ভূবনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়
হরিদাসের গুপ্তকথাপ্রথম খণ্ড
অষ্টম কল্প : সব নূতন
>ভূমিষ্ঠ হবার পর ক্রমশঃ জ্ঞানোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে শিশু যেমন জগৎসংসারের সমস্ত পদার্থই নূতন দেখে, বর্দ্ধমানে সর্ব্বানন্দবাবুর পবিত্র আশ্রমে আশ্রয় পেয়ে আমিও সেইরূপ সমস্ত পদাথই নূতন দেখতে লাগলেম। যা দেখি, সমস্তই নূতন; যা যা শুনি, আমার কর্ণে সমস্তই নূতন। এক বর্দ্ধমানেই নূতন জগৎ। সব নূতন। কর্ত্তার অনুমতি নিয়ে মধ্যে মধ্যে আমি নগরদর্শনে বাহির হই। এক একদিন এক একজন লোক সঙ্গে থাকে, এক একদিন আমি একা। নগরের পথ, ঘাট, দোকান, পসার, বাজার, লোকালয়, আদালত, একে একে দর্শন করি, সব যেন চমৎকার বোধ হয়। বর্দ্ধমানে এক মহারাজা থাকেন, মহারাজের সম্পদসমৃদ্ধি দেশবিখ্যাত। মহারাজের আসবাবপত্র সমস্তই সুন্দর সুন্দর। একে একে অনেকগুলি আমার দেখা হলো। রাজবাড়ী, রাজগাড়ী, রাজঠাকুর, রাজবাগিচা, রাজবানর, রাজতুরঙ্গ, রাজমাতঙ্গ, রাজমৎস্য, রাজবাদ্য, রাজসিপাহী, রাজসাগর, রাজ-পশুশালা, কৌতুকে কৌতুকে আমি সব দর্শন কোল্লেম। সকলগুলিই আশ্চর্য্য! মহারাজের চেহারা কেমন, অনেক দিন আমি দেখতে পাই নাই; একদিন অপরাহ্ণে জনাকীর্ণ রাজপথে রাজমূর্ত্তি আমি দর্শন কোরেছিলেম। বর্দ্ধমানের মহারাজ। শুনতেও যেমন নামটী জমকালো, চেহারাও তদ্রপ মনোহর; যেমন রূপ, তদুপযুক্ত বেশভূষা, তদপযুক্ত গাড়ী-ঘোড়া, তদপযুক্ত অনুচর-রেসালা। মহারাজকে যুগলহস্তে নমস্কার কোরে সেইদিন আমি আমাকে চরিতার্থ মনে কোরেছিলেম। কমলার কৃপায় মহারাজের সমস্তই পরম সুন্দর।
রাজপথে আমি বেড়াই, দিন দিন কত কি দেখি, সকলগুলির নাম জানি না, কিন্তু দেখে দেখে বড় আমোদ হয়।—না না, বোলতে আমার ভুল হচ্ছে; সকলগুলি দেখে আমোদ হয় না। যেখানে জনতা অধিক, সেখানে ভাল-মন্দ সব রকম দেখা যায়, সুদৃশ্য-কুদৃশ্য, উৎকট বিকট, নানা প্রকার জীবপ্রবাহ নয়নগোচর হয়। মানুষের ভিতর বিকটমূর্ত্তি দর্শন কোরে ভয় হয়। মানুষেরা সৎকার্য্যে যেমন প্রতিষ্ঠাভাজন হয়ে থাকে, দুষ্কার্য্যেরত দুরাচার মনুষ্য তদ্রূপ নিন্দাভাজন হয়।
কেবল এই পর্য্যন্ত ভেদ, এ কথাও বলা যায় না। সৎ-পুরষ দর্শনে মনে যেমন প্রীতি ও সন্তোষের আবির্ভাব হয়, দুষ্টলোক দর্শনে স্বভাবতঃ মনে সেইরপ ঘৃণার উদয় হয়ে থাকে। একটা দৃষ্টান্ত এইখানে আমি পাঠক-মহাশয়কে শুনাই।
একদিন বৈকালে বাজারের কিঞ্চিৎ দূরে একাকী আমি ভ্রমণ কোচ্ছি, এমন সময় দেখি, একটা জায়গায় অনেক লোকের ভিড়। আমি একাকী, এ কথার অর্থ কি? যেখানে অনেক লোক, সেখানে কেন আমি একাকী বলি, এটাও একটা ক্ষুদ্র সমস্যা। গঠনে, চলনে, বর্ণে, কিঞ্চিৎ কিঞ্চিৎ পার্থক্য থাকলেও সকল মনুষ্যই একাকার। দুই হস্ত, দুই পদ, এক মস্তক, এক বক্ষ, এক উদর সবাকার, তথাপি সকল মনুষ্যই ভিন্ন ভিন্ন কার্য্যে ভিন্ন ভিন্ন খ্যাতি লাভ করে। আমার যেমন আকার, ভিড়ের ভিতর সকল লোকের প্রায় সেই রকম। তবে কেন আমি একা?—আমি অপরিচিত, ভিড়ের ভিতর আমার চেনা লোক একজনও ছিল না; পূর্বে কোথাও দেখেছি, এমন একটীও লোক সেই জনতার মধ্যে দেখলেম না; সেই জন্যই আমি একাকী।
কিসের ভিড়? সেই সময় কেহ আমাকে এই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা কোল্লে নিশ্চয়ই আমি বোলতেম, “কি জানি।”—এখন ঠিক উত্তর প্রদান কোত্তে পারি। খোলা জায়গা, ছোট মাঠ, চতুর্দ্দিকে ঘাসবন, একধারে একটা পুকুর; মাঠের ঘাসের উপর মস্ত একটা মশারি ফেলা; মশারির বাহিরে একটা লোক বোসে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে মন্ত্র পোড়ে পোড়ে মস্ত একটা ঘণ্টা বাজাচ্ছে। আমি একটু দূরে ছিলেম, মন্ত্রগুলো কি, স্পষ্ট স্পষ্ট শুনতে পেলেম না, ভিড়ের সমারোহে কৌতুকী হয়ে পায়ে পায়ে নিকটবর্ত্তী হোলেম। তখন সেই মন্ত্রগুলা ঠিক ঠিক আমার কাণে এলো। লোক বোলছে :—
“একখানা গরু।—সাতখানা পা!—তিনখানা পুশ্চ!—দুইখানা মুখ!—এক মুখে খায়, এক মুখে প্রস্রাব করে!—ভগবতীর স্বপ্ন!—দর্শনে সশরীরে স্বর্গবাস!—দর্শনী এক পয়সা।”
মন্ত্র শুনেই আমার চক্ষু স্থির! বিধাতার সৃষ্টির বিষম বিপর্য্যয়। যে লোকটা ঘণ্টা বাজিয়ে ঐরূপ মন্ত্র পাঠ কোচ্ছিলো, সে লোকটার চেহারাও বিষম উৎকট! রং কালো, জোঁদা কালো; গঠন কতকটা দীর্ঘ, নীচের দিকটা হ্রস্ব; হাত-দুখানা মোটা মোটা পা-দুখানা সরু সরু; বুকখানা খুব খোলা; দু-ধারে উঁচু উঁচু দুটো ঢিবি; পেটের মাংস উপরদিকে উঠে সেদিকেও একটা ঢিবি বানিয়ে রেখেছে; মাথা হেঁট কোল্লে বুকের খালায় দাড়ী ঠেকে; দাড়ীতে চুল নাই, অথচ ত্রিকোণ আকারে অনেকটা লম্বা; নাকটা চ্যাপটা; চক্ষদুটো কোটরে বসা, সেই চক্ষু রক্তবর্ণ; ভাল কোরে দেখলে মনে হয় যেন দুটো গর্তের ভিতর দুটো জবাফুল ঘুরছে; কপালখানা প্রায় আধ হাত চওড়া; কাণের দিকে কিছুই নাই; মাথাটা নেড়া, কিন্তু খুব ডাগর : ঘাড় আছে কিনা অনুভব করা যায় না; বয়স আন্দাজ ৪০/৪২ বৎসর।
লোকটার চেহারাও আমি নূতন দেখলেম, মন্ত্রগুলো নূতন শুনলেম। ভিড়ের লোকেরা এক এক পয়সা দর্শনী দিয়ে সশরীরে স্বর্গলাভের আশায় একে একে মশারির ভিতর ঢুকে সেই অদ্ভুত গরু দর্শন কোরে এলো। আমার প্রবৃত্তি হলো না, স্বর্গবাসের বাসনাও ছিল না, আমি গেলেম না : খানিকক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফিরে এলেম। লোকটাকে চিনে রাখলেম। কে যেন আমাকে বোলে দিলে, এ লোকের অসাধ্য দুষ্কার্য্য কিছুই নাই।
মন কেমন অস্থির হলো। সে দিন আর অন্য কিছু দর্শন করবার ইচ্ছা থাকলো না। আশ্রমে ফিরে যাবার জন্য পশ্চিমদিকের রাস্তা ধোল্লেম। রাস্তাটায় জোয়ার-ভাঁটার জলস্রোতের ন্যায় অনবরত নরনারীর স্রোত প্রবাহিত। পথে যেতে যেতে আমি মনে মা জগদম্বার সৃষ্টিতে কত রকম জীবজন্তুর খেলা হয়, জগদম্বাই জানেন। মানুষের জ্ঞান-গোচর হওয়া অসম্ভব। ভাবতে ভাবতে আশ্রমে ফিরে এলেম।