» » » দ্বিতীয় কল্প : উপায় কি?

বর্ণাকার

ভূবনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়

হরিদাসের গুপ্তকথা
প্রথম খণ্ড

দ্বিতীয় কল্প : উপায় কি?

আরো দুই মাস কেটে গেল। গুরুপত্নী মুখ ফুটে আমাকে কিছু বোলতে পারেন না, আমিও নিজের ভাগ্যফল নিজে কিছু জানতে পারি না, মন কিন্তু সৰ্ব্বদাই অস্থির। যাঁর আশ্রয়ে থাকা, তাঁর অবস্থা প্রতিকূল, তিনি তাঁর নিজের আর কন্যাটীর ভরণ-পোষণেই অক্ষম, তার উপর আমি যদি আর বেশীদিন গলগ্রহ হয়ে থাকি, যে-ই দিক, যে-ই পাঠাক, ডাকে আমার টাকা আসতো, সেটা বন্ধ হয়ে গেছে, এখন আমি এই বিধবার গলগ্রহ ভিন্ন আর কিছুই নহি। পাঁচ মাস। এই পাঁচ মাসের মধ্যে কেবল প্রথম মাসের চিঠিখানি এসেছিল, আর এলো না। কারণ কি?—যে পাঠাতো সে লোক হয় তো মোরে গেছে। কিম্বা হয় তো আমি মোরে গেছি, সেইটাই ভেবে নিয়েছে, কিম্বা হয় তো আমি এখন বড় হয়েছি, শরীর খাটিয়ে দিনগুজরাণ কোত্তে পারি, এখন আর কেন দিবে, তাই ভেবেই বন্ধ কোরেছে। যা-ই হোক, উপায় তো কিছুই দেখছি না।

নিত্য নিত্য এই সব কথা আমি ভাবি, আরো কত কি ভাবি, ভেবে কিন্তু কূলকিনারা কিছুই পাই না। যেখানে আমাদের পাঠশালাটী ছিল, ঠিক তারই পশ্চিমদিকে একটী বৃদ্ধ বকুলফুলের গাছ। একদিন বৈকালে সেই বকুলতলায় বোসে আমি আপন অদৃষ্ট ভাবনা কোচ্ছি, দুই চক্ষু দিয়ে জলধারা গড়াচ্ছে, হৃদয়সাগরে চিন্তা-তরঙ্গ তোলপাড় কোচ্ছে, মাথাটী হেট কোরে আমি বোসে আছি, হঠাৎ একবার মুখ তুলে চেয়ে দেখি, সম্মুখে গুরুপত্নী।

চঞ্চল হস্তে চক্ষের জল মার্জ্জন কোরে শশব্যস্তে আমি উঠে দাঁড়ালেম। মনের দুঃখে আমি কাঁদি। গুরুপত্নীকে সেটা জানতে দিব না, আমার চক্ষের জল তাঁকে দেখতে দিব না, তিনি আমার মা, তিনি আমাকে পুত্ৰতুল্য স্নেহ করেন, প্রাণের সঙ্গে ভালবাসেন, তাঁর প্রাণে আমি ব্যথা দিব না, ইহাই আমার সংকল্প। অসাবধানে আজ আমার চক্ষের জল তিনি দেখতে পেলেন, তাই ভেবে চিত্ত আমার অত্যন্ত কাতর হলো, আড়ে আড়ে চেয়ে চেয়ে দেখলেম, ঠাকুরাণীর চক্ষেও জলধারা। অঞ্চলে নেত্র মার্জ্জন কোরে স্তম্ভিতস্বরে তিনি আমাকে আদেশ কোল্লেন, “হরিদাস! বোসো।”

আমি বোসলেম। ঠাকুরাণীও ধীরে ধীরে আমার সম্মুখভাগে উপবেশন কোল্লেন। তখনো তাঁর চক্ষু-দুটী সজল। আমি মনে কোল্লেম, স্নেহবশেই স্নেহবতী আমার দুঃখে অশ্রুবিসর্জ্জন কোচ্ছেন। বাস্তবিক কোন মেঘে কিরুপ বর্ষণ হয়, সেটা অনুমান করা সাধারণ মানুষের অসাধ্য, বিশেষতঃ আমার মত বালকের পক্ষে।

নীরবে গুরুপত্নীর মুখপানে চেয়ে আমি বোসে আছি, তিনিও সজলনয়নে আমার মুখপানে চেয়ে আছেন, দেখতে দেখতে তাঁর চক্ষু-দুটী জলশুন্য হয়ে এলো, হস্ত দ্বারা শুষ্কনেত্র পরিমার্জ্জন কোরে রুদ্ধস্বরে থেমে থেমে তিনি আমাকে বোল্লেন, “হরিদাস বাছা! দেখতেই তো পাচ্চো, সংসার অচল। লোকজন সব জবাব দিয়েছি, আসবাবপত্র তৈজসপত্র সমস্তই বিক্রয় কোরেছি, খাজনার দায়ে টোলবাড়ীখানিও নীলাম হয়ে যায়, উপায় কি? তোমার কি হবে? আহা! অনেক দিন ছিলে, অনেক দিন আছ, সন্তানের মত মায়া বোসেছে, কি কোরে তোমাকে আমি—”

এই পর্য্যন্ত বোলেই ঠাকুরাণী তাড়াতাড়ি দুই হস্তে চক্ষু-দুটী ঢাকা দিলেন, তাঁর নাসায় ঘন ঘন বড় বড় নিশ্বাস পোড়তে লাগলো। আমি দেখলেম, প্রবল ঝড়! এ ঝড়ের পরিণাম কি হবে, আমার ভাগ্যচক্র কোন পথে ঘুরে যাবে, ভেবে চিন্তে কিছুই ঠিক কোরে উঠতে পাল্লেম না।

চক্ষু থেকে হাত নামিয়ে জড়িতস্বরে গুরুপত্নী আবার বোলতে লাগলেন, “হরিদাস! তাই তো! উপায় কি হয়? কি কোরে চালাব? তোমাকে বিদায় দিতে ইচ্ছা ছিল না, কিন্তু কি করি! তোমার জন্যই আমার বেশী ভাবনা। তুমি কোথায় যাবে।

আর আমি ধৈর্য্য রাখতে পাল্লেম না; ক্ষুদ্র বালকের মত উচ্চকণ্ঠে রোদন কোরে করুণস্বরে বোল্লেম, “যাব?— কোথায় যাব? কোন জায়গা আমি চিনি? কাহাকে আমি জানি? জন্মাবধি এই আশ্রমে প্রতিপালিত হয়েছি, এই আশ্রমটীই জানি। আপনি আমাকে পরিত্যাগ কোল্লে আমি কোথায় গিয়ে কার কাছে দাঁড়াব? কে আমাকে আশ্রয় দিবে? দোহাই আপনার পায়ে ধরি, আপনি আমাকে পরিত্যাগ কোরবেন না। আমি আর আপনার গলগ্রহ হব না, এই বয়সে যতদূর পারি, পরিশ্রম কোরে, কোন লোকের কাছে চাকরী কোরে আপনার সংসারে যথাশক্তি সাহায্য কোরবো, আপনি আমাকে বিদায় কোরে দিবেন।”

গম্ভীরবদনে ঠাকুরাণী বোল্লেন, “উপায় নাই হরিদাস, উপায় নাই। আমার কাছে তোমার আর থাকা হোতে পারে না; কি কোরে হবে? আমি এখানকার সব বিলিব্যবস্থা কোরে মেয়েটী নিয়ে এক মাসের মধ্যেই কাশী চোলে যাব, তখন তুমি আর কার কাছে থাকবে? চাকরীর কথা বোলছিলে, আমিও সেই কথা বোলছি। তোমার জন্য আমি একটী বেশ চাকরী যোগাড় কোরেছি। বেশ লোক; যার কাছে তুমি থাকবে, তোমার সেই মনিবটী বেশ লোক। খাটনীও বেশী হবে না, আপনার পুথি পড়বার সময়ও পাবে, সেখানকার সকলেই তোমাকে ভালবাসবে, যত্ন কোরবে, আদর কোরবে, বেশ থাকবে; কোন কষ্ট হবে না। সেই লোকটীকে আমি—”

আমার মাথায় যেন বজ্রাঘাত হলো! চক্ষে যেন ধাঁধাঁ লাগতে লাগলো; মাথা ঘুরে গেল। বিস্তর মিনতি কোরে, গুরুপত্নীর চরণে ধোরে কতবার দয়া ভিক্ষা কোল্লেম, কিছুই ফল হলো না। যতই আমি কাঁদি, ততই তিনি কঠিন হন! আমার প্রতি তার দয়া ছিল, স্নেহ ছিল, ইহাই আমি জানতেম; ছিলও সত্য, কিন্তু ক্ষণেকের মধ্যে সব যেন কর্পূর হয়ে উবে গেল! ক্রমাগত কেঁদে কেঁদে আমি নির্ব্বাক হয়ে পোড়লেম, গৃহিণীর বাকপটুতা চতুর্গুণ হয়ে বেড়ে উঠলো!

আপন মনে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কত কথাই তিনি বোলতে লাগলেন, আমার কাণ আর সে দিকে থাকলো না। থাকলেই বা কি হোতো? একটপূর্ব্বে যে সব কথা আমি শুনেছি, তাতেই আমার ধড়ের মন যেন ঝড়ের সঙ্গে উড়ে গেছে, মন উড়ে গেলে কাণ তখন আর কোন কার্য্যেই লাগে না; আওয়াজগুলো কেবল কাণের ভিতর ভোঁ ভোঁ কোরে ঘুরে বেড়াতে লাগলো। আমি নিৰ্ব্বাক।

টোলবাড়ীর সম্মুখদরজাটা তখন খোলা ছিল। যে বকুলতলায় আমরা ছিলেম, সেখান থেকে সে বাড়ীর ভিতর পর্য্যন্ত বেশ দেখা যায়। সে দিকে গুরুপত্নীর চক্ষু ছিল না, চক্ষু ছিল আমার দিকে, দৈবাৎ একবার আমার চক্ষু, সেই দিকে ঘূর্ণিত হলো। দেখলেম, একটা লোক একখানা ঘর থেকে বেরিয়ে, উঠান পার হোয়ে, আমাদের দিকে চাইতে চাইতে আর একখানা ঘরে প্রবেশ কোল্লে। দেখেই আমার বুক কেঁপে উঠলো। এম্নি ভয়ানক চেহারা!

লোকটা দীর্ঘাকার; মুখখানা গোল, মাথাটা ন্যাড়া, হাত-দুখানা ছোট ছোট, পা-দুখানা খুব লম্বা, বুকখানা সরু, পেটটা খুব মোটা, চলতী বয়ানে নাদাপেটা; বর্ণ ঘনশ্যাম, বয়স আন্দাজ ৪৫/৪৬ বৎসর। পরিধান চওড়া কস্তাপেড়ে ধোপদাস্ত ধূতী;—ধূতী বলাও চলে, শাড়ী বোল্লেও ভুল হয় না।—গা আদুড়।

তাকে আমি দেখলেম। সে আমাদের দিকে চেয়ে চেয়ে গেল, আমি তাকে দেখতে পেলেম কি না, সেটা সে জানতে পাল্লে কি না, তা আমি জানি না, বোলতেও পারি না। অন্য ঘরে প্রবেশ কোরেই সে লোক অদেখা হলো। গুরুপত্নী অনেকক্ষণ আমাকে নিরুত্তর দেখে, আপন বক্তব্য সমাপ্ত কোরে, উঠে দাঁড়িয়ে, অল্প উচ্চস্বরে ধীরে ধীরে আমাকে বোল্লেন, “হরিদাস! বোসো। তোমার সঙ্গে আরো আমার অনেক কথা আছে; যাতে কোরে তোমার ভাল হয়, সে ব্যবস্থা আমি অবশ্যই করবো; অব্যবস্থায় তোমারে আমি অকালে ভাসিয়ে দিব না, সেটা তুমি বেশ জেনো।—বোসো, কোথাও যেয়ো না; এখান থেকে উঠো না; শীঘ্রই আমি ফিরে আসচি।”

গুরুপত্নী বাড়ীর ভিতর প্রবেশ কোল্লেন, তাঁর আদেশমত আমি সেই বৃক্ষতলেই বোসে থাকলেম। অন্তরসাগরে কত তরঙ্গ প্রবাহিত হোতে লাগলো, আমার অন্তরাত্মাই তা অনুভব কোল্লে।

আচার্যের বাড়ীখানি দুমহল। সদর-মহলে পাঠশালা ছিল, অন্দরমহলে তাঁরা বাস কোত্তেন। এখন আর পাঠশালা নাই, কিন্তু অন্দরের অবস্থা পূৰ্ব্ববৎ। সদরমহলের নাম টোলবাড়ী। সেই বাড়ীতেই আমি থাকতেম, অন্যান্য ছাত্রেরাও থাকতো, এখন তারা নাই, এখন আমি একাকীই সেই টোলমহলের অধিবাসী। গুরুপত্নী ঠাকুরাণী সেই মহলেই প্রবেশ কোল্লেন, দ্বার বন্ধ কোল্লেন না, ভেজিয়ে রেখে গেলেন।

আকাশে তখনও সূৰ্য্য ছিলেন। অল্প অল্প বেলা ছিল। ঠাকুরাণী ঘরে গেলেন, আমি তরুতলে বোসে বোসে ভূতভবিষ্যতের দুঃখের ভাবনা ভাবতে লাগলেম। জন্মাবধি ঘর ছিল না, তবু একটু আশ্রয় ছিল;—এইবার তাও যায়! গুরুপত্নী দয়াবতী ছিলেন, এখন হোচ্ছেন মায়াবতী! আর আমি এ আশ্রমে আশ্রয় পাব না! কোথায় যাব? কার হব? কার কাছে গিয়ে দাঁড়াব? উপায় কি?