» » অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ

অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ

পুরোনো ঢাকার এইখানে, হাঁ এইটেই তো—এই তো তাঁর খালার বাড়ি কতো এসেছেন। তবু যেন আমিনা বাড়িটাকে চিনতে পারছেন না। কি ক’রেই বা চিনবেন? কখনো তো লোহার গেট এমন ক’রে বন্ধ দেখেন নি। লোহার গেটে বিরাট তালা ঝুলছে। কোথায় গেছেন তার খালা-আম্মা! কিংবা তার খালাত ভাইয়েরা? স্বামী ও সন্তানদের নিয়ে আমিনা যেন অকুল সমুদ্রে পড়লেন। আর তো সময়ও বেশি নেই। বিশ-পঁচিশ মিনিটের মধ্যেই কারফিউ শুরু হয়ে যাচ্ছে। ফিরোজকে ছেড়ে দিয়ে কি ভুলটা যে হয়ে গেল! এবং সে জন্য সম্পূর্ণ দায়ী আমিনা। এখানে সঙ্কীর্ণ গলিতে গাড়ি ঢোকালে বেরুতে অসুবিধা হতে পারে বিবেচনা ক’রে বড়ো রাস্তার পাশে গাড়ি দাঁড় করিয়ে এটুকু পথ, পথ সামান্যই, ফিরোজ তাদের এগিয়ে দিতে চেয়েছিলেন।–

‘চলুন ভাবী, আপনাদের পৌঁছে দিই।’

‘না ভাই, কিচ্ছু দরকার নেই। এটুকু আমরা দিব্বি পৌঁছে যেতে পারব। পারলে কাল সকালে একবার খোঁজ নেবেন।’

সুদীপ্তদের বড়ো সুটকেশটা হাতে নিয়ে ফিরোজ তাঁদের সাথে পা বাড়িয়েছিলেন। মীনাক্ষীও বেরিয়ে এসেছিলেন গাড়ি থেকে। বেশ তো, ওঁদের একটু পথ হেঁটে গিয়ে আমরা একেবারে তাঁদের পৌঁছে দিয়ে আসি।

কিন্তু আমিনা এ ব্যবস্থায় কিছুতেই রাজি হলেন না।–

‘এই তো সামান্য দু পা গিয়ে সাত নম্বর বাড়ি। অকারণে আর কষ্ট করতে দেব না আপনাদের। সুটকেশটা আপনি ওকে দিন।’

ব’লেই অবলীলাক্রমে একটা ব্যাগ তিনি কাঁধে ঝুলিয়ে নিলেন, এবং অন্যটা বাঁ হাতে নিয়ে ডান হাতে এলাকে ধ’রে পথ চলা শুরু করলেন। অতঃপর স্ত্রীকে অনুসরণ করা ছাড়া গত্যন্তর কি? তাঁর একটা হাত বেলা ধরেই ছিল, অন্য হাতে ফিরোজের কাছ থেকে সুটকেশটা তিনি নিয়ে নিলেন। এবং খুব একটা মলিন হাসি হেসে বিদায় নিলেন বন্ধুর কাছ থেকে। আমিনা বলে দিলেন–

‘কাল কিন্তু ভাবীকে নিয়ে আসবেন। এই সামনের সাত নম্বর বাড়ি।’

‘আসব।’

হয়ত ফিরোজ আসবেন। কিন্তু সে তো সেই আগামী কাল নটার আগে নয়। তারা এমনি বেকুবের মতো কাজ করেছেন যে, ফিরোজের বাড়ির নম্বরটাও নেন নি। তালা-ঝুলানো লোহার গেটের সামনে স্বামী ও সন্তানদের নিয়ে আমিনা তখন কি ভাবছিলেন?

না, কিছুই ভাবেন নি। অত ভেবে কাজ করা মেয়েদের অভ্যাস নয়। তিনি সোজাসুজি স্বামীকে বললেন।

‘এখন কি করবে কর। আমি তো আর ভাবতে পারছি নে।’

কেন পারবে না শুনি! সেই দুপুর থেকেই তো খালার বাড়ি খালার বাড়ি করছিলে। ঠেলাটা সামলাও এবার। কিন্তু ঠেলাই যদি সামলাবেন তা হলে আর স্ত্রীলোক হতে গেলেন কেন? এতোক্ষণ তো বেশ প্রবল পরাক্রম দেখানো হচ্ছিল? এখন যে বেকায়দায় পড়েছেন, অমনি অবলা সেজে বসলেন—কি করবে কর, আমি তো আর পারি নে। হাঁ, আমরা সব পারি। পুরুষ যখন হয়েছি। তোমরা দয়া ক’রে কেবলি তালগোল পাকাবে, আর আমরা খুলব। সেই জন্যই তো আছি আমরা।

সুদীপ্ত পাশের বাড়ির দরজায় গিয়ে কড়া নাড়লেন। বেশ কয়েকবার জোরে জোরে কড়া নাড়ার পর ভেতর থেকে একটা নারীকন্ঠের সাড়া পাওয়া গেল–

‘কে? কাকে চান?’

‘আপনাদের সাথে আমরা একটু কথা বলতে চাই, আমরা বিপদে পড়েছি। একটু খুলবেন?’

‘আপনারা কারা? বাড়িতে কোন পুরুষ নেই।’

‘তা হলে আপনার কাছেই না হয় দুটো কথা শুধিয়ে নিতাম। একটু যদি খুলতেন!’

‘আপনি কেমন ধারা ভদ্দর লোক! বলছি বাড়িতে পুরুষ নেই। তাও কপাট খুলতে বলেন! তাও আবার এই কারফিউ আওয়ারে!’

‘না, না দেখুন…মানে আমার সঙ্গে আমার স্ত্রী আছেন।’ আমিনার দিকে তাকিয়ে—‘এই যে, তুমি একটু কথা বল না।’

খুব আস্তে বিড় বিড় ক’রে আমিনা বললেন—

‘আমি কি বলব! তোমারই বুদ্ধির দৌড় একটু দেখা যাক।’

কিন্তু স্বামীকে এ কথা তিনি শোনালেও বুঝতে তার কোনোই অসুবিধা ছিল না যে, এই অবস্থায় তাঁর এখন এগোনো কর্তব্য। সত্যিই তো, কারফিউ আওয়ারে কোন স্ত্রীলোক কোনো পুরুষকে বাড়ির দরজা খুলে দেবে এটা ভাবা যায়? কথাটা শুনতে তো কেমন। আমিনা একটু এগিয়ে বললেন—

‘আমরা ভাই হঠাৎ বড়ো বিপদে পড়ে গেছি। একটু যদি খুলতেন।’

একটু খানিই খুলল—কপাট নয় জানলা! জানলার ফাঁক দিয়ে মহিলা আমিনার সাথে কয়েকটি কথা বললেন। আমিনা তাঁর খালার কথা শুধালেন। পাশের বাড়িতে থাকতেন। অতএব কোথায় গেছেন সেটা যদি জানা যেত! কিন্তু জানা গেলেই বা কি লাভ!

‘তাঁরা তো ভাই বুড়িগঙ্গার ওপারে সেই জিঞ্জিরায় চলে গেছেন।’

‘কালই গেছে নাকি?’

‘না, কাল যেতে পারেন নি। আজ সকালে গেলেন। আমরা কত মানা করলাম। সবাই মিলে আসুন, এক সাথে থাকি। কপালে যা আছে তার তো আর রদ হবে না। কিন্তু কে শোনে ভাই।’

‘আমরা তা হলে কি মুশকিলে পড়লাম বলুন তো! এখন তো আর ফিরতেও পারিনে। বাসা থেকে বেরিয়ে কি ভুলটাই করলাম!’

‘কোথায় বাসা ছিল আপনাদের?’

‘আর বলবেন না ভাই। নীলক্ষেতে থাকতাম আমরা। উনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক।’

‘কে রে বুলা?’ বলতে বলতে একজন প্রৌঢ়া এসে দাঁড়িয়েছিলেন ঘরের মধ্যে। বুলা মুখের কাছে আঙুল এনে সঙ্কেতে আমিনাকে চুপ থাকতে বললেন। এবং প্রৌঢ়াকে যা বলার তা নিজেই বললেন। খুব চাপা স্বর। কিছু তার শোনা গেল, কিছু গেল না। অবশেষে বুলা নামক মেয়েটি তাঁদেরকে একটু অপেক্ষা করতে বলে প্রৌঢ়াকে নিয়ে ভেতরে চলে গেলেন।

কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে এলেন। বুলা নিজেই কপাট খুলে তাদেরকে ভেতরে নিয়ে বসালেন। ঘরে একখানা টেবিল, এবং কয়েকখানা কাঠের চেয়ার ছিল। সেখানে তাঁদের বসতে দিয়ে তিনি বললেন–

‘একটা কথা। কেউ এসে কড়া নাড়লে খুলে দেবেন না! কিংবা কোন প্রকারের সাড়া দেবেন না যেন।’

আমিনা শুধু সম্মতিসূচক মাথা নাড়লেন। বুলা আবার যথারীতি ঘরে খিল তুলে দিয়ে ভেতরে চলে গেলেন। হাঁ, মাত্র এইটুকুর জন্যই এখন খোদার কাছে মনে মনে অনেক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন সুদীপ্ত। আমিনা কিন্তু খোদার অবিচারকে স্মরণ করলেন। এতো বিপদের পরও ভাগ্যের এই পরিহাস। কাল কতো ক’রে বললাম, চল খালার ওখানে যাই। কাল এলে তো এই বিপদটা হত না। দিব্যি খালাদের সাথে ওপারে জিঞ্জিরায় চলে যেতাম! কেমন নিরাপদে থাকতাম। কিন্তু নিরাপদ আশ্রয় খোদা আমার কপালে লেখেনি। এখন কি সারারাত এখানে ছেলে-মেয়ে নিয়ে বসে কাটাতে হবে?

ইতিমধ্যেই বেলা তার আব্বার কাছে আবেদন জানিয়েছে—

‘আব্বু কি খাব?’

সত্যিই তো, কি খাওয়ানো যায় ছেলেমেয়েদের! সঙ্গে বিস্কুট ও গুঁড়ো দুধের টিন আছে। কিন্তু পানি? বাংলাদেশে পানি চাইলে অবশ্যই পাওয়া যায়। কিন্তু সে চাওয়ার ভার তো আমিনাকে দিতে হয়। আমিনাকে বলবে নাকি ভেতরে থেকে একটু পানি চেয়ে আনতে! না, সে সাহস সুদীপ্তর হল না। নিজের জন্য চাইলে আমিনা কিছু বলবে না। চেষ্টা ক’রে হয়ত জোগাড় ক’রে এনে দেবে। কিন্তু মেয়ের দরকারে উঠতে বললে দেবে ধমক। মেয়েকে এ দুঃসময়ে ধমক খেতে দেওয়ার চেয়ে একটু সোহাগ দেওয়া উত্তম বৈকি। সুদীপ্ত মেয়েকে সোহাগ দিয়ে ভোলাতে চাইলেন—

‘একটু কষ্ট ক’রে থাক মা মণি। একটু খানি।’

মায়ের কাছে একটা চেয়ারে বসে ছিল অনন্ত। ছেলে মানুষ হলেও এখন কিছু একটা বলা উচিত বলে তার মনে হল—

‘ছী ছোট আপা, যেখানে সেখানে খেতে হয় না। আমরা তো খাচ্ছি নে। তোমার বড়ো আপা খাচ্ছে না।’

ছোট বোনকে অনন্তর সান্ত্বনা দেওয়ার ভঙ্গিটা অন্য সময় হ’লে হাসি জাগত—একটু কৌতুকের সঙ্গে মা-বাবা উভয়ে সেটা উপভোগ করতেন। কিন্তু এখন? উভয়েরই মনের গভীরে কোনো জমাট তুষার যেন গলতে শুরু করেছিল। এবং তা অশ্রু হয়ে বেরোতে চাইলে উভয়েই ছেলে-মেয়েদের সামনে প্রখর সতর্কতায় তাকে গোপন করলেন।

অনন্ত তার মায়ের কাছে, আব্বার কাছে বেলা। মাঝখানে বেচারা এলাটা কারো সঙ্গ পায় না সে একবার তার মায়ের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়, একবার বাপের কাছে। বাপের কাছে এলা শুধায়—

‘এখানে কেন এলে আব্বু! নানীরা কই?’

নানী অর্থাৎ আমিনার খালার বাড়ি ইতিপূর্বে একাধিকবার এলা এসেছে। এলা তাই চেনে বাড়িটা। সে বাড়ি বন্ধ থাকলে চল ফিরে যাই। তা না, এখানে কেন?

সুদীপ্ত এক হাতে কোলের বেলাকে জড়িয়ে ছিল। আর-এক হাতে এলাকে কাছে টেনে নিয়ে মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন–

‘তোমার নানীরা একটু বাইরে গেছেন আম্মু। ফিরে এলেই আমরা তোমার নানীদের বাড়ি যাব, কেমন?’

সেটা ছোট্ট একখানি বাইরের বসার ঘর। পুব-দক্ষিণ দু’দিকে দু’টি জানলা, এবং দু’টি দরজা। পশ্চিম দিকের দরজা দিয়ে অন্দরমহলে যাওয়া যায়, পুব দিকেরটা রাস্তায় বেরুবার। উত্তর দেয়াল-সংলগ্ন একটি টেবিল এবং খান চারেক কাঠের চেয়ার। তাতেই ঘরের অর্ধেক জায়গা জুড়ে ফেলেছে। এই ঘরে তাদের রাত্রিবাস করতে হবে? হয়ত হবে। নিশ্চয়ই হবে। সেজন্য মনে শঙ্কা লাগছে নাকি! এর চেয়েও ছোট ঘরে মানুষ বাস ক’রে না? তবে ইতিমধ্যেই তারা যে ঘেমে উঠেছেন। মার্চের শেষ সপ্তাহের গরম, তদুপরি সারা দুপুর প্রায় পথে পথে কেটেছে। ছেলেমেয়েদের মুখগুলো কেমন শুকনো আর করুণ দেখাচ্ছে। সুদীপ্তর বুকের মধ্যে একটি আহা ধ্বনির হাহাকার খেলে গেল। কি যে ভয়াবহ রাত্রি সামনে আসছে! আল্লাহকে ডাকলেন সুদীপ্ত। কিন্তু আমিনা তখনো ভাবছেন, কাল যদি আসতাম! কথা তো শুনবেন না। বন্ধুর বাড়ি যাবেন। কেমন দিব্বি আজ ঢাকার বাইরে গ্রামের খোলামেলা জায়গায় ছেলেমেয়ারা ঘুরে বেড়াত। খালা কি তাকে ফেলে যেতে পারতেন!

আমিনার ধারণায়, জিঞ্জিরাতে গিয়ে খালারা বেঁচে গেছেন। এবং পরম সুখে আছেন। সুখে ছিলেন। কিন্তু ওই একটা দিন। পরদিনই সেখানে পাকিস্তানিরা তাদের কারবার শুরু করেছিল। সেটা তাঁদের নীলক্ষেতের চেয়ে কম কিছু ছিল না। কিন্তু তাতে এখন কি। ভবিষ্যতকে তো মানুষ দেখতে পায় না। পেত যদি? অন্ততঃ আমিনা যদি সেই ভবিষ্যতের কিঞ্চিৎ কল্পনাও করতে পারতেন তা হলেও এতোবার জিঞ্জিরার কথা এখন স্মরণ করতেন না। একদিন তো আমিনাকে স্মরণ করতে হয়েছিল–জিঞ্জিরাতে যাওয়া হয়নি যে, সেটা আল্লাহর অপার কৃপা। আল্লাহর কৃপাতেই তারা বেঁচেছেন। তার খালারা কেউ বাঁচেন নি। সারা জিঞ্জিরা কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই শুন্‌শান হয়ে গিয়েছিল।

এক ঘণ্টা পর প্রায় পাঁচটার দিকে সেই বুলা নামে মহিলাটি আবার এসেছিলেন।

‘চারটে থেকে কারফিউ শুরু হয়ে গেছে এ অবস্থায় আপনাদেরকে যেতে বলতেও পারি নে। আবার থাকবেন যে তারও অসুবিধা বিস্তর।’

সুদীপ্ত বললেন—

‘আমাদের অসুবিধা কি বলছেন! আপনাদের যে অসুবিধা সৃষ্টি করেছি সেইটেই ভাবতে লজ্জা পাচ্ছি।’

‘কিন্তু কি আর করবেন! ইচ্ছে ক’রে তো আর করেন নি। তবে কথা কি জানেন, আমরা কেউ এখন নিজের ইচ্ছা অনিচ্ছার উপর চলছিনে। অবস্থান আমাদের চালাচ্ছে।’

বাহ ভদ্র মহিলা কথাটা ভারি সুন্দর বলেছেন তো! নিঃসন্দেহে খুব বুদ্ধিমতী মহিলা। বাঁচা গেল। সুদীপ্ত মনে মনে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। মহিলার যে বুদ্ধি আছে এটা তাদের অনুকূলে না গিয়েই পারে না। বিপক্ষে গেলে? এতোক্ষণ এখানে প্রবেশাধিকারই মিলত না।

আমিনা তাঁদের আলোচনায় যোগ না দিয়ে কাজের কথা তুললেন—

‘বোন, একটু গরম পানি দিতে পারেন। শুধু খানিকটা গরম পানি। সামান্য গরম হলেই চলবে।’

‘কেন?’

‘বাচ্চাদের একটু দুধ খাওয়াতাম।’

‘তা হলে পারি নে।’

আমিনা একটু বোকা ব’নে গেলেন। এবং সুদীপ্তও। এখানে কি যে তাঁরা বলবেন, পুনর্বার গরম জলের অনুরোধ শোভনীয় হবে কি না, কেননা ওটা যে না হলেই নয়, বাচ্চাদের তো খাওয়াতেই হবে— তাঁরা ভাবছিলেন। এমন সময় বুলা বেরিয়ে গেলেন। আমিনা স্বামীর মুখের দিকে তাকালেন। সুদীপ্তও তাকিয়েছিলেন স্ত্রীর মুখের দিকে। দু’জনেই দু’জনকে নীরবে প্রশ্ন করলেন–ব্যাপরটা কি হল?

ব্যাপার কিছুই হয়নি। আধ ঘণ্টা পর বুলা একটা বড়ো কেৎলিতে দুধ আর। রেকাবীতে ডজনখানেক বিস্কুট নিয়ে এলেন।–

‘এ সবের মধ্যে কিছু আবার আবিষ্কার করতে যাবেন না যেন। ছোট ছেলেদের যেমন কোনো জাত নেই, তেমনি তাদের বিশেষ কোনো ঘরও নেই। ক্ষিধে পেলেই তাদের খাবার অধিকার আছে। তা সে যে ঘরেই হোক।’

‘ক্ষিধের সময় ও থিওরিতে আমরাও বিশ্বাসী’–আমিনা বললেন।

‘সেই জন্যই আপনাদেরকে মেরে ফেলা দরকার। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এই সব কথা আপনারা দেশের যুবকদের মধ্যে ছড়িয়ে বেড়াচ্ছেন। দেশের সর্বনাশ ডেকে আনছেন আপনারা।’

এবার সুদীপ্ত বললেন–

‘কিন্তু আপনি তো বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে থেকেও কথা কম জানেন না দেখছি।’

‘আপনাদের কাছেই শেখা। বিশ্ববিদ্যালয়ে এককালে পড়েছি তো।’

এককালে? মানে, কোন্ কালে? কোন সাবজেক্টে? আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে। নাকি?–প্রশ্ন সুদীপ্তর মনে একরাশ থাকলেও কোনোটাই তিনি তুললেন না। কোনোটারই উত্তর চাইলেন না। তিনি চুপচাপ দেখে গেলেন বুলা ও আমিনা আলাপ করতে করতে বাচ্চাদের খাওয়াচ্ছেন।

‘যতোটা পার, শুধু দুধ খেয়ে থাকতে হবে বাছারা! তোমাদের খালার ঘরে আর কিছু নেই।’

‘ভাত?’—এলা প্রশ্ন ক’রে বসল।

প্রবল দুঃখের মধ্যেও একটু হাসতে হ’ল সকলকে। এবং সুদীপ্ত শুধুই একটু হাসলেন। আমিনা বললেন—

‘দেখলেন, ইংরেজির অধ্যাপকের মেয়ে হ’লে হবেকি! একেবারে খাঁটি বাঙালি। খালা হতে চান, ডাল ভাত খাওয়ান।’

বুলা এই সময় মুখের কাছে আঙুল এনে যেন আমিনাকে সাবধান করে দিলেন।–

‘দিদি আস্তে। কথা যেন বাইরে শোনা না যায়।’

সুদীপ্ত যেন অনেক দূরে থেকে মহিলা দুজনকে দেখছিলেন। শাশ্বত বঙ্গজননী। একজন খাওয়াচ্ছেন এলাকে, একজন বেলাকে। অনন্ত নিজেই খাচ্ছে। কিন্তু বসেছে বুলার কাছে। বুলাই তাকে কাছে বসিয়েছেন।

নাহ, বাঙালি মরবে না। এতো প্রীতি মমতার মৃত্যু হয় না।

কিন্তু শুধুই তুমি প্রীতি-মমতা দেখলে? ঈর্ষা-কলহ দেখনি? আর প্রকাণ্ড পরশ্রীকাতরতা?

হাঁ, তাও তো ঠিক ঈর্ষা-কলহ-বিশেষ ক’রে পরশ্রীকাতরতা এবং ক্ষুদ্রতা…সুদীপ্তকে কে যেন কানে ধরে কেবলি বাঙালি-চরিত্রের দীনতা ও তুচ্ছতাগুলিকে দেখিয়ে নিয়ে বেড়াল অনেকক্ষণ! ততক্ষণে বুলা চলে গেছেন। কিন্তু অতীতের দীনতাসঙ্কুল ঈর্ষাকুটিল গলিপথ পরিক্রমণ যেন সুদীপ্তর ফুরোচ্ছে না।

কিন্তু তিনি কি বুলার প্রতি অবিচার করছেন না! বুলাকে কেন্দ্র ক’রে তোমার মনে একই ধরনের চিন্তার উদয় হওয়া অন্যায় সুদীপ্ত। খুবই অন্যায়। অন্যায় বৈ কি। গতকাল থেকে বাঙালি বাঙালিকে কম সাহায্য করেছে! ফিরোজের চাচারা সংখ্যায় ক’জন? বোধ হয়, শতকরা একজন হতে পারে। এবং তাঁরা হয়ত দুর্ভাগ্যক্রমে ওই একের কবলেই পড়েছিলেন। তার জন্য সমগ্র জাতিকে অপবাদ সইতে হবে?

এক মীরজাফরের জন্য সমগ্র বাঙালীকে যুগে যুগে অপবাদ সইতে হচ্ছে না?

নন্‌সেন্স। মীরজাফর আবার বাঙালি কবে ছিলেন? ওই যে, মীরপুর-মোহাম্মদপুরে অবাঙালিরা আছে না! ওরা তো প্রায় পাইকারী হারে আজ পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে হাত মিলিয়ে বাংলার দুর্দশা ঘটাচ্ছে। সেজন্য ইতিহাসের কাঠগড়ায় আসামী হতে হবে বাঙালি জাতিকে? না, তা হবে কেন। এবং এও ঠিক যে, ওই জন্য সকল অবাঙালিকেই বেঈমান বিশ্বাসঘাতক বলারও কোনো যুক্তি নেই। তার মাও তো অবাঙালি ছিলেন। আহ, ভারত ছেড়ে আসার ছ’মাসের মধ্যেই তিনি জান্নাতবাসিনী হলেন। ঐ শোকটা সুদীপ্তর ভুলতে অনেক সময় লেগেছিল। সুফিয়ার শোক ভুলতে না পেরে মা সব সময় কেমন যেন হয়ে থাকতেন। সেই শোকেই তো মারা পড়লেন এত তাড়াতাড়ি। বড়ো ভাই বদলি হয়ে গেছেন রাজশাহীতে। সেখানে কেমন আছেন কে জানে। এখনো তো কোনো খারাপ খবর পাওয়া যায়নি। তবে সবচেয়ে নিরাপদে আছে ছোট ভাই প্রদীপ্ত হাসান। প্রদীপ্ত ভারত থেকে আসেনি। ভালো করেছে। অথচ এই কদিন আগেও নক্সালপন্থীদের খবরে সুদীপ্তর মনে হয়েছিল, প্রদীপ্ত এখানে চলে এলে ওই সব হাঙ্গামা থেকে বাঁচত। কি জানি কখন কি দুর্বিপাকে পড়তে হয়। হিংসার রাজনীতিতে ভারত এখন কলুষিত। এখন ওখান থেকে সরে আসাই তো ভালো। কিন্তু কেন যে প্রদীপ্তটা আসে না? সুদীপ্ত ভাবতেন। ভাবতেন সামান্য কদিন আগেও। কিন্তু এখন? সুদীপ্তর আজ মনে হচ্ছে, নক্সালপন্থীরা পাকিস্তানিদের তুলনায় ফেরেশতা।

বুলা যাওয়ার সময় পূর্ব দিকের জানালাটিও বন্ধ ক’রে দিয়ে গেছেন। অযৌক্তিক কিছু করেন নি। পথের দিকের জানলা খুলে রাখা যায় না। এখন একটি কেবল দক্ষিণের জানালা খোলা। তাতে বাতাসের সমাগম বিশেষ হচ্ছে না। ঘরে সুতীব্র গরম। ছেলেমেয়েদের গরম সহ্য করার অভ্যাস নেই। তারা কষ্ট পাচ্ছে খুব। কিন্তু সেই পরিমাণে জ্বালাচ্ছে না। ছেলেরাও যেন এক রকম ক’রে টের পেয়ে গেছে, এ অবস্থায় কান্নার ফলে ঘোরতর বিপদ হতে পারে।

ক্রমে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল। ঠাঁই বসে থাকতে থাকতেই এল সন্ধ্যা। তাতে অবস্থার পরিবর্তন কেবল এইটুকু হল যে ঘরের স্বল্পশক্তিসম্পন্ন বিজলি বাতির আলো আরো স্পষ্ট ও তীক্ষ্ণ হল। দিনের ভীরুতা কেটে সে যেন রজনীর স্বচ্ছন্দচারিণী নায়িকা হয়ে উঠল। দেয়ালের একটি কালো দাগে দুচোখ নিবন্ধ। ক’রে সুদীপ্ত সেটাকে একটা বাঘের মুখবয়ব দান করতে চেষ্টা করলেন। দুরন্ত বাঘের প্রবল প্রাণকে আর বিপুল অরণ্যকে সেই মুহূর্তে মনে মনে তিনি প্রার্থনা করছিলেন। কিন্তু আমিনার অসুবিধা হচ্ছিল চরম। নিভৃত আত্মসংলাপ, ধ্যান কল্পনা—এ সবের কোনটাতেই অভ্যস্ত নন তিনি। কাজে ও কথায় সময় কাটানো তাঁর অভ্যাস। আর অভ্যাস আছে সামান্য তাস খেলার। এমনি ক’রে বসে থাকা, স্বামীর সম্মুখে হলেও, তাঁর পক্ষে অত্যন্ত কঠিন কর্ম। বুলাও যে আসে না ছাই। তিনি কি ভেতরে যেতে পারেন না। কিন্তু বুলা ডাকলেন না যে। শুধু ডাকলেন না তাই নয়, যাবার সময় মেয়ে বলে গেলেন—

‘আচ্ছা দিদি, আপনারা এখন বসুন। আমি খানিক পরে আসছি।’

এরপর এমনি বসে না থেকে উপায়? বসেই আছেন তারা। কিন্তু ছেলেমেয়েরা ইতিমধ্যেই অবস্থাটাকে যেন সহজ ক’রে নিয়েছে। আর পকেট থেকে রুমাল নিয়ে তিনজনে কী-একটা খেলা শুরু ক’রে দিয়েছে তারা।

কিন্তু বুলার ব্যাপারটা কি? এমনি ক’রে বসিয়ে রাখবে নাকি! বাড়িতে এক জায়গা না দাও সেটা বুঝি। জায়গা দেবার পর এমনি ঠাঁই বসিয়ে রাখাটা কি ধরনের কাণ্ড! রসিকতা?

হাঁ রসিকতাই। তবু রসিকতাও নয়। এখন কি রসিকতার সময়? অন্য সময় হলে রসিকতা করা যেত। পাশের বাড়ির মাসিমার জামাইকে শ্ৰীমতী বুলা কি ছেড়ে কথা কইতেন? ভগিনীপতি হওয়ার ঠেলা টের পাইয়ে দিতেন পদে পদে। জমিলা খালাকে বুলাও তো খালা ডাকেন। অতএব আমিনা তো সম্পর্কে দিদিই হবেন। অতএব সুদীপ্ত! বুলার রাজ্যে তোমার দশাটা কি হ’তে পারত ভেবে দেখ। কিন্তু সেই দশা সৃষ্টির সময় বুলার কোথায়?

দু দণ্ড কথা বলার সময়ও বুলার ছিল না। দেশের এই দুঃসময়ে এখন কি একটি মুহূর্তও বাজে কাজে ব্যয় করার সময় আছে? অবশ্যই সময় ও কথার বাজে খরচকে পুরোমাত্রায় পাপ মনে করার মতো পিউরিটান বুলা নন। মার্কস্‌বাদ-লেনিনবাদে দীক্ষা নেয়ার পরও এখনও তাই গল্প-কবিতার বই পড়ার এবং আড্ডা দেওয়ার জন্য সময়ের অভাব তার হয় না। কিন্তু সে কথা শান্তির সময়ে চলে। এখন জরুরি অবস্থায় সব কথা অচল। এখন শুধু ঐ কথাটা সত্যি–ঐ যে মোক্ষম কথাটা বুলা শুনিয়েছেন—আমরা কেউ এখন নিজের ইচ্ছা-অনিচ্ছার উপর চলছি নে। অবস্থা আমাদের চালাচ্ছে। তবু অবস্থাকে আয়ত্তে আনার জন্যই তো চলছে যতো দুর্মর সাধনা। তাই সময় নেই। কিংকর্তব্যবিমুঢ়তা কাটিয়ে এখনি তো রুখে দাঁড়ানোর সময়। কিন্তু বুলার কোনো পরিচয়ই যে সুদীপ্তর জানা নেই।

সাতটা বাজতেই বুলা ভাত-তরকারি নিয়ে হাজির হলেন। স্নেহমমতাময়ী একজন বঙ্গ ললনা।–

‘অধ্যাপক সাহেবকে একটু কষ্ট করতে হবে। এই অসময়ে চারটে খেয়ে নিতে হবে।’

‘খেয়ে নিতে আর কষ্ট কি? আনন্দের সাথেই খাব।’

‘আনন্দ আপনার কাছে খুব সস্তা মনে হচ্ছে। আমি কিন্তু সত্যিই আপনাদের কষ্ট দিয়ে খাওয়াব। এই দেখুন, তরকারি কিছু নেই।’

তবু খেতে কোনো কষ্ট হল না সুদীপ্তর। ডাল আর সামান্য বেগুনের সাথে মাগুর মাছের একটা টুকরো। কিন্তু টুকরো এত ছোট করা সম্ভব? আঙুল কেটে যায়নি? না কাটেনি। তবে কাটতে পারতো। এবং কাটলেও কিছু করার ছিল না। বুলার তো দোষ নেই। সেই পঁচিশ তারিখের সকালে কেনা হয়েছিল দশটা মাগুর। আজকে আটাশ না, বেশিদিন হয়নি। এবং মাগুরগুলো বেশ বড়ো সাইজেরই ছিল। কিন্তু কাল থেকে খাচ্ছে কতো লোক? সুদীপ্ত সেটা জানেন না। বাইরে যে ঘরটাতে তারা আছেন, সেখানে থেকে এ বাড়িতে মানুষের সংখ্যাটিকে নির্ণয় করা যাবে না। কোনো শব্দ নেই। অথচ বাটির অভ্যন্তরে এখন বাস করছেন তেত্রিশ জন। গতকাল এসেছিলেন আঠারো জন। তার মধ্যে বারো জন আজ চলে গেছেন। এবং এসেছেন তার দ্বিগুণ, চব্বিশ জন আর বুলারা তিনজন। তার উপরে সুদীপ্তরা পাঁচজন। এই সুদীপ্তদের নিয়েই যতো সমস্যা হয়েছে বুলার। সমস্যা হয়েছে বাচ্চা তিনটিকে নিয়ে। তাদের জন্য দুধ চাই। তা গুঁড়ো দুধের টিন প্রায় ভরতিই আছে। কিন্তু চিনি আছে অতি সামান্য। দুবেলা কম ক’রে হলেও অমন তিরিশ-চল্লিশ কাপ চা হচ্ছে। তাতে কতো চিনি লাগে? বাচ্চাদের চিনি না হলে চলে? তাছাড়া, অমন, দুধের ছেলেরা—দুধের সঙ্গে পাকা কলা দিতে না পারলে বড়োদের কখনো তৃপ্তি হয়? ছেলে-মেয়েদের সামনে শুধু দুধ এনে ধরতে বুলার খারাপ লেগেছিল। কিন্তু এলা তাঁকে বাঁচিয়েছে। এলা ভাত খেতে চেয়েছে। বুলা শুনেছেন–এলা যেন বলেছে, অত কি দরকার মাসি। শুধু ডাল-ভাত দাও না। আমরা ডাল-ভাত খেয়ে থাকব।