হরিদাসের গুপ্তকথাপ্রথম খণ্ড
আমি বকুলতলায়। বাড়ীর পশ্চিমদিকে বকুলগাছ। যাকে আমি বাড়ীর ভিতর দেখেছিলেম, তার চেহারা-বর্ণনে বোলে রেখেছি, বর্ণ-ঘনশ্যাম। ঠাকুরাণীর সহিত তার যখন কথোপকথন হয়, তখন শুনেছি, ঠাকুরাণী তাকে ঘনশ্যাম বোলে সম্বোধন কোরেছিলেন। আমার বর্ণনা নিরর্থক হয় নাই। লোকটার নাম ঘনশ্যাম। বর্ণের সঙ্গে নামের মিলটী বেশ আছে। যে দিকে আমি ছিলেম, সে দিক দিয়ে ঘনশ্যাম বাহির হয় নাই; বাড়ীর পূৰ্ব্বদিকে আর একটী দরজা ছিল, সেই দরজা দিয়েই বেরিয়ে গেল। ঠাকুরাণী আমার কাছে এলেন; এসেই বোল্লেন, “হরিদাস! রাত্রি অনেক হয়েছে, বাড়ীর ভিতর চল।” আমি যে এতক্ষণ কি কোরেছি, তা তিনি কিছুই জানতে পাল্লেন না।
বাড়ীর ভিতর প্রবেশ কোল্লেম। মনে সুখ ছিল না, যৎসামান্য আহার কোল্লেম। গুরুঠাকুরাণী তাই দেখে কপট স্নেহে একবার জিজ্ঞাসা কোল্লেন, “কিছুই খেতে পাল্লে না, অসুখ হয়েছে কি?”—আমি উত্তর কোল্লেম, “তেমন অসুখ কিছুই না—অক্ষুধা।”
কর্ত্তার মত্যুর পর অবধি রাত্রিকালে যে ঘরে আমি শয়ন করি, সেই ঘরেই শয়ন কোল্লেম। ঠাকুরাণী সে রাত্রে সেই ঘরের দরজায় চাবী দিয়ে রাখলেন। পাছে আমি পালাই, সেই জন্যই সাবধান। পালাতে আমি পারবো না, তা তিনি জানতেন। কেন না ঐ পাঠশালা ছাড়া আর কোথাও আমি যেতেম না, গ্রামের পথঘাট কিছুই চিনতেম না। রাত্রিকালে পালিয়ে যাওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব ছিল, সেটা তিনি ভালই জানতেন, তথাপি সন্দেহ; সেই সন্দেহেই চাবী দিলেন। আমি যেন নিরপরাধে সেই রাত্রে ঘরের ভিতর কয়েদী হয়ে থাকলেম।
নিদ্রা হলো না। ভয়ে আর চিন্তায় সমস্ত রাত্রি জাগরণ কোল্লেম। ভয় কিসের? সেই বিকটাকার ঘনশ্যাম আমার মনিব হবে, বলদের মতন হাললাঙ্গলে জুড়ে দিয়ে, কোথায় যে নিয়ে যাবে, কতই যে যন্ত্রণা দিবে, সেই ভয়। চিন্তা কিসের?—কি প্রকারে পরিত্রাণ পাই, কি প্রকারে পলায়ন করি, কি প্রকারে সেই নরাকার রাক্ষসমূৰ্ত্তি আর দর্শন কোত্তে না হয়, সেই চিন্তা।
চিন্তা আমাকে কোন উপায় বোলে দিতে পাল্লে না। দিনের বেলা পলায়ন করবো, এইরুপ সঙ্কল্প কোরেছিলেম, সে সম্বন্ধটাও সিদ্ধ হলো না। প্রভাতে গুরুপত্নী আমার ঘরের চাবী খুলে দিলেন, বিমর্ষবদনে আমি বাহির হোলেম, একটু সুবিধা দেখলেই ছুটে পালাবো, এইরূপে আশা কোত্তে লাগলেম, কিন্তু সুবিধা ঘোটে উঠলে না; ঠাকুরাণী সৰ্ব্বক্ষণ আমাকে চক্ষে চক্ষে আটক রাখতে লাগলেন : নিজে যখন কোন কার্য্যে ব্যস্ত থাকেন, তখন ছোট মেয়েটীকে আমার কাছে রেখে যান; মুহূর্ত্তের জন্যও আমি পালাবার সুবিধা পেলেম না।
আমার গুরুকন্যার বয়স আট বৎসর, নাম অপরাজিতা। অপরাজিতা বেশ বুদ্ধিমতী; আমার প্রতি তার ভ্রাতৃতুল্য ভালবাসা হয়েছিল। আমিও সেটীকে ভগ্নীতুল্য ভালবাসতেম। সেই দিন মাতৃ-আদেশে অপরাজিতা যখন আমার কাছে এসে বোসলো, আমি তখন সভাবনায় অন্যমনস্ক ছিলেম, বদন বিষন্ন ছিল, তাই দেখে সে তখন আমাকে জিজ্ঞাসা কোল্লে, “দাদা! আজ তুমি একটাও কথা কোচ্চো না, একটীবারও হাসচো না, মুখখানি ভারী কোরে রয়েচো, এমন হয়েছো কেন?”
আমার চক্ষে জল এলো। মেয়েটার মুখের দিকে ভাল কোরে চাইতে না পেরে নতবদনে বোল্লেম, “রাত্রে একটা কুস্বপ্ন দেখেছি, তাতেই এমন বিমর্ষ দেখছো। আমার বড় দুভাবনা হয়েছে। স্বপ্ন দেখেছি, আমি যেন এ বাড়ীতে, আর জায়গা পাব না, কে যেন আমাকে ধোরে বেঁধে কোন দেশে নিয়ে যাবে, তোমারে আর দেখতে পাব না, তুমিও আমারে দেখতে পাবে না, সেই জন্যই দুর্ভাবনা।”
অপরাজিতার দুটী চক্ষু, ছল ছল কোত্তে লাগলো। সত্য সত্য স্বপ্ন কি না, স্বপ্ন কখন সত্য হয় কি না, বালিকার সে জ্ঞান ছিল না, আমার দুখানি হাত ধোরে ভেউ ভেউ কোরে কাঁদতে লাগলো, চক্ষের জলে আমার হাতদুখানি ভাসিয়ে দিলে।
গৃহিণী কোথায় ছিলেন, মেয়ের কান্না দেখে তাড়াতাড়ি ছুটে এসে, তার হাত ধোরে সেখান থেকে সোরিয়ে নিয়ে গেলেন, আমাকেও মিষ্ট মিষ্ট ভর্ৎসনা কোল্লেন। আমি চুপ কোরে থাকলেম। তদবধি তিনি আর আমাকে একবারও নজরছাড়া কোল্লেন না। দিনমান কেটে গেল, সূৰ্য্যদেব অস্ত গেলেন, সন্ধ্যার পর আহারাদি সমাপ্ত হলো, পূৰ্ব্ব-রাত্রের ন্যায় সে রাত্রেও তিনি আমাকে দ্বারে চাবী দিয়ে আটক রাখলেন। দ্বিতীয় প্রভাতে দ্বার মুক্ত হলো, আমি বাহির হোলেম। মন অত্যন্ত চঞ্চল। সেই দিন আমার সে আশ্রমবাসের শেষদিন আজ বৈকালে সেই লোক আসবে, এসেই আমাকে পোরে নিয়ে যাবে। ছোট ছোট ছেলেরা ছেলেধরার ভয়ে যেমন কাতর হয়, ঘনশ্যামের ভয়ে আমিও সেইরূপ কাতর হোলেম। সূৰ্য্য যতক্ষণ পূর্ব্বগগনে ছিলেন, ততক্ষণ পর্য্যন্ত একটু একটু আশা ছিল, সূর্য্য যখন মধ্যগগনে বিরাজ করেন, তখনও আমি নিতান্ত হতাশ হই নাই, সূৰ্য্য যখন অল্পে অল্পে পশ্চিমদিকে ঢোলতে লাগলেন, তখন আমার বক্ষঃস্থল গর গর কোরে কাঁপতে লাগলো। আর বিলম্ব নাই; অপরাহ্ন আগত এইবার আমাকে নিরাশা-সাগরে ডুবে যেতে হবে, সেই ভাবনাতেই আমি ম্রিয়মাণ হয়ে থাকলেম।
বৈকালে মহাজনের মত পোষাক পোরে ঘনশ্যাম এসে দেখা দিলে। তাকে দেখেই আমার সমস্ত আশা-ভরসা উড়ে গেল! আমার গুরুপত্নী সেই লোকটাকে সঙ্গে কোরে আমার কাছে নিয়ে এলেন। আমি কাঁপতে লাগলেম। লোকটার চেহারা যে রকম, একবার চক্ষে দেখলেই ভয় হয়, পোষাক পোরে আরও ভয়ানক হয়েছে। দুর্জ্জনেরা দেখতেও যদি সুশ্রী হয়, তবু তাদের চক্ষু দেখলে নিরীহ লোকে অন্তরে অন্তরে ভয় পায়; আর এর সেই যমোপম মূর্ত্তি! ঘনশ্যামের চক্ষের দিকে আমি চক্ষু রাখতে পাল্লেম না, মাথা হেঁট কোরে থাকলেম।
ঠাকুরাণী বল্লেন, “হরিদাস! এই ইনিই তোমার মনিব হোলেন। ইনি একজন বড়দরের মহাজন, ইনি তোমাকে বেশ যত্নে রাখবেন; সহজ সহজ কাজ দিবেন, যে কাজ তুমি জান, যে কাজ তুমি পারবে, সেই কাজেই ইনি তোমাকে নিযুক্ত রাখবেন। এর সঙ্গে তুমি যাও; কোন কষ্ট হবে না।”
এই পর্য্যন্ত বোলে কপট স্নেহ জানিয়ে, বসনাঞ্চলে নয়নকোণ মার্জ্জন কোরে, ঠাকুরাণী আবার আমাকে বোল্লেন, “কি করি বাছা, সকল কথাই তো তোমাকে বোলেছি। এদেশে আমি থাকবো না, মেয়েটী নিয়ে কাশী যাব। তোমাকে বিদায় করবার ইচ্ছা ছিল না, নিতান্ত দায়ে পোড়েই বিদায় কোরে দিতে হলো। একটা কিছু কিনারা কোরে না দিলে অজানা জায়গায় কোথায় তুমি যাবে, তাই ভেবে এই ভদ্রলোকটীর হাতে সোঁপে দিলেম, যাতে তুমি ভাল থাক, যাতে তুমি সুখে থাক, তাই আমার ইচ্ছা; তাই তোমাকে ভাললোকের হাতেই সমর্পণ কোল্লেম। মধ্যে মধ্যে চিঠিপত্র লিখবো, তুমিও লিখবে, কোন প্রকার কষ্ট হোলে আমারে জানাবে, আমি তখন অন্য প্রকার বন্দোবস্ত কোরে দিব। এখন যাও। আহা! তোমাকে বিদায় দিতে আমার প্রাণ কেমন কোচ্চে!”
ঘনশ্যামের স্বর অতি কর্কশ। সেই কর্কশ স্বরকে একটু মিষ্ট করবার চেষ্টা কোরে লম্বা লম্বা কথায় ঘনশ্যামও আমাকে অনেক রকম আশ্বাস দিলে। আমি কাঁদতে লাগলেম। গুরুপত্নী পুনঃপুনঃ ঘনশ্যামের মুখের দিকে চেয়ে মাথা নেড়ে নেড়ে ইসারা কোল্লেন, ঘনশ্যাম আমার একখানা হাত ধোল্লে। উঃ! ঠিক যেন বজ্ৰমষ্টি! বোধ হলো, আমার হাতখানি যেন ভেঙে গেল! এক হাতে গুরুপত্নীর চরণ ধারণ কোরে সেইখানে আমি শুয়ে পোড়লেম, কণ্ঠ শুষ্ক হয়ে এলো, শুষ্ককণ্ঠে রোদন কোত্তে লাগলেম। ঘনশ্যামের একবারও দয়া হলো না, গুরুপত্নীও দয়া কোল্লেন না। ঘনশ্যাম আমাকে টেনে হিঁচড়ে বাড়ী থেকে বাহির কোরে নিয়ে চোল্লো। আমার পরিত্রাহি চীৎকার, গুরুপত্নীর চক্ষে কপট অশ্রুবিন্দু অপরাজিতার বালিকাসুলভ কুন্দন, এই তিন একত্র, কিন্তু একত্র হলে কি হয়, ঠাকুরাণী আমাকে রাক্ষসের হস্তে সমর্পণ কোরেছেন, ইচ্ছাবশেই মায়া-দয়া বিসর্জ্জন দিয়েছেন, রাক্ষস আমাকে ছাড়বে কেন, হিড়হিড় কোরে টেনে নিয়ে চোল্লো।
বাইরে একখানা গাড়ী ছিল, সেই গাড়ীতে ঘনশ্যাম আমাকে টেনে টেনে তুল্লে। বেলা তখন প্রায় শেষ হয়ে এসেছিলো, দিবাকর অস্তাচলে গমন করবার উপক্ৰম কোচ্ছিলেন, সেই সময় আমি আমার আশৈশব আশ্রয়স্থান থেকে জন্মশোধ বিদায় হোলেম; জন্মশোধ বিদায় কি না, ভগবান জানেন, আমি কিন্তু মনে কোল্লেম, জন্মশোধ! আমার নিজের কোন জিনিসপত্র ছিল না, জিনিসপত্রের মধ্যে আমি আর আমার পরিহিত বস্ত্রখানি। আমার দেহ আর আমার প্রাণকে লয়েই আমি। সম্বলের মধ্যে পুথি ক’খানি ছিল, গুরুপত্নী সেগুলি আমাকে দিলেন না। বেশী ভালবাসতেন কি না, বেশী স্নেহ কোত্তেন কি না, সেই জন্য সেইগুলি বিক্রয় কোরে স্নেহ ও ভালবাসার নিদর্শন দেখাবেন, সেইটীই তাঁর ইচ্ছা হয়েছিল।
আমাকে গাড়ীতে তুলে যমোপম ঘনশ্যাম আমার বামদিকে এসে বোসলো। আমার আর নড়নচড়নের শক্তি থাকলো না। বড় বড় ঘোড়ারা আমাদের গাড়ীখানাকে পবনবেগে টেনে নিয়ে চোল্লো। খানিক দূরে গিয়েই সন্ধ্যা হলো। কোন দিকে যাচ্ছি, কতদুর যাচ্ছি, কিছুই আমি অনুভব কোত্তে পাল্লেম না। মন অত্যন্ত অস্থির হয়ে ছিল, কোন দিকেই ভ্রূক্ষেপ ছিল না। গাড়ী ক্রমাগতই চোলছে; কোথাও দাঁড়ায় না, কোথাও থামে না, ঘোড়াবদলও হয় না; পিপাসায় আমার ছাতি ফাটে, একবিন্দু জল কোথাও আশা কোত্তে পারি না, কণ্ঠ-তালু বিশুষ্ক। ভয়ের সময়, রোদনের সময়, নৈরাশ্যের সময় পিপাসা অধিক হয়, ক্ষুধা থাকে না, কিন্তু জলপিপাসায় দম বন্ধ হবার লক্ষণ দাঁড়ায়; গাড়ীর ভিতর আমারও সেই দশা।
রাত্রি যখন প্রায় শেষ, গাছে গাছে পাখীরা কলরব কোচ্ছে, দূরে দূরে গঙ্গাস্নানের যাত্রীরা দুর্গা দুর্গা নাম স্মরণ কোচ্ছে, যবনপল্লীতে কুক্কুটধ্বনি শোনা যাচ্ছে, তাতেই আমি অনুমান কোল্লেম, ঊষাকাল। মনে মনে আমিও দুর্গানাম স্মরণ কোল্লেম। বৃহৎ একখানা ভগ্নবাড়ীর সম্মুখে গিয়ে গাড়ীখানা দাঁড়ালো। ঘনশ্যাম আমাকে গাড়ী থেকে নামিয়ে সেই বাড়ীর ভিতর নিয়ে গেল। পথে পথেই রাত্রিকাল কেটে গিয়েছে, গাড়ীর-ঘোড়ারা কত স্থানে কত বেগে পথ অতিক্রম কোরেছে, কোন দিক দিয়ে এসেছি, কোথায় এসেছি, কিছুই ঠিক কোত্তে পাল্লেম না; যে বাড়ীতে প্রবেশ কোল্লেম, সে বাড়ীর কোন দিকে কি, ঊষার আঁধারে, চক্ষের আঁধারে তাও আমি দেখতে পেলেম না।
একটু পরেই প্রভাত হলো। পূর্ব্বদিন বেলা এক প্রহরের সময় যৎকিঞ্চিৎ আহার কোরেছিলেম, তার পর সমস্ত দিন সমস্ত রাত্রি উপবাস, একবিন্দু জল পর্য্যন্ত না, তার উপর মনের চাঞ্চল্য, কাজে কাজে চক্ষে অন্ধকার দেখতে লাগলেম। ঘনশ্যাম একটা ঘরে আমাকে রেখে দরজায় শিকল দিয়ে বোধ হয় অন্য ঘরে চোলে গেল। ঘরে আমি একাকী থাকলেম। সূর্য্যোদয় হলো। যে ঘরে আমি ছিলেম, সে ঘরে পাঁচটা জানালা; একটা জানালাতেও কপাট ছিল না, ঘরের ভিতর রৌদ্র এলো। তখন আমি ঘরের আসবাবপত্রের প্রতি চেয়ে চেয়ে দেখতে লাগলেম। গৃহশয্যা দেখবার প্রবৃত্তি ছিল না, যা আমি দেখছিলেম, যা দেখবার ইচ্ছা হেচ্ছিলো, সে বস্তু সে ঘরে আছে কি না, সেই দিকেই আমার লক্ষ্য। ধন্য জগদীশ! ধন্য তাঁর দয়া! চারিদিকে চক্ষু ঘুরিয়ে শেষকালে দেখতে পেলেম, ঘরের এক কোণে একটা জলের কলসীর নিকটে একটা মাটীর ভাঁড়। জলের কলসীতে ঢাকা ছিল না, গিয়ে দেখলেম, তাতে প্রায় একসের আন্দাজ জল ছিল, সেই জলে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মশক-মক্ষিকারা সাঁতার দিচ্ছিলো। জল অপেয়; তবু আমার আহ্লাদ হলো; মাটীর ভাঁড়ে সেই কীটপূর্ণ জল পরিপূর্ণ কোরে দুই নিশ্বাসে দুই চুমকে সবটুকু আমি পান কোল্লেম। বুক অনেকটা ঠাণ্ডা হলো; আমিও একটু ঠাণ্ডা হয়ে নিশ্বাস ফেল্লেম।
এইবার দেখলেম, ঘরের খিলানে খিলানে বড় বড় মাকড়সার জাল, কোণে কোণে কালো কালো ঝুল, দেয়ালে দেয়ালে ভূষাকালি, ঘরের মধ্যস্থলে একখানা পায়াভাঙা তক্তপোষ, তার উপর একখানা খেজুরপাতার চেটাই, একধারে একটা শ্মশানের বালিশ, এক কোণে একটা প্রকাণ্ড ডাবা হুঁকা, তিন ধারে আমের আটার তালি দেওয়া, কোলকেট্টার তিন ধারে ফাটা, পার্শ্বে একটা কাণাভাঙা হাড়ী, তার গর্ভে আধ হাঁড়ি ছাই। এই পর্য্যন্ত আসবাব! আর কিছুই না!
আমি বোল্লেম, সুপারিসটা খুব পাকা-রকম বটে! গুরুপত্নী বলেছেন, ঘনশ্যাম একজন মহাজন! খুব ভদ্রলোক! পোষাকেও দেখা গিয়াছে বড় মহাজন! ব্যবহারেও দেখা গিয়াছে খুব ভদ্রলোক! এখন আমার ভাগ্যে কি হয়, সেইটুকু জানতেই বাকী। বসে আছি, একবার একবার আসবাবপত্র নিরীক্ষণ কোচ্ছি, এমন সময় দরজার শিকল খুলে একটা বুড়ী সেই ঘরে প্রবেশ কোল্লে। ঘরের চারিদিকে চেয়ে আমাকে দেখতে পেয়েই বড় কম্পিত কণ্ঠে একটু থেমে থেমে বোল্লে, “হ্যাঁ গা ছেলেটী, তোমার নামটী কি ভাল, হাঁ, ঠিক ঠিক! হরি হরি;—হ্যাঁ গা হরি! তুমি কি আমাদের বাবুর বাড়ী ভাত খাও? বাবু আমাদের ব্রাহ্মণ। বাবু জিজ্ঞাসা কোরে পাঠালেন, ব্রাহ্মণের ভাত তুমি খাও কি না?”
প্রশ্ন শুনেই আমি মনে কোল্লেম, অদ্ভুত সমস্যা। চেহারা যে রকম, ব্যবহার যে রকম, বাক্য যে রকম, তাতে কোরে বোধ হয়, আগাগোড়া সমস্তই কৃত্রিম। বুড়ী বল্লে, “বাবু আমাদের ব্রাহ্মণ।” বাবু যে দিন সপ্তগ্রামে গিয়েছিলেন, সে দিন খোলা গা আমার চক্ষে পোড়েছিল; ব্রাহ্মণের লক্ষণ ত কিছুই ছিল না, নিদর্শন একগাছি যজ্ঞসূত্র, তা পর্য্যন্ত ছিল না, এখন এখানে এসে ব্রাহ্মণ সেজেছে! ব্যাপার বড় শক্ত! ভেবে চিন্তে আমি উত্তর কোল্লেম, “আমার বড় অসুখ, কিছুই আহার করবার ইচ্ছা নাই, তবে যদি এখানকার কোন দোকানে কিছু মিষ্টান্ন পাওয়া যায়, তা হোলে—”
আমার কথা সমাপ্ত হোতে না হোতেই বুড়ী বোলে উঠলো, “মিষ্টান্ন কি বাবা! মিষ্টান্নের মধ্যে মুড়ি পাওয়া যায়, চিঁড়ে পাওয়া যায়, ঘোল পাওয়া যায়, আর—আর—আর—”
বোলেছি বটে বড় অসুখ, ক্ষুধায় কিন্তু পৃথিবী অন্ধকার দেখছি। কি করি, বুড়ীকে বোল্লেম, “ঐ রকম মিষ্টান্নই পেটের অসুখে বড় ভাল। চিঁড়ে আর ঘোল ভাল, ঐ দরকম মিষ্টান্ন হোলেই ঠিক হবে।”
আমার উত্তর শ্রবণ কোরে বুড়ী আপনা আপনি কি বোকতে বোকতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। খানিক পরেই আমার ভাগ্যে ঘোল-চিঁড়ে হাজির।
প্রাণধারণের অনুরোধে যৎসামান্য ঘোল-চিঁড়ে আমি ভক্ষণ কোল্লেম, কিন্তু চিঁড়েগুলি সহজে আমার উদরস্থ হলো কি না, বোলতে পারি না। কারণ, চিঁড়েগুলির আকার কিছু বৃহৎ, বর্ণও আরক, গন্ধও বিকৃত! তাদৃশ বস্তু মানুষে ভক্ষণ করে, এমন বিশ্বাস আমার ছিল না, তথাপি যথাশক্তি চর্ব্বণে এক ছটাক আন্দাজ রক্তচিপিটক আমি ভক্ষণ কোরেছিলেম। পেটে থাকলে না; বুড়ী বিদায় হবার পরেই বমি হয়ে গেল। কপাটশূন্য জানালায় মুখ বাড়িয়ে বমনকার্য্য সম্পাদন কোল্লেম, গৃহমধ্যে কোন চিহ্ন থাকলো না, আমার উদরেও থাকলো না; সুতরাং কেহই কিছু দেখতে পেলে না।
বেলা প্রায় দেড় প্রহর। নূতন রকম পোষাক পোরে, মুখে একটা চুরুট লাগিয়ে, ঘনশ্যাম এসে দর্শন দিলে। আমার মুখের কাছে চুরুটের ধোঁয়া উড়িয়ে লোকটা গম্ভীর আওয়াজে বোল্লে, “কেমন, প্রস্তুত আছ? আহার হয়েছে? আপিস করবার সময় হয়েছে। এসো আমার সঙ্গে।”
আফিস কি, জন্মাবধি আমি কখনো শুনি নাই। কি রকমে আফিস করে, তাও আমি জানতেম না। কিন্তু অপ্রস্তুত কেন হব, কৌতহলে কৌতুকী হয়ে তৎক্ষণাৎ আমি উঠে দাঁড়ালেম; অগ্রে অগ্রে ঘনশ্যাম, পশ্চাতে আমি, দুজনে একসঙ্গে সে ঘর থেকে বেরুলেম। চতুর্দ্দিকেই আমার চক্ষু বিঘুর্ণিত।
তিনখানা ঘরের পরে আর একখানা ঘর। ঘনশ্যাম সেই ঘরে আমাকে নিয়ে গেল। ঘরটা কিছু জমকালো। মেজেতে ক্যাম্বিস মোড়া; মাঝখানে একটা বড় টেবিল; ধারে ধারে ৩/৪ খানা ছোট ছোট চৌকী। টেবিলের উপর রাশীকৃত চোতা কাগজ, ধারে ধারে সেই রকম কাগজে নানা বর্ণের নানা প্রকার জিনিস-ছোলা, মাষকলাই, প্রেক, তেঁতুলবীচি, সাগুদানা, কুল, সাবান, মসিনা, তেজপত্র, কাবাবচিনি ইত্যাদি।
টেবিলের পার্শ্বে একখানা সাদা রঙের গড়াপাতা ক্ষুদ্র বিছানা। সেই বিছানার উপর মুন্সীধরণের একজন বৃদ্ধ খাতাপত্র কোলে কোরে চক্ষু বুজে বসে আছে, দুকাণে দুটো সরকাঠীর কলম গোঁজা। লোকটীর চেহারা মন্দ নয়। বর্ণ অন্ধ গৌর, গঠন দীর্ঘও নয়, খর্ব্বও নয়, মোটাও নয়, রোগাও নয়, দিব্য পাকাগোঁফ, মাথার চুলগুলিও শ্বেতবর্ণ, পশ্চাদ্দিকে ঘাড়ের নীচে খোঁপাবাঁধা, বয়স অনুমান ৬০/৬৫ বৎসর।
আমি, ঘনশ্যাম আর সেই মুন্সী, এই তিনজন মাত্র তথায় উপস্থিত। ঘনশ্যাম আমাকে বোসতে বোল্লে, টেবিলের দক্ষিণ ধারে একখানি চৌকীর উপর আমি বোসলেম; আমার গা ঘেঁসে আর একখানা চৌকীতে ঘনশ্যাম নিজেও বোসলে।
ঘনশ্যাম আমাকে জিজ্ঞাসা কোলে, “আপিসের কাজকর্ম্ম তুমি জানো?” —আমি উত্তর কোল্লেম, “আফিস কাকে বলে, তাই জানি না। আফিসের কাজকৰ্ম্ম কিরপে জানবো?” ঘনশ্যাম পুনরায় বোল্লে, “আপিস ইংরাজী কথা, যে বাড়ীতে অথবা যে ঘরে বিষয়কার্য্যের লেখাপড়া হয়, তারই নাম আপিস।”
আমি কিছু, উত্তর দিব মনে কোচ্ছিলেম, এমন সময় সেই ঘরে ৫/৭ জন লোক প্রবেশ কোল্লে। সকলেরই চাপকান গায়, বড় বড় পাগড়ী মাথায়। তাদের মধ্যে দুজনের প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড ভুঁড়ী। সচরাচর সাধারণ লোকে যাকে ঢাকাই জ্বালা বলে, সেই রকমের ভুঁড়ী, মানুষের তত বড় ভুঁড়ী হয়, আমি আর কখনো দেখি নাই। ভুঁড়ীর ভারে কাতর, কাজেই আর তারা বেশীক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পাল্লে না, ধপ ধপ কোরে দুজনে দুখানা চৌকীর উপর বোসে পোড়লে। চৌকী দুখানা মড় মড় শব্দে কেঁপে উঠলো। বাকী লোকেরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘনশ্যামের টেবিলের উপর হাত দিয়ে দিয়ে এক এক রকম জিনিস পরীক্ষা কোত্তে আরম্ভ কোল্লে। ভাবে বুঝলেম সেখানে খরিদবিক্ৰী দুই-ই চলে। কেহ কেহ খরিদ করে, কেহ কেহ বিক্রয় করে। সকলেই ব্যাপারী। ভুঁড়ীওয়ালারা খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে গায়ের চাদরের বাতাস খেতে খেতে বার দুই তিন বড় বড় হাই তুল্লে। ঘনশ্যামের দিকে চেয়ে একজন বোল্লে, “ভাই সায়েব, তুমি সেদিন আমার কাছে যে একখানা ইস্তাহার পাঠিয়েছিলে, সেখানা ভারী চমৎকার! তেমন ইস্তাহার ইতিপূর্ব্বে আমার নজরে আর একখানাও পড়ে নাই। সেই কারবারে আমার বড় ইচ্ছা।”—তিনবার মাথা নেড়ে নেড়ে হুঁ হুঁ দিয়ে ঘনশ্যাম একটু হাস্য কোল্লে। তার পর অনেক রকম কথা হলো, জিনিসপত্রের দর-দস্তুর ঠিক করা হলো, ভুঁড়ীওয়ালারা ছাড়া অন্য লোকেরা বিদায় হবার উপক্রম কোল্লে, এমন সময় আর একজন লোক এলো। সে লোকের চাপকান পাগড়ী ছিল না, বাঙ্গালীর মত সাদাসিদা কাপড় পরা, দেখতেও বেশ সুশ্রী। বয়স অনুমান ৫০/৫২ বৎসর। ঘনশ্যাম তাকে চিনতো না, তথাপি আদর কোরে বসালে। লোকটী বোল্লে, “যে কারবারে পাঁচবৎসরে লক্ষপতি হওয়া যায়, সেই কারবারে আমি অগ্রিম ৫০৲ টাকা জমা দিতে এসেছি, কারবারের নিয়মাবলী একবার দেখতে চাই।”
মহাজনের পার্শ্বে বৃদ্ধ মুন্সীজী বোসে বোসে ঝিমুচ্ছিলেন, মহাজন তার দিকে ফিরে একবার একটা ঘণ্টা বাজালেন, মুন্সীর চমক ভাঙলো। কারবারের ভাষায় মহাজন ঘনশ্যাম সেই মুন্সীকে কি উপদেশ দিলে, মুন্সী তখন বড় একখানা খাতা হাতে কোরে সম্মুখে এসে দাঁড়ালেন। দুই কাণে দুটী কলম। পঞ্চাশ টাকা জমা হবে, নিয়মাবলী জানাতে হবে, ঘনশ্যামের বড়ই আহ্লাদ, মুন্সীজী বড়ই ব্যস্ত। আগত ব্যাপারীরাও আহ্লাদে কৌতুকে একবার ঘনশ্যামের মুখের দিকে, একবার সেই নূতন লোকটীর মুখের দিকে সতৃষ্ণনয়নে চাইতে লাগলেন।
এইবার নিয়মাবলীর ব্যাখ্যা। ঘনশ্যাম নিজেই ব্যাখ্যাকৰ্ত্তা। গলা কাঁপিয়ে কাঁপিয়ে তিনি বোল্লেন, “লক্ষপতি হওয়া ছোট কথা। দশ টাকা জমা দিলেই পাঁচ বৎসরে আপনি লক্ষপতি হোতে পারেন। আচ্ছা এনেছেন পঞ্চাশ টাকা, দিয়ে যান পাঁচগুণ; পাঁচ দশে পঞ্চাশ; পাঁচ বৎসরে আপনি পাঁচ লক্ষ টাকা পাবেন। যদি কিছু বেশী হয়, সেটা আমার এই মুন্সীজীকে দস্তুরী বোলে বকসীস দিয়ে যাবেন। জমা দিন। লেখ হে মুন্সী!”
সকলেরই চক্ষু তখন মুন্সীজীর মুখের দিকে নিক্ষিপ্ত হলো। কাণের একটী কলম খুলে নিয়ে মুন্সীমহাশয় সেই আগন্তুক জমাদাতাকে নম্রস্বরে জিজ্ঞাসা কোল্লেন, “আপনার নাম কি মহাশয়?”—জমাদাতা বোল্লেন, “হরেরাম শুকুল, নিবাস পাটনা, খয়রাতগঞ্জ।”
মুন্সী সেই নাম-ধাম লিখে নিলেন। টাকা হাতে না পেয়ে অঙ্কপাত করা হয় না, সুতরাং অঙ্কপাত কোল্লেন না, হাঁ কোরে সেই লোকের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। লোক বোল্লেন, “নিয়মের কথাটা অগ্রে শোনা যাক, তার পর বন্দোবস্ত।”
অট্টহাস্য কোরে ঘনশ্যাম বোল্লেন, “ও হো হো! ওটা আমার ভুল হোচ্ছিলো বটে। নিয়ম হোচ্ছে এই অগ্রিম দশ টাকা জমা দিলে পাঁচসের তেঁতুলবীচি প্রদান করা হয়। তেঁতুলবীচিকে বাঙলাদেশে কাঁইবীচি বলে, এ কথাও বোধহয় আপনি জানেন। সেই কাঁইবীচিগুলি বর্ষাকালে একটা জমীতে ছড়িয়ে দিতে হয়। সকল বীচিতেই গাছ হয়, একটা বীচিও নষ্ট হয় না। পাঁচ বৎসরে সেই সব গাছ বড় হয়, ফল ধরে। মনে করুন, পাঁচসের কাঁইবীচিতে দশ হাজার গাছের কম জমে না। এক একটা গাছে বৎসরে যদি এক টাকার তেঁতুল বিক্রী হয়, তা হোলে দশহাজার টাকা। আমি খুব কম কোরেই হিসাব ধোল্লেম; বাস্তবিক বিশ হাজার টাকা। আর সেই গাছগুলি যদি কেটে কেটে কয়লা করা হয়, তেঁতুলকাঠের কয়লার দাম খুব বেশী, দশ হাজার গাছের কয়লা আশী হাজার টাকায় বিক্রী হবে। তবেই ধরুন, লক্ষ টাকা।”
নিয়মাবলী শ্রবণ কোরে হরেরাম শুকুলের চক্ষ স্থির! জমা দিবার জন্য টাকা বাহির কোচ্ছিলেন, সেগুলি সামলে রেখে, ঘনশ্যামকে সেলাম দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। একটীও বাক্যব্যয় না কোরে মস্ মস্ শব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। মুন্সীর হাতের কলমটা খোসে পোড়লো, সকলের মুখ শুকিয়ে গেল, দর্শক লোকেরা অবাক! আমি ত সৰ্ব্বাপেক্ষা অধিক চমকিত হয়ে অন্য দিকে মুখ ফিরালেম। ভয়ের সঙ্গে ঘৃণা এসে আমাকে নিতান্তই অবশ-অস্থির কোরে ফেল্লে।
যারা এসেছিলো, কাজকর্ম্ম দেখে তারা চোলে গেল, জমা না পেয়ে হতাশ হয়ে শুষ্কবদনে মুন্সী গিয়ে আপন আসনে উপবেশন কোল্লেন, ঘনশ্যাম গম্ভীরবদনে বোসে রইলেন। আফিসের কাজকর্ম্ম তখনকার মত সমাধা হলো, আমি কেবল দেখলেম আর শুনলেম, আমাকে আর কোন কাজ স্বহস্তে কোত্তে হলো না।
একটু পরে ঘনশ্যাম উঠে গেলেন। মুন্সীর কাছে বোসে বোসে খানিকক্ষণ আমি তাঁর ঘুমন্ত চক্ষু দর্শন কোল্লেম, তার পর আমিও সে ঘর থেকে বেরুলেম। বাড়ীখানা খুব বড়, কিন্তু অনেক দিনের জীর্ণ। বাহিরদিকে বারান্দা ছিল না, পূর্ব্বকালে বোধ হয়, সে প্রকার পদ্ধতিও ছিল না, ছোট ছোট জানালা রাখলেই বাড়ী মানাতো, সে রকমের বাড়ী। আমার মনের ভিতর যা হোচ্ছিলো, অট্টালিকা বর্ণনা করা তার কাছে ছোট কথা। বাড়ীতে অনেক ঘর : একতালা, দোতালা, তেতালা। সকল ঘরেই লোকজন আছে কি না, সেটা আমি প্রথমে জানতে পাল্লেম না, জানবার ইচ্ছাও হলো না। আমার ইচ্ছা কেবল পলায়ন। দোতালার একটা ঘরের জানালা দিয়ে দেখলেম, বাহিরে রাস্তার দিকে ফটক। সেই ফটকে একজন দরোয়ান বোসে দুই হাতে গাঁজা টিপছে আর হিন্দুস্থানী সুরে গান গাচ্ছে। ফটকে দুখানা বৃহৎ বৃহৎ কপাট, সেই কপাটে প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড তিনটে তালায় চাবী বন্ধ। জানা হলো আফিসবাড়ী, কিন্তু আফিসবাড়ীর ফটকে দিনের বেলা চাবী বন্ধ থাকে কেন, সেটা আমি বুঝতে পাল্লেম না। ঘর অসংখ্য; কোন দিকের কোন ঘরে কি, দেখতে পেলেম না, ভাবতে ভাবতে উপর থেকে নীচে নেমে এলেম। সকল ঘরেই মানুষ আছে, গরু আছে, ছাগল আছে, ভেড়া আছে। অনেক ঘরে কাজকর্ম্মও হোচ্ছে; ঘর প্রায় খালি নাই। এক জায়গায় দেখি, কামারেরা বড় বড় জাঁতায় লৌহ দগ্ধ কোচ্ছে, বড় বড় হাতুড়ী দিয়ে লোহা পিটছে, অনেক দূর পর্য্যন্ত আগুন ঠিকরে ঠিকরে যাচ্ছে, মিস্ত্রীরা নানারকম গড়ন প্রস্তুত কোচ্ছে। সকলেই ঘর্ম্মাক্ত-কলেবর। আর এক জায়গায় দেখি, করাতী মিস্ত্রীরা বড় বড় বাহাদুরীকাঠ চিরে চিরে জমা কোরে রাখছে, র্যাঁদা-বাটালীর কাৰ্য্যও হোচ্ছে, করাতীরা এক মুহূর্ত্তও বিশ্রাম পাচ্ছে না। আর এক জায়গায় স্তুপাকার ধোঁয়া উঠছে, পাঁচ সাতজন লোক সেইখানে হৈ হাই কোরে গোলমাল কোচ্চে; বোধ হলো, কি যেন পোড়াচ্ছে। আর এক জায়গায় ভেড়া-ভেড়ী জবাই হোচ্ছে, রক্তের ঢেউ খেলাচ্ছে, বড় বড় ছোরা-হাতে দাড়ীওয়ালা লোকেরা চতুর্দ্দিকে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর খানিক এগিয়ে গিয়ে দেখলেম, উচ্চ উচ্চ প্রাচীর দিয়ে ঘেরা মস্ত একটা পুষ্করিণী, জল সবজবৰ্ণ, ধারে ধারে তক্তার মাচান, ধোপারা সেই সকল তক্তার পাটে কাপড় কাচ্ছে। লোক অনেক! সকল লোকই নানা কাজে ব্যস্ত। কোন দিকেই আমি পালাবার পথ পেলেম না। অত বড় বাড়ীতে একটামাত্র ফটক, অন্য কোনদিকে আর দরজা নাই, এটাও আ-রোধ হলো। আবার উপরে উঠে গেলেম।
যে ঘরে মুন্সীজী, যে ঘরটার নাম আফিসঘর, সেই ঘরে প্রবেশ কোল্লেম। মুন্সী তখন খাতাপত্র বন্ধ, কাণেও কলম নাই। তিনি তখন কাঁইবীচির ঝুড়ীগুলো সাজিয়ে সাজিয়ে একধার থেকে আর একধারে নিয়ে গিয়ে রাখছেন, আর অনবরত ঘামছেন। বৃদ্ধ লোকের উপর অত বড় শক্ত কাজের ভার, সেটাও আমি ভয়ানক নিষ্ঠুরতা মনে কোল্লেম। আমি প্রবেশ করবামাত্র মুন্সীজী আপন হাতের কাজ পরিত্যাগ কোরে হাঁপাতে হাঁপাতে একখানা চৌকীর উপর বোসে পোড়লেন। পূর্ব্বে আমি ঘরের উপরদিকে চেয়ে দেখি নাই, কড়িকাঠে খুব লম্বা একখানা টানাপাখা ঝুলছিলো, দেয়ালের গায়ে দড়ী বাঁধা ছিল। মুন্সী সেই দড়ীগাছটা খুলে নিয়ে আপন হতেই পাঙ্ক্ষাওয়ালার কাজ কোত্তে লাগলেন, আমাকে নিকটে বোসতে বোল্লেন। আমিও সেই পাখার নীচে বোসলেম। পাখার বাতাসে শরীর একটু জুড়ুলো। কথায় কথায় মুন্সীর সঙ্গে আমার বেশ আলাপ হলো। আমার জীবনকাহিনীর গোটাকতক কথা শুনেই তিনি এক দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ কোল্লেন। কি যে তিনি বুঝলেন, কি যে তাঁর মনে হলো, প্রথমে আমি সেটা অনুভব কোত্তে পাল্লেম না, তিনি কিন্তু আমার দিকে চেয়ে চেয়ে কাতরভাব জানাতে লাগলেন।
কথায় কথা বাড়ে। ইচ্ছা কোরেই আমি কথা বাড়ালেম। ঘনশ্যামের পরিচয় জিজ্ঞাসা কোল্লেম। মুন্সীজী দিব্য সরলপ্রকৃতি, কোন বিষয়ে কোন কথায় তাঁর একটু কপটতা আমি ধোত্তে পাল্লেম না। পূর্ব্বে তিনি ঘনশ্যামের মুখে আমার একটু পরিচয় পেয়েছিলেন, নামটীও শুনেছিলেন, সেই সুত্রে আমার নাম ধোরেই সম্ভাষণ কোত্তে লাগলেন। দ্বিতীয়বার নিশ্বাসত্যাগ কোরে তিনি বোল্লেন, “হরিদাস! তুমি এখানে কেন এসেছ? এ জায়গা ভাল নয়, এখানকার বাতাস পর্য্যন্ত পাপরক্তে মাখা। আমি বন্ধ হয়েছি, আমার উপর ঘনশ্যামের অধিক প্রভুত্ব চলে। এখান থেকে যদি আমি চোলে যাই, যমের বাড়ী গেলে ঘনশ্যামের হাত থেকে পরিত্রাণ পাব না, ঘনশ্যামের সঙ্গে আমার জীবনান্ত সম্বন্ধ; সেই জন্যই আমি আছি। তুমি কেন এ নরককুণ্ডে প্রবেশ কোরেছ?”
সত্য সত্য উত্তর দিয়ে পুনর্ব্বার আমি ঘনশ্যামের পরিচয় জিজ্ঞাসা কোল্লেম। শুনলেম, জাতিতে ঘনশ্যাম চাষা-গয়লা, ঘনশ্যাম বিশ্বাস নামে পরিচয়, পেশা দালালী। সকল কাজের দালালী করাই ঘনশ্যামের কার্য্য। বাড়ীতে তিনি সৰ্ব্বদা আসেন না, সকল দিন আসেনও না, সাত দিন অন্তর, দশ দিন অন্তর, কখনো বা একমাস অন্তর একবার আসেন, লোকজনের উপর জলুম করেন, মনের মতন ব্যাপারী পেলে দস্তুরমত ব্যাপারও করেন। কাঁইবীচির কারবারেই তাঁর বেশী ঝোঁক।
আমি জিজ্ঞাসা কোল্লেম, দিনের বেলা ফটকে চাবী দেওয়া কেন? মুন্সী বোল্লেন, “তিনি বেরিয়ে গিয়েছেন; বেরিয়ে গেলেই সদরফটকে চাবী পড়ে। এ বাড়ীতে যে সকল লোক থাকে, সকলকেই তিনি কেনা গোলাম মনে করেন। সকলের কাজের উপার্জ্জন তিনি নিজেই গ্রাস কোত্তে চান। তুমি এখানে এসেছ, বাহির হোতে না পার, দরোয়ানকে সেইরুপ হুকুম দিয়ে গিয়েছেন; আমাকেও বোলে গিয়েছেন, ‘ছেলেটাকে ছেড়ো না।’ ভাবভক্তি আমি কিছুই বুঝতে পারি নাই, তোমাকে গোলাম কোরে রাখাই বোধ হয় তাঁর মতলব। যা হোক, তুমি ভয় পেয়ো না। যাতে তুমি নিরাপদে এস্থান থেকে প্রস্থান কোত্তে পার, আমি তার উপায় কোরে দিব। আমি ব্রাহ্মণ, আপাততঃ পাঁচ সাত দিন তুমি এইখানে থাকো। আমি স্বয়ং রন্ধন কোরে ভোজন করি, আমার কাছেই তুমি আহার কোরবে, আমার ঘরেই শয়ন কোরবে। কষ্ট যাতে না হয়, সাধ্যমতে আমি সেই রকম ব্যবস্থা কোরবো। তোমাকে নূতন এনে রেখে গিয়েছেন, বোধ হয়, এবার আর তিনি বেশী দিন বাইরে বাইরে থাকবেন না, শীঘ্রই ফিরে আসবেন। তোমার কিরূপ ব্যবস্থা করেন, সেইটী জেনে শুনে যাহা কর্ত্তব্য আমি অবধারণ কোরবো।”
আমি একটু আশ্বস্ত হোলেম। ব্রাহ্মণ আমার মুক্তির উপায় কোরে দিবেন, এইটকু মাত্র আশ্বাস। মনের ভয় মনেই থাকলো, মনের ঘৃণা মনেই চাপ দিয়ে রাখলেম, মুন্সীর কাছেও সে কথা প্রকাশ কোল্লেম না।
সন্ধ্যা হয়ে গেল। যে যে ঘরে মানুষ থাকে, সেই সব ঘরে এক একটা প্রদীপ জ্বালা হলো। লোকেরা সব নানা প্রকার গোলমাল কোত্তে লাগলো। আমার মন সৰ্ব্বদাই চঞ্চল, কোন দিকে আমি মন দিতে পাল্লেম না। আফিসঘরের আশে পাশে যে সকল ঘর, একে একে সেই সব ঘরে আমি উঁকি মেরে দেখতে লাগলেম। যে ঘরে আলো, সে ঘরে দুই একজন মানুষ, যে ঘর অন্ধকার, সে ঘর খালি। আরশোলা, মাকড়সা, ছুঁচো আর ইঁদুরেরা সেই ঘরের বাসিন্দা; ঘরগুলিও দুর্গন্ধে পরিপূর্ণ, সমস্তই দুর্গন্ধ। পাপের পরাক্রম যেখানে অধিক, সেখানে শান্তির ছায়া পড়ে না, এই কারণেই আমার মনে তত ভয় ও তত ঘৃণা। রাত্রি চারি দণ্ডের পর মুন্সীর ঘরে ফিরে গেলেম, এক প্রহরের মধ্যেই তাঁর রন্ধনকার্য্য শেষ হলো। আমার জাতিজন্ম আমার জানা ছিল না, উভয়ে স্বতন্ত্র স্বতন্ত্র বোসে আহার কোল্লেম। শেষকালে সেই বুড়ী এসে মুন্সীর পাতে প্রসাদ পেলে, উচ্ছিষ্ট স্থানগুলি পরিষ্কার কোরে দিয়ে গেল, স্বতন্ত্র স্বতন্ত্র শয্যায় মুন্সীর ঘরেই আমরা শয়ন কোল্লেম।
মনে আমার আর এক ভাবের উদয়। মনে মনে না রেখে চুপি চুপি মুন্সীজীকে আমি জিজ্ঞাসা কোল্লেম, “আচ্ছা মহাশয়! আপনি যে বোল্লেন, ঘনশ্যামবাবু সৰ্ব্বদা এখানে থাকেন না, কত দিন অন্তর এক একবার আসেন? সে সব দিন তবে থাকেন কোথায়?”
মুন্সী উত্তর কোল্লেন, “কিছুই ঠিক নাই, কোথায় যে কখন থাকেন, কোন কার্য্যে যে কখন ব্যস্ত, কেহই সে কথা বোলতে পারে না। তবে আমি কেবল এইটুকু জানি, হুগলীজেলার সপ্তগ্রামের কাছে কি একখানা ক্ষুদ্র গ্রাম আছে, সেইখানে একখানা আড়ত আছে, সেইখানেই মধ্যে মধ্যে আড্ডা হয়। কুলিধরা কাজ একটা ভাল ব্যবসা, যাদের কাজ, তারাই বলে ভাল। এই ঘনশ্যামবাবু সেইখান থেকেই ছেলেধরা ব্যবসাটা চালান; ছোট ছোট ছেলে-মেয়ে ধোরে নদীয়াজেলায় আর অন্য অন্য জায়গায়, যেখানে নীলকুঠী আছে, সেই সব জায়গায় চালান দেন। পাপের কৰ্ম্ম কি না, এক এক সময় এমনি ঘটে, ঘনশ্যামের আহার পর্য্যন্ত জোটে না; সে সময় তিনি বড় বড় কুঠীয়াল লোকের দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করেন; মুষ্টিভিক্ষা নয়, মোটা মোটা সাহায্য ভিক্ষা। কোথাও ফল ফলে, কোথাও অর্দ্ধ ফলন; কেবল কুঠীয়ালের কথাই বা কেন বলি, রকমারী দাতালোকের শরণাপন্ন হওয়াও ঘনশ্যামের অভ্যাস। সেই প্রকারের দিন নিকটবর্ত্তী হয়ে এসেছে, আমি তার সন্ধান জানতে পেরেছি। আর সেই যে হরেরাম শুকুলটী এসেছিলেন, সত্য তিনি হরেরাম শুকুল নন; আমি তাঁকে চিনি। এখন সে কথা আমি তোমাকে বোলবো না; এখন তোমাকে এখান থেকে মুক্ত করাই আমার কাজ। এর পর যদি কখনো তোমার সঙ্গে আমার দেখা হয়, তখন তুমি আমার মুখে ঘনশ্যামচরিত সবিশেষ শুনতে পাবে। আমার নাম গয়ারাম মিশ্র, আমার পিতামহ নবাব-সরকারে চাকরী কোত্তেন, তাঁর পদবী ছিল মুন্সী। সেই জন্য এখনও আমরা পুরুষানুক্রমে মুন্সী। আমার নিবাস নবদ্বীপ। আর দেখ হরিদাস! আমি যে এখানে থাকি, ঘনশ্যামের চাকরী করি না, কাজকর্ম্ম করি, বেতন গ্রহণ করি না, বরং ঘনশ্যাম আমার কাছে মধ্যে মধ্যে বিশ পঞ্চাশ টাকা হাতকর্জ্জ বোলে গ্রহণ করেন, শেষে উবুড়হস্ত হন না, তবু আমি দিই। কেন দিই, সে কথাও এখন ভাঙবো না। আমার পিতার কাছে ঘনশ্যামের দস্তখতী পঞ্চাশখানা খত ছিল, পিতার মৃত্যুর পর সেই সকল খত আমার হাতে এসেছে। আমি যদি পীড়াপীড়ি করি, সেই ভয়ে আমার নাম জাল দস্তখত কোরে ঘনশ্যাম অনেক টাকার জালখত আপন হস্তে রেখেছে। আমি যদি এখানকার কাজকর্ম্ম ছেড়ে অন্যস্থানে চোলে যাই, সেই সময় আমাকে জব্দ কোরবে, এইটীই তার মতলব। সেই জন্যই আমি বোলছি, আমার উপর ঘনশ্যামের অধিক প্রভুত্ব। আমার খাতক আমার হাতে থাকলো না, কালের গতিকে আমিই এখন তার হাতের ভিতর। সেই দিন একবার—”
ঘরের দরজা খোলা ছিল, ঘরে প্রদীপ জ্বোলছিলো, মুখে ঐ কথাটী নির্গত হতে না হতেই কে একজন হঠাৎ ঘরের ভিতর এসে ধমক দিয়ে বোল্লে, “এত রাত পর্য্যন্ত ঘুম নাই? কোথাকার একটা পলাতক ছোকরাকে ধোরে এনেছে, তার কাছে ঐ সকল ঘরের কথা? এবার তিনি এলেই এই সব কথা আমি বোলে দিব, দুজনে তোরা ইংরেজের জেলখানায় পোচে মোরবি!”
আমি চোমকে উঠলেম। মুন্সীজীও ভয় পেলেন। তিনি বোল্লেন, “করো! এত রাত্রে তুই এখানে কি কোত্তে এলি? ঘরে যা!—শু গে যা! বোলে দিয়ে যা কোত্তে পারিস, চেষ্টা করিস, তোকেও আমি ভয় করি না, তাকেও আমি ভয় করি না।”
যার সঙ্গে মুন্সীজীর ঐ রকম কথা-কাটাকাটি, কে সে? যে আমাকে ঘোল-চিঁড়ে এনে দিয়েছিল, সেই বুড়ী। মুন্সীজীর কথা শুনে খিলখিল কোরে হেসে বুড়ী তখন চুপি চুপি বোল্লে, “সেজন্য নয় গো, সেজন্য নয়, এই ছেলেটীকে দেখে আমার কেমন মায়া হয়েছে, কি কোচ্চে, তাই আমি দেখতে এসেছি। তুমি বোলেচ, ঠিক কথা! কৰ্ত্তা আমাদের দু-এক দিনের মধ্যেই ভিক্ষাযাত্রা কোরবেন, আমি তার আভাষ পেয়েছি, সেই সময় এই ছেলেটীকে তুমি এখান থেকে সোরিয়ে দিও, আমি তোমার সহায় হবো।
এই কথা বোলেই বুড়ী চোলে গেল, সে প্রসঙ্গে আমরাও আর কিছু বলাবলি কোল্লেম না, ঘুমিয়ে পোড়লেম। নিরুদ্বেগে রজনী প্রভাত হলো। পাঁচ সাত দিন আমি মুন্সীজীর কাছেই থাকলেম, কাজকর্ম্ম কিছুই কোত্তে হলো না, রাশীকৃত কাঁইবীচি দেখে দেখেই কেবল হাসলেম আর ভগবানকে ডাকলেম।
অষ্টম রজনীতে ঘনশ্যাম দর্শন দিলেন। বাড়ীর মধ্যে সোরগোল পোড়ে গেল। রাত্রি প্রায় এক প্রহরের কাছাকাছি। কৰ্ত্তা এসেই উপরে উঠে অগ্রে আমাকেই খোঁজ কোল্লেন। মুন্সীর ঘরে আমি শুয়েছিলেম, মুন্সী আমাকে ডেকে দিলেন, নিজেও আমার সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে এসে কৰ্ত্তার সম্মুখে দাঁড়ালেন। সকলকে বিদায় দিয়ে ঘনশ্যাম কেবল আমাকেই নিকটে রাখলেন। যেটার নাম আফিসঘর, সেই ঘরে তিনি আমাকে নিয়ে গেলেন। ঘরে আলো ছিল না, ডাকাডাকি হাঁকাহাঁকিতে ফটকের সেই দরোয়ান এসে একটা আলো জ্বেলে দিয়ে গেল। দুজনে আমরা দুখান চেয়ারে বোসলেম। চেয়ার, টেবিল, আফিস, এ সকল নাম আমি জানতেম না, ক্রমে ক্রমে শিক্ষা কোত্তে লাগলেম। এতদিন আচার্য্যগৃহে শিক্ষা পেয়েছি, সে শিক্ষা অন্যপ্রকার;—সে শিক্ষা কেবল পুথিগত; সৌভাগ্য অথবা দুর্ভাগ্যবশে এখন অবধিই আমার সংসার-শিক্ষা আরম্ভ।