প্রথম খণ্ড
- প্রথম খণ্ড
- প্রথম কল্প
- দ্বিতীয় কল্প
- তৃতীয় কল্প
- চতুর্থ কল্প
- পঞ্চম কল্প
- অষ্টম কল্প
- নবম কল্প
- দশম কল্প
- একাদশ কল্প
- দ্বাদশ কল্প
- ত্রয়োদশ কল্প
- চতুর্দ্দশ কল্প
- পঞ্চদশ কল্প
- ষোড়শ কল্প
- সপ্তদশ কল্প
- অষ্টাদশ কল্প
- উনবিংশ কল্প
- বিংশ কল্প
- একবিংশ কল্প
- দ্বাবিংশ কল্প
- ত্রয়োবিংশ কল্প
- চতুর্ব্বিংশ কল্প
- পঞ্চবিংশ কল্প
- ষড়্বিংশ কল্প
- সপ্তবিংশ কল্প
- অষ্টাবিংশ কল্প
- ঊনত্রিংশ কল্প
হরিদাসের গুপ্তকথা
বাবুর নাম সর্ব্বানন্দ মুস্তফী;—বসু মস্তফী। পুত্রসন্তান নাই, তিনটী কন্যা। জ্যেষ্ঠা কন্যার নাম শ্যামাসুন্দরী, মধ্যমা উমাকালী, কনিষ্ঠা আশালতা। বড়মেয়েটী বিধবা, মেজোটী সধবা, ছোটটী অবিবাহিতা, বয়ঃক্রম প্রায় দশ বৎসর। বাবুর বাড়ীতেই আমি থাকলেম। বাবু মহৎলোক, নামলব্ধ জমীদার, বৎসরে প্রায় আশী হাজার টাকা আয়, সংসারে বিলক্ষণ জলজলাট। আমার প্রতি বাবুর বেশ আদর-যত্ন। টোলে আমি সংস্কৃতভাষা শিক্ষা কোরেছিলেম, সংস্কৃতের প্রতি বাবুরও বিশেষ অনুরাগ, সেই কারণেই তিনি আমাকে বেশী ভালবাসলেন। মাসখানেক থাকতে থাকতে একদিন তিনি আমাকে বোল্লেন, “দেশে এখন ইংরেজের রাজত্ব, কিছু কিছু ইংরেজী শিক্ষা করা ভাল, তুমি ইংরেজী ভাষা শিক্ষা কর।”—তৎক্ষণাৎ আমি সম্মত হোলেম। আমি পর, কে আমি, তা তিনি কিছুই জানতেন না, জাতি কি, তাও আমি বোলতে পাত্তেম না, বাড়ীতে রসুই-ব্রাহ্মণ ছিল, ব্রাহ্মণের পাককরা অন্ন সকলেই খায়, তাই আমি আহার কোত্তেম। আহারে কিছুই কষ্ট ছিল না, বাবু আমাকে ভিন্ন ভাবতেন না, উপাদেয় সামগ্রী আহার কোত্তেম, উত্তম গৃহে উত্তম শয্যায় শয়ন কোত্তেম, নুতন লোকেরা আমাকে বাবুর বাড়ীর ছেলে বোলেই মনে কোত্তো, দিব্য সুখস্বচ্ছন্দেই সে বাড়ীতে আমি থাকলেম। বাবু আমার জন্য একজন শিক্ষক রেখে দিলেন, স্কুলে দিলেন না, সেই শিক্ষকের নিকটেই আমি ইংরাজী ভাষা শিক্ষা কোত্তে লাগলেম।
বাড়ীখানি বৃহৎ; তিন মহল। সদরমহলে পুজার দালান, তিনদিকে বারান্দাযুক্ত বৈঠকখানা, নীচের একদিকের বৈঠকখানায় জমিদারী সেরেস্তা। অন্দরমহলে মন্ত্রীলোকেরা থাকেন, তৃতীয় মহলে একটী সরোবর, চারিধারে উচ্চ প্রাচীর, প্রাচীরের কোলে কোলে নানাজাতি ফলফলের গাছ; একধারে খুব লম্বা একখানা চালাঘর, সেই ঘরে অনেকগুলি গরু থাকে, রাখালেরাও একপাশে শয়ন করে। সুন্দর বন্দোবস্ত।
একমাস আমি থাকলেম। আমার রীতিব্যবহার দেখে বাবু আমাকে অন্দরমহলেও প্রবেশ করবার অনুমতি দিলেন। রাত্রিকালে সদরমহলের উপরের একটী বৈঠকখানায় আমি শয়ন কোত্তেম। অন্দরে বাবুর ধর্ম্মপত্নী আর ছোট-মেয়েটী। তারা ছাড়া সম্পর্কীয় পাঁচ-সাতটী স্ত্রীলোক নিয়তই সেই বাড়ীতে বাস কোত্তেন। কর্ত্তার বড়মেয়েটী বিধবা বটেন, কিন্তু পিত্রালয়ে থাকতেন না, শ্বশুরালয়েই থাকতেন; মধ্যমাটীও শ্বশুরালয়বাসিনী। পূৰ্ব্বে বোলেছি, ছোটমেয়েটীর নাম আশালতা। থাকতে থাকতে আশালতার সঙ্গে আমার বেশ ভাব হলো। আশালতা লেখাপড়া করেন, রামায়ণ-মহাভারত বেশ শুদ্ধ শুদ্ধ উচ্চারণে পাঠ কোত্তে পারেন, আমার সঙ্গে আশালতার লেখাপড়ার চর্চা হতো, আরও অনেক রকম ভাল ভাল কথাবার্ত্তা চোলতে, গৃহিণী আমাকে সন্তানের মতন আদর কোত্তেন, অপরা স্ত্রীলোকেরাও আমাকে আপন ভেবে স্নেহ-যত্ন কোত্তেন, কোন সুখের আমার অভাব ছিল না। অবকাশকালে সর্ব্বানন্দবাবু আমাকে নিকটে বোসিয়ে লেখাপড়ার কথা জিজ্ঞাসা কোত্তেন, যেমন জানি, যতদূর শিখেছিলেম, সেই রকম উত্তর কোত্তেম, শুনে তিনি খুসী হতেন।
বাড়ীতে তিনজন চাকর, পাঁচজন দাসী, একজন মালী, তিনজন রাখাল আর আট দশ জন সেরেস্তার আমলা। ইহা ছাড়া দুইজন রসই ব্রাহ্মণ আর একজন ব্রাহ্মণী ছিল। চাকরেরা সকলেই আমাকে বাবুর ছেলের মতন মান্য কোত্তো আর ভালবাসতো।
একটা কথা এইখানে বোলে রাখি। আমার পূৰ্ব্বকাহিনীতে যেখানে যেখানে যে সকল লোকের যে যে নাম বর্ণিত আছে, সেই নামগুলি কাল্পনিক, এ কাহিনীর নামগুলিও অকাল্পনিক নহে; তথাপি পাঠক-মহাশয় এই সকল নামের সঙ্গে আসল আসল নামের অনেকটা সাদৃশ্য দেখতে পাবেন।
ছয় মাস আমি সর্ব্বানন্দবাবুর বাড়ীতে নির্বিঘ্নে পরমসুখেই থাকলেম। এক রাত্রে বাবু আমাকে জিজ্ঞাসা কোল্লেন, ‘হরিদাস! তুমি কি নিজের পরিচয় কিছুই জান না? কোথায় তোমার নিবাস, কে তোমার মাতা-পিতা, কিছুই কি তোমার জানা নাই?”—আমি উত্তর কোল্লেম, “আজ্ঞে না, কিছুই আমি জানি না। জানি শুধু আমার নাম হরিদাস। নিতান্ত শিশুকাল থেকে হুগলীজেলার সপ্তগ্রামে অধ্যাপকের গৃহে আমি প্রতিপালিত হয়েছি, অধ্যাপকের মত্যুর পরে সেই ভিকারী বেশধারী লোকটা আমাকে একখানা অজানা বাড়ীতে নিয়ে আসে, তার পর বর্দ্ধমানে এনেছিল, তার পর যা হয়েছে, আপনি জ্ঞাত আছেন। বাসস্থান জানি না, জাতি জানি না, আপনার লোক কে কোথায় আছে, আছে কিনা তা পর্য্যন্ত আমি জানি না।”
আমার উক্তিগুলি শ্রবণ কোরে, একদৃষ্টে আমার মুখপানে চেয়ে, বাবু অনেকক্ষণ চুপ করে থাকলেন, তার পর মৃদুস্বরে বোল্লেন, ‘আশ্চর্য্য বটে! আচ্ছা, যাতে সন্ধান হয়, আমি তার উপায় করবার জন্য সবিশেষ যত্ন কোরবো। ভদ্রলোকের ছেলে, হীনবংশে তোমার জন্ম নয়, চেহারাই সে কথা বেলে দিচ্ছে। আমি তোমাকে পুত্রতুল্য ভালবেসেছি, চিরদিন ভালবাসবো, যাতে তোমার মঙ্গল হয়, অবশ্য সেই চেষ্টা আমি কোরবো। তুমি কিছু ভেবো না, মন দিয়ে লেখাপড়া শিক্ষা কর।”
আমি মাথা হেঁট কোরে চুপ কোরে থাকলেম। বাবু আমাকে যথার্থই পত্ৰতুল্য স্নেহ করেন, সেইটী স্মরণ কোরে পরমেশ্বরকে ধন্যবাদ দিলেম।
আর একমাস অতীত। একদিন বৈকালে আমি বৈঠকখানার বারান্দায় বোসে আছি, নিকটে কেহই নাই, এমন সময় গাড়ীবারান্দার নীচে একখানা গাড়ী এসে দাঁড়ালো। চমৎকার গাড়ী। দামী দামী সাজপরা বড় বড় দুটী কৃষ্ণবর্ণ অশ্ব সেই গাড়ীতে সংযোজিত। গাড়ীর পশ্চাতে উর্দ্দীতকমাধারী দুজন আরদালী, কোচবাক্সেও সারথির বামদিকে সেই রকমের আর একজন আরদালী। গাড়ীতে কে এলেন, অগ্রে আমি জানতে পাল্লেম না, গাড়ীখানি ভাল কোরে দেখবার জন্য আগ্রহে আগ্রহে উপর থেকে নেমে এলেম। বাবু তখন বাড়ীতে ছিলেন না, সেরেস্তার দুজন আমলা আর বাড়ীর দুজন চাকর সেই গাড়ীর সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছে, পরস্পর মুখচাহাচাহি কোচ্চে। মূল্যবান পরিচ্ছদ-পরিহিত একটী বাবু গাড়ী থেকে নামলেন। সম্মুখে যারা দাঁড়িয়ে ছিল, তারা সকলেই করপুটে সেই বাবুটীকে নমস্কার কোল্লে, দেখাদেখি আমিও নমকার কোল্লেম। কারো পানে না চেয়েই, কোন কথা না বোলেই, বাবু সরাসর উপরে গিয়ে উঠলেন। আমরাও সঙ্গে সঙ্গে গেলেম। চুপি চুপি একজনকে জিজ্ঞাসা কোরে জানলেম, জামাইবাবু।
দিব্য চেহারা। আকার দীর্ঘ, অঙ্গ স্থূল, বদন গম্ভীর, বর্ণ গৌর, দিব্য মুখ, দিব্য গোঁফ, মাথার চুলগলি খাটো খাটো, মাঝখানে সিঁতিকাটা আর গোঁফের দুই চারিগাছ চুল পাকা; বয়স অনুমান ৪৫/৪৬ বৎসর। পরিধানে শান্তিপুরে কালাপেড়ে মিহি ধুতী, অঙ্গে চাপ্কানের উপর সবুজ শাটিনের চোকা, পায়ে পঞ্চবর্ণের মোজা, মোজার উপর ফুলদার জরীর জুতা, বুকপকেটে সোণার চেইনঝুলানো ঘড়ী, দশ অঙ্গুলীতে দশ অঙ্গুরী; হস্তে একগাছি গজদন্তমণ্ডিত সূক্ষ্ম যষ্টি।
জামাইবাবু উপরে উঠেই, ভিতরদিকের বারান্দার একখানি চেয়ারের উপর উপবেশন কোল্লেন, দুই পাশে দুজন চাকর বড় বড় পাখা হাতে কোরে বাতাস কোত্তে আরম্ভ কোল্লে, একজন চাকর সোণার অলিবোলাতে তামাক সেজে এনে দিলে। জামাইবাব, আপন মনে সালমোড়া বৃহৎ নলে ওষ্ঠাপর্ণ কোরে উদাসভাবে ধূম নির্গত কোত্তে লাগলেন; মুখে বাক্য নাই। চেয়ারের একটু তফাতে আমি চুপ কোরে দাঁড়িয়ে ছিলেম, জামাইবাবুর মন কিছু চঞ্চল, চঞ্চলনয়নে তিন দিকে চাইতে চাইতে হঠাৎ একবার আমার দিকে নজর পোড়লো। ভাবে বুঝলেম, আমার দিকে চেয়েই তিনি যেন একটু চোমকে উঠলেন। ভাব গোপনের ক্ষমতা বেশ, এমনি সাবধানে তৎক্ষণাৎ সামলে নিলেন যে, কেহই কিছু অনুভব কোত্তে পাল্লে না। সকলের অলক্ষিতে চকিতমাত্রেই কাটা হয়ে গেল; আমার নাকি কিছু কূটদৃষ্টি, সেই চমকিত ভাবটা কেবল আমিই জানতে পাল্লেম।
অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে অন্যমনস্কভাবে একজন আমলাকে সম্বোধন কোরে জামাইবাবু জিজ্ঞাসা কোল্লেন, “কৰ্ত্তা কোথায়?”—উত্তর পেলেন, “আহরান্তে বাগানে গিয়েছেন, এখনি আসবেন। আজ আপনার আসবার কথা ছিল, সেটা তিনি জানেন, অধিক বিলম্ব হবে না।”
বাস্তবিক দশ মিনিট পরেই কৰ্ত্তা বাড়ী এলেন, দস্তুরমত আদর-অভ্যর্থনা কোরে জামাইয়ের কুশলবার্ত্তা জিজ্ঞাসা কোল্লেন। দুই এক কথায় উত্তর দিয়ে জামাইবাবু পুনৰ্ব্বার গম্ভীরভাব ধারণ কোল্লেন; আসন থেকে উঠলেন না, শ্বশুরকে একটী প্রণামও কোল্লেন না; আদরের মধ্যে আলবোলার নলটীকে ক্ষণেকের জন্য ঊরদেশের উপর বিশ্রাম দিলেন।
কৰ্ত্তা একবার অন্দরমহলে গেলেন, একটু পরে জামাইবাবুকে ডেকে পাঠালেন। জামাইবাবু একজন চাকরের সঙ্গে অন্দরে প্রবেশ কোল্লেন, কৌতূহলবশে আমিও পশ্চাৎ পশ্চাৎ চোল্লেম। জলযোগের আয়োজন হলো, জামাইবাবু জল খেলেন, আমি একটু তফাতে তফাতে ঘুরতে লাগলেম, কিন্তু জামাইবাবুর দিকে একটু একটু কটাক্ষ থাকলো। কটাক্ষভঙ্গীতে বুঝতে পাল্লেম, আমার দিকেও জামাইবাবুর কটাক্ষ। সে কটাক্ষের প্রত্যক্ষ ফলও তৎক্ষণাৎ জানা গেল। কৰ্ত্তার দিকে চেয়ে, আমাকে লক্ষ্য কোরে, জামাইবাবু জিজ্ঞাসা কোল্লেন, “আপনি যে দেখছি, মাঝে মাঝে নূতন নূতন লোকজন আমদানী কোচ্ছেন। ঐ ছোকরাটীকে আপনি কোথায় পেলেন?”
প্রশ্ন শুনেই আমি অমনি ধাঁ কোরে সেখান থেকে সোরে গেলেম; সে প্রশ্নে কৰ্ত্তা কি উত্তর দিলেন, শুনতে পেলেম না; শোনবার তত আবশ্যকও ছিল না। একটু পরে জামাইকে সঙ্গে নিয়ে কর্ত্তাবাবু বাহিরের বৈঠকখানায় এসে বোসলেন, আমিও অন্যদিক দিয়ে বৈঠকখানার বারান্দার ধারে গিয়ে দাঁড়ালেম। সন্ধ্যা হবার অধিক বিলম্ব ছিল না, একটু পরেই সন্ধ্যা হলো; বৈঠকখানার ঘরে ঘরে বাতী জ্বোল্লো; কৰ্ত্তাবাবুর খাসকামরায় বসা-সেজে ডবল বাতী। ঘরে কেবল কৰ্ত্তা আর জামাইবাবু।
যেটী কৰ্ত্তাবাবুর খাসকামরা, সেই ঘরের পার্শ্বে ক্ষুদ্র একটী পুস্তকাগার। আমি একাকী সেই পুস্তকাগারে বোসে একখানি ইংরাজী পুস্তক পাঠ কোচ্ছি, কর্ত্তার গৃহে কিছু বড় বড় কথা শুনতে পেলেম। শ্বশুর-জামাই নির্জ্জনে কথোপকথন কোচ্ছেন, সে কথায় কাণ দিবার আমার কোন দরকার ছিল না, কিন্তু চুপি চুপি কথা নয়, নিতান্ত গোপনীয় কথাও হতে পারে না, বিশেষতঃ শোনবার ইচ্ছা না থাকলেও কথাগুলি আমার কর্ণে প্রবেশ কোত্তে লাগলো। দুটী ঘরের মধ্যস্থলে একটী দরজা, সে দরজা তখন বন্ধ ছিল না। আমি পুস্তকাগারে আছি, কত্তা সেটা হয় তো জানতেন না। তিনি একটু জোর গলায় কথা কোচ্ছিলেন, তাই শুনে কেমন একটা আগ্রহ হলো। দরজা ভেজানো ছিল। বইখানি বন্ধ কোরে রেখে, সেই দরজার পাশে গিয়ে দাঁড়ালেম। গুরগৃহে ঘনশ্যামের সঙ্গে গুরুপত্নীর যখন কথা হয়, তখন যে রকমে লুকিয়ে লুকিয়ে আমি শুনেছিলেম, এখন সে লুকোচরিভাব ছিল না, অথচ দাঁড়ালো যেন সেই ভাব।
কর্ত্তা বোল্লেন, “দেখ মোহনলাল! দিন দিন তুমি বেজায় বাজেখরচ আরম্ভ কোরেছ। যা যখন চাও, তাই তখন আমি দিই, তাতেও তোমার না, প্রায় প্রতি মাসেই রাশি রাশি দেনা হয়; আজ আবার দশ হাজার টাকা চাচ্ছো;—দিব আমি, তোমরা ভিন্ন আর আমার কে আছে? থাকলে তোমরাই পাবে, না থাকলে তোমরাই বঞ্চিত হবে। আমি মনে কোরেছি, এখন অবধি আর আমি তোমার বেহিসাবী খরচে প্রশ্রয় দিব না। আমার তিনটী মাত্র কন্যা, তিন নামেই আমি সমান সমান অংশে উইল কোরে রেখেছি। তুমি যদি বার বার এই রকম অপব্যয় কর, বার বার বেহিসাবী টাকা লও, তা হোলে উইলের ক্রোড়পত্রে তোমার অংশে সেই সব টাকা আমি বাদ দিয়ে নতুন ব্যবস্থা কোরে যাব, তখন তুমি আমাকে দোষ দিতে পারবে না।”
এই পর্য্যন্ত বোলে, অঙ্গুলিসঙ্কেতে একটী সিন্দুক দেখিয়ে দিয়ে, কর্ত্তা আবার বোল্লেন, ঐ সিন্দুকেই উইল আছে, যদি দেখতে চাও, দেখতে পার।” একটু যেন লজ্জা পেয়ে জামাইবাবু বল্লেন, “না, আপনার সিন্দুক আপনার উইল, এখন আমার দেখবার অধিকার নাই। আপনি অনুমতি কোচ্ছেন, এখন অবধি আমি সাবধান হয়েই চোলবো, এইবার একটা দায় পোড়েছে, দশ হাজার টাকা হোলেই সেই দায় থেকে আমি মুক্ত হোতে পারি।”
খানিকক্ষণ আর কোন কথাবার্ত্তা আমি শুনতে পেলেম না, তার পর একটী বাক্স খুলে কর্ত্তাবাবু জামাইবাবুর হস্তে খানকতক নোট দিলেন। বুঝতে পাল্লেম, দশ হাজার টাকা।
রাত্রি এক প্রহর অতীত। একজন দাসী এসে সংবাদ দিলে, শ্বশুর-জামাই উভয়েই অন্দরে প্রবেশ করবার জন্য সে ঘর থেকে বেরুলেন। আমি তখন অন্যদিক দিয়ে বেরিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছিলেম, কৰ্ত্তা আমায় দেখেই একটু দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা কোল্লেন, “কি হরিদাস! চুপটী কোরে এইখানেই দাঁড়িয়ে আছ? পড়াশনা সাঙ্গ হয়েছে?”
আমি উত্তর কোল্লেম, “আজ্ঞে হাঁ, নূতন বইখানির দশ পাতা পড়েছি, ঘরে বড় গ্রীষ্ম বোধ হোচ্ছিলো, সেই জন্য একটু বাতাসে এসে দাঁড়িয়েছি।”
কৰ্ত্তাবাবু জামাইবাবু আর আমি, তিনজনে একসঙ্গে অন্দরমহলে প্রবেশ কোল্লেম। একসঙ্গেই আহারাদি হলো। আহারের সময় জামাইবাবু বক্রনয়নে দুই তিনবার আমার দিকে চাইলেন, দেখেও যেন দেখলেম না, মাথা হেঁট কোরে শান্ত হয়ে থাকলেম।
আহারাতে বাড়ীর ভিতরের একটী ঘরে জামাইবাবুর শয্যা প্রস্তুত হলো; জামাইবাবু শয়ন কোল্লেন, কর্ত্তাবাবু আপন শয়নগৃহে গেলেন, আমি নিত্য রাত্রে যেখানে থাকি, সেইখানেই এসে শয়ন কোল্লেম।
প্রভাতে জামাইবাবু বিদায় হোলেন। আমার একটা ভয় ঘুচে গেল। আমাকে দেখেই প্রথমে তিনি চোমকেছিলেন, কে আমি, কোথা থেকে এসেছি, কৰ্ত্তাকে সে কথা জিজ্ঞাসা করে জানেন, বার বার কেমন একরকম ভঙ্গীতে আমার দিকে কটাক্ষপাত কোরেছিলেন, আমি যেন কিছুই বুঝতে পারি নাই। তিনি বিদায় হবার পর কর্ত্তা আমাকে ডেকে খুব হাসতে হাসতে বোল্লেন, “হরিদাস! তোমার উপর জামাইবাবুর নজর পোড়েছে। আমার কাছে তুমি থাক, সেটা যেন তাঁর ইচ্ছা নয়; তিনি তোমাকে তাঁর নিজ বাড়ীতে নিয়ে যেতে চান; আমাকেও সে কথা জানিয়েছিলেন, আমি রাজী হই নাই। তোমার অভিপ্রায় কি? যাবে?”
জলে আমার চক্ষ, ছলছল কোরে এলো। সজলনয়নে কর্ত্তার মুখপানে চেয়ে কম্পিত কণ্ঠে আমি বোল্লেম, “আজ্ঞে না, তাঁর বাড়ীতে আমি যাব না,—আপনার আশ্রয় ছেড়ে কোথাও আমি যাব না। আমার অদৃষ্ট বড় মন্দ। পাঠশালা পরিত্যাগ কোরে একটা দুষ্ট লোকের হাতে আমি পোড়েছিলেম, আপনি রক্ষা না কোল্লে আমার কপালে কতই না বিপদ ঘোটতো, তাই ভেবে সৰ্ব্বদাই আমার গা কাঁপে। সংসার আমি চিনি না, সংসারের লোকের রীত-ব্যবহার কিছুই আমি জানি না, মাতৃগর্ভে যেমন থাকা, চতুর্দশ বর্ষকাল পাঠশালার গর্ভেই আমি সেইরূপ ছিলেম; আমার অধ্যাপক-মহাশয় পাঠশালার বাহিরে কোথাও আমাকে যেতে দিতেন না। তিনিও সংসারলীলা সাঙ্গ কোল্লেন, তাঁর পত্নীর নিষ্ঠুরতায় আমিও নিরাশ্রয় হয়ে একটা ভয়ানক জুয়াচোরের সঙ্গে পথে বেরুলেম। আর দুর্দ্দশাই যে আমার হোতো, অদৃষ্ট কোন পথেই যে আমাকে নিয়ে যেতো, কিছুই আমি বোলতে পারি না। বিপদকালে বিপত্তির মধুসূদন আমার প্রতি সদয় হোলেন, জুয়াচোরীর ঘটনাবশে আপনার দ্বারেই আমায় নিয়ে এলো, আপনার কাছে আমি আশ্রয় পেলেম, আপনার দয়ার ক্রোড়েই আমি প্রতিপালিত হোচ্ছি, এ আশ্রয় ত্যাগ কোরে কোথাও আমি যাব না। দোহাই আপনার! আপনি আমাকে পরিত্যাগ কোরবেন না।”
সন্তুষ্ট হয়ে কর্ত্তা বোল্লেন, “না হরিদাস। তোমাকে আমি পরিত্যাগ কোরবো না, তোমার স্বভাব-চরিত্র খুব ভাল, নির্ভাবনায় এই বাড়ীতেই তুমি থাকো, মন দিয়ে লেখাপড়া শিক্ষা কর, অবশ্যই তোমার ভাল হবে।”
এইরূপ কথাবার্ত্তার পর আমি আপন পাঠাগারে প্রবিষ্ট হয়ে নিবিষ্টচিত্তে নূতন পাঠের অভ্যাস কোত্তে লাগলেম। দুর্ভাবনা দূরে গেল, নিশ্চিন্ত হয়ে বাড়ীর পরিবারবর্গের সঙ্গে পরমসুখে আরো একমাস সেই মহৎ আশ্রমে আমি থাকলেম।