ভূবনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়
হরিদাসের গুপ্তকথাদ্বিতীয় খণ্ড
দ্বিতীয় কল্প : কুমারী-অন্বেষণ
আমি মাণিকগঞ্জে যাব। হেতু কি, দীনবন্ধুবাবুকে আর পশুপতিবাবুকে সেটি জানালেম; নিশ্চয় অমরকুমারীকে সেখানে পাওয়া যাবে, সে বিষয়ে তাঁদের প্রতীতি জন্মিল না, তথাপি অন্বেষণ করা কর্ত্তব্য, এই বিবেচনায় তাঁরা আমারে অনুমতি দিলেন। মণিভূষণকে সংবাদ দেওয়া গেল, মণিভূষণ এলেন; তাঁরে সঙ্গে কোরে একবার আমি বহরমপুরের আদালতে গেলেম। ম্যাজিস্ট্রেটের নিকটে এই মর্ম্মে এক দরখাস্ত করা হলো যে, অপহৃতা অমরকুমারীর কিঞ্চিৎ অনুসন্ধান পাওয়া যাচ্ছে, ঢাকাজেলার এলাকায় অমরকুমারী আছেন, কোন বিশ্বস্তসূত্রে এই সংবাদটি শুনা হয়েছে, সন্ধানের জন্য আমি ঢাকায় চোল্লেম, সন্ধান যদি ঠিক হয়, ঢাকার ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশে ঢাকার পুলিশ তদ্বিষয়ে আমার সহায়তা করেন, এইরূপ হুকুম প্রার্থনা।
আমি দরখাস্ত কোল্লেম না, মণিভূষণ দরখাস্ত কোল্লেন; আমাদের উকীল রজনীবাবু সেই দরখাস্তে তাঁর নিজের নামটিও দস্তখৎ কোরে দিলেন। পেস হবার পর দরখাতে এই হকুম হলো যে, “দরখাস্তের মৰ্ম্মানুসারে ঢাকাজেলার ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের হুজুরে অত্রাদালতে রূবকারি প্রেরণ করা যায় ইতি।”
ঢাকায় রূবকারি যাবে, মুর্শিদাবাদ পুলিশের কোন লোককে সঙ্গে লওয়া আবশ্যক হবে না। ম্যাজিস্ট্রেটকে সেলাম দিয়ে, রজনীবাবুর কাছে বিদায় নিয়ে, সন্ধ্যার পূর্ব্বে আমরা গঙ্গা পার হোলেম। নিরুপিত দিবস উপস্থিত হলো, হরিহরবাবু প্রস্তুত, দুর্গানাম স্মরণ কোরে আমরা তরণী-আরোহণ কোল্লেম। হরিহরবাবুর সঙ্গে তাঁর বন্ধু লোকেরা, আমার সঙ্গে মণিভূষণ দত্ত। ভিন্ন ভিন্ন যানবাহনে পথে যত দিন যায়, তত দিন গেল, আমরা মাণিকগঞ্জে উপস্থিত হোলেম।
আমি অদৃষ্টবাদী; ভাগ্যে আমার অখণ্ড বিশ্বাস; ভাগ্য আমার মন্দ, শৈশবাবধি পদে পদে তার প্রমাণ আমি প্রাপ্ত হয়ে আসছি, কিন্তু একটি বিষয়ে আমার কিছু শ্রদ্ধা আছে। যেখানে যখন যে কোন ভদ্রলোকের কাছে আমি আশ্রয় পাই, সেইখানেই তখন আমার আদর হয়। কেন জানি না, সত্য পরিচয় পেয়েও, বংশপরিচয় না জেনেও ভদ্রলোকেরা আমারে যত্ন করেন। হরিহরবাবুর বাসাবাড়ীতে আমরা আশ্রয় পেলেম, আদর পেলেম, যত্ন পেলেম, সম্পূর্ণ মনের সুখে না হোক, কায়িক সুখে সেইখানে আমরা থাকলেম। আমি আর মণিভূষণ।
বরদার রাজকুমার রণেন্দ্র রায় বাহাদুর আমাকে সহস্র স্বর্ণমুদ্রা পুরস্কার দিয়েছিলেন। সেই টাকাগুলি আমি দীনবন্ধুবাবুর কাছে গচ্ছিত রাখি মাণিকগঞ্জে আসার সময় প্রয়োজনমত খরচপত্রের জন্য সেই টাকার মধ্যে দুইশত রজতমুদ্রা আমি সঙ্গে রেখেছিলেম; এই দূরপথে সেই টাকাগুলি আমার সম্বল। অন্বেষণ আরম্ভ কোল্লেম। হরিহরবাবুর মুখে শুনা হয়েছিল, মাণিকগঞ্জে একজনের বাড়িতে অমরকুমারী নামে একটি সুন্দরী বালিকা আছে, কোন কোন লোকের কাণাঘুষায় এই তত্ত্বটুকু তিনি অবগত হন; অজ্ঞাতকুলশীলা একটি বিদেশিনী কুমারী এই স্থানে একজনের বাড়িতে আছেন, কে সেই একজন, কোথায় তার বাড়ি, ঘর ঘর জিজ্ঞাসা কোরে সে সন্ধানটি ঠিক প্রাপ্ত হওয়া সহজ নয়; যে সকল লোকের কাণাকাণিতে হরিহরবাবু সেই কথা শুনেছিলেন, সেই সকল লোকের নামগুলিও তিনি মনে কোরে রাখেন নাই; রাখবার কোন আবশ্যকও ছিল না। কে অমরকুমারী, কোথা থেকে কার বাড়িতে এসেছে, কেন এসেছে, কে এনেছে, একজন নিঃসম্পর্কীয় ভদ্রলোক ততদূর বিশেষ কথা পরিজ্ঞাত হবার নিমিত্ত আগ্রহ প্রকাশ কোরবেন, এটাও সম্ভব নয়। ফল কথা, অমরকুমারীর ঠিক ঠিকানা শীঘ্র জানা গেল না। মোটামুটি অন্বেষণ কোল্লেম, কেহ কেহ হাস্য কোল্লে, কেহ কেহ চক্ষ পাকালে, কেহ কেহ মুখ বাঁকালে, কেহ কেহ যেন রঙ্গ করবার অভিলাষে “আয় গো নবীন বিদেশিনী, ডাকচে মোদের কমলিনী,” এই রকম গান গেয়ে আমাদের মুখের কাছে হাত নেড়ে নেড়ে চোলে গেল।
সমস্তই যেন তামাসা। আমার প্রাণের কতদূর উদ্বেগ, কেহই সেটা অনভব কোল্লে না। অনুভবের আশা করাও দুরাশা। এ অবস্থায় হয় কি? একপক্ষ অতীত। ঢাকার ফৌজদারী কাছারীতে অবশ্যই বহরমপুরের রূবকারি এসেছে, হাকিমের হুকুম, আইনসিদ্ধ সরাসরি কার্য্য, হুকুম তামিলে আমলারা বিলম্ব কোত্তে পারে নাই, এ কথা ঠিক, কিন্তু সে রূবকারির তত্ত্ব লওয়াতে এখন আমার ফল কি? একবার মনে কোরেছিলেম, ঢাকার সদর আদালতে যাব, রূবকারির খবরটা জানবো, নিষ্ফল বিবেচনা কোরে সে সঙ্কল্প ছেড়ে দিতে হয়েছিল।
মুখে মুখে লোকের কাছে কথা ফেলি, কেহ কিছু জানে কি না, জিজ্ঞাসা করি, যথাসম্ভব যথাশক্তি অন্বেষণ করি, সমস্তই বিফল হয়। যে দিন যেখানে যে রকম ফল হয়, রোজ রোজ হরিহরবাবুকে সেই সব কথা বলি, গম্ভীরভাবে তিনি চুপ কোরে থাকেন। মুখের ভাব দেখে আমার মনে হয়, তিনি যেন ভাবেন, তাঁর পূর্ব্বের কথাগুলি হয় তো মিথ্যা রটনা। হরিহরবাবুর ভাবনার সঙ্গে আমার ভাবনার সম্বন্ধ কি? যে ভাবনা আমার হৃদয়-পোষিত, সেই ভাবনাই আমি ভাবি। সে ভাবনার অংশী নাই;—একটি ভগ্নাংশের অংশী মণিভূষণ দত্ত।
একমাস পূর্ণ হতে যায়, কোন সন্ধান পাওয়া গেল না; এক প্রকার নিরাশ হয়ে মনে আমি স্থির কোল্লেম, অমরকুমারী মাণিকগঞ্জে নাই। বৃথা শ্রম, বৃথা কষ্ট, বৃথা ব্যয়, বৃথা একজন ভদ্রলোকের গলগ্রহ হওয়া, বৃথা কতকগুলি অচেনা লোকের কাছে উপহাসাস্পদ হওয়া। সন্ধান পাওয়া গেল না ভেবে মুর্শিদাবাদে যদি ফিরে যাই, সেখানে গিয়েও যদি ঐরুপ ভাবি, তাতেই বা কি হবে?
অনেক রকম আমি ভাবলেম; সে সকল ভাবনার কথা মণিভূষণকেও জানতে দিলেম না। একরাত্রে একটি নির্জ্জন ঘরে শয়ন কোরে পর পর নানা ঘটনা আমি স্মরণ কোচ্ছি, হঠাৎ মনে হলো, মাণিকগঞ্জ কতটুকু স্থান? সদরে মফঃস্বলে এমন অনেক স্থান আছে, একটা কোন প্রসিদ্ধ স্থানের নামে নিকটস্থ অনেকদূর পর্য্যন্ত বুঝায়; সেই ভাবটাই হঠাৎ আমার মনে উদয়; সেই গভীর রজনীতে কে যেন আমার কাণে কাণে বোলে দিলো “ঐ কথাই ঠিক; মানসিক ভূগোলের মানসিক মানচিত্রের ঐরূপ মনঃকল্পিত অঙ্করেখা প্রমাণে তুমি সেই পন্থা অবলম্বন কর!”
আমি ঘুমাই নাই, জাগিয়া জাগিয়া যেন ঐরুপ স্বপ্ন দর্শন কোল্লেম; স্বপ্নে যেন ঐরূপ দৈববাণী শ্রবণ কোল্লেম। পরীক্ষা করা আবশ্যক। প্রভাতে গাত্রোত্থান কোরে নিয়মিত নিত্যকর্ম্মসমাপনান্তে বাসা থেকে আমি বেরুলেম; একাকীই বেরুলেম; মণিভূষণকেও সঙ্গে নিলেম না। মানসিক ভূগোলের মানসিক মানচিত্র! হাঁ, মুদিতনয়নে সেই মানচিত্র আমি দর্শন কোরবো।
প্রতিজ্ঞা; প্রতিজ্ঞা-পালনে আমি সৰ্ব্বদাই তৎপর। মাণিকগঞ্জের লোকেরা যে স্থানটিকে মাণিকগঞ্জ বলে, যে পর্য্যন্ত মাণিকগঞ্জ সীমা দেয়, অনন্যমনে পরিমাণ কোত্তে কোত্তে পূৰ্ব্বদিকের সেই সীমা আমি অতিক্রম কোল্লেম; চোলেছি;—আপন মনেই চোলেছি;—পথের লোকেরাও চোলেছে, কোন লোককেই কোন কথা আমি জিজ্ঞাসা কোচ্ছি না, লোকেরাও কেহ কোন কথা আমারে জিজ্ঞাসা কোচ্ছে না; এক একজন কেবল আমার দিকে চেয়ে চেয়ে দেখছে, আমি তাদের দেখছি, সেটাও জানতে দিচ্ছি না; আড়ে আড়ে একটু একটু কটাক্ষপাত কোচ্ছি মাত্র। ঘর-বাড়ী দেখছি, বৃক্ষলতা দেখছি, ছোট বড় উদ্যান দেখছি, ছোট বড় সরোবর দেখছি, রকমারি মনুষ্য দর্শন কোচ্ছি, গরু, বাছর, ছাগল, কুকুর, বিড়াল ইত্যাদি নানাপ্রকার জীবজন্তুও দর্শন কোচ্ছি, মনে কোন প্রকার নূতন ভাবের উদয় হোচ্ছে না। অনেকদূর গিয়ে একটি লোককে আমি জিজ্ঞাসা কোল্লেম, “এ গ্রামের নাম কি?” লোক উত্তর কোল্লে, “মাণিকগঞ্জ।” তখন আমি মনে কোল্লেম, এই বটে সেই কথা। মানসিক ভূগোলের মানসিক মানচিত্র। এই বটে সেই কথা।
বেলা দুই প্রহরের পূর্ব্বে বাসায় ফিরে এলেম। কোথায় গিয়েছিলেম, কাহাকেও বোল্লেম না;—মণিভূষণকেও না। ক্লান্ত হয়েছিলেম, বৈকালে আর কোথাও গেলেম না; রাত্রে আমার কোথাও যাওয়া ছিল না, বাবুদের সঙ্গে খানিকক্ষণ খোসগল্প কোরে নির্দ্দিষ্ট স্থানে শয়ন কোল্লেম।
দ্বিতীয় প্রভাতে স্থানের দক্ষিণসীমায় পরিভ্রমণ। পূৰ্ব্বদিনের যে ভাব, এ দিনেও সেইরূপ। তৃতীয় দিবসে পশ্চিমসীমা, চতুর্থ দিবসে উত্তরসীমা উলঙ্ঘন। ডাকের কথায় যতদূরে যাই, ততদূর মাণিকগঞ্জ। মানসিক ভূগোলের মানসিক মানচিত্র।