» » ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ

ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ

কিন্তু সুদীপ্তর মধ্য থেকে শুধুই সাহস নয়, প্রাণও যেন বিলুপ্ত হয়েছে। প্রাচীন মিসরের মমির মতো একজন ফ্যাকাসে সুদীপ্ত ফিরোজের সামনে সোফার উপর নিশ্চলভাবে পড়ে রইলেন। সুদীপ্তর স্ত্রী ঘরে এলেন। হাতের আঙুল ধরে পায়ে পায়ে এল তিন বছরের শিশু কন্যা বেলা। আব্বাকে দেখেই বেলা এবার মায়ের আশ্রয় ছেড়ে বাপের কোলে গিয়ে চড়ে বসল। এই বেলার কাছেই সুদীপ্ত পরাজয় স্বীকার করেছেন। এলা কিংবা অনন্ত কখনো তাদের আব্বার কাছে এতো প্রশ্রয় পায় নি। এলা তার বড় ভাই অনন্তর চেয়ে মাত্র দেড় বছরের ছোট। এবং এলার পাঁচ বছর পর বেলা। সুদীপ্তর বারো বছরের বিবাহিত জীবনে সন্তান এই তিনটিই। স্ত্রী আমিনা বললেন—

‘নাও, তোমার মেয়েকে সামলাও। ও সেই নীলক্ষেতের বাসায় যাবে।’

কথাটা না বললেও চলত। কেননা বেলাই তার আব্বার গলা জড়িয়ে ধরে কানে কানে বলেছে—

‘বাসায় যাবে না আব্বু।’

‘ও কথা আমরা বিশ্বাস করব না ভাবী’, ফিরোজ বললেন, ‘আপনিই নিজের কথাটি কন্যাকে শিখিয়ে দিয়ে নিয়ে এসেছেন।’

অন্য সময় হ’লে এ কথার উত্তরে আমিনা কি বলতেন? হয়ত বলতেন। ঠিকই তো করেছি। আপনি জানেন না, ছেলেপেলের মা হ’লে মেয়েরা সন্তানদের দিয়ে নিজেদের উদ্দেশ্য সিদ্ধ ক’রে নেয়। চটুলা রমণী আমিনার সাথে ফিরোজ কখনো কথায় পারেন নি। তাই ফিরোজ একদা মোক্ষম প্রশ্ন করেছিলেন–

‘আচ্ছা, বলতে পারেন ভাবী, সুদীপ্ত মুখচোরাটা আপনার সাথে কথা বলে কি করে?’

‘আপনার মতো ঠোঁটকাটা স্বামীর সাথে আপনার মুখচোরা লজ্জাবতীটি যেভাবে কথা বলেন ঠিক সেইভাবে।’

ফিরোজের স্ত্রী স্বভাবতই একটু লাজুক। তদুপরি বন্ধ্যা বলে সব সময়ই মনে বোধ হয় একটি বিষাদকে বহন করেন। তাই কথা বলেন কম। ফিরোজের এটা পছন্দ নয়। কিন্তু সুদীপ্ত ভারী পছন্দ করেন স্বল্পভাষিণী মীনাক্ষী নাজমাকে। মীনাক্ষী নাজমা—ঠিক এই নামটাই আমিনার হওয়া উচিত ছিল। নিদেনপক্ষে মীনাক্ষী আমিনা। তা না, শুধু আমিনা খাতুন। বাপ-মা আর নাম পান নি। কিন্তু মীনাক্ষী নাজমা? অদ্ভুত নাম। কথিত আছে, ফিরোজ নাম শুনেই মেয়েটিকে পছন্দ করেছিলেন। কিন্তু সে আজ সাত বছর আগের ঘটনা। মাত্র সাত বছর। সে আর কতটুকু! কিন্তু আজ সেই সাত বছর আগের কথা মনে হ’লে ফিরোজের কেমন ছেলেমানুষ ছেলেমানুষ ঠেকে। কি আশ্চর্য স্বপ্নময় ছিল সেই দিনগুলো। বিয়ে তিনি একটু বেশি বয়সেই করেছিলেন। বয়স তখন পঁয়ত্রিশের কাছাকাছি। কিন্তু তখনো তাঁর পৃথিবী প্রথম যৌবনের রঙ হারিয়ে ফেলে নি। তারপর সেদিনের পরে গেছে কত শত দিন।

ফিরোজ আজ অবাক হলেন এই দেখে যে, তার ভাবী অর্থাৎ আমিনা খাতুন তার কথার উত্তরে সাড়া দিলেন অত্যন্ত শীতলভাবে—

‘না ভাই। ওখানে কি আর ফেরা যায় যে সে কথাটি মেয়েকে শেখাতে যাব।’

কেমন একটা করুণ সুর বাজল আমিনার কথায়। এবং সহসা ফিরোজ উপলব্ধি করলেন, বড় ভুল ক’রে ফেলেছেন তিনি। সত্যিই তো বড়ো বেদনায় বড়ো অসহায় হ’য়ে তাঁরা গৃহত্যাগ করেছেন। এখন গৃহে ফেরা নিয়ে কোন রসিকতাও যে আঘাত হ’য়ে বাজবে। তাঁর মতো লোকের সেই এত বয়সে এতো অসাবধানে কথা বলা উচিত হয় নি। তবে কিছু একটা বলতে তাঁকে হ’ত। কেননা সুদীপ্ত কিছু বলছেন না। মেয়েকে কোলে নিয়ে তাঁর মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে নীরব শুধু সোহাগ করছেন। কিন্তু সুদীপ্তর সোহাগে খুব একটা কাজ হ’ল না। কানের কাছে খুব আস্তে আস্তে মেয়ে অনুযোগ করেই চলেছে–

‘হুঁ—উঁ–উঁ, বাসায় চল আব্বু।’

নীরবে মেয়েকে কোলে নিয়ে বাইরে গেলেন সুদীপ্ত। বারান্দা পেরিয়ে বাগানে নামলেন। কয়েকটি গোলাপ ফুটে আছে একটি গাছে। সেদিকে যেতেই মেয়ে হাত বাড়িয়ে দেখাল জবা। সারা গাছ ভরে আছে অজস্র জবা। যেন সদ্যরক্তস্নাত গাছটা মধ্যাহ্নকে ব্যঙ্গ করছে। সুদীপ্ত ঐ গাছের সারা সবুজ অঙ্গে রক্তের ছাপ দেখলেন। আর এগোতে পারলেন না। মেয়েকে আরো নিবিড় ক’রে জড়িয়ে ধরলেন বুকের মধ্যে। কিন্তু মেয়ে হাত বাড়িয়ে দেখাল—

‘ঐ ফুল আব্বু।’

তাই তো, ওইগুলি তো ফুলই। তবে দাঁড়িয়ে গেলেন কেন তিনি! তবু এগোতে চেষ্টা করেও এগোতে পারলেন না। পা বাড়াতেই মনে হল–না না, ওরা ফুল হবে কেন বুলেট-বিদ্ধ অঙ্গের ক্ষত মনে হচ্ছে না? ঠিক তাই ডঃ ফজলুর রহমানের গায়ে গুলির দাগগুলো কেমন দেখাচ্ছিল? ঠিক এমনি প্রস্ফুটিত জবার মতো না? মেয়েকে বুকে জড়িয়ে আবার ছুটে গিয়ে ঘরে ঢুকলেন তিনি। হাঁ, ছুটেই গিয়েছিলেন। কেমন একটা হন্তদন্ত ভাব। আমিনা তখনো ঘরে ছিলেন, ইতিমধ্যে মীনাক্ষীও এসে জুটেছিলেন। আর ফিরোজ তো ছিলেনই। তিনজনই সুদীপ্তর ছুটে আসা দেখে কেমন ঘাবড়ে গেলেন যেন।

‘কী হল?’

তিন জোড়া দৃষ্টি সুদীপ্তর পানে নিবন্ধ। ফিরোজ লাফিয়ে উঠলেন সোফা ছেড়ে। মহিলা দু’জন দাঁড়িয়েই ছিলেন। হয়েছে কী?—প্রতিটি চোখে এই জিজ্ঞাসা। সুদীপ্ত কিন্তু সটান সোফাতে এলিয়ে পড়লেন। বেলা কি তার বাপের চিত্ত বৈকল্যের অংশ পেয়েছিল? সেই যেন অভিভূত হয়ে চুপ মেরে গেছে। নীলক্ষেতের বাসা, লাল জবা—কিছুই আর চাইবার নেই যেন।

‘কী হয়েছে? আর্মি নাকি!’

শুধুই একটু মাথা নাড়লেন সুদীপ্ত। জানিয়ে দিলেন—না। আর্মি আসেনি। আর্মি ছাড়া এতে ভয়ের কিছু এখন দেশে আছে নাকি! আমিনা স্বামীর মাথায় হাত রাখলেন, ফিরোজ গিয়ে বসলেন পাশে। কিন্তু সুদীপ্ত তাঁর পার্শ্বদেশে যাদের উপস্থিতি তখন উপলব্ধি করছিলেন তাঁদের মধ্যে ফিরোজের নাম ছিল না। মীনাক্ষী বা আমিনাও ছিলেন না। ছিল কয়েকটি লাশ। অচেনা লাশগুলির স্পর্শে তাঁর চেনা জগতের জীবনগুলি একে একে লাশ হয়ে যাচ্ছে। এবং সেই মড়কের মধ্যে তিনি বুকে চেপে ধ’রে বাঁচাতে চাইছেন তাঁর তিন বছরের কন্যাটিকে। তাই আমিনা যখন কন্যাকে নিজের কোলে নিতে গেলেন তখন বাধা দিলেন সুদীপ্ত। কিন্তু কিভাবে? ওকে বাধা দেওয়া বলে না। এ যেন প্রার্থনা–

‘না না, আমার মাকে কেড়ে নিও না আমার কোল থেকে।’

সুদীপ্তর এই মূর্তি ফিরোজ চিনতেন না। বাইরের কর্মজগতে চেনা বন্ধুদের ঘরোয়া পরিবেশের ছবি তো আমাদের অচেনাই থাকে। হ’তেই পারে না। এটা বুঝতে ফিরোজের আদৌ অসুবিধা হ’ল না যে, সুদীপ্তর স্বাভাবিক অবস্থা এটা নয়। এই অবস্থায় তাঁকে একাকী স্ত্রীর কাছে ছেড়ে দেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে–ফিরোজ ভাবলেন। উঠে জানলার কাছে গেলেন। এবং জানলা দিয়ে বাইরে কি যেন দেখলেন। তারপর বেরিয়ে গেলেন। ডাকলেন মীনাক্ষীকেও। মীনাক্ষী সুদীপ্তর মুখের উপর চোখ বুলিয়ে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন নীরবে।

স্বামীর মানসিক অবস্থা নিয়ে সচেতন হতে গেলে স্ত্রীদের চলে না। আমিনা স্বামীর মন নিয়ে কখনো মাথা ঘামান না। পুরুষের মনকে প্রশ্রয় দিলে তার আবদারের সীমা বেড়ে যায়। এতো বেড়ে যায় তখন তাকে সামলানো দায় হ’য়ে ওঠে। মতটা আমিনার। বিদুষী আমিনা বলেন–‘দীর্ঘকালে স্ত্রীদের মাথায় কাঁঠাল ভেঙ্গে খাওয়া স্বামীদের অভ্যাস। সে অভ্যাসটাকে আরো বাড়িতে দিলে মেয়েদের দাসীত্ব কখনো ঘুচবে না।’

অতএব নারীজাতির স্বার্থে আমিনা কখনো স্বামীর মন নামক পদার্থটিকে আমল দিতে শেখেন নি। সেজন্য সংসারের পক্ষে আশঙ্কাজনক কোনো ঝড়ের প্রাদুর্ভাবও লক্ষ্য করা যায় নি। ওটা আমিনার ভাগ্য। ভাগ্যিস তুই গোবেচারা স্বামী পেয়েছিস–মন্তব্যটা আমিনার বাল্যসখি সেলিমার।

ফিরোজ ও মীনাক্ষী বেরিয়ে গেলে স্বামীকে এবার একা পেয়ে আমিনা তাঁর কর্তব্য শুরু করলেন। স্বামীর দিকে দু’ পা এগিয়ে কোমরে আঁচল জড়িয়ে ঠিক চোখের উপর চোখ রেখে বললেন—

‘দুঃখটা তুমি একাই পেয়েছ নাকি।’

বারো বছরের পুরোনো স্ত্রীকে স্বামীর না চেনার কথা নয়। সুদীপ্ত স্ত্রীর মেজাজ টের পেলেন। স্ত্রী এখন চটেছেন। কিন্তু কি আর করা যাবে। কারো রাগকে আমল দেবেন–এমন অবস্থা এখন সুদীপ্তর কই? হাঁ, কিছু একটা বলে এখন স্ত্রীকে শান্ত করা প্রয়োজন। কিন্তু কারো প্রয়োজন মেটাতে গেলেও একটা শক্তি লাগে। কোনো শক্তিই সুদীপ্তর ছিল না বোধ হয়। চোখ তুলে স্ত্রীর দিকে তাকানোর কথাও মনে এল না।

‘হোক তোমার বন্ধু, তা হলেও পরের বাড়ি। এখানে ঐ নাটকটা না করলে চলত না।’

তবু সুদীপ্ত মুখ খুললেন না। স্ত্রী ব’লে চললেন—

‘দয়া ক’রে আর বোবা সাজতে হবে না। শোনো এখানেও অবস্থা সুবিধের নয়। যে কোনো সময় ফিরোজ সাহেরের খোঁজে আর্মি আসতে পারে। অতএব যাবে কোথায় এখন ভাবো।’

প্রাণপণ প্রয়াসে সুদীপ্ত শুধু বললেন–

‘আজ এখন আর কোথায় যাই! রাস্তায় যানবাহন নেই।’

‘তা নেই। তুমি এখানে এনে কি বিপদেই ফেললে আমাকে! বললাম, চল খালার বাসায় যাই, তুমি শুনলে না।’

হাঁ, আমিনা গতকাল এক ফাঁকে বলেছিলেন সে কথা। তেইশ নম্বরে ফিরোজ তখন সুদীপ্তর ফ্ল্যাটের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ইকবাল হলের দিকে চেয়ে ছিলেন। একটা ঘরে জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছিল, মশারি টাঙানো আছে। ফিরোজ যেন দেখছিলেন, উতলা বাতাসে জানলা দিয়ে বাইরে উড়ে পালাতে চাইছে মশারিটা! কারফিউ উঠে যাওয়ায় এই অবকাশে ওটা এখন যেন পালিয়ে বাঁচতে চায়। এর মালিককে তারা গুলি ক’রে মেরেছে। ওকে যদি পুড়িয়ে মারে। এখনও যে পোড়ায়নি সেইটেই ভাগ্য! ফিরোজ এইসব ভাবছিলেন। এবং আমিনা নিভৃতে ডেকে স্বামীকে বলছিলেন—

‘ফিরোজ ভাইকে বলি–আমাদের একটু খালার বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসুন।’

তা বলা যেতে পারে, তবে ফিরোজ নিজেই যখন আগ্রহ ক’রে তাঁর বাসায় নিয়ে যেতে চায়–

বাক্য শেষ করেন নি সুদীপ্ত। তাঁর চিন্তায় ছিল ফিরোজের সেই বিশাল বাড়ি! ওটা প্রায় খালিই পড়ে থাকে। এদের মাত্র স্বামী-স্ত্রীর সংসার। দরকার হলে একাংশ নিয়ে তাঁরা আলাদা সংসার পাততে পারবেন। নীলক্ষেতের যা অবস্থা তাতে অদূর ভবিষ্যতে সেখানে যে তাঁরা ফিরতে পারবেন তেমন সম্ভাবনা কই? অতএব মোটামুটি একটা দীর্ঘস্থায়ী ব্যবস্থা ফিরোজের বাড়িতে করা যেতে পারে। খালার বাসায় এটা সম্ভব হবে না! ফিরোজের বাসাতেও ব্যাপারটা যে খুব সহজ হবে তা নয়। হয়ত ফিরোজ ব’লে বসবেন–তা হ’লে বেরিয়ে যেতে হবে আমার বাড়ি থেকে এবং সুদীপ্ত বললেন–তা হ’লে তাই যাব। কী আর করা যাবে। বন্ধু ব’লেই তো আর সিন্দাবাদের নাবিকের মতো তোমার ঘাড়ের উপর বৃদ্ধ সেজে অনন্তকাল ব’সে থাকতে পারি নে। এইভাবে কথা চলবে কিছুক্ষণ। অগত্যা সুদীপ্ত যখন বেরিয়ে পড়তে উদ্যত হবেন, তখন অগত্যা রাজি হ’তে হবে ফিরোজকে। মোটামুটি এইসব সুদীপ্ত ভেবে রেখেছিলেন। এবং আমিনাও খালার বাড়ি খুব একটা পছন্দ করেন এমন নয়। খালা একটু দূর সম্পর্কের। তার মায়ের মামাতো বোন। তা ছাড়া দেখতে হবে, পাঁচ ছেলে ও দুই মেয়ে নিয়ে খালার সংসারটি কতো বড়ো। বড়ো মেয়ের না হয় বিয়ে হয়ে গেছে। কিন্তু বাকি ছ’জনের সংসারে তাঁরা গিয়ে যুক্ত হলে ব্যাপারটা খুব সুবিধার হবে না সেটা আমিনাও বোঝেন বৈ কি। অতএব ফিরোজের বাড়ি সম্পর্কে তিনি খুব আর আপত্তি প্রকাশ করেন নি। কিন্তু এখানে এসেই তিনি ভুলটা টের পেয়েছেন। না, মীনাক্ষী কিছু বলেন নি। এবং ফিরোজ তত বলতেই পারেন না আর বললেও সেটা সুদীপ্তকেই বলবেন। স্ত্রীলোকের সঙ্গে হাস্য-পরিহাস চলে কিন্তু যথেষ্ট আশঙ্কাজনক ও সিরিয়াস কোনো বিষয় নিয়ে আলোচনার পক্ষে ওই জীব একেবারেই অযোগ্য— মতটা ফিরোজের। অতএব বলাই বাহুল্য যে, এ বিষয়ে ফিরোজের আমিনার সাথে কোনো কথা হয়নি। কথাটা আমিনার কানে দিয়েছে পাশের বাড়ির প্রতিবেশিনী আফরোজা সাবির। প্রখ্যাত ব্যবসায়ী সাবির চৌধুরীর স্ত্রী। আফরোজা এক ফাঁকে এসে উপকারটি ক’রে গেছে। ব’লে গেছে–

‘আপনারা তো ভাই তপ্ত কড়াই থেকে এসে জ্বলন্ত উনুনে পড়লেন। এঁরা পাড় আওয়ামী লীগার। আর্মির নজর যোল আনা এদের পরে। আমরা পাশে থেকেই ভয়ে ভয়ে আছি।’

তা ভয় তাদের এখন হচ্ছে। কিন্তু দু’দিন আগেও যেটা ছিল সেটাকে কি বলা যাবে। সেকালের ভাষায় বলা যায় ভক্তি। এই পরিবার সম্পর্কে তাদের একটা ভক্তি বোধ প্রকাশ পেত–সাবির চৌধুরী বা তার স্ত্রী আফরোজা সাবির দু’জনেই কাউকে নিজেদের বাড়ির ঠিকানা দেবার সময় বলত–

‘আওয়ামী লীগের ফিরোজ সাহেবের বাড়িটা চেনেন? তার পশ্চিম দিকে আমাদের বাসা।’

কোথা থেকে সাবির চৌধুরী শুনেছিল, ফিরোজ সাহেব এবার প্রাদেশিক সরকারের মন্ত্রী হচ্ছেন। তারপর থেকেই ফিরোজের সঙ্গে দেখা হলে সালাম দেওয়া অভ্যাস করেছিল। এবং সে যে ফিরোজ সাহেবের প্রতিবেশী সে কথা যত্রতত্র বলে বেড়াচ্ছিল। সেই সাবির চৌধুরী গতকাল গিয়েছিল পুরোনো ঢাকায় খাজা সাহেবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। সেখান থেকে ফিরে ব’লে বেড়াচ্ছে, সে নাকি বাসা বদল করবে। আওয়ামী লীগের লোকের পাশে আর থাকবে না।

স্বামীর অনুরূপ স্ত্রী সচরাচর হয় না হয়ত। কিন্তু কখনো তো হয়ও। প্রাচীন সাহিত্যের উপমা অনুসারে হাঁড়ির মতন সরা এযুগেও একেবারে দুর্লভ যে নয়। তারই প্রমাণ সাবির চৌধুরী ও তার স্ত্রী আফরোজা সাবির। দুটি নামই অ্যাফিডেভিট ক’রে পাওয়া। সাবির চৌধুরীর পূর্ব নাম ছিল ছাবের আলি এবং আফরোজা ছিল আফজা। আফজা আই. এ. পাস। প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষয়িত্রী। ছাবের আলি বি. এ. ফেল ক’রে প্রথম দিকে একটা অফিসে কেরানী ছিল। মোনায়েম খান গভর্ণর হলে সহসা ছাবের আলি আবিষ্কার ক’রে যে, মোনায়েম খানের স্ত্রী হচ্ছেন তার মায়ের ফুপাতো বোনের ননদ। মায়ের বোন মানে খালা। ছাবের আলি খালাকে ধরে গভর্ণর হাউসের কৃপা লাভে সমর্থ হয়েছিল। তারপরেই হয়েছিল বি, ডি, মেম্বার এবং ওয়ার্কস প্রোগ্রামের কাজে বিস্তর কৃতিত্বের পরিচয় দিয়ে অঢেল টাকা কামিয়েছিল। সেই টাকার বলেই আজ সে ঢাকা শহরে মাসে অন্ততঃ কয়েক হাজার টাকা উপার্জনক্ষম ব্যবসায়ী। কিন্তু এই উপার্জন কার বদৌলতে। আয়ুব খান মৌলিক গণতন্ত্র না খুললে? কোথায় থাকতো সাবির চৌধুরীর ব্যবসা। সে কি সাবির চৌধুরীই হ’তে পারত? আজো সেই ছাবের আলি হয়ে থাকতে হ’ত। অতএব আয়ুবের পতনে সত্যই যাদের চোখের জল পড়েছিল সেই তাদের একজন ছাবের আলি, ওরফে সাবির চৌধুরী। অতঃপর বড়ো দুর্দিন গেছে সাবিরের। তাকে দুর্দিনই বলে। বহু যত্ন সত্ত্বেও আওয়ামী লীগের শিবিরে ঢোকার কোনো প্রয়াস তার সফল হয়নি। কিন্তু কোন প্রয়াসই কি পৃথিবীতে একেবারে ব্যর্থ যায়? সহসা এক সময় প্রতিবেশী ফিরোজ সাহেবের কথা মনে হয়েছিল সাবিরের। এবং তার পরেই। আফরোজা সাবির সেদিন বিকেলে একটু বিশেষ রকমের প্রসাধন ক’রে মীনাক্ষীর সঙ্গে আলাপ করতে গিয়েছিল। হাজার হলেও প্রতিবেশী। এতোদিন যে আলাপ-পরিচয়টা হয় নি সেটা দুর্ভাগ্য বৈ কি। আধুনিক নগর জীবনের এই হচ্ছে সব চেয়ে বড়ো অভিশাপ।

‘মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্কটা এখানে তাই বড়ো শিথিল, আমার তো একটুও ভালো লাগে না।’

বলেছিল আফরোজা। প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষয়িত্রী এই কথাটি বলবার জন্য অনেক তালিম নিয়েছিল মনে মনে। কিন্তু কাজ হয় নি। মীনাক্ষী অতি সরল মেয়ে। খুব সরল বুদ্ধিতেই তিনি বলেছিলেন–

‘তা আর কি করবেন বলুন। সবাই এখানে আপন আপন স্বার্থ নিয়ে ঘোরে কিনা তাই নিঃস্বার্থ হৃদয়–সম্পর্কের কারবারটা বড়ো একটা চলে না এখানে। তা ছাড়া হাতে সময়ও থাকে বড়ো কম। এখানে লোকের কতো কাজ।’

ওহ, মাগী কি সেয়ান দেখেছ। ঠিকই সন্দেহ করেছে গো। অতএব সেদিন আর আলাপ খুব জমে নি। কেবল লাভের মধ্যে এটুকু হয়েছিল, ফিরোজের দেখাটা শেষ পর্যন্ত মিলেছিল। প্রথমেই গিয়ে যখন সে জেনেছিল যে ফিরোজ বাড়িতে নেই তখন বেশ আফসোস হয়েছিল। এতো যত্নের সকল সাজগোজ কি ব্যর্থ হবে? শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ যে হয় নি তাতে খুবই খুশি হয়েছিল আফরোজা। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরোজ ঘরে ফিরেছিলেন। আফরোজা তখন বুকের আঁচল ঠিক করতে গিয়ে সম্পূর্ণ আঁচলটাকেই দু-হাতে সরিয়ে নিয়েছিল। এবং সাদা ডিমের মতো ফর্সা পেটের ইঞ্চি ছয়েক অনাবৃত অংশে ফিরোজের দৃষ্টি আকর্ষণ ক’রে এমন কায়দায় আঁচলটাকে তাড়াতাড়ি ঘাড়ের উপর স্থাপন করেছিল যে সেখানে তা স্থায়ী হয়েছিল কয়েক সেকেণ্ড মাত্র। রেশমের শাড়ির আঁচল—একটা আদাব দেবার চেষ্টা করতেই ঘাড়ের উপর থেকে খসে পড়েছিল। ব্লাউজের নামে আফরোজা যেটা পরেছিল সেটাকে ব্রেসিয়ারের একটু চওড়া সংস্করণ বলেই মনে হয়েছিল ফিরোজের। কেবল স্তন দুটি ছাড়া আর সবি দেখা যায়। কিন্তু দেখতে কি ভালো লাগে? প্রাইমারী স্কুলের মাস্টারনী আফরোজাকে ফিরোজের ভালো লাগে নি। তবে একটা লোভ হয়েছিল। রমণীর অনাবৃত দেহাংশ পুরুষচিত্তে স্বাভাবিক একটা লোভের সঞ্চার করেছিল। ওটা ভালগালা নয়। ভাল লাগা ও লোভ লাগা কি এক। তবে লোভটাকে ফিরোজ অস্বীকার করেন না। আফরোজার দেহ-সৌন্দর্য ফিরোজ অস্বীকার করেন নি। মধ্যবয়সী, তবুও তনু তোমার/আশ্বিন আলো ছড়ায় আমার মনে। ফিরোজ একটু ভেবে দু’ছত্র কবিতা স্মরণ করেছিলেন। কিন্তু আফরোজার দেহ ঘিরে আশ্বিন আলোর উৎসবকে ফিরোজ কি সত্যই প্রত্যক্ষ করেছিলেন? তবু দুই চক্ষের প্রশংসা দিয়ে তাকে চেটেছিলেন। আফরোজাকে ঘিরে কোনো কবিতার চরণ স্থানকালপাত্রপোযোগী বলে মনে হয় নি। তবু তার সঙ্গেই হেসে কথা বলেছিলেন। যদিও মামুলি কথা, তবু তাতেই খুশি হয়ে আফরোজা বাড়ি ফিরেছিল। বিশেষ ক’রে খুশি হয়েছিল ফিরোজের শেষ বিদায় বাক্যটিতে।–

‘আসবেন আবার। আবার দেখা হবে এই আশায় থাকলাম।’

শুনে আফরোজার দেহ ঐ মুহূর্তেই গ’লে জল হয়ে যেতে চেয়েছিল। বেশি নয়, ফেব্রুয়ারি মাসের কথা সেটা। মাস খানেক মাত্র পার হয়ে পঁচিশে মার্চ পৌঁছতেই ফিরোজের সামনে এখন বেগম আফরোজা সাবির মধ্যযুগীয় কুলবধূ হয়ে উঠেছে। পর-পুরুষের সামনে লজ্জা দেখাতে হয়।

সেই আফরোজা গতকাল থেকেই ফাঁক খুঁজছিল। গতকাল সুদীপ্তরা যখন এখানে এসে পৌঁছলেন, তখনই জানলার ফাঁক দিয়ে দৃশ্যটা দেখে নিতে আফরোজা ভুল ক’রে নি। অতঃপর আজ এই বেলা এগারটার দিকে এসে এক সময় আমিনাকে একা পেয়ে বলে গেছে—এঁরা পাড় আওয়ামী লীগার। আর্মির নজর ষোল আনা এদের পরে।

কথাটা কিছু অস্বাভাবিক তো মনে হয় নি। আমিনার মনে হয়েছিল এ কথা আগেই তাঁরা ভাবতে পারতেন। ভাবা উচিত ছিল। হাঁ তো, আওয়ামী লীগারদের এখন বিপদ বৈ কি। এবং সে বিপদ এখানে এলে তাদের ঘাড়েও কিছুটা পড়তে পারেই তো। অতএব সরে যাওয়া কর্তব্য। সেই কর্তব্যের কথা তিনি স্বামীকে স্মরণ করিয়ে দিলেন। এবং ঐ পর্যন্ত। রাস্তায় যানবাহন নেই। অতএব অচলাবস্থা।

স্বামী-স্ত্রী, সুদীপ্ত ও আমিনা, দুটি পৃথক সোফায় নিঃশব্দে মুখ গুজে বসে রইলেন।