» » » দ্বাদশ কল্প : অমরকুমারী

বর্ণাকার

ভূবনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়

হরিদাসের গুপ্তকথা
প্রথম খণ্ড

দ্বাদশ কল্প : অমরকুমারী

বাড়ীখানা অনেকদিনের পুরাতন। দেয়ালে দেয়ালে নোণা ধোরেছে, ঠাঁই ঠাঁই চূণবালী খোসে পোড়েছে, ছাদের মাথায় ছোট ছোট গাছ বোসেছে, এক এক জায়গায় ফাট ধরেছে। একতালা বাড়ী বটে, কিন্তু দুমহল। সদরমহলে একখানি ঘর, সেই ঘরের সম্মুখে একটা রক, রকের ধারে ধারে গরানকাষ্ঠের খুটী, খুঁটীদের মাথায় উলুখড়ের চাল। অন্দরমহলে সারি সারি তিনখানি ঘর, সেই ঘরগুলির সম্মুখেও ছোট ছোট থাম দেওয়া দর-দালান, মাথায় খড়ের চাল নয়, বরোগা দেওয়া ঢালু ছাদ। দরদালানের ধারে রন্ধনগৃহ। রক্তদন্ত আমাকে সঙ্গে কোরে ঐ তিনখানি ঘরের মাঝের ঘরে নিয়ে বসালে। সেই ঘরে একটী স্ত্রীলোক একখানি মাদুরের উপর শুয়ে ছিলেন, রক্তদন্ত তাঁকে সম্বোধন কোরে বোলে, “এই হরিদাস এসেছে, আদর-যত্ন কোরো, নজরে নজরে রেখো, কোথাও যেন পালায় না; ছেলেটা ভারী ছটফটে।”

স্বভাব কোথাও যায় না, কর্কশভাষীর কর্কশকণ্ঠ লুকায় না, প্রকৃতিসিদ্ধ কর্কশ আওয়াজে ঐ কথাগুলি বোলেই রক্তদন্ত সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। স্ত্রীলোকটী বিছানার উপর উঠে বোসলেন। কোমলদৃষ্টিতে অল্পক্ষণ আমার আপাদমস্তক নিরীক্ষণ কোরে অতি কোমলঘরে তিনি বোল্লেন, “হরিদাস! তোমারে আমি আর কখনো দেখি নাই, কার মুখে তোমার নাম শুনেছিলেম, তুমি এসেছ, বড় তুষ্ট হোলেম।”

কথা বোলতে বোলতে আমার কাপড়ের দিকে তাঁর নজর পোড়লো। ভিজে কাপড় দেখে তৎক্ষণাৎ একখানি শুল্ক বস্ত্র এনে আমাকে পরিধান কোত্তে দিলেন। আমি কাপড় ছেড়ে একটু সুস্থ হয়ে বোসলেম। মনে দুর্ভাবনা অনন্ত, ম্লানবদনে চুপটী কোরে বোসে থাকলেম। স্ত্রীলোকটী তখন আবার বোল্লেন, “হরিদাস! তোমার মুখখানি এমন বিরস বিরস দেখছি কেন: পথে কি বড় কষ্ট পেয়েছ?”

রক্তদন্তের সাবধানতা স্মরণ কোরে ধীরে ধীরে মৃদস্বরে আমি উত্তর কোল্লেম, “কষ্ট এমন কিছুই নয়, দুদিন আহার হয় নাই।”

আমার উত্তরবাক্য শ্রবণ কোরেই স্ত্রীলোকটী তাড়াতাড়ি দাঁড়িয়ে উঠে পাশের ঘরে প্রবেশ কোল্লেন, একখানি রেকাবে চারিখানি বড় বড় বাতাসা আর এক গেলাস জল এনে আমাকে খেতে দিলেন; বোল্লেন, “আহা! ছেলেমানুষ, দুদিন আহার নাই, কিছু জল খাও।” আমি জল খেলেম। একবার ইচ্ছা হলো, আমার জীবনকাহিনীর কতকগুলি কথা তাঁকে আমি শুনাই, কিন্তু চেপে গেলেম। কিসে কি হবে, কি জানি কি বিপদ ঘোটবে, রক্তদন্ত যদি শুনে, যে রকম স্বভাব, হয় তো আমাকে কত লাঞ্ছনা কোরবে, তাই ভেবে সে সম্বন্ধে কোন কথাই প্রকাশ কোল্লেম না; অপর কথা উত্থাপন কোরে স্নেহ জানিয়ে স্ত্রীলোকটী আমাকে যে সব কথা জিজ্ঞাসা কোল্লেন, সংক্ষেপে সংক্ষেপে সেই সব কথারই উত্তর দিলেম। প্রথমে তিনি যেমন আমার পানে একদৃষ্টে চেয়েছিলেন, আমিও সেই রকমে তাঁর সৰ্ব্বাবয়ব নিরীক্ষণ কোল্লেম। স্ত্রীলোকটী সুন্দরী, চক্ষু দুটী বড় বড়, কপালখানি ছোট, মস্তকে কৃষ্ণবর্ণ দীর্ঘকেশ, কিন্তু বর্ণটী কিছু ফিকে ফিকে। বোধ হলো যেন কোন প্রকার পীড়া আছে; শরীরে রক্তের কিছু অভাব : শরীর কাহিল, মুখখানি ম্লান; বয়স অনুমান ৩৫/৩৬ বৎসর।

আমাকে সেই ঘরে বোসিয়ে সেই কৃপাময়ী রমণী অন্যঘরে উঠে গেলেন; বোলে গেলেন, “এইখানে একটু থাকো। আহা! দুদিন আহার হয় নাই, আমি তোমার আহারের আয়োজনে যাই।”

তিনি গেলেন, আমি একাকী বোসে বোসে আপন অদৃষ্টের ভাবনাই ভাবতে লাগলেম। ভাবছি, এমন সময় একটী বালিকা ধীরে ধীরে সেই ঘরে এসে আমার সম্মুখে দাঁড়ালেন। বালিকাটীও দিব্য সুন্দরী। ফুট গৌরবর্ণ, কিঞ্চিৎ দীর্ঘাকার, মুখখানি নিখুঁত সুন্দর, খগচঞ্চু নাসিকা, চক্ষু আকর্ণ বিশ্রান্ত, কপাল চৌরস, দাঁতগুলি ছোট ছোট, অধরোষ্ঠ লাল টকটকে, কেশ পরিপাটী, সর্ব্বাঙ্গই সুন্দর কিন্তু কিছু কাহিল; বয়স অনুমান একাদশ কি দ্বাদশ বৎসর। ফল কথা, আমার অপেক্ষা কিছু কম বয়স দেহের উচ্চতায় উভয়েই আমরা সমান। মেয়েটীকে দেখে দেখে আমার তখন কেমন এক প্রকার মতন আহ্লাদ হলো : আহ্লাদের সঙ্গে কিছু কিছু সংশয়। এ মেয়েটী কে? আর সেই রমণীই বা কে?

মনের সংশয় মনে চেপে রেখে মেয়েটীকে আমি বোসতে বোল্লেম। মেয়েটী বোসলেন না, যে ভাবে এসে দাঁড়িয়েছিলেন, সেই ভাবেই দাঁড়িয়ে রইলেন। ইতিমধ্যে পূর্বোক্ত রমণী পুনৰ্ব্বার সেই ঘরে এসে পূৰ্ব্ববৎ কোমলস্বরে আমারে বোল্লেন, “হরিদাস! এটা তোমার ভগিনী হয়, এটী আমারি কন্যা, এর নাম অমরকুমারী। তোমরা দুটী ভাই-ভগিনীতে এইখানে বোসে গল্প কর, একটু পরেই আবার আমি আসছি।”

আমাকে ঐ কথা বোলে কন্যাটীকে সম্বোধন কোরে তিনি বোল্লেন, “অমর। এই সেই হরিদাস; কর্ত্তার মুখে যার কথা শুনেছিলে, এই সেই হরিদাস। তোমার পিসীমার ছেলে, হরিদাসের কাছে লজ্জা কোত্তে নাই; ভাই হয়, ভাইকে দেখে কেহ কি লজ্জা করে, বোসো; বোসে দুজনে কথাবার্ত্তা কও, লেখাপড়ার পরিচয় দাও, লজ্জা কি? আমি শুনেছি, হরিদাস বেশ লেখাপড়া জানে, হরিদাসের কাছে তোমার অনেক শিক্ষা হবে; দুটীতে বেশ আমোদে থাকবে; বোসো।”

অমরকুমারী বোসলেন, কুমারীর জননী অন্য কার্য্যে চোলে গেলেন। অমরকুমারীর সঙ্গে আমি কথা কইতে আরম্ভ কোল্লেম। আমার মুখে অনেক কথা, অমরের মুখে দুটী একটী মাত্র। অমরকুমারী লেখাপড়া করেন, আমি দুটী একটী লেখাপড়ার কথা জিজ্ঞাসা কোল্লেম, অমরকুমারী সুন্দর মুখখানি একটু নীচু কোরে মৃদু মৃদু হাস্য কোল্লেন। অতি মধুর মৃদু হাস্য। বর্দ্ধমানে আশালতাকে দেখেছি, আশালতাও সুন্দরী, এই অমরকুমারীও সুন্দরী। আশালতার মুখে মৃদু হাস্য দেখেছি, সেই হাস্য যেমন সুমধুর, অমরকুমারীর হাস্যও তদ্রূপ সমধুর। আহা! অভাগিনী আশালতা! অকালে অকস্মাৎ পিতৃহীনা! বিবাহের সূচনায় নিদারুণ বিঘ্ন! আহা! এ জন্মে হয় তো আশালতাকে আর আমি দেখতে পাব না!

দুঃখের কথা যতই ভাবি, ততই বাড়ে! অদৃষ্ট আমার! যতটা ভুলে থাকা যায়, ততই মঙ্গল। যেখানে এখন এসেছি, সেইখানকার কথাই বলি। লেখাপড়ার কথায় অমরকুমারী হাসলেন কেন?—কারণ আছে। আজকাল আমাদের দেশে আমাদের বালিকাগণের বিদ্যাশিক্ষার যে প্রকার রীতি আরম্ভ হয়েছে, তখন এপ্রকার ইংরাজীধরণের বালিকা বিদ্যালয় ছিল না। অমরকুমারী কোন বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেন নাই; এখনকার বালিকাবিদ্যালয়সমূহে যে সকল পাঠ্যপুস্তক প্রচলিত, তখন সে সকল পুস্তকের জন্মও হয় নাই। অমরকুমারী আপন জননীর নিকটে রামায়ণ মহাভারত পাঠ করেন, অপরাপর ধর্ম্মশাস্ত্রের আলোচনা করেন, বিষ্ণুশর্ম্মার হিতোপদেশের শ্লোকগুলি মুখস্থ করেন, এই রকম শিক্ষা। চন্দ্র কত বড়, পথিবী কত বড়, পৃথিবী থেকে সূৰ্য্য কত দূর, নবাব সিরাজোদ্দৌলা কেমন লোক, এই ভাবের গোটাকতক প্রশ্ন আমি জিজ্ঞাসা কোরেছিলেম, সেই জন্যই অমরকুমারী হেসেছিলেন। ধর্ম্মশাস্ত্রের সহজ সহজ কথায় অমরকুমারী বেশ নীতিশিক্ষার পরিচয় দিলেন, সেই সঙ্গে মুখখানি একটু কাচুমাচু কোরে বোল্লেন, “শিক্ষার আমি সময় পাই না : মেয়েমানুষের লেখাপড়ার উপর বাবা বড় চটা। বাবা যখন ঘরে না থাকেন, সেই সময় গোপনে একটু একটু পড়াশুনা করি; তিনি দেখতে পেলে কিম্বা জানতে পাল্লে আমাকে শুদ্ধ, মাকে শুদ্ধ মেরে গুড়ো কোরে দিবেন, পুঁথিগুলি পর্য্যন্ত আগুন জ্বেলে পুড়িয়ে দিবেন; এত বড় রাগ!”

মনে আমার বিস্ময়ের উদয় হলো। সবিস্ময়ে আমি জিজ্ঞাসা কোল্লেম, “তোমার বাবা কোথায় থাকেন?” যেন চোমকে উঠে মৃদস্বরে কুমারী বল্লেন, “এ কি গো! কেমন কথা জিজ্ঞাসা কর? যিনি তোমারে নিয়ে এলেন, যাঁর বাড়ীতে তুমি এসেছ, তিনিই আমার বাবা। তা কি তুমি জান না? তিনি বলেন, তোমার মামা তিনি; মামাকে তুমি জানো না?”

বিস্ময়ভাব গোপন কোরে অম্লানবদনে আমি বোল্লম, “না, তা আমি কেমন কোরে জানবো? তিনি তোমার বাবা, সে পরিচয় আমি কার কাছে পাবো? এ সব কথা তিনি আমাকে কিছুই বলেন নাই।

কুমারীকে এই কথা বোল্লেম বটে, কিন্তু মনটা বিষম চঞ্চল হলো : সর্ব্বশরীর শিউরে উঠলো; প্রাণে কেমন ব্যথা লাগলো। কি ভয়ানক কথা! সেই রুগ্ণশরীরা সুন্দরী কি না রক্তদন্তের পত্নী! এই কুসমকোমলা সর্ব্বাঙ্গসুন্দরী অমরকুমারী কি না রক্তদন্তের কন্যা! কি সৰ্ব্বনাশ! বিধাতার এ কি অদ্ভুত সংঘটন! রাক্ষসের গৃহে সুরসুন্দরী! রাক্ষসের সঙ্গে সুরসুন্দরীর বিবাহ! প্রজাপতির এ কি অদ্ভুত নিৰ্ব্বন্ধ! অমরকুমারী যেন যথার্থই অমরকুমারী! এই দেবকন্যার পিতা কি সেই রাক্ষস রক্তদন্ত?

মনে অনেক প্রকার তোলপাড় কোল্লেম, ক্রমশই সংশয় বিস্ময় বেড়ে উঠতে লাগলো। কথাটা চাপা দিয়ে অমরকুমারীকে আমি জিজ্ঞাসা কোল্লেম, “কোথায় আমি এসেছি? এটা কোন স্থান? এ গ্রামের নাম কি?”

অমরকুমারী বোল্লেন, “গ্রামের নাম নন্দীগ্রাম, বীরভূম জেলা, অতি নিকটেই সিউড়ি সহর। এ জেলার নাম তুমি কি কখনো শুন নাই? এত দিন তুমি কোথায় ছিলে?

এই আবার সেই বিভ্রাট! এ প্রশ্নের কি উত্তর দিই? এত দিন আমি কোথায় ছিলেম, সে কথা বোলতে গেলেই গোড়ার কথা এসে পড়ে। সে সব কথা প্রকাশ করা রক্তদন্তের বারণ। রক্তদন্তের বারণ না থাকলেও এই সুশীলা কুমারীর কাছে সে সব কথা আমি বোলতে পাত্তেম না; সে ভাবের কোন কথাই বোল্লেম না; ভাবলেম কেবল বলি কি? যদি বলি বর্দ্ধমানে ছিলেম, সে কথাতে সঙ্গতি রাখা যাবে না। কেন না, বর্দ্ধমানের নিকটেই বীরভূম। যারা বর্দ্ধমানে থাকে, তারা বীরভূমের নাম জানে না, এ কথা হাস্যকর; অমরকুমারীর বয়স অল্প, তথাপি এই হাস্যকর কথায় অমরকুমারীরও বিশ্বাস হবে না। তবে বলি কি?—অনেক ভেবে চিন্তে শেষকালে বোল্লেম, যেখানে যখন থাকা আবশ্যক হয়েছিল, সেইখানেই তখন ছিলেম; বীরভূমে কখনো আসি নাই; নূতন জায়গায় এলেই স্থানের নামটা জিজ্ঞাসা কোত্তে হয়, সেই জন্যই জিজ্ঞাসা কোরেছিলেম। আচ্ছা অমর, তোমার জননীকে ওরকম কাহিল কাহিল শুষ্ক শুষ্ক বিবর্ণা দেখায় কেন? রুপের সঙ্গে লাবণ্য ছিল, চেহারা দেখে সেটী বেশ বুঝা যায়, বাঙ্গালী সুন্দরী-সমাজে তিনি গণনীয়া, ওরকম সুন্দরী আমি কম দেখেছি, এ কথাও বেশ বলা যায়, তবে তাঁর দেহখানি কেন ও রকম পাণ্ডুবর্ণ?”

কুমারী উত্তর কোল্লেন, “আগে ও রকম ছিল না, আজ প্রায় দুবছর হবে, পেটের ভিতর কি একটা রোগ হয়েছে, তাতেই মা আমার দিন দিন কাহিল হয়ে যাচ্চেন, গায়ের রক্ত জল হয়ে যাচ্চে, সেই জন্যই রংটা অমন ফ্যাঁসাটে দেখাচ্চে। আহা! মায়ের আমার কি চমৎকার বর্ণই ছিল! ঠিক যেন মা ভগবতীর বর্ণ!”

পূর্ব্বেই আমি অনুমান কোরেছিলেম, কোন প্রকার পীড়া আছে, কুমারীর মুখে শুনে জানতে পাল্লেম, সত্যই তাই। একটু চিন্তা কোরে জিজ্ঞাসা কোল্লেম, চিকিৎসা করান হয় না? কি রোগ? কবিরাজেরা কিছু বলেন না?”

চঞ্চলনয়নে ঘরের বাহিরের দিকে চেয়ে কুমারী উত্তর কোল্লেন, “কবিরাজ কোথায় পাবো? চিকিৎসা করাবে কে? বাবা ও সকল দিকে আসলেই মন দেন না। একটী কথা বোলতে গেলেই রেগে উঠেন। কথায় কথায় রাগ! কেবল রাগ! মা আমার ঐ রোগা শরীরে সংসারের সব কাজ করেন, আমারে কিছুই কোত্তে দেন না, তবু আমি যতদূর পারি, সাহায্য করি; তাতেও তিনি বারণ করেন; হাজার কষ্ট হলেও উঠে হেঁটে বেড়ান, কাজকর্ম্ম করেন, সাধ্যমতো বাবার সেবা করেন, একটু ত্রুটি হোলেই বাবা বেজার হন, দাঁত-মুখ খিচিয়ে গালাগালি দেন, মারতে আসেন। এক একদিন ঐ রোগা মানুষকে মেরেও বসেন! মেরে মেরে আধমরা করেন! তিনি আবার চিকিৎসা করাবেন? ও হরি! আমাদের কপাল যেমন!”

সজললোচনে চুপি চুপি ঐ কটী কথা বোলে কুমারী যেন কতই ভয়ে ঘন ঘন বাহিরের দিকে চাইতে লাগলেন। পাছে সেই নৃশংস রাক্ষসটা হঠাৎ এসে পড়ে, সেই ভয়। ভাবটা বুঝতে পেরেও কাতরে মৃদস্বরে আবার আমি জিজ্ঞাসা কোল্লেম, “তোমার বাবার যদি অতই রাগ, অতই অযত্ন, তবে ঘরসংসার চলে কিরূপে?”

চক্ষের জল মার্জ্জন কোরে, পুনৰ্ব্বার বাহিরের দিকে চেয়ে চেয়ে, দীর্ঘ একটী নিশ্বাস ফেলে, ভয়াকুলা সুশীলা পূর্ব্ববৎ মৃদস্বরে বোল্লেন, “আর আমাদের ঘরসংসার। সংসারে আমাদের ভারী কষ্ট! এক বিন্দুও সুখ নাই! বাবা আমার খামখেয়ালী! যেমন রাগী, তেমনি অস্থির! রাগের কথা কি আর বলবো, শুনলে তুমিও মনে কষ্ট পাবে। আমার একটী দিদি ছিল, আমার চেয়ে দু-বছরের বড়। বাবা যখন আমার উপর রাগ করেন, বিনা দোষে আমাকে ধরে ধরে মারেন, আমি তখন মুখটী বুঁজে চুপটী কোরে থাকি, কাঁদতেও পারি না; কাঁদলে পর আরো মারেন! দিদি সে সব দৌরাত্ম সইতে পাত্তো না, মুখের উপর চোটপাট জবাব কোতো। একদিন বাবা তাকে সপাসপ ঝাঁটার বাড়ি মারেন, বিনা দোষে ঝাঁটা; বুক বেয়ে, পিঠ বেয়ে রক্ত পড়ে, ঠাঁই ঠাই ঝ্যাঁটার কাঠী ফুটে থাকে; জালায় ছটফট কোত্তে কোত্তে দিদি সেই দিন আমার একটা খেলানাপতুল ছুড়ে মেরেছিলো, গায়ে লাগে নাই, তবুও রক্ষে থাকলে না; বাবা একেবারে রেগে অগ্নিশর্ম্মা হয়ে, দিদির গলা টিপে ধোরে, মাটীতে ফেলে, দমদম কোরে লাথি মাত্তে লাগলেন। মা ছুটে গিয়ে বাবার একখানা হাত ধোল্লেন, আমিও কাঁদতে কাঁদতে ছুটে গিয়ে দিদির গায়ের উপর শুয়ে পোডুলেম। আমাদেরও নিস্তার থাকলো না! মায়ের তখন পীড়া হয় নাই, শরীরে বল ছিল, বাবাকে ধোরে টানাটানি কোল্লেন, তবুও পেরে উঠলেন না; পুরুষের জোরে পারবেন কেন? জোর কোরে হাতখানা ছাড়িয়ে নিয়ে, মাকে দুই লাথি মেরে পাঁচ হাত তফাতে ঠেলে দিলেন; আমাকেও এক লাথি মেরে তফাৎ কোরে দিয়ে দিদিকে আবার ধোল্লেন, গুমগম কোরে কীল মাত্তে মাত্তে হাত ধোরে টেনে টেনে দাঁড় করালেন; দিদির নাক দিয়ে মুখ দিয়ে রক্ত পোড়তে লাগলো! তবুও ক্ষতি নাই! শেষকালে একখানা ন্যাকড়া পোড়িয়ে গলাধাক্কা দিয়ে বাড়ী থেকে তাড়িয়ে দিলেন! বাড়ীর কাছেও থাকতে দিলেন না, ধাক্কা দিতে দিতে কত দূর নিয়ে নদী-পারে ফেলে দিয়ে এলেন। সেই অবধি আমার দিদির আর উদ্দেশ নাই! আছে কি মোরে গেছে, তাও আমরা জানি না!”

থেমে থেমে নিশ্বাস ফেলে ফেলে এই দুঃখের কথাগুলি বোলে, অমরকুমারী দুই হতে চক্ষু ঢেকে হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন। হৃদয়ে বেদনা পেয়ে অনেক প্রবোধবাক্যে আমি তাঁকে সান্ত্বনা কোত্তে লাগলেম। রাত্রি প্রায় এগারটা। জননী মেয়েটীকে ডাকলেন, সাবধানে রোদন সংবরণ কোরে, জননীর সঙ্গে স্নেহময়ী কন্যাটী রন্ধনগৃহে গেলেন। একটু পরেই আহারের আয়োজন হলো, আমি আহার কোল্লেম। আহার হলো রুটী, নিরামিষ তরকারী আর দুগ্ধ-সন্দেশ। বীরভূমজেলায় ময়রার দোকানের চিড়ে-মুড়ী ছাড়া সমস্ত খাবার জিনিসকেই সন্দেশ বলে। মুড়কীও সন্দেশ, পাটালীও সন্দেশ, বাতাসাও সন্দেশ, গুড়ও সন্দেশ। লোকবিশেষের নিকটে কচুরিজিলাপীও সন্দেশ নামে বাচ্য। রুটীর সঙ্গে আমি দুধ-সন্দেশ খেলেম, এই কথা বলেছি, এখানে সন্দেশ মানে গুড়।

রক্তদন্ত তখনও ফেরে নাই। কন্যার মুখে শুনলেম, লোকটা খামখেয়ালী। যখন ইচ্ছা হয়, তখন আসে, কোন কোন দিন আসেও না। আমি আহার কোল্লেম, অমরকুমারী খেলেন না, গৃহিণীও খেলেন না; কার অপেক্ষায় দুজনেই বোসে থাকলেন। তিনটী ঘরের একটী ঘরে আমার শয়নের স্থান হলো। রক্তদন্তের মুখের সম্পর্কে অমরের জননী আমার মামী;—রক্তদন্তকে মামা বলতে আমার মনে বিজাতীয় ঘৃণার উদয় হয়, অমরের জননীকে মামী বোলতে আহ্লাদ জন্মে।

মামী আমাকে শয়ন কোত্তে বোল্লেন। পথে অনেক কষ্ট পেয়েছিলেম, শরীর বড় ক্লান্ত ছিল, সুতরাং তাদের আহারের অগ্রেই আমি শয়ন কোল্লেম।

ক্লান্তশরীরে শয়নমাত্রেই নিদ্রা হয়, সে রাত্রে আমার তা হলো না। মনে মনে অনেকক্ষণ অমরকুমারীর কথাগুলি আলোচনা কোত্তে লাগলেম। কবিরা বলেন, আকারের সঙ্গে চরিত্রচর্যার ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ। কথা ঠিক। রক্তদন্তের আকার যেমন ভয়ঙ্কর, স্বভাবও ঠিক তাহার অনুরুপ। পরিবারের প্রতি সেই লোকের যে প্রকার নিষ্ঠুর ব্যবহার, সত্য সত্য নরখাদক রাক্ষসদেরও সেরূপ ব্যবহার হয় না। সামান্য অপরাধে বড়মেয়েটীকে বাড়ী থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে, দেশছাড়া কোরে দিয়েছে, আছে কি নাই, সংবাদ পর্য্যন্ত অজ্ঞাত! বড়ই ভয়ঙ্কর!—ভয়ঙ্কর রাক্ষস অপেক্ষাও ভয়ঙ্কর! এই লোক যে অবাধে মানুষগরু হত্যা কোত্তে পারে না, কাঁচা কাঁচা মানুষ-গরু ধোরে ধোরে খেতে পারে না, কিছুতেই তো আমার মনে এমন ধারণা আসে না; এমন ধারণা এলোও না।

এই সব আলোচনা কোত্তে কোত্তে নিদ্রা এলো, আমি অকাতরে ঘুমালেম। প্রভাতে জাগরিত হয়ে দরজা খুলতে যাই, খোলা যায় না;—দরজা বন্ধ; বাহিরদিকে বন্ধ; বোধ হলো, চাবী দেওয়া। বেলা যখন আটটা কি নটা, সেই সময় কটকট শব্দে চাবী খুলে কে যেন একটু বাহিরদিকে পাশ কাটিয়ে দাঁড়ালো। বেরিয়েই দেখি, রক্তদন্ত।

রক্তদন্তের মুখখানা তখন রক্তবর্ণ, চক্ষু দুটোও রক্তবর্ণ। মুখের গন্ধে নিকটে দাঁড়াতে পাল্লেম না, একটু তফাতে গিয়ে দাঁড়ালেম। কিসের দুর্গন্ধ? “তফাৎ থেকেও সেই দুর্গন্ধটা আমার নাকে আসতে লাগলো, বোধ হলো, মদ খেয়েছে। লোকের মুখে শুনেছি, পচা গন্ধ অপেক্ষা মদের গন্ধের ঝাঁজ বেশী। রক্তদন্তটা নিশ্চয়ই মদ খেয়েছে।

আপন মনে এইরূপ অবধারণ কোচ্ছি, কর্কশকণ্ঠে জড়িয়ে জড়িয়ে রক্তদন্ত জিজ্ঞাসা কোল্লে, “কি রে ছোকরা! বাবার বাড়ীতে তুই যে বড় বোলেছিলি, আমি তোর মামা নই! এখন কেমন? মামার বাড়ীতে তোর আদরযত্ন কেমন? খাসা রুটী, খাসা দুধে, খাসা সন্দেশ, খাসা বিছানা, জন্মে কখন কি এত সুখের মুখ দেখতে পেয়েছিস? মনে রাখিস, মামা না হোলে এত সুখে রাখতে কেহই পারে না! কেমন, এখন আমাকে মামা বোলতো।”

অমরকুমারী ব্যস্তভাবে এসে তাড়াতাড়ি বোল্লেন, “বাবা! সদরে কে একজন লোক এসেছে, তোমাকে ডাকছে।”

রাক্ষস শেষকালে আমাকে যে কথা বোলছিল, তা আর বলা হলো না, রক্তচক্ষে আমার দিকে চাইতে চাইতে সদরবাড়ীতে চোলে গেল। একটু পরে কুমারীর মুখে শুনলেম, নূতনলোকের সঙ্গে বাড়ী থেকে বেরিয়ে গেল। একটা ঝড়ের মুখ থেকে আমি যেন পরিত্রাণ পেলেম।

প্রভাতের নিয়মিত কাৰ্য্য সমাধা কোরে নিকটের এক সরোবরে আমি স্নান কোল্লেম, কেহই আমার সঙ্গে থাকলো না। সেই সময়ে একবার মনে হয়েছিল, এই বেলা ছুটে পালাই, কিন্তু সেই সংসারের মাতা পুত্রীর সদব্যবহার স্মরণ কোরে সে ইচ্ছাটা পরিত্যাগ কোল্লেম। তাঁরা আমাকে কখন দেখেন নাই, এক রাত্রির মধ্যে ততটা দয়া জানালেন, ততটা ভালবাসলেন, তাঁদের প্রতি আমার স্নেহ-ভক্তির সঞ্চার হলো।

স্নান কোরে বাড়ীর ভিতর আমি ফিরে গেলেম, কাপড় ছাড়লেম, সন্দেশনামক ফেনীবাতাসা জল খেলেম, রাত্রে যে ঘরে শয়ন কোরেছিলেম, সেই ঘরে গিয়ে বোসলেম, অমরকুমারী তখন গৃহকাৰ্য্যে জননীর সাহায্যে ব্যস্ত ছিলেন, আমার কাছে বসবার অবসর পেলেন না। নিরবলম্বনে একাকী বোসে বোসে আমি কি করি? পাঠশালা থেকে দূরীভূত হবার পর অবকাশকালে নিত্য নিত্য যা আমি কোরে থাকি তাই করি;—ভাবি।—ভাবনা আমার নিত্য-সহচর। নির্জ্জনে ভাবনা ভিন্ন আর কিছুই আমার সঙ্গে থাকে না। আজ এখন একটা নূতন ভাবনা। আহারের ব্যবস্থা কিরূপ হয়? আমার জাতি আমি জানি না, সে কথা সত্য, কিন্তু তা বলে যার তার অন্ন গ্রহণ করা কর্তব্য হয় না। ব্রাহ্মণের অন্নে বাধা নাই, কিন্তু এটা ব্রাহ্মণের বাড়ী নয়, কি জাতির বাড়ী, সেটাও আমার জানা হয় নাই। আমি কি জাতি, রক্তদন্ত হয় তো জানে না। জানলে মামা বোলে আমার সঙ্গে সম্পর্ক পাতাতে যাবে কেন? আচ্ছা তাই যদি ঠিক হয়, আমি যে জাতি, রক্তদন্ত সেই জাতি, তাই যদি ঠিক হয়, তা হোলেই বা রক্তদন্তের অন্নভক্ষণে আমার রুচি হবে কিরূপে? একটী কথা আছে। রক্তদন্তের স্ত্রী-কন্যার যে প্রকার রূপলাবণ্য, যে প্রকার মুখশ্রী, তাতে কোরে রক্তদন্তের পত্নীকে ইতরজাতীয় বোলে কিছুতেই প্রত্যয় হয় না; ব্যবহারেও এই রমণীটী রমণী-রত্ন; ইতরজাতি হোলে এ রকম হতো না। পরিচয়টা মিথ্যা হোলেই ভাল হয় —এ রমণী রক্তদন্তের স্ত্রী, মিথ্যা হলেই ভাল হয়। রক্তদন্তের উপর আমার ঘৃণা, রক্তদন্তকে দেখলেই আমার ভয় হয়, অমরকুমারীকে দেখলে, অমরকুমারীর জননীকে দেখলে উল্লাসে যেন হৃদয় নৃত্য করে; অমরের জননীর হস্তে পাক করা অন্নভক্ষণে কোন দোষ হবে না, কাজে কাজে অনেক ভাবনার পর শেষে এই সিদ্ধান্তটা দাঁড়ালো। না দাঁড়ালেই বা কি হতো? পশ্চিমের হিন্দুস্থানী লোকের মতন দু-বেলা রুটী খাওয়া বঙ্গদেশের পদ্ধতি নয়, তোমাদের ভাত আমি খাব না, এ কথা বলাও ভাল নয়, সুতরাং সেই সিদ্ধান্তের উপদেশেই আমি কাজ কোল্লেম; বেলা দুই প্রহরের পূর্বে স্নেহময়ী মাতুলানীর হস্তে পাক করা অব্যঞ্জন পরিতোষরূপে ভোজন কোল্লেম।

রক্তদন্ত এলো না; বেলা আড়াই প্রহর অতীত হয়ে গেল, তিন প্রহর হোতে যায়, এখনো এলো না। তবে আর আসবে না, স্থির কোরে, নিতান্ত শেষবেলায় মাতাপুত্রী উভয়ে আহার কোল্লেন।

একটু পরেই সন্ধ্যা হলো। সন্ধ্যাকালের কাজকর্ম্ম সমাপন কোরে অমরকুমারী আমার কাছে এসে বোসলেন। প্রথমেই আমি জিজ্ঞাসা কোল্লেম, “সমস্ত দিন গেল, তোমার বাবা তো এলেন না, আহারও কোল্লেন না, কি কাজে তিনি ব্যস্ত আছেন?”

কুমারী বোলেন, “তাঁর স্বভাবই ঐ রকম। কাজকর্ম্ম থাক, না থাক, বাইরে বাইরে দিন কাটাতেই তিনি ভালবাসেন; মাঝে মাঝে একেবারে ডুব মারেন। কখনো পাঁচ দিন অন্তর, দশ দিন অন্তর, বিশ দিন অন্তর, কখনো বা মাসান্তরে দেখা দেন। এবারে হয় তো সে রকম কোরবেন না। তোমারে এনেছেন, তুমি নূতন এসেছ, তোমার খবরদারী লওয়া দরকার; কি প্রকার ব্যবস্থা করা হবে, দিনে দিনে তিনি সেটা স্থির কোরবেন বোলেছেন, এখন আর বাইরে বাইরে রাত কাটাবেন না। কাল অনেক রাত্রে এসেছিলেন। বেশী রাত্রে বাড়ীতে এলে তিনি বিষম গণ্ডগোল করেন, মিছামিছি চীৎকার শব্দে বাড়ী ফাটান; চিরদিন ঐ রকম অভ্যাস। কাল রাত্রে সেই রকম চীৎকারে তিনি যখন গোলমাল করেন, সেই গোলমালে আমি তখন জেগে উঠি। মা ঘুমচ্ছিলেন, ঘরের ভিতর এসেই বাবা তাঁকে এক ধাক্কা মেরে জিজ্ঞাসা করেন, হরিদাস কোন ঘরে? যে ঘরে তুমি শুয়েছিলে, মা সেই ঘরটী দেখিয়ে দিলেন, বাবা তাড়াতাড়ি একটা চাবীতালা খুঁজে নিয়ে ঘরের দরজার চাবী দিলেন : চাবীটা আমাদের কাছে রাখলেন না, নিজেই রাখলেন। রাত্রি তখন বেশী ছিল না, বাবা কিছুই আহার কোল্লেন না, আমরাও উপবাস কোরে থাকলেম। কেন যে তিনি তোমার ঘরে চাবী দিয়েছিলেন, আমরা তার ভাব বুঝতে পাল্লেম না। আজও হয় তো সেই রকম কোরবেন। সমস্ত দিন তো এলেন না, আজো হয় তো অনেক রাত্রে আসবেন।”

অমরের জননী অন্যঘরে অন্য কার্যে ব্যাপৃতা। রন্ধনাদি কার্য্য ছাড়া তাকে অনেক কাজ কোত্তে হয়। কাপড় ছিঁড়ে গেলে, বিছানা-বালিশ ছিঁড়ে গেলে, স্বহস্তে সেলাই কোত্তে হয়, নিকটের বাগান থেকে কাঠ কুড়িয়ে আনতে হয়, মাঠের গোবর কুড়িয়ে ঘুটে দিতে হয়, সাজিমাটী দিয়ে ময়লাকাপড় কেচে নিতে হয়, আরো কত কি রকমারী কাজ, একে একে অমরকুমারী অনেক পরিচয় দিলেন। সকল কাজ রাত্রে হয় না, রাত্রে তিনি একখানি ছেঁড়া কাপড় সেলাই কোত্তে বোসেছিলেন, অমরকুমারীও বোসেছিলেন। অমরকুমারীও সেলাই জানেন, কিন্তু আমি একাকী থাকবো, সেটা ভাল দেখায় না, সেই জন্য আমার কাছেই তারে বোসতে হয়েছিল। আমরা দুজনে নির্জ্জনে ঘরে বোসে গল্প কোচ্ছিলেম। কথা কইতে কইতে বার বার আমার মুখের দিকে চেয়ে বুদ্ধিমতী বালিকা হঠাৎ জিজ্ঞাসা কোল্লেন, “হরিদাস! তুমি যেন সৰ্ব্বক্ষণ অন্যমনস্ক, সদাই যেন বিমর্ষ, এসে অবধি একবারও তুমি ভাল কোরে হেসে কথা কইলে না, একবারও আমি তোমাকে প্রফুল্ল দেখলেম না, মনের ভিতর কি যেন দুর্ভাবনা আছে এই রকম বোধ হয়। আমার মনে হয়, কি যেন তুমি ভাবো। রাতদিন এত কি তুমি ভাবো?”

আমি উত্তর কোল্লেম, “ভাবনা আমার অনেক। আমার ভাবনার পার নাই, পথ নাই, সীমা নাই। কত কি যে ভাবি, মুখে আমি তা বোলতে পারি না। তোমার বাবা আমাকে আমার দুঃখের কথা তোমাদের কাছে বোলতে বারণ কোরেছেন, কি কারণে বারণ, তা আমি জানি না, সে সব কথা আমি বোলতে পারবো। যেটা আমার এখন বেশী ভাবনা, সেটা কেবল মনের উদ্বেগ; বিষম একটা সন্দেহ। তোমারে দেখা অবধি আমি একটু ভাল আছি, তুমি আমারে বিশ্বাস কোরেছ, আমিও তোমারে বিরক্তি কোরেছি; তোমার কাছে যদি বলি, কারো কাছে প্রকাশ হবে না, সেটাও আমি বুঝতে পাচ্ছি। তুমি যখন জিজ্ঞাসা কোল্লে, তখন আর গোপন রাখতে পারি না; আপনার লোকের কাছে মনের বেদনা প্রকাশ কোল্লে হৃদয়ের ভার অনেকটা লাঘব হয়, এটা সাধুবাক্য; সাবধান, যা তোমাকে আমি বোলবো, কারো কাছে গল্প কোরো না, মায়ের কাছেও না। বর্দ্ধমানে এক বাবুর বাড়ীতে আমি ছিলেম, বাবু, আমাকে যথেষ্ট ভাল বাসতেন, ভবিষ্যতে আমার ভাল কোরবেন অঙ্গীকার কোরেছিলেন, বাড়ীর মেয়েদের কাছেও আমার আদর ছিল। হঠাৎ একরাত্রে সেই দয়াময় বাবুটীকে কোন দুষ্টলোকে খুন কোরে গেছে! বাড়ীতে ডাকাত পোড়েছিল, এই কথা প্রকাশ, পুলিশের তদারকে কিন্তু কোন বিষয়ের কিছুই কিনারা হলো না। ডাকাতে কেটে গেছে, ডাকাতের সন্ধান করা হলো, পুলিশের রিপোর্টে এই পর্য্যন্ত কথা। ডাকাত পোড়েছিল, জিনিসপত্র লয় নাই, কেবল কর্ত্তাকেই খুন কোরেছে, এটা বড় আশ্চর্য্য ব্যাপার! পুলিশের তদন্ত, পুলিশের অনুসন্ধান, এই দুটী বাক্য অথবা এই দুটী কাৰ্য্য অনেক জায়গায় ছেলে ভুলানো প্রবোধের মধ্যেই দাঁড়ায়। প্রথম প্রথম দিনকতক একটু হৈ চৈ পড়ে, তার পর প্রায়ই চাপা পোড়ে যায়। আহা বাবুটীকে কোন দুরাত্মা খুন কোরে গেল, কেনই বা খুন কোল্লে, তাই আমি সৰ্ব্বক্ষণ ভাবি, সেই বাড়ীতে থেকে আমি বেশ জানতে পেরেছিলেম, বাবুর কেহ শত্রু ছিল না, বাবুর স্বভাব অমায়িক ছিল, সকল লোকের উপকারে তিনি অগ্রে দাঁড়াতেন, মিষ্ট সম্ভাষণে সদয় ব্যবহারে সকলকেই তিনি তুষ্ট রাখতেন। আহা! তেমন সদাশয় মহৎলোকের ভাগ্যে এমন বিপরীত ঘটনা কেন হলো?

রাত্রি অনুমান আটটা। ঘরের দরজাটা ভেজানো ছিল, সজোরে ঝনঝন শব্দে দরজাটা খুলে ফেলে একটা লোক সেই ঘরের মধ্যে প্রবেশ কোরেই দুই হাতে আমার গলা টিপে ধোল্লে! উর্দ্ধদৃষ্টিতে আমি চেয়ে দেখলেম, সেই দুরন্ত দুরাচার রক্তদন্ত! ভীষণগর্জ্জনে সে আমাকে বিস্তর গালাগালি দিয়ে, খোমকে ধামকে বোল্লে, “পাজি! শূয়ার! কুকুর! ইঁদুর! ছুঁচো। এত বড় আস্পর্ধা তোর! পরের বাড়ীর খুন-ডাকাতীর কথা নিয়ে ঘরের ভিতর তোলাপাড়া! কচি-মেয়ের কাছে খুন-ডাকাতীর গল্প? আমি তোকে বারণ কোরেছিলেম, সে কথা ভুলে গেছিস? আচ্ছা, থাক তুই, হাতে হাতে প্রতিফল পাবি।”

আমাকে ঐ রকমে গালাগালি দিয়ে শাসিয়ে, শেষকালে মেয়েটীর উপরে হুহুঙ্কার! “ও সব কথা তুই কেন শুনতে আসিস? তুই কেন ওর কাছে বোসে থাকিস? এক লাথিতে তোকে আমি যমের বাড়ী পাঠাবো! একটাকে বিদায় কোরেছি, তোকেও সেই পথে বিদায় কোরবো! আয় আয় বেটী আয়, এ ঘর থেকে বেরিয়ে আয় আজ তোকে আমি আর আস্ত রাখবো না, গুঁড়ো কোরে ফেলবো।”

এইরুপ গর্জ্জন কোত্তে কোত্তে মেয়েটীকে টেনে নিয়ে সেই রাক্ষসটা তখন ঘর থেকে বেরুলো, ঘরের দরজার শিকল টেনে দিলে, ঘরের ভিতর আমি একাকী কয়েদ থাকলেম। রক্তদন্ত গমগম শব্দে ভূতলে পদাঘাত কোত্তে কোত্তে কতরকম চীৎকার কোল্লে, ঘরের হাড়ি-কলসী ঘটী-বাটী ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলতে লাগলো, তার পর আমার ঘরের দ্বারে চাবী বন্ধ কোরে বোকতে বোকতে বাড়ী থেকে বেরিয়ে গেল। বাড়ীখানা যেন একটু জুড়ুলো।

ঠিক আমি কয়েদী। মনে আবার নূতন ভয়ের আবির্ভাব। সর্ব্বশরীরে নূতন কম্প। অমরকুমারীর সঙ্গে এক ঘরে আমি বেসেছিলেম, অমরকুমারীকে যে সব কথা বোলেছিলেম, রাক্ষসটা হয় তো আড়ালে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেই সব কথা শুনেছিল, তা না হলে, অত রাগ কেন হবে? বর্দ্ধমানের বাবুর বাড়ীর ডাকাতীর কথায় এ লোকটারই বা সে রকম অগ্নিমূর্ত্তি কেন হলো? এর ভিতরেও বোধ হয়, কোন ভয়ঙ্কর গুপ্তব্যাপার আছে। যাই হোক, আমার নিজের এখন উপায় কি?

উপায় তো কিছুই স্থির কোত্তে পাল্লেম না। লোকটা আমাকে কয়েদ কোরে রেখে গেল, রাত্ৰিমধ্যে আর ফিরে আসবে কি না, সে-ই জানে। যদি আসে, এসেই হয় তো আমাকে কেটে ফেলবে! শাসিয়ে গেল, হাতে হাতে প্রতিফল! আমার আর প্রতিফলের বাকী কি? এই বয়সে, অল্প দিনে কত বিপদের মুখে পতিত হয়েছি, কত কষ্টই সহ্য কোরেছি, আমি জানি, আর যিনি সেই সৰ্ব্বসাক্ষী ভগবান, তিনিই জানেন। হাতে হাতে প্রতিফল!—এটাই বা কি কথা? প্রতিফল কিসের?—কুকার্য্য কোল্লে তো পাপীলোকে প্রতিফল পায়; আমি জন্মাবধি জ্ঞানগোচরে কোন কুকাৰ্য্য করি নাই, যে কার্য্যে পাপ হয়, সে কার্য্য কখনো আমি স্বপ্নেও কল্পনা করি নাই, তবে আমি প্রতিফল কেন পাব? নিরাশ্রয় নিঃসহায় আমি, দয়াময় ভগবান আমাকে রক্ষা কোরবেন, সেই ভরসায় অন্ধকার ঘরের মধ্যে করযোড়ে আমি সেই মঙ্গলময় পরমেশ্বরের শ্রীপাদপদ্ম উদ্দেশে শত শত প্রণিপাত কোল্লেম।

রাত্রে আর রক্তদন্ত ফিরে এলো না। তার স্ত্রী-কন্যা উপবাসিনী থাকলেন, আমিও উপবাস কোল্লেম। পরদিন বেলা দুই প্রহরের সময় রক্তদন্ত এলো, স্ত্রী-কন্যার উপর পর্ব্ববৎ গর্জ্জন কোল্লে, আমার ঘরের চাবী খুলে আমাকে ধাক্কা দিয়ে বাইরের ঘরে নিয়ে গেল। প্রহরীরা যেমন জেলখানায় কয়েদীগণকে পাহারা দিয়ে স্নান করায়, রক্তদন্ত আমাকে সেই রকমে পাহারা দিয়ে স্নান করিয়ে আনলে। আমি মনে কোল্লেম, বলিদানের অগ্রে বলীকে, যেমন ছাগশিশুকে স্নান করিয়ে শেষকালে গলা কাটে, এ লোকটাও আমাকে সেই রকমে কাটবে, স্নান করানোটা তারি পৰ্ব্বলক্ষণ।

কুঁজোটা আমাকে কাটলে না, বরং দুটো ভালকথা বোলে মন ভিজিয়ে আবার অন্দরমহলে নিয়ে গেল। অমরের জননী সেই সংসারের লক্ষ্মীস্বরূপিণী, রাক্ষসের তাদশৃ দুর্ব্যবহার সহ্য কোরেও রন্ধন কোরে রেখেছিলেন, সকলের যথাসম্ভব আহার হলো, সেদিনের আহারে আমার একটুও তৃপ্তিবোধ হলো না, আতঙ্ক আমাকে হতাশ কোরে দিয়েছিল।

অপরাহ্ণে আবার আমাকে দুটী পাঁচটী মিষ্টকথা বলে, সাবধান কোরে, রক্তদন্তটা ঘর থেকে বেরুলো, চাবী দিয়ে রেখে গেল না, আমি খোলসা থাকলেম। সন্ধ্যাকালে অমরকুমারী বাড়ীর মাঝদরজা বন্ধ কোরে আমার কাছে এসে বোসলেন, গত রজনীর হাঙ্গামা শেষ কোরে অন্যকথা কিছুই উত্থাপন কোল্লেন না, আমিও আমার ভাগ্যের কোন কথাই উত্থাপন কোল্লেম না। অশোকবনে সীতাদেবীর যন্ত্রণার কথা রামায়ণে যেরূপ লেখা আছে, অমরকুমারী সেইভাবের গুটীকতক কথা বিরসবদনে আমার কাছে বোল্লেন।

ভাব বুঝতে পাল্লেম না। পূর্ব্বে কিছু সূচনা ছিল না, হঠাৎ কেন সে কথা মনে কোল্লেম, এটা হয় তো অভাগিনীর অন্তরের উচ্ছ্বাস। এই দুরন্ত লোকের সংসারে কন্যা-জননীর যেরূপে যন্ত্রণাভোগ হয়, বালিকা সেই সব যন্ত্রণা মনে কোরে রাখে। সীতাদেবীর যন্ত্রণার উদাহরণটী বোধ হয় সেই স্মৃতির উচ্ছাস।

রামায়ণের কথা উত্থাপন না কোরে সহসা আমি জিজ্ঞাসা কোল্লেম, “তোমার সেই দিদিটীর কি বিবাহ হয়েছিল?” কুমারী ম্লানবদনে উত্তর কোল্লেন, “বিবাহ হয় নাই। তখন তার বিবাহের সময়ও হয় নাই। দিনকতক এক একটা সম্বন্ধ এসেছিল, বাবা তাতে কিছুই মনোযোগ করেন নাই। দিদির নাম সমরকুমারী। নামটা খুব নূতন, ছোটবেলা থেকে দিদি বড় চঞ্চলা ছিল, মুখরা ছিল, গায়ে অনেক জোর ছিল, ছেলেবেলা ছোট ছোট মেয়েদের সঙ্গে খেলা করবার সময় প্রায়ই ঝগড়া কোত্তো; বাখারি, তীর-ধনুক নিয়ে যুদ্ধ কোত্তো; তার চেয়ে বড় বড় মেয়েদের কিল চড় মেরে মেরে ফেলে ফেলে দিতো; এক একজনকে কামড়ে কামড়ে রক্তপাত কোত্তো; মায়ের মুখে শুনেছি, সেই সব দেখে শুনে পাড়ার সম্পর্কের একজন ঠাকুরদাদা আমার দিদির নাম দিয়েছিলো সমরকুমারী। দুঃখের সময় একটা হাসির কথা মনে পোড়লো। একটী লোক তাঁর ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিবার জন্য দিদিকে দেখতে এসেছিল, সমরকুমারী নাম শুনে ভয় পেয়ে পালিয়ে গেল;—বলে গেল, বাবা! বাঙ্গালীর মেয়ের এমন নাম! ও বাবা? এ মেয়ে নিশ্চয়ই রাক্ষসী হবে! আমার ছেলেটী রোগা, টপ কোরে খেয়ে ফেলে দেবে।

আমার মুখে হাসি আসে না, কত দিন হাসি ছিল না, তব অমরকুমারীর ঐ কথাগুলো শুনে আমি হাস্য সম্বরণ কোত্তে পাল্লেম না; মৃদু মৃদু হাস্য কোল্লেম। অমরকুমারী আমার হাসি দেখে বড় খুসী হেলেন। মধুর স্বর সুমধুর কোরে প্রফুল্লবদনে ফুল্লমুখে বোল্লেন, “হরিদাস! তিন দিনের মধ্যে একবারও তোমার মুখে আমি হাসি দেখি নাই। আজ তোমারে হাসিয়েছি! বাঃ! তোমার মুখে হাসিটুকু বেশ মানায়!”

আমোদে আমি হাসি নাই, কৌতুকেও হাসি নাই, বালিকার কথার ভঙ্গীতে হাসি এসেছিল, সেই হাসির জন্য বালিকার মুখে আমি খোসনামী পেলেম;—খোসনামীতে আমি তুষ্ট থাকি না; দৈবাৎ যেখানে যে কেহ আমাকে বেশ ছোকরা বোলে তারিফ কোরেছে, সেইখানেই আমি অন্যমনস্ক হয়েছি। অমরকুমারীর খোসনামীতেও তাদৃশ মনঃসংযোগ কোল্লেম না। তখন আমি মনে মনে আর একটা কথা ভাবছিলেম; কেমন একটা কৌতুহলের উদয় হয়ে ছিল, খানিকক্ষণ চুপ কোরে থেকে, সমসূত্রে কুমারীর মুখপানে চেয়ে, মৃদুস্বরে জিজ্ঞাসা কোল্লেম, “অমর! তোমার বিবাহ হয়েছে?”

মেঘের কোলে চপলা একবারমাত্র খেলা কোরেই অমনি মেঘ-সাগরে ডুবে গেল। নম্রমুখখানি অবনত কোরে দীর্ঘ দীর্ঘ নেত্রপল্লবে পদ্মমুখী তখনি তখনি দুটী পদ্মনেত্র ঢাকা দিয়ে ফেল্লেন; সুন্দর কপোলযুগল আরক্তবর্ণ ধারণ কোলে; একটু পূর্ব্বে যে মুখে কত কথাই শ্রবণ কোচ্ছিলেম, সে মুখে আর তখন একটী বাক্যও নিঃসত হলো না; লজ্জাবনতমুখী বালিকা ধীরে ধীরে উঠে সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

কথায় কথায় আমরা অন্যমনস্ক ছিলেম, সূর্য্যদেব অস্ত গিয়েছিলেন, অন্ধকার হয়েছিল, জানতে পারি নাই। গৃহিণীঠাকুরাণী সেই ঘরে একটী প্রদীপ জেলে দিয়ে গেলেন, যাবার সময় এদিক ওদিক চেয়ে জিজ্ঞাসা কোল্লেন, “অমর কোথায়?”—তাঁর মুখের দিকে চেয়ে আমি উত্তর কোল্লেম, “ছিলেন এইখানে, এইমাত্র উঠে গেছেন।”

গৃহিণী রন্ধনগৃহে প্রবেশ কোল্লেন। আমি একাকী যথাস্থানেই বোসে থাকলেম। অনেকক্ষণ অমরকুমারী দেখা দিলেন না। বাড়ী থেকে তিনি কোথাও যান না, বাড়ীতেই আছেন, সেইটী স্থির জেনে জননী উদ্বিগ্ন হোলেন না। বৈকালে বাড়ীর মাঝ-দরজা বন্ধ হয়েছিল, সে দরজা তখন খোলা; তাই দেখে, আমি মনে কোল্লেম, অমরকুমারী সদরবাড়ীতেই গিয়েছেন। একাকী বোসে থাকলেম, একাকী থাকলে চিন্তা-তপ্ত অন্তরে নানা চিন্তার উদয় হয়, নানা চিন্তায় আমার চিত্ত ক্ষণে ক্ষণে অস্থির হোতে লাগলো, আমি যেন তখন চিন্তা-সাগরে ডুবে রইলেম।

অমরকুমারী সদরমহলেই গিয়েছিলেন, গবাক্ষ দিয়ে দেখলেম, ফিরে এসে রন্ধনগৃহে জননীর কাছে গেলেন। কতক্ষণ তাঁরা সেইখানে ছিলেন, তার পর রন্ধনকার্য্য সমাপ্ত কোরে, দুজনেই একসঙ্গে শয়নগৃহে প্রবেশ কোল্লেন; সে রাত্রে জননীর কিছু বেশী অসুখ বোধ হয়েছিল, অসুখেও তাঁরে সংসারের সমস্ত কাজ-কর্ম্ম কোত্তে হয়, কাজগুলি একরকম সারা হয়েছিল, ঘরে এসে তিনি শয়ন কোল্লেন। মেয়েটা খানিকক্ষণ তাঁর কাছে বোসে থাকলেন, তার পর বাইরে এলেন; এসেই আবার সদরবাড়ীর দিকে চোলে গেলেন। রাত্রি অনুমান এক প্রহর।

কত কি যে আমি ভাবছি, স্থিরতা রাখতে পাচ্ছি না। চিন্তার সাগর, সে সাগরে আমি থই পাচ্ছি না। একবার মনে হোচ্ছে, এখানে যেন কোন প্রকার বিপদ ঘোটবে, সে বিপদ থেকে নিস্তার পাবার উপায় কি হবে? একবার মনে কোচ্ছি, সত্যই কি রক্তদন্ত আমার মামা? সত্য সত্যই কি অমরকুমারী রক্তদন্তের কন্যা? মীমাংসা কোত্তে বড়ই সন্দেহ উপস্থিত হয়; যতই মনে করা যায়, ততই সন্দেহ বাড়ে। রক্তদন্ত এখানে কেন আমাকে এনেছে? ভাল মতলবে কখনই না; তবে তার মতলব কি? একবার দুটো ভালকথা কয়, একবার বিষবর্ষণ করে, একবার কপটমায়ায় বিড়াল সাজে, একবার ব্যাঘ্ৰমূর্ত্তি পরিগ্রহ করে! লোকটী বড়ই ভয়ঙ্কর! বিকট চেহারাটাই তার উজ্জল প্রমাণ। এই লোকের হাতে আমার যে কি দশা হবে, ভাগ্যে আমার যে কি ফল ফোলবে, কিছুই তো স্থির কোত্তে পাচ্ছি না। তার মেয়ের কাছে আমি বর্দ্ধমানের ডাকাতীর গল্প কোচ্ছিলেম, গোপনে দাঁড়িয়ে সেই কথা শুনে আমাদের উভয়কে যেন খেতে এসেছিল! আজ দুই একটা ভালকথা বোলে বেরিয়ে গেছে, আমাকে চাবী দিয়ে রেখে যায় নাই, একটু সদয়, কিন্তু দুর্জ্জনের প্রসন্নতা, দুর্জ্জনের সদয় ব্যবহার বিষাক্ত ঘৃত দুগ্ধের মত অধিকতর ভয়!

নানা কথা ভাবছি, রাত্রিও ক্রমশঃ বাড়ছে, ঘর থেকে বেরিয়ে একবার বারান্দায় এলেম, জ্যোৎস্না-রজনী; ফুট জ্যোৎস্না। আকাশে শুক্লপক্ষের দ্বাদশকলা চন্দ্রমার সমুদ্রহাস্য; পৃথিবীও হাস্যমুখী। এ শোভা দেখলে স্বভাবতই মানুষের মনে আনন্দ জন্মে, আমার মনে আনন্দ এলো না; প্রকৃতির শোভা সন্দর্শনে কি যেন এক প্রকার আতঙ্কে আমি কেপে উঠলেম। কি অমঙ্গল?-বারান্দায় আর দাঁড়ালেম না, আবার সেই নির্জ্জন ঘরের মধ্যে প্রবেশ কোল্লেম। কি জানি, কিরূপে ঘরের প্রদীপটী তখন নিবে গিয়েছিল; অন্ধকারে আমি বেসে থাকলেম। সহচর আতঙ্ক, সহচরী চিন্তা। অমরকুমারী এলেন না।