ভূবনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়

হরিদাসের গুপ্তকথা
প্রথম খণ্ড

একাদশ কল্প : মামা!

পাঁচদিন গেল। সেই পাঁচদিন আমি জামাইবাবুর কাছে কাছে থাকতে শিখলেম, ঘনিষ্ঠতা করবার ইচ্ছা হলো। কেন হলো, পাঠক-মহাশয় বোধ হয়, সেটা অনুভবে বুঝেতে পেরে থাকবেন। নিরাশ্রয় আমি, উত্তম আশ্রয় পেয়েছিলেম, কৰ্ত্তা আমাকে ভালবেসেছিলেন, বাড়ীর পরিবারেরাও আদর কোচ্ছিলেন, সুখেই ছিলেম, এ আশ্রয় যদি যায়, তবে আমি পথের ভিকারী হব! জামাইবাবু যদি দয়া কোরে এই বাড়ীতে আমাকে থাকতে দেন, সেই আশাতেই তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা করবার ইচ্ছা। যখন যা তিনি বলেন, তখনি তাই আমি করি, কোন কথাতেই আর অবাধ্যতা দেখাই না, সৰ্ব্বদাই তাঁর অনুগত হয়ে থাকি। তিনি যে সকল কথা কন, তা শুনে আমার প্রতি তার আদেশ আছে, এমন কিছুই বুঝা যায় না। কোন কার্য্যের আদেশ পেয়ে যখন আমি শীঘ্র ছুটে যাই, তখন তিনি মৃদু মৃদু হাস্য করেন, আড়ে আড়ে তাও আমি দেখতে পাই। আমার প্রতি তার একটু সদয়ভাব, ঐ হাস্য দেখে সেটাও আমি যেন বুঝতে পারি। মনে একটু ভরসা হয়।

বাড়ীর স্ত্রীলোকেরা কর্ত্তা বিদ্যমানে আমার প্রতি যে ভাব দেখাতেন, এখনও তাঁদের সেই ভাব। আশালতার সুন্দর মুখখানি সৰ্ব্বদা বিষন্ন, মুখখানি দেখে আমার বড় কষ্ট হয়, তথাপি আমার প্রতি তাঁর সমান ভালবাসা।

কর্ত্তার জ্যেষ্ঠা কন্যা শ্যামাসুন্দরী পূর্ব্বে আমাকে দেখেন নাই, এই বিপদের সময় প্রথম দেখা, তথাপি তিনি আমাকে বেশ আদর-যত্ন করেন। আমি যখন তার মুখের দিকে চাই, তিনি তখন একদৃষ্টে খানিকক্ষণ আমার মুখপানে চেয়ে হঠাৎ অন্যদিকে মুখ ফিরান; বোধ হয়, যেন চক্ষে একটু জল আসে। কেন যে তেমন ভাব, তা আমি বুঝতে পারি না। আমি অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে চোলে গেলেও তিনি আমার দিকে চেয়ে থাকেন। মধ্যমা উমাকালীর সে ভাব নয়, তিনি আমাকে আদর করেন বটে, কিন্তু ততটা স্নেহমমতা প্রকাশ পায় না।

গৃহিণী ঠাকুরাণী একদিন আমাকে কাছে বোসিয়ে এ কথা সে কথার পর সস্নেহবচনে বোল্লেন, “হরিদাস! ঘরসংসার তো অন্ধকার হয়ে গেল। সাধে বিধাতা বাদসাধলেন! বিধাতার মনে যা থাকে, তাই হয়; আমাদের ভাগ্যে যা ছিল তাই হলো; তুমি কিন্তু এখান থেকে কোথাও যেয়ো না; আমি তোমাকে কোথাও যেতে দিব না; কৰ্ত্তার কাছে যেমন ছিলে, আমাদের কাছেও তেমনি থাকো। আমি তোমাকে ঠিক যেন পেটের ছেলের মতন দেখি, কোথাও তুমি যেয়োনা, মোহনলাল তোমাকে আপন বাড়ীতে নিয়ে যেতে চান, কৰ্ত্তাকেও বোলেছিলেন, আমাকেও বোলেছিলেন, আমি অস্বীকার কোরেছি; তোমাকে যদি বলেন, তুমিও অস্বীকার কোরো। মোহনলালের—”

কথাটী সমাপ্ত হোতে পেলে না, গৃহিণীর অর্দ্ধোক্তির সময়েই শ্যামাসুন্দরী সেইখানে এলেন; কথাটী চাপা পোড়ে গেল। শ্যামাসুন্দরী বোধ হয়, আড়ালে দাঁড়িয়ে জননীর কথাগুলি শুনেছিলেন, তিনিও ঠিক সেই রকমে স্নেহ জানিয়ে অতি কোমলস্বরে বোল্লেন “হরিদাস! মা যে কথা তোমাকে বোলছেন, তুমি তাই কোরো, এইখানেই থেকো, কোথাও যেয়ো না; তোমাকে দেখলে আমরা সকলেই—”

বোলতে বোলতে বসনাঞ্চলে চক্ষু ঢেকে দয়াবতী নীরবে অশ্রুপাত কোল্লেন। কেন, কে জানে, তাঁর চক্ষের জল আমি দেখতে পাল্লেম না;—কি জানি কেন, ভারী কষ্ট হোতে লাগলো, চক্ষু মুছতে মুছতে আমি তৎক্ষণাৎ সেখান থেকে উঠে গেলেম।

আরো পাঁচদিন গেল। সন্ধ্যার সময় আমি আর জামাইবাবু বৈঠকখানায় নির্জ্জনে। স্থান প্রকার ভূমিকা না কোরেই জামাইবাবু আমাকে বোল্লেন, “হরিদাস! তুমি আমার বাড়ীতেই চলো। কর্ত্তার কাছে যেমন ছিলে, আমিও সেইরূপ যত্নে রাখবো। তুমি লেখাপড়া শিখেছ, আমার কাজকর্ম্ম কোরবে, মাসে মাসে কিছু কিছু, জলপানীও পাবে, কোন কষ্ট হবে না। থাকতে থাকতে আমি তোমাকে একটা ভাল কাজে নিযুক্ত কোরে দিব, বেশ সুখেই থাকবে। এখানে তো কিছু পেতে না, কৰ্ত্তা কেবল ভালকথা বোলে তোমাকে ভুলিয়ে রাখতেন, আমার কাছে সে রকম অবিবেচনার কাৰ্য্য হবে না; আমার সঙ্গেই তুমি চল। দুই এক হপ্তার মধ্যেই আমি যাব, সেই সঙ্গেই তোমাকে নিয়ে যাব, এইরূপ ইচ্ছা কোরেছি। কেমন, কি বল?”

নতবদনে আমি উত্তর কোল্লেম, “আজ্ঞে না, তা আমি যেতে পারবো না, কর্ত্তা আমাকে নিরাশ্রয় দেখে আশ্রয় দিয়েছিলেন, চিরজীবন আমি এইখানেই থাকবো, এইরুপ আজ্ঞা কোরেছিলেন, সে মহাপুরুষের সে আজ্ঞা আমি লঙ্ঘন কোত্তে পারবো না। বিশেষতঃ গৃহিণী ঠাকুরাণী আমাকে ছেড়ে দিবেন না, সেদিন তিনি আমাকে বোলেছেন, এ সংসার ছেড়ে কোথাও তুমি যেয়ো না।” তাঁর কথা অমান্য কোল্লে আমার ধর্ম্ম থাকবে না। জন্মাবধি আমি জননী জানি না, তারে আমি জননী তুল্য দেখি, তিনিও আমাকে পত্ৰতুল্য স্নেহ করেন। আমি যাব না।”

উত্তর শুনে, মুখ ভারী কোরে, সক্রোধে জামাইবাবু বোল্লেন, “আচ্ছা, তবে থাকো! এই অবাধ্যতাই তোমার অধঃপাতের কারণ হবে! অবোধ বালক! আপনার ভাল আপনি বুঝতে পারে না! আমি তোমার ভাল করবার জন্য চেষ্টা কোরছিলেম, সেটা তোমাকে ভাল লাগলো না, গৃহিণী পত্ৰতুল্য স্নেহ করেন, সেই কথাটাই বড় হলো! ধৰ্ম্ম থাকবে না! উঃ! কত বড় ধর্ম্মজ্ঞান। আচ্ছা, ধর্ম্ম তোমার কত উপকার করে, দেখা যাবে! থাকো তুমি!”

আমি আর একটীও কথা কইলেম না, নতশিরে অল্পক্ষণ সেইখানে বোসে থাকলেম। একখানা কাগজ হাতে কোরে জামাইবাবু সেখান থেকে উঠে গেলেন, একটু পরে আমিও বাড়ীর ভিতর চোলে গেলেম।

আরো পাঁচদিন অতীত। উইলপাঠের পর এক পক্ষ অতিক্রান্ত। পক্ষান্তরজনী প্ৰভাত হলো। প্রভাতসূৰ্য্য পৰ্ব্বগগনে হাসতে হাসতে দেখা দিলেন। বড় বড় গাছেরা আর বড় বড় অট্টালিকার সকিরণ মাথায় কোরে রজতবর্ণ দীপ্তি ধারণ কোল্লে। আমাদের বৈঠকখানার সংলগ্ন মনোহর পুষ্পোদ্যানে প্রস্ফুটিত কুসুমেরা বাতাসে বাতাসে হেলে দুলে সুগন্ধ বিতরণ কোরে, আমার সন্তপ্তচিত্তকে সুশীতল কোত্তে লাগলো, ফুলে ফুলে উড়ে উড়ে গুন গুন স্বরে গান কোত্তে কোত্তে মধুভক্ত মধুমক্ষিকারা প্রভাতকুসুমের মধুপানে প্রবৃত্ত হলো, একাকী বারান্দায় বসে বোসে প্রকৃতির সেই নয়নমোহিনী শোভা আমি দর্শন কোত্তে লাগলেম।

বেলা অনুমান চারিদণ্ড। জামাইবাবু বাড়ীর ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে বৈঠকখানায় বোসলেন। একজন চাকর তামাক দিয়ে গেল, তিনি আপন মনে তামাক খেতে লাগলেন। বৈঠকখানাঘর থেকে বারান্দা বেশ দেখা যায়, যেখানে আমি বোসে ছিলেম সেদিকের দরজার সঙ্গে বৈঠকখানার দরজা ঠিক রুজু রুজু; জামাইবাবু আমাকে দেখতে পেলেন, কিন্তু ডাকলেন না। আমি একবার তার দিকে চেয়ে দেখলেম, বুঝলেম, রাগ রাগ ভাব।

গাছের মাথায় ছাদের মাথায় রৌদ্র দেখেছিলেম, সে রৌদ্র সে দিন মাটীতে নামলো না, সূৰ্য্যও আর দেখা গেল না। মেঘ উঠলো; মেঘের সঙ্গে অল্প অল্প হাওয়া; প্রভাতের মেঘে বৃষ্টি হয় না এই আমার সংস্কার, সুতরাং বারান্দা থেকে উঠলেম না, মেঘ ক্রমশই গাঢ় হয়ে এলো। ঊষাকালে কাক ডাকে; বেলা চারি দণ্ডের সময়, ঝাঁক ঝাঁক কাক কা কা রবে ডেকে ডেকে ঝটাপট শব্দে উড়ে উড়ে আমাদের বাড়ীর দিকে আসতে লাগলো; বাড়ীর নিকটস্থ জঙ্গলে শেয়ালেরা হুয়া হুয়া রবে চীৎকার কোরে উঠলো। মেঘাগমে দিনমানকে উষা অনুমান কোরে কাক-শৃগাল কলরব কোচ্ছে। এরপ সিদ্ধান্ত করা ভুল; অল্পজ্ঞানে আমার মনে যেন কোন অমঙ্গল আশঙ্কার আবির্ভাব হলো। দিবাভাগে শিবার ডাক অমঙ্গল, এ দেশের স্ত্রীলোকেরাও ইহ জানেন; অমঙ্গল আশঙ্কায় অকস্মাৎ আমার বুক কেঁপে উঠলো। কর্ত্তার অপমৃত্যুতে মহা অমঙ্গল ঘোটেছে, আজ আবার আরো বা কি ঘটে, সেই আশঙ্কাই প্রবল। বারান্দা থেকে উঠে আমি বৈঠকখানায় প্রবেশ কোল্লেম। যে ঘরে জামাইবাবু ছিলেন সে ঘরে গেলেম না, সেই ঘরের পাশের ঘরে অদেখা হয়ে একটা গবাক্ষের কাছে দাঁড়িয়ে থাকলেম; ঘরে যখন প্রবেশ করি, তখন দেখলেম, জামাইবাবুর কাছে আরো তিন চারিটী ভদ্রলোক বোসে আছেন। পোষাকে ভদ্র কি ব্যবহারে ভদ্র, তা আমি বুঝলেম না; কেন না, তাঁদের আমি আর কোন দিন দেখি নাই; সব মুখ অচেনা; কখন তাঁরা এসেছেন, কুসম দর্শনে অন্যমনস্ক ছিলেম, তা আমি দেখতে পাই নাই। জামাইবাবুর সঙ্গে তাদের হাসি-ঠাট্টা চোলছে, গল্প-গুজব হোচ্ছে, শব্দ আমার কাণে এলো। কিসের হাসি, কিসের গল্প, তা আমি জানতে পাল্লেম না; জানবার দরকার ছিল না, সেদিকে মনোযোগ রাখলেম না; ভ্রূক্ষেপই কোল্লেম না।

জামাইবাবু আমাকে ডাকলেন না, আমি ইচ্ছাবশে সে ঘরে গেলেম না; অন্যলোকের সঙ্গে যদি কোন গোপনীয় কথাই থাকে, আমার সেখানে যাওয়া অনধিকারপ্রবেশ, তাই ভেবেই গেলেম না; ঘর থেকে বেরিয়ে তাঁদের অলক্ষিতে উপর থেকে নেমে এলেম; সদরদরজায় দাঁড়িয়ে আকাশপানে চেয়ে দেখি, ঘোর অন্ধকার! সেই সময় যদি আমার নিদ্রাভঙ্গ হোতো, তা হোলে মনে কোত্তেম, তখনো রাত্রি আছে; এত অন্ধকার।

বাড়ীর সম্মুখের রাস্তা দিয়ে দুই একজন লোক যাওয়া-আসা কোচ্ছে, এখনি হয় তো বৃষ্টি আসবে, এই ভেবে তারা খুব তাড়াতাড়ি চোলছে, আর এক একবার উর্দ্ধদৃষ্টিতে আকাশপানে চেয়ে চেয়ে দেখছে;—দেখছে আর চোলেছে। হাওয়া; ক্রমশই জোর হাওয়া! আকাশের পশ্চিমকোণে ঘন ঘন চপলার হাসি; চপলার হাসি আমি অনেকবার দেখেছি, কিন্তু সে দিনের হাসি যেন কেমন একপ্রকার অভূতপূৰ্ব্ব, অভাবনীয়পূর্ব্ব, অননুভূতপূর্ব্ব বিকট ভয় দেখাচ্ছে! একবার গড়গড়শব্দে মেঘ ডেকে উঠলো। সেই অসাময়িক জলদগর্জ্জনও কেমন এক একার ভয়প্রদ! অল্প অল্প বৃষ্টি এলো। তখন আর আমি সদরদরজায় দাঁড়িয়ে থাকতে পাল্লেম না, দেউড়ী পার হয়ে উপরে উঠবার সিঁড়ির কাছে এসে দাঁড়ালেম।

উপরে উঠি উঠি মনে কোচ্ছি, সিঁড়ির দিকেই মুখ রয়েছে, হঠাৎ পশ্চাদ্দিক থেকে কে একজন এসে আমার একখানা হাত ধরে ফেলে। মুখে ফিরিয়ে চেয়ে দেখি, সেই বিকটাকার রক্তদন্ত! বিকটমূর্ত্তি দেখেই আমার হৃৎকম্প! জোর কোরে হাতখানা ছাড়িয়ে নিয়েই ছুট! এক ছুটে গুম গুম শব্দে উপরে উঠে, চীৎকার কোরে কেঁদে জামাইবাবুর দুই পায়ে জড়িয়ে ধোল্লেম; কুঁজোটাও আমার পশ্চাৎ পশ্চাৎ সটান ছুটে এসে বৈঠকখানার চৌকাঠের উপর দাঁড়ালো। আমি কেঁদে কেঁদে জামাইবাবুকে বোলতে লাগলেম, রক্ষা করুন। রাক্ষস! রাক্ষস! আমাকে ধরেছিল! ঐ এসেছে! ঐ এসেছে। রক্ষা করন!”

বাবুর পাশের লোকগুলো যেন কি একটা অপরুপ রঙ্গ মনে কোরে খিলখিল শব্দে হেসে উঠলো। কতই যেন বিরক্ত হয়ে পা ছুঁড়ে ছুঁড়ে আমাকে ঠেলে ঠেলে দিয়ে, জামাইবাবু গম্ভীরগর্জ্জনে জিজ্ঞাসা কোল্লেন, “কি?” রাক্ষসটা সেই সময় সুযোগ বুঝে ভয়ানক ঝনঝনে আওয়াজে বোলতে আরম্ভ কোল্লে, “ঐ ছোঁড়া আমার ভাগ্নে, আমি ঐ ছোঁড়ার মামা, আমি ওটাকে নিয়ে যাবো। কেবল পালিয়ে পালিয়ে বেড়ায়, কিছুতেই বাগে আনা যায় না। একবার আমি এইখানে নিতে এসেছিলেম, এই বাড়ীর কর্ত্তা আমাকে তাড়িয়ে দিয়েছিলো, এবার আমি কিছুতেই ছাড়বো না।”

কাতর হয়ে কাঁদতে কাঁদতে আমি বোল্লেম, “না গো না, ও আমার মামা নয়! ও আমার কেহই নয়! ও কখনই মানুষ নয়! আপনি আমাকে রক্ষা করুন! ওর সঙ্গে আমি কখনই যাব না! ওটা রাক্ষস! আমারে ধোরে নিয়ে গিয়েই খেয়ে ফেলবে! দয়া করে আপনি আমাকে রক্ষা করুন!”

করণস্বরে এই সব কথা বোলতে বোলতে একবার আমি বাবুর মুখের দিকে আর একবার কুঁজোটার মুখের দিকে ভয়ে ভয়ে দেখলেম। বোধ হলো যেন, সেই সময় তাঁদের পরস্পর কি এক রকম চোক-টেপাটিপি হয়ে গেল। জামাইবাবু আরো বিরক্ত হয়ে উচ্চকণ্ঠে বোলে উঠলেন, “আমি তার কি জানি? কে কার মামা, কে কার ভাগ্নে, আমি তার কি জানি? যে যা ভাল বুঝবে, সে-ই তাই কোরবে, আমি তাতে কি কোরবো? এ ফ্যাঁসাতে আমি কেন মাথা দিব? আমি কেমন কোরে রক্ষা কোরবো নানা কাজে নানা দিকে আমার মাথা ঘুরছে, তার উপর এ কি উৎপাত! যাও,—যাও,— চোলে যাও! যে যার মামা, সে তারে নিয়ে যাবে, আমি তাতে বাধা দিবার কে?”

বাবু যেন তখন সেই বাড়ীর সর্বেসৰ্ব্বা কৰ্ত্তা, পাশে যারা বোসেছিল, তারা যেন তাঁর মোসাহেব, তারা সকলেই বাবুর কথায় প্রতিধনি কোরে বোলতে লাগলো, “তা বটেই তো তা বটেই তো? বাবু কেন কথা কবেন? কে কার মামা, কে কার ভাগ্নে, বাবু তার কি জানেন? কাজের সময় কোথাকার মামা ভাগ্নের ঝগড়া এসে উপস্থিত হলো! কোথাকার পাপ! বিষম উৎপাত!”

মোসাহেবের কলরবে ভ্রূক্ষেপ না কোরে জামাইবাবুকে আমি বিস্তর মিনতি কোল্লেম, চক্ষের জলে তাঁর পা-দুখানি ভিজালেম, কিছুতেই তাঁর দয়া হলো না! উৎসাহ পেয়ে, সাহস পেয়ে, বিকট মর্কট মুখখানা আরো বিকট কোরে, বিকট বিকট দাঁতগুলা আগাগোড়া বিকাশ কোরে, সেই বিকটাকার রাক্ষসটা পায়ে পায়ে এগিয়ে এগিয়ে জাজিমের উপর এসে উঠলো। আমি ক্রমাগত কাঁদতে লাগলেম, বাবু তাতে কর্ণপাতও কোল্লেন না, মোসাহেবদের সঙ্গে আবার হেসে হেসে নূতন গল্প জুড়ে দিলেন! কুঁজোটা আমার দুখানি হাত ধোরে হিড়হিড় কোরে টেনে নিয়ে চোল্লো, দরজার বাহিরে এনে ফেল্লে টেনে হিঁচড়ে সিঁড়ি দিয়ে নামিয়ে সদরদরজায় নিয়ে এলো। চীৎকার শব্দে আমি বাড়ীখানা কাঁপিয়ে তুল্লেম; বলিদানের অগ্রে ভিজে পাঁঠা যেমন কাঁপে, সেইরকম কাঁপতে লাগলেম, দুঃখ প্রকাশ কোরে কেহই একটী কথাও কইলে না! দেউড়ীতে দরোয়ান ছিল, বাবুর কাছ থেকে একটা রাক্ষস আমাকে ধারে এনেছে, বাবু তাতে বাধা দেন নাই, সুতরাং দরোয়ানেরাও সাহস কোরে কিছু বোলতে পাল্লে না, কিন্তু তাদের মুখের ভাব দেখে আমি বুঝলেম, তাদের যেন মনে মনে কষ্ট হোতে লাগলো।

রাস্তায় বাহির কোরে কুঁজোটা আমাকে জলের উপর দিয়ে টেনে নিয়ে চোল্লো। অবিশ্রান্ত বৃষ্টি; বৃষ্টির জলে রাস্তা প্লাবিত, সেই জলের উপর আমি গড়গড়িয়ে যাচ্ছি, এক আধ জায়গায় আধখানা শরীর ডুবে ডুবে যাচ্ছে, তখনও আমি কেবল চেঁচাচ্ছি আর হাঁপাচ্ছি। বৃষ্টির জলে আমাদের দুজনের অষ্টাঙ্গ অভিষিক্ত। খানিক দূরে একটা উঁচু রাস্তা। সে রাস্তায় কেবল বালী আর কাদা; জল দাঁড়ায় নাই; কাদার উপর দিয়ে লোকটা আমাকে টানছে। সৰ্ব্বশরীর কাদামাখা হয়ে যাচ্ছে; ইট-পাথরের রাস্তা হোলে কেটে ছিঁড়ে আমার সৰ্ব্বাঙ্গ ক্ষতবিক্ষত হয়ে যেতো, পথেই হয় তো প্রাণ যেতো, প্রাণ গেলেই ভাল হোতো; তত যন্ত্রণা সহ্য কোত্তে হোতো না।

কোথায় আমি চোল্লেম? রাক্ষসটা আমাকে কোথায় নিয়ে চোল্লো? হায় হায়! কারো সঙ্গে দেখা হলো না! আশালতাকে দেখতে পেলেম না। আমার কি দশা হলো, বাড়ীর পরিবারের কেহই কিছু জানতে পাল্লেন না! নিষ্ঠুর মোহনলাল হাসতে হাসতে আমাকে রাক্ষসের হাতে সমর্পণ কোরে দিলেন! আমার ভাগ্যবিধাতা আমার ভাগ্যে কত কষ্টই লিখে রেখেছেন, সেই বিধাতাই তা জানেন!

লোকটার আকর্ষণে ক্রমাগতই আমি গোড়িয়ে গোড়িয়ে চোলেছি। লোকটার শরীরে অনেক বল। মুখে বানর, দন্তে রাক্ষস, লোমে ভল্লুক, কুঁজে উষ্ট্র, হস্তপদে মনুষ্য, এই পশুজীবের সমষ্টিতে এ লোকটার পঞ্চভূতের গঠন সমাপ্ত! বৃষ্টির জলে ভিজে ভিজে তার গায়ের লোমগুলো আর মাথার ঝুমরো ঝুমরো চলগুলো গায়ের সঙ্গে লেপে গেছে, মূর্ত্তিটা আরো ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে। একবার একবার আমি তার দিকে চেয়ে দেখছি, জলে শীতে সৰ্ব্বশরীর কাঁপছে, উচ্চৈঃস্বরে রোদন কোচ্ছি, রক্তদন্ত আমার রোদনে কর্ণপাত কোচ্ছে না। রাস্তায় লোক নাই। সে দুযোগে কে-ই বা বাহির হবে? কেহই নাই। রাস্তার ধারে ধারে তফাতে তফাতে লোকালয় আছে, সে সকল বাড়ীর লোকেরাও আমার দুর্দশা দেখে রক্ষা করবার চেষ্টা কোচ্ছে না; বরং কেহ কেহ গবাক্ষ পথে দাঁড়িয়ে যেন তামাসা দেখছে, কেহ কেহ করতালি দিয়ে হাস্য কোচ্ছে। আমি চীৎকার কোচ্ছি, তাদের হাস্যকোলাহলে সে চীৎকার ডুবে ডুবে যাচ্ছে। কুঁজোটা দুই হাতে ধোরে ক্রমাগতই আমাকে টানছে; কাঁচপোকা যেমন আর্শলা টানে, সেই রকমে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। এক জায়গায় গিয়ে থামলো। বোধ হয় আর টানতে পাল্লে না, সেইজন্য সেইখানে একখানা গরুর গাড়ী ভাড়া কোল্লে। এ অঞ্চলের গরুর গাড়ীর উপর ছত্রী থাকে, রাক্ষসটা আমাকে টেনে ছত্রীওয়ালা গাড়ীর উপর তুল্লে; আপনিও আমার গা ঘেঁষে ঠেসে বোসলো। তার গায়ের দুর্গন্ধে আমার তখন বমী আসতে লাগলো।

গরুরগাড়ী চোলেছে, কাদার উপর দিয়ে হেলে হেলে চোলেছে। গতি অত্যন্ত মৃদু। আমার সৰ্ব্বাঙ্গ কর্দমাক্ত। লোকটার আকর্ষণে সৰ্ব্বাঙ্গে বেদনা; বোসে থাকতে পাল্লেম না, গাড়ীর ভিতর খড়ের বিছানায় শুয়ে পোড়লেম।

বেলা প্রায় এক প্রহরের সময় পাষণ্ড আমাকে পোরেছিল, সমস্ত দিন গেল, সমস্ত রাত্রি গেল, উদরে একবিন্দু জলও গেল না, অত্যন্ত কাতর হোলেম।

আবার প্রভাত হলো। গাড়োয়ান দুজন। তারা আপনাদের আহারের সম্বল সঙ্গে রেখেছিল, ক্ষুধার সময় আহার কোল্লে, গাড়ী থামিয়ে নিকটের পুকুর থেকে জল খেয়ে এলো। আমার উপবাস! আমাকে জব্দ করবার জন্য রাক্ষসটাও উপবাসী।

আকাশ পরিষ্কার। পূৰ্ব্বদিনের ন্যায় ঘনঘটা ছিল না, জলঝড় ছিল না, প্রকৃতির হাসিমুখ দেখলে ছেলেবেলা থেকে আমার আনন্দ হোতো, সেদিন আর আমার হৃদয়ে সে আনন্দের স্থান হলো না, ছত্রীর ভিতর থেকে মুখ বাড়িয়ে সূৰ্য্য দর্শন কোরে জগচ্ছক্ষু দেব দিবাকরকে প্রণিপাত কোল্লেম; মনে মনে মধুসূদনের নাম স্মরণ কোরে শরীর যেন একট, শীতল বোধ হলো।

গাড়ী চোলেছে। বেলা প্রায় দুই প্রহরের কাছাকাছি। সম্মুখে একটা বাগান। রক্তদন্ত সেই বাগানের কাছে একবার নামলো আমাকেও নামতে বোল্লে, আমি নামলেম। নিকটে একটা পুষ্কর্ণী ছিল, যথারীতি নিত্যকর্ম্ম সমাধা কোরে সেই পুষ্কর্ণীতে আমরা সান কোল্লেম। সঙ্গে আর বেশী বস্তু ছিল না, উভয়কেই সিক্তবস্ত্রে থাকতে হলো। বাগানের ধারে একখানা মুদীর দোকান। রক্তদন্ত সেই দোকানে চিড়ে-মুড়কি কিনে জল খেলে; আমার সম্মুখেও কিছু ধোরে দিলে; রক্তদন্তের বৃহৎ দন্ত, সে সকল দন্তের শক্তিও বেশী, আমি নিস্তেজ বালক, তার মত জোরে জোরে চিপিটক চর্ব্বণে অশক্ত, সুতরাং একমুষ্টি মুড়কি মুখে দিয়ে এক ঘটী জল খেলেম।

বেলা আড়াই প্রহর। আবার আমরা গাড়ীতে উঠলেম, গাড়োয়ানেরাও জলযোগ কোরে গাড়ী চালাতে আরম্ভ কোল্লে। শেষবেলায় একখানি গ্রামে গিয়ে পৌঁছলেম। কি গ্রাম কোথাকার গ্রাম, বিনা জিজ্ঞাসায় আমার জানবার উপায় ছিল না, কেবল গৃহস্থলোকের বাড়ী আর দোকানপাট দেখে স্থির কোল্লেম, একখানি পল্লীগ্রাম। সেই গ্রামের প্রায় অর্দ্ধক্রোশ গিয়ে একখানা একতালা বাড়ীর সম্মুখে গাড়ীখানা দাঁড়ালো। ভাড়া চুকিয়ে দিয়ে, আমাকে হাত ধরে নামিয়ে নিয়ে, রক্তদন্ত সেই বাড়ীর মধ্যে প্রবেশ কোল্লে; আমাকে শিখিয়ে দিলে, “বেশ শিষ্ট-শান্ত হয়ে থাকবে, কোন কথার অবাধ্য হবে না, আমাকে মামা বোলে ডাকবে, কোথা থেকে কি রকমে আমি তোমাকে এনেছি, কারো কাছে সে সকল কথা গল্প কোরবে না! সাবধান! সাবধান!”—দায়ে পোড়ে আমি সম্মত হোলেম। তদবধি রক্তদন্ত আমার মামা!