাকিনী বোলেই বোধ হয়। বাবু তাদের দিকে চেয়ে বাঙলাকথায় জিজ্ঞাসা কোল্লেন, “কি খেলা তোমরা জানো? কি খেলা তোমরা দেখতে চাও?”
বাঙালী-সংসর্গে কামরুপের স্ত্রী-পুরষেরা অনেকটা বাঙলাকথা শিখেছিল, সেই দুটী স্ত্রীলোক বাঙলাতেই উত্তর কোল্লে, “ভেল্কী খেলা; অনেক রকম তামাসা।”—আমার অনুমান সত্য। খেলা দেখাও উপরপড়া হয়ে আমার এ কথাটা বলা ভাল দেখায় না, সতৃষ্ণনয়নে ঘন ঘন আমি বাবুর গম্ভীরবদন নিরীক্ষণ কোত্তে লাগলেম। বাবু তাদের হকুম দিলেন, “আচ্ছা খেলো; কি খেলা দেখাতে চাও, দেখাও।” খোটা খেমটাওয়ালীরা যেমন নাচে, প্রথমে তারা হেলে-দুলে নানা ভঙ্গীতে সেইরকম নাচ আরম্ভ কোল্লে; ঘুরে ঘুরে ঘাগরা তুলে তুলে খঞ্জনের মত নৃত্য কোত্তে লাগলো; একবার বসে, একবার দাঁড়ায়, একবার পশ্চাদ্দিক মাথা নীচু কোরে, শরীরখানা বাঁকিয়ে বাঁকিয়ে, আধশোয়া হয়ে তালে তালে বক্ষঃস্থল উঁচু কোত্তে লাগলো। হস্তপদ ভূমিলগ্ন, পৃষ্ঠদেশ শুন্যে অবস্থিত; আলুলায়িত দীর্ঘকুন্তল ভূমিস্পর্শী; সেই কেশপাশ বাতাসে উড়ে উড়ে মুখে চক্ষে বক্ষে ক্ষণে ক্ষণে নিক্ষিপ্ত হোতে লাগলো; কুম্ভকারের চক্র যেমন ঘোরে, এই নর্ত্তকীদের অষ্টাঙ্গ সেইরূপ বন বন শব্দে ঘুরতে লাগলো! আশ্চর্য্য শিক্ষা, আশ্চর্য্য নৈপুণ্যে! দেখে দেখে আমি মনে কোল্লেম, তাদের সৰ্ব্বাঙ্গের অস্থিগুলি, সংযোগস্থলগুলি যেন ভেঙে ভেঙে শিথিল হয়ে গিয়েছে, যে অঙ্গ যে দিকে ঘুরাতে ইচ্ছা করে, সেই অঙ্গ সেই দিকে ঘোরে, কোথাও বাধন আছে, এমন মনে হয় না। একরূপ নাচের নাম, পায়রা-লোটন। লক্কা-পায়রা যেমন পক্ষবিস্তার কোরে, গলা ফুলিয়ে, ঘুরে ঘুরে নৃত্য করে, এই নর্ত্তকীরা একবার সেই রকমের পায়রালোটন দেখালে। সত্যই যেন লোটন-পায়রা। চক্রবৎ ঘুর্ণনে সেই দুটী সুন্দরী নারীমূর্ত্তি তখন আমাদের চক্ষে যথার্থই যেন পক্ষীমূর্ত্তি বোধ হোতে লাগলো! চমৎকার অভ্যাস!
যুধিষ্ঠির কোথায় গেল? এমন সময় যুধিষ্ঠির উপস্থিত নাই, এমন নূতন রঙ্গটা যুধিষ্ঠির দেখতে পেলে না, আমার মনে আপশোষ উপস্থিত হলো। নৃত্য-অবসানে নর্ত্তকীদের কিয়ৎক্ষণ বিশ্রাম। কপালে, নাসাগ্রে, ওষ্ঠপটে, বিন্দু বিন্দু ঘর্ম্ম। বড় একখানা পাথরের উপরে তারা দুজনে বোসলো। তাদের বিরামকালে, বাবুর মুখের দিকে চেয়ে আমি একবার যুধিষ্ঠিরের অন্বেষণে উঠে গেলেম।
যুধিষ্ঠির তখন বাসায় ছিল না। কোথায় গিয়েছে, জানবার জন্য বাহির দরজার কাছ পর্য্যন্ত আমি গিয়েছি, দেখি, একখানা চিত্রপট হাতে কোরে যুধিষ্ঠির ছুটে ছুটে বাড়ীর দিকে আসছে। দরজাতেই দেখা হলো! আমি জিজ্ঞাসা কোল্লেম, “এ কি যুধিষ্ঠির! হাঁপাচ্ছ কেন? ছুটছিলে কেন? এখানি কিসের ছবি?” হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে যুধিষ্ঠির বল্লে, “কা—কা—কা—কামিখ্যের ছবি ডা—ডা—ডা—ডাকিনীর ছবি।”
তালে তালে মিলে গেল। উৎসাহ জাগাবার উত্তম সুযোগ পেলেম। ছবিখানা তার হাত থেকে টেনে নিয়ে, একবারমাত্র চক্ষু দিয়ে, শীঘ্র শীঘ্র আমি বোল্লম, এ সব তোমার আঁকা ডাকিনী; জয়ন্তী ডাকিনী একজোড়া এসেছে। একটা দেখবে বলেছিলে, একেবারে একজোড়া! কতকরকম রঙ্গ কোচ্ছে, কেমন ভঙ্গীতে কত রকমের নাচ দেখাচ্ছে, আমি তোমাকে খুঁজে খুঁজে বেড়াচ্ছি। চল, চল, শীঘ্র চল, বাবুর কাছে তারা বসে আছে, দেখবে এসো।”
যুধিষ্ঠিরকে সঙ্গে নিয়ে নাচের আসরে আমি উপস্থিত হোলেম। নর্ত্তকীরা বেশ ঠাণ্ডা হয়ে বোসে বোসে বাবুর সঙ্গে কি সব কথা কোচ্ছিল। আমারে দেখে একটু হেসে বাবু বোল্লেন, “কোথা গিয়েছিলে হরিদাস? তোমার নাচওয়ালীরা ধৈর্য্য রাখতে পাচ্ছে না, এইবার খেলা দেখাবে বোসো।”—আড়চক্ষে একবার যুধিষ্ঠিরের দিকে চেয়ে মৃদু হেসে চুপি চুপি বাবু আবার বল্লেন, “এই যে পাগলটীকে ধোরে এনেছ, বেশ হয়েছে। বোসো।”
আমি বোসলেম। নর্ত্তকীদের দিকে চেয়ে, যুধিষ্ঠির ফুল্লবদনে চুপটী কোরে একধারে দাঁড়িয়ে থাকলো; ছবিখানি আমি আমার নিজের কাছেই রেখে দিলেম। নর্ত্তকীরা এখন আর নর্ত্তকী নয়, নিজমূর্ত্তি ধারণ কোল্লে। সঙ্গে বাদ্যযন্ত্র ছিল না, করতালিতেই তালে তালে সঙ্গত কোরে মনের মত গীত ধোল্লে; রাগিণীযুক্ত সঙ্গীত নয়, সুরে সুরে মন্ত্রপাঠ। প্রথম ক্রীড়া ক্ষুদ্র একটী সিংহশাবক। একজনের ঘাগরার ভিতর সেই শাবকটী লুকানো ছিল, মন্ত্রের আকর্ষণে সেই শাবক আমাদের সম্মুখে এসে নেচে নেচে খেলা কোত্তে আরম্ভ কোল্লে; ভাল ভাল কাবুলী বেড়াল যত বড় হয়, এই সিংহশাবক ঠিক তত বড়। এক একবার বাজীকরীর দিকে ছুটে ছুটে যায়, লাফ দিয়ে দিয়ে বুকে উঠে, কাঁধে উঠে, মাথায় চড়ে, মাথার উপর থেকে হেঁট হয়ে বাজীকরীর কাণে কাণে মানুষের মত কথা কয়, আবার লাফিয়ে এসে আমাদের সম্মুখে নাচে। সকৌতুকে আমি জিজ্ঞাসা কোল্লেম, “বাজীকরি! তোমার এ সিংহশিশু, তোমারে কামড়ায় না?”—ফিক কোরে হেসে বাজীকরী বোল্লে, “কামিখ্যেদেবীর আজ্ঞায় এখানকার সিংহ-ব্যাঘ্রেরা কাকেও কামড়ায় না। দেখবে তুমি, নেবে তুমি, খেলবে তুমি?—এই লও!”—এই কথা বোলেই বাজীকরী দুই হাতে সেই সিংহশিশু ধোরে আমার কোলে দিতে এলো। আমি একটু পেছিয়ে বোসলেম। কৌতুকের সঙ্গে একটু ভয়। নয়ন ঠেরে হাসতে হাসতে কি সব মন্ত্র বোলে নৰ্তকী সেই ক্ষুদ্র সিংহশাবককে আমার গায়ে ফেলে দিলে, আতঙ্কে আমি লাফিয়ে উঠলেম। আশ্চর্য্য ব্যাপার! কোথায় বা সিংহশাবক, কোথায় বা সেই যুগল নর্ত্তকী! কোথাও কিছু নাই; দিব্য একটী ময়ূর আমার স্কন্ধের উপর প্যাকম ধোরে বোসে আছে, এইরূপে দেখা গেল! বাবুর কোলেও সেই রকম একটী, যুধিষ্ঠিরের মাথার উপরেও সেই রকম একটী! বাবুর কোলের ময়ুরীকে হস্ত দ্বারা বাবু একবার স্পর্শ কোল্লেন, ময়ুর উড়ে গেল! একসঙ্গে তিনটীই উড়ে গেল! হতবুদ্ধি হয়ে আমরা চেয়ে থাকলেম!
তখনি তখনি সেই সহাস্যবদনা নর্ত্তকীরা হাসতে হাসতে আমাদের কাছে এসে, দুখানি দুখানি হাত পেতে, সুমিষ্টবচনে বোল্লে, “বাবু আমাদের ময়ূর দাও! আমাদের সিংহ দাও। তারা আমাদের খেলার জিনিস।”
আমি তো কথা কোইতে পাল্লেমই না, অল্পক্ষণ ইতস্ততঃ কোরে বাবু বোল্লেন, “তোমাদের সিংহ পালিয়ে গিয়েছে, ময়ূরেরা উড়ে গিয়েছে।” কটাক্ষ ঘুরিয়ে, ফিক ফিক কোরে হেসে, করতালি দিয়ে, একজন বাজীকরী বোল্লে, “সে কি কথা বাবু! তোমার কোলে ময়ূর, ছেলেবাবুর স্কন্ধে ময়ূর, বুড়ার মাথায় ময়ূর, তুমি বল উড়ে গিয়েছে?”
তাজ্জব ব্যাপার! সত্যই দেখি তাই, একটু পূর্ব্বে ছিল না, এখন আবার কোথা থেকে এসে সেই তিন ময়ূর সেই সেই জায়গায় প্যাকম ধোরে বোসে আছে! ময়ূর এলো, সিংহশিশু এলো না।
বাজীকরীরা এই সময় উভয়েই অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে, জোরে জোরে করতালি দিলে, জোরে জোরে মন্ত্রপাঠ কোল্লে; সেই দিকে আমরা চেয়ে দেখি, নানাবর্ণের বৃক্ষলতা-শোভিত ছোট একটী বাগান গড় গড় কোরে আমাদের সম্মুখদিকে চোলে আসছে। বাগান এলো। অনেক রকম গাছ, অনেক রকম লতা, অনেক রকম ফল, অনেক রকম ফুল সেই বাগানের সম্পত্তি। গাছে গাছে কত প্রকার পক্ষী, বাজীকরীদের ইঙ্গিতে সেই সকল পক্ষী মধুরস্বরে গান ধোল্লে; নরকণ্ঠের সঙ্গীতে যে প্রকার স্পষ্ট স্পষ্ট বাক্য, সেই সকল মায়াতরুর শাখায় শাখায় পক্ষীকণ্ঠেও সেইরুপ স্পষ্টবাক্য আমরা শ্রবণ কোল্লেম। আমাদের অঙ্গের ময়ূরেরা সেই বাগানে উড়ে গেল। ময়ূরের কেকারব কর্কশ, কিন্তু আমরা শুনলেম, ময়ূরকণ্ঠে সুস্বর, মধুর সঙ্গীত!
ক্রমশই আমার মোহ উপস্থিত হোতে লাগলো। সত্য দেখছি কি ভেল্কী দেখছি সে ভাবটা মনেই এলো না। ডাকিনী-দর্শনাকাঙ্ক্ষী যুধিষ্ঠির গালে হাত দিয়ে স্থিরনয়নে এককালে নিৰ্ব্বাক। বাবু কেবল মায়ার প্রভাব বিবেচনা কোরে নয়ন দ্বারা আশ্চর্য্য বিজ্ঞাপন কোচ্ছিলেন, আমার মত তাঁর মোহ জন্মে নাই।
আবার এ কি! কোথায় গেল বাগান, কোথায় গেল তরুলতা, কোথায় গেল ফুলকুল, কোথায় গেল পক্ষিকুলের সুরলহরী! কিছুই নাই! কিছুই নাই! সম্মুখে এক পদ্মসরোবর! প্রস্ফুটিত পদ্মফুলে সমস্ত জল ঢাকা; ভিতরের জল-হিল্লোলে পদ্মফুলগলি কাঁপছে, কম্পিত পদ্মে পদ্মে চঞ্চল মধুকরেরা উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে, চতুর্দ্দিক সহসা সুগন্ধে আমোদিত। বাজীকরীরা আমাদের দৃষ্টিপথের অগোচর। সরোবরের যে কূলে আমরা, সেই কূলে শ্বেতপাথরের বাঁধা একটী মনোহর ঘাট; সেই ঘাটের চাতালে অপরূপ-রূপ-যৌবনসম্পন্ন যুগলমূৰ্ত্তি;—একটী যুবাপুরুষ, একটী যুবতী। সরোবরের দিকে আমরা চেয়ে আছি, সরোবরের জল পদ্মফুলে ঢাকা, দেখতে দেখতে অনেকগুলি পদ্মফুল ঘাটের সম্মুখ থেকে সোরে সোরে গেল, প্রায় পাঁচ হাত পরিমাণ স্থানে নির্ম্মল জল দেখা গেল; সেই যুগলমূৰ্ত্তি সেই নিৰ্ম্মলজলে অবগাহন কোল্লে। যখন তারা উঠলো, তখন দেখলেম, তারা নয়। আর একটী সুন্দর কামিনী; সেই কামিনীর এক হস্তে একগাছা নিম্বকাষ্ঠের যষ্টি, অন্য হস্তে একগাছা রজ্জু; সেই রজ্জুপ্রান্তে মস্ত একটা ভেড়া বাঁধা।
কামরূপের কামিনীরা বিদেশী পুরুষকে ভেড়া করে, মায়ার কৌশলে কামরূপের কামিনীরা তাই-ই আমাদের দেখালে। যারা দেখালে, তারা কোথায় গেল, অনেকক্ষণ দেখতে পেলেম না; সরোবরের দিকে চেয়ে থাকলেম। সরোবর-সোপানে সেই সুন্দরী আর সেই রজ্জবদ্ধ ভেড়াটা। ঘাটের নিকট থেকে যে পদ্মফুলগুলি সোরে গিয়েছিল সেগুলি আবার ফিরে এসে অনাবৃত জলাংশ সমাবৃত কোরে দিলে। আর একটী আশ্চৰ্য্য দেখলেম। পদ্মপুকুরে পদ্মফুল আছে, পদ্মপত্র একটীও নাই! জলের উপর কেবল ফুলে ফুলে যেন মালাগাঁথা! অতি চমৎকার ইন্দ্রজাল।
আর নাই! সরোবর নাই! পদ্ম নাই! মধুকর নাই! সুন্দরী নাই! সুন্দরীর হাতে রজ্জুতে নিবন্ধ ভেড়াটাও নাই! সব ফাঁক! সব শূন্য! মনে মনে আমি অনেক রকম বিতর্ক কোচ্ছি, এমন সময় আর একদিক থেকে সেই দুই বাজীকরী হাসতে হাসতে সম্মুখে এসে দেখা দিলে। বাবুকে নমস্কার কোরে তারা একবার করযোড়ে উর্দ্ধদৃষ্টিতে আকাশপথ নিরীক্ষণ কোল্লে। একজন বোল্লে, “আমাদের আর একটী খেলা আছে; সে খেলার নাম ‘আপনাদের ভবের খেলা।’ যদি আজ্ঞা হয়, ভবের খেলটা খেলিয়ে যাই।”
ভবধামে মানুষেরা যে সব খেলা করে, সেই খেলাই তো ভবের খেলা; সেই খেলাই তো ভেল্কীখেলা। পেশাদার ভেল্কীওয়ালীরা কোন ভাবে আবার ভবের খেলা দেখাতে চায়, ভাবটা সংগ্রহ কোত্তে আমার বড় কৌতুক জন্মিল; বাবুও এই খেলায় ভবের খেলা দেখবার জন্য আগ্রহ প্রকাশ কোরে বাজীকরীদের আজ্ঞা দিলেন।
খেলা আরম্ভ। পাঠকমহাশয়েরা ছায়াবাজী দর্শন কোরেছেন, ছায়াবাজীর কৌশল বুঝতে পারা যায়, কিন্তু এই বাজীকরীরা যে রকমে ভবের খেলা দেখাল, সে খেলার কোন কৌশল বুঝতে পারা গেল না। তারা দুজনে লুকিয়ে গেল। আমাদের সম্মুখে কি যেন স্বচ্ছ আবরণ লম্বে লম্বে স্থাপিত হলো;— দর্পণের ন্যায় স্বচ্ছ সেই আবরণের ভিতরদিকে সারি সারি নরনারী। পদাঙ্কুলী থেকে কণ্ঠদেশ পর্য্যন্ত দর্শন কোরে আর যদি উর্দ্ধদিকে নেত্র উত্তোলন করা না যায়, তা হোলে ঠিক দেখা যায়, নরনারী, কিন্তু মুখগুলি দেখলে ভয়ে বিস্ময়ে গাত্র রোমাঞ্চিত হয়। বাঘের মুখ, সাপের মুখ, শেয়ালের মুখ, বানরের মুখ, ভল্লকের মুখ, রাক্ষসের মুখ, কাকের মুখ, শকুনির মুখ, হাড়গিলার মুখ, পেঁচার মুখ ইত্যাদি নানাপ্রকার পশু-পক্ষীর মুখ সেই সকল নরনারীর স্কন্ধের উপর সংলগ্ন। হাতী, ঘোড়া, গাধা, উট, বৃষ—তা ছাড়া ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ইঁদুর, চুঁচো, কাঠবিড়াল প্রভৃতির মুখেও এক একটা অবয়বের উপর দেখা গেল। অচল পতুল নয়, সকলগুলোই যেন সজীব-সচল। অত মুখের ভিতর সিংহের মুখে আর কুকুরের মুখ দেখা গেল না। ভূত আমরা কখনো দেখি নাই, খানকতক মুখ কালো কালো বিকটাকার; কিসের মুখে, আমরা চিনতে পাল্লেম না। যুধিষ্ঠির বোল্লে ভূত। যা-ই হোক, সেই সকল মূৰ্ত্তি এক একবার হাঁ করে, এক একবার কলহ করে, এক একবার নাচে, এক একবার লাফায়, এক একবার হাসে, এক একবার কাঁদে, এক একবার কথা কয়;— মানুষের মতন কথা। একটু পরে দেখলেম, মূর্ত্তিরা সারিবন্দী ছিল, ছড়িভঙ্গ হয়ে গেল। এক একটা পুরষ এক একটা মেয়েমানুষ ধোরে টানাটানি আরম্ভ কোল্লে; মেয়েমানুষগুলো এক একবার চেঁচিয়ে উঠলো, পরক্ষণেই আবার হাসি-তামাসা জুড়ে দিলো! দুই তিনজন একত্র হয়ে একজনের কাপড়ের গাঁঠরী চুরি কোরে নিয়ে ছুটলো, পুলিশের মত পোষাকপরা দুই মূর্ত্তি এসে তাদের বেঁধে ফেল্লে, তার পর কাণে কাণে কি পরামর্শ কোরে তখনি আবার ছেড়ে দিলে! সংসারী মানুষেরা সচরাচর যে সকল কাজ করে, খেলার ভিতর সবরকম আমরা দেখলেম; চোর, ডাকাত, জুয়াচোর, গাঁটকাটা, যারা যারা সংসারের শত্রু, তাদেরও লীলাখেলা দেখলেম, হাসিখুসী দেখলেম, কি মন্ত্রে তারা পুলিসের লোককে বল করে, তাও তাদের মুখে শুনলেম। যা যা দেখি, যা যা শুনি, সকলই যেন সত্য সত্য মনে হয়। রাজা দেখলেম, রাজমন্ত্রী দেখলেম, রাজার পোষাক দেখলেম, অলঙ্কার দেখলেম, মন্ত্রীর মন্ত্রণা শুনলেম। রাজার মুখখানা বাঘের মুখ, মন্ত্রীর মুখখানা শিয়ালের। দুই একবার ঘুরে এসে সেই রাজা আর একরকম হয়ে গেল। রাজবেশ কোথায় গেল, কটিতটে মলিন কৌপীন, অঙ্গে খড়ি, তৈলাভাবে রুক্ষচুল, ক্ষৌরাভাবে শুষ্কমুখ, কদাকার; হস্তে ভিক্ষাপাত্র! শৃগালমন্ত্রী রাজবেশে সমুজ্জ্বল!
প্রায় দুইঘণ্টা এইরকম খেলা। সকল মূর্ত্তি চোলে চোলে বেড়াচ্ছিল, পর পর পাঁচ সাতটা মুর্ত্তি শুয়ে পোড়লো, একটা বাঁশী বেজে উঠলো, বাঁশী গাইলে, “এই সব লোকের ভবের খেলা ফুরিয়ে গেল!” মত্যু!—ভবধামে মত্যু অহরহ ঘুরে বেড়ায়, জীবের কেশাকর্ষণ কোল্লেই জীবের ভবের খেলা ফুরিয়ে যায়।
ভবের খেলা সাঙ্গ হলো। খেলা আমি দেখলেম, সব খেলাতে কিন্তু সমান মনোযোগ থাকলো না। সংসারে কারে আমি বেশী ভয় করি, বাজীকরীরা সে তত্ত্ব জানতো না, কিন্তু আশ্চর্য্য! যে মূর্ত্তির মুখখানা বানরের মত, সেই মূর্ত্তি দর্শন কোরেই আমার মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল;—মুখখানা ঠিক যেন সেই রক্তদন্তের মুখ! অপরাপর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ রক্তদন্তের মত নয়, তবুও সেই মুখখানা দেখে আমার ভয় হয়েছিল। খেলা যখন সাঙ্গ হয়ে গেল, তখন আমি সেই দিকে চাইলেম। কোথাও কিছু নাই, যেমন ফাঁকা জায়গা, সেই রকম পরিষ্কার। কেবল সেই দুটী বাজীকরী হাত-ধরাধরি কোরে নাচতে নাচতে হাসতে হাসতে আমাদের সম্মুখে এসে, নতমস্তকে অভিবাদন কোল্লে। একজন বল্লে, “সংসার ফক্কিকার! ভবের খেলা এই প্রকার। ভবক্ষেত্রে যারা চরে, দেখতে মানুষের মতন গঠন হোলেও সকলে তারা মানুষ নয়। আমাদের ভবের খেলায় যার যে রকম মুখ দেখলেন, তারা সব সেই রকমের স্বভাব ধরে। সত্য যাঁরা সত্যমানুষ, তাঁদের নাম সাধু-মানুষ; আমাদের মায়ার ঘরে আমরা তাঁদের আনতে পারি না!”—এই কথা বোলেই দুজনে আবার নতমস্তকে বক্ষঃস্থলে অঞ্জলি বদ্ধ কোরে আমাদের উভয়কে—বাবুকে আর আমাকে হাসতে হাসতে নমস্কার কোল্লে। বাবু তাদের বিস্তর তারিফ দিয়ে প্রত্যেককে পাঁচ পাঁচটী টাকা বকসীস দিলেন। পুনরায় নমস্কার কোরে তারা বিদায় হয়ে গেল।
কি যেন বোলবে বোলবে মনে কোরে যুধিষ্ঠির ঘন ঘন আমার দিকে চাইতে লাগলো, বাবু নিকটে ছিলেন বোলে কিছু বোলতে পাল্লে না। একটু পরেই সন্ধ্যা হলো। জামা-চাদর গায়ে দিয়ে একগাছি ছড়ী হাতে কোরে বাবু আমারে জিজ্ঞাসা কোল্লন, “যাবে হরিদাস?”—আমি উত্তর কোল্লেম, “আজ্ঞা না, আজ আর আমি কোথাও যাব না। খেলাটা দেখে মন কেমন বিচলিত হয়েছে, কেন জানি না, কিছুই যেন ভাল লাগছে না।” বাবু আর কিছু বোল্লেন না, ধীরে ধীরে বাড়ী থেকে বেরিয়ে, একাকী কামাখ্যাদেবীর আরতি দেখতে চোলে গেলেন।
বাবুর সঙ্গে আমি গেলেম না, তার একটা কারণ ছিল। যুধিষ্ঠিরকে নিয়ে একটু রঙ্গ করা যাবে, সেইটীই আমার ইচ্ছা, সেই জন্যই গেলেম না। সন্ধ্যাকালের কাজকর্ম্ম সমাপন কোরে, যুধিষ্ঠির এসে আমার কাছে বোসলো। যুধিষ্ঠির বড় আমুদেলোক; সেদিন আমি কিন্তু তার স্বভাবে কিছু ভাবান্তর দেখলেম। অন্য অন্য দিন তার বদন যেমন প্রফুল্ল থাকে, সেদিন তখন তেমন নয়; মুখখানি কিছু, বিমর্ষ। বিনা আহ্বানে আপনা হোতে যখন এসে বোসেছে, তখন অবশ্যই কিছু বোলবে, এইটী স্থির বুঝে প্রথমে কোন কথা আমি উত্থাপন কোল্লেম না; কিয়ৎক্ষণ ইতস্ততঃ কোরে যুধিষ্ঠির বল্লে, “ডাকিনী তো বেশ সুন্দর হয়। দেশে আমি যখন ডাকিনীর গল্প শুনতেম, তখন ভাবতেম, ডাকিনী বুঝি রাক্ষসীদের মতন ভয়ঙ্করী; তা তো নয়, কামিখ্যার ডাকিনী, যে দুটী এখানে এসেছিল, তারা তো খুব ভাল! কেমন হাসলে কেমন নাচলে, কেমন নমস্কার কোল্লে, বেশ ডাকিনী! খেলাগুলিও খুব চমৎকার দেখিয়ে গেল। মানুষের শরীরে কতরকম জানোয়ারের মুখ! ওরা সব পারে! গাছচালা ডাকিনী, ভেড়া-করা ডাকিনী, ভূতধরা ডাকিনী, সব তবে ঠিক কথা! তুমি যদি আর একটু বড় হোতে, তা হোলে তোমার সঙ্গে বিয়ে দিয়ে, বাজনাবাদ্দি কোরে, ঐ রকমের একটা সুন্দরী ডাকিনীকে আমি দেশে নিয়ে যেতেম।”
যদি হাসি, যুধিষ্ঠির কি মনে কোরবে, অথচ না হেসেও থাকা যায় না, মাথা নীচু কোরে একটু হেসে, মুখ তুলে প্রশান্তস্বরে আমি বোল্লেম, “তুমি তো আমার চেয়ে অনেক বড়, তুমি কেন একটী ডাকিনীকে বিয়ে কোরে, সঙ্গে নিয়ে দেশে চল না? সত্য যুধিষ্ঠির তাই তুমি কর;—তুমিই একটা ডাকিনীকে বিয়ে কোরে ফেলো।”
অঙ্গসঞ্চালন কোরে শঙ্কিতবদনে যুধিষ্ঠির বোলে উঠলো, “বাপরে! সে কর্ম্ম ছিল আমার? রাম রাম রাম! ডাকিনীরা ভূত নামায়, ভূত চালে, আমি বুড়োমানুষ, কোন দিন একটা ভূত চেলে নিয়ে গিয়ে আমার ঘাড় ভেঙে ফেলবে, আমার ছেলেপুলে অনাথ হয়ে পোড়বে! আমি পারবো না! তুমি নবীন ছোকরা, দিব্য সুন্দর, কার্ত্তিকের মতন রূপ, তোমার রূপে রূপসী ডাকিনী মোহিত হয়ে যাবে, তোমার কাছে আর ভূত চেলে আনবে না। তুমিই বিয়ে কর! যে দুটী এসেছিল, সে দুটী কিছু ডাগোর ডাগোর, তাদের চেয়ে একটু ছোট দেখে, আরো কিছু সুন্দরী দেখে, তুমি একটী ডাকিনীকে বিয়ে কর। বলো যদি, বাবুকেও আমি সুপারিস কোত্তে পারি।”
এইবার আমি যুধিষ্ঠিরের মুখের উপর হাস্য কোল্লেম; তখনি আবার গম্ভীরভাব ধারণ কোরে ধীরে ধীরে জিজ্ঞাসা কোল্লেম, “আচ্ছা যুধিষ্ঠির, বার বার তুমি ভূতের কথা আনছো, ভূতের ভয়ে কাঁপছো, বাজীকরদের খেলার সময়েও ভূতের মুখ দেখতে পেয়েছিলে; আচ্ছা যুধিষ্ঠির, ভূত কি তুমি দেখেছ?”
একখানা হাত উঁচ কোরে তুলে, মুখখানি একটু বিকৃত কোরে, কম্পিতকণ্ঠে যুধিষ্ঠির বোলে উঠলো, “রাম রাম রাম! তা আর আমি দেখিনি? একবার কি কতবার!–বেলগাছে ভূত থাকে, নিমগাছে ভূত থাকে, চাঁপাফুলের গাছে ভূত থাকে, শ্মশানঘাটের আশে পাশে ভূত থাকে, মুসলমানের গোরস্থানে বড় বড় মামদো থাকে, কতবার আমি দেখেছি! রাম—রাম—রাম! —একটা গল্প বলি শোনো!—একদিন ভোরবেলা আমি বাবুদের বাগানে ফুল তুলতে গিয়েছিলেম।—বাগানে একটা পুকুর আছে,—শাণবাঁধানো ঘাট;—ঘাটের দুপাশে দুটো চাঁপাফুলের গাছ। যাচ্ছি, আর দশ-পা এগুলেই চাঁপাতলায় যেতে পারি, —রাম—রাম—রাম! এমন সময় দেখি, একটা চাঁপাগাছে থেকে একজন নামলো;—বাপ রে!—মনে কোল্লে এখনো গা কাঁপে! রাম—রাম—রাম! —চাঁপাগাছ থেকে নামলো;—পায়ে খড়ম, দিব্যি কোঁচানো তসর-কাপড় পরা, গলায় ধপধপে সাদা গোচ্ছা পৈতে, হাতে একটা গাড়ু;—বেম্মদত্তিভূত! রাম—রাম—রাম!—দিব্য গৌরবর্ণ, নাদুস-নুদস ভুড়ি, ঘাড়ের দিকে খোঁপা কোরে চুলবাঁধা, গোঁফ-দাড়ী কমানো। বেম্মদত্তিরা নাপতে কোথায় পায়, তা আমি বোলতে পারি না, কিন্তু কামানো!—খট খট কোরে খড়মের শব্দ হোতে লাগলো, বেম্মদত্তিঠাকুর বাঁধাঘাটের সিঁড়ি দিয়ে জলের ধারে নামলো, খড়মজোড়াটা খুলে রাখলে না, খড়ম পায়ে দিয়েই একবুক জলে বারকতক ডুব দিলে। তফাৎ থেকে আমি দেখছি, গুর গুর কোরে বুক কাঁপচে, একটা কাঁঠালগাছের আড়ালে লুকিয়ে আছি, এক একবার উঁকি মেরে দেখছি;—বেম্মদত্তি উঠলে; তসরকাপড় একটুও ভিজলো না, মাথার চুলেও জল দেখা গেল না, হাতে সেই গাড়ু। তখনো ভোর;—একটু একটু ফর্শা;—বেশ দেখা যাচ্ছে।— বেম্মদত্তি একটা ধাপের উপর যোগাসনে বোসলো, হাতমুখ নেড়ে নেড়ে সন্ধ্যা-আহ্নিক কোল্লে, তার পর আবার খট খট কোরে চোলে এসে চাপাগাছে উঠে গেল। আর আমি দেখতে পেলেম না; গাছের সঙ্গে যেন মিলিয়ে গেল! আর আমার ফুলতোলা! ভয়েই আমি আড়ষ্ট! সাজিটী হাতে কোরে কাঁপতে কাঁপতে ছুটে পালালেম। ধর্ম্মে ধর্ম্মে রক্ষা পেলেন! বেম্মদত্তি ভূতেরা ভালমানুষ হয়, না দোষে মানুষকে কিছু বলে না, অন্যভূত হোলে আমাকে আর! ঘরে ফিরে আসতে হতো না; ঘাড় ভেঙে সেইখানেই আমার দফা নিকেশ কোরে দিতো।
মূর্ত্তিমান ব্ৰহ্মদৈত্যের গল্পে কৌতুকী হয়ে আমি জিজ্ঞাসা কোল্লেম, “আর কোথাও আর কোন রকম ভূত তুমি দেখেছ?”
হাঁ কোরে আমার মুখের দিকে চেয়ে ভয়াতুর ভূতবক্তা বোলে উঠলো, “ও বাবা! আবার বলে ভূতের কথা! কি ডাকাবুকো ছেলে বাপ! বোল্লেম তো, কতবার কত জায়গায় কত ভূত আমি দেখেছি, একটা বেম্মদত্তির কথা শুনিয়ে দিলেম, তাতেও কি ভয় হলো না? রাম— রাম— রাম! —ভূতের কথা কেন তোলো? হচ্ছিল বিয়ের কথা, ভূতের কথা কেন এলো? আর আমি বোলতে পারবো না। আর বোল্লে রাত্রে আমার আর ঘুম হবে না! বিয়ের কথা বলো। যা আমি বোলছিলেম, তাতেই রাজী হও;—ভাল দেখে ছোটরকম একটা ডাকিনীকে তুমি বিয়ে কোরে ফেলো।”
ঘেঁটিয়ে ঘেঁটিয়ে আরো কিছু আমি শুনবো, এই রকম ইচ্ছা ছিল, আর শুনা হলো না; বাবু এসে পোড়লেন, যুধিষ্ঠির উঠে গেল।
জামা-চাদর খুলে রেখে, একটু স্থির হয়ে বোসে, বাবু হাসতে হাসতে আমাকে জিজ্ঞাসা কোল্লেন, “আজ আবার কিসের গল্প জুড়েছিল?”—আমি উত্তর কোল্লেম, ভূতের গল্প, ডাকিনীর গল্প আর বিয়ের গল্প। ডাকিনী দেখে যুধিষ্ঠির বড় খুসী হয়েছে, যারা এখানে নেচে গেল, ভেল্কী দেখিয়ে গেল, যুধিষ্ঠির তাদের ডাকিনী স্থির কোরেছে। একটু রঙ্গ করবার জন্য আমি তারে বোলেছিলেম, “তুমি একটা ডাকিনী বিয়ে কোরে দেশে নিয়ে চল। যুধিষ্ঠির বোল্লে, “আমি বুড়োমানুষ, ডাকিনী আমাকে ভেড়া বানিয়ে ফেলবে, আর আমি দেশে যেতে পাব না, ছেলেপিলে অনাথ হবেন।”
বাবু একটু হাস্য কোরে বোল্লেন, “পাগলকে তুমি ও রকমে ক্ষেপাও কেন? একটা কিছু সূত্ৰ পেলেই পাগলেরা অনেক কথা এনে ফেলে। ভূতের গল্প যুধিষ্ঠির অনেক জানে আমরা তার মুখে অনেক রকম ভূতের গল্প শুনেছি। আমাদের দেশে এমন অনেক লোক আছে, একজনের মুখে ভূতের কথা, বাঘের কথা, রোগের কথা কিম্বা সর্পাঘাতের কথা শুনলেই তারা সকলেই মুখে মুখে অনেক আজগুবী আজগুবী গল্প আরম্ভ করে। সকলেই যেন সৰ্ব্বজ্ঞ, সকলেই যেন ভূত দেখেছে, সকলেই যেন বাঘের মুখ থেকে মানুষ ছাড়িয়ে নিয়েছে, সকলেই যেন ধম্মাকাসযুক্ত রোগীকে চব্বিশঘণ্টায় আরাম কোরেছে, সকলেই যেন সর্পাঘাতে মরা মানুষকে বেঁচে উঠতে দেখেছে, এই রকম ভাব জানায়; আমার যুধিষ্ঠিরটী সেই দলের একজন। তুমি আর তার কাছে ভূতের কথা তুলো না।”—এই পর্য্যন্ত বোলে, কি যেন ভেবে, বাবু আমাকে জিজ্ঞাসা কোল্লেন, “আচ্ছা হরিদাস, ভূতের কথায় তোমার কি বিশ্বাস হয়?”
বিনা চিন্তায় আমি উত্তর “কথায় বিশ্বাস হয় না, কিন্তু খানকতক পুস্তক পাঠে জানতে পেরেছি, পৃথিবীর সকল দেশেই ভূতের নাম, ভূতের অস্তিত্ব, ভূতের গল্প চিরদিন প্রচলিত আছে। গল্প আছে, কিন্তু ভূতেরা আকার ধারণ কোরে মানুষকে পায় কিম্বা মানুষের ঘাড় ভাঙে, এরূপ গল্পে আমার বিশ্বাস হয় না।”
বাবু হাস্য কোল্লেন; আবার কিয়ৎক্ষণ চুপ কোরে থেকে আবার জিজ্ঞাসা কোল্লেন “ডাকিনী?—ডাকিনীতে তোমার বিশ্বাস আছে?”
কেন এ প্রকার প্রশ্ন, ভাব বুঝতে পাল্লেম না; তথাপি উত্তর কোল্লেম, “কামাখ্যার ডাকিনীর কথা অনেক লোকেই বলে, আমিও কামাখ্যা দর্শন কোল্লেম, মূর্ত্তিমতী ডাকিনী— যাদের মুক্তি দেখলে ভয় হয়, তেমন ডাকিনী একটাও দেখা গেল না, বোধ করি, সে রকম ডাকিনী এখন এখানে নাই; পূর্ব্বে হয় তো ছিল, এখন হয় তো তাদের বংশলোপ হয়ে গিয়েছে। এখন যারা আশ্চর্য্য আশ্চর্য্য ইন্দ্রজাল দেখায়, লোকের মুখে তারাই হয় তো ডাকিনী।”
বাবুকে এই কথাগুলি বল্লেম; যুধিষ্ঠির আমারে ডাকিনী বিয়ে কোত্তে অনুরোধ কোরেছিল, সে কথাটা বাবুর কাছে ভাঙলেম না; কেমন লজ্জা হলো। সে ভাবের যে সকল কথা হোচ্ছিল, সে সকল প্রসঙ্গ চাপা দিয়ে বাবুকে আমি জিজ্ঞাসা কোল্লেম, “আর কতদিন আমাদের এখানে থাকা হবে?”
বাবু উত্তর কোল্লেন, “আর কেন? তীর্থস্থান দর্শন করাই কাৰ্য্য, সে কাৰ্য্য সমাপ্ত হয়েছে, আসামের প্রধান সহর গৌহাটী, সে সহরটীও দেখা হয়েছে, ডাকিনীদের খেলা দেখবার কৌতূহল ছিল, সে কৌতূহলও আজ মিটে গেল, আর কেন? আর এখানে বিলম্ব করবার কোন প্রয়োজন দেখছি না; যত শীঘ্র যেতে পারি, ততই ভাল; একটা ভালদিন দেখে এখান থেকে প্রস্থান করা যাবে।”
নূতন কৌতূহলে আমি জিজ্ঞাসা কোল্লেম, “অন্য কোন তীর্থদর্শনের অভিলাষ আছে কি?”—আলস্যে একটী হাই তুলে প্রশান্তবদনে বাবু বোল্লেন, ছিল অভিলাষ, কিন্তু এ যাত্রা আর সে অভিলাষ পূর্ণ হলো না; অনেকদিন বেরিয়েছি, নানা স্থানের নানা প্রকার জল-হাওয়াতে শরীর মধ্যে মধ্যে অসুস্থ হোচ্ছে, এ যাত্রা আর অন্যতীর্থে যাব না। দক্ষিণে শ্রীক্ষেত্র আর গঙ্গাসাগর দূর্গম তীর্থ, ঐ দুটী বাকী থাকলো; গয়া, কাশী, প্রয়াগ, বিন্ধ্যাটবী দর্শন করা হয়েছে, কামাখ্যাদেবীর পীঠস্থানটীও দর্শন করা হলো, এবার এই পর্য্যন্তই ভাল; মথুরা, বৃন্দাবন, হরিদ্বার আর পুষ্করতীর্থ-দর্শনের আশা থাকলো, যদি বেঁচে থাকি, ভগবানের যদি মনে থাকে, বারান্তরে সে আশা চরিতার্থ করবার চেষ্টা পাব; এ যাত্রা এই স্থান থেকেই স্বদেশে যাত্রা করবার ইচ্ছা।”
বাবুর সঙ্গে পঞ্জিকা ছিল, সেই রাত্রেই পঞ্জিকা উদ্ঘাটন কোরে শুভদিন অন্বেষণ করা হলো, দশদিনের মধ্যে শুভদিন পাওয়া গেল না, দশদিন পরে শুক্লা ত্রয়োদশী পুষ্যানক্ষত্র, শুভযোগ, সেই দিনেই যাত্রা করা হবে, স্থির হয়ে থাকলো।
আমার গন্তব্যস্থান নির্ণীত ছিল না। প্রয়াগে দীনবন্ধুবাবু আমারে বোলেছিলেন, কামরূপদর্শনের পর তিনি আমারে তাঁর স্বদেশে নিয়ে যাবেন, সেই অঙ্গীকার স্মরণ কোরে আমি মনে কোল্লেম, সেইটাই এখন আমার গন্তব্যস্থান। একটা নূতন জায়গায় যাওয়ার সঙ্কল্প থাকলে উল্লাসে উৎসাহে শীঘ্র শীঘ্র দিন কেটে যায়, আমাদের সেই দশটী দিন শীঘ্র শীঘ্র অতিবাহিত হয়ে গেল; শ্রাবণমাসের শুক্লা ত্রয়োদশী তিথিতে তরণী আরোহণ, আমরা কামরূপ থেকে যাত্রা কোল্লেম।