ভূবনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়
হরিদাসের গুপ্তকথাপ্রথম খণ্ড
ষড়্বিংশ কল্প : নূতন বিপত্তি!
বরদায় জঙ্গল অনেক। বুদ্ধির ভ্রমে একদিন আমি একাকী সন্ধ্যার পূর্ব্বে ভ্রমণে বহির্গত হই, পথেই সন্ধ্যা হয়, পথ ভুলে আমি বনের দিকে গিয়ে পড়ি। বরদা বাস্তবিক তীর্থস্থান নয়, কিন্তু অনেক দেশের অনেক লোক নানা কার্য্যে এই রাজ্যে অবস্থান করে। আমি যেন বরদাকে নূতন তীর্থ মনে কোল্লেম। স্বাধীন হিন্দুরাজ্য ভারতে তখন অতি কম, এই হিন্দুরাজ্যকে পবিত্র তীর্থস্থান মনে করা আমার পক্ষে বিচিত্র বোধ হয় নাই। সাহেব-বিবিরা মুর্শিদাবাদের পলাশী-প্রান্তরকে তীর্থস্থান জ্ঞান করেন, হিন্দুরা বিপরীত ভাবেন। কথিত আছে, পলাশীযুদ্ধের শেষদিন আকাশে মেঘ ছিল, সমস্ত দিন বৃষ্টি হয়েছিল, যুদ্ধের পরিণাম দর্শন করা কষ্টকর বিবেচনা কোরেই যেন সূর্য্যদেব সেদিন একবারও আকাশে দেখা দেন নাই। চারিযুগের সাক্ষী চন্দ্র-সূর্য্য, পলাশীযুদ্ধের শেষদিন সূর্য্যদেব সাক্ষী ছিলেন না, বরদার জঙ্গলের দিকে আমি যখন পথ-ভ্রান্ত হয়ে বিপাকে পড়ি, তখন আকাশে সূর্য্য ছিলেন না। সন্ধ্যা হয়ে গয়েছিল, চতুর্দ্দিক অন্ধকার, কোন দিকে পথ, কোন দিকে আমাদের বাসা, অন্ধকারে কিছুই আমি ঠিক কোত্তে পাল্লেম না, নিত্য নিত্য যেমন অন্ধকার হয়, সে দিনের অন্ধকার তদপেক্ষা গাঢ়-প্রগাঢ়;—নিবিড় অন্ধকার।
কি কারণে নৈশ অন্ধকার প্রগাঢ়, সে কথাও বলা আবশ্যক। সমস্ত দিন সূর্য্য ছিলেন, আকাশে বিন্দুমাত্র মেঘ ছিল না। সন্ধ্যার পরেই মেঘাড়ম্বর, অল্প অল্প বৃষ্টি, নক্ষত্রমালা অদৃশ্য, সেই কারণেই ঘোর অন্ধকার। আমার ভাগ্যচক্রের আবৰ্ত্তন অনেক প্রকারেই পরীক্ষিত, এ রাত্রে আবার কিরুপ পরীক্ষা হয়, অন্তরে সেই ভাবনাই প্রবল। বিদেশে অজানা পথে আমি একাকী; যে দিকে গিয়ে পোড়েছি, সে দিকে জনমানবের চলাচল নাই, নিরবচ্ছিন্ন আমি একাকী।
বনপথ। বনমধ্যেই আমি প্রবেশ কোরেছি। নিবিড় বন, বনের নিবিড়তায় অন্ধকারের নিবিড়তাও অধিক। যে দিকে অগ্রসর হই, সেই দিকেই বন, সেই দিকেই অন্ধকার। এক একবার মনে কোচ্ছি, এই দিকে গেলেই হয় তো পথ পাব, মনে করাই ভুল, পলকে পলকে ধাঁধাঁ লাগতে লাগলো; যে দিকে মুখ ফিরাই, যে দিকে পদচালনা করি, সেই দিকেই অরণ্য। ভ্রান্তিবশে বনের ভিতর আমি ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছি, যদি কোন বিপদ ঘটে, যদি কোন বন্যজন্তুর সম্মুখে পড়ি, প্রাণ যাবে, মনোমধ্যে কেবল সেই ভয়; অন্য কোন ভয় তখন আমার কল্পনায় আসে নাই। রক্ষক কে?—সজীব রক্ষক কেহই না, নির্জীব রক্ষক দুটি পিতল। ব্যাঘ্রাভল্লুকাদি সম্মুখে এলে, সে অন্ধকারে কিছুই লক্ষ্য হবে না, পিস্তল তখন কোন কাজে আসবে না, সেটাও মনে মনে ভাবছি; ভয় ক্রমশই বেশী হয়ে আসছে।
কতদূরে গিয়ে পোড়েছি, কিছুই ঠিক পাচ্ছি না। হঠাৎ বনমধ্যে যেন অশ্বপদধ্বনি শুনতে পেলেম। বনের ভিতর রাত্রিকালে ঘোড় বেড়ায়, এটাই বা কি? এ রাজ্যে কি নিশাকালে বন্য অশ্ব বিচরণ করে?—মনে মনে তর্ক আসছে, কিন্তু অশ্বের পদধ্বনি বন্য অশ্বের পদধ্বনির মত নয়; খুরে নালবাঁধা থাকলে যে প্রকার শব্দ হয়, সেই প্রকার শব্দ; বন্য অশ্ব নয়, সওয়ারের অশ্ব। মেঘাবৃত অন্ধকার রাত্রে এ রকম নিবিড় বনে ঘোড়সওয়ার কি কোত্তে এসেছে?—একবার ভাবলেম, হয় তো শীকারী, অন্ধকারে শীকারীরাই বা কি রকমে শীকার লক্ষ কোরবে, তাও বুঝতে পাচ্ছি না। ক্রমাগতই চোলেছি; ভাবছি আর চোলছি, পদে পদেই গতিরোধ হোচ্ছে; গাছে গাছে এক একবার মাথা ঠুকে যাচ্ছে, অতি সাবধানে খুব ধীরে ধীরেই চেলেছি।
অকস্মাৎ ঘোর বিপদ! দু-দিক থেকে দু-জন লোক ছুটে এসে, আমার দুখানা হাত ধোরে ফেল্লে, ধোরেই অমনি শুন্যে শূন্যে আমাকে যেন উড়িয়ে নিয়ে চোল্লো, বোধ হলো যেন, মাটির নীচে মানুষ ছিল, মাটি ফুঁড়ে উঠেছে, উঠেই আমাকে ধোরেছে! ভুইফোঁড় মানুষ! কেন আমাকে ধোল্লে। অন্ধকারে নিঃশব্দে আমি যাচ্ছি, কেমন কোরেই বা দেখতে পেলে? কেমন কোরেই বা জানতে পাল্লে? কারা এরা? নিশ্চয়ই ডাকাত! বনের মাঝে ডাকাতের হাতে আমি পোড়েছি।
অশ্বের পদধ্বনি আর শুনা যায় না। লোকেরা আমাকে শুন্যে শুন্যে নিয়ে চোলেছে, ভয়ে আমার সৰ্ব্বশরীর কাঁপছে, কোন কথা জিজ্ঞাসা কোরবো, কথা ফুটছে না। মনে হোচ্ছে, এরাই হয় তো ঘোড়া ছুটিয়ে আসছিল, বনপথ এদের জানা আছে, বনের ভিতর হয়তো ফাঁকা জায়গা আছে, সেই জায়গাতেই ঘোড়ার পায়ের শব্দ হোচ্ছিল, সেইখানেই ঘোড়া থেকে নেমে, এরা হয় তো আমাকে ধোরে ফেলেছে। কারে হয় তো খুঁজছিল, কে হয় তো এদের হাত থেকে পালিয়ে গিয়েছে, বাঘ-বিড়ালের মত অন্ধকারে হয় তো এদের চক্ষু জ্বলে, তফাৎ থেকে আমাকে দেখতে পেয়েই ধোরেছে।
অতি অল্পক্ষণের মধ্যেই এই সকল ভাবনা আমার মনে এলো, বেশীক্ষণ ভাবতে হলো না, লোকেরা আমাকে এক জায়গায় নামিয়ে দিলে, দাঁড় করালে, কিন্তু হাত ছেড়ে দিলে না, তখনি আবার শুন্যে তুলে একটা ঘোড়ার উপর বোসিয়ে দিলে, আমার কোমরে একগাছা দড়ি বেঁধে ঘোড়ার সঙ্গে বেঁধে দিলে, আমার হাত দুখখানিও বেঁধে ফেল্লে। একটা লোক লাফ দিয়ে সেই ঘোড়ার উপর আমার ঠিক সম্মুখে বোসলো, আর একটা লোক সেই ঘোড়ার লাগাম ধোরে দাঁড়িয়ে রইলো।
বড় বড় কথা; জড়ান জড়ান অনেক রকম অস্ফালনের কথা; তখন আমি বুঝলেম, দুটো একটা লোক নয়, অনেক লোক। পিস্তল সঙ্গে আছে, কিন্তু আমি নিশ্চেষ্ট, হাত-পা বাঁধা, কোন উপায় ছিল না। চতিকমাত্র একটা মশাল জ্বোলে উঠলো, মশালের আলোতে দেখলেম, দশ জন লোক, সকলের মুখেই যেন মুখোস ঢাকা, কালো কালো মুখোস। বনের ভিতর সে রকম ছদ্মবেশ কেন, তারাই জানে, আমি কিন্তু অনুমান কোত্তে পাল্লেম না। পূর্ব্বে যেটা অনুমান কোরেছিলেম, সে অনুমান ঠিক। খানিকটা ফাঁকা জায়গা, চারিদিকে বন, মধ্যস্থলে সেই জায়গা। সেইখানেই আমাকে ঘোড়ার উপর তুলেছে, আরো আট দশটা ঘোড়া সেইখানে দাঁড়িয়ে আছে। ভয়ে আমার প্রায় বাকরোধ হয়ে গিয়ে ছিল, এতক্ষণ একটি কথাও আমার রসনা থেকে নির্গত হোচ্ছিল না, এই সময় সাহসে ভর কোরে, আমার সম্মুখের সওয়ারটাকে আমি জিজ্ঞাসা কোল্লেম, “কেন তোমরা আমাকে ধরেছ? আমি পথিক, আমি বিদেশী, আমার সঙ্গে টাকা নাই, পথ ভুলে অন্ধকারে বনের ভিতর এসে পোড়েছিলেম, কেন তোমরা আমাকে ধোরেছ?”
বজ্রগর্জ্জনে লোকটা উত্তর কোল্লে, “চোপরাও! ফের যদি কথা কবি, এক গুলীতে তোর মাথার খুলী উড়িয়ে দিব!” সমান গর্জ্জনে আর একটা লোক বোলে উঠলো, “মুখ বেধে ফেল, দম বন্ধ কোরে দে!”
যেমন হকুম, তেমনি কাৰ্য্য। আমার উত্তরীয়বস্ত্রে আমার সম্মুখবর্ত্তী সওয়ার তৎক্ষণাৎ আমার মুখ-চক্ষু বেঁধে ফেল্লে, আর আমি কিছু দেখতেও পেলেম না, একটি কথা বোলতেও পাল্লেম না; অনুভবে বুঝতে পাল্লেম, লম্ফে লম্ফে লোকেরা এক একটি ঘোড়ার উপর সওয়ার হলো। যে ঘোড়াতে আমি ছিলেম, সেই ঘোড়া অগ্রে, পশ্চাতে সওয়ারেরা সারিবন্দী হয়ে দাঁড়ালো; দুপাশে দুজন মোতায়েন থাকলো, মৃদুকদমে ঘোড়ারা চোলতে আরম্ভ কোল্লে। প্রায় দুই শত হস্ত দূরে ঘোড়া থেকে নামিয়ে লোকেরা আমাকে একটা গহ্বরের মধ্যে নিয়ে গেল, বাকী সওয়ারেরাও ঘোড়া থেকে নেমে নেমে আমাকে পাহারা দিয়ে নিয়ে চোল্লো। ডাকাতের হাতে আমি বন্দী।
গহ্বরের মধ্যে ঘর, ঠিক যেন ছোট রকম কেল্লা। একটা ঘরের ভিতর নিয়ে গিয়ে তারা আমার মুখের বাঁধন খুলে দিলে, হাত-পা যেমন বাঁধা, তেমনি থাকলো। আমার মুখের কাছে তলোয়ার নাচিয়ে নাচিয়ে একজন বোলতে লাগলো, “মুখ বুজে চুপ কোরে থাক; এখানে তোর রক্ষাকর্ত্তা কেহ নাই। চেঁচিয়ে মোরে গেলেও কেহ উত্তর দিবে না, যদি চেঁচাস, এক কোপে টপ কোরে তোর মাথাটা কেটে ফেলবো!”
মাথা যাবে, তা আমি বুঝলেম, চীৎকার করাও বিফল, সেটাও আমি বুঝলেম, তবু কিন্তু চুপ কোরে থাকতে পাল্লেম না। যমদূতের মত দশজন ডাকাত আমার সম্মুখে দাঁড়িয়ে, কাহার হতে বন্দুক, কাহার হাতে তলোয়ার; মূর্ত্তি দেখেই আমার প্রাণ উড়ে গেল। ঘরময় মশালের আলো, কথা কোইলেই প্রাণ যাবে, বুঝতে পেরেও মৃদুস্বরে মিনতি কোরে আমি বোল্লেম, “অকারণে তোমরা আমাকে ধোরেছ, আমার সঙ্গে টাকা নাই, দয়া কর, বন্ধন খুলে দাও, আমি পালাবো না, এই অন্ধকারে কোথায় বা আমি পালাতে পারবো? খুলে দাও। রাত্রে আর কোথাও আমি যাব না, আমার সঙ্গে টাকা নাই, তোমরা বরং আমার অঙ্গবস্ত্র অন্বেষণ কর; দেখ—” অঙ্গবস্ত্র অন্বেষণের কথা আমি বোল্লেম বটে, কিন্তু ভয় হলো। সত্য যদি তারা অন্বেষণ করে, পিস্তল পাবে, তা হোলেই বিপদ বাড়বে; সেই ভয়েই কথা বোলতে বোলতে থেমে গেলেম। লোকগুলো হো হো কোরে হেসে উঠলো, “ছোঁড়াটা ভারী ধড়ীবাজ, ঐ কথাই তো বার বার বোলছে। টাকা নাই, ঐ কথাই তো কথা! টাকার জন্যই আমরা ধোরেছি! লেখ চিঠি, দেখতে এমন ফটফটে দামী দামী কাপড়পরা, মুখেও বেশ টগরা, বার বার বোলছে টাকা নাই। লেখ চিঠি! কারা তোর মুরুব্বী, কাদের কাছে তুই থাকিস, তাদের নামে তুই চিঠি লেখ? খালাসীপণ দশ হাজার টাকা, তোর মুরুব্বীরা আমাদের লোকের হাতে যদি নগদ দশ হাজার টাকা দিতে পারে, তা হোলেই খালাস পাবি, তা না হোলে—হুঁ—হুঁ—হুঁ—”
এই সব কথা বোলতে বোলতে সকলেই এককালে মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তলোয়র নাচালে, বন্দুক নাচালে, রণবেশে যেন ধেই ধেই কোরে নাচতে লাগলো।
ভয়েই আমি আড়ষ্ট। খালাসীপণ দশ হাজার টাকা! হায় হায়! নিশ্চয় প্রাণ গেল! দশ হাজার টাকা! এ টাকা কোথা থেকে সংগ্রহ হবে? আমার প্রাণের জন্য দশ হাজার টাকা কে দিবে? টাকা না পেলেই ডাকাতেরা আমাকে মেরে ফেলবে! জীবনে হতাশ হয়ে মুখটি বুজে সেইখানেই আমি বোসে থাকলেম, থর থর কোরে কাঁপতে লাগলেম, আর একটিও বাঙ্নিষ্পত্তি কোল্লেম না; দারুণ পিপাসায় কণ্ঠ-তালু বিশুষ্ক, একবিন্দু জল চাইতেও সাহস হলো না।
ডাকাতেরা আমাকে ঘিরে আছে; মাঝে মাঝে ধমক দিচ্ছে, দশ হাজার টাকার জন্য চিঠি লিখে দিতে বোলছে, কোন কথারই আমি উত্তর দিচ্ছি না। লোকেরা আপনাদের ভাষায় কাঁই-মাঁই কোরে কত কথা বলাবলি কোল্লে, মাঝে মাঝে হো হো রবে হেসে উঠলো। ভয়ে আমি আড়ষ্ট, শরীরে ঘন ঘন কম্প, কল্পের সঙ্গে ঘর্ম্ম।
এইভাবে আমিই আছি, হঠাৎ অন্ধকার হয়ে গেল। লোকেরাও গোলমাল কোত্তে কোত্তে একে একে বেরিয়ে পোড়লো। আমার হাত-পা বাঁধা, পালাতে পারবো না, তবু তারা ঘরের দরজায় চাবী বন্ধ কোরে দিয়ে গেল। সেই অন্ধকারে সেই ঘরের ভিতর আমি কয়েদ থাকলেম! সঙ্গী কেবল ভয় আর হতাশ।
প্রাণ যাবে! বিদেশে বেঘোরে ডাকাতের হাতে আমার প্রাণ যাবে! খালাসীপণ দশ হাজার টাকা। সে টাকা সংগ্রহ করা আমার অসাধ্য! আর উপায় নাই! কোথায় আমি এসেছি, কোথায় গেলেম, কোথায় আমি থাকলেম, দীনবন্ধবাবু কিছুই জানতে পাল্লেন না। কতই যে তিনি উতলা হোচ্ছেন, কতই যে অন্বেষণ কোচ্ছেন, কিছুই ঠিক নাই। আকাশ-পাতাল চিন্তা! আমার হৃদয়ের দেবীপ্রতিমা অমরকুমারী! হায় হায়! চোরেরা অমরকুমারীকে চুরি কোরেছে, বহরমপুরে মোকদ্দমা হোচ্ছে, এতদিনে সে মোকদ্দমা কতদূর হলো, কিছুই জানতে পাল্লেম না। গুজরাটের জঙ্গলে ডাকাতের অন্ধকূপে আমি বন্দী, অন্ধকূপে আমার প্রাণ যায়, অমরকুমারী কিছুই জানতে পাচ্ছেন না? এ জীবনে আর দেখা হবে কি না, তারো কোন নিশ্চয়তা নাই। এই রাত্রের মধ্যে যদি আমার মরণ হয়, তা হোলেও এ যন্ত্রণার হাত আমি এড়িয়ে যাই। মত্যুকামনায় পাপ হয় জানি, কিন্তু যন্ত্রণা অসহ্য! এ যন্ত্রণা থেকে নিস্তার পাব না, সৰ্ব্বক্ষণ সেইরুপ হতাশ আমার মনে আসছিল। উদ্দেশে বিপদভঞ্জন মধুসূদনের নাম স্মরণ কোল্লেম, সেই নামের সঙ্গে অমরকুমারীর নাম একবার আমার রসনা থেকে পরিস্ফুট উচ্চারিত হলো।
আশ্চর্য্য! ভগবানের নামের কি চমৎকার মহিমা! প্রাণে যারে ভালবাসা যায়, হৃদয়ের অধিষ্ঠাত্রী দেবীরূপে যারে বরণ করা যায়, তার পবিত্র নামেরই বা কি আশ্চর্য্য সঞ্জীবনীশক্তি! ভগবানের নামে আর অমরকুমারীর নামে অকস্মাৎ আমার সেই তাপিত অন্তরে তৎকালে মঙ্গলময়ী শান্তির আবির্ভাব হলো। সে অন্ধকার কারাকূপে আমি যেন তখন মূর্ত্তিমতী শান্তির অপরূপ প্রতিমা-দর্শন কোল্লেম। প্রতিমা জ্যোতির্ম্ময়ী! ঠিক যেন দেখলেম, একটি জ্যোতির্ম্ময়ী দেবীপ্রতিমা আমার চক্ষের সম্মুখে বিরাজিতা। দেবী যেন করপদ্ম-সঞ্চালনে আমাকে অভয় দিলেন। সভয় অন্তরে আমি যেন সাহস পেলেম। অন্ধকার গৃহ অকস্মাৎ যেন জ্যোতির্ম্ময়! গৃহ যেন পদ্মগন্ধে আমোদিত।
কি আশ্চর্য্য! পুরাণশাস্ত্রে আমি পাঠ কোরেছি, সরল অন্তরে সেই মঙ্গলময়কে স্মরণ কোল্লে, আপদ-বিপদ দূর হয়ে যায়, ঘোর বিপদেও নির্ভয় হওয়া যায়। সত্যই সে কথা। জন্মাবধি আমি কখনো কারো কোন অনিষ্ট করি নাই, উপকার করবার ইচ্ছায় যথাশক্তি নিঃসম্পর্কীয় লোকেরো উপকারের চেষ্টা পেয়েছি; সর্ব্বান্তর্যামী জগদীশ্বর আমার অন্তঃকরণ জানেন, বিপদে পোড়ে আমি ডাকলেম, তিনি শ্রবণ কোল্লেন, আমাকে অভয় দিবার জন্য এই অভয়ামূৰ্ত্তিকে কারাকূপে পাঠালেন! তবে বোধ হয়, আমি রক্ষা পাব! তবে বোধ হয়, এ বিপদ আমার থাকবে না। হতাশ-প্রাণে আশার সঞ্চার! ভক্তিভাবে মনে মনে সেই ভক্তবৎসল ভগবানকে আমি প্রণিপাত কোল্লেম।
জ্যোতির্ম্ময়ী প্রতিমা-দর্শনে আমি নয়ন মূদিত কোরেছিলেম, এই সময় চেয়ে দেখি কোথাও কিছু নাই! ডাকাতের সেই অন্ধকূপ! যে অন্ধকার, সেই অন্ধকার! সেই ঘোর অন্ধকারের মধ্যে আমি সেই শৃঙ্খলাবদ্ধ হরিদাস! সে চিরদরিদ্র—চিরনিঃসহায়—জগতের অপরিচিত—নিৰ্ব্বান্ধব সেই অভাগা হরিদাস!
অনুমানে বুঝলেম, রাত্রি দুই প্রহর। সেই সময় কটকটশব্দে দরজার চাবী খুলে কে একজন আমার কারাকূপে প্রবেশ কোল্লে। তার এক হাতে একটা জ্বলন্ত মশাল, এক হাতে একটা আধার। চেয়ে দেখলেম, স্ত্রীলোক; ডাকাতের আড্ডায় স্ত্রীলোক থাকে, ডাকাতেরা স্ত্রীলোক সঙ্গে কোরে ঘর-সংসার করে, এটাও আমি নূতন বুঝলেম। স্ত্রীলোকটি দরজা ভেজিয়ে ধীরে ধীরে আমার কাছে এসে মশালটা একধারে রেখে দিলে, হস্তখিত আধারটাও আমার সম্মুখে রাখলে; রেখে, ফিক ফিক কোরে হেসে আমার কাছে এসে বসলো। একবার মাত্র তার মুখের দিকে চেয়ে, আমি মস্তক অবনত কোল্লেম। স্ত্রীলোকের মুখের চেহারা যেন কুলকন্যার মুখের ন্যায়, দুরন্ত ডাকাতের ঘরে এমন সুন্দরী কন্যা থাকে, এটাও অতি আশ্চর্য্য ব্যাপার। স্ত্রীলোক কৃশাঙ্গী, গাত্র অলঙ্কার-বর্জ্জিত, মস্তকের কেশ রুক্ষ রুক্ষ, তথাপি সেই অবয়বে দিব্য লাবণ্য বিদ্যমান। মুখ বিশুষ্ক নয়, একটু হাসি হাসি; সেই হাসি দেখেই আমার মস্তক অবনত।
স্ত্রীলোকটি চুপি চুপি আমাকে বোল্লে, “এই তোমার খাবার সামগ্রী এনেছি, এইগুলি খাও; ডাকাতের আড্ডা, এই রকম খাবার এখানে পাওয়া যায়।”
কথাগুলি বেশ মিষ্ট মিষ্ট। মুখখানি উঁচু কোরে আবার আমি সেই স্ত্রীলোকের মুখ দর্শন কোল্লেম! এইবার ভাবান্তর। সে মুখে আর সে হাসি নাই, বড় বড় চক্ষু—দুটি অশ্রুপূর্ণ। ক্ষণেকের মধ্যেই কেন এরুপ ভাবান্তর, শীঘ্র বুঝতে পাল্লেম না; কারণ জিজ্ঞাসা না কোরে, আপন অবস্থা-স্মরণে তারে আমি বোল্লেম, এ রকম ছলনা কিসের জন্য? দেখতেই পাচ্ছ, আমার হাত-দুখানি শৃঙ্খলাবদ্ধ, আমার সম্মুখে খাদ্যসামগ্রী, এ ছলনা কিসের জন্য?”
স্ত্রীলোক বোল্লে “শিকল আমি খুলে দিচ্ছি, খুলে দিবার হুকুম আছে, তোমার খাওয়া হোলে আবার—”
এই সময় আবার আমি সেই স্ত্রীলোকের মুখের দিকে চাইলেম; চেয়েই একবার সেই আধারের দিকে নয়ন ফিরালেম। আধারে আছে কি? দু-খানি আধপোড়া রুটি আর একটি মাটির ভাঁড়ে আধভাঁড় জল। দেখেই আমার ক্ষুধা উড়ে গেল। অত্যন্ত পিপাসা হয়েছিল, স্ত্রীলোকটিকে বোল্লেম, “আবার যদি বেঁধে রেখে যাবে, তবে আর শিকল খুলে কাজ নাই, কিছুই আমি খাব না, দয়া কোরে ঐ ভাঁড়টি তুমি আমার মুখের কাছে ধর, আমি একটু জল খাই।”
“খাও, খাও” বোলে স্ত্রীলোকটি দু-তিনবার অনুরোধ কোল্লে, অনুরোধ বিফল হলো। অগত্যা সে আমার মুখের কাছে সেই জলের ভাঁড়টি তুলে ধোল্লে, আমি একচুমক জল খেলেম; তাতেই যেন কত তৃপ্তি। জল খেয়ে একটি নিশ্বাস ফেলে সেই স্ত্রীলোককে আমি জিজ্ঞাসা কোল্লেম, “তুমি এখানে কতক্ষণ থাকবে?”
স্ত্রী।—যতক্ষণ তুমি বলো।
আমি।—সে কি কথা? আমি যতক্ষণ বোলবো; ততক্ষণ থাকবে, এ কথার অর্থ কি? তুমি কে? এইখানেই কি তুমি থাকো?
স্ত্রী।—আমি কে?—তুমি আমারে জিজ্ঞাসা কোচ্চ আমি কে?—হা অদৃষ্ট! দেখেও কি কিছু বুঝতে পাচ্চো না? তোমারে যে দশা, আমারো সেই দশা!
আমি।— (সবিস্ময়ে) ভাল বুঝলেম না, স্পষ্ট কোরে বল।
স্ত্রী।—আরো স্পষ্ট শুনতে চাও?—(কপাটের দিকে চাহিয়া অতি মৃদুস্বরে) আমি এদের শীকার। বনের ভিতর তোমারে যেমন ধোরেচে, আমারেও তেমনি কোরে ধেরে রেখেছে! আমার সঙ্গে লোক ছিল, পাল্কী ছিল, বনের ভিতর ধরে নাই, বনের বাইরে রাস্তা দিয়ে আমরা যাচ্ছিলেম, সন্ধ্যা হয়েছিল, আমার সঙ্গের লোকগুলিকে মেরে ধোরে তাড়িয়ে দিয়ে কেবল আমারেই এরা কয়েদ কোরে রেখেছে। আটমাস আমি এখানে আছি। হাজার টাকা চায়। হাজার টাকা পেলে ছেড়ে দিবে বলে। আমার গায়ে অলঙ্কার ছিল, তার দাম হাজর টাকার বেশী। তা এরা সব খুলে নিয়েছে, তা বলে, হাজার টাকা চাই। কোথায় আমি পাবো? কাজেকাজেই কয়েদ আছি! এরা আমারে দাসী কোরে রেখেচে! এদের সর্দ্দার আমার—আমার—ধর্ম্ম—
আমি।—(শিহরিয়া) উঃ! কি নরাধম। সে সর্দ্দার এখন কোথায়?
স্ত্রী।—সর্দ্দার এখানে নাই, শীকারে গিয়েছে। শীকার বুঝতে পারো?—লোকের যেটা সৰ্ব্বনাশ, সেইটিই এদের শীকার।
আমি।—সর্দ্দারটা আসবে কখন?
স্ত্রী।—সকল দিন যায় না, যেদিন যেদিন যায়, শেষরাত্রে ফিরে আসে। সর্দ্দার এখানে থাকলে—ডাকাতেরা যে সব কথা বোলছিল, সে সব আমি শুনেচি। চিঠি লিখতে বলছিল। সর্দ্দার এখানে থাকলে চিঠিখানা লিখিয়ে নিয়ে তবে ছাড়তো। দশ হাজার টাকা দিতে পারে, সত্য কি তেমন কোন বন্ধ লোক এখানে আছেন?
আমি।—আমার বন্ধু জগদীশ্বর! জগতের বন্ধু যিনি, তিনি ভিন্ন আমার জীবনের বন্ধু আর কেহই নাই।
স্ত্রী।—(নিশ্বাস ফেলিয়া) তবেই তো! আহা! তোমার মতন কতজনকে এরা ধরে, এক একজন টাকা দিয়ে খালাস পায়, এক একজন চাকর হয়ে দলে মিশে যায়, দলে যারা না মেশে কিবা টাকা দিতে না পারে, তাদের বেঁধে রাখে, কুকুর দিয়ে খাওয়ায়, না হয় তো প্রাণে মেরে রাতারাতি দরিয়ার জলে ভাসিয়ে দেয়! সত্য কি তোমার উদ্ধার করবার কেহই নাই?
আমি।—কেন থাকবে না? ঐ যে বোল্লেম, জগতের বন্ধু যিনি, তিনিই আমার উদ্ধারকর্ত্তা।—দীনবন্ধু, অনাথবন্ধু, জগবন্ধু!
স্ত্রী।—(সচকিতে) আর একটি লোক—তিনি—না বাপু! আর আমি এখানে দেরী কোরবো না, চোল্লেম, জগবন্ধু তোমারে রক্ষা কোরবেন!
স্ত্রীলোকটি আর থাকলো না, মশালটা হাতে কোরে নিয়ে, ঘর থেকে বেরিয়ে, পূৰ্ব্ববৎ দ্বারে চাবী দিয়ে চোলে গেল। পোড়া রুটি দুখানা আমার কাছেই পোড়ে থাকলো। আমি আবার অন্ধকারে ডুবে থাকলেম।
স্ত্রীলোক তবে ডাকাতের মেয়ে নয়। আপন মুখেই বোলে গেল, ‘তোমারো যে দশা, আমারো সেই দশা!’ কথা ঠিক! ভদ্রলোকের কন্যা; প্রাণে দয়া আছে; আমার কল্যাণকামনা কোরে গেল। উঃ! পিশাচের পুরী! সর্দ্দার ডাকাতটা এই কন্যাটির ধর্ম্ম নষ্ট কোরেছে! টাকা না পেলে নরহত্যা করে। এ সকল লোকের এই সকল মহাপাতকের কি প্রায়শ্চিত্ত আছে?
এই সকল আমি ভাবছি, প্রায় চারিদণ্ডকাল ভাবনাসাগরে ডুবে অন্ধকূপে বোসে আছি, এমন সময়ে আবার দ্বারের বাহিরে কটকট কোরে চাবী খোলার শব্দ। ভয়ে আমার সৰ্ব্বাঙ্গ কেঁপে উঠলো। এবার আর স্ত্রীলোক নয়, এবার নিশ্চয়ই ডাকাত! হয় তো সর্দ্দারটাই স্বয়ং! এইবার হয় তো আমার ভাগ্যফলের শেষপরীক্ষা।
নিঃশব্দে একটি লোক প্রবেশ কোল্লে; আলো নাই, অন্ধকারেই প্রবেশ কোল্লে। শব্দে বুঝলেম, দরজাটা ভিতরদিকে বন্ধ কোরে দিলে। আন্দাজে আন্দাজে চুপি চুপি আমার দিকে এগিয়ে এলো। অনুভবে বুঝলেম, বোসলে;—সাবধানে মৃদস্বরে আমারে উদ্দেশ কোরে বোলে, “ভয় পেয়ো না, যেমন আছ, ঠিক ঐ ভাবে চুপ কোরে থাকো—কোন ভয় নাই!”
বেশ স্পষ্ট কথাগুলি আমি শুনলেম। স্বরে বুঝলেম, দয়ামিশ্রিত কোমলস্বর। ডাকাত নয়। ডাকাতের কণ্ঠস্বর এরকম হয় না। স্বর আমারে অভয় দিচ্ছে। ধন্য জগদীশ্বর! কোন মহাপুরুষ আমারে অভয় দান করবার নিমিত্ত ডাকাতের অন্ধকূপে উপস্থিত? চুপ কোরে থাকবার আদেশ—চুপ কোরেই তো আছি, আছি তো সত্য, কিন্তু একটি কথা জিজ্ঞাসা না কোরেও তো স্থির থাকা যায় না, প্রাণ হাঁইফাঁই কোত্তে লাগলো, মনে মনে অনেক রকম তোলাপড়া কোরে, যা থাকে ভাগ্যে, এইরুপ ভেবে, পূর্ণসাহসে একনিশ্বাসে চুপি চুপি জিজ্ঞাসা কোল্লেম, “আপনি কে?”
পূৰ্ব্ববৎ সতর্কবাক্যে সেই সদয় স্বর আমারে আদেশ কোলে, “চুপ! নিস্তব্ধ থাকাই নিরাপদ। কোন ভয় নাই!—আমি—এখানকার ডাকাতেরা যে সকল লোককে ধরে, আমি তাদের উদ্ধার করবার চেষ্টা করি, ডাকাতের সঙ্গে ছদ্মবেশে বেড়াই। একটা নিগূঢ় বিষয়ের অনুসন্ধানে আমি আছি, যত দিন সে কাৰ্য্য সিদ্ধ না হয়, তত দিন ডাকাতের দলকে ধরিয়ে দিতে পাচ্ছি না। যে সকল নিরীহ লোক এদের কবলে ধরা পড়ে, সঙ্গোপনে আমি তাদের বন্ধুর কাজ করি, ডাকাতেরা কিছুই জানতে পারে না। তুমি যেই হও, মনে কর, মনে রাখ, তোমারো বন্ধু আমি।”
কথাগুলি আমার কর্ণে যেন অমৃতবর্ষণ বোধ হলো। সত্য সত্য শঠতা কি কপটতা, নিঃসংশয়ে সেটি তখন স্থির কোত্তে না পাল্লেও, ঈশ্বরকে স্মরণ কোরে আমি আশ্বস্ত হোলেম। আশ্বাসের ধৰ্ম্ম শান্তভাব, আমি তখন শান্তভাবকে হৃদয়ে ধারণ কোরেও কিঞ্চিৎ চাঞ্চল্য দেখালেম; দুর্ণিবার আগ্রহে ধীরস্বরে পুনরায় জিজ্ঞাসা কোল্লেম, “কোন মহাপুরুষের অভয়বাক্য আমি—”
অন্ধকারে অঙ্গস্পর্শে বাধা দিয়ে সেই স্বর উত্তর কোল্লে, “পরিচয়ের সময় আছে। উতলা হয়ো না। ডাকাতেরা যা তোমারে বোলবে, উত্তর দিয়ো না, ভয় পেয়ো না, সময়োচিত ব্যবস্থা করা আমার ভার, এখন আমি চোল্লেম। পুনরায় তোমাকে আমি নিশ্চয় কোরে বলে যাচ্ছি, কোন ভয় নাই! কোন ভয় নাই!”
মূর্ত্তি বোসে ছিলেন, উঠে দাঁড়ালেন। অনুমানে আমি বুঝলেম, দ্বারে নিকটে গিয়ে ধীরহস্তে অর্গল মুক্ত কোরে ঘর থেকে বেরুলেন, তার পর দ্বারে চাবী বন্ধ কোরে গন্তব্য স্থানে প্রস্থান কোল্লেন।
ইনি কে? যে সব কথা বলে গেলেন, সেগুলি কি সত্য? কপটতা কোরে আমারে স্তোক দিবার জন্য ঐ সব কথার রচনা, এমনও তো বোধ হোচ্ছে না। কথাগুলি সত্য ডাকাতের দলে কেন আছেন, তিনি নিজেই একটু আভাষ দিয়ে গিয়েছেন। দেবতারা যদি আমার প্রতি সদয় হন, ঐ ছদ্মবেশী লোকটির দ্বারাই আমার উদ্ধার হোতে পারবে, মনে এইরূপ আশা জন্মিল; উদ্দেশে ঈশ্বরকে নমস্কার কোল্লেম।
রজনী প্রভাত। কারাকূপ অন্ধকার। কোন দিকের দেয়ালে একটিও গবাক্ষ ছিল না, দ্বারে পাষাণবৎ সুদৃঢ় সুবৃহৎ কপাট, ছিদ্রপথপরিশূন্য, কোন দিকেই আলো দেখা গেল না। মানুষের কলরবে আর কাননের পক্ষীকুলের ঝঙ্কারে আমি অনুভব কোল্লেম, রজনী প্রভাত। আমার আর প্রভাত-সন্ধ্যায় প্রভেদ কি? প্রভাতে কেহই সে কারাগারে প্রবেশ কোল্লে না, আমি একাকী বোসে বোসে আপন অদৃষ্টের ভাবনা ভাবতে লাগলেম। অনেক বিলম্বে একজন লোক এলো। রাত্রিকালে যে সকল লোকের মুখে মুখোস দেখেছিলেম, তাদের মধ্যে কেহ কি না, বুঝতে পাল্লেম না। লোকটার মুখোস মুখে ছিল না, বড় বড় গোঁফদাড়ীযুক্ত ভীষণ বিকট মুখ, মাথার চুলে পৃষ্ঠদেশের অর্দ্ধেকটা পর্য্যন্ত ঢাকা; চুলগুলো ঝাঁকড়া ফাঁকড়া, তাম্রবর্ণ; দেখলেই ভয় হয়।
ভয় আমার সহচর; ভয় আমারে বেশী ভয় দেখাতে পারে না; ভয়কে আমি একরকম ঘরপোষা ভেবে নিয়েছি। লোকটাকে দেখে ভয় হলো, কিন্তু সেই লোক আমাকে একটি কথাও বোল্লে না, ইসারায় মুখভঙ্গী কোরে ডাকলে। শৃঙ্খলাবদ্ধ অবস্থায় যে ভাবে চলা যায়, সেই ভাবে আমি তার সঙ্গে সঙ্গে চোল্লেম। কোন দিকে কি দেখছি, কোন দিকে বাহিরে যাবার পথ, কিছুই জানতে পাচ্ছি না। ইতস্তত আরো জনকত লোক ঠাঁই ঠাঁই বোসে আপনাদের কাজে অন্যমনস্ক ছিল, আমি যখন বেরুলেম, তারা সেইসময় এক একবার ঘূর্ণিতনয়নে আমার দিকে চেয়ে দেখলে, চেয়েই আবার অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিলে। দিনের বেলায় এরা মুখোস পরে না, খোলামুখে থাকে; তাদেরো মুখে তখন মুখোস ছিল না। রেতের বেলা মুখোস পরে, এটাইবা কি রকম? বোধ হয়, আপনাদের আড্ডা বোলেই নির্ভয়। সবগুলো খোলামুখ আমি দেখলেম।
যে লোক আমারে সঙ্গে কোরে এনেছিল, তার ইঙ্গিতে আমি একটা অন্যঘরে প্রবেশ কোল্লেম। লোক আমার হাতের হাতকড়ী খুলে দিলে। একটু স্বাধীনভাবে সেইখানে আমি নিত্যক্রিয়াদি সমাপ্ত কোল্লেম, ঘরের একধারে বড় বড় গামলায় জল ছিল, স্নান কোল্লেম; শরীর একটু স্নিদ্ধ হলো। বন্দীর আবার স্নান! গায়ের জল গায়ে থাকলো, মাথার জল দরদরধারে গায়ে পোড়তে লাগলো, ভিজে কাপড়েই আমি কাঁপতে লাগলেম। স্নানের অগ্রে গায়ের জামাগুলি খুলে রেখেছিলেম, সিক্তবস্ত্রের উপর সিক্তগাত্রে সে জামাগুলি গায়ে দিলেম। লোক আমারে সঙ্গে কোরে আর একটা ঘরে নিয়ে গেল। কোনদিকেই রৌদ্র দেখতে পেলেম না, ভূগর্ভ-গহ্বরে রবির প্রবেশ করে না, কেবল অল্প অল্প আলো হয়, এইমাত্র বুঝা যায়। বেলা কত, নির্ণয় করবার উপায় ছিল না, লোক আমারে সেই ঘরে রেখে, দ্বারে চাবী দিয়ে অন্যদিকে চোলে গেল। অনুগ্রহের মধ্যে কেবল এই থাকলো, আমার হাত-দুখানি বেঁধে রেখে গেল না। আর একটি অনুগ্রহের কথা বলি। বার বার আমি বোলেছিলেম, আমার সঙ্গে টাকা নাই; কথায় তাদের বিশ্বাস হয়েছিল কি না হয়েছিল, বোলতে পারি না, কিন্তু তারা আমার অঙ্গবস্ত্র অন্বেষণ করে নাই। পকেটে দুটি পিস্তল ছিল, তাও তারা জানতে পারে নাই।
ক্ষণকাল পরেই দ্বার উদ্ঘাটিত। সেই স্ত্রীলোক। রাত্রে যে স্ত্রীলোকটি আমারে রুটী দিয়ে গিয়েছিল, কতক কতক আত্মপরিচয় প্রকাশ কোরেছিল, সেই স্ত্রীলোক।
সেই রকম আধপোড়া রুটি, সেইরকম জলের ভাঁড় সেই স্ত্রীলোকের হস্তে ছিল, “খাও খাও” বোলে আমার সম্মুখে ধোরে দিলে। বিগ্রহের কাছে ভোগ দেওয়া যে প্রকার, ডাকাতের আড্ডায় আমার সম্মুখে খাদ্যসামগ্রী ধরাও সেইপ্রকার। একবার চেয়ে দেখলোম মাত্র, খেলেমও না, স্পর্শও কোল্লেম না। স্নানের পূর্ব্বে পিপাসা ছিল, স্নানান্তে সে পিপাসারও শান্তি হয়েছিল, জলের ভাঁড়ের দিকে একবার চাইলেম, ছুঁলেম না; ভাঁড়ের জল, ভাঁড়েই থাকলো।
রাত্রে মশালের আলো থাকলেও স্ত্রীলোকের মুখখানি আমার ভাল কোরে দেখা হয় নাই, এই সময় দেখলেম; অনেকক্ষণ চেয়ে চেয়ে ভাল কোরে দেখলেম। হঠাৎ আমার সর্ব্বশরীর রোমাঞ্চিত হলো! এই স্ত্রীলোককে কোথায় যেন আমি দেখেছি, এই ভাব মনে পোড়লো। বেশীদিন দেখি নাই, দূরে থেকে একবারমাত্র দেখা, এইরুপ যেন অনুমান কোল্লেম। এ স্ত্রীলোক গুজরাটে কেমন কোরে এলো, কেনই বা এসেছে, অনুমান কোত্তে পাল্লেম না। রাত্রে শুনেছি, স্ত্রীলোক বোলেছে, সঙ্গে লোকজন ছিল, পাল্কী ছিল, গায়ে গহনা ছিল, কথাগুলি মিথ্যা বোধ হয় না, কিন্তু কারা সেই সব লোকজন?
স্বপ্নের ন্যায় একটু একটু মনে কোত্তে লাগলেম, নিঃসংশয় হোতে পাল্লেম। পরিচয় দিতে দিতে অর্দ্ধোক্তিতে স্ত্রীলোক একবার বোলেছিল, “ডাকাতের সর্দ্দার আমার—ধর্ম্ম” স্ত্রীলোকের মুখে দেখে দেখে, সেই অর্দ্ধসমাপ্ত বাক্যই আমার মনের উপর তখন যেন বেশী আধিপত্য কোত্তে লাগলো।
মনের ভাব মনের ভিতর গোপন কোরে স্ত্রীলোককে আমি জিজ্ঞাসা কোল্লেম, “তোমাদের সেই সর্দ্দারটি কত রাত্রে ফিরে এসেছে?”
স্ত্রী।—আসে নাই। মাঝে মাঝে তার এইরকম হয়। যে রাত্রে শীকার ধোত্তে পারে না, সে রাত্রে ফিরে আসে না। চেষ্টা নিষ্ফল হলে দু-তিন রাত্রি আসে না। আরো কোথায় কি তার কাজ আছে, পরমেশ্বর জানেন, সেই সব কাজেই মাঝে মাঝে তার অনেক সময় যায়।
আমি।—আটমাস তুমি এখানে আছ, এই আটমাসের মধ্যে তার অপরাপর কার্য্যের কোন সূত্ৰই কি তুমি জানতে পার নাই?
স্ত্রী।—তা আমি কেমন কোরে জানবো? ডাকাতের কাজ ডাকাতী করা। এখানকার ডাকাতেরা কেবল দল বেঁধে বেঁধে লোকের বাড়ী বাড়ী ডাকাতী কোরে বেড়ায় না; বনের ধারে রাস্তার ধারে ওৎ কোরে থেকে, সুবিধামত শীকার পেলেই ধোরে ফেলে। এই,—আমারে যেমন ধোরেচে, তোমারে যেমন ধোরেছে, সেইরকমই শীকার ধরে। তা ছাড়া আরো কতরকম শীকারধরা ফন্দী আছে, কে বোলবে?
আমি।—আচ্ছা, সর্দ্দার তোমারে এখানে আটক কোরে রেখেছে, সে যখন উপস্থিত থাকে না, তখন অন্য ডাকাতেরা তোমার সঙ্গে কি রকম ব্যবহার করে?
স্ত্রী। (লজ্জায় নতমুখী হইয়া) ও কথা কেন তুমি জিজ্ঞাসা কোচ্চো? ডাকাতদের ধর্ম্ম-কর্ম্ম ডাকাতেরাই জানে, আমার সঙ্গে অন্য ডাকাতের কথাবার্ত্তা হয়, এক একজন ডাকাত হাসি-তামাসাও জোড়ে, সর্দ্দারের ভয়ে—ধর্ম্মের ভয়ে নয়, সর্দ্দারের ভয়ে কেহ কিছু বোলতে পারে না।
আমি!—হাঁ, বুঝলেম, ডাকাতের আড্ডায় তুমি আছ, আটমাস আছ, যাদের সঙ্গে তুমি এসেছিলে, ডাকাতেরা সকলকেই কি মেরে ফেলেছে? একজনও কি বেঁচে নাই?
স্ত্রী।—তা হয় তো থাকতে পারে। পথে যখন যুদ্ধ হয়, তখন দুই একজন পালিয়ে গিয়েছে, তা আমি দেখেচি।
আমি। তবে? তারা কি তোমার অন্বেষণ করে না? এই আটমাসের মধ্যে তারা কি তোমার উদ্ধারের জন্য কোন চেষ্টা করে নাই?
স্ত্রী।—প্রাণের ভয় সকলেরই আছে। বাঘের ঘরে আমি রোয়েচি, ক্ষুদ্রপ্রাণে বাঘের ঘরে প্রবেশ কোত্তে কার তেমন সাহস হবে?
আমি।—হাঁ, সে কথা সত্য, কিন্তু দেশ তো অরাজক নয়, কোন উপায়ে কোন কৌশলে রাজ-দরবারের সংবাদ দিলেও তো—
স্ত্রী।—রাজ-দরবার? রাজাকে এরা গ্রাহ্য করে না! রাজাও এদের নামে ভয় পান! একটি লোক—না বাপ!—সেই কথাই বার বার আমার মনে পড়ে, সে কথা আমি বোলবো না; বলি বলি মনে করি, ভয় হয়।
আমি।—(চিন্তা করিয়া) আচ্ছা, দেখতে পাচ্ছি, তুমি তো গুজরাটি মেয়ে নও, চেহারাতেও দেখছি, কথা শুনেও জানতে পাচ্ছি, তুমি বাঙালী। আচ্ছা, বোলতে যদি কোন বাধা না থাকে, সত্য কোরে আমাকে বল দেখি, কোন দেশে তোমাদের বাড়ি?
স্ত্রীলোকটি বোসে ছিল, আমার ঐ প্রশ্ন শুনেই অস্থির হয়ে উঠে দাঁড়ালো; তাড়াতাড়ি বোল্লে, “খাও তো খাও, আর আমারে বোসিয়ে রেখো না; ও সব কথার উত্তর দিতে আমি পারবো না! বাড়ী কোথায়, ঘর কোথায়, জন্মো কোথায়, সে সব খবর আর কেন? সে সব কথা শুনলে আমার কেবল কান্না পায়! ধর্ম্মকর্ম্ম যখন জলাঞ্জলি হয়ে গিয়েছে, তখন আর ও সকল খবরে কি ফল? খাও তো খাও, আমি চোল্লেম।”
ঊর্দ্ধমুখে আমি চেয়ে দেখলেম, সত্যই অভাগিনীর চক্ষে জল এসেছে। সে প্রসঙ্গ আর আমি উত্থাপন কোল্লেম না, আর তার মুখের দিকে না চেয়েই মৃদুস্বরে বোল্লেম, “কিছুই আমি খাব না, এ সকল তুমি নিয়ে যাও।”
সজলনয়নে আমার মুখপানে চেয়ে স্ত্রীলোকটি বোল্লে, “না খেয়ে কি রকমে বাঁচবে; কত দিন যে এখানে কষ্টভোগ কোত্তে হবে, তাই বা কে বোলতে পারে? কিছু খাও। রাত্রে বরং আমি খানকতক ভাল রুটি এনে দিব, এখন দু-একখানি এই রুটি খেয়ে একটু জল খাও; না খেলে বাঁচবে কেন?”
সে সব কথা আমি শুনলেম না, কিছুই খেলেম না, জল-রুটি সেইখানে ফেলে রেখে স্ত্রীলোকটি বেরিয়ে গেল, দস্তুরমত কপাটে চাবী পোড়ালো।
যে ঘরে এখন আমি আছি, এটা নূতন ঘর; দেয়ালের দুই ধারে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দুই তিনটি ছিদ্র, সেই সকল ছিদ্রে অল্প অল্প আলো আসে, অল্প অল্প হাওয়া আসে, একটু আরামে নিশ্বাস ফেলা যায়। ছিদ্রগুলি কিছু উচ্চে উচ্চে অবস্থিত; সার্দ্ধ ত্রিহস্ত পরিমিত মানবদেহ বাহু উত্তোলন কোরে সেই সকল ছিদ্রপথ স্পর্শ কোত্তে পারে না, তথাপি একটু আরাম পায়। সেই ঘরে আমি বোসে আছি, ডাকাতেরা কেহই আসছে না। খালাসী টাকার জন্য চিঠি লিখে দিতে হবে, টাকা না পেলে তারা আমাকে ছেড়ে দিবে। কার নামেই বা চিঠি লিখবো? কারেই বা আমি চিনি? দীনবন্ধুবাবু দয়া কোরে আমাকে আশ্রয় দিয়েছেন, আমার খালাসের জন্য ডাকাতকে তিনি দশ হাজার টাকা দিবেন, এমন তো কিছুতেই সম্ভব বোলে বোধ হয় না, তেমন আশাও করা যায় না; তাঁরে আমি এ কথা লিখতেই পারবো না। পরমেশ্বর; যদি রক্ষা করেন, তবেই রক্ষা হবে, না হয় তো এইখানেই প্রাণ যাবে। ডাকাতেরা যদি মারে, তা হোলেও প্রাণ যাবে, তারা যদি না মারে, অনাহারেই মারা যাব, এই আমার তখনকার সিদ্ধান্ত।
বেলা হোচ্ছে, বেলা যাচ্ছে, সংস্কারবশে বুঝতে পাচ্ছি, কিন্তু বাস্তবিক কত বেলা, সেটা ঠিক জানতে পাচ্ছি না। নিষ্কর্ম্মা বোসে বোসে ছিদ্রপথে চেয়ে আছি, মন কিন্তু চিন্তাশূন্য নয়। চিন্তা অনেক প্রকার, তার উপর নিজের প্রাণরক্ষার চিন্তা। সকল চিন্তাকে অতিক্রম কোরে আড্ডার ঐ স্ত্রীলোকটির চিন্তা তখন আমারে কিছু অধিক চঞ্চল কোরে তুল্লে। কে এই স্ত্রীলোক? কোথাকার স্ত্রীলোক?
কে ঐ স্ত্রীলোক? পূর্ব্বে কোথায় তারে আমি দেখেছি?—দেখেছি নিশ্চয়, কিন্তু কোথায়? যে কয়েকটি স্ত্রীলোকের সঙ্গে এ জীবনে আমার দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছে, তাদের কথা মনে আছে। তাদের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠভাবে কথাবার্ত্তা চোলেছে, তাদের চেহারা যেন, নিত্য সৰ্ব্বক্ষণ আমার চক্ষের কাছে উপস্থিত হয়। এ স্ত্রীলোকটিকে সে ভাবে আমি দেখি নাই, কেমন যেন নূতন নূতন মনে হয়। এখানে দেখলেম নূতন, গত রাত্রে ভেবেছিলেম নূতন, আজ মনে হচ্ছে, পূর্ব্বের দেখা; কিন্তু কোথায়?
দিনমানের মধ্যে মনে আনতে পাল্লেম না। সন্ধ্যা সমাগত। দেয়ালের ছিদ্রপথে একটু একটু আলো আসছিল, সে আলো তিরোহিত; সেই লক্ষণেই জানতে পাল্লেম, সন্ধ্যাকাল। আমি কয়েদী। ডাকাতেরা আমার উপকারের জন্য ঘরে আলো জ্বেলে দিবে না, আলো আমি চাইও না, ভাগ্য যখন অন্ধকার, তখন এ জায়গায় অন্ধকারে থাকাই ভাল; অন্ধকারেই আমি থাকলেম। চঞ্চলা চিন্তা অন্ধকারে একটু যেন শান্তভাব ধারণ করে। স্ত্রীলোকটি কে, সেই চিন্তা সেদিন আমার প্রধান হয়েছিল, স্থির কোত্তে পাল্লে তাদৃশ ফল কিছুই হবে না, তাও বুঝতে পেরেছিলেম, তবু কিন্তু সেই চিন্তা প্রধান।
অনেক ভাবলেম। অন্ধকারকে জিজ্ঞাসা করি, কে ঐ স্ত্রীলোক? অন্ধকার উত্তর দেয় না; শূন্যকে জিজ্ঞাসা করি, কে ঐ স্ত্রীলোক? শুন্য উত্তর দেয়; বাতাসকে জিজ্ঞাসা করি, কে ঐ স্ত্রীলোক? বাতাস উত্তর করে না। তাদের কাছে উত্তর পাওয়া গেল না। মনের প্রতিই বারম্বার প্রশ্ন। মন আমার প্রাণের সঙ্গে কথা কয়। মনের কাছেই উত্তর পেলেম। ঠিক—ঠিক—ঠিক! কাশীরাম!
এই বটে সেই! এই সেই কুল-কলঙ্কিনী। কাশীর রসিক পিতুড়ীর বাড়ীতে কুমারী-ভোজন হোতে যে যুবতী ব্রতবতী হয়েছিল, এই সেই ব্রতবতী! বীরভূমের কানাইবাবুর পরিবার! কি সম্পর্কে পরিবার, পাঠকমহাশয় সে তত্ত্ব অবগত আছেন। পরিবারটি কানাইবাবুর মাতুল-কন্যা! এই কলঙ্কিনী অম্লানমুখে আমার কাছে বোলে গেল, ডাকাতের সর্দ্দার তারে দাসী কোরে রেখেছে, একটু লজ্জা জানিয়ে ধর্ম্ম-কথাটাও প্রকাশ কোচ্ছিল, স্পষ্ট আভাষও দিয়েছিল, বোলতে বোলতে থেমে গেল। যাদের ইহকাল নাই, পরকাল নাই, তাদের এই রকম দশা হওয়াই ধর্ম্মের ইচ্ছা। কিন্তু এ কলঙ্কিনী গুজরাটে কেন এসেছিল? প্রেমের নায়ক কানাইবাবু। বীরভূমে সুবিধা হলো না, কলিকাতায় নিরাপদ হোলেন না, কাশীর তুল্য পতিতপাবন পীঠস্থানেও বোধ হয় ধরা পড়বার ভয় হয়েছিল, সেই জন্যই কি কানাইবাবু এই পরিবারটিকে নিয়ে গুজরাটে এসেছিলেন? তাই বোধ হয় সত্য। এত দূরদেশে এসেও কানাইবাবু এই পরিবারটিকে রক্ষা কোত্তে পাল্লেন না; ডাকাতেরা কেড়ে নিলে! কানাইবাবু গেলেন কোথা? ডাকাতেরা কি তাঁকে খুন কোরেছে? তা যদি হয়, প্রায়শ্চিত্ত ঠিক হয় নাই। তাদৃশ পাপে এ প্রকার প্রায়শ্চিত্ত জনসাধারণের শিক্ষাস্থল হয়। দীর্ঘকাল বেঁচে থেকে সেই প্রকারের পাপীরা যদি ইহ-সংসারে নিরন্তর কষ্টভোগ করে অথবা ভীষণ যন্ত্রণা পেয়ে প্রাণ হারায়, তা হলেই ঠিক হয়।
মনে মনে এইগুলিই আমি ভাবলেম। সত্য নির্ণয় কোত্তে পেরেছি কি না, সেই স্ত্রীলোক যদি আবার আজ রাত্রে আমার খাবার দিতে আসে, ইঙ্গিতে কৌশলে জিজ্ঞাসা কোরে জানবো, এইটি তখন স্থির কোরে রাখলেম।
ডাকাতের সর্দ্দার ফিরে আসে নাই। গত রাত্রে অভাবনীয়রূপে যিনি আমার কারাকূপে প্রবেশ কোরেছিলেন, বন্ধুভাবে কথা কোরেছিলেন, আজ যদি তিনি আসেন, তা হোলে তাঁরে আমি রক্ষাকর্ত্তা পিতা বোলে তাঁর কাছে কৃপা ভিক্ষা কোরবো।
ইংরেজী বড়দিনের পর একটু একটু দিন বাড়ে, চৈত্রমাসে দিবা-রাত্রি সমান হয়, তার পর ক্রমশঃ দিন দীর্ঘ, রাত্রি খৰ্ব্ব। আমি গুজরাটের ডাকাতের অন্ধকার কারাগারে। কখন দিন হয়, কখন রাত হয়, দিন বড়, কি রাত বড়, সেটা স্থির করবার উপায় নাই; রাত-দিন আমার পক্ষে সমান। অন্ধের যেমন দিবারাত্রিজ্ঞান থাকা অসম্ভব, আমারও প্রায় সেইরুপ। কয়েদ থাকা যে কি যন্ত্রণা, কয়েদীরাই তা জানে। তার মধ্যেও—আমার অবস্থার সঙ্গে মিলনে, তার মধ্যেও অনেকটা প্রভেদ। রাজ-কারাগারের কয়েদীরা অপরাধী, তাদের কারা-যন্ত্রণা অনিবার্য্য, সেটা তারা বুঝে; আমি নিরপরাধ, রাজ-কারাগারের পরিবর্ত্তে ডাকাতের কারাগারে আমি বন্দী; সাধারণ কয়েদীর যন্ত্রণা অপেক্ষা আমার যন্ত্রণা সহস্রগুণে অধিক। সময়টা দীর্ঘ বোধ হয়, কিন্তু রাত-দিন কোথা দিয়ে চোলে যায়, কখন যায়, কখন আসে, সেটা আমি কিছুই জানতে পারি না।
যখন আমি এই সকল ভাবছি, তখন রাত্রি কত, তাও আমি জানি না। বাহিরে দরজাখোলার শব্দ হলো; মশালহস্তা পাত্রহস্তা সেই স্ত্রীলোকটি প্রবেশ কোল্লে। বেশ সাবধান। মশালটি যথাস্থানে রেখে, সাবধানে সেই স্ত্রীলোক এক হস্তে দরজাটা খুব চেপে ভেজিয়ে দিলে, তার পর হস্তের পাত্রটি আমার সম্মুখে নামিয়ে ধীরে ধীরে আমার কাছে এসে বোসলো। আমি তখন দেখলেম, তার বদন দিব্য গম্ভীর! পূর্ব্বে দুইবার প্রকৃতিতে যেমন একটু একটু চাঞ্চল্য দেখা গিয়েছিল, এ রাত্রে সে চাঞ্চল্য ছিল না। বারাণসী শাড়ীপরা, গললগ্নবসনা, কাশীর কুমারী-পুজায় ব্রতবতী অবস্থায় মুখের যেরূপ শান্তভাব ছিল, আজ রাত্রেও যেন সেই ভাব; তফাতের মধ্যে মুখখানি কিছু কাহিল, কিছু, শুষ্ক শুষ্ক।
অগ্রে আমি কথা কোইলেম না। অল্পক্ষণ আমার মুখের দিকে চেয়ে থেকে, ধীরস্বরে স্ত্রীলোক বোল্লে, “আজ আমি তোমার জন্যে ভাল ভাল রুটি এনেছি, গুড় এনেছি, খাও। দুদিন কিছু খাও নাই, না খেয়ে বাঁচবে কিরূপে?—খাও!”
আমি।—(নিশ্বাস ত্যাগ করিয়া) বাঁচবো?—বাঁচিয়ে রাখবার জন্যই কি এরা আমাকে ধোরেছে? বাঁচায় আর আমার দরকার নাই।
স্ত্রী।—(বিস্ময়ে) ও কি কথা বলো? এই ছেলেমানুষ তুমি, এই কোমল শরীর, তোমার মনে এতো নিরাশা? বাঁচার দরকার নাই! অমন কথা কি বোলতে আছে? এই দেখো না কেন, আমারেও তো এরা ধোরে এনেচে, ধোরে এনে আটক কোরে রেখেচে, কষ্ট অনেক পাচ্চি বটে, তবু তো আমি খাচ্চি, শুচ্চি, বেড়াচ্চি, বেঁচে রোয়েচি, অমন কথা তো আমার মুখ দিয়ে বেরোয় না!
আমি।—(চিন্তা করিয়া) তুমি বেঁচে রয়েছ, খাচ্ছ, শুচ্ছ, বেড়াচ্ছ, তোমার মনে একটু সুখ আছে; আমার মনে বিন্দুমাত্র সুখ নাই। যারা কয়েদ থাকে, তারা চোর-ডাকাত, খুনে বদমাস। কোন দোষে দোষী আমি নই, বিনা দোষে আমার ভাগ্যে এই কারাযন্ত্রণা! এ যন্ত্রণা থেকে নিস্তার পাব কি না, তাও আমি জানি না; তবেই ভাব দেখি, এই নিদারুণ যন্ত্রণা সহ্য কোরে বেঁচে থাকতে কি ইচ্ছা হয়? জগতের জীবের জীবনদাতা যিনি, তাঁর সেই পবিত্র নাম স্মরণ কোরে অনাহারে তাঁর দত্ত জীবন তাঁরেই আমি ফিরিয়ে দিব; কিছুই আমি খাব না!
স্ত্রী।—(নিশ্বাস ত্যাগ করিয়া) তোমার কথা শুনে আমার প্রাণ বড় অস্থির হোচ্চে! দোষ তুমি কর নাই, দোষী লোকেরাই বিনা দোষে তোমারে ধারেচে, এটাও এক রকম প্রবোধ বোলে মনে হয়, তাই কেন তুমি ভাবো না! পরমেশ্বরের বিচারে দোষীলোকের সাজা হয়, নির্দ্দোষীর সাজা হয় না; আমার মনে নিচ্চে, শীঘ্র তুমি খালাস পাবে; পরমেশ্বর তোমারে রক্ষা কোরবেন।
আমি।—(চমকিত হইয়া) আমিও ইচ্ছা করি, পরমেশ্বর তোমার মঙ্গল করুন! পরমেশ্বরে তোমার ভক্তি আছে, শুনেও আমি তুষ্ট হোলেম। (পূৰ্ব্বকথা স্মরণ করিয়া) আচ্ছা, একটি কথা তোমারে আমি জিজ্ঞাসা কোত্তে চাই। আজ দিনের বেলা যখন তুমি এসেছিলে, তখনি জিজ্ঞাসা করবার ইচ্ছা হয়েছিল, সন্দেহ ভেবে চুপ কোরে ছিলেম। কিছু মনে কোরো না তুমি, দোষের কথা কিছুই নয়, জিজ্ঞাসা কোরবো; ঠিক উত্তর পাব কি?
স্ত্রী।—(ম্লানমুখে শান্তনয়নে চাহিয়া) কি জিজ্ঞাসা কোত্তে চাও, কর, যদি আমার জানা থাকে, যদি উত্তর দিবার হয়, অবশ্যই উত্তর দিব। কি কথা তোমার?
আমি।—(পূর্ব্বাপর বিবেচনা না করিয়াই) বীরভূমে কি তুমি কখনো ছিলে?
ওঃ হরি!—অকস্মাৎ এ কি মূর্ত্তি! প্রশ্ন শ্রবণমাত্রেই সেই স্ত্রীলোক অকস্মাৎ চমকিয়া বিস্তৃত-নয়নে আমার মুখের দিকে স্থির হয়ে চেয়ে রোইলো! পলক পড়ে না। একে সেই চক্ষুদুটি খুব বড় বড়, এই সময় আমার চক্ষে যেন আরো বড় বড় বোধ হোতে লাগলো! স্ত্রীলাক যেন পাষাণমূৰ্ত্তির ন্যায় নিশ্চলা! ভাব দেখে যেন আমি মনে কোল্লেম, ঠিক—ঠিক—ঠিক!—আমার অনুমান তবে নিশ্চয়ই ঠিক!—সত্য না হোলে এ মূর্ত্তির এ ভাব কেন হবে? এমন কোরে চোমকেই বা কেন যাবে? মনে এইরুপ ঠিক অবধারণ কোরে, দুই কথায় আমি পুনঃ প্রশ্ন কোল্লেম, “কৈ, উত্তর দিলে না?”
স্ত্রী—(সেই রকমে চাহিয়া) কোন কথার উত্তর দিব? বীরভূম?—বীরভূমের কথা তুমি কেন জিজ্ঞাসা কোচ্চো?
আমি।—বীরভূমে আমি একবার গিয়েছিলেম। সেইখানে—
কথা বোলতে বোলতে চেয়ে দেখলেম, স্ত্রীলোকর মুখের চক্ষের সে ভাব আর নাই! শুষ্কমুখ অকস্মাৎ রক্তবর্ণ, বিশালনয়নে অকস্মাৎ কপোলবাহিনী জলধারা! অবধারণের উপায় অবধারণ যদি স্বভাবসঙ্গত হয়, সেই দ্বিগুণ অবধারণ আমার চিত্তকে প্রদীপ্ত কোরে তুল্লে। আমি জিজ্ঞাসা কোচ্ছিলেম, “বীরভূমের নাম শুনে, তোমার চক্ষে—”
আর জিজ্ঞাসা করা হলো না। সহসা কারাদ্বার উদ্ঘাটিত; একমূর্ত্তির দ্রুত প্রবেশ। মুখে মুখোস, কিন্তু চক্ষু বেশ দেখা যায়। দ্বারে চাবী বন্ধ ছিল না, তা দেখেই সেই মূর্ত্তির সন্দেহ বিস্ময় একত্র হয়েছিল, চক্ষের ভাব দেখে সেইটিই আমি অগ্রে স্থির কোল্লেম; দ্বার আবৃত কোরে দিয়ে সেই নবপ্রবিষ্ট মূর্ত্তি মুখোস ঢাকা মুখখানা ইতস্তত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ঘরের চতুর্দ্দিকে দৃষ্টিসঞ্চালন কোত্তে লাগলো। আমার সমীপবর্ত্তিনী স্ত্রীলোকের উপর সেই দৃষ্টি নিপতিত হলো; বিস্ময় প্রকাশ কোরে মূর্ত্তিটি সেই লোককে জিজ্ঞাসা কোল্লে, “কি রে রঙ্গিণি! এখানে বোসে বোসে তুই কিসের গল্প কোচ্ছিস? শীকারের সঙ্গে গল্প? রুপের চটক দেখে ভুলে গিয়েছিস বুঝি? আসুক তোর সর্দ্দার আগে, সব ভুর আমি ভেঙ্গে দিব!”
রঙ্গিণী আর বোসে থাকতে পাল্লে না, চক্ষের জল মুছতে মুছতে উঠে দাঁড়িয়ে দুই হাত জোড় কোরে কাতরস্বরে বোলতে লাগলো, “দোহাই তোমার! দোহাই তোমার ভূষণলাল, সে সব কথা কিছুই নয়, ছেলেটি দুদিন কিছুই খায় না, তাই জন্যে ত তুমি এখন এসেচো, তোমার তলোয়ারখানা চকমক কোচ্চে, তলোয়ার দেখেই ভয়ে ভয়ে খাবে এখন! আমি তবে—তবে—”
বোলতে বোলতে মূর্ত্তির দিকে একবার চেয়ে চক্ষু ঘুরিয়ে আমার দিকে চাইতে চাইতে স্ত্রীলোকটি তাড়াতাড়ি কপাট খুলে বেরিয়ে গেল; দ্বারে চাবী দিবার প্রয়োজন হলো না; পূর্ব্ববৎ ভেজিয়ে রেখেই চোলে গেল। ঘরে তখন সেই মূর্ত্তি আর আমি।
মশাল জ্বোলছিল। ঘরে বেশ আলো। মূর্ত্তি আমার সম্মুখে দণ্ডায়মান। ডাকাত এসেছে, অন্তরে অন্তরে আমার কাঁপনী ধোরেছে; রঙ্গিণী বোলে গেল, তলোয়ার চকমক। সত্যই সেই মূর্ত্তির হস্তে খাপখোলা সুশোণিত সুদীর্ঘ তলোয়ার। রঙ্গিণী তো পালালো এইবার আমার পালা! না জানি, আমার কপালে কি ঘটে!
খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেই মূর্ত্তি সেই তলোয়ারখানি কোষবদ্ধ কোরে দেয়ালের গায়ে ঝুলিয়ে রাখলে, মশালটা যেখানে জ্বোলছিল, সেইদিকে একটু একটু এগিয়ে এগিয়ে চোল্লো। ঠিক আমি সেইদিকে চেয়ে আছি। মুক্তি চোলেছে; চোলতে চোলতে আপনার মুখে একবার হাত দিলে; দৈবের কর্ম্ম, সেই সময় তার মুখের মুখোসটা হঠাৎ অসাবধানে খোসে পোড়ছিল, বুক পর্য্যন্ত আসতে আসতেই অধিকারী ব্যস্তভাবে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে চঞ্চল-হস্তে পুনৰ্ব্বার সেই মুখোসে মুখখানা ঢেকে ফেল্লে, বড় বড় ফুৎকার দিয়ে জলন্ত মশালটা নিবিয়ে দিলে। ঘর অন্ধকার হয়ে গেল। তখন আমি বুঝলেম, মুখে মুখোস থাকলে ফুৎকার দেওয়া যায় না, সেই জন্যই মুখোসধারী হয় তো মুখোসটা একটু সোরিয়ে দিবার চেষ্টা কোচ্ছিল, সেই চেষ্টাতেই মুখোসটা খুলে যায়, আসল মূর্ত্তি প্রকাশ পায়; দীর্ঘ মূর্ত্তি সুপ্রকাশ।
এই লোকটি কি ডাকাত? কি আশ্চর্য্য! আহা! কি চমৎকার রূপ! মুখখানি আমি দেখেছি; যদিও অতি অল্পক্ষণ মাত্র দেখা, তবু কিন্তু দেখেছি, বেশ পরিষ্কার দেখেছি; কি চমৎকার মুখ! যেমন সুন্দর গৌরবর্ণ, তেমনি সুন্দর মনোহর লাবণ্য, দিব্য দীর্ঘ দীর্ঘ সমুজ্জ্বল চক্ষু, দিব্য লোমযুক্ত টানা ভ্রূ, ললাট প্রশস্ত, নিটোল; সেই ললাটের উভয়পার্শ্বে কুঞ্চিত কুঞ্চিত সুচিক্কণ কেশ, কর্ণমূলে সুশোভন জুলপী; সুদীর্ঘ নাসিকা, নাসিকার নিম্নভাগে ওষ্ঠের উপর নবীন গোঁফের রেখা; ওষ্ঠাধর তরুণ অরুণের ন্যায় আলোহিত; চিবুকখানি কিছু, খৰ্ব্ব; পরম সুন্দর মুখমণ্ডল; মুখে যেন গাম্ভীর্য্যের সঙ্গে বীরগৰ্ব্ব সুপ্রকাশ! এমন সুপুরুষ কি ডাকাত হয়?—না না, ডাকাত নয়! তবে কে? তবে কি? ডাকাতের দলে এ মূর্ত্তি কেন?
মনে এই রকম তোলাপাড়া কোচ্ছি, সেই লোকটি সেই অন্ধকারে আমার কাছে এসে বোসলো। না না, ইতরজ্ঞানে সম্ভাষণ করা হবে না, ডাকাত নয়; লোকটি আমার কাছে এসে বোসলেন। পূৰ্ব্বে আমার যতটা ভয় হয়েছিল, চেহারা মনে কোরে ততটা ভয় আর থাকলো না। কে ইনি, মনে মনে কেবল সেই তর্ক। রঙ্গিণী বোলে গেছে, ভূষণলাল; এই লোকটির নাম তবে ভূষণলাল। নামটিও দিব্য-সুন্দর। গুজরাটি নাম; বুঝতে পাচ্ছি, ইনি গুজরাট নিবাসী। ইনি আমারে ভয় দেখাবেন না, মনে মনে এইরূপ বিশ্বাস আসতে লাগলো।
ভূষণলাল আমার কাছে বোসে সতর্কস্বরে প্রথমেই জিজ্ঞাসা কোল্লেন, “কি হে ছোকরা! তুমি কি আমাকে চিনতে পেরেছ?”—প্রশ্ন শুনেই আমি ভাবলেম, মুখোসখোলা মুখখানি আমি দেখেছি, সেটি হয় তো ইনি জানতে পেরেছেন, সেইজন্যই হয় তো ঐরূপ প্রশ্ন। আবার ভাবলেম, তাই বা কিরূপে সম্ভবে? আর তো কখনো সে চেহারা আমি দেখি নাই, মুখখানি আমার পরে চেনা নয়, চিনতে পারার প্রশ্নটা তবে কিরূপে সঙ্গত হোতে পারে? মুখখানি আমি দেখেছি, তা হয় তো ইনি জানতে পারেন নাই, ডাকাত মনে কোরেই আমি বোসে আছি; দশজন ডাকাত কাল রাত্রে একত্র হয়েছিল, ইনিও তাদের মধ্যে একজন, তাই হয় তো আমি ভেবে নিয়েছি, এইরূপ মনে কোরেই হয় তো ঐরূপ প্রশ্ন। মনের ভিতর আমার এই প্রকার তর্ক-বিতর্ক; উত্তর দিবার আমার ইচ্ছা হলো না, কাজেই আমি নিরুত্তর।
আমাকে নিরুত্তর দেখে, ভূষণলাল পুনরায় জিজ্ঞাসা কোল্লেন, “চুপ কোরে রইলে কেন? কথা কও; চুপি চুপি কথা কও। তুমি কি আমাকে চিনতে পেরেছ? গত রাত্রে আমি এসেছিলেম, ভয় নাই বোলে অভয় দিয়েছিলেম, মনে হয়? এখনো বোলছি, ভয় নাই। কথা কও। নির্ভয়ে মনের কথা বল। যা তুমি আমাকে দেখছো, তা আমি নই। আমি তোমার বন্ধুলোক।”
ধন্যবাদ দিয়ে সাগ্রহ আনন্দে আমি বোল্লেম, “আপনি মহাপুরুষ, আমি বুঝতে পেরেছি। ডাকাতের দলে আপনি আছেন, আপনার কোন প্রকার সদভিসন্ধি আছে, গত রজনীতে ইঙ্গিতে সেই কথা আপনি আমাকে বোলেছিলেন, ইঙ্গিতটি অতি জটিল, সেটি আমি বুঝতে পারি নাই। পরমেশ্বর করুন আপনার অভিপ্রায় সিদ্ধ হোক। আপনি আমার মনের কথা জিজ্ঞাসা কোচ্ছেন, এখানে আর আমার মনের কথা কি থাকতে পারে? আশা কেবল মুক্তিলাভ। আপনি আমাকে অভয়দান কোচ্ছেন, তাতেই আমি চরিতার্থ হয়েছি; আপনার প্রসাদে আমি এই নরককুণ্ড থেকে মুক্ত হোতে পারবো; আশা আমাকে এইরূপ উল্লাস বিতরণ কোচ্ছে।”
আমার উত্তরে সন্তুষ্ট হয়ে ছদ্মবেশী ভূষণলাল পুনর্ব্বার আমাকে জিজ্ঞাসা কোল্লে, গুজরাটে তুমি কবে এসেছ? কেন এসেছ? দেখছি, তুমি বাঙালীর সন্তান, বালক, কার সঙ্গে তুমি এসেছ? তোমার সঙ্গে কে কে আছে?”
আমি।—আমার দুঃখের কথা শুনলে পাষাণও দ্রব হয়! নিতান্ত শিশুকাল থেকে আমি নিরাশ্রয় নির্ব্বান্ধব; মাতা-পিতাও আমার অপরিজ্ঞাত। এই বালক-জীবনেই যত কষ্ট আমি ভোগ কোরেছি, যত বিপদের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছে, পরম শত্রুও যেন তত কষ্টে—তত বিপদে কখনো না পড়ে। স্বপ্নেও আমি কোন লোকের কোন মন্দ ভাবনা করি নাই, তথাপি আমার অনেক শত্রু হয়েছে; যেমন তেমন শত্রু নয়, প্রাণঘাতক শত্রু। সেই সকল শত্রুর ভয়ে দেশে বিদেশে আমি ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছি!”
ভূষণ।—তোমার শত্র,? চেহারা দেখে আমার মনে হোচ্ছে, জগৎ-সংসার তোমাকে মিত্রভাবে আলিঙ্গন কোত্তে আনন্দ বোধ করে। তোমার আবার শত্রু? দেশে বিদেশে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছ, শুনে আমি বড় দুঃখিত হোলেম। এখানে কি কেহই তোমার সঙ্গে নাই? গুজরাটে তবে কি তুমি একাই এসেছ?”
আমি।—আজ্ঞা না, একাকী আসি নাই; বঙ্গের মুর্শিদাবাদজেলার একটি ভদ্রলোক দ্বারকা-দর্শনে এসেছেন, তাঁর সঙ্গেই আমি এসেছি; বেশী দিন আসি নাই, অল্পদিনের মধ্যেই আমার এই বিপদ!
ভূষণ।—এ বিপদ তোমার থাকবে না; পরমেশ্বরের কৃপায় আমি তোমাকে এই প্রেত-পুরী থেকে উদ্ধার করবার সহায় হোতে পারবো। চিন্তা কোরো না, কোন ভয় নাই। উপবাসী থেকো না, কিছু কিছু আহার কোরো। রঙ্গিণীকে আমি বোলে দিব, সে তোমাকে ভাল ভাল খাদ্যসামগ্রী এনে দিবে। রঙ্গিণী বাঙালী-ব্রাক্ষণের মেয়ে, অন্য পরিচয় জানি না, তার মুখে কেবল এইটকু আমি শুনেছি। রঙ্গিণী স্বহস্তে খাদ্য-সামগ্রী প্রস্তুত করে, আহারে তাদৃশ দোষ হবে না; যে অবস্থায় সে এখন আছে, তার হস্তে অন্ন গ্রহণে দোষ হোতে পারে, রুটিতে দোষ নাই। কিছু কিছু আহার কোরো।”
আমি।—আহারে আমার প্রবৃত্তি হয় না; ক্ষুধা যেন আমারে পরিত্যাগ কোরে গিয়েছে, কিছুতেই আর রুচি নাই। মন বড় উতলা। যাঁর সঙ্গে আমি এসেছি, তিনি একজন জমীদার, টাকা দিয়ে তিনি আমাকে খালাস কোত্তে পাত্তেন, যদি কম টাকা হোতো, তা হলে নিশ্চয়ই তিনি দিতেন, তিনি আমাকে বড় ভালবাসেন, নিশ্চয়ই দিতেন, কিন্তু ডাকাতেরা দশ হাজার টাকা চায়, তত টাকার জন্য তাঁকে অনুরোধ করা আমার মত আশ্রিত গরিবের উচিত হয় না, বিশেষতঃ কেই বা তাঁকে সংবাদ দিবে? আমি এখানে কয়েদ আছি, কিরূপেই বা তিনি জানবেন?
ভূষণ।—টাকা তোমার প্রয়োজন হবে না, আমি বরং তোমাকে এখান থেকে উদ্ধার কোরে প্রচুর অর্থ দান কোরবো, এখানকার রাজবংশের সঙ্গে আমার অতি নিকট সম্বন্ধ; সময় যখন আসবে, সে পরিচয় তখন তুমি জানতে পারবে। যে বাবুটির সঙ্গে তুমি এসেছ, তোমার জন্য অবশ্যই তিনি উদ্বিগ্ন হোচ্ছেন; নাম বোলে দাও, ঠিকানা বোলে দাও, কালই তাঁর কাছে আমি তোমার নিরাপদের সংবাদ পাঠাব।
আমি।—আপনাকে শত সহস্র ধন্যবাদ! গরিবের প্রতি আপনার এত দয়া, ভগবান আপনার এই দয়ার কার্য্যের উচিত পুরস্কার প্রদান কোরবেন। যাঁর সঙ্গে আমি এসেছি, তাঁর নাম দীনবন্ধুবাবু শ্রীশ্রীভবানীদেবীর মন্দিরের পশ্চিমাংশে অদূরে একখানি দোতালা বাড়ীতে তাঁর বাসা, তিনি আমার জন্য মহা উদ্বিগ্ন, এটি আপনি নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন, দীনবন্ধুবাবুর উদ্বেগশান্তির নিমিত্ত শীঘ্র মুক্তিলাভে আমি অভিলাষী।
ভূষণ।—অশীঘ্র যাতে না হয়, সে চেষ্টায় আমি থাকলেম; উর্দ্ধসংখ্যা এক সপ্তাহ। ডাকাতেরা এখন প্রায়ই দূরে দূরে ডাকাতী কোত্তে যায়; সর্দ্দার ডাকাত বীরমল্ল অনেক দূরে গিয়ে পোড়েছে, এখানে এখন প্রায় সকল কাজেই আমার হকুম চলে; ডাকাতের বিশ্বাসে আমিও একজন তাদের মত ডাকাত, সুতরাং এখানকার প্রহরীরা—চাকরেরা সকলেই আমার বাধ্য। অবসর উপস্থিত হোলেই আমি তোমাকে নিরাপদে দীনবন্ধুবাবুর বাসায় পৌঁছে দিব। বড় জোর এক সপ্তাহ।
আমি।—(নমস্কার করিয়া) ভগবান আপনাকে সংসারে সৰ্ব্বপ্রকারে সুখে রাখুন। যত শীঘ্র আপনি আমাকে খোলা বাতাসে ছেড়ে দিতে পারেন, তত শীঘ্রই আমি স্বদেশে প্রস্থান করবার জন্য প্রস্তুত হব। কেবল দীনবন্ধুবাবুর উদ্বেগ দূর করা আমার আশু মুক্তিলাভের উদ্দেশ্য নয়, আরো একটি গুরুতর কৰ্ত্তব্য আমার মাথার উপর বিলম্বিত। মহা বিপদে একটি দয়াবতী বালিকা আমার প্রাণরক্ষা করেছিলেন, আমার শত্রুপক্ষের দস্যুতস্করেরা সেই বালিকাটিকে হরণ কোরে কোথায় নিয়ে গিয়েছে, সন্ধান নাই। মুর্শিদাবাদের আদালতে আমি মোকদ্দমা দায়ের কোরেছি, প্রাণদায়িনীর উদ্ধারসাধন আমার ধর্ম্মনগত কর্ত্তব্য; মোকদ্দমা-স্থলে আমার উপস্থিত থাকা প্রয়োজন।
ভূষণ।—হাঁ, তোমার হৃদয়ের ধর্ম্মভাব তোমার বদনেই প্রকাশ পায়। সব আমি বুঝতে পাচ্ছি; শীঘ্রই আমি তোমাকে মুক্ত কোরে দিব; নিশ্চিন্ত হয়ে সপ্তাহকাল এইখানে তুমি অপেক্ষা কর। হাঁ, জিজ্ঞাসা কোত্তে ভুল হয়েছে, তোমার নামটি কি?
আমি।—আমার নাম হরিদাস। যাঁদের সঙ্গে আমার দেখা হয়, আলাপ হয়, যাঁদের কাছে আমি আশ্রয় পাই, তাঁরা সকলেই আমারে হরিদাস বোলে জানেন; যারা আমার প্রতি বৈরী, তারাও জানে, আমার নাম হরিদাস।
ভূষণ।—আচ্ছা, দেখ হরিদাস, বোলেছি আমি তোমাকে, ডাকাতের সর্দ্দারের নাম বীরমল্ল; যে ঘরে তুমি এখন রয়েছ, এটা সেই বীরমল্পের ভাঁড়ার-ঘর। এ ঘরে অনেক রকম আশ্চর্য্য আশ্চর্য্য কলা-কৌশল আছে। বীরমল্লের যত সব মণি-মুক্তাদি মহামূল্য পদার্থ, যত সব গুপ্তক্ৰীড়ার গুপ্ত উপকরণ, এই ঘরের স্থানে স্থানে এক এক প্রকার কল-সংযোগে তৎসমস্ত লুক্কায়িত আছে; কতক কতক পোতা আছে, কতক কতক দেয়ালে গাঁথা আছে। ঘরে প্রবেশ কোল্লে কোন চিহ্নই জানতে পারা যায় না। এই ঘরটায় সৰ্ব্বক্ষণ চাবি বন্ধ থাকে। সর্দ্দার ছাড়া অপরাপর ডাকাতেরা কেহই সে সকল গুপ্ত-সন্ধান জানে না। ঘরের বাহিরেও আর এক প্রকার কল। সে কল যারা জানে, তারাই কাজে এ ঘরে প্রবেশ কোত্তে পারে, ইচ্ছামাত্রেই বেরিয়ে যেতে পারে; নূতন লোকে পারে না। স্থানটা এক প্রকার নূতন ধরণের গোলকধাঁধা। দরজা দিয়ে বেরিয়ে যে দিকেই যাও, ঘুরে ঘুরে এই ঘরে এসেই উপস্থিত হোতে হবে। যাদের হাতে তুমি ধরা পোড়েছ, উচিত বিবেচনা কোরেই তারা এই গোলকধাঁধার ভিতরে তোমাকে এনে আটক রেখেছে। তোমার হস্ত-পদের বন্ধন না থাকলেও—দ্বারে চাবীবন্ধ না থাকলেও গোলকধাঁধা ভেদ কোরে তুমি পালাতে পারবে না, এটা তারা বেশ জানে; সেইজন্য এ ঘরের দ্বারে অথবা নিকটে নিকটে পাহারা থাকে না।
আমি।—বীরমল্লের দলে সৰ্ব্বশুদ্ধ কত লোক আছে?
ভূষণ।—সহস্র অপেক্ষাও অধিক। সব লোক এক জায়গায় থাকে না। ঠাঁই ঠাঁই এইরকমের আরো অনেক বনদুর্গ আছে। সব জায়গায় সমান কায়দা। মানুষ ছাড়া বীরমল্লের দলে শতাধিক পাহাড়ী কুকুর আছে, বীরমল্লের পছন্দ মন্দ নয়, সব কুকুরগুলোই কালো কালো।
আমি।—অত কুকুর আছে, ডাক শুনা যায় না, এটাও তো বড় আশ্চর্য্য!
ভূষণ।—সর্দ্দার যখন শীকারে যায়, কুকুরেরা তখন তার সঙ্গে থাকে, এখন এ দুর্গে একটাও কুকুর নাই, সেইজন্যই ডাক শুনতে পাও না। ডাক শুনলে নূতন লোকের অর্দ্ধেক প্রাণ উড়ে যায়। সব মানুষ যেমন এক দুর্গে থাকে না, ডাকাতের কুকুরেরাও সেইরুপ এক দুর্গে বাস করে না। ও সব কথা এখন থাক, আমি একটা আলো জ্বেলে দিচ্ছি, তুমি কিঞ্চিৎ আহার কর।
নূতন কৌশলে ভূষণলাল একটি আলো জ্বালিলেন, অনুরোধ এড়াতে না পেরে নিতান্ত অনিচ্ছায় একখানি রুটি আমি ভক্ষণ কোল্লেম, মাটির ভাঁড়ে জল খেয়ে দেয়াল ঠেস দিয়া আমি বোসলেম। ভূষণলাল সেই সময় আমার বন্ধনমোচন কোরে আদেশ কোল্লেন, “শয়ন কর, স্বচ্ছন্দে নিদ্রা যাও, কোন ভয় নাই, কোন চিন্তা নাই, কল্য রাত্রে আবার আমি আসবো, কল্য আবার দেখা হবে।”
আমি শয়ন কোল্লেম, আলোটি নিৰ্ব্বাণ কোরে ভিত্তিলম্বিত তলোয়ারখানি নিয়ে, দ্বারে চাবী দিয়ে ভূষণলাল অন্য স্থানে চোলে গেলেন।
পাঁচদিন পাঁচরাত্রি অতিবাহিত। ভূষণলাল বোলে রেখেছেন, সপ্তাহ; আর দুটি দিন অতীত হোলেই সপ্তাহ পূর্ণ হয়। নিত্য রজনীতে তিনি আসেন, রঙ্গিণীও দিবা-রাত্রের মধ্যে দুবার আমার খাবার দিয়ে যায়। রঙ্গিণীর সঙ্গে আমার অনেক রকম কথাবার্ত্তা হয়, ভূষণলালও নূতন নূতন অনেক কথা বলেন, সে আলাপে আমি একরকম থাকি ভাল। ছয়দিনের দিন সন্ধ্যার পর আমার অনেকগুলি ভাবনা একত্র।