ভূবনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়
হরিদাসের গুপ্তকথাপ্রথম খণ্ড
ত্রয়োদশ কল্প : নারীবেশ
ঘরের ভিতর অন্ধকারে আমি বোসে আছি, অন্যঘরে অমরের জননী শুয়ে আছেন। জাগরিতা কি নিদ্রিতা, জানি না, রাত্রি এক প্রহর অতীত হয়ে গেছে, কোন দিকে আর কোন সাড়াশব্দ পাচ্ছি না, জ্যোৎস্না রাত্রে ঝিঁঝিঁ পোকার আওয়াজ কিছু কম শুনা যায়, সেই দিকে মন রাখলে বেশীও শুনা যায়, আমি কেবল ঝিল্লীরব শ্রবণ কোচ্ছি; অমরকুমারী এলেন না। কোথায় অমরকুমারী? বিবাহের কথায় লজ্জাতে লজ্জাবতী বাইরে গিয়েছিলেন, আবার ফিরে এসেছিলেন, আমার কাছে আসেন নাই, জননীর কাছে এসেছিলেন, আবার সদরবাড়ীতে গিয়েছেন দেখেছি, ফিরে আসতে দেখি নাই। গেলেন কোথায়? —সদরবাড়ীতেই আছেন। সেখানে কেহ নাই, বালিকা একাকিনী সেখানে কি কচ্ছেন? ইচ্ছা হলো, একবার দেখে আসি।
উঠি উঠি মনে কোচ্ছি, অকস্মাৎ ঘরের-বাহিরে চৌকাঠের ধারে কাহার পদশব্দ; কে যেন অতি সাবধানে টিপে টিপে আমার দিকে আসছে; কে আসছে? নিশ্বাস বন্ধ কোরে স্থির হয়ে আমি শুনলেম। পা টিপে টিপে কে যেন আমার কাছে এলো; অন্ধকারে আন্দাজে আন্দাজে আমার কাছে এসে বোসলো; অতি মৃদস্বরে আমার কাণের কাছে তাড়াতাড়ি বোল্লে, “চুপ! চুপ! চুপ! আমি অমরকুমারী। মহাবিপদ! বাবু এসেছেন; সঙ্গে দুটো লোক এনেছেন; পরামর্শ হোচ্ছে! সাঙ্ঘাতিক পরামর্শ! বাইরের ঘরের পশ্চিমদিকের লাগাও একটা ছোটঘর, সে ঘরটা তুমি দেখ নাই, ছেলেবেলা আমরা সেই ঘরে খেলা কোত্তেম, এখন আর সে ঘরে বড় একটা কেউ যায় না, বর্ষাকালে কাঠ-ঘুটে থাকে; আমি একাকিনী এত রাত্রে সদরবাড়ীতে আছি, বাবা দেখলেই রেগে উঠবেন, সেই ভয়ে সদরদরজার কাছে তাঁকে দেখেই সেই ছোটঘরে আমি লুকিয়েছিলেম, বাড়ীর ভিতর আসতে পারি নাই, চাঁদের আলোতে দেখতে পেতেন, সেই ভয়েই আসি নাই, সেইখানেই লুকিয়ে ছিলেম; লুকিয়ে লুকিয়ে তাঁদের সেই ভয়ানক পরামর্শ আমি শুনেছি। রাত দুপুরের সময় তুমি যখন ঘুমিয়ে থাকবে, বাবার লোকেরা সেই সময় তোমারে হাত-পা বেঁধে ধোরে নিয়ে যাবে, কোথাকার একটা নীলকুঠীতে চালান কোরে দিবে। তা যদি না পারে, তবে হয় তো কেটে ফেলবে!”
শুনে আমার আত্মাপুরুষ কেঁপে উঠলো। শুষ্ক-কম্পিত-মৃদুকণ্ঠে আমি বোলে উঠলেম, “তবে উপায়? এইখানে এইরুপ ডাকাতের হাতে বিঘোরে আমার প্রাণ যাবে, এই কি বিধাতার মনে ছিল? প্রাণে আমার সুখ নাই, এ কথা সত্য, কিন্তু বিঘোরে অপঘাতে প্রাণ হারাব, এ কথাটা ভেবে তো আমি যেন জগৎ অন্ধকার দেখছি!”
পূৰ্ব্বাপেক্ষা আরো মৃদুস্বরে আশ্বাস দিয়ে আমার হিতৈষিণী ভগ্নী অভয়বচনে বোল্লেন, “ভয় নাই। আমি রক্ষা কোরবো! এখনো সময় আছে। তুমি এক কাজ কর। আমার একখানি শাড়ী পর, দুগাছি পিতলের বালা দিচ্ছি, হাতে দাও, মেয়েমানুষ হও; শীঘ্র!—শীঘ্র! রান্নাঘরের পাশেই খিড়কীদরজা; সে দরজা খোলা আছে, যেখানে তারা বোসে পরামর্শ কোচ্ছে, সেখান থেকে আমাদের রান্নাঘরখানি বেশ দেখা যায়, চাঁদের আলো, উঠানে নামলেই তারা দেখতে পাবে; পুরুষবেশে বাহির হোলে তুমি পালাতে পারবে না, ছুটে এসে তারা ধোরে ফেলবে! মেয়েমানুষ সেজে পালাও! ভগবান যদি দিন দেন, আবার দেখা হবে; তুমি আমারে ভুলে থেকো না, আমিও তোমাকে ভুলে যাব না; ভগবান তোমার মঙ্গল করুন; তুমি পালাও! শীঘ্র! শীঘ্র! —আর বিলম্ব কোরো না; বিলম্বেই বিপদ সম্ভাবনা?”
প্রাণের মায়া বড় মায়া। প্রাণের মায়ায় আমি সেইখানেই নারীবেশ ধারণ কোল্লেম, দয়াময়ী স্নেহকুমারী একখণ্ড ছিন্নবস্ত্রে আমার মস্তক বেষ্টন কোরে ঠিক যেন একটী কবরী প্রস্তুত কোল্লেন, সেই কৃত্রিম কবরীর উপর একটু, ঘোমটা টেনে দিয়ে আস্তে আস্তে আমি উঠানে নামলেম। কুমারী চুপি চুপি আমার হাতে একটী টাকা দিলেন, কিছুতেই আমি গ্রহণ কোরবো না, দয়াবতী সে কথা শুনলেন না, “রাহাখরচ কোরো” বলে দিব্য দিয়ে গছিয়ে দিলেন, আবার পরমেশ্বরের নাম কোরে মঙ্গলকামনা কোল্লেন। আমি ধীরে ধীরে খিড়কীর দিকে চোল্লেম; আড়ে আড়ে চেয়ে দেখলেম, সদরের ঘরের রোয়াকে তিনজন লোক। নারীবেশে আমিই যেন তখন অমরকুমারী, লোকেরা যদি দেখে থাকে, নিশ্চয়ই আমাকে অমরকুমারী মনে কোরেছে, নতুবা সন্দেহ কোরে ছুটে আসতো, এলো না, আমি মনে মনে নিরাপদ ভাবলেম; তবু আমার বুক কাঁপলো; পরমেশ্বরকে ধন্যবাদ দিয়ে, দয়াময়ী বালিকাটীকে আশীৰ্ব্বাদ দিয়ে, খিড়কীদরজা পার হয়ে আমি রাস্তায় পোড়লেম! এতক্ষণ প্রায় নিশ্বাস বন্ধ ছিল, রাস্তায় এসে নিশ্বাস ফেল্লেম।
দু-দিকে দুটো রাস্তা। বামদিকের রাস্তা ধোল্লে রক্তদন্তের বাড়ীর সম্মুখ দিয়েই ঘুরে যেতে হয়, সে দিকে না গিয়ে দক্ষিণের রাস্তা দিয়েই দৌড়!—ভোঁ দৌড়! রাত্রি অন্ধকার হোলে অজানা পথে ছুটে যেতে পাত্তেম না, নিকটেই ধরা পোড়তেম, ভগবান সুধাকরের কৃপায় অনেক দূরে ছুটে গেলেম; ধোত্তে আসছে কি না, কেহ পিছ নিয়েছে কি না, সতর্ক হয়ে এক একবার পশ্চাদ্দিকে চেয়ে দেখি আর প্রাণপণে ছুট দিই!
এই ভাবে ছুটে ছুটে প্রায় আধ ক্রোশ পথ গিয়েছি, সম্মুখে দেখি, রাস্তার মাঝখানে একখানা গাড়ী। কাদের গাড়ী, কিসের গাড়ী, মানুষ নাই, এত রাত্রে পথের মাঝখানে খালিগাড়ী কেন দাঁড়িয়ে আছে, মনে মনে এইরূপ ভাবছি, এমন সময় দু-দিক থেকে দুজন লোক ছুটে এসে আমার মুখে চোকে কাপড় বেঁধে সেই গাড়ীখানার ভিতর তুলে দিলে; তারাও গাড়ীর ভিতর উঠে বোসলো। একজন আমার সম্মুখে, একজন আমার পাশে। প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড ঘোড়ারা গাড়ীখানা নিয়ে নক্ষত্ৰবেগে দক্ষিণদিকে ছুটে চোল্লো। লোকেরা তখন আমার মুখের বাঁধন-চক্ষের ঢাকন খুলে দিলে। যে লোকটা সম্মুখে বোসেছিল, তার হাতে একখানা ছোটরকম তলোয়ার; আমার মুখের কাছে সেই তলোয়ারখানা নাচিয়ে নাচিয়ে লোকটা বলতে লাগলো, “খবরদার! চুপ কোরে থাক! যদি কথা কবি, যদি চেঁচাবি, এখনি দুটুকরো কোরে কেটে ফেলবো!”
আমি আড়ষ্ট! বাকশক্তি তখন যেন আমাকে পরিত্যাগ কোরে গেল। লোক আমাকে ভয় দেখিয়ে কথা কইতে নিষেধ কোল্লে, নিষেধ না কোল্লেও সে সময় আমার রসনা থেকে একটী কথাও নির্গত হতো না। ভাবতে লাগলেম, কে এরা? কোথায়ই বা নিয়ে চোল্লো? কেনই বা মুখ-চোক বেঁধেছিল, কেনই বা খুলে দিলো? প্রাণের ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে কতই যে ভাবলেম, এখন আর যে সব কথা মনে পড়ে না। রাত্রিকালে পথে আমাকে ধেরেছে; কেন ধরেছে? পরুষমানুষ রেতের বেলায় মেয়েমানুষ সেজে রাস্তায় বেরলে এখানকার লোকেরা বুঝি এম্নি কোরে ধরে। ধোরে নিয়ে কি করে? ভেবে চিন্তে কিছুই স্থির কোত্তে পাল্লেম না। লোকেরা গাড়ীর দরজা-খড়খড়ি বন্ধ কোরে দিয়েছিল, কোন দিকে যাচ্ছি, গাড়ীখানা কোন পথ দিয়ে চোলেছে, তাও কিছু স্থির কোত্তে পাল্লেম না। দরজা খোলা থাকলেই বা আমি ঠিক কি কোত্তেম? এ সব জায়গায় কখনো আসি নাই, পথ-ঘাট কিছুই জানি না, জ্যোৎস্নারাত্রেও আমার চক্ষে সমস্ত অন্ধকার বোধ হতো। কে এরা? কোথাকার লোক? আমাকে প্রাণে মারবার জন্য দুরাত্মা রক্তদন্ত যাদের ভাড়া কোরে এনেছিল, এরাই কি তারা? না, তারা নয়। আমি যখন অমরকুমারীর পরামর্শে উঠান পার হয়ে খিড়কীর দিকে আসি, তখন একবার সদরের দিকে চেয়ে দেখেছিলেম, তিনজন লোক। একজন রক্তদন্ত, আর দু-জন নূতন। সেই দুজনের মধ্যে জ্যোৎস্নার আলোতে একজনকে আমি একটু একটু চিনতে পেরেছিলেম; ঘনশ্যাম বিশ্বাস। যে লোকটা আমাকে গুরুপত্নীর উপদেশে কারখানাবাড়ীতে ধোরে এনেছিল, ভিকারী সেজে যে লোকটা আমাকে বর্দ্ধমানে নিয়ে গিয়েছিল, বিধাতার অনুগ্রহে যার হাত থেকে আমি অভাবনীয় উপায়ে রক্ষা পেয়েছিলেম, সেই লোকটা—সেই দালাল, মহাজন, ভিকারী ঘনশ্যাম বিশ্বাস। এখন যারা আমাকে ধোরেছে, এদের ভিতর সে লোক নাই। তবে এরা কে? কোথাকার লোক?
গাড়ীর গতি অত্যন্ত দ্রুত; কিন্তু আমার ভাবনার স্রোত যত দ্রুত প্রবাহিত, গাড়ীর গতি তত দ্রুত নয়; হওয়াটা সম্ভবও নয়। কত দূর গেলেম। এক জায়গায় লোকেরা আমাকে গাড়ী থেকে নামতে বোল্লে, আমি নামলেম, তারাও নামলো। চন্দ্র তখন মধ্যগগন পার হয়ে পশ্চিমে খানিক দূর ঢোলেছিলেন, তখনও বেশ জ্যোৎস্না ছিল; দেখলেম, সম্মুখে একটা নদী; নদীর ধারে নৌকা ছিল, লোকেরা সেই নৌকাতে আমাকে তুল্লে; গাড়ীখানা সেই খান থেকে ফিরে গেল। নৌকাযোগে নদীপার হয়ে আমরাও পারে উঠলেম। একজন আমাকে চৌকী দিতে লাগলো, আর একজন কোথায় চোলে গেল। খানিক পরে আর একখানা গাড়ী আনলে, সেই গাড়ীতে উঠে আমরা প্রায় দুই ক্রোশ পথ অতিক্রম কোল্লেম।
গাড়ীখানা যেখানে থামলো, তার বামদিকে একখানা দোতালা বাড়ী। সম্মুখে ফটক। ফটকে আলো ছিল না, আকাশেও চন্দ্র ছিল না, শুক্লদ্বাদশীর চন্দ্র, সমস্ত রাত্রি বিহার করেন না, রজনীকে একাকিনী রেখে রজনীকান্ত তখন অস্তাচলে চোলে গিয়েছিলেন, অন্ধকার হয়েছিল, লোকেরা আমাকে সেই অন্ধকারে বাড়ীর ভিতর নিয়ে গেল। সদরবাড়ী। একটা ঘরে আলো ছিল, লোকেরা সেই ঘরে আমাকে টেনে তুল্লে। ঘরে একটী বৃদ্ধলোক বোসে ছিলেন, তাঁর প্রকৃতি গম্ভীর, মাথায় শ্বেতবর্ণ ছোট ছোট চুল, শ্বেতবর্ণ গোঁফ, গলায় তুলসীর মালা, বাহুতে একখানা অর্দ্ধচন্দ্রাকার স্বর্ণকবচ। আমাকে দেখেই সেই বৃদ্ধটী চোমকে উঠলেন; যারা আমাকে নিয়ে গিয়েছিল, চমকিতস্বরে তাদের জিজ্ঞাসা কোল্লেন, “কে এ?”—–লোকেরা অবাক।
বৃদ্ধ তখন আমাকেই জিজ্ঞাসা কোল্লেন, “কে তুমি?”—কিছুমাত্র চিন্তা কোরেই আমি উত্তর কোল্লেম, “আমি হরিদাস।”
আমার আপাদমস্তক নিরীক্ষণ কোরে, বিস্ময়ে কিয়ৎক্ষণ নিস্তব্ধ থেকে, বৃদ্ধ পুনরায় আমাকে জিজ্ঞাসা কোল্লেন, “এ রকম বেশ কেন তোমার?”
কি উত্তর করি? সত্যকথা যদি বলি, নানা সন্দেহের কারণ উপস্থিত হবে, ঘটনাসূত্রে লোকের মুখে মুখে রক্তদন্তও হয় তো শুনতে পাবে, বিপদ আরো বেড়ে উঠবে। এক বিপদ থেকে রক্ষা পাবার আশায় নারীবেশে পথে বেরিয়েছিলেম, বেরিয়েই নূতন বিপদে পোড়েছি, তার উপর যদি আরো গোলযোগ হয়, তা হোলে আর রক্ষা পাবার কোন উপায়ই থাকবে না। ভরসা ভগবান; ভগবানের কৃপায় সেই সময় আমার একটা উপস্থিতবুদ্ধি যোগালো। একটা মিথ্যাকথা বোল্লেম। সপ্তগ্রামে পাঠদ্দশায় গুরুদেবের মুখে শুনেছিলেম, এমন এক একটা বিপদ ঘটে, মিথ্যাবাক্য প্রয়োগ না কোল্লে সে বিপদ থেকে উদ্ধার হবার উপায় থাকে না; তাদৃশ স্থলে মিথ্যাকথায় দোষ হয় না, শাস্ত্রেও এরূপ বিধান আছে। সেই কথাটীও তখন আমার স্মরণ হলো, ভেবে চিন্তে কাজে কাজে একটা মিথ্যাকথা বোল্লেম।
বৃদ্ধের প্রশ্নের উত্তর দিলেম, “আমি বিদেশী বালক, নিরুপায়, নিরাশ্রয়, যাত্রার দলের একজন অধিকারী আমাকে আমার অনিচ্ছায় আপনাদের দলে ভর্তি কোরেছিল। আজ রাত্রে এক বাড়ীতে যাত্রা হয়, অধিকারী আমাকে সখী সাজিয়েছিল; তাদের দলে ভাল ভাল সাজপোষাক নাই, সেই কারণেই আমার এই রকম বেশ। যারা আমাকে এখানে ধোরে এনেছেন, তাঁরা যেখানে আমাকে দেখতে পান, তার আধ ক্রোশ তফাতে যাত্রা। যাত্রা করা আমার ইচ্ছা নয়, অভ্যাসও নয়; অতএব দলের ভিতর থেকে বেরিয়ে চুপি চুপি আমি পালিয়ে আসছিলেম, খুব ছুটে ছুটে আসছিলেম, আসতে আসতেই পথের মাঝখানে ধরা পোড়েছি।”
এই পর্য্যন্ত বোলেই আমি চুপ কোল্লেম। বৃদ্ধটী হেসে উঠলেন, যারা আমাকে ধোরেছিল তারাও অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে হাসতে লাগলো। একটু পরেই পূর্ব্ববৎ গম্ভীরভাব। বৃদ্ধ আমাকে বোল্লেন, “কিছু মনে কোরো না তুমি, ভুলে তোমাকে ধরা হয়েছে, বৃথা বৃথা কষ্ট পেয়েছো, আচ্ছা থাকো,—রাত্রিও আর বেশী নাই, এই ঘরেই তুমি থাকো; যেখানে যেতে চাও, কাল সকালবেলা বিদায় কোরে দিব।”
কথার ভাবে বুঝলেম, তিনিই সেই বাটীর কৰ্ত্তা। একজন চাকরকে ডেকে কৰ্ত্তা আমাকে একখানি কাপড় আনিয়ে দিলেন, সখীবেশ পরিত্যাগ কোরে আমি আবার হরিদাস হোলেম; কাপড় ছেড়ে, হাত-পা ধুয়ে ঠাণ্ডা হয়ে বোসলেম; ভয়টা ঘুচে গেল। বড়মানুষের বাড়ী, খাদ্যসামগ্রীর অভাব ছিল না, কৰ্ত্তার হুকুমে বাড়ীর ভিতর থেকে আমার জলখাবার এলো, পরিতোষে জলযোগ কোরে কর্ত্তার সঙ্গে নানা রকম কথা কইতে লাগলেম। আমার কথাবার্ত্তা শুনে কৰ্ত্তা তুষ্ট হোলেন। তার পর সেই ঘরে আমার শয়নের ব্যবস্থা কোরে দিয়ে কৰ্ত্তা বাড়ীর ভিতর উঠে গেলেন, নির্দ্দিষ্ট সুখশয্যায় আমি শয়ন কোল্লেম।
যে ঘরে আমি, তারি পাশের ঘরে চাকরেরা থাকে। কৰ্ত্তা উঠে যাবার আধ ঘণ্টা পরে সেই ঘরে একটা হাসির গর্রা উঠলো। একজন বোল্লে, “সাবাস বাবা সাবাস! কি ধোত্তে কি ধোরেছে! ধোত্তে গেল মেয়েমানুষ, ধোরে আনলে হরিদাস! কানাইবাবু ভারী তুখোড়লোক! ধরেন মাছ, না ছোঁন পানী! এই বাড়ীতে মানুষ হয়ে মামার মেয়েটীকে বেমালুম সোরিয়ে দিয়েছেন, রকমারি আখড়ায় মজা করা হবে, এই মতলব! আর কি তাকে পাওয়া যায়! ধরবার জন্য চারিদিকে লোক ছুটেছে, কেহই ধোত্তে পারবে না; এরা তবু যা হোক একটা ধোরে এনেছিল, হয়ে গেল হরিদাস! এরা ভদ্রলোক, এদের ঘরে এই কাণ্ড! আমরা ছোটলোক, আমাদের ঘরে এমন কাণ্ড হয় না!”
পাঁচজনে মিলে আবার হেসে উঠলো। আমি তখন একটু একটু বুঝতে পাল্লেম, ব্যাপারখানা কি। বাড়ীতে একজন কানাইবাবু আছেন, কর্ত্তাবাবুর ভাগ্নে তিনি, কর্ত্তার একটী মেয়েকে কুপথগামিনী করা তাঁর কার্য্য, অন্যলোকের দ্বারা সোরিয়ে ফেলেছেন, নিজে খাঁটি হবার চেষ্টা পাচ্ছেন, নিজেও খুঁজতে বেরিয়েছেন। যাঁদের হাতে আমি পোড়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে কানাইবাবু ছিলেন কি না, জানতে পাল্লেম না, কিন্তু বড় ঘৃণা হলো। যারা আমাকে ধোরেছিল, তারা কোন ঘরে শুতে গেল, তাও আমি জানি না। রাত্রি শেষ, নানা ভাবনায় একবারও আমি চক্ষের পাতা বুজতে পাল্লেম না, দুরে দুরে রামপাখী ডেকে উঠলো, গাছে গাছে গায়ক পক্ষীরা গান আরম্ভ কোল্লে, বনে বনে দলে দলে শেয়াল ডাকলো, কাকেরা কা কা রবে বাসা ছেড়ে উড়ে যেতে লাগলো, বুঝতে পাল্লেম, উষাকাল। একটু পরেই প্রভাত। একটী যুবাপুরুষকে সঙ্গে কোরে কর্ত্তাবাবু বৈঠকখানায় এলেন। আমি তখন বিছানার উপর উঠে বোসেছি, কিছুই যেন জানি না, সেইভাবে এদিক ওদিক চেয়ে দেখছি, কৰ্ত্তা এসেই প্রসন্নবদনে আমাকে জিজ্ঞাসা কোল্লেন, “কি হরিদাস! উঠেছ? রাত্রে কোন কষ্ট হয় নাই তো?”
নম্রস্বরে আমি উত্তর কোল্লেম, “আজ্ঞে না, কোন কষ্ট হয় নাই, বেশ আরামেই ছিলেম; এমন সুন্দর বিছানা আমার ভাগ্যে জুটে না।”
কর্ত্তা একটু হেসে, যুবাটীর মুখের দিকে চেয়ে, আমার দিকে ফিরে একটু স্নেহ জানিয়ে বল্লেন, “রাত্রে কিছুই আহার হয় নাই, কষ্ট হয়েছে, এইখানে আহারাদি কোরে যেখানে যেতে চাও. সেইখানেই—”
আর আমি বোলতে দিলেম না; শীঘ্র শীঘ্র বাধা দিয়ে শানুনয়ে বোল্লেম, “আজ্ঞে না, আহারের জন্য এখানে আর আমি বিলম্ব কোরবো না, এ অঞ্চলে থাকতে আমার ভয়; এখনি আমি যাবো।”
কৰ্ত্তা জিজ্ঞাসা কোল্লেন, “কোথায় তুমি যাবে?”—সাত পাঁচ ভেবে আমি উত্তর কোল্লেম, “কোথায় যাব, ঠিক নাই; যাবার জায়গা আমার কোথাও নাই; আমি বড় গরিব; আমার আপনার লোক কেহই নাই, থাকবার স্থানও কোথাও নাই; যেখানে আশ্রয় পাব, যেখানে একটী চাকরী পাব, যেখানে দশজনের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় হবে, ভবিষ্যতে ভাল হবার আশা থাকবে, সেই রকম জায়গাই আমি অন্বেষণ কোচ্ছি।”
একটু চিন্তা কোরে কর্ত্তা বল্লেন, “সে রকম জায়গা পাড়াগাঁয়ে বড় কম; সহরেই সবরকম সুবিধা; আচ্ছা, বেশ কথা; সেই রকম জায়গাতেই তোমাকে আমি পাঠাব। আমার একটী ভাইপো আজ কলিকাতায় যাবেন, তারি সঙ্গে তুমি যাও, দেখে শুনে তিনি তোমার একটা বিলি-ব্যবস্থা কোরে দিবেন। সেই কথাই ভাল। থাকো, আহারাদি কর, আমরা ব্রাহ্মণ, ব্রাহ্মণের বাড়ীতে সকলেই আহার কোত্তে পারে, এখানে আহার কোত্তে তোমার কোন বাধা নাই।”
আর আমি আপত্তি কোত্তে পাল্লেম না, অস্বীকার করাও শিষ্টাচারবিরুদ্ধ; বিশেষতঃ কলিকাতায় যাবার সুবিধা হোচ্ছে; কলিকাতার নাম আমি শুনেছি, অনেক দিন অবধি কলিকাতা-দর্শনের ইচ্ছা রয়েছে, সুবিধা ঘটে নাই। পুস্তকে পাঠ কোরেছি, কলিকাতা সহর ভারতবর্ষের রাজধানী, সেখানে লক্ষ লক্ষ লোকের অন্ন হয়, লক্ষ লক্ষ লোকে কাজকর্ম্ম পায়, কেহই বেকার থাকে না; সেখানে অনেক রকম কারবার চলে, অনেক রকম চাকরী মেলে, অনেক দেশের লোক কলিকাতায় গিয়ে সুখে থাকে, আমি কলিকাতায় যাব। একজন ভদ্রলোক আমাকে সঙ্গে কোরে নিয়ে যাবেন, এটা আরও বিশেষ সুবিধা। কলিকাতা অনেক দূর; চিনে চিনে ততদূর হেঁটে যাওয়া আমার অসাধ্য; যানবাহনেরও খরচা নাই; অমরকুমারীর দত্ত একটী টাকামাত্র আমার সম্বল; অসুবিধা অনেক; এই সকল বিবেচনা কোরে কৰ্ত্তার প্রস্তাবেই আমি সম্মত হোলেম।
কৰ্ত্তার নাম বাণেশ্বর চট্টোপাধ্যায়, তাঁর ভ্রাতুষ্পত্রের নাম নরহরি চট্টোপাধ্যায়। বাণেশ্বরবাবু একজন জমীদার। তাঁর জমীদারীতে নায়েবগোমস্তা অনেক আছে, কিন্তু ঐ নরহরিবাবুই সময়ে সময়ে সমস্ত জমীদারী পর্য্যবেক্ষণ করেন, মামলা-মোকদ্দমার তদ্বিরাদি করেন, তাঁর উপরেই সকল ভার। সম্প্রতি আলীপুরের দেওয়ানী আদালতে কি একটা বৃহৎ মোকন্দমা রজৃ আছে, সেই মোকদ্দমার তদ্বির করবার জন্যই নরহরিবাবু কলিকাতায় যাবেন, এইরূপ বন্দোবস্তই আমি জানতে পাল্লেম।
বেলা এক প্রহরের পর আমরা আহার কোল্লেম। আহারান্তেই যাত্রা। কৰ্ত্তা আমার জন্য একজোড়া ধুতি-চাদর আর দুটী জামা আনিয়ে দিলেন, আর কি কি ব্যবস্থা কোত্তে হবে, ভ্রাতুষ্পত্রকে চুপি চুপি সে সব কথা বোলে দিলেন। নূতন কাপড় পোরে, নূতন জামা গায়ে দিয়ে, সেইখানে আমি এক রকম বাবু সাজলেম। অনন্তর কর্ত্তাকে প্রণাম কোরে নরহরিবাবুর সঙ্গে বাড়ী থেকে আমি বেরুলেম। ঘরের গাড়ী প্রস্তুত ছিল, সেই গাড়ীতে আরোহণ কোরে আমরা যাত্রা কোল্লেম; সঙ্গে একজন চাকর থাকলো। গাড়ীখানা সরাসরী উত্তরমুখে চোল্লো।
লোকেরা রাত্রিকালে যখন আমাকে ঐ বাড়ীতে নিয়ে যায়, পথে তখন একটা নদী পার হোতে হয়েছিল, এবারে নদী দেখা গেল না, খানিক দূর কেবল একটা বালীর চড়ার উপর দিয়ে গাড়ী এলো। চড়া পার হয়ে নরহরিবাবুকে আমি জিজ্ঞাসা কোল্লেম, “রাত্রে এ পথে গাড়ী আসে নাই, নদী ছিল, এটা কি তবে সে পথ নয়?”
বাবু উত্তর কোল্লেন, “সেই পথ। নদী আমরা পার হয়েছি। আশ্চর্য্য নদী। সৰ্ব্বদা জল থাকে না, অল্প অল্প বৃষ্টি হোলে কিম্বা আকাশে মেঘ দেখা দিলে নদীতে জল হয়, অতি বেগে স্রোত বয়, অন্য সময়ে কেবল বালী ধূ ধূ করে। কল্য দিবাভাগে মেঘ ছিল, এদিকে বৃষ্টিও হয়েছিল, সেইজন্য গাড়ী চলে নাই।”—জিজ্ঞাসা কোরে জানলেম, সেই নদীর নাম ময়ুরাক্ষী নদী। পূর্ব্বে বোলেছি, বীরভূমের প্রধান সহর সিউড়ী। গাড়ীখানা সিউড়ীতে একবার থামলো, সেইখানে ঘোড়া বদল কোরে আবার আমরা সদর-রাস্তায় যেতে লাগলেম। এখানকার রাস্তাগুলি বড় সুন্দর; মিউনিসিপালিটীর সাহায্য ব্যতিরেকে বালী-কাঁকরে নির্ম্মিত; বর্ষাকালেও কাদা হয় না, সৰ্ব্বদা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকে। আমাদের গাড়ী সেই পথে বরাবর একটা জায়গায় এসে থামলো; সেই জায়গার নাম সাঁইথিয়া। যে সময়ের কথা আমি বোলছি, সে সময় এদেশে রেল পথ হয় নাই, এখন সাঁইথিয়াতে ইষ্টইণ্ডিয়া-রেলওয়ে কোম্পানীর একটী ষ্টেশন হয়েছে।
সাঁইথিয়া থেকে ঘরের গাড়ীখানি বিদায় হয়ে গেল, আমরা একখানা ভাড়াটিয়া গাড়ীতে আরোহণ কোরে কলিকাতার দিকে আসতে লাগলেম। কোথাও ঘোড়ার গাড়ী, কোথাও গরুর গাড়ী, কোথাও নৌকা, এইরূপ বিবিধ যানে, মাঝে মাঝে বিশ্রাম কোরে, তিন দিনে আমরা কলিকাতায় পৌঁছিলেম।