নবম পরিচ্ছেদ
বলাকা সিনেমার কাছে বাটার জুতোর দোকানের সামনে বারান্দায় লোকটাকে সুদীপ্ত দেখতে পেলেন। হাঁ, একটি মাত্র লোক। তবু একটি মানুষ তো। আহ্, একটি মানুষের দেখা পাওয়া গেল। সেই নীলক্ষেত আবাসিক এলাকার রেলগেটের কাছে ভক্সওয়াগণের ভদ্রলোকটিকে দেখেছিলেন—অতঃপর দেখলেন এই বলাকা বিল্ডিংয়ের বারান্দায় একটি অভদ্র লোককে। মানুষ এমনি অভদ্র হয় নাকি! খোঁচা খোঁচা গোঁফ দাড়িতে সারা মুখমণ্ডল ভরতি। বোধ হয় চার পাঁচ দিন ওতে খুর পড়ে নি। রুক্ষ চুল। ময়লা শার্ট। ফুল প্যান্টের কোনো শ্রী নেই। জুতো নোংরা সুদীপ্তকে দেখেই লোকটা খেঁকিয়ে উঠল–
‘এই উল্লু, কেতনা বাজতা হ্যায়?’
লোকটা উর্দু ভাষী বলে নিজেকে জাহির করতে চাইল। কিন্তু তার উচ্চারণেই ধরা পড়ল, সে বাঙালি। সহসা কথাটা সুদীপ্তর মনে পড়ল। এই সময় নিজেকে অবাঙালি বলে প্রমাণ করতে পারলে ভারি সুবিধে। গতকাল থেকে বহু বঙ্গ-সন্তানই উর্দু ভাষা রপ্ত করতে লেগেছে। এবং সেই সঙ্গে ঘৃণা। উর্দুকে এতো ঘৃণা বাঙালিরা আর কখনো ক’রে নি। তারা বাংলা চেয়েছে, কিন্তু মনে কোনো উর্দু বিদ্বেষ পোষণ ক’রে নি। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের সময় সুদীপ্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। তখন উর্দুকে বয়কট করার একটা প্রবণতা ছিল, কিন্তু এমন ঘৃণা ছিল কোথায়। আজ তারা, বাঙালিরা পথে বেরিয়ে উর্দু বলে। অন্তত বলতে চেষ্টা করে। কিন্তু সেই সাথে ঘৃণাও করে—বিজাতীয় ঘৃণা। একেবারেই পছন্দ নয় এমন মেয়ের সাথেও মানুষের বিয়ে হয়। অন্য দেশে হয় কিনা জানা নেই—আমাদের দেশে তো হয়। অবস্থার ঠেলায় পড়ে এমন অবাঞ্ছিত মেয়ের সাথেও যদি ঘর করতে হয়? তাকে ভালোবাসার কোন প্রশ্ন ওঠে নাকি। না। বরং ঠিক উল্টোটি হয়। তালাক দিতে পারলে তবু যা। হোক সহানুভূতিটা থাকে—প্রীতি না থাক, শুভেচ্ছার অভাব হয়ত হয় না। অন্যথায় সারা জীবন ঘৃণা ক’রে যেতে হয় সে মেয়েকে। বাঙালির ভাগ্যে এমনি অপছন্দ অবাঞ্ছিত স্ত্রীর মতো উর্দুর উদয় হয়েছে নাকি?
অন্ততঃ সুদীপ্তর সামনে একজন অভদ্র লোকের উদয় যে হয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। এই উল্লু—কোনো অপরিচিত ভদ্রলোককে সম্বোধনের ভাষা এইটে নাকি?
‘উল্লু? কাকে উল্লু বলছ তুমি।’
‘তুমি উল্লু হ্যায়। সারা বাঙালি আদিম সব বিলকুল উল্লু হ্যায়।’
বলতে বলতে হো হো ক’রে হেসে উঠল সেই অপরিচিত অভদ্র মানুষটি। সহসা সুদীপ্ত যেন মনে করতে পারলেন, লোকটিকে তিনি চেনেন। ইনি সেই প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী আবদুল্লা মনসুর না? ঠিক তাই। আবদুল্লাহ মনসুর —ওরফে আমন। আমনকে তিনি চেনেন। না চিনে উপায় কি? পশ্চিম পাকিস্তান কিভাবে বাঙলাকে শোষণ ক’রে যাচ্ছে সে কাহিনীকে ছবিতে এঁকে ইদানীং শহরে বিপুল সাড়া জাগিয়েছেন চিত্রশিল্পী আমন। আমনের আঁকা বঙ্গ-জননীর একখানি তৈলচিত্র পাঁচ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে এই তো কয়েক দিন মাত্র আগে। সেই আমন এখানে? এমন বেশে? সুদীপ্ত বললেন–
‘আপনি এখানে কি করছেন?’
‘তুমি উল্লু এখানে কিয়া করতা হ্যায়? জানতা নেহি যে বারো বাজে তো ফের কারফিউ হো যায়ে গা।’
বারো বাজলে আবার কারফিউ শুরু হবে? কে বললে? সে জন্যই লোক নেই নাকি! বারো বাজতে বেশি দেরিও তো নেই। তা হলে উপায়? উপায় অতি দ্রুত হেঁটে চলে যাওয়া। হয়তো বাসায় পৌঁছানো যেতেও পারে। কিন্তু ইনি?
‘আপনি যাবেন না বাসায়?’
‘নেহি। হাম গোলি ক’রে গা, গোলি খায়ে গা।’
মানে? গুলি খাবেন? খাদ্য হিসেবে গুলিটা কেমন বস্তু সে কৌতূহল একজন শিল্পীর থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। তা হলেও সহসা গুলি খেতে চাওয়াটা কি স্বাভাবিক কর্ম? আর গুলি যে করবেন সেটা কি দিয়ে?
কয়েকটি জিজ্ঞাসা নিয়ে অধ্যাপক তাকালেন শিল্পীর দিকে। শিল্পীর হাতে আধখানা ভাঙা ইট ছিল।
শিল্পী আবদুল্লাহ মনসুর পঁচিশে মার্চের দিবাগত রাত্রে বাসায় একা ছিলেন। আজকাল মাঝে মাঝে এমন একা থাকতে তিনি ভালোবাসতেন। একা একা অনেক রাত জেগে বেশ কাজ করা যায়। শুধু কাজ? কলহ নেই? কলহ তাদের সুদীর্ঘ দাম্পত্য জীবনে ছিল বৈ কি। তবে ততটুকু ছিল যতটুকু সংসারের জন্য স্বাস্থ্যপ্রদ। এবং কলহ ক’রে স্ত্রী কোনোদিন বাপের বাড়ি যাননি। সেদিন গিয়েছিলেন ছোট বোনের বাড়ি। রাতে বোন আর তাকে ফিরতে দেয় নি। ব্যবসায়ী ভগ্নিপতি ব্যবসা উপলক্ষে গিয়েছিলেন চট্টগ্রাম। অতএব বোনের কাছে বোনেকে থাকতে হয়েছিল। আত্মীয় স্বজনের মধ্যে এমনটি তো হতেই পারে। পূর্বেও হয়েছে। এক ছেলে এবং এক মেয়ে নিয়ে আমনের স্ত্রী বোনের কাছে থেকে গিয়েছিলেন। আমন বলেছিলেন—
‘আমি কিন্তু ফিরে যাব। ছবিটা আজ শেষ করার কথা।’
একটা ছবি আজ তিনি শেষ করবেন। অতএব বাসায় ফিরছিলেন। এবং ফেরার সময় তার ছেলে-মেয়েদের আদর করেছিলেন। ছোট মেয়েকে কোলে নিয়ে চুমু দিয়ে বলেছিলেন–
‘মা মণি, এখন তবে যাই। কাল সকালে এসে তোমাকে নিয়ে যাব। কেমন।’
‘আব্বু, খালা?’
হাঁ, ঠিক বলেছ তো আম্মু, এবার তোমার খালাকেই নিয়ে যেতে হবে। তোমার মা পুরোনো হয়ে গেছে। অতঃপর আমন তাঁর ছোট শ্যালিকার পানে তাকিয়ে বলেছিলেন–
‘দেখলি রোজি, আমার মেয়ে কিন্তু তার মাকে চায় না। তার জায়গায় চায় তোকে?’
এমনি খানিক হাস্য-পরিহাসের মধ্য দিয়ে বিদায় নিয়েছিলেন চিত্রশিল্পী আমন। কত রাত হবে তখন? না, খুব বেশি রাত হয় নি। কাজের তাড়া ছিল ব’লে নটার মধ্যেই তিনি বাসায় ফিরেছিলেন। এবং ফেরার সময় সহসা ঢাকা শহরকে বড়ো বেশি নির্জন মনে হয়েছিল সেদিন। মাত্র নটার মধ্যেই শহর এমন ঝিমিয়ে পড়ে নাকি? আগে কখনো এমন দেখেননি তো। শিল্পী আমনের বুকে নিঃঝুম ঢাকা শহরের একটি ছবি গাঁথা হয়ে গেল। এই নিঃঝুমতা কি ক্লান্তির? ঢাকা নগরী এমনি স্থবির হয়ে গেছে? নাকি অন্য কিছু। এ যদি ঝড়ের পূর্বাভাস হয়। ভাবতে ভাবতেই আমন ঘরে ফিরেছিলেন।
ছবি নিয়ে একান্তভাবে মগ্ন ছিলেন। বাইরের ছোট-খাট শব্দ সহসা পাবার কথা নয়। অতএব সন্দেহ নেই যে, শব্দটা বেশ বৃহৎ আকারের ছিল। একটা প্রবল শব্দে আমনের হাতের তুলি কেঁপে উঠল। পরে পরেই আর একটা শব্দ, তার সঙ্গেই আর একটা—এমনি চলতেই থাকল। প্রচণ্ড শব্দের আর গর্জনের বিরাম নেই। আর শব্দ কি এক রকমের? শব্দের যে এতো বৈচিত্র্য থাকে তা কি আমন কখনো জানতেন। শব্দকে তুলি দিয়ে আঁকা যায় না?—চিত্রশিল্পীর মনে একটা অদ্ভুত প্রশ্ন সৃষ্টি হল। তিনি বাইরে এসে বারান্দায় দাঁড়ালেন। এ কি! আগুন যে। সারা ঢাকা শহরই জ্বলছে নাকি? চারপাশে আগুন, ধোঁয়া আর গন্ধ। বারুদের গন্ধ। কী শুরু হল ঢাকা শহরে? যুদ্ধ? যুদ্ধ কেমন ক’রে হয়। আমনের জানা নেই। রণাঙ্গনের দৃশ্য তিনি দেখেননি। ধোঁয়া, আগুন, বারুদের গন্ধ, বিচিত্র বিকট শব্দ সবটা মিলিয়ে যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে এরি নাম যুদ্ধ? কিন্তু কার সঙ্গে যুদ্ধ? কারা যুদ্ধ করছে? আমন কিছুই ভাবতে পারলেন না। ভাবনারা ভয়ে মূক হয়ে গেছে। তাকিয়ে বুঝলেন, আগুনের শিখাটা নীলক্ষেতের দিকেই বেশি। সারা নীলক্ষেত জুড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়—বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি হল, কলাভবন ও শিক্ষকদের আবাসিক এলাকা। ওই সবই ওরা জ্বালিয়ে দিয়েছে নাকি! প্রচণ্ড শব্দগুলিও বেশির ভাগ আসছে ঐ দিক থেকেই। তা হলে কি ছাত্রদের সঙ্গে সামরিক বাহিনীর যুদ্ধ বেধে গেছে? তা কি ক’রে হবে। অবশ্য কয়েক দিন থেকেই শহরে সংগ্রামের কথা চলছিল—আমাদের সংগ্রাম, চলবেই চলবে—বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর ইত্যাদি শ্লোগান দিয়ে দিয়ে মিছিল চলছিল শহরে। কিন্তু সবাই তারা ছাত্র তা তো নয়। সব স্তরের মানুষই তাদের মনের অনুভূতিকে ব্যক্ত করতে চাইছিল ঐ সব মিছিলে শ্লোগান দিয়ে। কিন্তু সত্যিই তারা কি অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিল? কৈ, তিনি তো জানতেন না। তবে তিনি না জানলেই তা মিথ্যা হবে? সত্য হওয়াই তো ভালো। আহা, কথাটা সত্য হোক। বাঙালির গোপন প্রস্তুতি সত্য হোক, তার অস্ত্র ধারণ সত্য হোক। বীর বিক্রমে বাঙালি যুদ্ধ করছে পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর সাথে—কল্পনাটা শিল্পী আমনের মধ্যে খুব উজ্জ্বল সুখের অনুভূতি এনে দিল। বাঙালি গোপনে এত অস্ত্র জমিয়েছিল? এতো অস্ত্রের ব্যবহার শিখেছিল? নিশ্চয়ই নীলক্ষেত এলাকায় ছাত্রদের সঙ্গে পাকিস্তানি সৈন্যদের যুদ্ধ চলছে। নাকি পাকিস্তানিরাই এক তরফা ছুঁড়ছে এতো গুলি-গোলা। হাঁ পাকিস্তানিরা তা পারে। সেরেফ না-কে হাঁ করতে পাকিস্তানের জুড়ি মেলা ভার। অকারণেই অতিরিক্ত পরিমাণে গুলি-গোলা ছুঁড়ে তারা প্রমাণ করবে—ছাত্রদের সাথে লড়াই হয়েছে আমাদের এবং ছাত্র-শিক্ষক যা আমরা মেরেছি তা ঐ লড়াইয়ের মধ্যে। হায় হায়, কী ধূর্ত ওই হারামজাদা! আমাদের নিরস্ত্র ছাত্র-শিক্ষকদের ওরা মারবে, তারপর বলবে-ওরা মরেছে আমাদের সাথে লড়াই করতে এসে। ওগো আল্লাহ তবে সেইটেই সত্য হোক। আমার ছাত্রবন্ধুরা লড়াই ক’রে মেরে তারপর যেন ম’রে। আমাদের অধ্যাপকরা এক-একটি দুর্জয় সেনাপতি হতে পারেন যেন। শিল্পী আমনের সারা বুক ভরে প্রার্থনা উচ্চারিত হ’ল। সব কথার শেষ কথা বাংলাদেশের স্বাধীনতা।
উহ্ কী প্রচণ্ড বুক-কাঁপানো গোলার আওয়াজ। এক মুহূর্তও যদি গুলি গোলার বিরাম থাকে। শ্রাবণের বৃষ্টিধারাও তবু মাঝে মাঝে মন্থর হয়ে আসে, কিন্তু গোলাবৃষ্টির যে ক্ষান্তি নেই। হায় হায়, সব ধ্বংস হয়ে গেল।
কিন্তু এতো ধ্বংসের পর স্বাধীনতা যদি আসে। অবশ্যই যেন আসে। আমাদের ছেলেমেয়েরা স্বাধীন দেশের নাগরিক হবে। বিশ্বের সর্বত্র বুক ফুলিয়ে বলবে, আমরা জনগণতান্ত্রিক বাংলাদেশের মানুষ। আমরা বাঙালি। আমনের বুক ভরে ফুটল একটি কথার সূর্যমুখী—আমরা বাঙালি। স্বাধীনতা-সূর্যের দিকে উন্মুখ একটি ফুলের নাম আমরা বাঙালি। আমন অস্থিরভাবে পায়চারী শুরু করলেন তার ঘরের মেঝেয়। চীৎকার ক’রে গেয়ে উঠলেন— মুক্ত বেণীর গঙ্গা যেথায় মুক্তি বিতরে রঙ্গে/আমরা বাঙালি বাস করি সেই তীর্থ বরদ বঙ্গে/বাম হাতে যার কমলার ফুল ডাহিনে মধুর মালা—-। না না না। এ কবিতা পড়ার অধিকার আমার নেই। তোমার বাম হাত ও ডান হাত আজ একই অঙ্গে তো নেই মা। তোমার অধম সন্তানেরা তাকে কেটে দুটুকরো করেছে মা গো, এ পাপ ক্ষমা কর।
অস্থিরতায় অনুশোচনায় বিনিদ্র রজনী পোহাল। শুক্রবারও সারাদিন অবিশ্রান্তভাবে চারপাশ জুড়ে গোলা-গুলির আওয়াজ শোনা যেতে লাগল। আমনের বাসা একটা কানাগলির মধ্যে দু’তালায়। সেখান থেকে বড়ো সদর রাস্তাটা দেখা যায় না। অতএব রাস্তায় বেরুনো যায় কিনা বুঝা গেল না। কিন্তু সকাল হতেই রাস্তায় বের হওয়ার জন্য আমন ছটফট করতে লাগলেন। কোন মতেই বের হওয়া যায় না? ওরা দুটি মাত্র স্ত্রীলোক একা বাড়িতে ভয় পাচ্ছেন না? মনের মধ্যে নানা প্রশ্ন, নানা আশঙ্কা। গুলির শব্দে মা মণি হয়ত ভয় পাচ্ছে, এবং কাঁদছে। সৈনিকরা আবার বাড়ি ঢুকবে না তো! নাহ ঐ আশঙ্কার কোনো মানে হয় না। কৈ, ভদ্রলোকের বাড়ি ঢুকে ওরা অত্যাচার করেছে, এমন তো কখনো শোনা যায়নি। তা ছাড়া, রোজির সেই ভাগনেটিও হয়ত বাসায় ফিরে থাকবে! আওয়ামী লিগের স্বেচ্ছাসেবক হয়ে রাতে পাড়া পাহারা দিতে যায়, ফেরে একেবারে শেষ রাতে। আজ নিশ্চয়ই আগেই ফিরে থাকবে। কিন্তু না ফিরে থাকে যদি। ওরা দুবোন ভয়েই মারা পড়বে হয়তো। তিনি যদি এখন কাছে থাকতেন! কিন্তু কি ভাবে থাকবেন? পথে বেরুনো যায়?
বেলা দশটার দিকে আমন জানলেন পথে বেরুনো যাবে না। রেডিওতে সামরিক কর্তৃপক্ষের কয়েকটি আদেশ শুনলেন। জানলেন, সারা শহরে এখন কারফিউ। এখন পথে বেরুলেই সৈন্যরা গুলি করবে। গুলি তো বেরাদরগণ সারা রাতই করেছ, কিন্তু কারফিউয়ের কথা বলছ এখন? এই বেলা দশটায়? কৈ সারারাত একবারও শোনা যায় নি যে, কারফিউ দেওয়া হয়েছে। কে জানে হয়ত রাত দুটোর সময় রেডিওতে কারফিউয়ের কথা প্রচারিত হয়েছল। দুটোর সময় কেউ রেডিও খোলে না। তাতে কি। আইন তো বাঁচানো গেল। বাঙালিকেও বুদ্ধ বানানো গেল।
বাঙালিকে বুদ্ধ বানিয়ে ইয়াহিয়া কাল রাতে ফিরে গেছে। ইয়াহিয়া এসেছিল আলোচনা করতে। কিসের আলোচনা? কেন, ক্ষমতা হস্তান্তরের, ক্ষমতার রুটি নিয়ে তোমরা কাড়াকাড়ি করছিলে না? তোমরা মানে পূর্ব বাংলা ও পশ্চিম পাকিস্তান। অতএব মাঝখানে কোনো বাঁদরকে আসতেই হয়। এবং বাঁদরের স্বভাব অনুসারে ক্ষমতার রুটি নিজের গালেই পুরতে হয়। ইয়াহিয়া কি অযৌক্তিক কিছু করেছে?
কার সাধ্যি, সে কথা বলুক দেখি। সামরিক আইনে চৌদ্দ বছর জেল—মিনিমাম পানিশমেন্ট লঘু শাস্তি। কি কি অপরাধে এই লঘুশাস্তি দেওয়া হবে তার বিবরণ এখন রেডিওতে প্রচারিত হচ্ছে। তোমরা শোন এবং পালন কর। কথা বল না। না, কারো কোন কথা বলার অধিকার নেই। রাজনীতিবিদ, অধ্যাপক, শিল্পী-সাহিত্যিক, সাংবাদিক, আইনজীবী, বুদ্ধিজীবী—কেউ না। তোমরা সব বিলকুল বুদ্ধ আছ। এবং বে-আদব। প্রেসিডেন্ট এসে প্রায় দু সপ্তাহ থেকে গেলেন ঢাকায়। বে-আদবীর চূড়ান্ত করেছে তখন। মনে নেই? প্রেসিডেন্ট আসল শহরে। আর সেই শহরে তোমরা মিছিল বের করেছ।
মিছিল কি অপরাধ? মিছিল মানে জানো? নিজেদের কোনো দাবীর কথা জানাতেই মানুষ মিছিল করে। দেশের মানুষ তাদের প্রেসিডেন্টের কাছে নিজেদের দাবীর কথা জানাবে না?
দাবী? কিসের দাবী? হুজুরের কাছে নিবেদন পর্যন্ত চলতে পারে। সে জন্য দরখাস্ত পেশ কর। মিছিল ক’রে শ্লোগান দিয়ে বেড়ানো কেন?
কারণ ঐটেই আধুনিক গণতন্ত্রসম্মত পন্থা।
তোমাদের ঐ সব কেতাবীগণতন্ত্র মাগরেবী মুল্লুকে চলতে পারে। আমাদের পাক-মুলুকে তা অচল।
তোমাদের মধ্য যুগীয় আবেদন-নিবেদন আমাদের বাংলাদেশে অচল। আমরা কোনো হুজুরে বিশ্বাস করিনে। এবং সেই কারণেই দেখতে পাচ্ছ। তোমাদের সঙ্গে আমাদের মিল হবে না। তোমরা তোমরা, আমরা আমরা।
নেহি। মুসলিম সব ভাই ভাই। কখনো তোমাদেরকে আমরা পৃথক হতে দিতে পারিনে। আমরা মুসলমান।
আমরা বাঙালি, তোমরা পাঞ্জাবী-পাঠান-সিন্ধী-বালুচ। তোমরা আমরা পৃথক হয়েই আছি।
বটে? তা হ’লে তোমাদের জন্য এই রইল কামান-মেশিনগান-রাইফেল।
শুক্রবার সারাদিন চলল কামান-মেশিনগান-রাইফেলের বিচিত্র কারবার। আবার রাত এল। সেই রাতেও মাঝে মাঝে শোনা যেতে লাগল গুলির আওয়াজ। আমন সারা রাত একা ঘরে তার ছেলে-মেয়ের জন্য কেবলি ছটফট করলেন। পরদিন শনিবার অর্থাৎ গতকাল বেলা দশটার দিকে কারফিউ ওঠে গেলে পথে লোক বেরুল। আমনও বের হলেন। সেই গতকালের বেলা দশটা থেকে আজ রবিবারের বেলা প্রায় বারটা—প্রায় ছাব্বিশ ঘণ্টা। এই ছাব্বিশ ঘণ্টার হিসাব আর আমন জানেন না। সেই যে বাসা থেকে পথে বেরিয়েছেন আর ঘরে ঢুকেন নি। কেন, রোজিদের, ঘরে? রোজিদের ঘরে তার স্ত্রী ও পুত্র-কন্যারা ছিলেন সেখানে তিনি যান নি? হাঁ গিয়েছিলেন। কিন্তু ঘরে নয়। তাকে ঘর বলে না। অবাধে পথের কুকুরটাও তখন সেখানে প্রবেশ করতে পারে। যেখানে কুকুর-শেয়ালেরও অবাধ যাতায়াত থাকে তাকে ঘর বলে নাকি। রোজিদের ঘর খোলাই পড়ে ছিল। খোলা শুধু নয়, ভাঙা দরজার কপাট ভেঙ্গে দুর্বৃত্তরা ঢুকেছিল। তারপর? আমন গিয়ে দেখলেন, কেউ নেই। ডাকলেন—রোজি। সাড়া নেই। স্ত্রীকে ডাকলেন পলি। পলিও নেই নাকি। ছেলে-মেয়েরা? শোবার ঘরে গিয়ে দেখলেন, মেঝের উপর দুটি ভাইবোন পড়ে আছে পাশাপাশি। রক্তে ভিজে গেছে অনেকখানি মেঝে। রবিবার সকালে দেখা গেল দুটি ছেলে-মেয়েকে বুকে জড়িয়ে মেঝের উপর পড়ে আছেন চিত্রশিল্পী আমন। সারাক্ষণই এমনি পড়ে ছিলেন? না। যতক্ষণ ক্ষমতা ছিল বিলাপ করেছেন। চীৎকার ক’রে কেঁদেছেন। এমন কচি শিশুদের যারা মারতে পারে তাদের জন্য আল্লাহর অভিশাপ প্রার্থনা করেছেন। তাদের উপর গজব নাজিল কর খোদা, এখনি তোমার গজব নাজিল কর। স্ত্রীর কথা মনে হয়েছে—চীৎকার ক’রে কতবার ডেকেছেন স্ত্রীকে। রোজিকে ডেকেছেন। যেন ডাকলেই এখনি ওরা এসে দেখা দেবে। রোজির কলেজে পড়া ভাগনেটিকেও পাওয়া গেল। বাঁচবার জন্য ঘরে ফিরেছিল বারোটার দিকে। এবং তার ফলে বাঁচতে পেরেছিল মাত্র ঘণ্টা পাঁচেক। ভোর পাঁচটার দিকে পাক-হানাদার বাহিনীর গুলিতে সে নিহত হয়। পাশের ঘরে তার লাশ পাওয়া গেল কিন্তু পালি ও রোজি। কোথাও নেই। আর নেই সেলাইয়ের কল, ট্রানজিসটার, টি. ভি. সেট এবং হয়ত আরো কিছু যা আমন জানেন না। মূল্যবান গয়না-পত্র টাকা-কড়ি কোথায় থাকত সেটা, শ্যালিকার বাড়ি হলেও আমনের জানার কথা নয়। তিনি কেবল দেখলেন আইরন-সেফ খোলা। ভেতরটা শূন্য।
আমনের পাঁচ বছরের ছেলের বুকে গুলির চিহ্ন দুটি, তিন বছরের মেয়ের বুকে একটি এবং রোজির ভাগনেটির গায়ে গুলির দাগ ছিল তিনটি—দুটি বুকে একটি পাঁজরে। যুবক ও শিশুদের মেরে যুবতীদের ধরে নিয়ে গেছে। আর লুটপাট ক’রে নিয়ে গেছে যা নেওয়া যায়। কাঠের আসবাবপত্র নেওয়া যায় না। সেইগুলি পড়ে আছে।
সর্বত্রই হানাদারদের কার্যক্রমের মধ্যে এই একটা মিল ছিল ভারি সুন্দর। যা পার লুটে পুটে নাও, যুবতীদের হরণ কর, অন্যদের হত্যা কর। না, সব ঘরেই তারা ঢেকে নি। কিন্তু যেখানেই ঢুকেছে এই কার্যধারায় কোন ব্যতিক্রম ঘটে নি। ব্যতিক্রম শুধু ঘটেছিল সুদীপ্তর ঘরে। সেখানে হরণের জন্য নারী পায় নি, লুটপাটের যোগ্য কোনো বস্তুও পায় নি। কেননা যেদিকে তারা তাকিয়েছিল শুধু দেখেছিল বই। আর বই। ধুত্তোর বই। বই নিয়ে হবেটা কি শুনি। কাগজের বুকে হিবিজিবি আঁক কাটা যতো সব আবর্জনা। ওই আবর্জনায় হাত দিয়ে পাক-সৈন্যরা না-পাক হতে চায় নি। হাত যেখানে-সেখানেই দেওয়া যায় না কি। হাত দেওয়া যায় রোটি ও রাইফেলে। আর আওরাতের গায়ে। দুনিয়ার সেরা চিজ আওরাত, আওর রাইফেল। রোটি খেয়ে গায়ের তাকাত বাড়াও, রাইফেল ধরে প্রতিপক্ষকে খতম কর, তারপর আওরাত নিয়ে ফূর্তি কর। ব্যাহ, এহি জিন্দেগী হ্যায়। এই তো জীবন। জীবন সম্পর্কে এই ধারণায় আমনের আস্থা নেই, কোনো বাঙালিরই নেই। আমন যতক্ষণ পারলেন প্রাণপণে প্রচণ্ড আর্ত-হাহাকারকে বহন করলেন। বিলাপ ক’রে করে বেদনাকে ঝেড়ে ফেলতে চাইলেন। মরে যাওয়া পুত্রকন্যাদের বুকে জড়িয়ে কাঁদলেন। অবশেষে এক সময় সংজ্ঞা হারিয়ে সন্তানদের বুকে জড়িয়ে পড়ে রইলেন।
রবিবার সকালে গোপনে কয়েকজন সাংবাদিক সাধারণ মানুষের ছদ্মবেশে শহরের অবস্থা দেখতে বেরিয়েছিলেন। তারাই শিল্পী আমনকে উদ্ধার করেন। অতঃপর হাসপাতাল কিছুক্ষণের মধ্যেই তার সংজ্ঞা ফিরেছে, কিন্তু মনের স্বাভাবিকতা ফেরেনি। এক সময় কখন তিনি হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এসেছেন কেউ তা টের পায় নি। এখন তিনি পথে পথে মাঝে মাঝেই চীৎকর ক’রে উঠছেন—হাম গোলি ক’রে গা, গোলি খায়ে গা।
আমার ছেলে-মেয়েদের গুলি করেছ, আমিও তোমাদের গুলি করব, আমার ছেলে মেয়েরা গুলি খেয়েছে, আমিও গুলি খাব, আমাকেও তোমরা গুলি কর, এ সব কথা কি পাগলের কথা! তবু এখন শিল্পী আমনকে সকলেই পাগল ঠাওরাচ্ছে, এবং এড়িয়ে চলছে।
অবশ্যই আমনের সব ইতিবৃত্ত সুদীপ্ত জানতেন না। কেবল তাঁর মনে হচ্ছিল, সত্যই একটা সাংঘাতিক কিছু ভদ্রলোকের জীবনে ঘটেছে যে কারণে তিনি এমন ভারসাম্য হারিয়েছেন আজ। কী সেটা? যাই হোক, সে নিয়ে কিছু ভাববার সময় এখন নেই। এখন কিছু করতে হয়। কিন্তু কী করা যায়! সঙ্গে ক’রে বাসায় নিয়ে যাওয়া যায়। বাসায় তিনি এখন যেখানে আছেন সেখানে? সেখানে পথের পাগল নিয়ে উঠাবেন? কেন উঠাবেন না। আমনের মতো চিত্রশিল্পী কি কোনো দেশে দলে দলে গজায়? তা ছাড়াও তিনি একজন মানুষ তো। বিপদের সময় মানুষের জন্য তো মানুষকেই এগোতে হয়। সুদীপ্ত আমনের একখানি হাত ধরলেন—
‘আপনি চলুন আমার সাথে। আমি আপনাকে দেব গুলি খেতে।’
‘তোম উল্লু হ্যায়। তোমহারা সাথ মে গুলি নেহি হ্যায়।’
গুলি যাদের সঙ্গে থাকে শহরে তখন তাদের অভাব ছিল না। চারদিকে নল উঁচিয়ে কত গাড়িই তো যাচ্ছে। ঠিক সেই সময়ই একটা যাচ্ছিল পাশের পথ দিয়ে। সহসা আমন সুদীপ্তকে এক ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলেন এবং দুহাত তুলে চীকার ক’রে উঠলেন–
‘হাম গোলি ক’রে গা। গোলি খায়ে গা।’
ফুটপাতের পাশে লোহার রেলিঙের কাছে দৌড়ে গিয়ে আমন তার প্রাণপণ শক্তিতে হাতের আধখানা ইট ছুঁড়ে মারতে চাইলেন। কিন্তু তার আগেই সৈনিকদের গুলি খেয়ে তিনি লুটিয়ে পড়লেন রেলিঙের পাশে। তাঁর হাতের আধখানা ইট ছিটকে পড়ল তারই নাকের কাছে।
সত্য সত্যই ওরা গুলি করল আমনকে? বিকৃত মস্তিষ্ক আমনকে? আমনকে অসুস্থ পাগল বলে চিনতে কি ভুল হবার কথা? পাকিস্তানের বীর সৈনিক অতসব বোঝে না। অতসব বুঝতে গেলে ভালো সৈনিক হওয়া যায় না। সৈনিকের কাজ কোনো কিছু বিচার করা নয়, কেবলি গুলি চালানো। হাঁ, পাকিস্তানিরা গুলি চালাতে জানে। রাইফেল-মেশিনগানের লোহার গুলি, রেডিও-টিভিতে গাঁজা-গুলি। গোটা পাকিস্তানটাই একটা গাঁজা-গুলি। বলাকা বিল্ডিংয়ের বারান্দায় পড়ে থেকেই কথাটা মনে হয়েছিল সুদীপ্তর। ভাগ্যিস আমন তাকে ধাক্কাটা বেশ জোরেই দিয়েছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে একেবারে ধূলিশায়ী হয়েছিলেন এবং সেই জন্যই বোধ হয় পাকিস্তানিরা তাকে দেখতে পায় নি। কিংবা দেখে থাকলেও মৃত ভেবেছিল। সুদীপ্ত কিন্তু সবই দেখলেন। চিত্রশিল্পী আমনের দেহ লুটিয়ে পড়ে আছে—রক্তের ধারা গড়িয়ে যাচ্ছে—পথের উপর।
ওরা মেরে চলে গেছে। সুদীপ্ত উঠে দাঁড়িয়েছেন। আশ্চর্য! একটুও ভয় পাচ্ছেন না তিনি। একদৃষ্টিতে দেখছেন নিস্পন্দ একটা মানবদেহকে। এই দেহ আশ্রয় ক’রে যিনি ছিলেন তিনিই সেই প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী আমন? এই তো ছিলেন। কোথায় গেলেন তবে? তিনি গেছেন সেই জনতার পথে, যারা প্রতিজ্ঞা নিচ্ছে—আমরা এর প্রতিশোধ নেব। সকাল বেলার হাসিম শেখের কথা মনে পড়ল—খোদার কসম, আমার মায়ের কসম, আমাদের রক্তের কসম আমরা এর শোধ নেবই নেব। প্রতিশোধ গ্রহণের দুর্বার শপথ ছড়িয়ে গেল চারপাশের বাতাসে, পথের ধূলোয়, আশে-পাশের প্রতিটি দেওয়ালে, প্রতিটি বাতায়নে, এমন কি আমনের হাতের সেই আধখানা ইটেও। সুদীপ্তর চোখের সামনে সেই ইটের টুকরো হয়ে উঠল আস্ত কামানের গোলা। সে এখন ওঁৎ পেতে শত্রুর মুখ খুঁজছে। যেন বলছে মাগো সন্তানের রক্তে তোমার বুক ভেসেছে, শক্রর রক্তে তোমার পা ধোয়াব। কথাগুলি আমনের। শিল্পী আমনের একটি ছবির নীচে এই শপথ বাক্য খোদিত ছিল–মা গো, সন্তানের রক্তে তোমার বুক ভেসেছে, শক্রর রক্তে তোমার পা ধোয়াব।……
না, ঐ পানে আর চেয়ে থাকা যায় না। এক সময় সুদীপ্ত চঞ্চল হয়ে উঠলেন। মানুষের শব কত আর দেখা যায়। গত বিশ-পঁচিশ দিন ধরে কত রক্ত, কত লাশ তিনি দেখেছেন, কিন্তু কান্না শোনা যায়নি। এই তো এই মার্চেরই মাঝামাঝিতে সেই দিনগুলি! সেদিন গত রাতের কয়েকটি শব এনে ছেলেরা বিশ্ববিদ্যালয়-প্রাঙ্গণের বটতলায় জড়ো করেছিল। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা সেই শব ঘিরে শ্লোগান দিচ্ছিল— “বাঙালি ভাই, ভাই-রে—বাঙালি ভাইয়ের রক্ত দেখ।” সকলে সেই রক্ত দেখেছিলেন। এ তো লাল পলাশের রঙ নয়। রক্তের রঙ এতো কালোও হয়? যেন কয়েকটি কৃষ্ণচূড়া আক্ষরিক অর্থেই কৃষ্ণ হয়েছে। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনের সারথি হয়ে তাকে ন্যায় সমরে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। এই কৃষ্ণ শহীদ ভাইয়েরা তেমনি ন্যায়ের সংগ্রামে গত রাতে দ্বারে দ্বারে ডাক দিয়েছিল—জয় বাংলা। বাংলাকে জয়যুক্ত করার সংগ্রামে তোমরা বীর বাঙালি বেরিয়ে এস। মানি না মানি না, কারফিউ মানি না।
গতরাতে শহরে কারফিউ দেওয়া হলে ওরা তা মানে নি। পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক সরকার বাংলাদেশের দাবি আদায়ের সংগ্রামকে টুটি টিপে মারার জন্য দিয়েছিল কারফিউ। সে কারফিউ নীরবে মেনে নেওয়ার মধ্যে ছিল স্বদেশের অপমান। সেই অপমান ঘোচাতে ওরা বেরিয়েছিল পথে। শ্লোগান দিয়েছিল–জয় বাংলা। “জয় বাংলা” শ্লোগানে যেন বিছুতির জ্বালা। ওদের সর্বাঙ্গ জ্বলে যায়! কভি নেহি বরদাস্ত করেগা। যে মুখের কথায় এতো জ্বালা গুলি মার সেই মুখে—একটা বর্বর ক্রোধে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে ইয়াহিয়ার সৈনিক নামধারী দস্যুরা। বাংলা শব্দটা উচ্চারণের সময় মুখ প্রসারিত হলে ঠিক সেই যথালগ্নে ওদের মুখ লক্ষ্য ক’রে গুলি ক’রে আর তার ফলে, দেখ, মুখের তালু ভেদ ক’রে সারা মুখ খানা কী বিকৃত হয়ে গেছে। কিন্তু মুখের সেই বিকৃতি যেন, সুদীপ্তর মনে হয়েছিল, সারা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এক বিরাট ব্যঙ্গ। ওরা যেন যাবার আগে একটা মুখ ভেঙচি দিয়ে গেছে ইয়াহিয়াদের পাকিস্তানকে। না, ওদের সঙ্গে আর নয়। সেই লাশগুলি সেদিন যারাই দেখতে এসেছিলেন তাঁদেরই মনে জন্ম নিয়েছিল কথাগুলি—না, ওদের সঙ্গে আর নয়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণের সেই প্রাচীন বটবৃক্ষ তার সাক্ষী। ওগো প্রাচীন বটবৃক্ষ, সাক্ষী থেকো তুমি—ওদের সঙ্গে আর নয়। ছাত্রদের প্রতিটি আন্দোলনের সাক্ষী সেই প্রাচীন বটবৃক্ষ। উনসত্তরের আয়ুব-বিতাড়নের আন্দোলনে এই বটতলা থেকেই ছাত্রেরা যুদ্ধ করেছিল মোনায়েম খানের পুলিশ বাহিনীর সাথে। না, পুলিশেরা রাইফেল মেশিনগান নিয়ে আসেনি। এসেছিল লাঠি ও টিয়ার গ্যাস নিয়ে। লাঠির মোকাবিলা করতে ছেলেরা সক্ষম ছিল, কিন্তু টিয়ার গ্যাস? সুদীপ্ত নিজে না দেখলে তা কি বিশ্বাস করতেন? টিয়ার গ্যাসের শেলগুলো এসে পড়তেই ভেজা চট হাতে জড়িয়ে সেগুলো ধরে ফেলছিল তারা, এবং ছুঁড়ে মারছিল রাস্তার পুলিশের দিকে তখন পুলিশেরাই তার ফলে টিয়ার গ্যাসের জ্বালায় অস্থির। সে এক আশ্চর্য যুদ্ধ! তার পরেই তো ঘটে গেল পর পর দুটি মৃত্যু—ঢাকায় মারা পড়লেন ছাত্র নেতা আসাদ, রাজশাহীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রপ্রিয় অধ্যাপক শামসুজ্জোহা। শামসুজ্জোহার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সমগ্র আন্দোলন এমনিই ভয়াবহরূপে ব্যাপকতা পেল যে আয়ুবশাহী আর টিকল না। তখন মুখোশ পরে এল ইয়াহিয়া। মুখোশধারী ইয়াহিয়া প্রথম দিকে অভিনয় ভালোই করেছিল। ধূলো দিতে পেরেছিল বাঙালির চোখে। কিন্তু সব মুখোশ আর খুলে গেল গত পয়লা মার্চ তারিখে। জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে বাঙালি যে এমন একটা কাণ্ড করবে তা কেউ ভেবেছিল নাকি! আয়ুব খান উপদেশ ইয়াহিয়াকে ঠিকই দিয়েছিলেন—দেখ হে, তুমি সোলজার মানুষ। ঐ সব ডেমোক্র্যাসি তুমি হজম করতে পারবে না। সকলের পেটেই কি ঘি হজম হয়?
হুজুর, সে কথা আমিও জানি। এ কেবল একটা ধাপ্পা। পরিষদে ইনশাআল্লাহ দেখবেন কোনো দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না। তারা তখন ব্যক্তিস্বার্থ নিয়ে কামড়াকামড়ি শুরু করবে। আর সেই সুযোগে–
কিন্তু সুযোগ পেলে তো হে। ধর, বঙ্গাল মুলুকের সকলেই একটা মাত্র দলকেই ভোট দিল। তখন? হুজুরের কথায় ইয়াহিয়া তখন মুখ টিপে হেসেছিল। হুজুর এই জন্যই আপনি তখ্ত হারালেন। বাঙালি চরিত্রকে আপনি চিনেন না। ঝগড়ার ভয়ে যাদের দুজনকে একসাথে কবর পর্যন্ত দেওয়া যায় না—তারাই মিলে মিশে একটা মাত্র দলকে ভোট দিয়ে জয়ী করাবে। এও বিশ্বাস করতে বলেন হুজুর! আপনি যে হাসালেন দেখি।
কিন্তু সত্যকার হাসবার দিন ইয়াহিয়া পায় নি। নির্বাচনের ফল বেরুলে সব হাসি তার মিলিয়ে গেল। এবার? হায় হায় দালালি করতে পারে এমন যে নামগুলি নোটবুকে টোকা ছিল তারা সব যে হেরে গেল। এখন যে আর চিন্তা করেও কোনো কুল মেলে না। ধুত্তোর চিন্তা। শারাব লে আও। মদের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দিল ইয়াহিয়া এবং কিছু চিন্তা না ক’রে হুকুমজারি করল জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বন্ধ। কিন্তু কেন? এবং কতো দিনের জন্য? এ সব প্রশ্নের জবাব দেওয়া হল গুলিতে। ইয়াহিয়া তার দেশ শাসনের ব্যাপারটাকে সরল ও সনাতন একটি সূত্রের উপর স্থাপন করল।—তেরে মেরে ডাণ্ডা, ক’রে দেব ঠাণ্ডা। বেশ, তবে তাই হোক। ডাণ্ডার জোরই পরীক্ষা হয়ে যাক। বাঙালির কাঁদবার দিন আর নেই। এবার অস্ত্রের উত্তর অস্ত্রের ভাষায়। বাঙালির কান্নার দিন শেষ হয়েছে। এই যে সারা মার্চ মাস ধরেই বাংলাদেশে ইতস্তত নরহত্যা চলল এ জন্য বসে বসে কাঁদলে কি বাঙালি বাঁচত। আশ্চর্য, ওরা যত মেরেছে ততই দৃঢ় শপথে সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে বাঙালি। পালটা মার দেবার শপথ নিয়েছে— দুর্জয় শপথ। কিন্তু গত পঁচিশের রাতের সেই মার? তার বিরুদ্ধেও দাঁড়াবার সাহস তার হবে? এক শো বার হবে। হতেই হবে। পালটা মার দিতে না পারলে বাঙালির দশা এখন কি হবে বলতে পার? দাস্যবৃত্তি আর গণিকাবৃত্তি। তার চেয়ে মরে যাওয়া ভালো। স্বাধীনতাহীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে!
সুদীপ্ত ভাগ্যবান বৈ কি। সুদীপ্তর নিজেরও ধারণা, খুব সহজে বোধ হয় মৃত্যুর মুখ তাঁকে দেখতে হবে না। তা হলে ঐ রাতেই সে কর্মটি সমাধা হতে পারত। হয় নি যে সেটা এখন কোনো সৈনিকের মৃঢ়তা বা দূর্বলতা বলে তাঁর আর মনে হয় না। ওটা ভাগ্য। এই ভাগ্য প্রার্থনা করলেই মেলে এমন নয়। সে খামখেয়ালি, যার উপর ইচ্ছে প্রসন্ন হয়, তার অপ্রসন্নতাও কোন নিয়ম মেনে আসে না। কোন কারণ ছিল না, অথচ গাড়িটা ঠিক ঐ সময়ই ঐ পথ দিয়ে যাচ্ছিল। আমনের মৃতদেহ যেন সুদীপ্তর বসন-প্রান্ত আঁকড়ে ধরে সুদীপ্তকে স্থবির ক’রে দিয়েছিল। ঐ অবস্থায় আর কিছুক্ষণ কাটলেই মৃত্যু অবধারিত ছিল। কিন্তু ভাগ্য একটা গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছিল। তখন কারফিউ শুরু হতে মাত্র দশ মিনিট বাকী—অন্তত গাড়ির চালকটি তাই জানত। অতএব অতি দ্রুত সে বাসায় ফিরছিল। জনহীন পথে একটি মানুষও দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বলাকা বিল্ডিংয়ের পাশে তাই সুদীপ্ত খুব সহজেই তার চোখে পড়েছিলেন। এ কি! স্যার এখানে। নাজিম শুনেছিল, সুদীপ্ত স্যার মারা গেছেন। সুদীপ্তর ছাত্র নাজিম হুসেন চৌধুরী। বছর তিনেক আগে পাস ক’রে বেরিয়ে গেছে। এখন সাংবাদিকতা করে। গাড়ি থেকে ছুটে বেরিয়ে এসে নাজিম তার স্যারের কদমবুসি ক’রে প্রায় কেঁদেই ফেলল। আবেগরুদ্ধ কণ্ঠে বলে উঠল–
‘স্যার, আপনি!’
কিন্তু সুদীপ্ত কিছু বলার আগে চিত্রশিল্পী আমনের পানে চেয়ে নাজিম আকাশ থেকে পড়ল যেন–
‘এ কি স্যার। আমনদা এখানে। আমরা তো আজ সকালেই এঁকে হাসপাতালে দিয়েছিলাম।’
স্যারের বৃত্তান্ত শুনল নাজিম। এবং নাজিমের কাছেই শিল্পী আব্দুল্লাহ্ মনসুরের আদ্যন্ত খবর পেয়েছিলেন অধ্যাপক সুদীপ্ত শাহীন। গাড়িতে ছাত্রের সঙ্গে চলতে চলতে খবর পেয়েছিলেন, কিছু পেয়েছিলেন পরে—নাজিমের সঙ্গে পুনরায় দেখা হলে। আর পেয়েছিলেন তাঁর সহকর্মী মোসাদ্দেক হোসেন ইউসুফ সাহেবের খবর।
আজ সকালে সাংবাদিকদের যে ক্ষুদ্র দলটি শিল্পী আমনকে হাসপাতালে পৌঁছে দিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে এই নাজিমও ছিল একজন। সকালে তারা সংজ্ঞাহীন দেহ হাসপাতালে দিয়েছিলেন, এখন এই প্রাণহীন দেহ নিয়ে করবেন কী? কাল থেকে কতো শবই তো দেখছেন! মৃতদেহ সম্পর্কে মন এখন অদ্ভুত রকমের অসাড়। খালি দেখো, কারা বেঁচে রইল। স্যার বেঁচে আছেন। স্যারকে নিয়ে নাজিম তার গাড়িতে স্টার্ট দিল।
আমনদা নাজিমের বহুকালের পরিচিত, এবং আত্মীয় না হয়েও আত্মীয়ের মতো আসা-যাওয়া ছিল তার আমনদার বাড়িতে। কিন্তু আমনদা এখানে কোথায়!—গতকাল রোজিদের বাড়িতে আমনদাকে দেখে প্রথমে বিস্মিত হয়েছিল নাজিম। পরে তার গুলিবিদ্ধ পুত্রকন্যাদের দেখে, এবং কোথাও ভাবী সাহেবাকে না দেখে, ব্যাপারটা কিছু কিছু সে অনুমান করেছিল। হাসপাতালে আমনদাকে দিয়ে সে গিয়েছিল ভাবী সাহেবার খোঁজে তাদের বাড়িতে। এবং যথারীতি ভাবী সাহেবাকে কোথাও পাওয়া যায় নি। তবে কি সেই কানাঘুষোটা সত্য? সাংবাদিক মহলে সে কানাঘুষো শুনেছিল শহরের সম্ভ্রান্ত মহিলাদের ধরে নিয়ে গিয়ে ক্যান্টনমেন্টের মধ্যে সামরিক অফিসারদের জন্য একটি গণিকালয় স্থাপন করা হয়েছে। সংবাদটা যে সত্য তার প্রমাণ পরে নাজিম হাতে হাতেই পেয়েছিল। দিনের বেলা দাসীবৃত্তি এবং রাতে গণিকাবৃত্তি—এই দুই কর্মে নিযুক্ত করা হয়েছে শহরের বহু সম্রান্ত পরিবারের মেয়েকে। সেখানে তাদেরকে শাড়ি পরতে দেওয়া হয় না, কেবল সায়া পরে থাকতে হয়। পাছে কেউ গলায় ফাঁস পরে আত্মহত্যা ক’রে সেই জন্যই এই ব্যবস্থা। কিন্তু সেই ব্যবস্থার মধ্যেও পলি ভাবী তার মুক্তির পথ ক’রে নিয়েছিলেন। কলেজে পড়ার সময় এককালে নাটকে অভিনয় করেছিলেন তিনি। তখন কি তিনি জানতেন যে, সংসার জীবনেও এমনি অভিনয়ের প্রয়োজন কখনো হবে। হাঁ, পলির অভিনয় নিখুঁত হয়েছিল। একটি পাঞ্জাবী অফিসারের সাথে প্রেমের অভিনয় করেছিলেন তিনি। কেন? বাঁচবার জন্য কি? বাঁচার সাধ আর পলির ছিল না। তার বুক থেকে তিন বছরের শিশু কন্যাকে ছিনিয়ে নিয়ে চোখের সামনে পাষণ্ডরা যখন গুলি ক’রে হত্যা করল সেই মুহূর্তেই পাষাণ হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। অল্প শোকে কাতর, অধিক শোকে পাথর। পলির পাথর-কঠিন প্রাণে একটি দীপ্ত শপথের পাপড়ি বিকশিত হয়েছিল। তিনি প্রেমের অভিনয় করেছিলেন শুধু সেই প্রতিজ্ঞা পালনার্থে। বাঁচার চিন্তাটা তার মনের ত্রিসীমানার মধ্যে কোথাও ছিল না। তার মনে ছিল, অন্ততঃ একটি পাঞ্জাবী অফিসারকে মারতে হবে। অতঃপর সম্ভব হলে আরো কিছু। সেই দৃপ্ত ইচ্ছার তাড়না তাকে পথ দেখিয়েছিল। গায়ের জোরে না পারি ছলনার আশ্রয় নেব। ইয়াহিয়া নেয়নি ছলনার আশ্রয়। আপোস আলোচনার নাম ক’রে সামরিক প্রস্তুতির জন্য সময় সংগ্রহের নাম ছলনা নয়? পলিও ছলনা-জাল বিস্তার করেছিলেন।
বাঙালি-নিধন শুরু করার প্রস্তুতি-পর্বে পাঞ্জাবিরা তাদের স্ত্রীদের দেশে পাঠিয়ে দিয়েছে। এখন নারীবর্জিত জীবনে পলির ফাঁদে সহজেই ধরা দিল সেই তরুণ পাঞ্জাবী অফিসারটি। পলিকে সে-ই উদ্ধার ক’রে ক্যান্টনমেন্টের গণিকালয় থেকে, এবং শহরের মধ্যে একটি বাড়িতে এনে রাখে। কিন্তু এ কোন বাড়ি? এ বাড়ি তো পলির অপরিচিত নয়। এখানে সেই হালিমারা থাকত না? হালিমার স্বামী একজন খুবই স্বনামখ্যাত স্বদেশকর্মী, এবং ধনী। হালিমা পলির স্কুল জীবনের বান্ধবী। রূপ থাকার জন্য রুপেয়াওয়ালার ঘরে বিয়ে হয়েছিল। পলি কয়েকবারই এসেছেন তার বান্ধবীর বাড়ি। হাঁ এই তো সেই বাড়ি। কিন্তু হালিমারা কোথায়? সুন্দরী হালিমা যদি ওদের চোখে পড়ে থাকে! হায় সেই পাষণ্ডরা এমনি কতো সংসার ধ্বংস করেছে গো! বাংলাদেশের কিছু আর থাকল না।
আহা, ঘর-দোর ঠিক তেমনি সাজানো আছে। এইটে ওদের লাউঞ্জ ছিল না! আহা, এই তো সেই হালিমার খোকার দোলনাটা। তারা বড়ো লোক না হলেও এমনি সুন্দর একটি দোলনা কিনে দিয়েছিলেন তার মেয়ের জন্য। মেঝেতে এটা? একখণ্ড কাপড়। পলি তুলে দেখেন, ছোট বাচ্চাদের জাঙিয়া। নিশ্চয় হালিমার খোকার। আব্বুরে, তোকেও ওরা মেরেছে নাকি। জাঙিয়াটা বুকে চেপে ধরে পলি হু-হু ক’রে কেঁদে ওঠেন। ওরে আমার সোনামণিরা, মা হয়ে তোদের বাঁচাতে পারি নি। কিন্তু শোধ এর নেব, নেবই নেব।
ওরে হাড়-হাভাতে পাষণ্ডরা। বাংলার এমন কতো সাজানো সংসার তোরা নষ্ট করেছিস? বল কত? আহা কী সুন্দর সংসার ছিল হালিমার! সইয়ের সেই পবিত্র সংসারকে ওরা আজ পণ্যাঙ্গনাবৃত্তির ক্ষেত্র করতে চায়। তার সাজা তোদের পেতে হবে। পড়েছিস পলির হাতে। প্রথম রাতেই পলি হত্যা করেন সেই পাঞ্জাবি অফিসারটিকে। মদ খেয়ে অফিসারটি যখন নিস্তেজ হয়ে বিছানায় পড়েছিল ঠিক সেই মাহেন্দ্রক্ষণে হেঁসেল ঘর থেকে বঁটি এনে প্রাণপণ শক্তিতে পাঞ্জাবির গলায় চেপে ধরেন পলি। হারামখোর মিনসের গায়ে এতো রক্তও ছিল। বিছানা ভিজে রক্তের ধারা গড়িয়ে মেঝেয় পড়েছিল। আশ্চর্য, পলি ভাবী একটুও অপ্রকৃতিস্থ হন নি।
কী বিপর্যয় ঘটে গেছে পলির উপর দিয়ে। তাতেই তো পাগল হয়ে যাবার কথা। ছোট বোন রোজি পাগল হয়ে গেছে, তাকে ওরা বের ক’রে দিয়েছে ক্যান্টনমেন্ট থেকে। অতঃপর সে যে কোথায় গেছে কেউ জানে না। রোজির মতো অমনি পাগল হলে ওই হারামির পোলাগুলোর তাতে কী আসে যায়। আবার কোনো ভদ্রঘরের মেয়ে ধরে এনে শূন্যস্থান পূর্ণ করবে। ওতে প্রতিশোধ নেওয়া হবে কি করে? মরেছিই যখন, তখন যে ক’রে হোক একজনকে মারবই।—পলি ভাবী তার এই প্রতিজ্ঞা-পালনে ব্যর্থ হন নি। এবং কেবল প্রতিজ্ঞা পালন করেই খুশি হন নি। পাঞ্জাবি অফিসারটিকে হত্যার পর বেরিয়ে একটা রিক্সা ক’রে সোজা এসেছিলেন নাজিম হুসেনের কাছে।
ভাই, একটা মাইন জোগাড় ক’রে দিতে পার।
হয়ত নাজিম হুসেন চেষ্টা করলে তা পারে। কিন্তু ঐটেই এখন বলার কথা নাকি! কয়দিন অদৃশ্য হয়ে থাকার পর সহসা উদিত হয়ে এখন তিনি বলছেন, আমাকে একটা মাইন জোগাড় ক’রে দিতে পার। তার আগে তো শুধাবার ও শুধিয়ে জেনে নেবার জন্য এক ঝুড়ি প্রশ্ন ও কৌতূহল মনে জমা হয়ে আছে। হাঁ, সব প্রশ্নের উত্তর পলি ভাবী দিয়েছিলেন। আদ্যন্ত ঘটনা সব শোনার পর নাজিম হুসেন কী বলবেন ভেবে পান নি। শুধাতে ইচ্ছে হয়েছিল—কই, আমনদার কথা কিছু তো শুধালেন না ভাবী? না না, ঐ কথা না তোলাই ভালো। প্রচ্ছন্ন ক্ষত-মুখে খোঁচা মারা হবে না সেটা। অতএব সে কথা সে আর তুলল না। তাদের বাড়ি তখন খালি। মেয়েদের সব গ্রামাঞ্চলে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তারা কয়েকজন পুরুষ কেবল থাকে সেখানে। স্বাভাবিক অবস্থায় পলি সেখানে থাকতে পারতেন? এখন কিন্তু কোনো অসুবিধা হল না। স্বচ্ছন্দে সেখানেই কয়েক দিন কাটিয়ে পলি ভাবী একদিন অদৃশ্য হলেন। কেবলি সেই বাড়িটা থেকেই নয়। একেবারে সংসার থেকেই। হাঁ অদৃশ্য বৈ কি। সহসা একটা মিলিটারি-ভরতি ট্রাকের নীচে পলি ভাবী অদৃশ্যই তো হয়েছিলেন। নাজিম হুসেনের সংগ্রহ করে-দেওয়া মাইন-বুকে বেঁধে সেই ট্রাকের সামনে ঝাঁপ দিয়েছিলেন পলি ভাবী। একটি মুহূর্ত, একটি প্রচণ্ড শব্দ—তার পরের দৃশ্য হচ্ছে, রাস্তার একাংশ জুড়ে ইতস্তত ছিটকে পড়া একটি প্রকাণ্ড ট্রাকের ভগ্নাংশ। আর অমন বিশ-পঁচিশটা শক্ত সেনার লাশ। আর? হাঁ, আরো ছিল লালপেড়ে শাড়ির ছিন্ন অংশ, ভগ্ন বিক্ষিপ্ত ট্রাকের গায়ে ও রাস্তায় লেপটে-যাওয়া কাঁচা থেতলানো মাংস আর রক্ত। ওই গুলোই পলি ভাবী। জ্বালামুখি রোশেনার পথ বেছে নিয়ে দেহের অসম্মানকে ধূলোয় ছুঁড়ে দিয়ে তিনি চলে গেলেন। রোশেনা কি শুধুই একটি নাম? সে একটি আদর্শ। সুদীপ্তদের বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ছাত্রী রোশেনা। বাঙালি-হত্যার শোধ নিতে শরীরে মাইন জড়িয়ে শত্রু সেনার ট্যাঙ্কের নীচে আত্মাহুতি দিয়েছিল সেই বীরদর্পিণী বঙ্গললনা। রোশেনা তাই বাঙালির ঘরে একটি রূপকথার নাম। বাংলার ঘরে ঘরে প্রতিটি নবাগত শিশুর কাছে রূপকথার মতোই সমাদৃত হবে রোশেনার কাহিনী—সেই সঙ্গে পলি ভাবীরও।
নাজিমের পলি ভাবীর এই পরিণতি অবশ্যই কয়েক দিন পরের ঘটনা। পরে একসময় নাজিমের সঙ্গে দেখা হলে তার কাছে সব শুনেছিলেন সুদীপ্ত। কিন্তু এখন শুনলেন তাঁর সহকর্মী মোসাদ্দেক সাহেবের কথা। মোসাদ্দেক ছিলেন এস. এম. হলের হাউস টিউটর। আশ্চর্য, গতকাল থেকে একবারও সুদীপ্তর মধ্যে এস, এম, হলের চিন্তাটা আসেনি। ঐ হলের উত্তর ও পূর্ব দিকের রাস্তা দিয়েই গতকাল তিনি হেঁটেছেন, অথচ হলে যে তাঁদের ছাত্ররা ছিল, তার কয়েকজন সহকর্মী ছিলেন, তাঁদের কথা তার মনে হয়নি। ইকবাল হলের চিত্র তাকে আচ্ছন্ন করেছিল—হল ক্যান্টিনের কাছে মৃত মানুষের স্তূপটাকে ঘিরে ঘিরে কেবলি এক রাশ প্রশ্ন সৃষ্টি হচ্ছিল তার মনে। মানুষ মেরে হত্যাকারী তা লুকাবার চেষ্টা করে, কিন্তু এরা তা কি সকলকে দেখাতে চায়? নিশ্চয়ই না। বোধহয় এতো বেশি মেরেছে যে, তার সবটুকু লুকানো এখন ওদের আয়ত্তের বাইরে। নাকি ওরা এখন সর্বপ্রকার লজ্জা শরমের অতীত? ইস্ কী মর্মান্তিক সেই দৃশ্য। ইত্যাদি নানা কথা ভাবতে ভাবতে এবং নানা দৃশ্যের যন্ত্রণায় বার বার আক্রান্ত অভিভূত হতে হতে এস. এম. হলের পাশ দিয়ে কখন চলে গেছেন এবং ফিরেছেন ফিরোজের গাড়িতে। অতএব এস. এম. হল সম্পর্কে কোনো ধারণা এখন তিনি অন্যকে দিতে পারেন না। মোসাদ্দেক সাহেবের ওখান থেকে তিনি কি খুব দূরে ছিলেন? বিশ্ববিদ্যালয়ে তো একেবারে পাশাপাশি ঘরে তারা বসে থাকেন। স্থানের দূরত্ব কোথাও বেশি নয়। কিন্তু মনের দুরত্ব? হাঁ, ওটাও একটা কারণ হতে পারে যে, নাজিমের কাছে শোনার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত সুদীপ্তর মনে মোসাদ্দেক সাহেব সম্পর্কে কোনো কৌতূহল ছিল। না, কোনো বিরূপতাও নয়। ভদ্রলোককে কেমন যেন সুদীপ্তর পছন্দ হয় না। সকলকেই সকলে পছন্দ করতে পারে? বিশেষত দুজনের বাস যদি দুই জগতে হয়! মোসাদ্দেক সাহেব ছিলেন প্রাচীন আচারের বালুরাশি-আচ্ছন্ন দ্বীপের অধিবাসী।
ক’দিন থেকেই মোসাদ্দেক সাহেব কেমন যেন স্বস্তিতে ছিলেন না। বিশে মার্চের রাতে কাকের ডাক শুনেই তিনি বুঝেছিলেন সাংঘাতিক কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। ইস্ কী ব্যাকুল হয়ে কাকটা ডেকেছিল সে রাতে। আবার দেখ, ঠিক পরের রাতে সেই স্বপ্ন। স্বপ্নে একটা বিশাল বাক্স দেখলেন মোসাদ্দেক সাহেব। এবং ঘুম থেকে জেগেই স্ত্রীকে ডেকে বললেন, এ বাড়ি থেকে চলে যাবার আদেশ হয়েছে। কিন্তু স্বপ্নে তো বিছানা দেখেননি, কেবলি বাক্স দেখেছেন। অতএব বাক্স-বিছানা গুটিয়ে একেবারে চলে যাবার নির্দেশ এ নয়। বাক্স বোঝাই ক’রে যা পার সরিয়ে ফেল। বাইশে মার্চেই মোসাদ্দেক সাহেব বয়স্ক পুত্র-কন্যাদের দেশের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। সঙ্গে যতোটা সম্ভব টাকা-কড়ি ও গহনাপত্রও সরিয়েছিলেন। বাসায় ছিলেন কেবল তারা স্বামী-স্ত্রী এবং কোলের একটি শিশু কন্যা। অতএব খুবই স্বাভাবিক যে, পাক-জওয়ানরা মোসাদ্দেক সাহেবের বাসায় ঢুকে আদৌ খুশি হয় নি। এ কেমন বাড়ি? রেডিও কৈ? সেলায়ের কল, টি. ভি. কিছুই যে নেই। মাত্র দুজন বুড়ো-বুড়ি। ছুকরী আওরাত কাঁহা? ধুত্তোর, এ সালা লোগ কো লে যাও, গোলি কর। শিশু-কন্যাকে বুকে নিয়ে ওরা স্বামী-স্ত্রী আগে পিছনে দুজন জওয়ানের সাথে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে। মানে, বেরুতে হল। হলের আঙ্গিনায় যেতেই মোসাদ্দেক সাহেবকে দেখে হাউমাউ ক’রে ছুটে এসে তাকে জড়িয়ে ধরল একটি ছাত্র। তাঁরই হলের ছাত্র। হলে ছাত্র সামান্যই ছিল। তাদের মধ্যে কয়েকজনকে ওরা ধরতে পারে নি। কেউ পালিয়ে বেঁচেছে, কেউ লুকিয়ে। ধরা পড়েছে জন পাঁচেক। তাদেরই একজন ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল মোসাদ্দেক সাহেবকে।
বাঁচান স্যার। আমাকে বাঁচান। আমার বিধবা মায়ের আমি একমাত্র ছেলে। আমাকে বাঁচান।
মোসাদ্দেক সাহেবের মনে হ’ল, এ তার নিজেরই সেই ক্ষুদ্র শিশু পুত্রটি। ভয় পেয়ে এসে বুকে আশ্রয় নিয়েছে। এমনি ক’রেই ছোট শিশুরা রাতের আঁধারে ভয় পেয়ে বাপের কোলে মুখ লুকোয়। কিন্তু হায়, বক্ষের সকল অভয়বাণী যে শুকিয়ে গেছে। মুখে কোনো কথা জোগাল না। দু’হাত দিয়ে বুকে চেপে ধরলেন ভয় পাওয়া সন্তানকে। কিন্তু কেবলি তো স্নেহ দিয়ে যমের কবল থেকে সন্তানকে রক্ষা করা যায় না। সেই মুহূর্তে মোসাদ্দেক সাহেব প্রবল যমের সম্মুখে ভীত অসহায় একটি জননীর প্রতীক হয়ে উঠলেন। আর যমের দোসর একটি জওয়ান এসে ছেলেটির মাথার চুল ধ’রে তাকে টানতে টানতে নিয়ে গেল, মোসাদ্দেক সাহেব কি পাষাণ হয়ে গিয়েছিলেন? তাঁর স্ত্রী কিন্তু সম্পূর্ণ বোধটুকু হারান নি। তিনি চীৎকার ক’রে উঠলেন—
‘খোদার কসম লাগে, এই বিধবা মায়ের ছেলেটিকে তোরা…’
ভদ্রমহিলার কথার শেষটুকু আর গুলির শব্দে শোনা গেল না। ছেলেটি মাটির বুকে লুটিয়ে পড়ল। তারপর? বাকি ছাত্রগুলিকে ওরা হুকুম করল–
‘বোলো জয় বাংলা।’
ছেলেরা কি বলবে। ভয়ে সকলের গলা শুকিয়ে গেছে। তা শুকোতে পারে। তবু কথা বলবে না এ কেমন বে-আদবি! দেখাচ্ছি মজা। একটি সৈনিক। ছুটে গিয়ে একটি ছাত্রের তলপেটে মারল একটা জোর-লাথি। ভারি বুটের লাথি। একটা কাতর শব্দ ক’রে পড়ে গেল ছেলেটি। কিন্তু রেহাই মিলল না। মিলল বেয়নেটের খোঁচা। আর সঙ্গে সঙ্গে ভীতস্বরে বাকি ছেলেগুলি বলে উঠল ‘জয় বাংলা’।
হাঁ, এই তো পাওয়া গেছে। হে বঙ্গ সন্তান, এবার তোমাদেরকে হত্যা করার হেতু পাওয়া গেছে। মুহূর্তেই তিনটি শব হয়ে ছাত্র তিনটি লুটিয়ে পড়ল মায়ের বুকে। অধ্যাপক মোসাদ্দেক হোসেন যেন দেখলেন, জননী শাহেরবানুর কোলে এলিয়ে পড়ল তাঁর তীরবিদ্ধ সন্তান—এজিদের সৈনিকরা জল চাওয়ার অপরাধে তীরবিদ্ধ করেছে শাহেরবানুর দুধের শিশুকে। জলেরই অন্য নাম জীবন। এ ছেলেরা সেই জীবনকে চেয়েছিল স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিকের জীবন। তার পরিবর্তে ভাগ্যে জুটেছে গুলি।
অতঃপর মোসাদ্দেক সাহেবদের পালা। তিনি কলেমা পড়ে তৈরি হলেন মরবার জন্য। সৈনিকটিও রাইফেল তাক ক’রে দাঁড়াল। হাঁ, ঠিক এমনি একটা অবস্থার মুখেও তিনি বেঁচেছেন। এবং বেঁচে আছেন। মোসাদ্দেক সাহেবের স্ত্রী উর্দু জানতেন। তিনি সেই মুহূর্তে ছুটে এসে স্বামীকে আড়াল ক’রে দাঁড়িয়ে ছিলেন এবং সৈনিকটিকে ‘বেটা!’ সম্বোধন ক’রে পরিষ্কার উর্দুতে বলেছিলেন–তোমার পিতাজীর প্রাণ ভিক্ষা চাই বেটা! এ কথায় কাজ হয়েছিল? বহু ক্ষেত্রেই হয়নি। বাপ ডেকেই সর্বত্র কি দুবৃত্ত লম্পটের হাত থেকে মেয়েদের রেহাই মেলে? কিন্তু কচিৎ কোন-ক্ষেত্রে মিলতেও পারে। অন্ততঃ মোসাদ্দেক সাহেব রেহাই পেয়েছিলেন। এই প্রৌঢ় দম্পতি-যুগলের মুখের পানে চেয়ে সামান্য একটি পাঠান সৈনিকের মনে কি ভাবের উদয় হয়েছিল তা এ ক্ষেত্রে অনুমান করা যায়নি। হয়ত তার মন বলে থাকবে—আমি কি করব মা, আমি তো হুকুমের গোলাম। কোনো-কিছু করা না করার ব্যাপারে সাধারণ একটি সৈনিকের স্বাধীনতা কতটুকু? সেটা মোসাদ্দেক সাহেব বা তার স্ত্রী বা তার ছাত্র নাজিম হুসেন কেউই জানেন না। কেবল কয়েক ঘণ্টা পর একটু প্রকৃতিস্থ হয়ে মোসাদ্দেক সাহেব দেখেন, নিজের বাসাতেই শয়নকক্ষে তারা বসে আছেন— তিনি তাঁর স্ত্রী, আর ছোট মেয়েটি। আল্লাহ তোমার কৃপাতেই এ যাত্রা বাঁচলাম। মনে মনে আল্লাহ্র প্রতি অসীম কৃতজ্ঞতায় মোসাদ্দেক সাহেব টুইটম্বুর হয়ে ওঠেন। কিন্তু কেমন ক’রে যেন পরক্ষণেই ভাবনাটা আসে—আবার কেউ আসবে না তো! হায়, সেই আশঙ্কাই সত্য হল কয়েক ঘণ্টা পর। দুপুর বেলায় নামায পড়বেন বলে ওজু করতে গেছেন মোসাদ্দেক সাহেব। মনে সেই আফসোসটা ছিলই। আজ শুক্রবার। শুক্রবারে আজ জুমার নামাযের জামাত হবে না। অগত্যা জোহরের জন্য ওজু করতে ঢুকলেন বাথরুমে। সহসা কন্যার চীৎকারে সেখান থেকে বেরিয়ে দেখেন, দুটি যমদূত। দুজন পাকিস্তানি জওয়ান ঘরের মধ্যে। তাদের একজন মোসাদ্দেককে দেখেই তার বুকের কাছে রাইফেলের নল তুলে ধরে দাবি জানাল—রুপেয়া নিকালো।
এতোক্ষণে তাদের খেয়াল হল, আলমারিতে কিছু টাকা ছিল বটে। এবং এতক্ষণে তাদের নজরে পড়ল, আলমারি খোলা। আগে যারা প্রথম ঘরে ঢুকেছিল তারাই সব লুটে নিয়ে গেছে। এখন তবে এদেরকে দেওয়া যাবে কী? মোসাদ্দেক সাহেবের স্ত্রী উর্দুতে বোঝালেন, যা ছিল সব তো তোমরা আগেই নিয়ে গেছ বাবা, এখন তোমাদেরকে আবার কী দেব?
তবে রে ……… বিশ্রী একটা গাল দিয়ে খেঁকিয়ে উঠল একটা জওয়ান। এবং আর একজন তার কর্ম শুরু করল। গুলি নয়, প্রহার। বুটের লাথি ও রাইফেলের বাট দিয়ে সে কী মার! মোসাদ্দেক সাহেবের স্ত্রীও রেহাই পেলেন না। পাঁচ বছরের কন্যাটি ভয়ে খাটের নীচে লুকিয়েছিল। লুকোতে দেখেও ছিল তারা। কিন্তু তাকে আর টেনে বের ক’রে কী লাভ! ঐটুকু এক রত্তি মেয়ে। মারতে গেলে হয়ত মরেই যাবে। তা মারতে আপত্তি নেই। কিন্তু মেরে লাভ? তার চেয়ে থাক। বড়ো হোক একটু। আমরা তো থাকবই এদেশে। আমাদেরই কোনো বেরাদারের কাজে লাগবে তখন। অতএব বুড়ো-বুড়ি দুটোকে মেরে অজ্ঞান ক’রে তার বদলে কচি মেয়েটিকে অব্যাহতি দিল তারা। গতকাল কারফিউ উঠলে সেই রক্তসিক্ত জামা-কাপড়েই তাদেরকে পথে বেরোতে হয়েছিল। অন্য জামা-কাপড় আর ছিল কোথায় যে, তা বদলে নেবার সুযোগ পাবেন তারা। তাদের সঙ্গেই হল থেকে বেরিয়েছিল একটি ছাত্র—মাসুম সিরাজ।
মাসুম সিরাজ বেরিয়ে হল-প্রাঙ্গণেই পেয়েছিল তার বড়ভাই মাসুদ সিরাজের লাশ। সেই লাশ জড়িয়ে ধরে তার সে কী কান্না! সেই লাশ থেকে তাকে ছাড়িয়ে আনা কি যায়! মোসাদ্দেক সাহেব তাকে অনেক বুঝিয়ে নিতে দুর্দশার কাহিনী শুনিয়ে কোনো মতে সঙ্গে ক’রে চ’লে গেছেন। কোথায়, বুড়ীগঙ্গার ওপারে, জিঞ্জিরার দিকে—সেখানে মোসাদ্দেক সাহেবের এক আত্মীয় থাকেন। কোনো গাড়ি না পেয়ে অগত্যা তারা হেঁটেই চলছিলেন ধীরে ধীরে। ঐ অবস্থায় দেখা হয়েছিল নাজিম হুসেনের সঙ্গে। মোসাদ্দেক সাহেবের প্রাক্তন ছাত্র নাজিম হুসেন তার স্যারকে নিজের গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে সদরঘাটে পৌঁছে দিয়েছিল।
মাসুম সিরাজ?
সেও গেছে স্যারের সঙ্গে। মাসুম সিরাজ সুদীপ্তর টিউটোরিয়াল গ্রুপের ছাত্র—খুবই ভালো ছাত্র। এস. এস. সি, এইচ. এস. সি—দুটো পরীক্ষাতেই সে প্রথমে দশজনের মধ্যে ছিল। কিন্তু বড় ভাই মাসুদ ছিল মূলত পড়ুয়া নয়, খেলোয়াড়। ক্রিকেটের গোলা ছুঁড়তে তার জুড়ি মেলা ভার। সে জন্য বিশ্ববিদ্যালয়-একাদশে তার স্থান ছিল অনড়। এই দুটি ভাই কেউই কখনো রাজনীতির ধার কাছেও ঘেঁষত না। অবশ্যই তা নিয়ে কোনো যে গর্ববোধ তাদের মনে ছিল তাও নয়। ওদের দুই ভাইয়েরই মত হচ্ছে, সব কাজ সকলে পারে না। অতএব নীরবে নিরীহ নির্বিরোধ ছাত্রের ভূমিকা নিয়ে হলের এক কোণে তারা পড়ে থাকত। সেই রাতের প্রলয়কাণ্ড শুরু হতেই মাসুদ তার ছোট ভাইকে চৌকির নীচে পাঠিয়ে বিছানাপত্র চটপট গুটিয়ে বেঁধে ফেলেছিল। বিছানার পুলিন্দা চৌকির উপর রেখে ভাইকে উপদেশ দিয়েছিল—এক কোণে চুপচাপ বসে থাকবি, কখনো গলা বাড়াবি নে। অতঃপর বাইরে এস ঘরে তালা দিয়ে কোথায় যে সে লুকিয়েছিল ছোট ভাই তা জানে না! খালি যাবার সময় বলেছিল—
‘আমার জন্য ভয় করিস নে। আমি কোথাও ঠিক ম্যানেজ ক’রে নেব।’ কিন্তু হায় সেই ম্যানেজ আর সম্ভব হয় নি। তবে তার বুদ্ধিবলে ছোট ভাই বেঁচে গিয়েছিল ঠিকই। হাঁ, মাসুদের বুদ্ধিতেই মাসুম বেঁচেছিল। তালা দেওয়াকে দুর্বৃত্তরা বিশ্বাস ক’রে নি। দারোয়ান ছাত্রদের তালা দিয়ে রেখে যেতে পারে না? অতএব প্রত্যেকটি তালা ভেঙ্গে তারা ঘরে ঢুকেছিল। মাসুমের ঘরে একেবারে চৌকির পাশে গিয়ে বিছানার স্তুপে বেয়নেটের খোঁচা দিয়ে দেখেছিল। সেই সময়ে চৌকির নীচে মাসুম অস্পষ্টভাবে কেবল দেখেছিল পাশাপাশি দুটি ক্ষুদ্র থামের মতো এক জোড়া পা। একেবারে হাতের নাগালে? ধরে এক টান দিলে কেমন হয়। হাঁ, নিশ্চয় তা সে দেবে। গুড়ি মেরে চৌকির নীচে নজর দেখা চেষ্টা করলে সে আর খাতির করবে না। তখন মরতে এমনিতে হবে। অতএব মরবার আগে একটাকে মারবার শেষ চেষ্টা ক’রে দেখতে হবে। মেঝের উপরে ফেলে দিয়ে গলা টিপে ধরতে পারলে কেল্লা ফতে। কিন্তু কেল্লা জয় কি অতই সোজা মাসুম! জওয়ানেরা কখনো একা থাকে দেখেছ? একটাকে তুমি কুস্তির প্যাঁচ কষে ফেলতে যদিও পার সঙ্গে সঙ্গে অন্য জওয়ানের গুলি খেতে হবে না তোমাকে? ঐ তো আর একটা জওয়ান একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে। এবং কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকেই সঙ্গীকে নিয়ে সে বেরিয়ে গিয়েছিল। অতএব মাসুম বেঁচে গেছে। এবং মাসুম কাঁদছে। এখন সে বড়ো ভাইয়ের খবর নিয়ে কী ক’রে বাপ মায়ের সামনে গিয়ে দাঁড়াবে। এক সাথে দু’টি ভাই তারা বরিশালের একটি গ্রামে একত্রে খেলা ক’রে ঝগড়া ক’রে ঈর্ষা ভালোবাসার জোয়ার-ভাটার দোল খেয়ে মানুষ— জীবনে কখনো এই দিনটির কথা কি মাসুম চিন্তা করেছিল! তার ভাইয়ের কি দাফন-কাফনও হবে না? ঐখানে পড়ে গলে পচে কাক শকুনের খাদ্য হবে? মাসুম তার স্যারের সঙ্গে হাঁটছিল, আর দুই গাল বেয়ে জল ঝরছিল। এখন ফিরে যাওয়া যায় না? ভাইয়ের কাছে বসে কোরান পাঠ………
‘মাসুম, ওঠ বাবা, আর তো কিছু করার নেই।’
তাই তো, একটা গাড়ি পাওয়া গেছে। স্যার উঠে গেছেন এবং মাসুমকে উঠতে বলছেন। আর যে হাঁটতে হবে না, সেই কথাটা একবার চট ক’রে মনে পড়ে গেল মাসুমের, এবং উঠে বসল নাজিমের ঝকঝকে মরিস মাইনরে।