ভূবনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়

হরিদাসের গুপ্তকথা
দ্বিতীয় খণ্ড

সপ্তম কল্প : এ আবার কে?

যখন চৈতন্যোদয় হলো, তখন আমি দেখলেম, বনমধ্যে একখানি কুটির, সেই কুটিরে পর্ণশয্যায় আমি শুয়ে আছি, আমার মাথার কাছে একটি স্ত্রীলোক উপবিষ্ট। কে এই স্ত্রীলোক? মানুষ যখন স্বপ্ন দেখে, তখন মনে করে, সব যেন ঠিক, স্বপ্নভঙ্গ হবার পর সকলের সকল কথা মনে থাকে না, স্বপ্নবৃত্তান্ত কেহ কেহ স্মরণ রাখতে পারে, কেহ কেহ পারে না, কিন্তু মূর্চ্ছার অগ্রে যা যা ঘটে, মূর্চ্ছাভঙ্গের পর সব কথাই মনে হয়। স্মৃতি আমারে পরিত্যাগ কোরে যায় নাই! তিনজন লোক আমার হিতৈষী হয়ে পথপ্রদর্শক হবার অঙ্গীকার কোরেছিল, পদব্রজে কষ্ট হবে বোলে অশ্ব সংগ্রহ কোরে দিয়েছিল, তাদের চক্রে আমার এই দশা। কারা তারা? কেন আমারে এই বিজনস্থানে এনে ফেলেছে, কেনই বা অজ্ঞান অবস্থায় বনমধ্যে পরিত্যাগ কোরে পালিয়েছে, বুঝে উঠতে পাল্লেম না; পালিয়েছে কি লুকিয়ে আছে তাও তখন জানতে পারা গেল না। এই স্ত্রীলোকটি কে?—তাদেরই কেহ হবে কিম্বা বনবাসিনী অন্য কোন কামিনী করুণাবশবর্তিনী হয়ে আমারে রক্ষা কোত্তে এসেছে, বিনা জিজ্ঞাসায় সেটিও আমি অবধারণ কোত্তে অক্ষম হোলেম।

সূৰ্য-দর্শনে অনুমান হোল বেলা এক প্রহর অতীত। বনমধ্যে কুটীর। কুটীরের চতুর্দিকে দৃষ্টিসঞ্চালন কোরে আমি অনুভব কোল্লেম, কেহই এখানে বাস করে না। বাসের যোগ্য যে সকল স্থান, সে সকল স্থানে মানুষের ব্যবহারের সামগ্রী থাকে; এ কুটীরে কিছুই নাই। পত্রশয্যায় আমি শয়ন কোরে আছি, মাথার কাছে সেই স্ত্রীলোকটি পত্ৰাসনে বসে আছে।

কিছুই যেন আমি দেখছি না, বাস্তবিক কিন্তু সেই স্ত্রীলোকের মুখের দিকে আমার নজর আছে। তার দিকে আমি চেয়ে দেখছি, তারে কিন্তু সেটি আমি জানতে দিচ্ছি না। আমার চক্ষে যখন তার চক্ষু পড়ে, তখন আমি অন্যদিকে চক্ষু ফিরাই।

কিঞ্চিৎ অগ্রে আমি ভাবছিলেম, কে এই স্ত্রীলোক? এই সময় অনেক পরিমাণে সে ভাবনা দূরে গেল। একরকমে সেই স্ত্রীলোকটি আমি চিনলেম। সে আমারে চিনতে পেরেছিল কি না, তা আমি বলতে পারি না। বাঙালীর ঘরের কন্যা, মুখশ্রীতে সে লক্ষণ বেশ জানা যাচ্ছে; কিন্তু বাঙালীর মেয়ে আপনাদের ঘরে যেমন থাকে, যেমন অলঙ্কারবস্ত্র পরিধান করে, যে ভাবে মস্তকে কেশবিন্যাস করে, এ মূর্তিতে সে ভাবের অভাব। বাজীকরী ভানুমতীরা যে রকমে কাপড় পরে, সেই ভাবে মালকোঁচ্চা কোরে কাপড় পরা, বক্ষে রক্তবর্ণ কাঁচলি, সেই কাঁচলির উপর বসনাঞ্চল খুব চোস্ত কোরে বাঁধা; গলায় একছড়া তবলকীর মালা, দুই কানে দুটি রূপার মাকড়ী, তাতেও তবলকী গাঁথা; মাথার চুল কিছু খাটো খাটো, সে চলগুলি কপালের দিকে টেনে বামদিকে নাড়ুগোপালের চূড়ার মত চূড়াকরা। একরকম ছদ্মবেশ বোল্লেও বলা যায়। তথাপি মুখ দেখে তারে আমি চিনলেম।

অনেকক্ষণ আমার দিকে চেয়ে চেয়ে সেই স্ত্রীলোক আমারে জিজ্ঞাসা কোল্লে, “তোমার কি ক্ষুধা হয়েছে? তুমি কি এখন স্নান কোরবে?” প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে আমি তারে জিজ্ঞাসা কোল্লেম, “কোথায় আমি এসেছি? যারা এনেছে, তারা কোথায় গেল?”

আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে স্ত্রীলোকটি সেখান থেকে উঠে গেল; একটু পরে এক কলসী জল আর একখানি ক্ষুদ্র বস্ত্র এনে সে আমারে স্নান কোত্তে বোল্লে। আমি কথা কোইলেম না। স্ত্রীলোক হড় হড় কোরে আমার মাথায় এক কলসী জল ঢেলে দিলে, মার্জনী অভাবে আমার মস্তক গাত্র জলসিক্ত থাকলো; শুষ্ক বস্ত্রখানি পরিধান কোরে সিক্ত বস্ত্রখানি আমি পরিত্যাগ কোল্লেম। স্ত্রীলোকটি আবার চোলে গেল; আবার একটু পরে গুটিকতক ফল আর এক ভাঁড় জল এনে আমারে খেতে দিলে। দুটি ফল ভক্ষণ কোরে আমি জল খেলেম। কিছুই ভাললাগে না। যে অবস্থায় আমি পতিত, সে অবস্থায় কিছু ভাল লাগাও সম্ভব নয়।

বেলা যখন প্রায় দুই প্রহর, সেই সময় সেই স্ত্রীলোক কিঞ্চিৎ ইতস্ততঃ কোরে আমারে জিজ্ঞাসা কোল্লে, “যদি তোমার বিশ্বাস হয়, বিশ্বাস কর, আমি গৃহস্থকন্যা, আমার হস্তে অন্ন গ্রহণ কোত্তে তোমার কোন বাধা আছে কি না?”—অন্নগ্রহণে আমার ইচ্ছা ছিল না, গৃহস্থকন্যা সামান্য কথা, ব্রাহ্মণের কন্যা বোলে পরিচয় দিলেও অন্নগ্রহণে আমার রুচি হোতো না। আমি নিরুত্তর থাকলেম। অনেকক্ষণের পর সেই স্ত্রীলোককে আমি জিজ্ঞাসা কোল্লেম, “এ জায়গায় তুমি কেন থাক? আর কে কে এখানে থাকে?”

স্ত্রীলোক উত্তর কোল্লে, “কেহই থাকে না, আমিও থাকি না, নূতন এসেছি। যারা তোমারে এনেছে, তারাও নূতন, আমিও নূতন। যখন যেখানে তারা যায়, আমারেও সঙ্গে নিয়ে যায়, যেখানে তারা আড্ডা করে, আমারেও সেইখানে থাকতে হয়।”

আমি মনে কোল্লেম, যখন যেখানে যায়, তখন সেইখানে আড্ডা করে, বেদেদের টোলফেলা; সেই জন্যই এই স্ত্রীলোককে ভানুমতীর সাজে সাজিয়ে রেখেছে। তারা বাজীকর, এখন আমি বেশ বুঝলেম। ঘোড়ার পিঠের জীনটা ঘুরে ঘুরে আমারে নাগরদোলায় দুলিয়েছিল, সেটা বাজীকরের কৌশল, এখন ঠিক বুঝলেম; কিন্তু এই স্ত্রীলোক কি কোরে বাজীকরের দলে মিশে আছে, সেটি আমি ভাল কোরে বুঝতে পাল্লেম না। রাত্রিকালে তাদের মুখে যদি ভাল কোরে আমি দেখতে পেতেম, তা হোলেও এক রকমে কিছু অবধারণ কোত্তে পাত্তেম, কিন্তু ঘোর অন্ধকারে সে তিনটে লোকের মুখ-দর্শনে আমার সুবিধা হয় নাই; অজ্ঞানাবস্থায় আমারে এইখানে ফেলে রেখে তারা গা-ঢাকা হয়েছে, আমি এখন এই স্ত্রীলোকটির জিম্মায়।

বেলা ক্রমশই অধিক হোতে লাগলো। স্ত্রীলোকটিকে আমি বোল্লেম, “আমার ক্ষুধা নাই, আহারে আমার রুচি নাই, আমার জন্য তুমি কেন আর কষ্ট পাও? তুমি গিয়ে আহার কর, তোমার লোকেরা যদি এসে থাকে, তাদের আহার করাওগে, আর একবার আমারে দেখা দিও।”

স্ত্রীলোক বোল্লে, “পালিও না, পালাবার চেষ্টা কোরো না, পালাতে পারবে না, এ স্থানটা অরণ্যময়, চারিধারে গড়খাই খালের ভিতর অগাধ জল, পালাবার উপায় নাই, পালাবার চেষ্টা কোল্লেই বিপদে পোড়বে।”

আমি ঈষৎ হাস্য কোল্লেম, কিঞ্চিৎ উত্তেজিতম্বরে বোল্লেম, “যারা আমারে এখানে এনেছে, তাদের সঙ্গে একবার দেখা না কোরে কোথাও আমি যাব না, তুমি স্বচ্ছন্দে আপনার গৃহকর্মে মনোযোগী থাক। আর দেখ, তোমারে যেন কোথায় আমি দেখেছি, এই রকম মনে হোচ্ছে, তোমার শরীরে দয়া আছে, তাও আমি বুঝতে পাচ্ছি; আমার প্রতি দয়া রেখো; কাজকর্ম সারা হোলে আর একবার তুমি আমার কাছে এসো; তোমার সঙ্গে আমার কতকগুলি কথা আছে।”

এইবার সটান আমার মুখের দিকে চেয়ে, মুখখানি একটু ভারী কোরে, স্ত্রীলোকটি কুটির থেকে বেরিয়ে গেল। আমি একাকী হোলেম। সূর্য কাহারও অনুরোধ উপরোধ রক্ষা করেন না। আমি বিপদে পোড়েছি, দিনমানে একটু নির্ভয় থাকি রাত্রিকালে বড় যন্ত্রণা, তুমি একটু থেকে যাও; আমার উপকারের জন্য তুমি একটু অপেক্ষা কর। যোড়হাতে মিনতি কোরে এরূপ প্রার্থনা কোল্লেও সূর্যদেব সে প্রার্থনা শ্রবণ করেন না। সেই অবস্থায় আমারে রেখে দিবাকর পশ্চিমাচলে অস্ত গেলেন। অন্ধকারে সেই কুটিরমধ্যে আমি থাকলেম। একাকী। সে স্ত্রীলোক আর ফিরে এলো না।

স্ত্রীলোকের মুখে আমি শুনেছি, এখানে তারা নূতন। ভালমানুষ নয়; ভালমানুষ হোলে অবশ্য লোকালয়ে থাকতো, বনের ভিতর থাকতো না, বনের ভিতর লুকিয়ে আছে, নিশ্চয়ই দুষ্ট মতলব। যে প্রকারে ঘোড়ায় তুলে এই বনের ভিতরে তারা আমারে এনেছে, তাতে আর নিশ্চয়তার বাকী কিছুই নাই। ঐ স্ত্রীলোকটি আমার চেনা; যা বোলে আমি চিনেছি, তাই ঠিক; বসন-ভূষণের পরিবর্তন হয়েছে, মুখের গঠনের পরিবর্তন হয় নাই, আমার চক্ষেরও ভুল হয় না; যা ভেবে চিনেছি, তাই ঠিক।

মহা বন, চারিদিকে গড়খাই, এই গড়বন্দী অরণ্যমধ্যে সেই তিনটি লোক আছে আর ঐ স্ত্রীলোকটি আছে, আরও কেহ কেহ থাকলেও থাকতে পারে। কুটির কেবল এই একখানি নয়, আরও কুটির আছে, সেই কুটিরে সেই স্ত্রীলোকটি গিয়েছে। ফিরে আসবার কথা আছে, আমিও ফিরে আসবার আমন্ত্রণ কোরেছি; কিন্তু এলো না। কতক্ষণ আমি এই অন্ধকারে একাকী অবস্থান কোরবো, তাই ভাবতে লাগলেম।

সে ভাবনা বড় নয়, তদপেক্ষা বড় ভাবনায় আমার হৃদয় ব্যাকুল। আবার আমি অমরকুমারীকে হারালেম! এত কষ্টে উদ্ধার কোরে আনলেম, এনেও নিরুদ্বেগ হোতে পাল্লেম না। হাকিমের বাসায় অমরকুমারী আছেন, মণিভূষণ রক্ষক আছেন, দুষ্টলোকেরা সেখান থেকে অমরকুমারীকে হরণ কোত্তে পারবে না, সেটি আমি বুঝতে পাচ্ছি, কিন্তু অমরকুমারীকে আমি দেখতে পাচ্ছি না; এই বড় আক্ষেপ।

কোথায় আমি এলেম? সেই তিনজন লোক কোথাকার? কেন তারা তেমন কোরে আমারে এই বনের ভিতর ধোরে নিয়ে এলো? আমি তাদের কাছে কি অপরাধ কোরেছিলেম? কি অপরাধে তারা আমার শত্রু? তারাও কি রক্তদন্তের দলের লোক? তাই হবে। রক্তদন্তের লোক সর্বঠাঁই! যেখানে আমি সেইখানেই রক্তদন্তের চর! প্রতাপ সামান্য নয়! আচ্ছা, রক্তদন্তের লোক তারা, এই যদি ঠিক হয়, তবে তারা একটি মেয়েমানুষের কাছে আমারে রেখে সোরে গেল কেন? সম্মুখে আর এলো না কেন? বেঁধে রাখলে না, প্রহার কোল্পে না, ভয় দেখালে না, অমনি অমনি সোরে গেল; মানে কি? শীঘ্র যদি আমি এখান থেকে মুক্ত না হোতে পারি, অবশ্যই আমার অনুমান একজন হাকিমের বাসাতে আমি থাকি, পূর্বদিন বৈকালে আমি বেরিয়ে এসেছিলেম, সমস্ত রাত্রির মধ্যে ফিরে যাই নাই, আজও সমস্ত দিন গেলেম না, অবশ্যই অনুসন্ধান হবে; হয় তো অনুসন্ধান আরম্ভ হয়েছে, কিন্তু এই নিবিড় জঙ্গলের মধ্যে আমি আবদ্ধ, নগরে আমারে পাওয়া যাবে না; বনে আমি আছি, এ সংবাদও প্রচার হবে না, অন্বেষণকারীরা কোথায় আমার দর্শন পাবে?

কপট-চাতুরীতে যারা আমারে এই বনের ভিতর এনেছে, তারা আর এখন দেখা দিচ্ছে না। কি মতলবে এনেছে, তাও আমি জানতে পাচ্ছি না। প্রাণে মারবে কি বাঁচিয়ে রাখবে, তারাই জানে। আমি মরি আর বাঁচি, তাতে আর আমার ক্ষোভ থাকছে না। কেন যে আমি পৃথিবীতে এসেছিলেম, পাঠাবার অগ্রে বিধাতার মনে যে কি ছিল, সে তত্ত্ব বিধাতারই সুগোচর; আমার ভাবনা বৃথা। জন্ম হয়েছে, বেঁচে আছি, এইমাত্র। এই বয়স পর্যন্ত জীয়ন্তে আমি মৃতবৎ; মরণেও আমার ক্ষোভ নাই। যদি মরি, অমরকুমারী নিরাপদ, এটি আমি জেনে যাব। আপাততঃ রক্ষক একজন হাকিম, অভিভাবক মণিভূষণ দত্ত। এখানকার কার্য সমাধা হবার পর অমরকুমারীকে সঙ্গে কোরে মণিভূষণ দেশে যাবেন, বৃদ্ধ শান্তিরাম দত্ত অমরকুমারীরে সযত্নে পালন কোরবেন, দীনবন্ধুবাবু পশুপতিবাবু তত্ত্বাবধান কোরবেন। অমরকুমারীর বিবাহ হবে।

অহো! অকস্মাৎ আমার প্রাণ কেন এমন করে? বড় গরম! প্রাণ আই ঢাই কোচ্ছে! এতক্ষণ তো এ রকম ছিল না, হঠাৎ কেন এমন হয়? অমরকুমারীর বিবাহ হবে, আমি দেখতে পাব না, সেই জন্যই কি প্রাণ আমার এত অস্থির?

ছুঁড়িটা কোথায় গেল? আমারে চৌকি দিবার জন্য নষ্টলোকেরা তারে এখানে বোসিয়ে রেখেছিল, আমি পালাতে পারবো না; ছুঁড়ী আমারে এই কথা বোলে ভয় দেখিয়ে গেল, আর এলো না। পিপাসায় যদি আমার ছাতি ফাটে, এক বিন্দু জল পাবো না। ছুঁড়িটা গেল কোথায়? কেন এলো না? বোধ হয়, আমারে চিনতে পেরেছে। যখন আমার জ্ঞান ছিল না, তখন সে ছিল; যখন আমি চৈতন্য পাই, তখনও সে ছিল, কথাও কোয়েছিল, চিনেছে, তেমন ভাব কিছুই জানায় নাই। আমি চিনেছি, সে ভাবটি আমিও তারে জানাই নাই। এখন আমি কি করি?

ভাবছি, এমন সময় একটা জলন্ত মশাল হাতে কোরে একটা লোক সেই কুটিরের মধ্যে প্রবেশ কোল্লে, একবার তার মুখের দিকে চেয়ে আমি মাথা হেঁট কোল্লেম। সে লোককে পূর্বে আমি কখন দেখি নাই, রাত্রে যারা আমাকে ঘোড়ায় তুলে বনে এনেছে, সেই লোকটা তাদের মধ্যে একজন, তাতে আমি কোন সন্দেহ রাখলেম না, কিন্তু তারে দেখে আমার কোন প্রকার ভয় হলো না। প্রাণে যার মায়া নাই, শত্রু-দর্শনে তার কোন প্রকার ভয় হোতেও পারে না। আমি ভয় পেলেম না। পূর্বরাত্রে পথের ধারে যখন তারা আমাকে দেখে, আমি যখন তাদের দেখি, রাত্রের অন্ধকারে তখন আমি তাদের মুখ ভাল কোরে দেখতে পাই নাই; তথাপি আমি স্থির কোল্লেম, সেই তিনজনের মধ্যেই এই একজন।

মশাল হাতে কোরে লোকটা খানিকক্ষণ নীরবে আমার সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকলো। তার পর ভাঙা কাঁসি যেমন খন খন শব্দে বাজে, সেইরূপ আওয়াজে সগর্জনে আমারে জিজ্ঞাসা কোল্পে, “কি রে ছোকরা! তোর নাম হরিদাস? এই বয়সে ততটা ধূৰ্ততা তুই কোথায় শিখেছিস? আমাদের হাতে এইবার সেই ধূর্তটা ভাঙবে।”

প্রথমে তার মুখ দেখে আমি মাথা হেঁট কোরেছিলেম, এই সময় মাথা তুলে তার মুখে পানে চেয়ে আমি জিজ্ঞাসা কোল্লেম, তোমরা কে?

হি হি শব্দে হাস্য কোরেই সেই লোক উত্তর কোলে, “আমরা কে? কোন আমরা? আমাদের পরিচয় অনেক। সে সকল পরিচয়ে তোর কি দরকার?”

ধীরস্বরে আমি বোল্লেম, দরকার আমার কিছুই নাই, তবে কি না, বিনা দোষে আমারে বনবাসে এই কারাযন্ত্রণা ভোগ কোত্তে হোচ্ছে, অকারণে তোমরাই আমার এই যন্ত্রণার হেতু, সেই জন্যই আমি জানতে চাই, তোমরা কে? কেন আমারে ধোরেছ? একবার আমি ভেবেছিলেম, অদ্য কোন লোককে ধরবার তোমাদের মতলব ছিল, অন্ধকারে ঠিক কোত্তে না পেরে আমারেই ধোরে ফেলেছ, এখন দেখছি, তুমি আমার নাম পর্যন্ত জানো, কেন আমারে ধোরেছ, সেইটি জানতে পারলে,—

মশালটা একধারে নামিয়ে রেখে উগ্রমূর্তি ধারণ কোরে, উগ্রস্বরে সেই লোক বোলে উঠলো, “জানতে পারলে তুই কি কোরবি? ভারী চালাক! এবারে আর চালাকী খাটছে না যাদু! গুজরাটের বরদা রাজ্য নয়! এ রাজ্য প্রবল প্রতাপ ইংরেজের, এখানে লোকের চক্ষে ধূলা দেওয়া বড় শক্ত কথা! একজন বিশ্বাসঘাতক রাজকুমার, কে জানে রাজকুমার কি প্রেতকুমার, সে ব্যক্তি ছদ্মবেশে বীর মল্লের আশ্রয়ে থেকে, বীরমল্লকে ধোরিয়ে দিয়েছে। হস্তী-পদতলে নিক্ষেপ কোরে সেই বীর-পুরুষের বীরদেহ ধূলিসাৎ কোরেছে, তুই তার সহায় হয়েছিলি, সেই নিমখারাম তোর মুরব্বি হয়েছে, এইবার দেখা যাবে, কে তোরে রক্ষা করে! তুই হয় তো মনে করেছিস, আমরা নিকটে থাকি না, তোরে আমরা বেঁধে রাখি নাই মনে কোল্লেই তুই পালাতে পারিস, সেই সাহসেই তোর বুকে ভয় নাই। হাঁ, আমরা নিকটে থাকি না, সম্মুখে আসি না, এ কথা সত্য, কিন্তু দূরে দূরে আমরা বিচরণ করি। দূরে থেকে তোকে পরীক্ষা করি। আমরা কেবল তিনজন নহি। তুই যা মনে ভাবিস, তা নয়, আমরা অনেক, আমাদের তাঁবেদার বন্দুকধারী লোকেরা গড়ের ধারে ধারে দিবারাত্রি পাহারা দেয়। পালাবার চেষ্টা কোল্লেই তুই মারা যাবি।

লোকটা নিস্তব্ধ হলো। মশাল জ্বোলছিল, লোকের মুখের দিকে চেয়ে আমি বুঝলেম, তার কথাগুলো আমার উপর কতদূর কাজ কোরেছে, রক্ত বর্ণ বক্রনয়নে আমার মুখের দিকে চেয়ে চেয়ে সেই লোকটা তাই পরীক্ষা কোচ্ছে। বাস্তবিক ঔষধ ধরে নাই, কথাগুলো আমার উপর কিছুই কাজ করে নাই;—

কাজ করা মানে আমার ভয় পাওয়া। আমি কিছু মাত্র ভয় পাই নাই, আমি তখন ভাবছিলেম, লোকটা মিথ্যাবাদী; দুষ্টলোকে সত্যবাদী হয় না। ধূর্তলোকে সত্যকথা বলে না। জানি, তথাপি আমি মনে কোল্লেম, এ লোকটার আগাগোড়া সমস্তই মিথ্যাকথা। যে স্ত্রীলোকটা আমার কাছে ছিল, আমি তারে চিনেছি, সে এখনও এ সব লোকের দলে দস্তুরমত অভিষিক্ত হয় নাই। অকপটে সে আমারে বোলেছে এ বনে তারা নূতন; এ লোকটা বোলছে, তাঁবেদার লোকেরা দিবারাত্রি গড়ের ধারে পাহারা দেয়। গড় যেন এই সব লোকের ইন্তমুবারী ভোগ-দখলী মৌরাশী পাট্টাই। পুরষানুক্রমে এরা যেন এই গড়বন্দী অরণ্যের অবিরোধ অধিকারী! কাণ্ডই মিথ্যা।

নানা কথায় আমারে ভয় দেখিয়ে, লোকটা সেখান থেকে চলে গেল। মশালটা নিয়ে যেতে ভুলে গেল না। কুটির অন্ধকার। আবার আমি ঘোর অন্ধকারে একাকী স্ত্রীলোকটা এলো না। গত রাত্রে আমি উপবাস কোরেছি, আজি দিবাভাগে গোটা দুই ফল খেয়েছি; ক্ষুধার উদ্রেক নাই, কিন্তু পিপাসা ধারণ করা যায় না। পিপাসা হোচ্ছে; স্ত্রীলোকটা যদি আসে, একটু জল পাবার আশা হয়। জল পিপাসা অপেক্ষা সে সময় আমার আর একটা পিপাসা ছিল। যা আমি ভেবেছি, যা আমি স্থির করেছি, যা বলে চিনেছি, বাস্তবিক সেই স্ত্রীলোকটি, সেই স্ত্রীলোক কি না, সেই তত্ত্বটি পরিজ্ঞাত হবার পিপাসা।

অন্ধকারে আমি বসে আছি, প্রায় অর্ধদণ্ড অতীত। বাহির দিকে একটু দূরে অল্প অল্প আলো দেখা গেল। যে লোকটা মশাল হাতে কোরে বেরিয়েছে, সেই লোক হয় তো আবার ফিরে আসছে, এইরূপ আমি মনে কোল্লেম। তা নয়, সে নয়; আলো যখন ক্রমশঃ নিকটবর্তী হলো, তখন দেখলেম, সেই পূর্বে কথিত স্ত্রীলোক। কুটিরদ্বারে ক্ষুদ্র এক লণ্ঠন হস্তে সেই স্ত্রীলোক।

স্ত্রীলোক কুটিরমধ্যে প্রবেশ কোল্লে, লণ্ঠনটি পাশে রেখে আমার নিকটে এসে বোসলো, অতি নিকটে। আমি তার মুখ দেখলেম। মুখে ম্লানও নয়, মাঝে হাসিও নাই; অথচ ভাবে যেন একটু হাসি হাসি বুঝা গেল। সেইভাবে সেই মুখখানি ঘুরিয়ে সে আমারে বোল্লে, “কেমন শুনলে? যা আমি বোলেছিলেম, তাই ঠিক কি না? পালাবার উপায় নাই।”

সে প্রশ্নের উত্তর দেওয়া আমি অনাবশ্যক বিবেচনা কোল্লেম। পূর্বাবধি যে কথাটি আমার মনে মনে জাগছিল, সেই কথাই অগ্রে উত্থাপন করি এই আমার অভিলাষ; কিন্তু হলো না, স্ত্রীলোক পুনরায় আমারে জিজ্ঞাসা কোল্লে, “যে লোকটি এসেছিল, তোমারে আর কি কি কথা বোলে গেল? আমি তোমার কাছে অনেকক্ষণ ছিলেম, তার পর অনেকক্ষণ অনুপস্থিত ছিলেম, তাতে কি তার রাগ রাগ ভাব দেখলে?”

আর আমি ধৈর্য রাখতে পাল্লেম না, ক্ষুধা আমার পূর্বেই দূর হয়েছিল, একটু পূর্বে একটু পিপাসা এসেছিল, ছুঁড়িটার বাচালতা দেখে, সে পিপাসাও দূর হয়ে গেল। এক নিশ্বাসে আমি জিজ্ঞাসা কোল্লেম, “নবীন! এ বনে কি তুমি নবীন তপস্বিনী?”

প্রশ্ন শ্রবণ মাত্র, স্ত্রীলোকটা চমকে গেল। আঁতে ঘা লাগলো। তার চক্ষু তখন আমার চক্ষের দিকে ছিল না। সহসা সমসূত্রে আমার চক্ষের দিকে চক্ষু উত্তোলন কোরে ছুঁড়ী খানিকক্ষণ হাঁ কোরে থাকলো; যতক্ষণে অন্ততঃ দশবার চক্ষের পলক পড়া সম্ভব, ততক্ষণের মধ্যে একটিবারও পলক ফেলে না। ভাব আমি তৎক্ষণাৎ বুঝতে পাল্লেম তার নাম আমি জানতে পেরেছি, নাম ধোরেই সম্বোধন কোরেছি, তার পরিচয় আমি জানি, সে জন্যই তার বিস্ময়।

বিস্ময়ে জড়ীভূতা সেই নবীন বন-বাসিনী চমকিতনয়নে চেয়ে অবাক হয়ে আছে, সেই ভাব দর্শন কোরে পুনরায় আমি জিজ্ঞাসা কোল্লেম, “নবীন! তোমার এ দশা কতদিন? কতদিন তুমি এই দস্যুদলের সহচারিণী? আমি এখান থেকে পালাতে পারবো না, সেই কথা তুমি বোলেছিলে, এবার তুমি আসবার কিছু পূর্বে যে লোক এখানে এসেছিল, সেই লোকটিও সেই কথা বোলে গেল। তার সঙ্গে তোমার কি সম্বন্ধ? আমার সঙ্গে তোমার কি শত্রুতা? আমারে তুমি চিনতে পেরেছ? তোমার চাউনি দেখেই তা আমি বুঝতে পেরেছি। তোমার ভাগ্যে এই ছিল, স্মরণ কোরে আমার প্রাণে কষ্ট হোচ্ছে; কিন্তু এ কি বিপরীত! আমি বিপদে পড়েছি, তাতে তুমি আহ্লাদিনী! ধর্ম ভাবটা তুমি একেবারেই ভুলে গিয়েছ। যে পথে তুমি এখন দাঁড়িয়েছ, যারা যারা সে পথে আসে, তারা সকলেই ধর্মভাব ভুলে যায়। দেখ নবীনকালি! দুই একদিন নয়, অনেকদিন তোমাদের বাড়ীতে আমি ছিলেম, তোমাদের সংসারে যাতে মঙ্গল হয়, তোমরা যাতে সুখে থাক, সাধ্যমত সেই চেষ্টাই আমি কোরেছি, তাও তুমি জানো; কি অবস্থায় কি প্রকারে এই বিজন বনমধ্যে আমি এসে পড়েছি, তাও তুমি জেনেছ; এ অবস্থায় তোমার কি করা কর্তব্য, সেটা তুমি ভাবলে না; যাতে আমি এখানে থেকে পালাতে না পারি, তাই তুমি ইচ্ছা কোচ্ছো! চিরদিন আমি সত্যধর্মের সেবা করি, তুমি নিশ্চয় জেনো, তোমার ইচ্ছা কখনই ফলবতী হবে না। মানুষ পৃথিবীতে আসে, চিরকাল পৃথিবীতে থাকে না। মানুষ কখনও অমর হয় না। কিছুদিন ইহসংসারে সুখভোগ অথবা দুঃখভোগের পর, মানুষকে এক অজ্ঞাত দেশে চলে যেতে হয়; সে দেশের নাম পরলোক। সে লোকের অবস্থার নাম পরকাল। সে লোকে সে কালেও সুখ-দুঃখের ভোগ আছে। তুমি অভাগিনী, পাপবুদ্ধির বশবর্তিনী, পাপীলোকের সঙ্গিনী, এ সব ঠিক; কিন্তু অবকাশ কালে নির্জনে এক একবার পরকালের কথাটা মনে কোরো।”

এইবার নবীনকালীর ঘন ঘন চক্ষের পলক পড়তে লাগলো। তার সর্বশরীর সিউরে উঠলো; কি যেন আমারে বোলবে বোলবে। মনে কোল্পে, দুই তিনবার একটু একটু হাঁ কোল্লে, কথা ফুটলো না, বোলতে পাল্লে না।

পাঠক মহাশয় হয় তো এই স্ত্রীলোকটির পরিচয় জানবার নিমিত্ত উৎসুক হয়ে থাকবেন। এই স্ত্রীলোক বঙ্গবাসিনী। শেষকালে কাশীবাসিনী হয়েছিল। কাশী রমণবাবুর বাড়ীতে যখন আমি আশ্রয় পাই, তখন তাঁর পরিবারবর্গের সঙ্গে আমার জানাশুনা হয়। রমণবাবুরা তিন সহোদর। তিনি জ্যেষ্ঠ, রামশঙ্কর মধ্যম, মতিলাল কনিষ্ঠ। তাঁদের পিসীমার দুটি কন্যা, সেই দুটি কন্যার মধ্যে একটি কন্যা এই নবীনকালী। রামশঙ্কর একরাতে পিসীমার হাতের অঙ্গুলিগুলি ছেদন কোরে, মেজ বৌমার গায়ের অলঙ্কারগুলি কেড়ে নিয়ে, বাড়ী থেকে পলায়ন করে। সেই রাত্রেই এই নবীনকালী নিরুদ্দেশ! এতদিন কোথায় ছিল, প্রকাশ ছিল না; এতদিনের পর পড়বি তো পড়, আমারই নজরের উপর! দর্শনমাত্রেই আমি চিনেছি; অংশ চিনতে কিছু, বাকী আছে। সঙ্গে সঙ্গে রামশঙ্কর আছে কি না, সেইটি এখন অনিশ্চিত।

পরকালের নামে নবীনকালী সিউরে উঠছে, চমকে উঠেছে; এতক্ষণ ডেকে ডেকে কথা কোচ্ছিল, এই সময় কিছু, নরমসুর ধোল্পে; বিষাদে ম্লানমুখী হয়ে নরমসুরে আমারে বোল্লে “না হরিদাস! অমন কোরে তুমি আমারে ভয় দেখিও না! কাশীবাস আমার ভাগ্যে নাই; বিশ্বেশ্বর আমারে কাশীতে রাখলেন না, তাড়িয়ে দিলেন, সেই জন্যই আমার নরকভোগ!”

এই দেখ! পাপিয়সী! কেমন কোরে আপনার মুখে আপনি আগুন দেয় দেখ! হতভাগিনী স্বৈরিনী। বিশ্বেশ্বর তোমারে তাড়িয়েছেন, পাপমুখে এমন কথা বোলো না। বিশ্বেশ্বরপুরী তোমারে ভাল লাগলো না, রামশঙ্করের প্রেমে মন মজে গেল, মুক্তিক্ষেত্র পরিত্যাগ কোরে রাতারাতি রামশঙ্করের সঙ্গে তুমি পালিয়ে এলে! বিশ্বেশ্বরের নিন্দা করবার সময় তোমার পাপ-রসনা অবসন্ন হয় না, এই বড় আশ্চর্য।

নবীনকালী আরও জড়সড়; আরও নরম হয়ে আরও অনুতাপ কোরে বোল্লে, “না হরিদাস! আর তুমি আমারে ওরকম তিরস্কার কোরো না; বিশ্বেশ্বর আমারে তাড়ান নাই; পাপে আমার মতি ছিল, কালভৈরব আমারে তাড়া কোরেছিল! তাও না! পাপে আমার মতি হয় নাই, একজন আমারে কুমতি দিয়ে ছিল! সেই রামশঙ্কর আমার পরকালের পথ বিষময় কোরে দিয়েছে, নরকের অগ্নি নরকের বিষ অহরহ আমারে দগ্ধ কোচ্ছে, জর্জরীভূত কোচ্ছে; ভুলিয়ে দাও, ভুলিয়ে দাও; নরকের মূর্তি আর আমারে তুমি দেখিও না! আচ্ছা হরিদাস! আমি যে সেই কুলকলঙ্কিনী নবীনকালী, এখানে এ বনে, তা তুমি কেমন কোরে চিনেছ?”

মৃদুহাস্য কোরে আমি বোল্লেম, ভানুমতী সেজে যে হরিদাসের চক্ষে ধাঁধা লাগান বড় শক্ত কথা! তোমার মত শত শত নবীনকালীও আমার চক্ষে ধাঁধা দিতে পারে না। একবারমাত্র তোমার মুখখানি দর্শন কোরেই আমি ছদ্মবেশের ছদ্ম-আবরণ ভেদ কোরে ফেলেছি। ধরা তুমি দাও কি না দাও, তোমার নিজমুখে নিজ পরিচয় প্রকাশ হয় কি না হয়, সেই প্রতীক্ষায় আমি চুপ কোরেছিলেম। বোধ হয়, তোমার ইচ্ছাও ছিল না, পরিচয় দেওয়া; বিশ্বেশ্বর দেওয়াইলেন। তুমি এখন বুঝতে পেরেছ, নরকভোগ। নিজ মুখে স্বীকার। দয়াময় বিশ্বেশ্বর তোমার প্রতি দয়া প্রকাশ কোরেছেন। আচ্ছা, নবীন! রামশঙ্কর কি তোমার সঙ্গে আছে?

এ প্রশ্ন আমি জিজ্ঞাসা কোরবো, কলঙ্কিনী সেটা ভাবে নাই; প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গেল না। প্রশ্নটা ঘুরিয়ে দ্বিতীয়বার আমি জিজ্ঞাসা কোল্লেম, তুমি কি রামশঙ্করের সঙ্গে আছ? সে প্রশ্নেও নবীনকালী কোন উত্তর দিল না। কাশী থেকে ঢাকা! পলায়নের দৌড় কম নয়! সরাসর এক যাত্রায় ঢাকা, এমনও সম্ভব নয়। এরূপ পাপ কার্যের রীতিপদ্ধতি যে প্রকার, সেই প্রকার পদ্ধতিতেই নানা স্থানে এরা পরিভ্রমণ কোরেছে, সেটি আমি অনুভবে বুঝে রাখলেম। আর এক তত্ত্ব আমার মনে এলো। মশালহাতে কোরে যে লোকটা আমার কাছে এসেছিল, সে লোক রামশঙ্কর নয়; কিন্তু সে বোলে গিয়েছে, তারা অনেক লোক; দিবারাত্রি গড়ের ধারে ধারে বন্দুকধারী পাহারা। কথাটা সত্য কি না? নবীনকালীকে আমি জিজ্ঞাসা কোল্লেম, সমান প্রকৃতির কত লোক এই বনে বাস করে? পথে আমার দেখা পেয়ে তিনজনে আমারে এখানে এনেছে। সত্য কি কেবল তিনটি লোক তোমার রক্ষাকর্তা?

নির্বাকে অল্পক্ষণ আমার নয়ন নিরীক্ষণ কোরে নবীনকালী আমারে এক প্রশ্ন দিলে। সে প্রশ্ন আমার অভাবনীয়। নবীনকালী জিজ্ঞাসা কোল্পে, কথা তুমি কেন জিজ্ঞাসা কর? কম লোক যদি হয়, তা হলে কি তুমি পালাবে? পালাবার উপায় থাকলে আমি পালাবো, এই ভাব আমার মনে ছিল। কাপুরুষের মত পলায়ন কোত্তে আমার ইচ্ছা ছিল না; যদি পালাতে হয়, বীরত্ব দেখিয়ে জয়ী হয়ে পালাবো, এই আমার মতলব। প্রশ্নের উত্তরে আমি বোল্লেম, আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে আমারে তুমি নূতন প্রশ্ন দিচ্ছ, এটা ঠিক হোচ্ছে না; আগে আমার প্রশ্নের উত্তর কর, তার পর আমার মনের কথা শুনতে পাবে।

নবীনকালী বোল্লে, “অল্প দিন হলো, আমরা এখানে এসেছি। যে তিনজনকে তুমি দেখেছ, তারাই এখানে থাকে। রাত দিন এক জায়গায় বোসে থাকে না, ঠাঁই ঠাঁই ঘুরে ঘুরে বেড়ায়; তাদের ভিতর রামশঙ্কর আছে কি না, সে কথা তুমি আমারে জিজ্ঞাসা কোরো না, সে প্রশ্নের উত্তর আমি দিতে পারবো না। এখন তোমার কথা হোচ্ছে, কেবল সেই তিনজন মাত্র এ বনের অধিকারী কি না। হাঁ, আপাততঃ অধিবাসী তিনজন, কিন্তু এই কদিনের মধ্যে আমি দেখেছি, আরও দুটি লোক একদিন এখানে এসে ঐ তিনজনের সঙ্গে ফুসফুস কোরে কি পরামর্শ কোরে গিয়েছে; পরামর্শ সব আমি শুনতে পাই নাই। একজন কেবল দুই একবার একটু বড় বড় কোরে তোমার নাম কোরেছিল, তাই আমি শুনেছি; তাই শুনেই আমি বুঝেছিলেম, তুমি ঢাকায় এসেছ; তার পর আর কোন উচ্চবাচ্য ছিল না; আজ সকালবেলা তোমারে আমি এখানে দেখলেম।”

আমি জিজ্ঞাসা কোল্লেম, “দেখে তোমার মনে কিরূপ ভাবের উদয় হয়েছিল? আপন ইচ্ছায় আমি এসেছি, কিংবা আর কেহ আমারে এনেছে, কি তুমি ভেবেছিলে?”

নবীনকালী উত্তর কোল্লে, “নিবিড় বন, হিংস্র জন্তুর বাসভূমি, বিরামকানন অথবা ক্রীড়াকানন নয়, ইচ্ছাপূর্বক রাত্রিকালে তুমি এখানে আসবে এমন আমি ভাবি নাই; কারা তোমারে ধোরে এনেছে, সেই কথাই আমি ভেবেছিলেম।

আমি।—ভেবে তোমার আনন্দ হয়েছিল, কিংবা আমার এই অবস্থা দেখে আমার কষ্টে তুমি কষ্ট অনুভব কোরেছিলে?

নবীন।—আমি তোমারে চিনেছিলেম। কাদের হাতে তুমি ধরা পড়েছ, সেইটি মনে কোরে আমি কষ্ট অনুভব কোরেছিলেম।

আমি।—হাঁ হাঁ, তা হোতে পারে! তোমার মনটি বড় ভাল! কারা আমারে ধোরেছ তা তুমি জানতে না, এখনো বোধ হয় জান না, প্রাতঃকালে আমারে এখানে দেখেই তোমার কষ্ট হয়েছিল, আনন্দ হয় নাই, এই তো তোমার কথা? আচ্ছা, এখন জানতে পেরেছ, কাদের হাতে আমি ধরা পোড়েছি?

নবীন।—(নিরুত্তর)।

আমি।—চুপ কোরে থাকলে হবে না, মিথ্যাকথাও খাটবে না, আমার সরল প্রশ্নের সরল উত্তর দাও।

নবীন।—উত্তর আমি দিতে পাচ্ছি না, গুর গুর কোরে বুক কাঁপছে! যারা তোমারে ধোরেছে, এখন তারা আমার দণ্ডমুণ্ডের কর্তা।

আমি।— দেখ নবীনকালী, পূর্বাবস্থা মনে কর। এখন তুমি কাশীবাসিনী নও; কাশীতে তুমি যেমন ছিলে, তোমার মন সেখানে যেমন ছিল, এখানে এখন তার সম্পূর্ণ বিপরীত; নষ্ট সংসর্গে স্বভাব নষ্ট হয়, মনও নষ্ট হয়; তাই তোমার ঘোটেছে। কাশীতে আমি তোমারে দেখেছি, তোমার কার্যকলাপ পরীক্ষা কোরেছি, আমার প্রতি তোমার স্নেহ-যত্ন ছিল, সদয় ব্যবহার ছিল, তাও আমি অনুভব কোরেছি; এখন সম্পূর্ণ ভাবান্তর; যাদের কাছে এখন তুমি আছ, তাদের প্রকৃতি প্রাপ্ত হয়েছ; পাকা পাকা মিথ্যাকথাও শিখেছ; জটিলতা কুটিলতা অভ্যাস কোরেছ; রামশঙ্কর এ বনে আছে কি না, সে কথাটাও তুমি আমার কাছে বোলছ না; সকালে তুমি আমারে চিনেছিলে, সঙ্কেতেও সে ভাবটি আমার কাছে প্রকাশ কর নাই; বনবাসী দস্যুরা আমারে নিয়ে কি কোরবে, তাও তুমি আমারে বোলছো না; সব একযোগ! কাশীতে তোমারে দেখে আমার আনন্দ হতো, এখানে তোমারে দেখে ভয় হয়! কাশীতে তুমি এক প্রকার দেবী ছিলে, এখানে এখন তুমি ভয়ঙ্করী পিশাচী হয়েছ।

নবীন।—আর আমারে লাঞ্ছনা দিও না হরিদাস, আর লাঞ্ছনা দিও না! তোমার কথা শুনে আমার প্রাণের ভিতর যেন আগুন জ্বোলে উঠছে! আগুন নির্বাণ করবার ঔষধ নাই! হাঁ, ভাল কথা! তুমি কি এখানে উপবাস কোরেই থাকবে? দিনমানে তো কিছুই আহার কোল্লে না, রাত্রেও কি কিছু খাবে না? অনাহারে বাঁচবে কিরূপে? সেই কথা জিজ্ঞাসা কোত্তেই আমি এসেচি।

আমি।— বাঃ! সব দয়া-মায়া তবে তুমি হারাও নাই! আমার আহারের কথা জিজ্ঞাসা কোত্তে এসেছ! তারা বুঝি এই কথা তোমারে শিখিয়ে দিয়েছে? দেখ নবীন, আহারে আমার রুচি নাই, একটু পূর্বে পিপাসা হয়েছিল, তখনি তখনি তা আবার মিলিয়ে গিয়েছিল, এখন আবার একটু একটু পিপাসা আসছে। মনে দুশ্চিন্তা থাকলে কিছুই ভাল লাগে না, এক দণ্ডও আর এখানে থাকতে আমার ইচ্ছা নাই।

নবীন।—তবে কি তুমি পালাবে?

আমি।—বিদ্রূপ কর কেন? নিজেই তুমি বোলছ, পালাবার উপায় নাই, তুমি আসবার আগে তোমাদের একটা লোক এখানে এসেছিল, সে লোকটাও বোলে গিয়েছে, পালাবার চেষ্টা কোল্লেই মারা যাবে। তোমাদের দুজনের মুখেই এক রকম কথা। এখন আবার এ কিসের ছলনা? ছলনা কোরে তুমি বুঝি আমার মন জানতে এসেছ?

নবীন।—না হরিদাস, ছলনা আমি শিখি নাই; আমার মনের কথা শুন। যে অবস্থায় পোড়ে কুল হারিয়ে আমি বেরিয়েছি, কতক কতক তুমি জান, কিন্তু গোড়ার কথা জান না; তুমি হয় তো মনে কোচ্ছো, আমি এখানে সুখে আছি। হায় হায়! যে সুখে আমি আছি, জগতের সৃষ্টিকর্তা যিনি, তিনিই তা জানছেন। এখানে আমি এক রকম পিঞ্জরবদ্ধ বিহঙ্গিনী। গাছতলায় বোসে বোসে পালাই পালাই ডাক ছাড়ি! পালাতে পারি না; তুমি কি পালাবে? তুমি যদি পালাও, সত্য বোলছি হরিদাস, তুমি যদি পালাও, আমিও তোমার সঙ্গে পালাবো। হাঁ, কি কথা বোলছিলে? পিপাসা হয়েছে? রোসো একটু শীঘ্রই আমি আসছি।

নবীনকালী উঠে দাঁড়ালো; আলো এনেছিল, সে আলোটি হাতে কোরে আমার মুখের দিকে চাইতে চাইতে কুটির থেকে বেরিয়ে গেল; একটু পরেই ফিরে এলো; হস্তে একটা মাটির ভাঁড়; এসেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ত্বরিতম্বরে বোলে, “এ বনে এক রকম ফল হয়, সে ফলের রস অতি সুসম্বাদু; পান কোল্লে তৎক্ষণাৎ পিপাসাশান্তি হয়, অনেকক্ষণ আর পিপাসা আসে না; সেই ফলের সরবত কোরে এনেচি, খাও, এক চুমকে সবটুকু খেয়ে ফেলো, শরীর জুড়িয়ে যাবে।”

ফলের গুণ ব্যাখ্যা কোরে, ঐ সব কথা বোলে, নবীনকালী সেই মৃৎপাত্রটি আমার হাতে দিলে, যথার্থই আমার পিপাসা হয়েছিল, যথার্থই এক চুমুকে সেই সরবতটকু আমি পান কোল্লেম। কতক্ষণ নবীনকালী আমার কাছে বোসে ছিল, কতক্ষণ আমার সঙ্গে কথা কোয়েছিল, মনে হয় না, কেবল এইটুকুমাত্র মনে হয়, আমার চক্ষের সম্মুখে যেন ঝাঁক ঝাঁক জোনাকী পোকা উড়ে বেড়াতে লাগলো, একপাল কালো কালো কুকুর আমার সম্মুখ দিয়ে ছুটে গেল, ঘুমের ঘোরে অবশাঙ্গ হয়ে আমি যেন সেইখানে তৃণাসনের উপর ঢোলে পোড়লেম।

Leave a Reply