» » » চতুর্থ কল্প : চণ্ডেশ্বর

বর্ণাকার

ভূবনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়

হরিদাসের গুপ্তকথা
দ্বিতীয় খণ্ড

চতুর্থ কল্প : চণ্ডেশ্বর

আমি চোলেছি;—কি সন্ধান কোরে এলেম, লক্ষ্য বস্তু পেলেম কি না, ভাবতে ভাবতে চোলেছি। অমরকুমারীর নাম এখনো ব্রজকিশোরী। আমার মুখে অবগুণ্ঠন না থাকলে ব্রজকিশোরী আমারে চিনতেন; অবগুণ্ঠন রেখে আমি এক প্রকার ভালই কোরেছিলেম; আমার চেনাই দরকার ছিল, আমারে সেখানে চেনা অমরকুমারীর পক্ষে এখন ততটা দরকার ছিল না। যদি আমি প্রকাশ হোতেম, খোলা মুখে যদি অমরকুমারীর সঙ্গে আমার কথাবার্তা চোলতো, তা হোলে রাতারাতি অমরকুমারীকে আমি উদ্ধার কোরে আনতে পাত্তেম। অবগুণ্ঠনে মুখ ঢাকবার অগ্রে সেইটি একবার আমি ভেবেছিলেম; সে ভাবের উদয় হবামাত্রই পরিণামবিবেচনার নূতন উপদেশ আমি প্রাপ্ত হই; সেই উপদেশেই সতর্কতা আসে, সেই সতর্কতায় অবগুণ্ঠনে মুখাবরণ।

“আমি হরিদাস, গুপ্তসন্ধানে তোমার তত্ত্ব অবগত হয়ে আমি তোমাকে উদ্ধার কোত্তে এসেছি,” খোলা-মুখে দেখা দিয়ে, নির্জনে অমরকুমারীকে এই কথা যদি আমি বোলতেম, অমরকুমারী অবশ্যই রাত্রিকালে গুপ্তভাবে আমার সঙ্গে সে বাড়ী থেকে বেরিয়ে আসতেন, বাড়ীর কেহই কিছু জানতে পাত্তো। সে উপায় আমি অবলম্বন কোল্লেম না কেন, তার একটি কারণ ছিল।

চোরেরা অমরকুমারীকে চুরি কোরেছে, দূরদেশে এনে একজন ভদ্রলোকের বাড়ীতে লুকিয়ে রেখেছে, কাহাকেও কিছু না জানিয়ে গোপনে আমি যদি অমরকুমারীকে বাহির কোরে আনতেম, চোরের উপর বাটপাড়ী করা হতো, সেটা নিশ্চয়, কিন্তু প্রকারান্তরে আমিই চোর হোতেম। চোরের মত কাজ আমি কোরবো না, বীরের মত পরাক্রম দেখাবো, এই আমার প্রতিজ্ঞা; গুপ্ত ভাবে চোরা জিনিস চুরি কোরে আনলে সে প্রতিরক্ষা হতো না, সেই কারণেই অমরকুমারীর কাছে আত্মপ্রকাশ করি নাই।

বাসায় এসে আমি পৌঁছিলেম। সূর্য তখন স্বর্ণবর্ণ পরিত্যাগ কোরে রজতবর্ণ ধারণ কোরেছেন, বেলা অনুমান আটটা। রাত্রে আমি কোথায় ছিলেম, হরিহরবাবুর এই প্রশ্নে আমি উত্তর দিলেম, “কার্যগতিকে স্থানান্তরে আটক থাকতে হয়েছিল, ফলাফল একটু পরেই আপনি জানতে পারবেন।”

হরিহরবার প্রশ্নে যখন আমি ঐ উত্তর দিই, মণিভূষণ তখন সেইখানে উপস্থিত ছিলেন; আমার মুখের ভাব দেখে মণিভূষণ কিরুপ অনুমান কোল্লেন, তখন আমি ঠিক বুঝতে পাল্লেম না, মণিভূষণ কিন্তু অধিকক্ষণ ধৈর্যধারণ কোত্তে না পেরে ইঙ্গিতে আমারে নিকটে ডাকলেন, আমি তাঁর কাছে সোরে গেলেম; যে ঘরে মণিভূষণের রাত্রিযাপন হয়, আমার হাত ধরে সেই ঘরের মধ্যে নিয়ে গিয়ে সাগ্রহস্বরে জিজ্ঞাসা কোল্লেন, “কোথায় তুমি আটক পোড়েছিলে? কারা তোমাকে আটক কোরেছিল? একরাত্রি আটক রেখে অমনি অমনি ছেড়ে দিলে, তবে বোধ হয়, তারা তোমার শত্রুপক্ষের কেহ নয়?”

মৃদুহাস্য কোরে আমি বোল্লেম, “সকাল সকাল প্রস্তুত হও, কালবিলম্ব না কোরে ঢাকা যেতে হবে; শত্রু-মিত্রের পরিচয় সেইখানেই পাবে।”

আমার হাতের উপর মণিভূষণের হাত, আমার চক্ষের দিকে মণিভূষণের চক্ষ, নির্নিমেষচক্ষে আমার চক্ষু নিরীক্ষণ কোরে, মণিভূষণ মুহূর্তকাল নীরব হয়ে থাকলেন; কি তিনি বুঝলেন, কি তিনি বোলবেন, তৎক্ষণাৎ সেটি আমি অনুমান কোত্তে অক্ষম হোলেম না। একটু পরেই মণিভূষণ আমারে জিজ্ঞাসা কোল্লেন, “সন্ধান কিছু পেয়েছ কি?”

আমি উত্তর কোল্লেম, “হাতের বস্তু যতক্ষণ হাতে না আসে, সন্ধান হয়েছে বোলে ততক্ষণ শ্লাঘা প্রকাশ করা উচিত হয় না। তুমি ঢাকায় চল, সন্ধানের ফলাফল—আশার ফলাফল—আমাদের পরিশ্রমের ফলাফল ঢাকা সহরেই পূণতা প্রাপ্ত হবে;—ফলের পূর্ণতা প্রাপ্ত হবে;—ফলের পূর্ণতার নাম পরিপক্কতা;—তুমি ঢাকায় চল; বাঙ্গলায় একটা কথা আছে, “বেরাল কাঁধে কোরে শীকার করা”—আমারে কাঁধে কোরে শীকার করবার অনুমতিলাভের জন্য তুমি ঢাকায় চল। উভয়েই আমরা উভয়ের কথা বুঝলেম, সময়মত স্নানাহার সমাপন করা হলো, হরিহরবাবু কর্মস্থলে যাবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন, সেই সময় আমি সম্মুখে গিয়ে জানালেম, “অমরকুমারীর সন্ধান হয়েছে; দুদিন একটু একটু উড়াভাষা সন্ধান, গত রজনীতে নিঃসংশয়। হরণকর্তারা আপাততঃ অদৃশ্য, কিন্তু অমরকুমারীকে আমরা যখন হস্তগত কোত্তে পারবো, করালমূর্তি ধারণ কোরে তারা তখন রঙ্গস্থলে দর্শন দিবে, ঘোরসংগ্রাম উপস্থিত করবার উপক্রম কোরবে, ভবিষ্যৎ জানতে পেরেও আমি ভয় পাচ্ছি না; আমারে আক্রমণ করবার জন্য যারা করালমুর্তি ধারণ কোরে আসবে, উত্তম অবসরে সেই ক্ষেত্রে আমিই তাদের করালতর করালমূর্তির করাল হস্তে সমর্পণ কোরে দিব; তাদের দেখে আমি ভয় পাব না, তারাই বরং আমারে দেখে প্রাণের ভয়ে কম্পিত হবে; শীঘ্রই আপনি আমার এই সকল বাক্যের সার্থকতা অনুভব কোরবেন, অধিক বাক্যব্যয় এখন নিষ্প্রয়োজন। আমরা ঢাকায় যাব; আমি আর মণিভূষণ। আপনি অনুগ্রহ কোরে দুটি লোক আমাদের সঙ্গে দিন, অচেনা জায়গায় আমরা যেন ফাঁপরে না পড়ি। এখন আপনি কেবল এইটকু জেনে রাখুন, এই মাণিকগঞ্জের উত্তরপ্রান্তে একটি ভদ্রলোকের বাড়ীতে অমরকুমারী আছে।”

হরিহরবাবুর বদন প্রফুল্ল, ধীরে ধীরে আমার পৃষ্ঠদেশে করাপর্ণ কোরে প্রফুল্লবদনে তিনি বোল্লেন, “বাহাদুর তুমি! এত অল্পবয়সে এতদূর কার্যপটুতা তুমি অভ্যাস কোরেছ, আশ্চর্যের কথা বটে! ঈশ্বর তোমার মনস্কামনা পর্ণ করুন। দেখো, ঢাকায় যাচ্ছ, সাবধান;— সাবধানে সাবধানে সকল কাজ কোরো। ঠোকো না!”

নতমস্তকে আমি নমস্কার কোল্লেম। আমাদের ঢাকা-যাত্রার বন্দোবস্ত কোরে দিয়ে, শেষকালে হরিহরবাবু, বোল্লেন, “ঢাকা-কোর্টের অনেকগুলি উকিলের সঙ্গে আমার আলাপ আছে, তাঁদের মধ্যে একজনের নাম শিবশঙ্কর মল্লিক; তিনি বিদ্বান, বহুদর্শী, বিশেষরূপ আইনজ্ঞ; আমার নাম কোরে তাঁরে তুমি বোলো, মোকদ্দমার বিবরণ ভাল কোরে বুঝিয়ে দিও, শীঘ্র শীঘ্র সুচারুরূপে কার্য নিৰ্বাহ হবে।”

শিবশঙ্কর মল্লিকের নামটি আমি মুখস্থ কোরে রাখলেম। ইংরাজী আদালতের কাজ, পাঁচরকমে খরচপত্র অধিক হয়, শতাধিক মুদ্রা আমি সঙ্গে রাখলেম, হরিহরবাবুর একজন সরকার আর একজন চাপরাসী আমাদের সঙ্গে থাকলো; কি জানি, কখন কি রকম বাতাস ফেরে, ছদ্মবেশ সঙ্গে রাখতেও বিস্মত হোলেম না; চাপকানের পকেটে থাকলো দুটি গুলীভরা পিস্তল। হাসি পায়। অস্ত্রশিক্ষা হয়ে অবধি পিস্তল আমি সঙ্গে রাখি; নখিন্দরের পিতা চাঁদ সদাগর সৰ্বক্ষণ যেমন হেঁতালের লাঠিকে আপন সঙ্গের সাথী কোরে রাখতেন, কোন প্রকার সঙ্কটস্থলে যাত্রা করবার সময় আমিও সেই রকমে জোড়া জোড়া পিস্তল সঙ্গে রাখি; কেবল রাখি, এই মাত্র, ব্যবহারে আসে না; তথাপি রাখি; আপদস্থলে নিরাপদের জন্য সাবধান থাকা ভাল। হরিহরবাবু কর্মস্থলে গেলেন, তাঁর চাপরাসী আমাদের জন্য একখানি নৌকা ঠিক কোরে দিলে, আবশ্যকমত জিনিসপত্র সঙ্গে লয়ে আমরা নৌকাআরোহণ কোল্লেম; আমি, মণিভূষণ, সরকার আর চাপরাসী। শীঘ্র গমনের বন্দোবস্ত। নৌকায় আটজন দাঁড়ী, একজন মাঝি।

বুড়ীগঙ্গার উপরে ঢাকা সহর। পূর্বে আমি আর কখনো ঢাকায় যাই নাই, ঢাকা আমি নূতন দেখলেম। বুড়ীগঙ্গার পূৰ্বতীরে সহর, পশ্চিমতীরে প্রসিদ্ধ মিয়া সাহেবের সুন্দর অট্টালিকা, গঙ্গাবক্ষ থেকে সেই অট্টালিকার সুদৃশ্য সুপ্রশস্ত সোপানাবলী দৃষ্ট হয়। উত্তম শোভা। নগরের শোভা দর্শন করা আমার তখনকার কার্য ছিল না, নগরে উপস্থিত হয়েই অগ্রে আমরা আদালতে উপস্থিত হোলেম। বেলা প্রায় তৃতীয় প্রহর। ম্যাজিস্ট্রেটের এজলাস ভঙ্গ হবার পূর্বেই দরখাস্ত করা চাই, শিবশঙ্কর মল্লিকের অন্বেষণ কোল্লেম; ফৌজদারী কোটে তখন তিনি ছিলেন না, দেওয়ানী কোটেই সাক্ষাৎ কোল্লেম, মাণিকগঞ্জের হরিহরবাবুর নাম কোরে আমার বক্তব্যগুলি সংক্ষেপে তারে বোল্লেম; হরিহরবাবু বলেন নাই, আপন ইচ্ছায় আমি শিববাবুকে ষোলটি টাকা ফী দিলেম, তিনি উদযোগী হয়ে তৎক্ষণাৎ দরখাস্তের মুসাবিদা কোরে দিলেন, এক টাকা তহরী নিয়ে তাঁর মুহুরি শীঘ্র শীঘ্র সেই দরখাস্তখানি পরিষ্কার কোরে নকল কোল্লেন, মণিভূষণ সেই দরখাস্তে আপন নাম দস্তখৎ কোরে দিলেন, উকীলের দ্বারা দরখাস্ত দাখিল হলো। বহরমপুরের আদালতের কথাও সেই দরখাস্তে লেখা ছিল, দরখাস্তের সঙ্গে বহরমপুরের ম্যাজিস্ট্রেটের প্রেরিত রূবকারিখানি পেস হলে, উকীলের সঙ্গে ইতিমধ্যে সেরেস্তাদার পেস্কারের গুপ্তবন্দোবস্ত হয়েছিল, তাঁদের সহায়তায় সেইদিনেই হাকিমের হুকুমমত পুলিশের নামে পরোয়ানা বাহির হয়ে গেল। এজলাস ভঙ্গ হয় হয়, এমন সময় শিবশঙ্করবাবুকে আমি চুপি চুপি বোল্লম, “কেবল পুলিশের দ্বারা সে কার্য সুসিদ্ধ হওয়া সন্দেহস্থল, মেয়েটিকে উদ্ধার করবার সময় একজন ক্ষমতাপ্রাপ্ত ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট সেইখানে উপস্থিত থাকলে ভাল হয়।” মুখে মুখে সেই কথাটি হাকিমকে জানিয়ে শিবশঙ্করবাবু সেরেস্তাদারের মুখের দিকে চাইলেন, হাকিমও সেই প্রার্থনা মঞ্জুর কোল্লেন, মণিভূষণের মূল দরখাস্তের পৃষ্ঠে সেইরকম হুকুম লেখা হলো, হাকিম সাহেব আসনত্যাগ কোরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই সেই হুকুমের নীচে স্বাক্ষর কোরে দিলেন। আমার উদ্বেগ দূর হয়ে গেল।

সন্ধ্যা হলো। রাত্রিকালে কোথায় থাকি? নৌকায় বাস করা সুবিধাজনক বোধ হলো না; বিশেষতঃ লোকের মুখে শুনলেম, বুড়ীগঙ্গার উত্তরাংশে ডাকাতের ভয় আছে, রাত্রিকালে তারা সময়ে সময়ে নৌকা মারে, নৌকায় বাস করা সুবিধাজনক বোধ হলো না, শিবশঙ্করবাবুর বাসাতেই রাত্রিবাস করা গেল।

পুলিশের দারোগা যাবেন, জমাদার যাবেন, বরকন্দাজ যাবে, সকলের উপর একজন ডেপুটিবাবু। একজন উকীল সঙ্গে থাকলে ভাল হয়, আমার মনে এই ভাবের উদয় হলো; শিবশঙ্করবাবুকে সেই কথা আমি বোল্লম; যুক্তিসিদ্ধ বিবেচনা কোরে সহানুভূতিপ্রাপ্ত নিম্নশ্রেণীর একজন উকীলকে তিনি আমাদের সঙ্গে দিলেন, আমরা মাণিকগঞ্জে যাত্রা কোল্লেম।

যত সময়ে যাওয়া যায়, নৌকাতে দাঁড়ীর সংখ্যা অধিক থাকাতে তদপেক্ষা অল্পসময়ে আমরা মাণিকগঞ্জে পৌঁছিলেম। অসময়ে হরিহরবাবু তখন বাসায় ছিলেন না, তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হলো না, কোর্টের ফলাফলের কথা বলাও হলো না, সুতরাং লক্ষ্যস্থলেই অগ্রে আমরা উপস্থিত হোলেম। যে বাগানে আমি ধনঞ্জয় ঘটকের সঙ্গে পরামর্শ কোরেছিলেম, সেই বাগানের আটচালাঘরে আমরা সকলেই খানিকক্ষণ বিশ্রাম কোল্লেম। বিশ্রামকালে ডেপুটিবাবু আমারে জিজ্ঞাসা কোল্লেন, “যে মেয়েটি এখানে আছে, যেটিকে উদ্ধার কোত্তে হবে, সেটি যে সেই মেয়ে, এমন সনাক্ত করবার লোক কেহ এখানে আছে?”

আমি উত্তর কোল্লেম, “সনাক্ত করবার লোক এই দরখাস্তকারী মণিভূষণ দত্ত, আর একজন সনাক্ত করবার লোক আমি স্বয়ং, আমরা এই দুজন ভিন্ন এখানকার আর কেহ সে বালিকাকে চিনবে না। যে বাড়ীতে আছে, সে বাড়ীর লোকেরা কেবল চেহারা চিনতে পারবে, আসল পরিচয় দিতে পারবে না। আপনি হাকিম, আপনার কাছে যদি কিছু বেয়াদবী হয়, অনুগ্রহ কোরে মাপ কোরবেন, সনাক্তের বদলে আমি একটি নূতন কথা বলতে চাই। সেই বাড়ীতে আপনি চলুন; আপনার কাছে সেই বালিকাকে যখন আনা হবে, আমি আর মণিভূষণ সেই সময় আপনার কাছে গিয়ে দাঁড়াব, আমরা বেশ জানি, বালিকার নাম অমরকুমারী; এখানে যারা এনেছে, তারা নাম দিয়েছে ব্রজকিশোরী। নামের কথা এখন থাকুক, আপনার কাছে আমরা দুজনে দাঁড়াব; অমরকুমারীই হোক অথবা ব্রজকিশোরীই হোক, সেই বালিকা যদি আমাদের দুজনকে চিনতে পারে, তা হোলে আপনার হৃদ-প্রত্যয় জমিবে কি না?”

বিকশিতনেত্রে আমার মুখপানে চেয়ে ডেপুটিবাবু একটু হাস্য কোল্লেন। দারোগামহাশয় মুখ ভারী কোরে আমার দিকে চেয়ে থাকলেন। মণিভূষণকে কোন কথা আমি শিখিয়ে না দিই, সেইরূপ ভাব জানিয়ে দারোগা আমারে তাঁর নিজের কাছে ডাকলেন, তাঁর কাছে আমি গেলেম, মণিভূষণ ডেপুটিবাবুর নিকটেই দাঁড়িয়ে থাকলেন। দারোগা আমায় জিজ্ঞাসা কোল্লেন, “সে মেয়েটি চুরি গিয়েছে কতদিন? তোমার সঙ্গে তার কি সম্পর্ক? মণিভূষণের সঙ্গে কি সম্পর্ক? সে মেয়ে এই গ্রামে আছে, কেমন কোরে তুমি জানতে পেরেছ? কত দিন হলো, এই গ্রামে তুমি এসেছো? মেয়েটির বয়স কত? তোমার সঙ্গে জানা-শুনা কত দিন?”

এই প্রকারের অসংখ্য প্রশ্ন। সকল প্রশ্নই নিরর্থক। ভাবি আমি কিছু, বুঝতে পাল্লেম না। পুলিশের লোকেরা এক এক সময়ে ফরিয়াদীকে, আসামীকে, সাক্ষীগণকে এই রকম অনর্থক প্রশ্ন জিজ্ঞাসা কোরে অন্যমনস্ক করবার চেষ্টা করেন, আসলকথায় কাহারো কাহারো ভুল হয়ে যায়, কেহ কেহ হতবুদ্ধি হয়ে পড়ে, গল্প প্রসঙ্গে অনেক ভাল ভাল লোকের মুখে এই রকম আমি শুনেছি। দারোগার প্রশ্নাবলীর উত্তরে ডেপুটিবাবুর অলক্ষিতে অগোচরে চুপি চুপি আমি বোল্লেম, “রসনাকে বিরাম দিতে আপনি কি ইচ্ছা করেন না? ও সকল প্রশ্নের উত্তর আবশ্যক হোলে হুকুমের অগ্রে ম্যাজিস্ট্রেট অবশ্যই আমারে জিজ্ঞাসা কোত্তেন, আমারে না করুন, দরখাস্তকারী এই মণিভূষণ, এই মণিভূষণকেও তিনি এই সব কথা জিজ্ঞাসা কোত্তেন। আবশ্যক ছিল না, আবশ্যক নাই, এই কারণেই আদালতে ও সকল কথা উত্থাপিত হয় নাই। কেন আপনি মাথা বকান? কেন আপনি মুখে ব্যথা করান? আপনার পুজার উপকরণ আমার কাছেই আছে, ষোড়শোপচারে না পারি, পঞ্চোপচারে পূজা দিব।”

দারোগা তখন হাস্য কোল্লেন। বন্দোবস্ত সব ঠিক। প্রাতঃকালে এসে মাণিকগঞ্জে আমরা পৌঁছিলেম, সেই উদ্যানেই আহারাদি করা হলো, বিশ্রামের পর আমরা সকলে একত্র হয়ে বাবু রমণীবল্লভের বাড়ীর নিকটে গিয়ে উপস্থিত হোলেম। পুলিশের লোকের পুলিশের সাজপরা, পুলিশ দেখলেই ভদ্রলোকের ভয় হয়; বিশেষতঃ গ্রাম্যলোকেরা অধিক ভয় পায়। নিকটে নিকটে যাদের বাড়ী, তারা সব ভয়ের কথা বলাবলি কোত্তে কোত্তে আপনাদের বাড়ীর দরজা বন্ধ কোরে দিলে; রাস্তা দিয়ে যারা চোলে যাচ্ছিল তারাও মুখ ফিরিয়ে ফিরিয়ে ভয়ে ভয়ে চেয়ে দেখে হন হন কোরে অন্যদিকে চোলে যেত লাগলো; “কোথায় কার বাড়ীতে চুরি হয়েছে, কোথায় ডাকাতী হয়েছে, কোথায় বুঝি দাঙ্গা হয়েছে, কে কারে বুঝি খুন কোরেছে, কার কি সৰ্বনাশ হয় দেখ, গাঁয়ের ভিতর পুলিশ প্রবেশ কোরেছে!” পথে পথে যারা ছিল, তাদের সকলের মুখেই এই রকম কথা; মনে মনে আপনাদের যেন কোন বিপদ গণনা কোরে সকলেই সেই দিক থেকে সোরে গেল; রমণীবল্লভের বাড়ীর মধ্যে আমরা প্রবেশ কোল্লেম।

বাড়ীর ভগ্নদশা, একাংশমাত্র সম্প্রতি মেরামত করা হয়েছে, সেই অংশই সদর ছিল। এখন সেই সদরমহলকেই দুই অংশে ভাগ কোরে সদর মফঃস্বল চিহ্নিত করা হয়েছে। পূজার দালানের খাটালে খাটালে জানালা-দরজা বোসিয়ে মধ্যে মধ্যে প্রাচীর দেওয়া; এখন আর দালান বোলে চেনা যায় না, ঘরগুলি এখন বৈঠকখানা। প্রাঙ্গণের দুইধারে পূর্বে বৈঠকখানা ছিল, সে সব এখন নাই, সমভূমি; সেই সকল ভূমিতে ছোট ছোট ফলের গাছ, বেগুনগাছ, লাউগাছ ইত্যাদি দৃষ্ট হয়। দালানের পশ্চিম অংশে ছোট রকম অন্দর-মহল। বৈঠকখানার মধ্যদরজাটি খোলা ছিল, সদর-বাড়িতে লোকজন কেহ ছিল না, আমরা সেই বৈঠকখানার মধ্যে প্রবেশ কোরে দেখলেম, বাবুলোকের বৈঠক খানার উপযুক্ত আসবাবপত্র কিছুই ছিল না, সেকেলে ধরনের পুরাতন একখানা কেদারা আর দু-ধারে বড় বড় দুখানা বেঞ্চ পাতা; মেজেতে বহু পরাতন একখানা সপ মোড়া, সেই সপের উপর দুটি পিতলের বৈঠকে দুটি কলী হুকা; বৈঠকের নিকটে ছোট ছোট খোপ কাটা কাটা একটা মাটির বাক্স; খোপে খোপে চকমকীর পাথর ইস্পাত, আধপোড়া সোলা, কয়লা, এক জোড়া কলিকা আর তামাকপোড়া ছাই। এই পর্যন্ত বৈঠকখানার আসবাব। কেদারাখানিতে ডেপুটিবাবুর আসন দিয়ে আমরা সেই দুইখানি বেঞ্চে সারি সারি উপবেশন কোল্লেম, পুলিশের বরকন্দাজেরা আর হরিহরবাবুর চাপরাসিটি বাহিরের বারান্দায় হাজির থাকলো।

আমি জানতেম, বাবু রমণীবল্লভ বাড়ীতে ছিলেন না; কাহাকে সংবাদ দেওয়া যায়, কি রকমেই বা কার্য হয়, পুলিশের সম্মুখে কেই বা মুরুব্বি হয়ে দাঁড়ায়, এই সব আমি ভাবছি, এমন সময় ভিতরমহল থেকে একটি স্ত্রীলোক বেরিয়ে এলো। দেখেই আমি চিনলেম, সেই রেবতী। ঢাকায় যাওয়াতে আদালতের কাজকর্মে তিন চারদিন আমার বিলম্ব হয়েছিল, ইতিমধ্যে হয় তো রমণীবল্লভবাবু ফিরে এসে থাকবেন, এইরূপ অনুমান কোরে ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় এসে রেবতীকে আমি কিছু জিজ্ঞাসা কোরবো মনে কোচ্ছি, সময় হলো না। দালানের উপর পুলিশের লোক দেখেই রেবতী আঁৎকে উঠলো, “ও মা! এরা সব কে গো! এখানে এ সব থানা-পুলিশ কেন গো!” আতঙ্কে এই সব কথা বোলতে বোলতে রেবতী বাড়ীর ভিতর ছুটে পালালো।

“ভয় নাই রেবতী, ভয় নাই, পালিয়ো না, শুনে যাও, বড়বাবু বাড়ী এসেছেন কি না, সেই কথা আমরা জানতে এসেছি।”—অভয়বাক্যে নরম সুরে বার বার আমি এই সব কথা বোলে পাছু ডাকতে লাগলেম, রেবতী সাড়া দিলে না।

নাম ধোরে আমি ডেকেছি, তবে হয় তো আমি চেনা, যথার্থ চেনা কি না, সেইটি জানবার অভিপ্রায়ে রেবতী একবার ভিতরদিকে অঙ্গ লুকিয়ে দরজার পাশ থেকে উঁকি মেরে আমারে দেখলে, চিনতে পাল্লে না, তখনি আবার মুখখানি লুকিয়ে নিলে। রেবতী তখন পালায় নাই, দরজার আড়ালেই দাঁড়িয়েছিল; উঁকি মেরে যখন মুখ লুকালে, সে সময় আবার আমি নাম ধোরে ডেকে উদ্দেশে জিজ্ঞাসা কোল্লেম, “বাবুরা কেহ বাড়ী আছেন কি?”

উত্তর পেলেম না। একটু পরে ছোট ছোট দুটি বাবু আদুড়-গায়ে বেরিয়ে এসে বৈঠকখানায় প্রবেশ কোল্লেন। দিব্য চেহারা, একটির বয়স অনুমান ষোড়শ বর্ষ, দ্বিতীয়টি ত্রয়োদশ অথবা চতুর্দশবর্ষীয়। দেখেই আমি বুঝতে পাল্লেম, কারা তাঁরা। সত্যই যেন কতদিনের চেনা, সেই ভাবে বড়টিকে আমি জিজ্ঞাসা কোল্লেম, “তোমার দাদাবাবু কি বাড়ী এসেছেন?”

যেন একটু চোমকে উঠে বাবুটি উত্তর কোল্লেন, “এসেছেন। শেষরাত্রে এসেছেন, একটু অসুখ আছে, আহার করেন নাই, ঘুমুচ্ছেন।”

রেবতীর উদ্দেশেও আমার কথা, এই বাবুটির সঙ্গেও আমার কথা; হাকিম অথবা দারোগা ততক্ষণ পর্যন্ত একটিও কথা কোইলেন না। বাবুটিকে সবোধন কোরে আমি আবার বোল্লম, “বেলা এখন শেষ হয়ে এসেছে, অসুখশরীরে এতক্ষণ পর্যন্ত নিদ্রা যাওয়া ভাল নয়, সংবাদ দাও।” এই পর্যন্ত বোলে, ডেপুটিবাবুর দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ কোরে সেই বাবুটিকে পুনৰ্বার আমি বোল্লেম, “বড়বাবুকে গিয়ে বল, এই ডেপুটিবাবু তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ কোত্তে এসেছেন, ঢাকা সদর-স্টেসনের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ইনি, বিশেষ প্রয়োজন আছে, সাক্ষাৎ করা নিতান্ত আবশ্যক, সংবাদ দাও।”

ডেপুটিবাবুর দিকে চাইতে চাইতে বাবুটি বাড়ীর ভিতর চোলে গেলেন, ছোটবাবুটি আমাদের কাছে থাকলেন; আমার কাছেই এসে বোসলেন। মুখপানে চেয়ে চেয়ে আমার মনে একটি নূতন বুদ্ধি যোগালো। ছোট ছোট ছেলেরা মিথ্যাকথা জানে না, মিথ্যাকথা বলে না; এই ছেলেটিকে জিজ্ঞাসা কোল্লে অনেক দুর সত্যক বাহির হোতে পারে। পারে বটে, কিন্তু আমি কে? উপস্থিত ব্যাপারে উপরপড়া হয়ে আমার কোন কথা জিজ্ঞাসা করা অধিকারবহির্ভূত। ডেপুটিবাবুর মুখের দিকে আমি চাইলেম, ডেপুটিবাবু আমার মনের ভাব বুঝলেন, চেয়ারখানি আমাদের দিকে একটু সোরিয়ে এনে বালকটিকে জিজ্ঞাসা কোল্লেন, “ব্রজকিশোরী নামে একটি মেয়ে তোমাদের বাড়ীতে আছে?”

বালক।—আছে।

ডেপুটি।—কোথা থেকে এসেছে?

বালক।—তিনজন লোক আমার দাদার কাছে তাঁরে রেখে গিয়েছে। বিয়ে হবে।

ডেপুটি।—মেয়েটি এখানে কি করে?

বালক।—কাঁদে।

ডেপুটি।—কার সঙ্গে বিয়ে হবে?

বালক।—( প্রাঙ্গণের দিকে চাহিয়া) ঐ দাদা আসছেন। দুই হতে নয়নমার্জন কোত্তে কোত্তে বালকের দাদাটি সেই ঘরে প্রবেশ কোল্লেন। পূৰ্বে আমার দেখা ছিল না, তথাপি স্থির বুঝলেম, তিনিই বাবু রমণীবল্লভ। ঘরে প্রবেশ কোরেই চঞ্চলনেত্রে ইতস্ততঃ দৃষ্টিপাত কোত্তে কোত্তে বিরক্তবদনে বাবু জিজ্ঞাসা কোল্লেন, “আপনারা কে? আপনারা এখানে কেন এসেছেন? বাহিরে পুলিশের লোক খাড়া আছে, ওরাই বা এখানে কেন?”

ও সকল প্রশ্নে আমার উত্তর করা ভাল হয় না, আমি চুপ কোরে থাকলেম; ডেপুটিবাবু স্বয়ং উত্তর দিলেন, “আপনি বসুন। জেলার ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের আদেশে আমরা এখানে এসেছি, পুলিশও এসেছে। আপনাকে গুটিকত কথা জিজ্ঞাসা করা আমাদের দরকার। আপনি বসুন।”

বেঞ্চে আমরা বোসে ছিলেম, একটু সোরে সোরে স্থান দিলেম, বড়বাবু বোসলেন। অতঃপর প্রশ্নোত্তর।

ডেপুটি।—ব্রজকিশোরী নামে একটি বালিকা আপনার বাড়ীতে আছে, যারা সেটিকে এখানে এনে রেখে গিয়েছে, তাদের আপনি জানেন কি না?

রমণীবাবু।—আমার উপর এরূপ প্রশ্ন করবার আপনার কি অধিকার?

ডেপুটি।—অধিকারের কথা পূর্বেইে আপনাকে বলা হয়েছে। জেলার ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের আদেশ। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব আপনার মুখে ঐ প্রশ্নের উত্তর চান। আমি ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের প্রতিনিধি; আমার কাছেই উত্তর দিতে আপনি বাধ্য। বলুন, তাদের আপনি জানেন কি না?

রমণীবাবু।—পূর্বে জানা-শুনা ছিল না, হঠাৎ একদিন একটি মেয়ে সঙ্গে কোরে তিনটি ভদ্রলোক এখানে আসেন। সেই তিনজনের মধ্যে একজন সেই মেয়েটির পিতা। তিনি গরিব, এই গ্রামে একজন ধনবান পাত্রে মেয়েটি তিনি সম্প্রদান কোরবেন।

ডেপুটি।—আপনি যে তিনজনকে ভদ্রলোক বোলছেন, হুজুরে দরখাস্ত হয়েছে, সেই তিনজন লোক একটা ভয়ানক কুচক্রের দলভুক্ত চোর, জুয়াচোর, বিখ্যাত বদমাস। মেয়েটিকে তারা মুর্শিদাবাদ থেকে চুরি কোরে এনেছে। মেয়েটির নাম ব্রজকিশোরী নয়, সত্যনাম অপ্রকাশ আছে। মেয়েটিকে আপনি আমার কাছে একবার আনয়ন করন, সত্যতত্ত্ব আমার অবগত হওয়া অগ্রে আবশ্যক।

রমণী।—তা আমি পারি না। পিতা যারে বিশ্বাস কোরে আমার কাছে গোছিয়ে রেখে গিয়েছেন, তারে আমি পুলিশের কাছে হাজির কোত্তে অসম্মত; তাতে আমার লজ্জা আছে; তেমন কার্যে বিশ্বাসঘাতকতা প্রতিপন্ন হোতে পারে।

ডেপুটি।—হাঁ, তা হোতে পারে বটে, বিশ্বাসঘাতক হওয়া ভদ্রলোকের উচিত নয়। আচ্ছা, সেই তিনজন লোককে আপনি হাজির করুন।

রমণী।—যতদিন পরে তাঁদের আসবার কথা, ততদিন পরে যদি আবশ্যক হয়, তবে আমি তাঁদের হাজির কোত্তে পারবো; এখন পারি না।

ডেপটি।—উত্তম। ততদিনের মধ্যে পুলিশ যদি পারে, হাজির করবার চেষ্টা পাবে; এখন আপনি সেই মেয়েটিকে আমার কাছে হাজির করুন। অবিবাহিতা কুমারী, বয়স অল্প; তথাপি হিন্দু পরিবারের ব্যবহার অনুসারে পরদানসীন মহিলাগণের রীত্যনুসারে সেই মেয়েটির মুখের কথাগুলি আমি শ্রবণ কোরবো।

রমণী।—তা আপনি পারেন না। আমার কাছে ইজ্জত রেখে যিনি নিশ্চিন্ত হয়ে কেহরে গিয়েছেন, তাঁর কন্যাকে আপনার কাছে উপস্থিত কোরে আমি তাঁর ইজ্জতের কেউ কোত্তে পারবো না।

ডেপুটি।—উত্তম। আপনার নিজ পরিবারের রমণীগণকে আপনি অন্য গৃহে সোরে থাকতে বলুন, আমি অতঃপুরে প্রবেশ কোরে সেই কুমারীর এজাহার গ্রহণ কোরবো।

রমণী।—আমি খুন করি নাই, ডাকাতী করি নাই, আমার নামে কোন নালিশ নাই, আপনি আমার বাটিতে খানা-তল্লাসী কোত্তে চান, এটা আইনের মর্ম নয়।

ডেপটি।—আপনি একটু সাবধান হয়ে কথা কবেন। মেয়ে-চুরি মামলা, আপনি সেই মামলার আসামীগণের বানিকার, খুনী-ডাকাতী মামলার তাদারকে আইন যেরুপ উপদেশ দেয়, এ মামলাতেও আইনের সেইরূপ উপদেশ। আমি বে-আইনী কার্য কোত্তে এসেছি কিবা বে-আইনী কার্য কোত্তে উদ্যত হোচ্ছি, এমন কথা যদি পুনরায় আপনি বলেন, তা হোলে—

রমণী।—তা হোলে আপনি কি কোরবেন?

ডেপুটি।—কুইন ভিকটোরিয়ার নামে আমি আপনাকে পুলিশের হেপাজাতে সমপর্ণ কোরবো।

রমণী।—করুন, আমি প্রস্তুত আছি।

ডেপটি।—অধিকক্ষণের কার্য নয়। মনে করুন, তাই আপনি আছেন। এখনো আমি ভালকথায় বলছি, মেয়েটিকে আপনি এইখানে হাজির করুন।

দালানের মাঝে মাঝে প্রাচীর দিয়ে ঘর করা হয়েছিল, পশ্চাদ্দিকে খড়খড়ি ছিল, সেই খড়খড়ির পশ্চাতে অন্দরের দিকে দর-দালান; ডেপুটি ম্যাজিষ্টেটের মুখে ঐরুপ বাক্য উচ্চারিত হবামাত্র সেই দর-দালানে কতকগুলি স্ত্রীলোকের বসনের খসখস শব্দ আর বদনে ভয়গুঞ্জনসূচক অস্ফুট শব্দ শ্রুতিগোচর হলো। সেই দিকে চেয়ে ডেপুটিবাবু বোল্লেন, “মা সকল! আপনারা ভয় পাবেন না, ভয় দেখাবার মত কোন কার্য আমি কোরবো না; ভদ্রলোকের পরিবারের সঙ্গে যে রকম ব্যবহার কোত্তে হয়, আমিও ভদ্রসন্তান, তা আমি ভাল জানি। আমি আইনের চাকর, আইন কাহারও মান-মর্যাদা নষ্ট করে না। ব্রজকিশোরী নামে যে মেয়েটি এই বাড়িতে আছে, সেটির সত্যনাম ব্রজকিশোরী কি না, কোন পরিচিত লোককে ব্রজকিশোরী এখানে চিনতে পারেন কি না, সেইটি আমি জানবো; মেয়েটিকে একবার আমি দেখবো।”

অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে রমণীবল্লভ বোলে উঠলেন, “এ আপনার বেজায় জুলুম। ভদ্রলোকের কন্যা ভদ্রলোকের বাড়িতে রয়েছে, তার আবার সত্যনাম মিথ্যানাম আছে, এ সব কথা আপনি কি বলেন?”

ডেপুটিবাবু বোল্লেন, “সত্যমিথ্যা নাম নিশ্চয়ই আছে। শুধু তাই নয়; মেয়েটি কি জাতি, তাও আপনি জানেন না; অথচ একজন সুবর্ণ-বণিকের সঙ্গে সেই মেয়ের বিবাহ-সম্বন্ধ স্থির কোরেছেন, মধ্যস্থ হয়ে মেয়েটিকে আশ্রয় দিয়েছেন, দুহাজার টাকায় বিক্রয় করবার বন্দোবস্ত হয়েছে, এ সব কথা কি আপনি অস্বীকার কোত্তে পারেন?”

বাবু রমণীবল্লভের আরক্তবদন অকস্মাৎ পাণ্ডুবর্ণ হয়ে এলো, আমতা আমতা কোরে কি যেন বোলবেন, চেষ্টা পেলেন, স্পষ্টকথা ফুটলো না। কাছেই তিনি বোসে ছিলেন, আমি বেশ দেখলেম, তিনি যেন একটু একটু কাঁপতে লাগলেন। সেই সময় দারোগাকে সম্বোধন কোরে ডেপুটিবাবু হকুম দিলেন, “এই গ্রামে ধনঞ্জয় ঘটক, আর বংশী পোদ্দার নামে দুটি লোক আছে, আপনার বরকন্দাজদের বলুন, অবিলম্বে সেই দুইজনকে এখানে হাজির করে।”

রমণীবল্লভের কাঁপুনি বাড়লো। মাথা হেঁট কোরে তখন তিনি কম্পিত স্বরে বোল্লেন, “অত ফ্যাঁসাদে কাজ নাই, তাদের তলব দিবার দরকার নাই, ব্রজকিশোরীকে আপনি দেখতে চাচ্ছেন, ব্রজকিশোরীকে আমি আনিয়ে দিচ্ছি, ব্রজকিশোরীকে দেখুন, যে যে কথা জিজ্ঞাসা কোত্তে ইচ্ছা হয়, করুন, ঘটককে, পোদ্দারকে তলব দিবার দরকার নাই।”

অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে মৃদ হাস্য কোরে ডেপুটিবাবু বোল্লেন, “তিনটিই আমার দরকার; ব্রজকিশোরীকেও দরকার, ধনঞ্জয়কেও দরকার, বংশীকেও দরকার। ব্রজকিশোরীকে যারা এখানে রেখে গিয়েছে, তারা চোর; যারা যারা চোরের সহায়তা করে,—জ্ঞানেই হোক, অজ্ঞানেই হোক, যারা যারা চোরের সহায়তা করে, বিচারস্থলে তাদের সকলকেই আকর্ষণ করা অবশ্য কর্ত্তব্য।”

রমণীবল্লভের মুখে আর বাক্য থাকিল না; আসন থেকে উঠে ম্লানবদনে তিনি একবার অন্দরের দিকে গেলেন। দারোগার আদেশে দুইজন বরকন্দাজ পূর্বকথিত দুইব্যক্তির অন্বেষণে গেল। যে বেঞ্চখানিতে আমরা বোসে ছিলেম, তারই ঠিক পশ্চাতে এক সুদীর্ঘ বাতায়ন; সম্মুখদিকে খড়খড়ির পাখি বন্ধ, ভিতরদিকে অর্গল বন্ধ ছিল; আমি জানতে পাল্লেম, ভিতরদিক থেকে ধীরে ধীরে সেই অর্গল উদ্ঘাটিত হলো। দ্বার উন্মুক্ত। যখন বন্ধ থাকে, তখন দেখায় যেন গবাক্ষ; বাস্তবিক সেটা খড়খড়িযুক্ত দরজা; সদরে অন্দরে গতিবিধির একটা দ্বিতীয় দ্বার। ভিতরদিকে দর-দালান; সেই দর-দালানে স্ত্রীলোকেরা ছিলেন, দ্বার উন্মুক্ত হবামাত্র তাঁরা সকলেই দুইধারে সোরে সোরে দাঁড়ালেন, চৌকাঠের উপর রমণীবল্লভ। তাঁর পশ্চাতে অর্ধ অবগুণ্ঠনবতী একটি বালিকা; বুঝতে না পারুক, আমি বুঝলেম, কে সেই বালিকা। বালিকার দর্শন কোরেই আমার নয়নযুগল উৎফুল্ল।

বাবু রমণীবল্লভ আমাদের দিকে সোরে এলেন, স্ত্রীলোকেরা আমাদের দেখতে না পান, সেই রকমে আমরাও একটু সোরে সোরে বোসলেম; খড়খড়ির কপাটে হস্তাপর্ণ কোরে বালিকাটি সেই চৌকাঠের ধারে নতমুখী হয়ে দাঁড়ালেন।

ডেপুটিবাবু সেই সময় আপনার চেয়ারখানি সেই খড়খড়ির দিকে সোরিয়ে নিয়ে, স্থিরনয়নে একবার বালিকাটির আপাদমস্তকে নিরীক্ষণ কোল্লেন; কুমারীকন্যা, অবগুণ্ঠনবসনে পূর্ণ বদনমণ্ডল আবৃত ছিল না, মুখখানিও তিনি দেখলেন; আমরা একটু তফাতে তফাতে গা-ঢাকা ছিলেম, কুমারী আমাদের দেখতে পেলেন না। সুধীর বিনম্রবচনে কুমারীকে সম্বোধন কোরে ডেপুটিবাবু বোল্লেন, “মা! আমি এখানকার মেজেষ্টার, তোমার কোন ভয় নাই, যে যে কথা আমি তোমারে জিজ্ঞাসা কোরবো, কাহারো উপরোধ অনুরোধ মনে না কোরে নিয়ে তুমি সেই কথাগুলির উত্তর দিও।”

কুমারীকে আমরা তখন দেখতে পাচ্ছিলেম না, ডেপুটিবাবুর কথায় কুমারী কি প্রকার সঙ্কেত জানালেন, তাও আমরা দেখতে পেলেম না, একটি কথাও শুনতে পেলেম না, ডেপুটিবাবু প্রশ্ন আরম্ভ কোল্লেন।

প্রথম প্রশ্ন।—তোমার নাম কি?

কুমারী।— (ধীরস্বরে) অমরকুমারী।

ডেপুটি।—তোমার আর কোন নাম আছে?

কুমারী।—না।

ডেপটি।—এখানে ব্রজকিশোরী নামে আর কোন বালিকা আছে?

কুমারী।—এই বাড়ীর লোকেরা আমারেই ব্রজকিশোরী বলেন।

ডেপুটি।—কেন বলেন?

কুমারী।—যারা আমারে এখানে এনে এই বাবুর বাড়ীতে রেখে গিয়েছে, তারা আমার সত্যনামটি গোপন কোরে ঐ নামে পরিচয় দিয়েছে।

ডেপটি।—কারা তোমাকে এখানে এনেছে?

কুমারী।—তাদের সকলকে আমি চিনি না। একজনকে চিনি, সে লোকটিও তার নিজের নাম প্রকাশ করে নাই।

ডেপটি।—তুমি তার আসল নাম জান?

কুমারী।—জানি।

ডেপুটি।—কি?

কুমারী।—জটাধর।

ডেপুটি।—সেই জটাধর এখানে কি নামে পরিচয় দিয়েছে?

কুমারী।—চণ্ডেশ্বর।

ডেপুটি।—চণ্ডেশ্বরের সঙ্গে আর কে কে ছিল?

কুমারী।—চিনি না।

ডেপুটি।—হাঁ তা তো শুনেছি, কিন্তু তারা কজন? তাদের নাম তুমি জানতে পেরেছ?

কুমারী।—চণ্ডেশ্বর ছাড়া আর দু-জন; একজনের নাম গণেশ্বর, আর একজনের নাম মিয়াজান।

ডেপুটি।—তাদের সঙ্গে তুমি এখানে কেন এসেছিলে?

কুমারী।—চোখ-মুখ বেঁধে তারা আমারে চুরি কোরে এনেছে।

ডেপুটি।—কোথা থেকে এনেছে?

কুমারী।—মুর্শিদাবাদ থেকে।

ডেপুটি।—যাদের নাম তুমি বোল্লে, তারাই তোমারে চুরি কোরেছে? সে কথা তুমি ঠিক বোলতে পার?

কুমারী।—না, তারা চুরি করে নাই, চোরেরা এক জায়গায় এনে জটাধরের হাতে—যে লোক এখন চণ্ডেশ্বর সেজেছে, সেই জটাধরের হাতে ধোরে দেয়। গণেশ্বর আর মিয়াজান সেইখানে এসে জোটে।

ডেপুটি।—যারা চরি কোরেছিল, তাদের নাম তুমি জানতে পেরেছিলে?

কুমারী।—চোরের নাম কেমন কোরে জানবো?

ডেপুটি।—এ বাড়ীর বাবুকে তুমি আর কখন দেখেছিলে?

কুমারী।—না।

ডেপুটি।—এ বাড়ীতে এখন তুমি থাকতে ইচ্ছা কর?

কুমারী।—না থেকে আর কোথায় যাবো? আমার কেহ নাই।

ডেপুটি।—তবে যে শুনছি, তোমার পিতা তোমার এই বাবুর কাছে গোছিয়ে রেখে গিয়েছেন।

কুমারী।—মিথ্যাকথা। আমার জন্মের পর অবধি পিতা আমার নিরুদেশ। মা ছিলেন, সম্প্রতি তিনিও স্বর্গে গিয়েছেন। যে লোক আমারে তাঁর মেয়ে বোলে পরিচয় দেয়, সে আমাদের কেহই নয়।

এইখানে রমণীবাবুর দিকে দৃষ্টিপাত কোরে ডেপুটিবাবু বোল্লেন, “কেমন বাবুজী! মেয়েটির কথাগুলি শুনলেন? চোরে চুরি কোরে এনেছে, একটা দুষ্টলোক এই মেয়ের পিতা বোলে পরিচয় দিচ্ছে, সেই লোকের কথায় বিশ্বাস কোরে এই বালিকাকে আপনি আপন বাড়ীতে আটক রেখেছেন, আইনের ক্ষমতায় আমরা এই অপহৃতা বালিকাকে উদ্ধার কোত্তে চাই, আপনি আমল দিতে চান না। আইনের চক্ষে আপনিও অপরাধী হোতে পারেন।”

রমণীবাবুর মুখে বাক্য নাই। আমার দিকে আর মণিভূষণের দিকে নেত্রসঙ্কেত কোরে ডেপুটিবাবু আমাদের উভয়কেই নিকটে আহ্বান কোল্লেন; সওয়াল-জবাব শ্রবণের নবীন উৎসাহে আমার হৃদয় তখন পূর্ণ হোচ্ছিল, পূর্ণ উৎসাহে তৎক্ষণাৎ আমরা তাঁহার নিকটবর্তী হোলেম। আমাদের ঠিক সম্মুখে অমরকুমারী।

আমাদের দিকে অঙ্গলিনির্দেশ কোরে, সস্নেহ সম্বোধনে ডেপুটিবাবু জিজ্ঞাসা কোল্লেন, “দেখ দেখি অমরকুমারি, দেখ দেখি মা, ভাল কোরে চেয়ে দেখ দেখি, এই দুটি বাবুকে তুমি চিনতে পার কি না?”

অমরকুমারীর সজল পদ্মনেত্র আমাদের উভয়ের মুখের দিকে উত্তোলিত, নেত্রপট সজল উজ্জ্বল। এক একবার এমন হয়, আকাশে মেঘ থাকে না, অথচ অকস্মাৎ বৃষ্টি আসে। অমরকুমারীর চক্ষে আমি সেই ভাব দর্শন কোল্লেম। সজল পদ্মনেত্র; লাবণ্য-হিল্লোলে স্বভাবতঃ সৰ্বক্ষণ ঢল ঢল করে; আমাদের প্রতি সেই নেত্র নিক্ষিপ্ত হবামাত্রই দর দরধারে অশ্রুধারা প্রবাহিত হলো, সমষ্টিতে চেয়ে থেকেই বাষ্পরুদ্ধকণ্ঠে মৃদুগুঞ্জনে অশ্রমুখী কুমারী তিনবার উচ্চারণ কোল্লেন, “হরিদাস! মণিভূষণ! দাদা!”

ক্ষণেকের জন্য হাকিমিত্ব বিস্মৃত হয়ে বন্ধুত্বের অমৃতস্বরে ডেপুটিবাবু বোল্লেন, “কেঁদো না মা, কেঁদো না! অবস্থা আমি সমস্তই বুঝলেম। এই দুটি বালক তোমার আত্মীয়, এই দুটি বালক তোমার উদ্ধারের নিমিত্ত বিস্তর আয়াস, বিস্তর কষ্ট, বিস্তর অর্থ ব্যয় স্বীকার কোচ্ছেন, তোমারে উদ্ধার কোরে এই দুই বালকের হস্তেই সমপর্ণ করা হবে, তুমি কেঁদো না।”

অমরকুমারীর চক্ষে জল দেখে আমার চক্ষও শুষ্ক থাকলো না, কুমারীর অলক্ষিতে আমিও ঘন ঘন আমার সিক্তনেত্র মার্জন কোত্তে লাগলেম; বিনা প্রশ্নে ডেপুটিবাবুর দিকে চেয়ে অমরকুমারী বোলতে লাগলেন “চণ্ডেশ্বর পাষণ্ড, তার অসাধ্য কর্ম নাই। এই হরিদাস আমার পরম বন্ধু; এই মণিভূষণ আমার দাদা হন, মণিভূষণের পিতা শান্তিরাম দত্ত আমার পিতৃতুল্য, রক্ষাকর্তা, আশ্রয়দাতা; তাঁর আশ্রয় থেকেই চোরেরা আমাকে চুরি কোরেছে! সেইখানেই আমি ফিরে যাব! আপনি দয়া করুন, হরিদাসের সঙ্গে-মণিভূষণের সঙ্গে মুর্শিদাবাদেই আমি ফিরে যাবো।”

হাকিমের সঙ্গে অমরকুমারীর কথা হোচ্ছিল, সে সময় আমার কথা কওয়া উচিত বিবেচনা করি নাই, কিন্তু কুমারীর কাতরতা দেখে আমি আর চুপ কোরে থাকতে পাল্লেম না, হাকিমের অনুমতি নিয়ে আশ্বাসবচনে বোল্লেম, “কেঁদো না, অমরকুমারি! সেই জন্যই আমরা এসেছি; কত ঠাঁই ঘরে ঘরে, অজ্ঞাত-লোকমুখে বার্তা পেয়ে এ অঞ্চলে আমরা এসেছি, বহরমপুরে মোকদ্দমা হোচ্ছে, তোমারে যারা চুরি কোরেছিল, তাদের মধ্যে দুজন চোর সেই খানে ধরা পোড়েছে, হাজতে আছে, সর্দার আসামীটা ধরা পোড়লেই চুড়ান্ত বিচার হবে। এই ডেপুটিবাবুর অনুগ্রহে তোমারে আমরা উদ্ধার কোরে নিয়ে যাব। সর্দার আসামীটা কে জান? এখানকার চণ্ডেশ্বর, ওরফে জটাধর, ওরফে রক্তদন্ত। সেই লোকটা নিরুদ্দেশ। আমি সেই—

কথা আমার শেষ হলো না। থানার বরকন্দাজেরা দৌত্যকার্য সমাধা কোরে ফিরে এলো, সঙ্গে এলো ধনঞ্জয় ঘটক আর বংশীধর পোদ্দার। ডেপুটিবাবু সেই দুজনকে যে যে কথা জিজ্ঞাসা করা আবশ্যক বিবেচনা কোল্লেন, সেই সকল প্রশ্নে যে প্রকার উত্তর পেলেন, তাতে কোরে আমার উক্তিগুলিই সপ্রমাণ হলো। রমণীবাবুর সহধর্মিণীর সততা স্মরণ কোরে রমণীবাবুকে দোষমুক্ত করবার ইচ্ছা আমার মনে মনে জাগছিল, কিন্তু ধনঞ্জয়ের কথাপ্রমাণে সেই ইচ্ছাকে ফলবতী করা কঠিন হয়ে দাঁড়ালো। ধনঞ্জয় বোল্লে, “বাবু রমণীবল্লভ একদিন আমারে ডেকে অনুরোধ করেন, একটা বর দেখ। টাকাওয়ালা হওয়া চাই। পরমসুন্দরী কন্যা, কুমারীকাল উত্তীর্ণ, জাতি-কুল-বিচার আবশ্যক করে না, টাকাওয়ালা বর দেখ। সেই অনুরোধে আমি এই বংশী পোদ্দারকে যোগ্যপাত্র ঠিক কোরেছি। বংশী পোদ্দার নগদ দুহাজার টাকা পণ দিবে, আমি আর রমণীবাবু উভয়েই ঘটক, উভয়ে আমরা ৫০০৲ টাকা পাব, মেয়েটি যারা এনেছে, তারা পাবে দেড় হাজার, এইরূপ বন্দোবস্ত। কথা যখন ধার্য হয়, কন্যাপক্ষের লোকেরা তখন এই বাড়ীতে উপস্থিত ছিলেন, তাঁরা তিনজন, কন্যার পিতার নাম চণ্ডেশ্বর।”

তদন্তের আর কোন অঙ্গ বাকী থাকলো না। হাকিম তখন রমণীবাবুকে জিজ্ঞাসা কোল্লেন, “এ সম্বন্ধে আপনার আর কি বক্তব্য আছে? বুঝতে পাল্লেন, সমস্তই জাল, পূৰ্বেই বুঝেছিলেন, টাকার খাতিরে জুয়াচোর লোকের মুরব্বিগিরী কোত্তে হবে; সেটি না বুঝলে ‘জাতিকুলের আবশ্যক করে না’ ঘটকের প্রতি এমন আম-হুকুম দিতে কখনই আপনার সাহস হতো না। আপনি ভদ্র-সন্তান, বংশমর্যাদা আছে, মান-সম্ভ্রম আছে, এমন ঘৃণিত কার্যে আপনার প্রবৃত্তি, বড়ই আশ্চর্য! অমরকুমারীকে আমরা ঢাকায় নিয়ে চোল্লেম, আপনাকেও সেখানে যেতে হোচ্ছে, ঘটকালী কোরেছেন ধনঞ্জয়, বর হয়েছেন বংশী পোদ্দার এ দুজনকেও আমি ছাড়তে পাচ্ছি না, আপনারা তিনজনে পুলিশের নজরবন্দীতে থাকবেন। যারা এই অমরকুমারীকে আপনার বাড়ীতে রেখে গিয়েছে, এক সপ্তাহের মধ্যে আপনি তাদের হাজির কোরে দিবেন, এই মর্মে একবার লিখে দিতে হবে।”

অন্দরের দিকে স্ত্রীলোকের ক্রন্দনধ্বনি সমুত্থিত। বৌমার সদ্ব্যবহার স্মরণ কোরে, মা-লক্ষ্মীর মত শান্তমূর্তি মনে কোরে মনে মনে আমি কাতর হোলেম। বুদ্ধির দোষে, অর্থ-লোভে রমণীবাবু আপন ফাঁদে আপনি জোড়িয়ে পোড়েছেন, হাকিমের সাক্ষাতে জাল-জুয়ারি প্রকাশ হয়ে পোড়লো, রক্ষা করা দুঃসাধ্য, তথাপি পুলিশের হস্তে বাবু যাতে বেইজ্জৎ না হন, সে বিষয়ে আমি বিশেষ যত্নবান থাকবো, এইরূপ স্থির কোল্লেম।

আর সেখানে কালবিলম্ব করা নিষ্প্রয়োজন। ডেপুটিবাবু প্রস্তুত হোলেন। ঢাকা থেকে দুখানি নৌকা এসেছিল, আর একখানি বজরা ভাড়া করা হলো, বজরাতে অমরকুমারীকে তুলে দিবার সময় ডেপুটিবাবু বোল্লেন, “বালিকার সঙ্গে একজন স্ত্রীলোক রাখা চাই।” সে স্ত্রীলোক কোথায় পাওয়া যায়, অনেক বিবেচনা কোরে রমণীবাবুকে আমি বোল্লেম, “আপনার বাড়ীর সেই দাসীটি, যার নাম রেবতী, সেই রেবতীকে আমাদের সঙ্গে যেতে বলুন; অমরকুমারীকে রেবতী ভালবাসে, বিদেশিনী ব্রজকিশোরী এখন অমরকুমারী হয়েছেন, এ পরিচয়ে, রেবতী অবশ্য আমোদিনী হয়েছে, অমরকুমারীর সঙ্গে রেবতী থাকলেই ঠিক হবে।”

ললাটে সৰ্বশিরা বকুঞ্চিত কোরে বাবু রমণীবল্লভ তীব্রদৃষ্টিতে আমার মুখের দিকে চাইলেন। আমি রেবতীর নাম জানি, এটা অবশ্য তাঁর পক্ষে বিষম বিস্ময়কর বোধ হলো। আরো আমি কান পেতে শুনলেম, বাড়ীর মেয়েরাও সেই কথা নিয়ে বিস্ময়ে বিস্ময়ে চুপি চুপি গুঞ্জন কোত্তে লাগলেন। একজন বোল্লেন, “এ ছেলে কে গো! এ ছেলে আমাদের রেবতীর নাম কেমন কোরে জানলে?”

আর কেমন কোরে জানলে। এ ছেলে কোথাকার কত কথা জানে, কৈফিয়ৎ দিবার সময় ঘটে না; এ ক্ষেত্রেও সময় ঘোটলো না, ডেপুটিবাবুর অনুরোধে রমণীবাবুর সম্মতিতে রেবতী আমাদের সঙ্গিনা হলো। বজরাতে আমি, মণিভূষণ, অমরকুমারী, রেবতী, আর একজন পুলিশ-প্রহরী; একখানি নৌকায় ডেপুটিবাবু রমণীবাবু আর একজন পুলিশ-প্রহরী, আর একখানি নৌকায় দারোগার সঙ্গে বাকী লোকগুলি সব; হরিহরবাবুর সরকার আর চাপরাসীও সেই নৌকায় থাকলো।

আমরা ঢাকায় চোল্লেম। একবার ইচ্ছা হয়েছিল, একখানি চিঠি লিখে হরিহরবাবুকে এই কার্যের ফলাফল জ্ঞাপন করি, অমরকুমারীর উদ্ধার সংবাদে হরিহরবাবু তুষ্ট হবেন, মনে মনে সেটি আমি বুঝেছিলেম, কিন্তু চিঠি লেখা হলো না। আমি কোথায় গেলেম, কি কোল্লেম, ঢাকার আদালতে কার্যফল কি প্রকার দাঁড়ালো, কিছুই তিনি জানতে পাল্লেন না, অবসর অভাবে চিঠি লেখা হলো না। এইবার ঢাকা পৌঁছে চিঠি লিখবো। দরিয়ায় আমাদের তরণী ভাসলো।

বহু শ্রম, বহু আয়াস, বহু বাদানুবাদ, বহু চিন্তা, আর বহুতর নীরস বিষয়ের আলোচনার পর, মানুষের মনে স্বভাবতই একটু আমোদ-কৌতুকের ভাব উদয় হয়। নূতন উৎসাহে জলপথ তরণী-আরোহণযাত্রা; বারিসিক সুশীতল সমীরণ-সেবনে চিত্ত প্রফুল্ল; অনেকদিন অদর্শনের পর অমরকুমারীর দর্শনলাভ; এই সকল সুখসংযোগে আমার মনে একটু আমোদকৌতুকের ভাবোদয়। মৃদু বাতাসে হেলে দুলে তরণী চোলেছে; দাঁড়ীমাঝীরা অভ্যাসমত জাতীয়সুরে জংলা রাগিণীতে গান ধোরেছে; আমরা অনেক দূরে এসে পোড়েছি। সেই সময় রেবতীকে নিয়ে একটু কৌতুক করবার ইচ্ছা হলো। যতক্ষণ আমরা তরণীতে আছি, ততক্ষণ রেবতী একটিও কথা কয় নাই, অমরকুমারীও নীরব, মণিভূষণের সঙ্গে আমার দুটি একটি কথা চোলছিল, সে কথার প্রসঙ্গ অন্য প্রকার। অমরকুমারীর সঙ্গে সত্য কি আমার একটিও কথা হয় নাই?—হয়েছিল, কথা কিন্তু ওষ্ঠরসনায় নয়, চক্ষে চক্ষে। রেবতীর সঙ্গেও সেই রকম চক্ষে চক্ষে কথা।

এইবার আমি রেবতীর মুখের কথা শুনবো। রেবতীর দিকে একটু সোরে গিয়ে তার মুখপানে চেয়ে সকৌতুকে আমি জিজ্ঞাসা কোল্লেম, “আচ্ছা রেবতি! সেই চণ্ডেশ্বর! নামটি কিন্তু বেশ। শুনলে একটু একটু ভয় হয়, কিন্তু দেখলে বোধ হয় ততটা ভয় থাকে না। রেবতি! তুমি সেই চণ্ডেশ্বরকে দেখেছ; বাড়ীতে এসেছিল, নিশ্চয়ই তার সঙ্গে কথা কোয়েছ; আচ্ছা বল দেখি, চণ্ডেশ্বরের চেহারা কেমন? চণ্ডেশ্বরের গলার আওয়াজ কেমন?”

একদৃষ্টে আমার নয়ন নিরীক্ষণ কোরে রেবতী কিয়ৎক্ষণ পূৰ্ববৎ নিস্তব্ধ হয়ে থাকলো। পুনরায় যখন আমি ঐ দুই প্রশ্ন কোল্লেম, তখন আমার আগ্রহ বুঝতে পেরে রেবতী উত্তর কোল্লে “চণ্ডেশ্বর?—চণ্ডেশ্বরের চেহারা তুমি শুনবে? কেন গা? তুমি কি রামায়ণ পড় নাই? লঙ্কাকাণ্ড?—পড় নাই? —নল, নীল, গয়, গবাক্ষ, হনুমান, জাম্বুবান, এ সব কি তুমি পড় নাই? চণ্ডেশ্বরের চেহারাটা ঠিক সেই রকম। একবার মনে হয় বাঁদর, একবার মনে হয় ভাল্লুক। চণ্ডেশ্বর দু-পায়ে চলে; দু-পায়ে না চোলে চণ্ডেশ্বর যদি চারপায়ে চোলতো, তা হোলেই ঠিক মানাতো; পিঠের উপর মস্ত একটা ঢিবি, চারি পায়ে হামাগুড়ি দিয়ে বেড়ালে তাকে আর মানুষ বোলে চিনতে হতো না। আধখানা বাঁদর, আধখানা ভাল্লুক। গলার আওয়াজটাও ভাল্লুকের মতন।”

কিছুই সন্দেহ ছিল না, তথাপি রেবতীর মুখের বর্ণনা শুনে, সম্পূর্ণ সংশয়শূন্য হোলেম। রেবতীর বর্ণনায় কবিত্বের ভাব অনুভূত হলো। চণ্ডেশ্বরকে যদি ঢাকায় পাওয়া যায়, গলায় দড়ী বেঁধে রেবতীর হাত দিয়ে তারে একবার নাচাবো, অন্তরে হাস্য রেখে সেই ইচ্ছাকে হৃদয়ে আমি স্থান দিয়ে রাখলেম।

রেবতী আমার সঙ্গে কথা কোচ্ছে, চণ্ডেশ্বরের রূপবর্ণনা শুনে আমি আমোদ কোচ্ছি, প্রসঙ্গ ছেড়ে দিয়ে হঠাৎ আমি জিজ্ঞাসা কোল্লেম, “আচ্ছা রেবতি! সম্প্রতি একদিন সন্ধ্যাকালে তোমাদের বাড়ীতে কে একটি বিদেশিনী গিয়েছিল, জলের ঘাটে যার সঙ্গে তোমার দেখা হয়েছিল, সেই বিদেশিনীটি তোমার চক্ষে কেমন ঠেকেছিল?”

অন্যমনকে চোমকে উঠে, চকিতনেত্রে আবার নয়ন নিরীক্ষণ কোরে রেবতী উত্তর কোল্লে, “সে বিদেশিনীর কথা তুমি কি কোরে জানতে পাল্লে? সন্ধ্যাকালে এসেছিল, ভোরবেলা পালিয়েছিল, তার কথা তুমি কার মুখে শুনলে?”

ও কথায় যেন আমি কান দিলেম না, মুখে হাসি আসছিল, সে হাসি চেপে রেখে, গম্ভীরবদনে আবার আমি প্রশ্ন কোল্লেম, “আচ্ছা রেবতি! ব্রজকিশোরীকে দেখে সে বিদেশিনী তেমন কোরে ঘোমটা টেনে মুখ ঢেকেছিল কেন?”

ক্রমশঃ রেবতীর মনে বেশী বেশী বিস্ময়ের আবির্ভাব। অমরকুমারীর মুখের দিকে চেয়ে দেখলেম, এবারে অমরকুমারীর মুখেও বিলক্ষণ বিস্ময়ের লক্ষণ প্রতিভাত। কৌতুকের নূতন তরঙ্গ প্রবাহিত। রেবতীর মুখে কোন উত্তর পাওয়া গেল না; মুখের বাক্যে পাওয়া গেল না, কিন্তু মুখের ভঙ্গীতে বেশ উত্তর পাওয়া গেল। আশ্চর্য জ্ঞান।

তৃতীয়বার আমি বোল্লেম, বিদেশিনী গণনা জানে, হাত-মুখ দেখে মানুষের ভাগ্যের ভবিষৎ ফলাফল বোলতে পারে না দেখেও বোলতে পারে! ঘোমটা দিয়ে ব্রজকিশোরীর ভাগ্যফল বোলেছিল হাতও দেখে নাই, মুখও দেখে নাই, কিছুই করে নাই; ঘোমটার ভিতর হয় তো জ্যোতিষবিদ্যার পুঁথি রাখে। অদ্ভুত বিদেশিনী। গণকঠাকুরেরা পুরুষমানুষ, মেয়েরা বলে গণৎকার, কিন্তু সেই বিদেশিনী গণকঠাকুরও হোতে পারে না, গণৎকারও হোতে পারে না। জ্যোতিষবিদ্যাতে আগে আগে স্ত্রীজাতির অধিকার ছিল। তুমি রেবতী, তুমি যদি রাজা বিক্রমাদিত্যের আমলে রাক্ষসের দেশে, রাক্ষসীদের কাছে জ্যোতিষবিদ্যা শিক্ষা কোত্তে, তুমিও একজন খনাবতী, লীলাবতী হোতে পাত্তে। আচ্ছা, সেকালের কথা যাক, সেই বিদেশিনী অত গণনা কি কোরে জানতে পেরেছিল?”

এ বারেও রেবতী উত্তর দিলে না। অমরকুমারীর দিকে মুখ ফিরিয়ে প্রশান্তবদনে আমি জিজ্ঞাসা কোল্লেম, “তুমি জানো অমর? তুমিই ত ব্রজকিশোরী ছিলে? ঘোমটা-ঢাকা বিদেশিনী তোমার ঐ মুখখানি না দেখেই সাফ সাফ বোলেছিল, ‘চোরে চুরি কোরেছে, এ কষ্ট থাকবে না, হারানিধি প্রাপ্ত হবে, শীঘ্র তুমি মুক্তি পাবে।” এ সব কথা কেমন কোরে জেনেছিল? কেমন কোরে বলেছিল? ফল তো দেখছি ঠিক হয়েছে, শীঘ্রই তুমি মুক্তি পেয়েছ, চোরের সন্ধান হোলেই এখন সব আপদ চুকে যায়। হবেও তা, কিন্তু বল দেখি অমরকুমারি, সে বিদেশিনী কোথায় গেল?”

এইবার একটু হেসে অমরকুমারী বোল্লেন, “তুমিও যে দেখছি, দিব্যি গণৎকার হয়েছ! তুমিই কেন বল না, সে বিদেশিনী কোথায় গেল? এসেছিল, বোলেছিল, পালিয়েছিল, এ সব তুমি জানতে পেরেছ, আগাগোড়া সব কথা বোলতে পেরেছে, কোথায় গেল, সেটি কি তুমি জানতে পার না?”

আমি মনে কোল্লেম হাসি; কিন্তু হাসলেম না; সমভাবে সমম্বরেই বোল্লেম, “তাই তো আমি ভাবছি! বিদেশিনী কোথায় গেল, তোমারে দেখা দিয়ে চুপি চুপি পালিয়ে গেল, আমি একবার সেই বিদেশিনীকে যদি দেখতে পাই, গোটাকতক মনের কথা জিজ্ঞাসা করি। অন্বেষণ কোরে বেড়াচ্ছি, ধোত্তে পাচ্ছি না; একটিবার দেখা হলে আগেই জিজ্ঞাসা করি চণ্ডেশ্বরের সন্ধান। তুমি কি বলতে পার, তোমারে এক জায়গায় ফেলে রেখে চণ্ডেশ্বর কোথায় লুকিয়েছে? পার বোধ হয়? তুমিও বিদেশিনী ছিলে, সেটিও বিদেশিনী হয়ে এসেছিল; দুটি বিদেশিনী মিলন হয়েছিল, বিদেশিনীর ছায়া তোমার গায়ে লেগেছে; বিদেশিনীর গায়ের বাতাস তোমার গাত্র স্পর্শ কোরেছে; তুমিও বোধ হয়, একটি গণৎকার হয়ে আছ; আমিও যেন তাই দেখছি। বল দেখি, সেই পাষণ্ড চণ্ডেশ্বর এখন কোথায়?”

হস্তসঞ্চালন কোরে অমরকুমারী বোল্লেন, “বোলো না, বোলো না হরিদাস! ও নাম আমার কানের কাছে আর তুমি বোলো না। শুনলেই আমার গা কাঁপে; প্রাণ ধড়ফড় করে! তিনটে নাম একরকম ভয় দেখায়! যে নামটা তুমি দিয়েছ, সেই নামটাতেই আরো বেশী ভয়!”

রেবতী দেখলে, অমরকুমারীর সঙ্গে আমার অনেকদিনের আলাপ, চণ্ডেশ্বরের সঙ্গেও আমার অনেকদিনের পরিচয়, আশ্চর্য মনে কোরে ব্যগ্রতা জানিয়ে, রেবতী আমারে বোল্লে, “তুমি বাপু হরিদাস! তুমি সব জানো, তুমি সব পারো, তুমিও গণনা জানো, বিদেশিনীর সব কথা তুমি ঠিক ঠিক বোলচো; বাপু হরিদাস! আমার একটি কথা কি তুমি রাখবে?”

কি জানি কি কথা, কি কথা বলবার জন্য রেবতী ও রকম ব্যগ্রতা জানাচ্ছে, শীঘ্র স্থির কোত্তে না পেরে, প্রশ্নের উপর প্রশ্ন দিয়ে আমি জানতে চাইলেম, রেবতীকে আমি জিজ্ঞাসা কোল্লেম, “কি তোমার কথা?”

মুখখানি একটু ম্লান কোরে রেবতী তখন বোল্লে, “কথা আমার আর কিছুই নয়, হাকিমের লোকেরা আমাদের বড়বাবুটিকে ধোরেছে, আড়াল থেকে শুনে শুনে কথার ভাবে আমি বুঝতে পেরেছি, হাকিমবাবুটি তোমার খুব বশীভূত; আমাদের বাবুটিকে হাকিম যেন ছেড়ে দেন, বিনা দোষে কোন রকম শাস্তি না দেন, এইটি আমার কথা। চোর হলো চণ্ডেশ্বর, চোর হলো তার দলের লোকেরা, আমাদের বাবু কি অপরাধে ধরা পড়েন, বাবু আমাদের নেহাৎ ভালমানুষ। যে যা বলে, তাই তিনি শোনেন, তাই তিনি করেন, এই তাঁর দোষ। তুমি বাছা, বাবুটিকে খোলসা কোরে দিও, সৰ্বমঙ্গলা তোমার মঙ্গল কোরবেন।”

সৰ্বমঙ্গলাকে স্মরণ কোরে আশ্বাসবাক্যে আমি বোল্লেম, “তোমাদের বৌমাটি সৰ্বমঙ্গলা, সেই সৰ্বমঙ্গলার পূণ্যবলে সকল দিকে মঙ্গল হবে, তোমাদের অমরকুমারীকে শ্রীবিষ্ণঃ!—তোমাদের ব্রজকিশোরীকে জিজ্ঞাসা কর, চণ্ডেশ্বরের সঙ্গে তোমাদের বাবুর বন্দোবস্তের কথাটা সত্য কি না? সে কথা যদি সত্য না হয়, রমণীবাবু বেকসুর খালাস পাবেন; ধনঞ্জয় ঘটক বন্দোবস্তের কথা প্রকাশ কোরেছে, তাতে বাবতে ৫০০৲ টাকা বখরা পাবে, এই কথা বোলেছে; এ কালের ঘটকেরা সব বলে; এখনকার ঘটকেরা প্রায়ই মিথ্যাবাদী হয়, আদালতেও তার প্রমাণ আছে। বাবু যদি ধনঞ্জয়ের কথাটা মিথ্যা বলেন, তা হোলে বাবুর নামে কোন দোষ দাঁড়াতে পারবে না।”

হাঁ কোরে আমার কথাগুলি শুনে রেবতী যেন সকল কথার সারমর্ম অক্ষরে অক্ষরে গ্রাস কোল্লে; কিন্তু অন্যকথার দিকে বেশী মনোযোগ না রেখে, বিস্মিত নয়নে অমরকুমারীর দিকে একবার চেয়ে, সমষ্টিতে আবার আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে, সমান বিস্ময়ে বোল্লে, “কে গা তুমি হরিদাস? কোথা কে তুমি এসেচ? আমাদের বৌমাটি সৰ্বমঙ্গলা সে কথা তুমি কেমন কোরে জানলে?”

কথাও সত্য। রেবতীর বৌমাটিকে আমি কেমন কোরে জানলেম? আমার কথা শুনে রেবতীরও যেমন বিস্ময়, অমরকুমারীরও তদ্রূপ বিস্ময়। সে বিস্ময় ভঞ্জন করবার কৈফিয়ৎ কি?

অবসর মন্দ নয়। সত্য কৈফিয়তেই এখানে কাজ হবে। রেবতীর বিস্ময়সচক প্রশ্নে প্রথমে উত্তর না দিয়ে অমরকুমারীকে আমি জিজ্ঞাসা কোল্লেম, “সে রাত্রে সেই যে সেই বিদেশিনী ঘরের ভিতর ঘোমটা দিয়ে তোমার সঙ্গে কথা কোয়েছিল, তুমি কি সেই বিদেশিনীকে তখন চিনতে পেরেছিলে?”

অমরকুমারী বোল্লেন, “তাও কি তুমি সম্ভব মনে কর? কখন যারে দেখি নাই, ঘোমটাতেই যার মুখ ঢাকা ছিল, তারে আমি চিনবো এমন কথা কেন তোমার মনে এলে? কি ভেবেই বা তুমি জিজ্ঞাসা কোল্লে?”

মৃদু হাস্য কোরে আমি বোল্লেম, “বৌমাকে আমি কেমন কোরে জেনেছি, রেবতী আমার মুখে সেই কথা শুনতে চায়; বিদেশিনীকে তুমি চিনতে পোরছিলে কি না, কেমন কোরে তেমন কথা আমার মনে এলো, আমার মুখে তুমি সেই কথা শুনতে চাও; সমস্যা বিষম। অমরকুমারী! এ সমস্যা-পূরণে আমি যদি এখন হৃদয়-কপাট মুক্ত করি, তোমরা উভয়েই মহা বিস্ময়াপন্ন হবে।”

বক্রনয়নে আমার দিকে দৃষ্টিপাত কোরে অমরকুমারী বোল্লেন, “আমার আর এখন মহা বিস্ময়াপন্ন হবার কিছুই বাকী নাই, এ সকল মহা বিস্ময়ের শেষ কত দূরে, তাও এখন আমি জানতে পাচ্ছি না। এই বিস্ময়ের উপর যদি আবার নূতন বিস্ময় উৎপাদন কোরে দাও, তাতে আমি অভিভূত হব না। যেটা যখন অভ্যাস হয়ে আসে, যতই ভয়ঙ্কর হোক, যতই কষ্টকর হোক, যতই বিস্ময়কর হোক, তাতে আর ততটা গুরত্ব থাকে না। তুমি বল, রেবতী যে কথা তোমারে জিজ্ঞাসা কোরেছে, সে কথার উত্তরে যা তুমি বোলতে চাও, প্রকাশ কোরে বল, বিস্ময়কে আলিঙ্গন কোত্তে আমি ভালবাসি।”

বাবু মণিভূষণ আমাদের তিনজনের ঐরূপ রহস্যোক্তি একমনে শ্রবণ কোচ্ছিলেন, কি যে সে সব কথা, সে সব কথার মর্মই বা কি, কিছুই তিনি অবধারণ কোত্তে পাচ্ছিলেন না; তাঁর মুখের ভাব দেখে, আমি বুঝতে পাচ্ছিলেম, বাজে কথা মনে কোরে তিনি একটু একটু বিরক্ত হোচ্ছিলেন। যাঁরা বিরক্ত হন, তাঁরা বিরক্ত থাকুন, মণিভূষণকে বিরক্ত রেখে অমরকুমারীকে আমি বোল্লেম, “অমর! এক বিষয়ে তোমাদের উভয়েরই আগ্রহ; তোমরা উভয়েই শ্রবণ কর। আমিই সে বিদেশিনী।”

আমার মুখের দিকে চেয়ে রেবতী অবাক, রেবতীর মুখের দিকে চেয়ে অমরকুমারী চমকিতা, আমার মুখের দিকে চেয়ে মণিভূষণের চক্ষু নির্নিমেষ। তিনজনেই নিৰ্বাক। আমি বোলতে লাগলেম, “সত্য অমরকুমারী! আমিই সেই বিদেশিনী। তোমার অন্বেষণে নানা স্থানে ঘুরে ঘুরে শেষে আমি মাণিকগঞ্জে উপস্থিত হই, জলের ঘাটে নারীবেশে রেবতীর সঙ্গে দেখা হয়; রেবতী আমারে বিদেশিনী পরিচয়ে বৌমার কাছে নিয়ে যায়, সেইখানে আমি বৌমাকে দেখি, স্নেহ-বাৎসল্য-মাখা মধুর বচনগুলি শ্রবণ কোরে অপ্রত্যাশিত স্নেহ-দয়া প্রাপ্ত হয়ে, বৌমার প্রতি আমার ভক্তি হয়। তার পর তোমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবার অভিলাষ প্রকাশ করি। তুমি দর্শন দাও, চিনতে পার কি না পার, পরীক্ষার জন্য সেই সময় আমি অবগুণ্ঠন ধারণ কোরেছিলেম।”

ঘন ঘন করতালি দিয়ে অমরকুমারী ঘন ঘন হাস্য কোত্তে লাগলেন। সমভাবে নিৰ্বাক থেকে রেবতী কেবল ঘন ঘন আমার দিকে দৃষ্টিপাত কোত্তে লাগলো, মণিভূষণ বিস্ময় প্রকাশ কোরে বারংবার আমারে বাহাদুরী দিলেন। কোন দিকেই আমার মন থাকলো না, আমি বোলতে লাগলেম, “অমরকুমারী! লোকমুখে কিছু কিছু, সন্ধান পেয়ে তোমারে দর্শন করবার জন্য নারীবেশে সেই বাড়ীতে আমি গিয়েছিলেম। তোমরা হয় তো মনে কোচ্ছ কৌতুক, মণিভূষণ মনে কোত্তে পারেন কৌতুক, রেবতী মনে কোত্তে পারে কৌতুক, কিন্তু তুমি পার না। অমরকুমারী! নারীবেশে সাজিয়ে দিয়ে বীরভূমে তুমি আমার প্রাণরক্ষা কোরেছিলে, নারীবেশে মাণিকগঞ্জে আমি তোমার উদ্ধারকামনায় গৃহস্থ লোকের অন্দরমহলে প্রবেশ কোরেছিলেম; ন্যূনকল্পে কৃতকার্য হয়েছি; নারীবেশকে নমস্কার করি। সংসারে নারীজাতি শক্তিরূপিণী; নারী যদি মহাশক্তির অনুগ্রহে নিজশক্তি পরিচালন করেন, সংসারের সকল কার্যই শুভ হয়; সৰ্বদা সকল স্থলেই সে শক্তির উচিত ব্যবহার হয় না বোলেই অনর্থ ঘটে। রমণীবাবুর সহধর্মিণীকে ভক্তির চক্ষে আমি দর্শন কোরেছি; দয়ার চক্ষে রেবতীকে আমি দর্শন করি, স্নেহের চক্ষে তোমারে আমি দর্শন করি, হৃদয়ে অহরহ তোমার মূর্তি ভাবি; শক্তিপূজায় সর্বদা আমার আনুরক্তি, শক্তির কৃপাতেই স্ত্রীবেশধারণে আমার মঙ্গল ফললাভ হয়েছে। মুখে সামান্য অবগঠন ছিল, সেইজন্য তুমি আমারে চিনতে পার নাই।”

অকস্মাৎ অমরকুমারীর মুখমণ্ডল রক্তিম আভায় রঞ্জিত হয়ে উঠলো। স্ত্রীজাতিসূলভ গৌরবে স্ফূর্তিমতী হয়ে গৌরবিণী বোল্লেন, “আমি তোমারে চিনতে পেরেছিলেম। অবগুণ্ঠনে মুখখানি ঢাকা ছিল, কণ্ঠস্বর ঢাকা ছিল না; কণ্ঠস্বরে অনেকবার আমি মনে কোরেছিলেম, হরিদাসের কথা, শুধু মনে করাই তখন সার হয়েছিল, মনের কথা ফুটে বলবার সুবিধা ঘটে নাই; কিন্তু আমি চিনেছিলেম।”

আমাদের উভয়ের মুখের দিকে চেয়ে, অমরকুমারীকে লক্ষ্য কোরে, চঞ্চলস্বরে রেবতী বোল্লে, “তুমি চিনতে পেরেছিলে, আশ্চর্য কথা নয়, হরিদাসকে তুমি অনেকবার দেখেচ, অনেকবার হরিদাসের মুখের কথা তুমি শুনেচ, ঘোমটার ভিতর থেকে কথা কোইলেও আওয়াজ তুমি বুঝতে পেরেছিলে, প্রকাশ কর নাই, এ কথাও অসম্ভব হতে পারে না; আমি—আমিও কিন্তু হরিদাসকে চিনিচি। সেই রাত্রে নারীবেশধারী হরিদাসের গুটিকতক, কথা আমি শুনেছিলেম, কণ্ঠস্বর আমার মনে ছিল, আজ যখন হরিদাসের মুখের কথা শুনি, তখনি মনে হয়েছিল, এখনো শুনচি, এখনো মনে হচ্ছে, সেই বিদেশিনীর কথা আর হরিদাসের কথা ঠিক একরকম; গলার সুরও যেমন, মিষ্ট মিষ্ট কথাগুলিও সেই রকম। হরিদাস তোমারে উদ্ধার কোল্লেন, তুমি সুখী হোলে, কিন্তু তোমরা আমাদের ফেলে চোলে যাবে, তাই মনে কোরে আমার প্রাণ কেমন কোচ্চে।”

অমরকুমারীর সঙ্গে রেবতীর এই রকম কথা, তার পর আমারে সম্বোধন কোরে রেবতী পুনৰ্বার বল্লে, “দেখ বাবা! দেখ হরিদাস! আমার কথাটি ভুলে থেকো না; আমাদের বাবুটি যাতে কোরে কোন বিপদে না পড়েন, তাঁরে যাতে আসামী হোতে না হয়, এই উপকারটি তুমি কোরো।”

“বাবু যদি কোন দোষে লিপ্ত না থাকেন, হাকিমের বিচারেই তিনি নিষ্কৃতিলাভ কোরবেন, এই আমার বিশ্বাস। তিনি বিপদে পড়েন, তেমন ইচ্ছা আমার নয়। তাঁর অনুকলে হাকিমকে কথা বলা যদি আমার আবশ্যক হয়, অবশ্য তা আমি বোলবো। সেজন্য তুমি ভেবো না।”—রেবতীকে এই রকমে আশ্বস্ত কোরে মণিভূষণের সঙ্গে উপস্থিত ক্ষেত্রের কথোপকথনে আমি প্রবৃত্ত হোলেম।

ঢাকা শহরের সদরঘাটে আমাদের তরণী পৌঁছিল। রাত্রিকাল। সঙ্গে স্ত্রীলোক, কোথায় যাওয়া যায়? বেশীক্ষণ চিন্তা কোত্তে হলো না। ডেপুটিবাবু ব্রাহ্মণ। আমাদের প্রতি তাঁর যত্নও যথেষ্ট। রাত্রিকালে তাঁর বাড়ীতেই আমরা উঠলেম। বিনা কষ্টে নিরুদ্বেগে সেই বাড়ীতেই আমরা রাত্রিযাপন কোল্লেম। আমি মনে কোরেছিলেম, হয় তো অমরকুমারীকে নিয়ে আদালতে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের সমীপে উপস্থিত হোতে হবে, সেখানে হয় তো শাখাপল্লব-সম্বলিত আসল মোকদ্দমার আসল বিবরণ এজাহার কোত্তে হবে, কিন্তু ডেপুটিবাবুর অনুগ্রহে সে কষ্টটা আমাদের স্বীকার কোত্তে হলো না; ডেপুটিবাবু নিজেই উপরওয়ালার কাছে রিপোর্ট দিলেন, অপহৃতা কন্যাকে উদ্ধার করা হয়েছে; কন্যা মুর্শিদাবাদে যে বাড়ীতে ছিল, সেই বাড়ীর অধিকারীর উপযুক্ত পুত্র মণিভূষণ দত্ত, সেই মণিভূষণের হস্তে কন্যাটিকে সমর্পণ করা হয়েছে, এই মর্মে রিপোর্ট। সে রিপোর্টে আরো লেখা ছিল, মূল আসামী নিরুদ্দেশ; সম্ভবতঃ যোগের আসামী রমণীবল্লভ ভৌমিক, ধনঞ্জয় ঘটক, আর বংশীধর পোদ্দার, এই তিনজনকে আদালতে উপস্থিত করা হয়েছে।

আমাদের আর আদালতে যেতে হলো না, ডেপুটিবার বাড়ীতেই এক দিন এক রাত্রি আমরা বাস কোল্লেম। রাত্রিকালে ডেপুটিবাবু আমারে নিজগৃহে আহ্বান কোরে বল্লেন, “অমরকুমারীকে নিয়ে তোমরা দেশে যাও, এখানকার পুলিশের একজন প্রহরী তোমাদের নিরাপদের জন্য সঙ্গে থাকবে; চণ্ডেশ্বর, গণেশ্বর আর মিয়াজান, এই তিনজনের নামে গ্রেপ্তারী পরোয়ানা জারি হচ্ছে; তারা গ্রেপ্তার হয়ে এলে মুর্শিদাবাদে চালান হবে; মূল মোকদ্দমা মুর্শিদাবাদে; শাখা-মোকদ্দমার বিচার এখানে হবে না। রমণীবল্লভ, ধনঞ্জয়, আর বংশী পোদ্দার এই তিনজনের হাজার টাকা তাইনে মুছলকা নিয়ে আপাততঃ তাদের খালাস দেওয়া হলো। তারা যদি মূল আসামীদের হাজির কোতে পারে, যোগাযোগ যদি প্রমাণ না হয়, তবে তারা আসামী-শ্রেণীভুক্ত হবে না। মোকদ্দমা বিচারের সময় তাদের কিন্তু একবার মুর্শিদাবাদে যাওয়া আবশ্যক হবে। তোমরা এখন দেশে যাও।”

সে রাত্রের এই পর্যন্ত কথা। পরদিন প্রভাতে আমরা মাণিকগঞ্জে যাত্রা কোল্লেম। রেবতী তখন আর আমাদের তরণীতে থাকলো না। বাবুদের নৌকাতেই তারে যেতে হলো। বাবুদের নৌকায় রমণীবাবু ধনঞ্জয় আর বংশীধর, সেই নৌকায় রেবতী।

আমাদের কাছে বিদায় নিয়ে রেবতী যখন বাবুদের নৌকায় যায়, চক্ষে অঞ্চল দিয়ে রেবতী তখন কেঁদে গেল। কিসের মায়ায় রেবতী কাঁদলো, তা আমি বুঝতে পাল্লেম। অমরকুমারীকে ভালবেসেছিল, অল্পক্ষণের পরিচয়ে আমার প্রতিও একটু স্নেহ বোসেছিল, বিশেষতঃ আমিই যেন তার বাবুটিকে আপাততঃ অব্যাহতি দিবার হেতু হোলেম; এই তিন কারণে, আমাদের বিরহে, আর বাবুর খালাসের আনন্দে রেবতী সেই সময় কেটে গেল। কথাবার্তার ভাবে আমি বুঝেছিলেম, রেবতীর শরীরে মায়া-মমতা কিছু বেশী।