» » » অষ্টম কল্প : ভূতের বাড়ী

বর্ণাকার

ভূবনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়

হরিদাসের গুপ্তকথা
দ্বিতীয় খণ্ড

অষ্টম কল্প : ভূতের বাড়ী

একখানা দোতালা বাড়ীর একটি ঘরে আমি শয়ন কোরে আছি; বড় বড় জানালার ফাঁক দিয়ে প্রখর সূর্য-কিরণ সেই ঘরের ভিতর প্রবেশ কোচ্ছে; রৌদ্র আমার গাত্র স্পর্শ কোচ্ছে; রৌদ্রের প্রখরতা দর্শনে অনুভব, বেলা দ্বিতীয় প্রহর। কোথায় এসেছি, যে রাত্রে নবীনকালীর হস্তে ফলের সরবত পান কোরেছিলেম, সেই রাত্রের পরদিনের সূর্য আমার গাত্রে উত্তাপ দিচ্ছিলেন কি না, অবধারণ কোত্তে অক্ষম হোলেম। শুয়ে আছি, ঘরের চতুর্দিকে চেয়ে চেয়ে দেখছি, অপরিচিত গৃহ সেটাও বেশ বুঝতে পাচ্ছি, কিন্তু কোথায়?

শয্যার উপর একবার আমি উঠে বোসলেম; বোসে থাকতে পাল্লেম না, ভোঁ ভোঁ কোরে মাথা ঘুরতে লাগলো; মাথা অত্যন্ত ভারী, চক্ষেও ঝাপসা দেখতে লাগলেম। আবার শয়ন কোল্লেম, কত যে কি ভাবনা তখন আমার মানসক্ষেত্রে তোলাপাড়া কোত্তে লাগলো, নিরূপণ করা দুঃসাধ্য। প্রায় আধ ঘণ্টা এইরকম। একখানা পাখা ঘুরিয়ে বাতাস খেতে খেতে একজন ভুড়িওয়ালা লোক সেই ঘরে প্রবেশ কোল্লে। আমি শয়ে ছিলেম, নিদ্রা আসছিল না, দিনমানে কখনই আমার চক্ষে নিদ্রা আসে না, নেত্র উন্মীলিত ছিল, তাই দেখে লোকটি বিকৃতস্বরে আমারে জিজ্ঞাসা কোল্লে, “কি হে নবাবপুত্র! জেগে আছ? ছি! ছি! ছি! এই বয়সে অত নেশাও করে? দু দিন দু রাত্রি একেবারেই বেহুঁস, বে-একতার! উঠ, স্নান কর, কিছু, আহার কর, শরীর তাজা হবে, উঠতে পারবে কি, না এই বিছানার উপর হড় হড় কোরে জল ঢেলে দিতে হবে? বুঝচো কেমন? নেশাটা ছুটেছে তো? দেখ দেখি চেষ্টা কোরে, উঠতে পারবে কি না?”

আমি অত্যন্ত লজ্জা পেলেম। লজ্জা পাওয়া অকারণ, মনে মনে বিরক্ত হোলেম। আধ ঘণ্টা পূর্বে আর একবার উঠে বোসেছিলেম, মাথা অত্যন্ত ভারী, শরীর অত্যন্ত দুর্বল, বোসে থাকতে পারি নাই, সেই ভাবটা স্মরণ হলো; কি করি, অতিশয় কষ্ট থাকলেও ধীরে ধীরে উঠে বোসলেম। লোক বোল্লে “এই ঠিক, নেশা তবে ছুটেছে; এসো, আমার সঙ্গে বাহিরে এসো।”

কষ্টে আমি দাঁড়ালেম, বিছানা থেকে নামলেম; কষ্টে সেই লোকের অনুগামী হোলেম। চোলে যেতে টোলে পড়ি, লোক আমার সে ভাবটা দেখতে পেলে না, দরজার দিকে মুখ কোরে আগে আগে চোলেছিল, আমি পশ্চাতে ছিলেম, বারান্দায় এলেম। ভাঙা ভাঙা রেল দেওয়া সুদীর্ঘ বারান্দা। এক-ধারে একখানা চৌকী পাতা ছিল, সেই চৌকীর উপরে আমি বোসে পোড়লেম। একজন চাকর আমার মাথায় প্রায় একপোয়া তেল ঢেলে দিয়ে কলসী কলসী জল ঢাল্লে, বোসে বোসেই আমি স্নান কোল্লেম। শরীর একটু সুস্থ বোধ হলো। তারা দয়া কোরে আমারে একখানি কাপড় দিলে, আমি কাপড় ছাড়লেম। আমার সম্মুখে এক গেলাস সরবত; দেখেই আমি মনে মনে কেঁপে উঠলেম, এক সরবতে এত হুলুস্থূল, আবার সরবত! খাই কি না খাই, মনে মনে তর্ক; কিন্তু অত্যন্ত পিপাসা হয়েছিল, এক চুমুক সরবত আমি পান কোল্লেম। সেই ভুড়িওয়ালা লোকটা আবার আমারে সঙ্গে কোরে ঘরের ভিতরে নিয়ে গেল; সেই শয্যার উপরে আবার আমি বোসলেম। লোকটা তখন আমারে বোল্লে, “আমরা ব্রাহ্মণ, ব্রাহ্মণী এখানে অন্নপাক করে, আহার কর, তাহার পর আবার নিদ্রা যেয়ো; শরীর সেরে যাবে; সব অসুখ ভাল হবে।”

সে কথায় কান না দিয়ে সহসা আমি জিজ্ঞাসা কোল্লেম, “কোথায় আমি এসেছি?”

আমার মুখপানে চেয়ে ব্রাহ্মণ বোল্লেন, “ঐ জন্যই তোমার এই দশা! হিতকথা বোল্লে তাতে তুমি কান দাও না, তোমার কান হিতকথা ভালবাসে না, সেই কারণেই তুমি কষ্ট পাও। একরত্তি ছেলে, আজিও ফুল ছাড়ে নাই, মুখে এখনো দুধের গন্ধ ঘুচে নাই, এই বয়সেই নেশা ধোরেছ! তিনদিন নেশায় বিভোর হয়ে অজ্ঞান ছিলে, সবে মাত্র চৈতন্য হয়েছে: ভালর জন্য আমি বোল্লেম, আহার কর; কথাটা তোমারে ভাল লাগলো না; কথার উপর কথা দিয়ে তুমি জিজ্ঞাসা কোল্লে, কোথায় এসেছ? সে কথায় এখন তোমার কি দরকার? আহার কর, সুস্থ হও, নিদ্রা যাও, তার পর যে যে কথা জিজ্ঞাসা কোত্তে ইচ্ছা হয়, জিজ্ঞাসা কোরো। তা নয়, এত অবাধ্য কেন তুমি?”

তিরস্কার সহ্য কোরে তৎক্ষণাৎ আমি বোল্লেম, “আহারে আমার ইচ্ছা নাই। কোথায় আমি এসেছি, সেই তত্ত্বটি অগ্রে আমি জানবো। আমার ভাগ্য বড় মন্দ, ভাগ্যদোষে লোকের কাছে আমি নিন্দাভাজন হই। যে সব কথা আপনি আমারে বোলছেন, তার বিন্দু-বিসর্গও আমি বুঝতে পাচ্ছি না। নেশা করা, অজ্ঞান থাকা, অবাধ্য হওয়া, এ সব কথার অর্থ কি? আচ্ছা মহাশয়, সব কথা না বলুন আমার একটি কথার উত্তর দিন। যেখানে এখন আমি আছি, এ স্থানটি কি ঢাকাজেলার এলাকা?”

ভুঁড়ি নাচিয়ে হাস্য কোল্লে ব্রাহ্মণ বোল্লেন, “রোগে ধোরেছে, রোগে ধোরেছে! রোগ বড় শক্ত! নেশা এখনো ছাড়ে নাই! নেশায় লোকে পাগল হয়; তাতে আবার কচি বাঁশে ঘুণ ধরা; মাথাটা খারাপ হয়ে গিয়েছে। হায়, হায়! পাগল রে পাগল! বলে কি না ঢাকাজেলা! কোথায় তোদের ঢাকাজেলা?”

বিষাদে দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ কোরে পুনরায় আমি বোল্লেম, “তবে কি এটা ঢাকাজেলার এলাকা নয়? কোথায় তবে আমি এসেছি? আমার অজ্ঞাতে কারা আমারে এখানে এনে ফেলেছে?”

ব্রাহ্মণের ক্রোধ উপস্থিত। চক্ষু পাকল কোরে ঘাড় বাঁকিয়ে ব্রাহ্মণ বোলে উঠলেন, “অধঃপাতে এসেছিস! কারা এনেছে, কোথায় এনেছে, কিসের এলাকা, এ সব নিকাস আমার কাছে নাই। বেহুঁস দেখেছিলেম, দয়া হয়েছিল, যত্ন কোরে রেখে দিয়েছিলেম। কপালে সুখ না থাকলে জোর কোরে কি সুখী করা যায়?”

আলাৎ-পালাৎ কত কথাই ব্রাহ্মণের মুখে বর্ষিত হলো, শুনে শুনে আমি যেন হতজ্ঞান হোলেম। সকল কথা আমার কানেও গেল না। অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে শেষবারে তাঁরে আমি জিজ্ঞাসা কোল্লেম, “আপনি আমারে বোলতে চান কি? কোথা থেকে কোথা আমি এসেছি, সেইটি আমি জানতে চাই, আর কোন বেশী কথা আমি জানতে চাই না, অনুগ্রহ কোরে সেইটি আপনি বলনে। বার বার আপনি আমার আহারের জন্য অনুরোধ কোচ্চেন, কলির মানুষের অন্নগত প্রাণ, অন্নাহার ব্যতিরেকে প্রাণধারণ করা যায় না, তাহা আমি জানি, কিন্তু ক্ষুধা নাই, রুচি নাই, প্রবৃত্তি নাই। কত স্থানে কত বিপদে আমি পতিত হয়েছি, তা যদি আপনি শুনেন, আমার প্রতি আপনার দয়া হবে। ঢাকাতে আমার আত্মীয়বন্ধু আছেন, আমার অদর্শনে তাঁরা ভাবিত হয়েছেন, আমারো দুর্ভাবনা অনেক। একখানি চিঠি লিখে সেখানকার একটি ডেপুটি বাবুকে আমার এই দুর্দশার কথা জানাব, এই আমার আকিঞ্চন, সেইজন্যই বারবার আমি আপনাকে মিনতি কোরে বোলছি, আপনি আমার প্রতি একটু সদয় হোন, কোথায় আমি এসেছি, দয়া কোরে কেবল সেইটি আমাকে বলুন।”

বিরক্তবদনে ব্রাহ্মণ তখন বোল্লেন, “কুমিল্লার এলাকা, ত্রিপুরাজেলা, রুদ্রাক্ষ গ্রাম। তুমি কিঞ্চিৎ আহার কর, তার পর অপরাপর কথা জানতে পারবে। একটা কথা কি জানো, এখান থেকে এখন তুমি কোথাও যেতে পাবে না, কিছুদিন এই বাড়ীতেই থাকতে হবে, যে যে কাজ আমরা বোলবো, সেই সব কাজ তোমাকে কোত্তে হবে; মুটে-মজুরের কাজ নয়, আমাদের সেরেস্তায় লেখা-পড়ার কাজেই তোমাকে নিযুক্ত রাখা আমাদের ইচ্ছা, লেখা-পড়া তুমি জানো?”

সংক্ষেপে তাঁর কথাগুলির উত্তর দিয়ে বিষাদে আমি একটি নিশ্বাস ফেল্লেম। ব্রাহ্মণ একজন বৃদ্ধা ব্রাহ্মণীর দ্বারা আমার জন্য কিঞ্চিৎ খাদ্যসামগ্রী আনিয়ে দিলেন। নামমাত্র আহার কোরে এক গেলাস জল খেয়ে আমি পিপাসা-শান্তি কোল্লেম। আমারে শয়ন কোত্তে বোলে ব্রাহ্মণ তখন সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন; আমাকে স্বাধীনতা দিয়ে গেলেন না, দ্বারের বাহিরে চাবী বন্ধ কোরে গেলেন। বেলা আড়াই প্রহর অতীত হয়েছিল, আমি একটু শয়ন কোল্লেম; নিদ্রার জন্য শয়ন কোল্লেম না, ক্লান্তি দূর করা প্রয়োজন ছিল, সেই কারণেই শয়ন। যখন আমি বোসে থাকি, যখন দাঁড়িয়ে থাকি, যখন কোন কাজকর্মে অন্যমনস্ক থাকি, চিন্তা তখন আমার উপর বেশী শক্তি প্রকাশ কোত্তে পারে না; শয়ন কোল্লেই প্রবল পরাক্রম প্রকাশ করে। বিনা সংগ্রহে চিন্তার উপকরণ আমার বিস্তর। অমরকুমারীর রূপখানি মনের মধ্যে আনয়ন কোরে আনুসঙ্গিক কত ভাবনা যে আমি ভাবলেম, অক্ষরে অক্ষরে লিখে জানানো যায় না। অমরকুমারী আমার জন্য কত ভাবছেন, মণিভূষণ কতই উৎকণ্ঠিত হয়েছেন, অন্যান্য স্থানে যাঁরা যাঁরা আমার হিতৈষী বন্ধু আমার সমাচার না পেয়ে তাঁরা কত উদ্বিগ্ন আছেন, সেই সকল ভাবনা তখন আমার মনে একত্র। ভাবনার কথা পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে ব্যক্ত কোরে পাঠকমহাশয়কে বিরক্ত করা কিম্বা ভাবনাযুক্ত করা আমার এখনকার কার্য নয়, গোটাকতক নূতন কথা বলি।

ত্রিপুরা জেলার কুমিল্লার এলাকা রুদ্রাক্ষ গ্রাম; ব্রাহ্মণের বাড়ী; যে ব্রাহ্মণ আমারে তিক্তমধুরমিশ্র সম্ভাষণে প্রপীড়িত করবার অথবা পরিতুষ্ট রাখবার চেষ্টা কোল্লেন, তাঁর কথা শুনে, কার্য দেখে আর ক্ষমতার পরিচয় পেয়ে, অনুমানে আমি বুঝলেম, তিনিই সেই বাড়ীর কর্তা—নামটি তখনো পাওয়া যায় নাই, কিন্তু পাঠকের মনে একটু ধারণা জন্মাবার উদ্দেশে ব্রাহ্মণটির রূপ বর্ণনা করা আবশ্যক।

ব্রাহ্মণের রূপবর্ণনে আমি অভিলাষী। সংক্ষেপে কেবল এইমাত্র বোলেছি, ভুড়িওয়ালা ব্রাহ্মণ। যারা যারা স্থূলাঙ্গ, সর্ব অবয়ব যাদের বিলক্ষণ স্থূল প্রায়ই তাদের ভুড়ি হয়, সে সকল অঙ্গে ভুড়িও মানায়; কিন্তু এ ব্রাহ্মণ স্থূলাঙ্গ নয়;—হাত দু-খানা সরু সরু পা দু-খানা সরু সরু, বুকখানাও সরু গলাটিও সরু, অঙ্গের সম্ভাবিত সমস্ত মাংস কেবল উদরেই আশ্রয় কোরেছে; ভুড়ি প্রকাণ্ড। উদরীরোগগ্রস্ত লোকের চেহারা যেমন হয়, মুখে যেমন পাণ্ডুবর্ণ দেখায়, এ ব্রাহ্মণের চেহারাও সেই প্রকার। গঠন দীর্ঘাকার, বর্ণ পিঙ্গল, চক্ষু বড় বড়, নাসিকা খর্ব, কপাল প্রশস্ত, মস্তক প্রায় কেশশূন্য, মধ্যস্থলে প্রায় এক হাত লম্বা এক টিকি, পৃষ্ঠদেশের অর্ধেক দূর পর্যন্ত লম্বিত; পরিধান একখানি সরু ফিনফিনে মলমলের ধুতি; ভুঁড়ি আচ্ছাদনেই সে ধুতির অর্ধাংশ অপেক্ষা অধিক পর্যবসিত, অপর অংশে নিম্নাঙ্গের জানু পর্যন্ত আচ্ছাদিত। মূর্তিদর্শনে সহসা ভয়ের আবির্ভাব হয়; ঘৃণা বলা গেল না,—ব্রাহ্মণের চেহারা দেখে ঘৃণা কোত্তে নাই; বস্তুতঃ ঘৃণা যেন আপনা হোতেই অগ্রে অগ্রে এসে উপস্থিত হয়।

এই অনুমানে আমার যদি ভুল না থাকে, তবে এই ব্রাহ্মণ এই বাড়ীর কর্তা। বাড়ীখানা কেমন, বাড়ীখানা কত বড়, তখনো পর্যন্ত তা আমি জানতে পারি নাই; কিন্তু যে ঘরে আমি আছি, সে ঘরের আয়তন আর সাজসরঞ্জামের পারিপাট্য দেখে মনে হয় বৃহৎ বাড়ী, ব্রাহ্মণ একজন বড়মানুষ।

বেলা যখন প্রায় অবসান, সেই সময় দ্বারের চাবী খুলে সেই ব্রাহ্মণ গৃহমধ্যে প্রবেশ কোল্লেন, সঙ্গে একটি লোক। প্রবেশ কোরেই গম্ভীরস্বরে ব্রাহ্মণ আমারে জিজ্ঞাসা কোল্লেন, “কি গো! ঐ দেখ, কথায় কথায় আমি তোমার নামটা ভুলে ভুলে যাই; কি নাম?—হাঁ, হরিদাস। কি গো হরিদাস! ঘুম ভেঙেছে?”

আমি উঠে বোসলেম; ব্রাহ্মণের প্রশ্নের উত্তর দিলেম, “ঘুম আমার আসে না; ঘুমের সঙ্গে আমার যে সম্বন্ধ ছিল, চিন্তা-পিশাচী সে সম্বন্ধটি যেন বিচ্ছিন্ন কোরে দিয়েছে: প্রকৃতির উপরেও যেন চিন্তা আপনার পরাক্রম প্রকাশ কোরেছে!”

সাপের মত বারকতক ফোঁস ফোঁস কোরে ব্রাহ্মণ বোল্লেন, “তাই তো! প্রকৃতির দোষ, চিন্তার দোষ, তোমার দোষ নাই! তাই তো বটে! তিন দিন তিন রাত বেহুঁস—বেহুঁসে ঘুমিয়েছ, তবে আর নিদ্রাকে দোষ না দিয়ে তুমি আর কি কোত্তে পার? আচ্ছা, আমার কাছে তুমি একটা প্রতিজ্ঞা কোত্তে পার? জন্মে আর কখনো কোন নেশার জিনিস তুমি ছোঁবে না, যারা নেশা করে, তাদের কাছে যাবে না, এই প্রতিজ্ঞা কোত্তে যদি রাজী হও, তা হোলে নিদ্রাকে উপরোধ কোরে আমি তোমার বশীভূত রাখতে পারবো।”

আমার অন্তরে অত্যন্ত আঘাত লাগলো। ম্লান বদনে ব্রাহ্মণকে আমি বোল্লেম, “বারম্বার কেন আপনি একটা মিথ্যাকথা নিয়ে আমারে ঐরূপ তিরস্কার কোচ্ছেন? নেশা কারে বলে, নেশার জিনিস কি প্রকার, জন্মেও কখন তা আমি জানি না। যারা আমারে অজ্ঞান অবস্থায় এখানে এনে ফেলে রেখে গিয়েছে, তারা আপনাকে কি একটা মিথ্যাকথা শুনিয়ে দিয়েছে, ধ্রুব-বিশ্বাসে তাই আপনি মনে কোরে রেখেছেন, তাই মনে কোরেই বার বার আপনি আমারে অপরাধী কোচ্ছেন। আমি গরীব। জন্মাবধি আমি ফকিরের মতন পর্যটক, দোষের কাছে জন্মাবধি আমি অপরিচিত; পরের মুখে রচা কথা শুনে আপনি আমারে দোষী করেন, শুনে শুনে আমার প্রাণে বড় ব্যথা লাগে!”

কেমন এক প্রকার হাস্য কোরে ব্রাহ্মণ তৎক্ষণাৎ আবার সক্রোধে বোলে উঠলেন, “কি কথা বোলছো তুমি? পরের কথা আমি শুনেছি? কাদের কথা আমি শুনেছি? বেহুঁস হয়ে পথে তুমি পোড়ে ছিলে, কুড়িয়ে এনে যত্ন কোরে নিজ বাড়ীতে আমি তোমায় আশ্রয় দিয়েছি, তারই বুঝি এই ফল? পরের কথা আমি শুনেছি, কে তোমাকে এমন কথা বোলে?”

আমি আর সে সময় বেশী শিষ্টাচার দেখাতে পাল্লেম না, তৎক্ষণাৎ উত্তর কোল্লেম, “কেহ কিছু বলে নাই, নিজেই আমি বুঝতে পাচ্ছি, পরের কথা আপনি শুনেছেন। তা না শুনলে আমার নাম আপনি কেমন কোরে জানলেন? আমি তো আপনার কাছে আমার নাম বলি নাই। অবশ্যই আপনি পরের কথা শুনেছেন। যা যা শুনেছেন, আমি বুঝতে পাচ্ছি, আমার নামটি ছাড়া সমস্তই মিথ্যা!”

ব্রাহ্মণ এইবার অপ্রতিভ হোলেন; অল্পক্ষণ নিরুত্তর থেকে, তেজটা একটু কোমিয়ে এনে, একটু নম্রস্বরে বোল্লেন, “তাই তো! তোমার মাথাটা এখনো গরম আছে! এসো, এই লোকটির সঙ্গে বাহিরের বাতাসে একট বেড়িয়ে এসো; ঠাণ্ডা হবে। আর কোথাও যেয়ো না, এখান থেকে পালিয়ে যাবার চেষ্টা কোল্লে ভারী বিপদে পোড়বে।”

প্রথমের কথাকটি আমি শুনলেম, শেষের কথায় কান দিলেম না; বাহিরের বাতাসে বেড়াবার একান্ত ইচ্ছা হয়েছিল, আবশ্যকও হয়েছিল, ব্রাহ্মণের সমভিব্যাহারী লোকটির সঙ্গে উপর থেকে নেমে বাড়ী থেকে আমি বেরুলেম।

যদিও শেষ বেলা, তথাপি তখনো আকাশে সূর্য ছিলেন। বাড়ীখানি আমি ভাল কোরে দেখলেম। প্রকাণ্ড বাড়ী। পূর্বে-পশ্চিমে লম্বা বৃহৎ বারান্দা; অর্ধেকটা ভগ্নদশাপ্রাপ্ত, অর্ধেকটা বে-মেরামতে মলিন। বারান্দার সম্মুখে বাগান ছিল, ফুলবাগান: চারিদিকে ছোট ছোট থাম দিয়ে ঘেরা ছিল; অনেকগুলি থাম কেবল ইষ্টকসার হয়ে আছে, ফুলগাছগালিও আধমরা। কিসের শোকে গাছেরা যেন কাঁদছে, এই রকম বোধ হলো। একদিকে দেখলেম, মস্ত একটা ঢিবি। যে লোকটি আমার সঙ্গে এসেছিল, তার নাম রামদাস। তারে আমি জিজ্ঞাসা কোল্লেম, “ঐ ঢিবিতে কি হয়?”

রামদাস উত্তর কোলে, “বাবুদের বাড়ীতে পূর্বে রাস হোতো, এখনো হয়, ঘটা হয় না; ঐখানে দিব্য একটি পাকা রাসমঞ্চ ছিল, ১২৫৯ সালের ঝড়ে সেটি সমভূমি হয়ে যায়; কেবল ঐ ঢিবিমাত্র অবশিষ্ট থাকে; এখনো তাই আছে; অবস্থা সিকস্ত; বাবুরা আর সেই রাসমঞ্চ খাড়া কোরে তুলতে পারেন নাই। তদবধি রাসের সময় ঐ ঢিবির উপর গোটাকতক বাঁশ খাড়া কোরে চাঁদোয়া টাঙিয়ে ঠাকুর বসানো হয়।”

আমি রামদাসের মুখের দিকে চেয়ে থাকলেম; কিন্তু আকার-প্রকারে বুঝতে পেরেছিলেম, রামদাস সে বাড়ীর একজন সামান্য চাকর মাত্র; মূলতত্ত্বে তার সঙ্গে অধিক কথা কওয়া আমি তখন অনাবশ্যক ভাবলেম। রাসমঞ্চের পরিচয় দিয়ে রামদাস আরো বোল্লে, “বাহিরে তো এই দশা দেখছো, ভিতরদিকে আরো দুর্দশা। অন্দরমহল একেবারে নাই, সমভূম; পূজাবাড়ীর দালানের তিনদিকে বারান্দা দেখেছ, পশ্চিমের বারান্দার পশ্চাদ্দিকে যতগুলি ঘর আছে, ফাটা চটা নোণাধরা, সেই সকল ঘরে এখন অন্দরমহল হয়েছে, দক্ষিণের আর পূর্বের বারান্দায় দিবারাত্রি চিক ফেলা থাকে।”

ও সব কথায় আমার তত প্রয়োজন ছিল না, কেবল শুনলেম এই মাত্র, বাবুদের এখন দূরবস্থা, সেইটি বুঝে রাখলেম। গল্প কোত্তে কোত্তে রামদাস আমারে সম্মুখদিকে খানিক দূর এগিয়ে নিয়ে গেল। চারিদিক আমি নিরীক্ষণ কোল্লেম। রামদাসের মুখে শুনলেম, অনেক দূর পর্যন্ত বাবুদের ভদ্রাসনের সীমা। বাবুদের দূরবস্থা ঘোটেছে, কিন্তু বিশ্বজননী প্রকৃতির যেরূপ মধুর ভাব, সে ভাবের কিছুই ব্যত্যয় ঘটে নাই; অপরাহ্নের সংশীতল সমীরণ সেবন কোরে অনেক পরিমাণে আমি শীতল হোলেম। বুকের ভিতর যে আগুনে জ্বোলছিল, তার কিছু উপশম হলো না, কিন্তু বাহিরে অনেকটা ঠাণ্ডা বোধ কোল্লেম।

সূর্যদেব অস্তগত। বেড়াতে বেড়াতে আমরা বাড়ীর দিকে ফিরলেম। যাবার সময় দেখি নাই,

আসবার সময় দেখলেম, বাহিরের বারান্দার যে অর্ধাংশ ভেঙে গিয়েছে, সেই অংশের শেষভাগের সর্ব পশ্চিম সীমায় একটি ভগ্নগৃহ বিদ্যমান; বাঁশের সিঁড়ির সাহায্য ভিন্ন সে গৃহে প্রবেশ করবার উপায় নাই। একবার পশ্চিমাকাশে, একবার সেই ভগ্নগৃহের দিকে দৃষ্টিদান কোরে, রামদাস তাড়াতাড়ি বোলে উঠলো, “চলো চলো, চলো, শীঘ্র চলো। অন্ধকার হয়ে এলো! এ জায়গায় অন্ধকারে বড় ভয় আছে!”

কথা বোলতে বোলতে,—পশ্চাতে হাত ফিরিয়ে হাতছানি দিয়ে আমারে ডাকতে ডাকতে রামদাস একদৌড়ে দেউড়ীর ভিতর ঢুকে পোড়লো; পূর্বাপর কিছুই চিন্তা না কোরে আমিও দ্রুতপদে তার অনুগামী হোলেম। বাবুর বাড়ীর দেউড়ী তখনো ছিল, কিন্তু দেউড়ীগুলি যারা শোভিত করে, তারা কেহ উপস্থিত ছিল না। দেউড়ী পার হয়ে রামদাসের সঙ্গে আমি উপরে গিয়ে উঠলেম। অল্পকথায় আমি বুঝে নিলেম, রামদাসটি লোক সরল, কিন্তু অত্যন্ত ভীরু।

দিনমানে যেখানে ছিলেম। সেইখানে প্রবেশ কোরে দেখলেম, ঘরের একধারে একটি প্রদীপ জ্বোলছে, যে বিছানায় আমি শয়ন কোরেছিলেম, সেই বিছানার উপর দুটি যুবা চুপ কোরে বোসে আছে; যে বৃদ্ধা স্ত্রীলোকটি আমার খাবার সামগ্রী দিয়ে গিয়েছিল, একধারে দেয়াল ঠেস দিয়ে সে স্ত্রীলোকটিও দাঁড়িয়ে আছে। আমারে দেখেই সেই স্ত্রীলোক একটু হাসতে হাসতে বোল্লে, “ওগো হরিদাস, এই দুটি বাবু তোমায় দেখতে এসেছেন। কর্তাবাবুর ছেলে।”

কর্তাবাবুর ছেলেদের মুখপানে আমি চাইলেম, তাঁরাও খানিকক্ষণ আমার মুখের দিকে চেয়ে থাকলেন। আমার মুখে দেখা শেষ হয়ে গেলে ভাই দুটি পরস্পর চক্ষু ঠারাঠারি কোরে মৃদু মৃদু হাস্য কোল্লেন, বিছানার উপর এক চাপড় মেরে একটি বাবু আমারে তাঁদের কাছে বসবার ইঙ্গিত কোল্লেন; ঠিক নিকটে না বোসে একটু দূরে গিয়ে আমি বোসলেম।

বাবুর ছেলে। ক্ষমতা না থাকলেও কর্তাবাবুর রূপ আমি বর্ণনা কোরেছি, বৃহৎ এক ভূঁড়ি থাকলেও কর্তাবাবু একটি কাহিল মানুষ, সোজাকথায় রোগা মানুষ; এই দুটি বাবুও রোগা রোগা;— আর সেই প্রাচীনা স্ত্রীলোক, নিশ্চয়ই পরিচারিকা, সেই পরিচারিকাটিও রোগা; যে রামদাসটি আমার সঙ্গে বেড়াতে গিয়েছিল, সেই রামদাসটিও খুব রোগা; বাড়িতে যতগুলিকে আমি দেখলেম, সকলগুলিই রোগা রোগা। এ এক আশ্চর্য ব্যাপার!

আশ্চর্য ভেবে একদিকে আমি চেয়ে আছি, বাবু দুটির মধ্যে একটি বাবু সেই সময় আমারে সম্বোধন কোরে বোল্লেন, “তোমাকে দেখে আমরা বড় তুষ্ট হোলেম। শুনেছিলেম, তুমি একটা দোষ কোরেছ, তোমার মুখ দেখে সে কথায় আমার বিশ্বাস হোচ্ছে না। দেখ হরিদাস, তুমি খুব সাবধানে থেকো; লোকের মুখে শুনতে পাই, এখানে কিছু ভয় আছে। রাত্রিকালে যদি কিছু ভয়ের লক্ষণ বুঝতে পার,— ঘরের ভিতর নয়, বাহিরে যদি কোন প্রকার শব্দ শুনতে পাও, বিছানা থেকে উঠো না, দরজা খুলে দেখো না, কোন প্রকার তত্ত্ব জানবার চেষ্টা কোরো না, ভয়টা আপনা আপনি দূর হয়ে যাবে। বুঝলে কি না?”

আর একটি বাবু বোল্লেন, “ভয়ের কথা বোলে দাদা তোমাকে সাবধান কোচ্ছেন, আমি কিন্তু আর একটি কথা বোলতে চাই। শুনলেম, কিছুই তুমি আহার কোচ্ছো না। কেন উপবাস কর? ব্রাহ্মণের বাড়ীতে আহার করায় কোন দোষ নাই। আহার কোরো,—অনাহারে শরীর শীর্ণ হোলে দাদার কথায় ভয়টা আরো তোমাকে জোড়িয়ে জোড়িয়ে ধোরবে। আহার কোরো।”—এই পর্যন্ত বোলে সেই প্রাচীনা স্ত্রীলোকের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ কোরে ছোটবাবুটি আরো বোল্লেন, “এই ইনি আমাদের পাচিকা, কুলীনব্রাহ্মণের কন্যা, রাত্রিকালে ইনি তোমার জন্য অন্ন-ব্যঞ্জন এনে দিবেন, আহার কোরো; কল্য আমরা শুনবো; কল্য আবার এক সময় আমরা দুজনে এসে তোমার সঙ্গে ভাল কোরে আলাপ কোরবো।”

বাবু দুটি উঠে দাঁড়ালেন, আমি তাঁদের উভয়কে দুই হাত তুলে প্রণাম কোল্লেম; তাঁরা চেলে গেলেন; প্রাচীনা ব্রাহ্মণীও তাঁদের সঙ্গে সঙ্গে গেলেন। অল্পক্ষণ আমি একাকী থাকলেম। একটু পরেই সেই রামদাস।

চুপি চুপি ঘরের ভিতর এসে রামদাস আমার বিছানার কাছে ছোট একখানা চৌকীর উপর বোসলো; নানা রকম গল্প জুড়ে দিলো। এ কথা সে কথা পাঁচ কথার পর ঘন ঘন নিশ্বাস নিল, পরে রামদাস একটু কৌতুকস্বরে বোল্লে, “রাম নামের চেয়ে আর নাম নাই; এই নামে ভয় যায়, রাম রাম বোলে শয়ন কোরো, কোন ভয় থাকবে না। এ বাড়ীতে ভূতের ভয় আছে শুনেছি, বড়বাবুও বোলে গেলেন; ভয় আছে সত্য, কিন্তু ‘রাম’ নাম শুনে ভূতেরা ছুটে পালায়।”

যখনই রামদাস বোলছে, তৎক্ষণাৎ তা আমি বুঝতে পাল্লেম, মনে মনে হানা কোরে আমি বোল্লেম, “রাম নামের অভাব কি? তোমার নাম রামদাস, আমার নাম হরিদাস, দুজনেই আমরা রামচন্দ্রের সেবক; তোমারো ভয় নাই, আমারো ভয় নাই। আচ্ছা রামদাস! এ বাড়ীর কর্তাবাবুর নাম কি? যে দুটি বাবু এসেছিলেন, সে দুটি বাবুর নাম কি?”

রামদাস উত্তর কোল্লে, “কর্তার নাম জয়শঙ্করবাবু, বড়বাবুর নাম প্রাণগতিবাবু, ছোটবাবুর নাম মিহিরচাঁদ। উপাধি চৌধুরী।”

রামদাসের সঙ্গে আমি অনেক রকম গল্প কোল্লেম, তার মুখেও অনেক রকম গল্প শুনলেম। রাত্রি প্রায় দেড় প্রহর পর্যন্ত কেবল রামদাসটি আমার দোসর। দেড় প্রহরের পর রামদাস উঠে গেল। সেই প্রাচীনা স্ত্রীলোকটি আমার জন্য অন্ন-ব্যঞ্জন প্রস্তুত কোরে সেই ঘরেই এনে উপস্থিত কোল্লেন। আগে আমি তাঁরে পরিচারিকা মনে কোরেছিলেম, শেষে জানলেম, তাদৃশী পরিচারিকা নন, বাবুদের পাচিকা। তিনি একাকিনী এলেন না, জল, আসন আর লবণাদি হাতে কোরে একটি পরিচারিকা তাঁর সঙ্গে এলো। আমার আহারাদির আয়োজন কোরে দিয়ে পাচিকাঠাকুরাণী একখানি চৌকীর উপর বোসে থাকলেন, কপাটের ধারে পরিচারিকা দাঁড়িয়ে থাকলো।

পরিচারিকার বয়স অল্প; বড় জোর পঁচিশ ছাব্বিশ বৎসর, বর্ণ অগৌর নয়, কিন্তু গায়ে ঠাঁই ঠাঁই বসন্তের দাগ, মুখেও বসন্তের দাগ; মাথায় চলু অল্প, মুখখানি কিন্তু দেহের সঙ্গে মানানসই, চক্ষু দুটি ভাসা ভাসা। গায়ে অলঙ্কার ছিল না, পরিধান একখানা লালপেড়ে শাড়ী। দেখতে নিতান্ত মন্দ নয়; কিন্তু রোগা। আমি মনে কোল্লেম, এ বাড়ীর বাতাসের কোন রকম দোষ আছে; যারা এ বাড়ীতে থাকে, যারা এ বাড়ীতে জন্মে, তারাই রোগা হয়।

আমার আহার-সামগ্রী প্রস্তুত। যদিও ব্রাহ্মণের বাড়ী, তথাপি সর্ব-প্রথমে বাড়ীর কর্তা আমার সঙ্গে যে রকম কর্কশ ব্যবহার কোরেছিলেন, আমায় যে সকল কটু বাক্য বোলেছিলেন, সে সব মনে কোরে সে বাড়ীতে অন্নগ্রহণ কোত্তেও আমার প্রবৃত্তি ছিল না। কর্তার ছেলে দুটির শিষ্টাচার দর্শনে আর সেই প্রাচীনা ব্রাহ্মণ-কন্যার স্নেহ-যত্ন দর্শনে আমার সে ভাবের পরিবর্তন হয়েছিল। রাত্রে আমি আহার কোল্লেম।

যতক্ষণ আমি আহার কোল্লেম, সেই পরিচারিকা ততক্ষণ সেই কপাটের কাছে দাঁড়িয়ে আমার দিকে চেয়ে থাকলো; চাউনি কি প্রকার, আড়ে আড়ে চেয়ে চেয়ে এক একবার তাও আমি দেখলেম। আহার যখন প্রায় শেষ হয়ে এলো, সেই সময় পাচিকাঠাকুরাণী সেই পরিচারিকাকে সম্বোধন কোরে বোল্লেন, “রূপসি! যা দুধ-সন্দেশ নিয়ে আয়!”

পরিচারিকার নাম রূপসী। পাচিকার আদেশে রূপসী একবার অন্দরের দিকে গেল; বোলে রেখেছি, বারান্দার পাশেই অন্দর, শীঘ্রই দুধ-সন্দেশ নিয়ে ফিরে এলো। আহার সমাপন কোরে বাহিরদিকের বারান্দায় আমি আচমন কোল্লেম। আহারান্তে তাম্বুল চর্বণ অথবা তাম্রকুট সেবন আমার অভ্যাস হয় নাই, সুতরাং সেই দুই দায় থেকে রূপসী অনিচ্ছায় অব্যাহতি পেলে। সাবধানে আমারে শয়ন কোত্তে বোলে পাচিকাঠাকুরাণী চোলে গেলেন, কিঞ্চিৎ ইতস্ততঃ কোরে, কপাটে চাবী লাগিয়ে রূপসীও চোলে গেল, যাবার সময় বোলে গেল, “প্রদীপে অনেক তেল থাকলো, ইচ্ছা হয়, জেলে রেখো, ইচ্ছা হয় নিবিয়ে দিও।”

ঘরে মানুষ থাকলো, দরজায় চাবী পোড়লো, এটাই বা কেমন? এখানেও কি আমি কয়েদী? গতিক ভাল নয়! সেই যে গোড়ায় রক্তদন্তের চক্র, এখনো সর্বত্র সেই চক্রের জের চোলে আসছে; রক্তদন্তের লোকেরা নিশ্চয়ই সেই চক্র ঘুরাচ্ছে! যাই হোক, দক্ষিণদিক খোলা, বাহিরদিকের দক্ষিণের বারান্দা উদার মুক্ত, বাতাসের অভাবে দম আটকে মারা যাব না, মনে তখন এইটুকু শান্তি।

আমি শয়ন কোল্লেম। ঘরে ঘড়ী ছিল না, অভ্যাসের অনুমানে অবধারণ কোল্লেম, রাত্রি দুই প্রহর। গুরুমহাশয়ের পাঠশালায় যত দিন ছিলেম, তত দিন কি রকম হতো, ঠিক মনে হয় না, কিন্তু পাঠশালা থেকে দূরীভূত হবার পর অবধি শয়নমাত্রই নিদ্রা আসে না, অনেকক্ষণ জেগে থাকতে হয়; জেগেই আছি। যে সকল ভাবনা নিত্য আসে, সে সকল ভাবনা তো আছেই, তার উপর নূতন জায়গায় নূতন ভাবনা। বেহুঁস হবার কথা, নেশা করবার কথা, কিছুদিন এই বাড়ীতে বাস করবার কথা আমার মনের ভিতর আসছে; ত্রিপুরাজেলার এলাকামধ্যে এসে পোড়েছি, সে কথাও ভাবছি; অমরকুমারী ঢাকায়, মোকদ্দমা বহরমপুরে, সে সব কথা মনে কোরে অন্তরে অন্তরে উদ্বেগ বাড়ছে; অন্যমনস্ক হবার চেষ্টা কোচ্ছি, পাচ্ছি না। এই নূতন বিপদের মূল সেই কুলকলঙ্কিনী নবীনকালী। ঘনিষ্ঠতা কোরে, আত্মীয়তা কোরে, নবীনকালী আমারে বোলেছিল, সে আমার পালাবার সহায় হবে, সে নিজেও আমার সঙ্গে পালিয়ে আসবে। বোলেছিল, তার কথায় আমি প্রত্যয় কোরেছিলেম; সেই প্রত্যয়ের ফল এই! হায়, হায়! কেন আমি তার কথায় বিশ্বাস কোরেছিলেম? কেন আমি তার হাতে কাল-সরবৎ পিয়েছিলেম? নিশ্চয় সে সরবতে মাদকদ্রব্য মিশানো ছিল! দুষ্টলোকের পরামর্শে নিশ্চয়ই নবীনকালী সে সরবতের সঙ্গে ভাং-ধুতুরা অথবা আর কোন উৎকট বিষ মিশিয়ে দিয়েছিল, তাতেই আমি অজ্ঞান হয়ে পোড়েছিলেম! অজ্ঞান অবস্থায় এক একবার যেন আমার মনে হয়েছিল, আমি যেন কিসের উপর দুলছি, হেলে দুলে যেন গোড়িয়ে গোড়িয়ে পোড়ছি; এক একবার ঝনঝনে ঘর্ঘরশব্দ আমার কানের ভিতর প্রবেশ কোরেছিল, এখনো সেই ভাবটা একটু একটু মনে পোড়ছে। লোকেরা হয় তো নৌকায় তুলে, গাড়ীতে তুলে কুমিল্লা এলাকায় আমাকে এনে ফেলেছে! নৌকার গতি আর গাড়ীর গতি এখনো যেন আমি অনুভব কোচ্ছি! এ অনর্থের মূল সেই নবীনকালী। পাপিনী, বিশ্বাসঘাতিনী নবীনকালী আমার সঙ্গে বিলক্ষণ চাতুরী খেলেছে! ব্যভিচারপাপে যে সকল স্ত্রীলোক রত হয়, অধিকন্তু পরিবারস্থ নিজসম্পর্কীয় পুরুষের সঙ্গে যারা কুলের বাহির হয়, তাদের মায়া এই প্রকার। যে সকল কুলকন্যা এইরূপে অপথে পদার্পণ করে, তাদের বিশ্বাস করা আর কালসাপ গলায় কখন করা এক সমান!

শুয়ে শুয়ে এই সকল আমি ভাবছি, হঠাৎ ছাদের উপর ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর শব্দ। দুম দুম, গুম গুম, দুপ দাপ, ধূপ ধাপ, হুপ হাপ, এই প্রকার বিকট বিকট শব্দ! একবার বোধ হলো, ঠিক যেন আমার মাথার উপর, একটু পরে আবার বোধ হলো যেন আমার শয়নঘরের বারান্দায়, একটু পরে আবার বোধ হলো যেন খানিকটা তফাতে! একবার এখানে, একবার ওখানে, একবার ছাদের উপর, একবার বারান্দায়, নানা স্থানে নানাপ্রকার শব্দ! এক একবার বোধ হোতে লাগলো যেন সূতিকাগারে শিশুর ক্রন্দন, এক একবার বোধ হলো যেন কোন বন্যজন্তুর সক্রোধ অস্ফূট গর্জন, একবার শুনলেম যেন দুই তিনজন মনুষ্যের বেতালা নৃত্যের সঙ্গে অট্ট অট্ট হাস্য!

কি ব্যাপার! এই গভীর রজনীতে বাড়ীর ভিতর এ সব কি হয়! যারা আমার প্রাণান্ত করবার চেষ্টায় ফেরে, তারাই কি রাত্রিকালে বাড়ীর কিছু ভিতর প্রবেশ কোরে এই রকমে আমারে ভয় দেখাচ্ছে? এই স্থির কোত্তে পাল্লেম না। উপর্যুপরি কেবল সেইরূপ শব্দ, সেইরূপে গর্জন আর সেইরূপ উচ্চ উচ্চ হাস্য শ্রবণ কোত্তে লাগলেম! ভূতে যার বিশ্বাস আছে, তারা অবশ্যই ভয় পেতো, ভূত আমি বিশ্বাস করি না, সুতরাং ভূতের ভয় আমার এলো না, কিন্তু অন্য এক প্রকার সন্দেহ আমার মনোমধ্যে সম্পদিত হয়ে কোন এক প্রকার অজ্ঞাত কারণে আমার চিত্তকে অত্যন্ত বিচলিত কোরে তুল্লে।

ওঃ! এই জন্যই বটে! এই জন্যই রামদাস আমারে সাবধান থাকতে বোলেছিল, এই জন্যই কর্তার বড়ছেলেটি আমারে সাবধান কোরে গিয়েছিলেন, এই জন্যই আমার আহারের পর পাচিকাঠাকুরাণী বার বার আমারে সতর্ক কোরে গিয়েছেন; তাঁরা বোধ হয় নিত্য রাত্রে ঐরূপ শব্দ শুনতে পান, শুনে শুনে তাঁরা বোধ হয় ভূত মনে কোরে ভয় পান। অনেক দিনের পুরাতন বাড়ীতে পরিবার বেশী না থাকলে ভূতেরা এসে বাসা করে, অনেক জায়গায় অনেকের মুখে এরূপ কথা শুনা যায়; কেহ কেহ তালগাছের মত ভূত দেখেন, শাদা কাপড় পরা, কালো কালো কোপনী পরা, লাল কাপড়ের জাঙ্গিয়াপরা, বিকটাকার ভূত অনেক লোকের চক্ষে পড়ে, কালো কালো ভূতেরা অনেক লোকের ঘাড়ে চাপে, যুবতী স্ত্রীলোকের প্রেমে পড়ে, এমন কথাও শুনা যায়, আমার মনে কিন্তু সে রকম ভাব কিছুই এলো না, ভূতের ভয়ে আমি অভিভূত হোলেম না। ব্যাপার কি, যদি কিছু জানা যায়, জানবার অভিপ্রায়ে দক্ষিণদিকের একটা দরজা খুলে বারান্দায় আমি বেরুলেম। নীচে দিব্য পরিষ্কার, আকাশ দিব্য পরিষ্কার, দিব্য জ্যোৎস্না, সকল দিকে চেয়ে দেখলেম, কোথাও কিছু নাই, ছাদের দিকে চাইলেম, কিছুই দেখা গেল না; ভগ্ন বারান্দার পশ্চিম প্রান্তে যে একটা ভগ্নাগৃহ রামদাস আমারে দেখিয়েছিল, সেই গৃহের দিকেও চাইলেম, সেখানেও কিছু নাই; মনে মনে হাস্য কোরে গৃহমধ্যে পুনঃপ্রবেশ কোল্লেম; দরজাটা বন্ধ কোরে দিলেম; প্রদীপটা তখনো জ্বোলছিল, নির্বাণ কোরে দিয়ে পুনর্বার আমি শয়ন কোল্লেম। পুনর্বার সেইরূপ শব্দ। যতক্ষণ আমি বারান্দায় ছিলেম, ততক্ষণ থেমেছিল, পুনর্বার সেইরূপ নৃত্য, সেইরূপ হঙ্কার, সেইরূপ হাস্য। কি এ? ভূত যদি হয়, তবে তো ভূতেরা বিলক্ষণ চালাক, বিলক্ষণ হুঁশিয়ার! সজাগ মানুষ দেখে সাবধান হয়! ভূত যদি হয়, এ রকম ভূত ভাল!

ভূতের কথা আর আমি ভাবলেম না। নাচে নাচুক, মাতে মাতুক, হাসে হাসুক, আমার তাতে কি? ভূতের ভাবনা দূরে রেখে আমি নয়ন মুদিত কোল্লেম; রাত্রিও প্রায় শেষ হয়ে এসেছিল, নয়ন মুদে থাকতে থাকতে নিদ্রা এলো, গাঢ়নিদ্রায় আমি অভিভূত হোলেম। প্রভাতে দরজার চাবী খুলে একজন সেই ঘরের মধ্যে প্রবেশ কোল্লে; সেই শব্দে আমার নিদ্রাভঙ্গ হলো; চেয়ে দেখি, সম্মুখে সেই রূপসী।

বারান্দার খড়খড়ী খোলা ছিল, ঘরের ভিতর রৌদ্র এসেছিল, রূপসীকে জিজ্ঞাসা কোরে জানলেম, বেলা প্রায় ছয়দণ্ড। কি আমি বলি, শুনবার অভিলাষে রূপসী আমার মুখের দিকে চেয়ে রইলো, কিছুই আমি বোল্লেম না; রাত্রে যে সকল আশ্চর্য আশ্চর্য শব্দ আমি শ্রবণ কোরেছিলেম, সে সব শব্দের কথা আমার মনের ভিতরেই চাপা থাকলো। ঘরের আবর্জনা পরিষ্কার কোরে, ঘরে ঝাড়ু দিয়ে, রূপসী নিঃশব্দে তখনকার মত বাহির হয়ে গেল। তার পর স্নান, আহার, বিশ্রাম; অপরাহ্ণ সমাগত।

রামদাসকে সঙ্গে কোরে প্রাণগতিবাবু প্রবেশ কোল্লেন। তখনো আমি শয়ন কোরে ছিলেম, বাবুকে দেখে উঠে বোসলেম। শয্যার এক পার্শ্বে উপবেশন কোরে সহাস্যবদনে বড়বাবু আমাকে জিজ্ঞাসা কোল্লেন, “কি হরিদাস! গত রাত্রে কেমন ছিলে? কোন রকম ভয় পাও নাই তো?”

প্রশ্ন শুনে আমি ভাবলেম, ভয় পাওয়াটা এ বাড়ীর একটা দৈনিক কার্যের মধ্যেই গণ্য হয়ে পোড়েছে। বাড়ীতে যাঁরা আছেন, তাঁরা হয় তো সকলেই ভয় পান কিম্বা হয় তো অভ্যাস হয়ে গিয়েছে, ততটা আর গ্রাহ্য করেন না; নতুন লোক এলেই ভয়ের কথাটা ভয়ের কাণ্ডটা নূতন হয়ে জেগে উঠে। কাজ কি আমার সে সব কথায়? বিনা সঙ্কোচে সপ্রতিভ হয়েই আমি উত্তর কোল্লেন, “বেশ ছিলেম, কিছুই ভয় পাই নাই, ভয় পেতে হয়, তেমন কোন লক্ষণও আমি জানতে পারি নাই।”

বড়বাবুর উভয় নেত্র বিস্ফারিত। নিষ্পলকে আমার নিষ্পলক নয়ন নিরীক্ষণ কোরে ক্ষণকাল তিনি নির্বাক থাকলেন, তার পর একটু গুঞ্জনস্বরে বোল্লেন, “ছেলেমানুষের ঘুম বেশী। তা বেশ! রাত্রিকালে জেগে থাকলেই অনেক রকম ভয় আসে, চক্ষের কাছে যেন কত রকম বিভীষিকা দেখা যায়। অচেতনে ঘুমালে আর কোন উৎপাত থাকে না। তা বেশ! এখন একটু বেড়াতে যাবে?”

অছিলা একটু পেলেই হয়। বেড়াতে যাওয়ায় আমার বড় আমোদ। নানা দিকে নানা বস্তু দর্শন কোরে মন একটু প্রফল্ল থাকে, চিন্তা-ভাণ্ডারের দ্বার খানিকক্ষণ অবরুদ্ধ থাকে, খানিকক্ষণ বেশ অন্যমনস্ক থাকা যায়। বড়বাবুর প্রশ্নে তৎক্ষণাৎ আমি উত্তর দিলেম, “যাব। নূতন জায়গায় এসেছি দেখে শূনে রাখা ভাল। বিশেষতঃ কর্তার মুখে শুনেছি, কিছুদিন আমারে এখানে থাকতে হবে, সেরেস্তায় লেখাপড়া কোত্তে হবে, স্থানটা ভালরূপে জেনে রাখা দরকার। কল্য বৈকালে রামদাস অল্প অল্প দেখিয়ে এনেছে। রামদাসটি বেশ লোক। আজিও কি রামদাস আমার সঙ্গে যাবে?”

বড়বাবু বোল্লেন, “হাঁ, রামদাসও যাবে, আমিও যাব। চল; এসো।”

তৎক্ষণাৎ প্রস্তুত হয়ে ঘর থেকে আমি বেরুলেম। দক্ষিণের জানালা দরজা বন্ধ হলো, ঘরের প্রবেশ-দ্বারে রামদাস চাবী দিল, আমরা বেড়াতে চোল্লেম। আমি আর বড়বাবু পাশাপাশি,— সারি সারি, পশ্চাতে রামদাস।

রুদ্রাক্ষ গ্রাম। যে বাড়ীতে আমারে থাকতে হয়েছে, গ্রামের উত্তর প্রান্তে সেই বাড়ী। বাড়ী থেকে বেরিয়ে আমরা পশ্চিমের রাস্তা ধোল্লেম। পল্লীগ্রামের রাস্তা, সর্বত্রই প্রায় সঙ্কীর্ণ, ঠাঁই ঠাঁই কিছু প্রশস্ত; ধারে ধারে দূরে দূরে এক একখানা সামান্য রকমের বাড়ী, দূরে নিকটে ক্ষুদ্র বৃহৎ বৃক্ষ মালা। শ্রেণীবদ্ধ বৃক্ষ, এমন কথা আমি বোলছি না, কোথাও একটি, কোথাও দুটী পাঁচটী, কোথাও বা আট-দশটী, স্থানে স্থানে এই রকমে নানাজাতি বৃক্ষ দণ্ডায়মান, মধ্যে মধ্যে এক একখানি বাগান। এইখানে আমি একটা আশ্চর্য দেখলেম। সকল গাছে পাতা নাই; যে সব গাছে পাতা আছে, সে সব গাছ যেন একটু একটু ঝলসানো ঝলসানো; পাতাগুলিও ছোট ছোট। পাতার বর্ণও অন্য প্রকার; নিখাত হরিৎবর্ণের বৃক্ষপত্র অতি অল্পই দেখা গেল। আর এক আশ্চর্য, কোন বৃক্ষশাখায় একটিও পাখী দেখলেম না।

গল্প কোত্তে কোত্তে আমরা চোলেছিলেম, প্রকৃতির ঐরূপ বিপর্যয় দর্শনে বড়বাবুকে আমি সেই বিপর্যয়ের হেতু জিজ্ঞাসা কোল্লেম। বড়বাবু বোল্লেন, “দ্বাদশ মাসের মধ্যে এই অঞ্চলে পাঁচবার অগ্নিকাণ্ড হয়েছিল, অনেক লোকের ঘর-বাড়ী ভস্ম হয়ে গিয়েছে, অনেক বড় বড় বৃক্ষ সমূলে দগ্ধ হয়েছে, অগ্নিক্ষেত্রের নিকট বৃক্ষ একটিও সতেজ নাই; যে সকল বৃক্ষ দূরে ছিল, সেইগুলিই বেঁচে আছে, এগুলিও দূরে থাকাতে রক্ষা পেয়েছে, কিন্তু ভীষণ অনলের উত্তাপে শাখাপত্রাদির অবস্থা ঐ রকম। এ অঞ্চলে তৃণগৃহ অনেক ছিল, অগ্নিকাণ্ডে প্রায় সমস্তই ভস্মীভূত; পুনর্নির্মাণে যারা অসমর্থ ছিল, তারা পালিয়ে গিয়েছে, কাজেই গ্রামবাসীর সংখ্যা কম হয়ে পোড়েছে।”

পশ্চাতে ছিল রামদাস। বড়বাবুর অপেক্ষা রামদাসের বয়স অনেক বেশী : রামদাস তাঁদের বাড়ীর অনেক দিনের চাকর, রামদাস বড়বাবুর জন্ম দর্শন কোরেছে; বড়বাবুর কথা সমাপ্ত হবামাত্র রামদাস আমাদের সম্মুখে এগিয়ে এসে হস্ত বিস্তার কোরে বোলে উঠলো, “সে কথাটা বুঝি বোল্‌বে না? ঘর পুড়ে গিয়েছে, গাছ পুড়ে গিয়েছে, মানুষেরা পালিয়ে গিয়েছে, এই কথা বোল্লেই বুঝি সব বলা হলো? আসল কথাটা চেপে রাখ কেন? ভয় করে বুঝি বোলতে?” বড়বাবুকে ঠেস দিয়ে দিয়ে ঐ কথাগুলি বোলে আমার দিকে চেয়ে রামদাস বোলতে লাগলো, “না গো হরিদাস, সে রকম আগুন লাগা নয়; লোকেরা সব লোকের ঘরে ঘরে আগুন দিয়ে দিয়ে বেড়াতো। কাজ পাবার মৎলবে এক এক জায়গায় গুপ্তভাবে ঘরামী লোকেরা যেমন লোকের ঘরে আগুন লাগিয়ে দিয়ে যায়, এ গাঁয়ের কাণ্ডটা সে রকম নয়;—রাম! রাম! রাম!—এ গ্রামে মাসকতক অত্যন্ত ভূতের ভয় হয়েছিল, সন্ধ্যার পর ভূতের ভয়ে কেহই ঘরের বাহির হোতে পাত্তো না; না বেরুলে নয়, এমন কোন প্রয়োজন উপস্থিত হোলে পাঁচ সাতজন একত্র হয়ে মশাল জ্বেলে জ্বেলে রাস্তায় বেরুতো। কেন জানো? ভূতেরা আগুন দেখলে ভয় পায়, আলো দেখলে পালিয়ে যায়, সেই জন্য। সেই রকম হোতে হোতে গ্রামের জনকতক ডানপিটে লোক একটা দল বেঁধে পরামর্শ কোল্লে, আগুন দেখে যদি ভূত পালায়, তবে গ্রামে আগুন দিয়ে ভূত তাড়াবার ব্যবস্থা করা যাক। সেই ব্যবস্থায় বার বার অগ্নিকাণ্ডে লোকের ঘর-বাড়ী গেল, গাছপালা গেল, ভূত কিন্তু পালালো না।”

কিঞ্চিৎ বক্রদৃষ্টিতে চেয়ে একটু উচ্চকণ্ঠে বড়বাবু বোল্লেন, “ও কি কর রামদাস বালকের কাছে ও সব পরিচয় কেন? রেতের বেলা ভয় পাবে। কত জায়গায় কত গ্রামে কতবার আগুন লাগে, ও রকমে হেতুর নির্ণয় কোরে কেহ কাহাকেও বুঝায় না, বুঝাতে হয়ও না।”

রামদাস চুপ্‌ কোরে থাকলো। আমি মনে মনে হাস্য কোল্লেম। বালক রেতের বেলা ভয় পাবে! ভূতের নামে ভয় পায়, এ বালক নয়, প্রাণগতিবাবু সেটি জানেন না, সেই জন্যই রামদাসকে সাবধান কোরে দিলেন। একরকম ইতিহাস আমি শুনলেম, মুখ বুজে চাপ কোরে থাকাও ভাল দেখায় না, বড়বাবুকেই আমি জিজ্ঞাসা কোল্লেম, “আগুন লেগেছিল, অনেক লোকের ক্ষতি হয়ে গিয়েছে, হোতেই পারে, হয়েই থাকে, গাছে একটীও পাখী বসে না কেন? পাখীরাও কি ভূতের ভয়ে পালিয়ে গিয়েছে?”

বড়বাবু উত্তর করবার পূর্বে আমার নূতন প্রশ্নে রামদাস উত্তর কোল্লে, “ভূতের ভয়ে পাখী পালায় না, ভূতের ভয়ে পালায় নাই; বৎসরের মধ্যে বার বার আগুন লাগতে লাগলো, পাখীদের বাসাগুলি সব পুড়ে গেল, ছানাগুলিও মারা গেল, বাসাতে যে সকল ডিম ছিল, সেগুলি সব দগ্ধ হলো, কাজে কাজে আগুনের ভয়ে পাখীরা সব উড়ে পালালো; আগুনের ভয়,— ভূতের ভয়ে নয়। আমি তো মনে করি, অনেক মানুষের চেয়ে অনেক পশু-পক্ষীর বুদ্ধি বেশী। পশু-পক্ষীরা মুখে কথা কোয়ে কিছু প্রকাশ কোত্তে পারে না, কিন্তু মনে মনে ভালমন্দ সমস্তই বুঝতে পারে; পেটে পেটে বুদ্ধি।”

আমরা বেড়াচ্ছি, রুদ্রাক্ষগ্রামের পশ্চিমসীমা যেখানে শেষ, সেইখানে একটা নদী, আমরা সেই নদী-কূলে উপস্থিত হোলেম। আর অগ্রসর হওয়া গেল না, নদীতীরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চারিদিকের শোভা আমরা দর্শন কোত্তে লাগলেম। খানিকক্ষণ আপন মনে কি আলোচনা কোরে একটা ম্লানবদনে রামদাস আমাকে বোল্লে, “পাড়াগাঁয়ে গরীবের বাস অধিক; গরীবলোকেরা পাতার ঘরে, খড়ের ঘরে বাস করে; এ গ্রামেও তাই ছিল, দেখে এসেছো খানকতক কুড়ে ঘর নূতন হয়েছে, আগেকার পোড়া-ঘর পোড়ে আছে, বড়ই দুর্দশা। আমাদের গাঁয়ে পাকাবাড়ী বড়ই কম; আমাদের বাবুদের ঐ একখানি আর গ্রামের পূর্বদিকে তিন ঘর তন্তুবায়ের তিনখানি, এই মাত্র। পাকাবাড়ীতে আগুনের ভয় বড় একটা থাকে না, বাবু লোকের উপর ভূতের উপদ্রবও বেশী হয় না, যত কোপ গরীবদের উপর!”

রামদাসের শেষ কথাগুলির উপর টীকা করবার কোন প্রয়োজন হলো না, আমি চুপ কোরে থাকলেম। রামদাসের মুখখানি একটু ভারী হলো, ভাবে বুঝা গেল অভিমান। যারা বেশী কথা কয়, তারা মনে করে, আমাদের কথায় সকল লোকের আমোদ হবে সকলে আমাদের বাকশক্তির প্রশংসা কোরবে, অবশ্যই কেহ না কেহ মনোযোগ দিয়ে শুনে শুনে বড় বড় কথার উত্তর দিবে। রামদাস এখানে কোন উত্তর পেলে না, তাতেই তার অভিমান হলো। রামদাস হঠাৎ পাকাবাড়ীর কথা কেন তুলেছিল, আমি সেটা কতক কতক বুঝতে পেরেছিলেম; ভূতেরা পাকাবাড়ীতে বাসা করে কি না, রামদাস হয় তো সেই কথাই বোলতো; উত্তর পেলো না বোলেই ভূমিকাতেই ইতিহাসটা সাঙ্গ কোরে দিলে; সাঙ্গ কোত্তেই বাধ্য হলো। সেইজন্যই অভিমান, তার তখনকার মুখের ভাব দেখে আমি সেইরূপ অনুমান কোল্লেম।

নদীর জল তলে রক্তবর্ণ সূর্যমণ্ডলের ছায়া। সূর্যদেবের অস্তাচলে গমনের সময় সন্নিহিত। প্রাণগতিবাবু আকাশের দিকে একবার চেয়ে আমার মুখের দিকে ফিরে প্রসন্নবদনে বোল্লেন, “দেখ হরিদাস, তুমি আমাদের কাছে নূতন, তথাপি তোমার চক্ষু দেখে আমি বুঝতে পেরেছি, তুমি বেশ বুদ্ধিমান। ভূতের প্রসঙ্গে যে সব কথা আমরা বলাবলি কোল্লেম, তত হোক না হোক, সব কথায় মনে এক প্রকার ভয় আসে; পৃথিবীর সকল দেশেই ভূতের অস্তিত্বে আশ্চর্য আশ্চর্য গল্প শুনা যায়; বিশ্বাসের সঙ্গে যারা গল্প করে, তারা অবশ্যই ভয় পায়। দিনমানে ততটা ভয় না আসুক, রাত্রিকালে নিশ্চয়ই ভয় হয়; আর এখানে আমাদের বিলম্ব করবার প্রয়োজন নাই; সন্ধ্যা আগতপ্রায়।”

সন্ধ্যার পূর্বেই আমরা বাড়ীতে ফিরে গেলেম। নূতন জায়গায় প্রথম প্রথম যেমন হয়ে থাকে, সেই রকমে সে রাত্রিও আমি যাপন কোল্লেম, সে রাত্রেও পূর্বে রাত্রের ন্যায় নানা প্রকার উৎকট শব্দ আমার শ্রুতিগোচর হলো; ভ্রক্ষেপ না কোরে নির্ভয়ে আমি শয়ন কোরে থাকলেম। নিদ্রার অগ্রে সে রাত্রে আমি একটা নূতন কথা ভাবছিলেম। গ্রামের পশ্চিমদিকে অগ্নিকাণ্ডের নিদর্শন। প্রাণগতিবাবু অন্য কোন দিকে না গিয়ে সেই দিকে আমারে নিয়ে গিয়েছিলেন কেন? অগ্নিকাণ্ডের হেতু জানবার ইচ্ছা হোলে আমারে তিনি ভূতের উৎপাতের কথা শুনাবেন, শূনে আমি ভয় পাব, এই কি তাঁর মতলব? পূর্বদিনের সতর্কতার উপদেশ, রামদাসের মুখে, পাচিকার মুখে আর তাঁর নিজমুখে সাবধানতার বার্তা, আজ আবার স্পষ্ট স্পষ্ট ভয়-প্রদর্শন-ভূমিকা। এ প্রকার ভূমিকার কারণ কি? আমারে ভূতের ভয় দেখিয়ে কার কি অভীষ্ট সিদ্ধ হবে? যারা আমারে আমার অজ্ঞাতে এ বাড়ীতে রেখে গিয়েছে, তারাই কি ঐরূপে উপদেশক? তাই যদি হয়, তবে ভূতের কথা কেন? ভয়ের হেতু অনেক রকম আছে, অনেক কারণেই লোক ভয় পায়, ভূতের ভয় দেখিয়ে ছলনা করবার উদ্দেশ্য কি? কিছুই মীমাংসা আনতে পাল্লেম না। নিদ্রা এলো, ঘুমালেম, সব ভয়—সব তর্ক ভুলে গেলেম।

উপর্যুপরি পাঁচ রাত্রি আমি ঐ প্রকার শব্দ শ্রবণ কোল্লেম, একবারও আমার ভয় হলো না; কেবল একটা সন্দেহ বাড়লো মাত্র। যা যা আমি শুনি, কাহারও কাছে প্রকাশ করি না, কেহ জিজ্ঞাসা কোল্লেও সে সব কথা বলি না। বড়বাবু পাচিকা ও রামদাস আমার নির্ভীকতা অনুভব কোরে বিস্ময়াপন্ন। কর্তাবাবু সেই একদিন ভিন্ন আর কোন দিন আমারে দেখা দেন নাই, ছোটবাবুও সেই একবার ভিন্ন আর আমার কাছে আসেন না। বড়বাবু, রামদাস, পাচিকা আর রূপসী, এই চারিজনের সঙ্গেই আমার দেখাসাক্ষাৎ কথাবার্তা চলে। রূপসী দিবারাত্রির মধ্যে পাঁচ সাতবার আমার ঘরে আসে, কাজ-কর্ম করে, কথা কবার প্রয়োজন না থাকলেও সামান্য একটা অছিলা ধোরে নানা রকম কথা কয়, হাস্যের কারণ না থাকলেও মুখ মুচকে মুচকে হাসে, আমি যখন অন্যদিকে চেয়ে থাকি, রূপসী তখন একদৃষ্টে আমার দিকে চেয়ে থাকে, ঘর থেকে যখন বেরিয়ে যায়, আমি তখন তার বিলক্ষণ কটাক্ষ-ভঙ্গী দর্শন করি; মনে সন্দেহ আসে।

এইভাবে দশদিন আমি সেই বাড়ীতে থাকলেম। সকল রকমেই সেই দশদিন সমভাব। কর্তা আমারে বোলেছিলেন লেখা-পড়ার কাজ-কর্মে নিযুক্ত থাকতে হবে। কথা আমার মনে ছিল, কাজে কিন্তু কিছুই না; কাগজ-কলমের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ মাত্র নাই। আমি তবে কি করি?—উত্থান করি, ভোজন করি, ভ্রমণ করি, শয়ন করি, চিন্তা করি, মাঝে মাঝে আজগুবী আজগুবী গল্পগুজব শ্রবণ করি, এই পর্যন্ত আমার কর্ম। দশদিন দশ রাত্রি ঠিক একভাবে কেটে গেল। থাকতে থাকতে বাবুদের পরিবারবর্গের পরিচয় পেলেম।

পুরুষের মধ্যে কর্তা স্বয়ং আর দুটি পুত্র; স্ত্রীলোকের মধ্যে গৃহিণী, বড়বধু, ছোটবধু, আর কর্তাবাবুর এক শ্যালকের একটি স্ত্রী; চাকরের মধ্যে রামদাস, চাকরাণীর মধ্যে রূপসী; এইগুলি ছাড়া সেই বৃদ্ধা পাচিকা-ঠাকুরাণী। বড়বাবুর বয়ঃক্রম পঞ্চবিংশতি বর্ষ, ছোটবাবুর বয়ঃক্রম ত্রয়োবিংশতি বর্ষ; বড়-বৌমার বয়স বাইশ বৎসর, ছোট-বৌমার বয়স ঊনিশ বৎসর। কর্তার যে শ্যালক-পত্নীটি বাড়ীতে আছেন, তিনি বিধবা, বয়স অনুমান তেইশ চব্বিশ বৎসর; দেখতে দিব্য সুশ্রী, বর্ণ গৌর, সে গৌরবর্ণের উপর রক্তবর্ণ আভা; কর্তা সেটিকে রাঙা-বৌ বোলে আদর করেন, গৃহিণীও বলেন, রাঙা-বৌ। সেই রাঙা-বৌটি ছেলেবাবুদের মামী হন; রামদাস আর রূপসী সেই সম্পর্কে রাঙা-বৌকে রাঙা-মামী বোলে সম্মান দেয়।

বাবুদের একটি ভগ্নী আছে, তার নাম শুকতারা। সেই ভগ্নীটি সর্ব-কনিষ্ঠা। সেটা প্রায় বারমাস শ্বশুরালয়ে থাকে, মাঝে মাঝে এক একবার আসে, সপ্তাহের মধ্যেই আবার চলে যায়। পূর্বে বলেছি, এ বাড়ীর ভিতরমহল বাহিরমহল প্রায় এক, কেবল একটি বারান্দা মাত্র ব্যবধান; তথাপি আমি প্রথম প্রথম কেবল বাহির-মহলেই থাকতেম, নারী মহলে প্রবেশের অনুমতি পেতেম না, বেশীদিন থাকতে থাকতে আমার রীতি চরিত্র দেখে, কর্তা আমারে অন্দরে গিয়ে আহার করবার অনুমতি দিলেন। সেই কর্তা; যিনি আমারে নেশাখোর ভেবে অগ্রাহ্য কোরেছিলেম, ঠাট্টা-বিদ্রূপ ঝেড়েছিলেন, একমাস পূর্ণ হোতে না হোতেই সেই কর্তা আমার প্রতি সুপ্রসন্ন।

ভিতরমহলে আমি প্রবেশ করি, গৃহিণীকে আমি মা বোলে ডাকি, বৌ দুটী আমারে দেখে ঘোমটা দেন, রাঙা-মামী ঘোমটা দেন না। দুই বেলা আহারের সময় বাড়ীর ভিতর আমি যাই, অন্য কোন প্রয়োজন উপস্থিত হোলেও অন্দরে আমার ডাক পড়ে; অবাধ গতিবিধি; কিন্তু রাত্রিকালে শয়নটা আমার বাহিরেই হয়। বাহিরে শয়ন করি বটে, কিন্তু রাত্রিকালে সমস্ত কলরব নিবৃত্তি হোলে ভিতরমহলের উচ্চ উচ্চ কথাবার্তা আমার শ্রবণগোচর হয়। আমার শয়ন-ঘরের ঠিক পাশেই অন্দর; বারান্দার দরজা পার হয়ে অন্দরের পথের বামদিকে যে ঘরটী, রাত্রিকালে সেই ঘরে রাঙা-মামী শয়ন করেন, সেই ঘরের পশ্চিমের দুটি ঘরে বড়বাবু আর ছোটবাবু। সেই তিনটি ঘর উত্তরদ্বারী, পূর্ব-পশ্চিমে দীর্ঘ। অপর ধারে ঐরূপ তিনটি ঘর দক্ষিণ-দ্বারী; একটিতে কর্তা-গৃহিণী থাকেন, একটিতে পাচিকা আর রূপসী, তৃতীয়টী ভাঁড়ার ঘর। রন্ধনগৃহ নিম্নতলে। অন্দরের চিত্র এইরূপ। বাহির-দিকেও উত্তর বারান্দার দক্ষিণাংশে সারি সারি তিনটি ঘর। একটি ঘরে আমি থাকি, তার পাশে পূর্বদিকের একটা ঘরে রামদাস শয়ন করে, তৃতীয় ঘরটী খালি থাকে। পূর্বে পূর্বে বাড়ীতে যখন পূজা-পার্বণ হতো, সেই সময় লণ্ঠনদেয়ালগিরি অনেক ছিল, অনেক এখন নষ্ট হয়ে গিয়েছে, অবশিষ্ট গোটাকতক এখন সেই খালি ঘরে রক্ষিত হয়েছে।

প্রতি রজনীতে আমি ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর শব্দ শুনি, কোথা থেকে শব্দ আসে, কারা সেই সকল শব্দ করে, কিছুই আমি ঠিক কোত্তে পারি না; দিনের বেলা আমি কাহাকে কিছু জিজ্ঞাসাও করি না। সেই ভাবে প্রায় একমাস গেল। আমার মন ক্রমশ‍ই চঞ্চল। যাঁরা আমারে ভালবাসেন, আমি যাঁদের ভালবাসি, তাঁরা কে কেমন আছেন, মামলা-মোকদ্দমার সংবাদ কি কিছুই জানতে পাচ্ছি না। একদিন বেলা এক প্রহরের পূর্বে আপন ঘরের একটি গবাক্ষে বোসে গালে হাত দিয়ে আমি ভাবছি, এত দিনের পর কর্তা হঠাৎ সেইখানে এলেন। ভাবনায় অন্যমনস্ক ছিলেম, চক্ষু ও অন্যদিকে ছিল, নিঃশব্দে টিপি টিপি প্রবেশ কোরে আচম্বিতে কর্তা আমারে জিজ্ঞাসা কোল্লেন, “কি হরিদাস, এত গভীর কিসের চিন্তা? কিসের ধ্যানে নিমগ্ন আছ?”

চমকে উঠে থাড়িমাড়ি খেয়ে আমি নেমে দাঁড়ালেম। একটু পূর্বে যে একটি কল্পনা, আমার অন্তরে খেলা কোচ্ছিল, কোন কথা মনে আনবার অগ্রেই সেই কল্পনাটি কর্তাকে জানিয়ে বিনম্রবচনে নিবেদন কোল্লেম, “আপনার নিকটে আমার একটি প্রার্থনা। নিরাশ্রয় অবস্থায় যাঁরা আমারে আশ্রয় দিয়েছিলেন, তাঁদের জন্য সর্বদা আমার প্রাণ কেমন করে; ডাকযোগে চিঠি লিখে তাঁদের শুভসমাচার আনাই, এই আমার ইচ্ছা। আপনি অনুগ্রহ কোরে অনুমতি দান করুন।”

গম্ভীর বদনে কি একটা চিন্তা কোরে কর্তামহাশয় আমারে বোল্লেন, “যা লিখতে চাও, লিখতে পার, কিন্তু শিরোনামগুলি আমি দেখে দেখে দিব।” —আমি বোল্লেম, “আজ্ঞে, কেবল শিরোনামা কেন, পত্রে যা যা আমি লিখবো, সমস্তই আপনি দেখে দিবেন।”

আমার বিছানার উপর কর্তা বোসলেন; একটু দূরে বোসে মনের উল্লাসে আর কিছু আমি বলবার উপক্রম কোচ্ছিলেন, সেই অবসরে এক রকম বিমর্ষস্বরে কর্তা আবার বোল্লেন, “না না, তা তুমি পার না। চিঠি যদি তুমি লিখতে চাও, তাতে কেবল এই কথা লিখতে পার যে, তুমি বেঁচে আছ, সুখে আছ, পীড়া হয় নাই, এই রকম খোলসা খোলসা কথা। কোথায় আছ, কি বৃত্তান্ত, সে সব কথা লিখতে পাবে না। আরও একটি কথা বোলে রাখি। চিঠিগুলি লেখা হোলে আমার হাতে দিও, আমি সেইগুলি কলিকাতা যাত্রী বিশ্বাসীলোকের হাতে দিয়ে রওনা কোরে দিব, তাঁরা সেগুলি কলিকাতার ডাক ঘরে অর্পণ কোরবেন। ত্রিপুরা, ঢাকা অথবা পূর্বাঞ্চলের কোন ডাকঘরের নাম নিদর্শন কোন চিঠিতেই থাকতে পারবে না। বুঝতে পেরেছ আমার কথা?”

বিষণ্ণ বদনে আমি উত্তর কোল্লেম, “বুঝতে পাল্লেম সব, যাঁদের আমি লিখবো, তাঁরা সে সকল পত্র পাবেন, সে কথাও সত্য, কিন্তু যে জন্য আমার প্রাণ আকুল, সে পক্ষে কোন উপকার হবে না;  ঠিকানা লেখা না থাকলে পত্রের প্রত্যুত্তর আমি প্রাপ্ত হব না।”

“তা আমি কি কোরবো?”— কিঞ্চিৎ উচ্চস্বরে কর্তা বোলে উঠলেন, “তা আমি কি কোরবো? এই জেলায় আমার বাড়ীতে তুমি আছ, সে কথা প্রকাশ হোলে দলে দলে লোক এসে আমাকে উস্তম-খুস্তম কোরবে, অনেক লোক তোমার তল্লাস কোরতে আসবে, সেটা আমি ইচ্ছা করি না। সাবধান, আমার অজ্ঞাতে ক্ষুদ্র একখানি চিঠিও এখানকার ডাকঘরে তুমি দিও না। যদি দাও, তোমার নিজেরই মন্দ হবে; স্মরণ রেখো।”

এই সব কথা বোলে, কটমটচক্ষে আমার দিকে চাইতে চাইতে কর্তাবাবু ত্বরিতপদে সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। কি কোত্তেই বা এসেছিলেন, কি কোরেই বা চোলে গেলেন, কিছুই আমি বুঝলেম না, অবাক হয়ে একটি ধারে আমি বোসে থাকলেম।

কর্তাও বেরিয়ে গেলেন, তৎক্ষণাৎ রামদাস এসে উপস্থিত। আমি মনে কোল্লেম, রামদাস বুঝি এবার কর্তারই প্রেরিত; কিন্তু তা নয়।

রামদাস এসেই যেন একটু চমকিতস্বরে আমারে জিজ্ঞাসা কোল্লে, “গত রাত্রিতে তুমি কি কাজ কোরেছিলে? তোমার ঘরের দক্ষিণের বারান্দায় সব শব্দ হয়েছিল?”

প্রশ্নের ভাব আমি বুঝতে পাল্লেম না। নিত্য রাত্রে ভয়ানক ভয়ানক শব্দ হয়, বাড়ীর লোকেরা সকলেই তা জানে, রামদাসও জানে, না জানলে ভয় পেয়ো না বোলে আমারে সাবধান কোরবে কেন? জানে সব, আমার বারান্দায় শব্দ হওয়াটা মিথ্যা কথা; নিদ্রা আমার অল্পক্ষণ; অন্য দিকে শব্দ হয়, হাস্য হয়, নৃত্য হয়, সব আমার কানে আসে, আমার সম্মুখের বারান্দার কোন রাত্রে কোন শব্দ হয় না; জানালা-খড়খড়ী খোলা থাকে, শব্দ শোনা মাত্র নয়, শব্দের নায়কেরাও আমার নয়ন-পথবর্তী হোতে পাত্তো। বারান্দায় কিছুই হয় নাই। রামদাস তবে এমন কথা বলে কেন? কোন রকম ধাম্পা না কি?

রাত্রে যে যে কাণ্ড হয়, একদিনও কাহারো কাছে আমি সে সকল গল্প করি না। সেই দিন রামদাসের কথায় কৌতূহলী হয়ে আমি বোল্লেম, “দেখ রামদাস, যে সব কথা তোমরা বোলেছিলে, সে সব কথা সত্য, অনেক রকম শব্দ আমি শুনতে পাই; কিসের শব্দ, কারা শব্দ করে, কিছু‍ই আমি বুঝতে পারি না, জান কি তুমি শব্দগুলো কিসের?”

বেলা এক প্রহর, তথাপি রামদাসের চক্ষে যেন ভয়ের লক্ষণ দেখা গেল। চকিতনেত্রে চারিদিকে চেয়ে, রাম রাম মন্ত্রে আত্মসার কোরে রামদাস চুপি চুপি বোলে, “রামনাম কর! রামনাম কর! এখানা ভূতের বাড়ী! বাড়ীতে পরিবার অনেক ছিল, যমের দৌরাত্ম্যে প্রায় সকলেই শ্মশানশায়ী হয়েছে, যে কয়জন বেঁচে আছে, চক্ষেই দেখতে পাচ্ছো। বাড়ীখানাও কত বড়, আছেই বা কতটুকু, তাও তুমি দেখছো। পাড়ার লোকেরা বলে, থানা বাড়ী! সকলে তো ভেতরের খবর রাখে না, যার মনে যা উদয় হয়, সেই কথাই সেই বলে। এ বাড়ীতে আজ কাল ভূতের অধিকার! তুমি নূতন এসেছো, ভয় পাবে বোলে সব কথা আমি তোমাকে বলি না। ভূত সব দেখা যায়! ভয়ানক ভয়ানক ভূত! গণনাতে অনেক! ইদানীং উপদ্রবটা কিছু বেড়েছে, এত দিনের পর কর্তা ভয় পেয়েছেন; ভূতেরা দুদিন তিন দিন কর্তার ঘরে দুধ-সন্দেশ চুরি কোরে খেয়েছে। বাক্সের টাকা সিঁড়িতে ছড়াছড়ি যাওয়া আরম্ভ হয়েছে, বাক্সে চাবি দেওয়া থাকে, টাকা উড়ে যায়, টাকার বাটিতে চাঁপাফুল, কোন দিন বা দু একটা রসগোল্লা পাওয়া যায়।”

এই পর্যন্ত শ্রবণ কোরে হঠাৎ আমি বোল্লেম, “তবে তো সে সকল ভূতের বেশ ধর্মজ্ঞান আছে! টাকা চুরী করে না, ছড়িয়ে দিয়ে যায়, খাবার জিনিস রেখে যায়, ফল রেখে যায়. আমার যেন মনে হয়, সে সব ভূত ঘরের ভূত! তাদের শরীরে মায়া দয়া বেশী। আচ্ছা রামদাস, ভূত যদি দেখা যায়, তবে কেন প্রতীকার করা যায় না?”

একটু শিউরে উঠে মস্তক সঞ্চালন কোরে রামদাস বোল্লে, “এই রে! ছেলেমানুষ কি না, ভূতের প্রতীকার কোত্তে চায়! ভূতের প্রতীকার কি রকম হরিদাস? আদালতে মোকদ্দমা করা? ঢাল-তলোয়ার নিয়ে তাড়া করা? লাঠি-সোঁটা নিয়ে সদরদরজা আটক করা? তা নয় হরিদাস, তা নয়! মোকদ্দমা-মামলাতে কিম্বা যুদ্ধ-সজ্জাতে ভূত দমন করা যায় না, যাতে দমন করা যায়, কর্তা সেই উদযোগে আছেন; কর্তা-গিন্নী দুজনেই এই মাসের মধ্যে গয়াধামে যাবেন, গদাধরের পাদপদ্মে পিণ্ডদান কোল্লেই একদিনে সমস্ত ভূত উদ্ধার হয়ে যাবে, বাড়ীতে আর কোন প্রকার উপদ্রব থাকবে না।”

সব কথায় বেশী মনোযোগ না রেখে, সত্যই যেন বেশী বিশ্বাস কোরেছি, সেই ভাব জানিয়ে গম্ভীরবদনে আমি বোল্লেম, “আচ্ছা রামদাস, সত্য কি ভূত তুমি স্বচক্ষে দেখেছ?”

রামদাস উত্তর কোল্লে, “চক্ষে না দেখে কোন কথা বলা আমার অভ্যাস নয়। অনেকবার দেখেছি। কিন্তু একটা কথা কি জান, ছোটলোক ভূত আর ভদ্রলোক ভূত এক রকম হয় না; ছোটলোক ভূতেরা সম্মুখে পোড়লেই ঘাড় ভাঙে, ভদ্রলোক ভূতেরা সে রকম করে না, কেবল দূর থেকে ভয় দেখায়। তাদের আরো একটা গুণ আছে। ঘরের মধ্যে বেশী লোক থাকলে তারা দেখা দেয় না, বাইরে বাইরে শব্দ কোরেই পালিয়ে যায়, রাত্রিকালে একঘরে যদি একজন থাকে, তা হোলেই দেখা দেয়। দেখবে তুমি? আজ অনেক রাত পর্যন্ত তুমি জেগে থেকো; রাত্রি দুই প্রহরের পূর্বে ভূত আসে না, রাত্রি যখন ঝাঁ ঝাঁ করে, পশু-পক্ষী কীট-পতঙ্গ সব যখন নিস্তব্ধ থাকে, সকলে যখন নিদ্রা যায়, সেই সময় ভূতের আমদানী! আজ তুমি জেগে থেকো, ভয় পেয়ো না কিন্তু, ভয় পেলেই তারা বিকটমমূর্তি দেখায়। চুপটি কোরে ঠাণ্ডা হয়ে চেয়ে থেকো, ভূতগুলির লাফানী ঝাঁপানী দেখতে পাবে। তারা আমাদের পোষা ভূত!”

ক্রমশঃ বেলা হোতে লাগলো, রামদাস উঠে গেল, দিবা-কর্তব্য সমাপ্ত কোরে আমি কিয়ৎক্ষণ বিশ্রাম কোল্লেম। বিশ্রামকালে রামদাসের কথা স্মরণ কোরে আমার হাসি পেলে, কিন্তু হাসতে পাল্লেম না। চিঠি লেখা হবে না, অমরকুমারীর সংবাদ লওয়া হবে না। কর্তা বোলে গেলেন, পূর্বেদেশের কোন ডাকঘরে আমার চিঠি অর্পণ করা হবে না। আমি যদি চিঠি লিখি, সাদা কথায় লিখে কর্তার হাতে দিব, এখান থেকে কলিকাতায় যারা যায়, সেই সকল চিঠি কর্তা তাদের হাতে দিবেন, কলিকাতার ডাকঘরে দস্তুরমত মোহর হয়ে সেই সব চিঠি বিলি হবে। কর্তার ইচ্ছা এই প্রকার। ভূতের কৌতুক মনে কোত্তে কোত্তে কর্তার ঐ সব কথা আগেই মনে এলো, হাসতে পাল্লেম না।

তাৎপর্য কি? যেখানে আমি আছি, সেখানকার ডাকঘরে চিঠি দেওয়া হবে না, যে স্থানে আমি আছি, আমার বন্ধুগণকে সে ঠিকানা জানতে দেওয়া হবে না, তাৎপর্য কি? বা আমি ভেবেছিলেম, ঠিক তাই! যে সকল লোক এখানে আমারে রেখে গিয়েছে, নিশ্চয়ই তারা রক্তদন্তের দলের লোক;  রক্তদন্তের চক্র বহুদূর-বিস্তৃত! চিরদিন আমারে গোপন কোরে রাখা সেই চক্রের লোকের মতলব। দেখি দেখি, কপালে কি আছে! ভগবান কাহারো প্রতি নির্দয় থাকেন না, লোকের অবশ্যই চিরদিন সমান থাকে না, আমার এই দুরবস্থা যে চিরদিন সমান থাকবে, এমন কি পাপ আমি কোরেছি? প্রাণে যদি না মরি, বৈরিহস্তে যদি আমার প্রাণ না যায়, তা হোলে একদিন না একদিন অবশ্যই আমার অবস্থার পরিবর্তন হবে, অবশ্যই সুদিন উদয় হবে, ভগবান অবশ্যই মুখ তুলে চাইবেন, সেই সময় অবশ্যই জানতে পারবো, এই ভয়ানক যুক্তি-তর্কের গোড়া কোথায়?

বেলা শেষ হয়ে এলো। আমি একাকী সেই ঘরটিতে বোসে আছি, রূপসী এসে আমারে ডেকে গেল; বোলে গেল, রাঙামামী ডাকছেন।

রাঙামামী আমারে কেন ডাকেন? রাঙামামী আমারে দেখে লজ্জা করেন না, কোন কিছু, আবশ্যক হোলে আমারেই এনে দিতে বলেন, এই পর্যন্তই আমি জানি। দাসী দিয়ে তিনি আমারে ডেকে পাঠাবেন, এটা আমার জানা ছিল না। কি করি, চাকুরী সম্পর্ক না হোলেও এদের বাড়ীতে আমি আছি, আমার উপর কর্তার প্রভুত্ব চলে, ভাবতে গেলে এক রকম আমি চাকর। যেতে হলো।

ভিতরমহলে আমি প্রবেশ কোল্লেম। এইখানে আমারে একটু অনধিকারচর্চা কোত্তে স্বাধীনতা নিতে হলো। পূর্বে বোলে রেখেছি, রাঙামামী বিধবা, রাঙামামী পরমা সুন্দরী। এই দিন আমি যে ভাবে তাঁরে দেখলেম, তাতে আমার এক মহা সন্দেহ দাঁড়ালো। অলঙ্কার-বস্ত্রে সুশোভিতা, অলক্তকরা-গরঞ্জিতা, মণি-মণ্ডিত-কবরী-বিভূষিতা সেই রাঙামামী একটি নির্জন গৃহে একাকিনী। তাঁর দুটি চক্ষে জলধারা। এই সুন্দরীর রূপ বর্ণনা করা আমার অনধিকারচর্চা। বিধবা যদি বিধবার মত ব্রহ্মচারিণীরূপে অধিষ্ঠিতা থাকতেন, তা হোলে সে দিকে চেয়ে দেখতে মানুষের মন পুলকিত হতো, দুষ্টের নয়ন ঝলসে যেতো। এ মূর্তি সে মূর্তি নয়, গৌরবর্ণের উপর গোলাপী আভা, অধরোষ্ঠে গোলাপী আভা, কপোল, গালে গোলাপী আভা, বিশাল নয়নে বক্রদৃষ্টি। বক্ষঃস্থলে নীলবর্ণ কাঁচালী, সেই কাঁচুলীর অর্ধাংশ নীলবসনে ঢাকা। সম্মুখে গিয়ে আমি নত-নয়নে নত-বদনে দাঁড়ালেম। মৃদু হেসে মামী বোল্লেন, “বোসো হরিদাস, তুমি অমন ভয় পাচ্ছো কেন? তুমি না কি ভূতের ভয় পেয়েছ?”

আমি বোসলেম না, ভূতের ভয়ের কথাতেও কোন উত্তর দিলেম না। রাঙা-মামী আবার বোল্লেন, “রামদাস আমারে বোলে গেল, তুমি ভূতের ভয়ে কাতর আছ। ছি। ভূতকে কি ভয় করে? আমি তো মেয়েমানুষ, অন্য অনেক রকম ভয় আমার আছে, কিন্তু ভূতের ভয় আমি রাখি না। বাড়ীতে এক রকম শব্দ হয়। এত বড় বাড়ীখানা, কত লোক এ বাড়ীতে থাকতো, এখন গুটিকতক অস্থি-চর্মসার ক্ষুদ্র প্রাণী খেলা কোরে বেড়ায়, সমস্ত বাড়ীখানা ফাঁকা; তাতে কোরেই রেতের বেলা বাতাসের শব্দকেও যেন বড় বড় কামানের শব্দ মনে হয়। তাতে তুমি ভয় পেয়ো না : কোথায় কি শব্দ হোচ্ছে, জানবার জন্য বিছানা থেকে উঠো না, উঁকি মেরে দেখো না, হাঁকাহাঁকি কোরে গোলমাল কোরো না! দেখ ভাই—–(শ্রীবিষ্ণু!) দেখ হরিদাস, তোমার উপর আমি বড় সুখী আছি। আজ তুমি আমার একটি উপকার কর।”

“উপকার কর!”—এই কথাটি শুনে, আমি তখন মুখে উচু কোরে রাঙা-মামীর মুখখানি ভাল কোরে দর্শন কোল্লেম। একটু পূর্বে চোখে জল দেখেছিলেম, সে জল কোথায় উড়ে গিয়েছে, চন্দ্রমুখ হাসি হাসি। চন্দ্ৰমুখ বোল্লেম, কিছু অশিষ্টতা প্রকাশ পেলে, কিন্তু কবিরা ভগবতীর বদনকেও চন্দ্রবদন বোলে বর্ণনা করেন। আমি কবি নই, কিন্তু সুন্দরী কামিনীর সুন্দর বদনকেও চন্দ্রবদন বলাতে দোষ হোতে পারে না, এইরূপ আমার ধারণা। উত্তমরূপে তাঁর মুখখানি নিরীক্ষণ কোরে, ধীরে ধীরে আমি বোল্লেম, “উপকার? – আমার দ্বারা আপনার কি উপকার হোতে পারে?”

রাঙামামী উঠে দাঁড়ালেন; ঘরের পূর্বপ্রান্তে ক্ষুদ্র একটী তোরঙ্গ ছিল, সেইটী খুলে কি একটী পদার্থ হাতে কোরে নিয়ে আমার কাছে ফিরে এলেন। অন্য কোন প্রকার ভূমিকা না কোরেই সেই পদার্থটী আমার হাতে দিয়ে আমার পিঠ চাপড়ে চাপড়ে তিনি বোল্লেন, “তুমি বেশ ছোকরা, খুব বুদ্ধিমান, এই জিনিসটি নিয়ে গিয়ে অমুক জায়গায় অমুক ঠিকানায় অমুক বাড়ীর সেজোবাবুর হাতে দিয়ে এসো। বুঝতে পেরেছো ঠিকানাটি? সে দিন তোমরা যে রাস্তা ধোরে নদীর ধারে বেড়াতে গিয়েছিলে, যে দিকে আগুন লেগেছিলো, সেই দিকে—সেই বড় একটা আম গাছ,—সেই দিকে বাঁ-হাতী একখানা ছোটবাড়ী। বুঝতে পেরেছো? সেই বাড়ীর সেজোবাবুকে ডেকে চুপি চুপি এই মোড়কটী তাঁর হাতে দিয়ে এসো। এ মোড়কে ওষুধ আছে। সঙ্গোপনে দিও কেহ যেন দেখেনা কোন লোকের কাছে কোন কথা প্রকাশ কোরো না, আমাদের রামদাসকেও কিছু, বোলো না।”

মোড়কটী আমার হাতে থাকলো, ফিরিয়ে দিতে পাল্লেম না, ‘এ কাজ আমার নয়’ এ কথা বোলে মুখের উপর স্পষ্ট জবাব দিতে পাল্লেম না, কাজে কাজে মুষ্টিবদ্ধ কোরে মোড়কটী ঢেকে রেখে আমি বেরিয়ে এলেম। আপনার ঘরে এনে মোড়কখানি আমি ভাল কোরে দেখলেম। বর্তুলাকার এক খণ্ড কাগজ। উপরে কিছু লেখা ছিল না ওজনেও ভারী নয়, ভিতরে কোন প্রকার ওষুধ কিম্বা বস্তু থাকলে ভারী হতো, তা নয় তবে কি? মোড়ক করা, ধারে ধারে আঠা দিয়ে জোড়া ভাব কিছু বুঝতে পাল্লেম না; এনেছি, মৌনসঙ্কেতে দৌত্যকর্ম স্বীকার কোরেছি দিয়ে আসতে হবে, তাও স্থির কোল্লেম কিন্তু মনে কেমন খটকা লাগলো।

মনে কোরেছিলেম, রাত্রে ভূত দেখার কথা আছে, রাত জাগতে হবে, আজ আর বেড়াতে যাব না, কিন্তু রাঙামামীর দৌত্য কার্য্যে সে সঙ্কল্প অটল রাখতে পাল্লেম না, সন্ধ্যার পূর্বে কাপড় ছেড়ে সম্মুখ-রাস্তায় বাহির হোলেম। কেহই আমারে তখন দেখতে পেলে না। নদীর তীরে রাস্তাটা আমার জানা হয়েছিল, সরাসর সেই রাস্তায় গিয়ে সেই আম্রবৃক্ষের তলে আমি দাঁড়ালেম। হস্তে সেই বর্তুলাকার পত্রিকা। কি বোল্লেম?—পত্রিকা?—কে আমারে এমন কথা বলালে?— দেবতারা? —সত্যই তবে এখানি এক গুপ্তপত্রিকা। একজন সেজোবাবুর হাতে এই গুপ্তপত্রিকা অর্পণ কোত্তে হবে। বৃক্ষতলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছি, নিকটে একখানি বাড়ীও দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু ডাকি কি বোলে? বাড়ীর ভিতর প্রবেশ কোত্তেও ভরসা হোচ্ছে না; বাইরে দাঁড়িয়ে “সেজোবাবু সেজোবাবু” বোলে ডাকা, সেটাও ঠিক নয়। আমি নূতনলোক, ততটা স্বাধীনতা লওয়া আমার পক্ষে দোষের কথা। করা যায় কি? সূর্যদেব অস্তাচলে যাচ্ছেন আকাশের অনেকদূর পর্যন্ত রক্তবর্ণ হয়েছে, কুলায়বাসী পাখীরাও সব উড়ে উড়ে পালাচ্ছে, সন্ধ্যার বাতাসে নদীর জলে তরঙ্গ খেলছে, এমন সময় সেই বাড়ী থেকে একটী স্ত্রীলোক বেরুলো; এক কোলে একটা জলের কলসী, এক কোলে একটা ছেলে।

যেখানে আমি দাঁড়িয়ে ছিলেম, স্ত্রীলোকটা সেইখান দিয়ে চোলে যায়, অগ্রবর্তী হয়ে আমি তারে জিজ্ঞাসা কোল্লেম “তুমি কি এই বাড়ীতেই থাকো?”

একটু চমকিতভাবে চমকিতস্বরে স্ত্রীলোক আমারে জিজ্ঞাসা কোল্লে, “কেন গা? কে গা তুমি? কোথা থেকে এসেছো?”

এইবার আমি উত্তর কোল্লেম, “অনেক দূর থেকে এসেছি, দিনকতক এই গ্রামেই আছি, এখানে আমার একটু দরকার আছে।”

স্ত্রীলোক বোল্লে, “কার কাছে দরকার? কি দরকার?” —আমি উত্তর কোল্লেম, “যে বাড়ী থেকে তুমি আসছো, ঐ বাড়ীর সেজোবাবুর কাছে আমার দরকার।” স্ত্রীলোক আপন মনে বোলতে লাগলো, “আমাদের সেজোবাবুর কাছে কত লোকের যে কতরকম দরকার, তা আর বলবার নয়। রাতদিন দরকার;—রাতদিন দরকার! দরকার আর ফুরায় না!” আপন মনে ঐ সব কথা বোলে, আমার মুখের দিকে চেয়ে, সে স্ত্রীলোক একটু যেন রুক্ষস্বরে বোল্লে, “সন্ধ্যা হয়, এখন আবার তোমার কি দরকার?”

আমি বোল্লেম, “একবার সাক্ষাৎ করা দরকার। যদি তুমি একবার তাঁরে খবর দিতে পার, আমার বড় উপকার হয়।”

বিড় বিড় কোরে আপনা আপনি কত কি বোকতে বোকতে সেই রুক্ষভাষিণী স্ত্রীলোক কি যেন ভেবে চিন্তে বিরক্ত হয়ে বোল্লে, “আচ্ছা, দাঁড়াও, আমি জল নিয়ে আসি, অন্ধকার হয়ে এলো, এ সব জায়গায়— আচ্ছা, এইখানে তুমি একটু দাঁড়াও, ফিরে এসে তাঁরে আমি জানাবো, কি তিনি বলেন, আমার মুখেই শুনতে পাবে।”

আমি বুঝতে পাল্লেম, সেই স্ত্রীলোক সেই বাড়ীর চাকরাণী। বয়স কম, বাড়ীর মেয়ে হোলে আমার কাছে দাঁড়িয়ে অত কথা কইতো না। যাই হোক, কাজ নিয়ে আমার কথা, চাকরাণী কি রাজরাণী, তাতে আমার কোন প্রয়োজন ছিল না। আমি সোরে গিয়ে সেই বৃক্ষতলে দাঁড়ালেম। স্ত্রীলোকটী নদীর ঘাটে জল আনতে গেল। যখন সে ফিরে এলো, তখন আর আমার দিকে চাইলে না; হন্ হন্ কোরে বাড়ীর দিকেই চোল্লো। গাছতলা থেকে একটু উচ্চকণ্ঠে ডেকে ডেকে আমি তারে মনে কোরে দিলেম, “ভুলো না, আমি দাঁড়িয়ে থাকলেম।”

স্ত্রীলোক উত্তর দিল না, চোলে গেল, বাড়ীর ভিতর প্রবেশ কোল্লে। সূৰ্য দেব অস্তে গেলেন। আমার ভয় হতে লাগলো। ভূতের ভয় নয়, কত লোকের কুচক্রের শীকার আমি, নূতন জায়গায় নিৰ্জন পথে একাকী, যদি আবার রাহুচক্রে পড়ি, সেই ভয়।

দাঁড়িয়ে আছি, প্রায় অর্ধদণ্ড পরে একটী বাবু সেই বাড়ী থেকে বেরিয়ে এলেন। এসেই তফাৎ থেকে তিনি জিজ্ঞাসা কোত্তে লাগলেন, “কে গা? কে আমার তত্ত্ব কোচ্ছে?”—প্রশ্নের সঙ্গে সঙ্গে তিনি এগিয়ে আসতে লাগলেন, আমি সেই সময় তাঁর সম্মুখে গিয়ে দাঁড়ালেম। সূর্যদেব চোলে গিয়েছিলেন, অন্ধকার হয় নাই, বাবুটি আমার মুখের দিকে চেয়ে রইলেন, আমিও তাঁর মুখের দিকে চাইলেম। বেশ বাবুটী। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ, চোখ-দুটী বড় বড়, ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া বাবরী চুল, মাঝখানে সিঁতিকাটা। চুলের কেয়ারীতে কলিকাতার ধরণ অনেকটা জানা যায়। বোধ হলো এ বাবুটীর কলিকাতায় গতিবিধি আছে। কি জাতি, কি বৃত্তান্ত, জানা ছিল না, আমি নমস্কার কোল্লেম না; ধীরস্বরে জিজ্ঞাসা কোল্লেম, আপনি কি এই বাড়ীর সেজোবাবু?

একটু চিন্তা কোরে বাবুটী উত্তর কোল্লেন, “হাঁ, আমি তাই। কেন তুমি ও কথা জিজ্ঞাসা কর? কে তুমি?” রাঙামামীর দত্ত-মোড়কটী বাহির কোরে দেখিয়ে আমি বোল্লেম, “একটি ওষুধের মোড়ক আছে, আপনার হাতে দিবার আদেশ।”

“ওষুধের মোড়ক? আমার জন্য? তোমার তো ভুল হয় নাই?”

বাবার মুখের ঐ প্রকার কাটা কাটা প্রশ্ন শুনে আমি উত্তর কোল্লেম, “আজ্ঞে না, ভুল হয় নাই। যিনি আমার হাতে দিয়েছেন, তিনি আমারে সব ঠিকানার কথা বোলে দিয়েছেন, আমি ঠিক এসেছি। যিনি দিয়েছেন, তিনি একটী স্ত্রীলোক।

বাবু তখন পূর্বস্মৃতির প্রসন্নতা লাভ কোরে প্রফলবদনে বোল্লে, “ও— হো হো! বটে, বটে। একটী স্ত্রীলোক আমাকে একটী ঔষধ দিবেন স্বীকার কোরেছিলেন, মনে পোড়েছে!” সেজোবাবু, দক্ষিণ হস্ত বিস্তার কোল্লেন, আমি সেই মোড়কটী তাঁর হস্তে অর্পণ কোল্লেম।

আর আমার সেখানে অপেক্ষা করা উচিত ছিল কি না, ভাবছিলেম, আমার মুখের দিকে চেয়ে বাবু বোল্লেন, “যিনি তোমার হাতে এই ঔষধের মোড়ক দিয়েছেন, ফিরে গিয়ে তাঁরে তুমি কিছু বোলো না। মোড়কটী যখন তিনি তোমারে দেন, তখন কেহ দেখেছিল, এমন তোমার মনে হয়?”

কথা হলো দুটী, একটী নিবারণ, আর একটী প্রশ্ন। দুটী কথার উত্তরেই একটি “না” দিয়ে আমি বিদায় হোলেম; বাবু, আর আমারে কোন কথাই বোলেন না।

সন্ধ্যার পর বাড়ীতে আমি ফিরে এলেম। সন্ধ্যার পূর্বে আমি কোথায় ছিলেম, কেহই আমারে সে কথা জিজ্ঞাসা কোল্লে না; বোধ হয়, কেহই সে সময় আমার তত্ত্ব করে নাই; বড় একটা কৈফিয়তের দায় থেকে নিষ্কৃতি পেলেম। সন্ধ্যার পর নিত্য যেমন হয়ে থাকে, সেই রকমে সময় কাটলো, আহারের সময় রাঙামামী একটু তফাতে দাঁড়িয়ে আমার চক্ষের দিকে চাইলেন, আমিও সেই রকমে চেয়ে ঈষৎ মস্তকসঞ্চালনে সঙ্কেতে সঙ্কেতে তদুত্তর দিলেম। রাঙামামী বুঝলেন, দৌত্যকার্যে আমি কৃতকার্য।

আহারান্তে বাহিরের ঘরে আমি প্রবেশ কোল্লেম। রামদাস সেইখানে ছিল। অন্যদিন সে সময় কেহ থাকে না, রামদাস সে দিন কেন ছিল, একটু একটু আমি বুঝতে পাল্লেম। ভূত দেখাবার কথা। রামদাস আমার কাছে উপস্থিত থেকে ভুতের খেলা দেখাবে, তাই যেন আমার মনে হলো। রামদাস বোসে ছিল, আমারে দেখে উঠে দাঁড়ালো; চুপি চুপি বোলে, “ভূত যদি দেখতে পাও, গোলমাল কোরো না, কাহাকেও ডেকো না, চুপ্ কোরে শুয়ে থোকো, ভূতেরা তোমাকে কিছুই বোলবে না; যদি গোলমাল কর, হাঙ্গাম বেধে যাবে। শয়ন কর। দুই প্রহরের পূর্বে নিদ্রা যেয়ো না, আমার কথাগুলি মনে রেখো।”

বেশীদিন আমি আছি, তথাপি রাত্রে আমার শয়নঘরে চাবী পড়ে। আমারে সদুপদেশ দান কোরে, দ্বারে চাবী দিয়ে রামদাস চোলে গেল। আমি শয়ন কোল্লেম। ঘরে আলো থাকলো, দক্ষিণ-বারান্দার দ্বার-গবাক্ষ অনাবৃত।

রাত্রিকালে রূপসী আসে, যাবার সময় রূপসীই দ্বারে চাবী দিয়ে যায়, এ রাত্রে রামদাস; বোধ হয় উপদেবতার অধিবাস। নিত্য রজনীতেই আমি দুই প্রহর পর্যন্ত জাগি, এক একদিন বেশীও জাগি; সে রজনীতে সে অভ্যাসের ব্যতিক্রম হলো না; জেগেই থাকলেম। একটা কিছু নূতন উপলক্ষ্য পেলে রাত্রিজাগরণের কিছু সুবিধা হয়। নাচতামাসা, খোসগল্প, তাসপাশা নিশা- জাগরণের নির্দোষ সহায়। সে সব সহায় আমার ছিল না; চিন্তা আমার সখী, চিন্তার সঙ্গেই আমার খেলা।

চিন্তা এলো, রাঙামামী ঔষধ জানেন; একটী গোলাকার মোড়কে ঔষধ পূর্ণ কোরে একটী বাবুর কাছে তিনি পাঠালেন। মোড়কে কেবল কাগজ ছিল, পরীক্ষা কোরে তা আমি জানতে পেরেছি। কাগজ যদি ঔষধ হয়, তবে সে ঔষধ ঠিক্। কাগজে শিরোনাম ছিল না, পত্রিকা বোলে অবধারণ করা সুসাধ্য নয়। একজন পরপুরুষের কাছে একটি কুলবধূর পত্রিকা-প্রেরণ, কথাও কিছু ভাল নয়; তবে কেন তিনি পাঠালেন? পাছে কাহারো মনে এই সন্দেহের উদয় হয়, সেই সন্দেহভঞ্জনের উদ্দেশে নাম দেওয়া হয়েছে ঔষধ। উত্তম ঔষধ। বাস্তবিক কাণ্ডখানা কি, জানতে পারা গেল না। ভবিষ্যতে কোন সূত্রে যদি কিছু জানা যায় ঔষধের পরাক্রমে সেজোবাবু যদি রোগমুক্ত হন, পাঠকমহাশয় জানতে পারবেন।

রাত্রি দুই প্রহর অতীত। আমার নিদ্রা নাই। ভূতের সঙ্গেও সাক্ষাৎ নাই। রামদাস যে কথা বোলেছিল, সে কথা আমার মনে মনে জাগছিল, আমিও জাগছিলেম, কথাও জাগছিল, কিন্তু কিছুই না; নিত্য রাত্রে শব্দ হয়, সে রাত্রে শব্দ পর্যন্ত স্তব্ধ। আমার শিয়রের কাছে একটা খড়খড়ী, সে খড়খড়ীর পাখীগুলি আমি খুলে রেখেছিলেম। রাত্রি যখন প্রায় তৃতীয় প্রহর, সেই সময় আমার ঘরের ভিতর কেমন একরকম আলো এলো; ভাগ ভাগ করা আলো জ্যোৎস্নারজনী মনে কোল্লেম, চাঁদের আলো, কিন্তু তাও না, বারান্দার দিকে দ্বার গবাক্ষ সমস্তই উন্মুক্ত, খড়খড়ীর পাখীর ফাঁক দিয়ে বিছানায় যদি চাঁদের আলো আসে, অপরাপর দ্বার-পথ দিয়ে ঘরের ভিতর আলো আসাও সম্ভব। সে রকম কিছু দেখা গেল না, কেবল বিছানার উপর ভাগ ভাগ করা আলো। রংমশালের আলোর বর্ণ যেরূপ, সে আলোর সেইরূপ বর্ণ, এলো আর গেল; বিদ্যুতে আলো যেমন আসে আর যায়, ঠিক সেই প্রকার। এ তবে কি? এ তবে কি? এই বুঝি তবে ভূত? বিছানার উপর আমি উঠে বোসলেম, আমি অনেকক্ষণ বারান্দার দিকে চেয়ে থাকলেম, প্রকৃতি যেমন নিস্তব্ধ, ঠিক সেই ভাব, কৌমুদীর যেমন খেলা, ঠিক সেই ভাব। একবার যে আলো আমি দেখলেম, সে আলো আর এলো না, ঘরের ভিতর তো এলোই না, বাহিরেও জ্যোৎস্নার কোলে সেরূপ মিশ্রবর্ণের আলো দেখা গেল না। কোন লোক হয় তো আমার চক্ষে চমক লাগাবার জন্য রংমশাল জেলে আমার মাথার দিকে বারান্দা দিয়ে চোলে গিয়েছিল, আর ফিরে এলো না, তাই আমি মনে কোল্লেম; বৃথা বৃথা সমস্ত রজনী-জাগরণ; প্রায় ঊষাকালে নিদ্রা এসেছিল, প্রভাতেই নিদ্রাভঙ্গ। প্রভাতেই গৃহমধ্যে রামদাসের প্রবেশ। রামদাসের অধরে মৃদু মৃদ হাস্য।

শয্যার উপর উপবিষ্ট হয়ে রামদাসকে আমি জিজ্ঞাসা কোল্লেম, “এত প্রত্যূষেই তুমি শয্যা ত্যাগ কর?” রামদাসের উত্তর,— “নিত্য আমার এরপ অভ্যাস নয়, তুমি যদি কোন প্রকার বিভীষিকা দর্শন কোরে থাক, তোমার মন যদি চঞ্চল হয়ে থাকে, তাই মনে কোরে সারারাত আমি ঘুমাই নাই; কেমন আছ, শীঘ্র শীঘ্র দেখতে এসেছি। কোন রকম বিভীষিকা কি তুমি দর্শন কোরেছ?”

আমি উত্তর কোল্লেম, “প্রায় শেষ রাত্রে একটা রংমশালের আলো; আর কিছই নয়। রংমশালের আলোকে বিভীষিকা বলা—”

ঐটুকু শুনেই রামদাস বোলে উঠলো, “আলো দেখেই বুঝি তবে তুমি চক্ষু বুজে শুয়ে ছিলে আলোর পশ্চাতে পশ্চাতে কি এসেছিল, সেটা দেখতে বুঝি তোমার ভরসা হয় নাই? ঐ রকম হয়। আগে একটা ঐ রকম আলো আসে, তার পশ্চাতে পশ্চাতে— রাম!—রাম!—রাম!—প্রভুরা দেখা দেন! তুমি তাঁদের দেখ নাই, ভালই হয়েছে; ছেলেমানুষ তুমি, একাকী এই ঘরের ভিতর সে সব মূর্তি দেখলে দাঁতকপাটি লেগে মূর্ছা যেতে।”

হাস্য কোরে আমি বোল্লেম, “মূর্ছা গেলেই তোমাদের কর্তাটি এসে নেশা কোরে বেহুঁস হয়েছে বোলে ভূমিকা জুড়ে দিতেন! জান তো সে কথা? একটা তুচ্ছকথা নিয়ে তিনি আমারে এককালে পশুর অধম কোরে দিয়েছিলেন!”

“না— না— না” মস্তকের সহিত বারকতক হস্তসঞ্চালন কোরে রামদাস বোলে উঠলো “না— না— না,— অমন কথা বোলো না! কর্তা আমাদের আশুতোষ! কটুবাক্য তাঁর মুখে নাই, সকলকেই তিনি ভালবাসেন, সকল লোকেই তাঁর নাম গায়, তাঁকে তুমি দোষের ভাগী কোরো না। যারা এসেছিল, তারা সেই কথা বোলে গিয়েছে, তুমিও অজ্ঞান ছিলে, কাজে কাজেই—”

রাত্রিজাগরণের কষ্ট বিস্মৃত হয়ে রামদাসের দুখানি হাত ধোরে উত্তেজিতস্বরে আমি বোল্লেম, “কি বোল্লে, কি বোল্লে? যারা এসেছিল? কারা তারা রামদাস? যারা আমারে এখানে এনে রেখে গিয়েছে, তাদেরই কথা তুমি বোলছো, বেশ আমি বুঝতে পেরেছি। রামদাস! তারা কি রকম লোক? তাদের চেহারা কি রকম?”

অসাবধানে রামদাসের মুখ থেকে ঐ সত্যকথাটি বেরিয়ে পোড়েছিল, প্রভু যেটি অস্বীকার করেন, ভৃত্য সেইটি প্রকাশ কোরবে, কথা ভাল নয়, অপ্রস্তুত হয়ে রামদাস বোল্লে, “তারা— তারা— অন্ধকার— চেহারা—”

রামদাসের মনের ভাব আমি বুঝতে পাল্লেম, লোকটা অপ্রতিভ হয়ে গেল, বেশ দেখলেম। কর্তাও একদিন ঐরকম অপ্রতিভ হয়েছিলেন, সে কথাও আমার মনে হলো, আমি থেমে গেলেম। প্রসঙ্গটা ছেড়ে দিয়ে রামদাসকে আমি বোল্লেম, “তুমি আমার কাছে ঐ কথা প্রকাশ কোচ্ছিলে, কাহারও কাছে এ কথা আমি বোলবো না; উপদেবতা দর্শন কোরে আমি মুর্ছিত হব, এমন কখন তুমি ভেবো না। কোন রাত্রে যদি কিছু তুমি দেখতে পাও, আমারে ডেকে নিয়ে দেখিয়ে দিও, আমি গুলী কোরবো।”

“ও বাবা! কি বুকের পাটা! উপদেবতাকে গুলী করে!” আত্মগত বাক্যে সাতঙ্কে এই কথা বোলতে বোলতে রামদাস অতি দ্রুত সেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। আমি ভাবলেম, ভালই হলো। নবীনকালী বিষফলের সরবত খাইয়ে আমারে অজ্ঞান কোরেছিল, তার মালিকেরা সেই অবস্থায় আমারে কুমিল্লার এলাকায় ফেলে দিয়ে গিয়েছিল, প্রথমাবধি সেটা আমি বুঝে আসছি; এ বাড়ীর কর্তা অস্বীকার কোরেছিলেন, নিজের উক্তিতেই একদিন ধরা পোড়েছিলেন, রামদাসও সত্যকথা বোলতে বোলতে সামলে গেল। নবীনকালীর নায়কেরাই আমার এই দুর্দশার কারণ, তাতে আর অণুমাত্র সন্দেহ থাকছে না; কিন্তু এখানে তারা ক-জন এসেছিল, জানবার উপায় নাই; এখন নাই, কিন্তু সব তত্ত্ব যখন প্রকাশ হবে, তখন আর কোন তত্ত্বই গুপ্ত থাকবে না।

এইগুলি আমার নির্জন ভাবনা। রাঙামামীর ঔষধ-প্রেরণের ভাবনা অপেক্ষাও এই ভাবনাই আমার চিত্তচাঞ্চল্যের পক্ষে অধিক প্রবল।

আর তিনটি দিবারাত্রি সমভাবে আমি কাটালেম। বাবু জয়শঙ্কর চৌধুরী সপরিবারে গয়াধামে যাত্রা কোল্লেন। সপরিবার অর্থে তিনি আর তাঁর সহধর্মিণী। ভূতের উপদ্রবে সংসারে অমঙ্গল হয়, সংসারের লোকেরাই অকাল-মরণে ভূতত্ব-প্রাপ্ত, গ্রামবাসী লোকেরাও মারীভয়ে গতানু হয়ে ভূতত্ব-প্রাপ্ত, গ্রামস্থ সমস্ত লোকের এই বিশ্বাস। গ্রামের কর্তা জয়শঙ্করবাবু। তিনি সস্ত্রীক গয়াতীর্থে গদাধরের পাদপদ্মে পিণ্ডদান কোল্লে সমস্ত ভূত উদ্ধার হয়ে যাবে, এটিও সে গ্রামের সর্ববাদিসম্মত।

কর্তাবাবু গয়ায় গেলেন। বড়বাবু ছোটবাবু প্রায় সর্বক্ষণ আমার কাছে বোসে গল্প করেন, আমার পূর্ববৃত্তান্ত জিজ্ঞাসা করেন, আমার দুঃখে দুঃখ প্রকাশ করেন, আমি তবু তাঁদের কাছে জীবনের বেশী কথা ভাঙি না। রামদাস যখনি আসে, তখনি ভূতের কথা কয়। দশদিন পরে ভূতের দফা গয়া হয়ে যাবে, পিণ্ড পেলেই ভূতেরা সব পালাবে, এই কথাই রামদাস বার বার আমারে শোনায়। রূপসী, পাচিকা, রাঙামামী এই তিন জনেও বড় বড় ভূতের গল্প করে।

দশদিন পরে ভূত থাকবে না, রামদাসের এই কথা। এ দশদিন মানে, অনেক দিন। তখন বাষ্পশকট ছিল না। ত্রিপুরাজেলা থেকে গয়াধামে যাত্রা, অধিক লোকের নামে পিণ্ডদান, কতক দিন তথায় অবস্থান, তৎপরে প্রত্যাগমন, অনেক দিনের কার্য।

দিন দিন এ বাড়াতে ভূতের উৎপাত বেশী হোতে লাগলো। “আমি কিছুই দেখতে পাই না, কেবল শুনতে পাই। আহা! ভূতগুলির লীলা-খেলা চিরকালের মত ফুরিয়ে যাবে, এই দুঃখে আমার বড় কষ্ট হয়।

পাঠকমহাশয় বোধ হয় ধৈর্যহারা হোচ্ছেন; একাদিক্রমে বহুক্ষণ এক বিষয়ের নানা কথা শুনে শুনে বোধ হয় বিরক্তিও জন্মাচ্ছে। নিজে আমি যে বিষয়টা মিথ্যা বোলে বুঝতে পাচ্ছি, সে বিষয়ে এত আড়ম্বর কি কারণে, এটাও বোধ হয়, অনেকের মনে উদয় হোচ্ছে। আমার নিবেদন, আর কিয়ৎক্ষণ ধৈর্য ধারণ করুন; উদ্দেশ্য অবশ্যই আছে; সেই উদ্দেশ্যটি প্রকাশ হোলে বিফল বর্ণনা বোলে বোধ হবে না।

কর্তা গয়াধামে। দুই তিন দিন অতীত। রাত্রিকালে নিত্য যেমন আমি শয়ন কোরে থাকি, সেই রকমে শয়ন কোরে আছি, ঘরের দরজায় দস্তূরমত চাবী বন্ধ আছে, গৃহদীপ নির্বাপিত, দক্ষিণদিকের দ্বার-গবাক্ষ অনাবৃত। রাত্রি কত, ঠিক জানতে পারি নাই; স্মরণ হোচ্ছে, কৃষ্ণপক্ষের সপ্তমী কিম্বা অষ্টমী, তখনো অন্ধকার, একটু পরেই চন্দ্রোদয় হবে, এইরূপ আমি মনে কোচ্ছি। ছাদের উপর নিত্য যেরূপ শব্দ হয়, নৃত্য হয়, হাস্য হয়, এ রাত্রে তখনো পর্যন্ত সেরূপ কোন লক্ষণ জানা গেল না।

আমার নিদ্রা নাই। উপাধানের উপর মুখে রেখে, শিয়রের খড়খড়ীপথে আমি চেয়ে আছি, বোধ হলো যেন, ফর্শা কাপড়পরা দুই মূর্তি সাঁ কোরে বারান্দা দিয়ে ছুটে গেল। মনের খেয়ালের সঙ্গে নয়নের ভ্রম হয়; আমার বোধ হয় তাই। লোকের মুখে শুনেছিলেম ভূত, মনে মনে ভাবছিলেম ভূত, রাত্রিও অন্ধকার ছিল, কোথাও কিছু নাই, যুগলমূর্তি ছুটে গেল, মনের কল্পনায় সে হয় তো আমার দৃষ্টিভ্রম। যারা ছটে গেল, আর তারা ফিরে এলো না; দৃষ্টির ভ্রমটাই যেন ঠিক দাঁড়ালো। যুগল হস্তে যুগল নয়ন মার্জন কোল্লেম। যে অন্ধকার, সেই অন্ধকার;— ঘরে বাহিরে সমান অন্ধকার। চন্দ্রমা তখনো অদৃশ্য।

বারান্দাতে ঘন ঘন গম গম শব্দ। ইতিপূর্বে যে দুই মূর্তি দেখেছিলেম,— দেখেছিলেম বোলে জ্ঞান হয়েছিল, সে রকম মূর্তি কিছু দেখা গেল না, কেবল শব্দ। একবার শুনলেম, দুই তিন কণ্ঠমিলিত অস্ফূট হাস্য; বারান্দার দ্বার উন্মুক্ত ছিল, মনে কোল্লে উঠে দেখতে পাত্তেম, কেহ কোথাও আছে কি না,— যারা আমারে সাবধান করে, তারা বলে, “শব্দ শুনে উঠো না, তত্ত্ব জানবার চেষ্টা কোরো না।” সেই কথা মনে কোরে বিছানা থেকে আমি উঠলেম না, শব্দও থামলো না, ঠিক আমার মাথার কাছে শব্দ; এক একবার একটু দূরে যায়, আবার সেইখানে ফিরে আসে; শব্দেরই চলাচল, পদার্থ দৃষ্ট হয় না। ঠিক আমি চেয়ে আছি, দৃষ্টির ভ্রম হোচ্ছে না মনে ভয়ও আসছে না, তত্ত্ব জানবার ইচ্ছাও হোচ্ছে না।

প্রায় এক ঘণ্টা এই ভাব। আকাশে চন্দ্রোদয়। চন্দ্রালোকে বাহিরের পদার্থগুলি আমার নয়নগোচর হোতে লাগলো, শব্দগুলাও শ্রবণগোচর হোতে লাগলো, সংশয়ে বিস্ময়ে আমি জড়ীভূত।

কট্ কট্ কোরে চাবী খোলার শব্দ হলো। একজন লোক গৃহমধ্যে প্রবেশ কোল্লে। এই কি ভূত? চাবী খুলে ভূত আসবে কেন? ভূতেরা অগ্নি স্পর্শ করে না, লৌহ স্পর্শ করে না, এরূপ প্রবাদ। চাবী খুলে ভূত আসা অসম্ভব। তবে কি?—কে প্রবেশ কোল্লে? চাঁদের আলো ঘরের ভিতর আসে নাই, প্রবেশকারী ধীরে ধীরে আমার শয্যাপাশে এসে নিকটে একটু হেঁট হয়ে, চুপি চাপি বোল্লে, “জেগে আছ?”

চক্ষু আমার গবাক্ষের দিকে ছিল, প্রশ্ন শুনে চোমকে উঠে পাশের দিকে চেয়ে দেখলেম, একটি মনুষ্য। স্বর শুনেও বুঝেছিলেন, অল্প অল্প চেহারা দেখেও বুঝলেম রামদাস। বিছানার উপর আমি উঠে বোসলেম; ডেকে ডেকে জিজ্ঞাসা কোল্লেম, “এত রাত্রে এখানে তুমি কি চাও রামদাস?”

রামদাস চাপি ছাপি বোল্লে, “তোমাকেই চাই। উঠ। যে সব কথা তোমাকে আমরা বলি, তাতে তুমি বিশ্বাস কর না, শব্দ হয় শুনতে পাও, অলৌকিক শব্দ মনে কর; সত্য বটে অলৌকিক, কিন্তু কিছু বিশেষ আছে। উঠে এসো; দেখবে এসো।”

বিছানা থেকে আমি নামলেন। রামদাস বোলে, “চলো।” মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় দ্বারের দিকে দুই তিন পদ আমি অগ্রসর হোলেম। রামদাস বোল্লে, “ওদিকে নয়।” রামদাসের দিকে মুখ ফিরিয়ে আমি দাঁড়ালেম। দক্ষিণের বারান্দার দিকে অগ্রসর হোতে হোতে পূর্ববৎ চুপি চুপি রামদাস বোল্লে, “সঙ্গে এসো— নিঃশব্দে, কথা কোয়ো না।”

নিঃশব্দে রামদাসের সঙ্গে সঙ্গে আমি বারান্দায় উপস্থিত হোলেম। পশ্চিমদিকে অঙ্গুলি নির্দেশ কোরে আমার কাণের কাছে রামদাস চুপি চুপি বোল্লে, “ঐ দেখ!”

স্বরকম্পনে আমি বুঝতে পাল্লেম, আতঙ্ক-মিশ্রিত কণ্ঠস্বর। রামদাস যেন কোন প্রকার ভয় পেয়ে সেই ভয়ের বস্তু আমাকে দেখাবার জন্য সমুৎসুক; আমারে বোল্পে, “ঐ দেখ!” নিজে কিন্তু পশ্চিমদিকে চাইলে না, পূর্বদিকে মুখ ফিরিয়ে থাকলো।

চন্দ্রদেব তখন আমাদের মশালচির কাজ কোল্লেন। পশ্চিমদিকে আমি চাইলেম। পাঠকমহাশয়ের স্মরণ আছে, সম্মুখ-বারান্দার অর্ধাংশ ভগ্ন, সেই ভগ্নাংশের সর্বশেষে একটা ভগ্নগৃহ, সেই গৃহের সম্মুখভাগে প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড গোটাকতক মুণ্ড, এত প্রকাণ্ড যে, এতেদ্দেশে ঢাকাই জালার যেরূপ প্রসিদ্ধি, সেই প্রসিদ্ধির অনুগত জালার আকারে ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর মুণ্ড। দুর্গার পদতলের পশুরাজ সিংহের যে প্রকার বর্ণ, মুণ্ডগুলোর বর্ণ সেই প্রকার। নাসিকাও সিংহনাসা সদৃশ। সুন্দরবন অঞ্চলে বনদেবতার পূজায় কালুরায় দক্ষিণরায় নামে বুনোরা যেরূপ বিগ্রহ গঠন করে, সেই সকল বিগ্রহের চক্ষের ন্যায় ভয়ানক ভয়ানক বড় বড় চক্ষু। বন্যবরাহের মূলদন্ত যে প্রকার, সেই সকল মুণ্ডের দন্তপাতি তদ্রূপ বৃহৎ বৃহৎ। সিংহের জটার ন্যায় পিঙ্গলবর্ণ কেশর বৃহৎ বৃহৎ কর্ণের উভয় পার্শ্বে বিলম্বিত। দূর থেকে দর্শন কোল্লে বাস্তবিক অন্তরে দারণ ভয়ের সঞ্চার হয়। মুণ্ডগুলো সারি সারি সংস্থাপিত।

সেই সকল বিকট মুণ্ড আমি দর্শন কোল্লেম, মনে কোল্লেম, তামাসাস্থলে যারা সং দেখায় তারাই হয় তো অবোধ মানুষকে ভয় দেখাবার জন্য ঐ সব মুণ্ড ঐ ভাবে সাজিয়ে রেখেছে। আমি মনে কোল্লেম ঐ রকম, রামদাস কিন্তু ঘন ঘন কাঁপতে লাগলো, কাঁপতে কাঁপতে বোলে, “আর নয়, আর নয়, আর এখানে থাকা নয়, আমাদের দেখতে পেলেই লাফ দিয়ে ঘাড়ে পোড়ে—”

রামাদাস ছুটে পালায়, আমি তার একখানা হাত ধোরে ফেল্লেম; অভয় দিয়ে বোল্লেম, “যা তুমি মনে কোচ্ছো, যা তোমরা মনে কর, বাস্তবিক তা নয়। তুমি এত ভয় পাচ্ছো কেন? আমি নিশ্চয় বুঝতে পাচ্ছি, দুষ্টমানুষের ঐ সব খেলা। কোন প্রকার মতলবে দুষ্টেরা ঐ রকম বিভীষিকা দেখায়, সেই চেষ্টাতেই তাদের অভীষ্ট সিদ্ধ হয়। তুমি দাঁড়াও, আমি আরও একটু ভাল কোরে দেখি।”

আমার হাত ছাড়াবার জন্য ধস্তাধস্তি কোত্তে কোত্তে হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে রামদাস বোল্লে, “রাম! রাম! রাম! কুলক্ষণ! বড় কুলক্ষণ! আজকের জন্যই আমি ছিলেম! ভূতের হাতে প্রাণ গেল! তুমি আমাকে ছেড়ে দাও।”

আমার অপেক্ষা রামদাসের বয়স অনেক বেশী, আমার অপেক্ষা রামদাস কিন্তু দুর্বল; টানাটানি কোরেও রামদাস আমার হাত ছাড়াতে পাল্লে না। পুনর্বার হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে বোলতে লাগলো, “তুমি ছেলেমান, কখন ওসব দেখ নাই, সেই জন্যই তোমার অত সাহস! বড় কুলক্ষণ! অমাবস্যার রাত্রে মেঘাড়ম্বর থাকলে, ঐ সব ভয়ানক-মূর্তি দেখা দেয়। জ্যোৎস্না-রাত্রে কখনো আমরা দেখি নাই, না জানি, কপালে আজ কি আছে! তুমি আমাকে ছেড়ে দাও! তুমিও এখান থেকে পালাও! কপালে—”

আরো জোরে রামদাসের হস্ত ধারণ কোরে আমি তখন বোল্লেম, “কপালে কি আছে, তা আমি বুঝতে পাচ্ছি। তোমার কপালে কি আমার কপালে কিংবা ঐ সকল মুণ্ডর কপালে, কার কপালে কি ঘটে, তাই আজ আমি দেখবো, তোমার বন্দুক আছে?”

চোমকে উঠে, শঙ্কিতনয়নে আমার মুখপানে চেয়ে রামদাস বোলে উঠলো, “বন্দুক? বন্দুক নিয়ে তুমি কি কোরবে?”—মৃদুস্বরে আমি বোল্লেম, “থাকে যদি, একটি আমারে তুমি এনে দাও। গুলী, বারুদ, সরঞ্জাম, সব যেন ঠিক থাকে। বন্দুক দিয়ে উপদেবতার পূজা কোত্তে হয়; সে পূজা তোমরা জান না, সেই জন্যই ভয় পাও; দেবতারাও সেই জন্য ভয় দেখান। আছে তোমার বন্দুক?”

অল্পক্ষণ কি চিন্তা কোরে রামদাস বোল্লে, “আমার নাই, তুমি আসবার আগে এই বাড়ীতে দরোয়ান ছিল, সেই দারোয়ানের এক জোড়া গুলীভরা বন্দুক আমার ঘরে আছে; পূজা কোল্লে যদি ভাল হয়, একটা আমি এনে দিতে পারি।”

“শীঘ্র এনে দাও। পূজা কোল্লে অবশ্যই ভাল হবে। এত ভাল হবে যে, সমস্ত উপদেবতা মুক্তিলাভ কোরে এই রাত্রেই স্বর্গধামে চোলে যাবে! এ কথা যদি আগে তুমি আমারে বোলতে কিম্বা আগে যদি ঐ সকল মূর্তি আমারে তুমি দেখাতে পাত্তে, তা হোলে আর কর্তাকে গয়ায় যেতে হোতো না; ঘরে বোসেই আমি নূতন প্রকার পিণ্ডদান কোরে দেবতাগুলিকে উদ্ধার কোরে দিতেম। দেখ না, এই রাত্রে তাই হবে। দাও তুমি, বন্দুক একটা আমাকে এনে দাও। কর্তা ফিরে আসতে না আসতে ভূতগুলি সব উদ্ধার হয়ে যাবে। দাও তুমি, দারোয়ানের সেই বন্দুক একটি আমাকে এনে দাও।”

এই সব কথা বোলে রামদাসের হাতখানা আমি ছেড়ে দিলেম। আমার শয়নঘরের ভিতর দিয়ে ছুটে গিয়ে, রামদাস অবিলম্বে একটি দুনলি বন্দুক এনে আমার হাতে দিলে; দিয়েই আমার সন্দিগ্ধস্বরে বোল্লে, “পূজা হবে, ফুল-চন্দন দরকার হবে না?”

অন্তরে হাস্য কোরে আমি উত্তর দিলেম, “মন্ত্র পাঠ কোল্লেই বন্দুকর গর্ভস্থ উপকরণগুলি ফুল চন্দনের আকার ধারণ করে। পূজা দর্শন কোরে তোমরা এককালে মোহিত হয়ে যাবে।” পূর্বে রামদাসের যতটা কম্প ছিল, আমার পূজার ফলশ্রুতি শ্রবণ কোরে আর তার ততটা কম্প থাকলো না। তারে একটু পশ্চাতে সোরিয়ে রেখে, বন্দুক হস্তে আমি সম্মুখে দাঁড়ালেম। আমার দৃষ্টি সেই সকল মুণ্ডর দিকে। লক্ষ্য একটা প্রকাণ্ড মুণ্ড। বন্দুকটি ভাল কোরে বাগিয়ে ধোরে অতি সাবধানে আমি আওয়াজ কোল্লেম। অব্যবহিত পরেই সেই দিক থেকে ঘেউ ঘেউ ভেউ ভেউ রব সমুত্থিত হলো, একটা মুণ্ড সেইখানে পোড়ে থাকলো, ছড়িভঙ্গ হয়ে সমস্ত মুণ্ড অদৃশ্য! বারুদের ধোঁয়ায় সে দিকটা আচ্ছন্ন।

রামদাসের মুখে আর বাক্য নাই। বাড়ীর ভিতর থেকে বড়বাবু ছোটবাবু সেই সময় তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এলেন; স্ত্রীলোকেরাও অন্যদিক থেকে উঁকি মেরে আতঙ্ক প্রকাশ কোত্তে লাগলেন : “কি হলো, কি হলো” বোলতে বোলতে রাঙামামীও ছাদের উপর থেকে চীৎকার কোত্তে থাকলেন।

আমি বুঝতে পাল্লেম, যা হবার তাই হলো; রামদাসকে বোল্লেম, “যে দিকে তোমাদের উপদেবতারা মায়া বিস্তার কোচ্ছিলেন, সেই দিকে আমারে তুমি একবার নিয়ে চল।” রামদাস নিরুত্তর। বাবুরা আমারে বার বার নিষেধ কোল্লেন, সে দিকে যাবার পথ নাই, এই কথা বোলে, আমারে নিরস্ত করবার চেষ্টা পেলেন। তাঁদের নিষেধ আমি শুনলেম না। একনলে আওয়াজ হয়েছিল, দ্বিতীয় নল তখন পরিপূর্ণ; বন্দুকটি উপর দিকে তুলে, উপরদিকে চেয়ে তাঁদের সকলকে আমি বোল্লেম, “ভগবান রক্ষাকর্তা, উপদেবতার উপরে সর্বময় দেবতার সম্পূর্ণ কর্তৃত্ব। উপদেবতাগুলি কোথায় গেল, একবার আমি দেখে আসি।”

যে দিকে সেই সব মণ্ডু ছিল, সেই দিকে অনবরত কুক্করমণ্ডলীর বিভীষণ চীৎকার। বড়বাবু বোল্লেন, “কর্ম” তুমি ভাল কর নাই, উপদেবতার মায়া! মায়াবী দেবতারা কুক্কুরের মত কলরব কোরে আমাদের সংসারকে দেখাচ্ছেন! অবিশ্রান্ত ঘেউ ঘেউ রব। একে উপদেবতা, তাহার উপর তুমি তাঁদের ক্রোধ উৎপাদনের হেতু হয়েছ! আমাদের আর রক্ষা নাই! ওদিকে তুমি যেয়ো না। একান্তই যদি যাবার ইচ্ছা হয়, রাত্রি প্রভাত হোক, প্রভাতে যা ইচ্ছা, তাই তুমি কোরো।”

রামদাস এই সময় বাবুদের কাছে আমার নামে নালিশ কোল্লে। আমি তার কাছে বন্দুক চেয়ে নিয়েছি, ভূতের মস্তকে আঘাত কোরেছি, ভূতগুলিকে রাগিয়ে দিয়েছি, এই তিন অভিযোগ। বড়বাবু আমারে বিস্তর ভর্ৎসনা কোল্লেন। কিছুতেই আমি সঙ্কল্প ত্যাগ কোল্লেম না। আমাদের পরস্পর কথা কাটাকাটি হোচ্ছে, সেই সময় নীচের সিঁড়ি দিয়ে গম গম শব্দে একটি নতূন বাবুলোক সেই বারান্দায় এসে উপস্থিত হোলেন। বাহিরের লোক। সদর দরজা যেন খোলা ছিল, বাহির থেকেই যেন তিনি এলেন, এইরূপ সকলে বিবেচনা কোল্লে। আমাদেরও তাই ভাবতে হলো। বাবুটিকে আমি দেখলেম। সম্পূর্ণ মুখমণ্ডল দৃষ্টিগোচর হলো না। মাথায় এক পাগড়ী। পাগড়ীর উপর দিয়ে কণ্ঠদেশ পর্যন্ত লম্বা একখানা সবুজ রুমালের পটি বাঁধা। কর্ণ, কপাল, ললাট, সমস্তই ঢাকা; কেবল নাকটি আর চক্ষুদুটি জাগছিল। চিনতে পারা অসম্ভব; কিন্তু চক্ষুঃ দর্শন কোরে আমি এক রকম অনুমান কোল্লেম। আমি কথা কোইলেম না। যিনি এলেন, তিনিও কোন কথা বোল্লেন না। আমার সঙ্কল্প উপদেবতার উপনিবেশনান্তর দর্শন করা। আমার নির্বন্ধতাতিশয্য দর্শন কোরে কেহই আর তখন বাধা দিলেন না, আমি তখন সঙ্গী পেলেম রামদাসকে আর ছোটবাবুকে। উপরেই বারান্দা, উপরেই সেই ভগ্নগৃহ; মধ্যস্থল সংযোগশূন্য। উপর দিয়ে সেই ভগ্নগৃহে গমন করবার উপায় ছিল না। তিনজনে আমরা উপর থেকে নেমে এলেম। রামদাস পূর্বে আমারে বোলেছিল, কোন প্রয়োজন উপস্থিত হোলে, বাঁশের সিঁড়ির সাহায্যে সেই ভগ্নগৃহে আরোহণ কোত্তে হয়। নির্দিষ্ট স্থলে আমরা উপস্থিত হোলেম। ফুট জ্যোৎস্না, বেশ দেখা গেল, দীর্ঘ একটা বাঁশের সিঁড়ি সেই স্থানে আড়ে আড়ে সংরক্ষিত আছে। রামদাস বোল্লে, “এই সিঁড়ি; এরূপ সিঁড়িতে উঠা নামা তোমার অভ্যাস আছে?” আমি উত্তর কোল্লেম, “অভ্যাসের কথা কেন বল : — আবশ্যক হোলে অনভ্যাসকেও অভ্যাসের মধ্যে গণনা কোরে নিতে হয়।”

ছোটবাবুর আদেশে রামদাস সেই সিঁড়িখানা খাড়া কোরে তুল্লে। আমরা উঠতে আরম্ভ কোল্লেম। অগ্রে ছোটবাবু, মধ্যে আমি, পশ্চাতে রামাদাস। আমার বাম হস্তে বন্দুক; দক্ষিণহস্তে সিঁড়ির বাঁশ ধোরে ধোরে ধীরে ধীরে আমি আরোহণ কোল্লেম। উপর্যুপরি ঘেউ ঘেউ রব। বিরামের অবসরে এক একবার শুনা গেল, কেঁউ, কেঁউ, কেঁউ, কেঁউ!

কুকুর নিশ্চয়। মানুষ ভূতের বদলে কুকুর ভূত, এটাও একটি আশ্চর্য ব্যাপার বটে। কোনটা আশ্চর্য, কোনটা আশ্চর্য নয় অগ্রে আমি স্থির কোত্তে পাল্লেম না। নিত্য রজনীতে ছাদের উপর যে রকম শব্দ হয়, কুকুরে সে রকম শব্দ কোত্তে পারে না। হাস্য, নৃত্য, হুহুঁঙ্কার, লম্ফনের গুপ গাপ শব্দ, সে সব কাণ্ড কুকুরের নয়। মানুষভূত আর কুকুরভূত দুই দল যদি থাকে, পরীক্ষা করা যাবে।

আমরা আরোহণ কোল্লেম। ঘেউ ঘেউ রব কোত্তে কোত্তে সেই সকল প্রকাণ্ড মুণ্ড ছুটে ছুটে বেড়াতে লাগলো। চতুষ্পদ জন্তুর যে রকম গতি, মুণ্ডেরও সেইরূপে গতি; মণ্ডের ভিতর কুকুর আছে, বেশ বুঝতে পারা গেল। আর আমার বন্দুকের আওয়াজ করবার আবশ্যক হলো না। রাগী কুকুরেরা সম্মুখের মানুষকে দংশন করে, যে সকল কুকুর আমাদের সম্মুখে, তাদের মুখে মোটা মোটা আবরণ ছিল, সেই সকল আবরণ নরমুণ্ড অথবা সিংহমুণ্ড সদৃশ, সে আবরণ ভেদ কোরে মানুষকে দংশন করা সেই সকল কুকুরের পক্ষে দুঃসাধ্য ছিল। দুঃসাধ্য না বোলে অসাধ্য বলাই ঠিক। সুতরাং কুক্কুরদংশনের আতঙ্ক আমাদের থাকলো না, সে অংশে আমরা নিঃশঙ্ক।

যে দিকে কেঁউ কেঁউ রব হোচ্ছিল, বন্দুক হতে দ্রুতগতি সেই দিকে আমি অগ্রসর হোলেম; দেখলেম, একটা কুক্কর রক্তাক্ত-কলেবরে ভূমিশায়ী। তার মুখের আবরণমুণ্ড আমার বন্দুকের গুলীতে বিদীর্ণ। সেই কৃত্রিম মুণ্ডটা ভেদ কোরে কুক্কুরের কণ্ঠদেশে গুলী লেগেছে, অনবরত রক্তধারা প্রবাহিত হোচ্ছে, মৃত্যু আসন্ন। থেকে থেকে এক একবার মৃত্যুযন্ত্রণায় কেঁউ কেঁউ রব।

দেখে আমার বড় দয়া হলো, কষ্টও হলো। ছোটবাবুকে ডেকে সেই কষ্টকর দৃশ্য আমি দেখালেম। তেমন কৰ্ম্ম কখন আমি করি নাই, বিনা দোষে নিরীহ প্রাণীর প্রাণ বিনাশ করা আমার আন্তরিক ইচ্ছার সম্পূর্ণ বিরোধী। ছোটবাবুকে বোল্লেম, একপ্রকার কুহকে পোড়ে এই কার্য আমাকে কোত্তে হয়েছে। সকলেই বলে ভূত; শব্দ শুনেও মনে হয়, কোন প্রকার ভৌতিক কার্য। আজ রাত্রে সেই মুণ্ডগুলো দর্শন কোরে তথ্য জানবার নিমিত্ত আমার আগ্রহ জন্মেছিল, তাতেই বিনা দোষে এই অবলা জন্তুটি আমি বিনাশ কোরেছি। এখন আপনি সন্ধান করুন, এ কার্য কার? কোন ব্যক্তি এইসকল কুকুরের মুখে ভয়ানক ভয়ানক কাষ্ঠের মুখোস সংযুক্ত কোরে ঐ ভাবে সাজিয়ে রেখেছে। বনের কুকুর নয়, পোষা কুকুর, সন্দেহ নাই। কুকুরকে যেমন যেমন শিক্ষা দেওয়া যায়, কুকুরেরা তাই শিক্ষা করে। কুকুরেরা প্রতিপালকের একান্ত বশীভূত হয়। আপনি সন্ধান করুন, কোন ধূর্ত মায়াবী লোক এই সকল কুকুরের প্রতিপালক।”

ছোটবাবু তখন আমার কথায় মনোযোগ দিলেন না: রামদাসকে বোল্লেন, “সব বুজরুকী বুঝতে পারা যাচ্ছে। এক এক কোরে এই কুকুরগুলিকে তুমি নামিয়ে নিয়ে চল। কার কি মতলব, এই সকল কুকুর কার কাছে ছুটে যায়, সেই ক্রিয়া দেখলে অভিসন্ধি নিরূপণ করা যাবে।”

রামদাস তৎক্ষণাৎ আজ্ঞাপালন কোল্লে। কুকুরগুলি বেশ শান্ত, বিশেষতঃ পোষা কুকুর, রামদাসের কোলে বেশ স্থির হয়ে থাকলো। রামদাস একে একে সকলগুলিকেই নামিয়ে নিয়ে গেল। যে কুকুরটিকে আমি অগ্রে গুলী কোরেছিলেম, সেটি বাঁচলো না। বাকীগুলি আমার শয়নঘরের বারান্দায় প্রেরিত হলো। কুকুরের মুখোসগুলো সেই ভগ্নগৃহে পোড়ে থাকলো। কাঠের মুখোস; সাদা রং মাখিয়ে ভীষণ আকারে চিত্র করা। লোকে দেখলেই রাত্রিকালে ভূতের মুখ বোলে ভয় পাবে, কোন লোকের পরামর্শে চিত্রকরের সেইরূপ নৈপূণ্যের পরিচয়।

রামদাসের কার্য সমাপ্ত হবার পর আমরা উভয়ে সেই বাঁশের সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে এলেম; আমি আর ছোটবাবু।

যে ঘরে আমি শয়ন করি, সেই ঘরের ভিতরে বাহিরে অনেকগুলি লোক। ভিতরের দিকের বারান্দায় স্ত্রীলোক : ঘরের ভিতর আর বাহিরের বারান্দায় পরুষ। সকলে সেই বাড়ীর লোক নয়, প্রতিবাসী লোকেরাও অনেকে সেই শেষরাত্রে সেইখানে এসে জমা হয়েছেন। আমরা গিয়ে সেইখানে ছোট-খাটো সমারোহ দেখলেম। এ সকল লোক খবর পেয়েছিল কিরূপে? বাড়ীতে তাদৃশ গোলমাল হয় নাই, কেহ চীৎকার করে নাই, কেহ কাহাকেও ডাকে নাই, কেহ কাহাকেও খবর দিতে যায় নাই, তবে কিরূপে এ স্থানে এত লোক একত্রিত হলো? এ প্রশ্নের উত্তর আমি স্বয়ং। ভূতের মুণ্ড লক্ষ্য কোরে আমি গুলী কোরেছিলেম, বন্দুকের আওয়াজ অনেকদূর গিয়েছিল, লোক জমায়েতের কারণ সেই আওয়াজ।

বাড়ী যখন গুলজার ছিল, বাড়ীর অধিকারীরা যখন শ্রীমন্ত ছিলেন, তখন এই বাড়ীর নাম ছিল, “বাবুদের বাড়ী।” এখন ভগ্নাবস্থা, সকলদিকেই ভগ্নদশা, তথাপি নাম আছে, বাবুদের বাড়ী। যতদিন সেই জায়গায় দুই একখানা ইষ্টক, দুই একখানা কাষ্ঠ বিদ্যমান থাকবে, ততদিন নাম থাকবে, বাবুদের বাড়ী। এ দেশের সর্বত্র ঐ রকম হয়েই থাকে। অত রাত্রে বাবুদের বাড়ীতে বন্দুকের আওয়াজ হয়েছে, হয় তো কি একটা নূতন কাণ্ড উপস্থিত, তাই মনে কোরে প্রতিবাসী লোকেরা সেইখানে জড় হয়েছেন। অনেকেই শুনেছিলেন, বাবুদের বাড়ীতে এখন ভূতেরা বাসা কোরেছে; বাবুদের বাড়ীর নাম এখন ভূতের বাড়ী। আমি যে ভূত শীকার করবার মতলবে বন্দুক ছুড়েছিলেম, সেটা কেহ ভাবেন নাই; এখানে জমা হয়ে সকলেই শুনলেন, সাফ কথা। সকলেই বিস্ময়াপন্ন।

কুকুরগুলিকে নামিয়ে এনে রামদাস নীচের একটি ঘরে শিকল দিয়ে বেঁধে রেখেছিল। আমার ইঙ্গিতে ছোটবাবুর আদেশে, সেই সময় সেইগুলিকে উপরে আনা হলো। পোষাকুকুর, ক্রীড়া-কৌতুকে সুশিক্ষিত। কার দ্বারা সুশিক্ষিত, সেইটি পরীক্ষা করবার জন্য সর্বাগ্রে আমার অভিলাষ। আমার অভিলাষে কাজ হয় না। চুপি চুপি বড়বাবুকে আমি মনের কথা জানালেম; ছোটবাবুও শুনলেন। যতগুলি পুরুষমানুষ সেখানে ছিল, সারিবন্দী কোরে সকলকে দক্ষিণ বারান্দায় দাঁড় কোরিয়ে দেওয়া হলো। উপদেশমতো রামদাস সেই সময় কুকুরগুলির শিকল ছেড়ে ছিল।

পশুপ্রভৃতির আশ্চর্য ক্রীড়া। কুকুর সাতটি। যতগুলি লোক সেইখানে দাঁড়িয়ে ছিল, সাতটি কুকুর ক্রমে ক্রমে সকলের সমীপবর্তী হয়ে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আঘ্রাণ কোল্লে; একে একে সকলের মুখের দিকে চাইলে, শেষকালে একটি লোকের নিকটে গিয়ে, অঙ্গবস্থাদির আঘ্রাণ লয়ে, আহ্লাদে লাঙ্গুল সঞ্চালনপূর্বক অস্ফুট আনন্দধ্বনি কোত্তে কোত্তে সেই লোকটির কন্ধে, বক্ষে, হস্তে ঝাঁপ দিয়ে দিয়ে উঠতে লাগলো। এই রঙ্গ দর্শন কোরে দর্শক লোকেরা স্তম্ভিতভাবে পরস্পর মুখ-চাহাচাহি কোত্তে লাগলো।

যে লোকটির সঙ্গে কুক্কুরদলের ক্রীড়া, সেই লোকটি অতিদ্রুত উপর থেকে নেমে এসে দক্ষিণদিকে দৌড়িল; দেখতে দেখতে অদেখা হয়ে গেল। ঝন ঝন শব্দে শিকলি বাজিয়ে বাজিয়ে কুকুরেরাও খানিকদূরে সেই লোকের সঙ্গে ছুটেছিল, চার পাঁচজন সঙ্গীসহ রামদাস ধাবিত হয়ে কুকুরগুলিকে ফিরিয়ে আনলে। কুকুরেরা তখন প্রভু-বিরহে অস্থির হয়ে বন্ধনশৃঙ্খল টানাটানি কোত্তে লাগলো : লাফিয়ে লাফিয়ে ঘেউ ঘেউ রব কোত্তে লাগলো : অল্পক্ষণের মধ্যেই আটক পোড়ে গেল। উপস্থিত লোকেরা অল্প অল্প ইতিহাস শ্রবণ কোরে বিস্ময় প্রকাশ কোল্লেন। কুকুরের মুখে ভূতের মুখোস ছিল, সকলের কাছে সেটা আমি প্রকাশ কোল্লেম না; কিন্তু কুকুরগুলির রঙ্গ দেখে সকলেই হাস্য কোল্লেন। হাস্যের কোন হেতু আছে, আমি কিন্তু তেমন কিছু বিবেচনা কোল্লেম না; আমি কেবল ভাবতে লাগলেম, যে লোকটা ছুটে পালালো, সে লোকটা কে? ইতাগ্রে মুখে মাথায় রুমাল বাঁধা যে একটি লোক দর্শন দিয়েছিল, সেই লোক।

কে সেই লোক, চিনে লওয়া আমার পক্ষে অসাধ্য। বড়লোকেরা যে সকল কুকুর পোষেন, সেই সকল কুকুরের সেবার নিমিত্ত এক এক চাকর নিযুক্ত থাকে; সেই সকল চাকরের উপাধি “ডুবিয়া”। অর্ধবদনাবৃত যে লোকের গাত্রে কুকুরগুলির খেলা, সে লোকের অবয়ব— সে লোকের পরিচ্ছদ ডুবিয়ার মত নয় : ডুবিয়ারা নীচজাতিসম্ভূত : অধিকাংশই মেথর। এখানকার কুকুরেরা যে লোকটিকে প্রভু বোলে চিনেছিল, সে লোকের আকার-প্রকার ভদ্রসন্তানের তুল্য; মেথর বলা যায় না। বস্তুত কুকুরগুলি সেই লোকের বহুদিনের পালিত, শিক্ষিত, বশীভূত, সে পক্ষে আমার কোন সংশয় থাকলো না।

ঊষাকাল উপস্থিত। ঊষাবায়ু প্রবাহিত, ঊষা-বিহঙ্গের সঙ্গীতে চতুর্দিক কূজনিত। ক্রমশঃ পূর্বদিক পরিষ্কার। বাহিরের লোকেরা রঙ্গ দর্শনে পরিতৃপ্ত হয়ে স্ব স্ব গৃহে ফিরে গেলেন, বাড়ীর স্ত্রীলোকেরা অন্দরে প্রবেশ কোল্লেন, বাবুরা আমারে নিয়ে জেঁকে বোসলেন। নিকটে থাকলো রামদাস।

কর্তা-গৃহিণী বাড়ীতে নাই। ছেলেবাবুরাই কর্তা। তাঁদের মতানুসারেই আমারে চোলতে হবে। যে যে কথা তাঁরা আমারে জিজ্ঞাসা করেন, সে সব কথার জবাব দিতে হবে, যে যে কার্য তাঁরা আমারে আদেশ করেন, আদেশ পালন কোরে সেই সকল কার্য আমারে নির্বাহ কোত্তে হবে; সেই সকল কার্য নির্বাহে আমি বাধ্য। উপস্থিত ক্ষেত্রে সম্ভবমত সকল কথার উত্তর আমি দিলেম।

এখন অবধি রাত্রিকালে আর ভূতের উপদ্রব হয় কি না, অগ্রে দেখা হোক, তার পর অপরাপর বিষয়ের নিগূঢ় তত্ত্ব অবধারণ করা যাবে।

প্রভাতে নিত্যকর্মে সকলেই ব্যাপৃত। মধ্যাহ্নে রামদাসকে নিৰ্জনে পেয়ে সকৌতুকে আমি বোল্লেম, “এই তো রামদাস! এই তো তোমাদের ভূতের বাড়ী! ভূতগুলি তো এখন বাঁধা পোড়ে গেল, কর্তা এখন গয়াধামে কোন ভূতের জন্য পিণ্ডদান করবেন, তা কিছু তুমি অননুমান কোত্তে পার?”

কিয়ৎক্ষণ ইতস্তত কোরে রামদাস বোল্লে, “কে জানে বাপু ভূতের কথা; ভূতেরাই বোলতে পারে, পিণ্ডির কথা পাড়ালোকেরাই বোলতে পারে; যারা ভূতের পিণ্ড দেয়, তারাই তার মর্ম জানে;  আমি গরীবলোক, সামান্য মানুষ ও সব কথা আমাকে তুমি কিছু জিজ্ঞাসা কোরো না।”

নিষেধ পেলেম, তথাপি আমি জিজ্ঞাসা কোল্লেম, “আচ্ছা রামদাস, ও সব তো তুমি জান না, ও সব কথা তো তুমি বোলতে পারবে না; আচ্ছা, কিন্তু ছাদের উপর না হয়, হাসি হয়, আরো কত রকম শব্দ হয়, সে সব তো নূতন ভূতের কাণ্ড। যে সকল ভূত এখন ধরা গেল, সে সকল ভূত মানুষের মত নৃত্য, হাস্য, হুহঙ্কার কোত্তে পারে না, এটা নিশ্চয়। তবে সে কি, তা কি তুমি জানো?”

রামদাস উত্তর কোল্লে, “সবরে মেওয়া ফলে। দুদিন সবুর কর, দেখা যাক, কোন দিকে আর কোন রকম ভৌতিক ক্রিয়া— ভৌতিক উৎপাত ঘটে কি না। তা যদি কিছু না ঘটে, তবেই জানা যাবে, ঐ সকল কুকুর ভূতের—”

প্রশ্ন এড়াবার মৎলবেই রামদাস ঐ রকম বাজেকথার আড়ম্বর আনছে, সেটা আমি বুঝতে পাল্লেম। সে সব কথা শুনবার আমার ইচ্ছা ছিল না, থামিয়ে দিলেম; অন্য প্রকার প্রশ্ন কোল্লেম, “গয়ায় পিণ্ডিদানের অগ্রে এখানকার উপদ্রব যদি থামে, তা হোলে কর্তা ফিরে এসে আমারে কি বোলবেন? গয়ামাহাত্ম্য অধিক কিম্বা আমার বন্দুকের মাহাত্ম্য অধিক, এই কথা আমি তাঁরে বোলতে পারবো কি না, তুমি রামদাস, তুমি অনেক দিন এই বাড়ীতে আছ, তুমি সে বিষয়ে আমারে কিরূপ পরামর্শ দিতে পার?”

দ্বারের দিকে চাইতে চাইতে রামদাস ধীরে ধীরে বোল্লে, “সেই কথাই তো আমি বোলছিলেম; এখন অবধি এখানকার উপদ্রব যদি থামে, তা হোলে তোমার বন্দুকের মহিমাই গয়ার মহিমার চেয়ে বড় হবে।”

রামদাসের মীমাংসা শ্রবণ কোরে আমার মনে একটি কৌতুক জন্মে থাকলো। কর্তার প্রত্যাগমনকাল পর্যন্ত প্রতীক্ষা না কোল্লে, সে কৌতুকের পরিতৃপ্তি সাধিত হবে না, মনে মনে সেটিও আমি বুঝে রাখলেম। নিম্নতলে ঘেউ ঘেউ রবে কুকুর ডেকে উঠলো। রামদাস উঠে দাঁড়ালো; একরকম মুখভঙ্গী কোরে বোল্লে, “ক্ষুধা লেগেছে, পেটের জ্বালায় চীৎকার জুড়েছে, খাবার দিলে খায় না, ক্ষুধা সেটা মানে না, যাই একবার, কৃষ্ণের জীব, অনাহারে মারা যাবে, সংসারের অকল্যাণ হবে।”

কুকুরের সেবার জন্য রামদাস নেমে গেল। আমি মনে কোল্লেম, কথাও ঠিক, যে লোকের পোষা কুকুর, যে লোকের হাতে আহার করে, সেই লোক সম্মুখে থাকলে আহার করে; যে লোক নিত্য আহার দেয়, তার কাছে ও লাঙ্গুল-সঞ্চালনে আমোদ কোরে আহার করে; পোষা কুকুরের ধর্মই এই। অপরিচিত লোকের হাতে ভক্ষ্য গ্রহণে একজনের পোষা কুকুরের শীঘ্র প্রবৃত্তি হয় না। থাকতে থাকতে রামদাসের যদি পোষ মানে, তা হোলেই ঠিক হবে।

আমার মনের কথা আমার মনেই থাকলো। কোন দিকে ভ্রূক্ষেপ না কোরে অবিরামে আপন কাম বাজিয়ে সূর্যদেব আপন বিরামস্থানে চোল্লেন, নানা চিন্তায় নিমগ্ন হয়ে একাকী আমি ঘরের মধ্যে বোসে থাকলেম।

বড়বাবু দর্শন দিলেন। স্ফীতবদনে আমার মস্তক স্পর্শ কোরে বড়বাবু বোল্লেন, “ছেলেমানুষ বটে, কিন্তু তুমি খুব বাহাদুর আছ। যে কাজ তুমি কোরেছ, সে কাজ আমরা পাত্তেম না। কর্তা তোমাকে অবিশ্বাস কোত্তেন, স্বাধীনতা দিতে রাজী ছিলেন না, আজ অবধি আমি তোমাকে কর্তার চক্ষে দর্শন কোরবো না। তীর্থযাত্রার পূর্বে আমাদের দুটি ভাইকেও তিনি বিশেষ কোরে বোলে গিয়েছেন, ‘হরিদাসকে সর্বদা চক্ষে চক্ষে রেখো, একাকী কোথাও যেতে দিও না।’—মানে আমি বুঝেছিলেম, কিন্তু পিতার সে আজ্ঞা আমি পালন কোত্তে পাল্লেম না। তোমাকে আমি স্বাধীনতা দিলেম। এখন অবধি তুমি তোমার ইচ্ছামত কাজ কোত্তে পারবে? কিন্তু আমাদের অজ্ঞাতে বাড়ী ছেড়ে কোথাও যেতে পাবে না।”

আমি মনে মনে হাস্য কোল্লেম। বড়বাবু শীঘ্র শীঘ্র উঠে গেলেন না, আমারে বেড়াতে যেতেও অনুরোধ কোল্লেন না। দিবাকার্য সমাধা কোরে দিবাকর স্বস্থানে প্রস্থান কোল্লেন। রূপসী এসে আমাদের দিকে চাইতে চাইতে ঘরে একটা বাতী জ্বেলে দিয়ে গেল। একটু পরেই ছোটবাবু সেইখানে এলেন। আকাশের মিহির আস্তাচলে বাড়ীর মিহিরটি উদয়াচলে উপস্থিত। আমরা তিনজনে নানা প্রসঙ্গে কথোপকথন কোচ্ছি, কথায় কথায় ভূতের প্রসঙ্গ এসে পোড়লো। ছোটবাবু বোল্লেন, “ইন্দ্রজাল অনেক রকম দেখা গিয়েছে, এরকম কোথাও দেখি নাই। কুকুরেরা ভূতের খেলা দেখায়, বড়ই আশ্চর্য। আমি একদিন—”

কি কথা বলা ছোটবাবুর মনে ছিল, শেষ পর্যন্ত শ্রবণ করবার অবসর হলো না, একটি লোক সেই সময় মন্থরগতিতে সেই গৃহমধ্যে প্রবেশ কোল্লেন। পরিচ্ছদে ভদ্রলোক, দৃষ্টি কিছু কুটিল, মস্তকে লম্বা লম্বা চুল, সম্মুখভাগে কুঞ্চিত, চুলের বাবরীতে কাণ দুটি ঢাকা, মাথায় একটি মৌলবীকে তার তাজ, ডানদিকে বক্রভাবে হেলা, এত হেলানো যে, লোকটির ডানকানটি আছে কি না জানা যায় না।

অভ্যর্থনা কোরে হাসতে হাসতে বড়বাবু বোল্লেন, “আসুন পায়রাবাবু, আসুন; অনেক দিনের পর আজ আপনার দর্শন পেলেম, সংসারের সমস্ত মঙ্গল ত?”

পায়রাবাবু বোসলেন। বড়বাবুর প্রশ্নের উত্তরে তিনি কত রকম কথা বোল্লেন, আমি সকল কথার অর্থ বুঝলেম না। মন যদি আমার সেই দিকে থাকতো, হয় তো বুঝতে পাত্তেম, কিন্তু মন তখন আমার সে দিকে ছিল না। চক্ষের সঙ্গে মনের মিলন কোরে পায়রাবাবুর চেহারাটি তখন আমি দর্শন কোচ্ছিলেম। চক্ষে অবশ্য পলক ছিল, কিন্তু দৃষ্টি সেই দিকে অবিরাম। দেখছি, লোকটির আপাদমস্তক নিরীক্ষণ কোচ্ছি। মনে একটা নূতন ভাবের আবির্ভাব। পায়রাবাবুর মুখমণ্ডলের প্রতিই আমার নয়নের অধিক আকর্ষণ। অশ্রুপুট দর্শন কোল্লেম, নাসিকা দর্শন কোল্লেম, নেত্রপুট দর্শন কোল্লেম, কেশস্তবক দর্শন কোল্লেম। সুবক্র তাজের উপরে নেত্র স্থির। অনেকদিন পূর্বে কলিকাতার নিকটে একরাত্রে আমি বিদ্যাসুন্দর যাত্রা শ্রবণ কোরেছিলেম। গোপালে উড়ের যাত্রা। সেই যাত্রায় যে লোকটি বর্ধমানের সুন্দরের প্রতিনিধি সেজেছিল, সেই লোকটির মস্তকের তাজ ঠিক ঐ রকমে দক্ষিণে হেলা। যাত্রার সুন্দরকে আমার মনে পোড়লো। সুন্দরের কার্যের সঙ্গে পায়রাবাবুর কার্যের মিলন আছে কি না, ক্ষণকাল তাই আমি ভাবলেম।

চেয়ে আমি পায়রাবাবুর মুখের দিকে; মনে হলো, মূর্তি যেন আমার চেনা। আর কোথাও দেখেছিলেম কি না, ঠিক স্মরণ কোত্তে পাল্লেম না, কিন্তু এই রুদ্রাক্ষগ্রামেই তাঁরে আমি দেখেছি, এইরূপে যেন অবধারণ কোল্লেম। গ্রামের কোথায় দেখা, সেটি স্মরণ কোত্তেও অধিক বিলম্ব হলো না। গতরাত্রে ভূতের উৎসবের সময় মুখে মাথায় রুমালবাঁধা যে লোকটি ভিড়ের ভিতর দর্শন দিয়েছিলেন, কুকুরেরা যাঁর গায়ে ঝাঁপিয়ে ঝাঁপিয়ে উঠেছিল, সেই লোক। মুখখানি তখন ঢাকা ছিল, নাকটি আর চক্ষুদুটি খোলাছিল। ঠিক চিনতে পারি নাই, একটু একটু সন্দেহ হয়েছিল। আজ এই সময় অনাবৃত মুখমণ্ডল দর্শন কোরে সেই সন্দেহভঞ্জন হয়ে গেল। সত্যই বড়বাবুর পায়রাবাবুটি সেই লোক। আমি যেমন স্থির কোল্লেম সেই লোক, বড়বাবু আর ছোটবাবু সে রকম স্থির কোত্তে পাল্লেন কি না, লক্ষণ দর্শনে তেমনটি নিশ্চয় কোত্তে আমি অক্ষম হোলেম।

মুখ ঢাকা দেখেছিলেম, খোলামুখ দেখলেম, মনে মনে চিনতে পাল্লেম। কেবল তাও নয়, আর কোথায় দেখেছি। মনে মনেই তর্ক, মনে মনেই নিশ্চয়। নদীতীরের আম্রবৃক্ষতলে একটি সেজোবাবু আমি দেখেছিলেম। রাঙামামীর প্রেরিত দূতস্বরূপ যাঁর হস্তে আমি সেই ঔষধের মোড়ক সমর্পণ কোরেছিলেম, ইনিই সেই সেজোবাবু। সাক্ষী আমার চক্ষু, আর আমার মানসিক স্মৃতি। এই পায়রাবাবুই সেই সেজোবাবু।

কথা কিছু ভাঙলেম না। পায়রাবাবু মধ্যে মধ্যে আমার দিকে কটাক্ষপাত কোচ্ছিলেন, কটাক্ষপাতে আমিও তাঁর সেই কটাক্ষ দর্শন কোচ্ছিলেম। বস্তুতঃ তাঁর দর্শন আর আমার দর্শনের ভাব স্বতন্ত্র। ভূতের গল্প আরম্ভ হলো। সেই সময় আমি দেখলেম, প্রবেশকালাবধি এতক্ষণ পর্যন্ত পায়রাবাবুর মুখের ভাব যে প্রকার ছিল, সে ভাবের সম্পূর্ণ পরিবর্তন। কোন প্রসঙ্গ শ্রবণের ইচ্ছা না থাকলে শ্রোতা যেমন ক্ষণে ক্ষণে অন্যমনস্ক হয়, কোন পুরাতন বৃত্তান্ত আপন কৃতকার্যের ন্যায় ভেবে নিয়ে সে যেমন ম্রিয়মাণ হয়, চাঞ্চল্যের হেতু উপস্থিত না থাকলেও সে যেমন ক্ষণে ক্ষণে চঞ্চল হয়ে অন্যদিকে দৃষ্টি ফিরায় কিম্বা পলায়নের পন্থা দেখে, মিহিরচাঁদের মুখে ভূতের গল্পের ভূমিকা শুনেই পায়রাবাবুর বাহ্যভাব সেই প্রকার। ভাবটা আমি বিশেষরূপে লক্ষ্য কোল্লেম। কি আমি লক্ষ্য কোচ্ছি, পায়রাবাবু হয় তো ঠিক সেটা অনুভব কোত্তে পাল্লেন না। অল্পক্ষণ পরেই অত্যন্ত চঞ্চল হয়ে তিনি উঠে দাঁড়ালেন; বড়বাবুর দিকে চেয়ে গদগদবচনে বোল্লেন, “রাত্রি হয়, স্থানান্তরে আমার আজ একটা কাজ আছে; এখন আমি চোল্লেম, অবকাশমতো আর একদিন এসে সকল কথা শুনবো।”

পায়রাবাবু দরজা পর্যন্ত অগ্রসর হোলেন।

‘যাও কিম্বা থাকো’, বড়বাবু এই দুটি কথার একটি কথাও বোল্লেন না। বারান্দা পার হয়ে সিঁড়িতে নামছেন, সেই সময় ছোটবাবুর কানে কানে চুপি চুপি গুটিকতক কথা আমি বোল্লেম। শশব্যস্তে গাত্রোত্থান কোরে, ছোটবাবু বারান্দায় বেরিয়ে পশ্চাতে ডাকলেন;— ডেকে ডেকে বোল্লেন, “পায়রাবাবু! পায়রাবাবু! চোল্লেন আপনি? একটু দাঁড়ান; আপনার কুকুরগুলি নিয়ে যান।”

ছোটবাবুর সঙ্গে আমিও বারান্দা পর্যন্ত গিয়েছিলেম, পশ্চাতেই দাঁড়িয়ে ছিলেম, দেখলেম, পায়রাবাবু নামতে নামতে মুখ ফিরিয়ে যেন কতই বিস্ময়ে বোলে উঠলেন, “আমার কুকুর? কে বলে এমন কথা? কোথাকার কুকুর? কার কুকুর? আমি ত— আমি—”

উপযুক্ত অবসরে ছোটবাবুর কর্ণে আমি আর এক মন্ত্র ঝাড়লেম। পায়রাকে সম্বোধন কোরে ছোটবাবু শীঘ্র শীঘ্র বোল্লেন, “আপনি একবার উপরে আসুন, আপনার একটি কার্য বাকী আছে, দাদা আপনাকে ডাকছেন।”

পায়রাবাবুর মুখের কথা ওষ্ঠাগ্রেই বিলীন হয়ে গিয়েছিল, ছোটবাবুর বাক্যাবসানে তিনি কিয়ৎক্ষণ সিঁড়ির উপর স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেন; নেত্রদ্বয় কিয়ৎক্ষণ উপরদিকে বিকসিত হয়ে থাকলো, তার পর ধীরে ধীরে তিনি উপরে এসে উঠলেন, গৃহমধ্যে প্রবেশ কোল্লেন, ছোটবাবু তাঁর সঙ্গে থাকলেন, আমি নীচে নেমে এলেম। পাঁচ সাত মিনিট পরেই আবার আমি বাবুদের মজলীসে গিয়ে আসনগ্রহণ কোল্লেম।

যে সময়টকু আমি গরহাজির ছিলেম, সেই সময়ের মধ্যে পায়রাবাবুর সঙ্গে বাবুদের কিরূপ কথাবার্তা হয়েছিল, তা আমি জানতে পাল্লেম না। আমি হাজির হবার পর বড়বাবু জিজ্ঞাসা কোল্লেন, “আচ্ছা, পায়রাবাবু, আপনি বোলছেন, কুকুর আপনার নয়, কিন্তু আমি শুনেছি, কুকুরপোষা আপনার ভারী সখ; কুকুর স্বভাবতই প্রভুভক্ত, সেই ভক্তির উপর আপনি আরও অধিক ভক্তিসংযোগ কোরে কুকুরগুলিকে অধিক ভক্ত—অধিক বশীভূত কোরে তুলতে পারেন, সে বিষয়ে আপনার অতুল ক্ষমতা। যে কুকুরগুলি আমার এখানে আছে, সেগুলি যদি—”

ঝুমুর ঝুমুর শব্দে শৃঙ্খলবাদন কোত্তে কোত্তে সাতটি কুকুর সেইখানে উপস্থিত হলো। আমাদের কাহারো মুখে বাক্য থাকলো না। কুকুরেরা সানন্দ-গুঞ্জনে লম্ফে ঝম্ফে দ্রুত ধাবিত হয়ে পায়রাবাবুর গায়ে মাথায় আরোহণ কোত্তে লাগলো। সেই ক্রীড়া দর্শনে বড়বাবু ছোটবাবু উভয়ে বিস্ময়াপন্ন, আমি কিন্তু কিছুমাত্র বিস্মিত হোলেম না। গত রাত্রে বহুরূপীর মত ছদ্মবেশে এই পায়রাবাবু এইখানে উপস্থিত ছিলেন, কুকুরেরা গত রাত্রে এই মূর্তির নিকটে এইরূপ অভিনয় কোরেছিল, আমি সেটি জানতে পেরেছিলেম, সেই কারণেই আমার মনে, বিস্ময়ের উদয় হলো না। আজ রাত্রে আবার সেই প্রকার অভিনয়ে আমি নিজেই এই অভিনয়ের সূত্রধার।

সিঁড়ির পথে ছোটবাবুর আহ্বানে পায়রাবাবু যখন দ্বিতীয়বার উপরে উঠে আসেন, সেই সময় আমি একবার নীচে গিয়েছিলেম; রামদাসকে ক্ষেত্রকর্মের পরামর্শ দিয়াছিলেম। সেই পরামর্শের ফলে কুকুরের প্রবেশ। কুকুরের অভিনয়; সতেরাং আমিই এই অভিনয়ের সূত্রধার।

পায়রাবাবু অস্থির। লোকটির মনে স্পষ্ট আঘাত লাগে, এমন কোন বাক্য উচ্চারণ না কোরেই হাসতে হাসতে বড়বাবু বোল্লেন, “বাঃ! আপনি তো কুকুরবশের উত্তম বশীকরণ জানেন; আপনাকে দেখলেই সব কুকুর আনন্দে নৃত্য করে, গায়ে উঠে খেলা করে। আশ্চর্য ক্ষমতা আপনার। আপনি বোলছিলেন। আপনার কুকুর নাই, আপনার কুকুর নয় সে কথায় অবিশ্বাস করা যায় না, কিন্তু এই কুকুরগুলো আপনি নিয়ে যান। একবার আপনাকে দেখেই এরা পোষ মেনেছে, আপনাকে দেখেই সুখী হয়েছে; আপনার কাছে এরা ভাল থাকবে, আপনি নিয়ে যান।”

আমতা আমতা কোরে পায়রাবাবু বোল্লেন, “আমি?— আমি?— আমি কেন? আমি কেন?— এ সব কুকুর আমি—” এইরূপ অসম্বন্ধ কথা বোলতে বোলতে হাত ছুড়ে ছুড়ে গায়ের কুকুরগুলিকে তিনি তাড়িয়ে দিবার চেষ্টা কোল্লেন, দূর দূর বোলে ধমক দিলেন, কুকুরেরা সে ধমক মানলে না, শুনলে না, গ্রাহ্যই কোল্লে না; যতই তিনি ফেলে ফেলে দেন, নূতন খেলা মনে কোরে কুকুরেরা ততই আহ্লাদে লাঙ্গুল সঞ্চালন কোরে ঝাঁপিয়ে ঝাঁপিয়ে বার বার তাঁর গায়ে উঠে।

টাকা যদি মেকী হয়, সে টাকার গায়ে অনেক রকম নিশানা থাকে, মানুষের কপটতারও নিশানা অনেক। কপট বিরক্তি দেখিয়ে পায়রাবাবু সেই কুকুরগুলিকে চপেটাঘাত মুষ্ট্যাঘাত উপহার দিতে আরম্ভ কোল্লেন : মুখে বোলতে লাগলেন, “এ কি উৎপাত! কোথাকার উপসর্গ! কোথাকার কুকুর এ সব! কেন আমাকে— কেন আপনারা— কেন আমি কুকুর নিয়ে—”

শীকারের গন্ধ পেয়ে বিড়াল যেমন চুপি চুপি ছলী পেতে আসে, সেই রকম ছলী পেতে পেতে রামদাস সেইখানে এসে উপস্থিত। দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রামদাস সেই মজলীসের বাগবিতণ্ডা শ্রবণ কোরেছিল, মধ্যবর্তী হয়ে পায়রাকে বোলতে লাগলো, “কেন মশাই অমন কর? কেন মশাই না না কর? নিয়ে যাও মশাই, নিয়ে যাও, কেন আমাদের মাথার উপর জীবহত্যা- পাপের বোঝাটা চাপিয়ে দিতে চাও? খাবার দিলে খায় না, ভেঁউ ভেঁউ কোরে কাঁদে, দু দিন থাকলে ঠায় মারা যাবে, কৃষ্ণের জীব, কে কোথায় অনাহারে বাঁচে? কেন আপনি আমাদের অতগুলো জীবহত্যার ভাগী কর। এখানে থাকলে ওরা বাঁচবে না; নিয়ে যাও।”

কাহারো কোন কথাই পায়রাবাবু শুনলেন না; গায়ের উপর থেকে কুকুরগুলিকে ঝেড়ে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে মুখ ভারী কোরে উঠে সটান চঞ্চলচরণে এককালে বাহিরের রাস্তায় উপস্থিত হয়েই ছুট! বড়বাবু, ছোটবাবু আর আমি তিনজনেই বাহিরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে পায়রাবাবুর ছুটের ঘটা দেখলেম; তিনজনেই হাস্য কোল্লেম; তিনজনেই রামদাসের প্রতি ইঙ্গিত কোরে যথাকর্তব্য আদেশ দিলেন। রামদাস তৎক্ষণাৎ সে কুকুরগুলির গলার শিকলগুলি খুলে নিয়ে সদরদরজায় বাহির কোরে দিয়ে দরজা বন্ধ কোরে দিলে। বন্ধ করবারও আবশ্যক ছিল না, দরজা খোলা থাকলেও কুকুরেরা বাড়ীর ভিতর ফিরে আসতো না। রাস্তার ধূলা আঘ্রাণ কোত্তে কোত্তে ঘোড়দৌড়ের ঘোড়ার মত ছুটে ছুটে তারা সেই পলায়িত মনিবের পথানুসরণ কোল্লে; দেখতে দেখতে অদৃশ্য হয়ে গেল। এইখানেই এ নাটকের যবনিকা-পতন।