» » » ত্রয়োবিংশ কল্প : আমার ভূতের ভয়

বর্ণাকার

ভূবনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়

হরিদাসের গুপ্তকথা
প্রথম খণ্ড

ত্রয়োবিংশ কল্প : আমার ভূতের ভয়

কার্ত্তিকমাসে দুর্গাপূজা হয়ে গিয়েছে, সুতরাং অগ্রহায়ণমাসে রাসযাত্রা। মাঝের রাসের দিন বৈকালে পশুপতিবাবু আমারে বোল্লেন, “হরিদাস, রাস দেখতে যাবে?” রাস কখনো আমি দেখি নাই; কি রকম রাস, রাসে কি কি দেখা যায়, কেহ কখনো আমারে সে কথা বলেন নাই, ছোটবাবুর প্রশ্ন শুনে কৌতূহলে আমি উত্তর কোল্লেম, “যাব।”

মুর্শিদাবাদজেলায় বোরাকুলী নামে একখানি গ্রাম আছে, সেই গ্রামে সর্ব্বেশ্বর চৌধুরী নামে একজন ধনাঢ্য কায়স্থের বাড়ীতে রাসযাত্রা। খুব ঘটা হয়, বাজার বসে, অনেক লোক জমা হয়, অনেক রকম নাচ-তামাসা হয়, রাত্রিকালে আতসবাজী হয়, মহাসমারোহ ব্যাপার। এই সব পরিচয় পেয়ে, বাবুর মত পোষাক পোরে, ছোটবাবুর সঙ্গে অমি রাস দেখতে চোল্লেম। বোরাকুলী গ্রাম যদুপুর গ্রাম থেকে অনেকটা দূরে। উপযুক্ত যানবাহনে রাত্রি প্রায় চারিদণ্ডের সময় সেই গ্রামে আমরা উপস্থিত হোলেম। সৰ্বেশ্বরবাবুর বাড়ীখানি প্রাচীনধরণে বিনির্ম্মিত। রাসোৎসবে বাড়ীখানি মেরামত করা হয়েছে, ফটকে ফটকে রং দেওয়া হয়েছে, ফটকের দু-ধারে মণ্ডলাকারে অনেকগুলি স্তম্ভগাঁথা; মধ্যস্থলে কেয়ারীকরা ফলবাগান; স্তম্ভের মাথায় মাথায় রকম রকম পুতুল বোসেছে, নৃত্যভঙ্গীতে সারি সারি পাথরের পরী দাঁড়িয়েছে, পরীদের দুই হাতে দুটী দুটী কাচের ফানুস, কাচের ফানুসের ভিতর বাতী জ্বোলছে, বাড়ীর বাহিরের বারান্দাতেও নানা বর্ণের বেল-লণ্ঠন সমুজ্জ্বল বাতী; ফটকের পশ্চিমদিকে রাসমঞ্চ; চতুষ্কোণ বেদী, চারিধারে উচ্চ উচ্চ গোলথাম, থামে থামে নানা বর্ণের লতাপাতা কাটা, থামের মাথায় চতুষ্কোণ ছাদ, ছাদের নীচে রক্তবর্ণ চন্দ্রাতপ, সবুজবর্ণের ঝালর; চন্দ্রাতপে হাতী, ঘোড়া, পক্ষী, পদ্মফল আর অনেকগুলি দেবমূর্ত্তি চিত্রকরা। মঞ্চের থামের খাটালে খাটালে ছোট ছোট বেলোয়ারি ঝাড়, ঝাড়ের ফানুস কতকগুলি নীলবর্ণ, কতকগুলি সবুজবৰ্ণ, কতকগুলি গোলাপীবর্ণ, কতকগুলি শ্বেতবর্ণ। সকল ফানুসেই বাতী জ্বোলছে; থামের গায়ে গায়ে জোড়া জোড়া দেয়ালগিরী; মঞ্চের নিম্নভাগে বেদীর উপর বড় বড় পরী, তাদের হস্তেও জোড়া জোড়া লণ্ঠন; অপরুপ শোভা! রাসমঞ্চের দক্ষিণাংশে নহবৎখানা; নহবৎখানার সম্মুখে প্রায় একবিঘা জমীতে বাজার। নানাদেশের নানাদ্রব্য সেই বাজারে বিক্রীত হোচ্ছে; সহস্র সহস্র লোক চতুর্দ্দিকে ভিড় কোরে বেড়াচ্ছে, কোলাহলে চতুর্দ্দিক প্রতিধ্বনিত; দেখতে দেখতে রাত্রি এক প্রহর।

যাদের বাড়ীতে রাস, তাঁদের সঙ্গে পশুপতিবার বেশ সম্ভব। দুই একজনের কাছে তিনি আমার পরিচয় দিয়ে দিলেন, তাঁরাও মিষ্টবচনে আমার সঙ্গে সম্ভাষণ কোল্লেন; আমি তাঁদের নমস্কার কোল্লেম।

রাত্রি দেড় প্রহরের কিছু পূর্ব্বে ঠাকুরের বার। ঘোরঘটায় বিবিধ বাদ্যোদ্যম, সঙ্গে সঙ্গে সঙ্কীৰ্ত্তন, দুধারি রঙমশালের রোসনাই সৰ্ব্বপশ্চাতে ঠাকুরের সিংহাসন;—সিংহাসনের পশ্চাতে ঢালতলোয়ারধারী প্রহরীশ্রেণী।

রাধামূর্ত্তিসহ রাসবিহারীবিগ্রহ শ্রীকৃষ্ণ রাসমঞ্চে এসে বার দিলেন; মঙ্গল উপচারে শীতলসামগ্রী নিবেদনের পর আরতি হয়ে গেল। ভট্টাচার্য্য সবেমাত্র বাম-হস্তের ঘণ্টাটী আসনের কাছে নামিয়েছেন, ঠিক তৎক্ষণাৎ অমনি গড়ম গড়ম শব্দে শত শত ব্যোমবাজীর আওয়াজ আমাদের শ্রুতিগোচর হলো। বাজীক্ষেত্রটা রাসমঞ্চ থেকে শতাধিক হস্ত দূরে। রাসমঞ্চের উপর থেকে আমরা আতসবাজী দর্শন কোত্তে লাগলেম। আকাশমার্গগামী সুন্দর সুন্দর হাউইবাজী, উল্কাবাজী, তারাবাজী, ফুলকাটা বিমানবাজী, মধ্যে মধ্যে বোমধ্বনি;—তা ছাড়া, হাতীবাজী, ঘোড়াবাজী, রাক্ষসবাজী, মল্লবাজী, লড়াইবাজী, তুবড়ীবাজী, চোরকাবাজী, বক্ষে বক্ষে পক্ষীবাজী ইত্যাদি কতরকম বাজী আমি দেখলেম, দেখে দেখে আশ্চর্য্যজ্ঞান হোতে লাগলো; তাদৃশ অগ্নিক্রীড়া পূর্ব্বে কখনো আমি দেখি নাই।

আরো অনেকরকম বাজী আছে, লোকের মুখে সেই কথা আমি শুনলেম, কিন্তু ছোটবাবু আমারে আর বেশীক্ষণ সেখানে রাখলেন না; বেশী রাত জাগলে অসুখ হবে, এই কথা বোলে রাসমঞ্চ থেকে নামিয়ে নিয়ে এলেন। রাসবাড়ীতে অসম্ভব ভিড়, সারারাত গোলমাল, সেখানে নিদ্রা হবার সম্ভাবনা নাই, অতএব তিনি আমারে সঙ্গে কোরে, খানিক তফাতে আর একখানি বাড়ীতে নিয়ে গেলেন। সেই বাড়ীর একটী ছেলের সঙ্গে পশুপতিবাবুর পূর্ব্বাবধি আলাপ ছিল, সেই খাতিরেই সেই বাড়ীতে যাওয়া। সেই বাবুটীও আমাদের সঙ্গে। রাত্রি দুই প্রহর।

বাড়ীখানি একতালা, একমহল, চারিদিকে প্রাচীর, বাড়ীর ভিতর সাত আটটী কুঠরী। রাসবাড়ী থেকে একজন ব্রাহ্মণ সেইখানে আমার জলখাবার দিয়ে গেল, ঠাকুরের প্রসাদ, বিবিধ মিষ্টসামগ্রী ভোজন কোরে একটী কুঠরীতে আমি বোসলেম।

কায়স্থের বাড়ী। বাড়ীর কর্ত্তার নাম শান্তিরাম দত্ত। কর্ত্তার অনেক বয়স হয়েছে, মস্তকের কেশ, ভ্রূ, কর্ণলোম, বক্ষলোম সমস্তই শ্বেতবর্ণ, কিন্তু চলৎশক্তি আছে; ছেলেমেয়ে আট দশটী হয়েছিল, যৌবনে শৈশবে প্রায় সকলগুলি দুরন্ত কালকবলে কবলিত, কেবল একটী পুত্র আর দুটী বিধবা কন্যা বর্ত্তমান। পুত্রটীর নাম মণিভূষণ। সেই মণিভূষণের সঙ্গেই আমাদের পশুপতিবাবুর আলাপ। মণিভূষণ পশুপতিবাবুর সমবয়স্ক, পরিচয় পেয়ে মণিভূষণ আমারে বেশ আদর-যত্ন কোল্লেন। রাত্রে সেই বাড়ীতে আমার শয়নের ব্যবস্থা। আমার আহারের অবসরেই একটী কুঠরীতে শয্যা প্রস্তুত হয়েছিল, বাড়ীতে দাসদাসী নাই, বাড়ীর মেয়েরাই শয্যা রচনা কোরেছিলেন, সেইখানে আমায় শয়ন কোত্তে বোলে, মণিভূষণের সঙ্গে ছোটবাবু; আবার রাসবাড়ীতে ফিরে গেলেন।

গৃহিণীও লোকান্তরগতা। কৰ্ত্তার কন্যারাই সংসারের কাজকর্ম্ম করেন। আমি শয়ন কোল্লেম। শুনেছিলেম, কর্ত্তার বিধবা কন্যা দুটী, কিন্তু আমি যখন আহার করি, তখন একখানি কপাটের আড়ালে তিনখানি মুখ আমি দেখেছি; একখানি হস্তও একবার আমার নয়নপথে পতিত হয়েছিল; সে হস্তে অলঙ্কার আছে। একবার মাত্র দেখা ছায়ামাত্র বোল্লেও চলে; কেন না, একবার ভিন্ন দুবার আমি সেদিকে চাই নাই; নূতন জায়গায় সে রকম চাওয়াও আমার অভ্যাস নয়; কিন্তু হাতখানিতে গহনাও আমি দেখেছি। বিধবার অলঙ্কার থাকে না, তবে সে হাতখানি কার? তৃতীয়া কন্যাটীই বা কে? শয্যায় শয়ন কোরে মনে মনে আমার সেই বিতর্ক।

অগ্রহায়ণ মাস; আমার শয়নঘরের গবাক্ষগুলি বন্ধ। ঘরের ভিতর দিয়ে ঘরে ঘরে যাওয়া আসার পথ, সুতরাং দরজাটী খোলা থাকলো, ঘরে আলো জ্বোলতে লাগলো। আলো জ্বেলে নিদ্রা যাওয়া অভ্যাস নয়, জ্বোলছে তো জ্বোলছে, সে আলো আমি নিৰ্ব্বাণ কোল্লেম না।

একখানি তক্তপোষের উপরে আমার শয্যা; শয্যাতে সরুকাপড়ের মশারিফেলা। আমি শুয়ে আছি। রাত্রি অনেক হয়েছিল, শীঘ্র শীঘ্র নিদ্রা আসাই সম্ভব ছিল, কিন্তু শীঘ্র নিদ্রা এলো না। এক একবার অল্প অল্প তন্দ্রা আসে, আবার তখনি তখনি জেগে উঠি। কেন এমন হয়? ঘরে আলো আছে বোলেই কি নিদ্রা হোচ্ছে না? মনে কোল্লেম, আলোটা তবে নিবিয়ে দিয়ে আসি। মনে কোল্লেম, কিন্তু কেমন আলস্য হলো, উঠলেম না, উঠতে পাল্লেম না, চুপটী কোরে শুয়ে থাকলেম। এক একবার চক্ষু বুজি, এক একবার যেন তন্দ্রা আসে, কি যেন দেখছি, কি হোচ্ছে, কে যেন আসছে, তন্দ্রাবশে এই রকম ভেবে ভেবে আবার চেয়ে চেয়ে দেখি।

অগ্রহায়ণ মাসের রাত্রি, দুই প্রহরের পর অনেক রাত্রি থাকে; আমি যখন শয়ন কোরেছি, তখন রাত্রি প্রায় ইংরেজীমতে একটা; বড়রাত্রি কি না; উষা আসবার তখন অনেক বাকী। ঘুম হচ্ছে না; এক একবার চক্ষু বুজে থাকছি, এক একবার চেয়ে চেয়ে দেখছি। এই ভাবে আরো একঘণ্টা। হঠাৎ একবার চেয়ে দেখি, অর্দ্ধ-অবগুণ্ঠিত একটী স্ত্রীলোক যেন টিপি টিপি সেই ঘরের ভিতর প্রবেশ কোল্লে। মশারির ভিতর ছিলেম কি না, অবয়বটী ঠিক দেখতে পেলেম না,—তন্দ্রাঘোরও অল্প অল্প ছিল, তন্দ্রাঘোরেই স্বপ্ন আসে; মনে কোল্লেম, স্বপ্ন। নেত্রমার্জ্জন কোরে ভাল কোরে চেয়ে দেখলেম, সত্যই একটী নারীমূর্ত্তি নিঃশব্দপদসঞ্চারে অতি মৃদুগতিতে আমার বিছানার দিকে এগিয়ে এগিয়ে আসতে লাগলো; আমার মশারির ধারে এসে দাঁড়ালো; আমি ঘুমিয়ে আছি কি না, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাই যেন অল্পক্ষণ পরীক্ষা কোল্লে; তার পর অল্পে অল্পে সোরে সোরে আমার শিয়রের দিকে তক্তপোষের ধারে এসে আবার দাঁড়ালো। তখনো আমি ভালরকম দেখতে পেলেম না। মূর্ত্তি তখন ক্রমে ক্রমে পায়ে পায়ে তক্তপোষখানা প্রদক্ষিণ কোরে এলো; ঘুরে এসে আবার ঠিক আমার চক্ষের সম্মুখে দাঁড়ালো, সেইবার আমি তার মুখখানি স্পষ্ট দেখতে পেলেম; দেখেই অন্তরে অন্তরে কেঁপে উঠলেম। গাটা যেন ডুলি দিয়ে উঠলো; অকস্মাৎ ভয় পেয়ে, চক্ষু বুজে, দুই হতে দুটী চক্ষু আবরণ কোল্লেম। মনের ভিতর ভয়ের সঙ্গে কতরকম তর্ক-বিতর্ক উপস্থিত হোতে লাগলো, আমার অন্তরাত্মাই তা জানতে পাল্লেন। যদিও সে মুক্তি মশারির বাহিরে, তথাপি বোধ হোতে লাগলো যেন, মশারির ভিতর হাত বাড়িয়ে সে আমারে ধোত্তে আসছে! এইবার তাড়াবো। সাহসে ভর কোরে সেই সময় আবার আমি মুখ থেকে হাত সোরিয়ে সটান নয়ন উন্মীলন কোল্লেম। সে মূর্ত্তি আর তখন সেখানে নাই! তখন আমার প্রাণে যেন কত ভয়। অহো! এই ভবসংসারের কি এই গতি! নিশ্চয়ই ভূত! নিশ্চয়ই অমরকুমারি! অমরকুমারি! আহা! কাশীধামে দেহত্যাগ কোরে, শিবত্ব প্রাপ্ত হয়েও কি তুমি আমারে ভুলতে পাচ্ছো না? পুনরায় ভৌতিক দেহ পরিগ্রহ কোরে এই মুর্শিদাবাদে এই নিশাকালে তুমি আমারে দেখা দিতে এসেছ? কোথায় গেলে? ভয় দেখাতে এসেছিলে? অমরকুমারি! ভূতের ভয় আমি রাখি না, তোমারে দেখে কেন তবে আমার প্রাণে এত ভয়? হায় হায়! অমরকুমারি! তুমি আমারে কত ভালই বেসেছিলে, আমি তোমারে কত ভালই বেসেছিলেম, হায় হায়! সেই ভালবাসা কি এখন ভূতের ভয়ে পরিণত? না না, ভয় আমি কোরবো না, অমরকুমারীকে দেখে ভয় করা, এ কথাটা মনে কোল্লেও আমার চক্ষে জল আসে! অমরকুমারি! তুমি ভূতই হও, প্রেতই হও, পিশাচীই হও, এসো, তোমারে দেখে আমি ভয় পাব না; সাক্ষাৎ দর্শনে অদর্শনে দেবীমূর্ত্তিরূপেই আমি ভাবনা কোরবো। এসো, এসেছিলে যদি, লুকালে কেন? একটীবার দেখা দিয়ে অলক্ষিতে আবার পালালে কেন? চিনেছি আমি তোমারে! অমরকুমারি! অল্পক্ষণ চক্ষের কাছে খেলা কোরে অকস্মাৎ তুমি কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেলে? সেইরূপে আর একবার এসে দেখা দাও!

উদ্দেশে মনে মনে অমরকুমারীকে আমি এই রকম অনেক কথা বোল্লেম, অনেকবার ডাকলেম, অমরকুমারী এলেন না। বিছানার উপর উঠে বিছানা থেকে নামি, ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে অন্বেষণ কোরে দেখি, এইরুপ মনে কোল্লেম, কিন্তু উঠতে পাল্লেম না। ভূতের ভয় অমূলক, আশৈশব এই বিশ্বাস থাকলেও একটা অজ্ঞাত ভয়ে আমি অভিভূত হোলেম। যুধিষ্ঠিরের কথা মনে পোড়লো। কামরুপে যুধিষ্ঠির বোলেছিল, এই মুর্শিদাবাদের এক বাগানের চাঁপাতলায় মূর্ত্তিমান ব্রহ্মচারীরূপী ব্রহ্মদৈত্য দর্শন কোরেছে, আমিও এই মুর্শিদাবাদের এক বাড়ীর একটী ঘরের ভিতর মূর্ত্তিমতী কুলকন্যারূপিণী অমরকুমারীর প্রেতমূর্ত্তি দর্শন কোল্লেম!

সে মূর্ত্তি আর এলো না। শুয়ে শুয়ে প্রায় আধ ঘণ্টা আমি প্রতীক্ষা কোল্লেম, সে মূর্ত্তি দেখতে পেলেম না। ভয়কে হৃদয়ে ধারণ কোরে, মনে মনে আবার আমি ডাকলেম, অমরকুমারি! কোথায় তুমি গিয়েছ? এসো, আর একটীবার দেখা দাও! আমারে সঙ্গে কোরে নিয়ে চল! যেখানে তুমি গিয়েছ, সেইখানেই আমি যাব! বীরভূমের রাক্ষসকুটীরে তোমাতে আমাতে কদিন যেমন সুখে ছিলেম, চিরদিন চির-শান্তিধামে দুজনে আমরা সেইরকম সুখে থাকবো। এসো, দেখা দাও! দেখা দাও! নিয়ে চল! নিয়ে চল! তুমি আমারে শান্তিধামে নিয়ে চল!

দরজার দিকেই আমি চেয়ে আছি। চক্ষের পলক পোড়ছে না, বিলম্বে একটী একটী নিশ্বাস পোড়ছে, সটান চেয়ে আছি। সেই মূর্ত্তি পুনৰ্ব্বার! এবার দেখলে ভয় পাব না মনে কোচ্ছিলেম, কি জানি, সংসারের ভয়-প্রবাহের কেমন গতি, মূর্ত্তির পুনরাবির্ভাব মাত্রেই আতঙ্কে আমার সৰ্ব্বশরীর রোমাঞ্চিত! মূর্ত্তির গতি এবারে আর মৃদু নয়, হংসগতিতে নিঃশব্দে দ্রুত দ্রুত; মূর্ত্তি এবার আর সতর্কভাবে দাঁড়িয়ে শয্যাসমীপে প্রতীক্ষা কোল্লে না, শয়নাসনটী প্রদক্ষিণও কোল্লে না, সরাসর নিকটে এসে, ধীরে ধীরে মশারিটী একটু তুলে, ভিতরদিকে মুখ বাড়িয়ে, আমারে সম্বোধন কোরে চুপি চুপি বোল্লে, “ঘুমিয়েচো হরিদাস?” চোমকে উঠে, এত হাত তফাতে সোরে গিয়ে চক্ষু বুজে আমি কাঁপতে লাগলেম। মুর্ত্তি আমারে পুনরায় জিজ্ঞাসা কোল্লে, “আমারে দেখে তুমি কি ভয় পেয়েছ? আর একবার আমি এসেছিলেম, তা কি তুমি জানতে পেরেছিলে? ও কি। তুমি কাঁপচো কেন?” এই প্রশ্নের সঙ্গে সঙ্গে আমার বক্ষঃস্থলে করষ্পর্শ অনুভব কোরে, সহসা আমি বিস্ময়সাগরে নিমজ্জিত হোলেম। এ কি! ভূতের স্পর্শ এমন কোমল, ভূতের কণ্ঠস্বর এমন সুমিষ্ট, এটা তো কল্পনাতেও আসতে পারে না; বিশেষতঃ অমরকুমারী যখন বেঁচে ছিলেন, অমরকুমারীর কণ্ঠস্বর তখন যেমন মধুমাখা ছিল, এ যে শুনি ঠিক তাই। তবে কি অমরকুমারী বেঁচে আছেন? কাশীধামে অমরকুমারীর শিবত্বপ্রাপ্তির কথাটা তবে কি মিথ্যা? মিথ্যা হওয়াই সম্ভব! মোহনলালের একটা কথাও যেন সত্য বোলে বোধ হয় না। অমরকুমারীর অমঙ্গল-সংবাদটা নিশ্চয়ই মিথ্যা। আমার পাশ্ববৰ্ত্তিনী সুন্দরীই সত্য সত্য সজীব অমরকুমারী! আনন্দের সঙ্গে, বিস্ময়ের সঙ্গে, সাহসের সঙ্গে, অন্তরে আমার পূর্ণ-শান্তির উদয় হলো, আনন্দাশ্রুতে বক্ষঃস্বল অভিষিক্ত হয়ে গেল, বোধ হলো যেন, আমি তখন শান্তিজলে স্নান কোল্লেম; পূর্ণানন্দে পর্ণ-উৎসাহে শয্যার উপর তখন উঠে বোসলেম। অমরকুমারীর মুখখানি তখন আমার অতি নিকটেই ছিল, সাশ্রুনয়নে চেয়ে দেখলেম, অমরকুমারীর পদ্মনেত্ৰদুটীও অূশ্রুপূর্ণ। কম্পিতকণ্ঠে জিজ্ঞাসা কোল্লেম, “অমর! সত্যই কি তুমি অমর?”

নেত্রমার্জ্জন কোরে, একটু মদৃ হেসে, অমরকুমারী বোল্লেন, “হাসালে হরিদাস, হাসালে! বড় দুঃখে আজ তুমি আমারে হাসালে! অমর কি মিথ্যা হয়?”

কথাগুলি বোলতে বোলতে অমরকুমারী অতি অনুপমভঙ্গীতে বিছানার উপর উঠে বোসলেন; বিকসিতনেত্রে আমার মুখপানে চাইতে চাইতে ঠিক আমার মুখের কাছে এসেই বোসলেন; মুখখানি আরো নিকটে এনে, অন্ধমৃদু হাস্যে সুরঞ্জিত কোরে, স্বভাবসিদ্ধ মধুরকণ্ঠে বল্লেন, “দেখ দেখি ভাল কোরে, সত্য অমর কি মিথ্যা অমর?”

আমিও বিকসিতনেত্রে দর্শন কোল্লেম, ঠিক সেই! কিছুমাত্র রুপান্তর হয় নাই! বিস্ময়ের উপর আমার মনে তখন আরো অধিক বিস্ময়। ভেলুয়াচটীতে অগ্নিকুণ্ড থেকে উদ্ধার, মোহনবাবুর সঙ্গে সাক্ষাৎ, মোহনবাবুর বাক্য, মোহনবাবুর সঙ্গে বিবাহ, প্রয়াগধামে যাত্রা, কাশীর রসিক পিতুড়ীর বাড়ীতে কুমারী-ভোজনোৎসবে দর্শন, তার পর মোহনবাবুর সঙ্গে কাশীতে আগমন, জ্বরবিকার, শিবত্বপ্রাপ্তি, আগা-গোড়া সেই সব কথা একে একে অমরকুমারীকে আমি শুনালেম। শুনে শুনে অমরকুমারী কিয়ৎক্ষণ অচলা প্রতিমার ন্যায় নিস্পন্দ নিৰ্ব্বাক হয়ে থাকলেন; অগ্রহায়ণমাসের শেষরাত্রের শীতেও কপালে দরদরধারে ঘাম ঝোরতে লাগলো। স্তম্ভিতবদনে খানিকক্ষণ সামলে, বসনাঞ্চলে ঘর্ম্ম মাৰ্জ্জন কোরে, সুশীলা বালিকা তখন চমকিতকণ্ঠে বোল্লেন, “এ কি হরিদাস! তোমার কি রকম কথা? এ সব কথার বাষ্পও তো আমি জানি না! নানা জায়গায় ঘুরে ঘুরে তুমি কি পাগল হয়ে গিয়েছ? আচ্ছা, তুমি বোসো, আসছি; বাড়ীর সকলে ঘুমচ্চে কি জেগে আছে, দেখে আসি; বিলম্ব হবে না, এখনি ফিরে আসবো; তুমি বোসা,—শয়ো না।”

অমরকুমারী অন্যঘরে গেলেন, একটু পরেই ফিরে এলেন; এসেই উদাসনয়নে আমার দিকে চেয়ে, বিছানায় উঠতে উঠতে চকিতস্বরে বোল্লেন, “না হরিদাস! সে আমি নই!”—এই দুটী কথা বলতে বোলতেই বালিকার নয়নকমলের জলে বদন-কমল ভেসে গেল! বিস্ময়ে অবাক হয়ে, শুষ্কনয়নে আমি সেই অশ্রুসিক্ত মুখপানে অনিমেষে চেয়ে থাকলেম। নেত্র মার্জ্জন কোরে পদ্মমুখী আবার বোলতে লাগলেন, “না হরিদাস, সে আমি নই! তোমারে পূর্ব্বে আমি বোলেছিলেম, হয় তো তোমার মনে থাকতে পারে, আমার একটী দিদি ছিল। যাঁরে আমরা এতদিন বাবা বোলে জানতেম, সেই হতভাগা লোকটা আমার দিদিকে ঝাঁটাপেটা কোরে, একখানা ন্যাকড়া পোরিয়ে বাড়ী থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল। দিদি আমার ভিকারিণীর মতন পথে পথে কেঁদে কেঁদে বেড়াচ্ছিল, কোথাকার এক মুখপোড়া মোহনবাবু এক জায়গায় তারে ধোরে দেশে দেশে নিয়ে বেড়ায়; শেষকালে কাশীতে নিয়ে গিয়েছিল বিয়েও নয়, সত্য ভালবাসাও নয়, সেরকমের কিছুই নয়;—তোমার কাছে সে দুঃখের কথাটা বলতে এখন আমার বাধাই বা কি, মুখপোড়াটা আমার দিদির কুমারীধর্ম্ম নষ্ট কোরেছিল? দিদি আমার মনের দুঃখে একরকম বিষ খায়,—বিষ খেলেই মানুষ মরে, কিন্তু সেটা সে রকম বিষ ছিল না; বিষ খাবার পর জ্বরের লক্ষণ দেখা দেয়। সেই সময় মুখপোড়ার অগোচরে আমার নামে দিদি ডাকযোগে একখানা পত্র পাঠায়। যারে আমি বাবা বোলতেম, পত্ৰখানা সেই লোকের হাতে পড়ে;—মাতাল মানুষ কি না, এক জায়গায় ফেলে রেখেছিল, আমারে দেয় নাই। একদিন আমি আমাদের বাইরের ঘরের একটা কোণে জঞ্জালের ভিতর সেই পত্ৰখানা কুড়িয়ে পাই; সেই পত্রে দিদির দুর্দ্দশার আগাগোড়া সব কথা লেখা ছিল; নির্জ্জনে গিয়ে পোড়ে দেখি, সৰ্ব্বনাশ!”

এই পর্য্যন্ত বোলে, অমরকুমারী দুই হাতে মুখখানি ঢেকে, হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন, বড় বড় নিশ্বাস পোড়তে লাগলো। বিষাদ-বিস্ময় চেপে রেখে, অনেক রকম সান্ত্বনা কোরে, বুঝিয়ে বুঝিয়ে একটু শান্ত কোরে, করুণবচনে আমি বোল্লেম, শেষের ঘটনা সব আমি জানি। আমিও তখন কাশীতে ছিলেম; মোহনবাবুর সঙ্গে দেখা হয়েছিল, তাঁরই মুখে শুনেছিলেন, তার পরিবারের জ্বরবিকার। আমি দেখতে গিয়েছিলেম; পূর্ব্বেও দেখা ছিল, রুগ্ন-শয্যাতেও সেই চেহারা আমি দেখি। চেহারা দেখে আমার ধারণা হয়েছিল, তুমি। যে দিন মত্যুসংবাদ পাই, সে দিন আমার দুঃখের অন্ত ছিল না; কি করা যায়, ঈশ্বরাধীন কাৰ্য্য, আপনা আপনি কতকটা প্রবোধ পেয়েছিলেম গতস্য শোচনা নাস্তি। এখন আর তুমি কেঁদো না; শেষকথাগুলি আমারে বল। পত্ৰখানা পাঠ কোরে তার পর তুমি কি কোল্লে?”

নিশ্বাস ফেলে, চক্ষের জল মুছে, বিষাদিনী বল্লেন, “তার পর? সেই সময় আমার মায়ের সেই রোগটা অতিশয় বেড়ে উঠেছিল; মনে কোরেছিলেম, একজন লোক সঙ্গে কোরে কাশীতে আমি চোলে যাব, মায়ের পীড়ার জন্য যেতে পারি নাই। হায় হায়! সেই রোগে মা আমার মায়া-মমতায় জলাঞ্জলি দিয়ে, আমারে অকুলপাথারে ভাসিয়ে, জন্মের মত পাপসংসার পরিত্যাগ কোরে চোলে যান! মাতৃহারা হয়ে তিনদিন আমি অন্ন-জল ত্যাগ কোরে অজ্ঞান ছিলেম। তার পর কি হলো, বলি শুন। মায়ের শেষ অবস্থায় যিনি চিকিৎসা কোরেছিলেন, তাঁর পায়ে ধোরে কেঁদে কেঁদে কাশী যাবার জন্য ব্যগ্রতা জানাই, দয়া কোরে তিনি আমাকে কাশীতে নিয়ে যান; অনেক অনুসন্ধানের পর ঠিকানাটা জানতে পেরে সেই সৰ্ব্বনাশের কথা আমি শুনি; জগৎ-সংসার অন্ধকার দেখি; দেশে ফিরে আসবো না, অন্নপূর্ণা-বিশ্বেশ্বরের নাম কোরে কাশীর গঙ্গায় ঝাঁপ দিয়ে দুঃখের জীবনের অবসান কোরবো, এই তখন আমার সংকল্প হয়; দেশে ফিরে আসবে না, কার কাছেই বা আসবো? প্রাণবিসর্জ্জন করাই তখন একমাত্র গতি, এইটীই আমি স্থির ভাবলেম। ভাবলেম বটে, কিন্তু সিদ্ধ হলো না; যিনি আমাকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন, নানা প্রকার প্রবোধ দিয়ে তিনি আমকে এই দেশে নিয়ে এসেছেন। যে বাড়ীতে এখন আমি আছি, তাঁরই এই বাড়ী; তাঁরে আমি পিতা বলি, তিনি আময়ে কন্যার মত স্নেহ করেন, তদবধি এইখানেই আমি রয়েছি। জাতিতে তিনি কায়স্থ, কিন্তু চিকিৎসাবিদ্যা জানেন, বীরভূমে কবিরাজী কোত্তেন, সেই সূত্রেই মায়ের চিকিৎসার জন্য তাঁরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।”

এই সব পরিচয় দিয়ে অমরকুমারী পুনৰ্ব্বার হা-হুতাশে অবিরল অশ্রুবর্ষণ কোতে লাগলেন। আবার নানা প্রকারে সান্ত্বনা কোরে, কথার কৌশলে আমি জিজ্ঞাসা কোল্লেম, “আজ রাত্রে প্রথমে তোমারে এখানে দেখে, প্রেতমূর্ত্তি মনে কোরে আমি ভয় পেয়েছিলেম, সেটা কি তুমি আশ্চর্য্য মনে কর?”

পুনরায় নেত্রমার্জ্জন কোরে অমরকুমারী বোল্লেন, “কিছুই আশ্চর্য্য নয়।— কেন? সে কথা কি তুমি ভুলে গিয়েছ? তোমারে আমি বোলেছিলেম, দিদি আর আমি, দুজনেই আমরা রূপে অভেদ। গঠনে, বর্ণে, অবয়বে কিছুই ভেদ ছিল না। দিদি আমার চেয়ে প্রায় দু-বছরের বড় ছিল, কিন্তু আমার গঠন কিছু দীর্ঘ, দিদি একটু বেঁটে, সেইজন্য মাথায় মাথায় সমান দেখাতো। দিদির নাম ছিল সমরকুমারী, সে কথাও তোমাকে আমি বোলেছি;—দুজনে আমরা এক জায়গায় দাঁড়ালে, কে সমর, কে অমর, চেনা যেতো না; একটীকে রেখে তার বদলে আর একটীকে এনে দিলে কেহই কিছু প্রভেদ বুঝতে পাত্তো না। অভেদ রূপ। গায়ের ছোট ছোট লোমগুলি পর্য্যন্ত, মাথার চুলগুলি পর্য্যন্ত ঠিক একসমান। হায় হায় হায়! দিদি আমার কোথায় গেল!”

পাশকথা পেড়ে তখন আমি কুমারীকে অন্যমনস্ক করবার চেষ্টা কোত্তে লাগলেম। আমার একটা বিষম ভ্রম, বিষম সন্দেহ এত দিনের পর দূর হয়ে গেল। দূরপথে সমরকুমারীকে দেখে বার বার আমি অমরকুমারী মনে কোরেছিলেম, এখানে—এই মুর্শিদাবাদে সজীব অমরকুমারীকে দেখে ভূত মনে কোরেছিলেম, সে দুর্জ্জয় ভ্রমটা আর থাকলে না; ভ্রমের পরিবর্ত্তে, সন্দেহের পরিবর্ত্তে অভাবনীয় আনন্দের উদয়। আনন্দোদয় হলো বটে, কিন্তু অমরের জননীর মত্যু-সংবাদে প্রাণে বড় ব্যথা লাগলো; দুষ্টলোকের চক্রে সমরকুমারী কুলকলঙ্কিনী হয়েছিল, তথাপি সেই অভাগিনীর শোচনীয় মৃত্যু-স্মরণে মন কেমন কাতর হলো। উঃ! মোহনবাবু কি ভয়ঙ্কর লোক! তাঁর গতি-ক্রিয়া দেখে যেরুপ আমি অনুমান কোরেছিলেম, কাশীধামে রমেন্দুবাবুর কাছে যে ভাবে তাঁর চিত্র এঁকেছিলেম, সমস্তই ঠিক! সব আমি বুঝলেম।

রাত্রি প্রায় শেষ হয়ে এলো। গ্রামের মধ্যে মহাসমারোহে রাসযাত্রা, বাড়ীর লোকেরা নিশ্চয়ই সকাল সকাল গাত্রোত্থান কোরবেন। অমরকুমারীর সঙ্গে নির্জ্জনে আর অধিকক্ষণ একগৃহে থাকা ভাল হয় না, অতএব চাঞ্চল্য জানিয়ে আমি বোল্লেম, “অমর! তুমি এখন অন্যঘরে যাও, বাড়ীর লোকেরা যদি আমাদের দুজনকে এক জায়গায় দেখতে পান, আসল তত্ত্ব না বুঝে, অন্য প্রকার সন্দেহ কোত্তে পারেন। ঊষাকাল উপস্থিত, এখন তুমি তোমার আপনার শষ্যায় গিয়ে একটু শুয়ে থাকো।” অমরকুমারী বল্লেন, “সন্দেহ করবার কোন কারণ থাকবে না, এখানে এসে অবধি এ বাড়ীর সকলের কাছে কতবার আমি তোমার গল্প কোরেছি, পরিচয় পেলে সন্দেহ করা দূরে থাকুক, সকলেই বরং তুষ্ট হবেন। আচ্ছা, তুমি বোলচো, আমি এখন যাই, কিন্তু আজ তোমার এখান থেকে যাওয়া হবে না; তোমার সঙ্গে আমার অনেক কথা আছে।”

অমরকুমারী গেলেন, শয্যার উপর আমি বসে থাকলেম। আমার সঙ্গে অমরকুমারীর অনেক কথা আছে, অমরকুমারীর মুখে এই কথা আমি শুনেলেম; আমার মুখে যদি কেহ শুনে, আমি বোলবো, অমরকুমারীর সঙ্গে আমারও অনেক কথা আছে। অমরকুমারীর কথা অপেক্ষা আমার কথার জোর বেশী। অমরকুমারী বল্লেন, আজ তোমার যাওয়া হবে না। সে অনুরোধটা কি কোরে রক্ষা হয়? আমি তো এখানে স্বাধীন নই, পশুপতিবাবু যদি বলেন, “চল হরিদাস!” দ্বিরুক্তি কোত্তে না পেরে হরিদাস তখনি তখনি পালিত মেষশাবকের ন্যায় তাঁর সঙ্গে সঙ্গে চোলে যেতে বাধ্য হবে। থাকাটা কিরূপে হয়? না থাকলেও তো কথাগুলি শুনা হয় না, আমার কথাগুলিও বলা হয় না।

আমার ভাবনার অবসর না দিয়েই ঊষাসতী চোলে গেলেন; কাননের বৃক্ষে বৃক্ষে সুগায়ক বিহগকুল নানাবিধ রাগিণীতে ঊষাকে বন্দনা কোরে, প্রভাতী গীত আরম্ভ কোল্লেন। যে ঘরে আমি শুয়েছিলেম, সেই ঘরের বাহিরদিকে যত্ন-রোপিত গুটীকতক মল্লিকাফুলের গাছ ছিল, ঊষার শিশিরে পরিষিক্ত হয়ে, সেই গাছগুলি নব-প্রস্ফুটিত মল্লিকাভার মাথায় কোরে, প্রভাত-সমীরণকে মনোহর সুগন্ধ উপহার দিতে লাগলো; গবাক্ষদ্বারগুলি উন্মুক্ত কোরে সেই সুবাস আঘ্রাণে স্বচ্ছন্দমনে আমি সেই নিশা-জাগরণের ক্লান্তি দূর কোত্তে লাগলেম; কাকেরা কা কা রবে চতুর্দ্দিকে আহার অন্বেষণে উড়ে যেতে লাগলো। প্রভাতকাল সমাগত; শিশিরাচ্ছন্ন প্রভাত। যতক্ষণ পূর্ব্বাকাশে নব-প্রভাকর সমুদিত হোলেন, ততক্ষণ পর্য্যন্ত ঘর থেকে আমি বেরুলেম না। গবাক্ষপথে প্রভাতআলোক সন্দর্শনে আমার হাসি এলো। ভূতের ভয়! আমার ভূতের ভয় ভূতকালের গর্ভে নিহিত হয়ে গেল; মনে মনে আমি হাস্য কোল্লেম। সূৰ্য্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে দুটী যুবাপুরুষ গৃহ-প্রাঙ্গণে দণ্ডায়মান;—মণিভূষণ আর পশুপতি।