» » » অষ্টাবিংশ কল্প : গ্রহ সুপ্রসন্ন

বর্ণাকার

ভূবনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়

হরিদাসের গুপ্তকথা
প্রথম খণ্ড

অষ্টাবিংশ কল্প : গ্রহ সুপ্রসন্ন

গভীর নিশীথকালেও বনবাসী শৃগালেরা রব করে। নিশাকালে প্রহরে প্রহরে শৃগালের রব শুনা যায়। আমাদের সঙ্গীত-শাস্ত্রের গুরুমহাশয়েরা দিবা-রজনীর কালভেদে ভিন্ন ভিন্ন রাগরাগিণীর ভেদ নির্দ্ধারণ কোরে রেখেছেন, শৃগালের রবেও সেইরূপ কালভেদ স্বরভেদ বুঝা যায়; কিঞ্চিৎ অভিনিবেশ পূর্ব্বক শ্রবণ কোল্লে, ভাবুকলোক মাত্রেই সেই ভেদাভেদ অনুভব কোত্তে পারেন। বোসে বোসে নিস্তব্ধ হয়ে আমি ভাবছি, দূরে দূরে শেয়াল ডেকে উঠলো। স্বরে বুঝলেম, রাত্রি শেষ; ঊষা আগমনের অতি অপমাত্র বিলম্ব।

শৃগালেরা নীরব হোতে না হোতেই ডাকাতের দুর্গমধ্যে মহা কোলাহলধ্বনি সমুত্থিত। এককালে বহুলোকের কণ্ঠমিশ্রিত চীৎকারধ্বনি! গর্জ্জন, আস্ফালন, হুহুঙ্কার, বিভীষণ চীৎকারমিশ্র চীৎকারের সঙ্গে সঙ্গে এক একবার সভয় চীৎকারও শ্রুতিগোচর হোতে লাগলো। এই বুঝি সর্দ্দার এসেছে, এই বুঝি সব দলবল এসেছে, এই বুঝি দলের লোকেরা সর্দ্দারের কাছে আমার কথা বোলে দিচ্ছে, এইবার বুঝি আমার উপরেই বজ্রবর্ষণ হবে, এই সকল ভাবনা উপর্য্যুপরি আমার শঙ্কাকুল হৃদয়ে সমুদিত। বোসে ছিলেম, থাকতে পাল্লেম না, ভয়ঙ্কর কলরব শুনে চঞ্চল হয়ে উঠে দাঁড়ালেম; ভয়ঙ্কর জলদ-গর্জ্জনের ন্যায় ক্রমশই সেই ভীষণ চীৎকারের প্রবলতা! দূরবনে ব্যাঘ্রগর্জ্জন শ্রবণ কোরে বনবাসী নিরীহ কুরঙ্গ যেমন প্রাণভয়ে ব্যাকুল হয়, ঘরের বাহিরে দস্যুদলের ভীষণ গর্জ্জন-শ্রবণে, প্রাণের ভয়ে আমিও সেইরূপ ব্যাকুল হোলেম।

ঘেউ ঘেউ রবে অনেকগুলো কুকুর ডেকে উঠলো। সঙ্গে সঙ্গে গুড়ুম গুড়ুম শব্দে গোটাকতক বন্দুকের আওয়াজ। কুকুরের ডাক সেই সকল বন্দুকের আওয়াজের উপর দিয়ে ছাপিয়ে ছাপিয়ে যেতে লাগলো। সে রকম কুকুরের ডাক অন্য কোন স্থানে আমার কর্ণে প্রবেশ করে নাই; ভীষণ জলদ-গম্ভীর নিনাদ! নিরেট ঘর, প্রকাণ্ড কপাটে চাবি বন্ধ, সেই ঘরের ভিতর থেকে সেই ভীষণরব শ্রবণ কোরে সত্যই যেন আমার অর্দ্ধেক প্রাণ উড়ে গেল। পুনর্ব্বার বন্দুকের আওয়াজ। উভয় গর্জ্জনে যেন খণ্ড-প্রলয় বোধ হোতে লাগলো! অনেকদূর পর্য্যন্ত প্রতিধ্বনি। এক একটা আওয়াজে আমি থর থর কোরে কাঁপতে লাগলেম, ঘর পর্য্যন্ত যেন কাঁপতে লাগলো। প্রবল ভূমিকম্পে ধরণী যেমন কাঁপে, ঘন ঘন সেই প্রকার কম্প! সঙ্গে সঙ্গে বহুলোকের কলরব। বিভীষণ চীৎকার! উভয়দলে যুদ্ধ উপস্থিত হোলে যে প্রকার হুহুঙ্কার শুনা যায়, সেই প্রকার বিমিশ্র চীৎকার। অবিরাম বন্দুকের ধ্বনি। মনুষ্যের চীৎকার, কুকুরের চীৎকার, বন্দুকের চীৎকার, প্রলয়কাণ্ড!

ব্যাপার কি! সর্দ্দার ডাকাত ফিরে এসেছে, কুকুরের দল ফিরে এসেছে, সেই কারণেই কি ঐরূপ জয়ধ্বনি হোচ্ছে? পরদ্রব্য লুণ্ঠনে পূণমনরথ হয়ে ডাকাতেরাই কি ঘন ঘন তোপধ্বনি কোরে আনন্দ প্রকাশ কোচ্ছে? অব্যক্ত চীৎকারে কুকুরেরাও কি প্রভুবর্গের আনন্দে উৎসাহিত হয়ে উঠেছে?—না, সে রকম কলরব নয়; জয়ধ্বনির সঙ্গে যেন ভয়ঙ্কর আর্ত্তনাদ এক একবার মিশিয়ে মিশিয়ে যাচ্ছে! ব্যাপার কি?

প্রায় আধঘণ্টাকাল আমি ঐ প্রকার প্রলয়-কলরব শ্রবণ কোল্লেম। তার পর উচ্চধ্বনি নিস্তব্ধ, দূর থেকে বহুজনপূর্ণ মেলাস্থলের মিশ্রকলরব যেমন শুনা যায়, কথা বুঝা যায় না, অর্থবোধ হয় না, কেবল যেন মহাঝড়ের অথবা দূরস্থ সমুদ্রগর্জ্জনের হুঙ্কারশব্দের ন্যায় গাত্র-কম্পন ভীমরব শ্রবণ কোত্তে লাগলেম। অকস্মাৎ আমার কারাগারের রুদ্ধদ্বার বিমুক্ত হয়ে গেল, প্রভাতের অল্প অল্প আলো গৃহমধ্যে প্রবেশ কোল্লে, সমুজ্জ্বল উষ্ণীষধারী একটি দিব্যমূর্ত্তি আমার সম্মুখে দণ্ডায়মান। যুগল হস্তে যুগল অসি, বদনমণ্ডল দিব্য প্রফুল্ল, দিব্য মহাবীর-মূর্ত্তি!

অসি-দুখানি ভূতলে সংস্থাপন কোরে সেই মূর্ত্তি পরমানন্দে আমারে আলিঙ্গন কোল্লেন; আনন্দবদ্ধন, সুমধুর গম্ভীরস্বরে শীঘ্র শীঘ্র বোল্লেন, “হরিদাস! হরিদাস! গ্রহদেবতা সুপ্রসন্ন! আর তুমি এখানকার বন্দী নও, মুক্ত পুরুষ! তোমার আবিষ্কৃত সেই ক্ষুদ্র বাক্সটির কল্যাণে বহুদিনের পর আজ আমি সিদ্ধমনোরথ হয়েছি। সব ডাকাত ধরা পোড়েছে! এসো, এসো, শীঘ্র এসো, দেখবে, গড়া গড়া পোড়ে আছে। দেখবে এসো!”

এই কথাগুলি তিনি বোল্লেন; যতক্ষণ বোল্লন, ততক্ষণ আমি তার মুখেপানে অনিমেষে চেয়ে থাকলেম। মহারোগে বাকরোধ হয়, মহাশোকে বাকরোধ হয়, মহা আনন্দেও বাকরোধ হয়ে যায়; ক্ষণেকের জন্য মহানন্দে আমার বাকরোধ! যে মুখে ঐ আনন্দবার্ত্তা বিঘোষিত, সেই মুখখানি একরাত্রে অল্পক্ষণের জন্য আমার দেখা হয়েছিল। পাঠকমহাশয় স্মরণ কোত্তে পারবেন। অসাবধানে মুখোসটি খোসে পড়বার উপক্রমে পলকমাত্র যে মুখ আমি দেখি, সেই মুখ! সে রাত্রে কেবল মুখখানি মাত্র দর্শন কোরেছিলেম, এই প্রাতঃকালে—এই সুপ্রভাতে সেই মুখের অধিকারীর পূর্ণ অবয়ব আমি দর্শন কোল্লেম। দর্শনে নয়ন চরিতার্থ, হৃদয় পুলকিত, অন্তরানন্দে মন-প্রাণ প্রফুল্ল; সম্মুখে আমার পরমোপকারী প্রিয়বন্ধু ভূষণলাল।

আমি তখন কথা কইতে পাল্লেম না, আনন্দ-প্রমোদিত ভূষণলাল, সস্নেহে আমার হস্ত আকর্ষণ কোরে ঘরের বাহিরে নিয়ে চোল্লেন। আকর্ষণ বোল্লেম কেন, যথার্থই আকর্ষণ। আনন্দে আমার অঙ্গ অবশ, রসনা নিৰ্ব্বাক, গতিশক্তি স্থিত। ভূষণলাল আমারে যথার্থই টেনে টেনে নিয়ে চোল্লৈন; কলের ঘর থেকে বেরিয়ে আমি যেন তখন কলে কলেই চোলে যেতে লাগলেম।

পূর্ব্বে শুনে রেখেছি, শুনে শুনে বলে রেখেছি, ডাকাতের বনদূর্গ। সেই দূর্গমধ্যে এক সুপ্রশস্ত প্রাঙ্গণ। সেই প্রাঙ্গণে বিকট বিকট চেহারার শতাধিক লোক শৃঙ্খলাবদ্ধ হয়ে পোড়ে আছে। হস্ত-পদে শৃঙ্খল, কটিদেশে শৃঙ্খল, গলদেশে শৃঙ্খল; নড়ন-চড়নের শক্তি নাই। রণবেশধারী প্রায় দুইশত সিপাহী চারিদিকে শ্রেণীবদ্ধ দণ্ডায়মান; অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত; বদন গম্ভীর, নিৰ্ব্বাক; হঠাৎ দর্শনে হৃদয়ে আশঙ্কার সঞ্চার হয়। একটু দূরে দেখলেম, একপাল কুকুর বাঁধা। জনকতক সিপাহী সেই সকল কুকুরের মুখে জাল বেধে বৃহৎ একটা শৃঙ্খলে সবগুলোকে একত্র বন্ধন কোরে আটকে রেখেছে। শৃখলবদ্ধ ডাকাতেরা মিট মিট কোরে চেয়ে দেখছে, রাগে রাগে ফুলছে, এক একটা লোক মুখ খিঁচিয়ে দাঁত কড়মড় কোরে আস্ফালন দেখাচ্ছে, বাক্য নাই। কোনটা তাদের মধ্যে বীরমল্ল, অনেকক্ষণের পর বাকশক্তি প্রাপ্ত হয়ে ভূষণলালকে আমি সেই কথা জিজ্ঞাসা কোল্লেম। হাস্য কোরে ভূষণলাল বোল্লেন, “সে একটা রাজা লোক, নিজের দলের ভিতর তার মহারাজ খেতাব, তার কি এই রকম খোলা জায়গায় এমন অযত্নে রাখা যায়। তার বিলাসঘরেই সুকোমল শয্যার উপর তারে রক্ষা করা হয়েছে। তার বিলাসিনী রঙ্গিণীটিও সেইখানে আছে; চল, দেখবে চল!”

ডাকাতের বিলাসগৃহে আমরা প্রবেশ কোল্লেম। বিলাসগৃহে বিলাস-শয্যা। সেই শয্যার উপর বীরমল্ল উপবিষ্ট। স্বেচ্ছায় উপবিষ্ট নয়, চতুর্ব্বিধ বন্ধনের কায়দায় কাজেই তারে বোসে থাকতে হয়েছিল। গলার সঙ্গে, কোমরের সঙ্গে, হাতের কব্জীর সঙ্গে, পায়ের সঙ্গে এক শৃঙ্খলের যোগ, শয়নের কথা দূরে থাকুক, হাত-পা ছড়িয়ে একটু আরামে নিঃশ্বাস ফেলাও অসাধ্য। আমি সেই ডাকাতের আপাদ-মস্তক নিরীক্ষণ কোল্লেম। আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা আছে, তথাপি সেই শয্যার নিকটবর্ত্তী হোতে আমার সাহস হলো না। ভয়ঙ্কর চেহারা। বেঁটে, ঘাড়ে-গর্দ্দানে এক, বুক চওড়া, কোমর মোটা, উরুদেশ যেন শালকাঠের মত প্রকাণ্ড, হাতের গুল ঘুরাণো ঘুরাণো, পায়ের গোছ খুব মোটা, নাকটা লম্বা, আগার দিকটা চ্যাপ্টা, চোখ খুব ছোট ছোট, কিন্তু তারা-দুটো বড় বড়, ভাল কোরে দেখলে বোধ হয় যেন জ্বোলছে, জ্বোলছে আর ঘুরছে, চক্ষের পাতায় লোম নাই, ভ্রুতেও অতি অল্প লোম; আছে কি না মালুম হয় না, কপালখানা প্রকাণ্ড, মাথার সম্মুখদিকে কপাল পর্য্যন্ত টাক, তাতে কোরেই কপালখানা আরো প্রকাণ্ড দেখায়; টাকের ধারে ধারে পাতলা পাতলা লম্বা লম্বা চুল; গোঁপ চোমরা, দাড়ি কামানো; গায়ের রং আধপোড়া ইটের মত, রোদ-পোড়া শুষ্ক বেল যে রকম, মুখের বর্ণটা সেই প্রকার। আমাদের দেখে সেই ক্ষুদ্র চক্ষু রক্তবর্ণ কোরে ডাকাতটা তখন বড় বড় দন্তদ্বারা ওষ্ঠ দংশন কোত্তে লাগলো। দশভুজা মা দুর্গার পদতলে সিংহাক্রান্ত নাগপাশবদ্ধ মহিষাসুরের যেরূপে গঠন, যেরূপ ভয়ঙ্কর আকৃতি লৌহশৃঙ্খলবদ্ধ বীরমল্পকে আমি তখন সেইরূপ দেখলেম। ঘরের কোণে করযোড়ে রঙ্গিণীরও হাত-পা বাঁধা, বিশেষের মধ্যে শৃঙ্খলের পরিবর্ত্তে দড়ি দিয়ে বাঁধা;—দুখানা পা বাঁধা ছিল না, একখানা পায়ে দড়ি বেঁধে একটা জানালার গরাদের সঙ্গে টানা দেওয়া। আমাদের দেখে রঙ্গিণী কাঁদতে লাগলো।

সে ঘর থেকে আমরা বেরিয়ে এলেম। চাতালের ডাকাতগুলোকে প্রথমে যে অবস্থায় দেখে গিয়েছিলেম, ঠিক সেই অবস্থায় তারা পোড়ে আছে; চারিধারে সিপাহী পাহারা। এক একবার সকলের দিকে চাইতে চাইতে গহ্বর থেকে আমরা বাহিরে আসছি, সেই সময় দেখি, প্রবেশ পথের দুই পাশে দুটো আস্তাবল; প্রায় ৪০/৫০টা বড় বড় ঘোড়া সেই দুই আস্তাবলে খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, মাঝে মাঝে নাসাগর্জ্জন কোচ্ছে আর খট খট কোরে পা ঠুকছে।

আমরা বেরিয়ে এলেম। সম্মুখে সেই কানন-বেষ্টিত প্রান্তর; ডাকাতেরা প্রথম রাত্রে সেই প্রান্তরমধ্যে আমারে ঘোড়ার উপর তুলে বন্ধন কোরেছিল, সেই কথা তখন স্মরণ হলো। দেখতে দেখতে আমরা উভয়ে পদব্রজে সেই নিবিড় বনভূমি অতিক্রম কোল্লেম। প্রাণে তখন আমার কতদূর আনন্দ, আমার মুখে শুনলেও সকলেই সেটি অনুভব কোত্তে পারবেন।

আমি খালাস পেলেম। পাপ ডাকাতের পাপ-নিবাসের দুর্গন্ধময় বাতাস আর আমারে যন্ত্রণা দিতে পাচ্ছে না, নির্ম্মল পবিত্ৰবায়ু সেবনে সুস্থ হয়ে আমি তখন স্বাধীনতাসুখ উপভোগ কোত্তে লাগলেম। অরণ্যসীমা পার হয়ে প্রশস্ত রাজপথে আমরা উপস্থিত। দুজন লোক দুটি সুসজ্জিত অশ্ব নিয়ে সেইখানে হাজির ছিল, ভূষণলাল আমারে জিজ্ঞাসা কোল্লেন, “ঘোড়ায় চড়া তোমার অভ্যাস আছে?” মুখে উত্তর না দিয়ে, একলম্ফে একটি ঘোড়ার উপর আমি সওয়ার হয়ে বোসলেম; বোসেই মনে মনে মুর্শিদাবাদের পশুপতিবাবুকে ধন্যবাদ দিলেম; তিনিই আমার অশ্বারোহণবিদ্যার গুরু। আমি সওয়ার হোলেম, ভূষণলাল একলম্ফে দ্বিতীয় অশ্বে আরোহণ কোল্লেন, ঘোড়ারা কদমে কদমে চলতে লাগলো। দুটি ঘোড়া পাশাপাশি। মুখ বুজে আমরা আসছি না, ভূষণলাল অনেক কথা আমারে জিজ্ঞাসা কোচ্ছেন, অনেক কথার আমি উত্তর দিচ্ছি। আমার তখন দিব্য স্ফূর্ত্তি, ভূষণলাল ও নূতন আনন্দে স্ফূর্ত্তিপ্রাপ্ত, কথোপকথনে সেই একরকম নূতন আমোদ।

কথার অবসরে আমি জিজ্ঞাসা কোল্লেম, “স্ত্রীলোকটা বন্ধনদশায় কেন? স্ত্রীলোক ডাকাতী করে না, ডাকাতেরা তারে ধরে রেখেছিল, তার অপরাধ কি? সে পালাবে না তার পালিয়ে যাবার স্থান নাই, তারে বন্ধন করা হয়েছে কি জন্য?”

ঈষৎ হাস্য কোরে ভূষণলাল উত্তর দিলেন, “রঙ্গিণীকে আমার দরকার আছে। বীরমল্লের সঙ্গে এই রাজ্য-সংক্রান্ত তার কি কি কথা হয়েছিল, সেইগুলি আমি শুনবো আরো, বাঙ্গালীর মেয়ে গুজরাটে এসেছিল কেন, তার জীবনের সে পরিচয়টিও আমার অবগত হবার ইচ্ছা আছে।”

ভূষণলালের ইচ্ছার কথা শুনেই চমকিতভাবে আমি বোল্লেম, “রঙ্গিণীর জীবনের কথা? জীবনের পরিচয়? রঙ্গিণী আমার উপর ভারী রেগে আছে। তার জীবনের দুটি একটি কথা আমি জানি, দুটি একটি জিজ্ঞাসা করেছিলেম, তাতেই তার রাগ।”

যতক্ষণ আমরা এই সকল কথা বলাবলি কোল্লেম, ততক্ষণে আমাদের অশ্বেরা নগরের একখানি সুরম্য অট্টালিকার নিকটে এসে পৌঁছিল। স্নিগ্ধস্বরে ভূষণলাল বোল্লেন, “আচ্ছা আচ্ছা, সে সব কথা আমি শুনবো; এই বাড়ীতেই আমি এখন থাকি, আমার সঙ্গে এই বাড়ীতেই তুমি এখন চল, এইখানেই তোমার আহারাদি হবে, অপরাহ্ণে লোক সঙ্গে দিয়ে দীনবন্ধুবাবুর বাসাতে তোমাকে পাঠিয়ে দিব। তুমি নিরাপদে আছ, তিনি সংবাদ পেয়েছেন, তাদৃশ উদ্বেগের কোন কারণ নাই।”

আমরা উভয়ে ঘোড়া থেকে নামলেম, বাড়ীর মধ্যে প্রবেশ কোল্লেম, অশ্বপালেরা অশ্বদুটিকে যথাস্থানে নিয়ে রাখলেন। বাড়িখানি ছোট, কিন্তু দিব্য পরিপাটী। দূর থেকে দেখায় যেন ছবিখানি। গৃহের সজ্জাগুলিও সুন্দর সুন্দর, দাস-দাসী আছে, কিন্তু সংখ্যায় অল্প। সেই স্থানে আমি স্নান আহার কোল্লেম। অপরাহ্ণে আমার দীনবন্ধুবাবুর বাসায় যাবার কথা। অপরাহ্ণ আগমনের অগ্রে ভূষণলাল আমারে একটি সুসজ্জিত ঘরে আহ্বান কোল্লেন, সেই ঘরে আমি গেলেম। দেখলেম, তিনি একাকী; মুখে মৃদু মৃদু হাস্য।

হাস্যের কারণ উপস্থিত ছিল না, তাদৃশ গম্ভীর প্রকৃতির লোক একাকী আপন মনে আপনা আপনি হাস্য করেন, বোধ হয়, কোন নিগূঢ় কারণ থাকতে পারে। কারণ জিজ্ঞাসা করা আমি আবিশ্যক বিবেচনা কোল্লেম না, তিনি আমারে বোসতে বোল্লেন, একধারে আমি উপবেশন কোল্লেম।

পূৰ্ব্ববৎ মৃদু মৃদু হাসতে হাসতে ভূষণলাল আমারে জিজ্ঞাসা কোল্লেন, “কেমন হরিদাস, ডাকাতের দলের পরিণামটা দর্শন কোল্লে? পরিণামের পরিনাম এখনো বাকী কিন্তু তুমি আমার যতদূর উপকার কোরেছ, সেটি আমার বহুদিনের বহুশ্রমের উচ্চ পুরস্কার!”

একটু কুণ্ঠিত হয়ে বিনীতবচনে আমি বোল্লেম, “সে কি মহাশয়। ও কি কথা আপনি বলেন? ডাকাতের অন্ধকূপে আমি মারা যাচ্ছিলেম, আপনি সদয় হয়ে পরিত্রাণ কোল্লেন, চিরজীবনের জন্য আমিই আপনার কাছে উপকৃত; আপনি বলছেন, আমি আপনার উপকার কোরেছি, এটি কি প্রকার কথা?”

ভূষণ।—যে উপকারটি তুমি আমার কোরেছ, সেটি তুমি জান না। মহা উপকার! পূর্ব্বে তোমারে আমি বোলেছি, যা তুমি দেখেছো, বাস্তবিক তা আমি নই, আমার সত্য পরিচয় অবগত হও। এখানকার মহারাজ আমার পিতৃব্য, আমার নাম ভূষণলাল নয়, ছদ্মবেশ ধারণ কোরে ঐ নামে আমি ডাকাতের দলে মিশে ছিলেম।

আমি।—ছদ্মবেশ ধারণ কোরে ডাকাতের দলে আপনি মিশেছিলেন, আমার তুল্য অনেক অভাগকে আপনি উদ্ধার কোরেছেন, আমারেও উদ্ধার কোল্লেন, আপনার বীরত্ব-প্রভাবেই ভয়ঙ্কর ডাকাতের দল ধরা পোড়লো, এ সকল কার্য্যে আমি আপনার কি উপকার কোল্লেম?

যারে আমি ভূষণলাল বোলে জানছিলেম, অট্ট হাস্য কোরে তিনি বোল্লেন, “আমার প্রকৃত নাম রণেন্দ্র রাও, আমি এখানকার মহারাজের ভ্রাতুষ্পুত্র; দস্যুদলপতি বীরমল্ল আমাদের এই রাজ্যটিকে বিপদগ্রস্ত কোরে তুলেছিল, দলটাকে গ্রেপ্তার করার নিমিত্ত অনেক দিন আমি অশেষ-বিশেষ চেষ্টা কোচ্ছিলেম, কৃতকার্য্য হোতে পারি নাই, আমার পক্ষে যেটা অসাধ্য বোধ হয়েছিল, সেই গুরুতর কার্য্য তোমার দ্বারাই সুসিদ্ধ হলো!”

সাগ্রহে আমি বলে উঠলেন, “আমার দ্বারা সুসিদ্ধ, আমি ত এ কথার কিছুই তাৎপর্য্য হৃদয়ঙ্গম কোত্তে পাল্লেম না। মহত্ত্বগুণে আপনি আমারে ভালবেসেছেন, পৃথিবীর আমি কেহই নই, আমারে বন্ধু বোলে আপনি আমার গৌরব বাড়িয়েছেন, মহাবিপদ থেকে আপনি আমারে রক্ষা কোল্লেন, আপনার অনুগ্রহেই আমি প্রাণ পেলেম, আপনারে শত নমস্কার, শত ধন্যবাদ।

এখন আর এই মহাপুরুষকে ভূষণলাল বলবার আবশ্যক নাই, আমার ঐরূপ উক্তি শ্রবণ কোরে গম্ভীরবদনে রাজপুত্র বোল্লেন, “কি প্রকারে তোমার দ্বারা কার্য্যসিদ্ধ, সে সব অনেক কথা, এখন তুমি তোমার সেই আশ্রয়দাতার সঙ্গে সাক্ষাৎ কোত্তে যাবে, সন্ধ্যার পর আবার এখানে এসো, সেই সময় সমস্ত ব্যাপার তুমি জানতে পারবে।”

অপরাহ্ণে দুটি অশ্ব সজ্জিত হলো, রাজপুত্র একজন বিশ্বস্ত কর্ম্মচারীকে আমার সঙ্গে দিলেন, আমরা উভয়ে অশ্বারোহণে ভবানীদেবীর মন্দিরাভিমুখে চোল্লেম। দীনবন্ধুবাবুর বাসায় উপস্থিত হোলেম। তাঁর চরণে প্রণিপাত কোরে আদ্যোপান্ত সমস্ত ঘটনা তাঁর কাছে আমি নিবেদন কোল্লেম। শুনে তিনি বিস্তর দুঃখ প্রকাশ কোরে শেষকালে বিস্ময় সহকারে আনন্দ প্রকাশ কোল্লেন। যিনি আমার সঙ্গে এসেছিলেন, তাঁর পরিচয় পেয়ে দীনবন্ধুবাবু তাঁরে যথেষ্ট সমাদর কোল্লেন। সে সময় আমাদের যে কত আনন্দ, লেখনীমুখে সে আনন্দ ব্যক্ত করা যায় না। কথায় কথায় সন্ধ্যা হয়ে গেল। রাজপুত্রের আমন্ত্রণ, দীনবন্ধুবাবুকে সেই কথা জানিয়ে রাত্রের মত আমি বিদায় চাইলেম। বাবু বোল্লেন, “ভয় হয়! আবার তুমি অন্ধকারে রাস্তায় বাহির হবে, কোথা থেকে কারা এসে আবার তোমারে ধরে ফেলবে, আবার কত কষ্ট পাবে, রাত্রিকালে তোমারে ছেড়ে দিতে আমার প্রাণ চায় না।”

প্রাণের উৎসাহে পূর্ণ সাহসে আমি বোল্লেম, এখন আর এখানে কাহাকেও আমি ভয় করি না। অকারণে যারা আমার ভয়ের কারণ হয়েছিল, তাদের বিষদাঁত ভেঙে গিয়েছে, লৌহ-শৃঙ্খল পরিধান কোরে তারা এখন জীবনের আশা পরিত্যাগ কোরেছে, আমার আর কোন ভয় নাই। আমি বিপদের মুখে নিক্ষিপ্ত হয়েছিলেম, তথাপি অতি নিরাপদে আছি, আপনার কাছে এইরূপ সংবাদ পাঠিয়ে যিনি আপনার উদ্বেগ শান্তির চেষ্টা কোরেছিলেন, তিনিই আমার অভয়দাতা, তিনিই আমার রক্ষাকর্ত্তা। তাঁরই আমন্ত্রণে তাঁরই কাছে আমারে যেতে হোচ্ছে। আপনি চিন্তিত হবেন না, কোন ভয় নাই, নিরাপদেই আমি ফিরে আসবো?”

রাজপুত্রের প্রেরিত লোকটি আমার সঙ্গেই ছিলেন, তিনিও আমার বাক্যের পোষকতা কোল্লেন। দীনবন্ধুবাবু আর কোন আপত্তি উত্থাপন কোল্লেন না; আমরা উভয়ে উপর থেকে নেমে এসে পূৰ্ব্ববৎ অশ্বারোহণে কুমার রণেন্দ্র বাহাদুরের নিকেতনাভিমুখে যাত্রা কোল্লেম।