» » » প্রথম কল্প : বঙ্গে প্রত্যাগমন

বর্ণাকার

ভূবনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়

হরিদাসের গুপ্তকথা
দ্বিতীয় খণ্ড

প্রথম কল্প : বঙ্গে প্রত্যাগমন

পথে কোন বিঘ্ন উপস্থিত হলো না, যথাযোগ্য যানবাহনে আমরা যথাসময়ে মুর্শিদাবাদে উপস্থিত হোলেম। বাড়ীর কর্ত্তার অদর্শনে সকলেই উদ্বিগ্ন ছিলেন, যদিও মধ্যে মধ্যে ডাকবাহকেরা উদ্বেগশান্তির দৌত্যকার্য্য কোরেছিল, তথাপি প্রভু সশরীরে উপস্থিত না থাকলে পরিবারবর্গের আকাঙ্ক্ষিত শান্তি পূর্ণাংশে মূর্ত্তিমতী হয় না। দীনবন্ধুবাবুর প্রত্যাগমনে সকলেই সুখী হোলেন, সকলের মনের উদ্বেগ দূর হলো; আমারে যাঁরা যাঁরা ভালবেসেছিলেন, আমারে দেখে তাঁরাও তুষ্ট হোলেন।

দেশভ্রমণের পরিচয় দিবার ভূমিকা আনয়নের অগ্রে পশুপতিবাবুকে আমি জিজ্ঞাসা কোল্লেম, “আমার মোকদ্দমা কতদুর? অমরকুমারীর সন্ধান হয়েছে কি না?”

পশুপতিবাবু উত্তর কোল্লেন, “বিশেষ সংবাদ আমি কিছু বোলতে পারবো না, আদালতে আমি যাই না, মণিভূষণের মুখে কেবল এইমাত্র শুনেছি, যে সকল ডাকাত ধরা পোড়েছিল, তাদের মধ্যে যে দুজন অমরকুমারীর চুরিমামলায় সংশ্লিষ্ট, তারা এখনো হাজতে আছে, বাকী লোকগুলোর ডাকাতী অপরাধে সাজা হয়ে গিয়েছে। তোমরা এখান থেকে চোলে যাবার পর আরো জনকতক ডাকাত ধরা পোড়েছিল, বমাল গ্রেপ্তার। তারাও যথাবিধি দণ্ডপ্রাপ্ত হয়েছে। আর একজন—”

ধৈর্য্য রাখতে না পেরে কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে চঞ্চলস্বরে আমি জিজ্ঞাসা কোল্লেম, “ও সব আইন-আদালতের কথা এখন আমি শুনতে চাচ্ছি না, অমরকুমারীর সংবাদ কি, সেইটি আপনি আগে বলুন, তার পর অন্য কথা।”

আমারে নিতান্ত অস্থির দেখে ছোটবাবু বোল্লেন, “শুনেছি না কি অমরকুমারীর সন্ধান হয়েছে, কিন্তু তাঁরে এখনো উদ্ধার করা হয় নাই। অমরকুমারী কোথায় আছেন, সেই সন্ধানটি জানা হয়েছে, যারা তারে সেইখানে রেখে দিয়েছে, তারা উপস্থিত না হলে নূতন আশ্রয়ের অধিকারীরা অমরকুমারীকে ছেড়ে দিতে চায় না, এই পর্য্যন্ত আমি শুনেছি।”

জলময় ব্যক্তি সম্মুখে একগাছি তৃণ দেখতে পেলে সেই তৃণ অবলম্বনে যেমন প্রাণে বাঁচবার আশা করে, অর্দ্ধ উল্লাসে আমার হতাশময় চিত্তে সেই প্রকার আশার সঞ্চার। ছোটবাবুর সঙ্গে যখন আমার কথা হয়, তখন রাত্রিকাল, কতক্ষণে রাত্রিপ্রভাত হবে, কতক্ষণে আমি বহরমপুরে যাব, সেই ভাবনায় অধীর হোলেম, একবারও নিদ্রা হলো না, জেগে জেগেই রাত্রি প্রভাত কোল্লেম।

প্রভাতে স্নানাহার না কোরেই তরণী আরোহণে আমার বহরমপুর-যাত্রা। উকীলবাবুর বাসায় গিয়ে স্নানাহার কোল্লেম, মোকদ্দমার স্থূল স্থূল বিবরণ শুনলেম, মনে তখন অনেকদূর আশ্বাসের উদয় হলো।

রক্তদন্তের সন্ধান হয় নাই। গ্রেপ্তারী পরোয়ানা আছে, পরোয়ানাতে হুলিয়া লেখা আছে, পুলিশের লোকেরাও স্থানে স্থানে সন্ধানে সন্ধানে ফিরছে, গ্রেপ্তার করবার সুবিধা হোচ্ছে না। নফর ঘোষাল পূর্ব্বে বোলেছিল, জটাধর গুজরাটে; জেরার মুখে অনেক তর্কবিতর্কের পর শেষকালে বোলেছে কলিকাতায়। জেরার মুখে কুঞ্জবিহারীও খেলাপ। কুঞ্জবিহারী প্রথমেই বোলেছিল কলিকাতা, জেরায় বোলেছে ঢাকা। ঢাকার পুলিশে পরোয়ানা গিয়েছে, ঢাকার মাজিষ্ট্রেট দস্তখৎ কোরেছেন, ঢাকার পুলিশ সেই আসামীটাকে খুঁজে খুঁজে হয়রাণ হয়েছে, সমস্ত যত্ন বিফল। রক্তদন্ত ঢাকায় নাই। সম্ভবতঃ অমরকুমারীর ঢাকায় থাকা সত্য হোতে পারে, কিন্তু ঢাকা একটি ক্ষুদ্রস্থান নয়, মুখের কথায় ঢাকা বোল্লেই অত বড় একটা জেলার ভিতর একটা লোককে খুঁজে বাহির করা সহজসাধ্য হয় না। নগরে কি উপনগরে, মহকুমায় কি পল্লীগ্রামে, তার একটা নিশ্চিত ঠিকানা চাই। সে ঠিকানা কে দিবে? হাজতী আসামীরা যদি জানে, জানে কি জানে, ঠিক নাই—যদি জানে, কখনই সত্যকথা বলবে না, কাজেকাজেই পুলিশের যত্ন বিফল।

আমার আর আদালতে যাওয়া আবশ্যক হলো না। মোকদ্দমা দায়ের আছে, মূল আসামী হাজির নাই, দরখাস্ত, রিপোর্ট, কৈফিয়ৎ, ইতিমধ্যে যা কিছু, আদালতে দাখিল হোচ্ছে, সমস্তই নথীর সামীল হয়ে যাচ্ছে; নথীর সঙ্গে পেস হবে, দস্তুরমত এই হুকুম। মোকদ্দমা কেবল দায়ের আছে মাত্র। সে অবস্থায় আমার এখন আদালতে উপস্থিত হওয়া নিষ্প্রয়োজন। হাজতী আসামীরা চুপচাপ; এখন আর তারা নূতন কথা কিছুই বলে না। সন্ধ্যার পূর্ব্বক্ষণ পর্য্যন্ত বহরমপুরে আমি থাকলেম, রজনীবাবু বাসায় এলে তাঁর কাছে পরামর্শ চাইলেম। কি করা কর্ত্তব্য? আমি যদি ঢাকায় যাই, কোথায় যাব? কোথায় অন্বেষণ কোরবো?—সহরে কি মফস্বলে অমরকুমারী আছেন, চোরেরা তাঁরে কোথায় নিয়ে লুকিয়ে রেখেছে, নিশ্চয় করা অসম্ভব; চেষ্টা কেবল পণ্ডশ্রম মাত্র। আমার এখন কি করা কর্ত্তব্য?

রাত্রেও আমি রজনীবাবুর বাসায় থাকলেম। রজনীবাবু, একটি পরামর্শ বোল্লেন। ঢাকাজেলার অনেকগুলি লোক বহরমপুরে থাকেন, মধ্যে মধ্যে তাঁরা বাড়ী যান, দুই একমাস বাড়ীতে বাস করেন, তার পর আবার অসেন। তাঁদের মধ্যে পাঁচ সাতজন প্রতিপত্তিশালী ভদ্রলোক। রক্তদন্তের চেহারাটা তাঁদের কাছে যদি বিশেষ কোরে বলা যায়, সে চেহারার কোন লোককে ঢাকার কোন স্থানে তাঁরা দেখেছেন কি না, এ কথা যদি জিজ্ঞাসা করা যায়, তা হোলে হয় তো কিছু না কিছু সূত্র প্রাপ্ত হওয়া যেতে পারে।

প্রভাতে আমি সেই পরামর্শ অনুসারে কার্য্য কোল্লেম। রজনীবাবু নিজেও আমার সহায় হোলেন। যেখানে যেখানে সেই সকল ঢাকাই বাবুর বাসা, সেই সেই স্থানে উপস্থিত হয়ে, প্রত্যেককে আমরা রক্তদন্তের উদ্দেশের কথা জিজ্ঞাসা কোল্লেম; কেহই কিছু ঠিক বোলতে পাল্লেন না; কেবল একটি লোক বোল্লেন, অনেক দিন হলো, মাণিকগঞ্জ মহকুমায় ঐরূপ চেহারার একটা লোককে তিনি একদিন দেখেছিলেন। কে তো কে, খবরেই আনেন নাই, এখনো পর্য্যন্ত সে লোক সেখানে আছে কি না, সে কথাও তিনি বোলতে পাল্লেন না।

এ সংবাদটাও অনিশ্চিত। শুনে রাখলেম, মাণিকগঞ্জ। যা হোক, তবু একটা সীমা পাওয়া গেল। উকীলের সঙ্গে উকীলের বাসায় আমি ফিরে এলেম। আহারান্তে রজনীবাবু আদালতে গেলেন, গঙ্গাপার হয়ে আমি আপনার মনিববাড়ীতে উপস্থিত হোলেম; যে যে কথা শুনে এলেম, বড়বাবুকে আর ছোটবাবুকে সেই সব কথা বোল্লেম। শুনে তাঁরা উভয়েই বিষন্নবদনে বোল্লেন, “তাই তো!”

তাঁরা বোল্লেন, তাই তো! আমিও ভাবলেম, তাই তো! কেবল “তাই তো” শুনেই, “তাই তো” ভেবেই নিশ্চিন্ত থাকতে পারা গেল না; বৈকালে আমি বোরাকুলি গ্রামে শান্তিরাম দত্তের বাড়ীতে গেলেম, মণিভূষণের সঙ্গে সাক্ষাৎ কোল্লেম, তীর্থদর্শন কোরে আমি ফিরে এসেছি, দেখে তাঁরা সন্তুষ্ট হোলেন। আমি তাঁদের সন্তোষ বিতরণ কোত্তে যাই নাই, যেটি আমার বলবার কথা, দুজনের সাক্ষাতেই সেটি আমি বোল্লেম। বন্ধু শান্তিরাম পরিণামদর্শী বিজ্ঞলোক, অনেকক্ষণ চিন্তা কোরে তিনি বলিলেন, “ওটা যেন বাতাসের কথা মনে হোচ্ছে, কবে কোন দিন সেই চেহারার একটা লোককে মাণিকগঞ্জে দেখেছিলেন, এই কথা শুনে মাণিকগঞ্জে ছুটে যাওয়া পরামর্শসিদ্ধ বিবেচনা হয়। তবে হাঁ, এমনটি যদি নিশ্চয় জানা যায় যে, অমরকুমারী মাণিকগঞ্জে আছেন, রক্তদন্ত এখন সেখানে থাকুক আর না থাকুক, তাতে আমাদের এখন কিছু আসে যায় না, পরোয়ানা আছে, যখন হোক, যতদিনে হোক, যেখানেই হোক, পুলিশের হাতে রক্তদন্তটা ধরা পোড়বেই পোড়বে। এখন তারে আমরা চাই না। অমরকুমারী মাণিকগঞ্জে আছেন, এ কথা যদি নিশ্চয় হয়, তা হোলে তো তোমরা কেন, আমি পর্য্যন্ত পুলিশের সঙ্গে সেখানে যেতে প্রস্তুত।”

আমি বিবেচনা কোল্লেম, বৃদ্ধের এই পরামর্শই যুক্তিযুক্ত। খানিকক্ষণ সেখানে থেকে মণিভূষণের সঙ্গে আমি ফিরে এলেম। সেই রাত্রেই শুনলেম, কৃষ্ণকামিনীর বিবাহ। যে পাত্রের সঙ্গে সম্বন্ধের কথা শুনে গিয়েছিলেম, সেই পাত্রের সঙ্গেই বিবাহ। বিবাহের আর দশদিন বাকী। সেই দশদিনের মধ্যে কৃষ্ণকামিনীর সঙ্গে আটদিন আমার এক একবার দেখা হয়েছিল। হর্ষ প্রকাশ কোরে আমি বোলেছিলেন, “প্রজাপতি সুপ্রসন্ন; তোমার বিবাহের নিমিত্ত সকলেই উদ্বিগ্ন ছিলেন, তুমিও ছিলে, আমিও ছিলেম; শুভদিন স্থির হয়েছে, শুনে আমি সখী হোলেম।”

আমি তো বল্লেম, সুখী হোলেম, কৃষ্ণকামিনী কিন্তু সে কথায় একটিও উত্তর দিলেন না; ম্লানবদনে ম্লাননয়নে খানিকক্ষণ কেবল আমার মুখপানে চেয়ে থাকলেন মাত্র। দুটি পাঁচটি অন্যকথা হলো, সে সব কথায় কুমারীকে বেশ সপ্রতিভ দেখলেম; কেবল বিবাহের কথায় কৃষ্ণকামিনী মৌনবতী; লজ্জায় মৌনবতী, তেমন লক্ষণ কিছু বুঝা গেল না, যেন কোন অন্যভাবে অন্যমনস্ক; বদন বিবর্ণ,—বিষণ্ন।

কথা আমি বাড়ালেম না, কুমারীর ঐ ভাব দেখেই শীঘ্র শীঘ্র সোরে এলেম। গাত্রে হরিদ্রা, আইবড়ো ভাত, অধিবাস যথারীতি সুসম্পন্ন; বিবাহরজনী সমাগত। বাবুদের উপরের নাচঘর সুসজ্জিত;—চিত্রপটে, পুষ্পমাল্যে, সুন্দর সুন্দর আলোকমালায় বিভূষিত, অনেকগুলি বরযাত্র সমাগত; বরযাত্রে কন্যাযাত্রে সে সময় বিদ্যার বিচারের প্রচলন ছিল, রহস্যে রহস্যে—গাম্ভীর্যে গাম্ভীর্যে সে সব পরীক্ষা হয়ে গেল। শুভলগ্নে কন্যাসম্প্রদান, তার পর বাসর-কৌতুক। কৃষ্ণকামিনীর বাসরবর্ণনা করা আমার কার্য্য নয়, এ বর্ণনায় আমি ক্ষান্ত থাকলেম।

কৃষ্ণকামিনী সুখে থাকুন, কৃষ্ণকামিনীর বিবাহোৎসবে আমার একটি বিশেষ মনস্কামনা পূর্ণ হলো। বরকর্তা-মহাশয় ঢাকা মাণিকগঞ্জে একটা বড়রকম চাকরী করেন। মাণিকগঞ্জ থেকেই তিনি পুত্রের বিবাহ দিতে মুর্শিদাবাদে এসেছেন, সেখানকার পাঁচসাতটি বন্ধুকেও সমভিব্যাহারে এনেছেন। পরিচয় পেয়ে বিবাহের পরদিন উপযুক্ত অবসরে বরকর্তার চরণে আমি গিয়ে প্রণাম কোল্লেম। পাঠকমহাশয় শুনে রেখেছেন, এই বরকর্তাটি দীনবন্ধুবাবুর ভগ্নীপতি, নাম হরিহর বন্দ্যোপাধ্যায়। দিব্য মিষ্টভাষী, সদালাপী, বদন সৰ্ব্বক্ষণ প্রফুল্ল, অমায়িক ভদ্রলোক। কৃষ্ণকামিনীর পিতাও কন্যাসম্প্রদানের নিমিত্ত এই বাড়ীতে এসেছিলেন; বিবাহের অগ্রে তাঁদের উভয়ের কাছেই দীনবন্ধুবাবু, আমার পরিচয় দিয়েছিলেন; পরিচয় শ্রবণ কোরে তাঁরা উভয়েই ক্ষণেক আশ্চর্য্যজ্ঞান কোরে আমার প্রতি সস্নেহ-ভাব জানিয়েছিলেন।

বিবাহের পরদিন হরিহরবাবুর সঙ্গে যখন আমি সাক্ষাৎ করি, একটি ঘরে তখন তিনি একাকী ছিলেন, প্রণাম কোরে একটু তফাতে গিয়ে আমি বোসলেম। প্রসন্নবদনে তিনি আমার সঙ্গে কথোপকথন আরম্ভ কোল্লেন। এ কথা, সে কথা, পাঁচ কথার পর ঠিক অবসর বুঝে আমি আমার মনের কথা তুল্লেম। বিনীতবদনে ধীরে ধীরে আমি বোল্লেম, “শুনেছি আপনি মাণিকগঞ্জে থাকেন; আমি একবার মাণিকগঞ্জে যাব।” বাবু, জিজ্ঞাসা কোপ্লেন, “কি নিমিত্ত?”

নিমিত্তটা আমি কি প্রকারে ব্যাখ্যা করি, কিয়ৎক্ষণ নীরব থেকে একটু চিন্তা কোল্লেম; শেষে বোল্লেম, “বিশেষ প্রয়োজন। একটা বানরমুখো কুব্জাকার লোক—নাম তার জটাধর তরফদার;—সৰ্ব্বাঙ্গে ভল্লুকের মত অনেক লোম; সেই লোকটা মাণিকগঞ্জে গিয়েছিল; সম্প্রতি এই তত্ত্ব আমি জানতে পেরেছি; আপনি কি সেই লোককে সেখানে দেখেছেন?”

চমকিত-নয়নে আমার দিকে চেয়ে গভীর-বদনে হরিহরবাবু বোল্লেন, “লোম? বানরের মত মুখ?—কুব্জাঙ্গ?—জটাধর?—কেন গা?—সে লোকের সঙ্গে তোমার কি?—মাণিকগঞ্জে একটা আড়ৎ-জায়গা; কত লোক যায়, কত লোক আসে,—হোতেও পারে,—হয় তো দেখে থাকবো, ঠিক স্মরণ কোতে পাচ্ছি , কিন্তু কেন গা; সে লোকটিকে কি তোমার দরকার আছে?”

“আমার দরকার নাই, আদালতের দরকার, তারে এখন আমি অন্বেষণ কোচ্ছি না, অন্বেষণ কোচ্ছি একটি বালিকাকে। সেই বানরমুখো লোকটা একটি কুমারী বালিকাকে এই মুর্শিদাবাদ থেকে চুরি কোরে নিয়ে পালিয়েছে; শুনতে পাচ্ছি, মাণিকগঞ্জে নিয়ে গিয়ে লুকিয়ে রেখেছে; বালিকাটির নাম অমরকুমারী। আপনি কি সে সংবাদ—”

একনিশ্বাসে তাড়াতাড়ি আমি ঐ সব কথা বোলছিলেম, ঐ পর্য্যন্ত শুনেই— যেন কি পূর্ব্বকথা স্মরণ কোরে, বিস্মিত-বদনে হরিহরবাবু বোল্লেন, “ও হো হো! বটে-বটে! একটি বিদেশিনী বালিকা আমাদের বাসার নিকটেই এক ব্রাহ্মণের বাড়ীতেই আছে বটে। মেয়েটিকে আমি দেখি নাই, লোকে কাণাকাণি করে, কোথা থেকে এসেছে, কে সেটিকে সেইখানে এনে লুকিয়ে রেখেছে, বাড়ীর বাহির হোতে দেয় না, দেখতে দিব্য সুন্দরী, যারা দেখেছে, তারা বলে, মেয়েটি কেবল কাঁদে আর ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলে। কি নামটি তুমি বোল্লে হাঁ হাঁ,—অমরকুমারী। আমিও শুনেছি, সেই মেয়েটির নাম অমরকুমারী। কেন গা?—সে মেয়েটি তোমার কে হয়?”

“কে হয়, সে কথা আমি এখন ঠিক বোলতে পারবো না; সকল পরিচয়ই আমার গোলমাল;—সে সব গোলমাল যদি আপনি শুনেন, অবাক হবেন; সে সব কথা বলবার এখন সময় নয়; সেই অমরকুমারী এক মহাসঙ্কটে একবার আমার প্রাণরক্ষা কোরেছিলেন। চোরেরা সেটিকে চুরি কোরে নিয়ে গিয়েছে, আমি সেটিকে উদ্ধার কোরে আদালতে উপস্থিত কোরবো, এই আমার পণ, এই আমার সঙ্কল্প, এই আমার অভিলাষ।”

অত্যন্ত উৎসাহে, অত্যন্ত উল্লাসে, অত্যন্ত আগ্রহে এইগুলি আমার উত্তর। আমার কণ্ঠস্বরের কম্পন অনুভব কোরে হরিহরবাবু বেশ বুঝতে পাল্লেন, যথার্থই অমরকুমারীর জন্য আমার প্রাণ কাঁদে। তিনিও বুঝতে পাল্লেন, আমিও সেই সময় উত্তেজিত-স্বরে বোলে উঠলেম, “অমরকুমারীর অন্বেষণে আমি মাণিকগঞ্জে যাব।”

আমার কাতরতা দেখে, অধীরতা দেখে, সদয়-বচনে বাবু, বোল্লেন, “আচ্ছা, আমি দেখছি। আমার আর বেশীদিন ছুটি নাই, সপ্তাহ পরেই আমি যাব, যদি তোমার ইচ্ছা হয়, আমার সঙ্গেই তুমি যেতে পার।”

আনন্দে আমার অন্তরাত্মা যেন নেচে উঠলো, অন্তরের কৃতজ্ঞতা জানিয়ে, দুই হাতে বাবুর পদধুলি গ্রহণ কোরে মস্তকে ধারণ কোল্লেম। আমার উভয় নেত্রে আনন্দাশ্রু প্রবাহিত হোতে লাগলো। কে একজন এসে সেই সময় বড়বাবুর নাম কোরে হরিহরবাবুকে ডাকলে, আমারে সেইখানে বোসতে বোলে, সেই লোকের সঙ্গে হরিহরবাবু শীঘ্র শীঘ্র বেরিয়ে গেলেন। প্রায় আধ ঘণ্টা সেইখানে আমি অপেক্ষা কোল্লেম, তিনি এলেন না, ক্রমশই বিলম্ব হোতে লাগলো, ধৈর্য্য রেখে আমি আর বেশীক্ষণ সেখানে একাকী বোসে থাকতে পাল্লেম না, আমিও সেখান থেকে উঠে এলেম। আনন্দের এক প্রকার উচ্ছ্বাস আছে, সেই উচ্ছ্বাসের সময় নাসাগ্রে বিন্দু বিন্দু ঘর্ম্ম দেখা দেয়; বক্ষঃস্থল কম্পিত হয়। খোলা বাতাসে ভ্রমণ করবার ইচ্ছা আছে; খোলা বাতাসে আমি বাহির হোলেম। অনেক দিনের পর অন্তরে আমার বিমল আনন্দ।

আমি মাণিকগঞ্জে যাব, মাণিকগঞ্জে আমি অমরকুমারীকে দেখতে পাব, অমরকুমারীকে আমি উদ্ধার কোরে আনবো, আমার অন্তর-সাগরে এই সকল উল্লাস-তরঙ্গের ঘন ঘন ক্রীড়া। কি আছে আমার মনে, কি কারণে আমার উল্লাস, কি সব কথা আমি শুনেছি, জনপ্রাণীর কাছেও তখন সে সব কথা আমি প্রকাশ কোল্লেম না; আপনার আনন্দে আপনিই আমি বিভোর হয়ে থাকলেম।

বিবাহের পরদিন বর-কন্যা বিদায় হয়, কুলাচারে অনেক পরিবারের এই প্রকার প্রথা; কিন্তু দীনবন্ধুবাবুর যত্নে হরিহরবাবুর সম্মতিক্রমে এই বাড়িতেই কুশণ্ডিকা, ফুলশয্যা সম্পাদিত হবে, বরকন্যা তিন দিন তিন রাত্রি এইখানেই থাকবেন, বরযাত্রীরাও সেই উৎসবে সাক্ষী হবেন, এইরূপ স্থির হলো। সে তিন দিন সকলেই ব্যস্ত, চোলে যেতে যেতে হরিহরবাবু, যখন আমারে দেখতে পান, প্রসন্ন-নয়নে চেয়ে চেয়ে একটু একটু হাসেন, আমিও নতবদনে একটু একটু হাস্য করি, এই প্রকার ভাব। ফুলশয্যার দিন সন্ধ্যাকালে একটা কাজের অছিলায় আমি একবার অন্দরমহলে প্রবেশ কোরেছি; পাড়ার স্ত্রীলোকেরা, বাড়ীর স্ত্রীলোকেরা, এক একটা ঘরের ভিতর মজলীস কোরে নানা রকম গোলমাল কোচ্ছেন, কেহ কেহ করতালি দিয়ে হাস্য-কৌতুক আরম্ভ কোরেছেন, চক্ষুকর্ণকে সে দিক থেকে ফিরিয়ে নিয়ে বড়বৌমার ঘরেই আমি প্রবেশ কোল্লেম। সে ঘরে তখন কেহই ছিলেন না; শূন্যঘরে প্রবেশ কোরে সন্দেহের আতঙ্কে তাড়াতাড়ি আমি বেরিয়ে আসছি, একদিক থেকে ছুটে এসে কৃষ্ণকামিনী আমার পথ আগলালেন : হাত ধোরে ঘরের ভিতর আমারে টেনে নিয়ে গিয়ে, সজোরে ঘরের দরজাটা ভেজিয়ে দিলেন; দুই হাতে আমার দুখানি হাত ধোরে সম্মুখে দাঁড়িয়ে, সুন্দর মুখখানির সঙ্গে সুন্দর চক্ষুদুটি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে, নববিবাহিতা নবসুন্দরী কেমন এক প্রকার নূতন সুরে বোল্লেন, “আর কি হরিদাস! আমার বিয়ে হয়ে গেল! মনে আছে তোমার? কি তোমারে আমি বোলেছিলেম, সে কথা তোমার মনে পড়ে? বিবাহে আমি সুখী হব না, তোমারে ভালবাসা দিয়েছিলেম, তুমি আমারে দিলে না, এ বিবাহে আমি সুখী হব না! মনে হয় যেন বেশী দিন আমি আর এ পৃথিবীতে খেলা করবার জন্য বেঁচে থাকবো না! এসো ভাই এইবার!–এসো ভাই! এই লও এই আমার সাধের ভালবাসার শেষ চুম্বন! সানুরাগে এই সব কথা বোলেই চপলা কৃষ্ণকামিনী আমার উভয় কপোলে চারিবার উষ্ণচুম্বন কোল্লেন! হরিদ্রা, চন্দন, চম্পক আর আতর গোলাপের মিশ্র সুবাস আমার নাসারন্তে যেন অগ্নিবর্ষণ কোত্তে লাগলো! কৃষ্ণকামিনী আপনার সুকোমল বাহুযুগলে আমার কণ্ঠ বেষ্টন কোরে, খানিকক্ষণ আমারে গাঢ় আলিঙ্গনপাশে আবদ্ধ রাখলেন। জোরে হস্তবন্ধন ছাড়িয়ে, চঞ্চল হস্তে দরজা খুলে, রুদ্ধশ্বাসে আমি চম্পট দিলেম; বাইরে এসে নিশ্বাস ফেল্লেম!

কৃষ্ণকামিনী ফুলশয্যার সুখযামিনী অবসান। চতুর্থদিবসের প্রাতঃকালে বরকন্যা বিদায় হোলেন, বরযাত্রেরা আপনাদের বংশানরূপ মর্য্যাদা প্রাপ্ত হয়ে বিদায় গ্রহণ কোল্লেন, বাবুদের সদরবাড়ী তখন যেন জনশূন্য হয়ে গেল। বাহিরের লোকের মধ্যে থাকলেন কেবল হরিহরবাবু আর তাঁর সমভিব্যাহারী বন্ধু সাতটি। বরের সঙ্গে বরকর্তা নিজবাড়িতে গেলেন না, কর্ম্মস্থলে ছুটি কম, মুর্শিদাবাদ থেকেই সরাসরি মাণিকগঞ্জে চোলে যাওয়া তাঁর পক্ষে সুবিধা, সেই কারণেই তিনি মুর্শিদাবাদে থাকলেন। আর তিন দিন পরেই তিনি রওনা হবেন, এইরূপ কথাবার্ত্তা স্থির।