ভূবনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়
হরিদাসের গুপ্তকথাপ্রথম খণ্ড
পঞ্চবিংশ কল্প : নূতন তীর্থ
বহরমপুরের আদালতে মোকদ্দমা। কতদিনে সে মোকদ্দমা শেষ হবে, কতদিনে অমরকুমারীকে পাওয়া যাবে, কতদিনে আমি আবার অমরকুমারীর দর্শন পাবো, দর্শনের আশা কতদিনে আমারে শান্তি দান কোরবে, সমস্তই ভবিষ্যতের গর্ভগত। নিষ্কর্ম্মা হয়ে বহরমপুরে বোসে থাকা আমি আর উচিত বিবেচনা কোল্লেম না, এক সপ্তাহ পরেই বাবুদের বাড়ীতে ফিরে এলেম।
পৌষমাসের শেষ। যে দিন আমি এলেম, তার পরদিন দীনবন্ধুবাবু আমাকে বোল্লেন, “ইংরেজী আদালতের মোকদ্দমা নিষ্পত্তি হোতে অনেক বিলম্ব হয়। আমি একবার দ্বারকাতীর্থে যাত্রা করবার অভিলাষ কোরেছি, তুমি দেশভ্রমণ ভালবাস, যাবে কি আমার সঙ্গে? পৌষমাসে যাব না, মাঘমাস পূণ্যমাস, মাঘমাসের ১০ই ১২ই একটী দিন দেখে যাত্রা করাই আমার ইচ্ছা। যাবে কি তুমি?”
দ্বারকাতীর্থ। গুর্জ্জরদেশে দ্বারকাপুরী। শ্রীকৃষ্ণের রাজধানী। দ্বারকাদর্শনে আমার কৌতুহল জন্মিল, বড়বাবুর প্রশ্নে সম্মতিসূচক উত্তর দিয়ে, মনে মনে আমি বিবেচনা কোল্লেম, মোকদ্দমার কোন পক্ষেই সাক্ষাৎসম্বন্ধে আমার সংস্রব নাই; বুদ্ধির কাজ হয়েছে; দরখাস্তকারী ফরিয়াদী মণিভূষণ দত্ত; সাক্ষী-সাবুদ ঠিক পাওয়া যাবে। আমি একজন সাক্ষী হোতে পারি, কিন্তু চোরেরা অমরকুমারীকে চুরি কোরেছে, চক্ষে আমি দেখি নাই; লোকের মুখে শুনা কথা; আমার সাক্ষ্যবাক্যের উপর বেশী জোর দাঁড়াবে না, হাকিমও আমারে হাজির করবার জন্য পীড়াপীড়ি কোরবেন না; যা কিছু আমার বক্তব্য, রজনীবাবুকে সমস্তই আমি বোলেছি, নায়েব-দারোগাকেও বোলেছি, উপস্থিত ক্ষেত্রে তাঁরাই যথাকৰ্ত্তব্য বিবেচনা কোরবেন; আমি গুজরাট-দর্শনে যাব। নফর ঘোষাল বোলেছে, রক্তদন্ত গুজরাটে; কথাটা বোধ হয় ঠিক নয়; কুঞ্জবিহারীর জবাবে সে কথাটার মিল নাই। যদিই সত্য হয়, সত্যই যদি রক্তদন্ত গুজরাটে গিয়ে থাকে, তা হোলে তো একরকম ভালই হবে। বঙ্গদেশের আদালতে মোকদ্দমা দায়ের, সর্দ্দার আসামী রক্তদন্ত, তারে যদি আমি সেখানে দেখতে পাই, সেখানকার আদালতে সংবাদ দিয়ে বহরমপুরে সংবাদ পাঠিয়ে অচিরেই তারে আমি ধরিয়ে দিতে পারবো। রক্তদন্ত এখন আমার হাতের ভিতর; এতদিন তারে আমি ভয় কোরে চোলেছি, এখন অবধি সে আমারে ভয় কোরে চলুক। গুজরাটে তারে দেখতে পেলেই আমি ধোরিয়ে দিব, তাতে আর কিছুমাত্র ভুল নাই। ভালই হবে। আমি গুজরাটে যাব।
পৌষমাসের ৭ দিন বাকী; মাঘমাসের ১০ই ১২ই যাত্রা করবার কথা; প্রায় কুড়ি দিন মুর্শিদাবাদে আমার থাকা হবে। মুর্শিদাবাদের একটী প্রসিদ্ধ স্থান পলাশী-ক্ষেত্র। এই অবকাশে পলাশীক্ষেত্রটি আমি একবার দর্শন কোরে আসবো, এই আমার নূতন সঙ্কল্প।
সঙ্কল্পের কথা পশুপতিবাবুকে জানালেম। একা আমি যাব কিম্বা অন্য কোন লোক আমার সঙ্গে যাবে, ছোটবাবু আমাকে এই কথা জিজ্ঞাসা করেন; আমি সে কথার কোন উত্তর দিতে পারি না। শেষকালে ছোটবাবু নিজেই আমাকে সঙ্গে নিয়ে যাবেন, এইরূপ স্থির হয়। দুদিন পরেই আমরা বেরুলেম। আমাদের সঙ্গে আরো ৮/১০ জন লোক থাকলো। বেশীর ভাগ দরোয়ান।
মুর্শিদাবাদ শহরের ১৫ ক্রোশ দক্ষিণে পলাশী-প্রান্তর। নিকটে পলাশীগ্রাম। সেই গ্রামের নামেই প্রান্তরের নামকরণ। প্রবাদ এইরুপ যে, পূর্ব্বে এই স্থানে বিস্তর পলাশবৃক্ষ ছিল, সেই সকল বৃক্ষের নামেই স্থানের নাম পলাশী। প্রান্তরের পশ্চিমপার্শ্বে ভাগীরথী। মুর্শিদাবাদ থেকে কৃষ্ণনগর পর্য্যন্ত যে একটী রাস্তা আছে, সেই রাস্তা ঐ প্রান্তরের মধ্য দিয়া চোলে গিয়েছে।
পলাশী-প্রান্তর দীর্ঘে দুই ক্রোশ, প্রস্থে এক ক্রোশ, এইরূপ সীমা ছিল, এখন স্থানে নূতন নূতন গ্রাম বোসেছে, কতক স্থান ভাগীরথীগর্ভে প্রবেশ কোরেছে, সুতরাং প্রান্তরের পূর্ব্ববিস্তৃতি অনেকটা কম হয়ে এসেছে। যে যে অংশ ভাগীরথী-গর্ভে প্রবিষ্ট, সেই সেই অংশের এক এক স্থানে অধুনা এক একটা চর দেখা যায়; বর্ষাকালে সেই সকল ভূমি জলমগ্ন হয়, ভাগীরথীর সঙ্গে মিলিত হয়ে বায়ু-হিল্লোলে তরঙ্গ খেলায়।
১৭৫৭ খৃষ্টাব্দের জুনমাসে এই পলাশীক্ষেত্রে বঙ্গের রাজলক্ষ্মী ব্রিটিশ প্রতাপের অঙ্কশায়িনী হন। নবাব সিরাজদ্দৌলার সঙ্গে ইংরেজ-সৈন্যের যুদ্ধ। বঙ্গের ইতিহাসে এই যুদ্ধই পলাশীযুদ্ধ নামে প্রসিদ্ধ। ছোটবাবুর সঙ্গে যে সকল লোক ছিলেন, তাঁদের মধ্যে যাঁরা বয়ঃপ্রবীণ এবং ইতিহাস-তত্ত্বে অভিজ্ঞ, তাঁদের মুখে শুনলেম, ইংরেজরা যতই গৌরব করুন, পলাশী বাস্তবিক ন্যায়যুদ্ধ অথবা মহাযুদ্ধ নামে কদাচ গণ্য হাতে পারে না; ফাঁকা আওয়াজে বিজয়ঘোষণা।
মীর জাফর প্রভৃতি মন্ত্রিগণের বিশ্বাসঘাতকতাই ইংরেজ-বিজয়ের প্রধান হেতু। ইতিহাসে আছে, পলাশীর আম্রকাননে জগৎশেঠ প্রভৃতির পরামর্শ হয়েছিল, আম্রকাননে কর্ণেল ক্লাইব শিবির স্থাপন কোরেছিলেন, আম্রকাননের শীকারমঞ্চে দণ্ডায়মান থেকে নবাব-সৈন্যের বিক্রম-দর্শনে ক্লাইব প্রথমে ভয় পেয়েছিলেন, সৈন্যগণকে প্রতিনিবৃত্ত হোতে আদেশ দিয়েছিলেন। পরিশেষে ভাগ্যবলে ক্লাইবের পক্ষে জয়লাভ, গুপ্তহন্তার হাতে সিরাজদ্দৌলার মৃত্যু, মুসলমানের বলক্ষয়, ইংরেজের বঙ্গাধিকার। পলাশী-বিজয়ের অগ্রে জাহাজের কেরাণী ক্লাইব কর্ণেল ক্লাইব হয়েছিলেন, পলাশী-বিজয়ের পর কর্ণেল ক্লাইব বারণ ক্লাইব হন। সেই ক্লাইব আমাদের ইতিহাসের লড ক্লাইব।
হাঁ, বোলছিলেম আম্রকাননের কথা। মুর্শিদাবাদের আম্রকাননগুলি আম্রকুঞ্জ নামে বিখ্যাত ছিল। এক একটী কুঞ্জে একলক্ষ আম্রবৃক্ষ বিদ্যমান থাকতো, সেই কারণে তাদৃশ উদ্যানের নাম লক্ষবাগ। এখন আর সে প্রকার আম্রকুঞ্জও দেখা যায় না, লাখবাগও দেখা যায় না, নামমাত্র অবশিষ্ট। শুনা গেল, পলাশীকুঞ্জের একটী প্রাচীন আমবৃক্ষ যুদ্ধক্ষেত্রের নিক্ষিপ্ত গুলীর আঘাতে বিদীর্ণগাত্র হয়েছিল, শাখাপত্র-পরিভ্রষ্ট হয়ে শুষ্ক অবস্থায় যুদ্ধের সাক্ষীস্বরুপ দণ্ডায়মান ছিল, ইংরেজেরা সেই শেষবৃক্ষটী সমূল উৎপাটন কোরে বিলাতে প্রেরণ কোরেছেন। পলাশী-যুদ্ধের আর একটী নিদর্শন এখানে মধ্যে মধ্যে পাওয়া যায় শুনা গেল। প্রান্তরের পূর্ব্বে বৃক্ষলতা অথবা তৃণাদি কিছুই জন্মিত না, এখন এক একদিকে চাষ হয়; ভূমি-কর্ষণের সময় লাঙ্গলমুখে কখন কখন গোলাগুলী উত্থিত হয়ে থাকে। ভাগীরথীর চরেও ঐরূপ।
পলাশীক্ষেত্রে যা কিছু দেখা গেল, তদপেক্ষা অধিক কথা শুনা গেল। তাদৃশ দর্শনযোগ্য আর কিছুই নাই। দুই একটী সমাধিস্তম্ভ দুই একজন বীর-পুরুষের নামের স্মৃতি ঘোষণা করিতেছে, এই মাত্র। পলাশী-দর্শনের আশা পরিতৃপ্ত, কৌতূহল নিবৃত্ত, কৌতুক প্রশমিত; আর আমরা সেখানে বিলম্ব কোল্লেম না, স্মৃতিকে হৃদয়ে ধারণ কোরে ছোটবাবুর সঙ্গে দলবলসহ ফিরে এলেম। পথে আসতে আসতে আমাদের সঙ্গীগণের মধ্যে একজন ইংরেজীনবীস ভদ্রলোক বোল্লেন, “বিলাতে সাহেব-বিবিরা এ পথে যখন আসে, জলপথেই আসুক আর স্থলপথেই আসুক, পলাশীপ্রান্তরে উত্তীর্ণ হয়, পলাশীকে তারা তীর্থস্থান বলে, পলাশী-তীর্থে পদার্পণ কোরে উচ্চকণ্ঠে তারা জয়ধ্বনি করে; অদেয় চীৎকারধ্বনি-শ্রবণে কাননের পাখীরা আতঙ্কে কলরব কোত্তে কোত্তে উড়ে উড়ে পালায়। এই পরিচয় শ্রবণে আমি হাস্য কোল্লেম।
আমরা বাড়ী এলেম। পূর্ব্বেই বোলেছি, পৌষমাস সমাপ্তপ্রায়। নিত্য নিত্য আমি বহরমপুরে যাই, মোকদ্দমা কোন দিন কতটুকু অগ্রসর, সংবাদ রাখি, রজনীবাবুকে সকল কথা জিজ্ঞাসা করি, যেগুলি তাঁর জানা দরকার, পূর্ব্বে যা আমি বলি নাই, সেগুলি জানিয়ে জানিয়ে দিই, এক একরাত্রি তাঁর বাসাতেও আমি থাকি, এই রকমে দিন যায়।
থানার চালানী আসামীদের মধ্যে নফর ঘোষাল আর কুঞ্জ সান্ন্যাল আমার জানা; নাম জানা ছিল, চেহারাতেও এখন জানা। অমরকুমারীর সন্ধান তারাই জানে, তাদের মুখেই ব্যক্ত হবে, নিত্য নিত্য এই আশা আমি পোষণ করি। নবীন নাগ আর সেই দুজন নূতন বন্দী অন্য যে খবর বোলতে পারে, সে খবরে কেবল পুলিশের দরকার, আমার সঙ্গে কোন সংস্রব নাই, নফরের আর কুঞ্জবিহারীর মুখে নূতনকথা আর কি কি প্রকাশ পেয়েছে, রজনীবাবুকে জিজ্ঞাসা করি, রজনীবাবু বলেন, “সব গোলমাল।” তিনি আরো বলেন, “মূল আসামী আছে। মূল আসামী গ্রেপ্তার না হোলে, এ মোকদ্দমার কোন কিনারা হবে না। অমরকুমারী মুর্শিদাবাদে নাই, সেটা একরকম বুঝতে পারা গিয়েছে। যেখানে মূল আসামী, সেইখানেই অমরকুমারী অথবা সেই জটাধর অন্য উপায়ে অমরকুমারীকে আর কোথাও সোরিয়ে ফেলেছে, সেটা এখনো ঠিক হোচ্ছে না; জটাধরকে ধোত্তে পাল্লেই সব কথা জানা যাবে। জটাধরটাই এ মোকদ্দমার গোড়া।”
যে রাত্রে আমাদের এই সব কথা, তার পরদিন আমি একবার আদালতে উপস্থিত হোলেম। মণিভূষণ ইতিপূর্ব্বে পূর্ণক্ষমতা প্রদান কোরে রজনীবাবুর নামে ওকালৎনামা দিয়ে রেখেছেন, নিত্য নিত্য মণিভূষণের হাজির হওয়া আবশ্যক হয় না, আমার তো হয়ই না, তবু আমি আসি। যার যেখানে ব্যথা, তার সেখানে হাত। আমারও তাই। অমরকুমারীর অদর্শনে আমি কাতর, সেইজন্যই আদালতে আমি আসি।
একজন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের এজলাসে সেই মোকন্দমা সেদিন উঠেছে। পুলিশে যেমন যেমন জবাব দিয়েছিল, চালানী আসামীরা হাকিমের কাছে সে রকম বলে নাই, অনেক কথার উলোট-পালোট হয়ে যায়। ইতিমধ্যে একদিন নফর ঘোষাল বোলেছিল, “প্যাম্চাঁদ মিত্তি, হ্যামচাঁদ পালুই, বজো ভশ্চাজ্জি, এই তিনজন মুরুব্বী আমাদের দলপতির কন্যাকে কলিকাতায় নিয়ে রেখেছে।”
সুড়ঙ্গে যারা যারা থাকে, তাদের সঙ্গে ঐ তিনজনের কি সম্বন্ধ, তারাও সুড়ঙ্গবাসী কি না, সরকারের পক্ষ থেকে এইরুপ জেরা হয়েছিল, নফর ঘোষাল সে জেরার সন্তোষকর উত্তর দিতে পারে নাই। সুড়ঙ্গে যারা থাকে, তাদের পেশা চুরি, ডাকাত, রাহাজানী, হাকিমের সম্মুখে নফরের মুখে এই কথা প্রকাশ পেয়েছে, ঐ তিনজন মুরুব্বীর বিশেষ পরিচয় প্রকাশ পায় নাই। প্রেমচাঁদ মিত্র, হেমচন্দ্র পালধি, ব্রজনাথ ভট্টাচার্য্য, তিনটে নামই আমার কর্ণে নূতন। তারা কলিকাতায় থাকে, কিন্তু কে? অমরকুমারীকে তারা কেন নিয়ে যাবে? তবে কি রক্তদন্তের সঙ্গে—মোহনলালের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ আছে? তাই থাকাই হয় তো সম্ভব। তা না হোলে নফর ঘোষাল তাদের নাম কোরবে কেন? নফর ঘোষালেরা মোহনলালের লোক, তবেই অবশ্য রক্তদন্তের পেটাও লোক, কুঞ্জবিহারীর জবাবে উইলে সাক্ষী হওয়া প্রসঙ্গে সেই তত্ত্ব প্রকাশ পেয়েছে। ক্রমে ক্রমে একে একে কত তত্ত্ব প্রকাশ পাবে, একসঙ্গে কতলোক জড়াবে, কাণ্ডটা কতদূর গড়াবে, এক দড়ীতে কত লোক বাঁধা যাবে, অনুমানে কিছুই আমি স্থির কোত্তে পাল্লেম না।
আমি আদালতে উপস্থিত। একজন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের এজলাস। কুঞ্জবিহারী সান্যালের সঙ্গে যে দুজন নূতন ডাকাত রাত্রিকালে বনমধ্যে ধরা পড়ে, হাতকড়ী-বাঁধা সেই দুজন সেই সময় হুজুরে হাজির। একজনের নাম ধুন্দুরাম, নিবাস ফরিদপুর; দ্বিতীয়জনের নাম কেফায়ৎ, নিবাস চট্টগ্রাম। দুজনেই খৰ্ব্বাকার, কৃষ্ণবর্ণ, মাথা ছোট, চক্ষু গোল, দুজনেরই সৰ্ব্বাঙ্গে দাদ। গাঁট গাঁট গড়নে খুব বলবান বোলেই বোধ হয়। ভিন্ন ভিন্ন জেলায় দুই তিনবার তারা ডাকাতী মোকদ্দমায় ধরা পোড়েছে, দুই তিনবার জেল খেটে এসেছে, কাশিমবাজারের সুড়ঙ্গে বাস করা অস্বীকার করে বাজারে কুঞ্জবিহারীর সঙ্গে পূর্ব্বের জানাশুনা হয়েছিল, সেই জন্যই বনের ভিতর এসেছিল, এসেই ধরা পোড়েছে। তারা ছ-জন, চারিজন পালিয়েছে, তারা দুজনে পালাতে পারে নাই। কুঞ্জবিহারীটা পালাবার চেষ্টা কোরেছিল, পারে নাই।
আসামীরা আবার হাজতে প্রেরিত হলো, আমিও আদালত থেকে বেরিয়ে এলেম; সন্ধ্যাকালে উকীলের বাসায় গিয়ে, আপন মনে পূর্ব্বাপর অনেক ঘটনা আলোচনা কোল্লেম। সে রাত্রেও আমারে বহরমপুরে থাকতে হোলো।
রাত্রিকালে রজনীবাবুকে আমি বোল্লেম, “মোকদ্দমা নিষ্পত্তি হবার অনেক বিলম্ব; এখনো পর্য্যন্ত মূল আসামীর কোন সন্ধান হলো না; দীনবন্ধু বাবুর সঙ্গে শীঘ্রই আমারে দ্বারকাতীর্থে যেতে হোচ্ছে। আপনি থাকলেন, মণিভূষণ থাকলেন, সকল ভার আপনার উপর। মোকদ্দমার আসামীরা সাজা পায়, সেটা অবশ্য বাঞ্ছনীয়, কিন্তু অমরকুমারীকে উদ্ধার করাই আমার প্রধান কার্য্য। ইতিমধ্যে যদি—গুজরাট থেকে আমার ফিরে আসবার পূর্ব্বেই যদি অমরকুমারীর সন্ধান হয়, অমরকুমারীকে যদি পাওয়া যায়, অনুগ্রহ কোরে মণিভূষণের হস্তে তাঁরে আপনি সমপর্ণ কোরবেন।”
রজনীবাবু সম্মত হলেন। পরদিন প্রভাতে আমি যদুপুরে ফিরে গেলেম। তিন চারিদিন অতীত হয়ে গেল। উত্তরায়ণ-সংক্রান্তি; সূর্য্যের মকররাশিসঞ্চার। মাঘমাসের ১০ই ১২ই দ্বারকাযাত্রা করা বড়বাবুর ইচ্ছা ছিল, ১০ই ১২ই শুভদিন পাওয়া গেল না, ৫ই মাঘ শুভদিন, সেই দিনেই যাত্রা করা স্থির। আর দিন নাই। ছোটবাবুকে আমি বোল্লেম, “মোকদ্দমা থাকলো, আপনি থাকলেন, রজনীবাবু থাকলেন, মণিভূষণ থাকলেন, অমরকুমারীকে যদি পাওয়া যায়, এবারে আর মণিভূষণের বাড়ীতে না রেখে, আপনি দয়া কোরে এই বাড়ীতেই আশ্রয় দিবেন, তা হোলেই নিরাপদ হবে। দুষ্টলোকে এখানে আর কোন প্রকার উপদ্রব কোত্তে পারবে না, সকলদিকেই ভাল হবে।”
ছোটবাবু আহ্লাদ পূৰ্ব্বক আমার প্রস্তাবে সম্মতি প্রকাশ কোল্লেন। সেই দিন মণিভূষণকে আনয়ন করা হলো, তাঁকেও আমি ঐ কথা বোল্লেম, তিনিও সম্মত হলেন।
৫ই মাঘ সমাগত। বড়বাবুর যেমন অভ্যাস, তদনুসারে বিনা আড়ম্বরে তিনি প্রস্তুত হলেন, একজনের পরিবর্ত্তে দুজন চাকর আর একজন পাচকব্রাহ্মণ সঙ্গে থাকলো, দুর্গানাম স্মরণ কোরে আমরা যাত্রা কোল্লেম। দ্বারে মঙ্গলঘট, কদলীতরু, আম্রশাখা; সেইগুলিকে প্রণাম কোরে উপযুক্ত যানারোহণে আমরা তীর্থভ্রমণে চোল্লেম। সে সময় এ দেশে কলের গাড়ী ছিল না, ভিন্ন ভিন্ন যানে যত সময়ে গুজরাটে উপস্থিত হওয়া যায়, ততদিনে আমরা গুজরাটে গিয়ে পৌঁছিলেম।
প্রথমে আহমদনগর। নগরটি দিব্য পরিপাটি, দেবালয়ও অনেকগুলি, তন্মধ্যে ভদ্রকালী প্রধান। আমরা ভদ্রকালী দর্শন কোল্লেম, পূজা দিলেম, তিন রাত্রি সেখানে বাস কোরে দ্বারকায় উপনীত হোলেম। দ্বারকায় শ্রীকৃষ্ণের রাজধানী ছিল, চিহ্নমাত্র অবশিষ্ট আছে, মন্দিরে বিগ্রহ আছেন, বিগ্রহগুলি আমরা দর্শন কোল্লেম, শরীর পুলকিত হলো। লোকের মুখে শুনলেম, দ্বারকার পূৰ্ব্ব-শ্রী এক্ষণে কিছুই নাই।
ব্যাধবীর কালকেতু মঙ্গলচণ্ডীর কৃপায় গুজরাটের বন কেটে নগর পত্তন কোরেছিলেন, সেই গুজরাট এখন আর একপ্রকার শ্ৰীসম্পন্ন। সৌরাষ্ট্র প্রদেশ পরিভ্রমণ কোরে আমরা বরদারাজ্যে উপনীত হোলেম। বরদা হিন্দুরাজত্ব। বরদার মহারাজ স্বাধীন। তিনি স্বয়ং সমস্ত রাজকার্য্য নির্ব্বাহ করেন, তাঁর নিজের ব্যবস্থানুসারে রাজ্য শাসিত হয়, প্রজাপুঞ্জ সুখে বাস করে। বরদায় ভবানীদেবীর একটি মন্দির আছে। ভবানী-মন্দিরে সাময়িক উৎসব হয়, নূতন প্রণালীতে নৃত্যগীত হয়, কুলকামিনীরাও উজ্জ্বল বেশভূষা পরিধান কোরে নৃত্যগীত করেন, দর্শনে শ্রবণে মনের প্রীতি জন্মে। যে সময় আমরা গিয়েছিলেম, সে সময় একটি উৎসব ছিল, উৎসবস্থলে মহারাজ উপস্থিত ছিলেন, দেবীদর্শন উপলক্ষে মহারাজকেও আমরা দর্শন কোল্লেম। সপ্তাহ কাল বেশ আমোদ-আহ্লাদে অতিবাহিত হলো।
নগরের একপ্রান্তে আমাদের বাসা হয়েছিল। ভ্রমণে আমার বেশী অনুরাগ, যেখানে যখন যাই, স্থানগুলি মনোযোগ পূৰ্ব্বক দর্শন করি। সেই অনুরাগে বরদারাজ্যের অনেক স্থান আমি দর্শন কোল্লেম; একাকী বেরুতেম না, সঙ্গে ললাকজন থাকতো, নির্ব্বিঘ্নে বাসায় ফিরে আসতেম।