» » » দ্বাবিংশ কল্প : কৃষ্ণকামিনী

বর্ণাকার

ভূবনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়

হরিদাসের গুপ্তকথা
প্রথম খণ্ড

দ্বাবিংশ কল্প : কৃষ্ণকামিনী

পুজার মঙ্গলাচরণে পুজার পূর্ব্বে আগমনীগীত হয়; পূজাবাড়ীতেও আগমনী আনন্দ বর্দ্ধিত হয়ে থাকে; সম্পর্কীয় নানাস্থান থেকে কুটম্বসাক্ষাতের আগমন হয়। সচরাচর নারী-কুটুম্বিকাই অধিক। দীনবন্দুবাবুর বাড়ীতে প্রায় ২০/২৫টী কুটুম্বিকা এসেছিলেন, পুর্ণিমার পূর্ব্বেই কতকগুলি বিদায় হয়ে গিয়েছেন, কতকগুলি আছেন, শ্যামাপূজার পর শুক্লপক্ষে বিদায় হবেন, এইরূপ অবধারিত। কুটম্বিকাগণের মধ্যে একটী আমাদের বড়বধূঠাকুরাণীর কনিষ্ঠা ভগিনী। সৰ্ব্বদা আমি বাড়ীর ভিতর যাওয়া-আসা করি, পরিবারেরা আমারে দেখে লজ্জা করেন না, নবাগতা কুটুম্বিকারাও অনাবৃতবদনে আমার সাক্ষাতে দেখা দিতেন, আমার মুখের দিকে চেয়ে চেয়ে দেখতেন, আবশ্যক হোলে দুটী একটী কথাও বোলতেন; আবশ্যক হোলে আমিও তাঁদের দুই একজনকে দুটী একটা কথা জিজ্ঞাসা কোত্তেম। যাঁরা চোলে গিয়েছেন, তাঁদের তো কথাই নাই, যাঁরা আছেন, তাঁদের সঙ্গে আমার সেইরকম ভাব। যিনি আমাদের গৃহলক্ষ্মীর সহোদরা, কি জানি কেমন ঘটনা, সেইটীর সঙ্গে আমার কিছু বেশী ঘনিষ্ঠতা। সেটা দেখতে দিব্য সুন্দরী, বর্ণ যেন দুধে আলতা মাখা, মুখখানি যেন পদ্মফুল, চক্ষুদুটী যেন মৃগচক্ষু, ভ্রূযুগল যেন তুলী দিয়ে আঁকা, নাসিকাটী সরল, ঠোঁট-দুখানি যেন বিম্বফলের মত লাল টুকটুকে, গালদুটী পুরন্ত, কাণদুটী ছোট ছোট, কপালখানিও ছোট, মস্তকের কেশ ঘোর কৃষ্ণবর্ণ, পশ্চাতে গুচ্ছে গুচ্ছে আজানুলম্বিত; সম্মুখের কেশাগ্র ঈষৎ কুঞ্চিত, কর্ণের উভয়পার্শ্বে কুঞ্চিত অলক দোদুল্যমান; বাতাসে উড়ে উড়ে সেই কুঞ্চিত কেশগুলি যখন কপালের উপরে এসে পড়ে, কপালখানি তখন প্রায় দেখা যায় না, সে সময় মুখখানি বড় সুন্দর দেখায়; হস্তপদ মোলায়েম, গঠন অতি সুন্দর, কিঞ্চিৎ দীর্ঘাকার, সদা রঞ্জিতবস্ত্র পরিধান করা অভ্যাস; অঙ্গে বিস্তর অলঙ্কার নাই; নাসাগ্রে একটী বড়মুক্তার নোলক, দুকাণে দুটী দুল, গলায় একছড়া দু-নরকরা চিকণ হার, দুহাতে দু-গাছি বালা, পায়ে পাইজোর;—এই পর্য্যন্ত। কণ্ঠস্বর অতি মধুর, কথা কবার সময় চক্ষের পাতাগুলি যেন নেচে নেচে খেলা করে, বয়স অনুমান পঞ্চদশবর্ষ; নাম কৃষ্ণকামিনী।

কৃষ্ণকামিনী অবিবাহিতা কুমারী। বাঙালীর ঘরে পঞ্চদশবর্ষীয়া কন্যা অবিবাহিতা থাকে, এটা একটা অসম্ভব কথা; আশ্চর্য্য বোল্লেও বলা যায়। কারণজিজ্ঞাসু হয়ে কারো কাছে সেই কথা আমি বোলবো, কারণটা কি, সেইটী জানবো, একবার এরূপ ইচ্ছা হয়েছিল, সেরূপ জিজ্ঞাসায় যদি কোন দোষ ঘটে, তাই ভেবে সে ইচ্ছাকে আমি দমন কোরে রেখেছিলেম। দৈবাৎ একদিন একটা কাজের জন্য গিন্নীর ঘরে আমি প্রবেশ কোরেছি, সেদিন ভূতচতুর্দ্দশী শ্যামাপূজার পূর্ব্বদিন। গিন্নীর ঘরে তখন তিনটী প্রতিবাসিনী প্রৌঢ়া রমণী উপস্থিত ছিলেন, একধারে কৃষ্ণকামিনীও চুপটী কোরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। প্রতিবাসিনীদের সঙ্গে গিন্নীর তখন কি সব কথাবার্ত্তা হোচ্ছিল, আমি গিয়ে দাঁড়ালেম, কথায় ভঙ্গ দিয়ে গিন্নী আমারে জিজ্ঞাসা কোল্লেন, “কি হরিদাস? আমারে কি তুমি কিছু বোলতে চাও?”

আমি উত্তর কোল্লেম, “বোলতে কিছু চাই না, বাবু পাঠিয়ে দিলেন, কোথায় তিনি যাবেন, আসতে রাত হবে, নীলরঙের শালের চাদরখানি—”

আর আমারে কিছু বোলতে হলো না; ঠাকুরাণী আমার দিকে চেয়ে একটু হেসে স্বভাবসিদ্ধ মিষ্টবচনে বোল্লেন, “আর বুঝি তিনি লোক পেলেন না? সকল কাজেই হরিদাস;—বড় বড় কাজেও হরিদাস, সামান্য সামান্য ছোটকাজেও হরিদাস; আচ্ছা দাঁড়াও, দিচ্চি।”—আমারে দাঁড়াতে বোলে, একজন প্রতিবাসিনীর দিকে ফিরে, তিনি বোলতে লাগলেন, “ও কথা আর কেন জিজ্ঞাসা কর? আরা কুলীনের মেয়ে, কুল কুল কোরেই দেশের লোকেরা সারা হন,—কি অশুভক্ষণেই যে আমাদের দেশে কুল এসে ঢুকেছে, কুলের কর্ত্তারাই তা বোলতে পারেন। ঘর-বর পাওয়া যায় না; এই আমি,—আমার কথাই বলছি, এই আমি এখন একটা সংসার মাথায় কোরে গিন্নীপনা কোত্তে বোসেছি, আমারই বিয়ে হয়েছিল যোল বছর উতরে গেলে; সে হিসাবে কৃষ্ণা তো এখনো ছেলেমানুষ, ষেটের কোলে এই সবে চোন্দ উৎরে পোনেরোতে পা দিয়েছে, কোথায় যে বিধাতা বর গোড়ে রেখেছেন, বিধাতাই জানেন। কুলের দেবতারা স্কুলের মেয়েদের মুখের দিকে তাকান না, পচা-বসা ফসলের দিকেই তাঁদের ষোলআনা নজর। সময়ে বিয়ে হোলে কৃষ্ণা এতদিনে ছেলে কোলে কোরে ঘর আলো কোত্তো। কোথায় যে বর, কবে যে ফুল ফুটবে, প্রজাপতিই তা জানেন!” বোলতে বলতে আমার দিকে চেয়ে বোল্লেন, “দাঁড়াও হরিদাস, আমি আসছি।”

বোলেই ঠাকুরাণী তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ালেন, ঘরের ভিতরে একটা দরজা খুলে অন্য ঘরে প্রবেশ কোল্লেন। এদিকে আর এক রঙ্গ। দিনের বেলা পদ্মফুল মুদিত হয়ে গেল! দিদির কথাগুলি শুনে শুনে লজ্জাবতী কৃষ্ণকামিনী মুদিতনয়নে অধোমুখী হোলেন, সুন্দর কপোলযুগল সহসা আরক্তবর্ণ ধারণ কোল্লে। কুমারীর সলজ্জ বদনকমলে আমি যেন তখন এক অপরূপ সৌন্দর্য্য দর্শন কোল্লেম। কুলীনের মেয়ের বিবাহের কথাগুলি যাঁরা শুনছিলেন, তাঁরাও কৃষ্ণকামিনীর মুখের দিকে চেয়ে একসঙ্গে একনিশ্বাসে বোলে উঠলেন, “আহা! তা আর হবে না গা, হবেই তো! বয়েস হয়েছে, সব তো বুঝতে পারে, হবেই তো! আহা! বাছার মুখখানি শুকিয়ে গেল! চক্ষুদুটী ছল ছল কোরে এলো! দেখে দেখে আমাদেরই বুক যেন ফেটে যাচ্ছে! কুলীনের কুলের মুখে ছাই!”

আমি দেখলেম, কৃষ্ণকামিনীর মুখখানি আরক্ত, অবনত; নয়ন নিমীলিত; নারীগণ দেখলেন, কৃষ্ণকামিনীর মুখ শুষ্ক, চক্ষ ছলছল! নারীজাতির এইরূপ রঞ্জিত মিথ্যা কথায় বড় আমোদ। কেবল একস্থানেও নয়, এক বিষয়েও নয়, সকল স্থানে সকল বিষয়েই সমভাব। ঐরূপ রঞ্জিতবাক্যে সহানুভূতি আসে না, ফল বরং বিপরীত দাঁড়ায়, রঞ্জনপ্রিয়া রমণীরা সেটা আসলেই বিবেচনা কোত্তে পারেন না।

ঠাকুরাণী ফিরে এলেন, রুমালবাঁধা শালের চাদরখানি আমার হাতে দিলেন। কটাক্ষে কৃষ্ণকামিনীর দিকে চাইতে চাইতে ঘর থেকে আমি বেরুলেম; কটাক্ষনিক্ষেপের সময় অনুভব কোল্লেম, কৃষ্ণকামিনীও বক্রনয়নে দুবার আড়ে আড়ে আমার দিকে চাইলেন।

বেলা প্রায় অবসান। বেশপরিবর্ত্তন কোরে বড়বাবু একটী ভদ্রলোকের সঙ্গে বাড়ী থেকে বেরিয়ে গেলেন। সেইদিন আমি জানতে পাল্লেম, কৃষ্ণকামিনী কি কারণে অত বয়স পর্য্যন্ত অবিবাহিতা। স্ত্রীলোকেরা কৌলীন্যের দোষ দিলেন, আমি তখন কৌলীন্যের ইতিহাস জানতেম না, যথার্থ কৌলীন্যপ্রথা কিরূপ, সে প্রথায় বাস্তবিক দোষ ঘোটতে পারে কি না, বিবাহের যোগ্যবয়সে এ দেশে কন্যাবিবাহে কৌলীন্যপ্রথা বাস্তবিক বাধা দেয় কি না, সে বিচারে আমি এখন অক্ষম। ঘর-বর পাওয়া যায় না, সমস্ত কুলীনের ঘরে যদি এইরূপে গোলযোগ ঘটে, তা হোলে তো কুলীনের মেয়েরা চিরজীবন অনূঢ়া থাকতে পারে, এমন সম্ভাবনা হয়ে দাঁড়ায়, এই বিতর্কটা তখন আমার মনোমধ্যে সমূদিত হলো।

সে বিতর্ক তখন অনর্থক, সুতরাং অন্যকথা আমার মনে আসতে লাগলো। বাড়ীর মেয়েরা সকলেই আমার সঙ্গে কথা কয়, কুটুম্বিকারাও আমারে দেখে লজ্জা করেন না, সকলের কাছেই আমি সপ্রতিভ; কিন্তু কৃষ্ণকামিনীর চক্ষু সর্ব্বক্ষণ যেন আমার দিকে ঘোরে। সৰ্ব্বক্ষণ আমি অন্তঃপুরে থাকি না; যতক্ষণ থাকি, যতক্ষণ দেখাশুনা হয়, ততক্ষণকেই আমি সৰ্ব্বক্ষণ বোলছি। কৃষ্ণকামিনীতে কেমন একরকম যেন নূতনভাব! কৃষ্ণকামিনী লজ্জাশীলা, আমার সঙ্গে যখন দেখা হয়, কথা হয়, তখনো লজ্জা থাকে। লজ্জাশীলা কামিনীদের লজ্জাপ্রকাশের সময় মুখমণ্ডল ঈষৎ আরক্ত হয়, যাদের সঙ্গে লজ্জার সম্পর্ক, হঠাৎ তাঁদের সঙ্গে দেখা হোলে লজ্জাবতীরা ঘোমটা দিয়ে মুখ ঢাকেন, ঘোমটা দিবার অগ্রে শীঘ্র শীঘ্র চক্ষের পাতা দিয়ে চক্ষুদুটী ঢেকে ফেলেন, এই তো লজ্জার লক্ষণ। কৃষ্ণকামিনীর সে প্রকার লজ্জা নয়; আমারে দেখে লজ্জা করবার সম্পর্কও নয়; তাঁর দিদিকে আমি মা বলি; সে সম্পর্কে কৃষ্ণকামিনী আমার মাসী হন; লজ্জা অনাবশ্যক; তথাপি একটু একটু লজ্জা দেখা যায়। কৃষ্ণকামিনী যখন আমার সঙ্গে কথা কন, অধরে তখন অল্প অল্প হাসি থাকে, কিন্তু দৃষ্টি থাকে নীচদিকে; সরাসর আমার মুখের দিকে চক্ষু থাকে না; এই এক প্রকার লজ্জা। আবার দেখি, আমি যখন অন্যদিকে চাই, কৃষ্ণকামিনী তখন সেই বিশালনেত্র বিস্ফারিত কোরে আমার দিকে চেয়ে থাকেন। আড়ে আড়ে সেই ভাবটী আমি দেখতে পাই, জানতেও পারি, অল্প অল্প বুঝতেও পারি। কটাক্ষসন্ধানে কুমারী কৃষ্ণকামিনী একেবারেই অনভ্যস্ত, এমনটীও বোধ হয় না; মাঝে মাঝে এক একবার সেই সুন্দর নয়নে বক্রকটাক্ষও আমি দর্শন করি। কেন তেমন ভাব, ঠিক ঠিক স্থির কোত্তে না পেরে আমারই বরং লজ্জা আসে। আশ্বিন কার্ত্তিক দু-মাস আমি কৃষ্ণকামিনীকে দেখছি, পূজার পূর্ব্বেও দেখেছি, পূজার পরেও প্রায় মাসাবধি দেখে দেখে আসছি; পূৰ্ব্বাপেক্ষা ক্রমশই যেন সে নয়নের বেশী আকর্ষণ অনুভব হোচ্ছে। ভাবটা বড় ভাল নয়; ইদানীং ঐ ভাব দেখে দেখে দিন দিন আমি সতর্ক হোতে শিক্ষা কোচ্ছি;— তফাৎ তফাৎ থাকাই ভাল, মনে মনে এইরূপ সিদ্ধান্ত কোচ্ছি। নিতান্ত আবশ্যক না হোলে কৃষ্ণকামিনীর কাছে আমি যাই না। কৃষ্ণকামিনী যখন একাকিনী থাকেন, তখন আমি সেখানে যেতে সঙ্কুচিত হই, তথাপি অদুরে আমারে দেখলেই কিঞ্চিৎ অধোবদনে, ঈষৎসলজ্জ নয়নে, শান্ত মৃদুগতিতে কৃষ্ণকামিনী আমার কাছে এগিয়ে এগিয়ে আসেন, আমারে একটু অন্যমনস্ক দেখলেই অলক্ষিতে কটাক্ষপাত করেন, বিশেষ কোন কাজের কথা না থাকলেও সুমিষ্টস্বরে দুটী একটী কথা কন, আমার মুখের কোন প্রকার নূতনকথা শুনলেই, হাসির কথা না হলেও, ঈষৎ অবনতমস্তকে মৃদু মৃদু হাস্য করেন। দেখায় ভাল, কিন্তু আমার মনে কেমন একরকম সন্দেহ আসে, অঙ্গ যেন শিউরে শিউরে উঠে; ইচ্ছা কোরেই সেখান থেকে আমি সোরে যাই।

পূর্ব্বে বোলেছি, অজি ভূতচতুর্দ্দশী। আগামী কল্য শ্যামাপূজা। দীনবন্ধুবাবুর বাড়ীতে শ্যামাপূজা হয় না, ব্রহ্মময়ীর মন্দিরেই মহোৎসব হয়। ব্রহ্মময়ীপ্রতিমা প্রস্তরময়ী চতুর্ভুজা কালীমূর্ত্তি; স্বতন্ত্র মৃন্ময়ীমূর্ত্তি নির্ম্মাণ করা হয় না, ব্রহ্মময়ীর নিকটেই পূজা, হোম, বলিদান, ভোগ প্রভৃতি কালীপূজার সমস্ত অঙ্গ সংসাধিত হয়ে থাকে। চতুর্দ্দশীর রজনীপ্রভাতে ব্রহ্মময়ীর মন্দিরে অনেক লোক সমবেত, সকলেই পূজার আয়োজনে ব্যস্ত।

মন্দিরের দুই ধারে সারিবন্দী অনেকগুলি ঘর, বাড়ীর স্ত্রীলোকেরা, প্রতিবাসিনী স্ত্রীলোকেরা বিশেষ বিশেষ উৎসবে সেই সকল ঘরে উপস্থিত থাকেন। ঐ দিন অপরাহ্ণসময়ে তাঁরা সকলেই সেখানে একত্র হয়েছেন। পূজার আয়োজনে, নৈবেদ্যের আয়োজনে, ভোগের আয়োজনে দিনমান কেটে গেল, সন্ধ্যাকালে সহস্র সহস্র দীপমালায় সমস্ত উদ্যান সমুজ্জ্বল করা হলো। দেবীর মন্দির, বাবুদের বৈঠকখানা, অবরোধবাসিনীদের গৃহশ্রেণী, উজ্জ্বল আলোকপ্রভায় সমস্তই যেন রত্নখচিত-স্বর্ণমণ্ডিত দেখাতে লাগলো। বৃক্ষে বৃক্ষেও দীপমালা। অমাবস্যা-রজনী; জোনাকী-পোকার আধিপত্য, অসংখ্য দীপপ্রভায় একটীও জোনাকী তখন দেখা গেল না, বোধ হলো, যেন দীপমালার কাছে পরাস্ত হবার ভয়ে জোনাকীপোকারা তখন সেই বাগান ছেড়ে পালিয়ে গেল।

বাগানে দীপমালা, দেবালয়ে দীপমালা, গ্রামের গৃহস্থালয়ে দীপমালা, মাথার উপর অনন্তনীলাম্বরে অনন্ত দীপমালা; শোভা অপরূপ!

বাবুদের সঙ্গে আমিও দেবালয়ে গিয়েছি, স্ত্রীলোকেরাও গিয়েছেন, দাসীচাকরেরাও গিয়েছে, ক্রমে ক্রমে একে একে নিমন্ত্রিত লোকেরাও দেখা দিচ্ছেন। ঢোল, ঢক্কা, জগঝম্প, সানাই প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্রের বিমিশ্রধ্বনিতে দেবালয় প্রতিধ্বনি হোচ্ছে, মহা সমারোহ ব্যাপার। রাত্রি দশদণ্ড। গুরু-পুরোহিতেরা দেবীপ্রতিমার সম্মুখভাগে বিচিত্র বিচিত্র আসনে উপবিষ্ট হয়ে, তান্ত্রিকমন্ত্রে সঙ্কল্প কোরে, পূজায় বোসলেন; এই সময় আর একবার ঘোরনিনাদে বাদ্যযন্ত্রগুলি বেজে উঠলো, সঙ্গে সঙ্গে শঙ্খধনি হোতে লাগলো।

দশজনের সঙ্গে আলোকমালার শোভা দেখে দেখে উদ্যানের চারিধারে আমি ভ্রমণ কোচ্ছিলেম, প্রকৃতির শোভা অপেক্ষা তখনকার কৃত্রিম শোভা অনেক লোকের চক্ষে মনোমোহিনী বোধ হোচ্ছিল, অকস্মাৎ একটা হাওয়া উঠে উদ্যানের সমস্ত প্রদীপ্ত দীপমালা নির্ব্বাপিত কোরে দিলে! তাদৃশ শোভাময় উদ্যান অকস্মাৎ ঘোর অন্ধকারে সমাচ্ছন্ন! সেই অন্ধকারে আকাশপানে আমি চেয়ে দেখলেম, অকস্মাৎ উৎফুল্ল মানসে মহাতঙ্কের সঞ্চার। অহো! কোথায় সেই নীলাম্বর? নক্ষত্ৰভূষিত সন্ধ্যাকালের সেই নির্ম্মল নীলাকাশ ঘোর কৃষ্ণবর্ণ ঘনঘটায় অন্ধকার,—নিবিড় অন্ধকার! সন্ধ্যাকালের সেই উজ্জ্বল নক্ষত্রমালা সেই নিবিড় অন্ধকারের অন্ধকারগুহায় লুক্কায়িত। মেঘাবৃত অন্ধকার আকাশে ঘন ঘন চঞ্চলা চপলার বিচিত্র খেলা! হাস্যমুখী প্রকৃতিদেবীর বিভীষণ মূর্ত্তি! দুর্জ্জয় বাতাসে উদ্যানের বড় বড় বৃক্ষেরা যেন মাতালের মত মাথা ঘুরিয়ে টোলতে টোলতে বিপর্য্যস্ত হয়ে গেল! গাছের উপর গাছ, ছাদের উপর গাছ, মন্দিরের উপর গাছ, ভয়ঙ্কর দুর্যোগ! লোকেরা কোলাহলশব্দে চীৎকার কোরে অন্ধকারে ইতস্ততঃ ধাবিত হোতে লাগলো! ভয়ানক ঝড়! একটু পরেই মুষলধারে বৃষ্টি! যাঁরা ঘরের ভিতর ছিলেন, ভয়ঙ্কর ঝড়বৃষ্টিতে তাঁরাও অঙ্গকম্পনে জড়সড় হয়ে আর্ত্তস্বরে চীৎকার কোত্তে লাগলেন। সকলের মুখেই দুর্গতিনাশিনী দুর্গানাম। পুরোহিতেরা কম্পিতহস্তে পৈতা জোড়িয়ে ঘন ঘন দূর্গানামজপে প্রবৃত্ত হোলেন। হুলস্থূল ব্যাপার!

“মনি-অমাবস্যা!”—বঙ্গের ইতরশ্রেণীর লোকেরা শ্যামাপূজার অমাবস্যাকে মনি-অমাবস্যা বলে। সেই সকল লোক উন্মত্তের ন্যায় ছুটতে ছুটতে বোলতে লাগলো, “মনি-অমাবস্যার রাত্রে খণ্ডপ্রলয় হয়, আজ তাই হবে! আজ আর কারো নিস্তার নাই! পালা—পালা—পালা!”—সকলেই পলায়নতৎপর। পালিয়েই বা যায় কোথায়? দেবালয়ের মধ্যে যতগুলি ঘর, সবগুলিই জনপূর্ণ, ভোগের ঘরে সকল লোক প্রবেশ কোত্তে পারে না, ক্রমশই ঝড়বৃষ্টির বেগবৃদ্ধি, প্রকৃতির মহাকোপ, বাহিরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সে কোপের বেগ সহ্য করা অতি বলবান পুরুষেরও অসাধ্য; যায় কোথা? বাগানে বাগানেই আরো ঝড়ের দৌরাত্ম্য বেশী। মড়মড় শব্দে ডাল ভেঙে পোড়ছে, গাছের গায়ে গাছ ভেঙে পোড়ছে, গাছে গাছে ডালে ডালে পাতায় পাতায় পথ দুর্গম হয়ে আছে, পথের উপর এক হাঁটু জল দাঁড়িয়ে গিয়েছে, লোকেরা সব যায় কোথায়? ঠিক নাই, তথাপি অনেক লোক ছুটে ছুটে পালাচ্ছে। হুড়াহুড়িতে অন্ধকারে কে কার গায়ে পোড়ছে, কে কারে মাড়িয়ে যাচ্ছে, কে কোথায় আছাড় খাচ্ছে, কেহই কিছু দেখছে না। গাছে গাছে কারো কারো মাথা ঠুকে যাচ্ছে, কেহই ভ্রুক্ষেপ কোচ্ছে না, প্রাণ হাতে কোরে সকলেই ছুটেছে! ভোলা পথে আরো বেশী বিপদ, বেশী ভয়, সেটা যেন তারা ভুলে ভুলে যাচ্ছে। অনেক লোক পালালো, ভিড় অনেকটা পাতলা হয়ে এলো; দীনবন্ধবাবুর গুরুবল, বাগান থেকে যারা পালালো, ঝড়ে তাদের কারো প্রাণহানি হলো না।

ঝাড়া দুই ঘণ্টা ঝড়-বৃষ্টি! রাত্রি দুইপ্রহর অতীত। ক্রমে ক্রমে ঝড়ের বেগ মন্দীভূত, বৃষ্টিও কম হয়ে এলো। রাত্রি দশ দণ্ডের পর পূজা আরম্ভ হয়েছিল, রাত্রি আড়াই প্রহরের পর সাঙ্গ। তিনপ্রহরের সময় ভোগ। যাঁরা উপস্থিত ছিলেন, শেষরাত্রে তাঁরা কিছু কিছু প্রসাদ পেলেন। সকলেই বাবুর বাড়ীর পাল্কী-বেহারা উপস্থিত হলো, প্রায় ঊষাকালে নারীবর্গ সঙ্গে নিয়ে আমরা বাড়ীতে ফিরে এলেম।

এইখানে আমার একটা কথা বলা আবশ্যক। না বোল্লেও চোলতো, কিন্তু অদৃষ্ট ঘটনার সামঞ্জস্য রাখবার জন্য অনিচ্ছা সত্ত্বেও বোলতে হলো। প্রকৃতির যখন মহাকোপ, ঝড়-বৃষ্টির যখন নবযৌবন, সেই সময় ভোগঘরের পাশের একটী ছোটঘরে আমি আশ্রয় নিয়েছিলেম। সে ঘরের সঙ্গে ভোগঘরের কোন সংশ্রব ছিল না; ঘরের একটীমাত্র দ্বার, সেই দ্বারটী ভিন্ন কোনদিকে একটীও গবাক্ষ অথবা ছিদ্র ছিল না। দ্বারে শিকল দেওয়া ছিল, ধীরে ধীরে শিকল খুলে সেই ঘরে আমি প্রবেশ করি। খুব জোর জোর দমকা, ঘরে প্রবেশ কোরেই ভিতরদিকে আমি অর্গল বন্ধ কোরে দিই। একটী কুলঙ্গীতে ছোট একটী লণ্ঠনে মোমবাতী জ্বলছিল, কিন্তু মানুষ ছিল না। আলোটী তবে কেন ছিল, তা তখন আমি জানতে পাল্লেম না; দেয়ালে ঠেস দিয়ে একধারে আমি বোসে থাকলেম। সে রকম ঘরে ঝড়বৃষ্টির শব্দ কিছু কম শুনা যায়, বাহিরে পবনের সঙ্গে প্রকৃতির কি রকম যুদ্ধ হচ্ছিল, সেখান থেকে তা আমি দেখতে পেলেম না, বড় একটা জানতেও পাল্লেম না।

চুপটী কোরে বসে আছি, এমন সময়ে কে একজন এসে দরজার কপাটের বাহিরের দিকে ধীরে ধীরে ঠক ঠক কোরে দুই তিনবার টোকা মাল্লে। আমি সাড়া দিলেম না; মনে কোল্লেম, কে? এই দুর্যোগের সময় এমন নির্জ্জন ঘরের দিকে কে আসবে? কি কোত্তেই বা আসবে? চপ কোরে থাকলেম। আবার টোকা;—সেইরকম সতর্ক-হস্তে ধীরে ধীরে তিনবার টোকা। তথাপি আমি সাড়া দিলেম না। তৃতীয়বার সেইরকম শব্দ। তখন আমি ভাবলেম, যে-ই হোক, ঐ লোক হয় তো ইতিপূর্ব্বে এই ঘরে ছিল, আলো রেখে গিয়েছে, দ্বারে শিকল লাগিয়ে আর কোথাও গিয়েছিল, এখন ফিরে এসেছে; শিকল খোলা, ভিতর বন্ধ, তাই দেখে অবশ্যই ভেবেছে, ভিতরে কেহ আছে। ভোগঘরের সামিলঘর, স্ত্রীলোক ভিন্ন আর কেহ এ ঘরে আসবে, সেটা অসম্ভব, তাই ভেবেই বার বার টোকা দিলে। ভাবতে ভাবতে আমি উঠে দাঁড়ালেম, কপাটের কাছে গিয়ে চুপ কোরে কাণ পেতে থাকলেম; তখন আর ঢোকার আওয়াজ পেলেম না, একটু পরেই আবার টোকা। তখনি আমি ধীরে ধীরে জিজ্ঞাসা কোল্লেম, “কে?”

অতি কোমলকণ্ঠে ধীরে ধীরে উত্তর হলো, “খুলে দাও; আমি।”

স্বরে বুঝলেম, বামাস্বর। বাড়ীর কোন স্ত্রীলোক ভিন্ন আর কেহ এখানে আসবে, এমন ভরসা হবে; নিশ্চয়ই বাড়ীর লোক; তা না হোলে অত চুপি চুপি কথা কবে কেন? মনে এইরূপ স্থির কোরে আস্তে আস্তে দ্বার উদ্ঘাটন কোল্লেম। একটী অবগুণ্ঠনবতী বালিকা। প্রবেশ কোল্লেন;—প্রবেশ কোরেই তৎক্ষণাৎ চঞ্চল-হস্তে দরজাটা বন্ধ কোরে দিলেন। কে এই অবগুণ্ঠনবতী?—প্রথমে বুঝতে পাল্লেম না। চঞ্চল-হস্তে অবগুণ্ঠন উন্মোচন কোরে, একটু হেসে, কোমল মৃদুস্বরে বালিকা বোল্লেন, “হরিদাস! ভারী ঝড়! তুমি এই ঘরে এসেচো, আমি দেখতে পেয়েছিলেম।”

কথা শুনে, মুখপানে চেয়ে, আমি শিউরে উঠলেম, নির্জ্জন ঘরে আমার চক্ষের সম্মুখে কৃষ্ণকামিনী! ক্ষণকাল আমি কথা কোইতে পাল্লেম না; মনে কোল্লেম, দরজা খুলে বেরিয়ে পড়ি। মনে কোরেই দরজার দিকে অগ্রসর হোচ্ছি, আবার একটু হেসে কৃষ্ণকামিনী আমার একটী হাত ধোরে ফেল্লেন; সেইরুপ কোমলস্বরে চুপি চুপি বোল্লেন, “কি কর হরিদাস? কোথা যাও? ভয় পাচ্চো নাকি? ভয় তো বাহিরে, ঘরের ভিতর ভয় কি? বোসো!” দুজনে রয়েচি, কিসের ভয়?—বোসো।”

বালিকার করস্পর্শে আমার সৰ্ব্বশরীর কাঁপছিল, হাত ছাড়িয়ে যদি পালাই, দোষের কথা হবে; এই ভেবে কাঁপতে কাঁপতে পূর্ব্ববৎ দেয়ালের ধারে আমি বোসে পোড়লেম; কৃষ্ণকামিনীও হাসতে হাসতে ঠিক সেইখানে এসে আমার গা ঘেঁসে বোসলেন। সঙ্কুচিত হয়ে আমি একটু সোরে বোসলেম। আবার একটু হেসে আমার মুখের দিকে একটু ঝুকে কুমারী বোল্লেন, “শীত পোড়েছে হরিদাস, বারান্দায় খুব শীত; তাই জন্যে আমি সৰ্ব্বাঙ্গে কাপড় জড়িয়ে ঘোমটা দিয়ে এসেছিলেম।”

আমি নিরুত্তর। আবার একটু সোরে এসে, যেন একটু ভয়ে ভয়ে কুমারী বোল্লেন, “বাপ রে, কি দুষণ! ঝাপটায় ঝাপটায় কাঁপুনি ধোরেছিল! এখনো শীত কোচ্চে। এই দেখ না আমার গায়ে হাত দিয়ে, এখনো আমি কাঁপচি!”

আবার একটু তফাতে আমি সোরে বোসলেম। কুমারীও আবার আমার কাছে সোরে এলেন। আমি যতই সোরে সোরে যাই, কৃষ্ণকামিনী ততই এগিয়ে এগিয়ে আসেন। বড় বিপাকেই ঠেকলেম। একবার আলোর দিকে চেয়ে, আমার মুখের দিকে ফিরে, যেন একটু চমকিতভাবে কুমারী বোল্লেন, “আচ্ছা হরিদাস, তুমি তখন সেখান থেকে পালিয়ে এলে কেন? বলিদানের উয্যুগ হোচ্ছিল, আমরা মন্দিরের ভিতর দাঁড়িয়ে ছিলেম, তুমি এইদিকে ছুটে পালিয়ে এলে, আমি বেশ দেখতে পেলেম। তেমন কোরে পালালে কেন?”

আমি।—বলিদান আমি দেখতে পারি না; ভয়ও হয়, মায়াও হয়।

কৃষ্ণ।—আমারো হয়। সকলে সেখানে ছিলেন, সেই জন্যই ছিলেম, কিন্তু সে দিকে চাইতে পারিনি, ঠাকুরের দিকেই চেয়ে ছিলেম। হাঁ, ভাল কথা। তুমি কি রোজ রোজ সন্ধ্যাকালে এখানে আরতি দেখতে আসো?

আমি।—রোজ পারি না, কাজের ঝঞ্চাটে এক এক দিন ফাঁক যায়।

কৃষ্ণ।—আমি রোজ আসি। যে দিন আমি এসেছি, তার পরদিন থেকে রোজ রোজ আমি দিদির সঙ্গে এসে আরতি দেখে যাই; কেবল চারটী দিন আসা হয় নাই;—পূজার তিন দিন আর বিজয়ার দিন। আরতির সময় মহামায়ার প্রতিমাখানি যেন সজীব সজীব দেখায়, সত্য সত্যই মা যেন জিভ বার কোরে হাসেন। এখন অবধি তুমি রোজ রোজ এসো, বেশ হবে,—দুজনে এখানে আরতি দেখবো, গল্প কোরবো, এক জায়গায় দেখা-শুনা হবে, বেশ থাকবো; রোজ রোজ তুমি এসো।

আমি।—এখানে না এলে কি তোমার সঙ্গে আমার দেখা-শুনা হয় না? বাড়ীতে কি আমার সঙ্গে তোমার কথাবার্ত্তা চলে না?

কৃষ্ণ।—তা চোলবে না কেন? সে কথা বোলচি না; দুটীতে নির্জ্জনে মনের কথা বলাবলি করাতে যতটা আমোদ হয়, বাড়ীর ভিতর পাঁচজনের সামনে ততটা হয় না; মনের সকল কথা খুলে বলা যায় না; কেমন বাধো বাধো ঠেকে, লজ্জা করে।

আমি।— লজ্জা করাই তো ভাল, লজ্জা তোমাদের নারী-জাতির ভূষণ।

কৃষ্ণ।—(কিয়ৎক্ষণ মৌন থাকিয়া) আচ্ছা হরিদাস! একটী কথা তোমারে জিজ্ঞাসা করি, ঠিক বোলো; মা কালী সাক্ষী,—তুমি কি আমারে ভালবাস?

আমি।—তা কি তুমি বুঝতে পার না? তোমারে দেখে অবধি, তোমার মধুর মধুর কথাগুলি শুনে অবধি, তোমার সঙ্গে কথা কোইতে আমি ভালবাসি, তোমারে দেখতে আমি ভালবাসি, তা কি তুমি বুঝতে পার না?

কৃষ্ণ।—বুঝতে আমি সব পারি।

আমি।—তবে জিজ্ঞাসা কোচ্ছো কেন?

কৃষ্ণ।—মানে আছে। ভালবাসা অনেক রকম। আমি তোমারে যেমন ভালবাসি, তুমি আমারে সেইরকম ভালবাস কি না, তোমার মুখে সেইটকু আমি শুনতে চাই।

আমি।—ভালবাসার আবার রকম কি?—এ রকম, ও রকম, সে রকম, অত শত আমি বুঝি না, ভালবাসার বস্তু দেখলেই ভালবাসতে হয়, সোজাসুজি এই তো আমি বুঝি, তার ভিতরে আবার রকম-সকম কি?

কৃষ্ণ।—(মৃদু হাস্য করিয়া) ঐ কথাই তো কথা! আচ্ছা, রোজ রোজ সন্ধ্যাকালে তুমি এইখানে এসো, আমি তোমারে বুঝিয়ে দিব।

আমি।—আচ্ছা কৃষ্ণ, এ গ্রামে তুমি আর কতদিন থাকবে?

কৃষ্ণ।—দিদি যত দিন থাকতে বোলবেন, বাবু যত দিন যেতে না দিবেন, ততদিন আমি থাকবো। আমার এক পিসী এসেচেন, তিনি বলেন, রাসপূর্ণিমার মধ্যেই আমারে নিয়ে যাবেন, আমি কিন্তু যাবো না। এখানে শ্রীপঞ্চমীতে খুব ঘটা হয়, এইখানেই আমি সরস্বতীপূজা দেখবো।

আমি।—(সচকিতে) ঝড়বৃষ্টি হয় তো থেমে গিয়েছে, লোকেরা সব গোলমাল কোচ্ছে; চল আমরা মন্দিরে যাই। আগে তুমি যাও, একটু পরেই আমি যাচ্ছি; দুজনে একসঙ্গে গেলে অন্যলোকে অন্য কিছু সন্দেহ কোত্তে পারে।

কৃষ্ণ।—তা আর কোত্তে হয় না! আমি তো অনেকক্ষণ একাকিনী এই ঘরেই ছিলেম, বাড়ীর মেয়েরা সকলেই তা জানেন। তোমার সঙ্গে যদি আমি বেরিয়ে যাই, কে কি মনে কোরবে?—কে কি মন্দ ভাববে? দরজাটা একটু খুলে আগে একবার দেখ, দুয্যুগটা থেমেছে কি না; যদি থেমে থাকে, একসঙ্গেই দুজনে যাবো।

আমি উঠলেম; ধীরে ধীরে দরজা খুলে দেখলেম, প্রকৃতি অনেকপরিমাণে শান্ত; ঝড়েরও তত বেগ নাই, বৃষ্টির তত জোর নাই; হস্তসঙ্কেতে কৃষ্ণকামিনীকে ডাকলেম। বাহিরের লোকেরা গোলমাল কোরে গৃহগমনের উপক্ৰম কোচ্ছিলেন, অগ্রেই আমি চৌকাঠের বাহিরে পদার্পণ কোল্লেম। শশব্যন্তে আমার একখানি হাত ধরে, আমার মুখের কাছে মুখ এনে সেই সময় কৃষ্ণ কামিনী আমার কাণে কাণে বোল্লেন, “দেখো, ভুলো না, মাথা খাও, রোজ রোজ, কাল সন্ধ্যাবেলা—”

শেষের কথা আর আমি শুনলেম না, দ্রুতপদে মন্দিরের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালেম। কৃষ্ণকামিনী গজগামিনী হয়ে ভোগঘরে প্রবেশ কোল্লেন। যে প্রকারে এই অভিনয়ের উপসংহার হলো, পাঠকমহাশয়কে পূর্ব্বেই সেটা বিজ্ঞাপন করা হয়েছে।

আমরা বাড়ী এলেম। রাত্রি ছিল না, শয্যার সঙ্গে সাক্ষাৎ করা নিষ্প্রয়োজন বোধ হলো; ভাগীরথীসলিলে প্রাতঃস্নান সমাধা কোরে, সকলেই স্ব স্ব কার্য্যে ব্যাপত হোলেন; এই দিন প্রতিপদ। গ্রামের অনেক বাড়ীতে মৃন্ময়ী কালীপ্রতিমার পূজা হয়েছিল, বৈকালে সেই প্রতিমাগুলির বিসৰ্জ্জন। ব্রহ্মময়ীর বিসর্জ্জন নাই, আমরা নিশ্চিন্ত। পরদিন ভ্রাতৃদ্বিতীয়া। পূর্ব্বে বলা হয় নাই, বাবুদের একটী ভগ্নী আছেন, বৎসরের দশমাস তিনি শ্বশুরালয়েই থাকেন, পুজোর পূর্ব্বে পিত্রালয়ে আসেন, ভ্রাতৃদ্বিতীয়ার পরেই চোলে যান। এ বৎসরেও তিনি এসেছেন, পঞ্জিকার নির্দ্দিষ্ট শুভক্ষণে ভাই-দুটীর কপালে তিলকদান কোরে গণ্ডুষমন্ত্রে তিনি গণ্ডুষ দিলেন। বড়বাবু প্রথামত আশীর্ব্বাদ কোল্লেন, ছোটবাবু তাঁর চরণবন্দনা কোরে দস্তুরমত প্রণামী দিলেন। এই উপলক্ষে বাড়ীতে সেদিন দ্বাদশটী ব্রাহ্মণ, দ্বাদশটী সধবা আর দশটী কুমারীকে ভোজন করানো হলো। বলা বাহুল্য, সেই ভগ্নীটী বড়বাবুর অনুজা, ছোটবাবুর অগ্রজা।

প্রতিপদ, দ্বিতীয়া, দুইদিন দুইরাত্রি অতিবাহিত হয়ে গেল। ব্রহ্মময়ীর মন্দিরে এ দুদিন আমি আরতি দেখতে গেলেম না। অঙ্গীকার করি নাই, সুতরাং কৃষ্ণকামিনীর অনুরোধ রক্ষা হলো না বোলে অনুতাপ এলো না। তৃতীয়ার দিন বৈকালে বাবুদের ভগ্নীর শয়নকক্ষে কৃষ্ণকামিনীর সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ। ভগ্নীর দুটী পুত্ত্র, একটী কন্যা। জ্যেষ্ঠ পুত্রটী বয়ঃপ্রাপ্ত, সেটী সঙ্গে আসে নাই; কনিষ্ঠ পুত্রটী পঞ্চমবর্ষীয়; সে একখানি ছবি কোলে কোরে ছবির মুখে চুমো খাচ্ছিল আর ছবির সঙ্গে কথা কোচ্ছিল। কন্যাটী খুব ছোট, ঠোঁটের উপর-নীচে পাঁচটী দাঁত উঠেছে, সেই দাঁতগুলি দেখিয়ে হেসে “হাঁটি হাঁটি পা পা” করে, আধো আধো কথা কয়, নিরবলম্বনে সোজা হয়ে বেশীক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। কৃষ্ণকামিনী তখন সেই মেয়েটীকে কাছে কোরে নিয়ে, হেসে হেসে খেলা দিচ্ছিলেন, আমারে সেইখানে দেখেই সেই হাসি-মুখখানি হঠাৎ ম্লান হয়ে গেল; একবারমাত্র আমার মুখের দিকে চেয়েই ম্লানমুখী বালিকা তৎক্ষণাৎ অধোমুখী হোলেন; বাষ্পবেগে চক্ষুদুটী ছল ছল কোরে এলো। দেখে আমার কিছু কষ্ট হলো। ছোটমেয়েটীর মা তখন সে ঘরে ছিলেন না, তাঁর কাছে আমার দরকার ছিল, ইচ্ছা হোলে কৃষ্ণকামিনীর সঙ্গে দুটী একটী কথা কোইতে পাত্তেম, কিন্তু পাল্লেম না;—নীরবেই প্রবেশ কোরেছিলেম, নীরবেই বেরিয়ে এলেম।

মন কেমন চঞ্চল। কেন এমন চঞ্চল হয়?—কৃষ্ণকামিনীর জন্য?—না, কৃষ্ণকামিনীর জন্য আমার চাঞ্চল্যের বিশেষ কারণ কিছুই ছিল না। তবে কেন?—কৃষ্ণকামিনীর অনুরোধবাক্য রক্ষা কোত্তে পারি নাই, সেইজন্যই কি চাঞ্চল্য? না, সেজন্যও নয়। তবে কি?—আমারে দেখে কৃষ্ণকামিনীর ফুল্ল-মুখখানি ম্লান হলো, পদ্মনেত্ৰ-দুটী বাষ্পপূর্ণ হয়ে এলো, সেইজন্যই আমার চাঞ্চল্য। দুদিন সন্ধ্যাকালে আমি দেবালয়ে যাই নাই, গেলেই কৃষ্ণকামিনীর সঙ্গে দেখা হোতো, তুষ্ট হোতেন;—আমি যাই নাই, কৃষ্ণকামিনীর অভিমান। পূর্ণ চতুর্দ্দশবর্ষীয়া বালিকা, বালিকা-স্বভাবে এরপ অভিমান আসতেই পারে। মনে মনে সঙ্কল্প কোল্লেম, বালিকার সে অভিমান স্থায়ী হোতে দেওয়া ভাল নয়। দোষ কি?—আমার মনে তো কোন প্রকার পাপপ্রবৃত্তি আসছে না,— বাড়ীতে দেখা-শুনা হয়, কথাবার্ত্তা হয়, সকলেই দেখেন, সকলেই শুনেন, কারো মনে মন্দ সন্দেহ আসে না, দোষ কি?—দেবালয়ে দেখা-সাক্ষাতে দোষ কি? অবিবাহিতা নিৰ্ম্মলা বালিকা, মনের ভিতর কোন প্রকার মন্দ মতলব থাকা এ বয়সের ধর্ম্ম নয়। দেবতার মন্দিরে দেখা দিলে বালিকাটী যদি তুষ্ট থাকে, তাতে আমি কেনই বা কৃপণ হই? অকারণে অমন সরলা বালিকার মনে ব্যথা দেওয়াতে বরং পাপ আছে। না, কৃষ্ণকামিনীর প্রাণে আমি ব্যথা দিব না; আজ সন্ধ্যাকালে আমি ব্রহ্মময়ীদেবীর আরতি দেখতে যাব, কৃষ্ণকামিনীর অভিমানটী ঘুচে যায় কি না, দেখবো; যদি কিছু, বদ-মতলবের আভাষ পাই, তৎক্ষণাৎ সোরে দাঁড়াবো। যাওয়াটা আজ অবশ্যই কর্ত্তব্য।

এই আমার তখনকার সঙ্কল্প। দিবাকর অস্তাচলে গেলেন, আকাশে একটী নক্ষত্র দেখা দিল, নক্ষত্রের মাথার উপর তৃতীয়ার তৃতীয়কলা ক্ষুদ্রচন্দ্রমা বক্রাবয়বে উদিত হোলেন, দুর্গানাম স্মরণ কোরে আমি আরতি-দর্শনবাসনায় ব্রহ্মময়ীর মন্দিরে চোল্লেম।

অমাবস্যা-রজনীর মহা ঝটিকার উপদ্রবচিহ্ন উদ্যানভূমিতে—উদ্যানপন্থায় কিছুই দেখলেম না, কিন্তু উদ্যানটী শ্রীশূন্য হয়ে গিয়েছে;—বড় বড় প্রাচীন বৃক্ষেরা শাখাপত্ৰ পরিশুন্য হয়ে শুককাষ্ঠের ন্যায় স্তম্ভকারে দাঁড়িয়ে আছে, ফুলগাছগুলি ভগ্নশাখ হয়ে কুসুমসজ্জাহারা হয়েছে, পতিত বৃক্ষপত্রে সরোবরের জল প্রায় ঢাকা পোড়ে গিয়েছে, মন্দিরের চূড়ার প্রতিষ্ঠিত চক্ৰফলকটী স্থানচ্যুত হয়ে পোড়েছে। শ্রীহীনতার এই সকল চিহ্ন-দর্শনে ঝড়ের নামেও আমি নমস্কার কোল্লেম। কত লোকের ঘর-বাড়ী পোড়ে গিয়েছে, কত লোকের বাগান বৃক্ষশূন্য হয়েছে, রাত্রিকালের ঝড়, কত গরিবলোক নিদ্রিতাবস্থায় ঘরচাপা পোড়ে প্রাণ হারিয়েছে, কত গৃহপালিত অবলাজীব বন্ধনাবস্থায় মারা গিয়েছে, দেবালয়ে দাঁড়িয়ে সেই সব চিন্তা কোরে ঝড়ের নামে আমি নমস্কার কোল্লেম; যে সকল পণ্ডিত প্রকৃতিজ্ঞানপ্রভাবে ঝটিকার মঙ্গলফল কীৰ্ত্তন করেন, উদ্দেশে তাঁদের চরণেও নমস্কার কোল্লেম।

উদ্যানের মধ্যে দুখখানি পাল্কী এলো। কলিকাতায় যেমন দেখেছি, একখানা পাল্কীর ভেতর গুড়ের কলসীর মত পাঁচ সাতটী স্ত্রীলোক, দুটী তিনটী ছেলেমেয়ে নিয়ে গাদাগাদি কোরে বসে সে রকম দস্তুর এখানে নাই; এখানকার বেহারারা একখানি পাল্কীতে দুটীর অধিক স্ত্রীলোক লয় না, স্থূলাঙ্গী হোলে একটীমাত্র গ্রহণ করে। যে দুখানি পাল্কী এলো, এর একখানিতে বাড়ীর গৃহিণী আর ছোট-বৌ, দ্বিতীয়খানিতে বাবুর ভগ্নী আর কামিনী। উৎসবদিনে অনেকেই আসেন, কিন্তু অন্যদিন সকলে আসেন না।

এই দেবালয়ে ঠিক সন্ধ্যাকালে আরতি হয় না, ন্যূনকল্পে রাত্রি চারি দণ্ডের পর আরতি আরম্ভ হয়; স্থিতিও প্রায় চারি দণ্ড। ব্রহ্মময়ীর আরতি দুই দণ্ড, মহাদেবের মন্দিরের আরতি একদণ্ড, আর একটা ক্ষুদ্রমন্দিরে একটী গণেশ আছেন, সেই গণপতির আরতিতেও একদণ্ড সময় লাগে; সৰ্ব্বশুদ্ধ তিন মন্দিরে চারি দণ্ড।

লোকের ভিড় খুব কম। পুরোহিতেরা তিনজন, চাকর দুজন, দাসী একজন, দর্শক পুরুষ আট দশজন, স্ত্রীলোকও আট দশজন। সে রাত্রে আমি যতগুলি দর্শক দেখলেম, তাদেরই সংখ্যা এই।

বাড়ীর মেয়েরা মহাদেবীর মন্দিরে প্রবেশ কোল্লেন, আমিও অল্পক্ষণ মন্দিরের বারান্দায় বেড়ালেম, একটু পরে কৃষ্ণকামিনী একাকিনী বাহির হয়ে এলেন, কেহই তাঁকে নিষেধ কোল্লেন না।

ভোগঘরের শ্রেণীর দক্ষিণধারে সেই ক্ষুদ্র কামরা। সেই কামরার সম্মুখে গিয়ে কৃষ্ণকামিনী দাঁড়ালেন। মন্দিরের সম্মুখে পাঁচ সাতজন স্ত্রী-পুরুষ সময়-প্রতীক্ষায় ঘরে ফিরে বেড়াচ্ছিল, কৃষ্ণকামিনী তাদের দিকে চাইতে চাইতে সেই ক্ষুদ্র কক্ষমধ্যে প্রবেশ কোল্লেন। লোকেরা তাঁরে দেখতে পেলে কি না, আমি সেটা জানতে পাল্লেম না। মন্দিরের বারান্দায় আমি বেড়াচ্ছিলেম, এদিক ওদিক চাইতে চাইতে মৃদুগতিতে নেমে এলেম, কিছুই যেন লক্ষ্য নাই, সেই ভাবে কিয়ৎক্ষণ ইতস্ততঃ কোরে ধীরে ধীরে সেই কক্ষসমীপে গিয়ে উপস্থিত হোলেম। দ্বার অনাবৃত, ঘরে আলো; দেবসেবার বন্দোবস্তর মধ্যে নিত্যনিয়মিত ব্যবস্থা এইরূপ যে, প্রতিদিন সন্ধ্যাকালে দেবালয়ে সমস্ত গৃহে এক একটী আলো দেওয়া হয়, আরতি-অবসানে চাকরেরা সেই আলোগুলি নিৰ্ব্বাণ কোরে দ্বারে দ্বারে চাবী লাগায়।

কক্ষমধ্যে আমি প্রবেশ কোল্লেম। একধারে কৃষ্ণকামিনী জড়সড়। দ্বার অনাবৃত রাখা উচিত বোধ কোল্লেম না, অর্গলবদ্ধও কোল্লেম না, ভেজিয়ে রাখলেম। কৃষ্ণকামিনীর মুখে কথা নাই; সৰ্ব্বক্ষণ যে মুখে মৃদু মৃদু হাস্যরেখা দৃষ্ট হয়, সে মুখে তখন হাসিও নাই। ভাব আমি বুঝতে পাল্লেম। অগ্রেই আমারে কথা কোইতে হলো। দুজনেই আমরা দাঁড়িয়ে আছি। যেখানে আমি, তার তিন হাত তফাতে কৃষ্ণকামিনী। সম্মুখে একটু অগ্রসর হয়ে, কুণ্ঠিতভাবে মৃদুবচনে আমি বোল্লেম, “কৃষ্ণ! আমি তোমার অনুরোধ রক্ষা কোত্তে পারি নাই, তোমার অভিমান হয়েছে, তা আমি বুঝতে পেরেছি।”

মৃদুস্বরে কৃষ্ণকামিনী বল্লেন, “পেরেছ, ভালই হয়েছে, সে কথা শুনে আমি কি কোরবো? কার উপর আমার অভিমান? নিজের উপরেই আমি অভিমান করি, নিজের সঙ্গেই মনের কথা কোই, নিজের সঙ্গেই আমি নিজে বেড়াই, নিজের সঙ্গেই আমি হাসি খেলি, নিজের সঙ্গেই আমার সব!”

আমি।—ওঃ! এখন আমি বুঝেছি! তোমার মত বয়সে বাঙালীর মেয়েদের বিয়ে হয়ে যায়, সকলেই প্রজাপতির অনুগ্রহে এক একটী অন্তরঙ্গ সহচর পায়, তুমি আজিও একাকিনী আছ, অন্তরের সেই দুঃখেই ঐ সব কথা তুমি বোলছো; মনের দুঃখেই তোমার মনে হয়, নিজের সঙ্গেই তোমার সব! কেমন, এই কথা নয়?

কৃষ্ণ।—(অন্যমনস্ক হইয়া) কোন কথা?

আমি।—আমি বোলছি, তোমার বিয়ের কথা! মা সে দিন বোলছিলেন,— তোমার দিদিকে আমি মা বলি, তা তুমি জানো,—মা সে দিন বোলছিলেন, “ঘরবর পাওয়া যায় না, কবে যে ফল ফুটবে, প্রজাপতিই জানেন।” কথাগুলি আমি শুনেছিলেম; তার পর কি শুনেছি, মন দিয়ে শুন; শুনে তোমার আহ্লাদ হবে।

কৃষ্ণ।—(ম্লানবদনে) আর আমার আহ্লাদে কাজ নাই! সেই সব কথা শুনেই আমার আহ্লাদ হয়েছে, আবার আমার কিসের আহ্লাদ?

আমি।—না না, সে রকম নয়; সত্যই আহ্লাদের কথা। কুঁড়ি ধোরেছে, শীঘ্রই ফুল ফুটবে, হয় তো এই অগ্রহায়ণ মাসেই ফুটে যাবে। প্রজাপতি প্রসন্ন হয়েছেন! শীঘ্রই তোমার বিয়ে হবে।

কৃষ্ণ।—(আরক্তবদনে) বিয়ের মুখে আগুন! তোমাদের প্রজাপতিরও মুখে আগুন! একটা কথা রক্ষা কোত্তে পার না তুমি, তুমি আবার প্রজাপতির দোহাই দিতে এসেচ! বিয়ে—বিয়ে—বিয়ে। এ রকম তামাসা কোত্তে তোমায় কে বলে?

আমি।—না না, তামাসা নয়; সত্য সত্যই তোমার বিয়ে। সম্বন্ধ স্থির হোচ্ছে। পিসীমার—বুঝতে পেরেছে?—তোমার দিদির ঠাকুরঝিকে আমি পিসী বলি, পিসীমার বড়ছেলের সঙ্গে তোমার বিয়ে হবে। যাঁদের ঘরে পিসীমার বিয়ে হয়েছে, তাঁরা মস্ত কুলীন, তোমাদের ঘরের মেয়েরা সেই ঘরের ঘরণী হয়, এই কথাই আমি শুনেছি। এ দুদিন তোমার সঙ্গে এখানে আমি দেখা কোত্তে পারি নাই, কার্য্যগতিকে আটকা পোড়েছিলেম, এইমাত্র সে কথা তোমাকে আমি বোলেছি; কাৰ্য্যগতিকটা আর কিছুই নয়, তোমারই শুভবিবাহের সম্বন্ধের মজলীস, ইচ্ছা কোরেই সে মজলীসে আমি উপস্থিত ছিলেম। একরকম ঠিকঠাক হয়ে গিয়েছে, বাবুও রাজী হয়েছেন; একমাসের মধ্যেই—

কৃষ্ণ।—(তাড়াতাড়ি বাধা দিয়া চঞ্চলস্বরে) না ভাই,—না হরিদাস! ও সব কথা তুমি আমার কাছে বোলো না। সত্য যদি তুমি আমার ভাল চাও, মাথা খাও, সত্য কোরে বল, তুমি আমাকে ভালবাস কি না, দেখো ভাই, ছলনা কোরো না, মনের ভাব গোপন রেখো না, আমিও আমার প্রাণের কথা তোমার কাছে খুলে বোলচি, আমি তোমাকে বড্ড ভালবাসি! তুমি ভাই আমার প্রাণের চেয়েও—

আমি।—(বিস্ময়ে চমকিয়া) এ কি কর কৃষ্ণ! তুমি আমারে ভাই বোলছো? তোমার দিদিকে আমি মা বলি, সে কথাটা কি তুমি ভুলে যাচ্ছ? সে সম্পর্কে তুমি আমার মাসী হও; মাসী কি কখনো—

কৃষ্ণ।—(চঞ্চলা ভঙ্গীতে হস্তসঞ্চালন করিয়া) না ভাই না, ও সব সম্পর্কের কথা তুমি ছেড়ে দাও; কাজের কথা বল। বার বার যে কথা আমি জিজ্ঞাসা কোচ্ছি, মন খুলে সেই আসলকথার উত্তর কর। সত্য সত্য তুমি আমাকে আমার মতন ভালবাস কি না?—আমার মনের মতন ভালবাসতে তুমি ইচ্ছা কর কি না? বল ভাই বল, মা কালীগঙ্গার দিব্যি, অকপটে সত্য বল ভাই! তুমি আমারে—

বিস্ময়ে-আতঙ্কে দারুণ সংশয়ে আমি তখন অসাবধান ছিলেম, অন্যমনস্ক হয়ে ঘন ঘন দরজার দিকে চাইতেছিলেম, অবসর বুঝে কৃষ্ণকামিনী ঐ সব কথা বোলতে বোলতে শীঘ্র শীঘ্র এগিয়ে এসে আমার গলা জড়িয়ে আমার দুই কপোল দুই চুম্বন কোল্লেন! আতঙ্কে আমার সৰ্ব্বশরীর রোমাঞ্চিত হয়ে উঠলো! চঞ্চলহস্তে বন্ধন ছাড়িয়ে দ্রুতপদে আমি দরজার কাছে ছুটে আসছি, এমন সময় মন্দিরমধ্যে শখ-ঘণ্টা বেজে উঠলো, সম্মুখের প্রাঙ্গণে ডঙ্কা বাজতে লাগলো, শশব্যস্তে দরজা খুলে সে ঘর থেকে আমি ছুটে বেরুলেম। আরতি হোচ্ছিল, সমাপ্তি পর্য্যন্ত অপেক্ষা কোত্তে না পেরে, মন্দিরের নীচে থেকে ব্রহ্মময়ীকে প্রণাম কোরে, কোন দিকে না চেয়েই, দৌড়;— এক দৌড়ে বাগান থেকে আমি বেরিয়ে পোড়লেম। কৃষ্ণকামিনী সেখান থেকে কখন বেরিয়ে এলেন, কি কোল্লেন, কিছুই আমি জানতে পাল্লেম না।

রজনীযোগে একাকী আমি একটী গৃহে শয়ন করি। মানুষ একাকী হোলেই চিন্তা করবার উত্তম অবকাশ পায়। এ রাত্রে কৃষ্ণকামিনী আমার চিন্তার সামগ্রী। সন্ধ্যাকালে সেই কাণ্ড হয়ে গিয়েছে, রাত্রি প্রায় দুই প্রহর হোতে যায়, তখনো পর্য্যন্ত আমি সেই কথা মনে কোরে থেকে থেকে এক একবার কেঁপে কেঁপে উঠছি! হলো কি!—ভাবলেম, গতিক দেখছি আর একরকম! কৃষ্ণকামিনী উচক্কা বয়সের লক্ষণ দেখাতে অভিলাষিণী, প্রকৃতি চঞ্চলা দেখায় না, ধীরা—সুধীরা দেখায়; অবিবাহিতা কুমারী, নির্দ্দোষ, নিষ্কলঙ্ক, নির্ম্মল—কুমারীভাবে এই বিশেষণগুলি ঠিক থাকাই ভাল; কৃষ্ণকামিনী কুমারীস্বভাবের সে পবিত্রতাটুকু রাখতে পাচ্ছেন না। সরলা নির্ম্মলা বোলেই আমি ততটা ঘনিষ্ঠতা কোচ্ছিলেম, এখন দেখছি, বিপরীত দাঁড়ায়!—এ সব কথা কিছুই ভাঙবো না, শীঘ্র শীঘ্র মেয়েটার বিয়ে দেওয়া কৰ্ত্তব্য, বড়বাবুকে আমি এই কথা বোলবো।

এইরুপ আমার চিন্তা। সে চিন্তা ভবিষ্যৎ; আমি এখন করি কি? অন্তঃপুরে যাব না, কৃষ্ণকামিনীর সঙ্গে কথা কব না, কৃষ্ণকামিনীকে দেখা দিব না, সেটাও তো ভাল কথা নয়; হঠাৎ সে রকম ভাবান্তর দেখালেই দোষ হবে; সকলেই এক এক প্রকার সন্দেহ কোরবেন। সেইরূপ সম্ভাবিত সন্দেহক্ষেত্রে যদি আমি বড়বাবুর কাছে কৃষ্ণকামিনীর বিয়ের কথা তুলি, তা হোলে সে সন্দেহটা আরো বাড়বে না, ভাবান্তর দেখানো হবে না, যেমন আছি, তেমনই থাকবো; সকলের সঙ্গে যেমন মুখের কথায় সদ্ভাব রেখে আসছি, কৃষ্ণকামিনীর সঙ্গেও সেইরুপ মৌখিক সদ্ভাব রাখবো; ভাবান্তর দেখানো হবে না। দেখাতে গেলেই হয় তো আর একখানা দেখাবে। স্ত্রী-চরিত্র দেবতারাও বুঝে উঠতে পারেন না; কৃষ্ণকামিনী বালিকা হোলেও স্ত্রী-চরিত্রের সীমা-বহির্ভূতা হোতে পারেন না। চতুরতার সঙ্গে খলতার যোগাযোগ আছে; চতুরা স্ত্রীলোক নিজে দুষী হয়েও, আশাভঙ্গে নির্দ্দোষ পুরুষের নামেও কলঙ্ক রটায়। আশাভঙ্গে কৃষ্ণকামিনী যদি সেই পন্থা অবলম্বন করেন, তা হোলে আমি আর এখানে লোকের কাছে মুখ দেখাতে পারব না;—ধর্ম্মের কাছে অপরাধী হব না, কিন্তু মানুষের কাছে মুখ তুলে কথা কোইতে আমার ভয় হবে; লজ্জা তো হবেই, ধরা কথা, মানুষেরা আমাকে ঘৃণা কোরবে। কাজ নাই, সে রকম স্বতন্ত্রতা দেখিয়ে কাজ নাই; যেমন আছি, যেমন বেড়াচ্ছি, সদরে অন্দরে সকলের কাছে যেমন ভাব দেখাচ্ছি, ঠিক ঠিক সেই ভাব বজায় রাখবো; আমার মনের ভাব কেহই কিছু জানতে পারবে না, কাহাকেও কিছু জানতে দিব না। কৃষ্ণকামিনীকে প্রশ্রয় দিব! দেখি— দেখি, বালিকাবুদ্ধি আমার বুদ্ধির উপর জয়লাভ কোত্তে পারে কি না।

নৈশ-চিন্তার উপদেশে এই সঙ্কল্পই আমার পাকা। রজনীপ্রভাত হলো, কৰ্ত্তব্যকার্য্যে মনোনিবেশ কোল্লেম, সময়মত অন্দরমহলে গেলেম, যার সঙ্গে যে রকম কথা আবশ্যক, সেরকম কথাবার্ত্তা কোইলেম। কৃষ্ণকামিনীর সঙ্গে দেখা হলো।

নিত্য নিত্য যেরুপ ভাব, সেই ভাবে একটু হেসে, কৃষ্ণকামিনী একটা ঘরের দিকে চোলে গেলেন। আমি মনে কোল্লেম, ও হাসিটা লজ্জার হাসি; গত রাত্রে মনের চাঞ্চল্যে একটা অন্যায় কাজ কোরে ফেলেছেন, তার পর সেটা বুঝতে পেরেছেন, সেইজন্যই লজ্জা এসেছে, ঐ হাসিতে সেই লজ্জার পরিচয় দিলেন, সেইজন্যই আমার সম্মুখে অধিকক্ষণ দাঁড়াতে পাল্লেন না, অন্যঘরে চোলে গেলেন।

ও পরমেশ্বর! তা নয়! আমার সিদ্ধান্ত অমূলক! সেই ঘরে প্রবেশ কোরে, কপাটের আড়াল থেকে মুখ বাড়িয়ে, হাতছানি দিয়ে কৃষ্ণকামিনী আমাকে ডাকলেন। স্ব স্ব কার্য্যে ব্যস্ত হয়ে মেয়েরা সকলেই তাড়াতাড়ি এঘর ওঘর কোচ্ছিলেন, দিনের বেলা, আমার প্রতি কেহই কোনরুপ সন্দেহ রাখেন না, আমিই বা তখন ইতস্ততঃ কেন কোরবো, কৃষ্ণকামিনীর সঙ্কেতে সেই ঘরের দিকে আমি চোলে গেলেম, ঘরের ভিতর প্রবেশ কোল্লেম। কপাটের কাছ থেকে সোরে এসে ঘরের একধারে দাঁড়িয়ে, করতালি দিয়ে খিলখিল কোরে হেসে, কামিনী যেন উন্মাদিনীর ন্যায় বোলে উঠলেন, “কেমন হরিদাস! কেমন! দেখলে তো! কেমন ভালবেসেচি! তুমি কি আমাকে ঐ রকম ভালবাসতে পার?”

কৃষ্ণকামিনীর মুখে হাত চাপা দিয়ে চঞ্চলস্বরে চুপি চুপি আমি বোল্লেম, “চুপ কর মাসি, চুপ কর! সকলে ওখানে রোয়েছেন, শুনতে পাবেন, তোমার মনে মন্দভাব নাই, তা হয়তো তাঁরা বুঝবেন না, কত কি গালাগালি কোরবেন, সেটা কি ভাল? আমাদের সরল প্রাণ, তুমি আমারে ভালবাস, আমি তোমারে ভালবাসি, সকলেই দেখতে পান, মুখে ততটা পরিচয় দেওয়া কেন? বয়সে সমান হোলেও তুমি আমার মাসী, আমি তোমার ছেলের মতন; ছেলের মুখে হামু খেয়েছ, বেশ কোরেছ। ছেলের মুখে কে না হামু খায়? বেশ কোরেছ! সে পরিচয় আবার লোকে শুনবে কি? এখন সদরবাড়ীতে একটী কাজ আছে, আমি এখন চোল্লেম, আবার সময়মত দেখা হবে।”

দরজা পর্য্যন্ত এসে, আবার ফিরে গিয়ে পূৰ্ব্ববৎ চুপি চুপি আমি বোল্লেম, “দেখ কৃষ্ণ, রোজ রোজ সন্ধ্যাকালে ঠাকুরবাড়ীতে দেখা করা সেটা বড় ভাল নয়। কেন, ঠাকুরবাড়ী না হোলে কি তোমাতে আমাতে দেখা-সাক্ষাতের আর স্থান নাই? সৰ্ব্বক্ষণ আমি বাড়ীতে আছি, তুমিও আছ, যখন ইচ্ছা, তখনি আমি দেখা কোত্তে পারি, যা যা তুমি বল, তারও ব্যবস্থা কোত্তে পারি, কি আমি না পারি? যেদিন সুবিধা হবে, সকলে যেদিন যাবেন, সেই দিন হয় ঠাকুরবাড়ীতে দেখা করা যাবে, রোজ রোজ ঠাকুরবাড়ীতে সুবিধা হবে না, সুবিধা হোলেও সেটা ভাল দেখাবে না; বুঝলে কি না? মনে মনে বা তুমি ভাবো, যা তুমি আমারে বোলবে বোলবে মনে কর, তা আমি বুঝতে পেরেছি, কাল সন্ধ্যার পর তার একটু আভাষও তোমারে আমি দিয়ে রেখেছি, আজ আবার বড়বাবুকে সেই কথাটী বিশেষ কোরে বোলবো ভেবে রেখেছি। তুমি ভেবো না; এক মাসের মধ্যেই তোমার বিয়ে হয়ে যাবে।”

শেষকথাটী বোলেই দ্রুতপদে আমি ঘর থেকে বেরিয়ে এলেম। কৃষ্ণকামিনীর মুখে উত্তর শুনবার প্রতীক্ষা কোল্লেম না।

তদবধি আমি রক্ষাকবচ ধারণ কোল্লেম। কৃষ্ণকামিনীর সঙ্গে সময়ে সময়ে আমি দেখা করি, হাসি খেলা করি, সমানভাবে ভালবাসা জানাই, কৃষ্ণকামিনী মুখ ফুটে যা যা বলেন, সমানভাবে তাতেই আমি সায় দিয়ে যাই, কিছুতেই কিছু ব্যতিক্রম ঘটে না। সমস্তই কিন্তু ছাড়া ছাড়া ভাব। ঠাকুরবাড়ীতেও দেখা হয়, বাড়ীতেও দেখা হয়, কৃষ্ণকামিনীর আদর-বিলাসে এক একবার আমি হাস্য করি, এক একবার মুখ বুজে থাকি, কৃষ্ণকুমারী খুসী থাকেন। পূর্ণিমা পর্য্যন্ত এইরূপ ভাব চোলতে লাগলো।