ভূবনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়
হরিদাসের গুপ্তকথাপ্রথম খণ্ড
চতুর্দ্দশ কল্প : রাজধানী
গঙ্গার পূর্ব্বতীরে কলিকাতা সহর। এই সহরটী এখন ভারতবর্ষের রাজধানী। ইংরেজেরা এখানে মা গঙ্গার নাম রেখেছেন হুগলী। ইংরেজী অক্ষরে গঙ্গানামটী লেখা যায় না, এমন কথা নয়; গঙ্গাকে আমরা দেবতা বলি, সেই কারণ গঙ্গানাম লিখনে বা উচ্চারণে হয়তো তাঁরা ঘৃণা বোধ করেন। গঙ্গাকে তাঁরা ইচ্ছামত ভিন্ন ভিন্ন নামে ভাগ কোরে নিয়েছেন। কোথাও গঙ্গা, কোথাও ভাগীরথী, কোথাও হুগলী; যে স্থানটুকু গঙ্গা, সে স্থানেও তাঁরা গঙ্গনামটী লেখেন না, কল্পনাবলে ভূগোলাদিতে লিখে দেন, “গ্যাঞ্জেস্।” ইংরেজ আমাদের রাজা, তাঁদের যে রকম ইচ্ছা, রাজক্ষমতায় অবশ্যই তাঁর মা গঙ্গার সেই রকম নাম দিতে পারেন, কিন্তু আমাদের ভাগীরথী গঙ্গা যত দিন ভারতভূমিতে প্রবাহিত থাকবেন, ততদিন পতিতপাবনী গঙ্গানাম কিছুতেই বিলুপ্ত হবে না; কালক্রমে গঙ্গা যদি সত্য সত্যই শুষ্কতোয়া হন, তথাপি চিরপ্রসিদ্ধ গঙ্গনামটী ভারতবাসী আর্য্য-সন্তানের চিরস্মরণীয় থাকবে।
মা গঙ্গার পূৰ্ব্বতীরে কলিকাতা। নৌকাপথে আমাদের কলিকাতায় আসা হয়েছিল। যে ঘাটে আমরা অবরোহণ করি, সেই ঘাটটীর নাম জগন্নাথ-ঘাট। সে ঘাটে নৌকা লাগাবার কারণ এই ছিল যে, জোড়াসাঁকো অঞ্চলে বীরভূমের বাণেশ্বরবাবুদের একখানি বাড়ী ছিল, সেই বাড়ীখানি জগন্নাথঘাট থেকে অতি নিকট। নৌকা থেকে উঠে প্রথমেই আমরা জোড়াসাঁকোতে গেলেম। যতদূর গেলেম, ততদূর কেবল দু-ধারে সারি সারি ছোট বড় অট্টালিকা; মাঝে মাঝে দোকান। বাবুদের বাড়ীতে রাত্রিবাস করা হলো, কলিকাতায় গঙ্গার যেরূপ অপরুপ শোভা দর্শন কোরে এলেম, রাত্রে সেই শোভার সমালোচনা আমার হৃদয়ক্ষেত্রে সমূদিত হোতে লাগলো। অপরুপ শোভা! বহুদূর-ব্যাপ্ত অসংখ্য তরণী! কোনখানি হালভরে, কোনখানি পালভরে, উত্তরদক্ষিণে ভেসে ভেসে চোলেছে, বায়ু-হিল্লোলে হিল্লোলিত হয়ে গঙ্গা-তরঙ্গ যেন মধুময় প্রেমতরঙ্গে নেচে নেচে যাচ্ছে; বোধ হলো যেন জীবপূর্ণ, পণ্যপূর্ণ তরণীগুলি বক্ষে নিয়ে পলক-প্রমোদে মা গঙ্গা নিজেই তালে তালে নৃত্য কোচ্ছেন, তরণীগুলিও বায়ুপ্রভাবে তরঙ্গপ্রভাবে হেলে দুলে নৃত্য কোচ্ছে; সাহেবলোকের বড় বড় জাহাজ স্থানে স্থানে মাস্তুলাঙ্গ ধ্বজপতাকায় সুশোভিত হয়ে শৃঙ্গশোভিত অচল-পৰ্ব্বতের ন্যায় নঙ্গর করা রয়েছে; দৃশ্য অতি চমৎকার! যখন আমরা নেমেছিলেম, তখন বেলা প্রায় দশটা; নগরবাসী লোকের স্নানের সময়; গঙ্গার প্রতি যাঁদের অচলা ভক্তি, তাঁরা সকলেই প্রতিদিন গঙ্গাস্নান করেন; যাঁদের অল্প ভক্তি অথবা যাঁরা ভক্তিশূন্য, তাঁরাও গঙ্গাস্নানে আনন্দ অনুভব করেন; অসংখ্য স্ত্রী, পুরুষ, বালক, বালিকা একসঙ্গে এক এক ঘাটে পরমানন্দে স্নান কোচ্ছেন; বালক-বালিকারা অল্প জলে গঙ্গার সঙ্গে হেসে হেসে খেলা কোচ্ছে; একটু বেশী বয়সের বলবান ছেলেরা গঙ্গাবক্ষে সাঁতার দিয়ে দিয়ে ভেসে যাচ্ছে; গঙ্গা-ভক্তি স্ত্রীলোকের হৃদয়েই অধিক বিরাজ করে, স্ত্রীলোকেরা স্নানান্তে পুষ্প-চন্দনে শিবপূজার সঙ্গে গঙ্গা-পূজা কোচ্ছেন; ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতেরা অষ্টাঙ্গে গঙ্গা-মূর্ত্তিকা লেপন কোরে, ললাটে তিলক কেটে, চক্ষু বুজে ধ্যানযোগে বোসে আছেন; বহুলোকের সমাগমে গঙ্গার জল-স্থল পরম শোভা ধারণ কোরেছে; সেই শোভা আমি নূতন দর্শন কোরেছি, সেই জন্যই গঙ্গ-প্রসঙ্গে এত কথা বোল্লেম।
প্রভাতে নগরদর্শন। নরহরিবাবুর মধ্যে মধ্যে কলিকাতায় আসা আছে, কলিকাতার অন্ধিসন্ধি তাঁর বেশ জানা ছিল, তিনি আমাকে সঙ্গে কোরে সহরটা দেখালেন। শকটারোহণে নগরদর্শন ভাল হয় না, অতএব প্রাতে ও অপরাহ্নে পদব্রজেই আমরা বেরতেম। পূর্ব্বে কখনো আমি কলিকাতা দেখি নাই, এই সবে নূতন দেখা; দু-এক দিনে সূক্ষ্মানুসূক্ষারূপে দর্শন করা অসম্ভব, ভ্রমণে ও দর্শনে আমাদের সাত দিন লাগলো। যা যা দেখলেম, সমস্তই আশ্চর্য্য।
বাড়ী, গাড়ী, দোকান, এই তিনটী জিনিস অসংখ্য। যে দিকে যাই, সেই দিকেই বাড়ী, সেই দিকেই গাড়ী, সেই দিকেই দোকান। ঠাঁই ঠাঁই বৃহৎ বৃহৎ অট্টালিকা; ক্ষদ্র-বৃহৎ এত বাড়ী আমি দর্শন কোল্লেম, গণনা কোরে শেষ করা যায় না। এক জায়গায় এত অট্টালিকার সমাবেশ, সেই কারণেই বোধ হয়, কলিকাতার নাম প্রাসাদ-নগরী। কলিকাতায় বাজার অনেক, বাজারগুলি তন্ন তন্ন কোরে আমি দেখলেম; বাজারে বাজারে নানাদেশের নানাপ্রকার জিনিসপত্র বিক্রয় হয়। ইংরেজী-বাজার ধর্ম্মতলায়, বাঙালীবাজার বাঙালীটোলায়। বাজারগুলি দিব্য গুলজার। নিকটে নিকটে পুলিশের থানা, রাস্তায় রাস্তায় দিবারাত্রি প্রহরীদের ঘাঁটি। নরহরিবাবুর সঙ্গে থানাগুলি আমি দেখলেম, আদালতগুলি আমি দেখলেম, কেল্লা আর কেল্লার মাঠ একদিন দেখে এলেম। দক্ষিণে আলীপুর, ভবানীপুর, কালীঘাট। আলীপুরে নরহরিবাবুর মোকদ্দমা। একদিন তাঁর সঙ্গে আলীপুরে গিয়ে সেখানকার আদালতগুলিও দর্শন কোল্লেম। দেওয়ানী, ফৌজদারী এক জায়গায় নয়, ফৌজদারী কাছারীর অনেক দূর পশ্চিমে স্বতন্ত্র বাড়ীতে জজ-আদালত; সেই বাড়ীতে জজ, সদরআলা, সদর-আমীন আর মুন্সেফেরা এজলাস করেন। দেওয়ানী-ফৌজদারী উভয় বিভাগেই হাকিমের সংখ্যা বেশী। নরহরিবাবুর মুখে শুনলেম, এত বড় আদালত আর এতাধিক হাকিম বঙ্গদেশের আর কোন জেলাতেই নাই। এই জেলাটী সদরজেলা; এ জেলার নাম চব্বিশ পরগণা। রাজধানীর নিকট বোলেই এই জেলার প্রাধান্য। বঙ্গদেশের লেফটেনাণ্ট গবর্ণর এই আলীপুরের বেলভেডিয়ার উদ্যানে বাস করেন।
কলিকাতা উত্তম সহর; লোকের মুখে শুনেলেম, পূর্ব্বে কলিকাতার এ অবস্থা ছিল না। স্থানে স্থানে জঙ্গল ছিল, বাগান ছিল, পচা পচা পূষ্কর্ণী ছিল, পশু-পক্ষী অনেক বাস কোত্তো, ভদ্রলোক অপেক্ষা ইতরলোক আর দুষ্টলোকই বেশী ছিল, ক্রমে ক্রমে সংস্কার হয়ে আসছে।
ঐ সকল কথার সার্থকতাও আমি বেশ অনুভব কোল্লেম। অনেকগুলি রাস্তার নামে তদ্বিষয়ের প্রমাণ পাওয়া যায়। হাতীবাগান, বাদুড়বাগান, ভাল্লুকবাগান, ডালিমবাগান, পেয়ারাবাগান, গয়াবাগান, হরীতকীবাগান, চোরবাগান, জোড়াবাগান, ডিঙ্গীভাঙা, শানকীভাঙা, কসাইটোলাঁ, উলটাডিঙী, নারিকেলবাগান ইত্যাদি পরিচয়ে বেশ জানা যায়, পূর্ব্বে এ সহরের এরূপ শ্রী ছিল না; পূষ্কর্ণী-পরিচয়ে এক দৃষ্টান্ত হেদুয়াদিঘী। ইংরেজশ্রীবৃদ্ধিকারিদলের অনুগ্রহে কলিকাতা ক্রমে ক্রমে সুন্দর শ্রীধারণ কোচ্ছে, ক্ৰমশঃ আরও সুন্দর হবে, তারও আভাস পাওয়া গেল।
নরহরিবাবু প্রায় কুড়ি দিন কলিকাতায় থাকলেন; সেই কুড়ি দিন আমি তাঁদের বাড়ীতেই থাকলেম। পাচক-ব্রাহ্মণ নিযুক্ত হয়েছিল, আহারাদির কোন কষ্টই ছিল না। থাকতে থাকতে পাড়ার পাঁচজন ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার জানাশুনা হলো; পরিচয় হলো না, পরিচয় আমার কি আছে, কাহার কাছে কি পরিচয় দিব, কিছুই পরিচয় হলো না; তথাপি বিনা পরিচয়ে ভদ্রলোকেরা আমাকে যেন ভালবাসলেন, লক্ষণে এইরূপ আমি বুঝলেম।
একদিন একটী ভদ্রলোক আমাকে সাবধান কোরে বোল্লেন, “এ সহর বড় ভয়ঙ্কর স্থান; চোর, জয়াচোর, গাঁটকাটা, জুয়ারী, মাতাল, লম্পট এখানে অনেক; ভদ্রলোকের সঙ্গে তুলনায় বদমাসলোকের সংখ্যাই অধিক। সহরে যখন একাকী বাহির হবে, খুব সতর্ক হয়ে থেকো, অচেনা লোকের কথায় শীঘ্র বিশ্বাস কোরো না, দুষ্টলোকের মিষ্টকথায় ভুলো না, ছেলেমানুষ তুমি, খুব সাবধান হয়ে চোলো; অসাবধান হোলেই বিপাকে ঠেকবে। সাবধান! সাবধান। বিশেষতঃ রাত্রিকালে।”
ভ্রমণকালে কতক কতক লক্ষণ দেখে দেখে ঐ রকম অনেকটা আমি বুঝেছিলেম, সাবধান হয়েই বেড়াতেম; ভদ্রলোকের মুখে স্পষ্ট স্পষ্ট ভয়ের কথা শুনে তদবধি আমি আরো অধিক সতর্ক হোলেম।
নরহরিবাবুর দেশে যাবার দিন নিকট হয়ে এলো। আমাকে তিনি কোথায় কার কাছে রেখে যাবেন, বোধ হয়, আগে থেকেই ভেবেছিলেন। একদিন সন্ধ্যার পর পাড়ার একটী ভদ্রলোক তাঁর সঙ্গে দেখা কোত্তে আসেন, লোকটীর বয়স কিছু ভারী, দিব্য শান্তমূর্ত্তি, চেহারায় জানা যায়, বাবুলোক। আমাকে কাছে ডেকে, নরহরি সেই লোকের নিকটে সুপারিশ কোরে সংক্ষেপে সংক্ষেপে বোল্লেন, “এই ছোকরার কথাই আমি আপনাকে বোলেছিলেম; যেমন বয়স, সেই হিসাবে সম্ভবমত লেখাপড়া শিখেছে, চরিত্র খুব ভাল, অবাধ্যতা জানে না, অত্যন্ত গরিব, আপনি যদি দয়া কোরে এটীকে রাখেন, আমার যথেষ্ট উপকার করা হবে, গরিবকে আশ্রয় দিলে আপনারও পূণ্য হবে, ইহার দ্বারা আপনার ছোট ছোট কাজকর্ম্ম বেশ চোলবে, ছোকরা খুব বিশ্বাসী, সত্যবাদী, ধর্ম্মভীরু; অল্পদিনে অনেক পরিচয় আমি পেয়েছি।”
তাঁকে আর বেশী কথা বোলতে হলো না, আমার মুখপানে চেয়ে, একটু হেসে ভদ্রলোকটী বোল্লেন, “কি বল হরিদাস! আমার বাড়ীতে তুমি থাকবে? কাজকর্ম্ম বেশী কিছু নয়, দপ্তরখানায় বোসে অল্প অল্প লেখাপড়া করা; আর বিশেষ প্রয়োজন উপস্থিত হোলে এক আধবার বাজারে যাওয়া, এই মাত্র কার্য্য। কেমন, রাজী আছ?”
নমস্কার কোরে তৎক্ষণাৎ আমি সম্মত হোলেম। পূর্ব্বে দুই একদিন ঐখানে তাঁর সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছিল, তাতেই তিনি জানতে পেরেছিলেন, আমার নাম হরিদাস। আমিও তাঁর সততা অনুভব কোরেছিলেন, তাঁর কাছে চাকরী কোত্তে আমার অনিচ্ছা হলো না, বরং আহ্লাদ হলো। খানিকক্ষণ থেকে সেই বাবুলোকটী আপন বাড়ীতে চোলে গেলেন, “কল্য আবার দেখা হবে,” এই কথা বোলে গেলেন।
সেদিন রবিবার। আগামী বুধবার নরহরিবাবুর স্বদেশযাত্রা। সোমবার বৈকালে সেই বাবুটী আবার এলেন। আমাকে সঙ্গে কোরে নিয়ে যেতে চাইলেন, নরহরিবাবু বাধা দিয়ে বোল্লেন, “আজ নয়, এ দু-দিন এইখানেই থাকুক, যেদিন আমি যাব, সেই দিন আপনার কাছে রেখে যাব।” সেই কথাতেই বাবুটী রাজী হোলেন; নরহরিবাবুর বাড়ীতেই আমি থাকলেম।
মঙ্গলবার বৈকালে আমাকে সঙ্গে নিয়ে নরহরিবাবু একবার বাজারে বেরুলেন; দেশের জন্য যা কিছু, খরিদ করা অবিশ্যক ছিল, খরিদ কোল্লেন আমার জন্য আর এক জোড়া ধুতী-চাদর, আর এক জোড়া জামা আর এক জোড়া বার্ণিসকরা বিলাতী জুতা কিনে দিলেন, সঙ্গে সঙ্গে মুটে এলো, সন্ধ্যার পূর্ব্বেই আমরা বাড়ীতে ফিরে এলেম।
রাত্রে নূতন অভিনয়। কল্য প্রাতে নরহরিবাবু দেশে যাবেন সন্ধ্যার সময় দুটী পাঁচটী বন্ধুবান্ধব দেখা কোত্তে এলেন, প্রসঙ্গাধীন পাঁচরকম গল্প হলো। তাঁরা উঠে যাবার পর নরহরিবাবু আমাকে ডাকলেন, ম্লানবদনে আমি তাঁর কাছে গিয়ে বোসলেম। দু-চারি কথার পর আমার হাতে ৫০০৲ টাকার পাঁচখানি ব্যাঙ্কনোট দিয়ে বাবু স্নেহবচনে বোল্লেন, “এই নোটকখানি রাখ। আমি দেশে চোল্লেম, মাসখানেক পরে আবার আসবো, তুমি কেমন থাকো, সাক্ষাৎ কোরে জেনে শুনে যাব, তুমি সাবধানে থেকো, সাবধান হয়ে কাজকর্ম্ম কোরো, বাবুটী লোক ভাল, আপাততঃ তোমাকে কিছু কিছু, জলপানী দিবেন, কাজকৰ্ম্ম শিখলে, থাকতে থাকতে তোমার ভাল হবে।”
নোটকখানি ফিরিয়ে দিয়ে, কৃতজ্ঞতা জানিয়ে আমি বোল্লেম, “এ সব আমাকে কেন দিচ্ছেন? আমি আপনাদের কি উপকার কোরেছি? আমাকে টাকা দেওয়া কিসের জন্য? আপনাদের কাছেই বরং আমি উপকার পেয়েছি, তজ্জন্যই কৃতজ্ঞ আছি, চিরদিন কৃতজ্ঞ থাকবো, টাকা আমি গ্রহণ কোরবো না; ও টাকা আপনিই রাখুন।”
শান্তবদনে বাবু বোল্লেন, “সে জন্য নয়, তুমি অনেক কষ্ট পেয়েছ, অকারণে আমাদের লোকেরা তোমাকে ধোরে কত কষ্ট দিয়েছে, তজ্জন্য আমরা বড় দুঃখিত আছি। জ্যাঠামহাশয় বলে দিয়েছেন, সে সব কথা তুমি কিছু মনে কোরো না, ভুলক্রমে লোকেরা তোমায় পোরেছিল, সে কথা কারো কাছে গল্প কোরো না, ভুলে যেয়ো। নোট-কখানি দিচ্ছি কেন, সে কথাও বোলছি; কর্ত্তার অনুমতি। বিশেষতঃ যেখানে তোমাকে আমি রেখে যাচ্ছি, সেখানে যদি তোমার কষ্ট হয়, সে বাড়ীতে যদি তুমি বেশী দিন থাকতে না পার, আশ্রয়হারা হয়ে ফাঁপরে পোড়বে :—সহর জায়গা, বিশেষ কলিকাতা, এখানে সহজে কেহ তোমাকে আশ্রয়ও দিবে না, কারো কাছে সাহায্য পাবে না; ছেলেমানুষ, অর্থাভাবে কোথায় যাবে, কি কোরবে, কোথায় থাকবে, বড়ই কষ্ট হবে; নোট-কখানি রাখ, আবশ্যকমত খরচপত্র কোরো; গ্রহণ না কোল্লে আমি বড়ই ক্ষুণ্ণ হব; কত্তাও ক্ষুণ্ণ হবেন।”
আমিও গ্রহণ কোরবো না, তিনিও কিছুতে ছাড়বেন না, বার বার জেদ কোত্তে লাগলেন, কাজেই সেই পাঁচখানি নোট গ্রহণ কোত্তে হলো; অগত্যা স্বীকার।
রাত্রি দশটার পূর্ব্বে আহারাদি কোরে আমরা যথাস্থানে শয়ন কোল্লেম। বাণেশ্বরবাবুর বদান্যতা, নরহরিবাবুর ভদ্রতা আর আমার অদৃষ্টের প্রসন্নতা চিন্তা কোত্তে কোত্তে নিদ্রিত হোলেম, ঊষাকালে নিদ্রাভঙ্গ হলো। প্রভাতে নরহরিবাবু গাত্রোত্থান কোরে, নিয়মিত কার্য্য সমাপন কোল্লেন, যে বাড়ীতে আমাকে রাখবার কথা, সঙ্গে কোরে সেই বাড়ীতে নিয়ে গেলেন। বাবুর সঙ্গে সাক্ষাৎ হলো, সময়োচিত কথাবার্ত্তার পর বাবুর হস্তে আমাকে সমর্পণ কোল্লে, বাবুর কাছে বিদায় নিয়ে, নরহরিবাবু আপন বাড়ীতে চোলে এলেন। কখন তিনি যাবেন, যাবার সময় দেখা কোরবো, সেই অভিলাষে আমার নূতন মনিবকে বোলে, আমিও তাঁর সঙ্গে সঙ্গে এলেম। দূরপথে যাওয়া, কোথায় কখন আহার হবে, হবে কি না হবে, কিছুই নিশ্চয় ছিল না, অতএব সেইখানেই আহারাদি সমাপন কোরে, বাড়ীর দরজায় চাবী দিয়ে, তিনি গাড়ীতে উঠলেন। আমার চক্ষে জল এলো, আমার মুখপানে চেয়ে, তাঁর চক্ষু-দুটীও সজল; মিষ্টবাক্যে আমাকে সান্ত্বনা কোরে, নানাপ্রকার হিতোপদেশ দিয়ে, তিনি নেত্রমার্জ্জন কোল্লেন; আর আমার দিকে চাইতে পাল্লেন না। জিনিসগুলি গাড়ীর ভিতর তুলে দিয়ে চাকরটী কোচবাক্সে কোচমানের কাছে বোসল, গাড়ীখানা গড়গড় শব্দে গঙ্গার দিকে ছুটে চোল্লো।
খানিকক্ষণ চেয়ে চেয়ে চক্ষু মুছতে মুছতে আমি মনিব-বাড়ী ফিরে এলেম।