ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

সুদীপ্ত বেরিয়ে পড়লেন।

কোথায় যাবেন? এমনই পথে পথে ঘুরবেন কিছুক্ষণ? ওরে বাবা, তার সাধ্যি কি! দলে দলে মিলিটারি টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে রাস্তায়—তাদের দিকে চাওয়া যায় না। প্রবল চেষ্টায় সুদীপ্ত একবার শুধু তাকিয়েছিলেন একটা দলের পানে। ওদের গাড়িটা তখন নিউ মার্কেট থেকে এলিফ্যান্ট রোডের দিকে মোড় নিচ্ছিল। গাড়িতে ওরা ছিল বোধহয় পাঁচ ছয় জন হবে, প্রত্যেকের হাতে একটা ক’রে মারণাস্ত্র, সেগুলোর কোনটার কি নাম সুদীপ্ত জানেন না। কোনো ভদ্রলোকেরই বোধহয় তা জানার কথা নয়। মানুষ মারার জন্য কত রকমের কল বানানো হয়েছে তার হিসেব রাখবে কে? আরেক জন মানুষ? হাঁ, তা রাখতেও পারে। কিন্তু সুদীপ্ত তাদের দলে নন। অতএব তিনি কেবল। কতকগুলো নল দেখলেন, হিংস্র পশুর মতো কয়েকটি চোখ দেখলেন, আর মাথায় লোহার টুপি। দেখলেন, ইস্পাতের নলগুলো প্রত্যেকটি তাক করা রাস্তার মানুষের পানে। সাধারণ অবস্থায় এ দেখে একটু তো শিউরে ওঠার কথা। কিন্তু শিউরে ওঠার সময় কারো নেই। এমনিতে কোনো ব্যস্ততাও নেই, উদ্বেগটাও বাইরে থেকে চেনা যায় না। কিন্তু একটা অদ্ভুত অসাড়তায় সকলে আচ্ছন্ন। কতকগুলো যেন কলের পুতুল–হাসি নেই, কথা নেই, ভীতিও বোধহয় বিদায় নিয়েছে। মানুষের ভয় পাওয়ারও একটা সীমা আছে না! সুদীপ্ত ভয় পান নি—যদিও স্পষ্ট দেখেছিলেন এক জোড়া চোখ তার দিকে থাবা প্রসারিত ক’রে যেন ল্যাজ নাড়ছে। কিন্তু গাড়ি স’রে গেল, সুদীপ্তও স’রে এলেন—তাদের ব্যবধানটা ক্রমেই প্রসারিত হ’তে থাকল। সুদীপ্তর দেখা হয়ে গেল ওসমান সাহেবের সঙ্গে। ওসমান সাহেব হাঁটছেন? গাড়ি গেল কোথায়?

‘খবিশগুলো গাড়িখানা পুড়িয়ে ছাই ক’রে দিয়ে গেছে।’

ওসমান সাহেব মাত্র সপ্তাহ খানেক হল বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক এলাকায় বাড়ি পেয়েছিলেন। কিন্তু গাড়ি রাখার গ্যারেজ খালি ছিল না ব’লে বাইরেই তা ফেলে রাখতে হচ্ছিল। তাঁদের আবাসিক এলাকার দারোয়ানকে বখশিস দিয়ে গাড়ি পাহারার ব্যবস্থাও করেছিলেন ওসমান সাহেব। অতএব স্বাভাবিক অবস্থায় ভয়ের কিছু ছিল না কিন্তু সেই কালো রাতের হানাদারগুলো ওসমান সাহেবের ভাষায় খবিশগুলো, গাড়িখানা পুড়িয়ে ছাই ক’রে দিয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের আর কত জনের ক’খানা গাড়ি গেছে কে জানে! সুদীপ্তর গাড়ি ছিল না। অতএব ঐ নিয়ে কোন দুশ্চিন্তার অবকাশও তাঁর ছিল না। আজ ওসমান সাহেবকে দেখে তাঁর মনে হ’ল, মানুষের গাড়ি না থাকাটাই বোধহয় ভালো। দীর্ঘকাল গাড়ি নিয়ে বেড়ানোর পর হাঁটতে হলে কেমন লাগে? অন্ততঃ অন্যের যে খারাপ লাগে সেটা ওসমান সাহেবকে দেখে অনুভব করলেন সুদীপ্ত। ওসমান সাহেবের সঙ্গে তাঁর স্ত্রীও হাঁটছিলেন, হেঁটে হেঁটেই তাঁরা চলছিলেন ধানমণ্ডির দিকে।

ভাবী, ভালো আছেন?—কথাটা শুধোতে গিয়ে সুদীপ্তর গলায় আটকে গেল। প্রশ্নটা ব্যাঙ্গাত্মক শোনাবে না? সদ্য গাড়ি হারিয়েছেন, তদুপরি রিক্সায় না চেপে হাঁটছেন—এমন অবস্থায় ভালো আছেন কি না শুধোলে কেউই সে প্রশ্ন প্রসন্নভাবে নিতে পারেন না। কিন্তু ওসমান সাহেবের স্ত্রী নিজেই কথাটা তুললেন—

‘আপনারা কোথায় উঠেছেন? ভালো আছেন তো?’

কোন মানুষের পক্ষেই তখন ভালো থাকার কথা নয়। সুদীপ্তর স্ত্রীও ভালো ছিলেন না। গত দু’দিন ভালো ক’রে কিছু খান নি; তা নিয়ে মীনাক্ষী ভাবী অভিযোগও করেছেন। সেই প্রগল্‌ভা মিনা এখন কথাও বলেন খুবই কম। ছেলেমেয়েরা কাছে গেলে বিরক্তি বোধ করেন। তবু সুদীপ্ত বললেন–

‘ভালোই আছি। আপনারা?’

ওদের কাছ থেকে চ’লে আসার সময় সুদীপ্ত বললেন—

‘কাল আপনারা আমাদের ওখানে আসুন না। আপনার ভাবী তো ভয়ানক ঘাবড়ে গেছেন।’

‘হ্যাঁ আসব। আপনারাও আসবেন।’

ব’লেই ওরা এগিয়ে গেলেন। সুদীপ্তও চলা শুরু করলেন কিন্তু কেউ কারো ঠিকানা শুধালেন না। বরং মাত্র দু’পা এগিয়ে সুদীপ্ত যখন পাশের মরা কুকুরটাকে এক মনে দেখছিলেন তখন ওসমান সাহেব খুব আস্তে স্ত্রীকে শুধাচ্ছিলেন—

‘একটা রিকসা করব? মানে তোমার কষ্ট হচ্ছে তো।’

খুব গম্ভীরভাবে স্ত্রী বললেন—

‘না।’

ব’লে তিনি চলতে শুরু করলেন। ওসমান সাহেবও স্ত্রীর সঙ্গে হেঁটে যাওয়া ছাড়া আর কিছু করার পেলেন না। স্ত্রীর ব্যবহারে অস্বাভাবিকতাও লক্ষ্য করলেন না। কেননা সেটাও লক্ষ্য করতে হয়। মন দিয়ে কিছু লক্ষ্য করার অবস্থা তখন ওসমানের ছিল না। গতকাল বাসা ছেড়ে বেরুনোর সময় স্ত্রী শুধু বলেছিলেন–

‘মাত্র এই একান্ন টাকা পুঁজি। তখন বললাম, কিছু টাকা উঠিয়ে রাখ।’

ব্যাংক থেকে টাকা ওঠানোর কথা স্ত্রী বলেছিলেন বটে। কিন্তু দুজনেই তারা জানতেন ব্যাংকে তেমন কিছু নেই যা ওঠানো চলে। কিন্তু নেই কেন? এমনি একটা প্রশ্নের চারা মনে গজাতে দিয়ে গতকাল থেকে কেবল তার উপরেই পানি ঢালছেন ওসমান সাহেবের স্ত্রী। বাইরে কিছু বলছেন না। এই দুঃসময়ে সেটা বলা অসভ্যতা। হাজার হলেও রিটায়ার্ড ডি. আই. জি. সাহেবের কন্যা তিনি। আর ওসমান? তার বংশের কেউ কখনো সামান্য দারোগা হয়েছে এমন দেখাও দেখি। কেবল পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করেছিল, তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি পেয়েছ, তার বেশি তো না। ফ্রিজ. টি. ভি. সোফা সবি তো আমার বাপ দিয়েছে, নিজে কেবল কিনেছ একখানা গাড়ি, তাতেই এমন ফকিরী দশা! মহিলার ক্ষুদ্ধ হওয়ার এক গাদা কারণ ছিল। সামান্য একখানা গাড়ি কিনতে গিয়ে সব গচ্ছিত টাকা নিঃশেষিত হয়েছে। বেশ কিছু ঋণও হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে। সেই ঋণ এখন মাসে মাসে কিস্তিতে শোধ করতে হচ্ছে। ফলে এখন প্রতি মাসে যে পরিমাণ টাকা হাতে আসে তা দিয়ে কোনো মতে মাসই চলে না। এই অবস্থায় কোনো মাসে মাইনে না পেলে? তেমনি একটা অবস্থার সম্মুখিন হয়েছেন ওসমান সাহেব। মার্চের মাইনে মিলবে কি না কে জানে!

ওসমান সাহেবের মতো দূরবস্থা সুদীপ্তর ছিল না। গাড়ি নয়, একটি বাড়ির মোহ ছিল সুদীপ্তর। নিজের একটি ছোট্ট বাড়ি থাকবে, চারপাশে থাকবে অনেকখানি খোলা জায়গা। তাতে নিজের হাতে ফুলের গাছ লাগাবেন। ইচ্ছে মতো ব্যবহার করবেন বিপুলা পৃথিবীর কয়েক কাঠা জায়গা। অতএব কিছু কিছু তিনি জমাতে চেষ্টা করতেন। কয়েক হাজার টাকা জমিয়েছেনও। কিন্তু সে আর কতো? একটা বাড়ির জন্যে যা প্রয়োজন তার এক চতুর্থাংশও তো হবে না। তা না হোক। এই দুর্দিনে কিছুকাল মাইনে না পেলে খেয়ে তো বাঁচবেন। হাঁ, ঐটেই এখন দরকার। কোনো মতে বেঁচে থাকা। কেবল বেঁচে থাকা এবং দেখে যাওয়া।

কিন্তু এতো দেখা যায় না! হায় হায়, বর্বরের দল বস্তিগুলো সব পুড়িয়ে দিয়েছে গো। গতকাল পালিয়ে আসার সময় এ সব তো চোখে পড়েনি। হয়ত গাড়িতে আসার জন্যেই চোখে পড়েনি। নীলক্ষেতের পরিত্যক্ত রেল লাইনের দুপাশে বাস করত হাজার হাজার গরীব মানুষ। নানা সময়ে ঝড়ে-বন্যায় গ্রাম বাংলার লক্ষ লক্ষ বাস্তুহারা শহরে এসেছে—তারাই এখানে এসে হয়েছে বস্তিবাসী। সেই গরীব মানুষের বস্তি পুড়িয়ে অশেষ বীরত্ব দেখিয়ে গেছে পাক ফৌজ। আর পুড়িয়েছেও ঠিক বীর পুরুষের মতোই। কই তুমি আগুন দিয়ে এমন ক’রে পোড়াও দেখি। টিনও যে এমন হয়ে পুড়ে গলে যায় সেটা নিজে না দেখলে সুদীপ্ত কখনো বিশ্বাস করতেন না। একটা টিনের কৌটাও কোথাও পড়ে নেই, তার ফাঁপা কোটরে বাতাসের হাহাকারও নেই। শ্মশানেও তো কিছু থাকে পোড়া বাঁশ-কাঠ, আধ পোড়া কাঁথা-বালীশ কতো কি থাকে। একটা দীর্ঘশ্বাসকে, একটা মর্মবেদনাকে জানান দেয় তারা। এখানে পোড়া ইটের গায়ে জমা হয়ে আছে বৃক্ষের তীব্র ক্ষত, দুচোখের প্রচণ্ড ক্রোধ। হাতের কাছে আর কিছু না থাকে ঐ পোড়া ইট ছুঁড়ে মার শত্রুর মুখে।

হায় হায়, আস্ত মরদেহ আগুনে ঝলসে রোষ্ট হয়ে আছে। এখনো আছে! কেবল সরিয়ে নিয়ে গেছে পথে পথে গুলি-ক’রে মারা মানুষগুলিকে। ঘরে আগুন লাগলে মানুষ পথে বের হয়। বস্তির মানুষেরা পথে বেরিয়েছিল। আর পথে বেরিয়েই গুলি খেয়েছিল। ভারি সুন্দর রণকৌশল জানে পাক-ফৌজের দল। প্রথমে আগুন জ্বালিয়ে দাও, তারপর লোক পথে বেরুলে কারফিউ-ভঙ্গের অপরাধে গুলি কর। নরহত্যা হালাল হয়ে যাবে। বাঙালিরা সব কাফের হয়ে গেছে, অতএব তাদেরকে হত্যা করা হালাল। এই যুক্তিতে হাজার হাজার নরহত্যার প্রত্যেকটিই হালাল ক’রে নিয়েছিল পাকিস্তানিরা। না ক’রে উপায়ও ছিল না। তারা ইসলামের বড়াই ক’রে থাকে না! এবং ইসলাম যদি শান্তির ধর্ম হয় তবে এতো অশান্তি সৃষ্টির এতো ধ্বংসলিলার একটা কারণ দেখাতে হবে তো।

অদ্ভুত কারণ দেখিয়েছিল সেই পাকিস্তানি সৈনিক। রেল লাইন অতিক্রম ক’রে তাঁদের নীলক্ষেত আবাসিক এলাকার গেটের কাছে পৌঁছতেই একটা মিলিটারি জিপ এসে সুদীপ্তর সামনে দাঁড়াল। সুদীপ্ত একবার মনে মনে আল্লাহকে ডাকলেন, এবং মুহূর্তের মধ্যে সামনের সদ্য পাতা-গজানো দেবদারু গাছটিতে চোখ বুলিয়ে নিলেন। চলে যাবার সময় যদি জীবনে এসেই থাকে তবে তৈরি হয়ে নেওয়াই ভালো। মনকে তিনি তৈরি ক’রে নিলেন। দেবদারুর সারা অঙ্গ ভরে বাংলার রূপ। এই রূপের পাথেয় নিয়ে পরকালের যাত্রাকে মধুময় ক’রে নেওয়া যায় না? ঘরের মধ্যে রাতের অন্ধকারে ইঁদুরের মতো মরে পড়ে থাকাটা তিনি যে এড়াতে পেরেছেন সেই জন্যই তিনি নিয়তিকে ধন্যবাদ দিয়েছেন। এখন এই উজ্জ্বল সকালে দেবদারু গাছের ছায়াতে ম’রে যেতে আর আপত্তি নেই।

ওহে জেন্টলম্যান, তোমার আপত্তি থাকলেই বা সে কথা শুনছে কে? ঐ যে রাইফেলের নলটা দেখছ। ঠিক তোমার বুকের দিকে তাক ক’রে আছে। সুদীপ্ত একটা খাকি মূর্তিকে দেখলেন।

‘ইধার সে কাঁহা যাতা হ্যায়।’

‘হামারা ঘর মে যানা চাহতে হ্যায়।’

উত্তরটা চট ক’রে বেরিয়ে গিয়েছিল সুদীপ্তর মুখ দিয়ে। কিন্তু ওদিক থেকে জবাব এসেছিল—

‘কুত্তাকা ঘার নেহি হ্যায়, চলো।’

ব’লেই সে খাকি মূর্তিটা রেল লাইনের দিকে তার রাইফেলের নল প্রসারিত ক’রে দিল। অর্থাৎ রেল লাইনের ওদিকে শ্মশানের মতো এলাকায় সুদীপ্তকে যেতে বলা হচ্ছে। তার মানে যে কি সেটা বুঝতে অসুবিধা ছিল না। যাওয়া আদৌ নিরাপদ নয়, না গেলেও বিপদ। বিপদের সময় বুদ্ধি কে জোগায় সুদীপ্তর জানা নেই। বুদ্ধিটা পেতে কোন চেষ্টাও তিনি করেন নি। তবু পেয়ে গেলেন—

‘হাম কুত্তা নেহি হ্যায়, হাম মুসলমান হ্যায়।’

‘তোম যো মুসলিম হ্যায় উ তো ভোল গিয়া।’

তুমি যে মুসলিম সে তো ভুলে গিয়েছিলে বেরাদর। এ অভিযোগের উত্তর কি হবে? সুদীপ্ত ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে চুপ মেরে গেলেন। তবু এ যাত্রায় বেঁচে গেলেন অধ্যাপক সুদীপ্ত শাহিন। খাকি মূর্তির আদেশ মোটামুটি ঠিকভাবেই তিনি পালন করেছিলেন—কলেমা পড়তে ভুল করেন নি। এবং নামটাও মিছে ক’রে বলেছিলেন। তো, চাকরির জন্য যে নাম তিনি গ্রহণ করেছিলেন সেটা মিথ্যে বৈ কি। সর্বত্রই তিনি সেই সুদীপ্ত শাহীনই আছেন। কিন্তু পাকিস্তানে সর্বত্র সত্যবাদী হয়ে কি ক’রে চলবেন তিনি? যখন কোনো বাঙালি নিজেকে পাকিস্তানি বলেন তখন সেইটেকেই একটা চরম মিথ্যা বলে মনে হয় সুদীপ্তর। পাকিস্তানের কোনখানে বাংলাদেশ আছে শুনি? প-এ পাঞ্জাব—পাঠান, ক-এ কাশ্মীর, স-এ সিন্ধু, স্তান-এ বেলুচিস্তান—এই তো “পাকিস্তান” শব্দের ব্যাখ্যা। তা হলে বাংলা স্থান পেল কোন্ অংশে? তবু এই বাংলাদেশ নাকি পাকিস্তানের অবিচ্ছেদ্য অংশ। শুনলেই গা জ্বালা ক’রে সুদীপ্তর। তবুও শুনতে হয়। কেন না তা শোনানোর মতো লোক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিস্তর না হলেও নেহাৎ কম ছিল না। সুদীপ্ত সাধ্যমতো তাদেরকে এড়িয়ে চলতেই অভ্যস্ত। কি আশ্চর্য, মাঝে মাঝেই সুদীপ্তকে ভাবতে হয়, মধ্যযুগীয় মানসিকতা বিশ্ববিদ্যালয়েও এতো প্রশ্রয় পায়; মধ্যযুগীয় প্রভুতোষণের মনোবৃত্তিটাকে সুদীপ্ত ঘৃণা করেন। অথচ অনেকে সেটাকে লালন ক’রে খুশি, এবং লাভবানও। তাদের সান্নিধ্য সুদীপ্ত এড়িয়ে চলেন। তবু কি সব সময় এড়িয়ে চলা যায়? হাজার হলেও এক সাথে চাকরি করেন–কমনরুমে, ক্লাবে দেখা-সাক্ষাতটা তো আর এড়িয়ে চলা যায় না। সেদিন একটা ছোট বিতর্ক সুদীপ্ত এড়াতে পারেননি। কতক্ষণ আর কথা না ব’লে দু’টি মানুষ মুখোমুখি বসে চা খেয়ে যেতে পারে। অত্যন্ত সাবধানে সুদীপ্ত নিছক আবহাওয়ার কথা উত্থাপন করেছিলেন—

পূর্ব বাংলায় এবার বেশ অনাবৃষ্টির বছর যাবে বলে মনে হচ্ছে।

নিঃসন্দেহে তিনি খুব নিরাপদ প্রান্তরে বিচরণ করেছেন বলেই সুদীপ্তর ধারণা হয়েছিল। কিন্তু সুদীপ্তর দশা হয়েছিল সেই একচক্ষু হরিণের মতো।

একটা দিকে তিনি নজর রেখেছিলেন ঠিকই, কিন্তু আর একটি দিক তিনি দেখতে পাননি। তাঁর সহকর্মী সঙ্গে সঙ্গে ব’লে উঠেছিলেন—

‘পূর্ব বাংলা নয়, বলুন পূর্ব পাকিস্তান।’

সহসা সুদীপ্ত একটু উত্তেজিত হয়েছিলেন যেন। বলেছিলেন—

‘কেন? পূর্ব বাংলা বললে কি দোষ হয়?’

‘একশো বার দোষ হয়। আমরা যে এক জাতি—পাকিস্তানি—সে কথাটা অস্বীকার করা হয় ওতে।’

এই কথা শোনার পর আর কিছু বলা যায় না। বলা উচিত নয়। উচিত অনুচিতের এই বোধটুকু না থাকলে পাকিস্তানের অস্তিত্ব রক্ষা অসম্ভব। তবে একদিক থেকে তাঁর সহকর্মী অধ্যাপকটি মিথ্যা বলেননি। পরে ভেবে দেখেছিলেন সুদীপ্ত। সত্যিই তো পাকিস্তানের মধ্যে বাংলার স্থান কোথায়। প এ পাঞ্জাব-পাঠান, ক-এ কাশ্মীর, স-এ সিন্ধু, স্তান-এ বেলুচিস্তান কিন্তু বাংলা হবে কি দিয়ে? অতএব সোজা সমাধান— “বাংলা” শব্দটাকে বাদ দাও। বল “পূর্ব পাকিস্তান”। জাতীয় সংহতি রক্ষা পাবে।

আয়ুব খানের আমলে অনেকেই জাতীয়-সংহতি রক্ষার দালালি নিয়ে বেশ দু’পয়সা ক’রে খেয়েছে। পথেঘাটে, ক্লাবে-রেস্তোরায় যত্রতত্র তারা এই জাতীয়-সংহতির সবক বিতরণ করত। তা নিতে না চাইলেও কানে শুনতে হত সকলকেই। সুদীপ্তও সেদিন তা নীরবে শুনেছিলেন, শুনতে হয়েছিল। আজ তেমনি তাকে শুনতে হল ধর্মের কথা। তাকে ইসলাম ধর্মের সবক নিতে হল পশ্চিম পাকিস্তানি সৈনিকের কাছ থেকে। তাঁরা যে মুসলিম এটা নাকি বাঙালিরা ভুলে গিয়েছিলেন, তাই পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী রাতের অন্ধকারে কামান-মেশিনগান-রাইফেল নিয়ে ঘরে ঘরে এসে বাঙালিকে মনে করিয়ে দিয়ে গেছে–তোমরা যে মুসলমান এটা মনে রেখো বেরাদরগণ।

মনে না রাখলে?

তোমাদের হত্যা করা হবে। মুসলমানদের আবাসভূমি পাকিস্তান। সেই পাকিস্তানে বাস ক’রে তুমি ইসলামকে ভুলে যাবে? তা হ’লে তোমাকে হত্যা করা আমাদের জন্য ফরজ কাম।

অতএব পাকসৈন্যদের সেই রাতের তাণ্ডবলিলা নাযায়েজ হয়নি।

কিন্তু তবু প্রশ্নটা মন থেকে তাড়ানো যায় না। মুসলমানরা না হয় হিন্দু হয়ে যাচ্ছিল বলে তাদের মেরে বেড়ালে। কিন্তু হিন্দুরা? তারা কি সব মুসলমান হয়ে যাচ্ছিল। তাদের মারার কারণ কি?

‘ওরে বাবা, তারা যে হিন্দু। পাকিস্তানে হিন্দু থাকতে দেওয়া যায় নাকি?’

কেন? তোমাদের বাপ কায়েদে আজম যে ব’লে গেছেন, পাকিস্তানে কোনো মুসলমান মুসলমান হবে না, কোনো হিন্দু হিন্দু হবে না। তারা সবাই মিলে হবে একটি জাতি—পাকিস্তানি। তা হ’লে আবার কিভাবে তোমরা এখানে হিন্দু মুসলমানের ভেদাভেদ সৃষ্টি করছ বুঝিনে।

বুঝলে না? হিন্দু মাত্রই ধরে নিতে হবে পাকিস্তানের দুশমন। আর দুশমন দেখলে তাদেরকে গুলি করা সামরিক বিধানে বিলকুল জায়েজ।

এইভাবে বস্তির দরিদ্র মানুষ, ভদ্রলোক মুসলমান, ভদ্রলোক হিন্দু প্রত্যেককে, হত্যা করার উপযুক্ত কারণ পাকিস্তানিরা বের করেছিল। আহা, একজন মুসলমান তো আর অকারণে নরহত্যা করতে পারে না।