» » » ঊনত্রিংশ কল্প : রহস্য প্রকাশ

বর্ণাকার

ভূবনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়

হরিদাসের গুপ্তকথা
প্রথম খণ্ড

ঊনত্রিংশ কল্প : রহস্য প্রকাশ

রাজপুত্রের নিকেতনে আমি উপস্থিত। যে ঘরে গিয়ে আমি প্রবেশ কোল্লেম, কুমার বাহাদুর তখন সে ঘরে ছিলেন না। দেখলেম, একটি নূতন লোক। সেই লোক আমারে অভ্যর্থনা কোরে সেইখানে বসালেন। আমি হরিদাস, আমার অসাক্ষাতে সে কথা তিনি শুনেছিলেন, আমার মুখে নামটি আর একবার শ্রবণ কোরে ঘনিষ্ঠভাবে বোল্লেন, “রাজকুমার এখনি আসবেন। ডাকাতেরা চালান হয়ে এসেছে, বিচারের অগ্রে হাজতী আসামীরা যে বাড়ীতে থাকে, সেই বাড়ীতেই তাদের রাখা হয়েছে। পাহারার সুবন্দোবস্তের জন্য রাজপুত্র সেখানেই গিয়েছেন। আপনি কিয়ৎক্ষণ এইখানে অপেক্ষা করুন, অবিলম্বেই তিনি আসবেন।”

কথাগুলি যিনি বোল্লেন, তিনি ভদ্রলোক। নাম শুনলেম, মঙ্গলচাঁদ। রাজসংসারের তিনি কর্ম্ম করেন, রাজকুমারের সঙ্গে তাঁর সখ্যভাব। মঙ্গলচাঁদের সঙ্গে আমার অনেক রকম কথাবার্ত্তা হোতে লাগলো। ডাকাত ধরার কথাও তিনি কতক কতক বোল্লেন। প্রধান দুর্গে বীরমল্ল থাকতো, তার অধীনস্থ অপরাপর দুর্গে অপরাপর ডাকাতেরা থাকতো, বীরমল্ল বন্দী হবার পর সেই সকল দুর্গেও সিপাহী প্রেরিত হয়েছিল, কোতোয়ালীর লোকেরাও সিপাহীদের সঙ্গে ছিল, সে সকল দুর্গের ডাকাতেরাও ধরা পোড়েছে। শুনলেম, জনকত পালিয়ে গিয়েছে! দুর্গমধ্যে যারা ছিল না, তারা এখনও নিরাপদে আছে। অবসর-প্রতীক্ষায় কোতোয়ালীর লোকেরা সেই সকল পলাতকের অনুসন্ধানে নিযুক্ত আছে।

এই সকল কথা হোচ্ছে, এমন সময় রাজপুত্র এলেন। উঠে দাঁড়িয়ে করপুটে আমি তাঁরে অভিবাদন কোল্লেম। স্মিতবদনে রাজপুত্র বোল্লেন, “বেশী রাত্রি কর নাই, শীঘ্র শীঘ্র এসেছ, ভালই হয়েছে। এদিকে অনেক কাজ ফর্সা হয়ে এসেছে! ডাকাতের কেল্লা পরিষ্কার। কেল্লার সজ্জিত ধন-রত্ন, অস্ত্র-শস্ত্র, গুপ্তযন্ত্র ইত্যাদি যতক্ষণ স্থানান্তরিত করা না হয়, ততক্ষণের জন্য কেল্লার মুখে পাহারা রাখা হয়েছে। অশ্বগুলোকে আর কুকুরগুলোকে আমাদের বাগান বাড়িতে এনে রাখা হয়েছে। সব একরকম পরিষ্কার। হাঁ, তুমি বোলছিলে, তোমার দ্বারা আমার কি মহোপকার সাধিত হয়েছে, সেটি তুমি বুঝতে পাচ্ছো না। যাতে কোরে বুঝতে পার, তাই আমি তোমাকে শুনাবো।”

নবীন আগ্রহে আমি বোল্লেম, “হাঁ রাজকুমার! কিছুই আমি বুঝতে পাচ্ছি না। আমি গরিব, নিরাশ্রয়, নিৰ্ব্বান্ধব, বিদেশী, ডাকাতের হাতে বন্দী, আমি একজন মহা প্রতাপশালী রাজপুত্রের উপকারে আসবো, ভেবে চিন্তে কিছুই ত ঠিক কোত্তে পাচ্ছি না। পরিহাসের সম্পর্ক নয়; পরিহাসের সম্পর্ক যদি হতো, তা হোলে আমি মনে কোত্তেম, পরিহাস।

হাস্য কোরে রাজপুত্র বোল্লেন, “না হরিদাস, পরিহাস নয়; যথার্থই তুমি আমার মহোপকার সাধন কোরেছ; তোমার কল্যাণে আমাদের এই সবিস্তৃত রাজ্যটি নিষ্কণ্টক হয়েছে। ঐ বীরমল্ল রাজসংসারে চাকরী কোত্তো; পূর্ব্বে একটা ছোট চাকরী ছিল, মহারাজের অনুগ্রহে শেষকালে ঐ বীরমল্ল রাজসেনাদলের হাবিলদার হয়। মহারাজ তাকে অকপটে বিশ্বাস কোত্তেন, বিশ্বাসঘাতক সেই বিশ্বাসের অহঙ্কারে নানা প্রকার দুষ্কার্য্য করে, গৃহবিবাদের ষড়যন্ত্রের সহায় হয়, প্রজামণ্ডলীকে বিদ্রোহোম্মদে মাতিয়ে তোলবার চেষ্টা করে। গোপনে গোপনে এই সকল কার্য্য চোলতে থাকে। সরকারী মালখানায় বীরমল্লের প্রবেশাধিকার ছিল, রাজ্যের কতকগুলি বিশেষ প্রয়োজনীয় দলীলপত্র সঙ্গোপনে সেই মালখানায় থাকত, বীরমল্ল সে সন্ধান জানতো; সেনাদলের হাবিলদার, যখন ইচ্ছা তখনই সে ব্যক্তি মালখানায় যাওয়া আসা কোত্তে পাত্তো, মহারাজের বিশ্বাস পাত্র, কেহই তার প্রবেশে বাধা দিত না, ঘর যখন জনশুন্য থাকত, কেহই যখন সেখানে উপস্থিত থাকতো না, প্রহরীরা পর্য্যন্ত দূরে দূরে বেড়াতে, কিবা নিদ্রাসুখ উপভোগ কোত্তো, সে সময়ও বীরমল্ল সেই ঘরে যেতো। কতদিন ঐ ভাব চোলেছিল, কেহই আমরা জানতেম না। হঠাৎ একদিন শুনা গেল, বীরমল্ল নিরুদ্দেশ! অনুসন্ধানে প্রকাশ পেলে, রাজ্যের সেই সকল প্রয়োজনীয় দলীলপত্র যে বাক্সটিতে ছিল, সেই বাক্সটিও অদৃশ্য!”

এই পর্য্যন্ত শ্রবণ কোরে বিস্ময়ে রোমাঞ্চিত কলেবরে নিৰ্ণিমেষ নয়নে রাজপুত্রের মুখের দিকে আমি চাইলেম। রাজপুত্র বোলতে লাগলেন, “বীরমল্ল নিরুদ্দেশ! কতস্থানে কত অন্বেষণ করা গেল, কতদিকে কতস্থানে কতলোক প্রেরিত হলো, কোন সন্ধান পাওয়া গেল না। তার পর দেশ বিদেশের দুরাচার দুর্দ্দান্তলোক সংগ্রহ কোরে, বীরমল্ল একটা ডাকাতের দল বাঁধলে, বনের ভিতর কোথায় কত গুপ্তদর্গ ভূগর্ভমধ্যে অবস্থিত, বীরমল্লের সে সকল সন্ধান জানা ছিল; সেই সকল দুর্গেই ডাকাতেরা আড্ডা কোল্লে। প্রায় প্রতি রজনীতেই প্রজালোকের গৃহাদি লুণ্ঠন কোত্তে আরম্ভ কোল্লে; রাজপুরী আক্রমণেরও দুরভিসন্ধি তাদের ছিল, পেরে উঠে নাই। যে দলীলগুলি বীরমল্লের হস্তগত, সেইগুলির উপর রাজসিংহাসনের নিরাপদ নির্ভর করে; সেগুলির অভাবে মহারাজকেও সৰ্ব্বক্ষণ শঙ্কিত থাকতে হয়েছিল; সিংহাসনের জন্য জ্ঞাতিবিরোধের সম্ভাবনা হয়ে উঠেছিল; সকলেই শঙ্কিত। আমি সেই সময় নানা প্রকার উপায় অবলম্বনে অভীষ্টসিদ্ধিতে বিফলচেষ্ট হয়ে ডাকাতের মত ছদ্মবেশ ধারণ কোরে, বীরমল্পের সঙ্গে বিশ্বস্তভাবে আলাপ কোরে, তাদের দলের সঙ্গে মিশি; লুটপাটের সময় দস্যুদলের সঙ্গী হই নাই, দুগমধ্যেই সৰ্ব্বদা অবস্থান কোত্তেম; রাহাজানীসূত্রে ডাকাতেরা যে সকল পথিক লোককে ধরে নিয়ে যেতো, ডাকাতেরা যেমন করে, সেই রকমে আমিও সেই সকল নিরীহ পথিক লোককে জোরে জোরে ধমক দিতেম, মুখের কাছে সঙ্গীন ধোরে ধোরে, তলোয়ার নাচিয়ে নাচিয়ে, গর্জ্জন কোরে ভয় দেখাতেম; ডাকাতের যেমন ধৰ্ম্ম, মুখে মুখে সেই রকম ধৰ্ম্মই আমি পালন কোত্তেম, সমস্তই আমার মুখে মুখে; তর্জ্জন, গর্জ্জন, আস্ফালন, ভয়-প্রদর্শন, সমস্তই আমার মুখের কথায়, একটি লোকের উপরেও কাজে আমি কোন প্রকার নিষ্ঠুরতা দেখাই নাই, দুর্গমধ্যে আমার জ্ঞাতসারে ডাকাতেরাও কোন নিরীহ শীকারের কেশস্পর্শ কোত্তে পারে নাই; মুখোসে মুখাবৃত কোরে বিপন্নের উপকারের জন্য, ডাকাতের মনস্তুষ্টির জন্য ঐরূপ কার্য্যই আমি কোত্তেম; আর কি কি কোত্তেম, সে কথা সেই কারাকুপের মধ্যেই আমি তোমাকে বলেছি, একটু চিন্তা কোল্লেই সে সব কথা তোমার স্মরণ হোতে পারবে।”

চিন্তার প্রয়োজন হলো না, কুমারের মহত্ত্বের কথাগুলি স্পষ্টই আমার মনে ছিল, ভক্তিভাবে অভিবাদন কোরে ত্বরিতস্বরেই আমি বোল্লেম, দেবচরিত্রের সঙ্গে আপনার চরিত্রের তুলনা করা যায়! আপনার কৃপায় অনেক নিরীহ লোক দুরন্ত ডাকাতের কবল থেকে নিষ্কৃতি লাভ কোরেছে, সে সব আমি শুনেছি, রাজভোগলালিত সুখের শরীর আপনি কেবল পরোপকারে ক্লিষ্ট কোরেছেন, পরোপকারের জন্য ডাকাতের বেশ ধরেছেন, এটি সাধারণ ঔদার্যের কার্য্য নয়।

প্রফুল্ল নয়নে আমার মুখের দিকে চেয়ে রাজপুত্র বোল্লেন, “হাঁ, শরীর আমি ক্লিষ্ট কোরেছি, কিন্তু কাজ কিছুই কোত্তে পারি নাই; তোমার কল্যাণেই কার্য্যসিদ্ধি। রাজার মালখানা থেকে বীরমল্ল যে বাক্সটা চুরি কোরেছিল, তোমার আবিষ্কৃত রজত-বাক্সটিই সেই দুর্লভ বাক্স। ঐ বাক্স যতদিন বীরমল্লের দখলে ছিল, বীরমল্ল ততদিন আমাদের মহারাজের উপরেও আধিপত্য কোত্তে সমর্থ ছিল, ইচ্ছা কোল্লেই রাজাকে রাজ্যচ্যূত কোরে অন্য একজন রাজাকে রাজসিংহাসনে বসাতে পাত্তো, কিম্বা হয়ত বীরমল্ল নিজেই সিংহাসন অধিকার কোরে স্বাধীন রাজক্ষমতা পরিচালন কোরবে, মনে মনে তাঁর এই ইচ্ছা ছিল। এই সকল কারণেই মহারাজ এতদিন ভীমরুলের চাকে লোষ্ট্র নিক্ষেপ করেন নাই। তোমার কল্যাণে,—সাধু হরিদাস, তোমার কল্যাণে আমরা সকলেই নিঃশঙ্ক হোলেম, প্রজাগণ নিরাপদ হলো, রাজ্য নিরুপদ্রব হলো, কুচক্রী দস্যুদল ধরা পোড়লো। এই মহোপকারের জন্য তোমার কাছে আমি চিরজীবনের জন্য কৃতজ্ঞ থাকলেম। জীবনকালের মধ্যে এ উপকার কদাচ আমি বিস্মৃত হব না। যাতে তুমি চিরজীবন পরমসুখে অতিবাহিত কোত্তে পার, অবশ্যই আমি উপায় কোরবো। যাতে কোরে তুমি বহু মান—বহু সম্পদের অধিকারী হও, অঙ্গীকার কোচ্ছি, ঈশ্বরের নামে শপথ কোরে বোলছি, অবশ্য আমি সে চেষ্টা কোরবোই কোরবো।”

করযোড়ে আমি তাঁরে নমস্কার কোল্লেম। কিয়ৎক্ষণ আমার মুখের দিকে অনিমেষে চেয়ে থেকে, অল্প অল্প হাস্য কোরে রাজপুত্র বোল্লেন, “এসো হরিদাস, একটা মজা দেখবে এসো!”

এই দুটি কথা বোলেই তিনি দাঁড়ালেন। ঘরের উত্তরদিকে একটা দরজা খোলা ছিল, আমাকে অনুগামী হবার ইঙ্গিত কোরে সেই দরজার দিকে তিনি অগ্রসর হতে লাগলেন, সকৌতুকে আমিও অনুগামী। মজা দেখতে চোলেছি, রাজপুত্র আমাকে কি মজা দেখাবেন, অনুমানে কিছু ভেবে পেলেম না। জাদুঘর নয়, চিত্রশালা নয়, পশুশালা নয়, একজন রাজপুত্রের বাসভবন, এর মধ্যে মজার জিনিস কি থাকতে পারে, ভাবতে ভাবতে আমার কৌতুহল বেড়ে উঠলো।

আমরা চোলেছি, অগ্রে অগ্রে রাজকুমার, পশ্চাতে আমি। দরজাটা পার হয়ে আর একটা ঘর। সে ঘরে জিনিষপত্র ছিল, মানুষ ছিল না; জিনিষের মধ্যে মজার জিনিষও কিছু নয়নগোচর হলো না; রাজপুত্রও কোন দিকে চাইলেন না; সম্মুখদিকে চক্ষু রেখে সমান চোলে যেতে লাগলেন। পর পর ঐ রকমের তিনটি ঘর আমরা অতিক্রম কোল্লেম। চতুর্থ গৃহে প্রবেশ। সকল ঘরেই আলো ছিল, এ ঘরেও বেশ আলো। ঘরের মধ্যস্থলে উপস্থিত হয়ে রাজপুত্র একবার স্থির হয়ে দাঁড়ালেন, ফল্লুনয়নে আমার দিকে চাইলেন। দৃষ্টির ভাবে আমি অনুমান কোল্লেম, এই ঘরেই হয় ত কোন রকম মজা থাকতে পারে।

ঘরের তিনদিকে তিনটি দরজা; দরজার ধারে ধারে বড় বড় গবাক্ষ; রাজপুত্র একে একে সেই সকল দ্বার গবাক্ষ বন্ধ কোরে দিলেন। আমি দেখলেম, ঘরের পূর্ব্বধারে একটা যবনিকা ফেলা;—নাট্যশালার রঙ্গমঞ্চে অভিনয় আরম্ভ হবার পূর্ব্বে যেমন যবনিকা ফেলা থাকে, সেই রকম যবনিকা;—তিন হত দীর্ঘ ও প্রশস্ত একটি স্থান সেই যবনিকায় ঢাকা।

রাজপুত্র ধীরে ধীরে যবনিকার নিকটবর্ত্তী হয়ে যুগলহস্তে একবারের একগাছি রজ্জু আকর্ষণ কোল্লেন, খড়খড় শব্দে যবনিকা উত্তোলিত হলো। একটু পাশ কাটিয়ে দাঁড়িয়ে আমার দিকে ফিরে হাসতে হাসতে তিনি বোলেন, “দেখ!”

কি আমি দেখলেম?—ক্ষুদ্র একখানি চৌকী, সেই চৌকীর উপর একটি স্ত্রীলোক। স্ত্রীলোকটি আপনার হাত দুখানি কোলের উপর রেখে পা ঝুলিয়ে বোসে আছে। মুখখানি স্পষ্ট দেখতে পেলেম না, নাসাগ্র পর্য্যন্ত ঘোমটাটাকা।

এইটিতেই তবে মজা আছে, এইরূপ অনুমান কোরে সতৃষ্ণ-নয়নে রাজপুত্রের মুখপানে আমি চাইলেম; রাজপুত্র মৃদু হাস্য কোল্লেন। স্ত্রীলোকটি যেন একখানি গঠিত প্রতিমা; নড়েও না, চড়েও না, কোল থেকে হাত দুখানিও সরায় না, অচলা।

গম্ভীর-বদনে রাজপুত্র আমাকে বোল্লেন, “এই পুত্তলিকার সঙ্গে তুমি আলাপ কর!” পুত্তলিকাকে সম্বোধন কোরে তিনি বোল্লেন, “পুত্তলিকে! ঘোমটা খোলো!”

পুত্তলিকা সমভাব নিশ্চলা। রাজপুত্রের মুখপানে আমি চেয়ে আছি, আমার মুখপানে রাজপুত্র চেয়ে আছেন; এই সময় আমাদের নিৰ্ব্বাক অভিনয়। পুত্তলিকা নড়ে না, রাজকুমার আরো দুই তিন পদ অগ্রসর হয়ে, ধীর হস্তে তার মুখের ঘোমটা খুলে দিলেন, মূর্ত্তি তখন যেন লজ্জা পেয়ে উজ্জ্বল নয়ন-দুটি নিমীলিত কোরে ফেল্লে। তখন আমি বুঝলেম, পুতুল নয়, প্রতিমা নয়, মূর্ত্তি সজীব।

হঠাৎ বিস্ময়ে আমার সৰ্ব্বশরীরে রোমাঞ্চ। কে এ? আমার বিস্ময়ের সঙ্গে পাঠকমহাশয়কে বিস্মিত হোতে হবে না, এ মূর্ত্তি পাঠকমহাশয়ের চক্ষে নূতন নয়, পূর্ব্বের পরিচিতা। মূর্ত্তি সেই রঙ্গিণী!

পুনৰ্ব্বার মৃদু হাস্য কোরে রাজপুত্র আমাকে বোল্লেন, “আলাপ কর হরিদাস, আলাপ কর! বীরমল্লের মহিষী রঙ্গিণীর সঙ্গে মন খুলে তুমি আলাপ কর!”

আমি একটু লজ্জা পেলেম। আমার লজ্জা অপেক্ষা রঙ্গিণীর লজ্জা যেন অনেক বেশী বোধ হলো। রাজপুত্র তার ঘোমটা খুলে দিলেন, হাত তুলে সে আর সে ঘোমটা টেনে মুখখানি ঢাকলে না, চক্ষু মুদে মৌনবতী হয়ে বোসে থাকলো, মস্তক ঈষৎ অবনত আমি দেখছি, রঙ্গকুশলা রঙ্গিণীর লজ্জাটার রঙ্গ কেমন, তাই আমি চেয়ে চেয়ে দেখছি।

অকস্মাৎ যেন মেঘোদয়। সেই মেঘে অকস্মাৎ বৃষ্টি! রঙ্গিণীর নয়নে মেঘ নয়ন নিমীলিত, অথচ সেই নিমীলিত নেত্রের প্রান্ত ভেদ কোরে অশ্রুধারা প্রবাহিত।

রঙ্গিণী কাঁদছে। বীরমল্লের সঙ্গছাড়া হয়ে বিরহের ক্ৰন্দন কিম্বা পূর্ব্বাবস্থা স্মরণ কোরে অনুতাপের ক্রন্দন, তখন সেটা বুঝতে পারা গেল না। যাই কেন হোক না, যেই কেন হোক না, লোকের চক্ষে জল দেখলে আমার চক্ষে জল আসে, এটি যেন আমার স্বভাবসিদ্ধ সংস্কার; নিজের দুঃখে নিজের বিপদে শৈশবাবধি অনেকবার আমি কেঁদেছি, নির্জ্জন হোলে এখনো আমি গুমরে গুমরে কাঁদি; আমি যত কেঁদেছি, সংসারে কেহই হয় ত তত কাঁদে নাই; আমি যত কাঁদি, কেহই হয় ত তত কাঁদে না, তথাপি পরের চক্ষে জল দেখলে আমার প্রাণে অতিশয় বেদনা অনুভূত হয়। “কেদো না রঙ্গিণী, কেঁদো না! চিত্তের আবেগে সে রাত্রে গোটাকতক কথা বোলে, আমি বড় অন্যায় কোরেছি, তোমার প্রাণে ব্যথা দিয়েছি, তুমি আমারে ক্ষমা কর!”

রাজপুত্র স্থিরভাবে দণ্ডায়মান, রঙ্গিণীকে যে কথা আমি বোল্লেম, রাজপুত্রের কর্ণে সে কথাগুলি নূতন; রঙ্গিণীকে কি কথা আমি বোলেছিলেম, রাজপুত্র তার কিছুই জানতেন না, এখনো জানেন না, আমার মুখে ঐ কটি কথা শুনে, চকিত-নেত্রে আমার পানে চেয়ে, ক্ষণকাল তিনি অবাক হয়ে থাকলেন। অনন্তর মৌনভঙ্গ কোরে তিনিও রঙ্গিণীকে বোল্লেন, “কেঁদো না রঙ্গিণী, কেঁদো না; চুপ কর; শান্ত হয়ে হরিদাসের সঙ্গে মনের কথা কও; মন খুলে আলাপ কর।”

রঙ্গিণী কথা কয় না;—নীরবে কেবল কাঁদে আর ফোঁস ফোঁস কোরে নিশ্বাস ফেলে। মনে মনে কি অনুধাবন কোরে রাজপুত্র তখন আমারে বোল্লেন, “আচ্ছা থাক হরিদাস, আমার সাক্ষাতে তোমার সঙ্গে কথা কোইতে রঙ্গিণী বোধ হয় লজ্জা পাচ্ছে, আমি এখন এখান থেকে চোল্লেম, রঙ্গিণীর মনের কথাগুলি তুমি শ্রবণ কর।”

যে দিকের দরজা দিয়ে সে ঘরে আমরা প্রবেশ কোরেছিলেম, সেই দিকের দরজাটি খুলে রাজকুমার বেরিয়ে গেলেন; শব্দে বুঝলেম, বাহিরদিকে শিকল দিলেন। তখন সেই অবরুদ্ধগৃহে কেবল আমি আর রঙ্গিণী।

কি কথা প্রথমে আমি জিজ্ঞাসা কোরবো, অনেকক্ষণ পর্য্যন্ত স্থির কোত্তেই পাল্লেম না। রাজপুত্রকে দেখে রঙ্গিণীর লজ্জা হোচ্ছিল, তিনি ত তাই ভেবেই সোরে গেলেন, কিন্তু লজ্জা আর রোদন সচরাচর একসঙ্গে আসে না। রঙ্গিণী কাঁদে কেন? আমারি হয় ত ভুল হয়েছে। এ রঙ্গিণী হয় ত বীরভূমের সে রঙ্গিণী নয়;—ঠিক হয় ত আমি চিনতে পারি নাই, অল্পক্ষণ একবার মাত্র দেখা, ঠিক চিনতে না পারাই সম্ভব; সেই রঙ্গিণী মনে করে সে রাত্রে যতগুলি কথা আমি বোলেছি, যত তিরস্কার কোরেছি, রঙ্গিণীর বুকে শেলসম সে সব কথা বেজেছে; কথাগুলো বোলে আমি ভাল করি নাই। আমার অনুমান হয় ত ভুল। চেহারার মিলনে অনেক সময় অনেক অনর্থ ঘটে। অমরকুমারী মনে কোরে সমরকুমারীর কার্য্যকলাপে আমি অভিমান কোরেছিলেম, অমরকুমারী মনে কোরে সমরকুমারীর মরণে আমি শোক পেয়েছিলেম, চেহারার মিলনে শান্তিরাম দত্তের বাড়ীতে সজীব অমরকুমারীকে ভূত ভেবে আমি ভয় পেয়েছিলেম; শেষকালে সত্য তত্ত্ব প্রকাশ পায়। এই রঙ্গিণী সম্বন্ধেও হয় ত আমার সেই রকম ভ্রম ঘোটেছে; এ রঙ্গিণী আর বীরভূমের সে রঙ্গিণী হয় ত এক নয়।

অনুতাপের সঙ্গে মনে মনে এই সব আলোচনা কোরে, আমি স্বহস্তে রঙ্গিণীর চক্ষের জল মুছিয়ে দিলেম, ক্ষমা প্রার্থনা কোরে পুনরায় বোল্লেম, “সে কথাগুলো বলা আমার ভাল হয় নাই, কিছু মনে কোরো না তুমি, আমার ভুল হয়েছিল। তোমার মত চেহারার একটি স্ত্রীলোককে আমি একদিন একবার মাত্র কাশীধামে দেখেছিলেম, তাই ভেবে মনে কোরেছিলেম, হয় ত তুমিই সেই। এখন যেন বুঝতে পাচ্ছি, তুমি নও। আর কোঁদো না, শান্ত হও, সে সব কথা ভুলে যাও। আমার সাক্ষাতে তোমার কি কথা বলবার আছে, যদি কিছু থাকে, স্বচ্ছন্দে বল। বিপাকে পোড়ে ধৰ্ম্ম হারিয়েছ, তোমার দোষ কি? পাপাচার দস্যু বলপূৰ্ব্বক তোমার জাতিকুল নষ্ট কোরেছে, তোমার দোষ কি? যা কিছু তোমার বলবার থাকে, নির্ভয়ে বল, রাজপুত্রকে অনুরোধ কোরে আমি তোমার ভাল করবার চেষ্টা পাব। রাজপুত্রটি পরম দয়ালু।”

আবার রঙ্গিণীর চক্ষে জলধারা। আবার আমি নানাপ্রকারে সান্ত্বনা প্রদান কোল্লেম। অবশেষে নেত্রমার্জ্জনা কোরে স্তম্ভিতস্বরে রঙ্গিণী বোলতে লাগলো, “না হরিদাস, তা নয়, তোমার ভুল নয়; আমিই সেই পাপীয়সী! আমিই সেই অভাগিনী কুলকলঙ্কিনী! তোমার ভুল নয়; ঠিক তুমি ধোরেছ! মতিভ্রমে কুৎসিত প্রলোভনে ভুলে আমি কুলের বাহির হয়েছিলেম! কপালের লিখন, কপালে যা ছিল, ঘোটে গেল! পাষণ্ড ডাকাতের ঘরণী হয়ে পরকালের পথে কাঁটা দিলেম! আমি মহাপাতকী! এ মহাপাতকে আর কি আমার নিস্তার আছে? ইহকাল পরকাল কিছুই আমার নাই। আমি যদি—”

বোলতে বোলতে অভাগিনী আবার চক্ষের জলে ভেসে গেল। বসনাঞ্চলে অশ্রুমার্জ্জন কোরে দিয়ে বিবিধ প্রবোধবাক্যে আমি বোল্লম, “অত কাতরা হোচ্ছ কেন? ভাগ্যফল মানো, ভাগ্যলিপি খণ্ডন হয় না জানো, তবে কেন অধীরা হও? সকল পাপেরই প্রায়শ্চিত্ত আছে, প্রায়শ্চিত্তে সৰ্ব্বপাপ-বিমোচন হয়। স্বেচ্ছায় তুমি পাপপথে পদার্পণ কর নাই; একবার দুষ্টের প্রলোভনে, দ্বিতীয়বার পিশাচের আক্রমণে তুমি স্বপথ ভ্রষ্ট হোয়েছিলে, অবশ্যই সে পাপের খণ্ডন আছে। অনুতাপ এসেছে, শান্তি পাবে; অনুতাপ এক মহা প্রায়শ্চিত্ত। কাতরতা পরিত্যাগ কর। যে সব কথার আন্দোলনে প্রাণে ব্যথা লাগে, সে প্রসঙ্গ ছেড়ে দাও; মন যাতে অন্যদিকে ফেরে, সেই সব কথা বল। সে সব গত কথা ছেড়ে দাও!”

“কি কোরে ছেড়ে দিব হরিদাস?”—দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে, অনুতাপিনী বোলতে লাগলো, “সে সব কথা কি কোরে ছেড়ে দিব হরিদাস?—কেমন কোরে ভুলে যাবো? প্রাণ যে কেমন হু হু করে! বুক যেন পুড়ে পুড়ে খাক হয়ে যায়! উঃ! পাপের আগুনের এত তেজ! কানাই! উঃ—সেই সৰ্ব্বনেশে কানাই আমার পরকালের পথে বিষবৃক্ষ রোপণ কোরেছে!—মোলো না!—ডাকাতে ধোরেছিল, মশাল জ্বেলে জ্বেলে মুখে আগুন দিয়েছিল, কান কেটে নিয়েছিল, তবুও মোলো না! পালিয়ে গেল! ভোঁ ভোঁ কোরে ছুটে পালালো!—অত বড় পাপীর কি শীঘ্র মরণ আছে? আমার মরণ কবে হবে হরিদাস?—মরণটা হোলেই জুড়িয়ে যাই!—ইচ্ছা হয়, জলে অনলে ঝাঁপ দিয়ে এ পাপ-প্রাণ বিসর্জ্জন করি।”

তীব্রস্বরে আমি বল্লেম, “আবার ঐ সব কথা? আত্মহত্যা মহাপাপ! আত্মহত্যার ইচ্ছা করাও অনন্ত নরকবাসের হেতু। ও সব কথা ভুলে যাও! আমি যে সব কথা জিজ্ঞাসা করি, শান্ত হয়ে সেই সব কথার উত্তর কর। আচ্ছা রঙ্গিণী, ডাকাতের আড্ডায় রাত্রে দুবার তুমি কি একটি কথা বলবার উপক্রম কোরেছিলে,—একটি লোক—কিন্তু একটি লোক—এই রকম চাপা চাপা কথা। সে কথাটি কি এখন তুমি স্মরণ কোত্তে পার? কার কথা সেটি? কোন লোকটি?—স্মরণ হয় কি?”

রঙ্গিণী। স্মরণ?—ও হোঃ!—স্মরণ আমার সব হয়। তবে কি না—তবে কি না—কোন রাত্রে—

আমি।—যে যে রাত্রে দস্যুদলের ভয়ানক ভয়ানক নিষ্ঠুরতার কথা বোলতে বোলতে—একটি লোক—একটি লোক—

রঙ্গিণী।—ওঃ হোঃ সেই কথা?—সে কথা আর এখন কেন? সে দিন তো ফুরিয়ে গিয়েছে! ডাকাতেরা যখন ধর পোড়েছে, তখন আর—

আমি।—কার কথা তুমি বোলবে মনে কোরেছিলে, সেই কথাই আমি জিজ্ঞাসা কোচ্ছি। সে লোকটিও কি ধরা পোড়েছে? নাম কর দেখি, বুঝি আমি, কোন লোকটিকে।

রঙ্গিণী।—আহা হা!—তা কি আর তুমি জানো না?—সে লোকটির সঙ্গে তোমার কত কথা, কত ভাব, তাকে আর তুমি জানো না?

আমি।—তবু?—তবু?—নামটি একবার শুনতে পেলে—

রঙ্গিণী।—(চুপি চুপি) সেই ভূষণলাল—ভূষণলাল!—আহা!—ডাকাতের দলে থাকতো, ডাকাত নিশ্চয়, কিন্তু—এদিকে কিন্তু দয়ার সাগর! দত্তকুলের পেল্লাদ!

আমি।—(মনোবেগ সংবরণ করিয়া) হাঁ, দৈত্যকুলের প্রহ্লাদ, সে কথা সত্য, নিকেষি কুলের কথা তুমি বোলছ, সে কুলে তাঁর উম্ভব নয়, দৈত্যকুলের যম তিনি! তথায় পদতলে বহু দৈত্য বিমর্দ্দিত।

রঙ্গিণী।—(সবিস্ময়ে) অ্যাঁ!—অ্যাঁ—তাই না কি? জানো তুমি? জানো? বলো,—বলো,—আহা! বলো হরিদাস,—কে তিনি? কোন কুলে—

আমি।—কুলের পরিচয় শীঘ্রই তুমি জানতে পারবে। আমার মুখে এখনকার কথায়, দৈত্যকুলে তাঁর জন্ম নয়। যেমন তুমি বুঝেছ, যেমন তুমি দেখেছ, বাস্তবিক তাই তিনি,—গরিবের বন্ধু, দয়ার সাগর!

রঙ্গিণী।—(সজলনয়নে চাহিয়া) আহা! তিনিও কি তবে ধরা পোড়েছেন?

আমি।—তা আমি এখন কেমন কোরে বোলব? দলের ভিতরের সকলকেই কি আমি চিনে রেখেছি? সকলেরই কি আমি মুখ দেখেছি?

রঙ্গিণী।—তবে এই যে তুমি বোলছিলে, দত্তকুলের যম তিনি। যম কি কখনো ধরা পড়ে?

আমি।—(অধোমুখে হাস্য করিয়া) তবে হয় ত পড়েন নাই?

রঙ্গিণী—(আহ্লাদে হস্ত তুলিয়া) আহা! বেঁচে থাকো হরিদাস, বেঁচে থাকো। তোমার মুখে ফল-চন্নন পড়ুক! তুমি রাজা হও!

রঙ্গিণীর মুখে ঐ আশীৰ্ব্বচন বিনির্গত হবামাত্র দ্বারের শৃঙ্খল উদ্ঘাটিত হয়ে গেল, সেই দিব্যমূর্ত্তি প্রবেশ কোল্লেন;—প্রবেশ কোরেই প্রসন্নবদনে সমুধরস্বরে তিনি জিজ্ঞাসা কোল্লেন, “কি হরিদাস, তোমার রঙ্গিণীটির লজ্জা এখন ভেঙ্গেছে?”

সমস্বরেই আমি উত্তর দিলেম, “পরীক্ষাকর্ত্তা আমি নই, আপনি পরীক্ষা করুন। রঙ্গিণী আমাকে জিজ্ঞাসা কোচ্ছিল, ডাকাতের দলে যে একটি ভূষণলাল ছিল, দলের সঙ্গে সেই ভূষণলালটি কি ধরা পোড়েছে?”

গম্ভীরবদনে রাজপুত্র পুনঃ প্রশ্ন কোল্লেন, “সে প্রশ্নে তুমি কিরূপ উত্তর দিয়েছ?”

আমি বোল্লেম, “সব তত্ত্ব আমার জানা নাই, রঙ্গিণীর প্রশ্নের ঠিক উত্তর আমি দিতে পারি নাই, আপনি যদি জানেন, রঙ্গিণীর সংশয় দূর করুন। অনুমানে আমি বলেছি, ভূষণলাল হয় ত ধরা পড়েন নাই; অনুমানের জোরেই রঙ্গিণীর মুখে আমি বড় বড় আশীর্ব্বাদ পেয়েছি। আপনি যদি নিঃসংশয়ে উত্তর দিতে পারেন, তা হোলে আমার অপেক্ষা সহস্রগুণে বড় বড় আশীৰ্ব্বাদ প্রাপ্ত হবেন।”

রঙ্গিণী এই সময় বিস্ফারিত-নেত্রে রাজপুত্রের মুখের দিকে চেয়ে থাকলো। রাজপুত্র বোল্লেন, “বীরমল্লের মহিষী ব্রাহ্মণের কন্যা, ব্রাহ্মণের কন্যার আশীৰ্ব্বাদ, আমি মস্তকে ধারণ কোত্তে প্রস্তুত; কিন্তু দস্যুদলের বিচারের অগ্রে আশীৰ্ব্বাদপ্রাপ্তির হেতুবাদটি আমি প্রকাশ কোত্তে সঙ্কুচিত হোচ্ছি। তুমি সেই ভূষণলালের একটি নূতন আখ্যা দিয়েছ, দৈত্যকুলের যম; সত্য যদি ভূষণলালের ঐ আখ্যা হয়, তবে ত ডাকাতের সঙ্গে ধরা না পড়াই সম্ভব।”

আমি চমকিত হোলেম; মনে কোল্লেম, রাজকুমারের বাহিরে যাওয়া কেবল ছলনা। দ্বারে শৃঙ্খলাবন্ধ কোরে দ্বারের নিকটেই তিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন, রঙ্গিণীর সঙ্গে আমার যতগুলি কথা হয়েছে, সমস্তই তিনি শ্রবণ কোরেছেন। একপ্রকার ভালই হয়েছে। তাঁর প্রতি আমার মনোভাব, ভূষণলালের প্রতি রঙ্গিণীর মনোভাব, উত্তমরুপেই তিনি জানতে পেরেছেন। আরো একটা কষ্টকর কৈফিয়তের দায় থেকে আমি অব্যাহতি পেয়েছি। বীরমল্লের দ্বারা সৰ্ব্বপ্রথম রঙ্গিণীর ধর্ম্মনষ্ট হয় নাই, ধরা পড়বার পূর্ব্বে রঙ্গিণীর সতীত্বধর্ম্ম ছিল না, সেটুকু রঙ্গিণীর নিজের মুখেই ব্যক্ত হয়ে গেল। গোপনে দাঁড়িয়ে রাজকুমার আপন কর্ণে ঐ পাপিনীর পাপস্বীকারবাক্যগুলি শ্রবণ কোল্লেন; কিঞ্চিৎ বিস্তৃত বর্ণনা যদি আবশ্যক হয়,–আছেও কিছু আবশ্যক, কেবল সেইটকু আমার বর্ণনার জন্য অবশিষ্ট থাকলো।

রঙ্গিণী মৌনবতী। যিনিই সেই ভূষণলাল, তিনিই এই রাজকুমার, রঙ্গিণী সেটি বুঝতে পাল্লে না। ডাকাতের দুর্গে ভূষণলালের খোলামুখ রঙ্গিণী একবারও দেখে নাই, সুতরাং রাজপুত্রকে চিনতে পারা অবশ্যই তার পক্ষে অসম্ভব। রঙ্গিণী সেই ঘরেই থাকলো, রাজপুত্রের সঙ্গে আমি অন্য ঘরে চোলে এলেম। অন্য প্রসঙ্গ উত্থাপিত হবার অগ্রে রাজপুত্র আমারে জিজ্ঞাসা কোল্লেন, “পাপের জন্য রঙ্গিণী অনুতাপ কোচ্ছিল, ডাকাতের হাতে পোড়েছিল, ডাকাত তার ধর্ম্ম নষ্ট কোরেছিল, সেই পাপের জন্য অনুতাপ এটাই বা কি রকম কথা? একবার বোলেছিল কানাই; কানায়ের নামে গালাগালি দিয়েছিল; কানাইটা কে? রঙ্গিণীর পাপের সঙ্গে কানাইয়ের কি সম্বন্ধ? সাধারণ স্ত্রীলোকের মনে পাপের জন্য অনুতাপ আসে, সেটা কি প্রকার পাপ?”

আমি উত্তর কোল্লেম, “পুরুষ যতপ্রকার পাপকর্ম্ম কোত্তে পারে, সম্ভবতঃ স্ত্রীলোকেও তাই পারে; রঙ্গিণী অন্য পাপে পাপিনী নয়, রঙ্গিণীর পাপ কেবল ব্যভিচার।” এই পর্য্যন্ত বোলে, রঙ্গিণীর সংক্ষিপ্ত জীবনী রাজপুত্রের কাছে আমি বিবৃত কোল্লেম। কর্ণে অঙ্গুলী দিয়ে, সৰ্ব্বাঙ্গ সঞ্চালন কোরে রাজপুত্র শিউরে উঠলেন। অল্পক্ষণ নিস্তব্ধ থেকে উদাসনয়নে আমার দিকে চেয়ে, প্রশান্তস্বরে তিনি বোল্লেন, “সে কার্য্যে রঙ্গিণীর তাদৃশ দোষ দুষ্ট হোচ্ছে না; প্রথম-পাপের মূলে ছলনা আর প্রলোভন, দ্বিতীয় ঘটনায় প্রবল পক্ষের বলপ্রকাশ; এ দুটি আমি বেশ বুঝতে পাল্লেম। রঙ্গিণী স্বেচ্ছাপূর্ব্বক ব্যভিচার-পাপে লিপ্ত , প্রকাশ্যে বেশ্যাবৃত্তিও অবলম্বন করে নাই, রঙ্গিণীর সে পাপের ক্ষমা আছে;—এখানেও আছে, উপরেও আছে। রঙ্গিণী দুঃখিনী, পাপের জন্য রঙ্গিণী অনুতাপিনী, রঙ্গিণীকে আমি আশ্রয় দিব। বুদ্ধির দোষে কুলোকের সঙ্গে কুলের বাহির হয়ে এসেছে, কলঙ্কিনী আর স্বদেশে মা-বাপের কাছে ফিরে যেতে পারবে না, পথে পথে কেঁদে কেঁদে ভিখারিণী হয়ে বেড়াবে, সেটাও বড় কষ্টের কথা; আমার যখন জ্ঞাতসার হয়েছে, পাপিনীর যখন অনুতাপ এসেছে, তখন আর বাজারের সাধারণ বেশ্যাবৃত্তির পথ মুক্ত থাকছে না, রঙ্গিণীকে আমি আশ্রয় দিব। সামান্য দাসী হয়ে থাকতে হবে না, নূতন পাপেও লিপ্ত হোতে পাবে না, আমার আশ্রয়ে রঙ্গিণী এখন একপ্রকার সম্ভবমত সুখে এখানে অবস্থান কোত্তে পারবে। রঙ্গিণীকে তুমি এই কথা বোলো, অভিপ্রায় জিজ্ঞাসা কোরো, যে রকম উত্তর পাও, আমাকে জানিও।”

সন্তুষ্ট হয়ে রাজকুমারকে আমি অভিবাদন কোল্লেম। সে রাত্রে রাজকুমারের নিকেতনেই আমারে থাকতে হলো, পরদিন প্রভাতে কুমারদত্ত অশ্বারোহণে দীনবন্ধুবাবুর বাসায় গেলেম। পূৰ্ব্বদিন সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিয়েছিলেম, এই দিন দীনবন্ধুবাবুকে আগাগোড়া সকল কথা বিশেষরূপে জানালেম। আমার প্রতি একজন সদাশয় স্বাধীন রাজকুমারের অনুগ্রহ, এই পরিচয় পেয়ে তিনি বিশেষ আনন্দ প্রকাশ কোল্লেন। তিন দিন পরে রাজপুত্রের এক চিঠি নিয়ে একজন অশ্বারোহী বার্ত্তাবহ দূত আমাদের বাসায় এলো। তার সঙ্গে আমি পুনৰ্ব্বার রাজপুত্রের আবাসে উপস্থিত হলেম। সেই দিন শুনলেম, রাজদরবারে দস্যুদলের বিচার আরম্ভ হয়েছে, তাদের সব বনদূর্গ সমূলে ধ্বংস কোরে সমভূমি করা হয়েছে, দস্যুভাণ্ডারের সমস্ত ধনরত্ন, পশুপক্ষী, অস্ত্রশস্ত্র রাজবাড়ীতে আনয়ন করা হয়েছে, পলাতক ডাকাতেরা সে রাজ্যের সীমা ত্যাগ কোরে পালিয়ে গিয়েছে, রাজ্য এক প্রকার নিষ্কণ্টক।

ক্রমে ক্রমে আরো আমি শুনলেম, ডাকাতের দলে অনেক দেশের লোক আছে। হিন্দু, মুসলমান, ফিরিঙ্গী, পর্তুগীজ, পাহাড়ী, ভীল, পাঞ্জাবী, তিব্বতী, ভুটিয়া, পেশোয়ারী, এই প্রকার নানা দেশের নানা জাতি একসঙ্গে মিলিত; বীরমল্লের কুমন্ত্রণায় রাজ্যের যে সকল প্রজা রাজবিদ্রোহী হয়েছিল, তারাও ঐ দলভুক্ত। এই সব আমি শুনলেম। মনের ভিতর একটা সংশয় উপস্থিত হলো। যে সংশয়টা পূর্ব্বে একবার এসেছিল, সেই সংশয় আবার। অত দেশের অত লোক দস্যুচক্রে সম্মিলিত, তাদের ভিতর বাঙ্গালী কেহ আছে কি না, সেই সংশয়। রাজপুত্রকে আমি বোল্লেম, “ডাকাতেরা যখন সকলে দলবদ্ধ হয়ে বিচারাসনের সম্মুখে দাঁড়ায়, তাদের প্রতি সওয়াল হয়, সেই সময় আমি একবার তাদের সকলকার মুখ দেখবো।”

রাজপুত্র হাস্য কোল্লেন। ছেলেমানুষ আমি, সং-তামাসা দেখতে ছেলেমানুষের বড় আমোদ, সেইটি বিবেচনা কোরেই হয় ত রাজপুত্রের হাস্য, এই ভেবে আমি একটু লজ্জিত হোলেম। রাজপুত্র বোল্লেন, “ডাকাতের মুখ দেখা কি তোমার বাকি আছে? কেল্লার ভিতর কয়েদ ছিলে, খালাস পেয়ে বন্ধনগ্রস্ত ডাকাতের দলকে নিশ্চেষ্ট দর্শন কোরেছ, তবুও কি সে তোমার সাধ মিটে নাই?”

কি উত্তর করি, মনে মনে খানিকক্ষণ ভাবলেম;—ভেবে চিনতে শেষে বোল্লেম, “সাধ মিটাবার ইচ্ছায় নয়, কৌতূহল মিটাবার ইচ্ছা। বন্ধনদশায় যাদের আমি দেখেছি, তারা এক জায়গায় ছিল, আপনি বোলেছিলেন, ভিন্ন ভিন্ন দূর্গে ভিন্ন ভিন্ন দল; বিচারস্থলে সব দলের সবগুলা একত্র, এই সময় সব মুখ আমি এক জায়গায় দর্শন কোত্তে ইচ্ছা করি। কেন করি, সে কথাও আমি আপনার কাছে অপ্রকাশ রাখবো না। গুজরাটের জঙ্গলে অন্ধকারের ভিতর ডাকাতেরা আমারে ধোরেছিল, সে দিন সেই সময় সেই পথে আমি যাব, ডাকাতেরা সে সংবাদটা কিরূপে জানতে পেরেছিল, প্রথম রাত্রি থেকেই সেই তক আমার মনে মনে জাগছিল, এখনো জাগছে। আপনার বোধ হয় স্মরণ থাকতে পারে, একরাত্রে আপনারে আমি বোলেছি, অকারণে স্বদেশে আমার অনেক শত্রু হয়েছে, বিদেশে আমি পথে পথে ঘুরে বেড়াই, সে সব জায়গাতেও সেই সব শত্রুপক্ষের এক একটা মূর্ত্তি আমার চক্ষে পড়ে; এখানে—এই দস্যুদলের মধ্যে সেই দলের কোন গুপ্তচর আছে কি না, মুখ দেখে দেখে তাই আমি পরীক্ষা কোরবো, চিনতে পারি ত চিনবো, এই আমার ইচ্ছা।”

গম্ভীরবদনে রাজপুত্র বোল্লেন, “কোন বাধা নাই। বিচারস্থল অবারিত বিশেষতঃ বড় বড় মোকদ্দমার বিচার যেখানে হয়, বহুলোক সেইখানে উপস্থিত থেকে আসামীদের মূর্ত্তি দর্শন করে, বাক্য শ্রবণ করে, দণ্ডাজ্ঞা অবগত হয়; প্রজাহিতৈষী নিরপেক্ষ বিচারপতিগণের বাস্তবিক সেটি অভিপ্রেত। কল্যই আমি তোমারে সঙ্গে কোরে ডাকাতগণের মুখ দেখাবো; কেবল ডাকাতের মুখ দেখিয়েই আমি তোমারে ফিরিয়ে আনবো না, দরবারের কার্য্যাবসানে মহারাজের মুখখানিও তোমারে দেখাবো। তুমি আমাদের যে উপকার কোরেছ, মহারাজকে আমি সে সব কথা বোলেছি, মহারাজ বিশেষ আহ্লাদ প্রকাশ কোরে তোমারে দেখতে চেয়েছেন।”

মহানন্দে আমার অতঃকরণ পরিপ্লুত। কল্য আমি ডাকাত দেখবো, দেশের গৌরব আর্য্যবংশের স্বাধীন রাজা, সেই রাজমুখ আমি দর্শন কোরবো, অন্তরসাগরে বিপুল আনন্দের প্রবল তরঙ্গ। ভবানীদেবীর মন্দিরে উৎসবস্থলে মহারাজকে একবার আমি দর্শন কোরেছি, সে দর্শনে তাদৃশী তৃপ্তিলাভ হয় নাই, নিকটে গিয়ে দর্শন কোরবো, শ্রীমুখের দুই একটি বাক্যও হয় ত শ্রবণ কোরবো, এই আমার আশা, এই আমার আনন্দ পরম সৌভাগ্য আমার!

দিন গেল, রাত্রি গেল, পরদিন প্রভাতের নব-প্রভাকর সুপ্রকাশ; আমার আশাগগনেও নবসূর্য্য সমুদিত। অগ্রেই প্রস্তুত হয়ে থাকলেম, যথাসময়ে কুমার রণেন্দ্র বাহাদুর আমারে সঙ্গে নিয়ে রাজদরবারে উপস্থিত হোলেন। বিচারালয় লোকারণ্য। বিচারাসনের সম্মুখে সপরিচ্ছদধারী সুন্দর সুন্দর পাত্র, মিত্র, অমাত্য প্রভৃতি পরিষদবর্গ, তিনদিকে নানাবর্ণের পরিচ্ছদ-পরিহিত অগণিত দর্শকবর্গ, মধ্যস্থলে সদৃঢ় লৌহনিগড়বদ্ধ হ্রস্বদীর্ঘ বিকটবদন দস্যুবর্গ। রাজপুত্র আমারে রাজকায়দায় সুসজিত সভাসমীপে নিয়ে গেলেন, রাজকায়দায় সদস্য-পরিবেষ্টিত, রাজমুকুটশোভিত মহারাজের সিংহাসনতলে সসম্ভ্রমে আমি প্রণিপাত কোল্লেম। তার পর দস্যু-দর্শন।

পরমেশ্বরের সৃষ্টিতে সকল মনুষ্যের গঠনে হস্তপদাদি সমান অবয়ব দৃষ্ট হয়ে থাকে; তথাপি স্বাতন্ত্র্যের কেমন একপ্রকার সুন্দর নিদর্শন, বিশেষরূপে মুখদর্শন কোল্লেই কোন দেশের কোন লোক, অনুভবে বেশ বুঝা যায়। সকল দেশের সকল লোককে আমি দর্শন করি নাই, তথাপি যে দেশের যত লোক আমি দেখেছি, মুখের গঠনে সে সকল লোককে পৃথক পৃথকরূপে আমি চিনতে পারি; বিশেষতঃ বাঙ্গালী চিনতে আমার কিছুমাত্র বিলম্ব হয় না, সন্দেহ আসে না, চক্ষে একটু ধাঁধাও লাগে না। একে একে শ্রেণীবদ্ধ সমস্ত ডাকাতকে আমি দর্শন কোল্লেম, প্রত্যেকের সম্মুখে গিয়ে গিয়ে বিশেষরূপে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সকলের মুখগুলি আমি নিরীক্ষণ কোল্লেম; অন্তরে অবশ্য ভয় হোতে লাগলো, বিকটাকার দুরন্ত লোকের মুখ দেখলেই স্বভাবতঃ হৃদয়ে ভয়ের সঞ্চার হয়,—ভয় হোতে লাগলো; চতুর্দ্দিকে তত লোক, তত লোকের ভিতর আমি ঐ সব ডাকাত দেখছি, তবুও মনে মনে ভয়। বাঁধা ডাকাত, নিরস্ত্র, তারা আমারে ধোরে ফেলতে পারবে না, ভয়কে একটু পশ্চাতে রেখে সাহসে সাহসে সকলগুলার মুখ আমি দেখতে লাগলেম। খানকতক মুখ আমারে দেখে যেন ফুলে ফুলে উঠলো, দন্তে দন্তে ঘর্ঘণ কোল্লে, চক্ষুগুলো পাকল কোরে বিকটদৃষ্টিতে আমার দিকে চাইলে, তাতে আমি ভ্রূক্ষেপ কোল্লেম না; একে একে সব মুখগুলো আমি দেখলেম, দেখে দেখে স্থির কোল্লেম, দুখানা বাঙালীর মুখ; দলের ভিতর দুজনমাত্র বঙ্গবাসী।

বিচারস্থলে ডাকাতের সঙ্গে যাঁদের কথা হয়, ডাকাতকে যারা কথা জিজ্ঞাসা করেন, কুমার রণেন্দ্র বাহাদুরের দ্বারা অনুরোধ কোরিয়ে তাঁদের মধ্যে এক জনকে আমি আমার মনের কথা জানালেম। বাঙালী বোলে যে দুজনকে আমি চিনলেম, তাদের বাড়ী কোথায়, নাম কি, এই দুটি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা কোত্তে অনুরোধ কোল্লেম; প্রশ্নকর্ত্তা আমার অনুরোধ রাখলেন। জিজ্ঞাসায় জানা হলো, একজনের নাম ব্রজনাথ ভট্টাচার্য্য, একজনের নাম হেমচন্দ্র পালধি।

বাহবা বাহবা! বঙ্গদেশের ভট্টাচার্য্য একজন ডাকাত। বহরমপুরের আদালতের মেদিনীপুরের নূতন আসামীটা যে তিনজন লোকের নাম কোরেছিল, তাদের মধ্যেই এই দুজন। হ্যামচাঁদ পালুই, বজো ভাজ্জি, এই দুই নামে হেমচন্দ্র পালধি আর ব্রজনাথ ভট্টাচার্য্য পাওয়া যাচ্ছে। নামেই কেবল পাওয়া যাচ্ছে, তাদের চেহারা আমি পূর্ব্বে দেখি নাই, আমার জানত পক্ষে কোথাও তারা ধরাও পড়ে নাই, আমারে তারা কোথাও দেখেছিল কি না, তাও আমি জানি না;—বোধ হয় দেখে থাকবে; অন্ধকারে পথ ভুলে গুজরাটের জঙ্গলে আমি প্রবেশ কোরেছিলেম, তারাই হয় ত বীরমল্লের দলে সংবাদ দিয়েছিল; পূর্ব্বে দেখা না থাকলে তারা আমারে চিনতে পাত্তো না; বোধ হয় পূর্ব্বে কোথায় দেখে থাকবে। নিশ্চয়ই তারা রক্তদন্তের দলের লোক। বাহাদুর রক্তদন্ত! বলিহারি প্রতাপ! অভিশপ্ত য়িহুদীর বংশনাশের মতলবে ফরাসী যে শুত পাদরী-মহাশয়েরা যে প্ৰকারে পৃথিবীর সৰ্ব্বস্থলে গুপ্তচরের বাজার বেসিয়েছিলেন, রক্তদন্তও যেন সেইরূপ ক্ষমতা ধরে বোধ হয়! বাহাদুর রক্তদন্ত। রক্তদন্ত বাহাদর অথবা মোহনলালবাবু বাহাদুর, আমার ভাগ্যনাটকের যবনিকাপতনের পূর্ব্বে হয় ত সেটি নির্ণয় করবার উপায় হবে না!

হেমচন্দ্র পালধি আর ব্রজনাথ ভট্টাচার্য্য, এই দুটি নাম পূর্ব্বে আমার শুনা হয়েছিল, মানুষদুটি এখন দেখা হলো। কে তারা, কোথায় থাকে, কি করে, রক্তদন্ত ওরফে জটাধর-নামধারী কোন লোককে তারা চিনে কি না, সে সব কথা জিজ্ঞাসা করবার স্থান নয়; গুজরাটের ডাকাতী মোকদ্দমার সঙ্গে সে সব কথার কিছুমাত্র সংস্রব নাই, কাজে কাজেই নাম-দুটি জেনে আর মানুষ-দুটি দেখেই সে ক্ষেত্রে আমাকে তুষ্ট থাকতে হলো।

কুমার রণেন্দ্র বাহাদুর আমার মুখপানে চাইলেন, আমিও তাঁর মুখপানে চাইলেম; সসসম্ভ্রমে আমি অভিবাদন কোল্লেম। দরবার-স্থল থেকে কুমার বাহাদুর আমাকে রাজপ্রাসাদের একটি বহিকক্ষে নিয়ে বসালেন।

রাজকার্য্যাবসানে মহারাজ যখন আপন বিরামকক্ষে নির্জ্জনে উপবিষ্ট, কুমার বাহাদুর সেই সময় আমাকে মহারাজ-সমীপে পেস কোরে দিলেন; বিনম্রবদনে বিনীতস্বরে বোল্লেন, “মহারাজ! যে বালকের কথা আমি নিবেদন কোরেছিলেম, বিশ্বাসঘাতক বীরমল্লের গুপ্তগৃহে যে বালক সেই অপহৃত বাক্সটির উদ্ধার কোরেছে, এই সেই বালক; এই বালকের নাম হরিদাস, বঙ্গদেশে নিবাস, শৈশবাবধি নিরাশ্রয়।”

প্রসন্নদৃষ্টিতে মহারাজ অমাব মুখের দিকে নেত্রপাত কোল্লেন; আমি অভিবাদন কোল্লেম। করযোড়ে মহারাজের অনুমতিক্রমে আমি যখন ভূজানুহয়ে রাজাসনের সন্নিকটে নতমস্তকে উপবিষ্ট হোলেম, মহারাজ তখন আমার মন্তকে করার্পণ কোরে প্রশংসাসূচক, আশীৰ্ব্বাদসূচক, আশ্বাসসূচক গুটিকতক অনুকলবাক্যে উচ্চারণ কোল্লেন; চরিতার্থ জ্ঞান কোরে পুনরায় আমি অভিবাদন কোল্লেম।

সে দিন আমার এই পর্য্যন্ত রাজদর্শন। ভ্রাতুষ্পুত্রের কর্ণে মহারাজ সেই সময় চুপি চুপি কি উপদেশ দিলেন, শুনতে পেলেম না। অতঃপর রাজপুত্র গাত্রোত্থান কোরে সদয়নয়নে আমার দিকে চাইলেন, তৃতীয়বার মহারাজকে অভিবাদন কোরে রাজপুত্রের সঙ্গে সে ঘর থেকে আমি বেরুলেম; এক অভিনব উল্লাসে আমার কলেবর রোমাঞ্চিত।

রাজপুত্রের নিকেতনে আমরা উপস্থিত। সে রাত্রেও সেই স্থানে আমার অবস্থান। পরদিন রাজকুমার আমাকে রাজদত্ত সম্মানের নিদর্শনস্বরুপ মুল্যবান শিরোপা প্রদান কোল্লেন। জন্মে কখনো যেরুপ চমৎকার পরিচ্ছদ আমার নয়নগোচর হয় নাই, সেই পরিচ্ছদে সজ্জিত হয়ে দীনবন্ধুবাবুর বাসায় আমি এলেম; রাজদরবারে, রাজগৃহে যা যা আমি দর্শন কোরেছি, যে সব কথা শ্রবণ কোরেছি, মহারাজের নিকটে যেরুপ সমাদর প্রাপ্ত হয়েছি, দীনবন্ধুবাবুকে সেই সব কথা বোল্লেম; বিস্মিতনয়নে আমার মুখপানে চেয়ে দীনবন্ধুবাবু; পরমানন্দ প্রকাশ কোল্লেন।

সাতদিন অতিবাহিত। রাজভবনে আমি যাই, বাসাতেও আসি, উভয়স্থানেই আমার সমান আদর, সমান যত্ন। মনের ভিতর নানা উদ্বেগের যন্ত্রণা থাকলেও আমি যেন তখন নির্ভয়হৃদয়ে নিত্য নিত্য নূতন আনন্দ উপভোগ কোত্তে লাগলেম। কুমার বাহাদুরের সাগ্রহ অনুরোধে একদিন আমি দীনবন্ধুকে রাজভবনে নিয়ে যাই, মহারাজের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় না, রাজপুত্রের সঙ্গেই কথোপকথন, রাজপুত্রের পরম সতোষ, কুমার বাহাদুরের অমায়িক ব্যবহারে দীনবন্ধুবাবুও আপ্যায়িত। মর্য্যাদাপন্ন লোকের সামাজিক ব্যবহার সৰ্ব্ব-সমাজের আদর্শ; সে ব্যবহারে দম্ভ থাকে না, অভিমান থাকে না, ছোট-বড় বিচার থাকে না, সেই এক অপূৰ্ব্ব ভাব। কুমার বাহাদুর একদিন অপরাহ্ণকালে একখানি শোভন যানে আরোহণ কোরে আমাদের বাসায় উপস্থিত হন, আমরা নিতান্ত সংকুচিত হয়ে যথাসম্ভব সমাদরে তাঁর অভ্যর্থনা করি। প্রায় একঘণ্টা থেকে, সখ্যভাবে দীনবন্ধুবাবুর সঙ্গে আলাপ কোরে রাজপুত্র বিদায় হোলেন। আমি কে, সেটি যদি তখন আমার জানা থাকতো, আমার মন তখন যদি নিশ্চিত থাকতো, অজ্ঞাত বৈরীদলের ভয়ে আমার অন্তঃকরণ যদি সৰ্ব্বক্ষণ অভিভূত না থাকতো, তা হোলো আমি তখন ঐ সকল আনন্দকে স্বর্গসুখ বিবেচনা কোত্তেম।

আরো এক সপ্তাহ। রাজদরবারে দস্যুদলের বিচারকার্য্য সমাপ্ত। সাক্ষীসাবুদের প্রয়োজন ছিল না, জাজ্জ্বল্যমান প্রমাণ, সুবিচারেই দণ্ডাজ্ঞা। দলপতি বীরমল্ল। এই ব্যক্তি রাজসংসারের চাকর, বিশ্বাসঘাতক, দলীল-অপহারক, রাজবিদ্রোহী, বিদ্রোহ-উত্তেজক, তাহার উপর প্রজালোকের ধনপ্রাণ-হরণকারী সাংঘাতিক ডাকাত; এই সকল অপরাধে বীরমল্লের প্রাণদণ্ডের আদেশ হয়। জল্লাদের খড়্গে মন্তকচ্ছেদন কিম্বা ফাঁসরজ্জুতে বন্ধন, তাদৃশ অপরাধীর পক্ষে উপযুক্ত বোধ হয় নাই, মত্তহস্তীর পদতলে নিক্ষেপ কোরে সেই পাপাত্মার পাপজীবনের অবসান করা হয়; অবশিষ্ট ডাকাতেরা চিরজীবনের জন্য রাজকারাগারে অবরুদ্ধ থাকবার দণ্ডাজ্ঞা প্রাপ্ত হয়; এই বিচারে রাজ্যের সমস্ত লোক পরিতুষ্ট—সমস্ত লোক নিরাপদ।

আমিও পরিতুষ্ট; সে রাজ্যে আমিও তখন নিরাপদ; কিন্তু পরিতোষের একাংশ যেন কিছু শূন্য শূন্য। ব্রজনাথ ভট্টাচার্য্য আর হেমচন্দ্র পালধি এই দস্যুদলে ছিল; পূর্ব্বে যদি ঐ দুটো নাম আমার শুনা না থাকত, তা হোলে আমি অন্য কোন কথাই ভাবতেম না, যারা আমার শত্রুদলের সহচর, তাদের মধ্যে একজনের মুখেই ঐ নাম আমার শুনা। বিচারস্থলে আমার মনের কথা জিজ্ঞাসা করবার সুবিধা ঘটে নাই এখন যদি কোন রকমে সুযোগ পাই, কারাগারে প্রবেশ কোরে লোকদুটোকে জিজ্ঞাসা করি, জটাধর তরফদার নামে কোন লোককে তারা জানে কি না, চিনে কি না, জটাধরের সঙ্গে তাদের কোন সংস্রব আছে কি না, অমরকুমারী নামে একটি কুমারী কুলবালাকে জটাধরের লোকেরা চুরি কোরেছে, সে সংবাদ তারা কিছু রাখে কি না, অমরকুমারীর সংবাদ তারা কিছু জানে কি না?

যদি সুযোগ পাই, সেই দুটো লোককে ঐ কথাগুলি আমি জিজ্ঞাসা করি, এইরুপ আমার ইচ্ছা। সে সুযোগ কি প্রকারে ঘটে, অনেক চিন্তা কোল্লেম; শেষকালে কুমার রণেন্দ্র বাহাদুরকে মনের ইচ্ছা জানালেম। ইচ্ছা যদি একাগ্র হয়, ইচ্ছাময়ের ইচ্ছায় সেই ইচ্ছা ফলবতী হয়ে থাকে, কোন কোন লোকের মুখে এই কথা আমি শুনেছি। কুমার রণেন্দ্র বাহাদুর আমার ইচ্ছায় অনুমোদন কোল্লেন। সময় অবধারিত হলো। কারাগারের অধ্যক্ষকে অগ্রে উপদেশ দিয়ে, কুমার বাহাদুর আমারে একদিন প্রাতঃকালে কারাগারের মধ্যে নিয়ে গেলেন; বহুলোকের ভিতর চিনে চিনে সেই দুটো লোককে আমি ধোল্লেম। আমার বামদিকে কারাধ্যক্ষ, দক্ষিণে রাজকুমার, মধ্যস্থলে আমি। তিনজনেই আমরা সশস্ত্র। হেমচন্দ্র পালধি, ব্রজনাথ ভট্টাচার্য্য। দুজনে অবশ্যই এক জায়গায় ছিল না, ভিন্ন ভিন্ন স্থানে পৃথক পৃথকরূপে আমার প্রশ্নগুলি আমি জিজ্ঞাসা কোল্লেম, কিছুই ফল হলো না; আমার দিকে চেয়ে চেয়ে তারা কেবল চক্ষু ঘুরালে, দাঁত খিচলে, হাতকড়ী-বাঁধা হাতগুলো জোরে জোরে নাচালে, একটিও কথা কোইলে না, কোন প্রশ্নেরই উত্তর দিলে না। কেবল আমার প্রশ্ন নয়, কারাধ্যক্ষও আমার প্রশ্নের প্রতিধ্বনি কোরে সেই সব কথা জিজ্ঞাসা কোল্লেন। সমান ফল;—একটিমাত্র উত্তরও প্রাপ্ত হওয়া গেল না; অগত্যা আমরা হতাশ হয়ে ফিরে এলেম।

হতাশে আমরা ফিরে এলেম, কিন্তু মনে মনে বুঝা গেল, অনেক কথা তারা জানে; পাকা ডাকাত! রক্তদন্তের বন্ধুলোক! প্রশ্ন শুনে শুনে মুখচক্ষের ভাব যে রকম তারা দেখালে, তাতে কোরেই বুঝতে পারা গেল, দলের লোক। সত্য সত্য জানা-শুনা না থাকলে ওরকম তারা কোত্তো না; চুপ কোরেও থাকতো না; একটা না একটা সোজা সোজা উত্তর দিতো। তা যখন দিলে না, তখন কি আর নিশ্চয় কোত্তে কিছু বাকী থাকে? নিশ্চয় আমি স্থির কোল্লেম। স্থির করাই সার।

দেশে আসবার জন্য দীনবন্ধুবাবু ব্যস্ত হোলেন, বহরমপুরের মোকদ্দমার ফলাফল জানবার জন্য আমারও অত্যন্ত উদ্বেগ, কুমার বাহাদুরের কাছে বিদায় চাইলেম। প্রার্থনা শীঘ্র মঞ্জুর হলো না। হোচ্ছে হবে, যাচ্ছে যাবে, এই রকম গতরজমায় ক্রমশই দিন কেটে যেতে লাগলো। একদিন আমি বিশেষ আগ্রহ জানিয়ে, বিশেষ ব্যাকুলতা প্রকাশ কোরে রাজপুত্রকে বোল্লেম, “আপনার অজ্ঞাত কিছুই নাই, আমার জীবনের সব কথা আপনাকে আমি বোলেছি। বিপদে আমার প্রাণদায়িনী সেই বালিকাটি,—অমরকুমারী নামে সেই স্নেহময়ী কুলকন্যাটি চুরি গিয়েছে, মোকদ্দমা হোচ্ছে, সন্ধান হলো কি না, কিছুই জানতে পাচ্ছি না, চিত্ত বড় অস্থির হয়েছে; অনুমতি করুন, আমরা দেশে যাই। আপনার অনুগ্রহ, আপনার দয়া, চিরজীবনে আমি বিস্মৃত হব না, উর্দ্দিষ্ট বিষয়ে কৃতকার্য্য হয়ে আবার আমি এই রাজ্যে আসবো; ভগবান করুন, আপনারা সুখে থাকুন, রাজলক্ষ্মী চিরস্থায়িনী হোন, আবার আমি আপনাদের দর্শন কোরে চরিতার্থ হব; এখন অনুগ্রহ কোরে কিছু দিনের জন্য বিদায় প্রদান করুন, এই আমার প্রার্থনা।”

তথাপি বিলম্ব। আজকাল কোরে কোরে রাজপুত্রের অনুরোধে আর এক মাসকাল বরদায় থাকতে আমরা বাধ্য হোলেম। একমাস পরে অনুমতিপ্রাপ্তি। রাজপুত্র আমারে একসহস্র স্বর্ণমুদ্রা পাথেয়স্বরূপ প্রদান কোল্লেন, মিষ্টবচনে বোল্লেন, “এটা তোমার পক্ষে কিছুই নয়; যে উপকার তুমি কোরেছ, তার সঙ্গে তুলনায় সহস্র স্বর্ণমুদ্রা কিছুই নয়; অন্তরের কৃতজ্ঞতার যৎসামান্য নিদর্শন মাত্র; ঈশ্বরেচ্ছায় স্বদেশে পূর্ণমনোরথ হয়ে এখানে তুমি ফিরে এসো, মহারাজের ইচ্ছামত পুরস্কারদানে আমি তোমার সম্মানবন্ধন কোরবো।”

কি করি, গ্রহণ কোত্তেও সঙ্কোচ আসে, গ্রহণ না কোল্লেও রাজপুত্র ক্ষুণ্ণ হন, কাজে কাজেই নিতান্ত কুণ্ঠিত হয়ে, কথাগুলি শুনে লজ্জা পেয়ে, সেই সহস্র স্বর্ণমুদ্রা আমারে গ্রহণ কোত্তে হলো। রাজদত্ত পুরস্কার গ্রহণ কোরে, ধন্যবাদ দিয়ে, রাজপুত্রকে আমি নমস্কার কোল্লেম।

স্বদেশযাত্রার দিনস্থির। দীনবন্ধুবাবু প্রস্তুত। যে দিন আসা হবে, তার পূৰ্ব্বদিন আমি একবার রঙ্গিণীর সঙ্গে সাক্ষাৎ কোল্লেম; রঙ্গিণীকে বোল্লেম, “পাপকর্ম্ম কোরেছিলে, ফলভোগ হয়েছে, সে সব কথা আর মনে কোরো না, পাপের দিকে আর মন দিও না, ধর্ম্মের দিকে দৃষ্টি রেখে এই রাজ্যেই তুমি থাকো। ডাকাতের দুর্গে যাঁরে তুমি ভূষণলাল বোলে জানতে, তিনিই এই রাজ্যের মহারাজের প্রিয়তম ভ্রাতুপুত্র, রাজকুমার রণেন্দ্র রাও। রাজকুমার তোমারে আশ্রয় দিবেন অঙ্গীকার কোরেছেন, এখানে তুমি স্বচ্ছন্দে নিরুদ্বেগে সুখে থাকতে পারবে। অনেক দিন হলো এ রাজ্যে আমি এসেছি, দেশে চোল্লেম, পুনৰ্ব্বার ফিরে এসে তোমার সঙ্গে আমি সাক্ষাৎ কোরবো।”

রঙ্গিণী কাঁদতে লাগলো। আমি তারে নানা প্রকার প্রবোধ দিয়ে সান্ত্বনা কোরে বোল্লেম, “তোমার অপেক্ষা অনেক বেশী বেশী বিপদের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছে, পাপকর্ম্ম কোরে তুমি বিপদে পোড়েছ, নিষ্পাপশরীরে নানা বিপদে আমি বহুকষ্ট ভোগ কোরেছি, কিন্তু একদিনের জন্যও বিচলিত হই নাই। মনকে তুমি বিচলিত কোরো না, শান্ত হয়ে এইখানেই থাক, মহৎলোকের আশ্রয়ে সুখী হোতে পারবে, সে বিষয়ে কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। পাপিষ্ঠ বীরমল্ল হস্তীপদতলে বিদলিত হয়ে স্বকৃত পাপের প্রায়শ্চিত্ত কোরেছে, ইহলোকে পাপকর্ম্মের স্মৃতি ভিন্ন আর তার অস্তিত্বের কোন চিহ্নই থাকলো না। সেই কানকাটা কানাই এখন কোথায় কি অবস্থায় আছে, আমি দেশে যাচ্ছি, সে যদি দেশে গিয়ে থাকে, তাকেও আমি উপযুক্ত বিচারালয়ে হাজির করবার চেষ্টা পাবো। যারা তোমার সরল প্রাণে আঘাত কোরেছে, ধর্ম্মের বিচারে কেহই তারা নিষ্কৃতি পাবে না, এটি তুমি নিশ্চয় জেনে রেখো। কেঁদো না; রাজপুত্রের আশ্রয়ে ক্রমে ক্রমে তুমি পুনরায় পবিত্র ধর্ম্মভাব অভ্যাস কোত্তে পারবে; পরমেশ্বর তোমারে সুমতি প্রদান করুন; ধর্ম্মপথে তোমার মতি হোক।”

কি যেন বোলবে বোলবে মনে কোরে চঞ্চলনয়নে রঙ্গিণী বারম্বার আমার মুখের দিকে চাইতে লাগলো, আর আমি সেখানে দাঁড়ালেম না, আর তার কোন কথা শুনবার ইচ্ছাও হলো না, মুখ ফিরিয়ে নিয়ে ঈশ্বরের নাম কোত্তে কোত্তে সে ঘর থেকে আমি বেরিয়ে পোড়লেম। শীতল বায়ু আমার অঙ্গ স্পর্শকোল্লে।

দিন সমাগত। শুভদিনে শুভক্ষণে সুসজ্জিত শকটারোহণে আমরা বরদারাজ্য পরিত্যাগ কোল্লেম। রাজকুমার রণেন্দ্র বাহাদুর আমাদের যাত্রাকালে শকটসমীপে উপস্থিত থেকে আমাদের মঙ্গলকামনা কোল্লেন; নমস্কার-বিনিময়ের পর শকটের অশ্বেরা দ্রতধাবনে আমাদিগকে রাজকুমারের নয়নের অগোচর কোরে শটখানা যেন উড়িয়ে নিয়ে চোল্লো।