হরিদাসের গুপ্তকথাপ্রথম খণ্ড
প্রথম কল্প : পাঠশালা
শিশুকাল থেকে চতুর্দ্দশ বর্ষ বয়সক্ৰম পৰ্য্যন্ত আমি গুরুগৃহে ছিলেম। আমার গুরুদেবের বাসস্থান কোথায় ছিল, শিশুকালে ঠিক জানতে না পেরে, পূর্ব্বে আমি বোলেছিলেম সুবর্ণগ্রাম। কথাটা ভুল ছিল; দেশের ভূগোলে তখন আমার জ্ঞান ছিল না, এখন বুঝ্তে পেরেছি, সুবর্ণগ্রাম নয়, সপ্তগ্রাম। সুবর্ণগ্রাম ঢাকাজেলায়, আমি ঢাকাজেলায় ছিলেন না, হুগলীজেলায় ছিলেম, সে কথা আমার মনে আছে; হুগলীজেলাতে সপ্তগ্রাম অবস্থিত, চলিতকথায় সাত গাঁ।
গুরুগৃহে আমি ছিলেম। কে আমি কাহার পুত্র, কি জাতি, কোথায় নিবাস, কিছুই আমি জানতেম না; পৃথিবীতে আমার কেহ আপনার লোক ছিল কি না, সেটাও আমার জানা ছিল না; জানা ছিল কেবল নামটী আমার হরিদাস। এ নামটী কে দিয়েছিল, সে কথাও আমি অবগত ছিলেম না। সমস্তই আমার চক্ষে অন্ধকারময় ছিল; চক্ষেও অন্ধকার, মনেও অন্ধকার।
একটী কথা স্মরণ হয়। মাসে মাসে এক একখানা রেজিষ্টারীকরা বেনামী চিঠিতে আমার শিক্ষাগুরুর নামে কিছু, কিছু টাকা আস্তো, কে পাঠাতো, আমি জানতেন না। গুরুদেবও কিছু আমাকে বোল্তেন না। শুনতে পেতেম, আমারই খরচপত্রের টাকা। এ তত্ত্বটাও ঘোর অন্ধকার।
পাঠশালেই আমার থাকা, পাঠশালেই আমার পড়াশুনা, পাঠশালেই আমার স্নানাহার, পাঠশালেই আমার খেলাধূলা, পাঠশালেই আমার শয়ন, পাঠশালেই আমার নিদ্রা, পাঠশালেই আমার সব। পাঠশালা ছাড়া আর কোন স্থান আমি জানতেম না, চিনতেম না, দেখতেমও না, কোন স্থানে যেতেমও না।
পাঠশালে অনেকগুলি ছেলে লেখাপড়া শিক্ষা কোত্তো। প্রাচীন অধ্যাপক মহাশয়দিগের চতুষ্পাঠীর নিয়মে অনেকগুলি ছেলে আমাদের গুরুগৃহেই আহারাদি পেতো, দিবারাত্রিই সেইখানে থাকতো। আমার সঙ্গে সব ছেলেগুলির বেশ সদ্ভাব হয়েছিল।
আমরা সকলেই হিন্দু-সন্তান। পার্ব্বণে পার্ব্বণে বিদ্যালয়ের ছুটী হোতো, সকল ছেলে ঘরে যেতো, আমোদ কোরে তারা আমাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে চাইতো, আমি যেতেম না। কোথায় যাব?—ঘর ছিল না, বাড়ী ছিল না, মাতাপিতা, ভ্রাতা-ভগিনী কেহই ছিল না। কোথায় যাব? কার কাছে যাব?— যেতেম না। মন যখন নিতান্ত উদাস হোতো, সেই সময় একাকী নির্জ্জনে বোসে নীরবে কেবল রোঁদন কোত্তেম আর নিশ্বাস ফেলতেম্। চক্ষের জলে অঙ্গবস্ত্র ভেসে যেতো। বাস্তবিক আমার ঘর-বাড়ী ছিল কিনা, বাস্তবিক আমার আপনার লোক ছিল কিনা, ভগবান জানতেন; মানুষের মধ্যে যদি কাহারো জানা সম্ভব থাকতো, সেই সকল মানুষই সে খবর রাখতো; আমি কিন্তু কোন খবর পেতেম না, কোন খবরই রাখতেম না; কোন দিন কেহ আমাকে দেখতেও আসতো না। নিত্য নিত্য আমি ভাবতেম, সৃষ্টিকৰ্ত্তার এত বড় সংসারে আমাকে আমার বলবার কেহ নাই, নিসম্পর্কে সুধুই আমি একাকী।
আমার যখন চৌদ্দ বৎসর বয়স, সেই সময় আমাদের আচার্যের মত্যু হয় : পাঠশালাটী ভেঙে যায়। আমার গুরুপত্নী শোকে কাতরা, তাঁর একটি কন্যা ছিল, অবিবাহিতা কুমারী. পিতার বড় আদরিণী কন্যা, সেটী তো পিতার বিয়োগে প্রায় জ্ঞানহারা। আমিও শোকে আকুল।
কেবল শোক প্রকাশ কোরেই গুরুপত্নী নিশ্চিন্ত থাকতে পাত্তেন, এমন কথা বলা যায় না। আচার্য্যঠাকুর বহুশ্রমে যা কিছু উপার্জ্জন কোত্তেন, তাতেই শিষ্যপোষণ ও সংসারপালন হতো; তিনি চোলে গিয়েছেন, উপার্জ্জন বন্ধ হয়েছে, সংসারে বড়ই কষ্ট। কিছুমাত্র সম্বল নাই। ডাকযোগে আমার খরচপত্রের টাকা আসবে, আশায় আশায় তবুও আমি সেই কষ্টের সংসারে আরো তিন মাস থাকলেম। রেজিষ্টারী চিঠি এক মাস এসেছিল, গৃহিণী ঠাকুরাণী স্বয়ং রসীদ দিয়ে সেই চিঠিখানি গ্রহণ কোরেছিলেন। তার পরেই বন্ধ; দুই মাস আর চিঠিও এলোনা, টাকাও পৌঁছিল না। নিরুপায়।
আমি তখন কি করি? গুরুপত্নী আমাকে বড়ই ভালবাসতেন, এক একবার আমার মুখপানে চান, চক্ষে জল আসে, বসনাঞ্চলে চক্ষু ঢেকে মুখ ফিরিয়ে অন্য দিকে সোরে যান। ক্রমাগতই এই ভাব। দিন দিন আরো কষ্টবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কাতরতার বৃদ্ধি।