» » » চতুর্ব্বিংশ কল্প : নূতন আনন্দ;—নূতন ভয়।

বর্ণাকার

ভূবনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়

হরিদাসের গুপ্তকথা
প্রথম খণ্ড

চতুর্ব্বিংশ কল্প : নূতন আনন্দ;—নূতন ভয়।

ঘর থেকে বেরিয়ে ছোটবাবুর সম্মুখে গিয়ে আমি দাঁড়ালেম। যে ঘরখানি আমার শয়নের জন্য নির্দ্দিষ্ট হয়েছিল, সে ঘরে প্রবেশ না কোরে, মণিভূষণের সঙ্গে তিনি আর একটী ঘরে গিয়ে বোসলেন, আমিও তাদের সঙ্গে সঙ্গে সেই ঘরে গেলেম। ছোটবাবু আমারে প্রথমে কোন কথা জিজ্ঞাসা কোল্লেন না, দু-তিনবার আমার মুখের দিকে চেয়ে চেয়ে কেবল একটু হাস্য কোল্লেন মাত্র। অকারণে অকস্মাৎ কেন সেপ্রকার হাস্য, ভাবটা আমি বুঝতে পাল্লেম না; হাস্যের দিকে চেয়ে আছি, সস্মিতবদনে মণিভূষণ আমাকে সম্বোধন কোরে বোল্লেন, “পশুপতিবাবুর মুখে তোমার সম্ভবমত পরিচয় আমি শুনেছি, কিন্তু এ পরিচয় পাবার অগ্রে তোমার সম্বন্ধে অনেক কথা আমার শুনা হয়েছিল, তোমাকে দেখে আমরা সকলেই সন্তুষ্ট হয়েছি।” এই কথাগুলি বোলে শেষে জিজ্ঞাসা কোল্লেন, “রাত্রে এখানে তোমার কোন কষ্ট হয় নাই তো?”

বিনীতবদনে উত্তরদান কোরে ছোটবাবুর মুখের দিকে আবার আমি চাইলেম। বাবুর মুখে হাসি মিলায় নাই। উপস্থিতবুদ্ধি অনেক সময়ে চপলতার হাত থেকে মানুষকে রক্ষা করে, উপস্থিতবুদ্ধিতে আমি বুঝলেম, অমরকুমারীর মুখে মণিভূষণ আমার কথা শুনেছিলেন, তাঁদের বাড়ীর পরিবারেরাও শুনেছিলেন, মণিভূষণ হয় তো ছোটবাবুর কাছে সেই গল্প কোরেছেন, তাতেই আমার পানে চেয়ে ছোটবাবুর হাস্য, সেই অনুমান ঠিক; সুতরাং হাস্যের কারণ জিজ্ঞাসা কোরে আমারে আর চপলতা প্রকাশ কোত্তে হলো না; প্রথমবারের হাস্য দেখে মনে যেমন একটা ধোঁকা লেগেছিল, সে ধোঁকাও আর থাকলে না।

তাঁদের দুজনের কাছে আমি চুপ কোরে বেসে আছি, তাঁরা দুজনে পরস্পর এ কথা সে কথা পাঁচ কথা বলাবলি কোচ্ছেন, হঠাৎ আমার দিকে চেয়ে ছোটবাবু বোল্লেন, “আজ আর যাওয়া হবে না হরিদাস, বাবুরা বিস্তর অনুরোধ কোরে ধোরে বোসেছেন, আজ শেষরাস। অনেকরকম নূতন তামাসা হবে, না দেখে যাওয়া হবে না এইকথাই তাঁরা বোলেছেন। আমিও রাজী হয়েছি। দিনের বেলা তুমি এইখানেই থাকো, ব্রাহ্মণ এসে তোমাদের খাবার সামগ্রী দিয়ে যাবে, এইখানেই থাকো।” এই পর্য্যন্ত বোলে আবার একটু হেসে তিনি আরো বোল্লেন, “এ বাড়ী তোমার নিতান্ত পরের বাড়ী নয়, অনেক কথা আমি শুনেছি, স্বচ্ছন্দে তুমি এখানে থাকতে পারবে; তাই তুমি থাকো; কল্য প্রাতঃকালে বাড়ী যাওয়া যাবে।”

মাথা হেঁট কোরে ঐ কথাগুলি আমি শুনলেম। মনে বড়ই উল্লাস। ধন্য জগদীশ! নিজে আমি মুখ ফুটে যে কথাটী বোলতে পাত্তেম না, ছোটবাবু নিজেই সেই কথা বোলে আমার আশা পূর্ণ কোল্লেন। অমরকুমারীর অনুরোধ রক্ষা করবার পন্থাটী পরিষ্কার হোলো। মণিভূষণও ছোটবাবুর বাক্যে অনুমোদন কোল্লেন।

খানিকক্ষণ সেইখানে থেকে, নিকটস্থ সরোবরে স্নান-আহ্নিক সেরে, তাঁরা উভয়ে পুনরায় রাসবাড়ীতে চোলে গেলেন, আমি থাকলেম। বাড়ীর যিনি কৰ্ত্তা, যাঁর নাম শান্তিরাম দত্ত, যিনি অমরকুমারীর জননীর চিকিৎসা কোরেছিলেন, যিনি যত্ন কোরে অমরকুমারীকে আপন বাড়ীতে এনে রেখেছেন, তিনি আমারে যেন পত্রতুল্য স্নেহ কোত্তে লাগলেন; তাঁর বিধবা কন্যা-দুটীও আমারে যেন মায়ের পেটের ভাই মনে কোল্লেন। আমার সকল সন্দেহ দূর হয়ে গেল।

রাত্রে যে ঘরে আমি শয়ন কোরেছিলেম, এই দিন বৈকালে সেই ঘরে নির্জ্জনে আমি আর অমরকুমারী। আমার মুখে প্রথমসংবাদ—“আজ আমার থাকা হবে, থাকবার জন্য তুমি আমারে অনুরোধ কোরেছিলে, হয় কি না হয় ভেবে আমি উদ্বিগ্ন হোচ্ছিল্লেম, সে উদ্বেগের শান্তি হয়েছে, রাসবাড়ীর বাবুদের অনুরোধে পশুপতিবাবু আজ সেইখানে থাকবেন, আমি এই বাড়ীতেই থাকবো। দেখ অমর। তোমার দিদির সঙ্গে আমার দেখা-সাক্ষাৎ ছিল না, তীর্থপথের চটীতে আগুনের মুখ থেকে যখন তাঁরে আমি উদ্ধার করি, তখন ভেবেছিলেম তুমি;— নাম ধরে ডেকেছিলেম, মুখের কাছে বোসেছিলেম, নৌকা পর্য্যন্ত গিয়েছিলেম, তোমার দিদি আমারে চিনতে পারেন নাই। তার পর কাশীধামে জ্বরবিকারে তোমার দিদি যখন শয্যাশায়িনী, তখনো আমি ভেবেছিলেম তুমি; তখনো তোমার দিদি আমারে চিনতে পারেন নাই; কত কথা জিজ্ঞাসা কোরেছিলেম, একটী কথারও উত্তর দেন নাই। বিস্ময়ে, সন্দেহে, অভিমানে আমি স্থির কোরেছিলেম, তুমি আমারে ভুলে গিয়েছ! সত্যই আমার অভিমান হয়েছিল! সে অভিমান আজ দূর হলো।”

যতক্ষণ আমি ঐ কথাগুলি বোল্লেম, ততক্ষণ অমরকুমারীর মুখখানি ক্রমে ক্রমে মলিন হয়ে আসছিল, আমার কথা শেষ হবা-মাত্র অশ্রু-প্রবাহে সেই মুখখানি অভিষিক্ত হলো। দুই হস্তে অশ্রু- মার্জ্জন কোরে গদগদস্বরে অমরকুমারী বোল্লেন, অভিমান তো আসতেই পারে!—অভেদরূপের প্রতারণা ঐ রকম! হরিদাস নয়, অথচ ঠিক হরিদাসের মতন আর একখানি মূর্ত্তি দৈবাৎ কোথাও যদি আমি দেখি, হরিদাস ভেবে তার সঙ্গে যদি আমি কথা কোই; সে যদি কথা না কয়, তারে যদি আমি কোন কথা জিজ্ঞাসা করি, সে যদি উত্তর না দেয়, তা হোলে আমারও ঐ রকম অভিমান আসে! অভেদরূপের প্রতারণা ঐ রকম!—থাক, ও সব কথা যেতে দাও; যতই মনে করা যায়, শৈশবস্মৃতির জাগরণে বুক ততই ভারী হয়। দুঃখী আমরা চিরদিন,—তবু—তবুও দুঃখের কথা মনে কোত্তে গেলে নূতন নূতন দুঃখের আগুনে মন-প্রাণ যেন দগ্ধ হয়ে যায়!—দুঃখের কথা এখন ছেড়ে দাও, এখনকার বক্তব্য কি, সেইটী স্থির কর। তুমি তো এই মুর্শিদাবাদে এক বাড়ীতে চাকরী কোচ্চো, আমি তো এই বাড়ীতে একরকম মেয়ের মতন রয়েছি, এইরকমেই কি চিরদিন যাবে? চাকরী, —কখন আছে, কখন নাই; চাকরীটা হয় তো ছুটেও যেতে পারে, ইচ্ছা হোলে তুমি নিজেই হয় তো চাকরী ছেড়ে অন্যদেশে চোলে যেতে পার। আমারও প্রায় সেইরকম; যদিও চাকরী নয়, কিন্তু চিরদিন যে এই বাড়ীতে থাকবো কিম্বা থাকতে পাবো, এমন কথা কে বোলতে পারে? সেইজন্যই বোলচি, এখনকার কর্ত্তব্য কি, সেইটী স্থির কর।”

আমার মনের ভিতর তখন যে কিসের খেলা হোচ্ছিল, অমরকুমারী সেটা জানতেন না। অনেকরকমের অনেকগুলি কথা অমরকুমারীর মধুর রসনায় উদ্গীরিত হলো, গুটীকতক আমার কাণে গেল, কতকগুলি গেলই না! কথাই তো ঠিক, একটাও তখন কাজের কথা বোধ হলো না। উষাকাল থেকে মন আমার বড়ই চঞ্চল। কোন কথার উত্তর না দিয়ে, উদাসভাবে চেয়ে, অতি সাবধানে চুপি চুপি আমি বোল্লেম, “আচ্ছা অমর। কর্ত্তব্য স্থির করাটা তো পরের কথা, এখন স্পষ্ট কোরে বল দেখি, ব্যাপারখানা কি? রাত্রে তুমি বোলেছ, যে লোকটাকে তুমি এতদিন বাবা বোলে জানতে, সেই লোকটা—ব্যাপারখানা কি? সত্য কি সে লোকটা তোমার বাবা নয়? কে সে? তার বাড়ীতে তবে তোমরা কেন ছিলে?”

“পোড়কপাল আমাদের!”—মাথাটী উঁচু কোরে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে অমরকুমারী বোল্লেন, “পোড়াকপাল আমাদের। কেন যে তার বাড়ীতে আমরা ছিলেম, আমাদের পোড়াকপালের লিখন লেখবার বিধাতা যিনি, তিনিই তা বোলতে পারেন! লোকটার চেহারা যেমন, দেখেচোই তুমি, ঠিক যেন একটা হনুমান, তেমন হনুমান কি ভাল-মানুষের ঘরে জন্মে?—তেমন হনুমান কি আমাদের বাবা হেতে পারে? ছোটবেলা থেকে ঐ রকম দেখে দেখে আসছিলেম, এক একবার বাবা বোলেও ডাকতেম, একটুখানি জ্ঞান হয়ে অবধি কেমন একটা ঘৃণা এসেছিল, দুরন্ত দুরন্ত সন্দেহ এসেছিল, সেটাকে বাবা বলে ডাকতে আসলে প্রবৃত্তিই হোতো না! আহা! মা আমার দেবকন্যা, দেবলোকে প্রস্থান কোরেছেন, সেই স্বর্গবাসিনীর মুখে আমি শুনেছিলেম, বেশীদিন আমরা সেই হনুমানের বাড়ীতে ছিলেম না;—দিদি যখন দুবছরের, আমি যখন একমাসের, সেই সময় হনুমানটা আমাদের কোথা থেকে ধোরে এনে নিজের বাড়ীতে কয়েদ রেখেছিল! রাত্রে একদিনও বাড়ীতে থাকতো না, আমার মায়ের সঙ্গে একটাও ভালকথা হোতো না, মা আমার আমাদের দুটী বোনকে নিয়ে একখানা ছেড়ামাদুরে শুয়ে থাকতেন, তাঁর চক্ষের জলে রোজ রাত্রে সেই মাদুরখানা ভিজে যেতো! হনুমানটার আক্কেল যেমন, তাড়ন-পীড়ন যেমন, সব কথা তোমারে বোলেছি, কতক কতক চক্ষেও তুমি দেখেচো, মানুষে কি সেরকম পিশাচের কাজ কোত্তে পারে? মুণ্ডুটা ছাড়া হাত-পাগুলোর গড়ন কতকটা মানুষের মতন, কোন দেশের মানুষ, ঠিক পাওয়া যায় না! “আহা! মা যখন আমার শেষদশায় শয্যাগত হন, বেগতিক বুঝে হনুমানটা তখন কোথায় পালিয়ে গেল, উদ্দেশ হলো না। পাড়ার একটী লোকের হাতে পায়ে ধরে আমিই কবিরাজ ডাকাই, পাড়ার লোকেরাই দয়া কোরে শেষের কাজগুলি নিৰ্ব্বাহ কোরে দেন। যিনি কবিরাজ, তিনি এই বাড়ীর কর্ত্তা, তিনি আমার কত উপকার কোরেছেন, এখনো কোচ্চেন, সে সব তুমি শুনেচ। আর—” এইখানে একবার থেমে, চকিতা-কুরঙ্গিনীর ন্যায় চক্ষু ঘুরিয়ে চারিদিকে চেয়ে, আতঙ্কে সর্ব্বাঙ্গ কাঁপিয়ে, শঙ্কিতকণ্ঠে অমরকুমারী বল্লেন, “ও হরিদাস! বোলতে তোমারে ভুলে গিয়েছি। এখানেও আমি নিরাপদ নই! এখানেও সেই পাপ পিশাচটা আমার সন্ধানে সন্ধানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কোন দেশে উধাও হয়ে উড়ে গিয়েছিল, মাসখানেক হলো, কে জানে, কি রকমে কোথা থেকে কি জানতে পেরে এই গ্রামে এসেছে। দিনের বেলা এদিকে আসে না কিম্বা হয় তো আসে, আমি দেখতে পাই না, লুকিয়ে লুকিয়ে ঘুরে বেড়ায়। একদিন সন্ধ্যাকালে ঘরে ঘরে আমি প্রদীপ জ্বালচি, একটা জানলার ধারে গিয়ে দাঁড়িয়েছি, দেখি, সেই বিকটমূর্ত্তি সেই জানলার বাইরে হাত পাঁচেক তফাতে একটা তেতুলগাছে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার কাছেও একটা মানুষ! দুজনেই তখন অন্যদিকে চেয়ে ছিল, আমারে দেখতে পেলে না। আমি তাদের দেখতে পেলেম;—ভাল কোরে না দেখে আগে ভেবেছিলেম, বুঝি চোর, তেঁতুলতলায় তেঁতুল চুরি কোত্তে এসেছে, তার পর যখন ঠাউরে ঠাউরে দেখলেম, তখন আমার সৰ্ব্বশরীর কেঁপে উঠলো। ঠিক সেই হনুমান!—দেখেই অমনি প্রদীপটা নিবিয়ে ফেলে, ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে ঘর থেকে আমি বেরিয়ে পোড়লেম। তারা সেখানে কতক্ষণ ছিল, কি কোরেছিল, তার পর কোথায় গেল, আর কেহ তাদের দেখেছিল কি না, তা আমি জানি না। আর একদিন—না হরিদাস, আর আমি বোলতে পারবো না। এখানেও আমি নিরাপদ নই! সেই অবধি আর আমি বাড়ীর বাহির হই না! কখন আসে, কখন দেখে, কখন ধরে, সৰ্ব্বদাই আমার প্রাণে সেই ভয়; ঘরের ভিতর বোসেও আমি ভয়ে কাঁপি।”

এত কথা হোচ্ছিল, স্থির হয়ে নূতন কৌতুকে আমি শ্রবণ কোচ্ছিলেম, অমরকুমারীর শেষের কথায় আমি এককালে স্তম্ভিত হয়ে গেলেম। রক্তদন্ত মুর্শিদাবাদে—সত্যই কি এ লোকটা সৰ্ব্বব্যাপী?—তাই তো দেখছি। এ পাপ যেমন সঙ্গে সঙ্গে ফিরছে, বিপদও তেমনি পদে পদে আমার সঙ্গে সাথী হয়ে রয়েছে। এবারে আবার অমরকুমারীকে ধরবার চেষ্টা। অনেকক্ষণ আমি অমরকুমারীর কথায় কোন উত্তর কোত্তে পাল্লেম না। সন্ধ্যা হয়ে গেল, মণিভূষণ একবার বাড়ীতে এলেন, অল্পক্ষণ থেকে আমারে সঙ্গে কোরে নিয়ে আবার রাসবাড়ীতে গেলেন। সেখানে পশুপতিবাবুর সঙ্গে দেখা হলো, রাসোৎসবের দুটী পাঁচটী নূতন তামাসাও দেখলেম, আতসবাজী দেখবার জন্য আর উৎসুক থাকলো না, অমরকুমারীর সঙ্গে আরো অনেক কথা বাকী ছিল, ছোটবাবুকে বোলে শীঘ্র শীঘ্র আমি চোলে এলেম। রাস্তায় অনেক লোক যাওয়া-আসা কোচ্ছিল, দূরও বেশী নয়, জ্যোৎস্নারাত্রি, তথাপি আমি বাবুদের বাড়ীর একজন দরোয়ানকে সঙ্গে নিতে বাধ্য হোলেম। রক্তদন্তের ভয়ে একা আসতে সাহস হলো না।

বাড়ীতে এসে পৌঁছেই প্রথমে কৰ্ত্তার সঙ্গে সাক্ষাৎ। ওতে ঘাতে রক্তদন্ত ঘুরে বেড়াচ্ছে, কৰ্ত্তা সেটা শুনেছিলেন কি না, অমরের মুখে সে কথা আমি শুনি নাই, অমর হয় তো সে কথা তাঁদের বলেন নাই; তথাপি কর্ত্তা আমারে কাছে বোসিয়ে, অনেকরকম আদরের কথা বোলে, শেষকালে বোল্লেন, “তোমাকে দেখে আমি বড় তুষ্ট হয়েছি। তুমি যখন বীরভূমে গিয়েছিলে, তখনো আমি বীরভূমে ছিলেম, চিকিৎসা কোত্তেম, শিউড়ীতেই আমার বাসা ছিল, আমার সঙ্গে তোমার সে সময় দেখা-সাক্ষাতের কোন সুযোগ ঘটে নাই; সম্প্রতি অমরকুমারীর মুখে তোমার অনেক কথা আমি শুনেছি। জননীর সঙ্গে অমরকুমারী সেখানে যে লোকটার বাড়ীতে ছিলেন, সে লোকটা বড় ভয়ঙ্কর; কোথাকার লোক, কি জাতি, কোথা থেকে এসে বীরভূমে আড্ডা কোরেছিল, সেখানকার লোকেও সে সংবাদ জানেন না; কি তার কার্য্য, তাও কেহ বোলতে পারেন না। অমরের মুখে শুনলেম, সেই লোক তোমার উপর বিষম দৌরাত্ম কোরেছিল, অমরকুমারীর কৌশলে তুমি পালিয়ে গিয়েছিলে। সাবধানে থেকো, সে লোকের খপরে পোড়লে সহজে নিষ্কৃতি পাবে না। আমি শুনতে পাচ্ছি, সে লোক এই গ্রামে এসেছে; নামটা শুনতে পাচ্ছি না,—নামটা এখানে জানবেই বা কে, কিন্তু দুই একজন তাকে দেখেছে, চেহারাটাও বোলেছে। কেহ বলে বাঁদর, কেহ বলে রাক্ষস। তুমি সাবধান থেকো, অমরকুমারীকেও আমি খুব সাবধান কোরে রেখেছি; লোকটা এ গ্রামে এসেছে, অমরকে আমি সে কথা বলি নাই, তোমাকে বোল্লম; খবরদার—খবরদার! কদাপি তুমি রাত্রিকালে একাকী পথে বেরিয়ো না!”

কথাগুলি আমি শুনলেম, নূতন বোধ হলো না, কিন্তু কৰ্ত্তার কথায় সাবধানে থাকবো, এইরূপে উত্তর দিলেম। কৰ্ত্তা আমাকে আরো অনেক কথা বোল্লেন, সে সকল কথার সঙ্গে পাঠক-মহাশয়ের তাদৃশ কোন সম্বন্ধ নাই, সুতরাং বাগ্‌বিস্তার করা অনাবশ্যক বিবেচনা কোল্লেম। এ সময় কাজের কথা অনেক।

গত রাত্রে যে ঘরে আমি শয়ন কোরেছিলেন, সেই ঘরে গিয়ে বোসলেম। মনের ভিতর আনন্দ আর ভয়। অমরকুমারী বেঁচে আছেন, মোহনলালের কাছে যারে আমি দেখেছিলেম, কাশীতে যার মৃত্যু হয়েছে, সে মেয়েটী অমরকুমারী নয়, অমরকুমারীর দিদি, অমরকুমারীর মুখে এত দিনের পর সেই রহস্যের মৰ্ম্ম আমি অবগত হোলেম; অমরকুমারীর সঙ্গে আবার আমার দেখা হলো; বিধাতা যদি অপ্রসন্ন না হন, কোন না কোন স্থানে আবার আমি অমরকুমারীর দেখা পাব, এই আমার আনন্দ;—নূতন আনন্দ। ভয় তবে কিসের? রক্তদন্ত মুর্শিদাবাদে এসেছে, অমরকুমারী মুর্শিদাবাদে, আমিও মুর্শিদাবাদে আছি, কখন কি ঘটে, দুরন্ত চক্ৰী লোকটা কখন কি সূত্রে আমাদের উভয়কে কোন বিপদে ফেলে, সেই ভয়;—এই আমার নূতন ভয়!

মনে মনে এই সব কথা ভাবছি, অমরকুমারী এলেন। মনে কোন প্রকার ভয় আছে, মুখ দেখে তেমন লক্ষণ আমি কিছুই বুঝলেম না। বেশ প্রফুল্লবদনে অমরকুমারী আমার কাছে এসে বোসলেন। কথা আরম্ভ হলো। প্রাসঙ্গিক অপ্রাসঙ্গিক পাঁচ প্রকার কথার পর সন্দেহ-কৌতূহলে আমি জিজ্ঞাসা কোল্লেম, “আচ্ছা অমর, সেই জটাধর—যার নাম আমি রক্তদন্ত রেখেছি, সেই লোকটা তোমাদের কেহই নয়, তা তো শুনেছি। শুনাটা নূতন বটে, কিন্তু প্রথমদিন যখন তোমাদের সঙ্গে আমার দেখা হয়, তখনি আমার মনে খটকা লেগেছিল, বিধাতার এটা কেমন সংঘটন! তেমন সুরসুন্দরী দয়াময়ী রমণী রাক্ষসতুল্য রক্তদন্তের স্ত্রী, এমন সুরবালা পদ্মমুখী বালিকা সেই রক্তদন্তের কন্যা, কিছুতেই আমার বিশ্বাস হয় না। সেই স্বভাবসিদ্ধ অনুমানটী এখন সত্য হয়ে দাঁড়ালো। আচ্ছা, রক্তদন্ত তোমাদের কেহই নয়;—আচ্ছা, তবে তোমরা সত্যপরিচয়ে কে, তোমার সত্য-পিতাই বা কে, কোথায় তোমার জন্ম, তোমার জননীই বা কোন দেশে ছিলেন, তা কি তুমি জানতে পেরেছ?”

আমার মুখপানে চেয়ে অমরকুমারী উত্তর কোল্লেন, “কিছুই আমি জানি না। মা আমারে সে সব কথা একদিনও বলেন নাই;—মরণকালে কেবল চক্ষের জলে ভেসে চুপি চুপি আমারে বোলেছিলেন, ‘ঐ লোকটা আমাদের কেহই নয়, অন্যদেশ থেকে ধোরে এনে বীরভূমে আমাদের রেখেছিল।’ কেবল এইটুকু মাত্র;—এইটুকু মাত্রই আমি শুনেছি। মা যখন ঐ কথা আমায় বলে, কবিরাজমহাশয় তখন কাছে ছিলেন, তিনিও ঐটুকু শুনেছেন। সেই কবিরাজমহাশয় এই বাড়ীর কর্ত্তা তুমি জানতে পেরেচো।”

গত রাত্রে যেমন একজন ব্রাহ্মণ এসে রাসবাড়ীর রাধাকৃষ্ণের প্রসাদ এনে দিয়ে গিয়েছিল, এ রাত্রেও সেই রকমে দিয়ে গেল, আমরা আহার কোল্লেম। রাত্রি দ্বিপ্রহরের পূর্ব্বে অমরকুমারী যখন শয়ন কোত্তে যান, সেই সময় ছলছলচক্ষে অর্দ্ধবদ্ধঘরে আমারে জিজ্ঞাসা কোল্লেন, “হরিদাস! তবে কি তুমি কল্য প্রভাতেই চোলে যাবে? না হরিদাস, যেয়ো না! যতদিন আমি এখানে থাকি, ততদিন তুমিও থাকো। আচ্ছা হরিদাস, আমি এখানে কতদিন থাকবো, তা কি তুমি বলতে পার?”

বাষ্পবেগে আমারো চক্ষু ছল ছল কোরে এলো। অর্দ্ধরুদ্ধ-কণ্ঠে আমি উত্তর কোল্লেম, কতদিন তুমি এখানে থাকবে, বিধাতার ইচ্ছা, বিধাতাই সে কথা বোলতে পারেন; আমি কেমন কোরে বোলবো? আমায় তুমি এখানে থাকতে বোলছো, তাই বা কি কোরে হয়? আমি একজন বড়লোকের বাড়ীতে চাকরী কোচ্ছি, তাঁর ছোটভাই আমারে সঙ্গে কোরে এনেছেন, তিনি আমারে রেখে যাবেন কেন? যদিই বা বোলে কোয়ে আর দুই একদিন এখানে থাকবার অনুমতি নিতে পারি, তাতেই বা কি উপকার হবে? কল্যই আমি যাব। তুমি ভেবো না। যেখানে আমি থাকি, এখান থেকে সে স্থান বেশী দূর নয়; মাঝে মাঝে এসে তোমারে আমি দেখে যাব। কৰ্ত্তা তোমারে খুব ভালবাসেন, মণিভূষণটীও দিব্য সৎ, পরিবারেরাও তোমারে ভালবাসেন, এখানে তোমার কোন প্রকার অযত্ন হবে না। ভয় কেবল রক্তদন্তের;—সাবধানে থাকলে সে লোকটাও কিছু কোত্তে পারবে না। রক্তদন্ত যদি এখানে রাস দেখতে এসে থাকে, দুদিন পরেই চোলে যাবে, তা হোলেই তুমি নিরাপদ হবে। মাঝে মাঝে এসে আমি তোমারে দেখে যাব। বিধাতার যদি মনে থাকে, সময় যদি শুভ হয়, আমাদের ভাগ্য যদি ভাল হয়, কতবার দেখা হবে; হয় তো চিরজীবন আমরা একবাড়ীতেই মনের সুখে থাকতে পারবো। চিন্তা কি?—ভেবো না, আশার আশ্বাসে অনেকেই ভবিষ্যৎ শুভদিনের মুখ চেয়ে থাকে, আশার আশ্বাসেই অনেক লোক প্রাণধারণ করে। চিন্তা কি?—এখন যাও, শয়ন কর গে।”

অঞ্চলে নেত্ৰমাৰ্জ্জন কোরে, ধীরে ধীরে উঠে, আমার দিকে চাইতে চাইতে, অমরকুমারী মৃদুগতিতে গৃহান্তরে প্রবেশ কোল্লেন; নেত্রমার্জ্জন কোরে আমিও শয়ন কোল্লেম। প্রভাতে সূর্য্যোদয়ের পর ছোটবাবু এলেন, মণিভূষণ এলেন, আহারান্তে আমরা সেখান থেকে রওনা হব, এইরুপ স্থির হয়ে থাকলো। সে দিন আর রাসবাড়ীর প্রসাদের অপেক্ষা কোত্তে হলো না, একটী প্রতিবাসিনী ব্রাহ্মণকন্যা সেই বাড়ীতেই রন্ধনাদি কোরে যত্নপূৰ্ব্বক পরিবেশন কোল্লেন, পরিতোষরূপে আমরা আহার কোল্লেম। আহারের পর স্বতন্ত্রগৃহে অমরকুমারীর সঙ্গে একবার দেখা কোরে, পূৰ্ব্ববৎ আশ্বাস দিয়ে, আমি বিদায় চাইলেম। অমরকুমারীর চক্ষের জল নীরবে নির্গত হয়ে বক্ষঃস্থল প্লাবিত কোল্লে। আমি সে সময় আর বেশী কথা বোলতে পাল্লেম না, অবেগ সংবরণ কোত্তেও অক্ষম হোলেম, অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে সংক্ষেপে কেবল চুপি চুপি বোল্লেম, “কেঁদো না!”

অমরকুমারীকে বোল্লেম কেঁদো না, আমি নিজে কিন্তু অধোবদনে নীরবে না কেঁদে থাকতে পাল্লেম না; অনেক কষ্টে মনোযোগ সংবরণ কোরে শুষ্কনয়নে সে ঘর থেকে বেরুলেম; তার পর বাড়ীর সকলের কাছে বিদায় নিয়ে পশুপতিবাবুর সঙ্গে রাসবাড়ীতে গেলেম; মণিভূষণটীও আমাদের সঙ্গে থাকলেন। বেলা আড়াইপ্রহরের পর বাবুদের নিজের শকটানোহণে আমরা দুজনে যদুপুর গ্রামে ফিরে এলেম।

রাধাকৃষ্ণের রাস; রাসাবসানে বোরাকুলীর রাধাকৃষ্ণ আপনাদের বারোমেসে মন্দিরে নিয়মিত নিত্যপূজায় পরিতুষ্ট থাকতে লাগলেন, আমি কিন্তু নিত্য নিয়মিত কার্য্যকলাপে পরিতুষ্ট থাকতে পাল্লেম না। আমার মনোমন্দিরে অভীষ্টদেবীরূপিণী অমরকুমারী অনুক্ষণ বিরাজ কোত্তে লাগলেন। সকল ভাবনা অপেক্ষা অমরকুমারীর ভাবনা আমার বেশী হয়ে উঠলো। সেই ভাবনার সঙ্গে রক্তদন্তের ভয়। সাঁ সাঁ কোরে হেমন্তের প্রথমমাস মার্গশীর্ষ বিদায় হয়ে গেল। ক্রমশই আমার চিত্ত অস্থির;—মাস বিদায় হলো আমার চিত্তের চিন্তা বিদায় হলো না। এইখানে একটা কথা বোলে রাখি। দীনবন্ধুবাবুর বাড়ীতে অনেক গুলি দরোয়ান, অনেকগুলি পালোয়ান। তারা সকলেই অস্ত্রশিক্ষায় নিপুণ, মল্লযুদ্ধে নিপুণ, পাঁচজন পালোয়ান বিলক্ষণ কুস্তিগীর। লাঠিখেলা, তলোয়ারখেলা, মুগুরভাঁজা, বন্দুকছোড়া, ধনুৰ্ব্বাণখেলা, এই সকল কার্যে অনেকেই দক্ষ। অবকাশকালে আমি বাবুদের অজ্ঞাতে ব্রহ্মময়ীর বাড়ীতে দুজন দরোয়ানের কাছে তলোয়ার, বন্দুক আর তীর ধনুকের ক্রীড়াকৌশল শিক্ষা কোরেছিলেম। অশ্বারোহণে পশুপতিবাবুর বড় সখ, তিনি আমার জন্য একটা ক্ষুদ্র টাট্টু নিৰ্ব্বাচন কোরে দিয়েছিলেন, ক্রমে ক্রমে অভ্যাস কোরে অশ্বারোহণে আমি একরকম পটু হয়েছিলেম। পশুপতিবাবুর সঙ্গে প্রতি রবিবার সকাল বিকাল দুইবেলা অশ্বারোহণে দূরস্থ ময়দানে ভ্রমণ কোত্তে যেতেম। আমার ঘোড়া প্রথম প্রথম কদমে কদমে চোলতো; ক্রমশঃ উৎসাহ, ক্ৰমশঃ সাহস, ক্ৰমশঃ গতিবেগশিক্ষা; ঘোড়াদৌড়ে ক্রমশই আমি পাকা হলেম। ছোটবাবুর ঘোড়ার সঙ্গে আমার ঘোড়ার সমান দৌড়। এক একবার বরং দ্রুতধাবনে আমার ঘোড়ার জিত হয়, ছোটবাবুর ঘোড়া আট দশ হাত পেছিয়ে পড়ে। আহ্লাদ কোরে ছোটবাবু আমার উপাধি দিয়েছিলেন, “খোকা ঘোড়সওয়ার!”—দীনবন্ধুবাবুর পত্নী সময়ে সময়ে আমারে খোকা বোলে ডাকতেন, সেই আদরে ব্যাকরণের কিঞ্চিৎ অবমাননা হোলেও, ঘোড়সওয়ার শব্দের পূর্ব্বে আমার “খোকা” বিশেষণ।

চিত্ত কেমন সৰ্ব্বদাই অস্থির। অমরকুমারীকে দর্শন করবার ইচ্ছা নিত্য নিত্য নূতনবেগে বলবতী। অমরকুমারী কে, সে পরিচয়টী অজানা থাকলেও, পশুপতিবাবু শুনে এসেছেন, অমরকুমারীর সঙ্গে আমার বিশেষরূপে জানাশুনা, পরষ্পর মমতাবন্ধনও বিলক্ষণ;—পশুপতিবাবু সেটা জেনেছিলেন, কিন্তু বড়বাবু কিছু জানতেন না। পৌষমাসের পঞ্চম দিবসের প্রাতঃকালে বড়বাবুকে আমি বোল্লেম, “বোরাকুলী গ্রামে শান্তিরাম দত্তের বাড়ীতে একটী বালিকা এসেছে, সেই বালিকাটীকে আমি চিনি; সমান বয়স, সেইজন্য তার সঙ্গে আমার বেশ ভাব। বালিকার মা-বাপ নাই, বড় দুঃখিনী বালিকা। রাস দেখতে গিয়ে সেই বালিকাটাকে আমি দেখে এসেছি, আর একবার তারে দেখবার জন্য আমার মন কেমন করে। আপনি যদি অনুমতি করেন, আজ আমি সেই বালিকাটীকে একবার দেখে আসি।”

ঈষৎ হাস্য কোরে বড়বাবু তৎক্ষণাৎ অনুমতি দিলেন। ছোটবাবুকে সেই কথা জানিয়ে আমি একজন দরোয়ান সঙ্গী চাইলেম; রাসের সময় সেই গ্রামে আমার একটা কালান্তক বৈরী এসেছিল, সেই কথাও তখন তারে জানালেম। সেই অকারণ বৈরীটা এখনো পর্য্যন্ত যদি সেখানে থাকে, একাকী যেতে ভয় হয়, সেইজন্যই একজন দরোয়ান মোতায়েন চাই, এ কথাটাও তাঁরে বোল্লেম। তিনিও ঈষৎ হাস্য কোরে আমার সঙ্গে একজন দরোয়ান দিলেন! বেলা দুই প্রহরের পূর্ব্বে আমরা বোরাকুলী গ্রামে যাত্রা কোল্লেম। দুজনেই আমরা ঘোড়সওয়ার। আমার সঙ্গে একজোড়া গুলীভরা পিস্তল, দরোয়ানের স্কন্ধে বন্দুক, কটিবন্ধে তরবারি।

যথাসময়ে বোরাকুলীতে আমরা উপস্থিত হোলেম, শান্তিরাম দত্তের বাড়ীতে গিয়ে পৌঁছিলেম। শুনলেম কি?—ভীম নির্ঘাত বজ্রবাণী! অমরকুমারী নাই! আমারে দেখে বাড়ীর সকলে কেঁদে উঠলেন। অমরকুমারী নাই! আমার মাথায় যেন বিনা মেঘে অকস্মাৎ বজ্রাঘাত! বজ্রাহত হয়েই যেন বাড়ীর উঠানে আমি আছাড় খেয়ে পোড়লেম;—ক্ষুদ্র বালকের মত কেঁদে ভাসিয়ে দিলেম! কৰ্ত্তা আর মণিভূষণ আমারে ধরাধরি কোরে তুলে বোসিয়ে, নানা প্রকারে সান্ত্বনা কোল্লেন। সান্ত্বনাবচনে কর্ত্তামহাশয় বোলতে লাগলেন, “এত ব্যাকুল হবার কোন কারণ নাই, কথাটা শুনেই অত অধীর হয়ে অমঙ্গল আশঙ্কা কোত্তে নাই; অমরকুমারী বেঁচে আছেন, চোরে তাঁরে চুরি কোরে নিয়ে গিয়েছে! একটু ঠাণ্ডা হও, সকল কথা তোমাকে বিশেষ কোরে বোলছি। এককালে হতাশ হয়ে অমঙ্গল আশঙ্কা কোরো না।”

প্রথমে আমি যতটা অধীর হয়ে পোড়েছিলেম, কৰ্ত্তার কথা শুনে ততটা অধীরতা থাকলো না, চোরে চুরি করার তাৎপৰ্য্যটা কি, সেটাও তখনি বুঝতে পাল্লেম। মণিভূষণ আমার হাত ধরে একটী ঘরে নিয়ে বসালেন, কৰ্ত্তাও সঙ্গে গেলেন, বাড়ীর মেয়েরাও সেইখানে এলেন। প্রথমে তাঁরা আমারে কিছু জল খেতে দিলেন। জল খাওয়ার কথা তখন আমার মনেই ছিল না, কিছুই ভাল লাগলো না, অস্থিরকণ্ঠে বল্লেম, “এখন আমি কিছুই খাব না; বৃত্তান্তটা কি, আগে শুনি, তার পর—”

আমারে আর কথা কোইতে না দিয়েই কর্ত্তামহাশয় বোলতে আরম্ভ কোল্লেন, “তোমার মনে থাকতে পারে, রাসের সময় তোমাকে আমি বোলেছিলেম, বীরভূমে যে লোকের বাড়ীতে অমরকুমারী ছিলেন, সেই চেহারার একটা লোক আমাদের গাঁয়ে এসেছিল, গ্রামের কেহ কেহ তাকে দেখেছিল, আমার কাছে গল্প কোরেছিল, আমিও বুঝেছিলেম, সেই লোক,—সেই জটাধর তরফদার। সেই লোক একদিন—”

ঘৃণায়-ক্রোধে উত্তেজিত হয়ে, কৰ্ত্তার কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে, তৎক্ষণাৎ আমি বোলে উঠলেম, “আমি সেই লোকের নাম রেখেছি রক্তদন্ত! জটাধর তরফদার, সে নামটা হয় তো জালনাম! তাদৃশ নরাধমেরা কোথাও সত্যনামে পরিচয় দেয় না। মুখের চেহারা দেখেই নাম রেখেছি রক্তদন্ত!”

যারা সেই ঘরে উপস্থিত ছিলেন, তাঁদের মুখের ভাব দেখে আমি বুঝলেম, আমার কথা শুনে তাঁদের সকলেরই যেন হাসি পেয়েছিল, কেহই কিন্তু হাসলেন না। কর্ত্তা বোলতে লাগলেন, “ঠিক নাম দিয়েছ বাবা! সে রকম লোকের ঐ রকম নামটাই ঠিক। সেই লোক একদিন আমাদের একটা জানালার ধারে দাঁড়িয়ে অমরকুমারীকে দেখেছিল; যে দিন দেখে, সে দিন আমি জানতে পারি নাই, তার পর পাঁচ সাত দিন গৌণে অমরকুমারীর মুখে শুনেছিলেম। তদবধি অমরকে আমি চক্ষে চক্ষে রাখতেম, একদিনও বাহির হোতে দিতেম না; তদবধি সে লোকের আর কোন খোঁজখবর ছিল না। সংক্রান্তির দুদিন পূর্ব্বে সর্ব্বেশ্বরবাবুর বাড়ীতে দুজন অতিথি আসে; একজন ব্রাহ্মণ, একজন কায়স্থ। ব্রাহ্মণের নাম কুঞ্জবিহারী সান্ন্যাল, কায়স্থের নাম জনার্দন মজুমদার; সেইখানে আহারাদি কোরে, সন্ধান জেনে বৈকালে আমাদের বাড়ীতে আসে। দুজনেরই লম্বা লম্বা চুল, লম্বা লম্বা গোঁফদাঁড়ি। তারা বলে, অমরকুমারী নামে একটা মেয়ে এই বাড়ীতে আছে, আমরা তার বিবাহের সম্বন্ধ কোত্তে এসেছি। যার নাম কুঞ্জবিহারী, সেই লোকটী ঘটক, যার নাম জনার্দ্দন, সেই লোকটী বরের কাকা। আমি তাদের—”

আমার মনের ভিতর যেন একটা ঝড় এলো; কত দিনের একটা পূৰ্ব্বকথা মনে পোড়ে গেল; কর্ত্তার কথার উপর কথা ফেলে আমি তখন বোলে উঠলেম, “রসুন মহাশয় রসুন, নাম-দুটো যেন আমার জানা জানা বোধ হচ্ছে। যদিও তাদের চেহারা আমি দেখি নাই, কিন্তু নাম শুনে বুঝতে পাচ্ছি, দুরাচার রক্তদন্তের সঙ্গে তাদের বিলক্ষণ যোগাযোগ! তারাই বুঝি অমরকুমারীকে—”

শুনেই শান্তিরাম কবিরাজ হস্তসঞ্চালন কোরে বল্লেন, “না না, তারা অমরকুমারীকে হরণ করে নাই; বিবাহের সম্বন্ধ কোত্তে এসেছে, এই কথাই তারা বোলেছিল, পাত্রটী ভাল, বিষয়-আশয় আছে, বংশ বুনিয়াদী, কন্যাপক্ষে কিছুই খরচপত্র লাগবে না, কন্যার গা-ঢাকা সমস্ত সোণার গহনা দেওয়া হবে, কন্যাটী চিরদিন রাজরাণীর মত সুখে থাকবে, এই সব কথাই তারা বোলেছে। আমি তাদের আড়ঘরবাক্যের উত্তরে বলেছিলেম, ‘সম্প্রতি কন্যাটীর মাতৃবিয়োগ হয়েছে, কন্যা বলেন, পিতার সমাচার জানেন না, সে সমাচার না পাওয়া গেলে বিবাহের কোন কথাই স্থির হোতে পারে না, কন্যার জাতি পর্য্যন্ত এখন আমাদের অজ্ঞাত।’ আমার এই সব শুনে, যার নাম জনার্দ্দন, সে লোকটী হাসতে হাসতে বোল্লে, ‘সে কি মশাই, কি কথা কন? পিতার সমাচার নাই, সে কি কথা? কন্যার পিতার সঙ্গে আমাদের অতি নিকট-সম্বন্ধ, মাসখানেক পূর্ব্বে তাঁর সঙ্গে আমাদের দেখা হয়েছে, কন্যা এইখানে আছে, তাঁরই মুখে এই খবর আমরা পেয়েছি। তিনি এখন বড় কাজে ব্যস্ত, আমাদের সঙ্গে আসতে পাল্লেন না, আমাদেরই দুজনকে মেয়ে দেখতে পাঠালেন। বাপ জানেন না, জাতি জানেন না, কি কথা কন আপনি? করণীয় ঘর, কন্যার পিতার বংশের সঙ্গে আমাদের তিনপুরুষের কুটুম্বিতা, কি কন আপনি?”—কিছুতেই আমি বিশ্বাস কোল্লেম না, ‘কন্যার পিতাকে হাজির কর, তা না হোলে কোন কথাই হবে না, এ বিবাহের কর্ত্তা আমি নই’, কাটা কাটা এই সব কথা বলেই আমি তাদের বিদায় কোরে দিই।”

ক্রমশই আমি উত্তেজিত হোতে লাগলেম। বৃদ্ধ শান্তিরাম শেষকালে যে সকল কথা বোলবেন, অগ্রেই তা আমি বেশ বুঝতে পেরেছিলেম, তথাপি চঞ্চলকণ্ঠে জিজ্ঞাসা কোল্লেম, “বিদায় কোরে দিলেন, তার পর কি হলো?”

নিশ্বাস ফেলে কর্ত্তা বোলতে লাগলেন, “সে দিন তারা চোলে যায়; অমরকুমারী ভয় পান। আমি তখন ততটা বুঝে উঠতে পারি নাই, সম্বন্ধটা হয় তো সত্য হলেও হোতে পারে, অমরকুমারীর পিতাকে হয় তো তারা জানলেও জানতে পারে, এইরুপ তখন আমি ভেবেছিলেম। দুই তিন দিন গেল, তারা এলো না; তার পর আর একজন লোক এসে পরিচয় দিলে, সে লোকটাও ব্রাহ্মণ, খুব রোগা, অস্থি-পঞ্জর সার, মাথাটী ন্যাড়া, মাথার মাঝখানে এক হাত লম্বা একটা টীকী, কপালে রক্তচন্দনের দীর্ঘ ফোঁটা, কর্ণে, কণ্ঠে, বক্ষে শ্বেতচন্দনের ছাপকাটা, পরিধানে একখানা আধময়লা তসরের ধুতি, স্কন্ধে তসরের দোব্জা কোচানো; নাম বোল্লে, নফরচন্দ্র ঘোষাল। সেই লোকের মুখেও অমরকুমারীর বিবাহের সম্বন্ধের কথা। সেই লোক বরং আরো জোরে জোরে কথা কোইলো। সে বোল্লে ‘অমরকুমারীর পিতা বহরমপুরের আদালতের একটা মোকদ্দমার তদ্বিরে অত্যন্ত ব্যস্ত আছেন, আমি তাঁদের কুল-পুরোহিত, আমারে তিনি পাঠালেন, আমার সঙ্গে তাঁর কন্যাটীকে তুমি পাঠিয়ে দাও। ঘটক এসেছিল, তাকে তোমরা তাড়িয়ে দিয়েছ, শুনে তিনি ভারী চোটেছেন; আমি তাঁর প্রতিনিধি, বাড়ীর পুরোহিত, বংশের পুরোহিত, আমার সঙ্গে মেয়েটীকে তুমি পাঠিয়ে দাও; মেয়েটীকে তুমি বাপের বাড়ী থেকে চুরি কোরে এনেছ, ভালোয় ভালোয় আমার সঙ্গে পাঠিয়ে দাও; আজিই আমি নিয়ে যাবো;—না যদি পাঠাও, তিনি তোমাদের নামে পুলিশকেস আনবেন।’—মণিভূষণ তখন বাড়ী ছিল না, আমি একবার উঠে গিয়ে অমরকুমারীকে জিজ্ঞাসা কোল্লেম, পুরোহিত বলে পরিচয় দিচ্ছে, ঐ লোকটীকে তুমি কি চিনতে পার?”—অমরকুমারী বলেন, ‘জানালার ফাঁক দিয়ে আমি দেখেছি, ও রকম চেহারার লোক আর কখনো কোথাও আমার চক্ষে পড়ে নাই।’—অমরের কথা শুনে ফিরে এসে ঘোষালকে আমি বোল্লেম, “তোমার সঙ্গে সে মেয়ে আমি কখনই পাঠাব না; পুলিশকেস কোরে যে যা কোত্তে পারে, কোত্তে বলে গে।’—ঘোষালই হোক কিম্বা পুরোহিতই হোক, যেই হোক, ভাঙাগলায় চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে, অনেক রকম শাসিয়ে শাসিয়ে, সে লোক তখন বিদায় হয়ে গেল। দু-দিন পরে অমরকুমারী অদৃশ্য। আমার একটা মেয়ের সঙ্গে খিড়কীর ঘাটে অমরকুমারী স্নান কোত্তে গিয়েছিলেন, কাঁচাবুদ্ধিতে আমার মেয়েটী ঘাটে তাঁরে একাকিনী রেখে এক বার বাড়ীর ভিতর এসেছিল, তার পর ফিরে গিয়ে দেখে, অমরকুমারী সেখানে নাই। কোথায় গেল? জলে ডুবে যাওয়া অসম্ভব; সে পুকুরে পাঁচবছরের মেয়েরাও ডুবে যেতে পারে না, এত কম জল; তবে অমরকুমারী কোথায় গেল? বিস্তর অন্বেষণ করা হয়েছিল, কোথাও পাওয়া গেল না। সন্ধ্যাকালে গ্রামের একজন বালক এসে খবর দিলে, বেলা প্রায় দেড়প্রহরের সময় তিনজন লোক একখানা গাড়ী কোরে অমরকুমারীকে নিয়ে যাচ্ছে; অমরকুমারীর মুখে কাপড়বাঁধা, কথা কোইতে পাচ্ছিল না, দুই চক্ষু দিয়ে জল পোড়ছিল, ফ্যাল ফ্যাল কোরে চেয়ে রয়েছিল, দুপাশে দুজন লোক তার দুই হাত ধোরে বোসেছিল; বালক যদি সময়ে খবর দিতো, তা হোলে বোধ হয় সন্ধান হোতে পাত্তো, দিনের বেলায় গ্রামের ভিতর থেকে মেয়েচুরি, চোরেরা অল্পে অল্পে পার পেতো না। বালক আরো বোল্লে, সে যখন দেখে, তখন গাড়ীর একটা দরজা খোলা ছিল, তাকে দেখেই লোকেরা সে দরজাটা বন্ধ কোরে দিলে; গাড়ীখানা ছুটেছে, প্রথমে অমরকুমারীকে সে ঠিক চিনতে পারে নাই, গাড়ীখানা অনেক দূর চোলে গেলে, চেহারা স্মরণ কোরে সে বুঝতে পারে, অমরকুমারী। দিনমানের মধ্যে খবর দেওয়া সে বালক আবশ্যক মনে করে নাই, অমরকুমারী হারিয়ে গিয়েছে, চারিদিকে খোঁজ পোড়েছে, সেই কথা শুনে সন্ধ্যাকালে খবর দিতে এসেছিল। তখন আর কি হয়, কোথাকার গাড়ী কোথায় গেল, কে আর তার সন্ধান পায়, কাজেই আমরা কেবল হা-হুতাশ সার কোরে—”

হা-হুতাশ সার করা অপরের পক্ষে সঙ্গত হোতে পারে, আমার পক্ষে কেবল তাই নয়, সব যেন আমি অন্ধকার দেখতে লাগলেম। কর্ত্তার কথা সমাপ্ত হবার অগ্রেই অস্থির হয়ে আমি বোল্লেম, “চোর ধরা দুঃসাধ্য হবে না। অমরকুমারী একদিন রক্তদন্তকে দেখেছিলেন, রক্তদন্তের সঙ্গেও সে দিন একটা লোক ছিল; তার পর তিনজন লোক এই বাড়ীতে আসে। সমস্তই রক্তদন্তের চক্র, সমস্তই আমি বুঝতে পাল্লেম, আর আমি এখানে বিলম্ব কোরবো না, আমি চোল্লেম; যে বাড়ীতে আমি থাকি, সে বাড়ীর বাবুদের প্রতিপত্তি খুব, বিস্তর লোক বাধ্য, সত্য যদি রক্তদন্ত বহরমপুরে থাকে, শীঘ্রই ধরা পোড়বে; পুলিশের সাহায্যে আদালতের ওয়ারীন বাহির কোরে অমরকুমারীকে আমি উদ্ধার কোরবোই কোরবো;—এখন আমি চোল্লেম, ফলাফল শীঘ্রই আপনি জানতে পারবেন।”

দরোয়ানের সঙ্গে অশ্বারোহণে আমি পথে বেরুলেম। তলোয়ার, বন্দুক, পিস্তল, এ সকল অস্ত্র সে দিন কোন কাজেই এলো না। পাপাত্মারা যে দিন সেই পবিত্র কুমারীকে হরণ করে, সে দিন যদি আমি এ গ্রামে এই ভাবে সজ্জিত থাকতেম, পরিণাম চিন্তা না কোরে নিশ্চয়ই আমি দুই একটা মণ্ডু এইখানে গড়াগড়ি যেতে দেখতেম! সে সময় অতীত হয়ে গিয়েছে, সে দিন আমি ছিলেম না, এখন সে আক্ষেপ বৃথা। আমরা চোল্লেম। আমার প্রাণের ভিতর তখন যে প্রকার বিষাদ-বেগ প্রবাহিত, ভুক্তভোগী পাঠকমহাশয়ের অনুভবেই সেটা বুঝতে পারবেন, অক্ষরে লিখে ব্যক্ত করা যায় না। বাড়ীতে এসে উপস্থিত হোলেম। ছোটবাবু অমরকুমারীকে দেখেছিলেন, অগ্রেই ছোটবাবুকে সেই দুঃখের কথা বোল্লেম, শেষকালে বড়বাবুও সেই বিষাদ-সমাচার শুনলেন। সেই দিনেই অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত দ্বাদশজন মল্ল বড়বাবুর আদেশে বহরমপুরে চোলে গেল, আমিও তাদের সঙ্গে থাকলেম। কোথায় আছে রক্তদন্ত। প্রথমে আদালতে অন্বেষণ করা হলো, জটাধর তরফদার নামে কোন লোক সেখানে কোন মোকদ্দমা জোগাড় কোত্তে আসে কি না, জিজ্ঞাসা করা গেল, কেহই কিছু বোলতে পাল্লে না, তার পর উকীলদের বাসায় বাসায় অনুসন্ধান করা হলো, কিছুই সন্ধান পাওয়া গেল না; বিদেশী লোকেরা যে সব জায়গায় বাসা কোরে থাকে, সে সব জায়গাতেও অন্বেষণ কোল্লেম, বিফল অবেষণ! রক্তদন্ত বহরমপুরে নাই। না থাকাই তো সম্ভব। এ রকম চক্রান্তকারীরা কদাচ সত্যকথা বলে না, এটা তাদের স্বভাবসিদ্ধ। চিত্তের আবেগে আমি অন্বেষণে গিয়েছিলেম, চিত্ত কিন্তু জেনেছিল, রক্তদন্তকে সেখানে পাওয়া যাবে না; মুর্শিদাবাদজেলার মধ্যেই পাওয়া যাবে কি না, তাতেও সম্পূর্ণ সন্দেহ। বিফল অন্বেষণ! ইষ্টসিদ্ধ কোরে কোথায় তারা পালিয়ে গিয়েছে, ভগবান বোলে না দিলে, কে আর সে সন্ধান বোলে দিবে? আশায় হতাশ হয়ে আমরা ফিরে এলেম।

প্রবল হতাশের ভিতর আমার মনে আর একটা কূটতর্ক। ঘটক, বরের কাকা, পুরোহিত, সে তিনটে লোক কে?—কারা তারা?—কুঞ্জবিহারী সান্ন্যাল, জনার্দ্দন মজুমদার, নফরচন্দ্র ঘোষাল, কারা তারা? সেই সেই নামের কোন লোকের সঙ্গে কখনো কোথাও আমার দেখা হয়েছে, এমন তো মনে কোত্তে পালেম না। কারা তারা?—নাম-তিনটে যেন পূর্ব্বে কোথাও আমি শুনেছি, শান্তিরামের মুখে শুনা নয়, অনেক পূর্ব্বে কোথায় যেন শুনেছি, এইরূপ মনে হোতে লাগলো, ঠিক স্মরণ কোত্তে পাল্লেম না। বাড়ীতে ফিরে এলেম। বিফল অন্বেষণের কথা ম্লানবদনে বাবুদের কাছে আমি বোল্লেম। সমবেদনা জানিয়ে তাঁরাও আমার দুঃখে দুঃখিত হোলেন।

রাত্রি এলো। রাত্রিকালেই চিন্তার পরাক্রম অধিক হয়। নামমাত্র ভোজনাবসানে আমি শয়ন কোল্লেম। কি নিমিত্ত শয়ন?—সুখীর সুখদায়িনী নিদ্রাদেবী দুঃখীর কাছে আসেন না, আমার কাছে আসবেন না, জানতেম, তথাপি শয়ন কোল্লেম। শয়নমাত্রেই চিন্তা আমাকে আক্রমণ কোল্লে।

ঘটক, পুরোহিত, বরের কাকা, এই তিনজন। নাম-তিনটী কোথায় আমি শুনেছি, অনেকক্ষণ মনে কোত্তে পাল্লেম না, কিন্তু শুনেছি কিম্বা কোথায় লেখা আছে, নিজের চক্ষে দেখেছি; মানুষ দেখি নাই, নাম দেখেছি, এটী স্থির; কিন্তু কোথায়?—অনেকক্ষণের পর স্মরণ হলো। কুঞ্জবিহারী সান্ন্যাল, নফরচন্দ্র ঘোষাল, জনার্দ্দন মজুমদার, এই তিন নাম। বর্দ্ধমানে সর্ব্বানন্দবাবুর খুনের পর যেদিন উইল পড়া হয়, সেই দিন ঐ তিনটী নাম সেই উইলের সাক্ষীর স্থলে স্বাক্ষরিত আমি দেখেছি। ঠিক তাই! উঃ! ভয়ানক চক্রান্ত! রক্তদন্তের সঙ্গে ঐ তিনজনের জানা-শুনা! সর্ব্বানন্দবাবুর বাড়ীতে ঐ তিনজনকে একদিনও আমি দেখি নাই। অকস্মাৎ মুর্শিদাবাদে দুইদিনে সেই তিনজন উপস্থিত। একদিন দুজন, একদিন একজন। অমরকুমারী যেদিন সন্ধ্যাকালে তেঁতুলতলায় রক্তদন্তকে দেখেন, রক্তদন্তের সঙ্গে সেদিনও একটা লোক ছিল। সে লোকটা কে? ঐ তিনজনের একজন কি আর কেহ সেটা আমি অনুমান কোত্তে পাল্লেম না।

যেখানে চক্রান্ত হয়, চক্রান্ত যেখানে অনেকদিন চলে, সেখানে দুই একটা লোক থাকে না, অনেক লোক থাকাই সম্ভব। ষড়যন্ত্রের মূল অধিনায়ক যে ব্যক্তি, সেই লোকের একটা দল থাকে; কোথাকার কত লোক সেই দলভুক্ত, সহজে নির্ণয় করা যায় না, কিছুই আমি নির্ণয় কোত্তে পাল্লেম না। যে লোকটার নাম ঘনশ্যাম বিশ্বাস, ওরফে ঘনশ্যাম সরস্বতী, সে লোকটার সঙ্গে রক্তদন্তের যোগ আছে, তা আমি জানতে পেরেছি; শেষের তিনজন সেই দলের লোক, সেটাও এখন বুঝতে পাল্লেম;—পেরেই বা করি কি? কোথায় তারা অমরকুমারীকে নিয়ে গিয়েছে, সে সন্ধান কেই বা বোলে দিবে?

ভাবনায় যন্ত্রণায় সমস্ত রজনী জাগরণ কোল্লেম। তার পর পাঁচদিন পাঁচরাত্রি কি অসুখেই যে আমি কাটালেম, ভগবান জানেন। ১১ই পৌষ। খৃষ্টান লোকগুলির বড় দিন;—প্রভু যীশুখৃষ্টের জন্মদিন। যে গ্রামে আমি আছি, সেই গ্রামে খৃষ্টানের উপাসনামন্দির ছিল না, খৃষ্টভক্ত ধার্ম্মিকলোকেরও অস্তিত্ব ছিল না, সুতরাং বড়দিনের উৎসব সেখানে আমি কিছুই দেখলেম না। কৃষ্ণকামিনীর সঙ্গে দস্তুরমত দেখা-সাক্ষাৎ হয়, কৃষ্ণকামিনী দিন দিন হাস্যপরিহাসের নূতন নূতন অভিনয় দেখান, মনে আমার সুখ নাই, কুলকন্যার সে সকল রঙ্গভঙ্গ কিছুই আমার ভাল লাগে না।

বেলা প্রায় অবসান। বড়দিনের বেলা, কত বড় দিন, সকলেই জানেন; পৌষমাসের বেলা খুব ছোট, দুর্ভাবনায় আমি কাতর, সে ছোট বেলা আমার পক্ষে অনেক বড় বোধ হয়েছিল। বেলা প্রায় অবসান। বড়বাবু ছোটবাবু দুজনেই বাড়ী নাই, সেরেস্তায় লোকজন আছে, আমি কিন্তু সেদিন সেরেস্তায় বসি নাই; শেষবেলায় ব্রহ্মময়ীর বাড়ীতে বেড়াতে গিয়েছি। যে কোন রকমেই হোক, একটু অন্যমনস্ক থাকাই আমার চেষ্টা। পূৰ্ব্বে বলা হয় নাই, ব্ৰহ্মময়ীর বাড়ীর ফটকের ধারে দারোয়ানদের ঘর। দরোয়ান পালোয়ান সেই সকল ঘরেই বেশী; দেউড়ীর দরোয়ানেরাও মাঝে মাঝে সেইখানে গিয়ে সিদ্ধি খায়, গীত গায়, মাদোল বাজায়, মালকাট ঘুরায়, আমোদ করে। সেইখানে গিয়ে আমি তাদের খেলার কৌশল দেখছি, গানবাজনাও শুনেছি, ঘরে প্রবেশ করি নাই, বাহিরেই দাঁড়িয়ে আছি, এক একবার রাস্তার দিকে চেয়ে দেখছি, হঠাৎ দেখি মণিভূষণ সেইখানে উপস্থিত;—বোরাকুলীর শান্তিরাম দত্তের পুত্র মণিভূষণ।

আমারে দেখেই মণিভূষণ বোল্লেন, “বাড়ীতে আমি গিয়েছিলেম, শুনলেম, তুমি ঠাকুরবাড়ীতে এসেছ, শুনেই তাড়াতাড়ি এখানে আমি আসছি। শীঘ্র তুমি আমার সঙ্গে এসো। একটা সন্ধান পাওয়া গিয়েছে।”

কিসের সন্ধান, কি বৃত্তান্ত, কিছুই বুঝতে না পেরে, চকিতনেত্রে মণিভূষণের মুখের দিকে আমি চেয়ে থাকলেম। মণিভূষণ বোল্লেন, “আমি কাশিমবাজারে গিয়েছিলেম, যেখানে নিমনাথের মন্দির, পরেশনাথের মন্দির, সেইখানে একটা লোককে আমি দেখতে পেয়েছি। সেই অস্থিসার, দীর্ঘকায়, নাড়ামাথা, টিকীওয়ালা,—যে লোকটা অমরকুমারীর বাপের পুরোহিত বেলে পরিচয় দিয়েছিল, অমরকুমারীকে নিয়ে যাবার জন্য আমাদের বাড়ীতে গিয়েছিল, সেই লোক। আমাকে দেখে সে হয় তো চিনতে পাল্লে না, একবারমাত্র চেয়েই আপন কাজে মন দিলে। কাজটা কি জানো?—হাঁস কিনছিল। একটা লোক গোটাকতক হাঁস বেঁচতে এসেছে, হাঁস আর হাঁসী, দর কম, তাদের ভিতর যেগুলো খুব মোটা মোটা, খুব বড় বড়, টিকীওয়ালা ভট্টাচার্য্য সেই রকম বেছে বেছে দরদস্তুর কোচ্ছিল। হাঁসেদের পা বাঁধা, পালক বাঁধা লম্বা একটা বাঁশের লাঠীতে ঝোলানো। আমার কেমন আশ্চর্য্য মনে হলো। জৈন-মন্দিরের কাছে নিরীহ পক্ষিজাতির প্রতি সেইরুপ নিষ্ঠুরতা; ক্রয়-বিক্রয়ের অবসানে সেই সকল পক্ষীর প্রাণান্ত হবে, জৈনধর্ম্মের পাণ্ডারা কিছুই বলছে না, তাই ভেবেই আমার আশ্চর্য্যজ্ঞান; তেমন একজন তিলকধারী, টিকীধারী ভট্টাচার্য্য হাঁস মেরে খাবে, তাই ভেবেই আমার আশ্চর্য্যজ্ঞান!”

মণিভূষণের গৌরচন্দ্রিকার আড়ম্বরে তাচ্ছল্যভাবে আমি বোল্লেম, “পরেশনাথদেবের মহিমা হয় তো কোমে গিয়েছে, সেই জন্যই মন্দিরের কাছে হাঁসব্যাপারীর নিষ্ঠুরতা, হাঁসখোর লোকের হর্ষবর্দ্ধন। ও কথা ছেড়ে দাও, সন্ধানের কথাটা কি বোলছিলে?”

হাতে একগাছা ছড়ি ছিল, সেই ছড়িগাছটা জোরে জোরে মাটীতে ঠুকে ঠুকে মণিভূষণ বোল্লেন, “ঐ তো সন্ধান। সেই লোকটা—সেই নফর ঘোষালটা যখন কাশিমবাজারে আছে, তখন হয়তো সেই ঘটক আর সেই বরের কাকাও সেখানে থাকতে পারে, তারাই অমরকুমারীকে চুরি কোরেছে, অমরকুমারীও সেইখানে আছেন, আমার যেন এই রকম মনে হোচ্ছে।”

অনিশ্চিত সন্ধান। তথাপি মনে কোল্লেম, তত্ত্ব লওয়ায় দোষ কি? আবার মনে হলো, তারা যদি থাকে, তবে হয় তো রক্তদন্তও সেখানে আছে। থাকে থাকুক অমরকুমারীর জন্য প্রাণ দিতেও আমার ভয় হয় না। কতক সংশয়ে কতক উল্লাসে চঞ্চলস্বরে আমি বলে উঠলেম, “আমারে তুমি কাশিমবাজারে নিয়ে চলো! ভাল কোরে সেই সন্ধানটা একবার জানতে হয়েছে। অমরকুমারীকে যদি উদ্ধার কোত্তে পারি, তবেই আমার মনস্কামনা পূর্ণ হবে। তুমি আমারে নিয়ে চলো!”

মণিভূষণের সঙ্গে বাবুদের বাড়ীতে আমি উপস্থিত হলেম। সময় ঠিক গোধুলি। ছোটবাবু তখন ফিরে এসেছেন। তাঁরে আমি ঐ কথা বোল্লেম; তখনি আমি কাশিমবাজারে যাব, বিশেষ আগ্রহে সেই ইচ্ছা জানালেম। তিনি বেল্লেন, “রাত্রে কোথায় যাবে? রাত্রে গিয়েই বা কি ফল হবে? কল্য প্রাতঃকালে বরং যেয়ো।”

আরো অধিক আগ্রহ জানিয়ে আমি বোল্লেম, “আজ্ঞে না, দেরী করা হবে না; লোকেরা কখন কোথায় থাকে, ঠিক পাওয়া যায় না, রাত্রেই আমি যা।

আমার ব্যগ্রতা দেখে ছোটবাবু তখন বোল্লেন, “আচ্ছা, একান্তই যদি যেতে চাও, আমি একখানা চিঠি দিচ্ছি, বহরমপুরের এক উকীলের বাসায় রাত্রিযাপন কোরে প্রাতঃকালেই কাশিমবাজারে যেয়ো, তা হোলেই সুবিধা হোতে পারবে।”

উকীলের নামে ছোটবাবু একখানা চিঠি লিখে দিলেন, সঙ্গে দুজন দরোয়ান দিলেন, তৎক্ষণাৎ নৌকা স্থির হলো, মণিভূষণের সঙ্গে সন্ধ্যার পরেই আমি যাত্রা কোল্লেম। সঙ্গে দুজন অস্ত্রধারী দরোয়ান; আমার সঙ্গেও একজোড়া পিস্তল। নৌকারোহণের পূর্ব্বে আমার মনে একটা বিতর্ক। অমরকুমারীকে ধোরেছে, এইবার আমার পালা, আমারে দেখতে পেলেই রক্তদন্ত আমারে ধোরে ফেলবে। সত্যি যদি রক্তদন্ত কাশিমবাজারে থাকে, নিশ্চয়ই আমি ধরা পোড়বো। মনে মনে এইরূপ আতঙ্ক সন্দেহ কোরে একটা বুদ্ধি স্থির কোল্লেম। ছোটবাবু মধ্যে মধ্যে সখের খাতিরে কৌতুকের জন্য রকম রকম বেশ পরিবর্ত্তন করেন। অনেক রকম মুখোস আছে, পরচুল আছে, পোষাক আছে; আমিও ছদ্মবেশধারণের সঙ্কল্প কোল্লেম; মুখোস চাইলেম না, একপ্রস্থ পরচুল গোঁফ-দাড়ী চেয়ে নিলেম। ছোটবাবু হাস্য কোল্লেন।

সন্ধ্যার পরেই নৌকায় আরোহণ কোরেছিলেম, অতি অল্প দূরে এসেই পাড়ী; এপার ওপার। সময় অধিক লাগলো না, রাত্রি চারিদণ্ডের পরেই বহরমপুরের স্নানের ঘাটে আমাদের নৌকা লাগলো।

যে উকীলের নামে পশুপতিবাবুর চিঠি, সেই উকীলের বাসার ঠিকানা মণিভূষণের জানা ছিল, অল্পক্ষণেই সেই ঠিকানায় গিয়ে আমরা পৌঁছিলেম। পশুপতিবাবুর চিঠি পেয়ে উকীলটী আমাদের সবিশেষ আদর-যত্ন কোল্লেন। উকীলের নাম রজনীকান্ত রুদ্র; তাঁর সদ্ব্যবহার-দর্শনে আমরা বিশেষ পরিতুষ্ট হোলেম। স্বচ্ছন্দে সেই বাসাতেই রাত্রিযাপন করা হলো। শয়নের অগ্রে রজনীবাবু আমাকে জিজ্ঞাসা কোল্লেন, কাশিমবাজারে যাবার উদ্দেশ্য কি? সংক্ষেপে তাঁর প্রশ্নের আমি উত্তর দিলেম। গম্ভীরবদনে তিনি বোল্লেন, “অমন কর্ম্ম কোরো না। যদি সন্ধান পাও, চুপি চুপি ফিরে এসে আমাকে জানিও। আইন অনুসারে গ্রেপ্তার করবার বন্দোবস্ত আমি কোরে দিব। তা না হোলে, তুমি যেমন বোলছে, খামোকা একটা লোককে ধোরে বেঁধে নিয়ে যাওয়া বে-আইনী কাজ; লোকের পশ্চাতে যদি কোন জবরদস্ত লোক থাকে, তুমি বালক, বিপদগ্রস্ত হবে। তেমন কর্ম্ম কোত্তে নাই। এখনকার আইন-কানুন বড় শক্ত; কথাটাও বড় শক্ত; সাক্ষী নাই, সাবুদ নাই, দলীল নাই, কেবল একটা মুখের কথা; লোক যদি শান্তিরামের বাড়ীতে যাওয়া অস্বীকার করে, মেয়েচুবির কথা অস্বীকার করে, তবেই মোকন্দমা বাধবে। মেয়েচুরি,—গুরুতর অভিযোগ, সে অভিযোগ প্রমাণ কোত্তে না পাল্লে বড়ই গোলযোগ। অমন কর্ম্ম কোরো না, সন্ধান পেলে আমাকে এসে খবর দিও, যে ক্ষেত্রে যেমন কোত্তে হয়, আমিই তা ব্যবস্থা কোরবো।”

আমি সম্মত হোলেম। রজনীপ্রভাতে আমার ছদ্মবেশধারণ। শীতকাল, জামাজোড়া পরিধান কোল্লেম, পরচুলে গোঁফ-দাড়ী সাজালেম, মাথায় একটী বড়রকম টুপী দিলেম, দুদিকের দুই পকেটে দুটী পিস্তল থাকলো। এই রুপ আমার ছদ্মবেশ। উকীলবাবুর ঘরের দেয়ালে বড় একখানা দর্পণ ছিল, সেই দর্পণে আমি মুখ দেখলেম। হাসি পেলো। আপনার মুখে আপনি দেখে আপনাকে আমি চিনতে পাল্লেম না। রক্তদন্ত যদি সেখানে থাকে, আমি সেই হরিদাস, কিছুতেই চিনে উঠতে পারবে না।

সে পক্ষে নিশ্চিন্ত হোলেম। বাজারে একখানা গাড়ী ভাড়া কোরে আমরা চারিজনে কাশিমবাজারে যাত্রা কোল্লেম। এখন যাওয়া যায় কোথায়? নিমনাথের মন্দিরের কাছে মণিভূষণ সেই ব্রাহ্মণকে দেখেছিলেন, ব্রাহ্মণ যে সেইখানে থাকে, সেইখানে গেলেই যে তাকে দেখতে পাওয়া যাবে, এমন কিছু ঠিক করা যায় না, তথাপি সেই মন্দিরের কাছে অগ্রেই যাওয়া গেল। মন্দির দর্শন করা তখনকার কাৰ্য্য নয়, ঘোষালের অন্বেষণ করাই প্রধান কাৰ্য্য। কিরূপে অন্বেষণ করা যায়? মণিভূষণ যেখানে তারে দেখেছিলেন, গাড়ী থেকে নেমে সেইখানে আমরা গেলেম। কাছেই একখানা দোকান ছিল, দোকানীকে জিজ্ঞাসা কোল্লেম, চেহারাটাও বোল্লেম। দোকানী উত্তর কোল্লে, “এসেছিল বটে, হাঁস কিনতে এসেছিল, একজোড়া হাঁস কিনে নিয়ে দক্ষিণদিকে চোলে গেল; কোথায় গেল, কোথায় থাকে, তা আমি জানি না। পাঁচ সাতদিনের মধ্যে দুদিন তাকে আমি দেখেছি, বোধ হয়, নিকটেই কোথাও বাসা কোরে আছে।”

নিশ্চিত ঠিকানা পাওয়া গেল না, অনুমানের উপর নির্ভর কোরে দক্ষিণদিকে খানিক দুর আমরা চোলে গেলেম। ছোট একটা পল্লীতে এলেম। খানকতক ঘর, খানকতক বাড়ী। ঘরগুলি প্রাচীর দিয়ে ঘেরা ছিল না, বাড়ীগুলি ঘেরা। লোকজন যাওয়া-আসা কোচ্ছিল, দুই একজন মেয়েমানুষও দেখলেম, বোধ হলো গৃহস্থ-পল্লী। একটি লোককে আমি জিজ্ঞাসা কোল্লেম, এই রকম চেহারার এক ব্রাহ্মণ এই পাড়ায় থাকে কি না? লোক উত্তর কোল্লে, “এ পাড়ায় যারা থাকে, সকলকেই আমি চিনি, বাসাড়ে লোক এ পাড়ায় থাকে না, তবে যে রকম চেহারা তুমি বোলচো, সেই রকম চেহারার একটা লোক মাঝে মাঝে এই পথে যাওয়া-আসা করে, সম্প্রতি এসেছে, পূর্ব্বে দেখি নাই, পাড়ার দিকে চাইতে চাইতে বনের দিকে চোলে যায়। সন্ন্যাসীরাই বনে থাকে, বোধ হয় সন্ন্যাসী হবে, বনের ভিতর হয় তো তপস্যা করে।”

মনে মনে হেসে আমি ভাবলেন, তপস্যাই করে বটে! তপস্বীরা হাঁস খায়, মেয়েচুরির মন্ত্রণা করে, মেয়েচোরের পুরোহিত সাজে, এ তামাসা মন্দ নয়! তপস্বীকে ধোত্তে হবে; বনের ভিতরই ধোরবো; বনের ভিতরেই থাকে; তেমন স্বভাবের লোক লোকালয়ে থাকতে পারে না; বনেই লুকিয়ে আছে, এই কথাই ঠিক। লোকটীকে আর কোন কথা জিজ্ঞাসা না কোরে বনের দিকেই আমরা চোল্লেম। অদূরে একটী শিবের মন্দির দেখা গেল; মন্দিরের পরেই বন। মণিভূষণকে সেই মন্দিরের কাছে রেখে দরোয়ান-দুজনকে সঙ্গে নিয়ে বনপথে আমি তপস্বীর অন্বেষণে অগ্রসর হোলেম। দরোয়ানদের অস্ত্রশস্ত্র আর মাথার পাগড়ী-দুটি মণিভূষণের কাছেই থাকলো।

মণিভূষণকে সঙ্গে রাখলেম না, কারণ এই যে, সে লোক যে দিন পুরোহিত সেজে যায়, সে দিন মণিভূষণকে দেখেছিল, মণিভূষণও তাকে দেখেছিলেন, হাঁস কেনার সময়েও হয় তো মণিভূষণ তার চক্ষে পোড়ে থাকবেন; এখন সে যদি বনের ভিতর মণিভূষণকে দেখে, ধূৰ্ত্তলোক কি না, পাপীলোকের মনে সৰ্ব্বদাই ভয়, মণিভূষণকে যদি দেখে, তা হোলে সে নিশ্চয়ই গা-ঢাকা হয়ে পোড়বে, না হয় তো পালিয়ে যাবে, আমার কাৰ্য্য-সিদ্ধ হবে না। তাই ভেবেই মণিভূষণকে মন্দিরের কাছে রাখা।

বনমধ্যে অমি প্রবেশ কোল্লেম। আমার দেহরক্ষক সেই দুজন নিরস্ত্র দরোয়ান উজ্জ্বল দিনমান। বনে বনচর হিংস্র জন্তু একটাও দেখা গেল না। আমি নির্ভয়। বন পৌরাণিক তপোবনের ন্যায় পরিষ্কার নয়, কিন্তু মধ্যে মধ্যে মুনি-ঋষির আশ্রমের ন্যায় ছোট ছোট খানকতক কুটীর দেখতে পেলেম। সত্য হয় তো সেই সকল কুটীরে সন্ন্যাসী তপস্বী বাস করে, প্রথমে সেই ভাবটা আমার মনে উদয় হয়েছিল, একে একে আট দশখানি কুটীরের সমীপবর্ত্তী হয়ে দর্শন কোল্লেম, জনমানবের সঞ্চার নাই; কুটীর মধ্যে আছে কেবল শুষ্ক শুষ্ক বৃক্ষপত্র, অর্দ্ধদগ্ধ কাষ্ঠখণ্ড, এক একখানা খেজুরপাতার চেটাই এক একটা গুড়ের নাগরীর মত ছোট ছোট জলের কলসী; দুই একখানা কুটীরে কেবল অঙ্গার আর ভস্মরাশি;—ভস্মের সঙ্গে এক একটা গেঁটে কোলকে আর তামাকপোড়া গুল। এই সকল আসবাব দেখে কিছুই আমি স্থির কোত্তে পাল্লেম না; কারা সেই সকল কুটীরে থাকে, কখন থাকে, সেটাও আমার অনুমানে এলো না। যে দুজন দরোয়ান আমার সঙ্গে ছিল, তাদের মধ্যে একজন (নাম তার ভল্লু সিং) অনেকদিন মুর্শিদাবাদে আছে, মুর্শিদাবাদের অনেক বৃত্তান্ত সে জানতো। আমার তখনকার মুখের ভাব দেখে বিস্ময়ের কারণ অনুমান কোরে, ভল্লু সিং বোল্লে, “এই সকল ঘরে রেতের বেলা শীকারী লোকেরা লুকিয়ে থাকে, বনজন্তু শীকার করে। দিনের বেলাও গরিবলোকেরা কাঠ কাটে, পাতা কুড়ায়, বনফল সংগ্রহ করে, তারাও মাঝে মাঝে ঐ সকল ঘরে আশ্রয় নিয়ে তামাক খেয়ে, গাঁজা খেয়ে, ক্লান্তি দূর করে।”

তখন আমার বিস্ময়ের কারণটা দূর হয়ে গেল। বনটা অনেকদূর পর্য্যন্ত বিস্তৃত। অনেক দূর অন্বেষণ কোল্লেম, যার অন্বেষণ, তার কোন চিহ্নই পাওয়া গেল না!

বেলা প্রায় দেড় প্রহর অতীত। অন্তরে হতাশ, এ দিকে ক্ষুধা-তৃষ্ণার উদ্রেক। হতাশে ফিরে আসি আসি মনে কোচ্ছি, এমন সময় এক অদ্ভুত কাণ্ড। ঘন ঘন বৃক্ষে ঘন ঘন কণ্টকীলতা, এক একটা স্থান অল্প অল্প অন্ধকার; নিবিড় বৃক্ষপত্র ভেদ কোরে সূর্য্যকিরণ সে সব জায়গায় সতেজে প্রবেশ কোত্তে পারে না, সেই জন্যই অন্ধকার। ফিরে আসি আসি মনে কোচ্ছি, হঠাৎ দেখি, সেই রকম অন্ধকার স্থানে একটা মুণ্ডু! ঠিক যেন মাটী ফুঁড়ে সেই মুণ্ডুটা উপরদিকে উঠছে! গলা পর্য্যন্ত উঠেছে! ঝাউপাতার মত ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া অনেক চুল, মুখের বর্ণটা জোঁদাকালো; বোধ হলো যেন আলকাতরামাখা। মুণ্ডুটা আমাদের দিকে ঘুরে একবার চাইলো; চক্ষু দুটো গোল গোল, ছোট ছোট; ভ্রূ নাই;—চেয়েই অমনি তৎক্ষণাৎ মাটীর ভিতর ডুবে গেল!

মুণ্ডু অদশ্য! মাটী ফুঁড়ে উঠছিল, মাটীর ভিতর লুকিয়ে গেল! এই বনে সুড়ঙ্গ আছে। বদমাসলোকেরা প্রচ্ছন্নভাবে ভূগর্ভে বাস করে। নিশ্চয় ডাকাত। কেবল ডাকাত কেন, যাবতীয় কুক্ৰিয়ার নায়ক-নায়িকারা এই প্রকার গহ্বরে লুকিয়ে থাকবার সুবিধা পেলে আর কোথাও থাকতে চায় না। যে লোকটার সন্ধানে আমরা বেরিয়েছি, এই গহ্বরমধ্যেই হয় তো সেই লোককে পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু এ গহ্বরে কত লোক আছে, জানা যাচ্ছে না। সংখ্যায় যদি বেশী হয়, তা হোলে এখন ঘাঁটা দেওয়া একটা নূতন বিপদের হেতু হয়ে দাঁড়াবে। পূর্ব্বাপর বিবেচনা কোরেই কাজ করা কর্ত্তব্য।

কন্তব্যস্থির কোরে পায়ে পায়ে আমরা অগ্রসর হোলেম। যেখানে সেই মুণ্ডুটা উঠেছিল, সাবধানে সেইখানে গিয়ে দেখলেম, কোন চিহ্ন পাওয়া গেল না, কোথায় সুড়ঙ্গের বার, বাহ্যদর্শনে স্থির করা দুরূহ। বনের অপরাপর স্থান যেমন সমতল, সে স্থলটাও সেইরূপ। ভিতরদিক থেকে কোন কৌশলে দ্বারপথ মুক্ত করা হয়, তার পর আবার সমভাবে ঢাকা দেওয়া হয়, এইরূপ আমি অবধারণ কোল্লেম। নিকটে অনেকগুলি বৃক্ষ। স্থাননিরূপণের সুবিধার জন্য একখণ্ড পাথর কুড়িয়ে নিয়ে একটা বৃক্ষগাত্রে আমি দাগ দিয়ে রাখলেম; সেই নিদর্শনে অক্লেশে সুড়ঙ্গস্থান নির্ণীত হোতে পারবে, সেই জন্যই দাগ দেওয়া। আরব্য উপন্যাসের সঙ্কেত।

বনে আর প্রতীক্ষা কোল্লেম না, শীঘ্র শীঘ্র বেরিয়ে এলেম; পূৰ্ব্বকথিত মন্দিরের নিকটে উপস্থিত হয়ে মণিভূষণকে সঙ্গে নিলেম। দরোয়ানেরা সেইখানে পূৰ্ব্ববৎ সজ্জিত হলো। পল্লী পার হয়ে নিমনাথের মন্দির। এইবার সেই মন্দিরটী ভাল কোরে দর্শন কোল্লেম। স্থপতিকাৰ্য্য অতি সুন্দর। মন্দিরমধ্যে জৈন-সম্প্রদায়ের চতুর্ব্বিংশতি দেব-মূর্ত্তি; প্রধান মূর্ত্তি নিমনাথ। নিমনাথ-বিগ্রহ প্রস্তর-নির্ম্মিত, পরেশনাথ অষ্টধাতুনির্ম্মিত। মূর্ত্তিগুলি দর্শন কোরে দেবালয় থেকে আমরা বেরুলেম। সেখানকার লোকের মুখে শুনেলেম, নিমনাথের মন্দিরের নীচেও এক সুড়ঙ্গ আছে। মুর্শিদাবাদ বহু প্রাচীন; বিশেষতঃ কাশিমবাজারে পূর্ব্বে পূর্ব্বে বিস্তর অট্টালিকা ছিল, বড় বড় কুঠী ছিল, রেশমের কুঠী সৰ্ব্বপ্ৰধান। ইংরেজ, ফরাসী, মার্কিণ, ওলন্দাজ, দিনেমার, পত্তুগীজ, আরমানী প্রভৃতি ভিন্ন ভিন্ন বৈদেশিক জাতি এই কাশিমবাজারে বিবিধ বাণিজ্যকার্য্যোপলক্ষে বাস কোত্তেন; কে কোথায় কি অভিপ্রায়ে কত সুড়ঙ্গ প্রস্তুত কোরেছিলেন, স্থির করা যায় না। বনমধ্যে যে সুড়ঙ্গের সন্ধান পাওয়া গেল, সেইটীই আমাদের লক্ষ্য; অন্য সুড়ঙ্গের তত্ত্বান্বেষণ করা আমাদের তখনকার কাৰ্য্য নয়।

বহরমপুরে ফিরে এসে আমরা স্নানাহার কোল্লেম। রবিবার ছিল, উকীলবাবু আদালতে যান নাই, অনুসন্ধানের ফলাফল তাঁকে জানালেম। সেদিন সেখানে থাকতে হবে, সোমবার আদালতে দরখাস্ত কোরে পুলিশের নামে পরোয়ানা বাহির কোত্তে হবে, রজনীবাবু এই কথা আমারে বোল্লেন।

রবিবার বহরমপুরেই আমাদের অবস্থান করা হলো। রাত্রিকালে কাশিমবাজারের পূৰ্ব্বসমৃদ্ধির অনেক কথা রজনীবাবুর মুখে আমি শুনলেম। কাশিমবাজারের রাজবাড়ী ইতিপূর্ব্বে আমি দর্শন কোরেছি, সেই রাজবংশ কতদিনের, এই কথাটা আমি রজনীবাবুকে জিজ্ঞাসা কোল্লেম। রজনীবাবু বোল্লেন, “বংশ খুব বুনিয়াদী নয়, কিন্তু একটী লোকের সৌভাগ্যের চমৎকার ইতিহাস আছে।” রজনীবাবুর মুখে সেই ইতিহাস আমি শুনি। মৰ্ম্ম এইরুপ যে, কাশিমবাজার যখন খুব গুলজার, কাশিমবাজার যখন বঙ্গদেশের মধ্যে একটী প্রধান বাণিজ্যস্থান বোলে গণ্য ছিল, সেই সময় তিলিজাতীয় কালী নন্দী নামে একটী কারবারী লোক বর্দ্ধমানজেলা থেকে কাশিমবাজারে কারবার কোত্তে আসেন। রেশমের কারবার আর সুপারির কারবার তাঁর অবলম্বন হয়। কারবার খুব ফ্যালাও ছিল না, সামান্যরকম দোকানেই কাজকর্ম্ম চোলতো। কালী নন্দীর পুত্র সীতারাম নন্দী ক্রমে ক্রমে কাজকর্ম্ম বৃদ্ধি করেন; সীতারামের পুত্র রাধাকৃষ্ণ; রাধাকৃষ্ণের পুত্র কৃষ্ণকান্ত। এই কৃষ্ণকান্ত নন্দী পৈতৃক কারবারেই লিপ্ত ছিলেন। নবাবের হকুমে জনকতক ইংরেজ যখন বন্দী হয়ে মুর্শিদাবাদে প্রেরিত হয়, সেই বন্দীদের ভিতর একটী সাহেব ছিলেন, তাঁর নাম হেষ্টিং। কোন প্রকারে পলায়ন কোরে সেই হেষ্টিং ঐ কৃষ্ণকান্ত নন্দীর দোকানে আশ্রয় লন। নবাবের প্রতাপে আপন জীবনকে সঙ্কটাপন্ন জেনেও কৃষ্ণকান্ত সেই সাহেবটীকে আশ্রয় দিয়ে, পান্তাভাত খাইয়ে, গুপ্তভাবে নিরাপদে কলিকাতায় পাঠান। হেষ্টিং সাহেব কৃষ্ণকান্তের সেই উপকার স্মরণ কোরে রেখেছিলেন; তিনি যখন সৌভাগ্যক্রমে বাঙ্গালার গবর্ণর জেনারেল হন, মহামান্য ওয়ারেন হেষ্টিং যখন তাঁর পদবী হয়, সেই সময় তিনি কৃষ্ণকান্তকে স্মরণ করেন; ওয়ারেন হেস্টিঙের কৃপায় কৃষ্ণকান্ত নন্দী ভাগ্যবন্ত হয়ে উঠেন; সাহেবের মুখে তখন তাঁর নাম হয় কান্তবাবু। গবর্ণরী-পদ পাইবার পূর্ব্বেও হেষ্টিংসাহেব কান্তবাবুর উপকার কোরেছিলেন। হেষ্টিং যখন মুর্শিদাবাদের রেসিডেণ্ট, তৎকালে প্রথা অনুসারে তখন তিনি নিজের একটা স্বতন্ত্র কারবারী কুঠী খোলেন; কান্তবাবুকে তিনি সেই কারবারে মুচ্ছুদ্দী নিযুক্ত করেন। তার পর হেষ্টিং সাহেব দেশে যান। দেশে গিয়ে তিনি এ দেশের উপার্জ্জিত টাকাগলি নানাকার্য্যে খরচ কোরে নিঃসম্বল হন; সেই অবস্থায় পতিত হয়ে কান্তবাবুর কাছে ১১ হাজার টাকা ধার চেয়ে পাঠান। কান্তবাবু তাদৃশ ধনী ছিলেন না, সুতরাং সাহেবের সে প্রাথনা পূর্ণ কোত্তে তিনি সমর্থ হন নাই; তথাপি তাঁর প্রতি হেষ্টিং সাহেবের সমান অনুগ্রহ ছিল। আবার তিনি এ দেশে এসে কান্তবাবুকে আপন কারবারে মুচ্ছদ্দীপদে বরণ করেন। সে সময় কোম্পানীর পদস্থ কর্ম্মচারীরা আপনাদের নিজ নামে কোন ব্যবসা চালাতে পারবেন না, এইরুপ শক্ত নিয়ম হয়েছিল; বেনামীতে মুচ্ছদ্দীর নামেই কারবার চোলতো, জমীদারী ইজারা লওয়া হোতো, নিমক-পোক্তানের কর্তৃত্বও আয়ত্ত থাকতো। হেষ্টিং সাহেবের মুচ্ছদ্দী কান্তবাবু; তিনিও ঐরুপ ক্ষমতা প্রাপ্ত হন; সেই সময় তিনি অনেক টাকা উপার্জ্জন করেন, অনেক ভূমি-সম্পত্তিও তাঁর অধিকৃত হয়।

মুচ্ছদ্দীদের উপাধি ছিল দেওয়ান। ওয়ারেন হেষ্টিং তাঁর দেওয়ান কান্তবাবুকে কতকগুলি ভাল ভাল জমীদারী ইজারা লওয়ান। কান্তবাবু সেই সময় কলিকাতায় এসে বাস করেন। বড়বাজারে আর জোড়াসাঁকোতে তাঁর বাড়ী হয়।

কান্তবাবুর উপকারকল্পে ওয়ারেন হেষ্টিং বঙ্গের কতকগুলি নিরীহ জমীদারের উপর বিষম দৌরাত্ম কোরেছিলেন; একজনের জমীদারী কেড়ে নিয়ে আর একজনকে দান করা, এটা যেমন সৎকাৰ্য্য, প্রত্যুপকারে সেরূপ কৃতজ্ঞতা দেখানো তদনুরূপ সৎকার্য্য।

রজনীবাবুর মুখে আমি শুনলেম, কান্তবাবুর উপকারার্থ হেষ্টিংসাহেব সেইরূপ সৎকার্য্যের অনুষ্ঠানে উৎসাহিত হয়েছিলেন। যতগুলি জমীদারী তিনি কান্তবাবুকে দেন, তন্মধ্যে রংপুরজেলার বাহারবন্দ পরগণাটী সৰ্ব্বপ্রধান। বাহারবন্দ পরগণা পূর্ব্বে রাণী সত্যবতীর সম্পত্তি ছিল, তিনি যখন কাশীবাসিনী হন, সেই সময় ঐ জমীদারীটী আপন ভগ্নী কুমারী বঙ্গগৌরবিণী রাণীভবানীকে দান কোরে যান। গবর্ণরী ক্ষমতায় ওয়ারেন হেষ্টিং সেই বিশাল জমীদারীটী বলপূর্ব্বক রাণীভবানীর অধিকার থেকে আকর্ষণ কোরে কান্তবাবুর নাবালক পুত্র লোকনাথ নন্দীকে প্রদান করেন। লোকনাথের বয়ঃক্রম তখন দ্বাদশবর্ষ পূর্ণ হয় না। হেষ্টিং সাহেবের হেতুবাদ ছিল, রাণীভবানী স্ত্রীলোক, তিনি অত বড় জমীদারী শাসন কোত্তে অক্ষম, অতএব যোগ্যপাত্রে সমর্পণ করা গেল। পাঠকমহাশয় বুঝলেন, যোগ্যপাত্র একটী নাবালক!

ওয়ারেন হেষ্টিং প্রত্যুপকার কোল্লেন, মহত্ত্ব প্রকাশ পেলে, কিন্তু সত্যধর্ম্মানুসারে প্রত্যুপকার কোত্তে পাল্লে সে মহত্ত্ব শতগুণে উজ্জ্বল হোতো। যা-ই হোক, কান্তবাবুর ভাগ্য সুপ্রসন্ন, সাহেবের অনুগ্রহে তিনি বিপুল সম্পত্তির অধিকারী হয়েছিলেন। বাহারবন্দ পরগণা রাণীভবানীর হস্তচ্যুত হওয়াতে সেখানকার প্রজারা বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিল, বহুকষ্টে সে বিদ্রোহ উপশমিত হয়।

কান্তবাবুর পুত্রের নাম লোকনাথ। অতি অল্পবয়সে লোকনাথের মৃত্যু হয়। কান্তবাবু রাজা উপাধি পান নাই, লোকনাথ রাজা হয়েছিলেন। কান্তবাবুর মৃত্যুর পর রাজা লোকনাথ অল্পদিন জীবিত ছিলেন। লোকনাথের পত্নীর নাম সুসারমোহিনী। দ্বাদশমাসবয়স্ক একটী শিশু-পুত্র নিয়ে সুসারমোহিনী বিধবা হন। পুত্রের নাম হরিনাথ বাহাদুর। হরিনাথের পুত্র কৃষ্ণনাথ। হরিনাথও রাজা, কৃষ্ণনাথও রাজা। হরিনাথের পত্নী হরসুন্দরী, কন্যা গোবিন্দসুন্দরী। রাজা হরিনাথের মৃত্যুর পর রাজ-সম্পত্তি ওয়ার্ডকোরে যায়, কুমার কৃষ্ণনাথ বয়ঃপ্রাপ্ত হবার পর রাজা উপাধি প্রাপ্ত হয়ে স্বয়ং রাজ্যভার গ্রহণ করেন। রাজা হরিনাথের ন্যায় রাজা কৃষ্ণনাথেরও অনেক সদ্গুণ ছিল। একটী মোকদ্দমায় আদালতে হাজির হবার অপমানের ভয়ে রাজা কৃষ্ণনাথ ১৮৪৪ খৃষ্টাব্দের অক্টোবর মাসে আত্মহত্যা করেন। কৃষ্ণনাথের মহিষী পুণ্যবতী রাণী স্বর্ণময়ী কাশিমবাজার রাজ্যের অধীশ্বরী হন। নফর ঘোষালের অনুসন্ধানে যখন আমি কাশিমবাজারে যাই, তখন কাশিমবাজারের রাজলক্ষ্মী সেই যশস্বিনী রাণী স্বর্ণময়ী।

রাত্রের গল্প এই পর্য্যন্ত। রাত্রিপ্রভাতে নিয়মিত কার্য্য সমাপন কোরে যথাসময়ে আমাদের সঙ্গে নিয়ে রজনীবাবু আদালতে গেলেন। প্রথম কার্য্য আমারে দরখাস্ত। দরখাস্তে আমি দস্তখৎ কোল্লেম না, দস্তখৎ কোল্লেন মণিভূষণ দত্ত। সেইটীই পরামশসিদ্ধ। কেন না, তাঁদের বাড়ীতেই অমরকুমারী ছিলেন, তাঁদের বাড়ী থেকেই চুরি হয়েছে, মণিভূষণের দরখাস্ত করাই ঠিক। দরখাস্তের বয়ানে স্থূল স্থূল বিবরণগুলি লেখা থাকলো, কাশিমবাজারের কাননমধ্যে সুড়ঙ্গ, সম্ভবতঃ সে সঙ্গে মেয়ে-চোরেরা থাকতে পারে, এই হেতুবাদে পুলিশের দ্বারা তদন্তের প্রার্থনা থাকলো, রজনীবাবু আমাদের পক্ষে পূর্ণক্ষমতাপ্রাপ্ত উকীল থাকলেন।

দরখাস্ত পেশ হবার পর মাজিস্ট্রেটসাহেব আমাদের প্রার্থনামত পুলিশতদন্তের হুকুম দিলেন। কালবিলম্ব না কোরে কথিত বনমধ্যে আমরা উপস্থিত হোলেম; সঙ্গে থাকলে পুলিশের দ্বাদশজন চাপরাসী; থানার নায়েবদারোগা থাকলেন সর্দ্দার।

একমুখো সুড়ঙ্গ থাকা সম্ভব; কিন্তু যে সকল সুড়ঙ্গে বদমাসলোক বাস করে কিম্বা সময়ে সময়ে প্রচ্ছন্নভাবে ওৎ কোরে থাকে, সে সকল সুড়ঙ্গের একটা মুখ থাকে না; দুই মুখ, তিন মুখ, কোন কোন স্থলে আগম-নিগমের বহু মুখ থাকে, পুলিশের লোকের সে সন্ধানটা জানা ছিল। পুলিশ-প্রহরীরা আমার নির্দ্দিষ্ট স্থলে উপস্থিত হয়ে নায়েবদারোগার আদেশে ছড়িভঙ্গ হয়ে দাঁড়ালো; দূরে দূরে ঘাঁটী; সেই রকমের আটটা ঘাঁটীতে আটজন চাপরাসী সকলের স্কন্ধেই এক এক বন্দুক। সুড়ঙ্গের যে মুখটা আমরা দেখেছিলেম, যে মুখে মুণ্ডু উঠেছিল, সেই মুখের কাছে আমরা;—আমি, মণিভূষণ, নায়েবদারোগা আর চারিজন চাপরাসী। এইখানে বলা উচিত, পূৰ্ব্বদিবসের ন্যায় আমার তখন ছদ্মবেশ; দুই পকেটে দুই পিস্তল।

পূর্ব্বে বলা আছে, ধূৰ্ত্তলোকেরা সুড়ঙ্গের প্রবেশমুখটা সাবধানে সমতল কোরে রাখে, ছিলও সমতল, অপরাপর মুখেও সেইরূপ সাবধানতা অবলম্বিত হয়, এ কথা বলাই বাহুল্য। আমার মুখে বৃত্তান্ত শুনে নায়েব-দারোগা মহাশয় মৃর্ত্তিকাখননের খন্তা, কোদালী সঙ্গে এনেছিলেন। যে বৃক্ষগাত্রে পূর্ব্বদিন আমি চিহ্ন দিয়ে রেখেছিলেম, সেই বৃক্ষতলের ভূমিখননে একজন চাপরাসী নিযুক্ত। ভূমিখনন হোচ্ছে, সেই সময় একটু হেসে নায়েবদারোগা আমারে বোল্লেন, “একটা মজা কোল্লৈ হয়। সুড়ঙ্গ-মুখে বৃক্ষপত্র জমা কোরে আগুন ধেরিয়ে দেওয়া যাক, খুব ধোঁয়া হবে, সুড়ঙ্গে যারাই থাকুক, ধোঁয়া খেয়ে, অধিকক্ষণ গর্ত্তমধ্যে তিষ্ঠিতে পারবে না, ছটফট কোরে বেরিয়ে পোড়বে।”

হাস্য কোরে আমি বোল্লেম, “উত্তম পরামর্শ। সুড়ঙ্গে একজন থাকুক, দশজন থাকুক অথবা বেশীই থাকুক, পুলিশের লোক সুড়ঙ্গে প্রবেশ কোলে, নিশ্চয়ই তারা মোরিয়া হবে হাতাহাতি যুদ্ধ বাধাবে, রক্তারক্তি সম্ভব; সেটা ভাল নয়; ধোঁয়া দেওয়াই ভাল।”

পরামর্শ ঠিকঠাক। খন্তা-কোদালীরা গহ্বরমুখ প্রকাশ কোরে দিলে; উঁকি মেরে দেখা গেল, অন্ধকার গহ্বর। নায়েব দারোগার নির্দ্দেশমতে চাপরাসীরা বনভূমির শুষ্কপত্র সংগ্রহ কোরে সুড়ঙ্গ-মুখে নিক্ষেপ কোল্লে, আগুন ধোরিয়ে দেওয়া হলো। শীতকাল রাত্রে শিশির পড়ে, পতিত বৃক্ষপত্র শিশিরজলে সিক্ত থাকে, বিশেষতঃ নিবিড় তরুপল্লবাকীর্ণস্থলে পৌষমাসের সূৰ্য্যরশ্মি প্রায়ই প্রবেশ কোত্তে পারে না;—পত্ৰস্তূপে আগুন ধোরিয়ে দেওয়া হলো, জ্বলে উঠলো না; ধোঁয়ায় ধোঁয়াকার! সুড়ঙ্গের ভিতরেও ধোঁয়া, বাহিরেও ধোঁয়া।

ধোঁয়াতেই উদ্দেশ্যসিদ্ধি। পাতাগুলি জ্বলে জ্বলে বিধূমে ভস্ম হয়ে গেলে তাদৃশ ফল কিছুই হোতো না, সুড়ঙ্গমধ্যে ধোঁয়া প্রবেশ করাতে সুড়ঙ্গবাসী অবশ্যই বেরিয়ে পোড়বে, এইটী স্থির কোরে, সকলেই তখন সতর্ক-নয়নে চতুর্দ্দিক নিরীক্ষণ কোত্তে লাগলো। যে মুখে আগুন, সুড়ঙ্গবাসীরা সেই মুখে বাহির হয় কিম্বা অন্য মুখ দিয়ে পালাবার চেষ্টা করে, সেইটী দেখবার নিমিত্তই সকলে সতর্ক। সড়ঙ্গমুখের চাপরাসীর দীর্ঘ দীর্ঘ লাঠীর সাহায্যে ক্রমাগতই পাতা সংগ্রহ কোরে গহ্বরমধ্যে ঠেসে ঠেসে দিচ্ছে, ক্রমাগতই কুণ্ডলাকারে ধূম্রচক্র আবর্ত্তিত হোচ্ছে। কেহই বাহির হয় না। আমি চিন্তাযুক্ত হোলেম; ভাবলেম, আজ কি তবে এ সড়ঙ্গে কেহই নাই?

দরখাস্তখানা তবে কি মিথ্যা হয়ে দাঁড়াবে? মিথ্যা দরখাস্ত, পুলিশ হায়রাণ, এই দুই অভিযোগে মণিভূষণ কি তবে বিপদগ্রস্ত হবেন? বোধ হয়, গহ্বরে কেহ নাই! যদি থাকতো, এত ধোঁয়া কখনই সহ্য কোত্তে পাত্তো না, অবশ্যই বেরিয়ে পোড়তো। বোধ হয়, কেহ নাই! কল্য সেই মুণ্ডুটা উঠছিল, আমাদের দেখতে পেয়ে লুকিয়ে গিয়েছিল, পাছে ধরা পড়ে, পাছে আমরা সন্ধান বোলে দিই, মুণ্ডুটা তাই ভেবেই হয় তো দলের লোকগুলোকে পালাবার পরামর্শ দিয়েছিল, রাতারাতি হয় তো পালিয়ে গিয়েছে। অনেক দেশের বনদুর্গের দস্যু-তস্করেরা এই রকম করে; একজায়গায় তারা বেশীদিন থাকে না; একটু কিছু সন্দেহ বুঝতে পাল্লেই সোরে সোরে পালায়। এ সুড়ঙ্গের তস্করেরাও হয় তো তাই কোরেছে। হায় হায়! আদালত সত্যকথা জানিয়ে আমার উপকারী বন্ধু মণিভূষণ অকারণে বিপদে পড়বেন, সেই ভাবনাই আমার।

ভাবছি, এমন সময় পূৰ্ব্বদিকের ঘাঁটীর দুজন চাপরাসী হল্লা কোরে চেঁচিয়ে উঠলো; উত্তরদিকেও সেইরূপ চীৎকার! ধন্য জগদীশ্বর! দুই মুখের দুই দিকে দুটো লোক ধরা পোড়েছে। যে মুখের কাছে আমরা ছিলেম, সেটা দক্ষিণের মুখে;—সেই মুখে আগুন দেওয়া হয়েছিল, সে মুখে কেহই আসবে না, নিশ্চয় এইটী অবধারণ কোরে আমরা সকলেই উত্তরদিকে ছুটে গেলেম। নায়েব-দারোগা পূৰ্ব্বমুখের কাছে দাঁড়ালেন। সে মুখে যেটা ধরা পোড়েছিল, সেটা পূৰ্ব্বদিনের মুণ্ডুওয়ালা; সেটাকে আমার তত আবশ্যক ছিল না, সেই জন্য আমি সেখানে দাঁড়ালেম না। উত্তরমুখে যেটা ধরা পোড়েছিল, শান্তিরাম দত্তের বর্ণিত চেহারার মিলনে সেই লোকটাই নফর ঘোষাল, সেই অস্থিচর্ম্মসার দীর্ঘকার টিকীওয়ালা ব্রাহ্মণ, তাই দেখেই উল্লাসে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিতে দিতে সেই দিকেই আমি ধাবিত হোলেম। একটু পরেই জানা গেল, সড়ঙ্গটার ঐ তিন মুখ; উত্তরদিকে একমুখ, পূৰ্ব্বদিকে একমুখ, দক্ষিণদিকে একমুখ; এই তিন মুখ ছাড়া আর মুখ ছিল না। পূর্ব্বমুখের লোকটাকে বন্ধন করবার হুকুম দিয়ে, তিনজন প্রহরীকে সেইখানে মোতায়েন রেখে, নায়েবদারোগাও আমাদের কাছে উত্তরমুখে উপস্থিত হোলেন; অপরাপর প্রহরীরাও সেইখানে এসে জমা হলো। ঘোষাল মহাশয় অবিলম্বেই পুলিশের প্রদত্ত লৌহ-বলয়ে সজ্জিত হোলেন।

সুড়ঙ্গমধ্যে আর কে কে আছে, তোরা এখানে ক-জন থাকিস, ক-জন ছিলি, ঐ দুজন বন্দীকে বার বার এই প্রশ্ন করাতে একজন বোল্লে, ষোলজন, একজন বোল্লে পাঁচজন। বাকী লোকেরা রাত্রিকালে শীকাবে বেরিয়ে গিয়েছে, দিনমানে ফিরে আসবে না, দিনমানে তারা কেবল দুজনেই ছিল, আর কেহ নাই।

আটজন প্রহরী বনমধ্যে পাহারা থাকলো। নায়েব-দারোগা তাদের বৃক্ষারোহণ প্রচ্ছন্ন থাকবার হকুম দিলেন, সন্ধ্যার সময় তারা ছুটী পাবে, আর আটজন বদলী এসে তাদের জায়গায় ভর্ত্তি হবে, এইরূপ কথা থাকলো।

দুজন বন্দীকে সঙ্গে নিয়ে নায়েব-দারোগা মহাশয় থানায় ফিরে এলেন। তাঁর গাড়ীতে আমরা উঠলেম না, আমি আর মণিভূষণ স্বতন্ত্র গাড়ীতে এলেম। নায়েব-দারোগার গাড়ীর কোচবাক্সে দুজন, আমাদের গাড়ীর কোচবাক্সে দুজন চাপরাসী থাকলো।

সন্ধ্যার পূর্ব্বেই আমরা থানায় গিয়ে পৌঁছিলেম। যে আটজন প্রহরী বনের সুড়ঙ্গসমীপে মোতায়েন ছিল, তাদের বদলে রাত্রিকালে আর আটজন যাবে, সেই বন্দবস্ত ঠিক কোরে নায়েব-দারোগা মহাশয় থানার বারান্দায় বার দিলেন। আমি আর মণিভূষণ দখোনি চেয়ারে উপবেশন কোল্লেম। তখন আর আমার ছদ্মবেশ থাকলো না। বন্দীদ্বয়কে প্রাঙ্গণে দাঁড় কোরিয়ে নায়েবদারোগামহাশয় আমারে উপলক্ষ্য কোরে দস্তুরমত সওয়াল আরম্ভ কোল্লেন। বন্দীদের কাছে দুজন দণ্ডহস্ত প্রহরী দণ্ডায়মান থাকলো।

সুড়ঙ্গপথে যে লোকটার মুণ্ডু আমি দেখেছিলেম, সেই লোকটার প্রতিই প্রথম সওয়াল। দারোগারাই পুলিশ থানার কর্ত্তা। এখানে দারোগার পরিবর্ত্তে নায়েব-দারোগা এই সকল কার্য্য কোচ্ছেন কারণ কি? কারণ, একটা খুনী মামলার তদারকের ভারপ্রাপ্ত হয়ে প্রধান দারোগা মফস্বলে গিয়েছেন, নায়েবদারোগার উপরেই এখন থানার সমস্ত কার্য্যভার সমর্পিত; অতএব নায়েবদারোগাই সওয়াল কোত্তে লাগলেন।

সওয়াল।—তোর নাম কি?

জবাব।—লবীনচাঁদ লাগ।

সওয়াল।—বাড়ী কোথায়?

জবাব।—মেদনীপুর।

সওয়াল।—পেশা কি?

জবাব।— চাষবাস করা।

সওয়াল।—কাশিমবাজারের বনের সুড়ঙ্গের ভিতর কি রকম চাষবাস করিস?

জবাব।—তা—তা—তা—

সওয়াল।—তা—তা—তা—দা—দা—দা—এ রকম এন্তাহাম দিবার জায়গা এ নয়, ঠিক কথা বল, সুড়ঙ্গের ভিতর তুই কি করিস?

জবাব।—তা বাবা—আমি বাবা—আমি—

সওয়াল। তা তো বুঝেছি! আমি বাবা, তুই বাবা, সে বাবা, সকলেই তোর বাবা, তা তো বুঝেছি! কালাচাঁদের গুঁতো জানিস? (একজন প্রহরীর প্রতি ইঙ্গিত, প্রহরীর দ্বারা নবীনচাঁদের উরুদেশে দুই দণ্ডাঘাত।)

জবাব।—(কাঁদিয়া নাচিয়া) ও বাবা!—ও বাবা!—বলি বাবা! বোলছি বাবা! সুড়ঙ্গে আমার—(নিস্তব্ধ।)

সওয়াল—হাঁ হাঁ, সুড়ঙ্গে তোর কি?

জবাব।—সুড়ঙ্গে আমার দাদাঠাকুর আমাকে যা যা বলে, আমি তাই করি।

সওয়াল।—কে তোর দাদাঠাকুর? তোর দাদাঠাকুর তোকে কি কি বলে? কি কি কাজ তুই করিস?

জবাব।—দাদাঠাকুরের নাম আমি বোলতে পারবো না; মানা আছে।

সওয়াল।—মানা আছে? আচ্ছা কালাচাঁদ মানাবে। তোর দাদাঠাকুরকে আমি জানি। তোর দাদাঠাকুর ডাকাতী করে, মানুষ মারে, রাহাজানী করে, মেয়ে চুরি করে, নৌকা মারে। দাদাঠাকুরের হুকুমে তুইও কি সেই সব কাজ করিস?

জবাব।—অতো কথা আমি বোলতে পারবো না। মানুষমারা, লৌকামারা, মেয়ে চুরি, ডাকা—না না, ও সব কথা আমি বোলতে পারবো না। আমি— (নিস্তব্ধ)

নায়েব-দারোগা দেখলেন, লোকটা পাকা, সহজে তাকে বাগে আনা যাবে না। এইরুপ স্থির কোরে তিনি প্রহরীদের হুকুম দিলেন, “ঠাণ্ডা গারদে নিয়ে যাও, দস্তুমত ঠাণ্ডা কর! একঘণ্টা বাদে ফের হাজির কোরো!”

আদেশমাত্র প্রহরীরা জোরে জোরে ধাক্কা দিতে দিতে নবীনচাঁদকে ঠাণ্ডাগারদে নিয়ে গেল! ঠাণ্ডগারদ কি রকম জায়গা, ঠাণ্ডাগারদে কি হয়, দণ্ডধারীরা কি রকমে আসামীলোককে ঠাণ্ডা করে, পুলিশের প্রতাপ আর পুলিশের কার্য্যকলাপ যাঁরা জ্ঞাত আছেন, তাঁদের কাছে সে বিষয়ের বিশেষ পরিচয় দেওয়া অনাবশ্যক।

নবীনচাঁদ নাগ ঠাণ্ডাগারদে গেল। দ্বিতীয় বন্দী পূৰ্ব্ববৎ দণ্ডায়মান। নামধাম জিজ্ঞাসা কোরে নায়েবদারোগা তারে আমার উপদেশমত প্রশ্ন কোত্তে আরম্ভ কোলেন। নামধামের পরিচয়ে আমি বুঝতে পাল্লেম লোকটা নিতান্ত বোকাধরণের নয়; টিকীওয়ালা ভট্টাচার্যের ন্যায় কতকটা ভ্যাবাগঙ্গারাম। নামধাম ঠিক বোল্লে; ভাঁড়ালেও না, গোপনও কোল্লে না। নাম নফরচন্দ্র ঘোষাল, নিবাস বর্দ্ধমান। আমার দিকে একবার চেয়ে নায়েবদারোগা মহাশয় গভীরভাব ধারণ কোল্লেন। সে ক্ষেত্রে যেরূপ অনুষ্ঠান আবশ্যক, ইঙ্গিতে ইঙ্গিতে আমিও তাঁরে জানিয়ে দিলেম। তার পর কার্য্যারম্ভ।

সওয়াল।—কি গো ঠাকুর! কি তোমার কার্য্য?

জবাব।—পু—পু—পু—পুরোহিত। ঠা—ঠা—ঠা—ঠাকুরপুজো করি।

সওয়াল।—কি ঠাকুর? নবীনচাঁদ যেমন দাদাঠাকুরের হুকুমবরদার, তুমি যে ঠাকুরের পুজো কর, তোমার সে ঠাকুরটী কি সেইরকম দাদাঠাকুর? দেখো, খবরদার! মিথ্যা বোলো না, কালাচাঁদের কথা যেন মনে থাকে, ঠাণ্ডাগারদের নামটা যেন ভুলো না! বলো এখন, কি ঠাকুরের পূজা কর?

জবাব।—কা—কা—কাকালীঠাকুর।

সওয়াল।—(আমার ইঙ্গিতে) আচ্ছা, বোরাকুলীগ্রামের শান্তিরাম দত্তের বাড়ী থেকে একটী মেয়ে চুরি গিয়েছে, সে খবর তুমি কিছু জানো?

জবাব।—মে—মে—মে—মেয়েচুরি? শা—শা—শা—শান্তিরাম?

সওয়াল।—ঠাকুর যে দেখছি আমার উপরেও টেক্কা দেন! আমি দিচ্ছি সওয়াল, আমার উপরেই ঠাকুরের সওয়াল! হাঁ গো ঠাকুর, হাঁ হাঁ হাঁ, মেয়েচুরি,—শান্তিরাম দত্তের বাড়ী থেকে মেয়েচুরি! মেয়ের নাম অমরকুমারী। খবর কিছু রাখো?

জবাব।—আ—আ—আ—আমি তো কিছু—

সওয়াল।—জানো না? তাই বুঝি তুমি বোলছো? তুমি কিছু জানো না?—না গো ঠাকুর, ও কথা নয়, আমি বেশ বুঝতে পাচ্ছি, কিছু কিছু তুমি জানো। মেয়ের বাপের পুরোহিত হয়ে অগ্রহায়ণমাসের একদিন তুমি সেই মেয়েটিকে আনতে গিয়েছিলে, শান্তিরাম দত্তের বাড়ীতেই গিয়েছিলে; মনে পড়ে। (মণিভূষণকে দেখাইয়া) এই বাবুটীকে তুমি চিনতে পারো?

জবাব।—(মণিভূষণকে দেখিয়া) বা—বা—বা—বাবু? আ—আ—আ—আমি? শা—শা—শা—শান্তি?

সওয়াল। (আমার ইঙ্গিতে) আচ্ছা, বাবুর কথা এখন থাক, অমরকুমারীর পিতার পুরোহিত তুমি,—একপুরুষের নয়, তিনপুরুষের কুলপুরোহিত, আচ্ছা, অমরকুমারীর পিতার নামটী কি, বল দেখি ঠাকুর?

জবাব।—(যেন আত্মবিস্মৃত হইয়া) জ—জ—জ—জটাধর তরফদার।

সওয়াল।—বাঃ! এইবার ঠিক হয়েছে। কুলপরোহিত কি কখনো মিথ্যাকথা কয়? ঠিক হয়েছে! সব কথা সত্য বল, মিথ্যা বোল্লে কি হয়, জানো তো?

জবাব।—মি—মি—মি—মিথ্যাকথা আমি জানি না।

সওয়াল।—আমিও তো সেই কথা বোলছি। মিথ্যা তুমি জানো না। আচ্ছা, সেই জটাধর এখন কোথায়? যে সুড়ঙ্গের ভিতর তোমরা ছিলে, জটাধর তরফদার কি সেই গহ্বরে থাকে?

জবাব।—থা—থা—থা থাকে না।

সওয়াল।—তবে কোথায়?

জবাব।—গু—গু—গু—গুজরাটে।

সওয়াল।—রে বাপ্পা! একচোটে মুর্শিদাবাদ থেকে গুজরাটে? একেবারেই দেশছাড়া? আচ্ছা, অমরকুমারী কোথায়?

জবাব।—তা—তা—তা—তা আমি কি কোরে জানবো?

সওয়াল।—হাঁ হাঁ, তাও তো বটে! তা তুমি কেমন কোরে জানবে! আচ্ছা, শান্তিরামের বাড়ী থেকে অমরকুমারীকে যারা চুরি কোরে আনে, তাদের নাম জানো?

জবাব।— চু—চু—চু—চুরি করা?

সওয়াল।—হাঁ হাঁ, সওয়ালটা হয় তো আমার ভুল হয়েছে,—চুরি নয়, ভুলিয়ে ভালিয়ে গাড়ী কোরে নিয়ে এসেছে। যারা এনেছে তাদের তুমি চেনো?

জবাব।—জ—জ—জ—জনার্দ্দন।

সওয়াল।—হাঁ, সে তো একজন, আর দুজন?

জবাব।—ম—ম—ম—মুর্শিদাবাদে তারা—

সওয়াল। তাদের সঙ্গে কি তুমি ছিলে? মুর্শিদাবাদে তুমি কত দিন এসেছ?

জবাব।—বা—বা—বা—বাপের কথা বোলছিলে,—

সওয়াল।—বোলছিলেম, এখন আর সে কথা বোলছি না, এখন তোমাকে জিজ্ঞাসা কোচ্ছি, ভুলিয়ে ভালিয়ে মেয়েটিকে যারা নিয়ে এসেছে, তাদের সঙ্গে তুমি ছিলে?

জবাব।—তা—তা—তা—তারা আমাকে—

সওয়াল।—হাঁ, আমিও সেই রকম বুঝতে পাচ্ছি। তারা তোমাকে সঙ্গে কোরে নিয়ে গিয়েছিল, তাই তুমি গিয়েছিলে, আপন ইচ্ছায় যাও নাই। ভালমানুষ তুমি বাপের বাড়ীর পুরোহিত, লোকেরা জোর কোরে তোমাকে না নিয়ে গেলে কখনই তুমি যেতে না। কেমন,—এই কথা নয়?

জবাব।—হিঁ গো।

সওয়াল।—হাঁ, তুমি গিয়েছিলে। চুরিকরা তোমার কাজ নয়, তারাই চুরি কোরেছে তুমি কেবল তাদের সঙ্গে ছিলে মাত্র। কেমন?

জবাব।—চু—চু—চু—চুরি—

সওয়াল।—আর কেন বাবা ঢাকা দিবার চেষ্টা পাও? খুলে ফেলো। চুরি করা যদি নয়, তবে মেয়েটির মুখে চোকে কাপড় বেঁধে এনেছিলে কেন?

জবাব।—কা—কা—কা—কাপড় আমি—

সওয়াল।—হাঁ, তা হোতে পারে। পুরোহিত তুমি, যজমানের মেয়েটির মুখে কাপড় বাঁধতে তুমি বল নাই, তারাই বেঁধেছিল, এ কথা ঠিক হোতে পারে, কিন্তু তারা কে কে? তিনজন;—একজন জনার্দ্দন, একজন তুমি, আর একজন কে? ঠিক বোলো ঠাকুর! ভয় নাই! ইচ্ছা কোরে তুমি যাও নাই, তোমার ভয় কি? সব সত্যকথা বোল্লেই আমি তোমাকে ছেড়ে দিব, হাকিমের মুখ পর্য্যন্ত তোমাকে দেখতে হবে না। মিথ্যা যদি বল, রাত্ৰিপ্ৰভাতেই তোমাকে আমি হুজুরে চালান কোরবো। খবরদার! মিথ্যা বোলো না। সত্য কোরে বোলে ফেলো, আর একটা লোক কে?

জবাব।—(খালাস পাইবার আহ্লাদে) কু—কু—কু—কুঞ্জবিহারী।

সওয়াল।—কুঞ্জবিহারী সাণ্ডেল?

জবাব।—হিঁ গো।

সওয়াল।—কুঞ্জবিহারী কোথায়?

জবাব।—জানি না।

সওয়াল।—তুমি বোলছে, জটাধর তরফদার গুজরাটে গিয়েছে। অকস্মাৎ গুজরাটে গেল কেন? গুজরাটে তার কি দরকার?

জবাব। জানি না।

সওয়াল।—অমরকুমারীকে কি সঙ্গে নিয়ে গিয়েছে?

জবাব।—জানি না।

সওয়াল।—ব্রাহ্মণ তুমি, পুরোহিত তুমি, সকল কথাই তুমি সত্য বোলছো, এইরূপে আমি বিবেচনা কোচ্ছি; উত্তম, সত্যকথা বোল্লেই বেকসুর খালাস পাবে। আচ্ছা, সত্য কোরে বল দেখি, অমরকুমারী—

বাধা পোড়ে গেল। থানার বাহিরে একটা গোলমাল উঠলো। কি সংবাদ, কি সংবাদ, জিজ্ঞাসা কোত্তে নায়েব-দারোগামহাশয় আসন ছেড়ে উঠছিলেন, উঠতে হলো না, সংবাদ জানবার জন্য লোক পাঠাতেও হলো না, প্রহরীবেষ্টিত তিনজন নূতন বন্দী পুলিশ-প্রাঙ্গণে উপস্থিত।

রাত্রি ৯টা। কে এই তিনজন বন্দী, অগ্রে একটু পরিচয় আবশ্যক। ঘোষালকে আর নবীনচাঁদ নাগকে বন্দী কোরে অনিবার সময় বনমধ্যে আটজন প্রহরী রেখে আসা হয়েছিল, প্রহরীরা আপনাদের বুদ্ধি খাটিয়ে সুড়ঙ্গের তিনটি দ্বার যথাপ্রাপ্ত উপকরণে বন্ধ কোরে দিয়েছিল। ভূতলে পরিভ্রমণ না কোরে বৃক্ষারোহণে প্রচ্ছন্ন থাকে, তাদের প্রতি নায়েব-দারোগার এরূপ আদেশ ছিল, সে আদেশ তারা অমান্য করে নাই। সন্ধ্যার অন্ধকার বনভূমিকে সমাচ্ছন্ন করবার একটু পরেই সেই প্রহরীদের বদলী আর আটজন নূতন প্রহরী থানা থেকে প্রেরিত হয়; সেই আটজন বনস্থলীতে উপস্থিত হবার অগ্রে পাঁচ সাতজন ছদ্মবেশী লোক সেই সুড়ঙ্গের পথে আসে, সুড়ঙ্গ-মুখ অন্বেষণ করে, সেই সময় গাছের উপর থেকে গুড়ম গুড়ম শব্দে দু-তিনবার বন্দুকের আওয়াজ হয়। বৃক্ষারূঢ় প্রহরীরা লম্ফে লম্ফে নেমে পড়ে, পুনরায় বন্দুকের আওয়াজ। যারা সুড়ঙ্গ-পথ অন্বেষণ কোচ্ছিল, তারাও বন্দুকধারী; কিন্তু হঠাৎ বন্দুকের আওয়াজ শুনে তারা যেন হতবুদ্ধি হয়ে যায়, বন্দুকে বন্দুকে যুদ্ধ হওয়া সম্ভব ছিল, চোরেরা সে চেষ্টা পরিত্যাগ কোরে ইতস্ততঃ পলায়নের উপক্রম করে; পাকড়ো পাকড়ো বোলতে বোলতে প্রহরীরা তাদের পশ্চাৎ পশ্চাৎ ধাবিত হয়। চোরেরা অন্ধকারে পলায়ন কোত্তে পাত্তো; কিন্তু সেই সময় বদলী আটজন উপস্থিত হওয়াতে পলায়নের ব্যাঘাত ঘটে। প্রহরী ষোলজন, আসামী সাতজন। প্রহরীরা তাদের সাতজনকেই ঘিরে ফেলেছিল, তখন তারা পশ্চাতে হোটে হোটে বন্দুকের আওয়াজ কোতে কোত্তে খানিকদুর এগিয়ে যায়; চারিজন পালিয়ে গিয়েছে, তিনজন ধরা পোড়েছে; সেই তিনজন এই। গ্রেপ্তারকারী সমাগত প্রহরীদের মুখেই এই সকল বৃত্তান্ত আমরা জানতে পাল্লেম।

এই তিনজনের মধ্যেই একজন কুঞ্জবিহারী সান্ন্যাল। বাকী দুজনকেই আমি চিনতে পাল্লেম না; কুঞ্জবিহারীকেও চিনলেম না, কেবল নাম শুনেই বুঝতে পাল্লেম। ঘোষালের মুখে যতদূর ব্যক্ত হবার, ততদূর ব্যক্ত হয়েছে, যে সকল কথা ঘোষাল বোলতে চায় না, পুলিশের প্রহারে সে সকল কথা পাওয়া যাবে কি না, তাতেও আমার সন্দেহ থাকলো।

নায়েব-দারোগার অনুমতি নিয়ে, কুঞ্জবিহারীকে আমি নিজেই সওয়াল কোত্তে লাগলেম। যে উপলক্ষ্যে এই সকল লোককে ধরা, সেই উপলক্ষ্যটি একটু অন্তরে রেখে, অগ্রেই আমি কুঞ্জবিহারীকে জিজ্ঞাসা কোল্লেম, তুমি বর্দ্ধমানে ছিলে, বর্দ্ধমানেই আমি সে সংবাদ শুনেছিলেম, মুর্শিদাবাদে কেন এসেছ?

কুঞ্জবিহারী উত্তর কোল্লে, “কার্য্যগতিকে কত দেশের কত লোক কত দেশে যায়, সে নিকাশ আমি কি দিব?”

সওয়াল।—নিকাশ তোমাকে দিতেই হবে, আমার কাছে না দাও, যাঁদের কাছে এসেছ, একদিন পরে অথবা দুদিন পরে তাঁদের কাছে সব নিকাশ দিতেই হবে। আজ আমি তোমাকে জিজ্ঞাসা কোচ্ছি, বর্দ্ধমানের সর্ব্বানন্দবাবুকে তুমি চিনতে কি না? সর্ব্বানন্দবাবুর উইলে তুমি সাক্ষী ছিলে কি না?

জবাব।—ছিলেম। তুমি কেন সে কথা জিজ্ঞাসা কর?

সওয়াল।—জিজ্ঞাসা না কোলে উপস্থিত মোকদ্দমার গোড়া ধরা যাবে না, সেই জন্যই ঐ কথাটা আমি আগে জানতে চাই। সাক্ষী তুমি ছিলে। আচ্ছা, উইলখানি তোমার নিজের হাতে লেখা কি না?

জবাব।—সে কথা আমার মনে পড়ে না!

সওয়াল।—উইলের ইসাদী স্থলে যেখানে তুমি নিজ নাম দস্তখৎ কোরেছ, সেখানে তোমার নামের নীচে নবিসিন্দা কথাটা লেখা আছে কি না, তা তোমার মনে পড়ে?

জবাব।—তা যদি মনে পড়ে, তবে উইলখানা আমারই হাতের লেখা, সে কথাও তো মনে পোড়তে পারে। আমিই হয় তো লিখেছিলেম।

সওয়াল।—আচ্ছা, সে উইলে আর কে কে সাক্ষী ছিল?

জবাব।—অতো আমার মনে নাই।

সওয়াল।—আচ্ছা, (ঘোষালকে দেখাইয়া) এ লোকটীকে তুমি চেনো?

জবাব।—চিনি। এই লোকটীও সেই উইলের একজন সাক্ষী।

সওয়াল।—আচ্ছা, উইল যখন লেখা হয়, তখন সর্ব্বানন্দবাবু কোথায় ছিলেন?

জবাব।—কোথায় ছিলেন, আমি কিরূপে জানবো? মোহনবাবু—না না, সর্ব্বানন্দবাবুর জামাইবাবু আমাকে যেমন যেমন লিখতে বলেন, তাই আমি লিখেছিলেম।

নায়েব-দাবোগার সওয়াল, আসামীদের জবাব, আমার সওয়াল, কুঞ্জবিহারীর জবাব, এই সকল জবাবের প্রত্যেক কথাই থানার একজন মুহুরী লিখে নিচ্ছেলেন, কুঞ্জবিহারীর শেষকথাগুলি লেখা হবার পর আর আমি কোন সওয়াল কোল্লেম না। নায়েব-দারোগা সেই সময়-অমরকুমারীর কথা জিজ্ঞাসা কোল্লেন। কুঞ্জবিহারী বোল্লে, “অমরকুমারীর পিতা অমরকুমারীকে কলিকাতায় নিয়ে গিয়েছেন, এই কথা আমি শুনেছি।”

সওয়াল।—কোথা থেকে নিয়ে গিয়েছে, তা তুমি কিছু শুনেছো?

জবাব।—সে কথা শুনবার দরকার ছিল না। বাপের সঙ্গে মেয়ে যায়, কোথা থেকে কোথায় যায়, অপরলোকে সেটা কিরুপেই বা জানবে?

সওয়াল। (আমার ইঙ্গিতে) অমরকুমারীর বিবাহের সম্বন্ধ করবার জন্য বোরাকুলীগ্রামে শান্তিরাম দত্তের বাড়ীতে কখনো তুমি গিয়েছিলে?

জবাব।—আমি?—বিবাহের সম্বন্ধ কোত্তে আমি যাব? আমি হোলেম ব্রাহ্মণ, তারা হলো শুদ্র, তাদের বিবাহের সম্বন্ধে আমি কেন যাব?

সওয়াল।—ঘটক হয়ে গিয়েছিলে, তোমার সঙ্গে আর একজন ছিল, তার নাম জনার্দ্দন মজুমদার, সে জনার্দনকে তুমি চেনো?

জবাব।—পূর্ব্বে জানাশুনা ছিল, এখন আর তার সঙ্গে আমার দেখা হয়।

সওয়াল।—কাশিমবাজারে সুড়ঙ্গের ভিতরে তোমরা কি কর? (অপর দুইজন আসামীকে দেখাইয়া) এরা তোমার কে হয়?

জবাব।—এরা আমাদের সঙ্গে থাকে। আমাদের যিনি কৰ্ত্তা, তিনি আমাদের কাছে যে সকল লোককে এনে দেন, তারাই আমাদের সঙ্গে সঙ্গে বেড়ায়।

সওয়াল।—(ঘোষালকে দেখাইয়া) তোমার এই সঙ্গী লোকটী বোলছিল, অমরকুমারীর পিতা জটাধর তরফদার গুজরাটে চোলে গিয়েছে, তুমি বোলছে কলিকাতায়, কোন কথাটা সত্য?

জবাব।—জটাধরের মুখে যেমন আমি শুনেছি, তাই আমি বোলছি, সত্যমিথ্যার বিচার আমি করি নাই।

সওয়াল।—আচ্ছা, জটাধর যখন কলিকাতায় যায়, তখন সেখানে কোথায় কোন বাড়ীতে থাকে, অমরকুমারীকে কোথায় কোন বাড়ীতে নিয়ে রেখেছে, কোথায় গেলে তাদের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে, সে ঠিকানাটা তুমি বোলতে পার?

জবাব।—কলিকাতায় জটাধরের নিজের বাড়ী নাই, যখন যায়, তখন যেখানে সুবিধা পায়, সেইখানেই বাসা করে, মেয়ে নিয়ে গিয়ে কোথায় রেখেছে, সে খবর আমি বলতে পারি না। কি রকমেই বা জানবো?

নায়েব-দারোগা আসন থেকে গাত্রোত্থান কোরে, চাপরাসীদের দিকে চেয়ে গর্জ্জনস্বরে বোল্লেন, “পাকা ডাকাত! একটাকে ঠাণ্ডা-গারদে দেওয়া গিয়েছে, এই নূতন তিন বেটাকেও ঠাণ্ডা-গারদ দেখাও; আর এই নফরচন্দ্র ঘোষালটাকে হাজত-গারদে নিয়ে রাখ।”

রাত্রি প্রায় ১১টা। আর আমরা সেখানে অধিকক্ষণ অপেক্ষা কোল্লেম না, পাঁচজন আসামী থানার গারদে আটক থাকলো, পরদিন আদালতে চালান হবে, আমরাও আদালতে উপস্থিত থাকবো, এইরূপে অবধারণ কোরে, নায়েবদারোগার কাছে আমরা বিদায় চাইলেম। থানার মুহুরী যে সকল কাগজে সওয়াল-জবাবগুলি লিখে নিয়েছিলেন, নায়েব-দারোগা মহাশয় সেই সকল কাগজে আমাদের দুজনের দস্তখৎ কেরিয়ে নিলেন, আমাদের মোকাবেলায় সওয়াল-জবাব হয়েছিল, সেইটী জানাবার নিমিত্তই আমার আর মণিভূষণের দস্তখৎ দলীলস্বরুপ তিনি রাখলেন। আমরা বিদায় হোলেম।

রাত্রি দুই প্রহরের সময় রজনীবাবুর বাসায় আমরা পৌঁছিলেম। বাসার চাকরদের বলা ছিল, চাকরেরা সজাগ ছিল, আমরা প্রবেশ কোল্লেম। বাবুর সঙ্গে তখন দেখা হলো না, আহারাদি কোরে আমরা শয়ন কোল্লেম। প্রভাতে রজনীবাবুর কাছে সুড়ঙ্গ-সন্ধানের ফলাফল বিজ্ঞাপন কোরে বেলা ১১টার পর আমরা আদালতে উপস্থিত হোলেম। থানার চালানী আসামীরা উপযুক্ত সময়ে হাজির হলো, দস্তুরমত তাদের জবাব লওয়া হলো, কতক কতক কথা থানার কাগজের সঙ্গে মিল্লো, কতক কতক মিল্লো না। মেয়েচুরির এজেহারটা যথার্থ, আদালতের এই বিশ্বাস হলো; বাকী আসামীদের নামে গ্রেপ্তারী পরোয়ানাজারী, মণিভূষণের মানিত সাক্ষীগণের নামে শমনজারী, আসামীদের হাজতবাসের হকুম, সে দিন এই পর্য্যন্ত হয়ে থাকলো। পশুপতিবাবুর নামে চিঠি লিখে, লোক পাঠিয়ে শনিবার পর্য্যন্ত আমরা বহরমপুরেই থাকলেম।

দিন দিন আদালতে যাই, দিন দিন আমরা নূতন নূতন তত্ত্ব জানতে পারি, কিন্তু অমরকুমারী কোথায় আছেন, ঠিক সন্ধান জানতে পারি না। মন বড় অস্থির। অমরকুমারীর সন্ধানের জন্য থানায় থানায় পরোয়ানা গেল, কলিকাতাপুলিশেও সংবাদ দেওয়া হলো, জটাধরের নামে ওয়ারীন বেরলো, মোকদ্দমা ক্রমশই মলতুবী।