দশম পরিচ্ছেদ

সুদীপ্ত বাসায় পৌঁছলেন সাড়ে বারটার দিকে। পৌঁছেই বুঝলেন তাঁকে ঘিরে একটা উৎকণ্ঠার নিম্নচাপ তীব্র আশঙ্কার ঝড়ে রূপ নিচ্ছিল। আমিনাকে সামলাতে মীনাক্ষী হিমসিম খেয়ে যাচ্ছেন।

‘বারোটা থেকে কারফিউ শুরু হয়েছে। কোন্ আক্কেলে বাইরে ছিলে? এলে কি ভাবে?’

নাজিম তার স্যারকে গেটের কাছে নামিয়ে দিয়ে চ’লে গেছে, এঁরা কেউ তা জানেন না। এবং তাদের জানা আছে, বারোটা থেকে কারফিউ শুরু হয়ে গেছে। নাজিমও প্রথমে তাই জানত। তাই স্যারকে নিয়ে ঢুকেছিল এলিফ্যান্ট রোডের এক বাড়িতে। ঐখানে তার এক বন্ধু থাকে। নিজের বাড়ি অনেক দূর সেই রঙ্কিন স্ট্রীটে। এত অল্প সময়ে সেখানে পৌঁছানো যাবে না। ফিরোজের বাড়ি পৌঁছতে হলেও টিচার্স ট্রেনিং কলেজের সামনেটা মাড়িয়ে যেতে হবে। এখানে আবার মিলিটারি ছাউনি পড়েছে। অতএব সুদীপ্ত চিন্তা ক’রে দেখলেন, সবচেয়ে নিরাপদ এখন নাজিমের বন্ধুর বাড়ি। কোন মতে বিশ ঘণ্টা সেখানেই কাটাতে হবে। কিন্তু কথাটা কি সুদীপ্ত ভাবেন নি? আমিনাকে একটা প্রবল দুশ্চিন্তা পোহাতে হবে না? তা হলেও, এর চেয়ে অধিকতর নিরাপদ কোন ব্যবস্থার কথা মাথায় এল না। সামনে ঝাঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ সমুদ্র, বন্দরে বিষণ্ণ উপায়ন্তবিহীন নাবিক—সুদীপ্তর দশা হল অনেকটা তেমনি।

বন্ধুর বাড়ি পৌঁছতেই রাস্তার অনেকখানি জুড়ে রক্তের ছাপ দেখে চমকে উঠেছিল নাজিম। এবং সুদীপ্ত চমকে উঠেছিলেন যখন নাজিমের বন্ধ ওয়াজেদের কাছে শুনেছিলেন–

‘ওটা লেফটেন্যান্ট কমাণ্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনের রক্ত। বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে মেরেছে।’

সেই তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম প্রধান আসামী লেফটেন্যান্ট কমাণ্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন? তাকেও ওরা মেরেছে নাকি? সার্জেন্ট জহুরুল হককে মেরেছিল ক্যান্টনমেন্টের ভিতরেই। মোয়াজ্জেম হোসেনকে মারবার আগেই আয়ুব খান ভয় পেয়ে মামলা উঠিয়ে নিলেন। নাহ্, ঐ রকম ভীতু আদমী দিয়ে দেশের শাসন চলে না। পাঞ্জাবি আর্মি অফিসারদের মনে মনে দারুণ একটা ক্ষোভ ছিল। আর্মিতে পাঞ্জাবিদের একটা স্পেশাল খাতির আছে না! আশ্চর্য, ঐ মোয়াজ্জেমটা সে কথা মানতে চায় না। পাঞ্জাবি-পাঠান-বালুচ-বাঙালি সব এক ক’রে দেখতে চায়। আর বলে কি না, আর্মিতে বাঙালিদের পথে আমরা কাঁটা বিছিয়ে রাখি! হাঁ বটে, বাধা না দিলে বিস্তর বাঙালি আর্মিতে ঢুকত, আমাদের একাধিপত্য খর্ব হত! অতএব কিছু কিছু বাধা আরোপ দেশের স্বার্থেই করতে হয় আমাদের। বাঙালি তো সব গাদ্দার। পাকিস্তানে সাচ্চা ঈমানদার নাগরিক যদি কেউ থাকে সে তো আমরা—পাঞ্জাবিরা। কথাটা সকলেই মানবে। খালি মানতে চায় না বাঙালিরা। অতএব বাঙালিদের হত্যা করা দেশের স্বার্থে ও ইসলামের স্বার্থে হবে খুবই নেকির কাম! কিন্তু ঐ পাঠান আয়ুবটার ভীরুতার জন্য সেবার একটা জবর গাদ্দারকে খতম করার সুযোগ হারাতে হয়েছে। দিলের ভেতর সাংঘাতিক ক্ষোভ ছিল একটা। সেই ক্ষোভের খানিকটা উপশম হয়েছে এবার। হাজার হাজার মানুষের রক্তে পিপাসার নিবৃত্তি হয়েছে। কিন্তু মফঃস্বল থেকে কি যে সব খবর আসছে! বাহাত্তর ঘণ্টা পর বিজয় মহোৎসবের সেই কর্মসূচীটা কি বাতিল হয়ে যাবে?

মোয়াজ্জেম হোসেনকে ঘরেই পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু সেই কর্ণেল ওসমানীকে পাওয়া যায় নি। সেইটেই ভয়ের কথা। বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ই. পি. আর. বিদ্রোহ করল, কর্ণেল ওসমানী অদৃশ্য হলেন—দুয়ের মধ্যে কোনো সময় থাকলে রীতিমত ভয়ের কথা বৈ কি। মোয়াজ্জেম হোসেনকে মারার আনন্দ ইতিমধ্যেই তাই ফিকে হয়ে গেছে। খায়েশ ছিল, মোয়াজ্জেম হোসেনের মতো সন্দেহজনক কিছু বাঙালি সামরিক অফিসারকে সাবাড় ক’রে ভবিষ্যৎটাকে নিরাপদ ক’রে ফেলা হবে। কিন্তু সকলেই মোয়াজ্জেম হোসেনের মতো সহজ লভ্য হন নি। ওদের মতলব পূর্বেই টের পেতে অনেকে কেটে পড়েছেন—

ওয়াজেদ তখন বাড়ি ছেড়ে ঐ মহল্লা থেকে কেটে পড়ার জন্য তৈরি হচ্ছিল—নাজিম তার স্যারকে নিয়ে পৌঁছল সেখানে। আমরা এলাম, ওরা বেরুচ্ছে। ব্যাপার কি? কারফিউ না? তখনি জানা গেল–

‘কারউফিউ যথারীতি চারটে থেকে।’

‘ঠিক জানো তো?’

না জানলে এখন সে স্ত্রী ও ভাই-বোনদের নিয়ে বেরুবে কেন? ‘কিন্তু! যাচ্ছটা কোথায়?’

আর ভাই বোলো না। এদের বোঝানো যাচ্ছে না। বলে, পুরোনো ঢাকা নাকি নিরাপদ। তাই বহু কষ্টে সেখানে একটা ঘর জোগাড় করেছি। বিস্তর কষ্ট হবে। কিন্তু কি আর করব। আপাতত সেখানেই কিছুকাল বনবাসে থাকব।

অনেকে আবার পুরোনো ঢাকা ছেড়ে ধানমন্ডি এলাকায় পারলে চলে আসছে তা জান!

এরি নাম বোধ হয় দিশেহারা অবস্থা! প্রত্যেকে ভাবছে, শহরের ঐ অংশ নিরাপদ। অবশ্য অবস্থাটা কেবল তাদের জন্য যারা শহরে থাকতে চায়। কিন্তু থাকতে না চাওয়াদের সংখ্যা শতকরা নব্বইয়ের কাছাকাছি। তারা সহসা গান্ধীজীর “গ্রামে ফিরে চল” নীতির ভক্ত হয়ে উঠে বুড়িগঙ্গা পাড়ি দিতে শুরু করেছে। কিংবা গাড়ি থাকলে পালাচ্ছে নরসিংদীর পানে। সাভারের দিকে যাবার উপায় নেই। ওদিকে যেতে পথে মীরপুরের কাছে বিহারিরা গাড়ি থামিয়ে লুটপাট চালাচ্ছে, আর বাঙালি বেঈমান পেলে ধরে জবাই করছে।

একটি পরিবারের কথা ওয়াজেদ বলল। গতকাল পালাবার সময় মীরপুর ব্রিজের কাছে বিহারিদের কবলে পড়েছিল। সবাই মারা পড়েছে। কেবল দুজন যুবক নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে ডুব-সাঁতার দিয়ে কোনো মতে প্রাণরক্ষা করেছে। বাংলাদেশে বসে বহিরাগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের হাতে বাঙালিকে মার খেতে হ’ল এ অতি নিদারুণ লজ্জা বটে, কিন্তু সময় এলে শোধ নেবার চিন্তাটাও কাপুরুষতা। ওয়াজেদ বলেছিল—

‘সময় এলে এবার দেখবেন স্যার, দেশকে বিহারিশূন্য ক’রে ছাড়ব।’

সেটা খুব সহজ। বাংলাদেশে বিহারিদের সংখ্যা কত? সুদীপ্ত সেটা জানেন না। খুব বেশি হলেও সংখ্যাটা শতকরা দশভাগের উর্ধে যাবে না। নব্বইজন ইচ্ছা করলে দশজনকে দশ মিনিটেই সাবাড় করতে পারে। কিন্তু সেটা কি নব্বই জনের পক্ষে গৌরবের কাজ হবে? সুদীপ্ত বললেন—

‘কাজটা সেই পাঞ্জাবিদের মতো হবে আমরা এখন যাদেরকে প্রবলভাবে ঘৃণা করছি। আমরা চাইছি নির্ভেজাল গণতন্ত্র! তার অন্যতম মূল কথাটি হচ্ছে, বিনা বিচারে অন্যায়ভাবে কাউকে শাস্তি দেওয়া হবে না। এবং মতামতের স্বাধীনতার সঙ্গে তার দায়-দায়িত্বটাও হবে প্রত্যেকের ব্যক্তিগত।’

‘তা ছাড়া, আমি জানি’, নাজিম বলল, ‘অনেক বিহারীই এখনো আমাদের আন্দোলনের সাথে যুক্ত আছেন। তাঁরা আমাদেরই ভালো-মন্দের সাথে নিজেদের ভাগ্য জড়িয়ে নিয়েছেন।’

সে কথা ওয়াজেদও কিছু কিছু জানে। সেই যে এক বিহারি ভদ্রলোকের দোকান ছিল নিউ মার্কেটে, মাঝে মাঝে দু’একটা জিনিস কিনত, সেই সূত্রে পরিচয়। কাল থেকে দু-তিনবার অন্ততঃ ওয়াজেদের খোঁজ নিয়ে গেছেন। ওয়াজেদ সে জন্য কৃতজ্ঞ বৈকি! কিন্তু সেটা তো ব্যক্তিগত ব্যাপার, জাতিগত প্রশ্ন উঠলে ওই জাতকে আর ক্ষমার কথা উঠতেই পারে না। সে বলল—

‘হাঁ, সেই রকম দু-চারজনকে বাদ দিয়ে বাকিগুলোকে ধরব আমরা।’

‘সেটা বলতে পার।’—নাজিম ওয়াজেদকে সমর্থন জানাল।

‘না, তাও নয়।’ সুদীপ্ত মাথা নাড়লেন, ‘ব্যাপারটা ঠিক উলটো হওয়া উচিত। যারা যারা এখন দুষ্কর্মে লিপ্ত কেবল তাদেরকেই চিহ্নিত ক’রে রাখ। তখন খুঁজে বের ক’রে শাস্তি দেব। শাস্তিটা কখনোই সমষ্টিগতভাবে কোনো সম্প্রদায়ের উপর চাপিয়ে দেওয়া যায় না।’

এ কথায় কেউই সন্তুষ্ট হ’ল না। নাজিমও না। ওয়াজেদ তো নয়ই। তবু তাদের স্যার বলছেন। অতএব আর তারা কিছু প্রতিবাদ জানাল না। স্যাররা। ওই রকম বলেই থাকেন। সব শুনলে চলে না।

একটি মেয়ের কথা তাদের শুনতে হলো! সদর রাস্তা ছেড়ে একটি গলি পথে অনেকখানি ঘুরে যাচ্ছিলেন তারা। টিচার্স ট্রেনিং কলেজের মিলিটারি ছাউনি এড়াবার জন্যই এই প্রচেষ্টা। গলিটার বেশ অভ্যন্তরে একটি বাড়ির দরজায় মেয়েটি দাঁড়িয়ে ছিল। পিঠের দিকটায় দরজার চৌকাঠে হেলান দিয়ে। গালে বাঁ হাত ডান হাত পাশে ঝুলছিল, সে দাঁড়িয়ে ছিল। তার পায়ের কাছে বসে ছিল পোষা কুকুরটা। তাদেরকে দেখে মেয়েটি ডান হাত তুলে থামতে ইশারা জানাল। এবং গাড়ি থামার সঙ্গে সঙ্গে জানলার কাছে এগিয়ে কোনো ভূমিকা না রেখে সরাসরি শুধাল—

‘আপনারা ভদ্দরলোক, আমার একটা কথার জবাব কইতে পারেন?’ বলেই আনমনে গাড়ির জানলার কাচে নখ ঘষতে শুরু করল। ঐ দিকটায় বসেছিলেন সুদীপ্ত। তিনিই অতএব বললেন–

‘বলুন।’

‘আমি মুরুক্ষু মাইয়া লোক। কিন্তু পাশের বাড়ির মৌলভি সাব আমারে কন কি, তোর ছাওয়ালের লগে দুখ্‌কু করিস না। জেহাদের ছওয়াব পাইবি। আপনারা কন তো, হেই সব কামেরে কি জেহাদ কয়? আর তাতে ছাওয়াল মারা গোলে কি ছওয়াব হয়?’

ছেলে মারা গেলে কি পুণ্য হয়?—এমন অদ্ভুত প্রশ্ন সুদীপ্ত কখনো শোনেন নি। পুরো বৃত্তান্ত না শুনলে সব বোঝাও যাবে না। তবে এক মৌলভির রেফারেন্স থেকে তার মনে হল কথাটা বোধ হয় উঠেছে সান্ত্বনা দেবার জন্য। হয়ত মেয়েটির ছেলে এই পাকিস্তানি বর্বরদের হামলার শিকারে পরিণত হয়েছে। এবং তা যখন হয়েছেই তখন অগত্যা সান্ত্বনা দেওয়া ছাড়া আর উপায় কি? প্রতিবেশী হিসাবে মৌলভি সাহেব তাই সান্ত্বনা দান করেছেন। কাজটা ভালোই তো।

কিন্তু হায় আল্লাহ! এ কি শোনাচ্ছে মেয়েটি! এই বিধবা মেয়েটির একমাত্র ছেলে মারা গেছে সে এবার তো নয়। সেই উনিশ শো পঁয়ষট্টিতে। ভারতের সঙ্গে যুদ্ধে! পঁয়ত্রিশ বছরের বিধবাটিকে তখনি যেন আবিষ্কার করেছিল এ পাড়ার সদ্য বিপত্নীক সোবহান মৌলভি। সোবহান ঐ সময় বুঝিয়ে দিয়েছিল–

‘এ তো যেমন তেমন লড়াই না। এ হল জেহাদ। হিন্দুস্থানের সাথে পাকিস্তানের জেহাদ। সেই জেহাদে মারা গেছে তোর ছাওয়াল। জেহাদে মারা গেলে আল্লাহ তারে বেহেস্তে লন। তোর ছাওয়ালের লগে লগে তোরেও বেহেস্তে লইবেন। আমাদের তখন ভুলিস না যেন।’

বলতে বলতে সোবহান মৌলভি মিসি দেওয়া কালো দাঁত বের ক’রে হেসেছিল। কিন্তু পরক্ষণে সংযত দার্শনিকের ভূমিকা নিয়ে গম্ভীর হয়ে উপদেশ দিয়েছিল–

‘তুই সবুর কইরা থাক। তোর ছওয়াব হইব।’

তা সবুর মেয়েটি করেছিল। এই ক’ বছরে সে বিস্তর নামায-রোজা করেছে। এবং ছেলের জন্য দোয়া করেছে! একটি মহৎকার্যের জন্য ছেলে জীবন দিয়েছে এমনি একটি ধারণা তার মনে বদ্ধমূল হওয়ার পর সে যথেষ্ট সান্ত্বনা পেয়েছিল। এমনি কি মৌলভি যে তাকে নেকা করতে চেয়েছিল সেই সুখের কামটাতেও আর আপত্তি জানাবে না বলে প্রায় ঠিক ক’রে ফেলেছিল। এমন সময় এল একাত্তরের পঁচিশে মার্চ। রাত্রে প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দে ভয় পেয়ে তখনি সে ছুটে গিয়েছিল সোবহান মৌলভির কাছে–

‘ওগো মৌলভি সাব কি হৈল গো! একি ওজ কেয়ামত শুরু হইল গো! ওগো আল্লাহ কী হবে গো।’

সোবহান মৌলভি বিবি সাবেরে ঘরে নিয়ে বিস্তর ঝাড়-ফুঁক করেছিল। সাহস দিয়েছিল—

‘আরে ভয় করিস না। এ রোজ কিয়ামত না। কাফের গো মারন লগে জেহাদ শুরু হইছে।’

‘এ্যা! এ্যারে বুঝি জেহাদ কয়! আমার ছাওয়াল এই জেহাদ করছিল। এই কাম করলে বেহেস্ত পাওন যায়!’

প্রবল বিস্ময়ে ও ভয়ে আক্রান্ত হয়েছিল মেয়েটি গতকাল কারফিউ ওঠার পর এই জেহাদ সম্পর্কে যতোই তথ্য সে অবগত হয়েছে ততই কেমন যেন হয়ে গেছে মেয়েটি। এ্যারে বুঝি জেহাদ কয়? ঘরে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া, এলোপাথাড়ি গুলি ক’রে মানুষ মারা, মেয়ে ধরে নিয়ে যাওয়া— এই সবই জেহাদ বুঝি? এই জেহাদ আবার ক’রে নাকি। একটা গ্রাম্য ক্রোধ তাকে গ্রাস করেছিল। সে কিছুক্ষণ আগেই মৌলভিকে শুধিয়েছিল–

‘অরে অ মিনসে, জেহাদ মানুষ কিসের লগে করে?’

‘এছলামকে বাঁচানোর লগে জেহাদ করতে হয়। বেশি চেঁচাবি না যা।’

মেয়ে মানুষ হলেও তার ঝাল মাখানো কথা সোবহান মৌলভির সহ্য হয় না। মেয়ে মানুষ বাপু দু-একটু রসের কথা বলবি। তা না, কাল থেকে খালি ফ্যাচর ফ্যাচর। ছাওয়াল হারিয়েছিস তো হয়েছে কি! আমার কথায় যখন রাজি হয়েছিস তখন ছাওয়াল তাড়াতাড়িই পাইবি। সে জন্য বেশি ভাবতে হবে না তোকে।

কিন্তু মেয়েটি তবু ভাবছিল। তার ভাবনারা অনন্ত শাখা-প্রশাখাবিশিষ্ট একটি বিপুল মহীরুহ হয়ে উঠেছিল। আমার ছাওয়ালটাও এমনি করেই জেহাদ করেছে নাকি!…… এমনি ক’রে আগুন দিয়েছে ঘরে ঘরে। এমনি ক’রে মানুষ মেরেছে। মেয়ে ধরেছে। এ্যা! ঐ কামে ছওয়াব হয় নাকি! আর ঐ সব কাম করলে তবেই এছলাম বাঁচে বুঝি! কি জানি! মুরুক্ষু মেয়ে মানুষ আমরা! কিন্তু—একটা কিন্তু কিছুতেই মেয়েটির মন থেকে যেতে চায় না।

সোবহান মৌলভি মেয়েটিকে গম্ভীর হয়ে যেতে দেখে ভাবে, ছেলের শোকটা আবার নতুন ক’রে জেগেছে বোধ হয়। তাই সে সান্ত্বনা দিতে চেয়েছিল।–

‘করিমন বিবি, তুমি ছাওয়ালের লগে আর দুকখু কইরো না। তা হ’লে ছওয়াব পাইবা। জেহাদের কামে…’ বাকিটুকু আর সে বলতে দেয় নি মৌলভীকে। পাশেই ঝাঁটা পড়েছিল। সেটা হাতে তুলে—‘তোর জেহাদের গুষ্টি নিপাত করি……’ বলতে বলতেই খেংরাপেটা শুরু করলে দৌড় দিয়ে পালাতে হয়েছিল সোবহান মৌলভিকে। কিন্তু তারপর এক সময় ভাবতে হয়েছিল মেয়েটিকে এমনটা না করলেই ভাল হ’ত। হয়ত মৌলভির কথাই ঠিক। ভাবছিল সে। ঠিক এমনি সময় নাজিম তার স্যারকে নিয়ে যাচ্ছিল ঐ গলি দিয়ে। মেয়েটি গড় গড় ক’রে তার কাহিনী বলে গেল। সংক্ষেপে। এবং ততটুকু, যতটুকু একজন বাইরের লোককে বলা যায়। রাতের সেই ঘটনাটা বলল না। সেই রাতে যখন দুনিয়া ফানা হওয়ার যোগাড় তখনি মৌলভী সাব সেই কামটা করল। না, সে বাধা বড় একটা দেয় নি। সাদী করবে বলে কথা দিয়েছে যখন তখন আর বাধা দিয়ে লাভ কি? সোবহান মৌলভি তাকে বুঝিয়েছিল—

‘এ কামে ছওয়াব আছে তা জানিস। এক একবারের কামে এক একটা কাফের কতলের ছওয়াব হয়।’

মৌলভির সঙ্গে সম্পর্কের এই অংশটুকু মেয়েটা গোপন করল। কিন্তু খেংরাপেটার কথাটা লুকাল না। শুনে সুদীপ্ত কান্নাহাসির মাঝখানে একটা ভারি অদ্ভুত অবস্থার মধ্যে পড়ে গেলেন। নাজিম হাসি চেপে বলল–

‘চলুন স্যার আমরা পালাই।’

‘একটু দাঁড়াও’—বলে পকেট থেকে তিনি পাঁচটি টাকা বের করলেন। মেয়েটির হাতে দিয়ে একটি উপদেশ দিলেন শুধু —

‘মা আপনি পারলে অন্য কোথাও চলে যান। নাজিম চালাও।’

মেয়েটিকে আর কিছু বলার সুযোগ দিতে চান না তিনি। কেননা এখন তিনি তাড়াতাড়ি বাড়ি পৌঁছতে চান।