» » » পঞ্চদশ কল্প : এ আবার কি কাণ্ড?

বর্ণাকার

ভূবনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়

হরিদাসের গুপ্তকথা
প্রথম খণ্ড

পঞ্চদশ কল্প : এ আবার কি কাণ্ড?

যে বাড়ীতে আমার চাকরী হলো, সেই বাড়ীখানি দোতালা; সম্মুখে ঝিলিমিলি দেওয়া টানা বারান্দা; সদরবাড়ীতে অনেকগুলি ঘর। উপরের একটী ঘরে বাবু বসেন, আর সব ঘরগুলি প্রায় সৰ্ব্বদাই শূন্য থাকে, ক্রিয়াকর্মোপলক্ষে জনপূর্ণ হয়। সব ঘরগুলি কিন্তু সমভাবে সাজানো। নীচের দুটী ঘরে দপ্তরখানা, উত্তরদিকে পুজার দালান, বাড়ী চকবন্দী;—চকের অন্যান্য ঘরে সরকার, মুহুরী, গোমস্তা, খানসামা আর অন্যান্য চাকর থাকে। সদরে দেউড়ী আছে, দরোয়ান নাই।

বাবুর নাম প্রতাপচাঁদ মৈত্র, বারেন্দ্ৰশ্রেণী ব্রাহ্মণ; বর্ণ উজ্জ্বল শ্যাম, গঠন নাতিদীর্ঘ, দোহারা, চক্ষুদুটী বড় বড়, মুখখানি সুন্দর, দীর্ঘ নাসিকার অগ্রভাগটী কিছু টেপা, মাথার চলগুলি কিছু লম্বা লম্বা, বয়স অনুমান পঞ্চাশ বৎসর। বাবুর দুটী পত্র, দুটী কন্যা। জ্যেষ্ঠ পুত্রের নাম হরিদয়াল, কনিষ্ঠের নাম শ্যামধন। বড়বাবু পিতার ন্যায় নাতিদীর্ঘ, বর্ণ গৌর, মুখ-চোখ দিব্য মানানসই, কেশ দীর্ঘ, মধ্যস্থলে সিঁতিকাটা; বয়স অনুমান পঁচিশ বৎসর। ছোটবাবুটী কিছু কালো, খৰ্ব্বাকার, একহারা, মুখেচক্ষে তীক্ষ্ণবুদ্ধির পরিচয় পাওয়া যায়; বয়স অনুমান বাইশ বৎসর।

অন্দরে বাবুর পত্নী, কন্যা দুটী, আর দুজন দাসী থাকে; আর কেহই না। আমি ছেলেমানুষ, অন্দরে প্রবেশ করবার অনুমতি ছিল, সময়ে সময়ে অন্দরে আমি যেতেম, মেয়েদের সঙ্গে কথাবার্ত্তা কইতেম, কেহই আমারে দেখে লজ্জা কোত্তেন না। গৃহিণী দিব্য সুন্দরী; মেয়ে-দুটীও সুন্দরী। বড় মেয়েটার নাম মৃণালিনী, বয়স অনুমান ১৮/১৯ বৎসর। ছোটমেয়েটীর নাম তরুবালা, বয়স অনুমান দশ বৎসর। মৃণালিনী সধবা, তরুবালা কুমারী।

একমাস সেই বাড়ীতে আমি থাকলেম। দু-বেলা দপ্তরখানায় বোসে লেখাপড়া করি, সন্ধ্যার-সময় একজন সরকারকে সঙ্গে নিয়ে রাস্তায় একটু একটু বেড়াই, অবকাশকালে দুই একখানি নূতন নূতন পুস্তক পাঠ করি; বেশ থাকি। বাবু বোলেছিলেন, মাঝে মাঝে এক একবার বাজারে যাওয়া আবশ্যক হবে; কিন্তু একমাসের মধ্যে সে রকম আবশ্যকতা একদিনও উপস্থিত হয় নাই; বাড়ীতেই আমি থাকি; বাহিরে অন্দরে সকলেই আমাকে ভালবাসেন। আমার ভাগ্যফলের মধ্যে সেইটকু একটী সুফল।

ক্লমেই দিন গত হোতে লাগলো। হিসাব কোরে দেখলেম, একমাস আট দিন। মাসখানেকের মধ্যে আর একবার কলিকাতায় আসবেন নরহরিবাবু, এই কথা বোলে গিয়েছিলেন, কিন্তু এলেন না; চিঠিপত্রও লিখলেন না; বোধ হয়, আমাকে ভুলে গেলেন। ভুলে থাকেন ভুলেছেন, তবু আমি তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ। যে আশ্রয়ে তিনি আমারে রেখে গিয়েছেন, সে আশ্রয়টী খুব ভাল। আরো ভাল এই জন্য বলি, রক্তদন্তের ভয়টা ঘুচে গেছে। কোথায় বীরভূম, কোথায় কলিকাতা। এত বড় সহরের ভিতর কোথায় কোন গলীতে কোন বাড়ীতে আমি আছি, কলিকাতায় এলেও সে রাক্ষসটা কিছুই জানতে পারবে না; আমি কলিকাতায়, কে-ই বা তাকে এ সন্ধান বোলে দিবে? কেহই দিবে না। আমি নিরাপদ। এইরুপ আমি ভাবলেম; এইরুপ আমার মনের ধারণা। রক্তদন্ত এখানে আসতে পারবে না, এই ধারণায় এক প্রকার আমি নিশ্চিন্ত কিন্তু অমরকুমারী সৰ্ব্বক্ষণ আমার মনে জাগেন। সে রাত্রে আমি পালিয়ে এসেছি, সেটা জানতে পেরে রাক্ষসটা হয় তো সেই স্নেহময়ী কুমারীটীকে কতই লাঞ্ছনা কোরেছে। আহা! সেখানে একদিন আমি মনে মনে বলেছিলেম, অভাগিনী অমরকুমারী! ভাল করি নাই। অমরকুমারী অভাগিনী নহেন, অমরকুমারীর ভাগ্যে অবশ্যই সুখ আছে। অভাগিনী হোলে সেই ক্ষুদ্র হৃদয়ে ততটা দয়ার স্থান হতো না। অমরকুমারীর জন্য আমি ভাবি; অমরকুমারীর জননীর জন্যও ভাবনা হয়। বর্দ্ধমানের আশালতাকেও মাঝে মাঝে মনে পড়ে।

এই রকমে আমার দিন যায়। দুই মাস পরিপূর্ণ। নরহরিবাবু এলেন। নরহরিবাবুর জন্য আমি কেন ভাবি? তিনি আমার উপকার কোরেছেন, আমি তাঁর কেহই নই, তবু তিনি আমারে আপন ভেবে ভালবেসেছেন, দয়া কোরে চাকরী কোরে দিয়েছেন, ৫০০৲ টাকার নোট দিয়ে গিয়েছেন, সেই জন্যই তাঁরে মনে করি। শেষকথাটা কিছু বেশী ভাবি। অত টাকা তিনি আমারে কেন দিলেন? বোলেছিলেন, কর্ত্তার অনুমতি। সেই অনুমতিরই বা কি কারণ? সেই রাত্রে চাকরেরা বলেছিল, তাঁদের বাড়ীর একটী মেয়ে হারিয়ে গিয়েছে, হারিয়ে গিয়েছে কি বেরিয়ে গিয়েছে, বাড়ীর লোকেই বাহির কোরেছে, কোন সূত্রে আমি যদি সেটা জানতে পেরে থাকি, অন্যলোকের কাছে প্রকাশ না করি, সেই জন্যই বোধ হয় টাকা দেওয়া। বোধ হয় কেন, সত্যই তাই। কৰ্ত্তাও বোলেছিলেন, নরহরিবাবুও বারংবার বলে গিয়েছেন, “সে রাত্রে কষ্টের কথা ভুলে যেয়ো, কোথাও গল্প কোরো না।” সত্যই তাই। কেন আমি গল্প কোরবো? পরের ঘরের কথা পরের কাছে বলা কখনই আমার অভ্যাস নয়; মনের কথা মনেই রয়ে গেছে; গল্পে আমার দরকার কি? গরিব আমি, গরিবের মত থাকাই আমার পক্ষে ভাল।

বেলা আটটা কি নটা। বড়বাবু গঙ্গাস্নানে যাবেন, আমারেও সঙ্গে কোরে নিয়ে যেতে চাইলেন। আমি তাঁর সঙ্গে একটা বড় রাস্তায় উপস্থিত হোলেম। রাস্তার নাম চিৎপুর রোড। বড়বাবু বোল্লেন, “জগন্নাথ-ঘাটের চেয়ে আহীরিটোলার ঘাট ভাল, সে ঘাটে ভিড় কম, সেই ঘাটেই যাওয়া যাক।” সেই ঘাটেই আমরা চোল্লেম। রাস্তায় ভারী ভিড়। ঘোড়ার গাড়ীর ভিড়, গরুর গাড়ীর ভিড়, হাঁটা-লোকের ভিড়, রাস্তা প্রায় দুর্গেম। গাড়ীও অগন্তি, মানুষও অগন্তি। দুধারেই বাড়ী, দুধারেই দোকান। দেখতে দেখতে আমি চোল্লেম। এক জায়গায় খানকতক গাড়ী এদিক ওদিক ফিরি কোরে বেড়াচ্ছে, গাড়োয়ানেরা “কাশীপুর, বাবু কাশীপুর, চোলতি বল্লগর” বোলে চীৎকার কোরে হাঁকছে; কথা বুঝতে না পেরে বাবুকে জিজ্ঞাসা কোরে জানলেম, সহরের উত্তরে কাশীপর বরানগর নামে পল্লী আছে, ভাগাভাগি গাড়ী কোরে কাজের লোকেরা সেইদিকে যায়, সেই জন্য ঐ সকল গাড়ী ঐ রকমে ঐ জায়গায় বেড়ায়। সুবিধা বেশ।

সে দিন কি একটা যোগ ছিল। গঙ্গার পথে, গঙ্গার ঘাটে স্ত্রী-পুরুষের বেশী জনতা। এক জায়গায় তত স্ত্রীলোক কখনো আমি দেখি নাই। ঘাটে ঘাটে দাঁড়া, বসা, শোয়া, চলা, গানকরা ভিকারীও বিস্তর। আরো শুনলেম, দিনের বেলা গঙ্গাস্নানের যোগে ঐ রকম ভিড়ের ভিতর অনেক গাঁটকটাও বেড়ায়। দুষ্টলোকে সকল কাজেই হুজুগ চায়। দুষ্কার্য্য বেশ চলে, পুলিশ প্রায় কিছুই কোত্তে পারে না।

আহীরিটোলার ঘাটে স্নান কোরে আমরা বাড়ীতে ফিরে এলেম। নানা কাজে দিনমান কেটে গেল। সন্ধ্যার পর আমি কর্ত্তাবাবুর বৈঠকখানায় নিষ্কর্ম্মা হয়ে বোসে থাকলেম। কৰ্ত্তা তখন বেড়াতে বেরিয়েছিলেন, সে ঘরে আর কেহই ছিল না, আমি একাকী। এইখানে বাবুদের সংসারের কথা আর একটু বলি। প্রতাপবাবুর জমীদারী নাই; সহরে পাঁচ সাতখানি বাড়ী আছে, ভাড়া চলে; বাহির অঞ্চলে খণ্ড খণ্ড জমীজায়গা আছে, গোলপাতার ঘর বেঁধে ইতরজাতীয় প্রজালোক বাস করে, ভেড়া রাখে, মহিষ রাখে, দোকান করে; তাদের কাছেও বাবু অনেক টাকা খাজনা পান; তা ছাড়া কোম্পানীর কাগজ; ছমাস অন্তর সুদ আসে, বেশ সচ্ছলে সংসার চলে। বাড়ীতে দুর্গাপুজো হয়, অপরাপর ক্ৰিয়াকৰ্ম্মও প্রায় বাদ যায় না। সকল পাৰ্ব্বণে ঘটা হয় না, সকলে জানতেও পারে না, দুর্গোৎসবে কিছু ঘটা হয়।

বড়বাবু আর ছোটবাবু উপরের বৈঠকখানায় বসেন না, তাঁদের জন্য নীচের তালায় দুটী স্বতন্ত্র স্বতন্ত্র বৈঠকখানা আছে। ভাই-দুটীতে বেশ ভাব। স্বতন্ত্র বৈঠকখানা থাকলেও তাঁরা দুজনে প্রায়ই এক ঘরে বোসে থাকেন। খোসগল্প হয়, তাসখেলা হয়, বই পড়া হয়, বেশ আমোদ। দুজনেই তামাক খান না, কোন উৎপাত নাই। বোলেছি, ভালবাসা পাওয়া আমার অদৃষ্টের একটী সুফল; বাবুরা দুজনেই আমাকে ভালবাসেন; কথায় বার্ত্তায়, আদর-যত্নে, ঠিক যেন সহোদরের মতন ভাব; ভাবের বিনিময়ে আমিও তাঁদের আজ্ঞাকারী। বাবুরা যখন আমারে ডাকেন, আমি তখন তাঁদের বৈঠকখানায় গিয়ে বসি, তাঁরা আমারে কত কথাই জিজ্ঞাসা করেন, বেশী কথা আমি কি জানি, সকল কথার উত্তর দিতে পারি না, পরিচয়ের কথায় বোবা হই, তাঁরা পরস্পর মুখচাহাচাহি কোরে গম্ভীরভাব ধারণ করেন।

বড়বাবুর নিজের একটী গাড়ীঘোড়ার কারবার আছে। নীলামে অল্পদরে সাহেববাড়ীর গাড়ী-ঘোড়া কিনে, সুবিধা বুঝে বেশী দামে বিক্রয় হয়, সে কারবারে বৎসর বৎসর বেশ দশ টাকা আয় হয়ে থাকে। বড়বাবুর হাত কিছু দরাজ, দশ টাকা খরচপত্র আছে, কিছু কিছু ব্যয় করাও আছে; আমোদগুলি কিন্তু নির্দোষ। ছোটবাবু কিছু, কৃপণ; নিজ খরচের জন্য পিতার কাছে মাসে মাসে তিনি ১০০ টাকা পান, অতি অল্পই খরচ হয়, বাকী টাকাগুলি তিনি তেজারতিতে খাটান; বয়স অল্প, কিন্তু বিষয়বুদ্ধি বেশ। যাতে কোরে টাকা জমে, সেই দিকেই তাঁর অধিক ঝোঁক।

আরো একমাস গেল। শ্রাবণ মাস। বাবুর বাড়ীতে প্রতিমা গড়া আরম্ভ হলো। দুর্গাপ্রতিমা কখনো আমি দেখি নাই; পঞ্জিকায় ছবি দেখেছি, মাটীর গড়ন কেমন হয়, সেটী দর্শন করা আমার ভাগ্যে ঘটে নাই; এইবার বোধ হয় ঘোটবে, এইরুপ আশা জন্মিল। খড়বাঁধা থেকে মাটীর কাজ পর্য্যন্ত নিত্য নিত্য আমি দর্শন করি। দিন যেতে লাগলো, মাস যেতে লাগলো, শ্রাবণ ভাদ্র বিদায় হলো, আশ্বিনমাস আগত। শরৎকাল। সুখের শরৎ। বসন্ত-ঋতুর ন্যায় বৎসরের এই ঋতুটীও অতি সুন্দর। শীত-গ্রীষ্ম থাকে না, বৃষ্টিও, বেশী হয় না, পথে-ঘাটে বড় একটা কাদা থাকে না, সুখের শরৎকাল। পল্লীগ্রামে থাকলে এই ঋতুর বেশী মহিমা অনুভব করা যায়। উদ্যানে উদ্যানে শেফালিকা, কামিনী, মল্লিকা আর যুথি-যাঁতি প্রভৃতি সুগন্ধি পুষ্প প্রস্ফুটিত হয়, সরোবলে পদ্মফুল ফুটে, সূর্য্যের তেজ বেশী থাকে না, আকাশ নিৰ্ম্মল হয়, চন্দ্রের সৌন্দর্য্য বৃদ্ধি পায়, দেশেব কবিরা শরচ্চন্দ্রের উচ্চ প্রশংসা কীৰ্ত্তন করেন।

প্রতিমায় রং করা, চিত্র করা আরম্ভ হলো। নিত্য নিত্য মা দুর্গার নূতন রূপ আমি দর্শন করি। কৃষ্ণনগরের কারিকর; প্রধান কারিকরের নাম রামচরণ পাল। মুখ কখানি গড়া, রং-ফলানো আর চিত্র করা ব্যতীত অপরাপর কাৰ্য্য রামচরণ স্বহস্তে কিছুই করে না, তাঁবেদারেরাই ওস্তাদের উপদেশমতে দস্তুরমত সে সকল কার্য্য নিৰ্ব্বাহ করে। রামচরণ পাল সৌখীন লোক; ফর্সা ফর্সা কোঁচানো কাপড় পরে, ভাল ভাল জামা গায়ে দেয়, দিল্লীর নাগোরা ব্যবহার করে, কোথাও যাবার সময় ছাতা-ছড়ি সঙ্গে রাখে; দক্ষিণ হস্তে একখানি ইষ্টকবচ, বামহস্তের বাহুমূলে চারি-পাঁচটী ঠাকুরের মাদুলী, গলায় ছোট ছোট মাদুলী-গাঁথা রুদ্রাক্ষের মালা; বেশ মানায়। চেহারাও মন্দ নয়, অল্প শ্যামবর্ণ, মুখেরও চটক বেশ, বয়স আন্দাজ ৫৫ বৎসর। বাবুসজ্জার প্রায় সকল অঙ্গই আছে, রামচরণ কিন্তু চল ফিরায় না; পাকা গোঁফ, চুলগুলিও অনেক পাকা, কাঁচা-পাকায় মিশানো, দেখায় বেশ। সতরঞ্চখেলায় রামচরণের বিশেষ নৈপুণ্য, বাড়ীর কর্ত্তাবাবুও সতরঞ্চখেলা ভালবাসেন; রামচরণের সঙ্গেই প্রতিদিন বৈকালে সতরঞ্চখেলা হয়। প্রায় সকল বাজীতেই বাবু হারেন, রামচরণের জিত। বাবু কিন্তু হেরে হেরেও অট্ট অট্ট হাস্য করেন, রাগ করেন না, বরং আরো খেলার উপর বেশী ঝোঁক হয়।

প্রতিমা চিত্র করা হয়ে গেল। মহালয়া অমাবস্যার দিন দুজন মালী এসে সপরিবার মা দুর্গাকে নানা অলঙ্কারে সাজিয়ে দিলে, কেবল কার্তিকের গোঁফচুল আর অসুরের গোঁফ-চুল-ভ্রূ বাকী থাকলো, সে কাজগুলি রামচরণের। ষষ্ঠীর পূর্ব্বদিন রামচরণ কার্ত্তিক-অসুরকে পূর্ণাঙ্গ কোরে দিল, ষষ্ঠীর রাত্রে অধিবাস হয়ে গেল, তার পর সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী, তিনদিন মহাপজা। দুর্গাপূজা কখনো দেখি নাই, নূতন দেখলেম; হৃদয়ে ভক্তির উদয় হলো, তিনদিন তিন তিনবার সাষ্টাঙ্গে ভক্তিভাবে প্রতিমাসমীপে প্ৰণিপাত কোল্লেম। অনেক লোকের নিমন্ত্রণ হয়েছিল, নিমন্ত্রিত লোকেরা ঘটের কাছে প্রণামী দিয়ে, প্রতিমাকে প্রণাম কোরে, কৰ্ত্তাবাবুর সঙ্গে যথাযোগ্য প্রিয়সম্ভাষণ কোল্লেন, অনন্তর যাঁর যেরুপ ইচ্ছা, তিনি সেইরুপ আহারাদি কোরে বিদায় হোলেন। ব্রাহ্মণের বাড়ী, ছোট খাট অন্নক্ষেত্র হয়েছিল, কতক লোক অন্ন-প্রসাদ পেয়ে পরিতৃপ্ত হয়ে গেল।

দশমীতে নিরঞ্জন। কলিকাতায় দুর্গা-প্রতিমা অনেক হয়। বৈকালে নূতন কাপড় পোরে, বাবুদের সঙ্গে আমি বিসর্জ্জন দেখতে বেরুলেম। কলিকাতায় প্রতিমা-বিসর্জ্জনে যেরূপ সমারোহ, দেখে আমার তাক লেগে গেল! চক্ষে না দেখলে সে সমারোহ ব্যাপার অক্ষরে লিখে অথবা মুখের কথায় বোলে অপরলোককে বুঝিয়ে দেওয়া যায় না, সে বর্ণনায় আমি অক্ষম, সুতরাং ক্ষান্ত থাকতে হলো। গঙ্গাজলে দুর্গা-বিসর্জ্জন। অনেক ঘাটেই বিসর্জ্জন হয়, তন্মধ্যে নিমতলাঘাটেই বেশী।

বিসর্জ্জনের পর বাড়ীতে ফিরে এসে বিল্বপত্রে দুর্গানাম লেখা, প্রসাদীসিদ্ধি পান করা এবং পরস্পর প্রণাম, আশীৰ্ব্বাদ ও মঙ্গলালিঙ্গন সমাপ্ত করা হলো। এই প্রথাটীও আমার নূতন দেখা, নূতন জানা।

বঙ্গের প্রধান পৰ্ব্ব দুর্গাপূজা। বৎসরের মধ্যে হিন্দুজাতির এমন পৰ্ব্ব আর নাই। বৎসরের মত দুর্গাপূজা ফুরিয়ে গেল। আশ্বিনমাস প্রায় শেষ। ছয় মাস আমি কলিকাতায়। রাস্তাঘাট অনেক জানা হয়েছিল, বিসর্জ্জনের পাঁচদিন পরে, কোজাগর-পূর্ণিমার দিন বৈকালে আমি একাকী চিৎপুর রোডে বেড়াতে বেরিয়েছিলেম। বৈকালে এ রাস্তায় আমি একদিনও আসি নাই। অন্যদিন অন্য সময়ে এ রাস্তায় যে রকম ভিড় আর যে রকম শোভা দেখি, আজো সব সেই রকম, কেবল একটা শোভা আজ আমার চক্ষে নূতন। গরাণহাঁটা থেকে কলুটোলা-রাস্তা পর্য্যন্ত বেড়িয়ে বেড়িয়ে দেখলেম, দুধারি বারান্দায় বারান্দায় রকমারি মেয়েমানুষ। রকমারি বর্ণের কাপড়পরা, রকমারি ধাতুর গহনাপরা, রকমারি ধরণের খোঁপাবাঁধা, অনেক রকম মেয়েমানুষ। কেহ কেহ টুলের উপর বসে আছে, কেহ কেহ চেয়ারে বোসেছে, কেহ কেহ রেলিঙের ধারে দাঁড়িয়ে রূপো-বাঁধা হুকায় তামাক খাচ্ছে, কেহ কেহ রেলিঙের উপর বুক রেখে ভানুমতী-ধরণের মুখ বাড়িয়ে রাস্তার দিকে ঝুলছে; কারো বুকে রংদার কাঁচলী, কারো কারো মুখে রংমাখা, কারো খোঁপা নাই, পৃষ্ঠদেশে দীর্ঘবেণী, কেহ কেহ এলোকেশী। কারা এরা? লোকমুখে শুনেছিলেম, কলিকাতা সহরে বেশ্যা অনেক; যে সকল পণ্ডিত সাধু ভাষায় কথা কন, তাঁরা বলেন, বেশ্যা মানে নগরবিলাসিনী বারাঙ্গনা; সুখবিলাসী মতিচ্ছন্ন যুবাদলের চিত্তমোহিনী-বিলাসিনী; এরা সব জঘন্য বিলাস-রসিক যুবাপুরষের ইহকাল পরকাল ভক্ষণ করে। চিৎপুর রোডে দাঁড়িয়ে পূর্ব্বের সেই শোনাকথাটা আমার মনে পোড়লো; স্থির কোল্লেম, এরাই তবে সেই সকল যুবকনাশিনী বিলাসিনী বারাঙ্গনা। দেখেই আমি চোমকে উঠলেম। সৰ্ব্বশরীরে কাঁটা দিলে। নগরের বিলাসিনীরা স্বী-জাতিসূলভ লজ্জাসরমের মস্তকে পদার্পণ কোরে, হেসে হেসে সদররাস্তার ধারে বাহার দিচ্ছে। আকার-অবয়বে ঠিক মানবী, কিন্তু ব্যবহারে এরা দানবী—পিশাচী! কলিকাতা সহর কলুষে পরিপূর্ণ! সিঁতিকাটা, গন্ধমাখা, সাজপরা ফলবাবুরা রাস্তা দিয়ে চোলে যাচ্ছেন, চক্ষু আছে উর্দ্ধ দিকে। বারান্দার চক্ষুরা তাঁদের দিকে ঘুরে ঘুরে ঘন ঘন কটাক্ষবাণ সন্ধান কোচ্ছে। সহরের একজন পক্ষীকবি এই সব কাণ্ড লক্ষ্য কোরে এক মজলীসে বোলেছিলেন, “বারান্দার ঐ চক্ষগুলি পাখীধরা ফাঁদ; পুরুষের মন মাতাবার মোহনমন্ত্রের বাঁশী?” আমারো মনে হলো, যথার্থই তাই!

চিৎপররোড এই সকল ফাঁদে আচ্ছন্ন। এ রাস্তাটায় গৃহস্থলোকের বাস একেবারে নাই বোল্লেই হয়। থাকলেই বা কি হতো? কলিকাতার বেশ্যানিবাসের প্রণালীটী অতি জঘন্য। গৃহস্থের বাড়ীর কাছে বেশ্যা, ছেলেদের পাঠশালার পাশে বেশ্যা, ডাক্তার-কবিরাজের আবাসের পাশে বেশ্যা, কোথাও বা ভালমানুষের মাথার উপর বেশ্যা; অধিক কথা কি, ব্রাহ্মসমাজ-মন্দিরের আষ্টেপৃষ্ঠে বেশ্যা। যে সহরের এমন দশা, সে সহরের পরিণাম কি হবে, সহরবাসী ভদ্রলোকেরা সেটা কি একবারও চিন্তা করেন না? ইংরেজীতে যাঁরা যাঁরা পণ্ডিত হয়েছেন, সগৌরবে তাঁরা মুক্তকণ্ঠে বলেন, “যেখানে সহর, সেই খানেই পাপ। সহরমাত্রেই বেশ্যা বেশী, মদ বেশী, বদমাস বেশী, রাজধানীতে আরো বেশী। রাজধানীতেই পাপের রাজত্ব। এ সকল পাপের নাম উপকারী পাপ; প্রয়োজনীয় পাপ। এ সকল পাপ না থাকলে কোন দেশেই সহর চলে না।”

চলাই ভাল। সৰ্ব্বনাশকর পাপের অভাবে সহর যদি না চলে, তবে সহরে আমাদের কাজ কি? সহরের উপর আমার ঘৃণা হলো। কলিকাতায় আর বেশী দিন থাকবো না, মনে মনে এইরুপ প্রতিজ্ঞা কোল্লেম। পথিক পুরষেরা রাস্তা দিয়ে চোলে যায়, বারান্দার দিকে চক্ষু থাকে, উপরে নীচে রসিকতা বর্ষে, গাড়ী-ঘোড়ার ধাক্কায় আছাড় খেয়ে হাত-পা ভাঙতে পারে, তেমন তেমন হোলে, প্রাণ যেতেও পারে, সে দিকে ভ্রূক্ষেপও থাকে না। এমন সহরে কি থাকতে আছে? কখনই থাকবো না। মনের ঘৃণায় এইরুপ সঙ্কল্প কোরে বাড়ীর দিকে আমি ফিরে চোল্লেম।

বীরভূমের নরহরিবাবু যে বাড়ীতে ছিলেন, সেই বাড়ীর সম্মুখ দিয়ে আমার মনিববাড়ী যেতে হয়। সেই পথ দিয়ে আমি যাচ্ছি, দেখলেম, সেই বাড়ীর দরজা খোলা। মনে কোল্লেম, নরহরিবাবু এসেছেন। সূৰ্য্য তখনও অন্ত যান নাই, অল্প অল্প বেলা ছিল, আশায় আশায় সেই বাড়ীর ভিতর আমি প্রবেশ কোল্লেম; উপরে গিয়ে উঠলেম; দুই-একজন চাকর আমার সম্মুখ দিয়ে চোলে গেল, আমাকে দেখে কিছুই বোল্লে না, আমিও কিছু জিজ্ঞাসা কোল্লেম না; সরাসর একটা ঘরের ভিতর প্রবেশ কোল্লেম। ঘরে একখানি চেয়ারের উপর একটী বাবু। বেশ বাবুটী। দিব্য সপুরষ। বাবরী চল, দিব্য গোঁফ, দিব্য চক্ষু, দিব্য বুকের ছাতি, বয়স অনুমান ত্রিশ বৎসর। আমারে দেখেই বাবু চকিতস্বরে জিজ্ঞাসা কোল্লেন, “কে তুমি? কি চাও?”

বাটীর ভাবভঙ্গী আর কণ্ঠস্বর যে প্রকার, দেখলে শুনলে উত্তর কোত্তে ইচ্ছা হয় না, তথাপি আমি ধীরে ধীরে উত্তর কোল্লেম, “চাই না কিছু,, আমি হরিদাস; নরহরিবাবু এসেছেন কি না, জানতে এসেছি।”

পূৰ্ব্ববৎ তীব্রস্বরে বাবু বোল্লেন, “কেন? তার কাছে তোমার কি দরকার? তিনি এখন আসবেন না, পৌষমাসের শেষে আসবেন।”

আর আমি কথা কইলেম না, সেখানে আর দাঁড়ালেমও না, তৎক্ষণাৎ বেরিয়ে এলেম। সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছি, একজন চাকর উপরে উঠছিল, তারে জিজ্ঞাসা কোল্লেম, বাবুটীর নাম কি? চাকর বোল্লে, কানাইবাবু, বীরভূমের বানেশ্বরবাবুর ভাগ্নে।

শিউরে উঠে অবাক হয়ে আমি নেমে এলেম। তখন আমার মনে যে কি ভাবের উদয় হলো, অন্তর্যামীই জানতে পাল্লেন। সূর্য্যাস্তের পূর্ব্বেই আমি মনিববাড়ীতে এসে পৌঁছিলেম। কোজাগরপূর্ণিমা। পাড়ার একজন আত্মীয়ের বাড়ীতে মা লক্ষ্মীর প্রতিমা হয়, নিমন্ত্রণ আছে, প্রদোষেই পূজা, বাবুরা সেই বাড়ীতে গিয়েছেন, আমি এসে বড়বাবুর বৈঠকখানায় বোসলেম। ভাবনা আমাকে পরিত্যাগ কোরে যেতে চায় না। অন্যমনস্ক হবার জন্য যতই চেষ্টা করি, ততই নূতন নূতন ভাবনা এসে জোটে। মিছামিছি পরের জন্য কেন ভাবনা, তাও আমি বুঝতে পারি না। নরহরিবাবুর তত্ত্ব নিতে গিয়ে শুনে এলেম, কানাইবাবু। মনটা ঝাঁৎ কোরে উঠলো। যে রাত্রে আমি মেয়েমানুষ সেজে পালাই, নূতন লোকের হাতে ধরা পড়ি, সেই রাত্রে বাণেশ্বরবাবুর চাকরেরা হাসির তুফান তুলে যে কানাইবাবুর নাম কোরেছিল, এই সেই কানাইবাবু! ইনি বাণেশ্বরবাবুর ভাগ্নে হন, ইনি আপন মাতুলকন্যাকে কুলকলঙ্কিনী কোরেছেন, অন্যলোকের দ্বারা কৌশলে সেই কন্যাটিকে ঘরের বাহির কোরেছেন! সে রাত্রে সেখানে কানাইবাবুকে আমি দেখি নাই, কলিকাতায় দেখলেম। মুখের ভাব আর কথার ভাব যে রকম, তাতে কোরে বিশ্বাস হলো, সত্যই তিনি সেই পাপকার্য্যের নায়ক। বাহাদুর পুরুষ বটে! নায়িকাটীকে কলিকাতায় এনেছেন কি না, বলা যায় না; অনুমানে বোধ হয়, এনে থাকবেন। কলিকাতা সহর যে রকম জায়গা, ঐ প্রকার কার্য্যের সুবিধাই এখানে বিস্তর। কে কোথায় কি ভাবে আছে, কি ভাবে থাকে, অন্যলোকে কিছুই জানতে পারে না; পোষাক-পরিচ্ছদে, কথার আলাপে, বাহিরে বেশ ভদ্রলোক, ভিতরে ভিতরে নরককুণ্ড!

এই সব আমি ভাবছি, বড়বাবু এলেন; এসেই আমারে সঙ্গে কোরে নিয়ে পূজাবাড়ীতে গেলেন। লক্ষ্মীপূজা দেখা হলো, সেইখানে মা লক্ষ্মীর প্রসাদ পাওয়া হলো, বাড়ী আসা হলো না। রাত্রে সেই বাড়ীতে লক্ষ্মী-মঙ্গল যাত্রা ছিল, সমস্ত রাত্রি আমরা সেই যাত্রা শুনলেম। কোজাগরের নিশা-জাগরণে লক্ষ্মীবৃদ্ধি হয়, যাত্রার কল্যাণে আমাদের বেশ আমোদ-আহ্লাদে পুর্ণিমার যামিনী পরিযাপিত হলো।

প্রভাতে বাবুদের সঙ্গে আমি বাড়ী এলেম। স্নানাহারাতে রাত্রিজাগরণের ক্লান্তিরকরণার্থ বাবুরা নিদ্রা গেলেন, আমার নিদ্রা নাই। দিবানিদ্রায় দোষ আছে, সেইজন্য আমি দিনমানে নিদ্রা যাই না, পাঠকমহাশয় এমন কথা মনে কোরবেন না শরীর রক্ষার শাস্ত্রসম্মত নিয়মগুলি পালন আমার মত পরিব্রাজকের পক্ষে অসম্ভব; সকল দিন রাত্রিকালেই বেশীক্ষণ নিদ্রা হয় না, দিনমানে নিদ্রা তো বহু দুরের কথা। কেন এমন হয়? যার হৃদয়ে অহরহঃ চিন্তা-রাক্ষসী খেলা করে, যার মনে অজ্ঞাতকারণে সদাসৰ্ব্বদা নানা আশঙ্কা, একটা আশ্রয়হারা হোলে রজনীপ্রভাতে কোথায় যাব, কোথায় গিয়ে দাঁড়াবো, যার মনে প্রতি রজনীতে এই দুঃসহ অনিশ্চিত ভাবনা, তার প্রতি কি বিরামদায়িনী নিদ্রাদেবীর অনুগ্রহ হয়? আমার অবস্থাও সেইরুপ। আমার প্রতি নিদ্রাদেবীর কৃপা হয় না, সেই জন্য আমার নিদ্রা নাই।

আমি জেগে আছি। বড়বাবুর বৈঠকখানার সম্মুখদিকের একটী দরজা খোলা আছে, তক্তপোষের বিছানার ধারে সেই দরজার কাছে আমি বসে আছি। বেলা প্রায় পাঁচটা। আশ্বিনমাসে বেলা যখন পাঁচটা বাজে, তখন ঠিক এক ঘণ্টা বেলা থাকে। সেই ঘরেই বড়বাবু নিদ্রিত; তখনো নিদ্রাভঙ্গ হয় নাই। সহসা “বৃন্দাবন গোবর্দ্ধন-কুঞ্জকানন বিহারী। বংশীবদন রাধিকারমণ শ্রীমকুন্দ মুরারি॥” উচ্চকণ্ঠে এইরূপ গান কোত্তে কোত্তে পাঁচজন সন্ন্যাসী সেইখানে এসে দাঁড়ালো। সন্ন্যাসিদের চীৎকারধ্বনিতে বড়বাবুর নিদ্রাভঙ্গ হয়ে গেল; তাড়াতাড়ি চক্ষু মুছতে মুছতে তিনি বিছানার উপর উঠে বোসলেন। বাবুকে দেখে সন্ন্যাসীরা কত রকম ভঙ্গীতে কত কথাই বোলতে লাগলো, কত রকম সুরে শ্রীরাধাবল্লভের কত রকম ভজন-গীত গাইতে লাগলো, সব কথা আমি মনে কোরে রাখতে পাল্লেম না; একদৃষ্টে কেবল সন্ন্যাসিদের আকার-অবয়ব আর চমৎকার ভাবভঙ্গী দর্শন কোত্তে লাগলেম।

পঞ্চ সন্ন্যাসী। পাঁচজনেই প্রায় সমবয়স্ক; কারো বয়ঃক্রম ত্রিশ বৎসরের অধিক বোধ হলো না। দুজন গৌরবর্ণ, দুজন শ্যামবর্ণ, একজন কৃষ্ণবর্ণ। লক্ষণে বুঝলেম, তারা পাঁচজনেই কৃষ্ণ-সন্ন্যাসী। সচরাচর সন্ন্যাসিদের দুই শ্রেণী;—শিব-সন্ন্যাসী আর কৃষ্ণ-সন্ন্যাসী। পথে পথে যারা বেড়ায়, তাদের মধ্যে শিব-সন্ন্যাসীই অধিক, কৃষ্ণ-সন্ন্যাসী অল্প; লক্ষণও ভিন্ন ভিন্ন। শিব-সন্ন্যাসীরা শিব সাজবার ভাব দেখায়; সৰ্ব্বাঙ্গে ভস্ম মাখে, মস্তকে জটা রাখে, রঙ দিয়ে মুখ-চক্ষু চিত্র করে, বাঘছাল পরে, বাঘছালের বদলে কেহ কেহ কৌপীন ধারণ করে, কেহ কেহ উলঙ্গ। শিব ত্রিশূলধারী, ত্রিশূলের বদলে সন্ন্যাসীর দক্ষিণ হস্তে দণ্ড ধরে, ডমরুর বদলে বামহন্তে কমণ্ডলু; এক একজনের হাতে গলায় রুদ্রাক্ষমালা, এক একজনের মালাভরণ থাকে না। মুখে থাকে হর্ হর্ বম্ বম্। ভেকধারিদের অনেক রকম ভেক থাকতে পারে, তিনটী মাত্র অভাব থাকে। মহাদেবও ত্রিনয়ন, চন্দ্ৰ সূৰ্য্য হুতাশন, মহাদেবের কণ্ঠে হলাহল, মহাদেবের অঙ্গে মস্তকে বিষধর সর্প। সন্ন্যাসীরা কপালের উপর চক্ষু ফুটাতে অক্ষম, বিষ খেয়েও নীলকণ্ঠ হোতে অক্ষম, ফণী ধারণ কোরে ফণিভূষণ হোতেও অক্ষম। রোগা রোগা সন্ন্যাসী ছাড়া মোটা মোটা সন্ন্যাসীরা ভোলানাথের মত ভুড়ি বাড়াবারও চেষ্টা করে।

কৃষ্ণ-সন্ন্যাসী সে রকম নয়। শ্রীকৃষ্ণের অনুকরণে কেহ কেহ ইচ্ছা রাখে, সর্ব্বাংশে কৃতকার্য্য হয় না। কৃষ্ণ-সন্ন্যাসী জটা রাখে না, ভস্ম মাখে না, বাঘছাল পরে না, রুদ্রাক্ষ ধরে না, সে ভাবের কিছুই করে না। জটার বদলে স্ত্রীলোকের মত দীর্ঘ দীর্ঘ কেশ কপালের উপর খোঁপার আকারে চড়া কোরে বাঁধা (অভাব ময়রপুচ্ছের), ভস্মবিভূতির বদলে সৰ্ব্বাঙ্গে হরিমৃর্ত্তিকার ছাপকাটা, বাঘছালের বদলে গেরুয়া, বহির্বাসের বদলে গৈরিক নামাবলী, কেহ কেহ কৌপীনধারী, বাঁশরীর বদলে গোপীযন্ত্র, কেহ কেহ শূন্যহস্ত, রুদ্রাক্ষের বদলে তুলসীমাল্য, কেহ কেহ শূন্যকন্ঠ। শিব-সন্ন্যাসীরা গাঁজা খায়, কৃষ্ণ-সন্ন্যাসীরা প্রায়ই গাঁজা খায় না। দুই দলে এই সকল প্রভেদ। দুই দলের মধ্যে ভণ্ডসন্ন্যাসী অনেক, আমি ছেলেমানুষ, আমি সে পরিচয় না দিলেও বহুদর্শী বিজ্ঞ পাঠকমহাশয়েরা মনে অবশ্যই সে বিষয়ের নিগুঢ় তত্ত্ব বুঝতে পারবেন। মহাপ্রভু চৈতন্যদেবের প্রসাদে যাঁরা কৌপীনধারী বৈষ্ণব, তাঁরা এই কৃষ্ণ-সন্ন্যাসিগণের অন্তর্গত কি না, সে বিচারেও আমি অসমর্থ।

আমাদের সম্মুখে পঞ্চ সন্ন্যাসী। বাহ্যলক্ষণে পাঁচজনেই কৃষ্ণ-সন্ন্যাসী। সন্ন্যাসীগুলির রূপ ভাল। যে দুটী গৌরবর্ণ, তাদের চেহারা আরো বেশী সুন্দর। আমাদের বড়বাবু শক্তিভক্তির সঙ্গে সনাতনী বিষ্ণুভক্তি হৃদয়ে ধারণ করেন, বাড়ীতে সাধু-সন্ন্যাসী দর্শন দিলে আদরযত্নে তিনি তাঁদের সেবা করেন, কৰ্ত্তাও তাতে উৎসাহ দেন। সন্ন্যাসিদের উপর ছোটবাবু বড় চটা। ছোটবাবু সেদিন তখন সেখানে ছিলেন না, বড়বাবু আমোদ কোরে সন্ন্যাসিদের গান শুনেলেন, শ্লোক শুনলেন, বৃন্দাবন-মথুরার গল্প শুনলেন, শুনে শুনে খুসী হয়ে পাঁচজনের হাতে পাঁচটী টাকা দিলেন; সন্ন্যাসীরা মিলিতকণ্ঠে আশীৰ্ব্বাদ বর্ষণ কোল্লে।

টাকা বড় চমৎকার জিনিস। “লোভের নিকটে যদি ফাঁদ পাতা যায়, পশু পক্ষী সাপ মাছ কে কোথায় এড়ায়?” কবিবর ভারতচন্দ্রের এই কটী কথা অখণ্ডনীয়। পাঁচ টাকা হাতে পেয়ে সন্ন্যাসিদের লোভ বেড়ে উঠলো; তখন আপনাদের বেশী বেশী গুণপনা জাহির কোত্তে আরম্ভ কোল্লে। এ ধরণের সন্ন্যাসিদের যেমন যেমন দস্তুর সেই রকমে একজন সন্ন্যাসী বোলতে লাগলো, “হরেক রকম ঔষধ রাখি। বন্ধ্যা নারীর সন্তান হয়, তামা ছুঁলে সোণা হয়, সোণা ছুঁলে হীরা হয়, বেদামী জিনিস যা কিছু দিবে, তার বদলে বহুতর মহামূল্য জিনিস পাবে, বড় বড় চিকিৎসকেরা মানুষের যে সকল ব্যাধি অসাধ্য বলে, একদিনের মধ্যে সে সকল ব্যাধি আমরা নির্ম্মূল কোরে দিতে পারি। আমাদের ঔষধের গুণে হারানিধি পাওয়া যায়, নিরুদ্দেশ প্রবাসী ঘরে আসে, অপ্রিয়জন প্রিয় হয়, অবাধ্যের বশীভূত হয়, রাগী লোক ঠাণ্ডা হয়, ব্যবসাবাণিজ্যে প্রচুর লাভ হয়, ঘরে লক্ষ্মী বাঁধা থাকেন।” ইত্যাদি ইত্যাদি।

কলিকাতা সহরে এ সকল বুজরুকী বড় একটা খাটে না, তথাপি মেয়েমহলে খুব খাটে। সন্ন্যাসীর কথা শুনে বড়বাবুর মুখের ভাব আর এক প্রকার হয়ে এলো; মনে যেন ঘৃণা জন্মিল; তাচ্ছল্যভাবে তিনি বোল্লেন, “হাঁ, হাঁ, দ্রব্যগুণে সব হয়, দেবতাদের কৃপায় সব সিদ্ধ হয়, ভগবানের সৃষ্টিতে কিছুই অসম্ভব নয়। আর একদিন আসবেন, একটা একটা পরীক্ষা কোরে দেখা যাবে।”

ফুল্লমুখে জয় উচ্চারণ কোরে সন্ন্যাসীরা বিদায় হলো, সে দিন আর অন্য ঘটনা কিছুই হলো না। বাবুরাও কোথাও গেলেন না, আমিও কোথাও বেরুলেম না। লক্ষ্মীবিসর্জ্জনে ঘটা হয় না, দূরে দূরে দুই একটা বিসর্জ্জনের বাদ্যধনি শুনা গেল, তার পর সমস্তই চুপচাপ। নিয়মিত কাৰ্য্যান্তে নিদ্রা, নির্ব্বিঘ্নে রজনীপ্রভাত।

সন্ন্যাসীরা নিত্য নিত্য দেখা দেয়, নাচে, গায়, শ্লোক পড়ে, কেচ্ছা ঝাড়ে, নিত্যই নূতন রঙ্গ। এক বাড়ীতে নয়, পাড়ায় পাড়ায় দশবাড়ীতে বেড়ায়, যেখানে সুবিধা পায়, সেইখানে বুজরুকী জানায়, শক্তলোকের কাছে জায়গা পায় না। লক্ষ্মীপূজার পর এই রকমে একমাস কেটে গেল। স্মরণ কোত্তে পারা যায়, এই একমাসের মধ্যে তেমন বিশেষ ঘটনা কিছুই হলো না। আমি শীঘ্র শীঘ্ৰ কলিকাতা-পরিত্যাগের সঙ্কল্প কোরেছিলেম, বাড়ীর পরিবারদের অনুরোধে ক্রমশই বিলম্ব হোতে লাগলো। একদিন সকালবেলা বাড়ীর সম্মুখের রাস্তায় সবে মাত্র আমি বেরিয়েছি, খানিক দূরে ভারী একটা গোল মাল উঠলো। কিসের গোলমাল, কিছুই ঠিক কোত্তে পাল্লেম না। রাস্তা দিয়ে অনেক লোক ছুটে ছুটে যাচ্ছে, “কোথায় খুন?—কোথায় খুন?—কোন বাড়ীতে খুন?” এই সব কথা বলছে আর ছুটছে। খুনের কথায় ভয় পেয়ে ছুটে আমি বাড়ীর ভিতর চোলে গেলেম, বাবুদের কাছে সেই সব কথা বোল্লম। লোকের বিপদে সম্পদে অগ্রসর হওয়া বড়বাবুর চিরদিন অভ্যাস, শশব্যস্তে তিনি একটা জামা গায়ে দিয়ে উদ্বিগ্নচিত্তে বাড়ী থেকে বেরুলেন; জামার বোতাম দিবার অবসর হলো না, যেদিকে গোলমাল হোচ্ছিল, রাস্তার লোকেরা যেদিকে ছুটছিল, অত্যন্ত দ্রুতপদে তিনি সেই দিকে যেতে লাগলেন। তখন একটু সাহস পেয়ে আমিও তাঁর পশ্চাৎ পশ্চাৎ চোল্লেম।

ভয়ঙ্কর ব্যাপার! যে বাড়ীতে লক্ষ্মীপূজা হয়েছিল, সেই বাড়ীর দরজার সম্মুখেই ভয়ঙ্কর গোলমাল। বহুলোক একত্র জমায়েত, পুলিশ জমায়েত, রৈ রৈ কাণ্ড! সেই বাড়ীতেই খুন! অন্দরমহলে কর্ত্তার একটী কন্যার ঘরে রেতের বেলা খুন হয়েছে! কি রকমে কি হলো, কিছুই ঠিকানা হোচ্ছে না।

অগ্রে একটু পরিচয় আবশ্যক, তার পর খুনের বৃত্তান্তটা আলোচনা করা যাবে। বাবুর নাম বিশ্বেশ্বর চক্রবর্ত্তী। বিশ্বেশ্বরবাবুর এক পুত্র, তিন কন্যা। পুত্রের নাম হরিবিলাস, কন্যাদের নাম নিতম্বিনী, কাদম্বিনী, সৌদামিনী। তিনটী কন্যাই বিবাহিতা, তিনটীই সধবা। সৌদামিনী সৰ্ব্বকনিষ্ঠা। সৌদামিনী পর্ণযুবতী, দিব্য সুন্দরী, বয়স ১৮/১৯ বৎসর। বিবাহ হয়ে অবধি সৌদামিনী কখনো শ্বশুরবাড়ী যায় নাই। পূৰ্ব্বদেশে শ্বশুরবাড়ী; শ্বশুর গরিব, স্বামী মুর্খ, তাতে দূরদেশ, এই কারণেই সৌদামিনী চিরদিন বাপের বাড়ীতেই থাকে। বৎসরে দুই একবার স্বামী আসে, মান পায় না, আদর পায় না, দু-পাঁচদিন থেকেই চোলে যায়। সৌদামিনীর সন্তান হয় নাই, কিন্তু সন্তানকামনায় সৌদামিনী অনেক রকম ব্রত করে, ঠাকুরদেবতাদের কাছে মানতি করে, নানা রকম ঔষধ খায়, সন্তান হয় না। সেই সৌদামিনীর ঘরেই খুন হয়েছে!

কর্ত্তার জ্যেষ্ঠ পুত্র হরিবিলাসবাবু বেহার অঞ্চলের একজন মুন্সেফ, দুর্গাপূজার ছুটীতে বাড়ী এসেছিলেন, শ্যামাপূজার পরেই চোলে গিয়েছেন। বাড়ীতে কোজাগর-লক্ষ্মীপূজা হয়, সেই উপলক্ষে নিতম্বিনী আর কাদম্বিনী আশ্বিনমাসে পিত্রালয়ে এসেছিলেন, লক্ষ্মীপূজার পরেই চোলে গিয়েছেন। বিশ্বেশ্বরবাবুর স্ত্রী নাই, সুতরাং সৌদামিনীই এখন এই বাড়ীর গৃহিণী। সঙ্গিনী কেবল একজন দাসী আর একজন পাচিকা ব্রাহ্মণী। বিশ্বেশ্বরবাবু তাদৃশ বড়মানুষ নন, মধ্যবিত্ত ও গৃহস্থ মাত্র, পুত্রের উপার্জ্জনেই সংসার চলে, সম্ভবমত ক্রিয়াকর্ম্ম হয়। রাত্রিকালে মেয়েমানুষের ঘরে খুন, ভয়ানক ব্যাপার!

পুলিশের তদন্ত আরম্ভ হয়েছে। পুলিশের লোকেরা বাজে দর্শকগণকে তাড়াহুড়া দিয়ে তফাত কোরে দিচ্ছে, সেই সময় আমরা গিয়ে উপস্থিত হোলেম। আমাদের বড়বাবুটী পুলিশের লোকের চেনা, বাড়ীর ভিতর যেতে তারা তাঁকে বারণ কোল্লে না, আমি বড়বাবুর সঙ্গেই গিয়েছিলেম, বাবুর খাতিরে অবাধে আমিও যেতে পেলেম; গিয়ে শুনলেম, সৌদামিনীর ঘরে একজন সন্ন্যাসী খুন হয়েছে।

যে পাঁচটা সন্ন্যাসী মাসাবধি নেচে গেল, বজুরুকী জানিয়ে জোড়াসাঁকো পল্লীতে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছিল, যাদের আমি ইতিপর্বে কৃষ্ণ-সন্ন্যাসী বোলে বর্ণনা কোরেছি, কাটা পোড়েছে, তাদের মধ্যে একজন। সন্ন্যাসীদের নাম সৰ্ব্বদা প্রকাশ হয় না, কিন্তু এ সন্ন্যাসীর নাম পাওয়া গিয়েছে, সৌদামিনীই নাম বোলেছে। সৌদামিনী গৃহস্থকন্যা, সন্ন্যাসীর সঙ্গে তার কিসের আলাপ, সৌদামিনী কি প্রকারে সন্ন্যাসীর নাম জানতে পাল্লে, সে কথাও একটু বলা দরকার। সৌদামিনী পুত্রকামনা করে, মহাপুরুষ সন্ন্যাসী এসেছে, বন্ধ্যানারীকে ছেলে দেয়, বোবালোকের কথা ফুটায়, অসাধ্য ব্যাধি আরাম করে, কাঁসাপিতলকে সোণা করে, এই সকল গুণের পরিচয় শুনে পিতাকে বোলে কোয়ে সন্ন্যাসীকে অন্দরমহলে নিয়ে গিয়েছিল, সৌদামিনীর রূপ দেখে সন্ন্যাসী মোহিত হয়, হাত দেখে মুখ দেখে, কপালের রেখা দেখে সন্ন্যাসী বলে, তোমার ভাগ্য ভাল, তুমি তিন পুত্রের জননী হবে। তোমার জন্য আমি একটী যজ্ঞ কোরবো, সে যজ্ঞ সাতদিনে পূর্ণ হয়, যজ্ঞস্থলে তোমাকে উপস্থিত থাকতে হবে, তোমাদের বাড়ীর ভিতরেই যজ্ঞকুণ্ডু প্রতিষ্ঠা কোরবো। সৌদামিনী সেই কথা পিতাকে বলে, বিশ্বেশ্বরবাবু বৃদ্ধ, বুদ্ধির ভিতর কোন রকম মার-পেঁচ খেলে না, সাধু-সন্ন্যাসীর উপর ভক্তিও আছে, মনে কোন প্রকার দ্বিধা না কোরে তিনি সম্মত হয়েছিলেন, যজ্ঞ আরম্ভ হয়েছিল। নিশাকালেই যজ্ঞ! হোমকুণ্ড-সমীপে চন্দনচর্চ্চিত হয়ে, তুলসীমাল্য ধারণ কোরে, কপালের উপর চুড়াবাঁধা খোঁপাটা এলিয়ে পৃষ্ঠের দিকে ফেলে, সেই কৃষ্ণ-সন্ন্যাসী যজ্ঞ কোত্তে বোসতো, পাশে থাকতো সৌদামিনী। প্রথম রাত্রে যখন সঙ্কল্প হয়, তখন উভয়ের নামে মন্ত্রপাঠ করা হয়েছিল, তাতেই সৌদামিনী শুনেছিল;—শুনেছিল আর জেনেছিল, সন্ন্যাসীর নাম রমাই সন্ন্যাসী। পুলিশের লোক সেই নামটা লিখে নিয়েছে। যজ্ঞ কিন্তু পূর্ণ হয় নাই, দুদিন বাকী ছিল, পঞ্চম রজনীতেই কৰ্ম্ম ফর্সা! বৃহৎ একখানা বটীর আঘাতে রমাই সন্ন্যাসীর প্রাণপক্ষী ছট ফট কোরে বেরিয়ে গিয়েছে; ভেঙে দুখানা হয়ে হোমকুণ্ডের ধারে দেহপিঞ্জরটা পোড়ে আছে। রক্তমাখা বটীখানাও কুণ্ডের কাছে পাওয়া গিয়েছে। একঠাঁই সন্ন্যাসীর মুণ্ড, একঠাঁই ধড়। এক কোপে গলাকাটা।

শুনলেম, এই খুনের ব্যাপারে পুলিশের লোক হতবুদ্ধি। এরকমে খুন কোল্লে কে, কিছুই তারা অনুমান কত্তে পারে না। বাড়ীতে অন্যলোক থাকে না, পুরুষের মধ্যে বৃদ্ধ কৰ্ত্তা বিশ্বেশ্বর, তিনি হরিনামের মালা ঘুরিয়ে পরমার্থ চিন্তা করেন, মালাজপের সময়েও তাঁর হাত কাঁপে, তিনি সন্ন্যাসী খুন কোরবেন, অসম্ভব কথা। তবে কে? সৌদামিনী ব্রতবতী, সৌদামিনীর মঙ্গলের জন্যই আগমন, সন্ন্যাসীর প্রতি সৌদামিনীর অচলা ভক্তি, সৌদামিনী খুন কোরেছে, এরূপ অনুমান করা নিতান্ত অৰ্ব্বাচীনের কার্য্য। তবে কে? দাসী আর পাচিকা। যে রকমে এক চোটে গলাকাটা, সে রকমে খুন করা স্ত্রীলোকের অসাধ্য; বিশেষতঃ স্ত্রীলোকে সন্ন্যাসী কাটে, সচরাচর এ কথা শুনা যায় না। বাকী কেবল একজন। কৰ্ত্তার একজন পুরাতন চাকর। সে চাকর প্রায় পঞ্চাশ বৎসর এই বাড়ীতে আছে, সে লোকটাও কৰ্ত্তার সমবয়স্ক তার নাম গঙ্গারাম। তার প্রতি সন্দেহ করাও নিতান্ত ভুল; এই জন্যই পুলিশ হতবুদ্ধি। শেষে তারা স্থির কোরেছে, বাহিরের লোকেই কেটে গিয়েছে। যে লোকটা কেটেছে, সে বড় চতুর। সে জানে, বাড়ীতে কেবল স্ত্রীলোক, দুজন পুরুষ আছে, তারা অথৰ্ব্ব বৃদ্ধ সতরাং স্ত্রীলোকের দ্বারা খুন হওয়াই সকল লোকের সিদ্ধান্ত দাঁড়াবে, এইরুপ বিবেচনা কোরেই ছোরা না চালিয়ে, তলোয়ার না চালিয়ে, বটী দিয়ে কেটেছে। পুলিশের এই আনুমানিক মীমাংসা অনেক লোকের যুক্তিসিদ্ধ বোলে মনে হলো, কিন্তু কে সেই বাহিরের লোক, রাত্রিকালে কোন পথ দিয়ে বাটীর ভিতর এসেছিল, সেটা কিছু ঠিক হলো না। পুলিশের লম্পঝম্প জারিজুরী সচরাচর যেমন হয়ে থাকে, সে সব ঠিক হলো, ঠিক থাকলো, কিন্তু পৰ্ব্বতের প্রসববেদনার ন্যায় শেষ দাঁড়ালো একটা ইঁদুর; আসলকাজ কিছুই হলো না। বড় বড় তদারকে এক একজন পুলিশপুরুষ মনে যেরূপ আশা রাখেন, সে আশাও বিফল হয়ে গেল। রিপোর্ট লেখা হলো, হাসপাতালে লাস চালান হয়ে গেল, সৌদামিনী কাঁদতে লাগলো, বৃদ্ধ কৰ্ত্তা গ্রহশান্তির নিমিত্ত হরিনাম জপ কোত্তে লাগলেন।

কিছুই কিনারা হলো না। দর্শকলোকেরা একে একে ঘরে ফিরে চোল্লো, কেহ কেহ বলাবলি কোত্তে কোত্তে গেল, “হয়েছে ভাল। এই রকম হওয়াই ঠিক। যেই কাটুক, যেই আসুক, ফলাফল এই রকম হওয়াই সংসারের মঙ্গল। সোণাকরা সন্ন্যাসী, ছেলেকরা সন্ন্যাসী, অনেক লোকের সৰ্ব্বনাশ করে, সে দলের সন্ন্যাসীকে বঁটীকাটা করাই সর্ব্বাংশে উত্তম, উপযুক্ত প্রতিফল।” আমিও মনে মনে প্রতিধ্বনি কোল্লেম, উপযুক্ত প্রতিফল। রমাই সন্ন্যাসীর পরিণাম দর্শন কোরে, বড়বাবুর সঙ্গে আমি বাড়ী ফিরে এলেম। সেই অবধি রমাই সন্ন্যাসীর সঙ্গী আর চারিজন সন্ন্যাসীকে একদিনও কোথাও দেখতে পাওয়া গেল না; বোধ হলো, তাদেরও পাছে ঐ রকম বিপদ ঘটে, তারাও ঐ কাজের কাজী, তাদেরও পাছে প্রাণ যায়, সেই ভয়েই তারা সহর ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছে। যেদিনের কথা আমি বোলছি, সেই দিন বৈকালে বিশ্বেশ্বরবাবুদের বাড়ীর দাসী কামিনীর মা আমাদের বাড়ীতে বেড়াতে এসেছিল, কামিনীর মা হাবাগোবা মেয়েমানুষ, বয়সটাও কিছু ভারী, সে এসে আমাদের বাড়ীর কর্ত্তাঠাকুরাণীর কাছে চুপি চুপি কত কথা বলছিল, আমি সেই সময় একটা কাজের জন্য হঠাৎ বাড়ীর ভিতর গিয়েছিলেম। যেখানে তাদের কথা হোচ্ছিল, সেখান পর্য্যন্ত যেতে না যেতেই আমার কাণে এলো, খুনের কথা, আমি একটুকু গা-ঢাকা হয়ে দাঁড়ালেম। আগেকার কথা শুনি নাই, শেষের কথা কেবল এইটুকু শুনতে পেলেম, সৌদামিনীর ঘরে তক্তপোষের নীচে তিনটে মদের বোতল বেরিয়েছে, একটা কাণাভাঙা মাটীর গেলাস আর কতকগুলো ছোট ছোট হাড়; পাঁটার কি মুরগীর কি আর কোন পাখীর হাড়, কে জানে, কিন্তু বেরিয়েছে, একটা বোতলে খানিকটা মদ ছিল। সন্ন্যাসীটা মদ খেতে। বোধ হয়, সৌদামিনীও খেয়েছে!

শুনেই আমি সেখান থেকে ধাঁ কোরে সোরে এলেম, যে কাজের জন্য গিয়েছিলেম, সে কাজটা তখন আর সারা হলো না; কেন না, গৃহিণীর কাছেই দরকার, তাঁদের তখন যে প্রকার গুপ্তকথা হোচ্ছিল, তখন সেখানে দেখা দেওয়াটা দোষ, তাই ভেবেই সোরে পোড়লেম; বড়বাবুর বৈঠকখানায় এসে বোসে পূৰ্ব্বাপর সেই কথাই মনে মনে তোলাপাড়া কোত্তে লাগলেম। কিছুই বিচিত্র নয়। সন্ন্যাসীর দলে ভণ্ডসন্ন্যাসীই বিস্তর দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করে, কিন্তু কোন প্রকার কুকাৰ্য্য তাদের বাকী নাই। কথার ছলনে মেয়েমানুষ ভুলায়, মেয়েমানুষের সঙ্গে নির্জ্জনে কথা কয়, একসঙ্গে নির্জ্জনে থাকে, ছেলে হবার ঔষধ দেয়, এ সব কাজ যারা কোত্তে পারে, তারা কি একটু মদ খেতে পারে না? কি তারা পারে না? সন্ন্যাসীরা গৃহস্থের ঘটী-বাটী চুরি করে, সোণা করার লোভ দেখিয়ে কৌশলে সৰ্ব্বস্ব চুরি করে, ভদ্রলোকের জাতিকুল নষ্ট করে, কি তারা করে না? ছেলেমানুষ আমি, কিন্তু একবার আমি শুনেছিলেম, ভস্মমাখা একটা শিব-সন্ন্যাসী কোথাকার এক বড়মানুষের সাত দেউড়ীর ভিতর থেকে একটী টকটকে বউ বাহির কোরে নিয়ে কোন দেশে পালিয়ে গিয়েছিল।

সন্ন্যাসিদের উপর আমার ঘৃণা ছিল, সে ঘৃণাটা আরো বেড়ে উঠলো। কেবল সন্ন্যাসীর উপরে কেন, সহরের উপরেই ঘৃণা বাড়লো। কলিকাতায় আর থাকা হবে না, এ অঞ্চলে আর থাকবো না, পশ্চিমদেশে চোলে যাই; সে দেশে অনেক তীর্থস্থান আছে, সম্পর্কশূন্য উদাসীন নিরাশ্রয় আমি, তীথে তীর্থে দেবদর্শন কোরে, যেখানে সেখানে ঘুরে বেড়াবো। সহরেই পাপ, সহরেই দুষ্ক্ৰিয়া, সহরেই মানুষ খুন, সহরেই ব্যভিচার, সহরে থাকা আমার পক্ষে ভাল নয়। আমার মত অবস্থায় সহরে যারা থাকে, মনে হয় কখনই তারা চরিত্র রাখতে পারে না। সব আমি হারিয়েছি, অনেক কষ্টই পেয়েছি, ভগবান রক্ষা করেন, দোহাই ভগবানের চরিত্রটী আমি হারাব না, হারাতে পারবোই না।

অষ্টাহ অতীত হয়ে গেল। কার্ত্তিকমাস শেষ হয়ে গিয়েছে, অগ্রহায়ণমাসের দশবারোদিন অতিক্রান্ত, শীতকাল উপস্থিত। আমার গায়ের কাপড় কিনে দিবার জন্য বড়বাবু আমাকে একদিন চাঁদনীর বাজারে নিয়ে গিয়েছিলেন, একজন দরজীর কাছে আমার গায়ের মাপ দিয়ে জামা তৈয়ারী করবার ফরমাস দিলেন, গায়ের একখানি কাপড় কিনে দিলেন, পাঁচদিন পরে জামা হবে, এইরূপ স্থির হয়ে থাকলো। পাঁচদিন পরে আমি একাকী চাঁদনীর চকবাজারে জামা আনতে যাই, জামা নিয়ে ফিরে আসছি, একটা রাস্তার মোড়ে দেখতে পেলেম, দু-জন লোক হন হন কোরে দক্ষিণদিকে চোলে যাচ্ছে। যেদিকে আমি ছিলেম, সেদিকে তারা চাইলে না, আপনা আপনি গল্প কোত্তে কোত্তে আমার পাঁচ হাত তফাৎ দিয়েই চোলে গেল। সৰ্ব্বদাই আমার মনে কেমন একপ্রকার আতঙ্ক; সেই দুটো লোককে দেখে আতঙ্কে আমার বুক কেঁপে উঠলো। দুজনের মধ্যে একজন সেই কালান্তক কুব্জ রাক্ষস রক্তদন্ত!

ও বাবা! রক্তদন্তটা এখানে পর্য্যন্ত এসেছে। তবে তো আমার আর নিস্তার নাই! কার-মুখে হয় তো শুনেছে, আমি কলিকাতায় আছি, তাই শুনেই হয় তো আমাকেই খুঁজতে বেরিয়েছে; বীরভূমের লোক কি না, বীরভূমে আমাকে নিয়ে একটা মস্ত কাণ্ড হয়ে গিয়েছে, মুখে মুখে কাণে কাণে সেই কাণ্ডটা হয় তো প্রকাশ হয়ে পোড়েছে, সেই সূত্রেই রক্তদন্ত কলিকাতায় আমাকে ধোরতে এসেছে! এই ভাবনায়, এই ভয়ে, এই সন্দেহে, আমার সৰ্ব্বশরীর কেঁপে উঠলো; এক মুহূর্ত্তও সেখানে আর দাঁড়ালেম না, হেঁটে আসবে মনে কোরেছিলেম, সে সঙ্কল্প পরিত্যাগ কোল্লেম; সঙ্গে টাকা ছিল, একখানা ঠিকাগাড়ী ভাড়া কোরে শীঘ্র শীঘ্র মনিববাড়ীতে এসে পৌঁছিলেম। সারাটা পথ গাড়ীর ভিতর কেবল ভাবনা। ঐ লোক আমার মামা সেজেছিল, ঐ লোক আমাকে বীরভূমে নিয়ে গিয়েছিল, ঐ লোক আমাকে নীলকুঠীতে চালান দিবার পরামর্শ কোরেছিল, ঐ লোক আমাকে প্রাণে মারবার মন্ত্রণা এঁটেছিল, সেই লোক আবার কলিকাতায়। আর আমি কলিকাতায় থাকবো না। আজিই আমি পালাবো। বেলা তখন অতি অল্প ছিল, স্থির কোল্লেম, যোগেযাগে রাত্রিটা কাটিয়ে, ভোরেই আমি পালাবো।

এই সঙ্কল্প স্থির।—একটী কথা পর্বে বলা হয় নাই। যখন আমি প্রতাপবাবুর বাড়ীতে ভর্তি হই, তখন আমার সঙ্গে সম্বল ছিল ৫০১৲ টাকা; —অমরকুমারীর দত্ত এক টাকা, আর নরহরিবাবর দত্ত পাঁচখানি নোটে ৫০০৲ টাকা। প্রতাপবাবুর বাড়ীতে আশ্রয় পেয়ে মাসে মাসে পাঁচটাকা কোরে জলপানী পেয়েছি। সব টাকাগুলি আমি বড়বাবুর কাছে গচ্ছিত রেখেছিলেম। সেই রাত্রে বড়বাবুকে আমি বোল্লেম, বিশেষ প্রয়োজনে কিছুদিনের জন্য আমাকে স্থানান্তরে যেতে হোচ্ছে, গচ্ছিত টাকাগুলি আমায় প্রদান করুন।” বড়বাবু প্রথমে আমাকে স্থানান্তরগমনে নিষেধ কোরেছিলেন, সে নিষেধ আমি মানলেম না;— না গেলেই নয়, বার বার এই কথা বোলে দৃঢ়সঙ্কল্প হোলেম। শেষকালে তিনি আর বাধা দিলেন না, কোন আপত্তিও কোল্লেন না, টাকাগুলি আর নোট-কখানি এনে আমার হাতে দিলেন, আমি নমস্কার কোল্লেম।

রাত্রিকালে নিদ্রা। নামমাত্র নিদ্রায় খানিক রাত্রি অতিবাহিত কোরে, চঞ্চলমনে বিছানার উপর বোসে থাকলেম। রাত্রি কত আছে, জানবার জন্য একএকবার গবাক্ষের কাছে গিয়ে দাঁড়াই, ঠিক কোত্তে পারি না, চঞ্চলপদে ঘরের ভিতর পাইচারী করি, বারম্বার জানালার কাছে যাই, আকাশপানে উঁকি মেরে দেখি, কিছুই ঠিক হয় না। রাত্রে যে ঘরে আমি শুই, সে ঘরে ঘড়ী ছিল না, অন্য ঘরের ঘড়ীর আওয়াজ শুনতে পেলেম না, ক্রমশই চাঞ্চল্যবৃদ্ধি হলো। বেশী রাত থাকতে গৃহস্থবাড়ীর সদরদরজা খুলে রেখে বেরিয়ে যাওয়া দোষের কথা, কৰ্ম্মটা ভাল হয় না; করি কি? বেরুতেও পাচ্ছি না, থাকতেও ভয় হোচ্ছে। প্রভাত হোলে কোনরকম বাধা পোড়তে পারে, খুঁজে খুঁজে সন্ধান নিয়ে রক্তদন্তটাও হয় তো এখানে এসে পোড়তে পারে, করি কি?

রাস্তার দিকে জানালার গরাদে ধোরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছি, পল্লী নিস্তব্ধ, এমন সময় দরবর্ত্তী গির্জার ঘড়ীতে ঢং ঢং শব্দে ছয়টা বাজলো;—স্থির হয়ে, কাণ পেতে, এক এক কোরে আমি গণনা কোল্লেম, ছয়টা। অগ্রহায়ণমাসের রাত্রে ছয়টা বাজবার পরেই ঊষার আগমন;—ঠিক বুঝলেম, ঊষাকাল। দুর্গা দুর্গা বোলে যাত্রা কোল্লেম। কৰ্ত্তার কাছে বিদায় লওয়া হলো না, বাড়ীর মেয়েদেরও কিছু বলা হলো না, ছোটবাবুও কিছু জানতে পাল্লেন না, আমি বিদায় হোলেম, সংক্ষেপে কেবল এইটুকু জানলেন বড়বাবু। জানলেন বটে, কিন্তু কোথায় যে আমি যাব, তা তিনি কিছুই জানতে পাল্লেন না। আমি বিদায় হলেম। দুর্গা—শ্রীহরি! দুর্গা—শ্রীহরি!