হরিদাসের গুপ্তকথাতৃতীয় খণ্ড
দ্বিতীয় কল্প : হায় হায়! আমি পাগল!
অষ্টাহ অতীত। রাজাবাহাদুরের সঙ্গে নিত্য আমার দেখা হয়, নিত্য তিনি আমারে উৎসাহবাক্যে আশা প্রদান করেন; আশ্রিতের প্রতি আশ্রয়দাতার যেরূপ স্নেহ থাকা সম্ভব, আমার প্রতি রাজা মোহনলাল সেইরূপ স্নেহ প্রদর্শন করেন; তাঁর কপট ব্যবহার জেনে শুনেও ঐ প্রকার বাহ্য ব্যবহারে আমি তুষ্ট থাকি। খেলাঘরের খেলার ন্যায় মিথ্যাবস্তুগুলিকে মনে মনে আমি সত্য সাজে সাজাই। কাজকর্ম কোরবো, রাজাবাহাদুর আমারে ভাল ভাল কাজকর্ম দিবেন, এইরূপ আশা করি, এইরূপ আশা পাই। যে সব কথা অন্তরে জাগে, এক এক সময় সে সব কথা ভুলে ভুলে থাকি।
দিবসে উপবেশনের নিমিত্ত আমার একটি স্বতন্ত্র গৃহ নিদিষ্ট ছিল, প্রয়োজন ব্যতিরেকে কেহ সে গৃহে হঠাৎ প্রবেশ কোত্তেন না। একদিন অপরাহ্ণে একটি ভদ্রলোক সহাস্যবদনে সহসা আমার সম্মুখে উপস্থিত হোলেন। কথাবার্তা কিছুই নাই, লোকটি আপন মনে হাসতে হাসতে আমার বিছানার উপর বোসলেন, হাসতে হাসতে খানিকক্ষণ অনিমেষনেত্রে আমার মুখের দিকে চেয়ে থাকলেন; ভাব আমি কিছুই বুঝতে পাল্লেম না। তাঁর উপস্থিতির কারণ জানবার অভিলাষে কোন কথাই আমি জিজ্ঞাসা কোল্লেম না। তিনিও নিস্তব্ধ, আমিও নিস্তব্ধ। বিশেষের মধ্যে তাঁর মুখে হাস্য ছিল, আমার মুখ বিস্ময়ভাব প্রকাশক।
লোকটির পরিচ্ছদ ভদ্রলোকের ন্যায়, চেহারায় কিন্তু তদ্রূপ ভদ্রতার কোন লক্ষণ প্রকাশ পায় না। সচরাচর বড়লোকের দরবারে মোসাহেব লোকের যেরূপ ভাব-ভঙ্গী দৃষ্ট হয়, এই লোকের ভাব-ভঙ্গী সেই প্রকার। বাক্যশ্রবণ না কোল্লে প্রকৃতি বুঝা যায় না; প্রকৃতির বিচারে আমি অক্ষম থাকলেম। লোকটির চক্ষু আমার মুখের দিকে, আমার চক্ষু তাঁর মুখের দিকে। এই ভাবে থাকতে থাকতে হেসে হেসে তিনি আমারে জিজ্ঞাসা কোল্লেন, “তোমার কি কোন প্রকার অসুখ আছে?”
অদ্ভুত প্রশ্ন! কস্মিনকালেও দেখা-সাক্ষাৎ নাই, আমার সুখাসুখের কথা কেহ তাঁরে বলেও নাই, অকস্মাৎ তিনি আমারে অমন কথা কেন জিজ্ঞাসা করেন? আমি উত্তর কোল্লেম না; দুই তিনবার মস্তকসঞ্চালন কোরে পুনরায় তিনি আপনা আপনি বোল্লেন, “ওহো! সেই কথাই ঠিক বটে। সে রকম না হোলে এ রকমটা হয় না সেই কথাই ঠিক বটে! আত্মগত বাক্যে এইরূপ মন্তব্য দিয়ে পূর্ববৎ হাসতে হাসতে আমারে তিনি বোল্লেন, “দেখি দেখি, তোমার হাতখানি একবার দেখি।”
আমি মনে কোল্লেম, হয় তো গণকঠাকুর; সামুদ্রিকবিদ্যায় পণ্ডিত; এই মনে কোরে আমি আমার দক্ষিণ করতলটি তাঁর সম্মুখে বিস্তার কোল্লেম। হাস্য কোরে তিনি বোল্লেন, “ও রকম নয়, ও রকম নয়, নাড়ী পরীক্ষা করা আবশ্যক।”
হাতখানি সরিয়ে নিয়ে বিরক্তভাবে আমি বোল্লেম, “শরীরে আমার কোন পীড়া নাই নাড়ী-পরীক্ষার কিছুই প্রয়োজন আমি দেখছি না।”— আমার কথা তিনি শুনলেন না নিকটে সোরে এসে আমার হাতখানি ধোরে তিনবার তিনি টিপে টিপে দেখলেন, মাথা হেলিয়ে হাতের কাছে কাণ পাতলেন, তার পর হুঁ হুঁ শব্দ উচ্চারণ কোরে পূর্বের ন্যায় তিনবার মস্তকসঞ্চালন কোল্লেন; হাসতে হাসতে বোলতে লাগলেন, “সে রকম কিছু নয় বটে কিন্তু কোথা থেকে তুমি এসেছ? কোন কোন লোক তোমাকে বুঝি অনেক কষ্ট দিয়েছে? তুমি বুঝি দেশে দেশে বেড়িয়ে বেড়িয়ে অতিশয় ক্লান্ত হয়ে পোড়েছ? লোকেরা বুঝি তোমার অন্বেষণে যেখানে সেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে? কোথাও বুঝি তুমি স্থির হোতে পাচ্ছো না? নাড়ীর লক্ষণে সেই রকম আমি দেখছি। অজ্ঞাত লোকেরা তোমার পরম শত্রু। কেন তারা তোমার উপর সে রকম দৌরাত্মা করে? কেন তারা তোমার পাছে পাছে দেশে দেশে ঘোরে?”
যখন তিনি আমার নাড়ী-পরীক্ষা করেন, সে সময় আমি ভেবেছিলেম, তিনি হয় তো বৈদ্যরাজ, শেষের কথাগুলি শুনে মনে কোল্লেম, তা নয়; কেবল বৈদ্যরাজ নয়, গণনাবিদ্যায় তাঁর দক্ষতা আছে। যে সব কথা তিনি বোল্লেন, যদি অন্য কারো মুখে না শুনে থাকেন, তবে তো সে সব কথায় তাঁর পাণ্ডিত্যের পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে। পূর্বে যতটা বিরাগ জন্মেছিল, ততটা থাকলো না, গণকঠাকুর মনে কোরে তাঁর গুণপণার উপর আমার কিঞ্চিৎ ভক্তির সঞ্চার হলো। তখনো তিনি মুখ টিপে টিপে হাসছিলেন। হাসে কেন? আমি কষ্টে পোড়েছি, লোকের উপদ্রবে কষ্ট পেয়েছি, সে সব কথা জানতে পেরে কাহার মুখে হাসি আসে? লোকটির স্বভাব বুঝি ঐ রকম, সর্বদাই হাস্য করা বুঝি তাঁর অভ্যাস, এইরূপে বিবেচনা কোরে দুই চারি কথায় আমি বোল্লেম, “আজ্ঞা হাঁ লোকে অকারণে আমার শত্রু হয়েছে, তারা আমারে বিস্তর কষ্ট দিয়েছে, এখনো পৰ্যন্ত ক্ষান্ত হয় নাই, বেশী কথা কি, বাগে পেলে তারা আমারে প্রাণে মাত্তে পারে, সে সব আমি জানতে পেরেছি।”
গণক, বৈদ্য অথবা সামুদ্রিক এই তিনের মধ্যে লোকটি যাই হোন, বিশ্বাস কোরে আমি তাঁরে বোল্লেম, “শত্রুর কুচক্রে সর্বদাই আমি বিপদাপন্ন।” সেই কথা শুনে সেইভাবে তিনি বোল্লেন, “হোতেই পারে, হোতেই পারে; তুমি মিথ্যাকথা বোলছো না। সত্য সত্যই তোমার পাছে শত্রু লেগেছে। তুমি বেশ ছেলে, কেন তারা তোমার শত্রু হলো, আমি বুঝতে পাচ্ছি না। আচ্ছা, তোমার বাড়ী কোন গ্রামে? তোমার পিতার নাম কি?”
বিশ্বস্তভাবে আমি উত্তর কোল্লেম, “তা আমি জানি না, বাড়ী-ঘর আমার নাই, মাতা-পিতার পরিচয় আমি অজ্ঞাত, যেখানে যখন আমি যাই, এক একটি মহৎলোকের কাছে আশ্রয় পাই, আমার দুর্দশা শুনে তাঁরা দুঃখপ্রকাশ করেন; সেখানেও আমার সঙ্গে সঙ্গে শত্রু ঘোরে, কোথাও আমি শান্তি পাই না। এই রাজাবাহাদুর পূর্বে আমারে দেখেছিলেন, নিরাশ্রয় দেখে আশ্রয় দিতে চেয়েছিলেন, তাঁর কাছে থাকতে আমি সম্মত হই নাই; মধ্যে কিছুদিন দেখা-শুনা ছিল না, সম্প্রতি তিনি আমারে এইখানে আনিয়াছেন; এখন এইখানেই আমি আছি।”
একবার ঊর্ধ্ব দিকে দৃষ্টিপাত কোরে লোকটি বোল্লেন, “হাঁ হাঁ; সেই কথাই তো আমি বোলছি, শত্রুর ভয়ে, শত্রুর উপদ্রবে কোথাও তুমি স্থির হোতে পাচ্ছো না। রাজাবাহাদুর আনিয়েছেন, এইখানেই তুমি আছ, সে কথা আমি জানতে পেরেছি; কিন্তু আচ্ছা, কারা তোমার শত্রু, কি কারণে তারা তোমার শত্রু, সে কথা তুমি বোলতে পার? শত্রু পক্ষের নাম তুমি জানো?”
তাৎক্ষণাৎ আমি কোন উত্তর দিলেম না, মনে কোল্লেম, এ সকল কি কথা? আমার অবস্থার কথা ইনি জানেন; শত্রু লেগেছে, সে কথাও বোলছেন, বোলতে বোলতে শত্রু পক্ষের নাম জিজ্ঞাসা করেন কেন? নাম যদিও আমি জানি, কিন্তু সেই নামের সঙ্গে কতদূরে টান পড়ে সেটা ভাবতে গেলে প্রকাশ কোত্তে সাহস হয় না। শত্রু, আমার একটি নয়, অনেক; কার নাম বোলতে কার নাম আনবো, কোথায় গিয়ে পরিণাম দাঁড়াবে, ঠিক নাই, ফল বরং বিপরীত দাঁড়াবার সম্ভাবনা। এইরূপে চিন্তা কোরে আমি উত্তর কোল্লেম, “গুপ্তশত্রুর নাম নিঃসন্দেহে জানা যেতে পারে না। যাদের উপর আমার সন্দেহ হয়, তারা আমারে কিরূপ বিবেচনা করে, তাও আমি জানি না। অমুক অমুক আমার শত্রু, অমুক অমুক আমার প্রাণবিনাশে উদ্যত, ঠিক ঠিক তা যদি আমি জানতেম তা হোলে আদালতের সাহায্য নিতে পাত্তেম। যারা গোপনে থেকে যুদ্ধ করে, তাদের নাম বোলতে আমি ভয় পাই।”
লোকটি আমার কথার প্রতিধ্বনি কোরে বোল্লেন, “তা তো বটেই! তা তো বটে! ঠিক কথাই তুমি বোলেছ! নাম বোলতে তুমি ভয় পাও! আমরাও ভয় পাই। আহা! বিস্তর কষ্ট তুমি পেয়েছ! যারা তোমাকে কষ্ট দিচ্ছে, তারা শাস্তি পাবে; এখানে না পায়, মরণান্তে যমলোকে অথবা অপর কোন পরলোকে অবশ্যই তারা শাস্তি পাবে। ও কি? তুমি অমন কোরে কাঁদ কেন? অসুখ হয়েছে, সেরে যাবে; শত্রু হয়েছে, ধরা পোড়বে; ভয় কি? রাজার বাড়ীতে এসেছ, রাজার বাজী আছ, কিসে তোমার ভয়? রোদন সংবরণ কর; শীঘ্রই আবার আমি তোমার কাছে আসছি, এখান থেকে তুমি কোথাও যেয়ো না।”
এই সব কথা বোলে, মুখে টিপে হাসতে হাসতে সে লোকটি আমার ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। কোথাকার লোক?— কে সে? —কি সব কথা বোলে গেল? আমি কাঁদছি! কে তারে বোল্লে আমি কাঁদছি? লোকটা কোন চক্ষে দেখলে আমি কাঁদছি? প্রথমেই তারে দেখে, তার কথা শুনে, আমি মনে কোরেছিলেম, গণকঠাকুর, তার পর ভেবেছিলেম বৈদ্যরাজ, এখন বুঝতে পাচ্ছি, কিছুই না। ভণ্ডলোক! যে সকল লোক কেবল কথা বেচে খায়, পাঁচ রকম কথা বোলে লোকের মন ভুলাবার চেষ্টা পায়, ‘অসাধ্য রোগের অব্যর্থ ঔষধ জানি’ বোলে যারা অবোধ লোকের পয়সা ফাঁকি দেয়, ঐ লোক হয় তো সেই দলের লোক হবে, এইরূপে আমার সন্দেহ হলো।
সন্দেহের কথাটা মনে মনে আলোচনা কোচ্ছি, সম্মুখে দেখি, আর একটি লোক। যে লোকটিরও অধর ওষ্ঠে মৃদু হাস্য। যে আসে, সেই হাসে, ব্যাপার কি? আমারে দেখলে নূতন লোকের হাসি পায়, পাটনায় এসে আমি কি সেই রকমের কোন আশ্চর্য বস্তু হয়ে পোড়েছি? লোকটি এলো, কৃষ্ণঠাকুরের মত পায়ের উপর পা দিয়ে আমার সম্মুখে দাঁড়ালো, হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা কোল্লে, “কি হে বালক! তোমারই নাম হরিদাস? জায়গায় জায়গায় তুমি না কি বিস্তর কষ্ট পেয়েছ? অজানা লোকেরা বা কি তোমার উপর বেজায় দৌরাত্ম্য কোরেছে? হায় হায়! এমন লক্ষ্মীছেলে তুমি, এমন চমৎকার রূপ তোমার, হায় হায়। তোমার উপর দৌরাত্ম্য? কেন তারা তোমার উপর দৌরাত্ম্য করে? মানুষ? না ভূত? হাঃ। হাঃ হাঃ! ভূতেরাই তোমার মত ছোট ছোট ছেলেদের উপর প্রতাপ দেখায়! নিশ্চয় তারা ভূত!”
লোকটি ঝড়ের মত একসঙ্গে কত কথাই বোলে গেল, একটি কথাতেও আমি কোন উত্তর দিলেম না। নূতন লোকে অত কথা কেন বলে, কোন কথার সঙ্গে কোন কথার মিল নাই, বিকারগ্রস্ত রোগীর প্রলাপের ন্যায় প্রায় সকল কথাই অসম্বদ্ধ। লোকটির উদ্দেশ্য কি বুঝা গেল না। তার মুখপানে আমি চেয়ে দেখলেম, কেবল হাস্য; মাঝে মাঝে যতবার চেয়ে দেখেছি, ততবারই দেখেছি, সমভাবে হাস্য। শেষবার যখন আমি দেখলেম, তখন সেই মুখে একটু গাম্ভীৰ্য অনুভূত হলো। গম্ভীরভাব ধারণ কোরে লোকটি তখন আপন মনে বোল্লে, “তাই তো! তাই তো দেখছি! কাণ্ডখানা কি? এত অল্পবয়সে— আচ্ছা, আচ্ছা, —এখনো উপায় আছে।”
“উপায় আছে” বোলতে বোলতে সেই লোক ধীরে ধীরে বাহির হয়ে গেল। কিসের উপায় আছে, আমি কিছু অনভব কোত্তে পাল্লেম না। সন্ধ্যার পর আর একজন? সেই তৃতীয় ব্যক্তিও পূর্বোক্ত দুইজনের ন্যায় অভিনয় কোরে গেল। প্রথম লোকটির কথায় বরং আমি দুই চারিটি উত্তর দিয়েছিলেম, এদের দুইজনের বক্তৃতার সময় উদাসভাবে আমি মৌন। কেন তারা এসেছিল, কেন তারা ঐ সব কথা বোল্লে, “আহা! আহা!” বোলে কেন তারা দুঃখপ্রকাশ কোল্লে, তারাই তা বোলতে পারে, আমি বোলতে পারি না। তারা নূতন; পরিচ্ছদ-পারিপাট্যে ভদ্রলোক, কথাগুলো কিন্তু ভদ্রলোকের কথার মত বোধ হলো না। আমার কষ্টের কথা উত্থাপন কোরে কেন তারা ততটা বাগাড়ম্বর বিস্তার কোরে গেল, আমার কষ্টের কথায় কেন তারা কষ্ট জানালে, সন্দেহে সন্দেহে তাই আমি ভাবতে লাগলেম।”
এই ঘটনার পর দশদিন অতিক্রান্ত। যারা ঐরূপে আমার বিস্ময় উৎপাদন কোরেছিল, এই দশদিনের মধ্যে তারা কেহই আর একদিনও আমার সঙ্গে দেখা কোত্তে এলো না। রাজার সঙ্গে আমি দেখা করি, রাজা মিষ্ট মিষ্ট কথা কন, হিতোপদেশ শিক্ষা দেন, হাসির কথা উত্থাপিত হোলে একটু একটু হাস্য করেন, বাগানের কথাটা একবারও আমার সাক্ষাতে আর উত্থাপন করেন না; এই রকমে দিন যায়। একদিন সন্ধ্যার পর রাজা আমারে ডেকে পাঠালেন। যে ঘরে তিনি বসেন, সেটির নাম খাসকামরা, সেই ঘরে গিয়ে আমি উপস্থিত হোলেম।
দেড় হাত উচ্চ গদীর উপর রাজাবাহাদুর উপবিষ্ট। আশেপাশে অনেক লোক। রাজার অতি নিকটে পাঁচজন; সেই পাঁচজনের মধ্যে একজন রাজগদীস কিনারার উপর হাতের কনুই রেখে, রাজার দিকে একটু হেলে, তাঁর কাণের কাছে কি যেন পরামর্শ দিচ্ছিল। বড় বড় লোকের মজলীসে ঐ রকমের লোক অনেক থাকে। গদীর গায়ে জানু রাখা, কণুই রাখা, মাথা রাখা সেই সব লোকের শ্লাঘাজনক দাম্ভিকতার পরিচয়; তারা ভাবে, আমাদের এইরূপ ভঙ্গী দেখে লোকে ভাবুক, আমরাও এক একজন বড়দলের লোকের মধ্যে গণ্য। বড়লোকের কাণের কাছে মুখ রেখে মিছামিছি মন্ত্র পড়াও ঐরূপ শ্লাঘাবিজ্ঞাপক; অমুক লোক অমুক রাজার অথবা অমুক বাবুর পরম প্রিয়পাত্র, দর্শকলোকের মনে এইরূপ বিশ্বাস উৎপাদন করা সেই সকল অভিমানী লোকের গূঢ় অভিপ্রায়। বড় বড় মজলীসে সর্বদা যাঁরা গতিবিধি করেন, তাঁদের মধ্যে যাঁরা সূক্ষ্মদর্শী, তাঁরা সকলেই জানেন, অনেক লোকেরই ঐ প্রকার অভ্যাস।
আমি উপস্থিত হোলেম। বেদীর উপর পুরাণবক্তা কথকঠাকুর, মঞ্চোপরি রাজনীতিবক্তা বাগ্মীবাবু, নাট্যশালার রঙ্গমঞ্চে নান্দীপাঠক রসিক নট,—সঙযাত্রার আসরে রাক্ষস-বানররূপী নূতন সং, এই সকল মূর্তির প্রতি দর্শকলোকের চক্ষু যেমন সুস্থিরভাবে আকৃষ্ট থাকে, রাজমজলীসের সমস্ত লোকের চক্ষু সেইরূপে আমার প্রতি সমাকৃষ্ট। সমস্ত চক্ষুর সঙ্গে রাজার চক্ষু প্রথমে আমার দিকে নিক্ষিপ্ত হয় নাই, একটু পরে নেত্রোত্তোলন কোরে আমারে দেখে প্রসন্নবদনে রাজা বোল্লেন, “এসো হরিদাস, বোসো।”
একটি পাশে চুপটি কোরে আমি বোসলেম। লোকেরা খানিকক্ষণ সমভাবে আমার দিকে চেয়ে থাকলো; দুই একজন একটু একটু হেলে হেলে পরস্পর ফুস ফুস কোরে কি যেন বলাবলি কোত্তে লাগলো, ভাব আমি অনুভব কোত্তে পাল্লেম না। হাঁ, একটি কথা বোলতে আমি ভুলেছি। ইতিপূর্বে তিন সময়ে যে তিনটি লোক আমার কষ্টে সমবেদনা জানাতে আমার ঘরে গিয়েছিল, তাদের মধ্যে একজনকে ঐ মজলীসে আমি দেখেছিলেম; রাজার অতি নিকটে যে পাঁচটি লোক উপবিষ্ট ছিল। তাদেরই মধ্যে সেই লোক। সেই পাঁচজনের দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ কোরে রাজাবাহাদুর আমারে বোল্লেন, “দেখ হরিদাস! এখানে এসে অবধি তুমি যে প্রকার উন্মনা উন্মনা ভাব দেখাচ্ছো, মাঝে মাঝে লোকের সঙ্গে,— কেবল লোকের সঙ্গে কেন, মাঝে মাঝে আমার কাছেও তুমি যে প্রকার অর্থশূন্য তাৎপৰ্যশূন্য কথা কও, তাতে যেন বুঝা যায়, নানা কষ্টে, নানা ভাবনায় তোমার বুদ্ধি বিচলিত হয়েছে, মাথা যেন কেমন খারাপ হয়ে গিয়েছে চাউনীতেও এক এক সময় সেইরূপ লক্ষণ প্রকাশ পায়। এই পাঁচটি বাবু এখানকার লব্ধপ্রতিষ্ঠ ডাক্তার; পরীক্ষা কোরে এই ডাক্তারবাবুরা যেরূপ ব্যবস্থা দিবেন, সেই ব্যবস্থামতেই তোমাকে চোলতে হবে। আমার কাছে তুমি এসেছ, তুমি পীড়িত, যাতে কোরে তোমার চিকিৎসা হয়, সেরূপ বন্দোবস্ত করা আমারই কর্তব্য।”
পাঁচজনের মুখের দিকে এক একবার চেয়ে, রাজার মুখের দিকে দুটি চক্ষু আমি স্থির কোরে রাখলেম। ডাক্তারের মধ্যে একজন সেই সময় মন্তব্য দিলেন, “পরীক্ষা নিষ্প্রয়োজন, মুখে-চক্ষের ভাব দেখেই প্রকৃত অবস্থা আমরা বুঝতে পেরেছি। বিশেষ, এই নীলাম্বরবাবু যে সব কথা বোলেছেন, তাতে আর নূতন পরীক্ষা করা আমরা আবশ্যক বিবেচনা কোচ্ছি না। রোগ এখনো প্রবল হয় নাই, দুই একটা লক্ষণ প্রকাশ পাচ্ছে মাত্র, সামান্য ঔষধেই আরাম হয়ে যাবে।”
নীলাম্বরবাবুর কথার উপরেই ডাক্তারগুলির পূর্ণ বিশ্বাস। নীলাম্বরবাবু কে? যে তিনটি লোক পূর্বে আমারে ছলনা কোরে এসেছিলেন, তাদের মধ্যে যাঁকে আমি এই মজলীসে চিনেছি তাঁরই নাম নীলাম্বরবাবু; মোটামুটি পরিচয় পেয়ে এখন আমি চিনলেম, ইনি একজন ডাক্তার। হা জগদীশ্বর! ডাক্তারের সঙ্গে আমার কিসের সম্পর্ক? শরীর আমার বিলক্ষণ সুস্থ, অবস্থাচিন্তনে মন চাঞ্চল্য, কি কারণে চাঞ্চল্য, আমিই তা জানি, সে চাঞ্চল্যের কারণ নিরূপণ করা ডাক্তার-কবিরাজের সাধ্য নয়। তবে কেন আমি ডাক্তারের চক্রে নিক্ষিপ্ত হোলেম?
উদ্বিগ্ন হয়ে এই রকম আমি ভাবছি, দলের ভিতর থেকে আর একটি লোক একটু মাথা উঁচু কোরে সেই সময় বোলে উঠলেন, “ততদূর বোধ হয় যেতে হবে না; রঘুনাথবাবু বোলছেন, সামান্য ঔষধেই আরাম হবে। আমি শুনেছি, ইংরাজীমতের ডাক্তারখানায় সামান্য ঔষধ থাকে না; যতই সামান্য হোক, সমস্ত ঔষধের শক্তি গরম; এ ছোকরাকে গরম ঔষধ দিবার দরকার নাই। আমার ঘরে পঞ্চানন্দের বিল্বপত্র আছে, সেই বিল্বপত্র ধরে একটু খাইয়ে দিলেই এক রাত্রির মধ্যে এ রোগটা সেরে যাবে।”
হো হো শব্দে সকলেই হেসে উঠলেন, ম্রিয়মাণ হয়ে আমি মাথা হেঁট কোল্লেম; মনে ভাবলেম, এই জন্য কি রাজাবাহাদুর আমারে পাটনায় আনালেন? গুপ্তরথীরা গুপ্তশর সন্ধান কোরে আমারে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছিল, সে এক রকম ছিল ভাল, এখন কি না বহুরথী একত্র হয়ে আমার এই ক্ষুদ্রপ্রাণ সংহার কোত্তে উদ্যত। বিদ্রূপের অগ্নিবাণে আমার অন্তরাত্মা যেন জ্বোলে যাচ্ছে! ভাবলো এই রকম, মুখে কিছু বোল্লেম না। বুঝলেম রঘুনাথবাবু একজন ডাক্তারের নাম, রঘুনাথের ব্যবস্থা খণ্ডন কোরে কিম্বা খণ্ডন করবার চেষ্টা কোরে যিনি পঞ্চানন্দের বিল্বপত্রের ব্যবস্থা দিলেন, তিনি একজন কবিরাজ। ধর্মজ্ঞানে জলাঞ্জলি দিয়ে যাঁরা কেবল অর্থ লোভে ডাক্তার-কবিরাজের নাম কলঙ্কিত করেন, তাঁদের অসাধ্য কাৰ্য কিছুই নাই। একবার আমি শুনেছিলেম, একজন অর্থলোভী জমীদার তুচ্ছ বিষয়লোভে আপনার বাড়ীর একটি স্ত্রীলোককে পৃথিবী থেকে তফাৎ করবার অভিপ্রায়ে একজন ডাক্তারের আর দুজন বৈদ্যবংশীয় কবিরাজের গুপ্তসাহায্য গ্রহণ করেন, বিসূচিকা রোগ, এইরূপ প্রকাশ কোরে চিকিৎসকেরা সেই বিধবা বধূটিকে প্রাণঘাতক ঔষধ সেবন করান। অনবরত ঘর্ম হয়; আবীরে ঘর্ম নিবারণ করে, সেই ছলে বিধবার সর্বাঙ্গে সাত সের আন্দাজ আবীর মাখানো হয়; আবীর সেই আবীরাকে অতি শীঘ্র যমালয়ে প্রেরণ করে। ধর্মশীল চিকিৎসকেরা সেই মহৎ কার্যে লক্ষাধিক মুদ্রা পুরস্কার পেয়েছিলেন এইরূপ আমার শুনা আছে, যখন এই পাটনাসহরে বিনা রোগে ডাক্তার-কবিরাজের চিকিৎসায় আমার অদৃষ্টে কি ঘটে, ভগবান কি করেন, কিছুই আমি বোলতে পারি না।”
মজলীসে অনেক প্রকার পরামর্শ হলো; চুপি চুপি পরামর্শই অনেক, সকলের সকল কথা আমি শুনতে পেলেম না। মজলীস থেকে উঠে আমি আসি আসি মনে কোচ্ছি, এমন সময় রাজাবাহাদুর বোল্লেন, “দেখ হরিদাস! আমার কথায় তুমি অবহেলা কোরো না; যা আমি বুঝেছি, তাই তোমাকে বোলেছি; তোমার চিকিৎসার জন্যই এই বিজ্ঞ বিজ্ঞ ডাক্তারগুলিকে আমি ডেকেছি। অবহেলা কোরো না, অবাধ্য হয়ো না; ডাক্তার-কবিরাজের অবাধ্য হোলে রোগ তো সারেই না, বরং বিপরীত হয়ে দাঁড়ায়। আমার এই কথাগুলি তুমি মনে রেখো।”
আমি বিবেচনা কোল্লেম, যাঁর যা কিছু বলবার ছিল, শেষ হয়ে গেল, তবে আর কেন সেখানে বোসে থাকা। ধীরে ধীরে আমি উঠলেম; মজলীসকে নমস্কার কোরে ভগ্নান্তঃকরণে বিদায় চাইলেম। প্রায় আধ ঘণ্টা মজলীসে ছিলেম, অতক্ষণের মধ্যে একটি কথাও আমার রসনা থেকে নির্গত হয় নাই, বিদায়-প্রার্থনাই সে মজলীসে আমার প্রথম কথা।
কতকগুলি লোক হো হো শব্দে হেসে উঠলেন। হাস্যের কারণ বুঝতে না পেরেও আমি অপ্রতিভ হোলেম। পূর্বে যাঁরা কথা কয়েছিলেন, জানা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে একজনের নাম রঘুনাথ। যিনি রঘুনাথ, তিনি একজন ডাক্তার; আমার প্রস্থানের উপক্রমে বাধা দিয়ে, রাজার নিকট থেকে উঠে এসে তিনি আমারে বোল্লেন, “সত্য সত্যই বুদ্ধির স্থিরতা নাই; কোথায় চোলেছ?— বোসো; তোমার রূপদর্শনের জন্য এখানে তোমাকে আহ্বান করা হয় নাই, তোমার প্রতি আমাদের গুটিকতক জিজ্ঞাস্য আছে বোসো; অত ব্যস্ত হোচ্ছ কেন? তোমার চিকিৎসার জন্য রাজাবাহাদুরের আহ্বানে আমরা এখানে এসেছি;: ব্যাধিটা অগ্রে নির্ণয় করা হোক, তার পর তোমার ছুটি।”
অপ্রস্তুত হয়ে পুনরায় আমি আসন গ্রহণ কোল্লেম। রাজাবাহাদুর একবার আমার দিকে চাইলেন; কিন্তু মুখে কিছু বোল্লেন না। দশদিন পূর্বে যে তিনটি লোক এসে আমার গৃহে উপস্থিত হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে একজন এই মজলীসে উপস্থিত আছেন এ কথা আমি পূর্বে বোলেছি। সেই লোকটি ছাড়া ডাক্তারের দলের অপর চারিটি লোক সে সময় রাজার নিকট থেকে সোরে এসে আমারে ঘিরে বোসলেন; সুস্থির নয়নে ক্ষণকাল আমার মুখের দিকে চেয়ে থাকলেন। দর্শনকার্যের অবসানে একজন একটউ বিস্ময় প্রকাশ কোরে বোল্লেন, “এ ছোকরা যথার্থ অনেক কষ্টভোগ কোরেছে, অনেক লোক এই ছোকরার শত্রু হয়েছে, এক একটা শত্রুর চেহারার ছায়া এই ছোকরার নেত্র পুতুলীতে দেখা যাচ্ছে।”— প্রতিধ্বনি কোরে আর একজন বোল্লেন, “ঠিক, ঠিক, আমিও যেন তাই দেখতে পাচ্ছি। মানুষ চিনতে পাচ্ছি না, কিন্তু ছায়াগুলো ঘরে ঘরে বেড়াচ্ছে, বেশ দেখা যাচ্ছে।”— তৃতীয় ব্যক্তি বোল্লেন, “শুধু তাই নয়, এ ছোকরা এত বয়স পর্যন্ত নিজের পরিচয় নিজে জানে না, সেই জন্য চক্ষুর পুতুলীতে স্পষ্ট কাহার মুখ দেখা যায় না, কেবল ছায়া দেখা যায়।”—চতুর্থ ব্যক্তির প্রকৃতি কিছু গম্ভীর, মুখের আকৃতিও গম্ভীর। তাঁর মুখে দাড়ী ছিল; দুই হস্তে সেই দীর্ঘ দাড়ীতে ঢেউ খেলিয়ে খেলিয়ে তিনি বোল্লেন, “আপনারা করেন কি? ছায়াবাজীখেলার আলোচনার মত ওসব আপনারা বলেন কি? সাক্ষাতে ওসব কথা বোলতে নাই; ছোকরাকে বোলতে দিন, পরিচয় অজ্ঞাত থেকে কোন কোন চক্রে কি প্রকারে ঘুরে ঘুরে কি প্রকার কষ্ট পেয়েছে কিম্বা পাচ্ছে, বোলতে দিন। কেমন হে ছোকরা!” আমারে সম্বোধন কোরে সেই গম্ভীর লোকটি বোল্লেন, “কেমন হে ছোকরা! সেই কথাই ঠিক নয়? নিজের পরিচয় তুমি জানো না, অনেক কষ্ট পেয়েছ, অনেক শত্রু তোমার আছে, এই সব কথা ঠিক নয়?”
বার বার এক কথা; সকলের মুখেই এক কথা; এ সব কথার মানে কি, বক্তাগুলির উদ্দেশ্যই বা কি, কিছুই আমি স্থির কোত্তে পাল্লেম না; মাঝে মাঝে রোগের কথা বলে, এটাও একটা বিষম সমস্যা! যাই হোক, উত্তর দেওয়া কর্তব্য। মজলীস সরগরম, অনেক লোক একত্র,— রাজসভা, রাজা মোহনলাল ঘোষ বাহাদুর স্বয়ং সভাপতি, এ মজলীসে আমার ভাগ্যের কথা প্রকাশ কোল্লে মন্দ হবে না; সকল লোক দয়াশূন্য হবে এমন কখনই সম্ভব নয়। আমার দুঃখের কথা শুনে অবশ্যই কাহার কাহার হৃদয়ে দয়ার সঞ্চার হোলেও হোতে পারবে, আমার অনুকূলে রাজাবাহাদুরকে তাঁরা দুটি একটি কথা বোল্লেও বোলতে পারবেন, এই ভেবে সেই গম্ভীর লোকটির প্রশ্নের উত্তরে আমি বোল্লেম, “হাঁ মহাশয়! কষ্ট আমি অনেক পেয়েছি। আমার জাতি-জন্মের পরিচয় আমি জানি না; শৈশবে আমি গুরুগৃহে বাস কোত্তেম, গুরুগৃহে বাস কোত্তেম, গুরুদেবের মৃত্যুর পর একটা বদমাসলোক আমারে দেশান্তরে নিয়ে যায়, তার পর একটি ভাল জায়গায় আমি আশ্রয় পাই, এই রাজাবাহাদুর সে কথা জানেন। তার পর আমার পশ্চাতে শত্রু লাগে, শত্রু একটা নয়, অনেক জায়গায় অনেক; এক একটা শত্রুর নাম আমি জানি, কিন্তু বোলতে ভরসা হয় না। ভগবান যদি—”
যাঁরা আমারে ঘিরে বোসেছিলেন, আমার মুখে ভগবানের নাম শুনে তাঁরা হো হো কোরে হেসে উঠলেন। একজন বোল্লেন, “তা তো হোতেই পারে! আমাদেরও ও রকম হয়; শত্রুর নাম কোত্তে আমাদেরও ভরসা হয় না। ভগবান যদি সে সব নাম বোলে দেন, তা হোলেই প্রকাশ পায়, তা না হোলে চিরকাল কষ্টভোগ কোরে ছটফট কোরে বেড়াতে হয়। আহা! এ ছোকরা বড়ই কষ্ট পাচ্ছে! আপনার পরিচয়টা পর্যন্ত জানতে পাচ্ছে না, যাকে তাকে পরিচয়ের কথা জেজ্ঞাসা করে; প্রাণ সর্বদা হু হু করে কি না, কাজে কাজেই ঐ রকম; ঐ রকমেই এই দশা ঘোটেছে।”
ঐ কথাগুলি যিনি বোল্লেন, তিনি আমার দিকে চাইলেন না, শেষে আমার দিকে চেয়ে যেন কতই সদয়ভাবে বোল্লেন, “ভয় পেয়ো না তুমি, অনেক লোকের ওরকম হয়; অল্পদিন চিকিৎসা কোল্লেই আরাম হয়ে যায়, ভয় কিছু নাই। দিবারাত্রি অত ভেবো না, সকল লোকের কাছে ওরকম গল্প কোরো না; তোমার মাথার ঠিক নাই, লোকে সেটা বুঝবে না, বৃথা তুমি ঐ রকম বোকে বোকে ক্লান্ত হয়ে পোড়বে, মাথাটা আরো খারাপ হবে। চুপ কোরে থেকো, আমরা যে রকম ব্যবস্থা কোরে দিব, সেই রকম ব্যবস্থা মতে দিনকতক থাকতে থাকতেই সমস্ত উপসর্গ সেরে যাবে। আচ্ছা, এখন তুমি যেতে পার, দু-দিন পরে আমরা আবার আসবো, সে দিন যদি এই রকম দেখি, তা হোলে চিকিৎসার বন্দোবস্ত ঠিক হবে।”
রাজাবাহাদুর ঐ সকল কথা শুনলেন, কোন প্রকার অভিপ্রায় প্রকাশ কোল্লেন না। তিনি আমারে আহ্বান কোরেছিলেন, প্রয়োজন কি ছিল, ডাক্তারমহাশয়েরাই সেটি ব্যক্ত কোল্লেন। ডাক্তারগণের বক্তৃতার তাৎপর্য আমার চিকিৎসা করা। কি রোগের চিকিৎসা হবে, আমি বুঝলেম না, অথচ চিকিৎসা হবে আমার। রহস্য ভেদ করা আমার অসাধ্য। আমার জীবনের ঘটনায় প্রায় পদে পদেই রহস্য। একটা রহস্যেরও মর্মভেদে আমি সমর্থ হোলেম না, এটা সামান্য আশ্চর্য ব্যাপার নয়!
বিদায়কালে রাজাবাহাদুরের দিকে আমি চাইলেম; মুখে যেন একটু একটু হাসি ছিল, আমার দৃষ্টিপাতমাত্রেই সে হাসি লুকালো। —মন্দ নয়! অনেক বড়লোকের এইরূপ অভ্যাস আছে; অনেক অভিমানিনী রমণীরও এইরূপ প্রশংসনীয় অভ্যাস আছে; ক্ষণমাত্রে হাস্য, ক্ষণমাত্রেই গাম্ভীর্য, ক্ষণমাত্রেই বিষণ্ণতা, ক্ষণমাত্রেই চক্ষে জল। হাসা কোত্তে কোত্তে রাজাবাহাদুর গম্ভীরভাব ধারণ কোল্লেন, সেই সময় আমি নমস্কার কোল্লেম। যাও কি থাকো, একটি কথাও তিনি আমারে বোল্লেন না। মজলীসের দিকে চাইতে চাইতে রাজার খাসকামরা থেকে আমি বাহির হোলেম। মজলীসভঙ্গ হলো না, আমারে উপলক্ষ্য কোরে যেরূপ অভিনয় হয়ে গেল, মজলীসী লোকেরা সেই অভিনয় সমালোচনা আরম্ভ কোল্লেন। নিকটে দাঁড়িয়ে থাকলে কথাগুলি আমার কাণে আসতো কিন্তু আমি মনের উদ্বেগে দ্রুতগতি চোলে আসছিলেম, কথা কাণে এলো না, একটা মহোচ্চ হাস্য কোলাহল শ্রবণ কোল্লেম মাত্র। আমারে উপলক্ষ্য কোরেই সেই হাস্য, সেটি বুঝতে আমার বাকী থাকলো না।
খেলা আমি অনেক রকম দেখেছি, রাজ-মজলীসের ডাক্তারমহাশয়েরা যেরূপ খেলা দেখালেন, সেরূপ খেলা আর কখন কোথাও দেখি নাই। খেলার সামগ্রী হরিদাস। —সত্যই এ সংসারে অনেক লোকের খেলার সামগ্রী হরিদাস। ডাক্তারের মুখে যে কথাগুলি আমি শুনলেম, নিজের চিন্তাগারে প্রবেশ কোরে মনে মনে সেইগুলি আলোচনা কোল্লেম। কথাগুলি যখন কাজে দাঁড়াবে, তখন যে রঙ্গ হবে, তাই ভেবে বড় দুঃখে আমার মুখে একটু হাসি এলো।
দুদিন গেল। ডাক্তার রঘুনাথ সেইকালে বোলেছিলেন, দুদিন পরে আবার তাঁরা আমার কাছে আসবেন; আমি প্রস্তুত হয়ে থাকলেম। তৃতীয় দিবসের প্রাতঃকাল থেকে বেলা দুই প্রহর পর্যন্ত কেহই এলেন না, রাজাও আমারে ডেকে পাঠালেন না। আড়াই প্রহর, তৃতীয় প্রহর অতীত হয়ে গেল, তখনো পৰ্যন্ত কেহ দেখা দিলেন না, আমিও ঘর ছেড়ে কোথাও গেলেম না। সূৰ্য বোধ হয় আমার নূতন চিকিৎসার ব্যবস্থা দর্শন করা কষ্টকর বিবেচনা কোরে অস্তগমনের উপক্রম কোল্লেন। সন্ধ্যা হয় হয় এমন সময় নূতন ধরণের পোষাকপরা দুটি ভদ্রলোক ধীরে ধীরে ঘরে প্রবেশ কোরে আমার সম্মুখে দাঁড়ালেন। পোষাকের ধরণ নূতন হোলেও মুখের ধরণ পুরাতন দেখেই আমি চিনলেম। পঞ্চমমূর্তির মধ্যে যে দুই মূর্তির নাম পাওয়া গিয়েছিলো, তারাই তারা, নীলাম্বরবাবু আর রঘুনাথবাবু দুজনই ডাক্তার, এ পরিচয় বাহুল্য।
ডাক্তারেরা আমার বিছানার উপর বোসলেন, গম্ভীরবদনে ক্ষণকাল আমার মুখপানে চেয়ে থাকলেন। দর্পণের সাহায্য ব্যতিরেকে নিজের মুখে নিজে দেখা যায় না, আমার মুখের ভাব তখন কি রকম ছিল কিম্বা ডাক্তার দর্শনে কি রকম হয়েছিল, আমি আর জানতে পাল্লেম না; যাঁরা দেখলেন, তারা অল্পক্ষণ নিস্তব্ধ থেকে, পরস্পর মুখচাহাচাহি কোরে অস্পষ্ট ইংরাজী ভাষায় কি দুই একটি কথা বোল্লেন, ঠিক আমি বুঝতে পাল্লেম না। তাদের উভয়ের নাম আমার শূনা হয়েছিল, চেহারাও বেশ মনে ছিল। যাঁর নাম নীলাম্বরবাবু, আমারে সম্বোধন কোরে তিনি বোল্লেন “তোমার মস্তিষ্কবিকারের একটা প্রধান হেতু আমি বুঝতে পেরেছি; শুনলেম, বাড়ী থেকে তুমি একবারও বাহির হও না। নিয়ত অষ্ট প্রহর এক জায়গায় আবদ্ধ থাকলে, সহজ মানুষেরও চিত্তবিকার ঘটে। আমি বোধ করি, ঔষধসেবনের অগ্রে তুমি যদি প্রতিদিন সকাল বিকাল— সূৰ্যকিরণ যখন প্রখর হয় না,— প্রখর থাকে না, সেই সময়—দুবেলা দুবার খানিক বেড়িয়ে আসতে পার, তা হোলে প্রভাতসমীর আর সন্ধ্যাসমীর সেবনে অনেকটা উপকার হোতে পারে। আমার ইচ্ছা, আজ থেকেই তুমি সেই অভ্যাস সুরু কর।”
সেই সুপারিসের প্রতিধ্বনি কোরে রঘুনাথবাবু, তৎক্ষণাৎ বোল্লেন, “ঠিক আমার মুখের কথাটা তুমি কেড়ে নিয়েছ, আমিও ঐ কথাটা বোলবো বোলবো মনে কোচ্ছিলেম; আজ থেকে সুরু করাই ভাল।” —বন্ধুবাবুকে এই কথা বোলে, নূতন একটা চুরুট ধোরিয়ে মুখে দিয়ে, আমার দিকে ফিরে, কি যেন ভেবে গলা কাঁপিয়ে কাঁপিয়ে তিনি বোল্লেন, “তোমার নামটি কি ভাল? —হরি —হাঁ —হরিদাস। —হাঃ হাঃ হাঃ! হরিদাস-নামটা কিছুতেই আমার মনে থাকে না! হাঃ হাঃ হাঃ! যতগুলি হরিদাসকে আমি চিনি, মাঝে মাঝে আমার সঙ্গে দেখা হয়,—দেখা হোলেই নাম ভুলে যাই!—ওটা হোচ্ছে বাবুজী বৈরাগীদের মুখস্থ করা নাম; আমার মত ইংরাজীওয়ালাদের নয়; আমার মধ্যে ওনামটা যেন কেমন বাধো বাধো ঠেকে।”
“বাধো বাধো ঠেকে” এই কথা বোলেই বক্তা ডাক্তারটি এক গাল ধূম উদ্গীরণ কোরে আমার মুখের কাছে ছেড়ে দিলেন। দোক্তার দুর্গন্ধ সহ্য কোত্তে না পেরে অন্যদিকে আমি মুখ ফিরালেম। বক্তার মুখের কাছে হাত ঘুরিয়ে ডাক্তার নীলাম্বর হাসতে হাসতে বোল্লেন, “কিছুদিন তুমি চৈতন্যচরিতামৃত পাঠ কর, হরিনাম মুখস্থ হবে, হরিদাস নামটিও আয়ত্ত কোরে রাখতে পারবে। আর একটা পরমার্শ আছে, আর এক সময়ে সে কথা হবে, এখন তুমি হরিদাসকে কি কথা বোলছিলে, বোলে যাও।”
আর একবার চুরুটের ধূম্র উদ্গীরণ কোরে রঘুনাথবাবু আমারে বোল্লেন, “দেখ হরিদাস! খোলা জায়গার হাওয়া খাওয়া একটা পরম ঔষধ, —সকাল বিকাল দুবেলা। ঠিক সময় হয়েছে, আমাদের সঙ্গে গাড়ী আছে, তুমি প্রস্তুত হও। আজ আমরা তোমাকে হাওয়া খাওয়া ঔষধের প্রথম ফল দেখাব; মনে কর, আজ তোমার হাওয়া খাওয়া বিদ্যার হাতে খড়ী; প্রস্তুত হও।”
কি আমি শুনলেম, কি আমি বুঝলেম, হঠাৎ যেন একটা সংশয়ের অন্ধকারমূর্তি আমার সম্মুখে এসে দাঁড়ালো। হাওয়া খাওয়া বিদ্যার হাতেখড়ী! ডাক্তারদের মুখের দিকে চেয়ে আমি নীরব হয়ে থাকলেম। ডাক্তারেরা উভয়েই দুই তিনবার আমারে বোল্লেন, “শুভক্ষণ, শুভক্ষণ প্রস্তুত হও, প্রস্তুত হও।” আর আমি অপ্রস্তুত থাকতে পাল্লেম না, ডাক্তারবাবুর অনুরোধ রক্ষা কোত্তে বাধ্য হোলেম। প্রস্তুত হওয়া কি রকম, তা আমি ভাবলেম না, অবসর চাইলেম না, কাপড়ও ছাড়লেম না, যে কাপড়খানি তখন আমার পরা ছিল, সেই কাপড়েই বাবুদের সঙ্গে আমি হাওয়া খেতে বেরুলেম, রাজাবাহাদুরের অনুমতি লওয়াও আবশ্যক বোধ কোল্লেম না।
সূৰ্যদেব অস্তাচলে গিয়েছিলেন, অল্প অল্প অন্ধকার হয়ে আসছিল, ঘোর অন্ধকার হয় নাই, সময়টা গোধূলি; গোধূলি লগ্নে যাত্রা; —উপর থেকে আমরা নেমে এলেম। দরজার সম্মুখে দিব্য একখানি গাড়ী, দিব্য দুটি কৃষ্ণবর্ণ অশ্ব। রঘুনাথ ডাক্তার আমার একখানি হাত ধোরে গাড়ীতে তুলে দিলেন, তার পর তাঁরা দুজনে আরোহণ কোল্লেন। গাড়ী উত্তরমুখে চোল্লো। অশ্বেরা টপাটপ শব্দে দ্রুতবেগে ছুটে ছুটে যেতে লাগলো।
কতদূরে গেলেম, ঠিক বুঝতে পাল্লেম না, অনুমানে বুঝলেম, এক কোশের বেশী। গাড়ীর ভিতর ডাক্তারেরা নানা রকম গল্প জুড়েছিলেন; গল্পের দিকে আমার কাণ ছিল না, মন ছিল না, সারা পথ আমি অন্যমনস্ক।
সমবেগে আর খানিক দূরে এগিয়ে গিয়ে গাড়ীখানা থামলো, ডাক্তারেরা নামলেন, আমারেও নামালেন। সেই সময় আমি একবার চতুর্দিকে চেয়ে চেয়ে দেখলেম, অন্ধকার। বেশী দূর দেখা গেল না, তথাপি আমি বুঝতে পাল্লেম, পাটনায় এসে অবধি সে পথে আর কখনো আমি আসি নাই। রাস্তার বামদিকে প্রকাণ্ড একখানা বাড়ী; ফটকে প্রকাণ্ড একটা লণ্ঠন জ্বলছিল, পাথরের পুতুলের মত দুইজন দ্বারপাল বড় বড় দুটো বন্দুক ঘাড়ে কোরে দরজার দুই ধারে দাঁড়িয়ে ছিল। তারা নিষ্পন্দ। পথ দেখিয়ে দেখিয়ে ডাক্তারেরা আমারে সেই বাড়ীর ভিতর নিয়ে গেলেন। অকস্মাৎ দূর দূর কোরে আমার বুক কেঁপে উঠলো! কেন বোলতে পারি না, আমার মনে তখন যেন কোন প্রকার অমঙ্গল আশঙ্কার সঞ্চার হলো! গোধূলিলয়ে যাত্রা; এরূপ যাত্রাতে মঙ্গলফল হয়, এই কথাই লোকে বলে, আমার মন কেন বলে অমঙ্গল, কেমন কোরে জানবো?
বাড়ীর ভিতর আমরা প্রবেশ কোচ্ছি, ঠাঁই ঠাঁই আলো জ্বোলছে দেখছি, শারি শারি কতই ঘর। যে দিক দিয়ে আমরা যাচ্ছি, সে দিকের দরজা বন্ধ। দুই ধারেই ঘর, মধ্যস্থলে সুঁড়ী পথ। প্রকাণ্ড বাড়ী, কোন দিকে কত ঘর, একদিক দর্শনে সেটা জানা গেল না। যাচ্ছি, এক একবার বামে দক্ষিণে চক্ষু ফিরাচ্ছি, মাঝে মাঝে এক একদিকে সেই রকমের অপ্রশস্ত এক একটা সুঁড়ীপথ দেখতে পাচ্ছি। ডাক্তারেরা আমারে সোজা পথেই নিয়ে চোলেছেন। বাতাসের লেশমাত্র নাই। অনেক দূর গিয়ে দক্ষিণধারে দেখলেম, একটা ঘরের দরজা খোলা। ঘরে আলো ছিল; দেখলাম ঘরটা দিব্য পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। আমারে অগ্রবর্তী কোরে ডাক্তারেরা সেই ঘরে প্রবেশ কোল্লেন। ঘরের একধারে একটি পরিষ্কার বিছানা, আর কোন আসবাবপত্র ছিল না। কেবল একদিকে দুটি বড় বড় মাটির কলসী, মুখে দুখানা কাচের বাসন ঢাকা; বোধ হলো, জলের কলসী। বিছানার উপর আমারে বোসতে বোলে নীলাম্বরবাবু আমার নিকটেই বোসলেন, রঘুনাথবাবু বেরিয়ে গেলেন।
ঘরটি পরিষ্কার বটে, কিন্তু কেমন একটা দুর্গন্ধ আমার নাসারন্ধ্রে প্রবেশ কোত্তে লাগলো। ঘরেই গন্ধ অথবা বাহিরের দুর্গন্ধ এসে ঘরটিকে দুর্গন্ধময় কোচ্ছিল, সেটা আমি অনুভব কোত্তে পাল্লেম না। কিয়ৎক্ষণ নীরবে বোসে থেকে, মৃদুস্বরে আমি জিজ্ঞাসা কোল্লেম, এ আমি কোথায় এলেম? আমারে কোথায় নিয়ে এলেন?” মাথা নেড়ে নেড়ে নীলাম্বরবাবু একটু হাসলেন; আমার কথার কোন উত্তর দিলেন না। হাওয়া খাবার প্রস্তাব যখন হয়, তখন আমার মনে একটা সংশয় এসেছিল, সেই সংশয় এখন প্রবল হয়ে উঠলো। অমঙ্গল আশঙ্কাই বড় বেশী। বাম অঙ্গের ঘন ঘন স্পন্দন। কি যে সেই আশঙ্কা, কেন যে সেই আশঙ্কা, তার মূল কারণ তখন আমি কিছু স্থির কোত্তে পাল্লেম না; সন্দেহই প্রবল।
রঘুনাথবাবু পুনঃপ্রবেশ কোল্লেন; সঙ্গে একটি লোক। কৃষ্ণযাত্রার আসরে বাসুদেবের যেমন সজ্জা, সেই লোকটির সজ্জাও সেইরূপে। লোকটি দীর্ঘাকার, কৃষ্ণবর্ণ, একহারা, মুখখানা কিছু গোল, চক্ষু ছোট, নাসিকা খর্ব, ঠোঁট পুরু, চোমরা গোঁফ, মাথার ঝাঁকড়া চুল, একখানা হাত একটু ছোট, সে হাতের অঙ্গুলি খুব মোটা মোটা, গণনায় একটি কম, বয়স অনুমান চল্লিশ বৎসর। অঙ্গুলিনির্দেশে আমারে দেখিয়ে দিয়ে ডাক্তার রঘুনাথ সেই লোকটিকে বোল্লেন, “দেখ অনাদি! এই বালকটি কিছুদিন এই বাড়ীতে থাকবে, যেন কোন অযত্ন না হয়; আহারে, শয়নে, ভ্রমণে বালক যেন কোন প্রকার কষ্ট না পায়। তোমার হস্তে এটিকে আমরা সমর্পণ কোল্লেম, আমাদের উপদেশমত কাজ কোল্লে তুমি প্রচুর পুরস্কার পাবে। বড়লোকের ছেলে, এখানে থেকে এ ছেলে যদি আরাম হয়, —বুঝলে অনাদি, —এখানে থেকে এ ছেলে যদি আরাম হয়, আরাম হবেই নিশ্চয়, —যদি বেশ আরাম হয়, তা হোলে তোমাকে আর এখানে চাকরী কোত্তে হবে না। সে কথাই বা কেন, একেবারেই হয় তো চাকরী কোত্তে হবে না; বাড়ী পাবে, পুকুর পাবে, আম-কাঁঠালের বাগান পাবে, দিব্য সুন্দরী একটি বৈষ্ণবীকে বিয়ে কোত্তে পারবে। সেবা-যত্নে এ ছোকরাকে খুসী রাখতে পাল্লে দু-একখানি কোম্পানীর কাগজও পাবে, কোন কষ্টই থাকবে না;— বুঝলে কি না?”
রঘুনাথের সঙ্গে যে লোকের নবপ্রবেশ, সে লোকটার নাম অনাদি। ঘন ঘন চক্ষের পলক ফেলে। অনাদিকে ঐরূপ উপদেশ দিয়ে, আশ্বাস দিয়ে, আমার দিকে চেয়ে রঘুনাথ বোল্লেন “দেখ ছোক— ঐ দেখ! আবার ভুলে গিয়েছি! কতবার মনে করি, ইষ্টমন্ত্রের মত জপ করি, তবু মনে থাকে না! —ইষ্টমন্ত্র! —হাঁ হাঁ— দেখ হরিদাস! এইখানেই তোমার চিকিৎসা হবে; এই অনাদি ঠাকুরটি অহরহ তোমার সেবায় নিযুক্ত থাকবে। অনাদি ঠাকুর বেশ লোক, তোমাদের মত ছেলেদের আদর-যত্ন কোত্তে অনাদি যেমন জানে, এমন তার এ বাড়ীর একটা লোকও না। অনাদিঠাকুর ব্রাহ্মণ বুঝতে পেরেছ আমার কথাটা? —জাতিতে এই অনাদিঠাকুর একটি ব্রাহ্মণ; ব্রাহ্মণের যত প্রকার কর্তব্য কাৰ্য আছে, অনাদিঠাকুর সব জানে। তুমি বেশ থাকবে, এইখানেই তুমি থাকো, স্বচ্ছন্দে থাকো, বেপরোয়া থাকো; আমরা মাঝে মাঝে এসে দেখে যাব, নূতন ব্যবস্থা কোরে যাব, কোন ভয় নাই।”
আমার চক্ষে জল এলো, অন্তরে অন্তরে আমি কাঁপছিলেম, এই সময় বাহ্য অবয়বে বিলক্ষণ কম্প! কাঁপতে কাঁপতে নীলাম্বরবাবুর দিকে আমি চাইলেম। হা অদৃষ্টে! নীলাম্বরবাবুও রঘুনাথের কথায় সায় দিলেন। হায় হায়! আর আমি কার মুখ চাই? এ দুটো লোক কে? সত্যই কি ডাক্তার? উঃ! ডাক্তার সেজে এ দুটো লোক আমারে এই বাড়ীতে কয়েদ কোরে রেখে যাচ্ছে! এটা কিসের বাড়ী? কাদের বাড়ী? জনমানবের সঞ্চার নাই, এত বড় বাড়ীতে কেবল এই একটা অনাদি দেখলেম, আর কোন লোকের সাড়া-শব্দ পাওয়া গেল না, মূর্তিও দেখা গেল না। কি ব্যাপার! না না, অবশ্যই লোক আছে। লোক না থাকলে ফটকে পাহারা থাকবে কেন? এতগুলো আলো জ্বোলবে কেন? অবশ্যই লোক আছে। কি রকম লোক তারা?
কত যে আমি ভাবলাম, কিছুই এখন মনে নাই; সত্য সত্যই আমি কেঁদে ফেল্লেম! বিস্তর মিনতি কোরে নীলাম্বরবাবুকে বোল্লেম, “কেন আপনারা আমারে এই বিজন বাড়ীতে ফেলে যাচ্ছেন? আমি আপনাদের কাছে কি অপরাধ কোরেছি? হাওয়া খেলে শরীর সুস্থ হবে; আপনাদের সঙ্গে আমি হাওয়া খেতে এলেম, আপনারা আমারে ভাল হাওয়া খাওয়ালেন! হাওয়া খাওয়ার সাধ আমার মিটেছে, আর হাওয়া খাব না, দোহাই আপনার, দয়া কোরে আমারে এখান থেকে নিয়ে চলুন! আমার যেন মনে হোচ্ছে, উপর থেকে কে যেন আমারে বোলে দিচ্ছে, এটা রাক্ষসের পুরী; এ পুরীতে কিছুতেই আমি থাকতে পারবো না! দু-দিন থাকলেই হয় তো আমার প্রাণ যাবে! পায়ে ধরি, আপনি আমারে সঙ্গে কোরে নিয়ে চলুন!”
মৃদুহাস্য কোরে নীলাম্বরবাবু বোল্লেন, “ভয় কর কেন? এখানে তোমার কোন ভয় নাই, এইখানেই তোমার চিকিৎসা হবে। রাজবাড়ীতে বেশী লোকের গোলমাল সেখানে তুমি শীঘ্র শীঘ্র আরাম হোতে পারবে না, এখানে থাকলে শীঘ্রই আরাম হবে, রঘুনাথবাবু যে যে কথা বোল্লেন, সমস্তই সত্যকথা; এখানে তোমার সেবাযত্ন বেশ হবে, ছেলেমানুষী কোরো না, পাগলের মত বোকো না, শান্ত হয়ে থাকো, কেঁদো না, চুপ কর, কাল আবার আমি আসবো।”
এই সব কথা বোলে ব্যস্তভাবে নীলাম্বরবাবু উঠে দাঁড়ালেন, রঘুনাথ দাঁড়িয়েই ছিলেন, দুজনে একসঙ্গে বেরিয়ে যেতে লাগলেন। “যাবেন না, যাবেন না, যাবেন না! আমারে এখানে একা ফেলে রেখে আপনারা চোলে যাবেন না! দোহাই আপনাদের আমি আপনাদের সঙ্গে যাব, কখনই আমি এখানে থাকবো না! এ জীবনে কষ্ট আমি অনেক ভুগেছি, আবার এই নূতন কষ্টের মুখে আমারে নিক্ষেপ কোরে আপনারা যাবেন না, যাবেন না, যাবেন না!” কাঁদতে কাঁদতে এই সব কথা বোলতে বোলতে ঘরের চৌকাঠের ধার পর্যন্ত আমি ছুটে গেলেম; চৌকাঠ পার হয়ে তাঁরা তখন বাইরে গিয়েছিলেন। অনাদিটা ঘরের মধ্যেই ছিল, দাঁত-মুখ খিচিয়ে দু-হাত দিয়ে সে আমারে জাপটে ধোল্লে! লোকটা রোগা বটে, কিন্তু জোর খুব; ধস্তাধস্তি কোরেও আমি তার হাত ছাড়াতে পাল্লেম না। বাহির থেকে মুখ ফিরিয়ে নীলাম্বরবাবু বোল্লেন, “ঐ কথাই তো কথা, ঐ তো তোমার রোগ; অনেক কষ্ট ভুগেছ, এখানে থাকতে পারবে না, লোকের কথা শুনবে না, ঐ তো তোমার রোগ। সেই জন্যই তো তোমাকে এখানে আনা হয়েছে। ও রকম যদি কর, এ জন্মে তোমার ও রোগ সারবে না। থাকো, গোলমাল কোরো না। অনাদির সঙ্গে লড়ালড়ি কোরো না, আমরা চোল্লেম!”
ডাক্তারেরা চোলে গেলেন, অনাদি আমারে আটকে রাখলে। ঝাড়া এক ঘণ্টাকাল আমি চীৎকার কোরে কাঁদলেম, ধমক দিয়ে দিয়ে অনাদি আমারে বশে আনবার চেষ্টা কোল্লে, কিছুতেই আমি শান্ত হোতে পাল্লেম না। খানিক পরে সেই ঘরে একটা স্ত্রীলোক এলো তার হাতে একটা চাবীর তাড়া। হেসে হেসে চাবীওয়ালা মুখ-চক্ষু ঘুরিয়ে অনাদিকে বোল্লে, “এই যে গো! এই যে তুমি দিব্য একটি নূতন শীকার পেয়েছ! বেশ হয়েছে; সদরদরজায় চাবী পোড়েছে, দরোয়ান এসে আমার হাতে এই চাবীর তাড়াটা দিয়ে গেল। ছেড়ে দাও, শীকারটিকে অমন কোরে ধোরে রেখেছ কেন? ছেড়ে দাও! আর পালাবার উপায় নাই।”
মানুষের গন্ধ পেয়ে যে সকল বিষধর সর্প ফণা তুলে গর্জন করে, ওঝাদের কাছে সেই সকল সৰ্প যেন কেঁচো হয়। এখানেও আমি সেই রকম দেখলেম। অনাদিঠাকুর এতক্ষণ আমার উপর তর্জন-গর্জন কোচ্ছিল, সেই স্ত্রীলোকের দুটি একটি কথা শুনে একেবারে ঠাণ্ডা; আমারে ছেড়ে দিয়ে কতই যেন ভাল-মানুষ হয়ে, সেই স্ত্রীলোকের সঙ্গে রহস্যালাপ আরম্ভ কোল্লে। আমি সেই অবসরে ধীরে ধীরে পাশ কাটিয়ে বিছানার উপরে গিয়ে বোসলেম। হৃদয় অত্যন্ত ভারী, মনে যেন কিছুই নাই, কিছুই যেন চিন্তা কোত্তে পাচ্ছি না, সম্মুখে আলো আছে, তবুও যেন আমি চারিদিকে অন্ধকার দেখছি, তখন আমার এই রকম অবস্থা। ভাগ্যক্রমে আপনা আপনি আমি এক একটা প্রবোধ প্রাপ্ত হই; যতই কেন মহাবিপদ উপস্থিত হোক না, তাদৃশ বিপদে আমি বড় একটা অবসন্ন হই না। বাল্যাবধি পরমেশ্বরে আমার অচল বিশ্বাস; যা যখন হবার হয়, নিশ্চয়ই তা তখন হয়, যা হবার নয়, তা কখন হয় না, সংসারে মানুষের ভাগ্যে যা যখন ঘটে, সমস্তই সেই ইচ্ছাময়ের ইচ্ছা, এইরূপে আমার ধারণা; সেই ধারণাই আমার প্রবোধ। সংসারচক্রের এক এক আবর্তনে আমি এক এক প্রকার অবস্থা প্রাপ্ত হোচ্ছি; পাটনায় এই এক নূতন অবস্থা! এ অবস্থা আমার চিরদিন থাকবে না, দয়াময় অবশ্যই একদিন আমার প্রতি সদয় হবেন, সেই বিশ্বাসে, সেই আশ্বাসে আপন মনে আমি এক প্রকার সান্ত্বনা পেলেম। গৃহমধ্যে অনাদি আর সেই চাবীওয়ালী। অলক্ষিতে সেই যুগলমূর্তির দিকে কটাক্ষপাত কোরে আমি তাদের রহস্যালাপ শ্রবণ কোত্তে লাগলেম।
অনাদি বোল্লে, “তুই ভাই আজ আমাকে যে হাসান হাসিয়েছিস জন্মেও আমি তেমন হাসি হাসি নাই; লোকেরা যখন চুপচাপ কোরে থাকে, তোর হাসিটা তখন খুব বাড়ে; তাই চিত্তোরি। তুই আমার প্রাণের সহচরী। তুই হাসিস, তুই হাসাস, তাতেই আমি বেঁচে থাকি। তোর হাসি যেন বরফের মত ঠাণ্ডা; হাটের কলরবের আগুনে আমার প্রাণ যখন জ্বোলে পুড়ে যায়, সেই সময় তুই হাসির ফোয়ারা খুলে দিস, জ্বালা-যন্ত্রণা সব আমি ভুলে যাই, হৃদয় জুড়িয়ে যায়; শুভক্ষণে বিধাতা তোর সঙ্গে আমার— বুঝলি চিতোরি,— তোর সঙ্গে আমার মিলন কোরে দিয়েছেন, জন্মেও আর ছাড়াছাড়ি হবে না। তুই বুঝলি? তুই আমার মাথার চুল, মুখের গোঁফ, চক্ষের তারা, বুকের মাংস, গায়ের লোম, তুই আমার সব। সেই একদিন তারা যখন—”
এই পর্যন্ত বোলতে বোলতে অনাদিঠাকুর হঠাৎ থেমে গেল। যতগুলি কথা তার মুখে উচ্চারিত হলো, তার প্রকৃত তাৎপৰ্য আমি হৃদয়ঙ্গম কোত্তে পাল্লেম না; অনেক কথার অর্থ নাই; বুঝলেম, কেবল তাদের দুজনের প্রেমসম্বন্ধ। স্ত্রীলোকটির নামও পাওয়া গেল, নামটা খুব নূতন বটে; নতুন পুরাতন বিচার করা অনাবশ্যক, নামটি কিন্তু পাওয়া গেল; নাম হোচ্ছে চিতোরী। আমার দিকে চেয়ে, পুনরায় চিতোরীকে সম্বোধন কোরে অনাদিঠাকুর বোল্লে, “দেখ চিতোরী! সেই একদিন তারা যখন সেই রকম বাড়াবাড়ি কোচ্ছিল না, থাক সে কথা—” আবার এইখানে থেমে, আবার আমার দিকে চেয়ে একটু একটু চুপি চুপি বোলতে লাগলো, এই নূতন ছোকরাটা দেখছি অকালপক্ক; ভূতে পেয়েছে; সেই যে দুটি বাবু এসেছিল, ছোকরাকে তারা আমার হাতেই সোঁপে দিয়ে গেল, সেবা কোত্তে বোলে গেল; হো হো হো! কিন্তু ভাই চিতোরী! সেবা যদি তুই কোত্তে পারিস, খুব বড় একটা দাঁও মারা যাবে। দেখিস কিন্তু, কোন রকমে যেন না পালায়! সব সময় আমি—”
এই সময় কে যেন কারে খুব চীৎকার কোরে ডাকলে। কাণ খাড়া কোরে শুনে, তাড়াতাড়ি চোলতে চোলতে অনাদিঠাকুর তাড়াতাড়ি বোলে গেল, “থাক তুই এইখানে, যেমন যেমন বন্দোবস্ত কোত্তে হয়, করিস; সব তুই জানিস, আমি যাই; আবার কে কোথায় কি হাঙ্গামা বাধিয়েছে, থামাই গিয়ে; ভাল ঝকমারীতেই পোড়েছি! রাত্রেও দু-দণ্ড স্থির হবার যো নাই।”
অনাদিঠাকুর কোথাকার হাঙ্গামা থামাতে গেল, চিতোরী এসে আমার বিছানার উপর বোসলো; গা ঘেঁষে বোসলো না, হাতখানেক তফাতে। যে সুরে চিতোরী প্রথমে অনাদির সঙ্গে কথা কোয়েছিল সে সুরটা বদল কোরে আর এক রকম নূতন সুরে কি গোটা কতক কথা আমারে বোল্লে, আমার মন তখন অন্যদিকে ছিল, অর্থ বুঝলেম না, উত্তর দিতেও পাল্লেম না; চিতোরী আমার মুখপানে চেয়ে রইলো। আমি তখন আর একখানা ভাবছিলেম; অনাদিঠাকুর হাঙ্গামা থামাতে গেল, কিসের হাঙ্গামা? এ বাড়ীতে কি হাঙ্গামা হয়? কি রকম জায়গা? যে একটা চীৎকার শুনলেম, সেটাও কেমন বিকট। অনাদি ইতিপূর্বে একবার বোলেছিল, “হাটের কলরব”, এখানে কি হাট আছে? রাত্রেই কি হাট বসে? একটা লোকের চীৎকারেই কি হাট হয়? বোধ হয়, সে রকম হাট না হবে। কেন না, অনাদি বোলেছিল, “হাটের কলরবের আগুন”, সে আগুন আবার কি প্রকার? ভাল হাওয়া খেতে বেরিয়েছিলেম, হাওয়ার বদলে আগুনের ভিতরে এসে পোড়েছি; সত্যই আগুন! শরীর যেন সেই আগুনে দগ্ধ হয়ে যাচ্ছে!
এই সব আমার মনের কথা। মনের কথা মনে মনে, মুখে কিছুই ফুটলো না। মুখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চিতোরী সেই সময়ে আবার বোল্লে, “কথা কও না কেন? বোবা না কি? অত কথা জিজ্ঞাসা কোল্লেম, খাতির নাই, কোথাকার ছোকরা? এটা বুঝি তোমার শ্বশুরবাড়ী? কথা কোইতে বুঝি লজ্জা হয়? পাঠশাল কখনো দেখেছো? পাঠশালে বজ্জাতী কোল্লে ঘোড়া বেত পিঠে পড়ে, নাড়ুগোপাল হোতে হয়, জানো সে সব শাস্তি? এটাও একটা পাঠশালা; এখানেও সেই রকম শাস্তি আছে, এখানেও সেই রকম হবে; কথা শোনো, কথা কও, রাত্রি অনেক, খাবে কি? পেট তোমার কি চায়? পেট তোমার সঙ্গে আছে, না আর কোথাও রেখে এসেছো? কথা কও, উত্তর কর, বল, রাত্রে তুমি খাবে কি?”
অনাদি চোলে যাবার পর চিতোরী প্রথমে আমারে যে সব কথা বোলেছিল, সে সব কোন ভাষার কথা, আমি বুঝি নাই, চিতোরী নামটা যেমন আমার কর্ণে নূতন, চিতোরীর ভাষাও সেই রকমের নূতন বোধ হয়েছিল। চিতোরী কি? রাজপুতানার চিতোর রাজ্যের মেয়েমানুষেরা কি চিতোরী নামে পরিচিতা হয়? এ চিতোরীর বাড়ী কি তবে চিতোরে?—তাই যেন বোধ হয়।
চিতোরীর প্রথমবারের কথাগুলোও বোধ হয় চিতোরী ভাষা; এবারের কথাগুলো হিন্দী বাঙ্গলা মিশানো? জিহ্বার একটু একটু আড়ষ্ট আছে, এইমাত্র তফাৎ।
কথাগুলো রুক্ষ রুক্ষ; চিতোরী কিন্তু দেখতে দিব্য সুশ্রী। তাদৃশী সুশ্ৰী রমণীর এ প্রকার কর্কশ কথা, এটাও আমার আশ্চৰ্য বোধ হলো। সুস্থিরনয়নে চিতোরীর অস্থিরনয়ন দর্শন কোরে আমি তার পূর্ব-প্রশ্নের উত্তর কোল্লেম, “রাত্রে আমি কিছুই খাব না, কিছুমাত্র ক্ষুধা নাই; তোমার যদি অন্য কাৰ্য থাকে, স্বচ্ছন্দে চোলে যাও, আমারে একটু বিশ্রাম কোত্তে দাও; আমার শরীর অসুস্থ, মন অসুস্থ, আমি অতিশয় পরিশ্রান্ত, অত্যন্ত ক্লান্ত, কিছুই আমি খাব না।”
চক্ষু ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে মুচকে মুচকে হেসে, একখানা হাত নেড়ে চিতোরী বোল্লে “তা হবে না যাদুধন! খেতেই হবে, এখানকার নিয়ম সে রকম নয়; মানুষকে আরাম করবার জন্য এখানে আনা হয়। তুমি তো তুমি, তোমার মত কত ছোকরা, কত ছুকরী, কত পুরুষমানুষ, কত মেয়েমানুষ এখানে বাস করে, সকলকেই দুবেলা পেট ভোরে খেতে হয়। সহজে না খেলে, জোর কোরে খাওয়ানো হয়, আমি তোমাকে ভাল ছেলে দেখছি। সেই জন্যই ভালকথা বোলছি, ভালমুখে জিজ্ঞাসা কোচ্ছি, কি খেতে ইচ্ছা হয়; কি খাবে বল, আমি এনে দিব, না যদি বল, অনাদিঠাকুরের যে রকম ইচ্ছা হবে, সেই রকম জিনিস তোমাকে খেতে হবে— খেতেই হবে।”
বড় দায়েই আমি ঠেকলেম। ক্ষুধা না থাকলেও খেতে হবে, না খেলে এরা জোর কোরে খাওয়াবে, কথা না শুনলে বেত লাগাবে, চিতোরী এই রকম ভয় দেখালে। চিতোরী মেয়েমানুষ, চিতোরীর মুখে যখন ঐ রকম কথা, তখন না জানি, অনাদিঠাকুর আরো কত উগ্রমূর্তি ধারণ কোরবে। সেটা ভাল নয়। মনে মনে এই রকম আলোচনা কোরে চিতোরীকে আমি বোল্লেম “একান্তই তোমরা যদি না ছাড়, এখানে যদি দুষ্প্রাপ্য না হয়, তবে আমারে কিঞ্চিৎ দুধ আর একপাত্র জল দিও, তাই দিলেই ঠিক হবে, তাই খেয়েই আমি শুয়ে থাকবো। চিতোরী উঠলো না; একটু পরে অনাদি এলো; আমার মুখের কথাগুলি চিতোরীর মুখে অনাদি শ্রবণ কোল্লে। ব্যবস্থা মঞ্জুর। অল্পক্ষণ পরে দুধ-জল পান কোরে আমি শয়ন কোল্লেম। কি বোলবো? —প্রকৃতই হোক কিম্বা কল্পিতই হোক, রহস্যালাপের ভাবে আমি বুঝলেম, এরা স্ত্রী-পুরুষ,—দম্পতী; ঘরের দরজায় চাবী দিয়ে অনাদিদম্পতি নিজস্থানে চোলে গেল।
সে সময় যদি আমার নিদ্রা আসতো, তবে এক প্রকার ভালই হোতো; তা হলো না; তেমন অবস্থায় শীঘ্র নিদ্রা হয়ও না। পাটনায় আসা অবধি এই দিনের হাওয়া খাওয়ার ব্যবস্থা পর্যন্ত আলোচনা কোত্তে কোত্তে প্রায় এক ঘণ্টা পরে নিদ্রা এলো, আমি ঘুমালেম। শেষরাত্রে কিম্বা ঊষাকালে বহুকণ্ঠমিশ্রিত একটা ভয়ঙ্কর কলরব শুনে আমি জেগে উঠলেম। বিভীষণ চীৎকার! চীৎকারধ্বনিতে অত বড় বাড়ীখানা যেন ভূমিকম্পনের মত কেঁপে উঠলো! কত দূর পর্যন্ত সেই চীৎকারধ্বনির প্রতিধ্বনি হোতে লাগলো। অনাদির একটা কথা সার্থক বোধ হলো, হাটের কলরব;— সত্যই যেন হাটের কলরব! অনুমান কোল্লেম, সত্যই এখানে হাট আছে।
পুনরায় সেই প্রকার কলরব! বোধ হলো যেন গগনভেদী চীৎকারধ্বনি! রুদ্ধদ্বার শিবমন্দিরমধ্যে চীৎকার কোল্লে যেমন গম্ভীর আওয়াজ হয়, মধ্যে মধ্যে সেইরূপ ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর আওয়াজ আমার শ্রবণকুহরে প্রবেশ কোত্তে লাগলো। রাত্রি দুই প্রহরের পর আমার নিদ্রা হয়েছিল, ঊষাকালে ভীম চীৎকারে জাগরণ। যতক্ষণ আমি ঘুমিয়েছিলেম, ততক্ষণের মধ্যে সে প্রকার চীৎকার হয়েছিল কি না, বোলতে পারি না; জাগরণ কোরে অবধি দুই তিনবার সেইরূপে হৃদয়কম্পন, গৃহ কম্পন, ভীষণ চীৎকারধ্বনি আমি শুনলেম! কোথা থেকে সেই সকল চীৎকার আসছে, কারা চীৎকার কোচ্ছে, ঠিক নির্ণয় কোত্তে পাল্লেম না; অনুমানে বোধ হলো, বাড়ীর মধ্যেই চীৎকার; শত শত লোকের চীৎকার! দেশে বিদেশে, অনেক স্থানে আমি ভ্রমণ কোরেছি, চীৎকারও অনেক প্রকার শুনেছি, কিন্তু এমন চীৎকার কখনো আমার কর্ণে প্রবেশ করে নাই। একবার মনে হয় মানুষে, একবার মনে হয় জানোয়ার। কত লোক এ বাড়ীতে থাকে, কত লোক আছে, কেন আছে, তারা এখানে কি করে, কেন তারা ঐ রকম রণরঙ্গ-উত্তেজন সিংহনাদ করে, তাও আমি বুঝলেম না। যে ঘরে আমি ছিলেম, এই সময় সেই ঘরের দ্বার উদ্ঘাটিত হয়ে গেল।
প্রবেশ কোলে অনাদি, চিতোরী আর একজন দীর্ঘাকার লোক। নূতন লোকের পরিধান খুব চোস্ত চুড়ীদার পায়জামা, ফরাসীছিটের চিত্র-বিচিত্র বুকবন্ধ চাপকান, মাথায় একটা সবুজবর্ণের বাধা পাগড়ী, হাতে একগাছা মনুষ্যপ্রমাণ প্রকাণ্ড যষ্টি। লোকটার মুখ দেখলে ভয় হয়। মুখখানা চৌগোঁফফা; বড় বড় রক্তবর্ণ দুই চক্ষু।
তখন প্রভাত। কিছু পূর্বেই আমি জেগেছিলেম, চীৎকার শুনে ভয় পেয়েছিলেম, নিশ্চয়ই আমার চক্ষে আতঙ্কলক্ষণ ছিল, নূতন লোকটা আমার আপাদমস্তক রক্তচক্ষে নিরীক্ষণ কোল্লে; অনাদির দিকে চেয়ে, গভীরগৰ্জনে বোল্লে, “ঠিক বটে! কিন্তু ঠাণ্ডা আছে। চক্ষু দেখে বোধ হয়, রক্ত খুব গরম! তোমরা এই বালককে ঠাণ্ডা জিনিষ খেতে দিও, পাঁচ সাতটা ডাব নারিকেল পুকুরের পাঁকের ভিতর পুতে রেখে, সাত আট ঘণ্টা পরে তুলে সেই সকল ডাবের জল ঘণ্টায় ঘণ্টায় খাইয়ে দিও, আট দশ কলসী ঠাণ্ডা জলে স্নান করিও, আহারের ব্যবস্থা খাতাপত্রে যেরূপ লেখা আছে, সেইরূপে চোলবে। খবরদার! নূতন নূতন এ ছোকরাকে ঘরের বাহিরে নিয়ে যেয়ো না; সকলের পক্ষে যে রকম ব্যবস্থা। এ ছোকরার পক্ষে সে রকম ব্যবস্থা হবে না, ডাক্তারমহাশয়েরা সেই কথা বোলে গিয়েছেন; সে রকম ব্যবস্থা হবে না কিম্বা এ ছোকরার পক্ষে খাটবে না, সেটা আমি বুঝি নাই, ডাক্তারদুটিকে সে কথা আমি জিজ্ঞাসাও করি নাই। ছেলেটির বয়স কম, চেহারাও ভাল, কিন্তু রক্ত খারাপ। এখন বাহিরে বেড়াবার সময় নয়, যখন সময় হবে, সময় যখন আমি ঠিক বুঝবো, তখন ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে উচিতমত বন্দোবস্ত করা যাবে।”
ব্যবস্থা বন্দোবস্তের এইরূপ উপদেশ দিয়ে, যষ্টিধারী নূতন লোক পুনর্বার আমার দিকে চাইতে চাইতে ঘর থেকে বেরুলো; ভাবে আমি বুঝলেম, সে লোকের ক্ষমতা কিছু অধিক; এখানে সেই লোকের প্রভুত্ব চলে, হুকুম চলে, বাসিন্দালোকের আহারাদির ব্যবস্থা করার ভারও সেই লোকের উপর।
লোক চোলে গেল; অনাদি থাকলো, চিতোরীও থাকলো। আমার মাথার উপর খিলানকরা ছাদ, সেই ছাদের উপর গুম গুম কোরে অনেক মানুষের পায়ের শব্দ হোতে লাগলো। মানুষেরা যেন লাফিয়ে লাফিয়ে ছুটাছুটি কোচ্ছে কিম্বা আহ্লাদে উন্মত্ত হয়ে নৃত্য কোচ্ছে, সেইরূপ শব্দ। ভয় আছে, সন্দেহ আছে, বিস্ময় আছে, সেই তিন ভাবের মধ্যবর্তী হয়ে অন্যদিকে আমি জিজ্ঞাসা কোল্লেম, “ও সকল কিসের শব্দ! আমার মাথার উপর মানুষেরা ও সব কি কোচ্ছে? একটু আগে দুই তিনবার আমি ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর চীৎকার শব্দ শুনেছি, একসঙ্গে বহু লোকের চীৎকার। কারা এখানে তেমন কোরে চীৎকার করে? কেন করে? বাড়ীতে কারা থাকে? বাড়ীখানা কার? এ বাড়ীতে কি হয়?”
“কিসের চীৎকার, তাও বুঝি তোমাকে বোলতে হবে? কিছুই বোলতে হবে না; থাকো কিছুদিন এখানে, থাকতে থাকতে সমস্তই জানতে পারবে; থাকতে থাকতে তোমাকেও এই রকম কোত্তে হবে। জায়গাটা বড় মজার জায়গা। দুনিয়ার মজা দেখতে যাদের সাধ হয়, তারাই এই বাড়ীতে আসে। দেখে যায়, শিখে যায়, ঐ রকম নেচে কুঁদে আমোদ করে যায়, শেষকালে আরাম হয়ে, দূরস্ত হয়ে ঘরে চোলে যায়।” —আমার বিস্ময়সূচক প্রশ্নে কৌতুকে উপরপড়া হয়ে চিতোরী এই সকল কথা বোলে উঠলো।
কি উৎপাত! জিজ্ঞাসা কোল্লেম অনাদিকে, ব্যঙ্গ কোরে উত্তর কোল্লে, চিতোরী। উত্তরের কোন কথার মর্ম আমি বুঝে উঠতে পাল্লেম না; রাত্রে চিতোরীকে এক রকম দেখেছিলেম, এখন দেখলেম আর এক রকম। চিতোরী আমার সঙ্গে ঐ রকম পরিহাস কোত্তে লাগলো, অনাদিঠাকুর মুখে টিপে টিপে হাসতে আরম্ভ কোল্লে। আমি বিরক্ত হোলেম; আর কোন কথা আমি তখন জিজ্ঞাসা কোল্লেম না, মাথা হেঁট কোরে মৌনভাবে বোসে থাকলেম।
রৌদ্রের তেজ বৃদ্ধি হবার অগ্রেই সেখানকার লোকেরা আমারে বাসী জলে স্নান করিয়ে দিলে, তত শীঘ্র পাঁকে পোতা হলো না, বড় বড় দুটো তাজা ডাবের শীতল জল আমারে খাইয়ে দিলে, উদর যেন পরিপূর্ণ হয়ে গেল। ভোরে একটু ক্ষুধাবোধ হয়েছিল, এখন আর কিছুমাত্র ক্ষুধা থাকলো না। অনাদিঠাকুর ঘণ্টাখানেক পরে আমার আহারসামগ্রী এনে হাজির কোল্লে; আমি বোল্লেম, “খাব না”, অনাদিঠাকুর সে কথা শুনলে না, কাজে কাজে যৎকিঞ্চিৎ মুখে দিয়ে বড় বড় ঢেঁকুর তুলে আমি আচমন কোল্লেম। আমার আচমন করা দেখে অনাদি চিতোরী উভয়েই যেন একটু চোমকে গেল। অনাদি চাইলে চিতোরীর মুখের দিকে, চিতোরী চাইলে অনাদির মুখের দিকে; শেষকালে দুইজনই চাইলে আমার মুখের দিকে। আমি ভ্রূক্ষেপ কোল্লেম না।
এই রকমে আট দিন। এক ভাব। প্রথম রজনী প্রভাতে যেমন চীৎকার আমি শুনেছিলেন, যে রকম শব্দ পেয়েছিলেম, অবিচ্ছেদে ঐ আট দিন ঠিক সেই রকম শুনলাম। বোলতে হয় সেই রকম। বোল্লেমও সেই রকম; বাস্তবিক দিন দিন বরং উচ্চমাত্রার শ্রীবৃদ্ধি! একদিন জিজ্ঞাসা কোরে চিতোরীর মুখে পরিহাস শুনেছিলেম, অনাদিকে নিস্তব্ধ দেখেছিলেম, তদবধি আর কোনদিন আমি সে সকল উপসর্গের কারণ জিজ্ঞাসা করি নাই;— জিজ্ঞাসা করি নাই বটে, কিন্তু মনে মনে ভয়বিস্ময়ের অবিচ্ছেদ ক্রীড়া। সে সকল ক্রীড়া কেবল আমিই অনুভব কোল্লেম।
অষ্টম রজনীতে বিশ্রামের জন্য যখন আমি শয়ন কোল্লেম, গৃহদ্বারে যখন চাবী বন্ধ হলো, সেই সময় আমার মনের সঙ্গে আমার প্রাণের কথা। রাজা মোহনলাল ঘোষ বাহাদুর আমারে পাটনায় আনালেন, ফলবাগানে যা কিছু বলবার, তা আমারে বোল্লেন, তার পর তিনবার তিন জন লোক এসে আমারে পরীক্ষা কোরে গেল। পরীক্ষার পর রাজাবাহাদুর একদিন এক সভা কোল্লেন, সভায় আমারে বিলক্ষণ অপ্রস্তুত হোতে হলো। লোকেরা জিজ্ঞাসা কোল্লে আমার কষ্টের কথা, আমিও বার বার বোল্লেম আমার কষ্টের কথা। বার বার কেহ যদি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এক কথা কয়, লোকে তারে পাগল মনে করে; রাজসভার লোকেরা আমারে পাগল বিবেচনা কোল্লে। ডাক্তার বোলে যারা পরিচয় দিয়েছিল, তারা আমার চিকিৎসা করবার ব্যবস্থা দিলে। চিকিৎসা! —কিসের চিকিৎসা;— তারা ভাবলে আমি পাগল; যে ঔষধে পাগল ভাল হয়, সেই রকম ঔষধ তারা আমার জন্য ব্যবস্থা কোরবে, এইরূপ আভাষ দিলে। তার পর দুটি ডাক্তার আমার কাছে গিয়ে নূতন রকম আত্মীয়তা জানালে; আমারে সন্ধ্যাকালের হাওয়া খাওয়াবে বোলে ফাঁকি দিয়ে এই বাড়ীতে নিয়ে এলো। আবার এসে দেখে যাবে বোলে, অনাদির হাতে আমারে সোঁপে দিয়ে হাসতে হাসতে তারা প্রস্থান কোল্লে; আর এলো না। নীলাম্বর আর রঘুনাথ।
কোথায় তারা আমারে রেখে গেল? লক্ষণে যে রকম আমি বুঝতে পাচ্ছি, লাফালাফি, হাঁকাহাঁকির যে রকম ঘটা, তাতে আমার যেন মনে হোচ্ছে, এ বাড়ীতে যারা আছে, তারা সকলেই পাগল! এটা পাগলাগারদ! ধূর্ত ডাক্তারেরা ধূর্ততা কোরে আমারে বাতুলালয়ে রেখে গিয়েছে! আমি পাগল! হায় হায়! লোকের চক্রেই আমি পাগল। ভাঁড়ের গল্পে শুনেছিলেম, “দশচক্রে ভগবান ভূত!” মোহনলালের ডাক্তারেরা পাঁচজন, পঞ্চচক্রে আমিও এক রকম ভূত হয়েছি! সহজ মানুষে যদি পাগল হোতে পারে, তবে ভূত হওয়া বড় আশ্চৰ্য নয়! আমি ভূত।— আমি পাগল!— পাগলা গারদে আমি বন্দী! লোকের কুচক্রে কি যে হোতে পারে না, বিশ্বাসী জ্ঞানবান পণ্ডিতেরাও সে তত্ত্বের মীমাংসা কোত্তে অক্ষম।
আমি পাগল! মানুষের চক্রান্তেই আমি পাগল! পর্যায়ে পর্যায়ে যে যে স্থানে যতপ্রকার বিপদের মুখে আমি নিক্ষিপ্ত হয়েছি, মানুষের চক্রান্তই সেই সমস্ত বিপদের মূল। আমার সম্বন্ধে একটিও দৈব বিপদ নয়, পূর্ণবিশ্বাসে এ কথা আমি বোলতে পারি। এখন আমি পাগল;— পাটনার পাগলাগারদে বন্দী। অমরকুমারী কি আমার এ অবস্থা জানতে পাচ্ছেন? অমরকুমারী এখন কোথায়!— ঢাকায় কিম্বা মাণিকগঞ্জে কিম্বা মুর্শিদাবাদে? আমি কোথায় আছি, অমরকুমারী কি তা জানেন?
এই সব কথা ভাবতে ভাবতে আর একটা বড় কথা আমার মনে পোড়লো। ত্রিপুরায় জয়শঙ্করবাবু আমার বন্ধুবান্ধবগণকে চিঠি লেখার সংকল্পের পথে প্রবল বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন, পাটনায় এসে সেই বাধা অতিক্রম কোরে, সাতখানি পত্র লিখে ডাকযোগে ভিন্ন ভিন্ন স্থানে আমি প্রেরণ কোরেছি। যাঁর যাঁর নামে শিরোনাম, নিশ্চয়ই তাঁরা যথা সময়ে সেই সকল পত্র প্রাপ্ত হয়েছেন। উত্তরপ্রাপ্তির ঠিকানা আছে, রাজা মোহনলাল ঘোষ বাহাদুরের বাটী,— পাটনা। অমরকুমারী যদি মুর্শিদাবাদে থাকেন, শান্তিরামের মুখে অথবা মণিভূষণের মুখে আমার বর্তমান ঠিকানা তিনি জানতে পেরেছেন — অবশ্য জানতে পেরেছেন; জানতে পেরে এখন তিনি কি মনে কোচ্ছেন? যে “ভাব” তাঁর মনে উদয় হয়েছে, মনে মনে আমিও তা জানতে পাচ্ছি। কেবল জানামাত্র, ফলাংশে নূতন গোলমাল।
পত্রগুলি যাঁরা পেয়েছেন, তাঁরা অবশ্যই উত্তর লিখে পাঠাবেন। কোথায় পাঠাবেন। রাজা মোহনলালের বাড়ীতে, রাজা মোহনলাল দয়া কোরে সে সকল পত্র আমার কাছে পাঠাবেন, সে আশা নাই;— পত্রগুলি আমি পাব না। পাগলাগারদে আমি কয়েদ আছি, ডাকঘরের লোকেরা এ অদ্ভুত ঠিকানা জানবে না, এখানে এসে আমার সঙ্গে দেখাও কোরবে না, পত্রগুলি আমি পাব না। বন্ধুলোকগুলির শারীরিক মানসিক শুভ সমাচার, অমরকুমারীর শারীরিক মানসিক অবস্থাও আমি জানতে পাব না। তাঁদেরও উদ্বেগবুদ্ধি হবে, আমারও উদ্বেগ দিন দিন বাড়তে থাকবে। দ্বিতীয়বার পত্র-লিখনেরও আর এখন আমার সুবিধা নাই। কতদিন যে এই রকমে যাবে, গণনা কোরে তার সীমাও আমি নিরূপণ কোত্তে পাচ্ছি না।
বাতুলালয়ে অষ্টম রজনীতে আমার মনোমধ্যে এই সকল ভাবনা সমূদিত। এই সকল ভাবনার সঙ্গে হঠাৎ একটা তর্ক আমার মনে উঠলো। পূর্বে আমি শুনেছিলেম, যে সকল লোককে সরকারী লোকেরা পাগলাগারদে রাখে, সে সকল লোকের চিকিৎসা নতুন প্রকার। গারদের লোকেরা পাগলগুলিকে ধরে, মারে, বাঁধে, যন্ত্রণা দেয়, ভয় দেখায়, ফস্ত খোলে, এক এক জনের সম্মুখে পুতিগন্ধযুক্ত ঘৃণাকর বস্তু রেখে দেয়;— আরো কত কি করে, সব কথা আমি শুনি নাই। এরা আমারে কয়েদ কোরে রেখেছে, একজন পুরুষ আর একজন স্ত্রীলোক নিত্য নিত্য আমার সেবা-শুশ্রূষা কোচ্ছে, একজন একদিন এসে তদারক কোরে গিয়েছে, চিতোরী, মধ্যে মধ্যে ঠাট্টাতামাসার কথা কয়, এই পর্যন্ত; তা ছাড়া কেহই আমার উপর কোন প্রকার দৌরাত্ম্য করে না। কেন করে না, তাও আমি মনে মনে এক রকম অনুমান কোল্লেম। এখন সেটা বলা হবে না; ভাগ্যক্রমে কোন লোকের অনুগ্রহে যখন আমি এই পিশাচপুরী থেকে খালাস পাব, তখন সে অনুমানের কথাটা সকল লোককে জানাবো।
রাত্রের কার্য নিদ্রা। আমার কার্য চিন্তা। বিশেষতঃ এই গারদঘরে। নানা দুর্ভাবনায়, দু-একটা সু-ভাবনায় সমস্ত রজনী আমি জাগরণ কোল্লেম। রজনী অবসানে। প্রভাতে—ঠিক প্রভাতে না, অথবা অল্পে অন্ধকার থাকতে দরজার চাবী খুলে এক জোড়া নর-নারী গৃহমধ্যে প্রবেশ কোল্লে; অনাদি আর চিতোরী। নিত্যনিয়মিত কাজগুলি সমাপ্ত হবার পর তারা দুজনে আমার নিকটে এসে বোসলো। অনাদিঠাকুর সত্য সত্য চিতোরীর স্বামী কি না, জানি না, কিন্তু আমি অনুমান কোরেছি স্বামী; অনুমানমতেই পূর্বে পরিচয় দিয়েছি “দম্পতি।” স্বামীর মুখপানে চেয়ে চিতোরী একটু মুচকে মুচকে হেসে আমার দিকে ফিরে বোল্লে, “হরিদাস।— এই দেখ, আমি তোমার নাম পেয়েছি! — হরিদাস! আজ তোমারে একটা সুসংবাদ দি! — আজ বৈকালে এক জায়গায় তোমার নিমন্ত্রণ হবে; সেখানে তুমি অনেক রকম নূতন নূতন মজা দেখতে পাবে।” এই কটী কথা বোলে, উঠে দাঁড়িয়ে তিনবার করতালি দিয়ে, কতই যেন উল্লাসে চিতোরী আপনা আপনিই বোল্লে, “ভারী মজা! ভারী মজা! ভারী মজা!”
কতই যেন আহ্লাদে ঐ কথাগুলি বোলে, বেশ আড়খেমটা তালে, চিতোরী সেইখানে হেলে দুলে নৃত্য আরম্ভ কোরে দিলে! অনাদিঠাকুর একটিও কথা বোল্লে না, আমার মুখের দিকে চাইতে চাইতে চঞ্চলভাবে উঠে দাঁড়ালো; উভয়েই একসঙ্গে বেরিয়ে গেল। আর একবার তারা এসেছিল; আমার আহারের আয়োজন কোরে দিয়ে খানিকক্ষণ সেখানে থাকলো, আমি আহার কোল্লেম; প্রাণধারণের জন্য আমার আহার করার অনিচ্ছায় যৎকিঞ্চিৎ খাদ্যসামগ্রী গ্রহণ কোরে বিছানার ধারে আমি বোসলেম। পুনর্বার পূর্বরূপ করতালি দিয়ে, কোমর দুলিয়ে দুলিয়ে পূর্বরূপ স্বরেই চিতোরী তিনবার বোল্লে “ভারী মজা! ভারী মজা! ভারী মজা!” কিছুই ভাব বুঝতে না পেরে আমি ভাবতে লাগলেম, না জানি, কি মজাই এরা আমারে দেখাবে!