হরিদাসের গুপ্তকথাদ্বিতীয় খণ্ড
পঞ্চম কল্প : পদ্মায় প্রাণ যায়
যে বজরায় ঢাকায় আসা হয়েছিল, সেই বজরায় আরোহণ কোরে আমরা মাণিকগঞ্জে চোল্লেম। আমরা ছয় জন;—আমি, মণিভূষণ, অমরকুমারী, হরিহরবাবুর সরকার, হরিহরবাবুর চাপরাসী আর ঢাকার পুলিশ-প্রহরী।
মনে আনন্দ আছে, অথচ আসামীরা ধরা পোড়ছে না, গুপ্তভাবে কোথায় কি প্রকারে ওৎ কোরে থাকে, কোথায় কি প্রকারে কখন কি বিপদ ঘটায়, সেই বিষয়ে কিছু কিছু, আশঙ্কাও আছে। আমার জীবনের কেমন এক গ্রহফল, চিন্তাশূন্য আমি থাকতে পারি না। নিশ্চিন্ত থাকায় যে সুখ, সে সুখ যেন আমার ভাগ্যে নাই, তাই আমি সৰ্বদা ভাবি। বজরায় বোসে বোসে অমরকুমারীর সঙ্গে কথা কোচ্ছি, মণিভূষণের সঙ্গে কথা কোচ্ছি, চিন্তারাক্ষসী বুকের ভিতর খেলা কোচ্ছে! রাশিচক্রের গতির ন্যায় কত পরিবর্তনে কত প্রকার চিন্তা আমার মনের ভিতর উদয় হচ্ছে, ঠিক রাখতে পাচ্ছি না। বর্ধমানে সর্বানন্দবাবুর খুনের পর রক্তদন্ত আমারে ধোরে এনেছে, সর্বানন্দবাবু পরিবারেরা কে কেমন আছেন, কোন সংবাদ পাই না, মোহনবাবুর সঙ্গে মধ্যে মধ্যে দেখা হয়েছিল, শ্বশুরবাড়ীর সংবাদ তিনি কিছুই বলেন নাই। আশালতা; স্নেহময়ী বালিকা আশালতা; রক্তদন্ত যে দিন আমারে ধোত্তে যায়, সেই দিন বালিকা আমার অনুকলে পিতার কাছে কত কথাই বোলেছিল। হায় হায়! আশালতার বিবাহের আয়োজনের সময়েই সর্বানন্দবাবুর প্রাণ গেল! কারা যে তাঁরে কেটে গেল, পুলিশ তার কিছুই কিনারা কোতে পাল্লে না; আজ পর্যন্ত খুনী আসামীর সন্ধান হলো কি না, তাও কিছ, জানা গেল না। জানা যাবেই বা কিরূপে? মোহনবাবুর মোহন চক্রে তদবধি আমি নানাস্থানে ঘুরে বেড়াচ্ছি; কোথাও স্থির হয়ে থাকতে পাচ্ছি। বর্ধমানের সংবাদ আমারে কে এনে দিবে?
রক্তদন্ত আমার শত্রু; জাতশত্রু; প্রাণসংহার কোত্তে চায়! তেমন শত্রুতা তার সঙ্গে আমার কি আছে, কিছুই আমি জানি না। কাশীতে জেনেছি, মোহনলালবাবুর গুপ্ত উপদেশে রক্তদন্ত আমার উপরে দৌরাত্ম্য করে। সে কথাটাই বা কি? মোহনবাবুর কাছে আমি কি অপরাধে অপরাধী, মোহনবাবু কেন আমার শত্রু, তাও আমার অজ্ঞাত। তাঁর শ্বশুরবাড়ীতে আমি ছিলেম, মহাবিপদসময়ে সেইখানে আশ্রয় পেয়েছিলেম, এই আমার অপরাধ, মোহনবাবু আমারে সে আশ্রয় ছাড়িয়ে নিজ বাড়ীতে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন, যেতে আমি সম্মত হই নাই, এই আমার অপরাধ। সে অপরাধে প্রাণে মারবার সংকল্প হয়, এটা আমার স্বপ্নের অগোচর ছিল।
চিন্তার স্রোত একটানা বহে না, জোয়ার-ভাঁটার ন্যায় গতির তারতম্য অনুভূত হয়, নানা দিকে শাখা-প্রশাখা প্রবাহিত হয়ে থাকে। মোহনলালবাবু একবার আমার প্রতি প্রসন্ন হয়েছিলেন, সে প্রসন্নতা দীর্ঘকালস্থায়ী হয় নাই। বারাণসীধামে রমেন্দ্রবাবুর নিকটে একদিন আমি মোহনলালের চরিত্রের একটু একটু ছায়া-চিত্র অঙ্কিত কোচ্ছিলেম, গুপ্তভাবে শ্রবণ কোরে মোহনবাবু আবার আমার উপর খড়াহস্ত; অল্পদিনের সেই প্রসন্নতা অল্পদিনেই উড়ে যায়; তদবধি চক্ষে চক্ষে তার সঙ্গে আর আমার দেখা-সাক্ষাৎ হোচ্ছে না, কিন্তু গোপনে গোপনে তাঁর দুষ্টচক্র সমভাবেই ঘূর্ণিত হোচ্ছে। অমরকুমারী-হরণের এই যে ভয়ানক চক্র, আমি বেশ বুঝতে পাচ্ছি, এ চক্রের মূলেও মোহনবাবু দণ্ডধর! অমরকুমারীকে উদ্ধার কোরে আমি নিশ্চিন্ত হোতে পাচ্ছি না। চক্রের নায়কেরা-উপনায়কেরা নিরাপদে মুক্ত আছে। আমার শান্তিপথে তারা বিষম কণ্টক; তবে আমি নিশ্চিত থাকি কিরূপে?
নিশ্চিত সুখ আমার ভাগ্যে নাই। আমার সম্মুখে অমরকুমারী; অমরকুমারীর চন্দ্রমুখ আমি দর্শন কোচ্ছি, অমরকুমারীর অমৃতময়ী বাণী আমি শ্রবণ কোচ্ছি, তথাপি যেন চিত্তে সুখ নাই; চিতার অনলে আমার হৃদয় দগ্ধ হোচ্ছে। কবির বাণী অখণ্ডনীয়। কবি বলেন, চিতা আর চিন্তা এই উভয়ের মধ্যে চিন্তাই গরীয়সী, কেন না, চিতা কেবল মৃতদেহ দাহ করে, চিতা সৰ্বদা সজীব প্রাণীকে দাহ করে! সেই চিন্তার প্রখর অনলে আমি দগ্ধীভূত। এক এক সময় এক একটি আনন্দের হেতু উপস্থিত হয়, চিন্তার অনল সেই হেতুগুলিকে তখনি দগ্ধ কোরে ফেলে। এখন আমার সেইরূপ অবস্থা।
মাণিকগঞ্জে তরণী পৌঁছিল। হরিহরবাবুর বাসায় আমরা উত্তীর্ণ হোলেম। বাসায় পরিবার থাকেন না, কিন্তু বাসাবাড়ী দু-মহল। ভিতরমহলে অমরকুমারীকে রাখা হলো, বাসায় দাসী আর পাচিকা অমরকুমারীর সঙ্গিনী হয়ে থাকলো। হরিহরবাবু অমরকুমারীর রূপ দর্শন কোল্লেন; যত কষ্টে, যত কৌশলে, যত ব্যয়ে, যত শ্রমে অমরকুমারীকে আমি উদ্ধার কোরেছি, আমার মুখে সেই সব কথা শ্রবণ কোল্লেন; তত অল্প বয়সে তত সৃষ্টি আমি কোরেছি, স্নেহবশে প্রশংসা কোরে আমারে সাধুবাদ দিলেন; ভক্তিভাবে আমি তাঁরে অভিবাদন কোল্লেম।
মাণিকগঞ্জে তিন দিন। দীনবন্ধুবাবু আমার কোন সমাচার প্রাপ্ত হোচ্ছেন না। চিঠি লিখে সংবাদ দেওয়া, তাও ঘোটে উঠছে না, সমস্তই অনিশ্চিত ছিল, অনিশ্চিত সংবাদে বন্ধুলোকের উদ্বেগ বৃদ্ধি করা হয় মাত্র; সেই কারণেই মুর্শিদাবাদে আমি চিঠি লিখি নাই। তৃতীয় দিবসের রজনীযোগে হরিহরবাবুকে সেই সব কথা আমি বোল্লেম; আর কালবিলম্ব না কোরে মুর্শিদাবাদে ফিরে যাওয়া আমার ইচ্ছা; এই নিবন্ধ জানালেম। একটু চিন্তা কোরে তিনি বল্লেন, “আর একটি দিন অপেক্ষা কর। মণিভূষণ আর তুমি, দুজনেই ছেলেমানুষ, অমরকুমারী বালিকা; যেতে হবে অনেকদূর, ভয়ঙ্করী পদ্মানদী, পদ্মার তরঙ্গে বড় বড় সাহসী পুরুষেরও হৃদয় কম্পিত হয়; উপযুক্ত বন্দোবস্ত কোরে, উপযুক্ত লোকজন সঙ্গে দিয়ে, একদিন পরে আমি তোমাকে পাঠাব; আর একটি দিন মাত্র অপেক্ষা কর।”
একটি দিন আমি অপেক্ষা কোল্লেম। সেই দিন দীনবন্ধুবাবুর নামে আর শান্তিরাম দত্তের নামে দুইখানি চিঠি লিখে, আমি স্বহস্তে ডাকঘরে দিয়ে এলেম। সে দিন আমার আর অন্য কার্য ছিল না, দিনমানে হরিহরবাবুও বাড়ীতে ছিলেন না, মণিভূষণের সঙ্গে আনুসঙ্গিক নানাপ্রকার গল্পে দিনমান আমি অতিবাহিত কোল্লেম। সন্ধ্যার পর হরিহরবাবুর বাসায় এলেম। আমাদের মুর্শিদাবাদে যাত্রার সমস্ত বন্দোবস্ত ঠিক হলো। অমরকুমারীর সঙ্গে দুজন দাসী থাকবে আর নৌকার হেপাজাতের জন্য পাঁচজন পাইক থাকবে, রন্ধনকার্যের জন্য একটি ব্রাহ্মণবালকও সঙ্গে যাবে, এইরূপ বন্দোবস্ত। সঙ্গে আমার যে টাকাগুলি ছিল, সমস্তই নিঃশেষিত হয়ে গিয়েছে, অতি অল্পমাত্র অবশিষ্ট, হরিহরবাবু আর একশত টাকা আমারে ঋণস্বরূপ প্রদান কোল্লেন, মুর্শিদাবাদে পৌঁছে সেই টাকা আমি পাঠাব, এইরূপ অঙ্গীকার কোল্লেম।
পরদিন মধ্যাহ্নের পূর্বে আহারাদি কোরে আমরা নৌকাররাহণ কোল্লেম, আমাদের জন্য বড় একখানি বজরা, আর রন্ধনের জন্য আর একখানি নৌকা ভাড়া করা হলো, বজরা আমাদের পদ্মানদীতে প্রবেশ কোল্লে, আমরা পদ্মাগর্ভে ভাসলেম। পূর্ণ বর্ষাকাল নয় তথাপি পদ্মার এ কূল ও কূলে দেখা যায় অল্পবাতাসেও পদ্মানদীতে তুফান হয় তরঙ্গে তরণীগুলি যেন নৃত্য কোত্তে থাকে। আমরা যে দিন পদ্মায়, সে দিন অল্প অল্প হাওয়া ছিল, তরঙ্গ প্রবল ছিল, বাতাসের গতি উত্তরদিকে, পদ্মা একটানা, দক্ষিণবাহিনী, উজানে তরণী চোলেছে, যে দিকে স্রোত, বায়ু সে দিকে অনুকূল ছিল না, কাজে কাজে দ্রূতগমনে বাধা হোচ্ছিল, এক ঘণ্টার পথে দুই ঘণ্টা অতীত। বজরার সারেং পাকালোক, নদীর যেখানে যেখানে চড়া, যেখানে যেখানে গভীরতা, সারেঙের সে সব জায়গা ঠিক ঠিক জানা ছিল; বেলা যখন প্রায় অবসান, সারেং সেই সময় মধ্যস্রোত পরিত্যাগ কোরে কিনারা ধোল্লে, কিনারায় কিনারায় মৃদুগতিতে তরণী চোল্লো, দশ হাত দূরেই তীরভূমি। মধ্যস্থল দিয়া গেলে কোন তীরের কোন বস্তু স্পষ্ট নজর হয় না, কিনারা থেকে একপারের সকল বস্তুই দেখা যায়। এক এক বার আমি তীরের দিকে চেয়ে দেখছি, লোকজন চলাচল কোচ্ছে, গরু-বাছুর চোরে বেড়াচ্ছে, এক একটা জঙ্গলের উপর বড় বড় কাক বোসে আছে, দূর থেকে দেখলে বোধ হয়, যেন এক একটা কৃষ্ণবর্ণ খাসী; এ অঞ্চলের লোকের মুখে কাকের নাম ‘কৌয়ো।’ ঠাঁই ঠাঁই অনেক গাছপালাও দেখা গেল, দূরে দূরে এক একখানা বাড়ীও দেখতে পেলেম, কিন্তু ক্রমশই লোকালয় অদৃশ্য, যে স্থানে আমরা এসে পোড়লেম, সে দিকে মানুষের গতিবিধিও বড় কম। পশ্চাতে আমি চেয়ে দেখলেম, একখানিও নৌকা দেখা গেল না, দূরে দূরে ক্ষুদ্রাবয়ব এক একখানি নৌকার পালদণ্ড দেখা গেল, কিন্তু সে সকল নৌকারও গতি অন্যদিকে। এক এক জায়গায় ইলিশমাছ ধরার ডিঙ্গী; জেলেরা স্ফূর্তিতে গান কোত্তে কোত্তে মাছ ধোরে বেড়াচ্ছে, এক এক ক্ষেপে বহু মৎস্য আটক পোড়ছে, দেখতেই এক তামাসা।
আমাদের তরণী ক্রমশই অগ্রসর; সূর্যও ক্রমশঃ পশ্চিমাভিমুখে অগ্রসর; মাছধরা নৌকাও ক্রমশঃ বিরল; তীরভূমি জনশূন্য, আমার বোধ হলো যেন, কোন একটা প্রশস্ত প্রান্তরের উপর দিয়ে আমরা ভেসে ভেসে যাচ্ছি, সম্মুখে পশ্চাতে বামে দক্ষিণে আর একখানিও নৌকা নাই। পদ্মাবক্ষে নৌকাযোগে যাঁরা নূতন যাত্রী, বিস্তার দর্শনে, তরঙ্গ দর্শনে তাঁদের ভয় হয়, যখন আবার অন্য নৌকা দৃষ্টিগোচর হয় না তখন আরো সেই ভয়ের বৃদ্ধি হয়। সূর্যদেব ডুবে যাচ্ছেন, ডুবুডুবু মূর্তিতে পদ্মার জলতলে তরঙ্গে তরঙ্গে কম্পিত হোচ্ছেন, বোধ হোচ্ছে যেন, সমস্ত দিন পরিশ্রমের পর দিনপতি ঠাকুর পদ্মাজলে স্নান কোত্তে নেমেছেন। ধরাতল অন্ধকার হয়ে আসছে; যে সময়ের নাম গোধুলি, সেই সময় অতি নিকট; আমার অন্তরে অল্প অল্প আশঙ্কার উদয়, অকারণে কেন তখন আশঙ্কা, নিজের মন নিজে জানতে পাল্লেও সে আশঙ্কার হেতুনির্দেশ করা দুরহ। এক একবার তীরের দিকে আমি চেয়ে চেয়ে দেখছি, একটিও লোক নাই, সে জায়গাটায় চলাচলের রাস্তা আছে কি না, তাও ঠিক জানা গেল না, অনাবশ্যক বিবেচনায় সারেঙকেও কিছু জিজ্ঞাসা কোল্লেম না।
তরণী চোলেছে, তীরের বৃক্ষশাখাও যেন চোলেছে। হঠাৎ দেখি, এক জায়গায় প্রকাণ্ড একটা বৃক্ষতলে একজন লোক। মাথায় প্রকাণ্ড একটা পাগড়ী; গায়ে বোধ হলে তুলাভরা চাপকান, হাতে একগাছা মানুষপ্রমাণ যষ্টি। লোকটা সেইখানে দাঁড়িয়ে ছিল, কোন দিকে তার দৃষ্টি, অনেকক্ষণ চেয়ে চেয়ে দেখেও আমি সেটা ঠিক কোত্তে পাল্লেম না, অনুভবে বুঝলেম যেন, পদতলের মৃর্তিকার দিকেই চেয়ে আছে, অন্যদিকে দৃষ্টি নাই। গোধূলির অল্প অল্প অন্ধকার, লোকটার মুখখানা কি রকম, স্পষ্ট দৃষ্টিগোচর হলো না; মুখে দৃষ্টিগোচর হলো না বটে, কিন্তু মনের ভিতর কেমন একরকম সন্দেহ দাঁড়ালো, কারণ উপস্থিত নাই, তথাপি আমি একটু একটু ভয় পেলেম।
ভয়ের সময় আপন মনে সাহস আনয়ন করা ভাল, ভয়কে অতিক্রম করা যাক না যাক, সাহসের প্রবোধে কতকটা আশ্বস্ত হওয়া যায়। মনে কোল্লেম, হয় তো পথিক লোক, কিম্বা হয় তো, কোন আদালতের পেয়াদা, কি হয় তো কোন জমীদারের পাইক। এই একপ্রকার প্রবোধ। ভয়ের সময় সাধ্যানুসারে অন্যমনস্ক হবার চেষ্টা করাও ভাল। লোকটার দিকে আর চাইলেম না, তরণীও ক্রমে ক্রমে সে জায়গা ছাড়িয়া গেল। যে বস্তু দেখবো না, যে দিকে চাইবো না মনে করা যায়, সেই বস্তু দেখতে সেই দিকে চাইতে আগেই যেন প্রবৃত্তি আসে, সেইরকম উপদেশ দেয়, মানুষের প্রবৃত্তির এই একটা ধর্ম যেন সাধারণ। পশ্চাতে ফিরে ফিরে দুই তিনবার সেই বৃক্ষের দিকে আমি চাইলেম, যতক্ষণ দেখা গেল, ততক্ষণ চাইলেম, শেষে চেয়ে চেয়ে দেখি, সে লোক সেখানে আর নাই। আতঙ্ক, উপেক্ষা, তাচ্ছল্য, এই তিনের পরপর মল্লযুদ্ধ। সে যুদ্ধ দেখবার লোক নাই, আমার চক্ষ কি দেখেছে, আমার মন কি ভেবেছে, চক্ষুই জানলে, মনই জানলে, কাহাকেও আমি কিছু বোল্লেম না; লোকটার কথা যেন ভুলেই গেলেম। অন্য বিষয়ে একটু চিন্তা কোরে, অমরকুমারীকে জিজ্ঞাসা কোল্লেম, “আচ্ছা অমর ডেপুটিবাবুকে তুমি বোলেছিলে, একটা লোকের নাম চণ্ডেশ্বর। আচ্ছা, চেহারা তুমি জান, পাপিষ্ঠ জটাধর ওখানে চণ্ডেশ্বর নাম ধোরেছিল, যেটা ঠিক হোতে পারে, কিন্তু আর একটা লোকের নাম তুমি বোলেছ, গণেশ্বর। আচ্ছা, শোনবার ত তোমার ভুল হয় নাই? ঠিক মনে কর দেখি, গণেশ্বর কি ঘনশ্যাম?”
অমরকুমারী বোল্লেন, “শোনবার ভুল হয় নাই। ঠিক শুনেছি, তার নাম গণেশ্বর; কিন্তু ভাই! চণ্ডেশ্বর এক একবার সেই লোকটাকে ঘনশ্যাম বোলে ডাকতে ডাকতে বড় বড় দাঁত দিয়ে জিব কামড়ে ফেলেছিল, তাও আমি দেখেছি। বোধ করি, সেই লোকটার দুটো নাম; এক নাম গণেশ্বর, এক নাম ঘনশ্যাম।”
আপন মনেই আমি বোলে উঠলেম, “ওঃ! ঘনশ্যামটাও তবে নাম ভাঁড়িয়েছে! যে সব কাজ তারা করে, সে সব কাজে নামভাঁড়ান, বেশ লুকান, বড়ই দরকার। ঘনশ্যামটা গণেশ্বর হয়েছে, জটাধরটা চণ্ডেশ্বর সেজেছে, তবে সেই যার নাম মিয়াজান, সে লোকটাও হয় তো ঠিক নামে পরিচয় দেয় নাই; সে লোকটাও হয় তো আর কিছু হবে। যাই হোক, জটাধরের নাম ভাঁড়ান ফস্কা গেরো;—বিধাতার গঠনের উপর কারিকুরি খাটে না; বানরের মত মুখ ভালকের মত লোম, উটের মত কুব্জ, সে লোক সামান্য একটা নাম ভাঁড়িয়ে কত দিন লুকিয়ে থাকতে পারে? চেনালোকের চক্ষে পোড়লেই সব বুজরুকী ভেঙে যাবে। থাক তারা। ইংরেজী পুলিশের দক্ষতা যদি পরীক্ষামূখে খাঁটি দাঁড়ায়, পুলিশ যদি কর্তব্যজ্ঞানটা করে, তা হোলৈ ভণ্ডলোকেরা কদাচ নামের আবরণে অব্যাহতি লাভ কোতে পারবে না।”
আমার মুখপানে চেয়ে অমরকুমারী বল্লেন, ‘আমিও তাই মনে করি। তিনটে লোকেই জালমানুষ সেজেছে, তিনটে লোকেই নাম ভাঁড়িয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে বেড়াচ্ছে, মিয়াজানটার কথা ঠিক আমি বোলতে পাচ্ছি না, কেন না, সে চেহারার লোক পূৰ্বে আর কোথাও আমি দেখি নাই; কিন্তু যে লোকটার নাম গণেশ্বর, তারে আমি দেখেছি। বীরভূমে যে রাত্রে জটাধর তোমার প্রাণবিনাশের মন্ত্রণা কোরেছিল, সেই রাত্রে সেই চেহারার একটা লোক জটাধরের কাছে বোসে ছিল, তারে আমি দেখেছি।”
পূর্বকথা স্মরণ কোরে সবিস্ময়ে আমিও বোল্লেম, “আমিও তাই বুঝেছি। গণেশ্বরটাই ঘনশ্যাম। জটাধরের কাছে বোসে ছিল, তুমি গিয়ে আমারে খবর দিলে, মেয়েমানুষ সাজিয়ে দিলে, খিড়কী দিয়ে যখন আমি পালাই, আড়ে আড়ে সদরের দিকে চেয়ে দেখেছিলেম, জ্যোৎস্না ছিল কি না,—ঠিক তাই! জটাধর আর ঘনশ্যাম। মিয়াজানটাকে এখনো ঠিক জানা যাচ্ছে না; ধরা পোড়লেই ধরা যাবে।”
এই সব কথা আমাদের হচ্ছে, নদীতীরে বৃক্ষতলে কিছু পূৰ্বে যে লোকটাকে আমি দেখেছিলেম, সে লোকটার কথা আমি প্রায় ভুলেই গিয়েছি, অমরকুমারী তারে দেখেন নাই, মণিভূষণও দেখেন নাই, অমরকুমারী যদি দেখতেন, মিয়াজানের আকারের সঙ্গে সেই লোকের আকারের সাদৃশ্য আছে কি না, বোধ হয় ধোত্তে পাত্তেন। আমার বোধ হোচ্ছে, সেই লোকটাই মিয়াজান, তিনজনেই তারা এই অঞ্চলে আছে। মাণিকগঞ্জে আমি এসেছিলেম, ঢাকায় আমি গিয়েছিলেম, অমরকুমারীকে আমি উদ্ধার কোরেছি গোপনে গোপনে এ সব সন্ধান তারা রেখেছে, কোন দিকে আমরা যাই, সঙ্গে আমাদের কত লোক, সেই সন্ধান জানবার জন্যই সেই লোক সেইখানে দাঁড়িয়ে ছিল, এই আমার অনুমান।
অমরকুমারী ভয় পাবেন, এই ভেবে সে অনুমানের কথা অমরকুমারীকে আমি বোল্লেম না; মনের অনুমান আমার মনের ভিতরেই চাপা থাকলো। সন্ধ্যা তখন উত্তীর্ণ হয়ে গিয়েছে, আকাশে চাঁদ উঠেছে, নক্ষত্র উঠেছে, দিনমান অপেক্ষা একটু জোরে জোরে বাতাস উঠেছে, আকাশপানে আমি চেয়ে আছি। চন্দ্রমণ্ডল প্রায় ষোলকলা পূর্ণ রূপখানি কিন্তু সৰ্বক্ষণ আমার নয়নগোচর হোচ্ছে না, এক একদিক থেকে এক একখানি তরল মেঘ এসে চাঁদের ছবিখানি ঢাকা দিয়ে ফেলছে, মেঘেরা চোলে যাচ্ছে, চাঁদ আবার একটু একটু হাসি-মুখে প্রকাশ হোচ্ছেন। আবার মেঘ আসছে, আবার চাঁদ ঢাকছে, চোলতী মেঘের অবিরণে চন্দ্রমা অধিকক্ষণ লুক্কায়িত থাকছেন না। তরল শুভ মেঘ যখন চন্দ্রগাত্র আচ্ছাদন করে, চন্দ্রমণ্ডল তখন পাণ্ডুবর্ণ দেখায়। আমাদের তরণী চোলেছে; আমি দেখছি, পাণ্ডুচন্দ্র আমাদের সঙ্গে সঙ্গে চোলেছেন।
একটা জায়গায় এসে বজরাখানি থামলো; পশ্চাতের নৌকাখানিও সেই খানে নোগর করা হলো, রন্ধনাদির আয়োজন।
শশধর মেঘমুক্ত। পদ্মার বক্ষে কৌমুদীহার শোভমান; আকাশ নীল চন্দ্র-নক্ষত্র সেই নীলাকাশে মণি-মরকত; পদ্মা-সলিলের গর্ভেও মণি-মরকত-খচিত নীলাকাশের নির্মল ছায়া, তরণীর গবাক্ষপথে মুখ বাহির কোরে সেই শোভা আমি দর্শন কোত্তে লাগলেম; শশিবিভূষিণী রজনীতে প্রকৃতির শোভা যেমন সুন্দর দেখায়, ভাবুকের মন সে সৌন্দর্যে অপরিচিত নয়, ভাবুকের ভাবে চিরবঞ্চিত থাকলেও সেই নৈশ শোভা সন্দর্শনে আমার নয়ন-মন পুলকিত হোতে লাগলো। সেইখানে আমি দেখলেম, প্রবল পদ্মার আর একটি স্রোত চন্দ্রকিরণে রজতবর্ণ ধারণ কোরে সমানবেগে দক্ষিণদিকে চোলে যাচ্ছে। ভূগোলে লেখা আছে, সে রকম নদীর নাম শাখানদী। আমাদের সারেং অবশ্য ভূগোলবিদ্যায় অপণ্ডিত, বাংলা স্কুলের ছাত্রও নয়, তথাপি তারে আমি জিজ্ঞাসা কোল্লেম, “এ নদীটির নাম কি?”
সারেং একটি গল্প বোল্লে। যে ভাষায় তার বর্ণনা, আমাদের পাঠকমহাশয়েরা সে ভাষায় রসাস্বাদনে তৃপ্তিলাভ না কোত্তে পারেন, এই বিবেচনায় আমি আমার নিজের ভাষায় সারেঙের কথাগুলি এইখানে সুপ্রণালীক্রমে লিপিবন্ধ কোল্লেম।
এইখানে পদ্মাতীরে একটি লোকালয় ছিল; অনেকগুলি লোকের বাস। এক বৎসর বৈশাখমাসে কি একটা যোগ হয়, সেই যোগে গঙ্গাস্নানে মহা ফল। অগ্রে যারা সে সংবাদ পেয়েছিল, যে দেশে গঙ্গা আছেন, সেই দেশে তারা গঙ্গাস্নানে গিয়েছিল; পূৰ্বে যারা সংবাদ পায় নাই, পদ্মাকে গঙ্গার ভগ্নীবিশ্বাসে পদ্মাস্নানেই তারা যোগফল লাভ করবার আশা করে। গ্রামে একঘর ব্রাহ্মণ ছিলেন, তাঁর ধর্মপত্নী সেই যোগে পদ্মাস্নানে অভিলাষিণী হন। বাড়ীতে একজন দাসী ছিল, তার নাম গৌরী। প্রভাতের গৃহকার্যে গৌরীকে নিযুক্ত রেখে ব্রাহ্মণী শীঘ্র শীঘ্র পদ্মাস্নানে আসেন। বেলা চারি দণ্ডের মধ্যে যোগ ছিল, গৌরীও স্নানার্থিনী, গৃহকর্মে তার বেলা হোতে লাগলো, গৌরী বড় ব্যাকুলা, এক হস্তে গৃহমার্জনী-ঝাঁটা, অপর হস্তে গোময়ের হাঁড়ী, সেই অবস্থাতেই গৌরী পদ্মাস্নানে ছুটলো; পথে একটি ফলগাছে অনেকগুলি ফুল ফুটেছিল, একটা কচুপাতা ছিড়ে নিয়ে গৌরী গুটিকতক ফল তুলে নিলে। আবার ছুট! সকলেই জানেন, পদ্মায় মধ্যে মধ্যে মহা ভাঙ্গন হয়; গৌরী আসছে;—আসতে আসতে দেখলে, পথের মাঝখানে শক্ত ভূমিতে একটা চিড়;—প্রখর সূর্যাতপে মাটি যেন ফেটে গিয়েছে, সেই রকমের একটা চিড়;—সেই ফাটোলে অল্প অল্প জল। ওদিকে সূর্যদেব অনেক দূরে উঠে এসেছেন, বেলা চারি দণ্ড হবার দেরী নাই, ততক্ষণের মধ্যে পদ্মার স্রোত প্রাপ্ত হওয়া অসম্ভব, গৌরী এইরূপে বিবেচনা কোল্লে। যোগ ফুরায়, কি হয়, সাত পাঁচ ভেবে গৌরী সেই ফাটোলের ধারেই বোসে গেল; ঝাড়, হাঁড়ি সেইখানে রেখে, কচুপাতার ফুলগুলিতে অঞ্জলি পূর্ণ কোরে সেই ফাটোলের জলেই পুষ্পাঞ্জলি অর্পণ কোল্লে। অপর্ণমাত্রেই ফাটোলের বিস্তার; জলস্রোত দক্ষিণদিকে ছুটলো; গৌরী কেঁদে উঠলো; “নিলে না মা! আমার পুজো নিলে না মা! দাসী বোলে অবহেলা কোরে চোলে যাচ্চো? আমি তোমায় ছাড়বো না, দাঁড়াও, দাঁড়াও, তোমার সঙ্গে আমিও যাবো।” স্রোত ক্রমশই দক্ষিণদিকে প্রবাহিত; ঝাড়ু, হাঁড়ি তুলে নিয়ে গৌরীও সেই স্রোতের ধারে ধারে প্রধাবিতা; স্রোত ক্রমশই বিস্তৃত, ক্রমশই বেগবান যেখানে ফাটোল ধোরেছিল, তার আধ ক্রোশ পর্যন্ত জলশায়ী হয়ে গেল। ধারে ধারে গৌরী ছুটেছে; নূতন জলস্রোত যতই ছোটে, গৌরীও ততই ছোটে; জল দাঁড়ায় না; হুঁ হুঁ শব্দে দক্ষিণদিকে গতি দেখতে দেখতে সেই স্রোত মহা বেগবতী নদী। গৌরীর হাতে ঝাঁটা ছিল, স্রোতের জলে নিক্ষেপ কোল্লে, পদ্মা পদ্মা বোলে ডাকতে লাগলো, উভরায় চীৎকার; পদ্মা উত্তর দিলেন না, গতিও থামলো না, সমানবেগে ছুট; গৌরীরও সমানবেগে ছুট। পূৰ্বদেশের লোকেরা আমাদের হাঁড়িকে পাতিল বলে; খানিক দূর গিয়ে গৌরী তার হাতের সেই গোলা-হাঁড়িটা সেই জলে ফেলে দিলে; স্রোত ছুটেছে, গৌরীও ছুটেছে; গৌরী আর পারে না;—পাল্লেনা; কেবল মা মা, পদ্মা পদ্মা, বোলে উচ্চরবে ডাক দিতে লাগলো;—ডাকেও কিছু হলো না;—গৌরী শেষকালে মা মা বোলতে বোলতে সেই স্রোতের জলে ঝাঁপ দিলে;—গৌরীকে কোলে কোরে পদ্মাবতী সমুদ্রের দিকে ছুটলেন। গৌরীর নামে পদ্মার সেই শাখানদীর নাম গৌরী-নদী; তীরবর্তী গ্রামবাসীরা এই গৌরী-নদীর নাম দিয়েছে, গড়ুই নদী;—ইংরেজরা নাম দিয়েছেন গোরাই। গৌরী যেখানে ঝাঁটা ফেলে দিয়েছিল, সে স্থানের নাম ঝাঁটাদহ, যে স্থানে পাতিল (হাঁড়ি) ফেলে দিয়েছিল, সে স্থানের নাম পাতিলদহ, যে স্থানে মা মা বোলে ডাক দিয়েছিল, সে স্থানের নাম ডাকদহ। সেই ডাকদহের বর্তমান নাম কুষ্টিয়া। পদ্মানদীতে যাঁদের গতিবিধি আছে, তাঁরা সকলেই জানেন, কুষ্টিয়া, কুমারখালি, পাংসা প্রভৃতি স্থানের নীচে দিয়ে যে নিশ্চলসলিলা নবনদী প্রবাহিতা, সেই নদীর নাম গড়াই নদী;—গৌরী নামের অপভ্রংশে গড়ুই নামের উৎপত্তি।
পদ্মার এক শাখানদী গৌরী। সারেঙের মুখে গৌরী নদীর উৎপত্তিবিবরণ শ্রবণ কোরে আমরা চমৎকৃত হোলেম। ওদিকে আমাদের রন্ধনকার্য সমাপ্ত হলো, আমরা আহার কোল্লেম। রাত্রি প্রায় দেড় প্রহর অতীত। আমার ইচ্ছা ছিল, সেইখানেই সে রাত্রে নঙ্গর ফেলে প্রভাত পর্যন্ত অপেক্ষা করা, কিন্তু সারেঙ আমার সে অনুরোধ রক্ষা কোল্লে না। সারেঙ বেল্লে, “দিব্য চাঁদনী রাত্রি, ঠাণ্ডায় ঠাণ্ডায় বেশ যাওয়া যাবে; এই বোলেই তরণী খুলে দিলো। তখনো জোর হাওয়া, তখনো পদ্মায় তরঙ্গ, তখনো আকাশে অল্প অল্প মেঘ, তখনো এক একবার চন্দ্রচ্ছতি মেঘাবৃত। তরণী চোল্লো, কতদূর চোলে গেল, কেবল আমাদের তরণীই চোলেছে, যতদূর চেয়ে দেখি, অগ্রে পশ্চাতে আর একখানি তরণীও দেখতে পাই না। সারেং আমাদের তরণীখানি ধারে ধারেই নিয়ে যাচ্ছে অল্প দূরেই ডাঙ্গা।
সময় প্রায় নিশীথ। সেই সময় পশ্চাদ্দিকে আমি চেয়ে দেখি, দূরে একখানা নৌকা আসছে, যাত্রীনৌকা। অন্য নৌকা, নির্ণয় কোত্তে পাল্লেম না, খানিকক্ষণ সেই দিকে চেয়ে থাকলেম, ক্রমশই সেই নৌকা আমাদের নৌকার দিকে অগ্রসর। আমাদের নৌকা অপেক্ষা সে নৌকার গতি দ্রুত, দেখতে দেখতে নিকটর্তী তখন আমি দেখলেম, সে নৌকায় অনেক দাঁড়; ঝুপ ঝুপ শব্দে দাঁড় পোড়ছে, নৌকাখানা যেন তীরবেগে ছুটেছে। সে ধরনের নৌকা পূৰ্বে আর কখন আমি দেখি নাই; কিসের নৌকা, দেখবার জন্য কৌতূহল জন্মিল। সারেঙকে জিজ্ঞাসা কোল্লেম, সারেঙ উত্তর কোলে, “ছীপ নৌকা; শিকারী লোকেরা ঐ রকম নৌকায় বড় বড় নদীতে বেড়ায়।”
কেবল ঐ পর্যন্তই আমি জানতে পাল্লেম। বড় বড় নদীতে শিকারী নৌকা, বিচরণ করে। নদীতে কি রকম শিকার পায়, সেটা আমি হৃদয়ঙ্গম কোত্তে পাল্লেম না। ছীপনৌকা অল্পক্ষণের মধ্যেই আমাদের নৌকার নিকটবর্তী হলো, দেখলেম, সেই ছীপের একজন লোক ক্ষুদ্র একটা লণ্ঠন হাতে কোরে ইতস্ততঃ একবার সঞ্চালন কোল্লে, পরক্ষণেই গড়ুম গড়ুম শব্দে নৌকার ভিতর থেকে বন্দুকের আওয়াজ হলো, শব্দে আমার বুক কেঁপে উঠলো। জলের উপর বন্দুকের আওয়াজ হোলে শব্দ আরো বেশী হয়, অনেকক্ষণ পর্যন্ত প্রতিধ্বনি থাকে; জলে স্থলে, উভয় স্থানে প্রতিধ্বনি হয়। অজ্ঞাত কারণে আমার অন্তরে ভয়ের সঞ্চার হলো। না জানি, রাত্রিকালে কি বিপদ ঘটে, ওখানা যদি ডাকাতের নৌকা হয়, ডাকাতেরা যদি আমাদের নৌকায় প্রবেশ করে, কি উপায়ে অমরকুমারীকে রক্ষা কোরবো, সেই ভাবনাতেই আমার ভয়। ছীপ-নৌকা তীরবেগে ছুটে আসছে; আর বিশ হাত অগ্রসর হোলেই আমাদের নৌকার উপরে পোড়বে। তখন আমাদের কি উপায় হবে? আমাদের বিপদ ঘটবার কোন হেতু আছে, সারেঙ সেটা জানতো না, দাঁড়ীমাঝীরাও জানতো না, সুতরাং তারা ভয় পেলো না; পূৰ্বাপর ঘটনা স্মরণ কোরে আমার কিন্তু ভয় হলো। পুনৰ্বার সেই শিকারী নৌকায় বন্দুকের আওয়াজ। আমি নিরস্ত্র ছিলেম না, আমার সঙ্গে পিস্তল ছিল, ছীপের দিকে চেয়ে পিস্তল বাগিয়ে আমি সতর্ক থাকলেম।
ছীপখানা প্রায় ৮০ হাত দীর্ঘ। বহর কম। কত লোক সেই ছীপে ছিল, দেখা গেল না, কোন দেশের লোক, তাও জানা গেল না, ছীপের দুই মুখে দুগাছা দীর্ঘ দীর্ঘ লাঠি, লাঠির মাথায় নিশান উড্ডীয়মান, সম্মুখের নিশান রক্তবর্ণ, পশ্চাতের নিশান কৃষ্ণবর্ণ। ছীপ আমাদের নিকটবর্তী হোলে সারেঙকে আমি জিজ্ঞাসা কোল্লেম, “এই কি শিকারী নৌকা?” সারেঙ তখন একটু ইতস্ততঃ কোরে যেন একটু কুণ্ঠিতভাবে উত্তর কোল্লে, “ওদিকে আপনারা চাইবেন না, চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কথাও কবেন না, রাত্রিকালে এ রকম ছীপ-নৌকায় কত লোক কত রকম মতলবে ফেরে, বুঝে উঠা যায় না।”
সারেঙের কথায় আমার আশংকা হলো। নিশান দর্শন কোরে আমি মনে কোচ্ছিলেম, হয় তো পুলিশের নৌকা হবে; সারেঙ বোল্পে, মতলবের কথা। কারা কি মতলবে রাত্রিকালে জলে জলে বেড়ায়, সে অঞ্চলের লোকেরা সে তত্ত্ব জানতে পারে, আমাদের জানা অসম্ভব। ছীপের দিকে আমি চেয়ে থাকলেম। বায়ুবেগে অতিক্রম কোরে নক্ষত্ৰবেগে ছীপখানা ছুটে আসছে, দেখতে দেখতে আমাদের তরণীর কাছে এসে পোড়লো, গায়ে গায়ে ঠেকাঠেকি হয় হয় এইরূপ গতিক; একজৃষ্টে সেই দিকে আমি চেয়ে আছি; ঠেকাঠেকি হলো না। সাঁ সাঁ কোরে ছীপখানা আমাদের বজরা ছাড়িয়ে প্রায় দশ হাত দূরে বেরিয়ে গেল। যে প্রকার দ্রুতগতি, তাতে আমি মনে কোল্লেম, অল্পক্ষণের মধ্যেই আমাদের চক্ষের অন্তর হয়ে যাবে, ভয়ের কারণ থাকবে না।
হরিহরবাবুর প্রেরিত পাইকেরা আমাদের পশ্চাতের নৌকায় ছিল। ছীপখানা বেরিয়ে যাবার পর তারা পরস্পর চুপি চুপি কি বলাবলি কোরে আমাদের বজরায় এসে উঠলো। তাদের মুখের ভাব দেখে আমি বুঝলেম, তারা যেন কোন রকম অমঙ্গলের আশঙ্কা কোচ্ছিল। অমরকুমারীকে সাবধানে রাখবার জন্য দাসী-দুজনকে আর মণিভূষণকে আমি সতর্ক কোরে দিলেম। আমি যে দিকে লক্ষ্য রাখছিলেম, মণিভূষণ তা দেখতে পান নাই; অমরকুমারীও কিছু জানতে পারেন নাই। বজরার কামরা মধ্যে তাঁরা নিয়ে নিশ্চিন্ত। ছীপের দিকে আমি চেয়ে আছি, অল্প অল্প দেখা যাচ্ছে, নদীর স্রোত অপেক্ষাও অধিকবেগে ছীপখানা চোলেছে। পুনৰ্বার গড়ুম গড়ুম শব্দে সেই ছীপ নৌকায় বন্দুকের আওয়াজ।
মণিভূষণ ইতিপূৰ্বে সারেঙের কথা শুনেছিলেন; অমরকুমারীও শুনেছিলেন, সেই কথাই তাঁদের মনে ছিল; শিকারী নৌকা, শিকারীরা বন্দুকের আওয়াজ করে, তাই তাঁরা কোন রকম আতঙ্ক অনুভব কোল্লেন না। না করাই আমার ইচ্ছা। বন্দুকধ্বনি শ্রবণ কোরে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে আমি সেই অল্প-দৃষ্ট ছীপের দিকে চেয়ে থাকলেম, গতির ভাবে বুঝলেম, ফিরেছে, যে দিকে যাচ্ছিল, সে দিকে আর গেল না, আমাদের নৌকার দিকেই আসতে লাগলো। এবার কিন্তু গতি তত দ্রুত নয়, কিঞ্চিৎ শ্লথগতি, কিঞ্চিৎ ধীরে ধীরে গতি। যদিও ছীপখানা তখন অনেক দুরে, তথাপি শঙ্কাসূচক মৃদুস্বরে আমাদের লক্ষ্য কোরে সারেঙ বোল্লে, “সাবধান!” আমিও প্রতিধনি কোল্লেম, “সাবধান!” পাইকেরা পূর্বেই হয় তো জানতে পেরেছিল: গতিক বড় ভাল নয়; তাদের মধ্যে যে লোকটি সর্দার, সারেঙকে সম্বোধন কোরে যথাসম্ভব অনুচ্চস্বরে সেই লোকটি বোল্লে, “কিনারায় ধর, নোঙ্গর কর।”
সর্দারের কথায় সারেঙের নিভীর্কতায় যেন আঘাত পেলে। কিনারায় ধরা অথবা নঙ্গর করা তার মত হলো না; বজরা এতক্ষণ যে ভাবে চোলছিল, তদপেক্ষা কিছু মৃন্দবেগে চালনের নিমিত্ত চালকগণকে অনুমতি দিল। পাইকেরা ব্যতিব্যস্ত। তাদের চাঞ্চল্য দর্শনে আমিও ক্ষেত্ৰকর্ম-বিধানের অবসর প্রতীক্ষায় প্রস্তুত হয়ে থাকলেম। যে দিকে স্ত্রীলোকেরা, সেই দিকে মণিভূষণকে রেখে আমি সম্মুখভাগে দরজা বন্ধ কোরে বহির্দিকে দাঁড়ালেম।
আর সময় নাই। ছীপখানা একবার মৃদুগতি ধারণ কোরেছিল, পুনৰ্বার দ্রূতগতি। আমাদের বজরা চোলেছে, ছীপখানাও চোলেছে, অবিলম্বেই কাছাকাছি। আমরা আছি দশ হাত দূরে পশ্চাতে, ছীপ আছে দশ হাত দূরে অগ্রে এই সময় এক ঘূর্ণন। সচরাচর সোজা পথে যেতে যেতে পাড়ি দিবার সময় নৌকা যেমন আড়ে আড়ে খেয়া দিবার জন্য ঘুরে যায়, ছীপখানা সেই রকমে এক ঘূর্ণনে ঘুরে এসে আড়ে আড়ে দাঁড়ালো। বলা হয়েছে, ছীপখানা প্রায় ৮০ হাত লম্বা, নদীর এক কিনারা থেকে জলভাগের ৮০ হাত পর্যন্ত আটক পোড়ে গেল। বোধ হলো যেন, অর্ধপদ্মায় সেতুবন্ধ। আমাদের বজরা আর অগ্রসর হবার পথ পেলো না, ৮০ হাত ঘুরে আবার স্রোতোপথে উপস্থিত হবার অগ্রেই ছীপের লোকের আক্রমণে কোথায় আমরা তলিয়ে যাব, ঠাঁইকিনারা থাকবে না। বিপদ আসন্ন। ছীপের লোকেরা আমাদের উপরেই লক্ষ্য কোরে আসছে। সারেং বোলেছিল, শিকারী নৌকা; আমাদের দুর্ভাগ্যক্রমে একপ্রকার সেই কথাই ঠিক হয়। শিকারী নৌকাই বটে। আমরাই সেই শিকারীদের শিকার।
চিন্তার অবসর নাই, বাক্যের অবসর নাই; ছীপখানা সেই ভাবে সোরে সোরে এসে আমাদের বজরার মুখের কাছে লাগলো। গোলন্দাজী জাহাজের ছিদ্রপথে যেমন বিভীষণ তোপধ্বনি হয়, জলদগর্জনের ন্যায় সেই ছীপে ঘন ঘন সেই প্রকার বন্দুকধ্বনি! রণতরীর সঙ্গে রণতরীর যুদ্ধ; সমুদ্রপথে সে যুদ্ধ যাঁরা দর্শন কোরেছেন, তুলনাকে একটু ছোট কোরে ভেবে তাঁরা এখন মনে করুন, পদ্মাবক্ষে সেইরুপ জলযুদ্ধের উপক্ৰম! আমাদের তরণীখানি রণতরণী নয়, তাদৃশ যোদ্ধাপতিও উপস্থিত নাই, মহাসঙ্কট উপস্থিত। ত্রাহি মধুসদন!
ঝপ ঝপ কোরে ৮/১০ জন অস্ত্রধারী লোক ছীপের উপর থেকে আমাদের বজরার উপর লাফিয়ে পোড়লো। ডাকাতী করবার অগ্রে মফস্বলের ডাকাতেরা বিকট চীৎকারে যে প্রকার কুকী দেয়, সেই সকল লোক সেই প্রকারে বিকট চীৎকার আরম্ভ কোল্পে, সঙ্গে সঙ্গে বন্দুকধ্বনি, সঙ্গে সঙ্গে তলোয়ারবিঘূর্ণন। ছীপে কত লোক ছিল, অনুমান কোত্তে না পেরেও আমাদের পাইকেরা মালসাট মেরে দাঁড়ালো; আক্রমণকারীরা দশজন, পাইকেরা আটজন। রাত্রিকালে পদ্মাবক্ষে বিপদ হয়, পাইকেরা সেটা জানতো; তারা প্রস্তুত ছিল, কেবল লাঠিমাত্র ভরসা নয়, ছোট ছোট তলোয়ার, ভুজালি, ছোট ছোট বন্দুক তারা সঙ্গে এনেছিল; মহা বিপদের সম্ভাবনা বুঝে, আমাদের দাঁড়ী-মাঝীরাও তরণীচালন পরিত্যাগ কোরে পাইকের দলে যোগ দিলে; আমি তখন কি করি; পকেটে পিস্তল ছিল, পিস্তল বাগিয়ে যোদ্ধাদলের পশ্চাতে দাঁড়ালেম। ঘোরতর যুদ্ধ। ছীপখানা ক্ৰমশঃ ঘুরে ঘুরে আমাদের বজরাকে প্রদক্ষিণ কোত্তে লাগলো। দুর্গানাম স্মরণ কোরে, সাহসে ভর কোরে, দুই তিন বার আমি পিস্তলের আওয়াজ কোল্লেম। কোন দিকেই লক্ষ্য ছিল না, সুতরাং সে আওয়াজে কিছুই ফল হলো না। তরণীমধ্যে স্ত্রীলোক তিনটার অস্ফুট আর্তনাদ! মণিভূষণ তাঁদের সান্ত্বনা কোত্তে লাগলেন; “ভয় নাই, ভয় নাই” বোলে আমিও বাহির থেকে সাধ্যমত অভয় দিতে লাগলেম; কে কার কথা শুনে, কে কারে অভয় দেয়, কে কারে সান্ত্বনা করে, মহা কলরবে প্রকৃতি প্রতিধ্বনিত! তলোয়ারে তলোয়রে যুদ্ধ, বন্দুকে বন্দকে যুদ্ধ! দুই পক্ষে পাঁচ সাত জন অস্ত্রাঘাতে ক্ষত-বিক্ষত! পদ্মার জল অনেক দূর পর্যন্ত রক্তিম! এই অবসরে ছীপারোহী আরো জনকতক লোক আমাদের বজরায় এসে উঠলো বহুলোকের পদভরে বজরাখানি যেন ডুবুডুবু হয়ে দোল খেতে লাগলো। আমার পিস্তলের গুলীবারুদ নিঃশেষিত! একজনের হস্তের একখানা তলোয়ার ছিনিয়ে নিয়ে আমি বৈরীদলের সম্মুখীন হোলেম; খেলাঘরের ছেলেরা যেমন ছোট ছোট ছুরী দিয়ে কলাগাছ কাটে বলবান দস্যুর সম্মুখে আমার অস্ত্রধারণও সেইরুপ কলাগাছ-কাটার প্রয়াসের ন্যায় ব্যর্থ হয়ে গেল; তবু, আমি ইতস্ততঃ তলোয়ার ঘুরিয়ে দুই একজন বিপক্ষের ঊরুতে বাহুতে রক্তপাত কোরে দিলেম। পাইকেরা সুশিক্ষিত মল্ল; তলোয়ার-খেলাতেও বিলক্ষণ নিপুণ, তারা আমার অঙ্গরক্ষক, তারা আমারে পশ্চাদিকে সোরিয়ে সোরিয়ে আপনারাই রণক্ষেত্রে বীরত্ব প্রকাশ কোত্তে লাগলো; তাদের আবরণে আমার গাত্রে কোন রকম আঘাত লাগলো না, কিন্তু রণরক্তে আমার অঙ্গ ভিজে গেল।
যথভঙ্গ! পাইকপক্ষেও বন্দুক ছিল; কিন্তু তলোয়ারের যুদ্ধেই তারা বৈরী-দলকে বিপর্যস্ত কোরে তুল্লে। গোলন্দাজেরা যখন বন্দুক লক্ষ্য করে, তখন তারা নীচু হয়ে গুড়ি মেরে বসে, মাথার উপর দিয়ে গুলী চোলে যায়। বন্দুকধারীরা যখন নীচদিকে গুলী করে, তখন তারা লম্ফ দিয়ে কুলালচক্রের ন্যায় ঘুরে ঘুরে ঠিক যেন শূন্যপথে ক্রীড়া করে; পায়ের নীচে দিয়ে গুলী চোলে যায়। চমৎকার শিক্ষা। আমাদের দাঁড়ী-মাঝীরাও সে বিপদে অল্প সাহস প্রকাশ কোল্লে না। আমারে আক্রমণ করা, তরণী মধ্যে প্রবেশ কোরে অমরকুমারীকে হরণ করা দস্যুদলের আসল মতলব; অর্থলোভেই এই নৈশযুদ্ধে তারা প্রবৃত্ত হয় নাই; সেটি আমি বেশ বুঝলেম। প্রতিপক্ষকে ঠেলে ঠেলে তারা কেবল আমার দিকেই রুকে রুকে আসে, তরণীর খড়খড়ী ভেঙে ভিতরে প্রবেশ কোত্তে চায়; আমার পক্ষের লোকেরা বিশেষ বীরত্ব দেখিয়ে পদে পদেই তাদের গতি অবরোধ করে; বিপক্ষেরা কিছুতেই অভিসন্ধি সিদ্ধ কোত্তে সমর্থ হয় না। আমাদের পাইকেরা একপ্রকার ব্যূহ-রচনা জানে; অল্পলোক হলেও দিব্য একটি অর্ধচন্দ্রাকার ব্যূহ-রচনা কোরেছিল; বোম্বেটেরা বহু চেষ্টা কোরেও সে ব্যূহভেদ কোত্তে পাল্লে না।
আমি স্থির কোল্লেম, বোম্বেটে। জলপথে যারা ডাকাতী করে, জলপথে যারা মানুষ মারে, তারাই সব বোম্বেটে। আমার লোকেরা আমারে ঢেকে ঢেকে রাখছে। আকাশের তরল মেঘমালা তখন অন্তর হয়ে গিয়েছে, সুধাকর তখন মেঘমুক্ত হয়ে সমুজ্জ্বল সুধাকর পরিবর্ষণ কোচ্ছেন, রক্ষক লোকগুলির বাহু পার্শ্ব দিয়ে বোম্বটে লোকের চেহারাগুলো আমি উঁকি মেরে মেরে দেখছি; ভয়ঙ্কর চেহারা! কতক লোকের ফিরিঙ্গী সজ্জা, মুখে ফিরিঙ্গী দাড়ী, গলায় ফিরিঙ্গী বগলোস, মাথায় ফিরিঙ্গী টোপ; কতক লোকের মাথায় বড় বড় পাগড়ী, গালে গাল-পাট্টা, গায়ে বুকবন্দ চাপকান, চাপকানের উপর লাল কাপড়ের কোমরবন্ধ; কতক লোকের মাথা নেড়া, মুখে কালী, কালীর উপর চুনের গোঁফ, চুণের ভ্রূ, গা আদুড়, হিন্দুস্থানী ধরনের মালকোঁচার উপর সবুজ কাপড়ের কোমরবন্ধ, কতক লোক কাফ্রিদের মতন কৃষ্ণবর্ণ, মাথায় সেই রকম কোকড়া কোঁকড়া চুল, নীলবর্ণ ইজেরপরা; বুঝা গেল ছদ্মবেশ; যেহেতু, ঠোঁটে আর নাকে কাফ্রি লক্ষণের অভাব।
নদীতীরে বৃক্ষতলে যে লোকটাকে আমি দেখেছিলেম, সেই দীর্ঘকার লোকটা সেই দলের মধ্যে ছিল, তুলাভরা চাপকানে আর প্রকাণ্ড পাগড়ীতে আমি তারে সনাক্ত কোত্তে পাল্লেম, কে যে কি, কারা যে তারা, কেন যে আমাদের উপর তাদের আক্রোশ, তা আমি অনুভব কোত্তে পাল্লেম না। একবার মনে কোরেছিলেম, চণ্ডেশ্বরের চক্র; অমরকুমারীকে আমি উদ্ধার কোরেছি, গোপনে গোপনে জানতে পেরে, সেই রাগে চণ্ডেশ্বর এই বোম্বেটোর দল ভাড়া কোরে এনেছে, কিন্তু ফিরিঙ্গী, কাফ্রী, পেশোয়ারী, এ সব লোক কোথাকার? সব লোক চণ্ডেশ্বরের আয়ত্তাধীন হবে, এমন তো আমি বিশ্বাস কোত্তে পাল্লেম না। তুলাভরা চাপকানধারী বৃহৎ পাগড়ীওয়ালা বৃহদাকার লোকটাই এই দস্যুদলের দলপতি, সে লোকটা কে? আকারে বুঝেছিলেম পঞ্জাবী, কিন্তু নিকটে মুখের চেহারা দেখে, পূৰ্বদেশবাসী বাঙালী বোলেই বোধ হলো; চাপকান-পাগড়ীতে বিদেশী সেজে এই বোম্বেটে-দলের মুরব্বী হয়েছে। এই লোকটাই হয় তো এখানে চণ্ডেশ্বরের পৃষ্ঠপোষক, শেষকালে এই সিদ্ধান্তই মনে এলো।
আমার তখন সিদ্ধান্ত করবার সময় নয়; তরণীর উপর উভয় দলে মল্লযুদ্ধ বেধে গিয়েছে। অস্ত্রশস্ত্র ত্যাগ কোরে উভয় দলের হাতা-হাতি, মুষ্টামুষ্টি, লাথা-লাথি, হুড়া-হুড়ি, জড়াজড়ি, মাথা-ঠোকাঠুকি আরম্ভ হয়েছে। জনকতক লোক রক্তবমি কোত্তে কোত্তে গড়াগড়ি খাচ্ছে। দুই একটা লোকের চক্ষু ফেটে রক্ত গড়াচ্ছে। একটা লোক দাঁতকপাটি লেগে মজ্জিত হয়ে পোড়েছে। তখনো যুদ্ধের বিরাম হোচ্ছে না, ছীপের উপর থেকে তখনো মাঝে মাঝে বন্দুকের আওয়াজ হোচ্ছে, সে সব কেবল ফাঁকা আওয়াজ, এইরুপ আমি স্থির কোল্লেম, কেন না, এক জায়গায় ঘরদল পরদল উভয়দল জমা, বন্দুকের গুলীতে কোন দলের কোন লোকের প্রাণ যাবে, বন্দুকওয়ালারা তা জানে না; শুধু কেবল আমাদের ভয় দেখাবার জন্যই ফাঁকা আওয়াজ কোচ্ছিল, বন্দুকে গোলাগুলী ছিল না। থাকুক আর নাই থাকুক, অমরকুমারীর ক্রন্দনে আমার প্রাণ ছটফট কোচ্ছিল। বন্দুকের ধ্বনিতে আমার কিছুই ভয় ছিল না।
ছীপের ভিতর ভীষণ চীৎকারধনি। ভীষণগর্জনে চার পাঁচজনে একসঙ্গেই চীৎকার কোরে বোলে উঠলো, “ডুবিয়ে দে! ডুবিয়ে দে!”
এতক্ষণ বরং একটু ভরসা ছিল, ঐরূপ গর্জনধ্বনি শ্রবণ কোরে আমার প্রাণ উড়ে গেল! ক্ষণেকের মধ্যে আশা-ভরসা ফুরালো! বোম্বেটেরা দলে পুরু, অবহেলেই আমাদের বজরাখানি ডুবিয়ে দিতে পারে। এইবারেই প্রাণ গেল! অনেক বিপদেই অনেকবার পোড়েছি, ভগবান রক্ষা কোরেছেন, এবার এই পদ্মাবক্ষে বোম্বেটের হাতেই প্রাণ গেল! পদ্মার কাছে আমরা কোন অপরাধ করি নাই, পদ্মার জলে প্রাণ যায়! পদ্মাগর্ভে আজ আমাদের জীবতেই সমাধি হয়! মা পদ্মা! এই কি তোমার মনে ছিল? বিদেশী নিরপরাধী বালক আমি, বিদেশিনী নিরপরাধিনী বালিকা অমরকুমারী; মা পদ্ম! তুমি কি এই রাত্রে বিষম বদন-ব্যাদান কোরে আমাদের দুটিকে গ্রাস কোরে ফেলবে? এতগুলি প্রাণী তোমার গর্ভে জীবন বিসর্জন দিবে, নরনারী-ভক্ষণে তোমার অভ্যাস আছে, জীবনগ্রহণে তুমি মায়া-দয়া রাখ না, কিন্তু মা! তুমি আমাদের মা গঙ্গার সহোদরা; গঙ্গা আমাদের পতিতপাবনী দয়াময়ী, তুমিও দয়াময়ী, তুমি আমাদের প্রতি দয়া কর!”
মনে মনে এই মন্ত্রে আমি পদ্মাবতীর স্তব কোল্লেম; পদ্মার প্রবল স্রোত আমার স্তবে কর্ণপাত না কোরে সাগরসঙ্গমে সমভাবে ছুটে চোল্লো; ছীপের লোকেরা আবার পূর্বরূপ উৎকট-স্বরে সঙ্গীলোকগুলোকে হুকুম দিতে লাগলো, “ডুবিয়ে দে! ডুবিয়ে দে! ডুবিয়ে দে!”
ভয় দেখাবার হকুম নয়। সত্যই তারা মোরিয়া হয়েছে; সত্যই বজরাখানি ডুবিয়ে দিবে। আর আমাদের অব্যাহতি নাই! যারা সন্তরণ জানে, তারা পরিত্রাণ পেতে পারে। আমি সন্তরণ জানি, পদ্মাস্রোতে সন্তরণে প্রাণরক্ষা যদি সম্ভব হয়, আমি পরিত্রাণ পেলেও পেতে পারি, কিন্তু স্বর্ণপ্রতিমা অমরকুমারীকে পদ্মার জলে বিসর্জন দিয়ে সংসারে আমি বেঁচে থাকবো, তাও কি কখনো হয়? আর দুটি স্ত্রীলোক অমরকুমারীর সহচরী হয়ে এসেছে, তাদের কি অপরাধ? বোলতে গেলে আমিই তাদের রক্ষক, দৈববিপাকে নয়, আমারই কারণে দস্যুপরাক্রমে তরণী ডুবছে, সেই দুটি স্ত্রীলোক জলে ডুবে প্রাণ হারাবে, আমি স্ত্রীহত্যার পাতকী হব, এ প্রাণে আমার কাজ কি? ত্রাহি মধুসদন! ত্রাহি মা দুর্গা! ত্রাহি সৰ্বমঙ্গলে! দীনের প্রতি সদয় হয়ে এই বিপদে রক্ষা কর?”
ঘোর বিপদে কাতর হয়ে আবার আমি বিপদ-বারণ মধুসূদনের স্তব কোল্লেম, বিপদ-বারিণী ব্ৰহ্মময়ীকে ডাকলেন; আবার আমার কর্ণে সেই ভীমগর্জন প্রবেশ কোল্লে,—“ডুবিয়ে দে। ডুবিয়ে দে! ডুবিয়ে দে!”
বার বার তিনবার! আর বিলম্ব নাই। মণিভূষণের উদ্দেশে উচ্চকণ্ঠে আমি বোলে উঠলেম, “ভাই মণিভূষণ! ভাই! অমরকুমারী থাকলেন, অমরকুমারীকে রক্ষা কোরো! বহরমপুরের মোকদ্দমা আমি দেখতে পেলেম না; দীনবন্ধু বাবুকে আমার এই শেষবার্তা জানিও; প্রাণ যায়! আমার জন্য এতগুলি লোকের প্রাণ যায়! ভাই! আমি যদি আগে মরি, তোমরা নিরাপদে থাকবে; মঙ্গলময় মহেশ্বর তোমাদের নিরাপদে রাখবেন। আমি কাহারো শত্রু নই, আমার শত্রু এতো! আমার জন্য বোম্বেটেরা পদ্মার অগাধজলে এ তরণী ডুবাবে! না ভাই! তা আমি দেখবো না! পৃথিবীতে আমি থাকবো না! অমরকুমারীকে তুমি দেখো! অমরকুমারীকে তুমি রক্ষা কোরো! জন্মের মত আমি বিদায় হোলেম!”
কথাগুলি আমি বোল্লম, কিন্তু চক্ষে আমার এক বিন্দুও জল এলো না। লম্ফ দিয়ে বজরার ছাদের উপর আমি উঠলেম। যে দিকে বেশী জল, সেই দিকে ঝাঁপ দিয়ে পোড়বো, পদ্মার সঙ্গে মহাসাগরে ভেসে যাব, দুই হস্ত উর্ধ্বে তুলে, সেই সঙ্কল্প সিদ্ধ করবার উদযোগ কোচ্ছি, আমার লোকেরা আমারে নিবারণ করবার নিমিত্ত কাতরে টানাটানি কোচ্ছে, এমন সময় এক দৈব অনুগ্রহ।
যে দিক থেকে আমরা আসছি, সেই দিকে অকস্মাৎ ঘন ঘন গোটাকতক বন্দুকের ধ্বনি শুনতে পাওয়া গেল। সকলের কর্ণ সেই দিকে স্থির, সকলের চক্ষু সেই দিকে চকিত। আমি তখন একপ্রকার মোরিয়া, জলে ঝাঁপ দিতে উদ্যত, আমার আর তখন ভাল-মন্দ ভাবনা করবার আবশ্যক ছিল না, তথাপি আমি সেই দিকে একবার চাইলেম। চক্ষু তখন সে কার্যে আমার কোন উপকারে এলো না, কিছুই দেখা গেল না; পদ্মার জলরাশি চন্দ্রালোকে যেমন জলময় প্রান্তরের ন্যায় ধূ ধূ কোচ্ছিল, চক্ষু আমার সেই রূপ অবলোকন কোল্লে। বন্দুকধ্বনি আমার কর্ণে এসেছিল, শরতের জলদ-গর্জনের ন্যায় গড় গড় নাদে পুনৰ্বার সেই প্রকার আগ্নেয়াস্ত্রের গম্ভীরধনি; জলে স্থলে প্রতি ধ্বনি। শব্দ কেবল কর্ণে প্রবেশ কোচ্ছে, কোথা থেকে শব্দ আসছে, তা কিছু, দেখা যাচ্ছে না। চেয়ে আছি, খানিক পরে দেখলেম, সাধারণ খেয়া-নৌকার ন্যায় একখানি তরণী বায়ুভরে ছুটে আসছে, সেই তরণী থেকেই বন্দুকের আওয়াজ আসছে। দেখতে দেখতে সেই নৌকা নিকটবর্তী, আর একখানা বৃহৎ ছীপ। দুর থেকে ক্ষুদ্র নৌকা মনে হয়েছিল, তা নয়, বৃহৎ ছীপ। যে ছীপের উপর বোম্বটেরা আমাদের প্রাণের উপর আক্রমণ কোচ্ছিল, সেই ছীপের পূৰ্বগতি অপেক্ষা আগন্তুক ছীপের গতিবেগ আরো অধিক দ্রুত; সে ছীপেরও দুইদিকে দুই নিশান; সে দুই নিশান ঘোর রক্তবর্ণে রঞ্জিত।
আমি মনে কোল্লেম, আর একদল ডাকাত! একদলের হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়াই দুর্ঘট হয়েছিল, তার উপর আর এক দল; গ্রহদেবতারা নিতান্তই বাম! পদ্মাগর্ভে শয়ন করাই আমাদের নিয়তি! ঝাঁপ দিয়ে পড়ি, আমার লোকেরা আমার হাত ধরে টানাটানি কোচ্ছে, ছাড়াবার জন্য আমি ধস্তাধস্তি কোচ্ছি, ইতিমধ্যেই নূতন ছীপখানা বিদ্যুতবেগে পশ্চিমদিকে খানিকদর ভেসে গেল। কেন গেল, তাও আমি বুঝতে পাল্লেম; পূর্বাগত বোম্বেটে নৌকা আড়ভাবে পদ্মাপ্রসারের অনেকদূর পর্যন্ত জুড়ে ছিল, আধখানা পদ্মায় যেন নৌ-সেতু হয়েছিল, সে স্থান দিয়ে অন্য নৌকার চলাচলের পথ ছিল না, কাজেই নূতন ছীপখানা তফাৎ দিয়ে ঘুরে গেল। গেল কি এলো, একটু পরেই চিনতে পাল্লেম।
ঘন ঘন বন্দুকের আওয়াজ। আওয়াজে আওয়াজে দুই ছীপে শব্দযুদ্ধ। তখন আমার মনে হলো, নূতন নৌকাখানা ডাকাতের নৌকা নয়; বিপন্ন লোকের কোন রক্ষাকর্তা ঐ নৌকার অধিকারী। আমাদের বজরার মাঝীমাল্লারা আকাশে হাত তুলে আনন্দধ্বনি কোরে উঠলো। বোম্বেটে ছীপ আর এই নূতন ছীপ পাশা-পাশি; ছীপে ছীপে তুমুল যুদ্ধ। প্রথমতঃ বন্দুকে বন্দুকে যুদ্ধ।
আমি কিঞ্চিৎ প্রকৃতিস্থ হোলেম। সারেং এসে আমার কানে কানে বেল্লে, সিপাহী-ছীপ;—সেনাদলের সিপাহী আর রণবেশধারী পুলিশ-প্রহরী একত্র সমবেত। ভগবান আমাদের রক্ষার জন্য এই অভয়া তরণী প্রেরণ কোরেছেন।”
একবার পদ্মার দিকে আর একবার সেই দুই রণতরীর দিকে আমি নয়ন ফিরালেম। যুদ্ধাস্ত্রের গর্জনশব্দে পদ্মা যেন নৃত্য আরম্ভ কোরেছিল; পদ্মার সেই ভয়ঙ্করী মূর্তি দেখতে দেখতে বজরার ছাদের উপর থেকে আমি নামলেন। হতাশে জলে ঝাঁপ দিবার শেষ সঙ্কল্পটা তখন একরকম ভুলেই গেলেম। যুদ্ধদর্শনের কৌতূহলে মন যখন একপ্রকার উন্মত্ত হয়ে উঠলো। ভয় নাই, ভয় নাই, আশ্বাসবাক্যে ভীরুলোকগুলিকে নিজেই আমি অভয় দিতে লাগলেম।
ছীপে ছীপে যুদ্ধ। এক ছীপে বোম্বেটেদল, এক ছীপে সিপাহীদল। প্রায় ২৫ জন সিপাহী আপনাদের ছীপ থেকে সুশোণিত অসি হস্তে বেম্বেটে ছীপে লাফিয়ে এলো; একটু পরে আরো ২৫ জন। উভয় দলে তলোয়ারযুদ্ধ। কাটা-কাটি, রক্তারক্তি, লোমহর্ষণ কাণ্ড! আমরা তখন নিশ্চেষ্ট। রক্ষাকর্তা পরমেশ্বর, কিন্তু পরমেশ্বর স্বয়ং বাহুবিস্তার কোরে কোন বিপদক্ষেত্রেই বিপদগ্রস্ত প্রাণী-পুঞ্জকে রক্ষা কোত্তে আসেন না, এক একটা উপলক্ষ্য হয়; এখানে আমাদের রক্ষার উপলক্ষ্য ঐ নবাগত সিপাহী-ছীপ। পর পর যুদ্ধে কত লোক নিহত, কত লোক আহত, গণনা করা গেল না, কিন্তু অল্পক্ষণ পরেই আমি দেখতে পেলেম, বোম্বেটেরা সকলেই পুলিশ-প্রদত্ত অলঙ্কার পরিধান কোরে, ঘন ঘন বেত্রাঘাতে ছীপের উপর যেন নৃত্য কোত্তে লাগলো। দুঃসাহসিক দুরন্ত লোকেরা নির্ঘাত প্রহারেও, নিদারুণ যন্ত্রণাতেও ক্রন্দন করে না, তপ্তলৌহে অঙ্গদাহ কল্লেও শীঘ্র তাদের চক্ষে জল আসে না; যে সকল লোক পুলিশের হাতে বাঁধা পড়লো, রোদন দূরে থাক, চক্ষে জল আসা দূরে থাক, তাদের কাহারো মুখে একটি ক্ষুদ্রবাক্যমাত্রও উচ্চারিত হলো না।
যুদ্ধের অবসান। প্রকৃতি একপ্রকার স্থির। পদ্মা একপ্রকার শান্ত। আমরা একপ্রকার নির্ভয়। এই সময় সিপাহী-ছীপের একটি ভদ্রলোক আমাদের বজরায় এলেন। দর্শনমাত্রেই আমি চিনলেম, অমরকুমারী-উদ্ধারের যিনি আমাদের প্রধান উত্তরসাধক হয়েছিলেন, তিনিই সেই উদারাশয় ডেপুটিবাবু। সাদরে আমার মস্তকে হস্তাপর্ণ কোরে মধুরবচনে তিনি বোল্লেন, “হরিদাস! তোমরা তো সকলে অক্ষত শরীরে আছ? দুরাত্মারা কেহই তো বালিকা অমরকুমারীর অঙ্গস্পর্শ কোত্তে পারে নাই?”
বাবুকে অভিবাদন কোরে আমি উত্তর কোল্লেম, “আজ্ঞে না, বোম্বেটেরা কেহই আমাদের অঙ্গে আঘাত কোত্তে পারে নাই; আমার সঙ্গের পাইকেরা, আর বজরার মাঝী-মাল্লারা বিশেষ বীরত্ব প্রদর্শন কোরেছে। বজরার মধ্যে অমরকুমারী কুশলে আছেন। আপনি আমাদের এ বিপদের সংবাদ কি প্রকারে প্রাপ্ত হেলেন?”
ঈষৎ হাস্য কোরে ডেপুটিবাবু বোল্লেন, “সে সব কথা পরে বোলছি। এখন দেখ দেখি, তোমার সঙ্গী লোকেদের মধ্যে অক্ষতশরীরে ক-জন জীবিত আছে?” ডেপুটিবাবু ঐ কথা বল্লেন, সেই জন্যই আমার সেই কথাটা তখন মনে হলো। অত লোকের সঙ্গে অল্পলোকে অতক্ষণ যুঝেছে, আমাদের বাঁচিয়েছে, এই তো তাদের মহাপরাক্রমের পরিচয়; তার উপর আরো বেশী;— সাতটি লোক আমাদের জন্য প্রাণবিসর্জন কোরেছে;—দাঁড়ী-মাঝী এগারজন, সারেং একজন, পাইক আটজন, এই কুড়িজনের মধ্যে তেরজন জীবিত। পাইকেরা সুশিক্ষিত খেলোয়াড়, তথাপি তাদের মধ্যেও দুটি লোক বোম্বেটের গুলিতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে মারা গিয়েছে। আমাদের প্রাণের জন্য অপর লোকে প্রাণ দিলে, বড়ই পরিতাপের কথা! ডেপুটিবাবুও তজ্জন্য আক্ষেপ প্রকাশ কোল্লেন। উপায় নাই, এইমাত্র প্রবোধ।
আমার পক্ষে এই কথা; অপরপক্ষে ডেপুটিবাবুকে আমি জিজ্ঞাসা কোল্লেম, বোম্বেটে-দলে কতগুলা লোককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে?” বাবু উত্তর কোল্লেন, “পূর্ণসংখ্যা জানা যায় নাই। আমাদের উপস্থিতির অগ্রে কজন ঘাল হয়েছে, সিপাহী-যুদ্ধে কজন কাটা পোড়েছে, ঠিক জানা গেল না। কতক মৃতদেহ নদীর জলে ডুবেছে, কতক দেহ ভেসে গিয়েছে, যুদ্ধের সময় জনকতক ঝাঁপিয়ে ঝাঁপিয়ে জলে পোড়ে সাঁতার দিয়ে পালিয়েছে। এগারোটা মৃতদেহ ছীপের উপর পোড়ে আছে, একুশটা জখম, তাদের বন্ধন করা হয় নাই, অবশিষ্ট ৩৫ জনকে হাতকড়ী-বাঁধা গিয়েছে। আমি একটি নিশ্বাস ফেলে বোল্লম, “তবেই তো বড় গোলমাল। যে সকল দেহ ডুবে গিয়েছে, ভেসে গিয়েছে, যে সকল লোক সাঁতার দিয়ে পালিয়ে গিয়েছে, তাদের মধ্যে মুখচেনা লোক যদি আমি দুটো-একটা ধোত্তে পাত্তেম, তা হোলে অনেকটা সংশয়ভঞ্জন হতো, সে উপায় থাকলো না। পূৰ্বে আমি আপনাকে বোলেছি, অকারণে আমার শত্রু অনেক। বিশেষতঃ অমরকুমারীকে যারা মাণিকগঞ্জে এনেছিল, তারা দূরদেশে যায় নাই। আমাদের মারবার জন্য কিম্বা ফাঁদ পেতে ধরবার জন্য বোম্বেটে দলের নিয়োগ-কর্তা তারাই; সে বিষয়ে আর সন্দেহ থাকছে না। প্রকাশ্যে তারা তিনজন;—সেই তিনজনের মধ্যে বোম্বেটে-দলে কেহ উপস্থিত ছিল কি না, নির্ণয় করা কঠিন হবে। তবু আচ্ছা, বন্দীদলে, জখমীদলে, ছীপে পতিত মৃতদলে, তাদের মধ্যে কাহাকেও চেনা যায় কি না, চেনালোক তাদের ভিতর আছে কি না, একবার আমি দেখবো।”
ডেপুটিবাবু আমারে বোম্বেটে-নৌকায় নিয়ে গেলেন। মরা ১১ জন সকলের স্কন্ধে মুণ্ড ছিল, একে একে আমি দেখলেম, চেনা গেল না; জখমী ২১ জন—তাদেরে সকলের মুখ দেখলেম, চেনা গেল না;—বন্দী ৩৫ জন;—হাতে হাতকড়ী, পায়ে বেড়ী, গলায় শিকল;—গুড়ের নাগরীর মত সারি সারি বোসে আছে; বিকট-শিকট-মুখে মিটমিট কোরে চেয়ে চেয়ে দেখছে, একখানা মুখও চেনা গেল না। চিনলেম কেবল একটা লোককে। পাঞ্জাবীধরনের পাগড়ী মাথায় দিয়ে যে দীর্ঘাকার লোকটা নদীর ধারে বৃক্ষতলে দাঁড়িয়ে ছিল, গায়ে তুলাভরা চাপকান, বন্দীদলে সেই লোক বিদ্যমান। তারে চিনেই বা আমার কি ফল? সে লোককে পূৰ্বে আমি দেখি নাই, দেখা দিয়ে পূৰ্বে যে আমার কোনপ্রকার শত্রুতাচরণ করে নাই, তারে চিনে মোকদ্দমাপ্রমাণের কোন সূত্ৰই আমি পাব না, সে লোকটা হয় তো বোম্বেটেদলের গুপ্ত গোয়েন্দা—গুপ্তচর! বিচারের সময় বোম্বেটেদের সঙ্গেই তার দণ্ড হবে, আমাদের মূল মোকদ্দমার সঙ্গে সে লোকের কোন সংস্রব নাই।
তবে হাঁ, একটা কথা, সেই সময় আমার মনে পোড়ল। অমরকুমারী বোলেছিলেন, তিনটে লোকের মধ্যে একটা লোকের নাম মিয়াজান। এই লোকটা যদি সেই মিয়াজান হয়, জিজ্ঞাসা কোল্লে এ যদি সত্যকথা বলে, তা হোলে বোধ হয়, চণ্ডেশ্বর নামধারী রক্তদন্তের সন্ধানটা পাওয়া গেলেও যেতে পারে। ডেপুটিবাবুর অনুমতি গ্রহণ কোরে সেই লোকের নাম আমি জিজ্ঞাসা কোল্লেম। লোক তো প্রথমে কথাই কোইলে না, শেষকালে সিপাহীলোকের ধমকে, পায়ের জুতার ঠোক্করে, বন্দুকের কু’দোর গুতোতে হাউ হাউ কোরে বোল্লে, “মাদু।”
এক কথায় সব ফর্শা। মুখের চেহারা দেখেও জানতে পারা গেল, নামটা সত্য হোক না হোক, লোকটা বাস্তবিক হিন্দু। মুসলমানের মুখে আর হিন্দুর মুখে অনেক প্রভেদ দৃষ্ট হয়। একটু চিন্তা কোরে দ্বিতীয়বার ডেপুটিবাবুর অনুমতি নিয়ে পুনরায় সেই লোককে আমি জিজ্ঞাসা কোল্লেম, “আচ্ছা মাধু, তুমি কি কখনো কোন জায়গায় কোন লোকের সঙ্গে উপস্থিত হয়ে মিয়াজান নামে পরিচয় দিয়াছিলে?”
লোক তখন দুই চক্ষু রক্তবর্ণ কোরে, সক্রোধে বারকতক অধরোষ্ঠ দংশন কোরে সগর্জনে বোল্লৈ, “হুঁ—উ—উ—উ—উম!”—জনান্তিকে ডেপুটিবাবু তখন আমারে বোল্লেন, ‘বজ্জাৎ বদমাসলোকের মুখে সত্যকথা বাহির করা এক প্রকার অসাধ্য! এখানে ও প্রকার প্রশ্ন করা নিষ্ফল। বিচারের সময় কোন সূত্রে যদি কিছু প্রকাশ হয়, অবশ্যই তুমি সে সব কথা জানতে পারবে।”
আর আমরা ছীপ-নৌকায় থাকলেম না, বজরায় উঠে এলেম। এগারটা মৃতদেহ পদ্মার জলে নিক্ষেপ করবার হকুম হলো। আমাদের পক্ষে যে সাতজন মারা গিয়েছিল, তাদের দেহ পাওয়া গেল না; পদ্মার স্রোতে অন্বেষণ করাও বিফল, সুতরাং পদ্মাগর্ভেই তাদের চিরবিশ্রাম।
আমরা বজরায় এলেম। যুদ্ধের সময় কামরায় প্রবেশের দ্বার আমি বন্ধ কোরে রেখেছিলেম, উন্মুক্ত কোরে কামরার মধ্যে প্রবেশ কোল্লেম; আমি আর ডেপুটিবাবু। কপাল পর্যন্ত ঘোমটা ঢেকে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে অমরকুমারী একধারে বোসে থাকলেন, অঞ্চলসঞ্চালনে দাসীরা তাঁরে বাতাস কোত্তে লাগলো, মণিভূষণও আমাদের দিকে সোরে এলেন। অমরকুমারীর দিকে চেয়ে প্রসন্নবদনে ডেপুটিবাবু বোল্লেন, “ভয় নাই মা! শত্রুনিপাত হয়েছে! তোমরা নিরাপদ হয়েছ!”—হুলস্থূলের সময় অমরকুমারী একবার মূর্চ্ছা গিয়েছিলেন, অনেক কষ্টে মূর্চ্ছাভঙ্গ করা হয়েছে, মণিভূষণের মুখে এই কথা শুনে, আমি একবার অমরকুমারীর সম্মুখে গেলেম, শত্রুনিপাত হয়েছে, তোমরা নিরাপদ হয়েছ, এই বোলে ডেপুটিবাবুর বাক্যের প্রতিধ্বনি কোল্লেম। অমরকুমারী একবার উজ্জ্বলনয়নে আমার দিকে চেয়ে বক্রনয়নে ডেপুটিবাবুর দিকে কটাক্ষ কোরে নীরবে নতমুখী হোলেন। আমি অতঃপর ডেপুটিবাবুর নিকটে এসে, আমার সেই প্রশ্ন পুনরুত্থাপন কোল্লেম, “পদ্মার উপর বোম্বেটের হাতে আমরা বিপদে পোড়েছি, এ সংবাদ আপনি কি প্রকারে প্রাপ্ত হোলেন?”
পকেটে কি একখানি কাগজ ছিল সেইখানি বাহির কোরে একবার দেখে, আবার সেখানি পকেটে রেখে, শান্তস্বরে ডেপুটিবাবু বোল্লেন, “তোমরা বিপদে পোড়েছ, সংবাদ পেয়ে তরণীসজ্জা কোরে এত শীঘ্র ঢাকা থেকে আমরা এখানে উপস্থিত হয়েছি, এমন অসম্ভব কথা তুমি মনে কোত্তে পার না। মাণিকগঞ্জের ওভারসীয়ার হরিহরবাবু তোমার আপনার লোক;—হাঁ, অবশ্যই আপনার লোক, উপকারী বন্ধু;—বজরা ছেড়ে তোমরা রওনা হবামাত্র, তিনি একজন বিশ্বাসী ভদ্রলোককে শীঘ্র শীঘ্র ঢাকায় প্রেরণ করেন। ষোলদাঁড়ী পানসীতে সেই লোকটি অবিলম্বে আমার কাছে উপস্থিত হয়, একখানি পত্র আমাকে দেয়। আমার সঙ্গে হরিহরবাবুর আলাপ আছে, পত্রপাঠমাত্র পত্রের কথাগুলি আমি ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের গোচর করি; তুমি শত্ৰুবেষ্টিত, পদ্মায় বোম্বেটের ভয়, এই সব অবস্থা জানিয়ে তোমার রক্ষাবিধানের জন্য ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবকে আমি বিশেষরূপ অনুরোধ করি; যেরূপ সজ্জায় আমি এসেছি, সেইরূপ সজ্জা প্রয়োজন, আমিই সেই প্রস্তাব করি। বর্তমান ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবটি অতিশয় সদাশয়; অবিলম্বে তিনি আমার প্রার্থনা পূর্ণ করেন। আমি বোধ করি, তোমরা এদিকে অধিক দূর আসতে না আসতেই আমরা অধিক দাঁড়ী-নিযুক্ত কোরে ঢাকায় গঞ্জঘাট থেকে ছীপখানা খুলে দিই, শীঘ্র রওনা হয়েছিলেম বোলেই এখানে আমরা উপস্থিত হোতে পেরেছি।”
উদ্দেশেই হরিহরবাবুকে প্রণাম কোরে, ঢাকার প্রধান ম্যাজিস্ট্রেটকে ধন্যবাদ দিয়ে, সমীপোবিষ্ট ডেপুটিবাবুকে আমি অভিবাদন কোল্লেম। উপরে বোলেছি, দৈব অনুগ্রহ; বিপদে বিপদভঞ্জন মধুসদনকে আমি ডেকেছি, বিপদনাশিনী মা দুর্গাকে আমি ডেকেছি, ডাকবার অগ্রেই তাঁরা হরিহরবাবুকে, ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবকে আর এই ডেপুটিবাবুটিকে সদয়ভাবে ভবিষ্যজ্ঞান বিতরণ কোরেছিলেন, তাতেই আমাদের রক্ষা হলো, সে বিষয়ে আর কিছুমাত্র সন্দেহ থাকলো না; এই জন্যই আমি বোলেছি, দেব অনুগ্রহ। বিপত্তিকাণ্ডারী হরি শ্রীমধুসদন! বিপত্তিনাশিনী দুর্গা ভবনিস্তারিণী। এই দুটি বাক্য সার্থক। মধুসূদনে যাঁদের বিশ্বাস নাই, দুর্গা-নামে যাঁদের ভক্তি নাই, তাঁরা আমারে যদি উপহাস করেন সে উপহাস আমি পরমাদরে মাথা পেতে গ্রহণ কোরবো।
আমরা পরিত্রাণ পেলেম। বিপদের রজনী দীর্ঘ হয়; দীর্ঘ রজনীর অবসান। ডেপুটিবাবুর সঙ্গে যখন আমি কথা কোচ্ছি, তখন ঊষাকাল; ব্রাহ্মমুহূর্ত সমাগত; অল্পে অল্প সূর্যমণ্ডলের আরক্ত ছবি পূৰ্বগগনে সমূদিত। তিথি ছিল কৃষ্ণপ্রতিপদ, প্রতিপদের চন্দ্র পশ্চিমগগনে অস্ত যাচ্ছেন, নূতন প্রভাকর পূৰ্বগগনে উদয় হোচ্ছেন। সুপ্রশস্ত নদীবক্ষে তরণীর উপর থেকে প্রকৃতির সেই শোভা কি চমৎকার দেখায়, যাঁরা দেখেছেন, তাঁরাই সেটি অনুভব কোত্তে পারবেন। সমুদ্রযাত্রী লোকের মুখে আমি শুনেছি, মধ্যসমুদ্র থেকে সেই দৃশ্য আরো সুন্দর দেখায়, আরো চমৎকার! নয়ন মন উভয়ই বিমুগ্ধ হয়।
ধূসরবসনা ঊষা তুষারসিক্ত হয়ে লজ্জাবনতবদনে প্রস্থান কোল্লেন, দিনমণি সপ্রকাশ। আমি তখন ডেপুটিবাবুকে বোল্লেম, “এখন আমরা তবে বিদায় হোতে পারি? দিনের বেলা নদীতে আর বোম্বেটের ভয় থাকবে না, দিনের বেলা নূতন বোম্বেটেরা আর আমাদের ধোত্তে আসবে না, আপনার অনুগ্রহে পরম উপকৃত হোলেম; মহা বিপদে জীবনরক্ষা হলো। আপনার মহত্ত্বের নিকটে আমি চিরকৃতজ্ঞ থাকলেম। এখন অনুমতি হয়, বজরা খুলে দিই।”
মৃদু হাস্য কোরে ডেপুটিবাবু বোল্লেন, “তাই বুঝি তুমি মনে কোরেছ? এত বড় কাণ্ডটা কেবল জলের উপরেই শেষ হয়ে গেল, এই বুঝি তোমার বিশ্বাস? তা নয় হরিহরিদাস, তা নয়। অল্পবয়সে সাহসে তুমি ধন্য, কিন্তু সংসারের বিষয়জ্ঞানে এখনো তুমি অপরিপক্ক। ব্যাপার ছোট নয়। ছীপনৌকায় আমোদ কোরে পদ্মানদীতে আমরা মাছ ধোত্তে এসেছিলেম, শীকার ধোরে আমোদ কোরে ফিরে চোল্লেম, তাও নয়। বিচার আছে। তোমারেও আর একবার ঢাকায় যেতে হবে। এই ভীষণ ব্যাপারের মূল উপলক্ষ্য তুমি। তোমার তরণী আক্রমণের উদ্দেশেই বোম্বেটেদল জমায়েত, তোমার লোকের সঙ্গেই বোম্বেটেদের প্রথম যুদ্ধ। উভয় পক্ষেই খুন-জখম; এ অবস্থায় বিচারস্থলে তোমার সাক্ষ্যই অগ্রগণ্য। তোমারে আর একবার ঢাকায় যেতে হবে। বোম্বেটে নৌকা নদী বেয়ে যাচ্ছিল, আমরা ছুটে এসে তাদের সঙ্গে যুদ্ধ কোরেছি; কত নৌকা অমন যায়, কোন একটা অকু ঘটনা না হলে পুলিশ তাদের ধরে না, বিনা প্রমাণে নৌকার লোককে বোম্বেটে বোলে ধরাও যায় না, প্রমাণ আবশ্যক; প্রমাণের জন্যই অগ্রে তোমারে দরকার হবে। তুমি আমাদের সঙ্গে ঢাকায় চল।”
আর আমার কোন ওজর-আপত্তি খাটলো না। আবার আমারে ঢাকায় ফিরে যেতে হলো। আমাদের বজরায় ডেপুটিবাবু থাকলেন। ডেপুটিবাবুর ছীপে সিপাহী শান্ত থাকলো, বোম্বেটেদের ছীপে পুলিশ-পাহারায় জখমী লোকেরা আর বন্দীলোকেরা থাকলো। আমরা ঢাকায় চোল্লেম। বজরার গতি মৃদু ছীপের গতি দ্রুত। একসঙ্গে কি প্রকারে যাওয়া যায়, সেই তত্ত্ব একবার আমার মনে উঠেছিল, কিন্তু ডেপুটিবাবুর বন্দোবস্তে তিন তরণীর গতি সমান কোরে দেওয়া হলো। সৰ্বপ্ৰথমে গ্রেপ্তারী আসামী নৌকা, মধ্যস্থলে আমার বজরা, পশ্চাতে সিপাহী। তিন তরণীর সমান গতি।