হরিদাসের গুপ্তকথাতৃতীয় খণ্ড
যত অল্প সময়ে পৌঁছান যেতে পারে, বিশেষ চেষ্টা কোরে আমরা পাটনা-সহরে পৌঁছিলাম। পাটনার প্রাচীন নাম পাটলীপুত্র। এক সময়ে পাটলীপুত্রের সবিশেষ সমৃদ্ধি ছিল। বুদ্ধাধিকার সময়ে এখানে বৌদ্ধধর্মের বিশেষ আলোচনা হতো। পাটনায় উপস্থিত হয়ে অনেক লোকের মুখে আমরা শুনলেম, পূর্বের সে শ্রীসমৃদ্ধি এখন কিছু নাই। গঙ্গা আছেন, পাটনা নামে সেই পাটলীপুত্র বিদ্যমান আছে, ব্যবসায়ী মহাজনমণ্ডলীর কলরব আছে, ভূমির উর্বরতাশক্তির অধিক লাঘব হয় নাই, কিন্তু পূর্বে পূর্বে এই নগরী সন্দর্শন কোরে লোকে যেমন প্রীতি প্রাপ্ত হতো, আজকাল সেই প্রীতিকর দৃশ্য বিলুপ্ত। ঠিকানায় পৌঁছিবার অগ্রে অনেকক্ষণ আমরা নগর দর্শন কোল্লেম। বড় বড় মহাজন, প্রসিদ্ধ প্রসিদ্ধ মহাজনী গদী, বিবিধ পণ্যদ্রব্য সেখানে বিস্তর। খাপরেলের ঘর অসংখ্য; দেশপর্যটকেরা সকলেই বলেন, পাটনায় যত খোলার ঘর, এত খোলার ঘর আর কোথাও নাই; দর্শন কোরে আমরাও জানতে পাল্লেম, পর্যটকবর্গের কথাই সত্য, এত খোলার ঘর আর কোথাও নাই।
যে পল্লীতে মোহনলাল বাবুর কুঠী, অন্বেষণ কোরে সেই পল্লীতে আমরা উপস্থিত হোলেম। পল্লীর মধ্যে অধিক লোকের কুঠী দেখা গেল না। একটি লোককে জিজ্ঞাসা কোরে জানলেম, রাজা মোহনলাল ঘোষ বাহাদুর সম্প্রতি স্থানান্তরে গিয়েছেন, শীঘ্রই ফিরে আসবেন; কুঠীবাড়ীতে লোকজন আছে, সেইখানে গেলেই বিশেষ বৃত্তান্ত জানতে পারা যাবে। কোথায় সেই কুঠীবাড়ী, সেই লোকটিকে আমরা জিজ্ঞাসা কোল্লেম, লোকটি আমাদের সঙ্গে কোরে বাড়ীখানি দেখিয়ে দিলো। বাড়ীখানি অতি সুন্দর; আমরা বাড়ীর মধ্যে প্রবেশ কোল্লেম।
বাড়ীখানি অতি সুন্দর; জায়গা অনেক, চারিদিক প্রাচীর দিয়ে ঘেরা, মধ্যস্থলে ইমারত; ধারে ধারে ফুলবাগান, মধ্যে মধ্যে অপরাপর ফলকর বৃক্ষ; স্থানটি রমণীয়। দোতালা কুঠী; আমরা দোতালায় গিয়ে উঠলেম; একটি ঘরের সম্মুখে গিয়ে দেখি, ঘরের মধ্যে ঢালা বিছানা, সারি সারি পাঁচ সাতটি তাকিয়া, প্রত্যেক তাকিয়ার পার্শ্বে সুন্দর সুন্দর বৈঠকোবিষ্ট এক একটি হুঁকা। একটি তাকিয়ার কাছে একটি লোক; —দিব্য স্থূলাকার, শ্যামবর্ণ, গলদেশে যজ্ঞোপবীত, কণ্ঠে ছোট ছোট সোণার মাদুলী-গাঁথা তিন-নর তুলসী-মাল্য; মস্তকের মধ্যস্থলে টাক পড়া, পার্শ্বের চুলগুলি অল্প পক্ক, অল্প অপক্ক, বয়স অনুমান পঁয়তাল্লিশ কি ছচল্লিশ বৎসর। লোকটির সম্মুখে বৃহৎ একটা লাল কাপড়ের দপ্তর, দপ্তরের পার্শ্বে বৃহৎ একটা বাকস, বাকসের উপর অনেকগুলি কাগজপত্র ছড়ানো। লোকটি একখানি পত্রিকা চক্ষের নিকটে ধারণ কোরে মনে মনে পাঠ কোচ্ছিলেন; পাঠে তন্মনস্ক। অন্য বিষয়ে অন্য মনস্ক ছিলেন, অন্য দিকে দৃষ্টি ছিল না, আমরা গিয়ে চৌকাঠের কাছে দাঁড়িয়েছিলেম, প্রথমে তিনি দেখতে পান নাই; তার পর পত্রিকার উপর থেকে চক্ষু তুলে, আমাদের দেখে, গম্ভীরবদনে জিজ্ঞাসা কোল্লেন, “কে আপনারা? কোথা থেকে আসছেন? কি চান?”
আমরা তখন গৃহমধ্যে প্রবেশ কোল্লেম। আমি বোল্লেম, “রাজা বাহাদুরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবার অভিলাষ; তিনি আসতে বোলেছিলেন, তন্নিমিত্তই আমাদের আসा।”
লোকটি আমাদের বোসতে বোল্লেন; দুটি তাকিয়ার নিকটে পাশাপাশি হয়ে আমরা দুইজনে বোসলেম। যেরূপ গদিয়ানীভাবে সেই লোকটি সেইখানে বোসে ছিলেন, তাতে কোরে আমার বোধ হলো, তিনি হয় তো একজন সরকার অথবা মহুরী অথবা খাতাঞ্জী। যাই তিনি হোন, স্থূলাঙ্গদর্শনে আমি তাঁরে দেওয়ানজী বোলেই অনুমান কোল্লেম? জমিদারী সেরেস্তার নিম্নপদস্থ কর্মচারীকে দেওয়ানজী বোলে সম্মান দিলে খাতির পাওয়া যায়, তাই মনে কোরে আমি তারে দেওয়ানজী বোলে সম্বোধন কোরবো, এইরূপ ভাবছি, এমন সময় আর একটি লোক সেই গৃহে প্রবেশ কোরে সসম্ভ্রমে বোল্লে, “দেওয়ানজী মশায়! একজন ঘোড়সোয়ার এসেছে, একখানা চিঠি এনেছে, যদি বলেন, সেই লোককে আমি এখানে নিয়ে আসি। চিঠিখানি আমি চাইলেম, দিলে না;— বোল্লে, মহারাজের হাতে দিবার আদেশ। আমি বোল্লেম, ‘মহারাজ বাড়ীতে নাই,’ কথাও শুনলে না। চিঠি আমাকে দিলে না।”
দেওয়ানজী মহাশয় গাত্রোত্থান কোল্লেন; আমাদিগের দিকে চেয়ে আর একবার বোল্লেন, “বসুন আপনারা, আমি আসছি।” যে লোক খবর দিতে এসেছিল, তার দিকে ফিরে তিনি আদেশ দিলেন, “বাবুদের তামাক দে রে!”— বোলেই তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। চাকরটি সেইখানেই দাঁড়িয়ে থাকলো।
তামাক আমিও খাই না, ছোটবাবুও খান না; তামাক আনতে নিষেধ কোরে চাকরটিকে আমি জিজ্ঞাসা কোল্লেম, “রাজাবাহাদুর কোথায় গিয়েছেন? কবে আসবেন?” চাকর উত্তর কোল্লে, “কোথা গিয়েছেন, তা আমি জানি না; গত রাত্রে আসবার কথা ছিল, আসেন নাই; আজ রাত্রে আসতে পারেন; যদি না আসেন, কল্য নিশ্চয়।”
চাকরের সঙ্গে আর আমাদের কোন কথা ছিল না; সে চোলে গেল, আমরা দুইজনে দেওয়ানজীর অপেক্ষায় সেইখানে বোসে থাকলেম।
দেওয়ানজী ফিরে এলেন। কোথাকার সোয়ার, কিসের পত্র, সে কথা জিজ্ঞাসা করা আমাদের অনধিকারচর্চা; আমরা আগন্তুক, সে কথার সঙ্গে আমাদের কোন সম্বন্ধই ছিল না; সুতরাং আমরা পূর্ববৎ নিস্তব্ধভাবেই বোসে থাকলেম। নিজাসনে আসীন হয়ে দেওয়ানজী তখন আমাদের পরিচয় জিজ্ঞাসা কোল্লেন। আমার পরিচয় আমি। আমি হরিদাস, রাজাবাহাদুরের আহ্বানে আমি এখানে উপস্থিত, এই পর্যন্ত আমার পরিচয়। ছোটবাবুর পরিচয়ে কিছু বেশী কথা। তিনি পরিচয় দিলেন, “নাম মিহিরচাঁদ চৌধুরী, পিতা জয়শঙ্কর চৌধুরী, নিবাস ত্রিপুরা; আমার পিতাঠাকুর মহাশয় সম্প্রতি পাটনায় এসেছিলেন, রাজাবাহাদুরের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিল, এই হরিদাস, আমাদের বাড়ীতে ছিল, আমার পিতার মুখে রাজাবাহাদুর সে কথা শুনেছিলেন, হরিদাসকে এখানে পাঠাবার জন্য পিতাকে অনুরোধ কোরেছিলেন, হরিদাস চিনবে না, একাকী আসতে পারবে না, সেই কারণে হরিদাসের সঙ্গে তিনি আমারে পাঠিয়ে দিয়েছেন।”
শান্তদর্শনে দেওয়ানজী আমাদের উভয়ের বদন নিরীক্ষণ কোরে, কি যেন পূর্বকথা স্মরণ কোরে প্রশান্তস্বরে বোল্লেন, “ঠিক কথা বটে; এখন আমার মনে পোড়লো। রাজাবাহাদুর আপনার পিতার কাছে হরিদাসের নাম কোরেছিলেন বটে, হরিদাসকে এখানে পাঠাবার কথা বোলেছিলেন বটে, এই বালকটির নাম হরিদাস?”
মিহিরবাবু উত্তর কোল্লেন, “হরিদাসের পরিচয় হরিদাস নিজ মুখেই প্রদান কোরেছে; আমিও পুনরায় বোলছি, এই বালকের নাম হরিদাস। বালকটি খুব ভাল; হরিদাসের শরীরে অনেক গুণে।”
দেওয়ানজী বোল্লেন, “সন্তুষ্ট হোলেম, আপনারা থাকুন, রাজাবাহাদুর একটি বিশেষ কার্যের নিমিত্ত আজ তিন দিন হলো, একটি বন্ধুলোকের সঙ্গে সাক্ষাৎ কোত্তে গিয়েছেন, আজ রাত্রে প্রত্যাগমন করবার কথা। এইমাত্র মাজিষ্ট্রেট সাহেবের এক পত্র নিয়ে একজন সওয়ার এসেছিল, ম্যাজিষ্ট্রেট সাহেব আগামী কল্য এইখানে উপস্থিত হয়ে রাজাবাহাদুরের সঙ্গে সাক্ষাৎ কোরবেন, পত্রের মর্ম এইরূপ। পত্রের উত্তরে রাজাবাহাদুরের অনুপস্থিতির কথা আমি লিখে দিয়েছি। আপনারা থাকুন, আজ রাত্রে না হয়, কল্য আমি হরিদাসকে রাজসমীপে পরিচিত কোরে দিব।”
আমরা থাকলেম। দেওয়ানজীর সুবন্দোবস্তে, সম্ভবমত আদর-যত্নে আমাদের কিছুমাত্র কষ্ট হলো না। রাত্রে রাজাবাহাদুর এলেন না, পরদিন বেলা দশটার সময় প্রত্যাগত হোলেন। দেওয়ানজীকে পুরোবর্তী কোরে রাজার সঙ্গে আমরা সাক্ষাৎ কোল্লেম। মিহিরচাঁদের পরিচয় পেয়ে রাজাবাহাদুর হর্ষ প্রকাশ কোল্লেন। নতুন কোরে আমার পরিচয় দিতে হলো না, আমারে তিনি চিনতেন; অনেক দিনের পর সাক্ষাৎ হোলে পরিচিত লোককে যে ভাবে জিজ্ঞাসা কোত্তে হয়, সেইভাবে তিনি আমারে জিজ্ঞাসা কোল্লেন, “কেমন আছ হরিদাস? দীর্ঘকালের পর তোমাকে আমি দেখলেম। এত দিন তুমি কোথায় ছিলে। তোমার জন্য আমার বড় কষ্ট হয়। তুমি আমার অবাধ্য, সেই জন্যই নিজের দোষে তুমি কষ্ট পাও। এখন অবধি আমার কাছেই তুমি থাকো; আমার বাধ্য থাকলেই তোমার ভাল হবে।”
নম্রভাবে উচিতমত উত্তর প্রদান কোরে আমি মৌন অবলম্বন কোল্লেম। অনেক দিনের অনেক পূর্বকথা আমার স্মরণ হলো। বাবু মোহনলালের শ্রীবৃদ্ধি হয়েছে, তিনি রাজা হয়েছেন, আমার প্রতি তাঁর মনোভাবেরও পরিবর্তন হয়েছে, এইরূপ আমি ভাবলেম। বারাণসীধামে দুখানি পত্রিকা দর্শন কোরে আমার উপর তিনি যেরূপ রুষ্ট হয়েছিলেন, সে ভাব এখন নাই, ইহাই যেন আমি বুঝলেম।
যতক্ষণ আমি ঐ সকল কথা আলোচনা কোল্লেম, রাজাবাহাদুর ততক্ষণ নিস্তব্ধ ছিলেন; সহসা মৌনভঙ্গ কোরে আমারে তিনি বোল্লেন, “ত্রিপুরায় জয়শঙ্করবাবুর বাড়ীতে তুমি ছিলে, তিনি মহৎ লোক, তাঁর কাছে তোমার কোন প্রকার অযত্ন ছিল না, সে সব আমি শুনেছি। তিনি এখানে এসেছিলেন; তাঁর মুখেই আমি তোমার সমাচার পেয়েছিলেম; পেয়েছিলেম বটে, কিন্তু কি প্রকারে কার সঙ্গে তুমি ত্রিপুরায় উপস্থিত হয়েছিলে, সেটা আমি জানতে পারি নাই, তিনিও কিছু বলেন নাই। ত্রিপুরায় তুমি কেন গিয়েছিলে? —সেখানে তোমার কি কোন বিশেষ প্রয়োজন ছিল?”
কেন জানি না, রাজার প্রশ্ন শুনে হঠাৎ আমি চোমকে উঠলেম; ভাব গোপন কোরে উত্তর কোল্লেম, “আজ্ঞা না; বিশেষ অবিশেষ কোন প্রয়োজনই আমার সেখানে ছিল না; কি জন্য গিয়েছিলেম, কিরূপে গিয়েছিলেম, তাও আমি বোলতে পারি না। যে দিন আমি—”
বোলতে বোলতে একবার আমি থাকলেম; ত্রিপুরার প্রথমদিনের কথা আমার মনে পোড়লো, আমি কাঁপলেম। প্রথমদিন জয়শঙ্করবাবু আমারে নেশাখোর বোলে তিরস্কার কোরেছিলেন; রাজাবাহাদুরের সঙ্গে তাঁর আত্মীয়তা আছে, ‘আমি নেশাখোর’ এ কথাটা যদি তিনি রাজাকে বোলে গিয়ে থাকেন, হয় তো বোলে থাকবেন, এমন যদি হয়, তা হোলে আমার উপর রাজাবাহাদুরের একটা কুসংস্কার জন্মেছে, ইহাই সম্ভব। সত্যকথা কি, জয়শঙ্করবাবু সে সবও হয় তো বোলে থাকবেন, রাজা হয় তো সেই কথা চেপে রেখে আমার মুখে কোন প্রকার নূতন কথা শ্রবণ করবার কৌশল প্রকাশ কোচ্ছেন, এইরূপ আমি ভাবলেম। প্রথমে যা ভেবেছিলেম, জয়শঙ্করবাবুদের তিরস্কার সহ্য করবার পর যে সব কথা আমার মনে হয়েছিল, সেই সব কথা যদি ঠিক হয়, তবে তো মোহনলালবাবুর কাছে আমাকে সর্বদা সাবধান হয়ে থাকতে হবে, পদে পদে কুণ্ঠিত হয়ে চোলতে হবে, সেটা নিশ্চয়। মনের কথা মোহনবাবুকে আমি, বোলবো কি না, একটু চিন্তা কোল্লেম। কৌশলক্রমে কিঞ্চিৎ আভাস দেওয়া ভাল; পরিশেষে সেই সিদ্ধান্তই অবধারিত হলো।
কথাগুলি লিখতে যতক্ষণ গেল, ভাবতে ততক্ষণ লাগে নাই। যে পর্যন্ত বোলতে বোলতে আমি থেমেছিলেম, সেই সূত্র ধারণ কোরে রাজাকে আমি বোল্লেম, যে দিন আমি জয়শঙ্করবাবুর বাড়ীতে উপস্থিত হই, সে দিন আমি অজ্ঞান ছিলেম। কে আমারে অজ্ঞান কোরেছিল, তা আমি জানি না; অজ্ঞান অবস্থায় কারা আমারে ত্রিপুরায় ফেলে গিয়েছিল, তাও আমি বোলতে পারি না; জয়শঙ্করবাবু যত্ন কোরে আমারে আশ্রয় দিয়েছিলেন, এই পর্যন্ত আমি বোলতে পারি।”
তাচ্ছল্যব্যঞ্জক হাস্য কোরে রাজাবাহাদুর বোল্লেন, “ওটা তোমার বুদ্ধির ভ্রম। মাঝে মাঝে তোমার এক একটা খেয়াল হয়, এটাও সেই প্রকার একটা খেয়াল। কে তোমাকে অজ্ঞান কোরে একটা জায়গায় ফেলে দিয়ে যাবে? কার এত দায় পোড়েছিল? কেনই বা তোমাকে অন্যলোকে একটা অজানা জায়গায় নিয়ে যাবে? ও সব কথা মনে কোরো না। ভাল লোকের আশ্রয়ে ছিলে, আমার কাছে এসেছ, শান্ত হয়ে থাকো, ও সব খেয়াল ছেড়ে দাও। শিষ্টশান্ত হয়ে কাজকর্ম কর, আমার পরামর্শ মত চল, সংসারে একজন মনুষ্য বোলে গণ্য হোতে পারবে। চিরদিন কি এইরূপে ছেলেমানুষ থাকবে? উদাসীনের মত চিরদিন কি দেশে বিদেশে পথে পথে ঘুরে ঘুরে বেড়াবে? ঐ রকম হয়ে ঘুরে বেড়ানো কি ভাল? স্থির হয়ে আমার কাছে থাকো; কাজকর্ম শিক্ষা কর, মঙ্গল হবে।”
আর আমি কিছু বোল্লেম না; ভাগ্য বিরূপ থাকলে মনে সর্বদাই কু-গায়; কু-ভাবনা আমার গেল না। রাজাবাহাদুর আমাদের সেইখানে বোসতে বোলে গৃহান্তরে প্রবেশ কোল্লেন, চাকরেরা গৃহপরিষ্কারাদি নানা কার্যে ব্যস্ত হয়ে বেড়াতে লাগলো; দেওয়ানজী মহাশয় মরুব্বী আনা জানিয়ে এটা ওটা সেটা পাঁচ প্রকার হকুমজারী কোত্তে লাগলেন; রাজাও ব্যস্ত। ফল, ফুল, মাখন, মিছরি প্রভৃতি বিবিধ দ্রব্য আমদানী হোতে লাগলো। সেই সব আয়োজন দর্শন কোত্তে কোত্তে ভগবান মরীচিমালী অস্তাচল-শিখরে প্রস্থান কোল্লেন : সন্ধ্যা হলো; ঘরে ঘরে পরিষ্কার পরিষ্কার দীপাধারে পরিষ্কার পরিষ্কার বার্তী জ্বোলে উঠলো : বিচিত্র নাচঘরের ন্যায় একটি প্রশস্ত ঘরে ইংরাজী ধরণের মজলীস সাজানো হলো। বাড়ীতে কি একটা উৎসব আছে, কারা যেন আসবেন, অনেকেই এইরূপ বিবেচনা কোল্লেন।
রাত্রি যখন আটটা, কি নয়টা, সেই সময় ফটকে একখানা গাড়ী এসে লাগলো। গাড়ীর পশ্চাতে একজন ঘোড়সওয়ার। একজন খানসামা দ্রুতগতি উপরে এসে সংবাদ দিলে, ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব। রাজাবাহাদুর উপরে ছিলেন, তাড়াতাড়ি নেমে গেলেন, অভ্যাগত দুটি সাহেবকে সঙ্গে নিয়ে উপরে এসে উঠলেন। শেষে আমরা জানত পাল্লেম, একজন ম্যাজিস্ট্রেট আর একজন ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের নবাগত বন্ধু। যেখানে মজলীস হয়েছিল, আমরা সে ঘরে প্রবেশ কোল্লেম না; ঘরের দুইধারে রঙ্গিন উদ্দীপরা দুইজন আরদালী দাঁড়ালো, দ্বারের কপাট রুদ্ধ হয়ে গেল।
কি প্রয়োজনে ম্যাজিস্ট্রেটের আগমন, সেটি আমি জানলেম না, জানবার জন্য আগ্রহও প্রকাশ কোল্লেম না। গৃহমধ্যে পান-ভোজন, কথোপকথন ও অন্যান্য কার্য সমাপ্ত হোলে, সাহেবেরা বিদায় হোলেন, ভোজনান্তে আমরাও বিশ্রাম করবার অবকাশ পেলেম।
পাঁচদিন অতীত। মোহনবাদকে বারংবার রাজাবাহাদুর বোলে উল্লেখ করা আমার বেশ কিছু কষ্টকর বোধ হোতে লাগলো; বলি রাজাবাহাদুর, কিন্তু যেন বাধ বাধ করে। সম্বোধনে রাজাবাহাদুর কেন, অবাধে মহারাজ বলা যায়; কিন্তু অপরের কাছে পরিচয় দিবার সময় একটু থেমে থেমে সাবধান হোতে হয়। মোহনরাজা অথবা মোহনলাল রাজা, এরূপ উচ্চারণ শ্রবণে নীরস। যত দিনের জানানো, তত দিন আমি মোহনবাবু অথবা মোহনলালবাবু বোলে এসেছি। এখন তিনি নূতন রাজা হয়েছেন, রাজাবাহাদুর বোলতে হবে, না বলাটা ধৃষ্টতা, বলা চাই, ক্রমে ক্রমে অভ্যাস করা আবশ্যক। এই পাঁচদিন রাজাবাহাদুর আমারে বেশ আদর-যত্ন কোল্লেন, স্নেহ-মমতা জানালেন মিষ্টকথা বোল্লেন; তুষ্ট হয়েও আমি তুষ্ট হোতে পাল্লেম না। অতুষ্টির কি কারণ, পাঠক মহাশয় সেটি অনুভবে হৃদয়ঙ্গম কোরবেন। রাজার কাছে আমি আদর-যত্ন পেলেম আমার অপেক্ষা মিহিরবাবু কিছু বেশী পেলেন; পাওয়াই উচিত। একে তিনি নূতন তাতে আবার ব্রাহ্মণ, তার উপর আবার মিত্রকুমার। আমার অপেক্ষা মিত্রকুমারের অধিক সমাদর অবশ্যই সামাজিক রীতির গৌরববর্ধক; সমাজের প্রথাই এইরূপ; সমাদরে বাস্তবিক আমি সন্তোষলাভ কোল্লেম।
পাঁচদিন পরে মিহিরচাঁদবাবু বিদায় হোলেন; তাঁরে প্রণাম কোরে রাজা-বাহাদুর বোলে দিলেন, “তোমার পিতাঠাকুরকে আমার প্রণাম দিও; হরিদাস এসেছে, ভাল আছে, থাকতে থাকতে ভাল হবে, এ কথাও তাঁরে বোলো।” মিহিরবাবু আশীর্বাদ কোল্লেন। আমাদের আসবার রাহাখরচ আর মিহিরবাবুর প্রতিগমনের রাহাখরচ রাজাবাহাদুর দিলেন। আমার সঙ্গে প্রিয়সম্ভাষণ কোরে মিহিরবাবু স্বদেশে প্রস্থান কোল্লেন। এইখানে আর একটি কথা বোলে রাখা আবশ্যক। প্রায়শ্চিত্তের ছলে পায়রাবাবুকে নেড়া করা, ‘কানকাটা কানাই’ প্রকাশ করা, কি প্রকার রহস্য, পাটনায় উপস্থিত হয়ে মিহিরবাবু নিৰ্জনে একদিন আমারে সেই কথা জিজ্ঞাসা কোরেছিলেন। কানাইয়ের স্থূল স্থূল পরিচয় তাঁর কাছে আমি ব্যক্ত কোরেছিলেম। শুনে তিনি ঘৃণার সঙ্গে বিস্ময় প্রকাশ কোরে বোলেছিলেন, “তবে আর রুদ্রাক্ষ-খোপে বাসা কোরে থাকতে পারবে না, লোকের কাছে বোঁচা-মুখ দেখাতে লজ্জা হবে, পায়রা অচিরেই রুদ্রাক্ষের বাসা ছেড়ে উড়ে পালাবে!” হাস্য কোরে আমি বোলেছিলেম, “সেটাও একপ্রকার দ্বিতীয় প্রায়শ্চিত্ত। তাদৃশ নরাধমের পনঃ পূনঃ প্রায়শ্চিত্ত হওয়াই কৃষ্ণের ইচ্ছা।”
মিহিরবাবু চোলে গেলেন, আমি থাকলেম। আদর পাই, যত্ন পাই, রাজার মুখের মিষ্ট মিষ্ট বাক্য পাই, রাজাদেশে সামান্য সামান্য কাজ-কর্ম ও নির্বাহ করি, এই রকমে একমাস। নিত্য নিত্য মনে করি, রাজাকে আমি মনের কথা জানাব; চিরজীবনের ঘোর অন্ধকার সংশয়টা ভঞ্জন করবার প্রয়াস পাব, অবকাশ পাই না। তিনি বড়লোক, আমি গরীব, শীঘ্র কোন কথা জিজ্ঞাসা কোত্তেও সাহস হয় না। রাজাকে নিৰ্জনে না পেলে সে সব কথা জিজ্ঞাসা করা ভাল নয়, নিৰ্জনে পাবারও অবসর ঘটে না। আরও একপক্ষ অপেক্ষা কোল্লেম।
বসন্তকাল উপস্থিত। বসন্তে আকাশমণ্ডল নিৰ্মল, প্রকৃতি প্রসন্নমুখী, তরুলতা প্রফুল্ল, বিহঙ্গকুল প্রফুল্ল, সুখলালিত মানবকুলও প্রফুল্ল। আমার মত অভাগা চিরদুঃখী ব্যতীত সকলেই প্রফুল্ল।
একদিন অপরাহ্ণে রাজাবাহাদুর মোহিনীমোহন বসন-ভূষণে সজ্জিত হয়ে উপর থেকে নেমে আসছেন, আমি সেই সময় একটা কাজের জন্য তাড়াতাড়ি নীচে থেকে উপরে উঠছিলেম, সিঁড়ির পথে দেখা হলো। থোমকে দাঁড়িয়ে সস্নেহ-সম্ভাষণে রাজা আমারে বোল্লেন, “এসো হরিদাস! আমি তোমার তত্ত্ব কোচ্ছিলেম, কোথায় ছিলে তুমি? এসো!”
বোলেই তিনি অগ্রে অগ্রে সোপানাবলী অতিক্রম কোত্তে লাগলেন, কথার ভাবনা বুঝতে না পেরে পূর্বস্থানেই আমি দাঁড়িয়ে থাকলেম। পশ্চাতে মুখ ফিরিয়ে রাজা পুনরায় আমারে আহ্বান কোরে বোল্লেন, “ভাবছ কি? এসো!”
তখন আমি তাঁর মনের কথা বুঝতে পাল্লেম; যে কার্যে যাচ্ছিলেম, সে কার্যে আর যাওয়া হলো না, সন্দিগ্ধচিত্তে রাজার সঙ্গে সঙ্গে নেমে ফটক পর্যন্ত এলেম। ফটকে গাড়ী ছিল, রাজাবাহাদুর আরোহণ কোল্লেন, আমারেও আরোহণ কোত্তে বোল্লেন; নতবদনে আমি রাজাজ্ঞা পালন কোল্লেম।
গঙ্গাতীরের রাস্তার অদূরে একটি মনোহর উদ্যান; সেই উদ্যানে শকট পৌঁছিল; আমরা অবরোহণ কোল্লেম। গাড়ীতে যতক্ষণ ছিলেম, ততক্ষণের মধ্যে আমি একটিও কথা কহি নাই, একখানা ইংরাজী খবরের কাগজে চক্ষু রেখে রাজাবাহাদুর অন্যমনস্ক ছিলেন, তিনিও আমারে কোন কথা জিজ্ঞাসা করেন নাই। গাড়ী থেকে নেমে রাজা যখন উদ্যানের পুষ্পবাটিকায় পরিক্রমণ করেন, আমি তখন তাঁর পশ্চাতে ছিলেম। রৌদ্রের উত্তাপ ছিল না, সুখস্পর্শ সমীরণ আমাদের অঙ্গস্পর্শ কোচ্ছিল, নানা কুসমের সৌরভে চিত্ত প্রমোদিত হোচ্ছিল, উদ্যানের শোভা দর্শনে আমি পরিতৃপ্ত হোচ্ছিলেম, উদ্যানপালেরা দূরে দূরে স্ব স্ব কার্যে নিযুক্ত ছিল, নিকটে কেহই ছিল না; নির্জন-আলাপের উত্তম অবসর।
উদ্যানের স্থানে স্থানে উপবেশনযোগ্য সুন্দর সুন্দর বেদী; বেদীর ধারে ধারে শ্বেতপ্রস্তর নির্মিত-চীনের মৃত্তিকানির্মিত নানা প্রকার সুন্দর সুন্দর পুতুল; দিব্য সুদৃশ্য! কুসমকাননের মধ্যস্থলে একটি শ্বেতবর্ণ ধারাযন্ত্র; সেই ফোয়ারার একদিকে ময়ূরের মুখ, একদিকে সিংহমুখ, একদিকে হংসমুখ, একদিকে এক অসুরের মুখ, উপরিভাগে বিচিত্র পক্ষযুক্ত একটি সুন্দরী পরী; যন্ত্রগাত্রের চারিমুখ দিয়ে নির্ঝরের ন্যায় ঝর ঝর শব্দে স্নিগ্ধ সলিল বর্ষিত হোচ্ছিল। সেই সকল শোভা দর্শন কোত্তে কোত্তে রাজাবাহাদূর নিকটস্থ একটি বেদীর উপর উপবেশন কোল্লেন, প্রসন্ন-নয়নে আমার দিকে চেয়ে আমারেও বোসতে বোল্লেন। যে বেদীতে রাজা, সে বেদীতে না বোসে নিকটবর্তী আর একটি বেদীতে আমি উপবেশন কোল্লেম।
প্রতিদিন মনোমোহিনী শোভা দর্শনে আমার চিত্ত পুলকিত হোচ্ছিল, কিন্তু আমার অন্তরসাগরে অহরহ অনুক্ষণ যেরূপ চিন্তা-তরঙ্গের খেলা, সে খেলার বিরাম ছিল না। রাজাকে একটি কথা জিজ্ঞাসা করা আমার ইচ্ছা; স্থান নির্জন, সময় রমণীয়; রাজাবাহাদুরের মেজাজ তখন বেশ ঠাণ্ডা, মনোগত কথা জিজ্ঞাসা করবার উপযুক্ত অবসর বটে; কিন্তু সহসা কি কথা বোলে মনের কথা উত্থাপন করি, তাই আমি ভাবতে লাগলেম। অবসর হয়েও অবসর হয় না; রাজার দৃষ্টি তখন অন্যদিকে ছিল, অপাঙ্গে তাঁর মুখের ভাব নিরীক্ষণ কোরে আমি বুঝলেম, আমার ন্যায় তিনিও যেন কোন প্রকার চিন্তায় অন্যমনস্ক। সেই ভাবে রাজার মুখের দিকে আমি চেয়ে আছি, হঠাৎ আমার দিকে ফিরে, কি যেন ভেবে তিনি আমারে জিজ্ঞাসা কোল্লেন, “কি ভাবছো হরিদাস?”
কি আমি ভাবছি, আমিই তা জানতেম। শৈশবে জ্ঞানের সঞ্চার হওয়া অবধি সর্বদা যে কথা আমি ভাবি, সেই ভাবনা আমার সহচরী। ভাবনাকে অন্তরে রেখে আমি উত্তর কোল্লেম, “উদ্যানটী অতি সুন্দর। এ উদ্যানে যা কিছ দর্শন কোচ্ছি, সমস্তই যেন আমার চক্ষে নতুন বোধ হোচ্ছে; পুতুলগুলি যেন সজীব বিবেচনা কোচ্ছি; পুতুলেরা যেন বাতাসের সঙ্গে কথা কোচ্ছে, এই ভাব আমার মনে আসছে; বাতাসে দলে দলে ফুলগুলি যেন আহ্লাদে আহ্লাদে ঢোলে ঢোলে পোড়ছে, পবনদেবের সঙ্গে যেন খেলা কোচ্ছে তাই আমি দেখছি।”
ঈষৎ হাস্য কোরে রাজাবাহাদুর বোল্লেন, “তা তো দেখছো, কিন্তু ভাবছো কি? দেখতে পাই, সর্বদাই কি তুমি ভাবো। পূর্বেও দেখেছি, এখনো দেখছি, একই ভাব। এখন আর তুমি নিতান্ত ছেলেমানুষটি নও, ক্রমেই বয়স বাড়ছে, উদাসীনের মত সর্বক্ষণ ভেবে ভেবে তোমার বুদ্ধিশক্তি দুর্বল হয়ে আসছে; ও সব ভাবনা ছেড়ে দাও। তোমাকে সংসারী হোতে হবে, সংসারী হবে, সংসারের মানুষগুলিকে চিনতে হবে, সংসারের প্রকৃতি বুঝতে হবে, সেগুলি কি তুমি একবারও ভাবো না? অন্য ভাবনা ছেড়ে দাও। যাতে কোরে মানুষের মত হোতে পার, সেই চেষ্টা কর; আমার কাছে যথেষ্ট সহায়তা পাবে।”
সুরে সুরে সুর মিলে গেল; ঠিক সুরে আমার হৃদয়-বীণা বেজে উঠলো। সূত্র অন্বেষণ কোচ্ছিলেম, উত্তম সূত্র পেলেম; উত্তম সুবিধা; ভাগ্যে যা থাকে, তাই হবে, এই সূত্রে মনের কথা আমি প্রকাশ করি। রাজা যদি সদয় হন, আশা পূর্ণ হবে; কথা শুনে রাজা যদি রুষ্ট হন, আশা ভেসে যাবে; যত দিন বাঁচবো, এই রকমে অকূলপাথারে ভেসে ভেসে বেড়াবো। আজ আমার ভাগ্যপরীক্ষার শেষদিন, মনের কথা প্রকাশ করা কর্তব্য। ভেবে ভেবে দৃঢ়সঙ্কল্প হয়ে ধীরে ধীরে আমি বোল্লেম, “যা আপনি আজ্ঞা কোচ্ছেন, তা ঠিক। সংসারে যখন এসেছি, তখন সংসারের পদ্ধতিতে সংসারী হওয়াই উচিত; কিন্তু পন্থা অবলম্বনের মূলতত্ত্ব আমি অপরিজ্ঞাত। এ সংসারে কে আমি, কে আমার জন্মদাতা, কে আমার জননী, এত বড় বিশ্বসংসারে আমার আপনার লোক কেহ আছেন কি না জন্মাবধিই সেটী আমি জানলেম না। আমি আছি কেবল এইটুকু মাত্র জানি, আর কিছুই আমি জানি না। আপনি বোলছেন, ‘উদাসীনের মত সর্বক্ষণ ভেবে ভেবে বুদ্ধিশক্তি দুর্বল হয়ে আসছে’; যথার্থই তাই, যথার্থই আমি উদাসীন; সংসারে আমি এসেছি, সংসারে আমি আছি সংসারেই ভ্রমণ কোচ্ছি, কিন্তু সংসারটী কি, তা আমি জানি না। এমন অবস্থায় জীবন আমার বিড়ম্বনা জ্ঞান হয়। কেন বেঁচে আছি, তাও আমি বুঝতে পাচ্ছি না। আপনি যদি সদয় হয়ে আমার পরিচয়টি আমারে বোলে দেন, তা হোলে—”
অকস্মাৎ রাজার মুখের সেই প্রফুল্লভাব তিরোহিত। আমার ঐ অর্ধোক্তি শ্রবণে যেন কতই বিস্ময়ভাব প্রকাশ কোরে রুক্ষস্বরে তিনি বোল্লেন, “পরিচয়? —তোমার? তোমার পরিচয় আমি কি জানি? পাগলের মত তুমি কি কথা কও? কোথাকার কে তুমি কিছুই আমি জানতেম না; আমার শ্বশুরের বাড়ীতে তোমাকে আমি প্রথম দেখি, দেখে তোমার প্রতি আমার দয়া হয়েছিল, নিজ বাড়ীতে নিয়ে গিয়ে যত্ন কোরে রাখবো, লেখাপড়া শিখাবো, কাজকর্ম শিক্ষা দিব, ঐরূপ আমার ইচ্ছা হয়েছিল; সে কথা তোমাকে আমি বোলেছিলেম। তুমি শুনলে না, আমার সৎপরমর্শ গ্রাহ্য কোল্লে না, আপন বুদ্ধিতে পথে পথে ঘুরে বেড়াতে লাগলে, তথাপি চৈতন্য হলো না। তার পরেও দুবার তোমার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল, তখনো আমি তোমার ভাল চেষ্টা করেছিলেম, তাও তোমার ভাল লাগলো না। লোকের কাছে অকারণে তুমি আমার নিন্দা কোল্লে তাও আমি ভুলে গিয়েছিলেম, ছেলেমানুষ বোলে ক্ষমা কোরেছিলেম; তদবধি তুমি আর আমার সঙ্গে দেখা কোল্লে না। নিরাশ্রয় দেখে তোমাকে আশ্রয় দিবার নিমিত্ত কত চেষ্টা আমি কোরেছি, সমস্তই বিফল হয়েছে। দয়াবশে কত সন্ধানের পর সন্ধান পেয়ে এখানে তোমাকে আমি আনিয়েছি, ভবিষ্যতে আর কোন কষ্ট না পাও, তার উপায় আমি কোরবো, স্বীকার কোরেছি, তাতেও তুমি সন্তুষ্ট থাকছো না। কোথাকার কথা কোথায়! আমার কাছে তুমি তোমার পরিচয় চাও! তোমার পরিচয় আমি কিরূপে জানবো?”
কঠোর কর্কশকণ্ঠে রাজাবাহাদুর এই সব কথা বোল্লেন, আমি কিন্তু ভয় পেলেম না; মনের উপদেশে আরো বরং অধিক সাহসে তৎক্ষণাৎ আমি বোল্লেম, “সব আপনি জানেন, কেন প্রতারণা করেন? গরীব দেখে কেন আমার কথাগুলি উড়িয়ে উড়িয়ে দেন? সমস্তই আপনি জানেন; দয়া করুন। দয়া কোরে বলুন, কে আমি, কোথা আমার জন্ম, কোথায় আমার জনক-জননী, কোথায় কোথায় কে আমার আপনার লোক বর্তমান আছেন, অনুগ্রহ কোরে সেই কথাগুলি আমারে বলুন! সমস্তই আপনি জানেন।”
পূর্ববৎ রুক্ষস্বরে রাজাবাহাদুর বোলে উঠলেন, “কি আমি জানি? তুমি একজন বিদেশী বালক, তোমার পরিচয় আমি কেমন কোরে জানবো? কোথায় তোমার জন্ম, কে তোমার বাপ, কে তোমার মা, সে সব কথা আমি কি জানি? আমাকে তুমি ও রকমে বিরক্ত কোরো না। যদি ভাল চাও, ঠাণ্ডা হয়ে কিছুদিন আমার কাছে থাকো, পাগলামী দেখিও না। আমি অঙ্গীকার কোচ্ছি, সেই রকমে থাকলে আমি তোমার ভাল চেষ্টা করব; ও রকম পাগলামী দেখালে এখানে তুমি জায়গা পাবে না। বার বার আমি বোলছি, তোমার পরিচয়ের কোন কথাই আমি জানি না।”
রাজা মোহনলাল আমারে ভয় দেখালেন, “পাগলামী দেখালে এখানে জায়গা পাবে না” বোল্লেন। যেটা আমার সত্যকথা, রাজা বোল্লেন, সেইটি আমার পাগলামী। আমি ভয় পেলেম না; কোন প্রকার ভয়ের লক্ষণ না দেখিয়ে তৎক্ষণাৎ আমি বোল্লেম, “কেন আপনি গোপন করেন? গরীব বোলে কেন আপনি আমারে অন্ধকারে রাখতে চান? কিছুই যদি আপনি জানেন না, তবে রুদ্রাক্ষগ্রামের জয়শঙ্করবাবুকে সে কথা আপনি কিরূপে বোলেছিলেন?”
কিঞ্চিৎ চমকিতভাবে রাজাবাহাদুর বোল্লেন, “কি আমি বোলেছিলেম? জয়শঙ্করের মুখে কি কথা তুমি শুনেছ? তোমার পরিচয় জয়শঙ্কর যেমন জানেন, আমিও সেইরূপে জানি। জয়শঙ্করের কাছে কি কথা আমি বোলেছিলেম? কিছুই ত আমার মনে হয় না। তুমি যদি—”
সত্য সত্যই আমি যেন তখন পাগলের মত হোলেম। যদিও অশিষ্টতা, যদিও অনুচিত, তথাপি আমি রাজার কথায় বাধা দিয়ে উত্তেজিতস্বরে বোল্লেম, “কিছুই আপনার মনে হয় না? আচ্ছা, আমিই মনে কোরে দিচ্ছি। জয়শঙ্করবাবুর মুখে আমি শুনেছি, তাঁরে আপনি বোলেছিলেন, আমি আপনার জাতি; আপনিও যে জাতি, আমিও সেই জাতি। জাতির কথা যদি আপনি জানেন, তবে আমার জন্মের কথাও অবশ্য আপনার জানা আছে, এই আমার বিশ্বাস। সেই বিশ্বাসেই এখানেই আমি এসেছি। কেন আপনি অস্বীকার করেন? কেন আর আমারে অন্ধকারে রাখেন? জাতি-জন্ম সম্বন্ধে চিরদিন আমি অন্ধকারে থাকি, সেইটিই কি অপনার ইচ্ছা? আপনার তুল্য মহৎলোকের সে রকম ইচ্ছা থাকা শোভা পায় না। দয়া করুন! যদি আমি আপনার কাছে কোন অপরাধ কোরে থাকি, ক্ষমা করুন! দয়া কোরে সত্যকথা বলুন! বিস্তর কষ্ট আমি পেয়েছি, আর কষ্ট সহ্য হয় না! আমার কষ্টের অনেক কথা আপনি জ্ঞাত আছেন। যারা আমার উপর দৌরাত্মা করে, তাদের মধ্যে কোন কোন লোককে আপনি জানেন। আপনার উপদেশে একজন—”
রাজা যেন কেমন এক রকম অস্থির হোলেন; অস্থির হয়েই বেদীর উপর থেকে নেমে দাঁড়ালেন; দুই চক্ষু রক্তবর্ণ কোরে সরোষে আমারে বোল্লেন, “আমি কি তবে মিথ্যাকথা বোলছি? যারা যারা তোমার উপর দৌরাত্মা করে, তাদের কি আমি জানি? আমার উপদেশে তোমার উপর দৌরাত্ম্য হয়? আমি কি তোমারে অন্ধকারে রাখছি? কি সব কথা তুমি বল? এ সব কথা শুনলে লোকে আমাকে কি বোলবে? তোমাকেই বা কি ঠাওরাবে? ও সব কথা তুলো না, ও সব কথা বোলো না; যা যা আমি বলি, আমার বাধ্য হয়ে তাই তুমি কর, বাচালতা দেখিও না; আমি যেন বুঝতে পাচ্ছি, দেশে দেশে ঘুরে ঘুরে তোমার মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে। হোতেই পারে; হোতেই পারে; অনেক লোকের এই রকম হয়। আমি বরং তোমার চিকিৎসা করাবো; এখানে ভাল ভাল কবিরাজ আছে, ডাক্তার আছে, ভাল ভাল ঔষধ আছে, চিকিৎসকের ব্যবস্থামত চোল্লে শীঘ্রই তুমি আরাম হোতে পারবে।”
এই সব কথা বোলতে বোলতে একবার আকাশপানে চেয়ে রাজাবাহাদুর বোল্লেন, “আর বেলা নাই, চল আমরা কুঠীতে ফিরে যাই। যে সব কথা আজ তুমি আমাকে বোল্লে, নিকটে লোকজন থাকলে, ও রকম কথা বোলো না; লোকে কেবল প্রলাপ মনে কোরবে, তোমাকে উপহাস কোরবে, পাগল মনে কোরে হাততালি দিবে, গায়ে ধূলা দিবে; সাবধান! চল এখন!”
আমার মনের ভিতর তখন কিরূপ ভাবের উদয় হলো, বিশ্ববিধাতা ভিন্ন আর কেহ সে ভাব জানতে পারেন না। রাজা চোল্লেন, নিস্তব্ধ হয়ে আমিও তাঁর সঙ্গে সঙ্গে চোল্লেম। অতঃপর শকটারোহণে কুঠীতে গিয়ে উপস্থিত হোলেম। সে রাত্রে সকল রাত্রি অপেক্ষা আমি অধিক অসুখী। বাবু মোহনলাল রাজা উপাধি পেয়েছেন, সম্প্রতি তাঁর ঐশ্বর্য বৃদ্ধি হয়েছে। আমি ভেবেছিলেম, পদমর্যাদা ও ধনমর্যাদার সঙ্গে তাঁর পূর্বপ্রকৃতির পরিবর্তন হয়ে থাকবে; কিন্তু পুষ্পকাননে আজ তিনি যেরূপ অভিনয় কোল্লেন, তাতে বুঝলেম, কপটতা আরো যেন বেশী পরিমাণে বর্ধিত হয়েছে। নিশ্চয় আমি বুঝতে পাচ্ছি, আমার পরিচয় তিনি জানেন; পূর্বে যতটকু বুঝেছিলেম, এখন তদপেক্ষা অনেকটা পরিষ্কার বুঝেছি; কিন্তু সেই পরিচয়টি তিনি আমার কাছে প্রকাশ কোরবেন না, অপ্রকাশ রাখতে তিনি যেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, লক্ষণে এইরূপ বুঝা গেল কিন্তু কেন? আমার পরিচয় আমার কাছে প্রকাশ কোল্লে তাঁর কি কোন প্রকার ক্ষতির সম্ভাবনা আছে? আমি আমার পরিচয় জানতে পাল্লে তাঁর কি কোন প্রকার ইষ্টসিদ্ধির আঘাত হবে? গরীবের পরিচয় বোলে দিলে তাঁর অভিনব রাজা উপাধিতে কি কোন প্রকার আঘাত পাবে? বহু-চিন্তা কোরেও কিছুই আমি অবধারণ কোত্তে পাল্লেম না, হতাশে কেবল এইটুকুমাত্র অবধারণ কোল্লেম যে, চিরদিন আমারে জাতি-জন্মের পরিচয়ে অন্ধকারেই থাকতে হবে। কেন না, ঐ মোহনলালবাবু ভিন্ন আর কেহ এই হতভাগ্য হরিদাসের সত্য পরিচয় জ্ঞাত আছে, এমন বোধ হয় না, বোধ হয়, রক্তদন্ত কিছু কিছু, জানতে পারে; কিন্তু তার মুখে সত্যকথা বাহির করা দূরাশামাত্র। এত বড় একজন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি এই বাবু, মোহনলাল,— অভিনব রাজা মোহনলাল, ইনি যখন এতদূর কৃপণতা কোচ্ছেন, তখন সেই একটা ধড়ীবাজ ডাকাত,— নরহন্তা অনুমান কোল্লেও মিথ্যা অনুমান হয় না, — সেই পাষণ্ড দস্যু আমার সম্বন্ধে সত্যকথা বোলবে কোনক্রমেই সেটা সম্ভব মনে করা যায় না; তবে আর কার কাছে আমার অভীষ্টসিদ্ধির আশা?— আশা নাই! সূতিকাগারে আমি যেমন ছিলেম, কোথায় এলেম, কোথায় ছিলেম, কে আমি কিছুই জানতেম না, মৃত্যুকাল পর্যন্ত সেইরূপেই আমারে ঘোর অন্ধকারে থাকতে হবে, বিধাতার হয় তো ইচ্ছাই তাই। এখন আমি কি করি? পরিচয়প্রাপ্ত হবার আশা তো দূরে গেল! বিনা পরিচয়ে যাঁদের কাছে আমি এক রকমে পরিচিত হয়েছিলেম, যাঁদের কাছে আমি ভালবাসা পেয়েছিলেম, যাঁরা আমারে আদর-যত্নে আশ্রয় দিয়েছিলেন, তাঁরাই বা কে কোথায় থাকলেন? অমরকুমারী কোথায় রইলেন? অমরকুমারীর কাছে জীবনঋণে ঋণী আমি, সে ঋণ পরিশোধ কোত্তে পাল্লেম না। দুই জেলার দুই জায়গায় দুই মোকদ্দমা; সে দুই মোকদ্দমার কিরূপ নিষ্পত্তি হলো, জানতে পাল্লেম না। ত্রিপুরায় যখন ছিলেম, বন্ধুবান্ধবগণকে চিঠি লিখে তত্ত্ব জানবার আশা কোরেছিলেম, জয়শঙ্কর চৌধুরী বাধা দিয়াছিলেন, আশা ফলবতী হয় নাই। এখন আমি পাটনায়, এখন আমি সে বিষয়ে স্বাধীন; চিঠি আমি লিখবো, সে কথা রাজাকে জানাব না। কি জানি, যে রকম প্রকৃতি, তাতে কোরে রাজা যদি জয়শঙ্করের মত আমার অভিলাষের পথে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ান; তা হোলে মনোরথসিদ্ধি হবে না। রাজাকে জানাব না, সেই পরামর্শই ভাল। আপন সংকল্প আপনিই জানবো আর কাহাকেও জানতে দিব না; দিনমানেও লিখবো না; কল্য রাত্রিতে বাড়ীতে নিশুতি হবে, বাড়ীর সকলে যখন ঘুমাবে, সেই সময় আমি পত্রগুলি লিখে রাখবো।
এই আমার সংকল্প; দৃঢ়সংকল্প। দিবসের শেষভাগে সুখীলোকে সুখময় স্থানে ভ্রমণ করে; শরীর সুস্থ হয়, মন সুস্থ হয়, নিশাকালে সুখে নিদ্রা যায়। অসুখী লোকে তাদৃশ রমণীয় স্থান পরিভ্রমণ কোরে সুস্থ হোতে পারে না, নিদ্রাও তারে আলিঙ্গন করে না। আমি অসুখী, রাজার সঙ্গে পুষ্পকুঞ্জ পরিভ্রমণ কোরে এলেম, উপকার পেলেম? —দুশ্চিন্তা বেড়ে গেল, প্রাণের ভিতর আঘাত লাগলো, নিদ্রাদেবী আমারে একবারও দয়া কোল্লেন না; সমস্ত রজনী আমি অসুখী হয়েই জাগরণ কোল্লেম। একটি সুখ, ঐ কল্পনা; — বন্ধবান্ধনগণকে চিঠি লিখবো।
রজনী প্রভাত। সূর্যোদয়ের পূর্বে গাত্রোত্থান কোরে আমি একবার নীচে নেমে এলেম, সম্মুখের রাস্তাটি উদাসনয়নে দর্শন কোল্লেম; সে ভাব আমার মনে কেন উদয় হয়েছিল, আমি নিজেই তা জানতেম না। অপরাপর স্থানে, অপরাপর সময়ে, যে যে বাড়ীতে আমি আশ্রয় পেয়েছিলেম, সেই সকল বাড়ীতে একটি না একটি অনুগত লোকের সঙ্গে আমার আত্মীয়তা ঘোটেছিল। বাবু হোক, সরকার হোক, সামান্য একজন চাকর হোক, যেই হোক, একটি না একটি লোকের সঙ্গে আমার সম্ভাব সঞ্চারিত হতো; কথা কহিবার দোসর পেতেম; এখানে সেটি ঘটে নাই। প্রথমে দেখেছিলেম, দেওয়ান।
আমার সঙ্গে কথা কোয়েছিলেন, এখনো কথা হয়, কিন্তু সে সকল কথা যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। অপরাপর লোকের সঙ্গেও কথা হয়, সে সকল কথাতেও কোন রস থাকে না। রাজার সঙ্গেও কথা চলে, কিন্তু সেই সকল কথায় আমার হৃদয়ের ভার যেন আরো বেশী বেশী গুরুভার মনে হয়। মনের কথা বোলতে পারি, পাটনার রাজবাড়ীতে তেমন সুখের সুখী, দুঃখের দুঃখী একটি লোকও পাই না, বাড়ী থেকে বেরিয়ে সহর দেখতে যাই না, সর্বদাই আমারে বাড়ীর মধ্যে বাস কোত্তে হয়। রাজাবাহাদুর আমারে গত কল্য উদ্যানে নিয়ে গিয়েছিলেন, সুখী হব ভেবেছিলেম, বিপরীত হয়ে গেল।
আজ আমি রাস্তা দেখছি কেন? পালিয়ে যাবার জন্য কি?—তা নয়; চিঠি লিখতে হবে। কাগজ, কলম, কালি, ডাকের টিকিট আবশ্যক আছে। রাজবাড়ীতে সমস্যা আছে, সমস্তই হয় তো পেতে পারি, কিন্তু আমি চাইবো না; মনের কথা কাহাকেও জানতে দিব না; রাজকিঙ্করগণের মধ্যে কাহাকেও সেই উপকরণগুলি সংগ্রহ কোরে দিবার অনুরোধ কোরবো না, বাজার থেকে নিজেই সেইগুলি খরিদ কোরে আনা আমার অভিলাষ; সেই নিমিত্তই রাস্তা-দর্শন। কোন দিক দিয়ে কোথায় যেতে হবে সেইটি আমি ঠিক কোরে রাখলেম। অপর হেন কাহাকেও কিছু না বোলে রাজবাড়ী থেকে আমি বেরুলেম। এ বাড়ীকে বারম্বার আমি রাজবাড়ী বোলছি কেন? ভদ্রাসন না হোলেও মোহনবাবু এখন রাজা; অতএব বাড়ীর নাম এখন রাজবাড়ী।
প্রয়োজন সিদ্ধ কোরে সন্ধ্যার মধ্যেই আমি ফিরে এলেম। দিনমানেও রাজার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছিল, সন্ধ্যার পরেও সাক্ষাৎ হলো, পূর্বদিনের কোন কথাই তিনি উত্থাপন কোল্লেন না, তাঁর মুখের ভাবেও কোন প্রকার বিরক্তিলক্ষণ লক্ষিত হলো না, আমি সে প্রসঙ্গে তাঁরে কোন কথা বোল্লেম না। নিত্য যেমন হয়ে থাকে, সেই রকম পাঁচ প্রকার মজলিসী কথায় সম্ভবমত পরিতৃপ্ত হওয়া গেল। রাত্রি দশটা। আহারাদির পর সকলে স্ব স্ব স্থানে শয়ন কোল্লেন, আমার শয়নের জন্য যে ঘরটি নির্দিষ্ট হয়েছিল, সেই ঘরে আমি বোসলেম।
এক ঘণ্টাকাল অনেক রকম আমি ভাবলেম, তার পর চিঠি লেখা আরম্ভ কোল্লেম। ঘরের দরজা বন্ধ করা হয়েছিল; কি আমি কোচ্ছি, হঠাৎ কেহ এসে দেখতে পাবে, সে ভয় ছিল না, নির্ভয়ে আমি চিঠি লিখতে লাগলেম। সাতখানি চিঠি; কাশীতে রমণবাবুর নামে একখানি, বরদায় রাজকুমার রণেন্দ্ররাও বাহাদুরের নামে একখানি; মুর্শিদাবাদে দীনবন্ধু বাবু, পশুপতিবাবু, শান্তিরাম দত্ত, মণিভূষণ দত্ত, এই চারি নামে চারিখানি আর মাণিকগঞ্জে হরিহরবাবুর নামে একখানি, এই সাতখানি। মোড়ক কোরে শিরোনাম লিখে, সেই পত্রগুলি আমি শয্যাতলে রেখে দিলেম; পরদিন প্রভাতে প্রভাতী-বায়ু সেবন-ব্যাপদেশে সেগুলি আমি স্বয়ং ডাকঘরের ডাকবাক্সে দিয়ে এলেম। একটা ভাবনা দূর হলো।