হরিদাসের গুপ্তকথাদ্বিতীয় খণ্ড
ষষ্ঠ কল্প : আমি নাগরদোলায়
আবার আমরা ঢাকায়। বোম্বেটেরা ফৌজদারী আদালতে চালান হয়ে গেল, জখমী লোকেরা হাসপাতালে প্রেরিত হলো, আমরা ডেপুটিবাবুর বাড়ীতে আশ্রয় পেলেম। হরিহরবাবুর আটজন পাইকের মধ্যে জলযুদ্ধের সময় দুজন নিহত হয়েছিল, বাকী ছিল ছয়জন, তাদের ইচ্ছা ছিল, মাণিকগঞ্জে ফিরে যায়, কিন্তু ডেপুটিবাবু যেতে দিলেন না। ইংরেজ আইন, প্রমাণের উপরেই অধিক পরাক্রম প্রকাশ করে; বোম্বেটে ধরা পড়াতে আবার এক নূতন মোকদ্দমা।
রক্তপাত হয়ে গেল, মানুষ মারা গেল, ভগবানের কৃপায়, ডেপুটিবাবুর অনুগ্রহে, আমরা কজন প্রাণে প্রাণে রক্ষা পেলেম; এই মোকদ্দমায় প্রমাণ আবশ্যক। বেঁচেছিলেম বোলে আমরাই সাক্ষী, পাইকেরাও সাক্ষী। আমাদের বজরার সারেং আর তার অধীনস্থ দাঁড়ী-মাঝীরা সাক্ষীশ্রেণীতে গণ্য। তারাও উপস্থিত থাকলো। বোম্বেটেদের বৃহৎ ছীপখানা ২০ জন লোকের দ্বারা চালিত হয়েছিল, তারাও বোম্বেটে। ডাকাতের সঙ্গের দলবল সকলেই ডাকাত, আসামীর দলে সেই ২০ জনও বন্দী হয়ে এসেছে; মোকদ্দমা গুরতর। বিচারের দিন ধার্য হয় নাই; অবসরপ্রতীক্ষায় পাঁচদিন আমরা ঢাকায় থাকলেম।
ডেপুটিবার বাসাবাড়ীর অন্দরমহলে অমরকুমারী। হরিহরবাবু যে দুটি স্ত্রীলোককে অমরকুমারীর সঙ্গে দিয়েছিলেন, তারা ঠিকাচাকরানী, যারা ঠিকালোক, তাদের উপর অধিক প্রভুত্ব চলে না; যাতে চলে, আমি তার উপযুক্ত উপায় অবলম্বন কোল্লেম। মুর্শিদাবাদ পর্যন্ত সঙ্গে যেতে হবে, অমরকুমারীর কাছে কাছেই থাকতে হবে, এই কড়ারে সম্মত কোরে তাদের আমি মাসিক পাঁচ পাঁচ টাকা বেতন ধার্য কোরে দিলেম; খোরাক-পোষাক স্বতন্ত্র। অমরকুমারীর মধুর ব্যবহারে, মধুর বচনে তারা তুষ্ট হয়েছিল, তার উপর অধিক বেতনের আশা পেলে, আর তাদের কোন আপত্তি থাকলো না। পাঁচ দিন আমরা নির্বিঘ্নে ঢাকায় বাস কোল্লেম।
পুলিশের সাহায্য-প্রার্থনায় আদালতে দরখাস্ত দাখিল উপলক্ষে ইতিপূৰ্বে একবার ঢাকায় আমি এসেছিলেম; লোকের মুখে শুনা ছিল, পূৰ্ববঙ্গের মধ্যে ঢাকা খুব ভাল সহর; মুর্শিদাবাদে বাঙলার রাজধানী হবার অগ্রে ঢাকাতেই রাজধানী ছিল। ঢাকা সহর আমার দর্শন করা হয় নাই; দর্শনের অভিলাষ প্রবল; পূৰ্বযাত্রায় সময় ছিল না, অভিলাষ পূর্ণ হয় নাই। এই যাত্রায় যদি ঘটে, বঙ্গের এই প্রাচীন সহরটি আমি ভালরূপে দর্শন কোরবো, এই সঙ্কল্প আমার মনে ছিল।
পাঁচ দিন অতিবাহিত। ইতিমধ্যে একদিন মোকদ্দমা ডাক হয়েছিল, আমাদের তলব হয় নাই। আসামীদের হাজতবাসের হুকুম। এই পর্যন্তই সে দিনের কার্য। আবার কবে দিন ধার্য হবে, আর কত দিন আমাদের ঢাকায় অবস্থান কোত্তে হবে, জানতে পারা গেল না। মনে উদ্বেগ থাকলো; কিন্তু সঙ্কল্পসিদ্ধির সময় পেলেম। সহরমাত্রই জনাকীর্ণ। বহুদিকে বহু গলীপথ; বহু দিকেই দোকান-পসার। অজানা লোকের পক্ষে শীঘ্র শীঘ্র সহরের সৰ্বস্থান চিনে লওয়া সহজ হয় না। ঢাকা আমার পক্ষে নূতন সহর। কোন দিকে কি, কোন দিকে কোন রাস্তা, কোন দিক দিয়ে কোন রাস্তায় যেতে হয়, কোন দিকে গৃহস্থলোকের বাস, কোন কোন দিকে কোন কোন দর্শনীয় পদার্থ, একাকী বাহির হয়ে ঠিক ঠিক সে সব নির্ণয় করা কঠিন; অতএব পল্লীর একটি বালককে আমি পথ-প্রদর্শক-রূপে মনোনীত কোল্লেম। বালকটি আমার সমবয়স্ক, বেশ চালাক-চতুর, কিছু কিছু লেখাপড়াও জানে, নাম অবলাকান্ত। প্রতিদিন অপরাহ্ণে, অবলাকান্তকে সঙ্গে নিয়ে আমি নগরদর্শনে বাহির হই। মণিভূষণ বাহির হন না, স্থানাদি-সন্দর্শনে তাঁর আগ্রহ অল্প, বাসাতেই তিনি থাকেন, সঙ্গে আসবার জন্য আমি তাঁরে অনুরোধও করি না, বরং অমরকুমারীর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আমার কোন উদ্বেগ থাকে না, সে জন্য আনন্দ জন্মে; নিত্য নিত্য নিরুদ্বেগে নগরদর্শনে আমি প্রীতি অনুভব করি। মণিভূষণের বাসায় থাকা ভালই হয়।
অবলাকান্ত আমার মনের মত সহচর। যেটি যেটি আমি দর্শন কোত্তে চাই, অবলাকান্ত সেইগুলি আমারে দেখায়, যে যে রাস্তার যে যে নাম, যে যে পদার্থের যে যে প্রকার বর্ণনা, যে যে মহাপুরুষের নামের যে সকল কীর্তি একে একে তন্ন তন্ন কোরে আমারে বোলে বোলে দেয়। বুড়ীগঙ্গার ধারে কোথায় কোথায় জলদস্যুর ভয়, তাও আমারে দেখিয়ে দেখিয়ে চিনিয়ে চিনিয়ে রাখে; যে দিকে ইংরেজটোলা, যে দিকে কোম্পানির বিদ্যালয়, চিকিৎসালয়, বিচারালয়, সাধারণ কার্যালয়, কারাগার, সে সকল দিকেও এক একদিন বেড়িয়ে বেড়িয়ে আসি। অষ্টাহকাল এইরূপে আমি অবলাকান্তের সঙ্গে ঢাকা সহরের বহুস্থান সন্দর্শন কোল্লেম। ঢাকার বাঙালীটোলার রাস্তাগুলি, বাজারের গলীগুলি অপ্রশস্ত; কাশীর বাঙালীটোলার ছোট ছোট গলী যত অপ্রশস্ত, তত অপ্রশস্ত নয়, কিন্তু যানবাহনের চলাচলে সঙ্কীর্ণ। ঢাকার বাজারে অনেক প্রকার জিনিষপত্র অতি সুন্দর। ঢাকাই কাপড়, ঢাকাই স্বর্ণালকার, ঢাকাই রজতালঙ্কার, ঢাকাই শঙ্খ অতি পরিপাটী। বঙ্গের সকলেই বলেন ঢাকার স্বর্ণকারেরা সোণারূপার উপর যেরুপ সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম বিচিত্র কাজ কোত্তে পারে, অন্য স্থানের স্বর্ণকারেরা সেরুপ পারে না। বিদেশী লোকের কাছেও ঢাকাই তাঁতি আর ঢাকাই সোণার বিশেষ প্রসিদ্ধ।
নিত্য নিত্য নূতন স্থান দর্শনে নিত্যই আমার নূতন নূতন কৌতূহল। একদিন অপরাহ্ণে, সহর ছাড়িয়ে অনেক দূরে গিয়ে পোড়লেম।—একটা মেলা উপলক্ষে সেইস্থানে অধিক জনতা। সেই জনতা ভেদ কোরে আমরা নানা প্রকার তামাসা দেখে দেখে বেড়াচ্ছি, মেলা স্থলে নানা প্রকার জিনিষপত্র বিক্রীত হোচ্ছে, এক একপ্রকার জিনিসের এক একটা পটি বোসে গিয়েছে; তরুণবয়স্ক ভিক্ষুক বালকেরা বহুরূপী সেজে পটিতে পটিতে ভিক্ষা কোরে বেড়াচ্ছে, ছদ্মবেশী জুয়াচোর ও গাঁটকাটারা উত্তম কৌশলে আপনাদের গুপ্ত মতলব হাসিল কোচ্ছে, বদমাসলোকেরা রকমারী যুবতী স্ত্রীলোকের অন্বেষণে ভিড়ের ভিতর লুকাচুরি খেলাচ্ছে, স্থানে স্থানে গীতবাদ্য হচ্ছে, একধারে হরিসংকীৰ্ত্তন বেরিয়েছে, যাত্রাওয়ালা ছেলেরা দিল্লীকা বাইজী সেজে ঘাঘরা ঘুরিয়ে ঘুরে ঘুরে নেচে নেচে দর্শকের কাছে পয়সা আদায় কোচ্ছে; এই সকল দেখতে দেখতে আমরা সেই ভিড়ের ভিতর পথহারা হোলেম, অবলাকান্তকে হারিয়ে ফেল্লেম। যেখানে মেলা হয়েছিল, সে দিকে আর কোনদিন আমি যাই নাই, সঙ্গীহারা হয়ে ফাঁপরে পোড়লেম। দেখতে দেখতে সুর্য অস্ত, দেখতে দেখতে সন্ধ্যা সমাগত, চতুর্দিক অন্ধকার। আকাশে নক্ষত্রোদয়।
সন্ধ্যাকালে যেমন অন্ধকার হয়, সেই রকম অন্ধকার, কিন্তু আমার চক্ষে তখন অনেক বেশী। কি কারণে আমি বেশী অন্ধকার দেখলেম, বোধ হয় তার পরিচয় দিতে হবে না। বিপদ আমার সঙ্গে সঙ্গে, শত্রু আমার সঙ্গে সঙ্গে, তার উপর সন্ধ্যাকালে অজানা জায়গায় সঙ্গীহারা। একবার তো বরদা-রাজ্যে সন্ধ্যাকালে পথ ভুলে বনমধ্যে প্রবেশ কোরে মহা বিপদে পতিত হয়েছিলেম, সেই কথাই মনে হোতে লাগলো। ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখে ভয় পায়, এ কথা নিস্ফল নহে। আমি ভয় পেলেম। সহরের ভিতর যদি থাকতেম, সহরের ভিতর যদি পথ হারাতেম, তা হোলে হয় তো ভয় পেতেম না। যেখানে এসেছি, সে স্থানটা সহরের বাহির; সেই জন্যই ভয়।
সহরের বাহিরেই মেলা। মেলাস্থল থেকে প্রায় আধ ক্রোশ পথ আমি চোলে এসেছি। কোন দিকে এসেছি, কোন দিকে যাচ্ছি, কোন দিকে সহর, কোন দিকে বড়ীগঙ্গা, কোন দিকে ডেপুটিবাবুর বাসা, কিছুই জানতে পাচ্ছি না। আকাশে সূর্য থাকলে বরং দিকনির্ণয় করা যেতো, সন্ধ্যার অন্ধকারে, সে পক্ষেও বাধা। কি করি?
দাঁড়ালেম। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বিষন্ননয়নে আমি চতুর্দিক নিরীক্ষণ কোল্লেম। দেখলেম কেবল অন্ধকার। আকাশপানে চাইলেম, আকাশে মেঘ ছিল না, উজ্জ্বল অনুজ্জ্বল নক্ষত্রমালা নয়নগোচর কোল্লেম; নীল চন্দ্রাতপে যেন মণি-মুক্তাখচিত, এইরুপ শোভা; প্রকৃতির সে শোভা তখন আমার ভাল লাগলো না; অন্য ভাবনায় প্রাণ আকুল। কত ভাবনাই ভাবছি, সকল ভাবনার উপরে অমরকুমারীর ভাবনা প্রবল হয়ে উঠছে। কোন দিকেই আর পদচারণ কোচ্ছি না, পথের একধারে একটি স্থানেই চুপ কোরে দাঁড়িয়ে আছি। আমি একাকী। কোন দিকে যাই, আপন মনে আপনা আপনি এই প্রশ্ন। নক্ষত্রেরা আকাশে জলে, আকাশে আলো হয়; সে আলো ধরাতলে আসে না; নক্ষত্রেরা যদি ধরাতলে পথ দেখিয়ে দিতে পাত্তো, তা হোলেও বরং অনুমানে অনুমানে গঙ্গা-তীরের রাস্তাটা আমি ধোরে নিতে পাত্তেম, প্রকৃতির খেলাঘরে নক্ষত্রপুঞ্জ যে দীপ্তি বিকাশ করে, সে দীপ্তিতে পার্থিব পথিকের বিশেষ উপকার কিছুই হয় না; নক্ষত্ৰ-দীপ্তি সে সময় আমার কোন উপকারেই এলো না।
পথের মাঝখানে আমি অচল। সাধ্য-সমীরণ বক্ষ-পল্লবের সঙ্গে খেলা কোচ্ছে, তরুবাসী বিহঙ্গেরা মিশ্রকণ্ঠে মিশ্র-রাগিণীতে গান কোচ্ছে, বাতাসের শব্দ আর সেই সঙ্গীত ধনি আমার শ্রবণকুহরে প্রবেশ কোচ্ছে, তমোময়ী নিশামূর্তি আমার সম্মুখে তিমির-বসন পরিধান কোরে কেমন এক রকম ভয় দেখাচ্ছে, কিছুই যেন আমি দেখছি না, কিছুই যেন আমি শুনছি না, নেত্র কর্ণ উভয়েই যেন নিশ্চেষ্ট। আমি অন্যমনস্ক।
রাত্রি প্রায় চারিদণ্ড। স্থাণুর ন্যায় এক স্থানেই আমি নিবদ্ধ; কে যেন সেই স্থানেই আমার পায়ে প্রেক মেরে আটক কোরে রেখেছে, এই প্রকার ভাব। এই ভাবে আমি আছি, এমন সময় দেখলেম, যে দিক থেকে আমি এসেছি, সেই দিকে একটু দূরে তিনটি শুভ্র পদার্থ;—পদার্থ তিনটি সচল;—আমার দিকেই যেন চোলে চোলে আসছে। ক্ষণকাল অনিমেষে সেই দিকে আমি চেয়ে থাকলেম। সেই তিন পদার্থের সমান গতি। ক্রমশঃ নিকটবর্তী।
যদিও অন্ধকার, তথাপি ক্ৰমশঃ নিকটবর্তী হওয়াতে আমি জানতে পাল্লেম, অন্য পদার্থ নহে, তিনটি মনুষ্য;—শুভ্রবসনাবৃত তিনজন পুরুষ। সমভাবে এক স্থানে আমি দাঁড়িয়ে ছিলেম, সেই তিনজন মনুষ্য সম্মুখরাস্তা দিয়ে চোলে যাবার সময় আমারে দেখতে পেলে। রাস্তার উপরেই আমি ছিলেম না, বামদিকের একটা বৃক্ষতলে নিঃশব্দে নীরবে দুর্ভাবনায় আমি নিমগ্ন, মুখে ফিরিয়ে আমার দিকে চেয়ে, সেই তিনজনের মধ্যে একজন একটু যেন চমকিতভাবে জিজ্ঞাসা কোল্লে, “কে আপনি? এখানে এই অন্ধকারে একাকী এমন ভাবে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?”
আমি উত্তর কোল্লেম, “পথিক আমি সম্প্রতি ঢাকা নগরে এসেছিলেম, আজ বৈকালে মেলা দেখতে বেরিয়েছিলেম, সঙ্গে আমার একটি বন্ধু ছিল, ভিড়ের ভিতর সেটিকে আমি হারিয়ে ফেলেছি; পথ ভুলে গিয়েছি; এদিকে আমার নূতন আসা, কোন দিক দিয়ে কোথায় যেতে হয়, জানি না, এজন্যই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছি।”
লোকটি যেন একটু সদয়ভাবে পুনরায় আমারে জিজ্ঞাসা কোল্লে, “কোথায় আপনি যেতে চান? কোন দিকে আপনার বাসা?”—আমি বোল্লেম, বাসা আমার এখানকার আদালতের দিকে; ডেপুটিম্যাজিষ্ট্রেট সদানন্দবাবু তাঁরই বাসাতে আমি থাকি; কোন দিকে বুড়ীগঙ্গা, অনুগ্রহ প্রকাশ কোরে সেইটি যদি আপনি দেখিয়ে দেন, তা হোলেই আমি চিনে নিতে পারবো।
আকাশের দিকে মুখ তুলে লোকটি একটু উচ্চকণ্ঠে বোলে উঠলো, “বুড়ীগঙ্গা?—বুড়ীগঙ্গা এখান থেকে অনেক দূরে। সে দিকের রাস্তা ছেড়ে আপনি অনেক দূর এসে পোড়েছেন। আমরাও মেলা দেখতে গিয়েছিলেম, এই দিকেই আমাদের বাড়ী, বুড়ীগঙ্গার ধার দিয়ে গেলেও আমরা বাড়ীতে পৌঁছিতে পারি, কিন্তু অনেকটা ঘুর হয়। কি করা যায়, আপনি দেখছি নূতন, রাত্রিও অন্ধকার, একাকী কোন দিকেই আপনি যেতে পারবেন না, নূতন লোকের পক্ষে রাত্রিকালে এ পথে যাওয়াও নিরাপদ নয়, কাজেই বুড়ীগঙ্গার তীর পর্যন্ত আপনাকে এগিয়ে দিয়ে আসা আমরা উচিত বিবেচনা কোচ্ছি। এ পথে ডাকাতের ভয় আছে; আপনি দেখছি নিতান্ত ভালমানুষ, আপনার সঙ্গে আমাদের পরিচয় না থাকলেও সময় এ পথে আপনাকে একা ছেড়ে যেতে আমার মন সরছে না; চলুন, গঙ্গাতীর পর্যন্ত আমরাও আপনার সঙ্গে যাই।”
কথাগুলি শুনে লোকটির প্রতি আমার শ্রদ্ধা জন্মিল। কোথাকার কে আমি, অকস্মাৎ আমার প্রতি দয়া, এলোক অবশ্যই শ্রদ্ধার পাত্র। যথার্থ ভদ্রলোক। তাঁর অঙ্গীকারে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে ধন্যবাদ দিব দিব মনে কোচ্ছি, এমন সময় হঠাৎ তিনি আমারে জিজ্ঞাসা কোল্লেন, “আপনি ঘোড়া চোড়তে জানেন? বুড়ীগঙ্গা এখান থেকে অনেকটা দূর, পদব্রজে যেতে হোলে দেরী হবে, অনেক রাত্রি হয়ে যাবে; ঘোড়ায় চেপে যাওয়াই সুবিধা; আপনি ঘোড়ায় চোড়তে জানেন?”
কেন, বোলতে পারি না, সহসা ঐ প্রশ্ন শ্রবণ কোরে আমার মনে একটু সন্দেহ এলো। এই তিনটি লোক পদব্রজে যাচ্ছিল সঙ্গে ঘোড়া ছিল না, হঠাৎ ঘোড়ায় চড়ার কথা কেন বলে? সন্দেহটুকু মনের ভিতর চেপে রেখে সেই প্রশ্নে আমি উত্তর দিলেম, “ঘোড়া যদি এখানে সুলভ হয়, আমি সওয়ার হোতে জানি; মধ্যে মধ্যে সওয়ার হওয়া আমার অভ্যাস আছে।”
যিনি আমার সঙ্গে কথা কোচ্ছিলেন, আমারে কিছু না বোলে তিনি তাঁর সঙ্গীদের দিকে একবার কটাক্ষপাত কোল্লেন, একজন তৎক্ষণাৎ ভোঁ ভোঁ কোরে একদিকে দৌড় ছিল। কেন দৌড়িল, কোথায় গেল, তা আমি বুঝলেম না, যারা সেখানে থাকলো তাদের কিছু জিজ্ঞাসাও কোল্লেম না। তিনজনেই আমরা নিস্তব্ধ।
দশ মিনিট পরে একজন ঘোড়-সওয়ার আমাদের সম্মুখে উপস্থিত। সহচরের ইঙ্গিতে যে লোকটি ইতিপূৰ্বে দ্রুতগতি ছুটে গিয়েছিল, সেই লোকটিই সওয়ার; তৎপশ্চাতে অপর তিনটি শুন্যপষ্ঠ অশ্ব; সে তিনটি অশ্বের লাগামও একগাছি রঞ্জ, বন্ধ কোরে সেই সওয়ার আপনার কটিদেশে নিবদ্ধ রেখেছে। ঘোড়ারা কদমে কদমে চোলে এসেছে। পশ্চাতের তিনটি অশ্ব শূন্যপৃষ্ঠ এ কথা বলবার তাৎপর্য এই যে, সেই তিন অশ্বপৃষ্ঠে সওয়ার ছিল না; —পৃষ্ঠদেশ শূন্য ছিল, এ কথা বলা আমার উদ্দেশ্য নয়; কেন না, চর্ম নির্মিত সুন্দর সুন্দর জীন সেই তিন অশ্ব-পৃষ্ঠে সজ্জিত ছিল।
প্রথমে যে লোকটি আমার সঙ্গে কথা কোয়েছিলেন, এই সময়ে তিনি আমারে একটি অশ্বপৃষ্ঠে আরোহণ করবার জন্য অনুরোধ কোল্লেন; কোনটিতে আমি আরোহণ কোরবো, অঙ্গুলিসঙ্কেতে সেটিও তিনি আমারে দেখিয়ে দিলেন, এক লম্ফে সেই সুন্দর জীনসজ্জিত তুরঙ্গ-পৃষ্ঠে আমি আরোহণ কোল্লেম। লোকেরা তিনজন. আমি একজন, চারিজন, একজন সওয়ার ছিল, দ্বিতীয় অশ্বে আমি আরোহণ করবার পর অবশিষ্ট দুজন অবশিষ্ট দুটি অশ্ব-পৃষ্ঠে আরোহণ কোল্লে, অশ্বেরা তখন দ্রুতগতিতে ধাবিত হোতে লাগলো। যে অশ্বে আমি আরোহণ কোল্লেম, সেই অশ্বের সম্মুখ দুজন, আর পশ্চাতে একজন সওয়ার অরূঢ় থাকলো।
ঘোড়ারা ছুটেছে। কোন দিকে চোলেছে, আমি সেটা নিরূপণ কোত্তে পাচ্ছি না; দিগভ্রম হয়েছিল, রাত্রিও অন্ধকার, নিরূপণ করাও কঠিন। মানুষের অনুমানটা সঙ্গে সঙ্গেই থাকে। যেখানে আমি ছিলেম, দিগভুল হোলেও ক্ষণে ক্ষণে মনে মনে আমি অনুমান কোচ্ছিলেম, মুখ যেন আমার দক্ষিণদিকে আছে; দক্ষিণদিকে মুখ থাকলে বামদিকে পূৰ্বদিক, পশ্চাতে উত্তরদিক, দক্ষিণ হস্তের দিকে পশ্চিমদিক থাকে। এ হিসাবে দক্ষিণদিকেই বুড়ীগঙ্গা; কিন্তু ঘোড়ারা যে দিকে দৌড়িল, ঐ হিসাবে আমার অনুমান সেটা পূৰ্বদিক। কোথায় যাচ্ছি, লোকেরা আমারে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, সভয় সংশয় মনে আমার এইরুপ বিতর্ক।
অশ্বগতি অবিরাম। কতদূর আমরা গিয়ে পোড়লম, ঠিক অনুমান কোত্তে পাল্লেম না, কিন্তু ভয় হলো। পথ ভুলেছিলেম, সেটা বরং এক রকম ছিল ভাল; নূতন লোকের কথায় ভুলে, ভুলের কান্তারে এসে পোড়লেম। বুড়ীগঙ্গা এ দিকে নয়; লোকেরা আমারে পথ ভুলিয়ে অন্যদিকে এনে ফেলেছে, ইচ্ছা কোরেই এনেছে, তাদের ভুল নয়, আমারই ভুল, তাদের হয় তো দুষ্ট মতলব, আমার সরল প্রাণে আশুপ্রত্যয়, উপকারী ভদ্রলোক বিবেচনা কোরেই তাদের প্রস্তাবে আমি সম্মত হয়েছিলেম, তাদের ঘোড়াতে আরোহণ কোরেছিলেম. সেইটিই আমার ভুল; সেই ভুল এখন আমার আতঙ্কের কারণ।
একবার উচ্চকণ্ঠে আমি জিজ্ঞাসা কোল্লেম, “তোমরা আমারে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ? কেহই উত্তর দিল না; সম্মুখে সওয়ারও নিরুত্তর, পশ্চাতের সওয়ারেরাও উদাসীন। ভগবানের মনে কি আছে, ভগবান জানেন, অজ্ঞাত লোকের ঘোড়ার উপর অজ্ঞাত ভয়ে আমি অর্ধকম্পিত; সংশয় ক্রমশই প্রবল।
আশুগতি অশ্বেরা কতক্ষণে কত পথ অতিক্রম কোত্তে পারে, অবধারণে শিক্ষা হওয়া অবধি সেটি আমি জেনেছিলেম, এই চারিটি অশ্ব এক ঘণ্টায় প্রায় তিন ক্রোশ অতিক্রম কোরেছে, এইরুপ আমি সিদ্ধান্ত কোল্লেম। যেখানে আমি বিফল প্রশ্ন কোরে হতাশ্বাস হয়েছিলেম, সে স্থান থেকে প্রায় অর্ধক্রোশ অগ্রসর হয়ে সম্মুখের ঘোড়াটা হঠাৎ থেমে গেল। আমি মনে কোল্লেম, এই বুঝি তবে ঠিকানায় এসে পৌঁছিলেম।
সব ভুল। মেলাস্থলে সঙ্গীহারা হয়ে এত রাত্রি পর্যন্ত যা যা আমি ভাবছি, যা যা আমি কোচ্ছি, সব ভুল। সম্মুখের ঘোড়াটা থেমে গেল। সওয়ার লোকটা এক-বেষ্টন প্রায় বিশ হাত পশ্চাতে হোটে গিয়ে ঘোড়ার পৃষ্ঠে এক কশাঘাত কোল্লে, ঘোড়া তৎক্ষণাৎ পুনরায় তীরবেগে অগ্রসর হয়ে তুড়িলাফ কেটে অনেক দূরে গিয়ে যেন ঠিকরে পোড়লো, আমি অবাক হয়ে সন্দেহে সন্দেহে কারণ চিন্তা কোত্তে লাগলেম। চিন্তার অবসর হলো না। পশ্চাতে যে দুজন সওয়ার ছিল, তাদের মধ্যে একজন বেশ মিষ্টবচনে উৎসাহ দিয়ে আমারে বোল্লে, “আপনিও ঐ রকম করুন, ঐ লোকটি যেমন বিশ হাত পেছিয়ে গিয়ে অধিক বেগে ঘোড়া ছুট করালে, আপনিও তাই করুন। সম্মুখে একটা নালা আছে, ওসার প্রায় চার হাত, কানায় কানায় জল, ঘোড়া যদি কিনারায় দাঁড়িয়ে লাফ দেয়, একলাফে পার হহতে পারবে না, জলে পড়া সম্ভব; দূর থেকে ছুট কোরিয়ে লক্ষের অবসর দিলে নির্বিঘ্নে পার হওয়া যায়, আপনি তাই করুন।”
তাই আমি কোল্লেম। সুশিক্ষিত অশ্ব একলম্ফে নালা পার হয়ে গেল। আমার পশ্চাতে যে দুজন সওয়ার ছিল, ঐ রকমে তারাও পার হয়ে এলো;— এলো, কিন্তু কেহই দাঁড়ালো না। যেমন সারিবন্দী হয়ে আমরা আসছিলেম, সেই রকম সারিবন্দী হয়েই যেতে লাগলেম। অগ্রপশ্চাতে ঘোড়াসওয়ার, মধ্যস্থলে আমি; এত পথ এলেম, কাহারও মুখে কোন কথা শুনলেম না। নালা পার হবার উপদেশটি মাত্র একজনের মুখে শুনা হয়েছিল, তার পর আবার সকলেই নিস্তব্ধ।
আমিও নিস্তব্ধ। মহা বিপাকে ঠেকলেম। নালা পার হবার পর অবধি আমার অশ্বপৃষ্ঠের জীনটা অল্প অল্প কম্পিত হোচ্ছিল, অশ্বের গতিবেগে সেই কম্পন ক্রমশই বেড়ে বেড়ে উঠতে লাগলো, অশ্বপৃষ্ঠে ক্ষণে ক্ষণে আমি যেন টোলে টোলে পোড়তে লাগলেম। আশ্চর্য ব্যাপার! যারা ভেল্কীবাজী দেখায়, তাদের কত কৌশল সকলেই দেখেন, কিন্তু ঘোড়ার পিঠের জীন, আপনা আপনি কাঁপে, আপনা আপনি টলে, এটা কি প্রকার ভেঙ্কী, সহজে অনুধাবন করা যায় না। দুই দিকের দুই রেকাবে দুই পা; জীন-কম্পনে পা আমি ঠিক রাখতে পাচ্ছি না, জীনের ভিতর কি রকম কল আছে, তাই যেন মনে হোতে লাগলো। জীন ঘোরে, জীনের সঙ্গে আমিও ঘুরি; একবার কাৎ হোলেম; ঘুরে ঘুরে ঘোড়ার পেটের নীচে আমার মাথা এলো, রেকাবশুদ্ধ পা-দুটি ঘোড়ার পিঠের উপর উঠলো, আবার আর এক চক্র ঘুরে জীনশুদ্ধ অশ্বপৃষ্ঠে আমি সওয়ার হয়ে বোসলেম, আবার ঘুরে পোড়লেম, আবার উঠলেম, দুই হস্তে অশ্বের কেশর আকর্ষণ কোরে অশ্বপৃষ্ঠে শুয়ে পোড়লেম; তবুও স্থির থাকতে পাল্লেম না, আবার ঘুরে ঘুরে ঝুলে পোড়লেম, ঝুলে ঝুলে আবার উপরদিকে ঠেলে উঠলেম, ভোঁ ভোঁ কোরে মাথা ঘুরতে লাগলো, অশ্বের বেগ সংযত করবার চেষ্টা পেলেম, বিফল চেষ্টা, কিছুতেই থামাতে পাল্লেম না। বায়ুবেগের ন্যায় অশ্বগতি, আমি কেবল ঝুলছি আর উঠছি, অশ্বারোহণে সুশিক্ষা না থাকলে কখনই আমি সেই ভাবে অধিকক্ষণ ঝুলতে পাত্তেম না, উঠছি, নামছি, ঝুলছি, ছেলেরা যেমন নাগরদোলায় দোলে, সেই রকমই দুলছি, সত্যই যেন আমি নাগরদোলায়।
বিধাতার নাগরদোলায় দোল খাওয়া আমার একপ্রকার অভ্যাস হয়ে এসেছে। গুরুপত্নী যখন আমারে বিদায় কোরে দেন, তখন আমি এক প্রকার অধঃপতিত, সর্বানন্দবাবু যখন আমারে দয়া কোরে আশ্রয় দেন, তখন আমি একপ্রকার উচ্চে উত্থিত, তার পর আবার রক্তদন্তের তাড়নে পুনঃ পুনঃ বিঘূর্ণিত; সংসারের নাগরদোলা উপর্যুপরি কতবার কত স্থানে অধঃপতিত হোচ্ছি, মাঝে মাঝে এক এক ঘটনায় একটু একটু সামলে উঠছি, পাঠকমহাশয় পদে পদে আমার এই নাগরদোলায় ঘূর্ণনের বিশেষ বিশেষ পরিচয় প্রাপ্ত হোচ্ছেন, আবার এই এক অশ্বপৃষ্ঠে নাগরদোলা! বিধাতা আমারে নাগরদোলায় ঘুরাচ্ছেন, মানুষেরাও ঘুরাচ্ছে, আবার এই চতুষ্পদ অশ্ব আমারে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চমৎকার খেলা খেলাচ্ছে। অশ্বারোহণে সুশিক্ষা না থাকলে হয় তো মাটিতে পোড়ে অশ্বপদাঘাতে চূর্ণ হয়ে যেতেম, পৃথিবী থেকে হরিদাসের নাম পর্যন্তও বিলুপ্ত হয়ে যেতো, কেবল ভগবানের কৃপায় রক্ষা পাচ্ছি। যে সওয়ার আমার অগ্রগামী, সে একবারও মুখ ফিরিয়ে আমার দিকে চেয়ে দেখছে না; যারা পশ্চাতে, তারা অবশ্য দেখছে; এক একবার আমিও তাদের দিকে চেয়ে চেয়ে দেখছি; তারা গম্ভীর। লোকে যেমন গম্ভীরবদনে কোন আশ্চর্য ক্রীড়া দর্শন করে, তারাও সেই রকমে আমার তখনকার সেই দুর্দশা দর্শন কোচ্ছে। উদরের দায়ে যারা পশুপক্ষী বলিদান করে, রাজ-সরকারের যারা জল্লাদের কাজ করে, জীবের জীবনান্তসময়ে আনন্দ প্রকাশ কোরে তারা হাস্য কোরে থাকে। অশ্বপৃষ্ঠে আমি নাগরদোলায় দলছি, সেই দশা দর্শন কোরে আমার পশ্চাদ্বর্তী সেই দুজন ঘোড়সওয়ারও অবশ্য মনে মনে হাস্য কোচ্ছিল, সে অংশে সন্দেহ বিরহ।
নাগরদোলায় দুলতে দুলতে কতদূর আমি গিয়েছিলেম, মনে হয় না, প্রাণ হাঁই ফাঁই কোচ্ছিল, থেকে থেকে দম বন্ধ হয়ে আসছিল, আর খানিকক্ষণ সেই ভাবে থাকলে নিশ্চয়ই আমার প্রাণবায়ু বহির্গত হোত। কোথাকার লোক এরা? আমার সঙ্গে এদের কি এত শত্রুতা? আমারে প্রাণে মারবার জন্য কেন এই চক্র বিস্তার? মনে মনে আমি এই সকল আন্দোলন কোচ্ছি, ঘোড়ার উপরে ক্রমাগত ঝুলছি আর উঠছি, তার পর আমি অজ্ঞান হয়ে পোড়েছিলেম। কতকক্ষণ অজ্ঞান ছিলেম, মনে নাই।