ভূবনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়

হরিদাসের গুপ্তকথা
প্রথম খণ্ড

দশম কল্প : উইলপাঠ

মোহনলালবাবু সৰ্ব্বদাই ব্যস্ত, সৰ্ব্বক্ষণ চঞ্চল। কি জন্য যে তত ব্যস্ততা, সকল লোকে সেটা অনুভব কোত্তে পাল্লে না। মোহনলালের শোক অপেক্ষা উদ্বেগ অধিক, সেটা আমি বেশ বুঝতে পাল্লেম। সংসারের প্রকৃতি এই যে, যাদের সঙ্গে শোণিত-সম্পর্ক, যাদের সঙ্গে নিকট-সম্পর্ক, কারো বিয়োগে তাদেরি শোক অধিক হয়, অপর লোকের ততটা হয় না। আমি একজন অপর লোক, সম্পূর্ণ নিঃসম্পর্ক, তথাপি আমি যেন বুঝলেম, সৰ্ব্বাপেক্ষা আমারি অধীরতা অধিক হয়ে দাঁড়ালো। কেন এমন বিপর্য্যয়?—জন্মাবধি আমি নিরাশ্রয়, এই মহৎলোকের আশ্রয় পেয়েছিলেম, তিনি আমাকে ফাঁকী দিয়ে চোলে গেলেন, দুষ্টলোকে অন্ধকারে তাঁকে খুন কোরে গেল, আবার আমি নিরাশ্রয় হয়ে পোড়লেম। কে আর আমাকে আশ্রয় দিবে? সংসারে আমার আপনার লোক কেহই নাই, লোকের বরং মাথা রেখে থাকবার এক-আধখানা পর্ণকুটীর থাকে, আমার ভাগ্যে তা পর্য্যন্ত নাই। গৃহিণী যদি দয়া না করেন, তবে আমি যাব কোথা, খাব কি, সৰ্ব্বক্ষণ সেই ভাবনা; সেই ভাবনাতেই; আমার অধিক শোক।

একমাস অতীত হয়ে গিয়েছে। বাবু মোহনলাল একদিন বৈকালে পাড়ার দশজন ভদ্রলোককে ডেকে প্রস্তাব কোল্লেন, “বিষয়াদি-বণ্টনের কিরূপ ব্যবস্থা হবে, সেইটীই এই সময় নির্ধারণ করা হোক। যা হবার, তা তো হয়ে গেল, তিনি তো আর ফিরে আসবেন না, এখন যারা থাকলে, তাদের একটা ব্যবস্থা করা ধর্ম্মসঙ্গত কাৰ্য্য। কৰ্ত্তা আমাকে বোলেছিলেন, উইল করা হয়েছে, সিন্দুকে উইল আছে। আপনারা চলন, আপনাদের সকলের সাক্ষাতে সিন্ধুকটী খুলে উইলখানি দর্শন করা যাক।”

একটী ভদ্রলোক বল্লেন, “অবশ্য কর্তব্য। আমরা তো থাকবোই, কিন্তু একজন সরকারী লোক উপস্থিত থাকা আবশ্যক; সেইটাই বিধিসিদ্ধ কার্য্য। পুলিশের দারোগাকেই মাঝখানে দাঁড় করানো ভাল।”

তাই-ই মঞ্জুর। মোহনবাবু নিজেই পুলিশে গেলেন, দারোগার সঙ্গে তাঁর সদ্ভাব ছিল, বিশেষতঃ তদন্তের দিন সেলামী দান করা হয়েছে, তিনি তুষ্টও ছিলেন, আহ্বানমাত্রই মোহনবাবুর সঙ্গে তিনি আগমন কোল্লেন। কৰ্ত্তার শয়নগহে সকলেই উপস্থিত। কর্ত্তার চাবীগুলি দারোগা পেয়েছিলেন, কিন্তু নিজে রাখেন নাই, সাক্ষাৎ উত্তরাধিকারিণী গৃহিণী, তাঁর কাছেই চাবীগুলি ছিল। চাবীর তাড়াটী চেয়ে নিয়ে বাবু মোহনলাল একটু সন্দিগ্ধবদনে বোল্লেন, “কোন সিন্দুকে উইল, তা তো ঠিক জানা নাই, এক এক কোরে সব সিন্দুকগুলি খুলে দেখতে হবে।” সকলে সেই কথাতেই সায় দিলেন, সৰ্ব্বসম্মতিতে সেইরূপ কাৰ্য্যই আরম্ভ হলো।

ঘরে পাঁচটী সিন্দুক! একে একে পাঁচটী সিন্দুক খোলা হলো। অন্য জিনিস পাওয়া গেল, উইল পাওয়া গেল না।

বলা উচিত, ভদ্রলোকগুলির সঙ্গে সেই দিন সেই সময় আমিও সেই ঘরে উপস্থিত হয়েছিলেম। মোহনবাবু রঙ্গ দেখে আমার বড় বিস্ময়বোধ হলো। পাঠক-মহাশয়ের স্মরণ থাকতে পারে, যে রাত্রে শ্বশুর-জামাই দুজনে নির্জ্জনে বৈঠকখানায় বোসে কথোপকথন করেন, পুস্তকাগারের দ্বারের পার্শ্বে দাঁড়িয়ে আমি শুনেছিলেম, কর্ত্তাবাবু জামাইবাবুকে ভর্ৎসনা কোরে শাসিয়ে বোলেছিলেন, “ঐ সিন্দুকে উইল আছে।” সে সিন্দুক বৈঠকখানায়। অন্দরের শয়নকক্ষে পাঁচটী সিন্দুক খোলা হলো, সে সকল সিন্দুকে উইল ছিল না, মোহনবাবু অবশ্যই তা জানতেন, জেনেও যেন ন্যাকা সেজে লোকগুলির কাছে সাঁচ্চা হবার ভূমিকা কোল্লেন। পাঁচটী সিন্দুকে উইল পাওয়া গেল না, বৈঠকখানায় লৌহসিন্দুকে আছে, সেইখানে যাওয়াই স্থির হলো। সকলে চোল্লেন, আমিও সঙ্গে সঙ্গে চোল্লেম। মনে আমার দারুণ সন্দেহ।

মোহনবাবু কেমন প্রকৃতির লোক, সেটা আমার ভাল জানা ছিল না। আমাকে প্রথম দেখে তিনি চোমকেছিলেন, আমাকে নিজবাড়ীতে নিয়ে যাবার জন্য কর্ত্তার কাছে অভিপ্রায় জানিয়েছিলেন, সে কথা আমার মনে আছে। তাঁকে দেখে আমার ভয় হয়। সেবারে কেবল এক রাত্রিমাত্র এ বাড়ীতে ছিলেন, আমার সঙ্গে বেশীক্ষণ দেখাশুনা হয় নাই, একটী কথাও হয় নাই। কর্ত্তার কথা শুনে জামাইবাবুর চরিত্র সম্বন্ধে কিছু জেনেছিলেম, স্বভাব ভাল নয়, এইটুকু মাত্র আমার ধারণা হয়েছিল। এখন একমাসের অধিক দিন আমার সঙ্গে দেখাশুনা, দুই একটী কথাও হয়, কিন্তু আমি বেশীক্ষণ তাঁর সম্মুখে থাকি না, আশেপাশে ঘুরে ঘুরে বেড়াই। এক একবার মনে কোন সন্দেহ আসে, তাঁর সঙ্গে দেখা হবামাত্রই কিম্বা তিনি আমার দিকে আসবেন, বুঝতে পাল্লেই ধাঁ কোরে সেখান থেকে আমি সোরে যাই। কেন এমন ভয়, কেন এমন সন্দেহ তখনো পর্য্যন্ত সেটা আমি ভাল কোরে বুঝতে পারি নাই। আজ আবার উইলের প্রসঙ্গে নূতন সন্দেহ। কোথায় উইল, জেনেও জানেন না। সিন্দুকটী দেখিয়ে দিয়ে কর্ত্তা তাঁকে স্পষ্টাক্ষরে বোলেছিলেন, ঐ সিন্দুকে উইল আছে। এখন তিনি যেন ন্যাকা লোক, সে কথা যেন ভুলেই গিয়েছেন।

যা-ই হোক, বৈঠকখানায় আসা হলো, লৌহসিন্দুক খোলা হলো, উইলখানা পাওয়া গেল। সিন্দুকে আরও পাঁচরকম অল্পমূল্যের জিনিসপত্র ছিল, টাকাকড়ি ছিল না, খান দুই তিন সাদা ষ্ট্যাম্পকাগজ আর সেই উইলখানি।

উইলখানি হাতে নিয়ে, সকলের দিকে চেয়ে, মোহনবাবু বোল্লেন, “আপনাদের মধ্যে একজন এইখানি পাঠ করুন।” সমবেতবাক্যে সকলে সমস্বরে বোল্লেন, আমাদের কেন, সরকারের লোক দারোগা-মহাশয়, ইনিই পাঠ করুন। সৰ্ব্বসম্মতিতে দারোগামহাশয় উইল পাঠ কোল্লেন। উইলে লেখা ছিল:—

“আমার তিনটী কন্যা। প্রথমা শ্যামাসুন্দরী, দ্বিতীয়া উমাকালী, তৃতীয়া আশালতা। শ্যামাসুন্দরী বিধবা, আশালতা অবিবাহিতা। আমার। * * * নম্বরের জমীদারী এবং ৭৫ হাজার টাকার কোম্পানীর কাগজ এবং ভদ্রাসনবাটী ও বাগানবাটী ইত্যাদি যাহা কিছু আছে, আমার সম্ভাবিত পুত্রিকা মধ্যমা কন্যা শ্রীমতী উমাকালী দাসী প্রাপ্ত হইবেন। আমার জামাতা উক্ত উমাকালী দাসীর স্বামী শ্ৰীযুক্ত মোহনলাল ঘোষ তাহার অছি ও অভিভাবক থাকিবেন। আমার জ্যেষ্ঠা কন্যা শ্যামাসুন্দরী দাসী মাসে মাসে একশত টাকা মাসহারা পাইবেন, কনিষ্ঠা কুমারী কন্যা শ্রীমতী আশালতা দাসীর শুভবিবাহ যদি আমি জীবদ্দশায় সম্পাদন করিয়া না যাইতে পারি, তাহা হইলে আমার জীবনান্তে উক্ত মোহনলালবাবু দুই সহস্র মুদ্রা ব্যয় করিয়া উপযুক্ত পাত্রে আশালতাকে সম্প্রদান করিবেন। আশালতার গর্ভে পুত্রসন্তান জন্মিলে আমার মধ্যমা কন্যা উল্লিখিত উমাকালী দাসী আপন প্রাপ্ত সম্পত্তির তৃতীয়াংশ সেই পুত্রকে অথবা পুত্রগণকে প্রদান করিবেন, আশালতার পুত্র না জমিলে আশালতা মাসিক একশত টাকা মাসহারা পাইবেন।’ যদবধি আমার পত্নী শ্ৰীমতী মহালক্ষ্মী দাসী জীবিত থাকিবেন, তদবধি কেহই আমার বিষয়টি বণ্টন করিয়া লইতে পারিবেন না, তাঁহার মতানুসারে ও তাঁহার ইচ্ছানুসারে সমস্ত বিষয়কার্য্য নির্ব্বাহ হইবেক, কিন্তু উক্ত মহালক্ষ্মী দাসীও কোন বিশেষ প্রয়োজন ব্যতীত বিষয়ের কোন অংশ কোন প্রকারে হস্তান্তর করিতে পারিবেন না ইত্যাদি ইত্যাদি।

উইলের পাঠ শ্রবণ কোরে আমি এককালে হতবুদ্ধি হোলেম। কৰ্ত্তার মুখে কি শুনেছিলেম, এখনি বা কি শুনলেম। সমস্তই বিপরীত! এ বৈপরীত্যের হেতু কি, কিছু, অনুমান কোত্তে পাল্লেম না; মনে মনে যতই আলোচনা করি, ততই সন্দেহবৃদ্ধি এবং মনের কথা প্রকাশ কোরে বলি, এখন একটী লোক নাই। মনের সংশয় মনে চেপে রাখলেম। উইল যখন পড়া হয়, তখন আমি দারোগার পাশে দাঁড়িয়ে একবার দেখেছিলেম, উইলে তিনজন সাক্ষীর নাম লেখা। শ্রীকুঞ্জবিহারী সান্যাল নবীদার, সাং বর্দ্ধমান; শ্রীনফরচন্দ্র ঘোষাল, সাং রায়না; শ্ৰীজনার্দ্দন মজুমদার, সাং বর্দ্ধমান। এই তিনজনের কোন পরিচয় আমি জানি না। কেমন কোরেই জানবো? আমি আসবার অগ্রে উইল লেখা হয়েছিল কিংবা পরে হয়েছিল, আমার অজ্ঞাত; অধিকন্তু আমি বর্দ্ধমানে আসবার পর ঐ তিনজনের একজনও বাড়ীতে আসে নাই, কারো মুখে তাদের নামও আমি শুনি নাই, আমার সম্বন্ধে ওরা তিনজনেই নূতন লোক। মনে মনে অনেক আন্দোলন কোল্লেম, কিছুই মীমাংসা খুঁজে পেলেম না, সন্দেহটাও গেল না। বাড়ীতে ডাকাত পোড়েছিল, লুটপাট কোল্লে না, অন্যঘরেও গেল না, কেবল কর্ত্তাটীকে কেটে গেল, ইহাও বড় আশ্চর্য্য ব্যাপার! এ সমস্যা বড়ই বিষম সমস্যা!

যে সকল ভদ্রলোক মধ্যস্থ হোতে এসেছিলেন, তাঁরা বিদায় হোলেন, দারোগামহাশয় থানায় গেলেন, গোলমাল চুকে গেল। লোকগুলি যখন বিদায় হন, তখন আমি দেখেছিলেম, কারো কারো মুখে বিষন্ন হলো, কারো কারো মুখে প্রসন্নভাব ধারণ কোল্লে; দারোগার মুখে প্রসন্ন অপ্রসন্ন কোন ভাবই লক্ষিত হলো না।

হায় হায়! শুভকার্য্যের সূচনায় কি ভয়ঙ্কর অশুভসংঘটন! এক একখানা উপন্যাসে আমি পাঠ কোরেছি, বিবাহরজনীতে অকস্মাৎ কন্যার মৃত্যু, বাসরঘরে বরের মৃত্যু, অন্নপ্রাশনের পূর্ব্বদিন দুগ্ধপোষ্য শিশুর পঞ্চত্বপ্রাপ্তি। এখানেও প্রায় সেইরূপে শোচনীয় ঘটনা। আশালতার বিবাহ। সমস্ত আয়োজন ঠিকঠাক, আত্মীয়-কুটুম্ব স্থলে নিমন্ত্রণপত্র পর্য্যন্ত প্রেরিত হয়েছিল, অকস্মাৎ বজ্রাঘাত! বিবাহের কথা আর কারো মুখে উচ্চারিত হলো না, সকলেরি মুখে কেবল শোকের কথা! মাসাধিক যে বাড়ীতে হর্ষধ্বনি সমুখিত হোচ্ছিল, সে বাড়ী এখন বিষাদপর্ণ!!