প্রথম খণ্ড
- প্রথম খণ্ড
- প্রথম কল্প
- দ্বিতীয় কল্প
- তৃতীয় কল্প
- চতুর্থ কল্প
- পঞ্চম কল্প
- অষ্টম কল্প
- নবম কল্প
- দশম কল্প
- একাদশ কল্প
- দ্বাদশ কল্প
- ত্রয়োদশ কল্প
- চতুর্দ্দশ কল্প
- পঞ্চদশ কল্প
- ষোড়শ কল্প
- সপ্তদশ কল্প
- অষ্টাদশ কল্প
- উনবিংশ কল্প
- বিংশ কল্প
- একবিংশ কল্প
- দ্বাবিংশ কল্প
- ত্রয়োবিংশ কল্প
- চতুর্ব্বিংশ কল্প
- পঞ্চবিংশ কল্প
- ষড়্বিংশ কল্প
- সপ্তবিংশ কল্প
- অষ্টাবিংশ কল্প
- ঊনত্রিংশ কল্প
হরিদাসের গুপ্তকথা
রাস্তার ধারে ধারে অনেকগুলি বাড়ী। ঠাঁই ঠাঁই ভাল ভাল অট্টালিকা। কোন কোন বাড়ীতে কি কি রকমের লোক থাকেন, বোধ হয়, ঘনশ্যামের জানা ছিল, সে আমার হাত ধোরে ধীরে ধীরে এক একখানা বাড়ীর দেউড়ীতে গিয়ে দাঁড়ালো, নানা সুরে কাঁদনী গেয়ে, চক্ষে জল এনে, মুস্কিল আশানের ফকিরের মতন আশীর্ব্বাদ কোরে কোরে ভিক্ষা চাইলে, কিছুই ফল হলো না। অনেক জায়গাতেই তাড়া খেলে, দুই একখানা বাড়ীর চাকরেরা মুষ্টিভিক্ষা দিতে এলো, ঘনশ্যাম সে ভিক্ষা গ্রহণ কোল্লে না।
এক বাড়ীর বাহিরের দরজায় একটী বাবু বোসে ছিলেন, তাঁর কাছে গিয়ে ঘনশ্যাম ফাঁদুনী কোরে কাঁদুনী ধোল্লে। “ঘর পুড়ে গেছে, গরু পুড়ে গেছে, ছেলেমেয়ে পুড়ে গেছে, এই দরখাস্ত দেখুন, দোহাই বাবা। এই ছোট ছেলেটী নিয়ে আমি পথে বেসেছি, দোহাই বাবা! দয়া কর! ভগবান নারায়ণ তোমাদের মঙ্গল কোরবেন।”—এই রকম অনেক আড়ম্বর কোরে ভিকারীটা হেঁট হয়ে, আমার মুখের দিকে চেয়ে, একখানা কাগজ বাহির কোরে বাবুটীকে দেখালে; ঝর্ঝর কোরে চক্ষের জল ফেলতে লাগলো।
লোকটা মহাজনও নয়, দালালও নয়, কারবারীও নয়, কিছুই নয়; বহুরূপী ভিকারী, ভেকধারী বদমাস, সেটা আমি তখন বেশ বুঝতে পাল্লেম। গত রাত্রে আমাকে দিয়ে যে দরখাস্তখানা লিখিয়ে নিয়েছিল, সেইখানাই ঐ বাবুর হাতে দিতে গেল।
মহা বিরক্ত হয়ে বাবু তৎক্ষণাৎ উগ্রস্বরে বোলে উঠলেন, “যাও যাও, ও রকম দরখাস্ত আমি অনেক দেখেছি, তোমার মতন ভিকারীও অনেক দেখেছি; ঘর পোড়া, গরু পোড়া, বাগান পোড়া, ব্যাগ চুরি, টাকা চুরি ইত্যাদি বাহানায় নিত্য নিত্য কত লোক এখানে ঘোরে, গৃহস্থ লোক তাদের জ্বালায় জর্জ্জর হয়ে আছেন; বর্দ্ধমান জায়গা, এখানে তোমার বুজরুকী খাটবে না; চোলে যাও!”
সেখানেও তাড়া খেয়ে বুজরুকটা আমাকে অন্য দিকে নিয়ে চোল্লো। একবারও হাত ছাড়ে না। একবার একটু ফাঁক পেলেই আমি ছুটে পালাই, সে সুবিধা কিছুতেই ঘটলো না। হাতখানা ধোরেই আছে। এক একবার একটু আলগা দেয়, আবার জোর কোরে চেপে ধরে। বিষম বিভ্রাট! বেলা দুই প্রহর। প্রচণ্ড রৌদ্রে মাথা ফাটছে, ক্ষুধা-তৃষ্ণায় আঁধার দেখছি, কোথাও একটু বসি, লোকটা একবারও সে অবসর দিচ্ছে না; ক্রমাগতই টেনে নিয়ে চোলেছে! পা আর চলে না। সৰ্ব্বশরীর অবশ হয়ে পোড়লো। ত্রাহি মধুসূদন!
শেষবেলায় আমরা যে দিকে গিয়ে উপস্থিত হোলেম, সে দিকটা বোধ হলো, সহরের প্রান্তভাগ। লোকজনও বেশী চলে না, দোকানপাটও বেশী নাই, বড় বড় বাড়ীও খুব কম। একখানা ময়রার দোকানে প্রবেশ কোরে, এক পয়সার পাটালী গুড় কিনে ঘনশ্যাম দু-ঘটী জল খেলো। আমাকেও একবিন্দু পাটালী দিয়েছিল, সেই বিন্দুটুকু জিবে বুলিয়ে আমিও এক ঘটী জল খেলেম। সূর্য্যদেব আর আমার কষ্ট দেখতে পাল্লেন না, অগ্নিকিরণ, সংবরণ কোরে, একটু ঠাণ্ডা হয়ে, অস্তাচলে প্রস্থান করবার উপক্রম কোল্লেন। আর রৌদ্র নাই। দোকান থেকে বেরিয়ে ঘনশ্যাম আমাকে একখানি সুদশ্য অট্টালিকার সম্মুখে নিয়ে গেল। রাস্তার উপরেই ফটক; ফটকে একজন দীর্ঘাকার দারোয়ান ছিল, যেন কত কালের পরিচয়, সেই ভাব জানিয়ে ঘনশ্যাম তাকে “রাম রাম” দিয়ে বাড়ীর ভিতর প্রবেশ করবার উপক্রম কোল্লে। দরোয়ানটী রুকে দাঁড়ালো।— “কাঁহাকা উল্লুক! কাহা যাও?—নিকালো!” এইরূপ মিষ্টবাক্য উপহার দিয়ে, দরোয়ান তারে ধাক্কা মেরে পাঁচহাত তফাতে সোরিয়ে দিলে। বেহায়া বদমাস বুজরুকটা তখনো আমার হাত ছেড়ে দিলে না; ধাক্কার সময় আমি তার হাতের সঙ্গে পাখীর মত ঝুলতে লাগলেম।
তফাতে দাঁড়িয়ে মহাজন তখন অভাজনের ন্যায় ভিক্ষা চাইতে লাগলো। দরোয়ান বোল্লে, “নেই—নেই, এসমাফিক জোয়ান আদমীকো ভিচ্ছা দেনেকা হকুম হ্যায় নেই!” এই কথা উপলক্ষে দ্বারপালের সঙ্গে ভিকারীর বচসা আরম্ভ হলো;— কলহতুল্য বচসা! আর সূর্য্য দেখা গেল না; দেখা গেল কেবল অল্প অল্প আলো;— অট্টালিকার মাথায় চপলার ন্যায় ক্ষণস্থায়িনী বর্ণরেখা।
অন্ধকার হবার অত্যল্প বিলম্ব। ভিক্ষুকে দোবারিকে বচসা চোলছে, ইত্যবসরে মুখ ফিরিয়ে আমি চেয়ে দেখি, রাস্তায় একটু দূরে একটী ভদ্রলোক। মৃদুপদসঞ্চারে প্রসন্নবদনে তিনি সেই বাড়ীর দিকেই এগিয়ে আসছেন। ঘনশ্যাম ইতিমধ্যে ফটকের দিকে দুই চারি পা অগ্রসর হয়েছিল, দরোয়ানজী তাই দেখে ফটক বন্ধ কোরে দিয়েছিল, ভদ্রলোকটী নিকটবর্ত্তী হবামাত্র দ্বার উন্মুক্ত কোরে দ্বারপাল ব্যস্তভাবে ঘনশ্যামকে বোল্লে, “যাও যাও, তফাৎ যাও, বাবা, আতা হ্যায়।”—ঘনশ্যাম একটু পেছিয়ে দাঁড়ালে বাবু এসে ফটকের সম্মুখে দাঁড়ালেন, দ্বারপাল দুই হস্তে সেলাম দিলে।
বাবুর চেহারা অতি সুন্দর। দিব্য গৌরবর্ণ, গঠন মোলায়েম, বদন বাদামে, নয়ন দীর্ঘ, জোড়া ভ্ৰূ, সর্ব্বাংশেই নিখুঁত; মাথার চুলগুলি শ্বেতবর্ণ; গোঁফজোড়াটী দিব্য কালো; বয়স অনুমান ৬০/৬২ বৎসর।
একটু তফাতে সোরে দাঁড়িয়ে, দরখাস্তখানি বাহির কোরে, চক্ষে জল এনে, ঘনশ্যাম কেঁদে বোলতে লাগলো, “দোহাই ধর্ম্মাবতার! আমি বড় গরিব, ঘরে আগুন লেগে সৰ্ব্বস্ব পুড়ে গিয়েছে, পরিবারলোক মারা গিয়েছে, গরুবাছর পুড়ে মরেছে, কেবল এই ছেলেটী আর আমি প্রাণে বেঁচে আছি; থাকবার স্থান নাই, আহারের সংস্থান নাই, একবারে নিরুপায়। এই ছেলেটীর জন্যেই আরো আমার বেশী ভাবনা।”
এক কথাই বার বার। লোকটা কত বড় ধড়ীবাজ, তা আমি বেশ বুঝতে পেরেছিলেম, সে আমার হাতখানি খুব শক্ত কোরে ধোরেছিল, কিছুতেই আমি ছাড়াতে পাল্লেম না, দুই চক্ষু দিয়ে জল পোড়ছিলো, বাবু আমার মুখের দিকে চেয়ে চেয়ে লোকটাকে জিজ্ঞাসা কোল্লেন, “এ ছেলেটী তোমার কে হয়?”—লোক উত্তর কোল্লে, “ছেলে হয়, আর কে হবে। এই ছেলেটী নিয়ে আমি পথে পথে কেঁদে বেড়াচ্ছি, তিনদিন উদরে অন্ন নাই, ছেলেটীকে বাঁচানো ভার!—হুজুর হোচ্ছেন কাঙ্গাল গরিবের মা-বাপ, হুজুর রক্ষা না কোল্লে ছেলেটী আমার না খেয়ে মারা যাবে।”
এতক্ষণ আমি চুপ কোরে ছিলেম, লোকটার এই কথা শুনে কেঁদে কেঁদে বাবুকে আমি বোল্লেম, “আমি নিরাশ্রয়, আমার নিজের পরিচয় আমি নিজেই জানি না, এই লোক আমাকে আটদিন হলো, সপ্তগ্রামের গুরুবাড়ী থেকে আমাকে ধরে এনেছে। জন্মাবধি গুরুর বাড়ীতেই ছিলেম, সেইখানেই শাস্ত্র অধ্যয়ন কোত্তেম, সম্প্রতি অধ্যাপকের মত্যু হয়েছে, গুরুপত্নী আমাকে বিদায় কোরে দিয়েছেন, এই লোক আমাকে এনেছে। এ আমার কেহই নয়, একে আমি কখনো চক্ষেও দেখি নাই। সমস্তই মিথ্যাকথা বোলছে, এ লোকের জুয়াচুরীর কথা আমি সব শুনেছি। এ আমাকে কোথাকার নীলকুঠীতে চালান কোরে দিবে, কুলীর কাজ করাবে, এই মতলব।”
আমার কথাগুলি শুনে, লোকটার আপাদ-মস্তক নিরীক্ষণ কোরে, বাবু তাকে বোল্লেন, “কেমন হে, বালক যে যে কথা বোলছে, এ সব সত্য কি না?” —ঘনশ্যাম উত্তর কোল্লে “একটাও সত্য নয়, সমস্তই মিথ্যাকথা, তবে এইটুকু সত্য হোতে পারে, ও আমার নিজের ছেলে নয়, পথে কুড়িয়ে পেয়ে আমি পুত্রবৎ মানুষ কোরেছি, কিছু কিছু, লেখাপড়া শিখিয়েছি, কলিকালের ছেলে কি না, এখন আর আমার কাছে থাকতে চায় না; খেতে পেতো না, জায়গা পেতো না, পথে পথেই পোড়ে থাকতো, কত উপকার কোরেছি, সব কথা এখন ভুলে গেছে।”
খানিকক্ষণ চুপ কোরে থেকে গম্ভীরস্বরে বাবু তাকে বোল্লেন, “হাঁ, তুমি যা যা বোলছে সমস্তই সত্য, আর এই বালক যা যা বোলছে, সমস্তই মিথ্যা, কেমন, এই কথা তোমার নয়? সব আমি বুঝেছি; তোমার চেহারাতে সকল কথাই ব্যক্ত হোচ্ছে। তুমি ভিকারী হয়েছ, জুয়ান মরদ, খেটে খেতে পার না? তোমাকে ভিক্ষা দেওয়া গৃহস্থলোকের উচিত হয় না। তুমি জুয়াচরী অভ্যাস কোরেছ, তোমাকে আমি এখনি পুলিশে দিতেম কিন্তু ক্ষমা কোল্লেম, ছেলেটীর হাত ছেড়ে দাও; চেহারায় বুঝতে পাচ্ছি, ভদ্রলোকের ছেলে, এ ছেলে আমার কাছেই থাকবে। তুমি ভিক্ষা নিতে এসেছ, ভিক্ষা নিয়ে চোলে যাও। ফের যদি কথা কও, পুলিশের গারদে তোমার স্থান হবে; এ কথা নিশ্চয়!”
পুলিশের কথা শুনে লোকটা কেঁপে কেঁপে আমার হাত ছেড়ে দিলে, আমি দৌড়ে গিয়ে বাবুর দুটী পায়ে জড়িয়ে ধোল্লেম, “রক্ষা করুন, রক্ষা করুন” বোলে অনবরত কাঁদতে লাগলেম। অভয় দিয়ে বাবু আমাকে বোল্লেন, “তুমি শান্ত হও, কোন ভয় নাই, সব আমি বুঝেছি। তুমি আমার কাছেই থাকবে, যাতে তোমার ভাল হয়, যাতে তুমি নিজের পরিচয় জানতে পার, যাতে তোমার আপনার লোকেরা সংবাদ পান, আমি তার চেষ্টাও কোরবো, কোন চিন্তা নাই।”
লোকটার সম্মুখে একটা আধুলি ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে উগ্রস্বরে বাবু বোল্লেন, “লও তোমার ভিক্ষা, চোলে যাও, তিলার্দ্ধ আর এখানে বিলম্ব কোরে না।”
ঘনশ্যামকে এই কথা বোলে আমাকে সঙ্গে কোরে নিয়ে বাবু বাড়ীর মধে প্রবেশ কোল্লেন। লোকটা তখনও যায় না, ফটকের বাহিরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কটমটচক্ষে আমার দিকে চাইতে লাগলো, ইসারায় ইসারায় যেন শাসালে। তার ভঙ্গী দেখে বাবু তখন দরোয়ানকে হুকুম দিলেন, “গলাধাক্কা দিয়ে দূর কোরে দাও?”—দরোয়ান তৎক্ষণাৎ হুকুম তামিল কোল্লে। আড়ে আড়ে চাইতে চাইতে আপন মনে গর্জ্জন কোত্তে কোত্তে জুয়াচোর ঘনশ্যাম দক্ষিণদিকে ছুটে পালালো। আমারো ভয় ভাঙলো, আশ্রয়হারা হয়েছিলেম, মহৎ আশ্রয় প্রাপ্ত হোলেম। বাবুর বাড়ীতেই আমি থাকলেম।