ভূবনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়
হরিদাসের গুপ্তকথাপ্রথম খণ্ড
সপ্তবিংশ কল্প : এ সকল কি ব্যাপার?
ডাকাতের আড্ডায় একটি দয়াময় সাধপুরষ। তিনি ডাকাত নন, সে কথা ঠিক। ডাকাতের চেহারা ভয়ঙ্কর হয়, ডাকাতেরা কালো হয়, এটা যেন একরকম বাঁধাকথার মধ্যেই গণ্য। যে সকল মূর্ত্তি আমরা দেখতে পাই না, অথচ যাদের নাম শুনলে, কাৰ্য্য ভাবলে, প্রাণের ভিতর মহাতঙ্কের উদয় হয়, কল্পনাতে সকলেই বলেন, সে সকল মূর্ত্তি ভয়ঙ্কর কৃষ্ণবর্ণ। অসুরেরা কালো; সেই অসুর অনেক প্রকারের বুঝায়; দানব, দৈত্য, রাক্ষস, দস্যু ইত্যাদি। এগুলি পৌরাণিক সংবাদ। যিনি আমাদের ধর্ম্মরাজ, কালে-অকালে সকালে বিকালে যিনি জগতের জীবকুলের জীবন হরণ করেন, আমাদের দেশে যিনি যম নামে বিখ্যাত, তাঁরে কেহ দেখে নাই, কিন্তু চিত্রপটে দেখা যায়, ভীষণাকার যমমূর্ত্তি কৃষ্ণবর্ণ। লৌকিক প্রবাদ ভূত; সকলেই বলে, ভূতেরা সকলেই কালো! মানুষের ছেলে যদি কালো হয়, দৃষ্টান্ত দিয়ে লোকেরা বলে, কালো ভূত! এই প্রকারে দুষ্কৰ্ম্মকারী দস্যুগণকেও কালো বলা যায়। দানব কালো, যম কালো, ভূত কালো, ডাকাত কালো, এই প্রকার সিদ্ধান্ত। এ সিদ্ধান্তে বর্জ্জিত আছেন করালবদনা মা কালী আর বৃন্দাবনের গোপিনীমোহন শ্রীকৃষ্ণ।
বিদ্যুতের গতির মত এই সকল কথা আমার মনে হলো। মনে হবার সূত্র ডাকাতের দল। সব ডাকাত কালো না হোলেও ডাকাতী করবার সময় তেলকালী মেখে কালো হয়; কালো সাজে। যিনি আমারে রাত্রিকালে অভয় দিতে আসেন, ডাকাতের দলে তিনি ডাকাত নামে পরিচিত; মুখোসটা কিন্তু ঘোর কৃষ্ণ। সত্য তিনি ডাকাত নন, একবারমাত্র চেহারা দেখে সেটা আমি বুঝতে পেরেছি। রাজপুত্রের মত চেহারা। বাস্তবিক কে তিনি, এ প্রেতপুরী থেকে মুক্তি না পেলে সে নিগুঢ় রহস্য প্রকাশ পাবে না, সেটাও আমি জানতে পাচ্ছি। গোলকধাঁধায় গোলকধাঁধার ঘোর অন্ধকারে আমি কয়েদ; এই গোলকধাঁধার ঘরে অনেকরকম কল-কৌশল আছে, বিশ্বাস কোরে সেই গুপ্তকথা তিনি আমারে বেলে গিয়েছেন, কি যে সেই কল-কৌশল, শেষকালে তাও হয় তো আমি জানতে পারবো। তিনি আমার বন্ধু, আমার মুক্তির জন্য আমার বন্ধুর কাজ কোরবেন, এইরুপ অঙ্গীকার। যদি আমার ভাগ্যে থাকে, যদি আমি খালাস পাই, সংসারে তাঁরে আমি বন্ধু পাব, এই আমার আশা।
মেয়েটার নাম রঙ্গিণী। সত্যনাম রঙ্গিণী নয়, ডাকাতেরা রঙ্গিণী নাম দিয়ে রেখেছে। রঙ্গিণী বেলেছে, আমার ঐ বন্ধুর নাম ভূষণলাল। নামটি শুনতে ভাল, কিন্তু এ নামটিও বোধ হয় সত্য নয়। ডাকাতেরা যে নাম জেনে রেখেছে, সে নাম যদি সত্য হোতো, তা হোলে তিনি কদাচ নির্ব্বিঘ্নে ডাকাতের দলে থাকতে পাত্তেন না। সমস্তই রহস্যপূর্ণ। যেটা ভাবি, সেইটাই ঘোর অন্ধকার-রহস্যে ঢাকা; আমার এই কয়েদঘর যেমন অন্ধকার, এই সকল রহস্যেও সেই রকম ঘোর অন্ধকারে সমাচ্ছন্ন। কতদিনে যে অন্ধকার দূর হবে, সৃষ্টিসংসারের বিধাতা যিনি, একমাত্র তিনিই সে তত্ত্ব পরিজ্ঞাত। মেয়েটির নাম রঙ্গিণী। আমার মনে হোছে রঙ্গিণী দুবার বোলেছিল কিম্বা হয় তো বলবার ইচ্ছা কোরেছিল, “ডাকাতের দলের একটি লোক”—বোলতে বোলতে থেমে গিয়েছিল। বোধ হয়, যিনি আমার উপকারী বন্ধু, তাঁর কথাই রঙ্গিণী কিছু বোলতে চায়; বোলতে পারে না। আজ একবার জিজ্ঞাসা কোরে দেখবো। রঙ্গিণীর সত্যপরিচয় কিছুই প্রকাশ পাচ্ছে না, আমি যেটা মনে মনে স্থির কোরেছি, সত্যই তাই, কিন্তু রঙ্গিণী মুখ ফুটে কিছুই বলে না। বীরভূমের নাম শুনেই রঙ্গিণী কাল চোমকে গিয়েছিল; তাতেই একরকম ধরা পোড়েছে, আজ আবার একবার সেই সুরটা আমি তুলবো।
বনের ভিতর শেয়াল ডেকে উঠলো। এককালে বহু শগালের কলরব। সন্ধ্যা হয়েছে অনেকক্ষণ; এতক্ষণের পর শেয়ালের ডাক, এটাও একপ্রকার প্রকৃতির খেলা। এ দেশে যাঁদের স্বধর্ম্মে বিশ্বাস, তাঁরা সকলেই সন্ধ্যাবন্দনা করেন। শেয়ালেরা যেমন সন্ধ্যাবন্দনা জানে, মানুষ তেমন জানে না। হুয়া হুয়া, ক্যা হুয়া, সন্ধ্যা হুয়া, রাত্রি হুয়া, উয়া হুয়া এই রবে তারা প্রকৃতির স্তব করে। যে সময়ে যে ভাবে স্তব কোত্তে হয়, সেই সময় সেই সেই রব তারা মানুষের কর্ণে শুনায়; আমারেও শুনালে। শৃগালের রব শ্রবণ কোরে করযোড়ে প্রকৃতিদেবীকে আমি নমস্কার কোল্লেম।
শেয়ালেরা নিস্তব্ধ হলো, আমার কারাগারের দ্বার উন্মুক্ত হয়ে গেল, রঙ্গিণীর প্রবেশ। অন্ধকার ঘরে আলো হলো। মশালটা নামিয়ে রেখে, পাত্রখানি আমার সম্মুখে ধোরে দিয়ে, অভ্যাসমত সাবধানে রঙ্গিণী আমার নিকটে বোসলো। অন্য অন্য দিন রঙ্গিণী আগে কথা কয়, সেদিন আমি ততক্ষণ অপেক্ষা কোত্তে না পেরে অগ্রেই জিজ্ঞাসা কোল্লেম, “আজ যে তুমি এত সকাল সকাল? সে রাত্রের সেই কথা শুনে বুঝি তোমার ভয় হয়েছে? যিনি তোমারে তিরস্কার কোরেছিলেন, করপুটে যার কাছে তুমি দয়া প্রার্থনা কোরেছিলে, যাঁরে তুমি ভূষণলাল বোলে সম্বোধন কোরেছিলে, তিনি এখানে আসবেন, তাই বুঝি তুমি তাঁর আসবার আগেই এসে উপস্থিত হয়েছ?
উদাসভাবে একটু হেসে রঙ্গিণী উত্তর কোল্লে, “না না, সে জন্য নয়; আজ আমাদের সর্দ্দারের ফিরে আসবার কথা, সেই জন্যই—
আমি।—আচ্ছা, রঙ্গিণী! সর্দ্দার তো আসবে, আসুক, তোমাকে আমি একটা কথা জিজ্ঞাসা করি। সেই ভূষণলাল, যিনি তোমারে সর্দ্দারের নামে ভয় দেখিয়েছিলেন, তাঁর সঙ্গে কি তোমার ঘরসংসারেরূ কথাবার্ত্তা চলে?
রঙ্গিণী।—ঘরসংসারের কথা এখানে কারো সঙ্গে আমার চলে না, সে সব কথা কেহই কিছু আমারে জিজ্ঞাসাও করে না।
আমি।—করে না যদি, ঘরসংসারের কথা চলে না যদি, তবে সেই ভূষণলাল কি কোরে তোমার পরিচয় জানতে পাল্লেন?
রঙ্গিণী।—কি পরিচয় তিনি জানতে পেরেছেন?
আমি।—তুমি বাঙালীর মেয়ে, ব্রাহ্মণের কন্যা।
রঙ্গিণী।—ওঃ! এইটুকু?—এটকু এখানকার অনেক লোকেই জেনেছে। যে রাত্রে আমারে এরা ধোরে আনে, সেই রাত্রে আমি তো কেঁদে কেঁদে সারা, আমার গহনাগুলি এরা খুলে নিয়ে, কত রকম ভয় দেখিয়ে জোরে জোরে ধমক দিলে, সেই সময় আমি বোলেছিলেন, আমি গরিব, বাঙলাদেশে আমার বাড়ী, ব্রাহ্মণের মেয়ে আমি, আমারে তোমরা বে-ইজ্জৎ কোরো না, দয়া কোরে ছেড়ে দাও। যত কথা আমি বোলেছিলেম, সমস্তই ভেসে গিয়েছিল, এখন আমার এই দশা! যে দুর্দশায় আমি আছি, সমস্তই তোমার কাছে বোলেছি।
আমি।—তবে ঐ পরিচয়টুকু তুমি দিয়েছিলে, এখন আমি বুঝলেম। আচ্ছা, আর একটি কথা। দুদিন দুবার তুমি একটু একটু ইঙ্গিতে আমার কাছে বোলেছিলে, এখানকার একটি লোক—একটি লোক—সেটি তোমার কি কথা? কোন লোকটিকে লক্ষ্য কোরে তুমি সেইরূপ আভাষ দিবার ইচ্ছা কোরেছিলে, আমার বড় কৌতূহল জন্মেছে, কথাটি আমি শুনতে চাই; কেন লোকটি?
রঙ্গিণী।—(একটু কি ভাবিয়া) কেন? সে কথা শুনে তোমার কি হবে? সেই কথা তুমি মনে কোরে রেখেছ? আমি ভেবেছিলেম, ভুলে গিয়েছ। সে লোকটির কথায় তোমার প্রয়োজন কি?
আমি।—আছে কিছু প্রয়োজন। বিনা প্রয়োজনে কেন আমি তোমাকে ও কথা জিজ্ঞাসা কোরবো? প্রয়োজন আছে। স্পষ্ট কোরে বল দেখি, কে সেই লোকটি?
রঙ্গিণী।—তাঁরে ত তুমি দেখেছ, তবে আর কেন জিজ্ঞাসা কর? তিনি ত তোমার কাছে এসেছিলেন; রোজ রাত্রেই হয় ত আসেন, তাঁরে তুমি দেখেছ, তাঁর কথাবার্ত্তাও শুনেছ, তাঁর সঙ্গে কথাও তুমি কোয়েছ, তবে আবার কেন জিজ্ঞাসা?
আমি।—(সত্য গোপনের ছলে) কার কথা বোলছো? কারে আমি দেখেছি? কোন লোকটি?
রঙ্গিণী।—আহা হা! কিছুই যেন জানেন না! সেই যে,—সেই—যাঁরে আমি ভূষণলাল বোলে—
আমি।—ও হো হো। তিনি? তাঁরই কথা তুমি বোলবে মনে কোরেছিলে? ডাকাতের দলে এত লোক থাকতে কেবল সেই লোকটির কথা আমার কাছে বোলতে কেন তোমার ইচ্ছা হয়েছিল, তাই আমি জানতে চাই।
রঙ্গিণী।—চাও? জানতে কি পার নাই? দেখেছ, কথা শুনেছ, কথা কোয়েছ, এখনো কি জানতে বাকী আছে?
আমি।—দেখ রঙ্গিণি, ও সব ঘোরফের ছেড়ে দাও, তর্কবিতর্কে কথা কাটাকাটি কর আমি ভালবাসি না। সোজা কথা কও। কি কারণে সেই লোকটির কথা আমার কাছে বলবার জন্য তুমি ইচ্ছা কোরেছিলে, সেই কারণটি আমারে জানিয়ে দাও।
রঙ্গিণী।—কারণটি তুমি জানবে? তবে জানো। লোকটির শরীরে খুব দয়া। কথা শুনে মনে হয়, তাঁর সমস্ত শরীর যেন দয়ামায়া-মাখা; বুকের ভিতর-প্রাণের ভিতর যেন দয়ার নদী! কেন, তুমি কি তাঁর দয়ার পরিচয় পাও নাই? যে রাত্রে আমি এখানে ছিলেম, তিনি এলেন, তার পরদিন আমারে তিনি বোলে দিলেন, সেই দিন তাঁর মুখে আমি তোমার নামটি পর্য্যন্ত শুনলেম;—তিনি আমারে বোলে দিলেন, হরিদাসের জন্য ভাল ভাল খাবার সামগ্রী—
আমি।—হাঁ হাঁ, সে কথা আমি শুনেছি, তিনি আমাকে সে কথা বোলেছেন; দয়ার পরিচয়ও আমি পেয়েছি। তিনি আমাকে এখান থেকে মুক্ত কোরে—না না, সে কথা তোমাকে বলা হবে না, তুমি তোমার সর্দ্দারের কাছে লাগাবে, দয়াল, লোকটি বিপদে পোড়বেন, আমিও চিরকাল এখানে বন্দী থাকবো, কিম্বা হয় ত মাথা হারাবো। সে কথা থাক। আচ্ছা, তাঁর শরীরে দয়া আছে, সেই কথাটি বলবার জন্য তোমার ততটা আগ্রহ হয়েছিল কি কারণে?
রঙ্গিণী।—কেবল সেই কথাটি নয়, আরো আছে। ডাকাত-মানুষ ও রকম হয়, ডাকাতের প্রাণে ও রকম দয়া থাকে, কখনো আমি কারো মুখে এমন কথা শুনি নাই। ডাকাতেরা মশালের আগুনে মানুষ পোড়ায়, মেয়েদের নাক-কান ছিঁড়ে গহনা খুলে নেয়, খাটের খুরোতে মেয়েমানুষকে বেঁধে রাখে, তলোয়ার দিয়ে মানুষ কাটে, বন্দুকের গুলি মেরে মানুষ মারে, এই সব কথাই ত শুনে এসেছি, মানুষের উপর ডাকাতেরা দয়া করে, এটা কি আশ্চর্য্য কথা নয়? তুমি ছেলেমানুষ, হও ছেলেমানুষ, তবু ত এ সব কথা বুঝতে পারো; সেই জন্যই তোমার কাছে ঐ আশ্চর্য্য কথা বলবার ইচ্ছা হয়েছিল।
আমি। ইচ্ছা তোমার হোতে পারে বটে, কিন্তু তোমার প্রতি কি রকম দয়া তিনি দেখিয়েছিলেন? বিপদে পোড়ে ডাকাতের হাতে তুমি বন্দিনী হয়ে আছো, একটা ডাকাত তোমার ধর্ম্ম নষ্ট কোরেছে বোলেছ, ততটা অত্যাচার। জানতে পেরেও যে সেই দয়ালু ডাকাতটি তোমার প্রতি দয়া প্রকাশ করেন নাই, এটা তুমি কি রকম ভাবো?
রঙ্গিণী। (সজলনয়নে) দয়া প্রকাশ? আমার প্রতি? আমার তুল্য অভাগিনীর প্রতি তাঁর দয়া? বিধাতা তার প্রতি নির্দ্দয়, মানুষে কি তার প্রতি দয়া কোরে কোন উপকার কোত্তে পারে? বিশেষতঃ যে লোকটা আমার উপর দৌরাত্ম করে, সে হোচ্ছে এখানকার সর্দ্দার, এখানকার সব ডাকাত সেই সর্দ্দারের অধীন; সকলেই সর্দ্দারের ভয় করে, সকলেই সর্দ্দারের হুকুমে চলে, সর্দ্দারের যাতে মনোরঞ্জন হয়, সমস্ত ডাকাত সেই চেষ্টা কোরে থাকে, তা কি তুমি বুঝতে পাচ্ছ না? কপালের লিখন কে খণ্ডায়? আমার কপালে ছিল, আমি ডাকাতের—(হাঁপাইয়া হাঁপাইয়া অশ্রুপাত)
আমি। বুঝেছি বুঝেছি। তুমি চুপ কর! কেঁদো না! কপালের লিখন খণ্ডন করা যায় না, তা আমি বুঝতে পারি; বেশ পারি; আমি নিজেই তার একজন বিলক্ষণ ভুক্তভোগী সাক্ষী। তুমি কেঁদো না; যে সব কৃপায় দুঃখের আগুনে আহুতি হয়, সে সব কথায় দরকার নাই, চুপ কর, ও সব কথা ছেড়ে দাও; আমি আর ও সব কথা তুলবো না। আচ্ছা রঙ্গিণী, তুমি কি কাশীতে গিয়েছিলে?
রঙ্গিণী। (অশ্রুমার্জ্জন করিতে করিতে চকিতনেত্রে আমার মুখপানে চাহিয়া) কাশীতে? কি সব কথা তুমি বলো? সেদিন বোলছিলে বীরভূম, আজ আবার বোলছ কাশী, এ সব তোমার কি রকম কথা? ডাকাতেরা যাদের ধরে, তাদের মাথার ঠিক থাকে না, তারা যেন সব জেগে জেগে স্বপ্ন দেখে, খেয়াল দেখে; তোমারও কি সব কথা সেই রকমের খেয়াল না কি?
আমি। না রঙ্গিণী, খেয়াল নয়; স্বপ্নও নয়; সত্যকথা। আমি যেন দিব্যচক্ষে দেখতে পাচ্ছি, তুমি কাশীতে। অষ্টালঙ্কারভূষিতা বারাণসী শাড়ীপরা এই তুমি—ঠিক যেন এই তুমি সেই কাশীধামে রসিকালাল পিতুড়ীর বাড়ীতে কুমারী-পুজায় ব্রতবতী হয়ে আছ; ডাকাতের এই কারাকূপে তোমার আগমনে আমি যেন সেই রসিকের বাড়ীর বারাণ্ডাগুলি সম্মুখে দেখতে পাচ্ছি! কেন ভাঁড়াও? কেন মিথ্যাকথা কও? ভাগ্যে যা ঘটবার, ঘোটে গেছে, আর কেন মিথ্যাকথা বোলে পাপ বাড়াও? কাশীপুরী পুণ্যক্ষেত্র, সেই পুণ্যক্ষেত্রে তুমি বড় বড় কুমারী-পূজায় পণ্যসঞ্চয় কোরে এসেছ, সেই কুমারীগুলিকেও আমি যেন এই কূপের মধ্যে দর্শন কোচ্ছি; ভাল ভাল কুমারী পুত্রবতী-কুমারী, গর্ভবতী-কুমারী, পণ্যবতী-বিধবা-সতীলক্ষ্মী-কুমারী, কত রকম কুমারী যে আমি এইখানে দেখছি, একমুখে ব্যাখ্যা কোত্তে পাচ্ছি না। আচ্ছা, রঙ্গিণী, যিনি তখন তোমার স্বামীরূপে বারাণসীধাম উজ্জ্বল কোরেছিলেন, যখন তুমি গুজরাটে আসো, তখন কি সেই কানাই বাবু তোমার সঙ্গে এসেছিলেন?
রঙ্গিণী আর বোসে থাকতে পাল্লে না; সাপের ন্যাজে পদার্পণ কোল্লে সাপ যেমন তিরবির কোরে ফণা তুলে খাড়া হয়ে দাঁড়ায়, সেই রকমে দাঁড়িয়ে উঠে, শঙ্কনয়নে আমার দিকে চেয়ে জড়িতস্বরে বোল্লে, “খাও তুমি, খাও তুমি! কোথাকার পাগল! ভালোর জন্য আমি এখানে আসি, পাগলের মুখে পাপকথা শুনতে হবে, এমন জানলে কখনই আমি আসতেম না! কোথাকার ছোঁড়া গো! খেতে হয় খাও, না হয় তো মরো! আর আমি আসবো না;—চোল্লেম!”
রেগে রেগে আমারে গালাগালি দিতে দিতে, রঙ্গিণী চঞ্চলপদে দরজার দিকে অগ্রসর হোতে লাগলো; বোসে বোসেই আমি একটু উচ্চকণ্ঠে ডেকে ডেকে বোলতে লাগলেম, “দাঁড়াও, রঙ্গিণী, দাঁড়াও, যেয়ো না, দুটো কথা শুনে যাও—সতীলক্ষ্মী পূণ্যবতী তুমি, রাগ কোরো না; দুটো কথা শুনে যাও। কানাইবাবু তোমার সঙ্গে গুজরাটে এসেছিলেন, এখনকার প্রবলপ্রতাপ দস্যুচক্রের সর্দ্দার ডাকাত মহারাজ বীরমল্লের মহিষী তুমি,—কানাইবাবু গুজরাটে এসেছিলেন, এখন তিনি বেঁচে আছেন কিম্বা ডাকাতের হাতে প্রাণ দিয়ে প্রায়শ্চিত্ত কোরেছেন, সেই কথাটি আমারে বোলে যাও;—আমি তাঁর মাতুলকে—কে তাঁর মাতুল, তা হয় ত তোমার মনে হয়,—কানাইবাবুর মাতুল তোমার জন্মদাতা পিতা,—বীরভূমে তোমার পিতাকে পত্র লিখে কানাইবাবুর ভাগ্যের কথা জানাবো, তোমার এই দুর্দশার কথা জানাবো, এ পাপের যদি কোন প্রায়শ্চিত্ত থাকে, তোমারে সেই প্রায়শ্চিত্ত আমি করাবো, কানাইবাবুর জন্যও আমি একবার কাঁদবো! দাঁড়াও, দাঁড়াও,—বোলে যাও, কানাইবাবু—”
রঙ্গিণী আর দাঁড়ালো না, যতগুলি কথা আমি বোল্লেম, শুনলে কি না শুনলে, বলতে পারি না, আমার শেষ কথাগুলিও বলা হলো না, ঝনাৎ, ঝনাৎ শব্দে দরজা খুলে, দরজা বন্ধ কোরে, চাবী দিয়ে পলায়ন কোল্লে।
অত্যন্ত উত্তেজিত হয়েছিলেম, রঙ্গিণীর পলায়নের পর একটু ঠাণ্ডা হয়ে আমি বিবেচনা কোল্লেম, কাজটা ভালো হলো না। রঙ্গিণীকে চটিয়ে দিয়ে ভাল কোল্লেম না; আমার মুক্তিলাভ নিশ্চিত কি অনিশ্চিত, কিছুই জানি না; সেই ছদ্মবেশী বন্ধুটি তাঁর অঙ্গীকারপালনে শীঘ্র কৃতকার্য্য হবেন কি না, পরমেশ্বর জানেন; শীঘ্র যদি কৃতকাৰ্য্য না হন, এই অবস্থায় আর আমারে কতদিন এখানে থাকতে হবে, কে বোলতে পারে? রঙ্গিণী চোটে গেল, বীরমল্ল আজ রাত্রে ফিরে আসবে, পাপীয়সী আমার নামে তার কাছে কত রকম চুকলি গাইবে, বীরমল্ল আমারে এখানে নূতন দেখবে, আরো কত রকম যন্ত্রণা বাড়াবে ভাবতে ভাবতে প্রাণ কেমন আকুল হলো।
রাগের তেজে রঙ্গিণী সেই মশালটা নিয়ে যেতে ভুলে গিয়েছিল, ঘরে আলো ছিল, আমি তখন কিছু আহার কোল্লেম না, অস্থিরমনে উঠে দাঁড়িয়ে ঘরের ইতস্ততঃ পরিভ্রমণ কোত্তে লাগলেম। কি যেন দুকর্ম্ম কোরেছি, মনের ভিতর এই রকম সন্দিগ্ধ ভাব; কিছুতেই চিত্তস্থির হোচ্ছে না; ঘরের ভিতর বেড়াচ্ছি, গতি ঠিক রাখতে পাচ্ছি না, মাতালের মত পা যেন টোলে টোলে আসছে, মাথা যেন ভোঁ ভোঁ কোরে ঘুরছে, চক্ষেও যেন ক্ষণে ক্ষণে ধাঁধা লাগছে। কেন এমন হয়? দুশ্চারিণী পাপিনীর মুখের উপর গোটাকতক সত্যকথা বোলেছি, সেটা কিছু অসৎকার্য্য নয়, তবে কেন এমন হয়? বিনা অবলম্বনে বেড়াতে পাল্লেম না, দেয়াল ধোরে ধোরে, এক এক জায়গায় থেমে থেমে, অন্যমনস্কভাবেই পাইচারী কোত্তে লাগলেম। দেয়ালের সৰ্ব্বত্রই মসৃণ, এক জায়গায় হাত ঠিক রাখতে পাচ্ছি না, পিছলে পিছলে সোরে সোরে পোড়ছে; এক জায়গায় কি যেন একটা হাতে ঠেকলো। জায়গাটা উত্তরদিকের একটা কেন্দ্র। সেইখানে আমি থোমকে দাঁড়ালেম। তাদৃশ মসৃণ ভিত্তিগাত্রে কি এমন পদার্থ আছে, ঘর অন্ধকার থাকলে সেটা আমি নিশ্চয় কোত্তে পাত্তেম না, আলো ছিল, বিশেষরূপে নিরীক্ষণ কোরে দেখলেম, দেয়ালের বর্ণের সঙ্গে সমবর্ণের একটা সরু তার আমার নয়নগোচর হলো। কিসের তার? দেয়ালের গায়ে তার বসানো; এ তারে কি কাজ হয়? ভূষণলালের সঙ্কেতকথা মনে পোড়লো। ঘরে অনেক রকম কল-কৌশল আছে; এটা হয় ত তারি কোন রকম কলের তার।
দুইবার তিনবার সূক্ষ্মরূপে নিরীক্ষণ কোল্লেম। খুব সরু তার। প্রাচীন ইমারতের গায়ে নবীন নবীন তরু উৎপন্ন হোলে যেমন তার ন্যায় শ্বেতবর্ণ সরু সরু শিকড় দৃষ্ট হয়, যেটা দেখলেম, যেটাকে “তার” অনুমান কোল্লেম, সেটাও ঠিক সেই রকম। একবার মনে হলো, হয় ত দ্বার, বেমালুম দ্বার; অঙ্গলি-স্পর্শে একটু একটু সন্দেহ জন্মিল। কি এ? সন্দেহভঞ্জনের ইচ্ছায় মশালটা তুলে নিকটে নিয়ে গিয়ে আরো ভাল কোরে পরীক্ষা কোল্লেম; দ্বার নয়, সত্য সত্যই একগাছি সূক্ষ্ম তার। কিসের তার, এমন পরিষ্কার দেয়ালে এত সরু তার কি জন্য? এ তারে কি কার্য্য হয়?
মশালটা যেখানে ছিল, সেইখানে রেখে এলেম; আবার সেই তারগাছটি আস্তে আস্তে খুটে খুটে দেখলেম; একটু যেন সোরে এলো; কৌতুকে কৌতুকে আবার খুটতে আরম্ভ কোল্লেম; তারগাছটি যতদূর দেখা যাচ্ছিল, ঐ রকমে ততদূর পর্য্যন্ত নখদ্বারা স্পর্শ কোল্লেম; যেখানে শেষ, অঙ্গুলির অগ্রভাগ দ্বারা সেই জায়গাটা একটু টিপে দিলেম।
আশ্চর্য্য! যেমন টিপেছি, অমনি ক্ষুদ্র ঘটিকা-যন্ত্রের চকু-ঘর্ষণের শব্দের ন্যায় খর খর শব্দে তারগাছটি কেঁপে উঠলো, দেয়ালের গায়ে একটু ফাঁক হলো। আর আমারে কিছুই কোত্তে হলো না; ভিত্তিগাত্রের গুপ্ততাক যত বড় হয়, ঠিক যেন একখানি শ্বেত পাথরের পাতলা টালি, তত বড় একটি তাক প্রকাশ পেলে; উঁকি মেরে দেখলেম, তাকটা শূন্যগর্ভ নয়, বিবরমধ্যে কি একটা শ্বেতবর্ণের পদার্থ। হন্তদ্বারা সেই পদার্থটা স্পর্শ কোল্লেম, গাঁথা নয়, সন্তর্পণে বসানো। একবার স্পর্শ করি, একবার হাতখানি সরিয়ে নিই; হাত কাঁপে; কি কোত্তে কি হবে, মনে যেন কেমন একপ্রকার ভয় আসে। কেনই বা ভয় পাই, বুঝতে পারি না। ভয়ের অগ্রে সাহস থাকে, ভয়ের পরেও একটু একটু সাহস আসে; আমার হৃদয়ে তখন অল্পে অল্পে সেইরপ সাহসের সঞ্চার; ভয়ের সঙ্গে সাহস; সেই সাহসকে সহায় কোরে পদার্থটি আমি হাতে কোরে তুল্লেম, বাহির কোরে অনলেম। ক্ষুদ্র একটি বাক্স; রজতনির্ম্মিত দিব্য একটি চিত্র করা বাক্স; চিত্রের মধ্যে মধ্যে কতকগুলি অক্ষর খোদা; দেবনাগরের ন্যায় আকার, কিন্তু ঠিক দেবনাগর অক্ষর নয়; পোড়তে পাল্লেম না; বাক্সে চাবী বন্ধ; গা-চাবী নয়, তালা-চাবী। তালাটিও রৌপ্যনির্ম্মিত। কি এ?—কিসের বাক্স? এমন কোরে লুকিয়ে রেখেছে কেন? একে ত এই জীবনসঙ্কট, তার উপর এ সব উৎপাতে কাজ নাই; অনধিকারচর্চ্চা না করাই ভাল। এইরূপ স্থির কোরে, যেখানকার বাক্স, সেইখানেই রেখে দিলেম দেয়ালের আবরণটা বন্ধ করবার চেষ্টা কোল্লেম, পাল্লেম না। খোলাই থাকলো। নূতন ভয়! মন কেমন ধুকপুক কোত্তে লাগলো। আর সেখানে দাঁড়ালেম না, সেখান থেকে সেরে এসে মহাসন্দিগ্ধ অন্তরে আপনার পূৰ্ব্বস্থানে চুপটি কোরে বোসলেম।
কত চিন্তায় প্রাণ আকুল, তার উপর আবার এই এক অভাবনীয় চিন্তা। কল-কৌশল; এ ঘরে অনেক প্রকার কল-কৌশল আছে, একটা কল আমি ধোরে ফেল্লেম; আশ্চর্য্য কল! এমন চমৎকার কল কখন কোথাও আমি দেখি নাই, ঘরের ভিতর এমন সক্ষম কল থাকতে পারে, লোকের মুখেও কখন শুনি নাই। নানাখানা ভাবছি, রাত্রি কত, অনুভব কোত্তে পাচ্ছি না, দ্বারে চাবি খোলা শব্দ। অবিলম্বেই দরজা খুলে গেল, আমার সম্মুখে ভূষণলাল।
প্রবেশ কোরেই এদিক ওদিক চেয়ে, যেন একটু চমকিতস্বরে ভূষণলাল আমারে জিজ্ঞাসা কোল্লেন “এ কি হরিদাস? ঘরে আলো কেন? কে দিয়ে গেল?”
ক্ষণেকের জন্য ভাবনাটা চেপে রেখে সসম্ভ্রমে আমি উত্তর কোল্লেম, রঙ্গিণী রেখে গিয়েছে। তারে আমি গোটা দুই গুপ্তকথা জিজ্ঞাসা কোরেছিলেম, তাই শুনে আমার উপর রাগ কোরে, রাগ কোরে কি ভয় পেয়ে রঙ্গিণীটা তাড়াতাড়ি ছুটে পালিয়েছে, মশালটা নিয়ে যেতে ভুলে গিয়েছে।
হাস্য কোরে ভূষণলাল পুনরায় জিজ্ঞাসা কোল্লেন, “এমন কথা কি তারে তুমি জিজ্ঞাসা কোরেছিলে, যাতে সে রাগ করে, ভয় পায়, এখানকার নিয়ম অমান্য কোরে, মশাল নিয়ে যেতে ভুলে যায়, এমন গুপ্তকথা কি তোমার?”
শশব্যস্তে আমি বোল্লেম, “সে কথা পরে বোলছি, আগে একটা আশ্চর্য্য কথা বলি। এই ঘরের ভিতর আমি একটা আশ্চর্য্য পদার্থ দৰ্শন কোরেছি। আপনি বোলেছিলেন, এ ঘরে অনেক প্রকার কল-কৌ—”
কথা সমাপ্ত করবার অবসর না দিয়েই মহা আগ্রহে চঞ্চলকণ্ঠে ভূষণলাল আবার আমারে জিজ্ঞাসা কোলেন, “কি—কি—কি, আশ্চর্য্য পদার্থ? কি পদার্থ তুমি এখানে দেখেছ? শীঘ্র বল, শীঘ্র বল! আশ্চর্য্য পদার্থের অন্বেষণেই আমি ডাকাতের সঙ্গে ডাকাত হয়ে বেড়াচ্ছি, শীঘ্র বল, কি আশ্চার্য্য পদার্থ?”
আমি দাঁড়ালেম যে খোপের ভিতর সেই রজত-বাক্স সেই খোপের কাছে ছুটে গিয়ে সেই বাক্সটি হাতে কোরে আনলেম; শীকার দেখে বাজপক্ষীরা যেমন ছোঁ মারে, সেই রকমে ছোঁ মেরে ভূষণলাল সেই বাক্সটি আমার হাত থেকে আকর্ষণ কোরে নিলেন; তাঁর বদনমণ্ডল অকস্মাৎ রক্তবর্ণ হয়ে এলো; উলটে পালটে বাক্সটি ভাল কোরে দেখে, আহ্লাদে আমার মস্তকে হস্তার্পণ কোরে, তিনি গদগদরে বোলে উঠলেন, “আশ্চর্য্য আবিষ্ক্রিয়া! তুমি দীর্ঘজীবী হও! বোলেছিলেম, আমি তোমার বন্ধু; এখন জানতে পাল্লেম, তুমি হরিদাস, তুমিই আমার পরম প্রিয়তম মহোপকারী বন্ধু! এই বস্তুর নিমিত্তই আমি এই ভয়ঙ্কর স্থানে বহুদিন আত্মগোপন কোরে আছি।”
আহ্লাদে এই সকল কথা বোলতে বোলতে দুই বাহু, প্রসারণ কোরে সস্নেহে ভূষণলাল আমারে আলিঙ্গন কোল্লেন। আলিঙ্গন করবার সময় বাক্সটি তিনি ভূতলে রেখেছিলেন, ভূতলেই থাকলো, অগ্রে তিনি সে কলের কাছে গিয়ে সূক্ষ্মরূপে পরীক্ষা কোরে কোরে সেই কলটি যথাস্থানে সংলগ্ন কোল্লেন। যেমন দেয়াল, তেমনি হলো। অতঃপর তিনি ভিতরদিক থেকে কারাদ্বার অবরুদ্ধে কোরে দিলেন, মশালটা নিৰ্ব্বাণ কোল্লেন না, বক্সটি হাতে কোরে নিয়ে প্রফুল্লবদনে উপবেশন কোল্লেন, আমিও তাঁর সম্মুখে গিয়ে বোসলেম।
বাক্সটি কোলের উপর রেখে, ফুল্লনয়নে আমার মুখপানে চেয়ে, ভূষণলাল বোলতে লাগলেন, “আশ্চর্য্য আবিষ্ক্রিয়া! এই কার্য্য হবে বোলেই ভগবান তোমাকে ডাকাতের কবলে নিক্ষেপ কোরেছিলেন! ধন্য ভগবান!”
আমিও তৎক্ষণাৎ প্রতিধনি কোল্লেম, “ধন্য ভগবান! ভগবানের ইচ্ছায় বিশ্বসংসার বিঘূর্ণিত হোচ্ছে। ভগবান স্বয়ং মঙ্গলময়, তাঁর সমস্ত ইচ্ছাও মঙ্গলময়ী। আমি ডাকাতের হাতে পোড়েছি, এটিও তাঁর ইচ্ছা ছিল। ডাকাতের গুহামধ্যে আপনার তুল্য মহাপুরষকে আমি বন্ধুরূপে প্রাপ্ত হব, এটিও সেই মঙ্গলময়ের ইচ্ছা; তিনিই আপনাকে আমার রক্ষাকর্ত্তারূপে এই বিপদক্ষেত্রে এনে দিয়েছেন! আপনি যদি—”
আমার কথা সমাপ্ত হবার অগ্রেই প্রসন্নবদনে প্রশান্তস্বরে ভূষণলাল বোল্লেন, “তার আর সন্দেহ কি? সমস্তই সেই মঙ্গলময়ের ইচ্ছা। এই যে রজতাধারটি তুমি আবিষ্কার কোরেছ, এটি যে আমার পক্ষে কত মুল্যবান, কত উপকারসূচক, তা তুমি এখন জানতে পাচ্ছ না; একটু পরেই জানতে পারবে। এখনো আমাদের অনেক কাজ বাকী। এখন একবার আমাকে স্থানান্তরে যেতে হবে, শীঘ্রই ফিরে আসবো, অল্পক্ষণ তুমি নিশ্চিন্তমনে এইখানেই বোসে থাকো; আজ রাত্রেই আমি তোমাকে উদ্ধার কোরে দিব। তোমার হয় ত মনে আছে, আজ রাত্রে বীরমল্লের ফিরে আসবার কথা; দলবল সমস্তই তার সঙ্গে ফিরবে,—মানুষ, কুকুর, লাঠি, সড়কি, ঢাল, তলোয়ার, সমস্তই তার সঙ্গে থাকবে; তারা ফিরে আসবার অগ্রেই আমি বেরিয়ে যাব, তারা এসে উপস্থিত হবার পর আমি ফিরে এসে তাদের সঙ্গে দেখা কোরবো। দেখ হরিদাস, মানুষের মন যে কেবল বিপদেই অস্থির হয়, তা নয়, আনন্দেও মানবচিত্ত অস্থির হয়ে থাকে। আমার হৃদয়ে এখন পূর্ণানন্দের আবির্ভাব, সেই আনন্দে আমার মন এখন বড় অস্থির। মশাল ফেলে রঙ্গিণীটা পালিয়ে গিয়েছে, কি গুপ্তকথা তারে তুমি জিজ্ঞাসা কোরেছিলে, সেটি জানবার জন্য আমার বড় কৌতুহল, আবিষ্ক্রিয়ার আনন্দে সেই রহস্য-শ্রবণে একটু বাধা জন্মিল, কিছু বিলম্ব হলো, তা হোক, মশালটা ফেলে গিয়ে ছুড়িটা আমাদের বিশেষ উপকার কোরেছে; মশালটা না থাকলে তুমি ঐ আশ্চর্য্য আবিষ্কারে সমর্থ হোতে না। আচ্ছা, সে সব কথা পরে হবে, এখন আমি চোল্লেম, অল্পক্ষণের জন্যই চোল্লেম; তুমি থাকো, নির্ভয়ে বসে থাকো, কোন ভয় নাই!”
এইবার মশলটা নিবিয়ে দিয়ে, অঙ্গবস্ত্রমধ্যে বাক্সটি লুকিয়ে নিয়ে, ভূষণলাল বেরিয়ে গেলেন, দ্বারে দস্তুরমত চাবি পোড়লো। আমি অন্ধকারে একাকী বোসে রইলেম। ভূষণলালের আনন্দের হেতু অনুভব কোত্তে পাল্লেম না, কিন্তু ঐ বাক্সটি যে তাঁর উপকারে আসবে, তাঁর কথা শুনে সেটি আমি বেশ বুঝতে পাল্লেম। কি উপকার, যদিও সেটি আমার অজ্ঞাত, তথাপি আমার উদ্ধারের পথে সেই নির্জীব বাক্স অনুকূল, সে অংশে আমার কোন সংশয় থাকলো না; কারাকূপে আনন্দ আমি ভুলে গিয়েছিলেম, নিভাঁজ আনন্দ কোন কালেই বা আমি উপভোগ কোরেছি, সে কথা নয়, তবুও মুক্ত বাতাসে নিষ্পাপ অন্তরে যে একটু একটু আনন্দের উদয় হোতো, ডাকাতের গহ্বরে সে আনন্দটুকুও আমি ভুলে গিয়েছিলেন, এই রাত্রে সেই আনন্দের অল্প অল্প আলো আমার হৃদয়ে বিভাসিত হলো। ভূষণলাল আমার বন্ধু—নিজ মুখেই তিনি বোলেছেন, তিনি আমার বন্ধু; বন্ধুর আনন্দেই আনন্দ সম্ভোগ করা যায়, এটি মানুষের স্বভাবসঙ্গত; ভূষণলালের আনন্দেই আজ আমার আনন্দ। ফল এখনো অনিশ্চিত, তথাপি বন্ধুর আনন্দেই আমার আনন্দ।
দুশ্চিন্তার রঙ্গভূমিতে আনন্দের স্থান অতি অল্প হয়। আমার অন্তরে সে সময় আনন্দসঞ্চার হোলেও দুশ্চিন্তা দূরে গেল না। সর্দ্দার ডাকাত ফিরে আসছে, সে আমাকে দেখে নাই, এই রাত্রে নিশ্চয়ই দেখবে, দশহাজার টাকা দিতে আমি অক্ষম, এই কথাও শুনবে, কোন লোকের নামে টাকার জন্য চিঠি লিখতেও আমি নারাজ, দলের লোকেরা সে কথাও তাহাকে বোলবে, এই সব তত্ত্ব জানতে পেরে দোর্দণ্ডপ্রতাপ বীরমল নিশ্চয়ই আমার উপর দৌরাত্ম্য কোত্তে আসবে, তখন আমি কি কোরবো? বিশেষতঃ সেই রঙ্গিণী; সেই রঙ্গিণী আমার উপর রেগে আছে, সর্দ্দার বীরমল্ল সেই রঙ্গিণীর প্রণয়-পাশে বাঁধা, রঙ্গিণী অবশ্যই তার কাছে আমার নিন্দা কোরবে, মনগড়া অপরাধের কথা জানাবে, রঙ্গিণীর উত্তেজনায় রঙ্গলাল বীরমল্ল আরো ক্ষিপ্ত হয়ে উঠবে, সে সময় আমার রক্ষাকর্ত্তা কে হবে? ভূষণলাল ফিরে আসবার অগ্রেই বীরমল্ল আসবে, ভূষণলাল নিজেই সে কথা আমাকে বোলে গিয়েছেন। বীরমল্ল যখন আমাকে তাড়না কোরবে, ভূষণলাল—তিনি যিনিই হউন, ভূষণলাল যদি তখন এখানে উপস্থিত থাকেন, সর্দ্দারের অধীন তিনি, তিনিই বা তখন আমার কি উপকার কোত্তে পারবেন। সেই ভাবনায় আমি অধীর হোলেম। এই সময় আর একটা চিন্তা এলো। বিদেশে একজন পথিক আমি, অপরিচিত পথিক বালক; পথ ভুলে বনের ভিতর এসে পোড়েছিলেম, বনের ডাকাত অতর্কিতে আমাকে ধোরে ফেলেছিল, এটাও যেন মনে লয় না। বোধ হয়, বনপথে আমি আসছি, এই সংবাদটা কোন লোক ডাকাতের দলে বহন কোরে থাকবে। তেমন লোকই বা কে? এখানে তেমন শত্রুই বা আমার কে আছে? ঠিক! রক্তদন্ত! নফর ঘোষাল বলেছিল, রক্তদন্ত গুজরাটে এসেছে। সেই কথাই হয় ত ঠিক! তা না হোলে ততদূর শত্রুতা করে, তেমন লোক গুজরাটে থাকা অসম্ভব। রক্তদন্ত গুজরাটে এসেছে। তার সঙ্গেও হয় ত আরো লোক থাকতে পারে; সেই সকল লোকও হয় ত এই ডাকাতের দলে ভর্ত্তি হয়ে আছে। রক্তদন্ত আমার জাতশত্রু! রক্তদন্ত আমার জীবনদায়িনী কোমলাঙ্গী নির্ম্মলকুমারী অমরকুমারীকে চুরি কোরেছে, আমাকেও ডাকাতের দলে ধোরিয়ে দিয়েছে, বিবিধ দুশ্চিন্তার সঙ্গে এই ভাবটাও তখন আমার মনের ভিতর উদয় হলো। বিপত্তিকাণ্ডারী হরি শ্রীমধুসূদন! তিনিই আমার আশা, তিনিই ভরসা তিনিই সম্বল, তিনিই আমার সৰ্ব্বস্ব। ঘোর বিপত্তিকালে সেই শ্রীমধুসূদনের নাম স্মরণ কোরে ঘোর অন্ধকারে আমি নয়ন মুদে বসে থাকলেম। ভূষণলাল এলেন না।