হরিদাসের গুপ্তকথাদ্বিতীয় খণ্ড
নবম কল্প : দারণ কলঙ্ক—কলঙ্কভঞ্জন
সপ্তাহ অতীত। এই সপ্তাহের মধ্যে একরাত্রেও ভূতের নৃত্য, ভূতের হুঙ্কার, ভূতের কুন্দন, ইত্যাকার কোন অদ্ভুত শব্দই শ্রুতিগোচর হয় নাই। কেবল আমার নিজের কথা বোলছি না, বাড়ীর কেহই কিছু শ্রবণ করেন নাই। অষ্টম দিবসে প্রাতঃকালে বড়বাবু প্রফুল্লবদনে আমার শয়নগৃহে প্রবেশ কোরে আমারে বাহাদুরী দিয়ে বোল্লে, “হরিদাস, তুমি বীরপুরুষ, যুদ্ধক্ষেত্রের বীরপুরুষের হস্তপদবিশিষ্ট সজীব মানুষের সঙ্গে যুদ্ধ করেন, সে যুদ্ধে জয়-পরাজয় উভয়ই আছে। তুমি ভূতের সঙ্গে যুদ্ধ কোরেছ, তোমার প্রতাপে ভূতেরা পরাজিত হয়ে পলায়ন কোরেছে। যথার্থই তুমি বীরপুরুষ! এখন অবধি আমি তোমাকে সহোদর তুল্য বিবেচনা কোরবো, তোমার পরামর্শ মতই কার্য কোরবো। লোকে যেমন নিরুপদ্রবে মনের সুখে নিজ বাড়ীতে বাস করে, এখন অবধি তুমি সেইরূপে মনের সাথে এই বাড়ীতে বাস কর। কর্তা ফিরে এসে যদি কোন বিরুদ্ধে কথা বলেন, আমি তাঁকে তোমার গুণের কথা বোলে ঠাণ্ডা কোরে রাখবো।”
বাহাদুরী পেলেম; বীরপুরুষ হোলেম; কর্তা আমাদের সুনয়নে দেখবেন, সেরূপ আশ্বাসও পেলেম, কিন্তু একটি কথাও আমার ভাল লাগলো না। সে বাড়ীতে কি একটা যে গুপ্তকাণ্ড আছে, অনুমানে সেইটি চিন্তা কোরে আমি নীরব হয়ে থাকলেম; অকৃতজ্ঞ হোলেম না, মৌনভাবে দুইহাত তুলে বড়বাবুকে নমস্কার কোল্লেম।
রামদাস আসে যায়, কত রকমের কত কথা কয়, রূপসী আসে যায়, অভ্যাসমত আপন মনে পাঁচ রকমের গল্প করে, যাবার সময় এক একবার আঁখি ঠেরে চোলে যায়। ছোটবাবু আসেন যান, আমার সঙ্গে বেশ আত্মীয়তা দেখান, এক একদিন আমারে সঙ্গে নিয়ে গ্রামের এক একদিক্ দেখিয়ে আনেন, এই রকমে দিন যায়। বড়বাবুর মুখে সেই উপদেবতার কথা ভিন্ন আর অন্যকথা প্রায়ই শুনতে পাই না; গতকথা নিয়ে অত আলোচনা কেন তাঁর, সেটাও ঠিক বুঝতে পারি না।
আর এক সপ্তাহ অতীত। একদিন বৈকালে ছোটবাবুর সঙ্গে আমি একটি সরোবরতীরে ভ্রমণ কোচ্ছি, গুটিকতক হংস-হংসী সেই সরসীজলে খেলা কোরে বেড়াচ্ছে, দেখে দেখে মনে আমার একটা ভাব উদয় হলো। ছোটবাবুকে আমি জিজ্ঞাসা কোল্লেম, “আপনাদের গ্রামে পায়রাবাবু আছেন, মানুষের আকার ধারণ কোরে পায়রাবাবু সংসারধামে ক্রীড়া করেন, এই সকল হংসের মধ্যে কোন হংস নরমমূর্তি ধারণ কোরে হংসবাবু কেন হয় না; প্রণয়-সংসারে আমি সংসারী নই, বাস্তবিক প্রণয়পদার্থটি যে কি, তাও আমি বুঝি না। এ সংসারে বিহঙ্গকুলে হংস-হংসী আর কপোত-কপোতী বিমল প্রেমের দৃষ্টান্তে প্রসিদ্ধ পায়রাবাবুর ক্রীড়া দর্শনে একটি হংসবাবুর ক্রীড়া দর্শন কোত্তে আমার অভিলাষ হয়; হংসের বাক্যশ্রবণে কৌতূহল জন্মে। তার কি কোনরূপ উপায় হোতে পারে না?”
ছোটবাবু বোল্লেন, “তোমার কথা আমি বুঝতে পাল্লেম না, হংসের বাক্য-শ্রবণে কৌতূহল, সে কৌতূহলের অর্থ কি? হংসেরা কি কথা কয়? সৃষ্টি কালাবধি হংসের মুখে কেহ কখন বাক্য শ্রবণ করে নাই।”
সমান আগ্রহে তৎক্ষণাৎ আমি বোল্লেম, “কেহ কখন শ্রবণ না কোল্লে আমার মনে সে ভাবের উদয় হোতো না। শ্রীহর্ষ দেবের হংসের মুখে নলরাজা কথা শুনেছিলেন, দয়মতীদেবীও হংসমুখে পরিণয়-সম্বন্ধ শ্রবণ কোরেছিলেন, প্রণয়-বিজ্ঞানে অনভিজ্ঞ থাকলে আমি কেন হংসবাক্য শুনতে পাব না, তাই আমি ভাবি; বিশেষতঃ পায়রা যখন নরাকার ধারণ করে, তখন হংস অপারগ থাকে কেন? আচ্ছা, ছোটবাবু, সেই পায়রাবাবুটি আপনাদের গ্রামে কতদিন আছেন? এখানে তাঁদের কয়পুরুষের বাস?”
খানিকক্ষণ বিস্মিতনেত্রে আমার মুখের দিকে চেয়ে থেকে কিঞ্চিৎ সঙ্কুচিতস্বরে ছোটবাবু বোল্লেন, “বংশাবলীর তত্ত্ব তুমি জানতে চাও? বেশী দিনের খবর আমি বোলতে পারবো না, পায়রাবাবুর পিত্রালয় এই গ্রামে বটে, কিন্তু এ গ্রামে পায়রাবাবুর জন্ম হয় নাই; মাতামহালয়ে জন্ম, মাতামহালয়েই তিনি প্রতিপালিত। জন্মাবধি এ গ্রামে তিনি আসেন নাই, সম্প্রতি এসেছেন। তাঁর প্রকৃত নামটি কি, তাও আমরা জানি না। কথা কবার সময় তাঁর গলাটি একটু ফুলে ফুলে উঠে, বক বকম, বক বকম শব্দের ন্যায় এক রকম ঘড় ঘড় শব্দ হয়, সেই জন্য দাদা রসিকতা কোরে তাঁর নাম দিয়েছেন ‘পায়রাবাবু’। দেখাদেখি— দাদার মুখে শুনে শুনে, গ্রামের পাঁচজনেও বলে পায়রাবাবু।”
কথা শুনলেম, কি আমি ভাবলেম, আর একটি কথা জিজ্ঞাসা করবার ইচ্ছা হলো। জ্বলন্ত আগ্রহে, জ্বলন্ত কৌতুহলে আমি জিজ্ঞাসা কোল্লেম, “কোথায় পায়রাবাবুর মাতামহালয়?”— ছোটবাবু বোল্লেন, “বীরভূমজেলা।”
আমার সর্বশরীর কেঁপে উঠলো। আর তখন ছোটবাবুর দিকে ভাল কোরে আমি চাইতে পাল্লেম না। বিস্ময়ের বিকাস হোলে মানুষের নয়নের দীপ্তি কেমন একপ্রকার দাঁড়ায়; বীরভূম জেলার নাম শ্রবণে আমার মনে এক মহাবিস্ময়ের উদয় হয়েছিল। সে সময় আমার চক্ষু দর্শন কোরে ছোটবাবু যদি কোন প্রকার বিস্ময়লক্ষণ বুঝতে পারেন, ভাল হবে না, সেই জন্যই ছোটবাবুর দিকে ভাল কোরে চাইতে পাল্লেম না; মাথা হেঁট কোরে মনে মনে বোল্লেম, “যা ভেবেছি, তাই, সেই লোক না হোলে এতদূর ধড়ীবাজী আর কার মাথায় যোগায়?”
কি ভাব আমার মনে উদয়, নয়নে আমার কোন ভাবের বিকাস, ছোটবাবু সেটি অনুভব কোল্লেন না, আমার চক্ষের দিকেও চেয়ে দেখলেন না, হঠাৎ আমারে জিজ্ঞাসা কোল্লেন, “পায়রাবাবুর বংশপরিচয় জানতে তোমার এত আগ্রহ কেন?”
বিভ্রাট! আগ্রহের হেতুবাদটা কি জানাই? অল্পক্ষণ চিন্তা কোরে একট উদাসীনভাবে আমি বোল্লেম, “এমন কিছু আগ্রহ নয়, বিশেষ কোন হেতুও নাই, তবে কি না, পায়রাবাবু একটি পাকালোক, কুকুর বশীভূত করবার বিশেষ ক্ষমতা তিনি ধরেন, কুকুরেরাও তাঁর সঙ্গে বেশ খেলা করে। পুরুষানুক্রমে কুকুরপোষার সখ না থাকলে এতটা দক্ষতা জন্মে না, এইজন্য আমি জিজ্ঞাসা কোরেছিলেম, এ গ্রামে তাঁর কয় পুরুষের বাস? জিজ্ঞাসা করবার আর কোন কারণ ছিল না।”
আসল কথা আমি গোপন রাখলেম। কথাটা আমি উলটে নিলেম, ছোটবাবু কিন্তু ধোত্তে পাল্লেন না; ধরবার কোন সম্ভাবনাও ছিল না, আমার সংক্ষিপ্ত উত্তর শ্রবণ কোরেই তিনি সন্তুষ্ট হোলেন। বেলাও শেষ হয়ে এলো, বাড়ীতে আমরা ফিরে এলেম।
সেই রাত্রে আর এক অভিনব কাণ্ড। রাত্রিকালে আমার আহারের পর প্রথম প্রথম ঘরের দরজায় চাবী বন্ধ হতো, এখন বড়বাবু আমার প্রতি সদয়, এখন আর চাবী বন্ধ হয় না। অন্দরেই আমি আহার করি, সামান্য সামান্য দুই একটা কাজের অছিলায় রূপসী আমার শয়ন-ঘরে আসে; নিত্য যেমন আসে, যে রাত্রের কথা আমি বোলছি, সে রাত্রেও সেইরূপ এসেছিল, রাত্রি দশটার পূর্বেই আবার চোলে গিয়েছিল। তার পর, রাত্রি যখন অনেক, বাড়ীর সকলে যখন নিদ্রাগত, সেই সময় রূপসী আবার চুপি চুপি দরজা ঠেলে, টিপি টিপি ঘরের ভিতর প্রবেশ কোল্লে, নিঃশব্দে দরজাটা ভেজিয়ে দিলে। আমি তখনো ঘুমাই নাই। যে রাত্রে কিছু বেশী চিন্তা থাকে কিম্বা কোন প্রকার নূতন চিন্তা উপস্থিত হয়, সে রাত্রে অনেকক্ষণ পর্যন্ত আমার ঘুম হয় না। আমি জেগেই ছিলেম; যা যা হোচ্ছে, ঘরে তখনো আলো ছিল, বেশ আমি দেখতে পাচ্ছি। রূপসী আমার বিছানার কাছে এসে দাঁড়ালো। কি করে, কি মতলব, জানবার জন্য কপটে সেই সময় আমি নয়ন মুদিত কোল্লেম; অনুমানে বুঝলেম, রূপসী আমার বিছানার উপর বোসলো। কিছুই আমি বোল্লেম না, চক্ষু খুলে একবার চাইলেমও না। রূপসী ক্ষণকাল নিশ্চেষ্ট; তার পর ধীরে ধীরে একবার আমার বাহুমূল স্পর্শ কোল্লে, ধীরে ধীরে নাড়া দিলে, আমি জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলতে লাগলেম, অঙ্গসঞ্চালন কোল্লেম না; কি ভেবে রূপসী তখন আমার হাত থেকে আপনার হাতখানা একবার সোরিয়ে নিলে, কিন্তু উঠলো না। ক্ষণকাল চুপ। আবার সেই রকম অঙ্গস্পর্শ।
কোন প্রকার স্বপ্ন দর্শন কোরে কিম্বা ঘুমের ঘোরে কোন প্রকার শব্দ শ্রবণ কোরে মানুষ যেমন হঠাৎ শঙ্কিত-ভাবে জেগে উঠে, ভাণ কোরে সেই রকম ভাব দেখিয়ে, আমি সেই সময় একবার নয়ন উম্মীলন কোল্লেম; কেবল নেত্রোন্মীলন মাত্র নয়, চমকিতভাবে বিছানার উপর উঠে বোসলেম। কাঁচা ঘুমে আশু জাগরিত লোকে সম্মুখস্থ ব্যক্তিকে যেরূপ চমকিতভাবে ত্বরিত প্রশ্ন করে রূপসীকে সম্মুখে দেখে সেই ভাবে আমি ত্বরিত প্রশ্ন কোল্লেম, “রূপসি! এত রাত্রে তুমি এখানে কি জন্য?”
শয্যা পরিত্যাগ না কোরেই দিব্য সপ্রতিভ ভঙ্গীতে একটু মৃদুস্বরে রূপসী উত্তর কোল্লে, “আমি তোমারে একটি কথা জিজ্ঞাসা কোত্তে এসেছি। সন্ধ্যার পর যখন এসেছিলেম, তখন মনে ছিল না, সেইজন্য আবার এসেছি।”
সহসা আমার অন্তরে বিষম সন্দেহের সঞ্চার। সংশয়াকুললোচনে কিঙ্করীর মুখখানে চেয়ে আমি বোল্লেম “জিজ্ঞাসা করবার আর কি তুমি সময় পাও নাই? যখনি ইচ্ছা, তখনি আসছো, যতবার ইচ্ছা ততবার আসছো, একটা কথা জিজ্ঞাসা করবার আর কি সময় হয় না?”
রূপসী।— সময় হয়, কিন্তু নির্জন হয় না। কথাটা নির্জনে জিজ্ঞাসা করবারই কথা। রোজ রোজ মনে করি, জিজ্ঞাসা কোরবো, এক একদিন ভুলে যাই, এক একদিন কেহ না কেহ এখানে উপস্থিত থাকে, অবসর পাই না।
আমি।— বুঝলেম, বুঝলেম, আবশ্যকটা বুঝলেম, আচ্ছা, আচ্ছা, বল দেখি, এত রাত্রে কি তোমার জিজ্ঞাসা?
রূপসী।— জিজ্ঞাসা— জিজ্ঞাসা— জিজ্ঞাসা—
আমি।— (কিঞ্চিৎ উত্তেজিত-স্বরে) এত রাত্রে ঘুম ভাঙিয়ে বোলতে বোলতে আবার থামা মারো কেন? ঘোরফের আমি বুঝি না কথাটা কি, খোলসা কোরেই বল? কি তুমি জিজ্ঞাসা কোত্তে চাও?
রূপসী।— কথা? চাই? একটি কথা; বেশী এমন কিছুই না, কেবল একটি মাত্র কথা। তুমি যদি—
আমি।— (বিরক্ত হইয়া) গৌরচন্দ্রিকা ছেড়ে দাও, আসল কথাটা কি, বোলতে হয় তো বল, না হয় তো চোলে যাও।
রূপসী।— (আমার দিকে একটু হেলিয়া মৃদুস্বরে) রাগ কর কেন? রাগ কর কেন? ভাল কথাই আমি বোলছি, ভাল কথা বোলতে আমি এসেচি। রোজ রাত্রে তুমি একলাটি এইখানে শুয়ে থাকো, ভয় করে না?
আমি।— ভয়? —কিসের ভয়? —ভূতের?
রূপসী।— না, না, না, সে ভয় তো তুমি এক রকম ঘুচিয়ে দিয়েচ সে কথা বোলচি না; বোলচি এই— ভয় অনেক রকম। এত বড় একটা বাড়ী, তাতে আবার লোকে বলে হানাবাড়ী— মানুষ কম, তারাও আবার অন্য মহলে, এ বাড়ীতে একা থাকতে রেতের বেলা তোমার ভয় করে না?
আমি।— কিছুতেই আমার ভয় নাই। আমি ভয় পাই না, আমার ভয় হয় না, তুমি আবার কি নূতন ভয়ের কথা বোলতে এসেছ? আচ্ছা ধর, ভয় যদি থাকে, তুমিই বা তার কি উপায় কোতে পার?
রূপসী।— আমি? —আমি? —ভয়ের? —না, —নূতন? —না, — নয়। দেখে অবধি তোমাকে আমি বড় ভালবেসেচি, তোমার জন্যই আমার ভয় হয়। ভালবেসেচি বোলেই সর্বক্ষণ যেন আমার মনে হয়, তুমি হয় তো ভয় পাও।
আমি।— যেন তোমার মনে হয়, আমি হয় তো ভয় পাই, এ কথার উত্তর আমি কি দিব? তুমি এক জায়গায় চাকরী কর, আমি সেই জায়গায় নূতন এসেছি, তোমার সঙ্গে আমার দেখা-শুনা হয়, আমি ভয় পাই না, তুমি ভাব, হয় তো আমি ভয় পাই, এত টান কিসের? এত ভালবাসা কিসের?
রূপসী।— টান? —ভালবাসা? এত কথা, এত কথা? —ভাব দেখি হরিদাস! আহাহা! কি সুন্দর নামটি তোমার! হরিদাস! —ইচ্ছে করে, নামটি লিখে মালা গেঁথে, গলায় পরি। —আহাহা! —কি সুন্দর রূপখানি তোমার! — কি সুন্দর মুখখানি তোমার! কি সুন্দর চক্ষু দুটি! —কি সুন্দর চুলগুলি! —আহাহা! রংটকু যেন কাঁচা সোণা! ইচ্ছা করে, সর্বকর্ম ত্যাগ কোরে রাতদিন ঐরূপখানি আমি দেখি! —আহাহা! কি মিষ্ট বচনগুলি তোমার! —কাণে যেন মধু ঢেলে দেয়! —ইচ্ছা করে, রাতদিন ঐ মধুমুখের মধু খেয়ে ভালবাসার ভাবে বিভোর হয়ে থাকি! —আচ্ছা, হরিদাস! কত ভালবাসি আমি তোমারে, আমার প্রাণ তা জানে; তুমি কি আমারে ভালবাস না? —একটুও ভালবাসতে পার না?
আমি দেখলেম, বেগতিক। এতক্ষণ অতটা বুঝতে পারি নাই। এতক্ষণের পর স্বৈরিণীর মনের ভাব কি তা আমি বুঝে নিলেম। কথার ভাবেই মনের ভাব, কেবল তাও না— শেষকথাগুলো বলবার সময় ছুঁড়ি আমার মুখের কাছে মুখ আনবার উপক্রম কোরেছিল! সামান্য একটা চাকরাণীর এতদূর বুকের পাটা! ত্বরিত গতিতে বিছানা থেকে নেমে ঘরের মাঝখানে গিয়ে আমি দাঁড়ালেম। রূপসী তখন ফ্যাল-ফ্যাল-চক্ষে আমার দিকে চেয়ে থাকলো। আমি তখন একটু জোরে জোরে বোলতে লাগলেম, দেখ রূপসি! এখান থেকে চোলে যাও! এখনি এ ঘর থেকে বেরিয়ে যাও! একতিল যদি বিলম্ব কর, এখনি আমি গোলমাল বাধাব, এখনি আমি বড়বাবুকে ডাকবো। বাড়ীর সব ঘুমন্ত লোকগুলিকে এখনি আমি জাগাব, ভালমুখে এখনো বোলছি, গরীবের মেয়ে, কলঙ্কের ডালি মাথায় কোরে কেন এই চাকরিটি খোয়াবে? বেরিয়ে যাও, শিষ্টশান্ত হয়ে আপনার ঘরে গিয়ে শয়ন কর।”
আমি ভেবেছিলেম, ঐ সব কথা শুনে চাকরাণীটা ভয় পাবে, ভয় পেয়েই হয় তো ছুটে পালাবে; কিন্তু কি আশ্চর্য, একটুও ভয় পেলে না, বিছানা থেকে লাফিয়ে পোড়ে উগ্রমূর্তিতে আমার দুহাত তফাতে এসে দাঁড়ালো। সেই রোগা শরীর যেন ফুলে উঠলো, কতই যেন দীর্ঘাকার দেখাতে লাগলো, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চক্ষু যেন জোনাকীর মত জ্বোলে উঠলো। স্বৈরিণী তখন আমার মুখের কাছে মুষ্টিবদ্ধ দক্ষিণহস্ত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে গৰ্জনস্বরে বোল্লে, “আচ্ছা —আচ্ছা —আচ্ছা! থাকো থাকো —থাকো। থাকো তুমি! —এতখানি ভালবেসেছিলেম, সেই ভালবাসার তুমি এই প্রতিফল দিলে! —আচ্ছা দাও! — দেখবো আমি তোমাকে! কলঙ্কের ডালি! —আরে আমার কলঙ্কের ডালি রে! — দেখবো আমি, কেমন কোরে তুমি কলঙ্কের ডালি ঝেড়ে ফেলো! আমাকে তুমি চেনো না যাদু! —আগুন —আগুন! —আগুন! — উঃ! —বুকের ভিতর আগুন জ্বোলছে! — প্রাণের সঙ্গে ভালবেসে যৌবনধন ডালি দিতে চাইলেম, তার কি না এই ফল! এত অপমান! —এত যন্ত্রণা!— উঃ! দেখবো আমি তোমাকে! — মেয়েমানুষ আমি। দেখবো আমি তোমাকে! কেমন কোরে কলঙ্ক কাটাও, দেখবো আমি! — দেখবো দেখবো! দেখবো!”
এই রকমে শাসিয়ে শাসিয়ে নাগিনী তখন যেন যষ্টি তাড়িতা নাগিনীর ন্যায় ফোঁস ফোঁস গর্জন কোত্তে কোত্তে চপলাগতিতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। নিশ্বাস ফেলে, দরজা বন্ধ কোরে আমি শয়ন কোল্লেম। দুটি ভাবনা আমার নূতন সহচরী। পায়রাবাবুর মাতামহালয় বীরভূমজেলা। যে দিন আমি রাঙামামীর দূত হয়ে ঔষধের মোড়ক বিলী কোত্তে গিয়েছিলেম, সে দিন জানতেম না, বাবুটির নাম পায়রাবাবু; সে দিন জেনেছিলেম সেজোবাবু! মুখখানি দেখে সেজোবাবুকে আমি আর এক বাবু অনুমান কোরেছিলেম, বীরভূমজেলার নাম শুনে, এ রাত্রে সেই অনুমানটি ঠিক মনে হোচ্ছে। ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া বাবরীচুল, সেই সব চুলে কাণদুটি ঢাকা। বাবুটি যে দিন তাজ মাথায় দিয়ে এসেছিলেন, সে দিনের ভঙ্গীতেও কতক কতক বুঝতে পারা গিয়েছিল। ছদ্মবেশী লোকের পরচুল খুলে দিলে আসল রূপ যেমন চেনা যায়, পায়রাবাবুকে নেড়া কোরে দিতে পাল্লে, সেইরূপ চেনা যেতে পারে। বরদারাজ্যে যে কথা আমার শুনা হয়েছে, সে কথা যে ঠিক নয়, এমন আমি মনে কোত্তে পাচ্ছি না। একটা গল্প মনে পোড়লো। একগ্রামে একটি বাবু ছিল; বাবুটি কুচকুচে কালো, লম্বে প্রায় চারি হাত, অঙ্গে মাংস অনেক, মস্তকটি অল্প অল্প চুলে ঢাকা, বাবুর মাথায় কি রকম রোগ ছিল, অধিক চুল রাখলে সেই রোগটা বাড়তো, সুতরাং হপ্তায় হপ্তায় বাবুটিকে নেড়া হোতে হতো। বাবুটির দুটি তিনটি মোসাহেব ছিল, বাবুর নেড়ামূর্তি দর্শন কোরে সেই মোসাহেবরা বৃহৎ বৃহৎ তারিফ কোত্তো। কেন কোত্তো, তার কারণ ছিল। গজকুম্ভের ন্যায় বাবুর মাথায় উঁচু নীচু দুটি তিনটি ঢিবি; কেশশূন্য হোলে সেই ঢিবিগুলি বেশ জেগে উঠতো, অত্যন্ত কদাকার দেখাতো। মোসাহেবেরা সেই সময় বাবুর মুখের কাছে হেঁট হয়ে পাঁচজনের সাক্ষাতে আমোদ কোরে বোলতো, “নেড়া হোলে আমাদের বাবুর চেহারার যেমন খোলতা হয়, আর কাহারো চেহারা তেমন খোলে না। অনেকেই ত সময়ে সময়ে নেড়া হয়ে থাকে, ছি ছি! কিম্ভুতকিমাকার দেখায়। আমাদের বাবু নেড়া হোলে কার্তিকের মত রূপ ফোটে।”
গল্পের ভাব এইরূপে। পায়রাবাবুকে যদি সেইরূপ প্রশংসায় ফালিয়ে তুলে একবার নেড়া কোরে দেওয়া যায়, তা হোলেই রঙ-তামাসা ধরা পড়ে। সজ্জাপারিপাট্য ভদ্রলোকের মত;— “দেখি তোমার চুল কেমন, দেখি তোমার কাণ কেমন,” হঠাৎ ভদ্রলোককে এমন কথা বলা ভদ্রলোকের উচিত হয় না। ছোটবাবুকে সুপারিশ কোরে পায়রাটিকে একদিন নেড়া করাই সুপরামর্শ। প্রথম চিন্তাটার সেই পর্যন্তই বিরাম। দ্বিতীয় চিন্তা রূপসী দাসীর অভিসার। রূপসীর অত্যন্ত দুঃসাহস! কুপথে আমার প্রবৃত্তি লওয়াবার অভিলাষে দুশ্চারিণী ঘোর নিশীথসময়ে এই ঘরে প্রবেশ কোরেছিল, হতমনোরথ হয়ে প্রতিশোধের ভয় দেখিয়ে গেল। নাগিনী আমারে দেখবে, নাগিনী আমারে দেখাবে, আমার মাথায় কলঙ্কের ডালি চাপাবে, এই রকম ভয়প্রদর্শন। পারে তা, দুষ্টবুদ্ধিতে কুলটারা সব কোত্তে পারে, জানি; আমি কিন্তু ভয় পাচ্ছি না। মনে জানছি, সামান্য একটা চাকরাণীর কথায় আমার ভয় পাবার কোন কারণ নাই; চরিত্রের প্রতি আমার অধিক দৃষ্টি, চরিত্ররক্ষায় সর্বদা আমি সাবধান, পাপিনী আমার কি প্রকারে অপকার কোত্তে পারবে? —কিছুই পারবে না। এই বিশ্বাসে সে ভাবনাটা আমি মন থেকে দূরে কোরে দিলেম; সে পক্ষে একরকম নিশ্চিন্ত হয়েই থাকলেম।
রূপসীকে আমি বার বার নাগিনী বোলে উল্লেখ কোচ্ছি; দৃষ্টান্তে নাগিনী বোলছি না, বাস্তবিক তার একটা নাম যেন নাগিনী, অনেকেই এইরূপে বিবেচনা কোরবেন, পাঠকের মনে সংশয় জন্মিবারও সম্ভাবনা; সে সংশয়ের হেতু আমি রাখবো না। চাকরাণীর কাজ করে, কিন্তু চেহারায় রূপসীকে চাকরাণী বোলে বোধ হয় না, এই কারণে রামদাসকে একদিন আমি জিজ্ঞাসা কোরেছিলেম, রূপসীটা কে?—রামদাস বোলেছিল “ছোটবাবুর জন্মের অগ্রে এই বাড়ীতে একজন চাকর ছিল, তার নাম লবকুমার লাগ; তারা স্ত্রীপুরুষে এই বাড়ীতে থাকতো, তাদেরই কন্যা ঐ রূপসী। ছোটবাবুর যখন জন্ম হয়, রূপসী তখন ছোট ছিল, বড় হয়ে এখন এই বাড়ীতেই দাসীবৃত্তি কোচ্ছে।”—বঙ্গের কোন কোন জেলার ইতরশ্রেণীর লোকেরা দন্ত্য “ন” স্থলে “ল” উচ্চারণ করে, সেই অভ্যাসে নবকুমার নাগকে রামদাস বোলেছিল, ‘লবকুমার লাগ’; সুতরাং নাগের কন্যাকে আমি নাগিনী বোলে পরিচয় দিলেম।
সে রাত্রের দুটি চিন্তাকেই ঐ প্রকারে বিদায় দিয়ে আমি নিদ্রাভিভূত হয়েছিলেম। পরদিন প্রভাতে আমার ঘরের নিয়মিত কার্যগুলি রামদাস এসে নির্বাহ কোরে গেল, রূপসী এলো না। তদবধি রূপসী আর আমার সঙ্গে দেখা করে না, আমি যখন অন্দরে যাই, রূপসী তখন আমারে দেখে, মুচকে মুচকে দুষ্টহাসি হেসে, মুখ ঘুরিয়ে অন্য ঘরে প্রবেশ করে। ক্রমাগত একপক্ষ এই ভাব। কিছুই আমি গ্রাহ্য করি না।
পক্ষান্তে এক রাত্রে আমি আপন কক্ষে শয়ন কোরে আছি, রাত্রি অনুমান দুই প্রহরের অধিক, অন্দরের ভিতর একটা গোলমাল উঠলো দুই তিনজনের কথা, একটি কণ্ঠস্বর কিছু উচ্চ উচ্চ। সে বাড়ীর সদর অন্দর একমহলে, অতি অল্পমাত্র ব্যবধান, এ কথা পূর্বেই আমি বোলেছি। যে ঘরে আমি শয়ন করি; সে ঘর থেকে অন্দরের উচ্চ উচ্চ কথা বেশ শুনা যায়; বিশেষতঃ গভীর রাত্রে। গোলমালটা ক্রমশই বাড়তে লাগলো। বিছানা থেকে আমি উঠলেম। রূপসীর দুর্বাসনা-প্রকাশের পর থেকে শয়ন-ঘরের দরজায় আমি রাত্রিকালে অর্গলবদ্ধ কোরে রাখি, নিঃশব্দে অর্গলমুক্ত কোরে চুপি চুপি বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালেম; এত রাত্রে বাড়ীর ভিতর কিসের গোলমাল, খানিকক্ষণ কান পেতে শুনলেম। স্ত্রীলোকের কন্ঠস্বর। স্বর বোলছে, “দেখ ঠাকুরপো, দেখ! তোমার দাদার কীর্তিখানা এসে দেখ; মামীর ঘরে রাসলীলা হোচ্ছে, তোমার দাদা দেই লীলার ঠাকুর হয়েছেন; দরজা খুলে একবার বেরিয়ে এসে দেখ!”
এই কথার পর একটা বদ্ধ দরজায় গুম গুম কারে শব্দ হোতে লাগলো; একটা দরজার খিলখোলা শব্দও আমি শুনতে পেলাম। তার পর আবার সেই পূর্বস্বরের উচ্চ ধ্বনি। ভূত-শাসনের পরদিন থেকে বড়বাবুর অনুমতিক্রমে বাড়ির বৌমা দুটি আমার সঙ্গে কথা কন; স্বরে বুঝলেম, বড়-বৌমার কণ্ঠস্বর। ডেকে ডেকে তিনি বোলছেন, “ডাকো ঠাকুরপো, ডাকো! চক্ষের উপর দেখ, এই ঘরেই তোমার দাদা! যেদিন থেকে ভূতের উপদ্রব থেমেছে, সেইদিন থেকেই এই রকম হোচ্ছে। দরকার আছে, কার্য আছে, বন্ধুর বাড়ী নিমন্ত্রণ আছে, এই রকম এক একটা অছিলা কোরে বড়বাবু রোজ রোজ সন্ধ্যাকালে বেরিয়ে যান, অনেক রাত্রে ফিরে আসেন, কিছুই আমি জানতে পারি না, তক্কে তক্কে থেকে আজ রাত্রে আমি ধোরে ফেলেছি; জেগেছিলেম, রাঙামামীর ঘরে দুজন মানুষের কথা শুনে, দুজনের হাসির শব্দ পেয়ে, বারান্দায় আমি বেরিয়েছি, কথার আওয়াজে মানুষটিকেও চিনতে পেরেছি; ডাকাডাকি কোল্লেম, কতবার দরজা ঠেল্লেম, কত বকাবকী কোল্লেম, এখন আর সাড়া-শব্দ নাই। নিশ্চয়ই এই ঘরে তোমার দাদা আছেন। কি কেলেঙ্কার! কি কেলেঙ্কার! ডাকো তুমি! দাদাকে ডাকতে সাহস না হয়, মামীকে ডাকো। সব ভুর আজ ভেঙে দিব!”
এই সব কথা আমি শুনলেম; শব্দে জানতে পাল্লেম, মামীর ঘরের দরজা খোলা হলো। বড়বাবু রেগে রেগে বোলতে লাগলেন, “কি— কিক্ক— কি? হয়েছে কি? অত হাঁকাহাঁকি ডাকাডাকি কিসের জন্য? রাঙামামীর পেটব্যথা কোচ্ছিল, যন্ত্রণায় ছটফট কোচ্ছিল, আমাকে ডেকেছিল, তাই আমি ওষুধের ব্যবস্থা কোত্তে এসেছিলেম; দেখো না এসে, ওষুধের শিশি! হয়েছে কি?”
বড়-বৌমা আবার চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে ব্যঙ্গ কোরে বোল্লেন, “আহাহা! কি আমার ডাক্তার গো! রসের নাগর, গুণের সাগর! পেটের ব্যথার ওষুধ দিতে এসেছিলেন! শোনো ঠাকুরপো, শোনো। তোমার দাদাবাবুর ডাক্তারী বিদ্যার পরিচয়টা একবার শুনে রাখো! ছি ছি ছি! ভদ্রলোকের বাড়ীতে এ কি কারখানা! গলায় দড়ী দিয়ে মোত্তে ইচ্ছা হয়!”
ছোটবাবুর কোন কথা আমি শুনতে পেলেম না; বড়বাবুও চাপ কোল্লেন, বোধ হলো যেন অন্যদিকে তিনি সোরে গেলেন। আবার বড়-বৌমার কণ্ঠস্বর। মামীকে লক্ষ্য কোরে তিনি বোলতে লাগলেন, “আর তোমাকেও বলি বাছা, তুমি রাঙামামী কুটুম্বুর মেয়ে, কুটম্বর বাড়ীতে রয়েছ, এ সব ঢলাঢলি কেমন কোরে কর? লজ্জা হয় না? ধিক্কি জীবন আর কি! মামী মায়ের সমান, ভাগ্নে সন্তান তুল্লি, ভাগ্নে নিয়ে এই সব কাণ্ড! দড়ী জোটে না? দড়ী কলসী নিয়ে আঘাটায় যাও। সব জ্বালা জুড়িয়ে যাবে; তোমারও যাবে, আমাদেরও যাবে। আমি না জানি কি? তোমাকে জানি, পায়রাকেও জানি, কি রকমে ভূতের নৃত্য হতো, তাও জানি, সব আমি জানি, হাঁস, পায়রা, হীরামন, পেঁচা, দাঁড়কাক, কত রকম ডাক্তার যে তোমার পেটের ব্যথার ওষধ দিতো, কিছুই আমার জানবার বাকী নাই! এখন কি না ঘরের ভিতর বৃন্দাবন বসালে! ভাগ্নে নিয়ে নীলে-খেলা! তুমি রাধা, তিনি শ্যাম! এইবার একটি কাঁদে বাড়ী বলরাম এলেই ঠিক হয়! কি ঠাকুরপো! বলরামের পালাটা গাইতে পারবে? ধিক— ধিক— ধিক! এখন আমাদের মরণই মঙ্গল!”
এই সময় ছোটবাবু বোধ হয়, কোন রকম থাবাথুবি দিয়ে গোলমালটা থামিয়ে দিলেন, আর কোন উচ্চবাচ্য আমি শুনতে পেলেম না। খানিকক্ষণ সমস্তই চুপচাপ; চুপি চুপি ফিরে এসে ঘরের দরজা বন্ধ কোরে বিছানার উপর আমি বোসলেম। অনিচ্ছায় আমার নাসারন্ধ্র থেকে দুটি নিশ্বাস বহির্গত হলো। কি পাপের ভোগ! ভাগ্যশেষে এমন বাড়ীতেও আমি বাস কোচ্ছি! রক্তবিচার নাই! ওঃ! সেই কথাই বটে বড়-বৌমা ঠিক ধোরেছেন! আমার মনে মনেও একটা খটকা ছিল! ঔষধের মোড়ক নিয়ে আমি রাঙামামীর দৌত্যকার্য কোরেছিলেম! কিসের ঔষধ, এখন আমি বুঝলেম। পায়রাবাবুই রাঙামামীর প্রেমের নাগর! কেবল একটি নয়, বৌমার কথায় তাও আমি বুঝতে পাল্লেম। পালায় পালায় ছাদের উপর অনেক রকম ভূত এসে দক্ষযজ্ঞ ভোগ কোত্তো! ভূতের পালা এখন ফুরিয়ে গিয়েছে, এখন ঘরে ঘরেই বৃন্দাবন! ও! কত দিনে যে এই পাপপুরী থেকে আমি পরিত্রাণ পাব, কিছুই বুঝতে পাচ্ছি না। দুরাচার রক্তদন্ত কত রকম পাপের মূর্তি যে আমাকে দেখাচ্ছে, কত রকম পাপ-কথাই আমাকে শুনাচ্ছে, আমার অন্তরাত্মাই তা জানতে পাচ্ছেন। আবার আমার নাসারন্দ্রে অগ্নিশিখা তুল্য তিনটি দীর্ঘনিশ্বাস বহির্গত।
বোসে বোসেই আমি রজনীপ্রভাত কোল্লেম। প্রভাতে রামদাস এসে ঘরের কাজগুলি সেরে দিয়ে গেল। রাত্রে কিছু আমি জেনেছি, কিছু আমি শুনেছি, রামদাসকে সে সব কথা কিছু আমি বোল্লেম না। ক্রমে ক্রমে বেলা হলো; কথায় কথায় আমি শুনলেম, শেষরাত্রে বড়বাবু কোথায় চোলে গিয়েছেন, কেহই কিছু বোলতে পারে না। দিন গেল, সন্ধ্যা হলো, রাত্রি এলো, বড়বাবু বাড়ী এলেন না। সকলেই উদ্বিগ্ন। কর্তাগৃহিণী বাড়িতে নাই, বড়বাবু কর্তৃত্ব কোচ্ছিলেন, তিনিও অদৃশ্য! আমার মনে কিছু ভয়ের সঞ্চার হলো! সর্বদাই আমি চিন্তাযুক্ত।
এই ঘটনার পর আট দশ দিন অতিক্লান্ত। বড়বাবুর দেখা নাই। মামীর ঘরে বৃন্দাবন-লীলার রজনীতে যে সকল কাণ্ড হয়েছিল, এই আট দশ দিনের মধ্যে সে প্রকাণ্ড কাণ্ডের কোন কথা কাহার মুখে প্রকাশ পেলে না; তুষারাবৃত আগ্নেয়গিরির ন্যায় বাহিরে বাহিরে বাড়ীখানা এক রকম ঠাণ্ডা। বোল্লেম আমি ঠাণ্ডা, কিন্তু আমার ভাগ্য-চক্রের ঘর্ষণে এক অভাবনীয় অগ্নিস্ফুলিঙ্গের উৎপত্তি! সেই রুদ্রাক্ষগ্রামেই বড়-বৌমার পিত্রালয়। একটি ভ্রাতুষ্পুত্রের অন্নপ্রাশন উপলক্ষে বৌমা পিত্রালয়ে যাবেন, রামদাস তাঁর সঙ্গে যাবে, রামদাসের মুখে সেই কথা আমি শুনলেম। আমার মনটা কেমন খারাপ হয়ে গেল। এই দূরন্ত সংসারে বড়বাবু আমার প্রতি সদয়, ছোটবাবু আমার বন্ধু, আমার প্রতি বড়-বৌমার পুত্রতুল্য স্নেহ, রামদাসটিও আমার বিশেষ অনুগত, বাধ্য; বড়বাবু কোথায় চোলে গিয়েছেন, বড় বৌমাও বাড়ীতে থাকছেন না, রামদাসও থাকছে না। বোলতে গেলে আমি এক রকম অসহায় হব। কেন ভাবি অসহায়? —অকস্মাৎ যদি কোন বিপদ ঘটে, ছোটবাবুটি ছাড়া আর কাহাকেও আমি রক্ষাকর্তা পাব না— আর কেহই আমার সহায় হবে না। ছোট-বৌমাটি ছেলে-মানুষ, যদিও তাঁর স্বভাব অতি নির্মল, তথাপি সংসারের কোন কার্যে তাঁর তাদৃশ হাত নাই। কেন এটা আমি ভাবলেম, বিপৎপাতের ভাবী আশঙ্কা হঠাৎ কেন আমার মনে এলো, সে কথা আমি বোলতে পারি না। ঘুঘুর বাসায় আমি আগুন দিয়েছি, কুকুরের মুখোসে গুলী কোরে ভূতের বাসা ভেঙ্গে দিয়েছি, রাঙ্গামামী আমার শত্রু হয়ে আছেন, অভিসারিকার কুৎসিত অভিলাষে আমি উপেক্ষা কোরেছি, রূপসী আমার শত্রু হয়ে আছে, বড়-বৌমা বাড়ী থেকে চোলে গেলে কি জানি কে কোন দিক থেকে কি প্রকার ফ্যাঁসাদ বাধায়, সেই জন্যই আমার ভয়। ভয়ত্রাতা মধুসূদন। বিপদ্বারণ মধুসূদনকে স্মরণ কোরে সে ভয়টা তখন আমি চেপে রাখলেম।
যে দিন আমি এই সব কথা ভাবলেম সত্য সত্যই রামদাসকে সঙ্গে কোরে বড়বৌমা সেইদিন বৈকালে ভ্রাতুষ্পুত্রের অন্নপ্রাশন দেখতে গেলেন। তিনদিন আসবেন না, রামদাসের মুখে সে কথাও আমি শুনেছিলেম। বেলাটুকু চোলে গেল, রামদাস নাই, রূপসী আসে না, সেই পাচিকাই সন্ধ্যাকালে আমার ঘরে আলো দিলেন, রাত্রিকালে আহারের পূর্বে যা কিছু আবশ্যক, সেই প্রাচীনার দ্বারাই অগত্যা আমি সেগুলি সাধন করাতে বাধ্য হোলেম। পরদিন প্রভাতেও তিনি আমার গৃহকার্য নির্বাহ কোরে দিলেন। বেলা দুই প্রহর পর্যন্ত আমি এক প্রকার গৃহশান্তি উপভোগ কোল্লেম; সন্ধ্যার পরে বিনামেঘে বজ্রপাত!
আহারান্তে ছোটবাবুর সঙ্গে আমি বেড়াতে বেরিয়েছিলেম, সন্ধ্যার পর ফিরে এসে দেখি, যে ঘরে আমি থাকি, সেই ঘরে আমার বিছানার উপর দুটি লোক; —একটি যুবা, আর একটি অর্ধ বৃদ্ধ। দরজার কাছে বাড়ীর দাসী আর পাচিকা। লোক-দুটির বদন গম্ভীর। আমরা আসবার পূর্বে কি তাঁরা বলাবলি কোচ্ছিলেন, আমাদের দেখে হঠাৎ থেমে গেলেন। লোক-দুটিকে পূর্বে আমি দেখি নাই, গৃহে আমরা প্রবেশ করবামাত্র তাঁরা পরস্পর মুখে-চাহাচাহি কোরে কেমন একপ্রকার ভ্রকুটী-ভঙ্গীতে আমার দিকে চেয়ে রইলেন। তাঁদের সেই গম্ভীর বদনে সেই সময় একপ্রকার বিকৃতভাব লক্ষিত হলো। রূপসীর মুখে চক্ষে উল্লাসলক্ষণ দেখলেম, বিজয়োল্লাসে বীরপুরুষের মুখ-চক্ষু যেরূপ প্রফুল্ল হয়, ঠিক্ যেন সেইরূপ; ভাব আমি কিছুই বুঝতে পাল্লেম না।
ছোটবাবুর দিকে চেয়ে সেই দুটি লোকের মধ্যে একটি লোক যেন কিছ উদাসীনভাবে বোলেন, “বসো মিহিরচাঁদ।—বস্,” এই পর্যন্ত কথা; আমারে কেহই কিছু, বোল্লেন না। ছোটবাবু বোসলেন। উদ্বেগযুক্ত হয়ে আমিও তাঁর কাছে বোসলেম। আমার দিকেই লোকদুটির ঘন ঘন দৃষ্টি। কিয়ৎক্ষণ সকলেই নীরব। নূতন লোকেরা কি জন্য এসেছেন, ছোটবাবু সেই কথা জিজ্ঞাসা কোরবেন, উপক্রম কোচ্ছেন, এমন সময় একটি বাধা। লোকটি এক নিশ্বাস ফেলে হঠাৎ বোলে উঠলেন, “দিন যায় ত ক্ষণ যায় না। কার মনে যে কি আছে, কে যে কখন কি করে, বুঝে উঠা ভার! দিনের বেলা বাড়ীতে চুরি হয়েছে, বড় আশ্চর্য কথা।”
যে লোকটির বয়স অধিক, তিনি প্রথম বক্তা। ছোটবাবুর বিস্ময়সূচক প্রশ্নে তিনি উত্তর কোল্লেন, “হাঁ গো, তোমাদেরই বাড়ী,—তোমারই ঘরে! স্নান করবার সময় ছোট-বৌ-মা গলার হারছড়াটি খুলে একটা তাকের উপর রেখেছিলেন, বৈকালে চুলে বাঁধবার সময় খুঁজে দেখলেন হারছড়াটি নাই। তুমি বাড়ীতে ছিলে না, তোমার মামী, পাচিকা ব্রাহ্মণী, বৌমা নিজে আর ঐ রূপসী অনেক জায়গায় অনেক খুঁজেছে, কোথাও সে হার নাই। তোমার মামীর আদেশে রূপসী ছুটে গিয়ে আমাকে সংবাদ দিয়েছিল, বরদাকান্তকে সঙ্গে কোরে তাই আমি এখানে এসেছি। ব্যাপারখানা কি, কিছুতেই তো জানা যাচ্ছে না। ঘরের ভিতর থেকে জিনিস গেল, কেহই খোঁজে পেলে না, এ বড় আশ্চর্য কথা! এসে আবার শূনলেম, রূপসী বোল্লে, ‘সেই ঘরে পালঙের নীচে জলখাবার দুটি গেলাস ছিল, তাও পাওয়া যাচ্ছে না।’ তাজ্জব ব্যাপার! দিনের বেলা বাড়ীর ভিতর কি চোর প্রবেশ কোরেছিল? বাড়ীতে এখন বেশী লোক নাই, এ কাৰ্য কার তবে?”
পূর্ণ বিশ্বাস না কোরে একটু তাচ্ছল্য-ভাবে ছোটবাবু বোল্লেন, “আছে হয় তো কোথায়, কে হয় তো কোথায় রেখেছে, এখন মনে কোত্তে পাচ্ছে না, একটা ভাল কোরে খুঁজলেই পাওয়া যাবে; চুরি কোত্তে কে আসবে?”
তিন পা এগিয়ে এসে, হাত নেড়ে নেড়ে রূপসী বোলতে লাগলো “খুঁজতে কি আর আমরা বাকী কোরেছি? তন্ন তন্ন কোরে খুঁজেচি; কোথাও নাই! কোথাও নাই! নিশ্চয় চুরি গিয়েছে! ছোট ছোট সিকি আধূলি নয়, দুটো একটা পয়সা নয়, মস্ত একছড়া দামী হার, বড় বড় দুটো জলের গেলাস, কোথায় লুকিয়ে থাকবে? উড়ে যাবে কি?”
বিরসবদনে পাচিকা ঠাকুরাণী মৌনবতী। ছোটবাবু চিন্তাযুক্ত। আমি বিস্ময়াপন্ন। কথায় কথায় আমি জানতে পাল্লেম, দুটি আগন্তুক ভদ্রলোকের মধ্যে যিনি বয়োধিক, তিনি এই গ্রামের একজন বদ্ধির্ষ্ণু লোক; — দলপতি; বরদাকান্তটি তাঁর কনিষ্ঠ সহোদর। পল্লীগ্রামে কোন প্রকার অকু ঘটনা হোলে গ্রামের মোড়ল-চৌকিদারকে মধ্যস্থ রেখে তদারক করা হয়, সেই হিসাবে এই দলপতি-মহাশয় এই গ্রামের মোড়ল; নাম রূপচাঁদ ভঞ্জ। রূপসীর বাক্যাবসানে ছোটবাবুকে সম্বোধন কোরে ভঞ্জবাবু বোল্লেন, “কথাও ত ঠিক্ বটে; ছোট-খাটো জিনিস নয়, বড় বড় জিনিস, ঘরের ভিতর কোথাও থাকলে কেনই বা খুঁজে পাওয়া যাবে না? চল দেখি যাই, তুমিও চল, রূপসীও চলুক, ব্রাহ্মণীও চলুন, আমিও তোমাদের সঙ্গে যাচ্ছি। ভাল কোরে অন্বেষণ কোল্লে, বোধ হয়, পাওয়া যেতে পারে। তাতেও যদি না পাওয়া যায়, তবে নিশ্চয় চুরি; নিশ্চয়ই চোরের কাজ।”
দলপতিবাবু এই কথাগুলি যখন বলেন, তখন কটমট চক্ষে বারকতক আমার দিকে চেয়েছিলেন; ভিতরে ভিতরে রেগেছিলেন, দন্তে দন্তঘর্ষণের কড় মড় শব্দও আমার কর্ণে এসেছিল। আমি কিন্তু এতক্ষণের মধ্যে একটিও কথা কই নাই, কেহ আমাকে কোন কথা জিজ্ঞাসাও করেন নাই, বাবুদের মুখের দিকে চেয়ে চুপ কোরে আমি বোসে ছিলেম। দলপতির অনুরোধে ছোটবাবু উঠে দাঁড়ালেন, দলপতিও উঠলেন, বরদাকান্ত বোসে থাকলেন। যাবার সময় পশ্চাতে একবার চেয়ে ছোটবাবু আমারে বোল্লেন, “যাবে হরিদাস? এসো!”
মুখ ফিরিয়ে সচকিতে দলপতি জিজ্ঞাসা কোল্লেন, “কারে তুমি ডাকছো?— কে যাবে?—হরিদাস?— কে হরিদাস?”
আমার দিকে হস্তনির্দেশ কোরে ছোটবাবু উত্তর দিলেন, “এই ছোকরার নাম হরিদাস; এটি এখন আমাদের বাড়ীতেই আছে; বেশ ছোকরা, স্বভাব-চরিত্র বড় ভাল; চরিত্রে কিছুমাত্র দোষ নাই।”
মুখ ভারী কোরে বক্রদৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে দলপতি-মহাশয় ছোটবাবুকে বোল্লেন, “না না, অন্যলোকের সেখানে যাবার কোন দরকার নাই; তোমাতে আমাতে গেলেই চোলবে; এসো তুমি।”
দলপতির সঙ্গে ছোটবাবু অন্দরের দিকে গেলেন, ঘনপদক্ষেপে সর্বাঙ্গ সঞ্চালন কোরে রূপসী তাঁদের সঙ্গে সঙ্গে চোল্লো; সর্বপশ্চাতে ব্রাহ্মণী-ঠাকুরাণীও চোল্লেন। ঘরে থাকলেম আমি আর বরদাকান্ত।
আমি আর বরদাকান্ত। উভয়ের নিকটে উভয়েই আমরা অপরিচিত। পরিচয়ের অবসর উপস্থিত। আমার পরিচয় যৎসামান্য। বিদেশী বালক, নানা বিপাকে ঠেকে নানা স্থান পর্যটন কোরে গ্রহগতিকে এই গ্রামে এসে উপস্থিত হয়েছি, এই বাড়ীতেই আছি, এই পর্যন্ত আমার পরিচয়; বরদাকান্তের পরিচয় পূর্বে একটু প্রকাশ হয়েছিল, দলপতিবাবুর সহোদর তিনি; কোথাও কাহারো চাকুরী করেন না, সর্বদা বাড়ীতেই থাকেন, পিতার একখানি তালুক আছে, সেই তালুক-সংক্রান্ত বিষয়কৰ্ম দেখেন শুনেন, স্বহস্তেও লেখাপড়া করেন। পরিচয় এই পর্যন্ত। অতঃপর আর কি কথা? —নূতন লোকের সঙ্গে নূতন কথা আমার কিছুই ছিল না, কিন্তু দুজনে এক স্থানে বোসে চুপ কোরেও থাকা যায় না; প্রসঙ্গ-শূন্য দুটি একটি ফাঁকা ফাঁকা কথা তাঁরে আমি বোলছি, তিনি এক একবার হু হাঁ দিচ্ছেন, এক একবার চুপ কোরে থাকছেন; এক একবার আমি তাঁর মুখের দিকে চাচ্ছি, দেখতে পাচ্ছি, কথার দিকে তাঁর মন নাই। কোন বিষয় শ্রবণ কোত্তে কোত্তে শ্রোতার মনে ঘৃণার সঞ্চার হোলে তাঁর মুখের ভাব যেমন হয়, বরদাকান্তের মুখের ভাব তখন সেই প্রকার। কটাক্ষভঙ্গীতে যখন তিনি আমার প্রতি দৃষ্টিপাত করেন, তখন সেই কটাক্ষে বিলক্ষণ ঘৃণার লক্ষণ প্রকাশ পায়। মনে মনে আমার সন্দেহের উদয়।
কেন তিনি আমারে ঘৃণার চক্ষে দেখেন? তাঁর চক্ষে আমি নূতন, আমার চক্ষেও তিনি নূতন মানুষ, এ ক্ষেত্রে ঘৃণার ভাব কেন আসে? নূতন দর্শনে পরস্পর অনুরাগ-বিরাগ একপ্রকার অস্বাভাবিক। নাটক-নবন্যাসে দুই একটি নায়ক-নায়িকার প্রথম-দর্শনে অভাবনীয় অনুরাগলক্ষণ পাঠ করা যায় বটে, কিন্তু প্রকৃতির সঙ্গে সে লক্ষণের তাদৃশ মিলন অনুভূত হয় না। সেই কথাই আমি ভাবছি, ছোটবাবুর সঙ্গে দলপতি মহাশয় সেই ঘরে ফিরে এলেন। দলপতির মুখখানা তখন অত্যন্ত ভার ভার; ছোটবাবুর মুখে সংশয়মাখা। দরজার দিকে আমি চেয়ে দেখলেম, এক ধার থেকে কে একজন উঁকি মেরে মেরে দেখছে। ভাল কোরে দেখে চিনলেম, উঁকি মারছিল রূপসী, রূপসীর চক্ষু যেন তখন কি আহ্লাদে ফিক ফিক কোরে হাসছিল, ভাব কিছু আমি বুঝতে পাল্লেম না।
একটা কর্তব্যকর্ম সমাধা কোরে যাঁরা ফিরে এলেন, তাঁদের মুখ দেখে সে কার্যের ফলাফল কিছুই বুঝা গেল না; ফলটা ভাল কি মন্দ, কিছুই প্রকাশ পেলে না। অনুমানে আমি যেন মন্দটাই ভেবে নিলেম। তাঁরা বোসলেন না, স্তম্ভিতভাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গুটিকতক কথা বলাবলি কোল্লেন। সে সব কথার মর্ম এইরূপ:— “কর্তার ঘরে চাবি বন্ধ, বড়বাবুর ঘরেও চাবি বন্ধ, যে কয়েকটি ঘর খোলা আছে, সেই সব ঘরে তল্লাস করা হয়েছে, চোরা জিনিস পাওয়া যায় নাই। বরদাবাবুকে সম্বোধন কোরে রূপচাঁদবাবু বোল্লেন, তোমরা একবার নেমে দাঁড়াও; এই ঘরটা একবার অন্বেষণ কোত্তে হবে।” বরদাবাবু বিছানা থেকে নামলেন, আমারে কেহই কিছু বোল্লেন না, তথাপি আমিও নামলাম।
রূপচাঁদবাবু স্বয়ং আমার বিছানাটী উলট-পালট কোরে বিশেষরূপে নিরীক্ষণ কোল্লেন, কিছুই দেখতে পেলেন না। শেষকালে আমার মাথার বালিশের ওয়াড় খুলে অন্বেষণ করবার সময়ে ওয়াড়ের ভিতর থেকে একছড়া হার সোরে পোড়লো। বিস্ময়ব্যঞ্জক চীৎকারস্বরে অনুসন্ধানকারী বোলে উঠলেন,— “এই বটে! এই বটে! দেখ দেখি তোমরা, এই সেই হার কি না?”
ছোটবাবুর মুখখানি এই সময় অত্যন্ত ম্লান হয়ে এলো। ম্লাননয়নে তিনি একবার আমার মুখের দিকে চাইলেন। তাঁর চক্ষু দুটী যেন ছল ছল কোত্তে লাগলো। নেত্রপ্রান্তে অশ্রুবিন্দুও দেখা গেল। রূপসী সেই সময় ছুটে এসে হার-ছড়াটা হাতে কোরে নিয়ে ত্বরিতস্বরে বোল্লে, “এই সেই হার, এই সেই হার। বাপ্ রে! আমার প্রাণে যে ভয় হয়েছিল, সে কথা আর বোলতে পারি না; চাকরাণী-মানুষ আমি, গরীবের মেয়ে, বাড়ীর লোকেরা হয় তো মনে কোচ্ছিলেন, আমিই চুরি কোরেছি। ধর্ম আছেন কি না, চারিযুগের সাক্ষী তিনি; আমার কোন পুরুষে চোর নয়, ধর্মের কাছে আমি খাঁটী আছি। ধর্মের বিচারে ধর্মে ধর্মে আজ রক্ষা পেলেম।”
এই সব কথা বোলতে বোলতে কেমন একপ্রকার নয়নভঙ্গী কোরে রূপসী বার বার আমার দিকে চাইতে লাগলো; খানিকক্ষণ কি একটু ভেবে ভেবে আবার বোলে উঠলো, “হার যখন এ ঘরে পাওয়া গিয়েছে, গেলাস-দুটোও তবে এই ঘরেই পাওয়া যাবে। দেখ তোমরা ভাল কোরে; খোঁজ তোমরা ভাল কোরে। এই ঘরেই পাওয়া যাবে। আমার যেন মনে নিচ্ছে, এই ঘরেই—”
আর তারে বেশী কথা বোলতে না দিয়ে দলপতি-মহাশয় ঘরের এধার ওধার, শয্যাতল, গবাক্ষতল, সমস্ত স্থান অন্বেষণ কোল্লেন, পাকলচক্ষে ঘন ঘন আমার দিকে চাইলেন, অন্বেষণ বিফল হলো। গেলাস পাওয়া গেল না।
ঘরের উত্তর দেয়ালে এক হাত লম্বা এক হাত চওড়া একখানা তক্তা ঢাকা; এ বাড়ীতে এসে অবধি সেই তক্তাখানা আমি দেখে আসছি। কেন যে সে তক্তা সেখানে আছে, তক্তার ভিতর কি বস্তু যে রক্ষিত আছে, একদিনের জন্যও সেটা আমার জানবার ইচ্ছা হয় নাই; খুলিও নাই, দেখিও নাই, জানিও না, জানতেমও না। হন হন কোরে চোলে গিয়ে রূপসী সেই তক্তাখানা খুলে ফেল্লে, একধারে কবজা আঁটা ছিল, তক্তাখানা ঘুরে এসে দেয়ালের গায়ে লাগলো, ভিতরটা ফাঁক হয়ে গেল;— ছোট একটী কুলুঙ্গী,— সেই কুলুঙ্গীর ভিতর দুটী বড় বড় কাঁসার গেলাস।
“এই যে গেলাস! এই যে গেলাস! যা আমি মনে কোরেছিলাম, ঠিক তাই মিলে যাচ্ছে। কার মনে যে কি আছে, কে বোলবে? রাঙামামী বোলছিলেন, হরিদাস তেমন ছেলে নয়; আমি তো জানতেন, তেমন হরিদাস নয়; কিন্তু এখন, ধর্ম সে কথা শুনবেন কেন? হাতে নাতে ধোরিয়ে দিলেন।”
রূপসীর কথা শুনে ঠক ঠক কোরে আমি কাঁপতে লাগলেম, হঠাৎ আমার যেন বাক্রোধ হয়ে এলো, একটী কথাও বোলতে পাল্লেম না; চেষ্টা কোল্লেম কিছু বলবার, কথা আসলে ফুটলোই না; ললাটে বিন্দু বিন্দু ঘর্ম। ভাবতে লাগলেম, একি আশ্চর্য ব্যাপার! এ সব জিনিস আমার ঘরে কেমন কোরে এলো? কে এমন শত্রুতাবাদ সাধলে? কার কাছে আমি কি অপরাধী হয়েছিলেম? ভগবান আমার ভাগ্যে কেন এমন ঘটালেন? ওঃ! বৃথা কলঙ্কের আগুনে কেন আর দগ্ধ হও? বাহির হও! রাত্রিকাল, অন্ধকারে অন্ধকারে এই বেলা বাহির হয়ে যাও! কল্যকার সূর্য যেন আমার এই কলঙ্কিত বদন দর্শন না করেন!
ভাবলেম অনেক। কতই যে ভাবলেম, ভেবে কিছু কূল-কিনারা পেলেম না। ভাবলেই বা কি হবে? লোকে আমার কথা শুনবে কেন? এত বড় প্রমাণের সম্মুখে লোকে আমার মনোবেদনা বুঝবেই বা কেন? চুতুর্দিক যেন আমি অন্ধকার দেখতে লাগলেম। যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেম, সেখান থেকে আর এক পাও নড়তে পাল্লেম না। দুটী চক্ষু দিয়ে অনবরত জলধারা গড়াতে লাগলো।
আমারও যেমন বাকরোধ, ছোটবাবুরও প্রায় সেইরূপই বাকরোধ হয়েছিল। মোড়লবাবুর উগ্রমমূর্তি দর্শন কোরে উগ্রমূর্তি শ্রবণ কোরে, তিনি তখন অল্প অল্প কম্পিত-কণ্ঠে বোল্লেন, “শুনলেম সব; শুনলেম সব, কিন্তু বুঝলেম না কিছুই, হরিদাস চোর, কিছুতেই আমার বিশ্বাস হোচ্ছে না। এতদিন রয়েছে, একদিনও হরিদাসের স্বভাবে বিন্দুমাত্রও দোষ আমি দেখি নাই; অকস্মাৎ চোর হবে, কিছুতেই আমার বিশ্বাস হয় না; বোধ হয়, এ কাণ্ডের ভিতর কাহার কুচক্র থাকতে পারে।”
আমি সেই সময় একটু সাহস পেয়ে ছোটবাবুর দুটি পায়ে জোড়িয়ে ধোল্লেম, চক্ষের জলে পা-দুখানি ভিজিয়ে দিলেম, কম্পিত-স্তম্ভিত স্বরে বোল্লেম, “দোহাই ছোটবাবুর! দোহাই ধর্মের! আমি চোর নই; কিছুই আমি জানি না, আমারে নষ্ট করবার মতলবে কে যে এই কুচক্রের সৃষ্টি কোরেছে, কিছুই আমি বুঝতে পাচ্ছি না; আপনি আমারে রক্ষা করুন! দোহাই আপনার থানায় খবর দিবেন না, থানায় আমারে পাঠাবেন না! বহু যন্ত্রণা আমি সহ্য কোরেছি, তত যন্ত্রণা পেয়েও জন্মাবধি আমি নিষ্কলঙ্ক, থানার হাতে সোঁপে দিলে কখনই আমি বাঁচবো না; ঘৃণায়, অপমানে, মিথ্যা অপবাদে প্রাণ আমার আপনা হোতেই ঠিকরে বেরিয়ে যাবে!”
আমার সকরুণ রোদনে অন্তরে ব্যথা পেয়ে, দলপতির দিকে চেয়ে, গদগদবচনে ছোটবাবু তখন বোল্লেন, “আপনি আমাকে ক্ষমা করুন, জিনিসগুলি হরিদাসের ঘর থেকে বেরিয়েছে, যদিও স্বচক্ষে আমি দেখলেম, তথাপি হরিদাসকে চোর বোলতে আমার মন চায় না। হরিদাসকে আমি থানায় দিতে পারবো না; যেখান থেকেই যা হোক, জিনিসগুলি পাওয়া গিয়েছে এই মঙ্গল, হরিদাসকে পীড়ন কোত্তে আদৌ আমার ইচ্ছা নাই।”
মোড়লবাবু রেগে উঠলেন; আসনত্যাগ কোরে দাঁড়িয়ে উঠে সক্রোধে বোলতে লাগলেন, “ইচ্ছা নাই? যদি ইচ্ছা নাই, তবে তোমার বাড়ীর মেয়েরা আমাকে খবর দিয়েছিল কেন? ডেকে পাঠিয়েছিল কেন? ঘরে ঘরে মিটমাট কোরে ঘরের ভিতর চোর পুষে রাখলেই তো ঠিক হতো, ডেকে এনে অপমান করা কি জন্য? থানায় তুমি যাবে না? চোরকে তুমি থানায় তবে দিবে না? আচ্ছা! আচ্ছা! থাক তবে। তুমি বুঝি মনে কোচ্ছো, আমার কান ক্ষমতা নাই? থানার দারোগা আমার আজ্ঞাকারী, মেজেষ্টার সাহেবের ডান হাত আমি, আমার পরামর্শ নিয়ে মেজেষ্টার সাহেব কাজ করে। আমার কথায় চোরকে তুমি থানায় দিতে রাজী নও? —আচ্ছা, আমি তবে চোল্লেম, দেখি, চোরকে তুমি কেমন কোরে রক্ষা কর! এসো হে বরদা! ঝকমারী কোরেছিলেম— এসেছিলেম, এসো!”
সরোষগর্জনে এই সব কথা বোলতে বোলতে মহাপ্রতাপশালী দলপতিমহাশয় চঞ্চলপদে ঘরের চৌকাঠ পর্যন্ত অগ্রসর হোলেন। চঞ্চলপদে পশ্চাতে ধাবিত হয়ে তাঁর দুখানি হাত ধোরে মিনতিবচনে ছোটবাবু বোল্লেন, “রাগ কোরবেন না মহাশয়, রাগের কথা নয়, যে সব কথা আমি বোল্লেম, ভাল কোরে আপনি বিবেচনা করুন। যদি ঠিক ঠিক প্রমাণ হয়, অগত্যা থানার সাহায্য গ্রহণে আমি অসম্মত হব না; এখনো আমার সন্দেহ দূর হয় নাই, বিষম সন্দেহ আছে। হরিদাসের চরিত্র আপনি জানেন না, সেইজন্যই এত ব্যস্ত হোচ্ছেন; আমরা সকলেই জানি, হরিদাসের স্বভাব নিষ্কলঙ্ক। কর্তা বাড়ী নাই, দাদা বাড়ীতে নাই, বড়-বৌটিও পিত্রালয়ে; তাঁরা আসুন, ইতিমধ্যে আমি আরও ভাল কোরে তত্ত্বটা জানি, যে তত্ত্ব আজ প্রকাশ পেলে, এ তত্ত্বের বিপরীত যদি কিছু প্রকাশ না হয়, তা হোলে—”
বিরক্ত হয়ে ভঞ্জবাবু বোলে উঠলেন, “তত্ত্ব আবার জানবে কি? তত্ত্ব জানবার আর বাকী কি? তোমার মামীও বোল্লেন, এই দাসীটিও বোল্লে, আজ বৈকালে এই ছোকরা ছোট-বৌমার ঘরে প্রবেশ কোরেছিল, অনেকক্ষণ সেই ঘরে ছিল; স্বকর্ণেই শুনে এলে, সে প্রমাণের উপর বিপরীত প্রমাণ তুমি আর কি জানতে চাও? আমি বাপু, তোমাদের ওসব কথার ভিতর আর থাকতে চাই না, চোর-ডাকাত ধরা যাদের কাজ, তারা যা জানে, তাই কোরবে, আমি এখন রিপোর্ট দিয়ে—”
শেষকথা না শুনেই অধিক ব্যগ্রতা জানিয়ে ছোটবাবু বোল্লেন, “না মহাশয়! ও কাজ আপনি কোরবেন না; রিপোর্ট এখন পাঠাবেন না। বাড়ীর ভিতর বৌমানুষের ঘরে দিনের বেলা চুরি, এ কথাটা অনেক রকমে ঘোরে; কলঙ্কের ভয় আছে, রিপোর্ট আপনি এখন পাঠাবেন না; হরিদাস বরং এখন এই ঘরের মধ্যেই আটক থাকুক, ঘরের দরজায় আমি সর্বদা চাবীবদ্ধ রাখবো, এই ঘরটাই এক রকম হাজত-গারদ হবে, হরিদাস কোথাও যেতে পাবে না, যদি পালায়, হাজির করবার জন্য আমি দায়ী থাকবো, থানা জানাজানিতে এখন দরকার নাই; অনুগ্রহ কোরে আপনি আমার এই প্রস্তাবে সম্মতিদান করুন।”
কিঞ্চিৎ শুভগ্রহ। সরলমনে না হউক, আন্তরিক অনিচ্ছায় দলপতিমহাশয় কিঞ্চিৎ ক্রোধ সংবরণ কোল্লেন, ছোটবাবুর অনুরোধে তিনি আমারে তত শীঘ্র পুলিশে পাঠাতে জিদাজিদি কোল্লেন না, ঘরের গারদে আটক রাখাই সাব্যস্ত হলো, বরদাকান্তকে সঙ্গে নিয়ে ভঞ্জবাবু বিদায় হোলেন। ঘরের গারদেই আমি বন্দী হয়ে থাকলেন। আমি পালাবো না, ছোটবাবু, সেটি জানতেন, দিনের বেলায় চাবী দিতেন না, রাত্রিকালে আহারাদির পর চাবী বন্ধ হতো। তিন দিন তিন রাত্রি এই রকম।
চতুর্থ দিবসে বড়বৌমা বাড়ী এলেন, রামদাসও এলো। রামাদাসকে দোসর পেয়ে আমি অনেকটা ভরসা পেলেম। চোর অপবাদে ঘরের ভিতর আমি কয়েদ, বড়বৌমা সে কথা শুনলেন। যেমন যেমন হয়েছিল, তার উপর দশটা ডালপালা দিয়ে সাজিয়ে রাঙামামী তাঁর কাণ ভারী করবার— মন ভারী করবার চেষ্টা পেলেন; রূপসীও তাতে বাতাস দিলে, বড়বৌমা সে সব কথায় কিরূপ উত্তর দিয়েছিলেন, সে সব আমি শুনতে পেলেম না। রামদাসের মুখে শুনলেম, ছোটবৌমা বোলেছেন, “যেদিনে চুরী হয়, সেদিন বৈকালে হরিদাস আমার ঘরে প্রবেশ করে নাই।” তিনি আরো বোলেছেন, “হরিদাস চুরী কোরবে, এমন কথা তিনি মনের কোণেও স্থান দেন না।” এ সংবাদেও আমার একটু ভরসা হলো। ধর্মে যার অকপট বিশ্বাস, ধর্ম তারে রক্ষা করেন, চিরদিন এইরূপে আমার ধারণা; শাস্ত্রে কবিবাক্যেরও সেইরূপ মর্ম; সেই বিশ্বাস উদ্দেশে ধর্মদেবকে নমস্কার কোরে ভক্তিভাবে ভগবান দীনবন্ধুর করুণাময় নাম আমি জপ কোত্তে লাগলেম।
এক গৃহস্থের এক গৃহমধ্যে আমি কয়েদ; রামদাস ছিল না, কথার দোসর পেতেম না, পাচিকা ব্রাহ্মণী দুইবেলা আমার আহারসামগ্রী দিয়ে যেতেন, সর্বদাই তাঁর মুখখানি আমি বিষণ্ণ বিষণ্ন দেখতেম। বিষণ্ণনয়নে আমার মুখের দিকে তিনি চেয়ে চেয়ে থাকতেন, কথা কইতেন না; দিবারাত্রি আমি একাকী থাকতেম। তিন দিন এই রকমে কেটেছিল। এখন রামদাস এসেছে, রামদাস মাঝে মাঝে আমার ঘরে আসে, দুটি পাঁচটি কথা কয়, আমি চোর হয়েছি, রামদাস সে কথায় বিশ্বাস করে না, আমার অবস্থা দেখে বরং দুঃখ প্রকাশ করে। রাত্রিকালে যখন চাবী বন্ধ হয়, তখন আর রামদাস আসতে পায় না। রাত্রেই আমার ভীষণ যন্ত্রণা।
চিন্তা করা আমার অভ্যাস। ভগবান আমারে যত চিন্তা দিয়েছেন, তত চিন্তা বোধ হয়, আর কাহাকেও দেন নাই। চিন্তা ভগবান দেন কি মানুষে দেয় কি আপনাআপনি আসে, সে তত্ত্ব আমি জানি না; কিন্তু শৈশবে যখন গুরগৃহে ছিলেম, তখন অবধিই আমার চিন্তা করা শিক্ষা হয়েছে; দুশ্চিতাই অধিক; স্বভাবতঃ শুভচিন্তা আসে বটে, কিন্তু শুভঘটনা আমার ভাগ্যে প্রায়ই ঘটে না, কাজে কাজে শুভচিন্তাগুলি জলবিম্বের ন্যায় অন্তরেই মিলিয়ে যায়। কিঞ্চিৎ জ্ঞানোদয় হবার সঙ্গে সঙ্গে চিন্তা আমারে অধিকার কোরেছে, অবিচ্ছেদে আমার হৃদয়ে আশ্রয় নিয়েছে, রাত্রিকালে অধিক পরাক্রম প্রকাশ করে। এখন আমার যেরূপ অবস্থা, এ অবস্থায় অন্য চিন্তা আমি ভুলে যাই। নাম নাই, পরিচয় নাই, আশ্রয় নাই, একটিও আপনার লোক জানা নাই; ছিল কেবল একটি চরিত্র, রেখেছিলেম কেবল একটি চরিত্র, সেই চরিত্র এখন সঙ্কটাপন্ন, প্রতি নিশাকালে সেই চিন্তাই এখন কেবল প্রবলা। রাত্রিতে শুয়ে শুয়ে ভাবি কেবল কি হলো? আমি চোর হোলেম! বিধাতার মনে কি এই ছিল? মানুষের কাছেও আমি অপরাধী নই, বিধাতার কাছেও আমি অপরাধী নই, তবে কেন আমার কপালে এমন ঘোটলো? আমি অদৃষ্টবাদী, অদৃষ্টকেই আমি বলবান জ্ঞান করি। দুই একখানি পুস্তকে আমি পাঠ কোরেছি, কোন কোন লোক অদৃষ্ট মানে না। যারা মানে না, তারা সুখে থাকে কি কষ্টে থাকে, তাও আমি বুঝে উঠতে পারিনে, বোধ হয় যেন তারা বেশী কষ্ট পায়। ভাগ্যফল আমি মানি, সেই কারণেই জন্মাবধি মানুষের অসহ্য কষ্ট আমি সহ্য কোত্তে পাচ্ছি, অদৃষ্টে আছে, ঘোটছে, এই আমার প্রবোধ; ভাগ্য যদি না মানতেম, তা হোলে বোধ হয়, কিছুতেই এ সকল কষ্ট আমি সহ্য কোত্তে পাত্তেম না। চিরজীবন কষ্টে যাবে, চিরজীবন বিপদগ্রস্ত হয়ে থাকতে হবে, কাহারো অদৃষ্টে এমন ফল লেখা থাকে না। কখন না কখন জীবনকালের মধ্যে আমার ভাগ্যে শুভদিনের উদয় হবে, মহাবিপদে পতিত হয়েও সেইটিই আমি ভাবি; সেই শুভ আশা আমার অবসর হৃদয়কে প্রফুল্ল কোরে দেয়, তাতেই আমি বেঁচে আছি। অদৃষ্টবাদে অবিশ্বাস থাকলে বোধ হয় কখনই আমি বাঁচতেম না। লোকে যেটিকে বিধাতার লিখন বলে, আমি সেটিকে বিধাতার ইচ্ছা মনে কোরেই আপনা আপনি সান্ত্বনা প্রাপ্ত হই।
পাঁচ দিন গেল, চোর অপবাদে পাঁচ দিন আমি বন্দী; থানার গারদে অথবা রাজকারাগারে বন্দী হয়ে থাকলে লোকে যত যন্ত্রণা ভোগ করে, তত যন্ত্রণা আমার হয় না বটে তথাপি আমি যেন মনে করি, অপরাধী বন্দী অপেক্ষা আমার যন্ত্রণা অধিক। অপরাধীরা জানে অপরাধের দণ্ড; আমি জানি কি? —আমি জানি, বিনা অপরাধে বিষম কলঙ্কে অজ্ঞাত লোকের কুচক্রে অকারণে আমি কারাবাসী!
অকারণ? —অসম্ভব! কারণ ব্যতিরেকে কোন কার্যই হয় না; অকারণে আমার কারাবাস, মূলতত্ত্ব অগ্রাহ্য কোরে কি সাহসে আমি এমন কথা বলি? অকারণে নয়, অবশ্যই কারণ আছে; সে কারণটা কি তবে? ষষ্ঠ যামিনীর অবসানকালে এই তর্ক আমার মনোমধ্যে সমূদিত। মিথ্যা অপবাদে আমার কারাবাসের কারণ কি তবে? ভাবলেম অনেক; যে ক-দিন কয়েদ আছি, সে ক-দিন নিত্য নিত্যই ঐ কথা ভাবি; মনে মনে একটা সন্দেহ জাগে। এই শেষের রাত্রে যেন কার উপদেশে অবধারণ কোল্লেম, কারণসূত্র দুটি মনুষ্য;— দুটি স্ত্রীলোক। বাবুদের রাঙামামী বহু নায়ক-বিলাসে কলঙ্কিনী ছিলেন, বাড়ীতে ভূতের উপদ্রবে সে কলঙ্কে এক রকম চাপা পোড়ে থাকতো; পিণ্ডদানে না হোক, মন্ত্রবলে না হোক, আগ্নেয়াস্ত্রের বলে সে সব ভূত আমি তাড়িয়েছি, রাঙামামী দারুণ মনঃপীড়া প্রাপ্ত হয়েছেন, তাঁর মনঃপীড়ার প্রধান হেতুই আমি; সেই কারণে আমার উপর রাঙামামীর মর্মান্তিক রাগ হওয়া সম্ভব। তিনি আমার এই কলঙ্কের— এই যন্ত্রণার একটি কারণ। আর এক কারণ রূপসী। —কুৎসিত অভিলাষে রূপসী আমার কাছে প্রেমভিক্ষা চাইতে এসেছিল, ঘৃণা পূর্বক আমি তাকে প্রত্যাখ্যান কোরেছি, প্রতিফল দিবে বোলে রূপসী আমারে ভয়প্রদর্শন কোরে রেখেছিল, অবসর বুঝে সেই কোপ— সেই আক্রোশ জাগিয়ে তুলেছে। রাঙামামী আর রূপসী, উভয়েই আমার শত্রু! কি সূত্রে তাদের সেই কুচক্র প্রকাশ পায়, আপন মনে তার উপায় কল্পনা কোত্তে আমি সচেষ্ট হোলেম। উপায় আমার কল্পনায় এলো না। কল্পনার সঙ্গে ঊষাসতী ধীরে ধীরে বিদায় হয়ে গেলেন। রজনী প্রভাত।
প্রভাতে আমার কয়েদঘরের চাবী খুলে রামদাস প্রবেশ কোল্লে। গৃহকর্ম সমাধা কোরে ম্লানবদনে রামদাস আমার বিছানার ধারে এসে বোসলো। কাতরনয়নে রামদাসের মলিন বদন নিরীক্ষণ কোরে সন্দিগ্ধস্বরে আমি জিজ্ঞাসা কোল্লেম, “রামদাস! সর্বদা আমি তোমাকে প্রফুল্ল দেখি, আজকাল তুমি এমন হয়েছ কেন? যখন তোমাকে দেখি, তখনি তোমার মুখখানি শষ্ক শুষ্ক, মুখে হাসি নাই, বেশী কথা নাই, কি যেন ভাবো, এই রকম লক্ষণ দেখতে পাই; কারণ কি?”
ম্লানবদনেই রামদাস উত্তর কোল্লে, “কারণ তুমি; তোমাকে এরা চোর বোলে আটক রেখেছে, বড় আশ্চর্য ব্যাপার! এই কথা শুনে আমি যেন আকাশ থেকে পোড়েছি। এ বাড়ীতে কারা তোমার শত্রু, তা আমি জানতে পাচ্ছিনে; শত্রু পক্ষের কুচক্র ভিন্ন তোমার নামে এত বড় কলঙ্ক আর কিছুতেই সম্ভব হয় না। বাড়ীর ভিতর আমি শুনলেম, বড়-বৌমা বোলছেন, হরিদাস কখনই চোর নয়; ছোট-বৌমা বোলছেন, হরিদাস কখনই চোর নয়; ব্রাহ্মণী বোলছেন, হরিদাসকে সোণার সঙ্গে ওজন করা যায়; সোণাতে বরং খাদ থাকে, হরিদাসে খাদ নাই। এই তো তিনজনের কথা, তবে আর কার কথাতে লোকে তোমাকে অপরাধী বোলে বিশ্বাস কোরবে?”
রামদাসের কথায় কিঞ্চিৎ উৎসাহ পেয়ে রামদাসকেই আমি জিজ্ঞাসা কোল্লেম, “তোমার কি রকম বোধ হয়?” রামদাস বোল্লে, “আমার তোমাকে দেবতা বোলে বোধ হয়। কলিকালে দেবতা যদি থাকে, ধৰ্ম যদি থাকে, তারা তবে অবশ্য তোমার মত একটি ক্ষুদ্র দেবতাকে—”
বারান্দার দিকে মানুষের পদশব্দ। কারা যেন শীঘ্র শীঘ্র সেই ঘরের দিকে চোলে আসছে, এই রকম দ্রুত পদবিক্ষেপের শব্দ। রামদাসের কথা সমাপ্ত হোতে না হোতেই ছোটবাবুর সঙ্গে সেই দলপতিবাবু গৃহমধ্যে প্রবেশ কোল্লেন। রামদাস আমার বিছানার ধারে বোসে ছিল, এই সময় সোরে গেল;—ঘর থেকে বেরিয়ে গেল না, একটু দূরে দেয়াল ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো। উপবেশন করবার অগ্রেই আমারে সম্বোধন কোরে একটু কুণ্ঠিতম্বরে দলপতিবাবু বোল্লেন, “হরিদাস! আগে ঠিক বুঝতে না পেরে আমি তোমাকে অপরাধী বিবেচনা কোরেছিলেম, এখন জানতে পাল্লেম, বিষম কুচক্র। তোমাকে আমি কষ্ট দিয়েছি, সে জন্য তুমি কিছু মনে কোরো না, ভুলচুক সকলেরই আছে; প্রথমে আমার বুঝবার ভুল হয়েছিল; তুমি এখন রাহুগ্রাসমুক্ত পূর্ণচন্দ্রের ন্যায় সগৌরবে প্রকাশ পাবে, তার আয়োজন হয়েছে। ছোটবাবুর মুখে সকল কথা শ্রবণ কর।”
উৎফুল্ল-নয়নে ভঞ্জমহাশয়ের মুখপানে আমি চাইলেম, মনের কথা তিনি বোল্লেন, কিম্বা ব্যঙ্গচ্ছলে আমার প্রাণে অধিক বেদনা দিচ্ছেন, সেই তত্ত্বটি জানবার জন্য তাঁর দুটি নয়ন আমি নিরীক্ষণ কোল্লেম। কথা কবার সময় মনের ভাব অনেকটা নয়নে প্রকাশ পায়; রূপচাঁদ ভঞ্জের নয়নে বদনে ব্যঙ্গের লক্ষণ কিছুই দেখা গেল না।
আমি যেখানে বোসে ছিলেম, তার দুই হাত তফাতে ফুল্লবদনে ছোটবাবু বোসলেন, ছোটবাবুর পার্শ্বে ভঞ্জবাবু উপবেশন কোল্লেন। ছোটবাবুর মুখে কি আমি শুনবো, আগ্রহে আগ্রহে প্রতীক্ষা কোচ্ছি, চক্ষের জল মুছতে মুছতে পাচিকাঠাকুরাণী সেই সময় এসে দেখা দিলেন।
ছোটবাবু বোল্লেন, “আপনাদের কথাতেই আপনারা ধরা দিয়েছেন, ‘ধৰ্ম্মের কল বাতাসে নড়ে’, এই একটা সাধারণ কথা আছে, উপস্থিত ক্ষেত্রে সেই কথাই মিলে গেল। হরিদাস চুরি করে নাই, সে কথা সপ্রমাণ করবার সাক্ষী-সাবুদ ছিল না, ধর্মই সাক্ষী হোলেন। রূপসী বোলেছে সেই দিন বৈকালে হরিদাস আমাদের শয়নঘরে প্রবেশ কোরেছিল, রাঙামামী সেই কথার পোষকতা কোরেছিলেন। বৈকাল কথাটা মাঝখানে যদি না থাকতো, তা হোলে শীঘ্র শীঘ্র সংশয়ভঞ্জনের সুবিধা হোতো না। রূপসীকে আমি গতরাত্রে অনেক সওয়াল কোরেছিলেম, প্রত্যেক সওয়ালের জবাবেই রূপসী ধরা পোড়েছে। রূপসী ধরা পোড়লেই রাঙামামীর ধরা পড়া হলো, তাতে আর সন্দেহমাত্র নাই। আচ্ছা হরিদাস! রূপসী তো তোমার কাজকর্ম কোরে দিত, তোমার নাম হোলেই ভাল কথা বোলতো, হঠাৎ ভাবান্তরের হেতু কি, তা কি তুমি কিছু বুঝতে পার? কিছু কি অনুমান কোত্তে পার?”
ভাবতে ভাবতে আমি উত্তর কোল্লেম “পারি কিছু, কিছু, কিন্তু সে কথা এখানে বলবার নয়, সকল লোকের সাক্ষাতে সে কথা আমি বোলতে পারবো না। আপনাদের প্রসাদে যদি আমি কলঙ্কমুক্ত হোতে পারি, তা হোলে সময়ান্তরে আপনাকে আমি নির্জনে সেই কথাগুলি শুনিয়ে দিব। বস্তুতঃ রূপসীর ভাবান্তরের বিশিষ্ট কারণ আছে, এই পর্যন্ত এখন আমি বোলে রাখতে পারি।”
দলপতির নয়নে ছোটবাবু নয়ন নিক্ষেপ কোল্লেন, ধীরে ধীরে মস্তকসঞ্চালন কোরে দলপতি যেন একটু শিউরে উঠলেন, উভয়ের ঐরূপে ভঙ্গী আর দৃষ্টিবিনিময় আমি দর্শন কোল্লেম; বোধ হলো যেন, ঐ দিন প্রাতঃকালেই দলপতির সঙ্গে ছোটবাবুর তৎসম্বন্ধে কোন প্রকার কথা হয়েছিল, লক্ষণেই সেটি বুঝা গেল; সেই কথা স্মরণেই দলপতির ঐ ভাবে মস্তক সঞ্চালন।
পাচিকাঠাকুরাণী আমার মুখের দিকে চেয়ে দলপতিকে বোল্লেন “যে কথা রূপসী বলে, সেই কথাটা আমি আর এক রকমে জানি। হরিদাসের কিছুমাত্র দোষ নাই, চন্দ্রসূর্য সাক্ষী কোরে সে কথা আমি বোলতে পারি।”
রামদাসের দিকে চক্ষু ফিরিয়ে ছোটবাবু আদেশ কোল্লেন, “যাও রামদাস! রূপসীকে এখানে আন!”— আদেশমাত্রেই রূপসীকে আনতে রামদাস অন্দরে গেল। আমি বুঝতে পাল্লেম, আজ আবার নূতন বিচার হবে; এই বিচারের ফলের উপর আমার ভাগ্যফলাফল নির্ভর কোত্তে লাগলো।
রামদাসের সঙ্গে রূপসী এসে উপস্থিত। আমার দিকে রূপসী আর চায় না, কোন দিকেই চায় না, কতই যেন ভালমানুষ, সেইভাবে মাথাটি হেঁট কোরে আপনার পদনখগুলি নিরীক্ষণ কোত্তে লাগলো। দলপতির দিকে ছোটবাবু, একবার নয়ন ইঙ্গিত কোল্লেন, ইঙ্গিতের তাৎপর্য হৃদয়ঙ্গম কোরে দলপতিমহাশয় কেবল রূপসীকে জিজ্ঞাসা কোত্তে লাগলেন; “রূপসি! হরিদাস যখন সে দিন ছোট বৌ-মার ঘরে প্রবেশ কোরেছিল, তখন বেলা কত?”
রূপসী।— বেলা? —বেলা বৈকাল।
দল।— বৈকাল বোল্লে অনেকটা সময় বুঝায়। বেলা দুই প্রহরের পর সন্ধ্যার পূর্বক্ষণ পর্যন্ত বৈকাল। তার মধ্যে কোন সময় তুমি হরিদাসকে সে ঘরে যেতে দেখেছিলে, সেইটি আমি জানতে চাই। বৈকালে দেখেছিলে, সে কথায় কিছুই স্থির বুঝা যায় না।
রূপসী।— তবে আমি কি বোলবো?
দল।—হরিদাসকে যখন তুমি দেখেছিলে, তখন কতখানি বেলা ছিল?
রূপসী।— বেলা ছিল আন্দাজ চার দণ্ড কি ছয় দণ্ড। আমি যখন—
এই সময় আমি ভিতরদিকের বারান্দায় বস্ত্রঘর্ষণের খস খস শব্দ শুনতে পেলেম; বুঝতে পাল্লেম, বিচারফল কিরূপ দাঁড়ায়, সেইটি শুনবার জন্য বাড়ীর স্ত্রীলোকেরা, স্ত্রীলোকেরা মানে, বৌ-মা দুটি সেইখানে এসে লুকিয়ে দাঁড়িয়েছেন, উৎকণ্ঠিতা হয়ে অঙ্গবস্ত্র সঞ্চালন কোচ্ছেন। ছোটবাবুর কর্ণ অথবা চক্ষু, সে দিকে ছিল না, রূপসীর অসমাপ্ত কথায় বাধা দিয়ে তিনি একটু উচ্চকণ্ঠে বোলে উঠলেন, “চারি দণ্ড কি ছয় দণ্ড! ধন্য জগদীশ!— আচ্ছা রূপসী! ছয় দণ্ড বেলা থাকতে হরিদাস কোথায় ছিল, তা কি তোমার মনে আছে?”
রূপসী।— কেন থাকবে না? সেই সময় বৌ-মার ঘর থেকে বেরিয়ে আপনার ঘরে এসেছিল।
ছোট।— হার আর গেলাস তখন হরিদাসের হাতে ছিল, তা কি তুমি দেখেছিলে?
রূপসী।— তখন দেখি নাই, তার পর এই ঘরে যখন তল্লাস করা হয়, তখন এই ঘরেই বেরিয়েছে।
ছোট।— তা তো জানি, বেরিয়েছে। কিন্তু চার ছ দণ্ড বেলা থাকতে হরিদাস কোথায় ছিল, সে কথা তুমি বলতে পার না?
রূপসী।— কোথায় আর থাকবে? যেখানে থাকে, সেইখানেই ছিল।
ছোট।— (পাচিকার প্রতি) আপনি কি জানেন? রূপসী যে কথা বোলছে, এই কথাই কি সত্য?
পাচিকা।— চার ছ দণ্ড বেলা থাকতে রূপসী দুবার হরিদাসের ঘরে এসেছিল। হরিদাস তখন ঘরে ছিল না, এই পর্যন্ত আমি জানি, ছোট বৌমাও তাই জানেন।
ছোট।— হাঁ! ছোট-বৌ সে কথা আমাকে বোলেছে; সব আমি জানতে পাচ্ছি। রাঙামামী আর রূপসী একপক্ষ। আপনি আর ছোট-বৌ এক পক্ষ। যার বস্তু সে বলে না হরিদাস দোষী, রূপসী বলে হরিদাস চোর, এখনই এ তত্ত্বের মীমাংসা হবে।
আমি সেই সময় দাঁড়িয়ে উঠে দলপতিকে আর ছোটবাবুকে বিনীতভাবে বোল্লেম, আমার ঘরে চোরা জিনিস বেরিয়েছে, আমি দোষী হয়েছি, রূপসীর সাক্ষ্যবাক্যে সেইটিই সপ্রমাণ হোচ্ছে। এই সঙ্গে আর একটি তত্ত্বের মীমাংসা হোক। ঐ যে দেয়ালের গায় কুলঙ্গী, ঐ কুলঙ্গী আমি কখন দেখি নাই তক্তা ঢাকা থাকতো, কি তো কি, ওদিকে আমি চাইতেম না। ঐ কুলঙ্গীর ভিতর গেলাস- দুটি কি রকমে এসেছিল, সেই কথা আমি—
আর আমারে কিছু বোলতে না দিয়ে গম্ভীর বদনে ছোটবাবু বোল্লেন, “বাস! বাস! তোমাকে আর কিছু বেশী বোলতে হবে না, সমস্তই আমি বুঝতে পেরেছি, গোড়া ফাঁক।” — আমারে এই পর্যন্ত বোলে দলপতির দিকে চেয়ে তিনি একটু নম্রস্বরে বোল্লেন, “দেখুন রূপচাঁদ কাকা, সে দিন আহারের পর বেলা দুই প্রহরের পূর্বে হরিদাসকে সঙ্গে নিয়ে আমি বেড়াতে বেরিয়েছিলেম, সন্ধ্যার পর ফিরে আসি। রূপসী দেখেছে, বেলা চার দণ্ড কি ছয় দণ্ড থাকতে হরিদাস আমার ঘরে হার চুরি কোরে গিয়েছিল! রূপসীই ফরিয়াদী, রূপসীই সাক্ষী; যোগের সাক্ষী রাঙামামী। এখন আপনি বিবেচনা করুন, এ মামলার জোর কত।”
ভঞ্জবাবু পূর্বে হোতেই সপ্রতিভ হয়েছিলেন, ছোটবাবুর শেষকথা শ্রবণ কোরে খানিকক্ষণ তিনি অবাক হয়ে থাকলেন। রূপসী সেই অবসরে পালাবার উপক্রম কোচ্ছিল, চৌকাঠ পর্যন্ত এগিয়েছিল; উগ্রস্বরে ধমক দিয়ে ছোটবাবু বোল্লেন, “যাস কোথা? —দাঁড়া! হরিদাসের নামে তুই নালিশ কোরেছিস, হরিদাসকে চোর বোলে ধোরিয়ে দিয়েছিস, তোর কথার প্রমাণেই হরিদাসকে আমরা কয়েদ কোরে রেখেছি, মোকদ্দমা এখনো চোকে নাই, তুই এখন যাস কোথা? —দাঁড়া! শেষকথাগুলো বোলে যা! কত বেলা থাকতে হরিদাসকে তুই আমার ঘরে প্রবেশ কোত্তে দেখেছিলি, রাঙামামীকে তুই কি কি কথা বোলেছিলি, ভাল কোরে মনে কর, ঠিক ঠিক কথা বল!”
রূপসী কাঁপতে লাগলো; অধোমুখে জড়িতস্বরে আমতা আমতা কোরে বোল্লে, “আমি তো— বেলা— মামীমা— হরি— বৌ— মা—”
ছোটবাবু তখন আর কি কথাই বা শুনবেন, মোড়লমহাশয়ই বা কি সিদ্ধান্ত কোরবেন? আসল কথা তাঁরা বিলক্ষণ বুঝতে পাল্লেন। পাচিকাঠাকুরাণী চক্ষের জল মার্জন কোরে এক পা এগিয়ে ছোটবাবুকে বোলছিলেন, “রুপসী যখন এই ঘরে আসে, আমি তখন সঙ্গে সঙ্গে আসতে আসতে—”
“আপনাকে আর কিছু বোলতে হবে না, যা কিছু বোলতে হয়, রূপসী নিজেই বোলবে; নিজেই বলকে।” —ব্রাহ্মণীকে এই রকমে থামিয়ে ছোটবাবু পুনর্বার রূপসীকে বোলতে লাগলেন, “দেখ রূপসী! ছোটবেলা থেকে আমাদের বাড়ীতে তুই আছিস, তোর বাপ এ বাড়ীতে অনেক দিন ছিল, তোর উপরে আমাদের মায়া বোসেছে, সত্যকথা বোলে তোকে আমরা কিছুই বোলবো না, যা যা হয়েছিল, ঠিক ঠিক বল; কার পরামর্শে তুই হরিদাসকে চোর বোলে সাক্ষ্য দিয়েছিলি, ঠিক ঠিক বল; মিথ্যাকথা যদি বলিস, পুলিশে চালান হোতে হবে; মনে রাখিস, সাবধান! মিথ্যাকথা বোল্লে কিছুতেই নিস্তার পাবি নে।”
পুলিশের নাম শুনে দুই হাতে দুই চক্ষু ঢেকে রূপসী কেঁদে ফেল্লে। ছোটবাবু তখন জোরে জোরে আরো অধিক ধমক দিতে লাগলেন। রূপসীর রোদনে কাহারো হৃদয়ে দয়ার সঞ্চার হলো না। ছোটবাবুর রুক্ষ প্রশ্ন, রুক্ষ আদেশ; মোড়লবাবুর উগ্র প্রশ্ন উগ্র আদেশ; মাগীটা তখন ফাঁপোরে পোড়ে গেল; কি করে! ছোটবাবুর মুখের দিকে একবার চাইলে, মোড়লের দিকেও চাইলে, দরজার দিকে মুখ ফিরিয়ে ভিতরের বারান্দার দিকেও একবার চেয়ে দেখলে, কোন দিক থেকেই একটি অভয়বাক্য এলো না। প্রথম অভিযোগে যে সকল মুখে হাসি এসেছিল, রূপসীর চক্ষে সে সকল মুখ তখন সক্রোধ বিস্ময়ে রক্তবর্ণ; ভাবদর্শনে নিরুপায় হয়ে কাঁদতে কাঁদতে রূপসী তখন বোলতে লাগলো— “আমার কোন দোষ নাই—আমি, ঠাকুর দেবতাসাক্ষী— আমি— না, আমার কোন দোষ নাই,” এই রকম খাপছাড়া কথা বলে, আর মাঝে মাঝে এ দিক ও দিক চায়। ধৈর্য ধারণ কোত্তে না পেরে চঞ্চলম্বরে ছোটবাবু বোল্লেন, “ভাল কথায় এখনো বোলছি, সত্যকথা বল। তোর যদি কোন দোষ নাই, তবে হরিদাসের বালিশের ভিতর হারছড়াটা কেমন কোরে এসেছিল? দেয়ালের গায়ে ক্ষুদ্র খোপের ভিতর গেলাস-দুটো কেমন কোরে গিয়েছিল? হরিদাস যখন ঘরে ছিল না, তখন হরিদাসের বিছানার মধ্যে হার রেখেছিল কে? গেলাস-দুটো লকিয়ে রেখেছিল কে?”
জলপূর্ণ চক্ষু ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে, চতুর্দিকে চেয়ে চেয়ে, কড়িকাষ্ঠের দিকে চক্ষু তুলে গলা কাঁপিয়ে কাঁপিয়ে রূপসী উত্তর কোলে, “মামী-মা আমাকে— না না— মামী-মা একদিন— ভূত পালাবার পর পায়রা— না—”
ভঞ্জবাবু এই সময় ছোটবাবুকে বোল্লেন, “সহজে কথা পাওয়া যাবে না, পুলিশের একজন লোককে—”
চক্ষের জলে ভেসে, মোড়লবাবুর পায়ের কাছে আছাড় খেয়ে পোড়ে, লুটোপুটি খেতে খেতে রূপসীটা চিৎকার কোরে বোলতে লাগলো, “না বাবা! —বলি বাবা! পুলিশ বাবা! —আমি বাবা! — মামী-মা আমাকে বোলেছিল— তাই জন্যে আমি—”
এই পর্যন্ত বোলেই রূপসী আবার কান্না আরম্ভ কোল্লে। মৃদু হাস্য কোরে ছোটবাবু বোল্লেন, “তাই জন্যে তুই কি কোরেছিলি? চুপি চুপি হার চুরি কোরে এই ঘরে ঢুকিয়ে রেখেছিলি? গেলাস চুরি কোরে খোপের ভিতর লুকিয়ে রেখেছিলি? কেমন, এই তো তোর কথা? সত্য বল। আমিও সত্য বোলছি, সত্যকথা বোল্লে আমি তোকে পুলিশে দিব না।”
রোদনের সুরের সঙ্গে নূতন রকম সুর মিশিয়ে গড়াগড়ি খেতে খেতে রূপসী বোলতে লাগলো, “আমি নই—আমি নই; ওগো, আমি তেমন কাজ করি নাই, তেমন কাজ আমি কোত্তেম না—রাঙামামী—”
বোলতে বোলতে রূপসী আবার থেমে গেল। ছোটবাবু বোল্লেন, “রাঙামামী তোরে কি বোলেছিল? চুরি কোত্তে বোলেছিল? জিনিসগুলি হরিদাসের ঘরে এনে রাখতে বোলেছিল? হরিদাসের মাথায় দোষ চাপাতে বোলেছিল?”
রূপসী উত্তর কোল্লে, “তাই তো আমি কোরেছিলেম, রাঙামামী শিখিয়ে দিয়েছিল, পায়রাবাবু আমাকে টাকা দিবে বোলেছিল, ভাল একটা চাকরী দিবে বোলেছিল, বুঝতে না পেরে—”
“বুঝতে না পেরে সেই লোভে তুই আমার ঘরের জিনিস চুরি কোরেছিলি? একটি ভদ্রলোকের ছেলেকে চোর বোলে ধোরিয়ে দিয়েছিলি? পায়রা বাবু যদি তোকে আমার গলায় ছুরি দিবার পরামর্শ দিত, টাকার লোভে— চাকরীর লোভে তাও তুই দিতিস?”
ছোটবাবুর এইরূপে তীব্র উক্তিতে দাসীটা কাঁপতে কাঁপতে দাঁড়িয়ে উঠে হাতযোড় কোরে বোলতে লাগলো, “না বাবা— না বাবা— না গো বাবা! তেমন কর্ম আর আমি কোরবো না। তুমি বরং আমার মাথা মুড়িয়ে দেশছাড়া কোরে দাও, পুলিশের হাতে আমারে ধোরিয়ে দিও না। হরিদাস চোর, এমন কথা আর আমি কখনই বোলবো না।”
মোড়লবাবু হাসা কোল্লেন, ছোটবাবুও হাস্য কোল্লেন; আমারও হাসি পেয়েছিল, আমি সামলে গেলেম। আর একটা কথা উত্থাপন না কোল্লে সে সময় হাস্য সংবরণ করা যেতো না, সেই জন্য ছোটবাবুকে আমি বোল্লেম, “পায়রাবাবুকে যদি পাওয়া যায়, এই সময় তাঁকে একবার এইখানে হাজির কোত্তে পাল্লে ভাল হয়। একটা কথা এতদিন আমি আপনাকে বলি নাই, ঘটনার বৈচিত্র দেখে অগত্যা আজ সেই কথাটা বোলতে হলো। একদিন রাঙামামীর আমি একটি উপকার কোরেছিলেম, পায়রাবাবুরও উপকার কোরেছিলেম; রাঙামামী আমার মারফতে একদিন একটি ঔষধের মোড়ক পায়রাবাবুর কাছে পাঠিয়েছিলেন, পায়রাবাবুকে তখন আমি পায়রাবাবু বোলে চিনতেম না; রাঙামামী বোলেছিলেন, সেজোবাবু; আমিও জেনেছিলেম সেজোবাবু। সেই উপকার আমি কোরেছিলেম; সেই উপকারের প্রত্যুপকার এই। তাঁদের পরামর্শে, রূপসীর যোগাযোগে আমি চোরদায়ে ধরা পোড়েছিলেম; ভগবানের কৃপায়, আপনাদের অনুগ্রহে আজ আমি অব্যাহতি পেলেম; — নিষ্কলঙ্কে অব্যাহতি। এই সময় একবার পায়রাবাবুকে—”
ছোটবাবু বোল্লেন, “সময় আছে, পায়রাকে এখন এখানে হাজির করবার দরকার নাই, ডেকে পাঠালেও পায়রা এখানে আসব না। কুকুরের খেলার সময় পায়রা এখানে বিলক্ষণ জব্দ হয়ে গিয়েছে, আমাদের উপর রাগ হয়েছে, সে কি আর এখন এখানে আসতে চায়? সময় আসুক, পাপের প্রায়শ্চিত্ত যে রকমে হয়, আর কিছুদিন যদি তুমি এখানে থাকো, চক্ষুই দেখতে পাবে। এখন তুমি একটা ভয়ানক অপকলঙ্ক থেকে মুক্ত হোলে, এইটিই আমাদের সন্তোষের বিষয়।”
করযোড়ে নমস্কার কোরে আমি বোল্লেম, “আজ্ঞা হাঁ, আপনাদেরও সন্তোষের বিষয়, সেই সন্তোষে আমারও কলঙ্কভঞ্জন। নষ্টচন্দ্রদর্শনের কলঙ্ক। আমি তো আমি, নষ্টচন্দ্র দর্শনে দ্বারকানাথ শ্রীকৃষ্ণেরও ‘মণিচোরা’ কলঙ্ক হয়েছিল। আমার এই কলঙ্কভঞ্জনে আমি আপনার কাছে চিরজীবনের জন্য কৃতজ্ঞ থাকলেম।”
এই কথাগুলি বলবার সময় মোড়লবাবুর দিকে আমি একবার বক্রনয়নে কটাক্ষপাত কোল্লেম। ভাব বুঝতে পেরে মিষ্টবচনে মোড়লবাবু আমাকে বোল্লেন, “দেখ হরিদাস! পুনরায় আমি বোলছি, তুমি কিছু মনে করো না; সে সব পূর্বকথা ভুলে যাও। মেয়েমহলে এত বড় একটা চক্র, চক্রের ভিতর এত সৃষ্টি, আগে আমি কিছুই বুঝতে পারি নাই, তোমাকে অনেক অপ্রিয় কথা বোলেছি, তজ্জন্য এখন আমার অনুতাপ আসছে, সে সব কথা তুমি ভুলে যাও; তোমার কলঙ্কভঞ্জনে আমি সুখী হোলেম।”
প্রসন্নবদনে আমারে ঐ সব কথা বোলে, ছোটবাবুর কাছে বিদায় নিয়ে রূপচাঁদবাবু গাত্রোত্থান কোল্লেন, পুনঃ পুনঃ আত্মীয়তা জানিয়ে সে দিনের মত তিনি বিদায় হয়ে গেলেন। অধোবদনে নেত্রমার্জনা কোত্তে কোত্তে মৃদুপদসঞ্চারে রূপসীদাসী অন্দরে প্রবেশ কোল্লে; ভিতরবারান্দায় যাঁরা আমার মুক্তিমন্ত্র শ্রবণ কোরেছিলেন, তাঁরাও সেখান থেকে সোরে গেলেন। ঘরে আমরা তিনজনে থাকলেম— ছোটবাবু, আমি আর রামদাস।
আমি কলঙ্কমুক্ত হোলেম, ছোটবাবু আনন্দিত হোলেন, রামদাসের শুষ্কমুখ প্রফুল্ল হয়ে উঠলো। খুসী হয়ে রামদাস বোলতে লাগলো, “মন যেন আগেই সব জানতে পারে। এই ঘটনার ভিতর রূপসী ছিল, ঘটনাটা শুনেই আমি সেটা বুঝতে পেরেছিলেম; রূপসীর সঙ্গে রাঙামামীর যোগ ছিল, তা আমি জানতে পারি নাই। ধর্মের কর্ম; ধর্ম হরিদাসকে রক্ষা কোল্লেন, মিথ্যা অপবাদ রটনার মূল যারা, ধৰ্মই তাদের চিনিয়ে দিলেন।”
কিঞ্চিৎ অন্যমনস্কভাবে ছোটবাবু আমারে জিজ্ঞাসা কোল্লেন, “পায়রাবাবুকে এখানে একবার হাজির কোল্লে ভাল হয়, এ কথাটা তুমি কেন বোলছিলে?”
কারণটা প্রকাশ করি কি না করি। প্রকাশে কোন প্রকার দোষ আছে, এইরূপ আমি ভাবলেম। সত্য যদি আমার অনুমানটি ঠিক না হয়, আমি অপ্রস্তুত হব, প্রথমে আমার মনোমধ্যে সেই ভাবের উদয় হলো; তার পর আবার বিবেচনা কোল্লেম, আসল কথা আগেই তো আমি ভাঙবো না, নিশ্চিতরূপে সন্দেহটা দূর হয়ে গেলে মনে কোল্লেম আমি খুলে দিব, স্থূলকথা প্রকাশে দোষ কি? এইরূপে ভেবে আমি উত্তর কোল্লেম “বোধ হয় যেন পায়রাবাবুকে আমি চিনি। ঐ নামে চিনি না, অন্য নামে চিনতেম, অন্যস্থানে দেখেছিলেম, এইরূপে যেন আমার মনে হয়। সত্য সত্য সেই লোকটি এই পায়রাবাবু কি না, একবার পরীক্ষা করবার ইচ্ছা হোচ্ছে; দেখেছিলেম, মুখোমুখি বোসে কথাবার্তা হয় নাই, কিন্তু লোকটির স্বভাব ভাল নয়, নানা প্রমাণে তা আমার জানা হয়েছিল। রাঙামামীর প্রেরিত দূত হয়ে পায়রাবাকে যে দিন আমি ঔষধের মোড়কটি দিতে যাই, সে দিন প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এসেছিল, চেহারা ভাল কোরে দেখতে পাই নাই, তথাপি যেন পূর্বস্মৃতি একটু একটু জেগেছিল। তিনি তখন সেজোবাবু ছিলেন, এখন হয়েছেন পায়রাবাবু। যে রাত্রে আমি ভূত শীকার করি, সে রাত্রে সর্বাঙ্গ বসনাবৃত, রুমালে গালপাটা বাঁধা একটি লোক জনতামধ্যে দর্শন দিয়েছিলেন, বোধ করি, আপনারা সে দিকে ততটা লক্ষ্য রাখেন নাই, আকার-ইঙ্গিতে আমি কিন্তু বুঝেছিলেম, সেই সেজোবাবু। তার পর একরাত্রে এইখানে তাজপরা মূর্তি; সেই রাত্রে কুকুরগুলির কৌতুকাবহ ক্রীড়া। আর একবার সেই মূর্তি দর্শন কোল্লে মনের অভিপ্রায় আমি প্রকাশ কোত্তে পারবো, সেইজন্যই বোলেছিলেম, একবার হাজির কোত্তে পাল্লে ভাল হয়।
ছোটবাবু বোল্লেন, “হাজির করা বোধ হয় সহজ হবে না; নিজে তিনি যে কথা অস্বীকার করেন, সেই কথাই ঠিক। তিনি বোলছিলেন কুকুর তাঁর নয়, কুকুরেরা দেখালে তারা তাঁরই। মিথ্যাকথা ধরা পড়াতে তিনি পালিয়ে গিয়েছেন, কুকুরেরা, তাঁর সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গিয়েছে, সব আমরা বুঝেছি, তাও তিনি জানতে পেরেছেন। এখন যদি তাঁকে আমরা ডেকে পাঠাই, তা হোলে—”
“রাধা-কৃষ্ণ! রাধা-কৃষ্ণ! মহাভারত! মহাভারত!” ছোটবাবুর কথা সায় হোতে না হোতে ঐরূপে পবিত্র নাম উচ্চারণ কোত্তে কোত্তে দ্রুতপদে একটি স্ত্রীলোক সেই ঘরে প্রবেশ কোল্লেন। চকিতনয়নে আমি চেয়ে দেখলেম, রাঙামামী! তাঁর বগলে একটি কাপড়ের পুঁটলী, হাতে একখানি ময়ূরপুচ্ছের পাখা। রোদনের সুরে ছোটবাবুকে তিনি বোলতে লাগলেন, “আর আমার এ বাড়ীতে থাকা হলো না! কর্তাকে বোলো, জন্মের মত আমি বিদায় হোলেম! রূপসী বোলে গেল, আমি তারে শিখিয়ে দিয়েছিলেম; হার চুরি কোরে হরিদাসের বালিশের ভিতর রাখা, সেটা আমারই পরামর্শ, এই কথাই রূপসী বোলেছে; তোমরাও তার কথাই বিশ্বাস কোরেছ, তোমাদের মোড়লবাবু— গাঁয়ের লক্ষ্মী ছেড়ে গিয়েছে কি না, গাঁখানা এখন ভাঙা গাঁ, মোড়লবাবটি সেই ভাঙা গাঁয়ের মোড়ল! প্রথম দিন তিনি বোলেছিলেন, হরিদাসকে থানায় দাও; আজ এসে বোলে গেলেন, হরিদাস ছোকরা রাহুমুক্ত পূর্ণচন্দ্র। দু রাত্রের বিচারের মূল সাক্ষী সর্বনাশী রূপসী। আমি সেই রূপসীর কথায় অপরাধিনী হয়েছি, ধর্মের বিচারে অপরাধিনী হব না, তোমাদের বিচারে আমি ধরা পোড়েছি, এ বাড়ীতে বাস করায় আর আমার মঙ্গল নাই, আমি বাপের বাড়ী চোল্লেম! আরো ভেবে দেখ, মিছামিছি, আমার সঙ্গে ঝগড়া বাধিয়ে তোমাদের বড়বৌটি সে রাত্রে কি কাণ্ডই না কোল্লেন! ছি! ছি! ছি! কি কেলেঙ্কার! গৃহস্থ-বাড়ীতে এমন কেলেঙ্কার ভাল কথা নয়, আমাকে নিমিত্তের ভাগী কোরে তোমার দাদাবাবুটি গাঁছাড়া হয়ে গিয়েছেন; গাঁ-ছাড়া কি দেশছাড়া, তাও ঠিক নাই, কর্তা ফিরে এসে আমাকেই দোষী কোরবেন; আসতেই আমি চাই নাই, কর্তাই জেদাজেদি কোরে আমাকে বাড়ীতে এনে রেখেছিলেন। আমার কপাল যখন ভেঙেছে তখনি আমি অকূল পাথারে ডুবেছি; ভাঙা কপাল নিয়ে যেখানে ইচ্ছা, সেইখানেই এখন আমি যেতে পারি। কর্তাকে এই সব কথা বোলো— আমি আমার বাপের বাড়ী চোল্লেম! সেখানে যদি আশ্রয় না পাই, পথের ভিখারিণী হয়ে দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা কোরে বেড়াবো, তোমরা সুখে থাকো।”
চক্ষের জলের সঙ্গে এই সব বিষাদবাক্য বর্ষণ কোত্তে কোত্তে অস্থিরপদে ঘর থেকে বেরিয়ে রাঙামামী সরাসরি সিঁড়ি দিয়ে নামতে আরম্ভ কোল্লেন, সঙ্গে সঙ্গে ছোটবাবু ছুটলেন, বাবুর সঙ্গে সঙ্গে রামদাসও ছুটলো; কি রঙ্গ হয়, দেখবার জন্য আমিও সিঁড়ির দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেম। ছোটবাবু বিস্তর সাধ্যসাধনা কোল্লেন, “রূপসীর কথায় বিশ্বাস করি নাই” বোলে বিস্তর বুঝালেন, গোঁ ফিরাতে পারেন না। যুবতীমামীর হাত ধোরে টানাটানি কোত্তে পারেন না, পাল্লেনও না; রাঙামামী কত কি বোকতে বোকতে বাড়ী থেকে বেরিয়ে গেলেন।
সে রাত্রের অভিনয় এই পর্যন্ত। পরদিন প্রাতঃকালে আমি শুনলেম রূপসী পালিয়ে গিয়েছে। উভয়েই আমার কলঙ্করটনার হেতু ছিল,— রাঙামামী আর রূপসী, উভয়েই পালালো। পায়রাটিও উড়েছে কি আছে, জানতে পারা গেল না। আমার নিজের জন্য যে উদ্বেগ জন্মেছিল, সে উদ্বেগটা দূর হয়ে গেল। নির্ভাবনায় দিবা অবসান। রাত্রিকালে আহারাদি কোরে আমি শয়ন কোল্লেম। পাঁচ দিন পাঁচ রাত্রি আমার নিশ্বাস পড়েছিল, সে নিশ্বাসে তীব্র তীব্র অগ্নিকণা আজ রাত্রে আমি স্বচ্ছলে নিশ্বাস ত্যাগ কোল্লেম। অমরকুমারীকে মনে পোড়লো; অমরকুমারী সর্বক্ষণ আমার মনের ভিতর জাগেন, এই রাত্রে মনে পোড়লো, কথাটা যেন অকৃতজ্ঞ হৃদয়ের কথা। তা নয়, চোর অপবাদে আমি প্রায় হতবুদ্ধি হয়েছিলেম, মনে যেন কোন বাসনা— কোন ধারণাই ছিল না; চিন্তাপথে অমরকুমারী আসতেন, চপলার মত চোলে যেতেন; চপলার সঙ্গে ছুটতে পাত্তেম না; নিজের ভাবনাতেই আমি আকুল হয়ে থাকতেম। মানুষের স্বভাবই এইরূপ। মানুষ যখন অভাবনীয় মহাবিপদে পতিত হয়, নিজের পরিত্রাণের চিন্তা ভিন্ন তখন তার মনে অন্যচিন্তা স্থান পায় না, নিজের চিন্তাই বলবতী হয়ে থাকে। সকল চিন্তার উপরেই চিন্তা। এই রাত্রে অমরকুমারীকে মনে পোড়লো, অমরকুমারী কোথায়? এখনো কি ঢাকায়? ঢাকার শাখা-মোকদ্দমা এখনো কি নিষ্পন্ন হয় নাই? আমার কথা কি অমরকুমারীর মনে আছে? লোকে আমারে চোর বোলেছিল, অমরকুমারীর মন কি সে অপবাদের কথা জানতে পেরেছে? আমার প্রতি কি অমরকুমারীর অশ্রদ্ধা জন্মেছে? কত দিনে আবার আমি অমরকুমারীকে দেখতে পাব?— নিৰ্জনে এক জায়গায় বোসে কবে আমি অমরকুমারীকে এই সব কথা জিজ্ঞাসা কোরবো? অমরকুমারীর নাম উচ্চারণ কোল্লে হৃদয় আমার শীতল হয়, দর্শনের আশায় প্রাণ আমার ব্যাকুল হয়; অন্য প্রকারে চিত্ত বিচলিত হয় না, এ রাত্রেও বিচলিত হোচ্ছে না। অমরকুমারী ভাল আছেন; কোন প্রকার অমঙ্গল ঘটনা হোলে বহুদূরে থেকেও অন্তরঙ্গ লোকের মন সে অমঙ্গল জানতে পারে; কোন অমঙ্গল ঘটে নাই, অমরকুমারী ভাল আছেন। অমরকুমারী হয় তো মুর্শিদাবাদে ফিরে গিয়েছেন, শান্তিরাম দত্ত হয় তো তাঁরে পুত্রীরূপে আশ্রয় দিয়েছেন। আবার কি রক্তদন্ত অমরকুমারীর উপর উপদ্রব কোরবে? —না, পারবে না; দীনবন্ধুবাবু অমরকুমারীর রক্ষার উপায়বিধান কোরবেন, পশুপতিবাবু সে কথা আমার কাছে মুক্তকণ্ঠে স্বীকার কোরেছেন। অমরকুমারীর ভয় নাই। আমার ভয় আছে, ভবসংসারের ভয়নিবারণ ভূতভাবন ভবানীপতি এ ভয় আমার ঘুচাবেন। পনেরায় আমি অমরকুমারীকে দেখতে পাব, দেখতে পেয়ে সখী হব, পদ্মমুখে হেসে হেসে পদ্মমুখী আমার সঙ্গে সুখর আলাপ কোরবেন, রজনী দেবী আজ আমারে সেই আশা প্রদান কোচ্ছেন। অমরকুমারীকে ভাবতে ভাবতে অন্যান্য হিতৈষী বন্ধুগণকে হৃদয়াসনে আমি আনয়ন কোল্লেম, হৃদয় জুড়াল; বিরামদায়িনী নিদ্রাদেবী এই সময় আমার প্রতি দয়া কোল্লেন, মঙ্গলময়ী আমাকে হৃদয়ে স্থান দান কোল্লেন। নিদ্রার ক্রোড়ে আমি অচেতন হোলেম।
নিত্য আমার মনে নূতন নূতন আশার সঞ্চার। আশা সর্বত্র সর্বদা সর্বকার্যে ফলবতী হয় না, তথাপি আশা মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে, এই গুণে আশাকে আমি আদর করি। চোরদায় থেকে মুক্ত হয়ে আমি আশা সলিলে অবগাহন কোল্লেম। সে সময়ে আমার মনে কত রকমের কত আশা খেলা কোত্তে লাগলো, এখন সে সব স্মরণ কোত্তে পাচ্ছিনে। আমার প্রতি ছোটবাবুর যে রকম ভালবাসা ছিল বুঝলেম, সে ভালবাসা দিন দিন বেড়ে উঠলো। রামদাসের ভক্তিও দিন দিন বাড়তে লাগলো, বৌমা দুটিও দিন দিন আমারে বেশী আদর কোত্তে লাগলেন, পাচিকার স্নেহ-যত্নও দিন দিন আমি বেশী বেশী অনুভব কোত্তে লাগলেম। এই রকমে আর একমাস কেটে গেল।
কর্তা বাড়ীতে এলেন। এসে তিনি সর্বাগ্রেই শুনলেন, বড়বাবু গৃহত্যাগী। কারণ-জিজ্ঞাসু হয়ে বাড়ীর পরিবারবর্গের কাছে কিরূপ তিনি শুনেছিলেন, সে সব কথা আমি শুনতে পেলেম না, তবু মনে মনে ভেবে নিয়েছিলেম, প্রাণগতিবাবু, তাঁর রাঙামামীর প্রাণগতি হয়েছিলেন, সেই গৌরবের কথা তিনি শুনতে পান নাই। রাঙামামী বাড়ীতে নাই, এ কথা যখন কর্তা শুনলেন, তখন তার কারণটিও অনলঙ্কৃতভাবে তাঁর কর্ণগোচর হয়েছিল। শুনে তিনি বিমর্ষ হয়েছিলেন; ক্রমে ক্রমে অপরাপর বিবরণ সমস্তই তিনি শুনলেন। ভূতের ক্রীড়ার অবসান। আমিই সেই অবসানের মূলাধার।
রামদাস এসে আমারে সংবাদ দিলে, ঐ কথা যখন কর্তার কাণে যায়, তখন তিনি এক বিশাল নিশ্বাস পরিত্যাগ কোরেছিলেন; জানতে চেয়েছিলেন, কোন দিন কোন সময়ে ভৌতিকলীলার অবসান। দিনক্ষণ ছোটবাবুর একখানি খাতায় লেখা ছিল, ছোটবাবু সেই খাতাখানি কর্তার কাছে ধোরে দিলেন, কর্তা সেই অক্ষরগুলি দর্শন কোরে নিমীলিত-নয়নে ক্ষণকাল যেন কি গুটিকত মন্ত্র জপ কোল্লেন, এক দুই কোরে অঙ্গলীর পর্ব গণনা কোল্লেন, শেষে আর একটি দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ কোরে বিস্মিতবদনে বোল্লেন, “ওঃ! তবে তো গয়ায় পিণ্ডদানের সপ্তাহপূর্বে সেই ঘটনা। আশ্চৰ্য।”
এই সব কথা রামদাসের মুখে আমি শুনলেম। কর্তার সঙ্গে আমার যখন সাক্ষাৎ হলো, ভূতের কথা তখনো উঠেছিল, কর্তা কিন্তু আমার সাক্ষাতে তখন “আশ্চৰ্য” বাক্যটি উচ্চারণ কোল্লেন না। ভূতের তিরোধান, বড়বাবুর অদর্শন, রাঙামামীর পলায়ন, রূপসীর পলায়ন, এই সমস্ত প্রসঙ্গে অনেকটা সময় অতিবাহিত হয়ে গেল, “আমি কেমন আছি” কর্তা সে কথাটি পৰ্যন্ত জিজ্ঞাসা করবার সময় পেলেন না। সময় পেলেন না কিবা সে কথা জানবার তাঁর দরকার ছিল না, তিনিই তা বোলতে পারেন। গয়ায় গদাধরের পাদপদ্মে পিণ্ডদানের অগ্রে ও অন্য উপায়ে ভূত উদ্ধার হোতে পারে, কর্তার সেটা বিশ্বাস ছিল না, বন্দুকের গুলীতে আমি ভূত উদ্ধার কোরেছি, সে কথাটা তাঁর ভাল লাগলো না, তাঁর মুখের ভাব দেখে তা আমি বুঝতে পাল্লেম। রাঙামামী পালিয়েছে, রূপসী পালিয়েছে, আমিই তার হেতু, বাড়ীর লোকের মুখে সে কথা তিনি শুনেছিলেন, তাতেও যেন আমার উপর তাঁর একটা একটা মন ভার। মনোভাব গোপনে রেখে গুটিকত মিষ্টবচনে আমারে তিনি তুষ্ট করবার চেষ্টা কোল্লেন, আমি তুষ্ট হোতে পাল্লেম না। তাঁর পূর্ব ব্যবহার স্মরণ কোরে আমার দারুণ ভয় হোতে লাগলো।
গৃহিণী ঠাকুরাণী আমার প্রতি সন্তুষ্ট। অজ্ঞাত লোকেরা আমারে যখন এই বাড়ীতে ফেলে দিয়ে যায়, কর্তা তখন আমারে নেশাখোর বিবেচনা কোরে কাৰ্যে বাক্যে ঘৃণা প্রকাশ কোরেছিলেন; গৃহিণী কিন্তু প্রথমাবধিই আমার প্রতি স্নেহবতী। বাড়ীতে যে কাজ আমি কোরেছি, ভূতগুলোকে তাড়িয়েছি, মিথ্যা মিথ্যা চোর অপবাদে অনেক কষ্ট পেয়েছি, সেই সব কথা শ্রবণ কোরে এবার আমার প্রতি গৃহিণীঠাকুরাণীর অধিক আদর, অধিক যত্ন, অধিক স্নেহ আমি অনুভব কোল্লেম। পুত্রের পরলোকপ্রাপ্তি হোলে জননীর পুত্রশোক উপস্থিত হয়; জ্যেষ্ঠপুত্রের অদর্শনে ততটা না হোক গৃহিণী-ঠাকুরাণী শোকসন্তাপ্ত হয়েছিলেন, কিন্তু আমার প্রতি কোন প্রকার অযত্ন হয় নাই। কর্তা-গিন্নীর প্রত্যাগমনে দিনকতক আমি বরং এক প্রকার সুখেই থাকলেম। কোন প্রকার অপ্রিয়বাক্য আমাকে শুনতে হলো না।
একদিন সন্ধ্যার পর আমি আপনার ঘরে একাকী বোসে আছি, একজোড়া চসমা চক্ষে দিয়ে, হস্তে একগাছি যষ্টিধারণ কোরে কর্তা সেই সময় সেইখানে এসে উপস্থিত হোলেন; জড়সড় হয়ে বিছানার একধারে আমি সোরে বোসলেম। ঘরের চতুর্দিকে নেত্রপাত কোত্তে কোত্তে কর্তা আমার কাছে বোসলেন।
কি তাঁর মতলব, কি কথা তিনি বলেন, ভাব বুঝতে না পেরে অবনতমস্তকে আমি ক্ষণকাল নীরব হয়ে থাকলেম। কর্তা হঠাৎ আমারে সম্বোধন কোরে গম্ভীরস্বরে বোল্লেন, “হরিদাস! পূর্বে কি তুমি বর্ধমানে ছিলে? মোহনলাল ঘোষ নামে একটি বাবুর সঙ্গে সেখানে তোমার সাক্ষাৎ হয়েছিল?” —দুই প্রশ্নেই আমি ‘হাঁ’ দিলেম। কর্তা বোল্লেন, “সেই মোহনলালবাবু এখন পাটনায়; তীর্থ কর্ম সমাধা কোরে আমি একবার পাটনায় গিয়েছিলেম, মোহনলালের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছিল। তিনি একজন জমীদার। এই জেলায় তাঁর একখানি জমীদারী আছে, মধ্যে মধ্যে কোন কোন বিষয়কার্যের উপলক্ষে পূর্বে পূর্বে তিনি এখানে আসতেন, এইখানেই তাঁর সঙ্গে আমার দেখাশুনো ছিল, আলাপপরিচয় হয়েছিল। পাটনা সহরে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ কোরে অনেক নূতন নূতন কথা আমি জানতে পেরেছি। তিনি বেশ লোক; ভাললোকের প্রতি ভগবানের কৃপা হয়, ভগবানের কৃপা হোলে কমলাও প্রসন্না হন, মোহনলালের প্রতি কমলার শুভদৃষ্টি পতিত হয়েছে। ছিলেন তিনি বড়মানুষ, আছেন তিনি বড়মানুষ, তার উপর সম্প্রতি নূতন সৌভাগ্যের উদয়। তাঁর একটি মাতুলানী সম্প্রতি লোকান্তর প্রাপ্ত হয়েছেন; তিনি বিধবা ছিলেন, সন্তান-সন্ততি জন্মে নাই, প্রায় লক্ষ টাকা উপস্বত্বের বিষয় তাঁর অধিকারে ছিল, অন্য কোন নিকট উত্তরাধিকারী না থাকাতে মোহনলালবাবু সেই বিষয়ের অধিকারী হয়েছেন। কতকগুলি সৎকার্যের পুরস্কারস্বরূপ রাজদরবার থেকে তিনি রাজা উপাধি লাভ কোরেছেন। তাঁর মুখে আমি তোমার অনেক সুখ্যাতি শ্রবণ কোরেছি। ছেলেবুদ্ধিতে তুমি তাঁর অবাধ্য হয়েছিলে, সে জন্য তিনি আপসোস করেন; অন্তরে কিন্তু তোমার উপর তিনি দয়াশূন্য হন নাই। এই সময় তুমি যদি একবার তাঁর সঙ্গে দেখা কোত্তে পার, তা হোলে তোমার বিশেষ উপকার হোতে পারে। আর দেখ— অবস্থাগতিকে তোমার চরিত্রের প্রতি প্রথমে আমার কিছু সন্দেহ জন্মেছিল, তোমাকে আমি তিরস্কার কোরেছিলাম, সে সব কথা তুমি আর মনে কোরো না; প্রকৃত অবস্থা আমি বুঝতে পারি নাই; মোহনবাবুর মুখে তোমার চরিত্রের প্রশংসা শুনে আমি বিশেষ সন্তুষ্ট হয়েছি। চিরদিন এই বাড়ীতে রেখে তোমাকে আমি পুত্রবৎ পালন করি, এই আমার ইচ্ছা। কিন্তু কিছু দিনের জন্য একবার তোমার পাটনায় যাওয়া আবশ্যক। কি বল? — যাওয়ার তোমার ইচ্ছা আছে?”
কথাগুলি আমি শুনলেম, প্রশ্নমাত্রেই কোন উত্তর দিলেম না। আমার মৌন দর্শন কোরে কর্তামহাশয় কি ভাবলেন, কি বুঝলেন, বোলতে পারি না, নীরবে কিয়ৎক্ষণ আমার দিকে চেয়ে থেকে সহসা তিনি গাত্রোত্থান কোল্লেন, ঘর থেকে বেরিয়ে চোল্লেন: যাবার সময় আমারে বোলে গেলেন, “আচ্ছা, বিবেচনা কর। পাটনায় যেতে তোমার ইচ্ছা আছে কি না, বিবেচনা কোরে স্থির কর, কল্য আমি তোমার মুখে এই বিষয়ের মীমাংসা শ্রবণ কোরবো।”
কর্তা চোলে গেলেন, আমি ভাবতে বোসলেম। মোহনলালবাবু লক্ষ টাকার বিষয় পেয়েছেন, রাজা হয়েছেন, আমারে স্মরণ কোরেছেন, কি ভাব? অকস্মাৎ আমার প্রতি কেন তিনি এত সদয়? তাঁর সঙ্গে আমার শেষ দেখা কাশীধামে। প্রথম প্রথম দিনকতক আদর পেয়েছিলেম। শেষকালে আমি তাঁর বিষনয়নে পড়ি; বুদ্ধির দোষে অথবা আত্মবিশ্বাসে আমি তাঁর চরিত্রের গুটিকতক কথা রমণবাবুর নিকটে ব্যক্ত কোচ্ছিলেম, গোপনে অন্তরালে দাঁড়িয়ে সেই সব কথা শ্রবণ কোরে তিনি আমার উপরে খড়্গহস্ত হয়েছিলেন, তদবধি তাঁর সঙ্গে আর আমার দেখা-সাক্ষাৎ নাই। এত দিনের পর অকস্মাৎ তিনি আমারে স্মরণ কোরেছেন, ভাব কি?— আর কি তবে আমার উপর কোন প্রকার উৎপীড়ন হবে না? বৈরিবেষ্টিত হয়ে আর কি আমারে অহরহ যন্ত্রণা ভোগ কোত্তে হবে না? সমস্ত উপদ্রবই কি থেমে যাবে? তাই যদি সত্য হয়, থামে যদি সত্য, তবে তো আমার গ্রহ সুপ্রসন্ন; কিন্তু তাও কি সম্ভব? দুরাচার রক্তদত্ত তাঁর প্রধান চেলা; কেবল চেলা নয়, বেতনভোগী চাকর। মোহনবাবুর পরামর্শে রক্তদন্ত চলে, বলে, কুকার্য করে, আবশ্যক হোলে মানুষ খুন কোত্তেও প্রস্তুত হয়। আমি ভুক্তভোগী, আমার উপর রক্তদন্তের বিষম আক্রোশ; মোহনবাবু যদি তারে নিবারণ করেন, তা হোলে সংসারে আমি এক প্রকার নিরাপদে থাকতে পারবো। কাশীতে আমি জানতে পেরেছিলেম, মোহনবাবু, একখানি পত্র লিখে রক্তদন্তকে আমার উপর দৌরাত্ম্য কোত্তে নিষেধ কোরেছিলেন; তার পর আবার যে সেই। এখন আমার কি করা কর্তব্য? পাটনায় গিয়ে মোহনবাবুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করা; পাটনায় আমার পরিচিত লোক কেহই নাই, কায়দায় পেয়ে মোহনবাবু, যদি আমারে আটক কোরে ফেলেন, তা হোলে আমি কি উপায়ে রক্ষা পাব? এ দিকে আমার অনেক কাজ বাকী, দুই জেলায় দুই মোকদ্দমা দায়ের, অমরকুমারীর উদ্ধারসাধন আমারই উদযোগ-সাপেক্ষ, কি করি?—যাই কি না যাই? প্রবলপক্ষের মনস্তুষ্টিসাধন করাতে উপকার আছে; মোহনবাবু প্রবল, আমি দুর্বল, তাঁর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা আমার অসাধ্য। তিনি কুপিত হোলে আমার বিস্তর অনিষ্ট কোত্তে পারেন; তিনি প্রসন্ন থাকলে সংসারে সর্বদা আমারে শঙ্কিত থাকতে হয় না। এই সকল বিবেচনা কোরে, কিঞ্চিৎ সন্দেহ থাকলেও অবশেষে স্থির কোল্লেম, পাটনায় একবার যাওয়াই কর্তব্য।
কর্তব্য স্থির কোরে বোসে আছি, ছোটবাবু এলেন। কর্তব্য স্থির হোলেও চিত্ত তখন আমার চিন্তাশূন্য ছিল না। আমারে চিন্তানিমগ্ন দর্শন কোরে উপবেশনের অগ্রেই ছোটবাবু জিজ্ঞাসা কোল্লেন, “কি ভাবছো হরিদাস? যখন আমি তোমাকে দেখি, তখনি তুমি বিমর্ষ থাকো; কত রকম আমোদজনক ঘটনা হয়, কত রকম আনন্দোৎসব উপস্থিত হয়, সে দিকে তোমার মন থাকে না, সর্বদাই তুমি যেন কি ভাব; এত অল্প বয়সে এত ভাবনা কি তোমার?”
আমি উত্তর কোল্লেম, “আপনি কখন আসবেন, তাই আমি ভাবছিলেম। আপনি বসুন কতকগুলি কথা আছে।” ছোটবাবু বোসলেন। প্রথমেই আমি কর্তার কথা তুল্লেম, কর্তা আমারে পাটনায় যেতে অনুরোধ কোচ্ছেন; পাটনায় একটি বাবু আছেন, সেই বাবুর সঙ্গে পূর্বে আমার জানাশুনা ছিল— আপনাদের বাড়ীতে আমি আছি, গল্প প্রসঙ্গে কর্তার মুখে সেই কথা জানতে পেরে সেই বাবুটি আমারে স্মরণ কোরেছেন, পাটনায় যেতে বোলেছেন; আমিও এক রকম স্থির কোরেছি, যাওয়া কর্তব্য। আপনি কিরূপ পরামর্শ দেন?”
ছোটবাবু বোল্লেন, “তোমাকে ছেড়ে দিতে আমার ইচ্ছা হয় না। পরামর্শ কি দিব? পাটনার বাবু কি প্রকৃতির বাবু, তোমার সঙ্গে তাঁর কিরূপ আলাপ, তাঁর কাছে তোমার কিরূপ প্রয়োজন, সে সব না জানলে কি প্রকারে পরামর্শ দেওয়া যায়?” সংক্ষেপে আমি গুটিকতক কথা বোল্লেম, মোহনবাবু আমার ভয়ের কারণ, সে কথা বোল্লেম না, সাক্ষাৎ কোত্তে পাল্লে কোন প্রকার উপকারের সম্ভাবনা আছে, কেবল এই পর্যন্তই ছোটবাবুকে আমি জানালেম। তিনি তখন একটু চিন্তা কোরে বোল্লেন, “কর্তা যদি ইচ্ছা করেন, তুমি যদি ইচ্ছা কর, তবে একবার যেতে পার, কিন্তু বেশী দিন সেখানে থেকো না, শীঘ্র আবার ফিরে এসো। কবে যাবে স্থির কোরেছ?”
আমি তখন আর একখানা ভাবছিলেম, “কবে যাবে স্থির কোরেছ” এই প্রশ্নের উত্তরের ভূমিকায় আমি বোল্লেম, স্থির এখনো কিছুই করি নাই, আপনার অভিপ্রায় জানবার জন্য অপেক্ষা কোচ্ছিলেম। এখানে এসে আমি অনেক রকম কাজ করেছি। অনেক রকম তাজ্জব ব্যাপার দর্শন কোরেছি, অনেক রকম অদ্ভুত অদ্ভুত কথাও শ্রবণ কোরেছি, একটি কাজ আমার বাকী আছে।” — ছোটবাবু জিজ্ঞাসা কোল্লেন, কোন কার্য বাকী?”
সেই পূর্বকথাই আমি পুনরোল্লেখ কোল্লেম,— পায়রাবাবুকে একবার এই বাড়ীতে হাজির করা। কি কারণে হাজির করা প্রয়োজন, স্পষ্ট কিছু ভাঙলেম না, কেবল এইমাত্র বোল্লেম, “ভূতের ব্যাপারের সঙ্গে পায়রাবাবুর অতি নিকট সম্বন্ধ। ভূতগুলি উদ্ধার হয়ে গিয়েছে, সেই দুঃখে পায়রাবাবু ম্রিয়মাণ আছেন; তাঁরে গুটিকত প্রবোধ বাক্য—”
হাস্য কোরে ছোটবাবু বোল্লেন, “পায়রাকে প্রবোধ দিয়ে তুমি ঠাণ্ডা কোত্তে পারবে, এমন আমার বিশ্বাস হয় না। পায়রাবাবুটি তুখোড় লোক, বেশী চালাক, সকল রকমে সকল দিকেই তার বুদ্ধি খেলে; অল্পদিনে সে সব আমি বুঝতে পেরেছি। পায়রা এ দেশে ছিল না, নূতন এসেছে, সে কথা তুমি শুনেছ; নূতন লোকের সঙ্গে বেশী ঘনিষ্ঠতা না কোল্লে চরিত্র ধরা যায় না, তথাপি বিনা ঘনিষ্ঠতায় পায়রাকে আমি এক প্রকার চিনে নিয়েছি। পায়রার একটা রোগ আছে; ঔষধের মোড়ক নিয়ে তুমি—”
হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটে এসে রামদাস সেই সময় সংবাদ দিলে, “নূতন বিপদ উপস্থিত! পুলিশের লোক এসেছে! খুনের খবর এনেছে! আমাদের বাড়ীতে যিনি আগে আগে ঠাকুরপূজা কোত্তেন, সেই বামুনঠাকুর সঙ্গে আছেন। চাতালপুর গ্রামের এক মাঠের ধারে একটা গাছতলায় মেয়েমানুষ খুন! এই রকম কথা তারা বোলছে, উপরে আসতে চাচ্ছে, আমি তাদের কি বোলবো?”
খুনের খবর শুনে চমকিতভাবে ছোটবাবু বোল্লেন, “কোথায় মাঠের ধারে খুন হয়েছে, আমাদের বাড়ীতে তার কি? আচ্ছা, দাঁড়াতে বল গে, আমি যাচ্ছি।”
রামদাস নেমে গেল। একটু পরে একটি জামা গায়ে দিয়ে ছোটবাবু উপর থেকে নামলেন, অনিশ্চিত ভাবনায় কৌতূহলবশে আমিও সঙ্গে গেলেম; — গিয়ে দেখি, একজন ফাঁড়ীদার ব্রাহ্মণ, আর দুই জন বরকন্দাজ, সঙ্গে একজন ভট্টাচাৰ্য। ভট্টাচাৰ্যকে সম্বোধন কোরে ছোটবাবু জিজ্ঞাসা কোল্লেন, “কি মথুরে কাকা? ব্যাপার কি? আপনার সঙ্গে পুলিশ কেন?”
ছোটবাবু বোল্লেন মথুর কাকা, আমি শুনলেম মথুর কাকা, এখন মথুর কাকা কি উত্তর দেন, সেই কথা শুনবার জন্য তাঁর মুখ-পানে আমি চেয়ে থাকলেম। মথুর কাকা একবার ফাঁড়ীদারের মুখের দিকে চাইলেন, ফাঁড়ীদার বোলতে লাগলো, “চাতালপুরের এক বাগানের এক বৃক্ষতলে একটি স্ত্রীলোকের মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছে, গলায় দড়ী কিম্বা সর্পাঘাত কিম্বা বিষখাওয়া, তার কোন নিদর্শন পাওয়া যাচ্ছে না। কেহ তাকে খুন কোরেছে কি না, তাও প্রকাশ হোচ্ছে না, কে সেই স্ত্রীলোক, কোথা থেকে এসেছিল, সে কথাও কেহ বোলতে পারে না। গ্রামের কেহ নয়; গ্রামের লোকেরা চিনতে পাচ্ছিল না, দু একজন বোলেছিল, তিন চারি দিন গ্রামের রাস্তার ধারে সেই স্ত্রীলোককে তারা দেখেছে। আর কোন বিশেষ কথা তার কিছুই জানে না। আমি তদারক কোচ্ছিলেম, এমন সময় এই ব্রাহ্মণঠাকুর সেইখানে উপস্থিত হোলেন, লাশ দেখে ইনি চিনতে পাল্লেন। এরি মুখে আমি শুনলেম, সেই স্ত্রীলোক আপনাদের বাড়ীতে ছিল, তার নাম রাধারাণী। কি প্রকারে মোরেছে, চাতালপুরে কেন গিয়েছিল, এই সব কথা আমাদের জানা দরকার। আপনাকে একবার চাতালপুরে যেতে হবে, মোড়ল-চৌকিদার মোতায়েন রেখে আপনার কাছে আমি এসেছি।”
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই কথা। ফাঁড়ীদারকে কেহ বোসতে বোল্লে না, আমরাও কেহ বোসলেম না, বরকন্দাজেরা এক এক লাঠি ঘাড়ে কোরে প্রাচীর ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো। ফাঁড়ীদারের কথায় ছোটবাবু বোল্লেন, “সে সব কাজ তোমাদের, আমাকে কেন চাতালপুরে নিয়ে যাবার আকিঞ্চন পাও? ভট্টাচাৰ্য মহাশয় চিনতে পেরেছেন, নাম রাধারাণী, সে কথাও বোলেছেন, এখন আমি বুঝতে পাচ্ছি। সে স্ত্রীলোক আমাদের বাড়ীর লোক নয়, কিছুদিন আমাদের বাড়ীতে ছিল, একমাসের বেশী হলো আপন ইচ্ছায় চোলে গিয়েছিল; তার পর কোথায় কি হয়েছে আমরা তার কি জানি? কোথায় কি রকমে মোরেছে, সরকারী ডাক্তারেরা পরীক্ষা কোল্লেই জানতে পারবে। সনাক্ত হয়ে গিয়েছে, তবে আর আমাকে কেন কষ্ট দিতে চাও? তোমরাই বা কষ্ট পেয়ে এতদূর কেন এসেছ? স্বস্থানে ফিরে যাও; ঐরূপ অপঘাতমৃত্যুর তদারকে যেমন যেমন তোমাদের কর্তব্য, আইন যেমন বলে, তাই তোমরা কর গে; আমার সেখানে যাবার কোন দরকার নাই; আমি যাব না।”
পুলিশের লোক প্রায়ই জুলমবাজ হয়; ভদ্রলোককে অনর্থক কষ্ট দিয়ে ষটচক্র সৃজন কোরে আপনাদের স্বার্থসিদ্ধির চেষ্টা পায়। এই ফাঁড়ীদারটী কিছু ভালমানুষ ছিল; বোধ হয় নূতন লোক, পুলিশের কায়দা দস্তুরমত শিক্ষা করে নাই। ছোটবাবুর কাটা কাটা কথাগুলি শ্রবণ কোরে সে লোক আর কোন মারপেঁচের কথা বোল্লে না, আট গড়া পয়সা রাহাখরচ গ্রহণ কোরে অল্পে অল্পে বিদায় হয়ে গেল। কায়দার মধ্যে কেবল এইটুকু দেখলেম, মথুর ভট্টাচাৰ্যকে ছেড়ে গেল না।
আমরা আবার উপরে গিয়ে উঠলেম; যে সব কথা শুনে এলেম, অননুচ্চস্বরে তারই আলোচনা কোত্তে লাগলেম। রামদাসকে সাবধান কোরে ছোটবাবু বোলে দিলেন, খবরদার, কর্তা যেন এ সব কথা না শোনেন। বাড়ীর মেয়েরাও যেন এ সব কথা শুনতে না পায়। কাহারো কাছে তুমি এ গল্প কোরো না।”
স্বীকার কোরে রামদাস আপন কর্মে গেল, ছোটবাবুতে আমাতে নির্জনে থাকলেম। ছোটবাবু বোল্লেন, “দেখ হরিদাস, কোথাকার পাপ কোথায়? পাপের প্রায়শ্চিত্ত এই রকমেই হয়। রাঙামামী মোরেছে, আত্মঘাতিনী হয়েছে কিম্বা কেহ তারে খুন কোরে মাঠের ধারে ফেলে গিয়েছে, ঠিক জানা যাচ্ছে না বটে; কিন্তু প্রায়শ্চিত্ত ঠিক হয়েছে। যে রকম ঢলাঢলি আরম্ভ হয়েছিল, আমি তাতে ভয় পেয়েছিলেম; বাড়ীর ভিতর পাছে কোন কাণ্ড ঘটে, বাড়ীর ভিতর পাছে খুনোখুনী হয়, সেই ভয়ে সদাই আমি শঙ্কিত থাকতেম। ভূতের কাণ্ড গেল, দাদার কাণ্ড গেল, তার পর তোমার নামে চোর অপবাদ রটলো, আর কিছু দিন থাকলে আরো যে কত রকম কি কারখানা হোতো, কে বোলতে পারে? ভালোয় ভালোয় আপনাআপনি বিদায় হয়ে গিয়েছিল, জন্মের মত পৃথিবী হোতে বিদায় হয়ে গেল, এক রকম হলো ভাল। সকল পাপের যদি এই রকম হাতে হাতে প্রায়শ্চিত্ত হয়, তা হোলে সংসারের পাপ-তাপ অনেকটা কম হয়ে আসে।”
ফাঁড়ীদারের কথা আমি শুনেছি, ছোটবাবুর কথাও শুনলেম, কিন্তু ছোটবাবুর শেষের কথাগুলি বিশেষ মনোযোগ দিয়ে শুনলেম না। নূতন একটা কল্পনা মনোমধ্যে সমূদিত হয়ে আমারে কিছু অন্যমনস্ক কোরে দিয়েছিল। ছোটবাবুর কথা সমাপ্ত হলো কিম্বা আরও কিছু, তাঁর বক্তব্য বাকী থাকলো, সে দিকে লক্ষ্য না রেখে হঠাৎ আমি মন্তব্য দিলেম, “হাতে হাতে প্রায়শ্চিত্ত হওয়া খুব ভাল। আর একজন যদি এই সময় একটা প্রায়শ্চিত্ত করে, তা হোলে আমার একটা মনস্কামনা পূর্ণ হয়, মস্ত একটা সন্দেহও জন্মে রয়েছে, সেটাও দূর হয়ে যায়।”
তাৎপর্যগ্রহণে অসমর্থ হয়ে সকৌতুকে ছোটবাবু আমারে জিজ্ঞাসা কোল্লেন, “আবার কার কি রকম প্রায়শ্চিত্ত হরিদাস? যার পাপ, সে তো আপনার জীবন দিয়ে মহাপ্রায়শ্চিত্ত কোরে গেল, তবে আর তুমি অন্য কোন পাপীর প্রায়শ্চিত্তের কথা বোলছ?”
আমি একটু ভাবলেম, সহসা যদি অকপটে মনের কথা প্রকাশ করি, তা হোলে হয় তো উপহাসেই ছোটবাবু আমার কথাটা উড়িয়ে দিবেন, একটু বাঁধনী রাখা আবশ্যক। মনে মনে বন্ধনের সূত্র কল্পনা কোরে ছোটবাবুকে আমি বোল্লেম, “আপনাদের গ্রামে অনেক রকম তামাসা আমি দেখলেম, তামাসা-দর্শনে প্রায় সকল লোকেই কৌতুক অনুভব করে, আমোদ অনুভব করে, যারা তামাসা দেখায়, তাদের অনেকের রঙ্গভঙ্গ দর্শনে প্রায় সকলেই অবিচ্ছেদে হাস্য করে; এখানকার তামাসায় আমি দুই প্রকার দেখলেম। হাস্যের উদয় হয়, কতক তামাসায় কষ্ট অনভূত হয়ে থাকে। কতক তামাসায় তামাসগীর লোক এখানে অনেক আছে বোধ হয়। একটি কথা আপনাকে আমি জিজ্ঞাসা কোত্তে চাই; এ গ্রামে কি দুই একজন বহুরূপী পাওয়া যায়? বহরূপীদের তামাসা বড় চমৎকার। একটি বহুরূপীর ক্রীড়াদর্শনে আমার অভিলাষ জন্মেছে, আছে কি কোন বহরূপী?”
একদৃষ্টে আমার নয়ন নিরীক্ষণ কোরে ছোটবাবু বোপ্পেন, “এ যে দেখছি তোমার অদ্ভুত অভিলাষ। সকল জায়গায় কি বহরূপী থাকে? সকল পল্লীগ্রামে কি বহুরূপী পাওয়া যায়? আমাদের গ্রামে বহুরূপী নাই; তবে মধ্যে মধ্যে দুই একটা মেলার স্থলে দুই একজন বহুরূপী আসে। মধ্যে মধ্যে কখন কখন গৃহস্থ লোকের বাড়ীতেও এক একজন বহুরূপী দেখা দেয়, এই পর্যন্ত আমি জানি। এ গ্রামে বহুরূপী নাই।”
আবার আমি একটু ভাবলেম; ভেবে ভেবে জিজ্ঞাসা কোল্লেম, “বহরূপীদের কোনপ্রকার সজ্জা এখানকার নিকটবর্তী কোন স্থানে কাহারো নিকটে পাওয়া যেতে পারে না?”— ছোটবাবু বোল্লেন, “যেখানে বহুরূপী নাই, সেখানে বহুরূপীর সাজ পাওয়া অসম্ভব; তবে এখানে যাত্রার দল আছে তাদের কোন রকম সাজ পেলে যদি তোমার কোন কাজে লাগে, তা বরং যোগাড় করা যেতে পারে।”
না পাওয়ার চেয়ে বরং তা পাওয়াও ভাল, এই বিবেচনা কোরে আমি বোল্লেম, “যাত্রার দলে যারা মুনিগোঁসাই সাজে, তাদের সেই রকমের একটা সাজ পেলে একটি লোকের উপকার হয়। আপনি যদি দয়া কোরে সেই সাজ আমারে আনিয়ে দেন, তা হোলে আমি উপকৃত হই।”
ছোটবাবু সম্মত হোলেন। আর তখন আমাদের বেশী কথা কিছু হলো না। ছোটবাবু অন্দরে প্রবেশ কোল্লেন। উপর থেকে নেমে গিয়ে আমি রামদাসের অন্বেষণ কোল্লেম, রামদাসকে পেলেম, চুপি চুপি তারে একটি পরামর্শ দিলেম। যেন একটু ভয় পেয়ে রামদাস বোল্লো, “আমায় ও কথা কেন বল? সে কি আমার কর্ম? আমি পারব না। তুমি যদি নিজে পার, চেষ্টা কোরে দেখ; আমি বরং তোমার সঙ্গে থাকবো।”
রামদাসের শঙ্কিতভাব অনুভব কোরে, মনে মনে হেসে পুনর্বার আমি তারে বোল্লেম “ভয় পাও কেন? সরপট তোমারে কোন কাজ কোত্তে হবে না, সে বাড়ীতে যেতে হবে না, পল্লীর অপর কোন লোককে জিজ্ঞাসা কোরে শুধু কেবল জেনে আসবে সেই লোক এখন এ গ্রামে আছে কি না? সর্বদা বাড়ীতে থাকে কি না? সর্বদা যদি না থাকে, কোন সময় তার দেখা পাওয়া যায়, শুধু কেবল সেইটুকু জেনে আসতে পার আমার কাজ হবে।”
গণগণেশ্বরে আপন মনে কিয়ৎক্ষণ গুঞ্জন কোরে রামদাস শেষকালে বোল্লে, “তোমার খেলা তুমিই বুঝতে পার, খেলার ভাল-মন্দ তুমিই জানো; আমি তোমাদের হুকমের চাকর, কাজেই আমাকে সব রকম হুকুম তামিল কোত্তে হয়। এখন তুমি যে কথা বোল্লে, সে কাজটা হয় তো আমি পারবো। রাত্রের কথা নয়, প্রভাত হোক, আমি একবার চেষ্টা কোরে দেখে আসবো।”
কাৰ্যসিদ্ধির আভাষ পেয়ে পুনর্বার আমি বোল্লেম, “প্রভাতে হোক, বেলা এক প্রহরে হোক, দ্বিপ্রহরে হোক, সন্ধ্যার মধ্যে সংবাদটা পেলেই আমি যথাকর্তব্য অবধারণ কোত্তে পারবো; কেবল কথাটিমাত্র এনে দিবে, এই তোমার কাজ।”
কি একটা চিন্তা কোরে রামদাস বোল্লে, “ঐ পর্যন্ত আমার কাজ, তা আমি বুঝলেম, ভাবতে কথাটা খুব সহজ বটে, কিন্তু আমার মনে যেন কোন প্রকার গোলমাল ঠেকছে। দেখ বাপু, আর যেন কিছু বাড়াবাড়ি করো না; যা করবার, ঢের কোরেছ, তার উপর আর কিছু বেশী হোলে ঢলাঢলি আরো বেশী হবে, আমি কেবল সেই ভয় করি, যে সব কাজ তুমি কোরেছ, এক রকম মানিয়ে গিয়েছে; সে সময় কর্তা বাড়িতে ছিলেন না, ততটা গোলমাল হয় নাই; কর্তা এখন ফিরে এসেছেন, সাবধান হয়ে কাজ কোরো। খবরটা আমি তোমাকে এনে দিব, তুমি নিশ্চিন্ত থাকো।”
রামদাসের তখন বাড়ির ভিতর কাজ ছিল, রামদাস অন্দরে গেল, আমি আপনার ঘরে গিয়ে এক প্রকার নিশ্চিন্ত হয়ে বোসলেম।
রাত্রের কার্য এই পর্যন্ত। আহারান্তে ঘরের দরজা বন্ধ কোরে আমি শয়ন কোল্লেম। যেটি আমার নূতন সংকল্প, মনে মনে খানিকক্ষণ সেইটি আলোচনা কোরে, পাকিয়ে রেখে, ভবিষ্যৎ কর্তব্য অবধারণ কোতে লাগলেম। বাধা পোড়ে গেল। আমার গৃহদ্বারে দুই তিনবার জোরে জোরে করাঘাত। শুয়ে শুয়েই আমি জিজ্ঞাসা কোল্লেম, কে?— উত্তর পেলেম না। সদরদরজা বন্ধ হয়েছিল, বাহিরের লোক আসবে না; রূপসী পালিয়ে গিয়েছে, রূপসীর ভয়ও ছিল না; আমি উঠলেম। পুনর্বার দ্বারে করাঘাত। ধীরে ধীরে দরজা খুলে আমি পাশ কাটিয়ে সোরে দাঁড়ালেম: গৃহের দীপ তখনো নির্বাপিত হয় নাই; সম্মুখে দেখি— কর্তা।
অকস্মাৎ আমার তখন কেমন একটা আতঙ্ক এলো। এত রাত্রে কর্তা এ ঘরে কেন? রামদাস বুঝি আমার পরামর্শের কথা কর্তাকে কিছু জানিয়েছে. তাই শুনে কর্তা বুঝি আমারে ধমক দিতে এসেছেন, এইরূপ ভাবনাই আমার আতঙ্কের কারণ। শেষে বুঝলেম; তা নয়; বিছানার উপর উপবিষ্ট হয়ে, নিকটে আমারে ডেকে, প্রফল্লবদনে কর্তা জিজ্ঞাসা কোল্লেন, “সে কথা মনে আছে হরিদাস? বিবেচনা কোরে কিরূপে স্থির কোরেছ? পাটনায় যেতে ইচ্ছা হয়; মোহনলালবাবু বেশ লোক, তিনি একবার তোমাকে দেখতে চান; দেখা কোল্লে বোধ করি তোমার পক্ষে ভাল হবে; তুমি তোমার নিজের জাতিকুল জানতে না, এখনো জান না; কিন্তু মোহনলালবাবু বোলেছেন, তিনি তোমার জাতিকুল অবগত আছেন। কথার ভাবে আমি বুঝেছি, তুমি তাঁর স্বজাতীয় কোন ভদ্রলোকের সন্তান। তার সময় এখন খুব ভাল, তোমার প্রতিও তিনি বেশ সদয়, এই সময় একবার যদি তুমি দেখা কর, খুব ভালই হবে, এইরূপ আমি বুঝতে পাচ্ছি। যাওয়া যদি তোমার মত হয়, বিলম্ব কারো না, বেশী দিন আর তিনি পাটনায় থাকবেন না; এক মাসের ভিতরেই তিনি শ্রীবৃন্দাবন- যাত্রা ’কারবেন, এইরূপে আমি শুনে এসেছি। কেন আমি তোমাকে এত কথা বোলছি, তা তুমি বুঝতে পেরেছ? তোমার উপকার হোলে, আমি সন্তুষ্ট হব, সেই জন্যই বলা। সন্ধ্যাকালে আমি পাঁজি দেখেছি, আগামী কল্য শুভদিন, কল্যই তুমি যাত্রা কোত্তে পার। রাহাখরচ ইত্যাদি যাহা কিছু প্রয়োজন, সব আমি দিব, কল্যই তুমি যাও, এই আমার ইচ্ছা।”
কর্তার ইচ্ছায় আমার একটা বড় ইচ্ছা চরিতার্থ করবার বাধা পড়ে, তাই ভেবে, বিনীতভাবে মৃদুস্বরে আমি বোল্লেম, “আজ্ঞা! আপনার ইচ্ছার অবাধ্য হওয়া আমার উচিত হয় না, কিন্তু এখানে আমার একটি বিশেষ কার্য আছে. সপ্তাহের মধ্যে সেকার্য আমি সিদ্ধ কোত্তেও পারবো, এমন আশা রাখি; অনুগ্রহ পূর্বক সপ্তাহের পরে আপনি আর একটি শুভদিন স্থির কোরে দিবেন, সেই দিনেই আমি রওনা হবো। মোহনলালবাবু একমাস পাটনায় থাকবেন, তার মধ্যে আমি সেখানে উপস্থিত হয়ে দেখা কোত্তে পারবো, তাতে আর কোন সন্দেহ থাকবে না।
কর্তা বোল্লেন, “আচ্ছা, তবে তাই কোরো, কিন্তু দেখো, বেশী বিলম্ব যেন না হয়। এখানকার কাজটা সপ্তাহের অগ্রে যাতে সমাধা কোত্তে পার, চেষ্টা কোরো।”
এইরূপ উপদেশ দিয়ে কর্তা উঠে গেলেন, আবার আমি দরজা বন্ধ কোরে শয়ন কোল্লেম। পাটনায় আমি যাব, ভেবে আমার ভয় হলো কি আহ্লাদ হলো, নিজেই যেন আমি সে ভাবটা স্থির কোত্তে পাল্লেম না। মোহনলালবাবু বর্ধমানে আমার প্রতি যেরূপ সদয়ভাব—নির্দয়ভাব দেখিয়েছিলেন, স্মরণ হলো; ভেলুয়া-চটিতে গৃহদাহের সময় তিনি আমারে যেরূপে আদর কোরেছিলেন, স্মরণ হলো; বারাণসীধামে প্রথম দর্শনে তাঁর প্রসন্নতা আমি লাভ কোরেছিলেম, তার পর অপ্রসন্নতার আক্রমণ, সে কথাও স্মরণ হলো। এখন পাটনায় গিয়ে আদর পাব কিম্বা তাঁর রক্তচক্ষু দর্শন কোরবো, নিশ্চয়তা নাই, এইরূপ আমি ভাবলেম। রক্তচক্ষু দর্শন সত্যই যদি আমার ভাগ্যে ঘটে, তাতেই বা এত কি ভয়? মোহনবাবু মনুষ্য, রাক্ষস নন, রাগের বশে টপ কোরে তিনি আমারে খেয়ে ফেলবেন না; যদি বেগতিক দেখি, পালিয়ে গিয়ে আত্মরক্ষা কোত্তে পারবো। পাটনায় আমি যাব। মোহনবাবু যেতে বোলেছেন, সেই জন্যই আমারে যেতে হবে, কর্তা যদি এমন কথা বোলতেন, তা হোলে আমি যেতেম না। আজ রাত্রে যে কথা শুনলেম, সেই কথার উপরেই আমার ভবিষ্যৎ আশার প্রধান একটি অংশ নির্ভর কোচ্ছে, সেই জন্যই আমি যাব।
কর্তা বোলে গেলেন, মোহনলালবাবু বোলেছেন, আমি তাঁর স্বজাতি; এ কথা যদি সত্য হয়, তা হোলে মোহনলালবাবু আমার অপরাপর পরিচয়ও অবশ্য জানেন। যে পরিচয় আমি জন্মাবধি জানি না, সেই পরিচয় আমি তাঁর মুখে শুনতে পাব; মনে একটি উল্লাস জন্মিল; সেই জন্যই আমি যাব।
একরকম সংকল্প আমি স্থির কোল্লেম, নিশ্চিন্ত হোলেম না; মনে আবার একটা তর্ক উঠলো। পাটনায় আমার কথাটা কেন উঠেছিল? কে তুলেছিলেন? মোহনবাবু কিম্বা জয়শঙ্করবাবু? মোহনবাবু হঠাৎ একজন অপর লোকের কাছে আমার কথা তুলবেন, এমন তো সম্ভব বোধ হয় না; জয়শঙ্করবাবুই তুলে থাকবেন; কিন্তু কেন? আবার মনটা আমার অন্যদিকে ঘুরে গেল; যে সন্দেহটা মনে মনে চাপা ছিল, সেই সন্দেহ আবার জাগলো। অজ্ঞান অবস্থায় ত্রিপুরা জেলায় যারা আমারে ফেলে রেখে গিয়েছে কর্তা সে কথা অস্বীকার কোল্লেও অন্য সূত্রে সে তত্ত্ব আমি জেনেছি। সূত্র কিছু না থাকলেও তাই-ই আমি জানতেম; কেন না অচেতন লোকেরা নিজের চেষ্টায় হেঁটে আসতে পারে না। আমি অচেতন ছিলেম, সেই অবস্থায় জয়শঙ্করবাবু এখানে আমারে দেখেছেন; তাতেই বুঝা গিয়েছে, আমার সঙ্গে অন্য লোক ছিল, আমারে এখানে রেখেই তারা পালিয়েছে। কারা তারা, প্রথমেই আমি অনুমান কোরেছিলেম। বনের ভিতর যারা আমারে ধোরে রেখেছিল, দুশ্চারিণী নবীনকালী যাদের সঙ্গিনী, তারাই ঢাকা থেকে ত্রিপুরায় আমারে এনেছিল, তাতে আর সন্দেহ নাই। তারা যদি নূতন লোক হতো, আমার বিপক্ষদলের সঙ্গে তাদের যদি কোন সংস্রব না থাকতো, তা হোলে এমন ঘটতো না। পূর্বেই আমি স্থির কোরেছিলেম, রক্তদন্তের চক্রের সঙ্গে সঙ্গে নানা দিকে নানা লোক ঘোরে। ঢাকায় যারা আমারে ধোরেছিল, তারা যে রক্তদন্তের লোক কিম্বা রক্তদন্তের শিক্ষিত গুপ্তচরের সহকারী লোক, সেটা নিঃসন্দেহ। রক্তদন্ত মোহনবাবুর পেটাও লোক।
রক্তদন্ত অথবা রক্তদন্তের চরেরা আমার সম্বন্ধে যে সব কাজ করে, মোহনবাবু অবশ্য সে সব কাজের খবর পান। জয়শঙ্করবাবু ইচ্ছায় অথবা অনিচ্ছায় মোহনবাবুর কাছে আমার নাম কোরেছিলেন, মোহনবাবু অমনি সদয় হয়ে আমারে দেখতে চেয়েছেন, পাটনায় আমারে যেতে বোলেছেন, কথা কিছু আশ্চৰ্য বটে! কথার ভিতর কিছু, গোলমাল আছে, তাও যেন আমি বুঝতে পাচ্ছি, তত্ত্বও আমি যাব। কোন গতিকে মোহনবাবুর মূখে আমি আমার নিজের পরিচয়টা যদি জেনে নিতে পারি, তা হোলে আমার একটা বিশেষ উপকার হবে, বুকের উপর থেকে ভারী একটা বোঝা নেমে যাবে; অজ্ঞ পরিচয় সর্বদা আমারে অপর লোকের কাছে সঙ্কুচিত হয়ে থাকতে হয়, সে অসঙ্কোচটা দূরে হবে, মাথা উচুঁ কোরে পূর্ণ সাহসে বুক ফুলিয়ে সব জায়গায় আমি বেড়াতে পারবো, সকল লোকের কাছে সপ্রতিভ থাকবো; কেহ পরিচয় জিজ্ঞাসা কোল্লে বোবা হয়ে থাকতে হবে না, কোথাও কাহার কাছে মাথাও হেঁট হবে না। পরিচয় জানবার জন্যই পাটনায় আমি যাব।
আর একটা কথা আমার মনে হলো। জয়শঙ্করবাবু বোলেছেন, মোহনলালের সঙ্গে তাঁর পূর্বাবধি পরিচয়। ত্রিপুরায় জয়শঙ্করবাবুদের বাড়ীতে আমি আছি, চক্ৰঘূর্ণনে মোহনবাবু হয় তো সে সংবাদ রাখতেন, জয়শঙ্করের মুখে আমার নাম শুনেই হয় তো আর কোন মতলব তিনি স্থির কোরেছেন; সেই মতলব সিদ্ধ করবার অভিপ্রায়েই পাটনায় আমারে যেতে বোলেছেন, এইটাই যেন সম্ভব বোধ হোচ্ছে। হয় হোক, তাই হোক; তবু, আমি যাব।
রাত্রে আর নিদ্রা হলো না; চিন্তায় চিন্তায় সারা রাত্রিজাগরণ। ঊষাপক্ষিগণ বৃক্ষে বৃক্ষে কলরব আরম্ভ কোল্লে; যে সকল পক্ষী গীত গায়, তাঁদের সুরে তারা ঊষাবন্দনা আরম্ভ কোল্লে; পল্লীবাসী শ্রমজীবী লোকেরাও একে একে জেগে উঠলো, নিকটে নিকটে কত লোকের কত প্রকার অস্পষ্ট কথা আমার শ্রবণগোচর হোতে লাগলো; গবাক্ষপথ দিয়ে ঘরের ভিতর আলো এলো, রজনীপ্রভাত।
বেলা দুই প্রহরের মধ্যে নূতন ঘটনা কিছুই হলো না। অপরাহ্ণে। রামদাস এসে আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ কোল্লে।
রামদাসকে আমি একটি দৌত্যকার্যে নিযুক্ত কোরেছিলেম, সেই কার্যে সিদ্ধমনোরথ হয়ে চুপে চুপে রামদাস আমারে সংবাদ দিলে, “সে লোক এ গ্রামে আছে, আরো তিন দিন থাকবে, তিন দিন পরে স্থানান্তরে চোলে যাবে।” রামদাসকে তখন আমি আর কোন কথা জিজ্ঞাসা কোল্লেম না, রামদাস চোলে গেল।
ঠিক সন্ধ্যার সময় একজন ছোকরাকে সঙ্গে কোরে ছোটবাবু এলেন। ছোকরার হাতে একটা পুঁটলী। ছোটবাবুর আদেশে সেই পুঁটলীটি আমার বিছানার উপর রেখে প্রণাম কোরে ছোকরা শীঘ্র শীঘ্র বিদায় হয়ে গেল। পুঁটলীটি খুলে ছোটবাবু আমারে কতকগুলি জিনিস দেখালেন। একখানি গেরুয়া বসন, একখানি নামাবলী, পরচুলা, শ্বেতবর্ণ দীর্ঘ দাড়ী, শ্বেতবর্ণ গোঁপ, পিঙ্গলবর্ণ জটা, আর একছড়া হরিনামের জপমালা; জিনিসগুলি দর্শন কোরে আমি হাস্য কোল্লেম।
হাস্য কোরে ছোটবাবু আমারে জিজ্ঞাসা কোল্লেন, “এই তো বহুরূপীর সজ্জা এলো, এ সজ্জাগুলি নিয়ে তুমি কি কোরবে? —আমি উত্তর কোল্লেম, কি আমি কোরবো আজ রাত্রে তা আপনি শুনতে পাবেন না; কাৰ্যসিদ্ধির পর কল্য কিম্বা পরশু সমস্তই আপনি জানতে পারবেন। সে প্রসঙ্গে ছোটবাবু আর কোন কথা বোল্লেন না; অন্য কথা উত্থাপন কোরে আমার গায়ে হাত দিয়ে বোল্লেন, “তুমি কি নিমন্ত্রণে যেতে ভালবাস? আজ আমাদের গ্রামের দক্ষিণপাড়ায় এক বাড়ীতে সত্যনারায়ণের সিন্নী; — সত্যনারায়ণের কথা হবে, কৃষ্ণমঙ্গল গীত হবে, কৃষ্ণভক্তি যাত্রা হবে, খুব ঘটা। আমাদের নিমন্ত্রণ আছে, আমি যাব, কর্তাও যাবেন, তোমার কি যাবার ইচ্ছা আছে?”
উল্লাসপ্রাপ্ত হয়ে মনে মনে আমি বোল্লেম, সত্যনারায়ণ দীর্ঘজীবী হয়ে থাকুন, ভালই হলো; যে ভাবনা আমি ভাবছিলেম, সত্যনারায়ণের ইচ্ছায় সে ভাবনা অন্তরে গেল, ছোটবাবুর প্রশ্নে উত্তর কোল্লেম, “আজ্ঞা না; আজ আমার শরীর বড় ভাল নয়, নিমন্ত্রণে আমি যেতে পারবো না।”
ছোটবাবু আমারে আর কিছু বোল্লেন না, খানিকক্ষণ সেইখানে বোসে অন্য প্রসঙ্গে দুইটি চারিটি কথা কোয়ে, তিনি অন্দরে প্রবেশ কোল্লেন, আমি এদিকেও প্রস্তুত হোলেম। নিমন্ত্রণে যাব না, তবে আমার প্রস্তুত হওয়া কিসের জন্য, কিঞ্চিৎ পরে তাহার পরিচয়।
রামদাসকে সঙ্গে নিয়ে কর্তা আর ছোটবাবু বাড়ী থেকে বেরলেন; যে বাড়ীতে নিমন্ত্রণ, সেই বাড়ীতেই গেলেন। কথা আছে, গীত আছে, যাত্রা আছে শীঘ্র তাঁরা ফিরে আসবেন না, তা আমি জানতে পাল্লেম। পাচিকা-ঠাকুরাণী সেই সময় একবার আমার ঘরে এসেছিলেন, তাঁরে আমি বোল্লেম, অসুখ আছে, রাত্রে আজ আমি কিছু আহার কোরবো না। সেই কথা শুনে, তিনি একবার আমার কপালে হাত দিয়ে বিষণ্ন বদনে বোল্লেন, “তাই তো! গা গরম হয়েছে! কপালের শির লাফাচ্ছে। মাথা ব্যথা কোচ্ছে বুঝি? চুপ কোরে শুয়ে থাক; বেশী রাত জেগো না। শীঘ্র যাতে ঘুম হয়, সেই চেষ্টা কর।”
শয়নের উপদেশ দিয়ে পাচিকা-ঠাকুরাণী অন্তঃপুরে প্রবেশ কোল্লেন। আমি আপনি আপনি হাস্য কোল্লেম। কতকগুলি স্ত্রীলোকের স্বভাব এইরূপে যে, কোন প্রকার অসুখের কথা শুনলে— অসুখটা সত্যই হউক বা মিথ্যাই হোক— স্নেহ জানিয়ে সেই কথারই পোষকতা করেন, সাবধান থাকবার পরামর্শ দেন। এই পাচিকাটিও তাই কোল্লেন; বাস্তবিক আমার কোন অসুখ ছিল না। ঘরের দরজা বন্ধ কোরে আমি আপনার ইচ্ছামত কাৰ্য কোল্লেম, দর্পণে মুখ দেখলেম, গৃহের প্রদীপটি নির্বাণ কোরে দরজা ভেজিয়ে বারান্দায় বেরুলেম। সে দিকটা অন্ধকার; সদরবাড়ীতে কেহই ছিল না, সিঁড়ির দরজাটি ভেজিয়ে রেখে নিঃশব্দে উপর থেকে নেমে এলেম, বাড়ী থেকে বেরুলেম। বাবুরা নিমন্ত্রণে গিয়েছেন, শীঘ্র শীঘ্র সদরদরজা বন্ধ হবে না, মনে ভরসা থাকলো, ধীরে ধীরে গন্তব্য স্থানে আমি চল্লেম।
সেই নদীতীর, সেই আম্রবৃক্ষ, নিকটে সেই বাড়ী, বৃক্ষতলে আমি। সত্য বটে আমি; কিন্তু তখন আমারে হরিদাস বোলে চিনতে পারে, তেমন চক্ষু সে অঞ্চলে ছিল না। আমি তখন একজন শ্বেতশ্মশ্রুবিশিষ্ট জটাধারী সন্ন্যাসী। কৌপীন অথবা ব্যাঘ্রচর্মপরিধান করা নাই, অঙ্গে ভস্মলেপন নাই, কেবল মুখের ঠাঁই ঠাঁই শ্বেতচন্দনের রেখা একেছিলেম। সজ্জিত সন্ন্যাসীতে আর আমাতে অতি অল্পমাত্র প্রভেদ। আমার পরিধান গৈরিকবসন, কৃষ্ণ নামাবলীচিত্রিত গৈরিকবসনে সর্বাঙ্গ আচ্ছাদিত, হস্তে জপমালা, মুখে অবিরাম হরিনাম।
সেই বাড়ীখানির সম্মুখ দরজার কাছে গিয়ে আমি দাঁড়ালেম; উচ্চকণ্ঠে হরিনাম গান কোচ্ছিলেম, একটি স্ত্রীলোক এসে আমারে দেখে গেল। ঔষধের মোড়ক সমর্পণ করবার দিন যে স্ত্রীলোকটি আমার দূতী হয়েছিল, সেই স্ত্রীলোক। আমারে তখন চিনতে পারে কার সাধ্য? সজ্জা সমাপ্ত কোরে দর্পণে যখন আমি মুখ দেখি, তখন আমি নিজেই আমারে চিনতে পারি নাই। স্ত্রীলোকটি আমারে দেখে গেল, অব্যবহিত পরেই বাবু এলেন। আমি সন্ন্যাসী, বাবু আমারে প্রণাম কোল্লেন। যে বাবুকে আমার দরকার, সেই বাবুই তিনি। জয়োচ্চারণ কোরে বাবুকে আমি বোল্লেম আপনার মঙ্গলের জন্যই আমার এখানে আসা; জন্মাবধি আপনি দেশে ছিলেন না, পৈতৃক ভদ্রাসনে নূতন এসেছেন, আপনার মনে কোন প্রকার অশান্তি আছে, গণনা কোরে সে সব আমি জানতে পেরেছি। কিছু দিন এই গ্রামে আমি আছি। গোটাকতক কুকুর সঙ্গে কোরে যে রাত্রে আপনি শিবের মন্দিরের সম্মুখে দিয়ে চোলে আসেন, সেই রাত্রে আপনারে আমি দেখেছিলেম, আপনারে দেখেই আমার দুঃখ উপস্থিত হয়েছিল। বুঝতে পেরেছেন আমার কথা? আপনার মনে কোন প্রকার দুশ্চিন্তা আছে; স্বকৃত কার্যের জন্যই সেই চিন্তা। এখানে আপনার নাম পায়রাবাবু। এখানে আপনার গুটিকতক বন্ধু আছেন, গুটিকতক শত্রুও আছেন, যাতে কোরে বন্ধুবিচ্ছেদ ঘটে, যারা শত্রুপক্ষ, তারা সেই চেষ্টাই কোচ্ছে। আপনি কোন প্রকার উৎকট পাপে— না না, সে কথা এখানে বলা হবে না, আপনার কোন ভয় নাই, শান্তি আছে, হরি আপনাকে শান্তি দিবেন। আপনি আমার সঙ্গে ঐ শিবালয়ে চলুন, আমি আপনার গ্রহশান্তির সুব্যবস্থা কোরে দিব।
বাবু একটু মুখে বাঁকালেন। হরিনামে তাঁর বিশ্বাস নাই, ধর্মেকর্মে আস্থা নাই, বাড়ীর ভিতর ফিরে যাবার উপক্রম কোল্লেন। আমি তাঁর একখানি হাত ধোরে নরম কথায় চুপে চুপে তাঁর কাণের কাছে বোল্লেম, আমার সম্মুখে থেকে পালিয়ে গেলে তুমি পরিত্রাণ পাবে না, কার্য বড় শক্ত। কুলস্ত্রীর —–সে সব কথা এখানে যদি তুমি শুনতে চাও, ঘরে বাহিরে মহাকলঙ্ক বেঁধে উঠবে; আমি তোমারে চাই। গ্রামে এত লোক থাকতে, খুঁজে খুঁজে তোমাকেই আমি সুপাত্র বোলে ধোরেছি, আমি তোমার ভাল কোরবো; পালিয়ে যাবার চেষ্টা কোরো না; সব কথা আমি জানি। বীরভূমের কথাও জেনেছি, কাশীর কথাও জেনেছি, এখানকার কথাও জানতে পেরেছি। পাপের আগুন হু হু কোরে জ্বোলছে, লুকিয়ে থাকলে সে অগ্নিনির্বাপিত হবে না। আমার সঙ্গে তুমি শিবমন্দিরে চল, শান্তিজলে আমি তোমার অশান্তি-বহ্নি নির্বাণ কোরে দিব।
পাঠক মহাশয়! বুঝতে পারেন, এই বাবুটিই সেই পায়রাবাবু। আমার মুখে শেষের কথাগুলি শুনে, মনে মনে কি তিনি ভাবলেন, তাঁর জীবনের সমস্ত খবর আমি রাখি, সেটিও যেন বুঝতে পাল্লেন; সেখানে আর আমি বেশী কথা না বলি, সেইরূপে সাবধান হয়ে আমার সঙ্গে শিবমন্দিরে আসতে সম্মত হোলেন।
নদীতীরে একটি শিবমন্দির; বাবুকে সঙ্গে নিয়ে সেই মন্দিরে আমি এলেম। মন্দিরের দ্বারে চাবি দেওয়া ছিল; মন্দিরের একদিকের বারান্দায় উপবেশন কোরে সংক্ষেপে সংক্ষেপে সমস্ত কথার সারমর্ম তাঁকে আমি শুনিয়ে দিলেম। বাবু ঘন ঘন কেঁপে কেঁপে উঠলেন। ভূতভবিষ্যৎ গণনায় আমি পরম পণ্ডিত, বাবু যেন সেটি বেশ বুঝতে পাল্লেন; আমার কথাগুলি যেন তাঁর অস্থিতে অস্থিতে বিঁধে গেল। আরো একটু খোলসা কোরেই আমি বোল্লেম রাধারাণী মরেছে। আত্মঘাতিনী হয়েছে! তোমার জন্যই রাধারাণীর অপঘাত মৃত্যু। পুলিশ পর্যন্ত জানাজানি হয়েছে, পুলিশে এখনো তোমার নামটা উঠে নাই; কার মনে কি আছে, কে জানে? তদন্তমুখে উঠতে পারে, গণনাতে তাও আমি জানতে পেরেছি, এই বেলা প্রতীকারের চেষ্টা পাওয়া ভাল। বীরভূমে যা তুমি কোরেছ, তার ভিতরেও একটি কুলকন্যা ছিল; সেই কুলকন্যা এখন গুজরাটে, গণনায় সব আমি নখদর্পণে দেখতে পাচ্ছি। সে নায়িকা বেঁচে আছে, রাধারাণী ইহসংসার থেকে বিদায় হয়েছে। মহাপাপ! মহাপাপ!! এ পাপের প্রায়শ্চিত্ত শীঘ্র শীঘ্র যদি তুমি না কর, পুলিশের হস্তে শীঘ্র তুমি ধরা পোড়বে, ইহলোকে রাজবিচারে শাস্তি পাবে। তার পর পালিশের উপর পুলিশ, সর্বশক্তিমান পরমেশ্বর—
এই পর্যন্ত শুনে পায়রাবাবু খানিকক্ষণ নির্বাক হয়ে থাকলেন, চঞ্চল-নয়নে চতুর্দিকে চাইলেন, কাতরবচনে আমারে বোল্লেন, “কি প্রকার প্রায়শ্চিত্ত কোল্লে আমি নিস্তার পাই, দয়া কোরে আপনি আমারে আজ্ঞা করুন।”
কথার ভাবে আমি বুঝলেম, প্রায়শ্চিত্ত কোত্তে পায়রাবার ইচ্ছা আছে। কিরূপে প্রায়শ্চিত্ত, আমি তা মনে জানতেম; মনে রেখেই প্রকাশ্যে বোল্লেম, এখানে সে কথা বলা হবে না। রাধারাণী মরেছে, দেহ এখন শ্মশানে ভস্ম হয় নাই, সেই দেহ যদি তুমি দর্শন কর, তা হোলেই একরকম প্রায়শ্চিত্ত হয়। দর্শন কোত্তে পারবে কি? পুলিশের সম্মুখে তোমার প্রেমনায়িকার মৃতদেহ দর্শন কোত্তে তোমার সাহস হবে কি?
আমি সন্ন্যাসী; সংসারের কোন কথাই যেন আমি জানি না, বিশ্বাসে একটু কপট বিস্ময় প্রকাশ কোরে তিনি বোল্লেন, “রাধারাণী? —কে রাধারাণী? রাধারাণীর মৃতদেহ আমি কেন দেখতে যাব? পুলিশ! পুলিশের সঙ্গে আমি কেন দেখা কোরবো? আমি যাব না।”
মৃদুহাস্য কোরে আমি বোল্লেম, প্রায়শ্চিত্ত কোত্তে রাজী আছ, অথচ রাধারাণীকে জান না; পুলিশের নামে ভয় হয়, কার কাছে তুমি এ চাতুরী খেলাচ্ছ? মানুষের কাছে বরং চাতুরী খাটে, বিদ্যার কাছে খাটে না; জ্যোতির্বিদ্যা প্রভাবে সমস্তই আমি জানতে পেরেছি। একটি বালক একদিন তোমার হস্তে রাধারাণীর প্রেমপত্রিকা প্রদান কোরেছিল, তার পর রাধারাণীর প্রেমাশ্রমের উপদেবতানিপাত; আমার কাছে তুমি এ সব কথা অস্বীকার কোত্তে পার না। যদি কর, অস্বীকার করবার যদি চেষ্টা পাও, পুলিশের সঙ্গে সাক্ষাৎ কর।
বাবুটির অন্তরে ভয় ছিল, বদনেও ভয়ের চিহ্ন উদিত হয়েছিল। দুই তিনবার আমার মুখে পুলিশের কথা শুনে, সেই ভয়টা এই সময়ে ঘনীভূত হয়ে উঠলো। তখন তিনি আমার প্রসাদভিখারী হয়ে মৃদুবচনে বোল্লেন, “ঐরূপ প্রায়শ্চিত্ত ছাড়া আর আপনি যেরূপে প্রায়শ্চিত্তের বিধি দেন, তাতে আমি প্রস্তুত আছি। আপনি দৈবজ্ঞ, ভূতভবিষ্যৎ উভয় তত্ত্ব আপনি পরিজ্ঞাত, আপনি আমাকে রক্ষা করুন!”
আমার মনোবাসনা পূর্ণ হবার পূর্বলক্ষণ। রাত্রি প্রায় এক প্রহর। সত্যনারায়ণের সিন্নী রাত্রি এক প্রহর পর্যন্ত, শেষ হোতে বাকী থাকে না; ছোটবাবু যদি যাত্রাগীতি শোনবার আশা না রাখেন, শীঘ্রই ফিরে আসবেন; শীঘ্র শীঘ্র প্রস্থান করাই আমার আবশ্যক। পায়রাকে বোল্লেম, তোমার প্রায়শ্চিত্তটা যাতে অন্য লোকের চক্ষে না পড়ে, তেমন উপায় আমি কোত্তে পারি; তুমি নারীবেশ ধারণ কর। তোমাদের গ্রাম, পাল্কীবেহারা কোথায় পাওয়া যায়, তা তুমি জানো, নারীবেশধারণের অগ্রে একখানা পাল্কী ডাকাও, তার পর যা যা কোত্তে হয়, সে সব আমার ভার। এইখানে আমি থাকলেম, নারীবেশের উপকরণ বাড়ীর ভিতর থেকে সংগ্রহ কোরে আমার কাছে রেখে যাও, তার পর পাল্কী-বেহারা ডাকো। আমি তোমাকে নারী সাজাব; যাও, দুই কার্য কোরে এসো! পালিও না, পালিয়ে নিস্তার পাবে না। ধর্মের চক্ষু সর্বদর্শী, সর্বত্রদর্শী—জলধিজলে ডুবে থাকলেও সে চক্ষু তোমাকে দেখতে পাবে, নিবিড় বনে প্রবেশ কোল্লেও সে চক্ষু তোমাকে আকর্ষণ কোরবে, কিছুতেই পরিত্রাণ পাবে না! যাও, পালিও না!
ধর্মের কর্ম, পায়রাবাবুকে আমি আপন কায়দায় আনলেম, যা যা বোল্লেম, সমস্তই ঠিকঠাক হলো। বস্ত্রালঙ্কার আর একখানি শিবিকা উপস্থিত। পায়রাকে আমি বধূসজ্জায় সজ্জিত কোল্লেম, পাল্কীর ভিতর বসালেম, সর্দার বেহারার কাণে কাণে ঠিকানা বোলে দিয়ে শিবিকার দ্বার রুদ্ধ কোরে দিলেম। শিবিকা সরাসর বাবুদের বাড়ীর ফটকের কাছে উপস্থিত হলো, শিবিকার সঙ্গে সঙ্গে পদব্ৰজে আমি।
অবগুণ্ঠনে কপোতীর বচন আবৃত কোরে আমি সেটিকে উপরে নিয়ে তুল্লেম। যে ঘরে আমি থাকি, সে ঘরে তখন আলো ছিল না, অন্ধকারেই নববধূটিকে ঘরের একধারে আমি বসালেম, কথাবার্তা কিছুই নয়। কোথায় আমি এনেছি, পায়রা সেটা বুঝতে পারে না। মন্দিরে বোসে যা আমি ভেবেছিলেম, তাই ঠিক হলো। একটু পরেই ছোটবাবু ফিরে এলেন; হরিভক্তির আকর্ষণে হরিগুণগান শ্রবণের অভিলাষে কর্তা সেই নিমন্ত্রণকর্তার বাড়ীতেই থাকলেন। প্রায়শ্চিত্তের আয়োজনে আমি সুবিধা পেলেম।
ছোটবাবু এসেছেন, জানতে পেরে, সিঁড়ির পথেই তাঁর সঙ্গে আমি সাক্ষাৎ কোল্লেম। তাঁর সঙ্গে আলো ছিল, সম্মুখে আমারে দেখে ছোটবাবু স্তম্ভিত হয়ে সিঁড়ির উপর দাঁড়ালেন। আমারে চিন্তে পাল্লেন না। আমি চুপি চুপি তাঁরে বোল্লেম, চমকিত হবেন না; ভাল কোরে আমারে দেখুন; আমি সন্ন্যাসী নয়, আমি হরিদাস। আপনি আমারে বহুরূপীর সাজ এনে দিয়েছিলেন, সেই সজ্জার অভ্যন্তরে আমি হরিদাস। আমি একটি কপোতী ধোরে এনেছি, সেই কপোতীও বহুরূপী; কখন কপোত হয়, কখন কপোতী সাজে। কপোত-কপোতীর প্রেম কবিকূলের প্রেম-সংসারের আদর্শ। কপোতবেশে আমার কপোতী বিশুদ্ধ প্রেমশিক্ষা করে নাই, পাপ হয়েছিল; সেই পাপের প্রায়শ্চিত্ত—”
আমার হিঁয়ালীর অর্থ ছোটবাবু শীঘ্র বুঝলেন না; কি রকম কপোতী, দর্শনের কৌতূহলে তিনি আমার সঙ্গে গৃহমধ্যে প্রবেশ কোল্লেন। ঘরের অন্ধকার ঘুচে গেল; দীপাধারে উজ্জ্বল দীপ সংস্থাপিত, অন্ধকার দূরে গেল। ঘরের অন্ধকার গেল, ছোটবাবুর মনের অন্ধকারও দূর হলো; ঘোমটা খুলে কপোতীর মুখখানি তাঁরে আমি দেখালেম। ছোটবাবু বিস্ময়াপন্ন। বিস্ময়ের সঙ্গে হাস্যের সম্বন্ধ অল্প, কিন্তু সবিস্ময়ে ছোটবাবু হাস্য কোলেন। পায়রাবাবু কাঁপতে লাগলেন। ছদ্মবেশ খুলে নিয়ে পায়রাটিকে আমি আবার পায়রাবাবু সাজালেম।
পরামর্শ স্থির হলো। অতি সহজেই প্রায়শ্চিত্ত হয়ে যাবে, লোক-জানা-জানি হবে না, এরূপ আশা দিয়ে, পায়রার মুখে আমি পাপস্বীকার করালেম। পূর্বকথা সে ক্ষেত্রে প্রকাশ পেলে না। রুদ্রাক্ষগ্রামের ভৌতিক ক্রীড়া পায়রাবাবু কথায় কথায় স্বীকার কোল্লেন; রাধারাণীর সঙ্গে গুপ্তপ্রেম, নিজমুখে তাঁকে স্বীকার কোত্তে হলো।
ছোটবাবু আমারে জিজ্ঞাসা কোল্লেন, “এ পাপের প্রায়শ্চিত্ত কি?” আমি ব্যবস্থা দিলেম, মস্তক মুণ্ডন। মন্ত্র পাঠ হয়ে গেল; পাপীর নিজ মুখেই মন্ত্রপাঠ— পাপস্বীকার; বাকী কেবল মস্তকমুণ্ডন। আর কোন প্রকার ক্রিয়া-প্রক্রিয়ার আবশ্যক হবে না, কেবল মস্তকমুণ্ডনেই ইহলোকে পূর্ণাঙ্গ প্রায়শ্চিত্ত সম্পাদিত হবে। এই রাত্রের মধ্যেই সে কার্যটি সম্পন্ন হোলে ভাল হয়। অন্য লোকে দেখবে না, গ্রামের লোকে জানবে না, রাত্রের কার্য রাত্রের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে; পায়রাবাবু যেখানে ইচ্ছা, রাত্রের মধ্যে সেইখানেই চোলে যেতে পারবেন।
ব্যবস্থা মঞ্জুর। ছোটবাবুও মঞ্জর কোল্লেন, পায়রাবাবু ও মঞ্জুরী জানালেন। রাত্রের মধ্যেই প্রায়শ্চিত্ত হওয়া স্থির। স্থির বটে, কিন্তু এ রাত্রে নাপিত কোথায় পাওয়া যায়? আমি সন্ন্যাসী; ক্ষৌরকারের কার্যে আমার পাণ্ডিত্য ছিল না, আমি কিঞ্চিৎ উদ্বিগ্ন হোলেম; উদ্বেগের কারণ ছোটবাবকে জানালেম। ছোটবাবু বোল্লেন, “চিন্তা কি? আমাদের রামদাসটি ক্ষৌরকার,— প্রামাণিক বংশসম্ভূত। কর্তা বোধ হয় প্রভাতের অগ্রে ফিরে আসবেন না, আমাদের সম্মুখে অনেকটা সময়; রামদাস নির্বিঘ্নে মুণ্ডনকার্য সমাধা কোরে দিতে পারবে।”
রামদাসকে আহ্বান করা হলো, গৃহমধ্যে রামদাস উপস্থিত। পায়রা-দর্শনে রামদাসের বিস্ময়-কৌতুক একত্র। বিস্ময়ে নিস্তব্ধ, কৌতুকে হাস্য। ছোটবাবু তারে পায়রাটির মুণ্ডনকার্য নির্বাহ করবার আদেশ দিলেন। আর এক অভাব। রামদাসের ক্ষুর নাই। সে অভাবটাও অধিকক্ষণ থাকলো না, ছোটবাবুর নিজের একখানি ক্ষুর ছিল, অন্দরে প্রবেশ কোরে সেই ক্ষুরখানি তিনি বাহির কোরে এনে রামদাসের হাতে দিলেন; রামদাস তখন পায়রার সম্মুখে হাঁটু গেড়ে বোসলো।
এইখানে আর এক রঙ্গ! উপনয়নের অগ্রে বিপ্রবালক এক নতুন আহ্লাদে আমোদিত হয়, কর্ণবেধ ও কেশমণ্ডনের সময় সেই আহ্লাদের সঙ্গে সে যেমন একটু একটু ভয় পায়, বিস্ফোটকে অস্ত্র করবার সময় তীক্ষ্ণছুরিকাধারী ডাক্তার সম্মুখে উপবিষ্ট হোলে রোগী যেমন নূতন যন্ত্রণার ভয়ে আকুল হয়, ক্ষুরাস্ত্রধারী রামদাসকে সম্মুখে দেখে যুগল হস্তে যুগলকর্ণ আচ্ছাদন কোরে পায়রাবাবু সেই রকম আতঙ্ক প্রকাশ কোত্তে লাগলেন; কাঁদো কাঁদো মুখে বোলতে লাগলেন, “মাথার মাঝখানটা কামিয়ে দিলেই ঠিক হয়, বাকী চুলগুলি থাক; সব চুল কামিয়ে দিলে মানুষকে কদাকার দেখায়, এ রকম হোলে লোকের কাছে আমি মুখ দেখাতে পারবো না। মাঝখানটি ছাড়া বাকী চুলগুলি আপনারা রেখে দিতে বলুন। আমি শুনেছি, মস্তকমুণ্ডন না কোরে চুলের মূল্য ধোরে দিলে ভট্টাচার্যেরা তুষ্ট হন। আমার প্রতি সদয় হয়ে তাই করুন, আমি মূল্য দিব।”
ছোটবাবু আমার মুখের দিকে চাইলেন, অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে আমি হাস্য কোল্লেম। সম্মুখদিকে ফিরে আমি অভিপ্রায় দিলেম, “এ পাপের সে-রূপ প্রায়শ্চিত্ত নয়, সম্পূর্ণ মুণ্ডন আবশ্যক।” আমার কথাই গ্রাহ্য হলো, ছোটবাবু রামদাসের প্রতি পূর্ণমুণ্ডনের আদেশ দিলেন, উৎসাহযুক্ত হয়ে দশমিনিটের মধ্যে রামদাস সেই আদেশ পালন কোল্লে। পায়রাবাবুর বাবরীচুলগুলি তার পদতলে লুণ্ঠিত হোতে লাগলো। তখনো হস্তদ্বারা পায়রাবাবু আপনার কাণ-দুটি ঢেকে ঢেকে রাখবার চেষ্টা পেলেন, চেষ্টা ফলবতী হলো না। আমি নিকটবর্তী হয়ে, তাঁর হাত দুখানি ধোরে চাঁদমুখখানি ভাল কোরে দেখলেম। পায়রার চক্ষে জল, গাত্রে কম্প, রসনা বাকশূন্য। কারণ কি? —বামকর্ণ অর্ধচ্ছিন্ন, দক্ষিণকর্ণ নাই। এই গ্রামে প্রথম দর্শনাবধি যে সন্দেহ আমার মনে ছিল, সেই সন্দেহই ঠিক। সন্দেহ আর থাকলো না, স্পষ্টই দেখলেম, কাণকাটা কানাই! আর একটি ছোট কথায় বোঁচা কানাই! পাঠকমহাশয় স্মরণ কোত্তে পারবেন, বীরভূমের কানাইবাবু, আপন মাতুলকন্যার সতীত্বরত্ন হরণ কোরে, সেই ভগিনীটিকে কুলের বাহির কোরেছিলেন; কত জায়গায় কত খেলা খেলিয়েছিলেন; এই সেই কানাইবাবু। কত রাজ্য ঘুরে ঘুরে সেই কানাইবাবু এখন ত্রিপুরায় এসে ধরা পোড়লেন। কানাইকে আমি বোল্লেম, “চিনেছি আমি তোমাকে, সত্য তুমি পায়রাবাবু নও, বীরভূমের কানাইবাবু। তোমার নূতন নাম কাণকাটা কানাই! এই তোমার প্রায়শ্চিত্ত হয়ে গেল, এখন তুমি স্বাধীন, এখানে এখন তুমি নিষ্পাপ, এখন তুমি বিদায় হোতে পার। রাতারাতি প্রস্থান কোল্লে কেহই কিছু জানতে পারবে না। আমার কার্য শেষ হয়ে গেল, আমি এখন চোল্লেম।”
ছোটবাবুর দিকে চাইতে চাইতে ঘর থেকে আমি একবার বেরিয়ে গেলেম, বাহিরে ছদ্মবেশ পরিত্যাগ কোরে, হরিদাস হয়ে গৃহমধ্যে পুনঃ প্রবেশ কোল্লেম। আমিই সেই সন্ন্যাসী, কানাইবাবু সেটি জানতে পাল্লেন না। দুই হস্তে কর্ণ আবৃত কোরে অধোবদনে তিনি বাড়ী থেকে বেরিয়ে গেলেন।
কানাইকে কানাই সাজিয়ে একটা সংকল্প আমি সিদ্ধ কোল্লেম। তিন দিন পর আমার পাটনা যাত্রার আয়োজন। একাকী আমি যেতে পারবো না কিম্বা হয় তো অন্য দিকে চোলে যাব এইরূপ সন্দেহ কোরে কর্তা আমার সঙ্গে ছোটবাবুকে পাঠাবেন। ছোটবাবুর হস্তেই আমাদিগের রাহাখরচের টাকা দিবেন, এইরূপে স্থির হলো। চতুর্থ দিবসে ছোটবাবুর সঙ্গে আমি পাটনা যাত্রা কোল্লেম।