» » » তৃতীয় কল্প : আর এক আবর্তন

বর্ণাকার

ভূবনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়

হরিদাসের গুপ্তকথা
দ্বিতীয় খণ্ড

তৃতীয় কল্প : আর এক আবর্তন

ভারতবর্ষের উত্তরে গিরিরাজ হিমালয়; পুরাণে পাওয়া যায়, হিমালয়ের উপর দিয়ে স্বর্গে যাবার পথ। আমি মাণিকগঞ্জের উত্তরে এসেছি; এখানে স্বর্গের পথ নাই; এখানে যদি আমি অমরকুমারীর সন্ধান পাই, এখানে যদি আমি অমরকুমারীর দর্শন পাই, তা হোলে এই স্থানকেই আমি স্বর্গধাম বিবেচনা কোরবো। যেখানে অমরকুমারী আছেন, সেই স্থানটি আমার পক্ষে স্বর্গ। কেন না, অমরকুমারী আমার হৃদয়-মন্দিরের দেবী। যেখানে দেবীর অধিষ্ঠান, সেই স্থানটিই সুপবিত্র ধর্গধাম।

মাণিকগঞ্জের উত্তরসীমা অতিক্রম কোরে অনেকদূর আমি এসেছি; সীমা অতিক্রম হয়ে গেছে, তথাচ আমি মাণিকগঞ্জে। উত্তরদিকের এই অংশে পথের ধারে ধারে বড় বড় প্রাচীন বৃক্ষ, স্থানে স্থানে বড় বড় বাগান; এক একটা বাগানের মাটি আচোট; বোধ হয়, সে মাটিতে হল-লাঙ্গল বিদ্ধ হয় না; বৃক্ষগুলিও নিস্তেজ; প্রায় সমস্ত বৃক্ষের পত্রগুলি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র,— রৌদ্রপক্ক,— অধিকাংশ পীতবর্ণ। এক একটি বৃক্ষ এককালে পত্রশুন্য; সর্ব্বাঙ্গে অর্দ্ধশুষ্ক মোটা মোটা গুলঞ্চলতা পরিবেষ্টিত; হঠাৎ দেখলে বোধ হয় যেন দীর্ঘবাহু দীর্ঘকায় দৈত্যকলেবরে বড় বড় অজাগর সর্প বেষ্টন কোরে রয়েছে। বৃক্ষরাজির তলভাগ অপরিষ্কার নয়; কেবল এক এক স্থানে বায়ুপ্রেরিত অর্দ্ধ-শুষ্ক পক্কপত্রের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্তূপ, অন্য কোনপ্রকার তৃণকণ্টকাদি সেখানে দৃষ্ট হয় না। স্থানে স্থানে বড় বড় পুষ্করিণী; অবস্থাদর্শনে বোধ হয়, বহুদিন বিনা সংস্কারে অল্পতোয়া, ঠাঁই ঠাঁই চড়া পড়া, ঠাঁই ঠাঁই হেলঞ্চকলম্বী দল জমাটবাঁধা; চড়ার উপর গরু চরে, ছাগল চরে, মৎস্যশীকারী দীর্ঘচঞ্চু সতর্ক সতর্ক বিহঙ্গেরা দামের ঝোপে গা-ঢাকা হয়ে একটু দূরস্থ নির্ম্মল জলে শীকার লক্ষ্য করে; অনেকগুলি দীর্ঘ সরোবরের এইরূপ অবস্থা। সময়ে দুই তিন দিক দিয়ে ভাল ভাল ঘাট বাঁধা ছিল, সে সকল ঘাট এখন ভগ্নদশা প্রাপ্ত হয়ে বৃহৎ বৃহৎ কুম্ভীরের চর্ম্মশূন্য দন্তপাতির ন্যায় বিকটদর্শন হয়ে আছে; এক এক সরোবর তীরে ভগ্নচূড়, ভগ্নগাত্র, ভগ্নসোপান বড় বড় শিবমন্দির, মন্দিরের নিকটে নিকটে ছোট ছোট পুষ্পকুঞ্জ,—কেবল কুঞ্জগুলিই ছোট ছোট, তাই নয়, কুঞ্জতরুগুলিতে যে সকল ফুল ফুটে আছে, সেই সকল ফুলগুলিও ছোট ছোট, বঙ্গের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বালিকা-বিধবার ম্লানমুখের প্রায় অর্দ্ধশুষ্ক মলিন মলিন। একটু দূরে থেকে সে সকল ফুলের আঘ্রাণও পথিকলোকের নাসারন্ধে প্রবেশ করে না। মাণিকগঞ্জের এই অংশে প্রকৃতির এইরূপ মলিনমতি দর্শনে মনে হয়, স্থানের পূৰ্ব্বসমৃদ্ধির পরিচয় দিবার জন্যই ঐ নিদর্শনগুলি এখনো জেগে আছে, পূর্ব্বস্মৃতি জাগিয়ে রেখেছে। দেখলেই কষ্ট হয়।

গ্রামের মধ্যে আমি প্রবেশ কোল্লেম। গ্রাম নিতান্ত ক্ষুদ্র নয়। অনেকগুলি বড় বড় বাড়ী জনশূন্য হয়ে খাঁ খাঁ কোচ্ছে। ইমারতের উপর বৃক্ষলতার সঙ্গে বনজন্তু বাসা কোরেছে। দেয়াল, খিলান, প্রাচীর ঠাঁই ঠাঁই ভেঙে ভেঙে পোড়েছে; এক একখানি বাড়ীতে দুটি পাঁচটি নরনারী দৃষ্ট হয়, সে সকল বাড়ীর পূৰ্ব্বাবস্থা নাই, দেখলেই বোধ হয়, ভূতের বাসা; কিন্তু অধিকারীরা সজীব। স্থানে স্থানে তৃণাচ্ছাদিত কুটীর। সে সকল কুটীরে গৃহস্থ আছে, কিন্তু সকলেই ম্রিয়মাণ, গ্রাম্য কোলাহল শ্রুতিগোচর হয় না, বালক-বালিকার আনন্দধ্বনি শুনা যায় না, যদি কিছু শুনা যায়, সে কেবল সায়ং-শৃগালের চীৎকারধ্বনির ন্যায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শিশুর ক্রন্দনধনি।

বিষণ্ণনয়নে ইতস্ততঃ দৃষ্টিসঞ্চালন কোত্তে কোত্তে বিষণ্ণবদনে বিষণ্ণহৃদয়ে মন্থরগতিতে আমি অগ্রসর হোতে লাগলেম। পথে এতক্ষণ একটিও মনুষ্য দৃষ্ট হয় নাই, এই সময় আমার সম্মুখে দুটি লোক। গ্রামের যেরুপ দুরবস্থা দর্শন কোল্লেম, লোক-দুটির পরিচ্ছদে, চেহারায়, কথোপকথনে সে অবস্থার প্রতিরূপ দৃষ্ট হলো না। লোকেরা পরষ্পর বলাবলি কোচ্ছে, শুষ্কমালঞ্চে এমন সুন্দর ফুল কেমন কোরে ফুটেছে? একজন বোল্লে, “প্রকৃতির খেলা। এক একটি ফুলগাছে যখন ফুল হয়, তখন সে সকল গাছে একটিও পাতা থাকে না; শুঙ্কবৃক্ষে সুবাসিত সুন্দর পুষ্প প্রস্ফুটিত হয়ে সুগন্ধে দশদিক আমোদিত করে। অমন যে দেবদুর্ল্লভ পদ্মফুল, ঘৃণাকর কর্দর্য পঙ্কে সেই পদ্মফুলের জন্ম!” যে মুখের এই কথা, বিস্মিত নয়নে সেই মুখের দিকে চেয়ে দ্বিতীয় ব্যক্তি বোল্লে, “তাই ত ভাই! তুমি ঠিক কথা বোলেছে! শুষ্কবৃক্ষে সুন্দর ফুল! পঙ্কহ্রদে পদ্মফুল! তেমন সুন্দরী মেয়েটি এমন জায়গায় কেমন কোরে এলো? যারা এনেছে, তারা কম লোক নয়! যেমন জায়গায় শোভা পায়, তেমন জায়গায় রাখলে দশজনের চক্ষে পোড়বে, দশজনের চক্ষে পড়ে, সেটা তাদের মতলব নয়, নিশ্চয়ই দুষ্ট মতলব!”

প্রথম ব্যক্তি একটু দম্ভ কোরে বোল্লে, “সে কথা আর বোলতে? ভয়ানক দুষ্ট মতলব! জান না বুঝি তুমি? শুনেনি বুঝি কিছু? মেয়েটিকে তারা বেচে ফেলবে! দাম ধার্য্য হয়েছে দু হাজার টাকা! ও পাড়ার সেই বংশী পোদ্দার দু হাজার টাকা পণ দিয়ে সেই মেয়েটিকে কিনে নিবে। কথাবার্ত্তা সব ঠিকঠাক হয়ে গিয়েছে, কেবল লেখাপড়া বাকী। লোকে যেমন দলীল লিখে দিয়ে জমি-জায়গা বিক্রী করে, সেই মেয়েটিও সেই রকমে খোস-কওলায় বিক্ৰী হবে! বংশী পোদ্দারের বড়ই কপালজোর! দু হাজার টাকায় সাক্ষাৎ লক্ষ্মী নিয়ে ঘরে বাঁধবে!”

এই সব কথা বলাবলি কোত্তে কোত্তে সেই দুটি লোক সরাসর পশ্চিমদিকে চোলে গেল। আমি বোলেছি, দুটি লোক আমার সম্মুখে। ঠিক সম্মুখে নয়, তারা যখন আসে, আমি তখন একটা প্রকাণ্ড বৃক্ষের অন্তরালে দাঁড়িয়ে ছিলেম, লোক-দুটিকে দেখে আরও একটু সাবধান হয়ে লুকিয়ে ছিলেম; তারা আমারে দেখতে পায় নাই, আমি কিন্তু তাদের ঐ কথাগুলি স্পষ্ট শুনে রেখেছি। আমার চক্ষু বরং সকলদিকে ঘোরে না, কর্ণ কিন্তু সকলদিকেই থাকে। একটু নিকটে দু-তিনজনে ফুসফুস কোরে কথা বোল্লে আমি শুনতে পাই; তাদের সব কথা আমি শুনতে পেয়েছি। তারা চোলে গেল; কথা বলাবলি কোত্তে কোত্তে অনেকদূর এগিয়ে গেল; শেষে তারা আর কি কি কথা বোল্লে, সেগুলি শুনতে পেলেম না।

পঙ্কজলে পদ্মফুল! কোন পদ্মের কথা এরা বোলে গেল?—বোধ হোচ্ছে যেন আমারি হৃদয়-সরোবরের পদ্মফুল! আমি যেন জানতে পাচ্ছি, এইখানেই আমার ইষ্টসিদ্ধির সম্ভাবনা আছে; আমার মন যেন আমারে বোলছে, এই গ্রামেই অমরকুমারী আছেন। একবার মনে হলো, পশ্চাতে ছুটে গিয়ে লোকদুটিকে জিজ্ঞাসা করি, কোথায় সেই পদ্মফুল;—কতদিন হলো সে পদ্ম এখানে ফুটেছে, বাহিরের লোকে যদি একবার সেই পুষ্পটি দর্শন কোত্তে অভিলাষী হয়, অভিলাষ পূর্ণ হোতে পারে কি না?

মনে হলো এই রকম, কিন্তু তাড়াতাড়ি কার্য্য করা ভাল নয়, এই বিবেচনায় লোক দুটির সঙ্গ আমি নিলেম না; গ্রামে যখন এসেছি, একটু সূত্র যখন পেয়েছি, তখন অবশ্যই অন্য কোন সূত্রে বিশেষ বৃত্তান্ত জানতে পারা যাবে, এইরূপ স্থির কোরে, বৃক্ষান্তরাল থেকে বেরিয়ে গ্রামের দিকে আরো খানিকদূর অগ্রসর হোলেম। সেদিকে ভাঙাবাড়ী কম, খানকতক ছোট ছোট নূতন বাড়ী কতক কতক ইষ্টকালয়, কতক কতক তৃণপত্রালয়। রাস্তার বামদিকে পূৰ্ব্ব-পশ্চিমে লম্বা একখানা বৃহৎ বাড়ী দেখতে পেলেম, সেই বাড়ীখানা বহুদিনের পুরাতন, অর্দ্ধেকের অধিকাংশ অব্যবহার্য্য, পূৰ্ব্বদিকের অল্পাংশ মাত্র। নূতন মেরামত করা হয়েছে, কপাট-জানালা বদল করা হয় নাই, এক একটা জানালা গরাদে-শূন্য, কীট-জীর্ণ, ভগ্নকপাটে ঢাকা। বোধ হলো, সেই অংশে মানুষ আছে। ছাদের উপর থেকে লম্বিতভাবে খানকতক ধুতিশাড়ী রবিতাপে বিস্তৃত ছিল, সেই নিদর্শনেই আমি বুঝলেম, সেই অংশে মানুষ আছে। একটু তফাতে দাঁড়িয়ে সেই বাড়ীখানার দিকে আমি চেয়ে চেয়ে দেখতে লাগলেম। দাঁড়িয়ে আছি, এমন সময় দেখি একজন অর্দ্ধবৃদ্ধ ব্রাহ্মণ একটি গাভীর বন্ধনরঞ্জু ধারণ কোরে সেই পথ দিয়ে চোলে আসছে, আমার নিকটবর্ত্তী হোলে কথা কবার ইচ্ছায় সেই ব্রাহ্মণকে আমি জিজ্ঞাসা কোল্লেম, “এ বাড়ীখানি কার?”

ব্রাহ্মণ খানিকক্ষণ নীরবে আমার মুখপানে চেয়ে থাকলেন, পূর্ব্বেবঙ্গের ভাষা, পূৰ্ব্ববঙ্গের সুর সৰ্ব্বদা শ্রবণ করা আমার অভ্যাস ছিল না, অনুকরণ করাও আমার পক্ষে কঠিন ছিল, সুতরাং সেই ব্রাহ্মণ আমারে হয় তো পশ্চিমদেশী বোলে অবধারণ কোল্লেন; আমার প্রশ্নের উত্তর দিলেন না। তার পর যখন আমি দ্বিতীয়বার সেই ভাবে সেই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা কোল্লেম, তখন তিনি দেশীয় সুরে একটু শীঘ্র শীঘ্র বোল্লেন, “বাবুদের বাড়ী। বাবুরা পূর্ব্বে এখানকার বিখ্যাত জমিদার ছিলেন, প্রজা-লোকেরা এই বাড়ীর কর্ত্তাকে রাজা বোলে গৌরব কোত্তো, বাড়ীখানারও নাম ছিল রাজবাড়ী। বাবুদের বহু গোষ্ঠী, ক্রমে ক্রমে যমদণ্ডে বংশ প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, জমিদারীও বিক্রি হয়ে গিয়েছে, এখন আছে কেবল তিনটি বাবু আর গুটিকতক বিধবা। অতি কষ্টে দিন চলে। বাবু তিনটির মধ্যে দুটি এখনো নাবালক, যিনি এখন কৰ্ত্তা, তিনিই ঐ নাবালক ভাইদুটির অভিভাবক। কর্ত্তার নাম রমণীবল্লভ ভৌমিক।” ঐ পর্য্যন্ত পরিচয় শ্রবণ কোরে, ব্রাহ্মণের হাত থেকে গরুর দড়িগাছটি গ্রহণ কোরে, পথের ধারের একটা গাছের ডালে আমি বেঁধে রাখলেম; মনে কেমন এক প্রকার নূতন রকম উৎসাহ এলো। ব্রাহ্মণকে আমি জিজ্ঞাসা কোল্লেম, “বংশী পোদ্দারের বাড়ী এখান থেকে কত দূর?”

আমার প্রথম প্রশ্ন শ্রবণে ব্রাহ্মণ যেমন চকিতনেত্রে আমার বদন নিরীক্ষণ কোরেছিলেন, এবারেও সেই ভাব। ব্রাহ্মণ নিরুত্তর। ভাবের ভাব শীঘ্র আমি বুঝতে পাল্লেম না। সেই পুরাতন বাড়ীর ছাদের কাপড়গুলি বাতাসে উড়ে উড়ে নৌকার পালের মত ফুলে ফুলে উঠছিল, অন্যমনে সেই দিকে চেয়ে চেয়ে, জোরে একটি নিশ্বাস ফেলে ব্রাহ্মণ আমারে জিজ্ঞাসা কোল্লেন, “তুমি বুঝি হুগলীজেলার ছেলে?”

আমার প্রতি এই প্রকার অদ্ভুত প্রশ্ন হবে, ঐরুপ উদ্ভট প্রশ্নের উত্তর আমারে দিতে হবে, সে জন্য আমি প্রস্তুত ছিলেম না; কাজেই ছাড়া ছাড়া উত্তর দিলেম, “কোন জেলার ছেলে আমি, তা আমি বোলতে জানি না; থাকি এখন মুর্শিদাবাদজেলায়; বহরমপুর থেকে এসেছি, মাণিকগঞ্জের বংশী পোদ্দারের বাড়ী এখান থেকে কতদূর—”

দুই তিনবার মস্তকসঞ্চালন কোরে ব্রাহ্মণঠাকুর বল্লেন “হুঁ—হুঁ—হুঁ! বংশী পোদ্দারকে এখন অনেক ছেলেই খুঁজবে! বংশী পোদ্দারের এখন জোরকপাল!”

আমি।—কেন মহাশয়? বংশী পোদ্দারের জোরকপাল কি জন্য?

ব্রাহ্মণ।—জন্যটা আমি এ জায়গায় বোলতে ইচ্ছা করি না। পথের মাঝখানে সব কথা গল্প করা ভাল নয়। তুমি দেখছি বংশীর একজন কুটম্বের ছেলে হবে, তোমার কাছে বোলতে পারি, কিন্তু এখানে পারি না। ঐ বাগানের ভিতর একখানি আটচালা ঘর আছে, সেইখানে চল। গরুটি আমার এইখানেই বাঁধা থাক।

আমি।—(ব্রাহ্মণের সঙ্গে বাগানের আটচালার বারান্দায় গিয়া) কি মহাশয়, বংশীর কপালের কথা কি রকম?

ব্রাহ্মণ।—কে জানে বাপ, কপালের কথা কেহই বোলতে পারে না। বংশী পোদ্দার যতদিন সোণা-রুপা বিক্রি কোত্তো, চোরেদের কাছে চোরামাল কিনে কিনে রাখতো, সেই বংশী এবার একটি মা-লক্ষ্মী কিনে ফেলবে।

আমি।—মা-লক্ষ্মী কেনা কি রকম?

ব্রাহ্মণ।—কে জানে বাপ! কোথাকার কারা আমাদের এই গ্রামে একটি মা-লক্ষ্মী এনে রেখেছে, মা-লক্ষ্মীর হাতে পায়ে পদ্মফুল থাকে, এ লক্ষ্মীটির আপাদমস্তক সর্ব্বাঙ্গ পদ্মফুলে গড়া!

আমি।—বংশী পোন্দার সেই পদ্মফুলের লক্ষ্মীটিকে কার কাছে কিনলে?

ব্রাহ্মণ।—কে জানে বাপু! কারা সব এসেছিল, তারা সব লক্ষ্ম-ব্যাপারী দরদস্তুর হয়ে গিয়েছে, দু হাজার টাকা পণ!

আমি।— ব্যাপারীরা এখন আছে কোথা?

ব্রাহ্মণ।— কে জানে বাপু! কোথা তারা চোলে গিয়েছে, এই মাসের শেষাশেষি এসে কাজটা নির্ব্বাহ কোরে দিয়ে যাবে, এই রকম আমি শুনেছি।

আমি।—লক্ষ্মীটি এখন আছেন কোথায়?

ব্রাহ্মণ।—তা আমি তোমায় বোলবো না।

আমি।—লক্ষ্মীটির নাম কি?

ব্রাহ্মণ।—তাও আমি বোলতে পারবো না। আমি একজন সাক্ষী আছি। কেনা-বেচার কথা যখন স্থির হয়, বাড়ীর লোকেরা সেই সময় আমায় ডেকেছিল, আমি একজন ঘটক ব্রাহ্মণ, ঐ রকম কাজ আমার, তাই জন্য আমায় ডেকেছিল, ব্যাপারীরা আমাকে দুটি টাকা প্রণামী দিয়ে গিয়েছে, কথা প্রকাশ করা নিষেধ।

আমি।—(প্রণাম করিয়া) ঘটকঠাকুর আপনি? আপনাকে দণ্ডবৎ! দুটি টাকা তারা দিয়ে গিয়েছে, আমি আপনাকে পাঁচটি টাকা দিচ্ছি, দয়া কোরে সেই লক্ষ্মীর নামটি আমাকে বলুন।

ব্রাহ্মণ।—নাম আমি কিছুতেই বোলবো না। শেষব্যাপারের দিন ব্যাপারীরা আমাকে আরও দশ টাকা দিয়ে যাবে, অঙ্গীকার আছে।

আমি।—আচ্ছা, দশ টাকাই আমি দিচ্ছি, নামটি আপনি বলুন।

ব্রাহ্মণ।—বাপুরে! তাও কি হয়? ঘটক আমি হোতে পারি, বিশ্বাসঘাতক হোতে পারি না।

আমি।—আচ্ছা, লক্ষ্মীটি কোথায় আছেন, সে কথা আপনি বোলতে পারেন। তাতে আপনার কোন আপত্তি নাই? নাম দিলেও আপনি দশটাকা পাবেন, ঠিকানা দিলেও আপনি দশটাকা পাবেন, এখনি হাতে হাতে নগদ পাবেন; দুদিকেই আপনার লাভ; ঠিকানাটি আপনি বলুন।

ব্রাহ্মণ।—(হস্ত বিস্তার করিয়া) অগ্রে দক্ষিণা দাও, তার পর—

ক্রমশই বেলা বাড়তে লাগলো, ব্রাহ্মণের সঙ্গে বৃথা আর কথা-কাটাকাটি কোত্তে ইচ্ছা হলো না; টাকা আমার সঙ্গেই ছিল, ব্রাহ্মণের হস্তে তৎক্ষণাৎ আমি দশটি টাকা প্রদান কোল্লেম, প্রদান কোরেই ঠিকানাটি আবার জানতে চাইলেম।

টাকাগুলি খুব শক্ত কোরে কোঁচার কাপড়ে বেধে রেখে, প্রফুল্লবদনে ব্রাহ্মণ বোল্লেন, “ঠিকানাটি তুমি তো জানতে পেরেছ; তবে আর আমার মুখে নূতন শুনবার আকিঞ্চন কেন? বর্ণ অপেক্ষা চক্ষের গুণ বেশী।”

সবিস্ময়ে আমি মনে কোল্লেম, ঠকালে! ঠকালে! —ব্রাহ্মণ আমারে ঠকালে! ভারী ধূর্ত্ত! টাকাগুলি আগে হস্তগত কোরে এখন উলটো কথা বলে! বিস্ময় প্রকাশ কোরে তৎক্ষণাৎ তাঁরে আমি জিজ্ঞাসা কোল্লেম, “সে কি মহাশয়! ঠিকানা আমি জানতে পেরেছি, এটা আপনি কি রকম কথা বলেন? কি আমি জানতে পেরেছি? বংশী পোদ্দারের বাড়ী?”

ব্রাহ্মণ বোল্লেন “তা কেন? বংশী পোদ্দারের বাড়ী এ পাড়ায় নয়, সে বাড়ী এইখান থেকে দু তিন রশী দক্ষিণে। মা লক্ষ্মী এখন তত দূরে কেন যাবেন? নিকটেই আছেন।”

অধিক আগ্রহে তৎক্ষণাৎ আমি জিজ্ঞাসা কোল্লেম, “নিকটে কোথায় মহাশয়?”

ব্রাহ্মণ তখন যেন চঞ্চল হয়ে উত্তর কোল্লেন, “কেন? যে বাড়ীর সম্মুখে তুমি দাঁড়িয়ে ছিলে, যে বাড়ীর ছাদে সেই সকল কাপড় শুকুচ্ছে, সেই বাড়ী, সেই বাড়ীতেই এখন মা-লক্ষ্মীর অধিষ্ঠান। যাই আমি,—আমার মা-লক্ষ্মীর হয় তো জলতৃষ্ণা পেয়েছে, অনেকক্ষণ জল দেখানো হয় নাই, দু-বেলা দুসের দুধ হয়, তৃষ্ণার সময় জল খেতে না পেলে, দুধ কম হবে। আমি একটু একটু আফিং সেবা করি, দুগ্ধ বিহনে দম ফেটে মারা যাব! চোল্লেম।”

চঞ্চল হয়ে বাধা দিয়ে আমি বোল্লেম, “কিঞ্চিৎ অপেক্ষা করুন, একটু থাকুন, আমার আর একটি জিজ্ঞাস্য আছে, একটি মাত্র কথা। আপনার নামটি আমি জেনে রাখতে ইচ্ছা করি। যদি কোন বিশেষ আপত্তি না থাকে, অনুগ্রহ কোরে বলন, আপনার নামটি কি?”

“শ্রীধনঞ্জয় ঘটক ন্যায়ভূষণ।”—সংক্ষেপে এইমাত্র উত্তর দিয়েই ঘটকমহাশয় বাগান থেকে রাস্তায় বেরিয়ে এলেন, বৃক্ষশাখা থেকে দড়িগাছটি খুলে, গাভীটি নিয়ে অন্যদিকে চোলে গেলেন। ঐ গাভীটি তাঁর মা-লক্ষ্মী। আফিংখোর গোস্বামীদের কাছে দুগ্ধবতী গাভীগুলির যথেষ্ট আদর। আমি সন্তুষ্ট হোলেম। আশার অতিরিক্ত ফল আমি লাভ কোল্লেম। বংশী পোদ্দারের বাড়ীর তত্ত্ব লওয়া তখন আর অবশ্যক বিবেচনা কোল্লেম না; বেলা অধিক হয়েছিল, বাসায় ফিরে চোল্লেম।

বাসায় আমি পৌঁছিলেম। নিত্যই আমি বেড়াতে যাই। কোথায় গিয়েছিলেম, কি কি কাজ কোরে এলেম, কেহই কিছু জিজ্ঞাসা কোল্লেন না, কাহারও কাছে আমারে কিছু কৈফিয়ৎ দিতে হলো না, অধিক বেলায় স্নান আহার কোরে কিয়ৎক্ষণ বিশ্রাম কোল্লেম, বৈকালে আর কোথাও বেড়াতে বেরুলেম না, সামান্য সামান্য কার্যে দিনমান কেটে গেল।

রাত্রে আমার দৈনিক কার্যের আলোচনা। পতিতপ্রায় গ্রামে দুটি গ্রাম্যলোকের কথোপকথন। “কদর্য্য পঙ্কে পদ্মফুল,” এই কথা যখন তাঁরা বলেন, আক্ষেপ কোরে যখন তাঁরা সেই কথাটির একটু একটু ব্যাখ্যা করেন, তখনি আমি বুঝেছিলেম, আমার পদ্মমুখী অমরকুমারীই তাঁদের সেই রূপক-বর্ণিত পদ্মফুল। কোথায় সেই পদ্মফুল, সে ক্ষেত্রে সেটি আমি নির্ণয় কোত্তে পারি নাই। গ্রামের মধ্যে ফুটেছে, পূর্ব্বে ফুটে নাই, নূতন ফুটেছে, এইটুকু মাত্র বুঝেছিলেম; বিধাতার অনুগ্রহ, গো-স্বামী-ঘটকের সঙ্গে সাক্ষাৎ। পরে দুটি ভদ্রলোকের বাক্যসঙ্কেতে বংশী পোদ্দারের নাম পাওয়া গিয়েছিল, বংশী পোদ্দারের নামের উল্লেখ ধনঞ্জয় ঘটকের বাক্যঝুলীর গ্রন্থি শিথিল। অনেক তত্ত্ব অবগত হওয়া গেল। এখন যদি—কল্যই যদি আমি ঢাকায় চোলে যাই বহরমপুরের রূবকারি অবশ্যই এসেছে,—এখন যদি আমি ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে দাম কোরে মণিভূষণের দ্বারা পুলিস মোতায়েনের প্রার্থনা করি, মঞ্জুর হোতে পারে, অবশ্যই সে প্রার্থনা মঞ্জুর হবে, কিন্তু এখনো আমার সব অনুমানের উপর নির্ভর; আনুসঙ্গিক কতকগুলি তত্ত্ব যদিও এখন আমার পরিজ্ঞাত, তথাপি নামটি পাওয়া গেল না। পুলিশ মোতায়েন নিয়ে যদি আমি এখন সেই অন্ধভগ্ন বাড়ীতে রমণীবল্লভের অন্দরমহলে অমরকুমারীর অন্বেষণে যাই, সেই পদ্মফুলটি—ঘটকমহাশয়ের সেই লক্ষ্মীদেবীটি সত্য যদি অমরকুমারী না হন, তা হোলে পরিণাম কি দাঁড়াবে! পুলিসের লোকেরা ফিরে যাবে, ম্যাজিষ্ট্রেটের হুজুরে রিপোর্ট দিবে, দরখাস্তকারী মিথ্যাবাদী প্রতিপন্ন হবে, চক্রঘূর্ণনে শুভকল্পনা পেষিত হয়ে যাবে!—না, সে কাৰ্য ভাল নয়। সূক্ষ্মানুসূক্ষ্মরূপে মূলতত্ত্বটি জানা উচিত। রমণীবল্লভের বাড়ীর সেই পদ্মফুলটি সত্য সত্য আমাদের অমরকুমারী কি না, সৰ্ব্বত্র সৰ্ব্বপ্রযত্নে সেই তত্ত্বটি নিঃসন্দেহে নির্ণয় করা আবশ্যক।

নির্ণয় করবার উপায় কি?—হয় স্বচক্ষে অমরকুমারীকে দর্শন করা, না হয় অন্য কোন উপায়ে অন্য কাহার দ্বারা সেই বিদেশিনী কন্যার নামটি অবগত হওয়া। এই দুটি উপায় আছে; কিন্তু আপাততঃ ঐ দুইটি আমার পক্ষে অসম্ভব হোচ্ছে। আমি একজন অপরিচিত, নূতনলোকের বাড়ীর অন্দরে প্রবেশ কোরে একটি বিদেশিনী কুমারীকে দেখে আসবো, এ কথা মনে করাও পাগলামী; আমার হয়ে আর একজন সেই নামটি জেনে এসে আমারে জানাবে, এমন আশাই বা কি প্রকারে করা যায়? এ অঞ্চলে কেহই আমারে জানে না, কেহই আমারে চিনে না, কারেই বা আমি অনুরোধ কোরবো? কেই বা আমার কথা রাখবে? কেনই বা রাখবে? বড়ই গোলমালে ঠেকলেম। একগাছি সূক্ষ্ম সূতার উপর আমার তখনকার আশা-ভরসা ঝুলতে থাকলো।

আদালতের সাহায্য নিয়ে অমরকুমারীর অনুসন্ধানে আমি এসেছি, ক্রমশই দিন গত হোচ্ছে, আসল কাজ কিছুই হোচ্ছে না। মনে মনে আমি জানতে পেরেছি, তিনটি লোকের মুখে অবস্থাগত-প্রমাণে মনে মনে আমি বুঝতে পেরেছি, অমরকুমারী এইখানে আছেন; কিন্তু আমার মনের সঙ্গে আইন-আদালতের সম্পর্ক নাই। আইনের মানরক্ষা, আদালতের সন্তোষবিধান আর আমার অন্তরের শান্তিবিধান, এই তিনটি একত্র না হোলে কার্য্য সিদ্ধ হবে না, সকলেই এটি বুঝতে পাচ্ছেন। সে সিদ্ধি কত দূর?

আর তিন দিন অতিবাহিত। সে তিন দিন আমি কেবল উপায় অবধারণে ব্যাপৃত থাকলেম; বাসা থেকে কোথায়ও বাহির হোলেম না; যা কিছু জানতে পাচ্ছি, আপনার মনে মনেই রাখছি; হরিহরবাবুকেও জানাচ্ছি না, মণিভূষণকেও কিছু বোলছি না। এ ভাবটাও ভাল নয়। একজনের বুদ্ধিতে সকল যুক্তি যোগায় না, তন্নিমিত্তই অপরের পরামর্শগ্রহণ আবশ্যক হয়। আমি মনে কোল্লেম, যতটুকু জেনেছি, হরিহরবাবুকে বলি। আবার ভাবলেম, কাঁচাকথার উপর জোর দাঁড়াবে না, হরিহরবাবু আমার কথার উপর বিশ্বাসস্থাপন কোরবেন না, আমার কেবল কাঁচাবুদ্ধির পরিচয় দেওয়া হবে মাত্র; আর একটু অগ্রসর হওয়া ভাল; কি ভাবে অগ্রসর হওয়া যায়, সেটিও মনে মনে অবধারণ কোল্লেম।

মুর্শিদাবাদ থেকে যখন আমরা আসি, তখন তিন প্রস্থ ছদ্মবেশ, দুই যোড়া পিস্তল, আর গুলীবারুদ আমার সঙ্গে ছিল, এইবার ছদ্মবেশধারণের প্রয়োজন উপস্থিত। চতুর্থদিবসে অপরাহ্নে বাসা থেকে আমি বেরুলেম, একপ্রস্থ ছদ্মবেশ আমার সঙ্গে থাকলো। যে বাগানের আটচালায় ধনঞ্জয় ঘটকের সঙ্গে আমার কথাবার্ত্তা হয়েছিল, সন্ধ্যা হয় হয়, এমন সময় সেই বাগানে গিয়ে আমি পৌঁছিলেম। আটচালায় উঠলেম না, যে দিকে সারি সারি অনেকগুলি আম্রবৃক্ষ, সেই দিকে গিয়ে অতি সাবধানে বসন-পরিবর্ত্তন কোল্লেম। স্ত্রীলোকের বেশ। বক্ষ-আবরণের যোগ্য কাঁচলিধরনের ছোট একটি জামা; যেন অনেকদিনের ব্যবহার করা, একটু একটু মলিন, ঠাঁই ঠাঁই একটু একটু দাগ; পরিধান একখানি আধময়লা শাড়ী; মাথায় পরচূলকবরী; অলঙ্কারের মধ্যে কেবল দুহাতে দুগাছি পিতলের বালা।

বেশ পরিবর্তন বেশ হলো, রূপ পরিবর্তনে কতদর কৃতকার্য হোলেম, সেটি আমি নিজে জানতে পাল্লেম না। সন্ধ্যার পরেই আকাশে চন্দ্রোদয় হলো, আমার পুরুষবেশের সজ্জাগুলি একখণ্ড ক্ষুদ্রবস্ত্রে বন্ধন কোরে একটি পুটলি প্রস্তুত কোল্লেম; সেই পুটলিটি কক্ষে রেখে, বাগান থেকে বেরিয়ে, বাগানের ফটকের ধারে এসে দাঁড়ালেম। সম্মুখেই রাস্তা; রাস্তার পরেই একটা পুষ্করিণী। সবে মাত্র সন্ধ্যা অতীত হয়েছে, রাত্রি হয় নাই, দিব্য জ্যোৎস্না, গ্রামের দুটি একটি স্ত্রীলোক সেই সময় সেই পুষ্করিণীতে জল নিতে এলো, তফাৎ থেকে আমি দেখলেম; পায়ে পায়ে এগিয়ে এগিয়ে ঘাটের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেম। ঘাটে তখন একটি মাত্র স্ত্রীলোক; গাত্রপ্রক্ষালন কোরে জলকুম্ভ-কক্ষে সিক্তবদনে সেই স্ত্রীলোকটি ঘাটের চাতালে এসে উঠলো; ঠিক চাতালের ধারেই আমি; আমারে দেখে সেই স্ত্রীলোক আমার মুখের কাছে একটু হেঁট হয়ে কেমন একরকম নূতন সুরে জিজ্ঞাসা কোল্লে, “কে গা তুমি?”

মুখে আমার ঘোমটা ছিল না, বুকে আমার কাঁচুলি ছিল, মুখের কথা না শুনে, চেহারা দেখে, পরিচ্ছদ দেখে, হঠাৎ কাহারো মনে হোতে পারে খোট্টার মেয়ে। সেই স্ত্রীলোক আমারে বাস্তবিক খোট্টার মেয়ে বিবেচনা কোরেছিল কি না, তা আমি বোলতে পারি না; বাংলা কথাতেই আমি উত্তর দিলেম, “আমি বিদেশিনী, এই গ্রামে নূতন এসেছি, আশ্রয় পাচ্ছি না, পথে শুনলেম, এইখানে একখানি রাজবাড়ী আছে, বিদেশী গরিব-দুঃখী দৈবাৎ এখানে এসে উপস্থিত হোলে সেই বাড়ীতে আশ্রয় পায়। তাই শুনেই আমি এদিকে আসছি, কোথায় সেই রাজবাড়ী, কোন দিকে যেতে হবে, তুমি যদি বোলে দাও, তবেই—”

স্ত্রীলোকটি অর্দ্ধবয়সী। আমার কথা শুনে সে যেন একটু কাতরভাবে বোল্লে, “আর বাছা রাজবাড়ী। রাজাদের কি আর সে কাল আছে? যমদণ্ডে সব গিয়েছে, সব গিয়েছে। বিধাতা সব কোত্তে পারেন! রাজলক্ষ্মীও ছেড়ে গিয়েছেন! তা তুমি এসেচো, থাকতে পাবে, এসো আমার সঙ্গে। সেই বাড়ীতেই আমি থাকি, কাজকর্ম্ম করি, বড়-বৌমা ভালবাসেন, সেই খাতিরেই থাকি; অনেক দিন আছি, ছেড়ে যেতেও মন চায় না। এসো তুমি আমার সঙ্গে।”

আমি বুঝতে পাল্লেম, ঐ স্ত্রীলোক সেই রাজবাড়ীর দাসী। সে দিন আমি যে বাড়ীখানা দেখে গিয়েছিলেম, আধখানা ভাগা, আধখানা নূতন মেরামত করা, দাসী আমারে সঙ্গে কোরে সেই বাড়ীর ভিতর নিয়ে গেল, প্রথমেই বৌমার কাছে নিয়ে হাজির কোল্লে।

ধনঞ্জয় ঘটকের মুখে শুনেছিলেম, তিনটি ভাই এখন এই বাড়ীর মালিক। ছোট দুটি নাবালক, বড়টি এখন কৰ্ত্তা। সেই কৰ্ত্তাটির গৃহলক্ষ্মী ঐ বৌমা। দাসীর মুখে আমার সংক্ষিপ্ত পরিচয় শুনে বৌমা আমারে কত কথাই জিজ্ঞাসা কোল্লেন, দুঃখিনী দেখে কতই দয়ার কথা বোল্লেন, মুখটি বুজে চুপটি কোরে সব কথাগুলি আমি শুনলেম; প্রত্যয় জন্মিল, যথার্থই এটি গৃহলক্ষ্মী; কথাগুলিও যেমন মিষ্ট, ব্যবহারও সেইরূপ কোমল। বৌমা আমারে নিশাকালে সেই বাড়ীতে আশ্রয় দিতে সম্মত হোলেন, মনে মনে আনন্দ অনুভব কোরে আমি আশ্বাস প্রাপ্ত হোলেম।

শুনেছিলেম ভৌমিক; ভৌমিকেরা ব্রাহ্মণ হয়, সে কথাও শুনেছিলেম; আহারাদি সম্বন্ধে মনে কোন দ্বিধা রাখলেম না, বৌমার সঙ্গে খানিকক্ষণ গল্প কোরে একটি শূন্য ঘরের মধ্যে খানিক আমি বিশ্রাম কোত্তে লাগলেম; বৌমা সেই সময় কার্য্যান্তরে অন্য ঘরে চোলে গেলেন।

ব্যাকরণ ভুল হবে না, সেই শূন্য ঘরে আমি একাকী। যাঁরা ব্যাকরণ জানেন “একাকিনী” কেন বোল্লেম না, সেই তর্ক উপস্থিত কোরে তাঁরা আমারে তিরস্কার করুন, সেই শূন্যঘরে আমি একাকী। বৌমার আদেশে সেই দাসী আমারে কিছু জলখাবার এনে দিলে, আমি জল খেলেম। পাত্রগুলি নিয়ে দাসী যখন চোলে যায়, তখন আমি মনে কোল্লেম তারে কিছু জিজ্ঞাসা করি, জিজ্ঞাসা করবার উপক্ৰম কোচ্ছিলেম, দুটি একটি কথা মুখে এনেও ছিলেম, আমার মুখের দিকে চেয়ে দাসী বোলে গেল, “বোসো বাছা! বোসো বাছা! আমি আসছি।”

দাসীটির নাম রেবতী। কথাবার্ত্তায় রেবতীকে নিতান্ত ছোটলোকের মেয়ে বোলে বোধ হয় না। রেবতীর সততার কথা মনে মনে আমি ভাবছি, বৌমার দয়ার কথা মনে আমি আলোচনা কোচ্ছি, দশটাকা দিয়ে ধনঞ্জয় ঘটকের কাছে যে কথাটি আমি কিনে নিয়েছি, সেই কথাটি সত্য কি না, সেই ব্যাপারে আমি ঠোকেছি কি না, সন্দেহে সন্দেহে তাই তোলাপাড়া কোচ্ছি, রেবতী এলো। ইসারায় আমি তারে দরজাটা ভেজিয়ে দিতে বোল্লেম, ইসারা অনুসারে কার্য্য কোরে রেবতী আমার কাছে এসে বোসলে।

আমি চাই রেবতীর মুখপানে, রেবতী চায় আমার মুখপানে, কথা হয় না। অগ্রে কি আমি বোলবো, চিন্তা কোরে অবধারণ কোচ্ছি, মনের আসল কথাটি প্রথমেই প্রকাশ করা উচিত কি না, ভাবছি, মৌনভঙ্গ কোরে রেবতী জিজ্ঞাসা কোল্লে, “কি তুমি আমারে তখন বোলবে বোলছিলে? বল দেখি শুনি কথাটি কি?”

আমি ভাবলেম, তাই ত! কি বলি? নূতন এসেছি, আশ্রয় চেয়েছি, আশ্রয় পেয়েছি, হঠাৎ যদি আমার সেই মনের কথা ভেঙে দিই, আমার কৌশলটিও হয় তো ভেঙে যাবে! বলি কি?—ভেবে চিন্তে সহসা জিজ্ঞাসা কোল্লেম, “বাবু কোথায়?”

রেবতী।— ছোট বাবুদুটি তাঁদের ঘরেই আছেন, বড়বাবু বাড়ী নাই।

আমি।— কোথায় তিনি?

রেবতী।—তিন দিন হলো, সহরে বেরিয়েছেন, নূতন একটা কারবার করবার ইচ্ছা আছে, সেই চেষ্টাতেই ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।

আমি।—রাজপুত্র তিনি, কারবারের জন্য ঘুরে ঘুরে বেড়াতে হয়, এতই কি হীনাবল হয়েছে?

রেবতী।—অবস্থার শেষ নাই। তিনি তো তিনি, আমি—আমি তো একজন চাকরানী আমি যখন এই বাড়ীর অবস্থার কথা মনে করি চক্ষের জলে ভেসে যাই!

আমি।—অকস্মাৎ এত দুরবস্থা হবার কারণ কি?

রেবতী।—অকস্মাৎ নয়, ক্ৰমে ক্ৰমে দুর্দশা দাঁড়িয়েছে। মারীভয়ে বংশশেষ, বংশের সঙ্গে বিষয় শেষ। কৰ্ত্তা যখন মারা পড়েন, ছোট ছেলে-দুটি তখন খুব ছোট ছোট; বড়টির বয়স তখন বড় জোর ১৬/১৭ বছর; কর্ত্তাবাবুর শত্রুপক্ষ অনেক ছিল, সুযোগ পেয়ে বিষয়-আশয় সব তারা ফাঁকি দিয়ে নিয়েছিল, পরের হাতে মামলা, তাতেই অনেক টাকা বৃথা নষ্ট হয়ে গিয়েছে, কেবল মা-গিন্নীর নামে ছোট একখানি তালুক ছিল, সেইখানি আছে, তাতেই একরকম চলে, ক্রিয়া-কৰ্ম্ম চলে না, খাওয়া-পরা চলে, কাজে কাজেই এক আধটা নূতন নূতন কারবার না কোল্লে ঠাঁট বজায় রাখা ভার হয়।

আমি।—তা তো বটেই! তা তো বটেই! কিন্তু লক্ষ্মীর সংসারে ততটা কষ্ট হয় না। যদিও কিছু কিছু হয়, লোকে সেটা টের পায় না। বিশেষ, এই বৌমাটি দেখছি সাক্ষাৎ লক্ষ্মী; ঐ লক্ষ্মীর দয়াগুণে দুঃখিনী বিদেশিনীরা আজিও এ সংসারে আশ্রয় পায়।

রেবতী।—(বিস্ময়ে চাহিয়া) কেন তুমি এমন কথা বোল্লে? তুমি বিদেশিনী, তুমি আজ রাত্রে এই বাড়ীতে আশ্রয় পেয়েচো, সেই জন্যই কি?

আমি।—না না না, শুধু সেই জন্যই নয়। আমি একটা দুঃখিনী বিদেশিনী, এমন দুঃখিনী বিদেশিনী কোথায় কত আছে, কে জানে? এ রকম অবস্থায় যে বিদেশিনী এখানে আসে, অক্লেশে এই বাড়ীতে আশ্রয় পায়।

রেবতী।—এ সব তুমি কি কথা বোলছো? নাম আছে পদ্মপুকুর, পদ্মফুল নাই। এ বাড়ীতে এখন বিদেশিনীর অক্লেশে আশ্রয় পাওয়া, এটা তোমার কি রকম অনুমান?

আমি।—অনুমান বল কেন, তোমাদের মা-লক্ষ্মী সুখে থাকুন, ঠিক কথাই আমি বোলছি; পদ্মপুকুরে পদ্মফুল আছে; সম্প্রতি একটি বিদেশিনী কুমারীও—

রেবতী।—(বিস্ময়ে) ও মা গো! সেই কথা বুঝি তুমি বোলচো? সে কথা তুমি কেমন কোরে জানলে?

আমি।—(অজ্ঞানতা জানাইয়া) কোন কথা? পদ্মফুলের কথা?

রেবতী।—বল যদি, পদ্মফল বোলতে পারো, বটেও একটি পদ্মফুল,—পদ্মর মত একটি বিদেশিনী সম্প্রতি এই বাড়ীতে এসেছে।

আমি।—আমি ত তবে ঠিক কথা ধোরেছি। পদ্মমফুলটি কি রকমে এসেছে?

রেবতী।—পশ্চিমদেশের তিনজন লোক একটি সুন্দরী মেয়েকে এই বাড়ীতে রেখে গিয়েছে।

আমি।—রেখে তারা কোথায় গিয়েছে, সে কথা তুমি কিছু শুনেছো?

রেবতী।—বাবু হয় তো শুনে থাকবেন, আমি কেমন কোরে শুনবো? দাসীর সঙ্গে তাদের সে সব কথা কেন হবে?

আমি।—তবে সেই বিদেশীনা মেয়েটি এখানে কি অবস্থায় আছে?

রেবতী।—আহা হা! বাছা কেবল বোসে বোসে রাতদিন কাঁদে, খায় না, ঘুমায় না, কথা কয় না, কেবল কাঁদে, কেবল কাঁদে!

আমি।—আহা হা! আমি তোমাদের সেই বিদেশিনী মেয়েটিকে একবার দেখতে পাই না?

রেবতী।—কেন পাবে না? মেয়েমানুষ তুমি, বিদেশিনী তুমি, বিদেশিনী মেয়েমানুষে দেখতে পাবে না কেন?

আমি।—দেখাও মা, একবার তবে দেখাও, কেবল কাঁদে? আহা হা! সেই দুঃখিনীটিকে দেখবার জন্য আমার প্রাণ কেমন আকুল হয়ে উঠছে।

রেবতী।—দেখে তুমি কি কোরবে?

আমি।—কে কার কি করে তা তো তুমি জান। সেটাও বিদেশিনী, আমিও বিদেশিনী; সেটিও দুঃখিনী, আমিও দুঃখিনী, দুটিতে এক ঠাঁই মুখোমুখি কোরে বোসবো, দুঃখের দুঃখিনী। সমান সমান কষ্টভাগিনী একটি সঙ্গিনী হব, একরাত্রের জন্যও তোমাদের সেই বিদেশিনীটিকে একটু সান্ত্বনা দিব।

রেবতী।—তা তুমি পারবে। তোমার যে রকম মধুরবচন, তোমার যে রকম দয়ার প্রাণ, তোমার যে রকম দুঃখের দশা, তাতে কোরে তুমি সেই দুঃখিনীর সঙ্গিনী হোতেও পারবে, মিষ্টকথায় সান্ত্বনা দিতেও পারবে। আনবো তারে এইখানে না তুমি সেই ঘরে যাবে?

আমি।—হঠাৎ সেখানে আমার যাওয়াটা ভাল দেখাবে না, সেই বিদেশিনী যদি আমার কাছে আসতে ইচ্ছা করে, তারে বরং একবার এইখানেই এনে দাও, পার যদি এনে দিতে, তা হোলে তোমার কাছে আমি চিরজীবনের মত কেনা হয়ে থাকবো।

রেবতী গেল। আমি তখন মনে মনে কত রকমের কত কথা আন্দোলন কোত্তে লাগলেম। নারীবেশে এসেছি, কণ্ঠস্বরে ধরা পড়বার ভয় ছিল। বিধাতা আমার প্রতি সদয় হয়ে আমার কণ্ঠে যেরূপ বর দিয়েছেন, বেশীবয়সে কি রকম হয় বলা যায় না, কিন্তু এই পঞ্চদশ বর্ষ বয়স পর্য্যন্ত স্বদেশের অল্পবয়স্ক বালিকাদের স্বরের সঙ্গে সেই স্বরে—আমার এই কণ্ঠস্বরের সুন্দর মিলন হয়, হরিদাস কথা কোচ্ছে, কিম্বা হরিদাসী কথা কোচ্ছে, প্রভেদ বুঝে কেহই কিছু ধোত্তে পারে না। অমরকুমারী আসছেন, এইবার জানা যাবে; আমার কণ্ঠস্বর শুনে অমরকুমারী আমারে হরিদাস বোলে চিনতে পারেন কি না, এইবার পরীক্ষা হবে। আগে আমি মুখ দেখাব না; স্থির কোরে রাখলেন, আগে আমি অমরকুমারীকে আমার মুখ দেখতে দিব না;—পরীক্ষা কোরে দেখবো, আজ রাত্রে অমরকুমারী আমারে চিনতে পারেন কিনা। এই সঙ্কল্পে চিত্ত দৃঢ় কোরে, চিবুকদেশ পর্য্যন্ত আমি ঘোমটা দিয়ে ঢেকে রাখলেম।

বৌ সেজে আমি বসে আছি, পুঁটুলীটি আমার সামনেই ধরা আছে, ঘরের দেয়াল আমার পৃষ্ঠের অবলম্বন। সে বাড়ীতে আমি নূতন গিয়েছি, বৌমা ছাড়া আর আর যাঁরা যাঁরা বাড়ীতে আছেন, তাঁরা সকলেই বিধবা, সে কথা আমার শুনা হয়েছে; কিন্তু বৌমা ছাড়া আর কাহারো সঙ্গে আমার দেখা হলো না; কেহই আমারে দেখতে এলেন না। বঙ্গদেশের বিধাবাদের নারীজন্মের সমস্ত সাধ আহ্লাদ ফুরায়; সেই সঙ্গে হৃদয়ের কৌতুহলপ্রবৃত্তিও বিলুপ্ত হয়; ইহাই কি ঠিক? আমি নূতন গিয়েছি, কি রকম আমি, কৌতুহলবশে স্ত্রীলোকেরা অবশ্যই একবার দেখতে ইচ্ছা করেন; বাড়ীতে নূতন মানুষ গেলেই নারীমহলে সেই রকম হয়; আমি কিন্তু সেখানে সে রকম লক্ষণ কিছুই দেখলেম না, কেহই আমারে দেখতে এলেন না। আমাতে নূতনত্ব কিছুই নাই, বিদেশিনী তো বিদেশিনী, হয় তো ভিখারিণী হলেও হোতে পারি, এই ভেবেই হয় তো কেহ এলেন না। আমি যদি বহুমূল্য বসনভূষণে সজ্জিত হয়ে সে বাড়ীতে প্রবেশ কোত্তেম, উৎকলী বেহারারা যদি বিচিত্র পাল্কীর উপর বসাইয়া সেখানে আমারে নিয়ে যেতো, পাল্কীর আগে আগে যদি ঢালতলোয়ারধারী দুজন ব্রজবাসী দরেয়ান ছুটতো, ঘর্ম্মাক্তকলেবরা, গাছকোমর-বাঁধা দুজন দাসী যদি পাল্কীর পাছু পাছু দৌড়িত, তা হোলে বাড়ীর আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা ছুটাছটি কোরে আমারে দেখতে আসতো; কেবল বাড়ীর লোক কেন, পাড়া-প্রতিবাসিনীরাও কৌতুকে কৌতুকে আমার কাছে এসে জমা হতো; সে জিনিস আমি নই, একজন দুঃখিনী বিদেশিনী মাত্র, কাজেই কেহ আমারে দেখতে এলো না; এলো না তো এলো না; না আসাই বরং আমার পক্ষে ভাল।

বোসে আছি, ঘরের একধারে একটি প্রদীপ জ্বোলছে, আর একটি বিদেশিনী আসবেন, সেই আশায় ঘোমটা তুলে দরজার দিকে এক একবার চেয়ে দেখছি, বিদেশিনী এলেন; সঙ্গে সঙ্গে রেবতী।

আমি অবগুণ্ঠনবতী। প্রবেশ কোরেই রেবতী যেন একটু চোমকে উঠে থোমকে দাঁড়ালো; চিবুকে অঙ্গুলীস্পর্শ কোরে বিস্ময়োক্তিতে সহসা বোলে উঠলো, “ও মা! এ কি গো! মেয়েমানুষকে দেখে মেয়েমানুষের লজ্জা! কি রকম বিদেশিনী। ঘোমটা-ঢাকা কলা-বৌ।”

আমার মুখাবরণ বস্ত্রখানি তাদৃশ স্থূল ছিল না, দীপালোকে অবগুণ্ঠনের ভিতর দিয়ে বাহিরের বস্তু আমি দেখতে পাচ্ছিলেম, বিদেশিনী এলেন। বিদেশিনীর মুখখানি আমি দেখলেম; রেবতীকে পূর্ব্বে দেখা ছিল, রেবতীর; বিস্ময়-প্রকাশক মুখখানিও আমি দেখলেম, আমার দিকে চাইতে চাইতে বিদেশিনী আমার কাছে বোসলেন; হাতখানেক তফাতে রেবতীও চুপটি কোরে বসলো। প্রায় পাঁচ মিনিটকাল তিনজনেই আমরা নিস্তব্ধ।

বিদেশিনীর বিস্ময়, রেবতীর বিস্ময়, আমার আনন্দ। বিদেশিনীর মুখখানি আমি দেখেছি, অন্তরানন্দে অন্তরে অন্তরে আমি আশার আনন্দময়ী মূর্তি আমি সন্দর্শন কোচ্ছি, বিদেশিনী আমার মুখ দেখতে পাচ্ছেন না। রেবতী দুই তিনবার আমার অবগুণ্ঠন-মোচনের জন্য অনুরোধ কোল্লে, সে অনুরোধে আমি বধির থাকলেম, রেবতী পাছে নিজেই খুলে দেয়, তাই ভেবে দুই হাতে অবগুণ্ঠনের অঞ্চলভাগ আমি টেনে টেনে চেপে রাখলেম। সুবিধা হলো। চাপামুখের কণ্ঠস্বর নিশ্চয়ই কিছু গম্ভীর হবে, কণ্ঠস্বর যাদের পরিচিত, কথা শুনে তারাও ঠিক বুঝে উঠতে পারবে না, সেইটি অবধারণ কোরে ধীরে ধীরে আমি বোল্লেম, “বিদেশিনী! আমি গণনা জানি; তুমি এখানে আছ, তাও জানি; তুমি আমার কাছে আসবে, তাও জেনেছিলেম; কেমন কোরে তুমি এখানে এসেছে, কারা তোমারে এখানে এনেছে, গণনা কোরে তাও আমি জানতে পেরেছি।”

বিদেশিনীর মুখে এতক্ষণ কথা ছিল না, আমার কথাগুলি শুনে, সমধুরস্বরে, সমধুর মৃদ-কম্পিতস্বরে বোল্লেন, “আমার দুর্ভাগ্যের কথা তুমি জানতে পেরেছো, আমি তোমারে জানতে পাচ্ছি না, তোমার মুখখানিও দেখতে পাচ্ছি না; মুখখানি একবার খোলো, তোমার মুখখানি একবার আমি দেখি, তার পর তোমার সঙ্গে আমার কথা হবে।”

অন্তরের ভাব অন্তরে রেখে পূৰ্ব্ববৎ মৃদুস্বরে আমি বোল্লেম, “যে সকল স্ত্রীলোক গণনা-বিদ্যা জানে, গণনার শেষফল পর্য্যন্ত সুসিদ্ধ না হোলে স্ত্রীলোকের কাছেও তারা মুখের কাপড় খোলে না; আমিও এখন মুখের কাপড় খুলবো না। আমার সঙ্গে তোমার কথা হবে। বিদেশিনী! কি কথা জানতে আমার বাকী আছে? এখানে এসে অবধি রাত-দিন তুমি কেবল কাঁদো; যারা এনেছে, এইখানে তোমারে রেখে তারা সোরে গিয়েছে, আবার তারা আসবে, সেইবার তোমার ভাগ্যের সঙ্গে তাদের যুদ্ধ হবে। কেমন, এই সব কথাই ত তুমি বোলতে চাও?”

উর্দ্ধ্বদৃষ্টিতে চেয়ে বিদেশিনী বোল্লেন, “পরমেশ্বর সাক্ষী, ঐ সব কথা আমি বোলবো না। আমার ভাগ্যের সঙ্গে সেই সকল লোকের কি রকম যুদ্ধ হবে, কেন আমি রাত-দিন কাঁদি, তোমার গণনা এই দুই প্রশ্নের কি রকম উত্তর দিতে পারে?”

আর আমি বাগাড়ম্বর কোল্লেম না; দুই প্রশ্নের উত্তরে স্পষ্টই আমি বোলে দিলেম, “তারা তিনজন। তারা তোমারে বেচে ফেলবার মন্ত্রণা কোরেছে। দু হাজার টাকা পণ ধার্য্য হয়েছে। খরিদ্দার এখানকার একজন বংশী পোদ্দার। সেই খরিদ-বিক্রয় উপলক্ষেই তোমার ভাগ্যযুদ্ধ। এই গেল এক কথা, দ্বিতীয়তঃ কোথায় তুমি ছিলে, কোথায় তুমি এসেছ, কারে তুমি হারিয়েছ, আর তার সঙ্গে দেখা হবে কি না, এর পর তোমার কি হবে, এই সব ভেবে ভেবেই রাতদিন তুমি কাঁদো। কেমন, এই সব কথার সঙ্গে তোমার মনের কথার মিলন হয়? এই সব কথাতেই তো তোমার ঐ দুই প্রশ্নের উত্তর হয়? আমার গণনা এই সব কথা বলে।”

অবাক হয়ে রেবতী আমার ঐ সব গণনার কথা শুনছিল, আমি চুপ করবামাত্র অকস্মাৎ একটু উচ্চকণ্ঠে রেবতী বোলে উঠলো, “ও বাপু! এ মেয়ে তো কম মেয়ে নয়। এ সময়ে তো কম গণনা জানে না! যা যা বোলে দিলে, সব ঠিক! সব ঠিক! সব যেন রেবতীর কথাগুলি বিদেশিনীর কর্ণে গেল কি না, ঠিক আমি বুঝতে পাল্লেম না; রেবতীর মন্তব্য পূর্ণমাত্রায় প্রকাশ হতে না হতেই আমার মুখের অবগুণ্ঠনের দিকে চেয়ে বিদেশিনী আমারে জিজ্ঞাসা কোল্লেন, “তোমার গণনা ঐ সব কথা বলে? বেশ গণনা তোমার! তোমার গণনা আর কি কথা বলে?”

“আর কি বলে, শুনবে?” ঠিক আমার মনের কথাই বিদেশিনীর প্রশ্নে ব্যক্ত হলো, তাই বুঝেই মহোল্লাসে আমি প্রশ্ন কোল্লেম, “আমার গণনা আর কি বলে, শুনবে? আমার গণনা আরো বলে, তুমি মুক্ত হবে। বন্দিনী আছ, এ অবস্থায় তোমারে আর বেশীদিন এখানে থাকতে হবে না। তোমার ভাগ্যের সঙ্গে যারা যুদ্ধ কোত্তে চায়, যুদ্ধ তাদের হবে, কিন্তু এখানে হবে না; শীঘ্রই তুমি এখানকার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবে।”

রেবতীর মুখের দিকে বিদেশিনী চাইলেন, বিদেশিনীর মুখের দিকে অনিমেষে রেবতী চেয়ে রইল; রেবতীর চক্ষের কোণে দুই বিন্দু অশ্রু দেখা দিয়ে, মুখ বেয়ে বুকের উপর গোড়িয়ে পোড়লো; রেবতী বোলছিল, “আজ আমাদের বাবু এখানে থাকলে—”

বৌমা এসে দেখা দিলেন। রেবতীর মুখের কথা মুখেই থেকে গেল। ঘরের এধার ওধার নেত্ৰ-সঞ্চালন কোরে ঈষৎ প্রফুল্লবদনে বৌমা বোল্লেন, “এই যে বেশ হয়েছে। দুটি বিদেশিনীই একঠাঁই! রেবতী আমাদের যোগাযোগটা জানে ভাল! নূতন বিদেশিনীর মুখখানি কেমন ঘোমটা-ঢাকা! বাঃ—ঘোমটাতে ঐ রূপখানি বেশ মানিয়েছে! কি গো বিদেশিনী!—তোমাদের দুটি বিদেশিনীকেই জিজ্ঞাসা কোচ্ছি, তোমাদের আলাপ-পরিচয় কেমন হলো?”

দুটি বিদেশিনীই নিরুত্তর। বিস্ময়বিহ্বলা রেবতীর মুখেই ঐ প্রশ্নের উত্তর। বিস্ময়চমকে চেয়ে রেবতী বোল্লে, “মা গো মা! এমন বিদেশিনী দেখি নাই! এই নূতন বিদেশিনী চমৎকার গণনা জানে! এই ব্রজকিশোরীর আগাগোড়া সকল কথা এই নূতন বিদেশিনী একে একে গণনা কোরে বোলে দিলে! কজন এসেছিল, কত দাম হলো, কে খরিদ্দার হলো, এখানে থাকা হবে কি না হবে, সব কথাই নূতন বিদেশিনীর গণনায় উঠেছে। মেয়েটি দেখতে ছোট, কিন্তু গণনা বড় আশ্চর্য্য! আশ্চর্য্য গণৎকার!”

বৌমা খানিকক্ষণ সুস্থির-দষ্টিতে আমাদের দিকে চেয়ে থাকলেন, চেয়ে চেয়ে আমারে জিজ্ঞাসা কোল্লেন, “সত্যই কি তুমি গণনা শিখেচ? বল দেখি, আমাদের সংসারের এ দশা আর কতদিন থাকবে?”

বিবেচনা না কোরেই আমি উত্তর দিলেম, “যে দিনে এই ব্রজকিশোরীর ভাগ্যযুদ্ধের অবসান হবে, সেইদিন আমি এই বাড়ীতে আর একবার আসবো, রাজলক্ষ্মীর কৃপাদৃষ্টি দর্শন কোরবো। গণনায় আমি জানতে পেরেছি, বাবু যদি পূৰ্ব্বপুরুষগণের ধর্ম্মপথ পরিহার না করেন, যারা বিপদে পড়ে, তাদের যদি সহায় হন, অবস্থাচক্রে মানুষের যেমন কুমতি ঘটে, বাবু যদি সেরূপ কুমতির দাসত্ব না করেন, তা হোলেই আপনার এই ধর্ম্মের সংসারে এ দুর্দিন কখনই স্থায়ী হবে না। আপনার তুল্য দয়াময়ী যে সংসারের লক্ষ্মী, সে সংসার অবশ্যই সৰ্ব্বসৌভাগ্যে সমুজ্জ্বল হবে।”

কি যেন পূর্ব্বকথা স্মরণ কোরে বৌমা একটু বিস্ময় ভাব প্রকাশ কোল্লেন, মুখের ভাবেই সেই ভাবটি প্রকাশ পেলে, বাক্যদ্বারা কিছুই প্রকাশ হলো না। অনুমানে আমি বুঝলেম, ব্রজকিশোরীর ভাগ্যযুদ্ধের উদযোগপর্ব্বে হয় তো বাবু রমণীবল্লভ ভৌমিকের অপর পক্ষে সেনাপতিত্ব গ্রহণের উৎসাহ আছে, সেটা অধর্ম্ম, সেই কথাটা হয় তো সেই সময় বৌমার স্মরণ হলো, সেই স্মরণেই তাঁর বদনমণ্ডলে ঐরূপ বিস্ময়ভাব চিহ্নিত।

প্রসঙ্গ চাপা পোড়ে গেল। রেবতীকে গৃহান্তরে প্রেরণ কোরে বৌমা আমাদের দুজনকে দুটি একটি কথা জিজ্ঞাসা কোল্লেন, ব্রজকিশোরীর মুখে একটিও তো উত্তর পেলেন না, অবগুণ্ঠনের ভিতর থেকে আমি তাঁর জটিল প্রশ্নের অস্পষ্ট উত্তর দান কোল্লেম। তার পর আহারের আয়োজন। আহারান্তে শয়নের ব্যবস্থা। স্বতন্ত্র গৃহে আমি একাকী স্বতন্ত্র আহার কোল্লেম, স্বতন্ত্র গৃহে স্বতন্ত্র শয্যায় আমি একাকী স্বতন্ত্র শয়ন কোল্লেম। ব্রজকিশোরীর সঙ্গে সে রাত্রে আর আমার সাক্ষাৎ হলো না। মনে মনে যা আমি জেনে রাখলেম, তাই আমার ইষ্টমন্ত্র হয়ে থাকলো।

কি?—পাঠকমহাশয় জিজ্ঞাসা কোত্তে পারেন, ইষ্টমন্ত্র হয়ে থাকলে কি? দেশের প্রথানুসারে লোকেরা লোকের কাছে ইষ্টমন্ত্র প্রকাশ করে না, আমিও প্রকাশ কোরবো না। ঠারে ঠারে এইটুকু মাত্র প্রকাশ থাকুক, যে পদ্মফুলটির অনুসন্ধানে এই ভগ্ন বাড়ীতে আমি প্রবেশ কোরেছি, এখানে সেই পদ্মফুলের নাম ব্রজকিশোরী। কারা দিয়েছে এই নাম, তা আমি জানতে পাল্লেম না। লোকেরা দিয়েছে কিম্বা পদ্মফুলটি নিজেই ঐ নামে পরিচয় দিয়েছেন, সে কথা কাহাকে জিজ্ঞাসাও কোল্লেম না; শুনে রাখলেম ব্রজকিশোরী। সে রাত্রে আমারে যদি কেহ আমার নাম জিজ্ঞাসা কোত্তেন, ঐ রকমে আমিও বোলতেম, আমার নাম সূর্যকিশোরী। পল্লীগ্রামে সকলেই প্রায় সূর্যোদয়ের সঙ্গে শয্যাত্যাগ করে, নিতান্ত শিশুকাল থেকে আমার চির-অভ্যাস উষাকালে গাত্রোত্থান করা। ঊষাআগমনের অগ্রেই আমার নিদ্রাভঙ্গ হয়। বাড়ীর কেহই যখন জাগরণ করেন নাই, সেই সময় আমি আমার কাপড়ের পুঁটুলীটি কক্ষে লয়ে উপর থেকে নেমে এলেম। রেবতী উঠেছিল, নীচের প্রাঙ্গণে রেবতীর সঙ্গে দেখা হলো; রেবতীকে বোল্লেম, “দেবতারা এ সংসারের মঙ্গল করুন, এই আশ্রমে নিরাপদে এক রাত্রি আমি আশ্রয় পেলেম, কৃতজ্ঞতা বিস্মৃত হব না; এখন বিদায় হোলেম। ভাগ্যে যদি থাকে, পুনরায় আর একবার সাক্ষাৎ হবে, বৌমাকে এই কথাগুলি তুমি বোলে রেখো। সূর্যোদয়ের পর রাস্তায় আমি বাহির হব না, ঊষার আবরণ থাকতে থাকতেই অন্য আশ্রয়ে আমি চোলে যাব। চোল্লেম।”

খানিকক্ষণ থাকবার জন্য রেবতী আমারে বিস্তর অনুরোধ কোল্লে, সে অনুরোধ আমি শুনলেম না, রাজবাড়ীকে নমস্কার কোরে রাস্তায় বেরুলেম। তখন ঘোমটা ছিল না, ঊষা আমারে ঢাকা দিয়ে নিয়ে চোল্লো। যে বাগানে নারীবেশ ধারণ কোরেছিলেম, সেই বাগানে গিয়ে বেশপরিবর্তন কোল্লেম। আর তখন প্রচ্ছন্ন থাকার প্রয়োজন হলো না, গন্তব্যপথে যাত্রা কোল্লেম। তখনও উষা পূর্ব্বদিকে অল্প অল্প আরক্তপ্রভা। মনে আমার নূতন উৎসাহ, নূতন আশা, নূতন আনন্দ।