» » চতুর্দশ পরিচ্ছেদ

বর্ণাকার

চতুর্দশ পরিচ্ছেদ

মন যে ঘুরে ঘুরে ঐখানেই যেতে চায়। ঐ সেই নারকীয় রাত্রির চত্বরে। তেইশ নম্বরে শেষ দুটি রজনীর নানা প্রহরের গলিতে নিশী-পাওয়া ব্যক্তির মত ঘুরে ঘুরেই মরতে হবে? যে-কোন মুহূর্তে নির্জন পেলেই সুদীপ্তর মন তৎক্ষণাৎ সেই দুটি রজনীর অধিবাসী হয়ে উঠে।

কিন্তু আমিনা? তিনি এখন ঠিক তেমনিভাবে ব’সে আছেন যেমন ব’সে ছিলেন সেই গতকাল সকালে। কারফিউ উঠার সময়। কারফিউ উঠলে আমিনা ঘর থেকে বেরিয়ে নিঃশব্দে এসে বারান্দায় বসেছিলেন। ইকবাল হলের দিকে চোখ রেখে একটা চেয়ারে যেন সহসা পুতুল হয়ে গিয়েছিলেন। সুদীপ্ত যখন বাইরে যাবার পোশাকে ঘর থেকে বেরিয়ে স্ত্রীকে বলেছিলেন–

‘আমি একটু নীচে থেকে আসি।’

আমিনা তখন কোনো কথা বলেন নি। ছত্রিশ ঘণ্টা পর সবে তখন কারফিউ উঠেছে। রাস্তায় মানুষ বেরুতে শুরু করেছে। নীচেও জমা হয়েছে কিছু মানুষ। সুদীপ্ত দোরগোড়া পর্যন্ত গিয়ে ফিরে এলেন। আমিনা বাধা দিচ্ছেন না দেখে খুবই অবাক হয়েছিলেন তিনি। বললেন–

‘আশে পাশে একটু ঘুরে দেখে আসব। আধ ঘণ্টা খানেক দেরি হতে পারে। তোমরা ঘাবড়ে যেও না যেন। আর তৈরি হয়ে থেকো। এখানে থাকা যাবে না। কোথাও কেটে পড়তে হবে।’

না। তাও কিছু বললেন না তাঁর স্ত্রী। স্ত্রীকে এমন অনুগত তাঁর বিবাহিত জীবনে একদিনও দেখেন নি সুদীপ্ত। স্ত্রীর মুখের উপর সেই মুহূর্তে কী দেখেছিলেন সুদীপ্ত। প্রায় সারা রাত না ঘুমিয়ে ভোরের দিকে গুলি-গোলার আওয়াজ কিছুটা কম হতেই ছেলে-মেয়েরা একটু ঘুমিয়েছে। এখনো ঘুমিয়েই আছে তারা। কিন্তু স্বামী স্ত্রী কেউ ঘুমোন নি। কেউ কাউকে কথাও খুব একটা বলেন নি। স্ত্রী আমিনার চোখে কেমন একটা নির্বিকার ভাব। স্বামী এখন কোথায় যেতে চায়, এখনি বেরুতে গেলে কোন বিপদ হতে পারে কি না, একান্তই যদি বেরুতে চায়, কতক্ষণে তবে ফিরতে পারবে—ইত্যাদি বহু প্রশ্নই তো এখন আমিনার থাকার কথা। কিন্তু কোন প্রশ্নই স্ত্রীর চোখে সুদীপ্ত দেখলেন না। এখন সুদীপ্তও যেন কেমন হয়ে গেছেন। তা না হলে এমন নিরুৎসুক, যেন প্রাণহীন স্ত্রীকে রেখে কি বেরিয়ে পড়তে পারতেন? মেয়েটার হ’ল কি—এমন একটা প্রশ্ন অন্ততঃ একবারও তো মনে জাগতে পারত। কিন্তু জাগেনি। বিশ্বাস, বিস্ময়, উৎসাহ এবং কৌতূহলের যে সকল গ্রন্থি জীবনকে নানা জগৎ-ব্যাপারের সঙ্গে গ্রথিত রাখে তার সব কটি কি ম’রে গেছে সুদীপ্তর মধ্যে? তা হলে এখন বাইরে বেরুনোর ঝোঁকটাই বা মাথায় চাপে কেন?

সত্যকার বাইরে বেরুনো কাকে বলে সেটা বারান্দায় বেরিয়েই কিঞ্চিৎ টের পেয়েছিলেন সুদীপ্ত। গত ছত্রিশ ঘণ্টা এই বারান্দায় তারা কেউ পা দিতে পারেন নি। ঘরের সংলগ্ন বারান্দা। সেখানেও পা দিতে ভয়! ভয় তো হবেই। বারান্দায় পা দিলেই ইকবাল হলের মসজিদের ছাদে মরা মানুষের সারি সারি লাশগুলো দেখা যাচ্ছিল। এখনো দেখা যাচ্ছে। এবং শেষ পর্যন্ত দেখা গিয়েছিল। কাক-শকুনে খেয়ে নেবার পর সেখানে কঙ্কাল পড়ে ছিল আঠারোই এপ্রিল পর্যন্ত। সুদীপ্ত সে সব জানতেন না। জানতেন না যে, তাদেরও ছাদে তিরিশ-চল্লিশ জনের মৃতদেহ, অবশেষে কঙ্কাল, অমনি পড়েছিল এপ্রিলের আঠারো তারিখ পর্যন্ত। অতঃপর সরানো হয়। সরানো না হতেও পারতো। কিন্তু বাহির বিশ্বে পাকিস্তান যে সকলের মুখ হাসিয়েছিল। কেলেঙ্কারি যা করেছিল তা নিয়ে বাইরের লোকের কানাকানির অন্ত ছিল না। সর্বত্র বদনাম কুড়োতে হচ্ছিল। অতএব সতীত্ব প্রমাণের তাগিদেই তখন কিছু কিছু সাংবাদিককে এ দেশ দেখে যাবার অনুমতি না দিয়ে তার আর উপায় ছিল না। এবং তখন অতি দ্রুত তার কুকীর্তির চিহ্নগুলি মুছে ফেলার জন্য তাকে তৎপর হতে হয়েছিল। অতএব কঙ্কালগুলি সরানো হয়েছিল, বস্তির আধ-পোড়া টিন-কাঠ প্রভৃতি সরিয়ে তার উপর দিয়ে রাস্তা নির্মাণের পাঁয়তারা শুরু হয়েছিল। এবং কামানের গোলায় বিধ্বস্ত বাড়ি ও দেওয়াল মেরামতের হিড়িক পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু ব্যাপারটা পাকিস্তানিরা যত সহজ ভেবেছিল আসলে তত সহজ ছিল না। অত ধ্বংসস্তূপ কদিনে মানুষ সরাতে পারে। সরাতে গেলে তো সময় আরো বেশি লাগে। অতএব সোজা উপায় — পোড়ানো বস্তির উপর দিয়ে বুলডোজার চালিয়ে পার্ক কিংবা রাস্তা বানিয়ে দাও। তাতে সময় বাঁচানো যাবে, কর্মীও লাগবে কম। কর্মী পাওয়াটা শহরে তখন একটা সমস্যা। গরীব লোকগুলো বেশির ভাগই হয় সংসার ত্যাগ কিংবা শহর ত্যাগ করেছে। এত দ্রুত সকলে শহর ত্যাগ করেছে যে, নিকট আত্মীয়ের মৃতদেহ পর্যন্ত কেউ সরাবার এবং গোর দেওয়ার বা দাহ করার কথা ভাবে নি। জননীও তার কোলের ছেলেকে কাক-শকুনের কাছে সঁপে দিয়ে পালিয়েছে, কিংবা পালাতে গিয়ে বন্দিনী হয়ে ক্যান্টনমেন্টে আশ্রয় পেয়েছে–দেশের জওয়ানদের মনোরঞ্জনের ভার নিতে হবে তাকে। হবে না! জওয়ানরা তোমাদেরকে বাঁচানোর জন্য এসেছে সেই সুদূর পাঞ্জাব মল্লুক থেকে, আর তাদেরকে একটু আমোদ দেবার জন্য তোমাদের মেয়েরা সতীত্বটুকু দিতে পারবে না! এই তোমাদের দেশপ্রেম! দেখছ না, জওয়ানরা তোমাদের জন্য কতো যুদ্ধ করেছে!

অবশ্যই নিরস্ত্র বাঙালির বিরুদ্ধে যুদ্ধ। কিন্তু সেইটুকুর জন্যই সেনাবাহিনীর পূর্ণশক্তি পাকিস্তানকে নিয়োগ করতে হয়েছিল। গোলন্দাজ বাহিনী, ট্যাঙ্ক ও সাঁজোয়া বাহিনী, বিমান বাহিনী, নৌ বাহিনী–বাকি ছিল কোনটা? কিচ্ছু না। শুধু যদি বিমান বাহিনীর ব্যবহার না করতে, তা হলেই দেখা যেত কত বীর তোমরা। কার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল পাকিস্তানের বীর সৈনিকের দল? অসহযোগ আন্দালনে ব্রতী দেশবাসীর বিরুদ্ধে। হাতে অস্ত্র নিয়ে কেউ অসহযোগ আন্দোলনে নামে না। বাঙালির হাতে পদাতিক বাহিনীর অস্ত্র ও ছিল না— বিমান বাহিনী ও নৌ-বাহিনীর কথা তো ওঠেই না। এ হেন বাঙালির বিরুদ্ধে নৌ, বিমান ও সাঁজোয়া বাহিনীর সম্মিলিত আক্রমণ। তাও সে বীরপুঙ্গবেরা দিনের আলোয় বেরুতে সাহস ক’রে নি। এসেছিল রাতের আঁধারে। সুদীপ্তরা তখন ঘুমিয়ে পড়েছেন।

প্রলয়-গর্জনে সুদীপ্তর যখন ঘুম ভেঙ্গেছিল তখন কত রাত? ঐ মুহূর্তে তিনি ঘড়ি দেখেন নি। এতে শব্দ কিসের সেই কথাটিই সুদীপ্ত বিছানায় শুয়ে থেকে একটু ভাবতে চেষ্টা করেছিলেন। ক্লাব থেকে ফেরার সময় গত সন্ধ্যাকে অস্বাভাবিক কিছু মনে হয়েছিল কি? ক্লাবেও তো কোনো অস্বাভাবিকতার আভাস মেলেনি।

উহ্, কী ভয়ঙ্কর শব্দ রে বাবা! এ যে শব্দের পর শব্দ সাজিয়ে মালা গাঁথার দুশ্চেষ্টা। টা-টা-টা-টা……. পট্-পট্-পট্……গুড়ুম—দ্রুম্ …হুডুম। একই সঙ্গে শব্দের এতো বিচিত্র চেহারাকে সুদীপ্ত কখনো দেখেন নি। ঠিক ঘটছেটা কী? ইতিমধ্যে আমিনাও জেগে উঠেছেন।

‘ওগো কী হয়েছে! শুনছো?’

‘আমি তো অনেকক্ষণই শুনছি।’

সুদীপ্ত উঠে বাইরে এলেন। উত্তর দিকের বারান্দায় গিয়ে দেখেন, পশ্চিম দিকের রেল–কলোনির ঘর-বাড়ি জ্বলছে। উত্তর-পূর্ব কোণেও আগুন। আগুন কোনদিকে নেই? আর সব দিক থেকে ভেসে আসছে অসহায় মানুষের আর্ত চীৎকার। শুরু হয়েছেটা কী? ফজলুর রহমান সাহেবকে ডাকবেন নাকি! দক্ষিণের বারান্দায় এলেন সুদীপ্ত। রান্নাঘরের দোরগোড়ায় দাঁড়ালেন গিয়ে। ওইখানে দাঁড়ালে নিচের তলায় ফজলুর রহমান সাহেবের বারান্দা দেখা যায়। ভদ্রলোকের স্ত্রী বিলেতে। পি. এইচ. ডি. করতে গেছেন। কয়েক মাসের মধ্যে রহমান সাহেবও যাবেন কথা আছে। আপাতত বিরহ যাপন করছেন। এ নিয়ে প্রায়ই সুদীপ্ত আজকাল রহমান সাহেবকে জ্বালিয়ে খাচ্ছিলেন। ‘জ্বালিয়ে খাওয়া’ কথাটা রহমান সাহেবেরই।

‘আপনি আমাকে জ্বালিয়ে খেলেন দেখি। দাঁড়ান, কালই প্লেনের টিকিট কাটছি।’

‘ব্যাস্, একখানা টিকেটেই বিরহের অবসান! রঙ্গ-রসিকতার মূল্য কতো টুকুই বা! কিন্তু এই সব নিয়েই চলছিল উপরে নিচে দুজন অধ্যাপকের পাশাপাশি দুটি জীবন-ধারা। কয়েক ঘণ্টা আগেই ঠিক এই রান্নাঘরের দোর গোড়াতে দাঁড়িয়েই সুদীপ্ত ফজলুর রহমানের খাওয়া দেখছেন। বারান্দায় টেবিল পেতে সেখানে রহমান সাহেবেরা খাওয়া-দাওয়া করেন এবং সে জায়গাটা এখান থেকে স্পষ্ট দেখা যায়। সুদীপ্ত দেখছিলেন। আর মনে মনে আগামীকাল কী-ব’লে রহমান সাহেবকে বিব্রত করবেন তার একটা রিহার্সাল দিচ্ছিলেন।

দেখুন রহমান সাহেব, অন্যায় একটা করেছি। তবে আপনার গৃহিণী থাকলে করতাম না।

এইভাবে ভনিতা ক’রে কথা শুরু করতে হবে। তারপর তুলতে হবে সেই ডাল মেখে ভাত খাওয়ার কথা। কিন্তু হায়, সুদীপ্ত কি তখন জানতেন যে, সে কথা তুলবার কোনো সুযোগই সারা জীবনে আর পাবেন না।

কয়েকবার সুদীপ্ত রহমান সাহেবের নাম ধ’রে ডাকলেন। কিন্তু বাইরের এতো আওয়াজে সুদীপ্তর ক্ষীণ আওয়াজ কারো কানে গেল না বোধ হয়। ইতিমধ্যে আমিনা এসে হাত ধ’রে সুদীপ্তকে ডাকলেন—

‘ওগো পাগল হ’লে তুমি। শিগ্‌গির ঘরে এসো। দেখছ না, কীভাবে চারপাশে গুলি ছুটছে। তোমাকে লাগতে পারে তো।’

তা তো পারেই। খোলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা নিরাপদ নয়। স্ত্রীর সঙ্গে সুদীপ্ত ঘরে এলেন। ছেলে-মেয়েরা তখন সকলেই জেগে উঠেছে। ঘরের মধ্যেও জানলা দিয়ে গুলি এসে তাঁদেরকে লাগতে পারে। আমিনা অতএব খাটের নিচে ঢুকলেন অনন্ত ও এলাকে নিয়ে। ছোট মেয়ে বেলা বাপের কোলে। বাপের কোল যখন পাওয়া গেছে তখন সে নিঃসন্দেহে নিরাপদ। নিরাপত্তার বোধটুকু বেলার ক্ষুদ্র বুকে সঞ্চারিত হওয়া মাত্রই ভীতি প্রকাশের সাহস পেল মেয়ে। এতক্ষণ কাঁদতেও যেন ভয় পাচ্ছিল।

‘আব্বু, ওইখানে চল না। ভয় করে।’

খাটের নিচে আঙুল দিয়ে দেখাল মেয়ে।

‘হ্যাঁ মা, চল যাই!’

খাটের নিচে বস্তায় এক মণ চাল ছিল। সুদীপ্ত সেই বস্তাটাকে সামনের দিকে একটা আড়াল সৃষ্টির চেষ্টা করলেন। কিন্তু এক মণ মাত্র চালের আড়ালে ক’জন আর লুকোতে পারে!

গুডুম–দ্রুম্ ‥ট্রা-রা-রা-রা…‥টা-টা-টা-টা-…ট্রা-রা-রা-রা…টা-টা… দ্রুম–গুড়ুম……।

কতো রকমের মারণাস্ত্র ব্যবহার করছে ওই বর্বরের দল! এবং আমাদের বিরুদ্ধে। আল্লাহ, আমাদের হাতে দুটো মর্টার কিংবা মেশিনগান যদি থাকত! একটা বন্দুকও নেই যে! এমনি খালি হাতে মরতে হবে। একেবারে খালি হাতে দাঁড়িয়ে মরতে হবে কথাটা মনে হতেই সুদীপ্তর কান্না পেল। পৃথিবীতে আজও বর্বর দানবের অস্তিত্ব যখন আছে তখন পুরোপুরি অস্ত্র বর্জন ক’রে লেখনী হাতে নেওয়া বাঙালির উচিত হয় নি। ঠিক এমন একটা অবস্থার মুখোমুখি না হলে এই জ্ঞানোদয়টা সুদীপ্তর কখনোই হত না।

ওরা এবার খুব কাছাকাছি এসে গেছে মনে হচ্ছে। তাদের বিল্ডিংয়ের পাশেই ওদের চিৎকার ক’রে বলা দু-একটা কথা কানে আসছে। কিন্তু কি বলছে বোঝা যাচ্ছে না। বোঝা গেল আমিনার কণ্ঠস্বর—

‘ওগো আল্লাহ্‌কে ডাক।’

ছাদে কিছুক্ষণ আগে থেকেই পদশব্দ শোনা যাচ্ছিল। সম্ভবতঃ রেলকলোনির মানুষ ওরা। ওদের কলোনি আক্রান্ত হ’লে যারা পেরেছে কোনো মতে প্রাণ নিয়ে এসে লুকিয়েছে।

কিন্তু লুকিয়েছে কোথায়? এই তো, তেইশ নম্বরও এখন তিন দিক থেকে গুলিবিদ্ধ হচ্ছে। সুদীপ্তদের জানলার কাঁচ ভেঙ্গে দু-একটি গুলি ঘরের মধ্যে এসে পড়তে শুরু করেছে।

‘ওগো, ওরা আমাদের মেরে ফেলবে। আল্লাহ্ বাঁচাও। ইয়া আল্লাহ্। ওগো তোমরা সব আল্লাহ্‌কে ডাক।’

‘আল্লাহ্, তোমার শক্তি এই মুহূর্তে কয়েকখানা মর্টার-মেশিনগান হয়ে আমাদের হাতে আসুক।’

–সহসা প্রচণ্ড ক্রোধে সুদীপ্তর দু’চোখ জ্বলে উঠল। কিন্তু নিভে গেল পরক্ষণেই। এদিকে সুদীপ্তর বুকের মধ্যে বেলা তার আব্বার কথা একটুও বোঝে নি। কিন্তু মায়ের কথা বুঝেছে ঠিকই। সে ততক্ষণে তার মায়ের অনুকরণে শিশু-কণ্ঠে আল্লাহ্‌কে ডাকতে শুরু করেছে–

‘আল্লাহ্ আল্লাহ্—আচ্ছা আব্বু, ওরা আমাদের মারবে কেন?’

মা গো, এ কথার কি জবাব তোমাকে আমরা দেব! ওরা আমাদের মারবে কেন? —মানব-শিশুর এই প্রশ্নের উত্তর আমরা চাইব কার কাছে? মানুষের কাছেই তো। কিন্তু মা, ওরা যে মানুষ নয়। মানব-জীবনের মূল্যবোধ নিয়ে কথা উঠলে ওরা যে, পশুর পর্যায়ে পড়ে। হাঁ, এই সবি ছিল সুদীপ্তর মনের কথা। বলতে পারলে এই সব কথাই সে মেয়েকে বোঝাত। কিন্তু সেই মুহূর্তে সব কথা বুকের মধ্যে শুকিয়ে গিয়েছিল। কোনো কথাই সুদীপ্ত বলতে পারেন নি।

সিঁড়িতে পদশব্দ সুদীপ্ত শুনতে পান নি। কয়েকটি ভারি বুটের শব্দ বুলেটের আওয়াজে ডুবে গিয়েছিল। সিঁড়ির প্রতি ধাপে তারা গুলি করতে করতে এগিয়েছিল। প্রথমে ছাদের উপরে। ছাদের ছুটাছুটির শব্দ, আর বেধড়ক বুলেটেবাজি। কেবল একপক্ষের বুলেট আর-এক পক্ষ দাপাদাপি ক’রে মরছে? মারছে না? কী দিয়ে মারবে? শেখ সাহেব অহিংস আন্দোলন শুরু করেছিলেন। অস্ত্রের কথা কেউ তো ভাবে নি। এবং সকলেই ভেবেছিল, নিরস্ত্র মানুষকে ওরা প্রচণ্ডতম অস্ত্র দিয়ে আঘাত হানবে এটা হতেই পারে না। কিন্তু “ওরা” মানে কারা—সেই কথাটা কারো চিন্তায় একবারও আসে নি।

‘ওগো ছাদে কারা গো! সব মেরে ফেলল।’

আমিনার কণ্ঠস্বরে বঙ্গজননীর মমতা ও করুণ কোমলতা প্রকাশ পেল। কিন্তু সুদীপ্তকে তা স্পর্শ করল না। তিনি তখন একটি স্বার্থপরতাকে আঁকড়ে ধরে ভাবতে চাইছিলেন, ছাদ থেকে এবার ওরা নেমে যাবে। ছাদের লোকগুলিকেই ওরা মারতে উঠেছে। তাদের ঘরে ওরা ঢুকবে না নিশ্চয়ই। কেন ঢুকবে? তারা নিরীহ শিক্ষক বৈ তো নন। হাঁ, রাজনৈতিক মত একটা তাদের আছে। সে তা সব মানুষেরই থাকে। কিন্তু সক্রিয় রাজনীতি তো কখনো করেন নি। অতএব, নেহি বেরাদর, কোনো অতএব নেই। টিক্কা খাঁর ঢালাও হুকুম—বাঙালিদের বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দাও, তাদের হত্যা কর, তাদের রমণীদের ধর্ষণ কর। অতএব সুদীপ্তর ফ্ল্যাটে প্রবেশ-দরজায় ধাক্কা পড়ল। প্রচণ্ড ধাক্কা। কিন্তু ধাক্কা দিয়ে খোলা যাবে না। সুদীপ্ত জানেন তাদের প্রত্যেকটি ফ্ল্যাটের প্রবেশ দরজা দুটি—একটি দিয়ে ঢুকলে প্রথম পাওয়া যায় বারান্দা, অন্যটি দিয়ে এলে পাওয়া যায় বাইরের বসবার ঘর। দু’টি দরজাই বেশ মজবুত এবং ভেতর থেকে শক্ত ছিটকিনি দিয়ে আঁটা। তা হলেও সামরিক বাহিনীর লোকেরা কি আর চেষ্টা করলে ঐ খিল ভাঙতে পারবে না? নিশ্চয়ই পারবে। কিন্তু কষ্ট কিছুটা হবেই। এবং কষ্ট করেই যদি ওরা ঢোকে তা হলে ভাগ্যে নির্ঘাত মৃত্যু। তার চেয়ে নিজে খিল খুলে দিয়ে ওদের কাছে আত্মসমর্পণ করাই তো ভালো। সুদীপ্ত মন স্থির করতে সময় নিয়েছিলেন দু-চার সেকেণ্ডের বেশি নয়। বেলাকে বুক থেকে সরিয়ে মায়ের কাছে দিয়ে চট ক’রে বেরিয়ে এলেন খাটের নিচ থেকে। জামা গায়ে পরতে পরতেই ঘর খুললেন! কিন্তু বারান্দায় পা দিতেই অনুভব করলেন পেছন থেকে স্ত্রী তাকে জড়িয়ে ধরেছেন।

‘ওগো তুমি পাগল হ’লে! ওই হাইয়ানদের সামনে যেতে আছে! শিগ্‌গির ঘরে এসো।’

ঠিক সেই মুহূর্তে। সৈনিকদের গুলিতে ড্রয়িংরুমের প্রবেশ-দরজার ছিটকিনি ভেঙ্গে গিয়ে প্রবল শব্দে দরজা খুলে গেল। সেই সঙ্গে মুহুর্মুহু গুলির আওয়াজ। ড্রয়িংরুমে ওরা কি আস্ত ব্যাটেলিয়ানের মুখোমুখি হয়েছে? ঘরটা যে গুলি ক’রে ঝাঝরা ক’রে ফেলল! কিন্তু সুদীপ্তর ভাবনারা তখন কোথায়! সেই যে চিন্তাটা তাঁকে ঘর থেকে বারান্দায় এনেছিল সে হঠাৎ অদৃশ্য হ’ল যেন। প্রচণ্ড ঝড়ে আন্দোলিত ডালে কি পাখি থাকতে পারে? স্বামী-স্ত্রী দু-জনেই ছুটে এসে ঢুকলেন খাটের নিচে। ঘরের দরজা পর্যন্ত ভেজানোর বুদ্ধিটুকুও তখন তাদের লোপ পেয়ে গেছে—খাটের নিচে বাপ-মা তাদের পুত্র-কন্যাদের বুকে জড়িয়ে ধরে মেঝেতে মাথা গুজলেন। আল্লাহ্, রক্ষা কর। রক্ষা কর। বাঁচাও।

হ্যাঁ, আল্লাহই তাঁদেরকে বাঁচালেন। তা না হ’লে ঘরে ঢুকে বিছানা খালি দেখেই ফিরে যাবার জন্য পা বাড়াবে কেন তারা? একটু উঁকি মেরে খাটের নীচেটা দেখার কথা তো সহজেই মনে হ’তে পারত। হয় নি যে, ওইটুকুই আল্লাহ্‌র রহমত। এমনি ক’রেই তার প্রেম নেমে আসে মানুষের জন্য। আরো দেখ, সৈনিকরা যাবার সময় খালি বিছানার এক কোণে শেল মেরে আগুন ধরিয়ে দিয়ে গেল। কাণ্ডটা তারা বিছানার মাঝখানে করতে পারত, কিবা একাধিক শেল ছুঁড়তে পারত সারা বিছানা ভরে। কিন্তু না। এক মুহূর্তও দাঁড়ায় নি তারা। ঘরে তাদের স্পর্শযোগ্য কিছু ছিল না। কেবল বই ছিল—রাশি রাশি বই। ও ভি শায়তান কা হাতিয়ার—বই হচ্ছে শয়তানের হাতিয়ার। অতএব সেই দিকেও তারা একটা শেল ছুঁড়ে দিয়ে একটা আলমারিতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল এবং ঐটেই আল্লাহর কৃপা যে, বই-বিছানা সব পুড়ে-যাওয়ার দৃশ্যটা তারা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে নি।

‘সালা বাঙালি কুত্তা ভাগ গিয়া।’

বলতে বলতে বেরিয়ে চলে গেল ওরা। একটা আলমারিতে ও খাটের এক কোণে আগুন ধরে গেছে ততক্ষণে। আর তো খাটের নিচে থাকা চলে না। কিন্তু সৈনিকরা যদি বাইরে ওত পেতে বসে থাকে। না, থাকবে না। ওরা না জেনে গেছে, বাঙালি কুত্তা ভাগ গিয়া। তবু যদি–। না, না যদি-র কোন অবকাশ নেই। পুড়ে মরার চেয়ে গুলি খেয়ে মরা ভাল। সকলে বেরিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে স্নান-ঘরে গিয়ে ঢুকলেন। ভাগ্যক্রমে কলে পানি ছিল। আগুন তখনও খুব বেশি ছড়ায় নি। ওরা স্বামী-স্ত্রীতে সহজেই সে আগুন নিভিয়ে ফেললেন। আর তাঁরা কেউ খাটের নিচে গেলেন না। মেঝেতে বসে থেকেই এখন বাকী রাতটুকু কাটাবেন। কিন্তু কাটাবেন কী করে। ওরে মা রে, এ কি আওয়াজ!

এতো প্রচণ্ড আওয়াজ সুদীপ্ত কখনো শোনেন নি। এতক্ষণ এই আওয়াজটা কই ছিল না। সম্ভবতঃ কামান দাগছে ওরা, কিন্তু কোথায়? সারা এলাকার ঘরবাড়ি সব ধূলিসাৎ ক’রে দেবে নাকি। গুলির হাত থেকে বেঁচে এখন ছাদচাপা পড়ে মরতে হবে। উহ্ কি বিকট আওয়াজ। আর গন্ধ। বিশ্রী ঝাঁঝালো গন্ধে বাতাস ভরে গেছে। ছাদ যদিও মাথায় না ভেঙ্গে পড়ে তা হলেও এই গন্ধেই মরতে হবে। এই কূটগন্ধ দূষিত বাতাস কিছুক্ষণ টানলেই নির্ঘাত মৃত্যু। সুদীপ্ত জানলা বন্ধ করতে গেলেন। উত্তর দিকের জানলা বন্ধই ছিল। পূর্ব ও দক্ষিণের জানলা দুটো পর্দা-আড়ালে দেহ লুকিয়ে বহু সন্তর্পণে তিনি বন্ধ করলেন। পায়ের নিচে অনুভব করলেন ভাঙা কাচের টুকরো। তখনি মোজা-জুতো পরিয়ে দিলেন ছেলে-মেয়েদের পায়ে।

চারদিকে ফর্সা হয়ে এলে অতি সন্তর্পণে জানলার পর্দা একটু ফাঁক ক’রে পুব দিকের খোলা মাঠের পানে তাকালেন সুদীপ্ত। এ্যাঁ! এ কী কাণ্ড! এত মৃতদেহ! মাঠের এক কোণে অনেক লাশ পড়ে আছে। অনেক লাশ! ওদেরকে কোথাও মেরে ঐখানে জমা করেছে? নাকি, জ্যান্ত ধরে এনে ঐখানে দাঁড় করিয়ে গুলি করেছে? যাই ওরা ক’রে থাকুক, ঐখানে এমনি ক’রে ফেলে রাখার কারণটা কি? লাশের আদমশুমারী করবে নাকি!

দক্ষিণ দিকের জানলা দিয়ে এবার দৃষ্টি ফেললেন সুদীপ্ত। ইকবাল হলের মসজিদের ছাদে কয়েকটি লাশ। একটি লাশ পড়ে আছে সেখানে পাইপের একটি বড় ছিদ্র দিয়ে ঝর ঝর ক’রে জল পড়ছে। বোধ হয়, গুলি খাওয়ার পরও জীবিত ছিল ছেলেটি, এবং পিপাসার্ত হয়েছিল। তখনি বোধ হয় সে কোনো মতে নিজেকে ঐ জলধারার নিচে নিয়ে ফেলেছিল। কিন্তু মুখ তো জলের নাগাল পায় নি। পানির পেয়ালা হাতে পেতেই প্রাণ নিঃশেষিত হলে সে পানি পাওয়া না-পাওয়ার মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকে? হায় হায়, ছেলেটা পিপাসা নিয়েই মরেছে। সুদীপ্ত দেখলেন, জলের ধারা ঝরছে তার গলার কাছে বুকের উপর। তখনও ঝরছে। কয়েকদিনই ঝরেছিল অনবরত। এবং ঝরে ঝরে তার গায়ের উপর দিয়ে গড়িয়ে গেছে। বিশুদ্ধ পিপাসার জল। কিন্তু পিপাসা-নিবৃত্তির প্রয়োজনে লাগে নি।

শুক্রবার ছাব্বিশে মার্চ সারাদিন সুদীপ্তকে ছেলেমেয়ে নিয়ে শোবার ঘরে কাটাতে হল। বারান্দায় বেরুনোর উপায় নেই। সামনে ইকবাল হলের নিচের তলায় প্রভোস্ট অফিসে আগুন জ্বলল বেলা প্রায় এগারোটা অবধি। আর ইকবাল হ’ল ও তেইশ নম্বর বিল্ডিংয়ের মাঝখানে বাবুর্চি-বেয়ারাদের জন্য যে ঘর বানানো হয়েছে তার বারান্দা অধিকার ক’রে কয়েকটি মিলিটারি জওয়ান বসে থাকল সারাদিন। তেইশ নম্বরের বারান্দা ঠিক মুখোমুখি। এখন তা হলে ছেলে-মেয়েদের খাওয়ানো হবে কী? হামাগুড়ি দিয়ে শরীর লুকিয়ে রান্নাঘরের কাছে পৌঁছানো যায়। কিন্তু পৌঁছানোই যায় শুধু। লাভ তো কিছু হয় না। তালা। খুলবার জন্য মাথা তুললেই ওদের নজরে পড়তে হবে যে! পুব দিকের মাঠে যেখানে রাশি রাশি লাশ পড়ে আছে যেখানে মিলিটারি জওয়ান টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে। আর, শকুনেরা লোভ ও সতর্কতা নিয়ে চারপাশে তাকাচ্ছে। সত্যি, শকুন বলেই মনে হচ্ছে এই টহলদার সৈনিকগুলোকে। শকুনেরাই ভালবাসে মৃতদেহ—মৃতদেহ ঘিরে বসে থাকে, ঘুরে বেড়ায়। শকুনেরা ভালোবাসে প্রাণ নয়, মৃতের শরীর। প্রাণবান মানুষকে দেখলেই তাকে শব বানাবার ইচ্ছে জাগবে ওদের, মুহূর্তের মধ্যে গর্জে উঠবে হাতের রাইফেল। অতএব বাঁচতে হলে ওদের দৃষ্টি এড়াতে হবে। কিন্তু রান্নাঘরের তালা খুলতে গেলে ওদের নজরে পড়ার সম্ভাবনা পৌণে ষোলো আনা যে। তা হ’লে ছেলে-মেয়েদের খাওয়ার কী হবে? ঘরে শুধুই চাল আছে। আর কিছু নেই। ইলেকট্রিক হিটার রান্নাঘরে। রান্নাঘরের মিটসেফে গতরাতের বাসি ব্যঞ্জনও আছে। নষ্ট হয় নি। জ্বাল দিয়ে খাওয়া যেতে পারে। কিন্তু সে কথা আমিনা এখন মনেও আনলেন না। পানিতে চাল ভেজাতে দিলেন। ঘরে চিড়ে থাকত যদি! কতো কাল তারা চিড়ে খায় নি। এই মুহূর্তে মনে হল চিড়ে অতি উত্তম খাদ্য। ঘণ্টা খানেক পরে চালগুলো ভিজে একটু নরম হলে তা-ই একটু চিনি দিয়ে ধরলেন ছেলে-মেয়েদের সামনে। নিজেরাও খেলেন। খাওয়া মানে দু বার মুখে দিয়ে এক গ্লাস ক’রে পানি খাওয়া। কতো জনের এই খাওয়া জন্মের মতো ঘুছে গেল এই রাতে! তাদেরও যেতে পারত।….এমন চিন্তায় আক্রান্ত হলে কোনো-কিছু আর খেতে ভালো লাগার কথা নয়। সুদীপ্তর ক্ষিধে কোথায় উরে গেল।

…আচ্ছা, তখন ম’রে গেলে আমরা এখন কোথায় থাকতাম। ওই যে লাশগুলো পড়ে আছে ওর মালিকরা গেছে কোথায়?—খুবই ছেলেমানুষের মতো একটা ভাবনা এল সুদীপ্তর মধ্যে। বোধ হয়, মনে মনে খুবই দুর্বল হয়ে বাল্যভূমিতে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন তিনি আর ভাবছিলেন—মরবার পর একবারও কি এই ফেলে-যাওয়া সংসারে বেড়াতে আসা যায় না। হ্যাঁ, তা গোপনেই তো। তার এই বিছানা-বালীশ, টেবিল-চেয়ার সবি ঠিক এমনিই থাকবে, কোনো সময় কেউ না থাকলে, গোপনে এসে একবার তিনি ব্যবহার ক’রে যাবেন। ঐ আলমারির বইগুলি মাঝে মাঝে এসে নেড়েচেড়ে দেখবেন। সম্ভব নয় সেটা? না না, এ প্রচণ্ড অবিচার। তার সব কিছু থাকবে, কেবল তিনি থাকবেন না—এ কখনো হয়, না। কিন্তু সংসারে সেইটেই তো হয়। পরকালের বাগানের একটি ফুলও মর্ত-সংসারের কাউকে উপহার দেবার অধিকার তোমার নেই। পুব দিকের জানলার পাশে দাঁড়িয়ে অকারণেই নানা চিন্তার সুলত শিকারে পরিণত হতে দিচ্ছিলেন নিজেকে। ঐখানে না দাঁড়ালেই তো হয়। বার বার তবু এই পুব দিকের জানলার পাশেই দাঁড়াচ্ছিলেন এসে। এবং একটি মাত্র চোখ মেলে দেওয়া যায় এমনি একটুখানি পর্দা ফাঁক ক’রে বাইরে দেখছিলেন। পড়েই আছে সেই লাশগুলো। কতগুলো হবে? গুণে দেখবার চেষ্টা ক’রে ব্যর্থ হলেন। গায়ে গায়ে জড়াজড়ি হয়ে এমনভাবে সেগুলো পড়ে আছে যে, গণনার চেষ্টা বৃথা। আজ রোদটাও হয়েছে অতি প্রখর। লাশগুলো ঝলসে যাচ্ছে। জীবনে ওরা নিশ্চিন্ত ছায়ার আশ্রয়ে দুদিন বাঁচতে চেয়েছিল।

‘তুমি অত ক’রে জানলার কাছে দাঁড়িয়ে থেকো না তো।’

আমিনা তাড়া দিলেন সুদীপ্তকে। হ্যাঁ, জানলার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা ঠিক নয়। তাছাড়া, জানলার বাইরে তো দৃশ্য আজ একটাই। সকাল থেকে যেমনটি দেখে আসছেন ঠিক তেমনি ওই মাঠ, মাঠের এক কোণে মরা মানুষের স্তূপ, ওই সেই আপন আপন জায়গায় দাঁড়িয়ে-থাকা গাছগুলি, ওই বিপুল সুউচ্চ জলাধার, ওই ক্লাব, ক্লাবের ওপাশের লাল দো-তালা বাড়িটা…সব সব আছে—একটি মাত্র ছবির মতো। অন্যদিকে হাঁ এরাই জন্ম দেয় প্রতি মুহূর্তের কতো অজস্র দৃশ্যমালার। আজ সেই দৃশ্যেরা কোথায়? ক্লাব-প্রাঙ্গণের গাছটা কতো নিঃসঙ্গ। সুদীপ্তর নিঃসঙ্গতাকে সে যেন সান্ত্বনা দিচ্ছে ওইখান থেকে।

শেষ পর্যন্ত জানলার কাছ থেকে সরে এলেন সুদীপ্ত। স্ত্রীর কথাতেই সরে এলেন। কিন্তু সরে এলেই বা স্বস্তি কই? উত্তর দিকের জানলায় আবার চোখ রাখলেন অতি সন্তর্পণে। সামনের একতালা পাশাপাশি দুটো বাংলো। খালি পড়ে আছে। পুব দিকেরটাতে থাকতেন উর্দু ও ফারসী সাহিত্যের অধ্যাপক ডঃ সাদানী। কবি ও পণ্ডিত হিসাবে তার খ্যাতির কথা সুদীপ্ত শুনেছেন। শুনেছেন। কেননা জানবার অবসর জীবনে পাননি। দেখা হলে সুদীপ্ত তাকে সালাম দিয়েছেন বহুবার। এবং উত্তর পেয়েছেন। তার অতিরিক্ত একটা কথাও নয় কিন্তু ওই দিক থেকে, সুদীপ্ত ভেবে দেখেছেন, একজন মানুষের মতো মানুষ ছিলেন অধ্যাপক ডঃ গোবিন্দচন্দ্র দেব, সংক্ষেপে জি. সি. দেব। সুদীপ্ত সবে তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের করিডোরে দেখা হতেই যথারীতি আদাব দিয়ে তিনি সরে যাচ্ছিলেন। গোবিন্দবাবু যেতে দিলেন না। নতুন মানুষ দেখে পরিচয় শুধালেন। এবং সুদীপ্ত অবাক হলেন এই দেখে যে নাম শুনেই গোবিন্দবাবু তাকে চিনলেন। তাঁর সদ্য-প্রকাশিত কবিতার বইটি তিনি পড়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক সাহিত্যের অধ্যাপকও তা পড়েন নি। এতো বিচিত্র পিপাসা ছিল ভদ্রলোকের। দর্শনের অধ্যাপক হয়েও কবিতার পিপাসা, হিন্দু হয়েও ইসলামকে জানার পিপাসা, বিশুদ্ধ বাঙালি হয়েও বিশ্বমানবের সকলের সঙ্গে মিলনের পিপাসা। পক্ষান্তরে প্রফেসর সাদানী? বাংলাদেশে অমন কম ক’রে হলেও তিরিশ বছর বাস করেছেন। সাহিত্যের অধ্যাপক। তাও আবার কবি। অথচ কবি রবীন্দ্রনাথের ভাষা বাংলার প্রতি কোনো আগ্রহ কখনো তার মধ্যে দেখা যায় নি। বাংলা বলতেও শেখেন নি। এবং তা না শেখার জন্য তার নাকি একটা গর্ববোধ ছিল মনে মনে। সামাজিক কুপমণ্ডুকতা সৃষ্টি ক’রে রক্তের বিশুদ্ধি রক্ষার মতো তিনি নাকি তার জবানের বিশুদ্ধতা রক্ষা করেছেন। অনার্য বাঙালির সঙ্গে বেশি মাখামাখি তিনি পছন্দ করতেন না। সেই সাদানী গতবার মারা গেলে বাঙালিরাই বুক ভাসিয়েছিল সভা করে। বলা হয়েছিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি স্তম্ভ নাকি খসে গেছে। কিন্তু ঐ স্তম্ভটা যে বিশ্ববিদ্যালয়ের কি শোভা বাড়াচ্ছিল সেটা সুদীপ্তর কাছে স্পষ্ট হয় নি কোনদিনই।

ডঃ সাদানীর বাংলোর পশ্চিম-সংলগ্ন এই বাংলোতে থাকতেন অধ্যাপক মনিরুজ্জামান—পরিসংখ্যান বিভাগের প্রধান। বাংলোটা এখন খালি। সপ্তাহ দুয়েক হল, তিনি চৌত্রিশ নম্বর দালানের একটা ফ্ল্যাটে চলে গেছেন। ভালোই করেছেন। বেঁচে গেছেন ভদ্রলোক। তাঁর ভাগ্যই তাঁকে এই অভিশপ্ত এলাকা থেকে সসম্মানে নিরাপদ এলাকায় নিয়ে গেছে। কী আশ্চর্য বোকার মতো। সুদীপ্তর তখন মনে হচ্ছিল, একমাত্র তাদের এলাকা ছাড়া ঢাকা শহরের আর সকলে দিব্যি সুখে আছে খাচ্ছে, গল্প করছে, কিংবা ঘুমুচ্ছে। না হয় তাস খেলছে। মানুষ বোধ হয় নিজের ট্রাজেডিকেই বড়ো ক’রে দেখতে ভালোবাসে। আবার স্ত্রীর তাড়া খেলেন সুদীপ্ত—

‘জানলার ধারে এতো কি দেখছ তুমি! তুমি দেখছি একটা বিপদ না বাধিয়ে ছাড়বে না?’

তাই তো। কি এতো দেখছেন তিনি! উত্তরের এই জানলাটা দিয়ে ওই প্রধান সড়কের কিয়দংশ দেখা যায়। সেই মুহূর্তে একটা ট্যাঙ্ক ছুটে যাচ্ছিল। সুদীপ্ত জীবনে এই প্রথম ট্যাঙ্কের দৌড় দেখলেন! ঢাকা শহর কি তা হলে এতোই বিদ্রোহী হয়েছে! ট্যাঙ্ক ব্যবহার না করলে হালে পানি পাচ্ছে না পাকবাহিনী!

আমিনার তাড়ায় জোহরের নামায প’ড়ে কোরান শরীফ নিয়ে বসতে হ’ল সুদীপ্তকে। নামাজ ও কোরান পাঠের জন্য ইতিপূর্বেও তিনি একাধিকবার স্ত্রীর তাড়া খেয়েছেন। কিন্তু অধম স্ত্রীজাতির কথাকে কখনো আমল দেওয়ার কোনো প্রয়োজন বোধ করেন নি। আজ কিন্তু ভারি সুবোধ অনুগত স্বামীর ভূমিকা পালনে প্রবৃত্ত হলেন। মনে পড়ল, সেই কবে কতো কাল আগে মরণাপন্ন মায়ের কাছে বসে কোরান পড়েছিলেন। তিনি তো জানতেন না, আজো তিনি যে কোরান নিয়ে বসেছেন তাও একটি মৃত্যু-শিয়রের পাশেই। তিনি জানতেন না যে, নিচের তলায় পড়ে ডঃ ফজলুর রহমানের মৃতদেহ, নাকি হতচেতন দেহে মৃত্যু আসতে কিঞ্চিৎ বিলম্ব ছিল তখনো। ডঃ রহমানের নিকটতম জীবিত ব্যক্তি সুদীপ্ত কোরান নিয়ে বসেছেন। আহা, এই এলাকার কতো জনই তো মরেছে আজ! সকলের আত্মার কল্যাণ হোক। অনেক বছর পর অনেকক্ষণ ধরে। কোরান শরীফ পাঠ করলেন অধ্যাপক সুদীপ্ত শাহিন। ক্রমে সন্ধ্যা এল।

সেই সন্ধ্যার অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে আমিনা গিয়ে রান্নাঘর খুললেন। স্বামী ও ছেলে-মেয়েদের সামনে যখন ভাত-তরকারি তুলে ধরলেন তখন কত রাত। তাকে রাত বলে না। সন্ধ্যা আটটা। সেই সন্ধ্যা আটটাতেই তখন ঢাকা শহরকে মৃত প্রেত-পুরী মনে হতে লাগল। কোথাও কোনোদিকে একটু আলো জ্বলুক! কিম্বা কোনো শব্দ! ওহ, কী ভয়াবহ। সুদীপ্তর মনে হল, ছোট-বড় মিলিয়ে তারা এই পাঁচজনই কেবল সমগ্র ঢাকা শহরে জীবিত আছেন। এক বিশাল আলবাট্রসের পাখার নিচে সমগ্র নগরী যেন দুঃস্বপ্নগ্রস্ত। খেতে গিয়ে একটি গ্রাসও মুখে তুলতে পারলেন না সুদীপ্ত। উঠে পড়লেন।

বেশিক্ষণ কিন্তু এ অবস্থাটা থাকল না। আলো দেখা গেল। পাকসেনারা আবার আগুন দিয়েছে শহরের বিভিন্ন এলাকায়। আবার গুলি চালাচ্ছে। তবে আশে-পাশে কোথাও বলে মনে হচ্ছে না। একটু দূরে দূরে। বোধ হয়, গতকাল তাদের এলাকার কাজ শেষ ক’রে আজ অন্য এলাকা ধরেছে। এমনি চলতেই থাকবে নাকি! আচ্ছা জাতাকলে ফেলেছে রে বাবা! সারা শহরে কারফিউ দিয়ে রেখে দিব্যি এখন একটা একটা ক’রে ধ’রে সাবাড় করবে সকলকে। মানে, সকল বাঙালিকে? এতো ঔদ্ধত্য ওই পশ্চিম পাকিস্তানিদের!

পশ্চিম পাকিস্তানের উদ্ধত কণ্ঠস্বর রেডিওতে বেজে উঠল—শেখ মুজিবুর রহমান দেশের শত্রু, বিশ্বাসঘাতক। কে বলছে এ কথা? স্বয়ং পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান। কিন্তু বাংলাদেশের প্রত্যেকটি ছেলেবুড়ো জানে, শেখ মুজিবুর রহমান তাদের বন্ধু। বাঙলার বন্ধু শেখ মুজিব। কিন্তু বাঙলার শত্রুরা কী বলে শোনো।…দেশকে ধংস করতে চেয়েছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। সে জন্য তার শাস্তি না হয়ে যায় না।…শেখ মুজিবুর রহমানের শাস্তি! দেবে ইয়াহিয়া খান! অভিযোগ? পাকিস্তানকে ধ্বংস করতে চেয়েছেন শেখ মুজিবুর রহমান। এ কথা শুনে এখন মুখ খিস্তি করতে ইচ্ছে করে,—ওরে খবিশের বাচ্চারা, পাকিস্তান বানিয়েছিল কারা? তোরা তখন তো ইংরেজ সরকারের বন্দুকের নল সাফ করতিস। আর শেখ মুজিব তখন তরুণদের মধ্যে পাকিস্তান আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। আজ মায়ের চেয়ে মাসীর দরদ বেশি হল? শেখ মুজিবের পেছনে আজ সাড়ে সাত কোটি মানুষের সমর্থন আর তোর পেছনে? কয়েকটা বন্দুক আর গোলাবারুদ। কিন্তু বন্দুক মানুষেই বানিয়েছে না? মানুষের চেয়ে সেই বন্দুকের ক্ষমতা কখনো বেশি হয় নাকি। নিশ্চয়ই মানুষের জয় হবে। জয় হবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের। কত রক্ত নেবে পিশাচেরা! বঙ্গবন্ধু তো বলেই দিয়েছেন, ‘রক্ত যখন দিয়েছি প্রয়োজন হ’লে আরো রক্ত দেব। দেশের মানুষকে মুক্ত ক’রে ছাড়ব। ইনশাআল্লাহ।’…বঙ্গবন্ধুর সেই সাতই মার্চের কণ্ঠস্বর। একবার তা যে বাঙালির কানে গেছে জীবনের মতো সে হয়ে গেছে অন্য মানুষ। কিন্তু হয় নি যারা? তারা মানুষ নয়। তারা ওই রক্তলোভী পিশাচের দলে। রক্তপায়ী জীবটা এখন বলে কি! পাকিস্তানের সংহতি রক্ষার জন্য সেনাবাহিনী দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।….আবার মুখে গাল এসে গেল সুদীপ্তর। অমন যে নিরীহ অধ্যাপক সুদীপ্ত শাহিন, তিনিও ক্রোধে প্রায় দিশেহারা হলেন—ওরে হারামের হাড়, সংহতি মানে কী? বিনা বাধায় পশ্চিম পাকিস্তানকে রক্ত চুষতে দেওয়ার নাম সংহতি? তোদের ওই সংহতির নিকুচি করি। রাগে রেডিওটাকেই এখন তুলে আছাড় মারতে ইচ্ছে করছে। নাহ্ রেডিওর কাছ থেকে এখন সরে যাওয়াই ভালো। ঘরের অন্য কোণে চলে গেলেন সুদীপ্ত। খাটের একাংশ পুড়ে গেছে, শুতে গেলে ভেঙ্গে পড়তে পারে। অতএব মেঝেতে সপ বিছিয়ে শুয়ে পড়লেন—ঘুমোনোর উদ্দেশ্য নয়। সাতই মার্চের রেসকোর্স মাঠে এখন ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে। অতীতের কোন আনন্দক্ষণে আত্মনিমজ্জনের মধ্যে বেঁচে ওঠার কোন রসদ যদি মেলে। হাঁ। বেঁচে ওঠার একটি মন্ত্রই আজ বাঙালি জপ করতে পারে সেই অগ্নিমন্ত্রের নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। না, নাম-জপ নয়। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশকে জপমন্ত্রের মতো সারাক্ষণ মনের মধ্যে জাগ্রত রেখে কর্মের পথ বেছে নিতে হবে… ‘আর যদি আমার মানুষের উপর একটি গুলি চলে, তোমাদের উপর নির্দেশ রইল, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো’।…আমরা যদি প্রত্যেকে নিজের ঘরকে এক-একটি দুর্গ ক’রে তুলতে পারতাম। মুজিব ভাই, তোমার বাংলাদেশ একদিন ওদের জন্য দুর্ভেদ্য দুর্গ হবেই। কিন্তু তার আগে একটি নয়, বহু গুলি তারা চালাবে তোমার দেশের মানুষের উপর।

উহ্‌, আবার সেই কাল রাতের মতোই গুলি-গোলা শুরু হল। বকসিবাজারের দিকেই আগুনের শিখাটা যেন বেশি দেখা যাচ্ছে। আগুন আর গুলি-গোলার আওয়াজ। সেই রাতও গুলি-গোলার বিচিত্র শব্দ শুনে কাটল। কারফিউ উঠল সকালে একটু বেলা হওয়ার পর।

আর কারফিউ উঠে যেতেই সেই ইচ্ছেটা প্রবল হল সুদীপ্তর মধ্যে। একটু সে ঘুরে দেখবে কী-ঘটেছে গত ত্রিশ ঘণ্টায়। কিন্তু দেখবার বহু কিছু তার ঘরেই ছিল। বসবার ঘরের প্রবেশ-দরজা খোলাই প’ড়ে আছে। দরজার গায়ে তিনটে গুলির দাগ। কয়েকটি ছবি টাঙানো ছিল ঘরে—রাফায়েল, রবীন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ, জয়নুল আবেদীন ও কামরুল হাসানের আঁকা কয়েকখানি ছবি। প্রত্যেকটাতে গুলি করেছে সেই বর্বরের দল, কিন্তু ভারি আশ্চর্য তো। পুব দেওয়ালে রবীন্দ্রনাথ অক্ষত আছেন। সুদীপ্ত কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রনাথকেঃ তোমাকে দেখলে বর্বরও বর্বরতা ভোলে। রবীন্দ্রনাথের ছবিতে গুলি ক’রে নি ওরা। আর গুলি করেছে সর্বত্র ঘরের মেঝেতে, দেওয়ালে, এমন কি তার সখের ক্যালেণ্ডারখানিতেও।

সুদীপ্ত বেরিয়ে গেলেন। প্রথমেই গেলেন তিন তলায়। ডঃ ফজলুর রহমানের ও ড্রয়িং রুম খোলা। লোকটি ড্রয়িং রুমেই পড়ে ছিল। ডঃ রহমানের বৃদ্ধ বাবুর্চি। মুখভরা দাড়ি, পরহেজগার মানুষ। রহমান সাহেবদের গ্রামেই বাড়ি। ছেলেবেলায় এর কোলে-পিঠে চড়ে রহমান সাহেব মানুষ হয়েছেন। তিনিই প্রস্তাবটা দিয়েছিলেন—

‘চাচা মিঞা, চল। তোমাকে ঢাকা নিয়ে যাই। দুটো রেধেবেড়ে খাওয়াবে, আর থাকবে আমাদের সঙ্গে।’

মন্দ কি! গ্রামেও তার তিন কুলে কেউ নেই যখন। অতঃপর ঢাকায় এতোকাল বেশ ভালোই কেটেছে। কিন্তু হঠাৎ এ কী ঘটে গেল! জওয়ানরা এসে ধাক্কাধাক্কি শুরু করলে নিজেই গিয়ে কপাট খুলে দিয়েছিল সে। বুড়ো মানুষের গায়ে কি আর ওরা হাত দেবে! সভ্য মানুষের মতোই চিন্তা করেছ তুমি। কিন্তু পাকিস্তানিদের চিন্তা অন্য রকম। মানে কী রকম সেটা? ঐ বৃদ্ধের সর্ব শরীরে তার পরিচয় আছে। না, মেরে ফেলে নি। মাত্র দুটো গুলি করেছে—একটা পায়ে এবং একটা হাতে। রক্তের ধারা গড়িয়ে মেঝে ভিজে গেছে। সে প’ড়ে আছে। সুদীপ্তকে দেখে শুধু ফ্যাল ফ্যাল ক’রে তাকাল তার পানে, কোনো কথা নেই মুখে। কেবল চোখ দিয়ে দু-ফোঁটা জল গড়িয়ে গেল।

এবং তখনি মনে হ’ল ডঃ ফজলুর রহমানের ভাগ্যেও কি তবে…? না, তা হতেও পারে। তাদের মতোই তিনিও লুকিয়ে বাঁচতে পারেন না? হাঁ, বেঁচেই আছেন হয়ত। আশাটাকে দু’হাতে বুকে চেপে সুদীপ্ত ভেতরে গেলেন। হায় হায়, কাঞ্চন যে! শয়ন কক্ষের সামনে বারান্দায় কাঞ্চনের লাশ প’ড়ে আছে। ডঃ ফজলুর রহমানের ভাগনে কাঞ্চন। মামার কাছে থেকে কলেজে পড়ত। কলেজে? ব্যাস, তবে আর কথা নেই। এ ছেলে রাষ্ট্রদ্রোহী না হয়ে যায় না। রাষ্ট্রদ্রোহী যে, তার আরো প্রমাণ আছে। স্বাস্থ্য ভালো ছিল কাঞ্চনের। খেলাধুলা করা সবল সুস্থ একজন বাঙালি যুবক। ওরে বাবা। তা হ’লে তো একে বাঁচতে দেওয়া যায় না। ভাগনে কাঞ্চনকে মেরে শোবার ঘরে ঢুকে মামাকে মেরেছে। দেয়াল-আলমারির পাশে কাত হয়ে প’ড়ে আছেন ডঃ ফজলুর রহমান। আলমারি খোলা! আলমারিতে ডঃ রহমান কিছুই রাখতেন না নাকি! নিশ্চয়ই মূল্যবান কিছু রাখতেন। কিছুই তার অবশিষ্ট নেই। রহমান সাহেবের গায়ের সৌখিন পাঞ্জাবীতেই সাক্ষ্য দিচ্ছে, তিনি ভদ্র পোশাকে ভদ্রলোকের মুখোমুখি হওয়ার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করেছিলেন। এবং ঐখানেই ভুল করেছিলেন। ভুল করতে যাচ্ছিলেন সুদীপ্তও। স্ত্রীর বুদ্ধিতে বেঁচে গেলেন, স্ত্রী ছিলেন না বলে রহমান সাহেবের ভুল শুধরে দেবার কেউ ছিলেন না। কিন্তু অনেকেরই তো স্ত্রী ছিলেন। যেমন অধ্যাপক মনিরুজ্জামানের, ডঃ জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার, ডঃ মুকতাদিরের। তাঁদেরকে ভালো মানুষ সেজে ডেকে নিয়ে গিয়ে মেরেছে। কিন্তু সাদেক সাহেবকে তো মেরেছে স্ত্রীর সামনেই গুলি করে। না, কোনো এথিকস মেনে ওরা কাজ ক’রে নি। যা ইচ্ছে করেছে। যা ইচ্ছে? এমনি ক’রে ইচ্ছার লাগাম ছেড়ে দেওয়া কি মানুষকে সাজে। বার বার চিন্তায় ভুল হ’য়ে যাচ্ছে সুদীপ্তর। তার চিন্তা কেবলি বিবর্তিত হতে চাইছে মানুষকে কেন্দ্র করে। অতএব এ হেন চিন্তা সম্পদ নিয়ে অমানুষের কার্যকলাপের ব্যাখ্যা তিনি কেমন ক’রে পাবেন? হুহু ক’রে শিশুর মতো কেঁদে ফেললেন সুদীপ্ত। ভাই ফজলুর রহমান, দুজনে সেদিন কত তর্ক করলাম রে! তর্ক হয়েছিল সংস্কৃতির ব্যাখ্যা নিয়ে। ডঃ রহমান সংস্কৃতির বিকাশে ধর্মের গুরুত্বকে স্বীকার করেন প্রবলভাবেই। সুদীপ্ত করেন না। তাই নিয়ে তর্ক। কিন্তু মনোমালিন্য নয়। মাত্র চার দিন আগের কথা। সদ্য তিনি অসুখ থেকে উঠেছেন। পানিবসন্তে ভুগে কেমন ম্লান দেখাচ্ছিল ভদ্রলোককে। কিন্তু মুখের সেই হাসিটুকু ঠিকই ছিল। আর সেই হাসি সুদীপ্ত কখনো দেখবেন না। চোখের পানি মুছতে মুছতে তিনি বেরিয়ে এলেন। এবং তখনি মনে হল ছাদটা একবার দেখা দরকার। পরশু রাতে অত দাপাদাপিটা শোনা গিয়েছিল কিসের? ভাবতে ভাবতেই আর নিচে না নেমে উপরে চললেন। সিঁড়ির সর্বোচ্চ ধাপে একটি কাঁথার উপরে পড়ে আছে একটি শিশু-কন্যা। থমকে দাঁড়াতে হল। এতো কচি মেয়েটাকেও ওরা মেরেছে। গলায় গুলির দাগ। নাকি বেয়নেটের খোঁচা! কত বয়স হবে? দু’মাস? তিন বা চারমাসের বেশি কিছুতেই নয়। কিন্তু মেয়ের মা কৈ? ছাদে কোনো যুবতী স্ত্রীলোকের লাশ সুদীপ্ত দেখলেন না। বয়স্ক পুরুষের লাশও না। বেশির ভাগই বৃদ্ধ-বৃদ্ধা এবং কয়েকজন ছোট ছোট ছেলে-মেয়ে। সব মিলে প্রায় তিরিশ-চল্লিশ জন হবে। ছোট ছেলে-মেয়েরা প্রাণের ভয়ে গড়িয়ে গিয়ে পানির চৌবাচ্চার নিচে লুকিয়ে ছিল। সেই খানেই গুলি ক’রে তাদের ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। হাঁ, ঘুমিয়ে থাকার মতোই দেখাচ্ছে। অনেক ক’টি ভাই-বোন এক শয্যায় শুয়ে ঘুমালে সকাল বেলায় তাদের কেমন দেখায়? কে কোথায় পা রেখে, কোথায় মাথা রেখে এলোপাথাড়ি ঘুম দিচ্ছে, কোনো চিন্তা-ভাবনা কিংবা সৌজন্যবোধের বালাই নেই—এ যেন অনেকটা তেমনি। তেমনি? এমনি রক্তের উপর পড়ে থাকে নাকি তারা! আহা, এতোগুলি কচি ছেলে-মেয়েকে মারতে ওদের হাত পা কাঁপেনি! ফজলুর রহমানকে দেখে সুদীপ্ত কেঁদেছিলেন। কিন্তু এতগুলি মানবসন্তানের এই নিষ্ঠুর পরিণতি সুদীপ্তকে লজ্জা দিল। বনের পশুও তো কেউ এমন ক’রে মারে না। দু’মাসের শিশুকে বনের বাঘও তো আক্রমণ করবে না। ক্ষুদ্র মানব-শিশু রমুলাসকে লালন ক’রে নি বনের এক বাঘিনী? হ্যাঁ, মানুষ পশুরও অধম কখনো হয়। কিন্তু সব মানুষ হয় না। যারা হয় তাদের সঙ্গে কি একত্র থাকা চলে? না, আর ওদের সাথে নয়। ফিরোজ ঠিকই বলে। ফিরোজ বলে, ব্রিটিশ রাজত্বে বাংলাদেশের অবস্থা যেমন ছিল এখনো ঠিক তেমনি আছে। স্বাধীনতা-সংগ্রাম এখনো তাই শেষ হয় নি। শেষ কী? শুরুই তো হয় নি এতোকাল। শুরু হয়েছে, গত ৭ই মার্চ থেকে। মুজিবুর রহমান গণ-আন্দোলন শুরু করলেন।…আমাদের এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। স্বাধীনতা? প্রশ্ন তুলেছিলেন সুদীপ্ত। বন্ধুর সঙ্গে তর্ক করেছিলেন। কিন্তু আর তো তর্কের অবকাশ নেই। পাকিস্তান নামে কোনো দেশ পাঞ্জাবসিন্ধু অঞ্চলে থাকতে পারে, বাঙলায় নেই। থাকলে তো ওরা-আমরা মিলেমিশে একই দেশের অধিবাসি হতাম। এবং তা হলে এমনি ক’রে নির্বিচারে নারী-শিশু-বৃদ্ধ সকলকে ওরা হত্যা করতে পারে? নিজের দেশের লোক হলে এমনি ক’রে নিরপরাধ জনসাধারণকে মারতে পারে কেউ? পরের দেশেও এমন ঢালাও গণহত্যার কথা কচিৎ শোনা গেছে।

গতকালের দেখা সেইসব দৃশ্যাবলি সুদীপ্তর চোখে এখনও ভাসছে। এখন তার মনে হচ্ছে, জীবনে আর কখনো বোধ হয় কোনো মুহূর্তটি একা বসে কাটাতে পারবেন না। একা হলেই ওরা এসে ঘিরে ধরে যে। চিলেকোঠার ছাদে সে বাপ-ছেলের লাশ! আর সিঁড়ির সর্বোচ্চ ধাপে দু’মাসের শিশুকন্যা। কিংবা দেখ, জলের ট্যাঙ্কের নিচে সেই জড়াজড়ি ক’রে পড়ে থাকা ছেলেরা। কে যেন কান ধরে ঐগুলোই দেখাতে নিয়ে যায় বারে বারে।

দু’তলার সিঁড়িতেই দৃশ্যটা ছিল সবচেয়ে মর্মান্তিক। সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে সুদীপ্ত প্রায় মূৰ্ছা যাচ্ছিলেন। দেয়ালের গায়ে স্ত্রীলোকের মাথার চুল। মনে হচ্ছে দেয়ালের শরীর ফুঁড়ে বেড়িয়েছে। একটা দুটো নয়, এক গোছা চুল প্রায় দু’ ফুট দীর্ঘ। ঠিক তার সামনেই দু’ধাপ পরে রক্তের ধারা জমাট বেঁধে আছে। সুদীপ্তর মনে হয়েছিল ছাদের ঐ তিন-চার মাসের শিশুকন্যার সাথে এই রক্তের যোগ আছে। যুবতী মায়ের কোল থেকে ঐ শিশুকে ছিনিয়ে কথার উপর ফেলে দিয়ে মাকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল বর্বরের দল। সন্দেহে কয়েকবার চীৎকার করেছিল সেই যুবতী জননী, তারপর সংজ্ঞা হারিয়েছিল! অসংবৃতার বিস্রস্ত দেহলতা চারতলা দালানের ছাদ থেকে চুল ধ’রে টেনে নামাচ্ছে। দৃশ্যটা কল্পনায় আসতেই সুদীপ্ত শিউরে উঠলেন। ঠিক অমনি ক’রে চুল ধ’রে টেনে হিঁচড়ে যদি না নামাবে তা হলে এক খাবলা মাংসসুদ্ধ চুলের গোছাটা এমন ভাবে উঠে আসবে কেন? আর উঠে আসতেই তারা সেটাকে ছুঁড়ে মেরেছিল দেয়ালে। কাচা মাংস দেয়ালে গাঁথা পড়ে চুলের গোছাটা এখন ঝুলছে। আর সেই মেয়েটি? মাংসসুদ্ধ মাথার চুল উঠে যাওয়ার ফলে নিশ্চয়ই বীভৎসদর্শনা হয়ে গিয়েছিল। তাই গুলি ক’রে সেই মুহূর্তেই মারা হয়েছিল তাকে। এই রক্ত তার। আর এক তলায় নেমে সিঁড়ির প্রশস্ত চাতালের সেই রক্ত? ওখানেও পিশাচেরা কাউকে গুলি ক’রে থাকবে। কাকে? তার নাম নেই। কিন্তু চিহ্ন রেখে গেছে। ওই দেখ, ময়লা কাঁথা-বালিশের পুঁটলি, আর গুঁড়া দুধের পরিত্যক্ত টিনপাত্রে কিছু চাল—বড়ো জোর সের খানেক হবে। ওই নিয়েই বাঁচতে এসেছিল এখানে। ওই সবি ফেলে এখন কোথায় গেছে? যেখানে গেছে আর সেখানে মৃত্যু নেই। প্রতি মুহূর্তে কি একটা আগলে-বেড়ানোর দায় নেই। অতএব শঙ্কাও নেই।

এতো শঙ্কা বয়ে বেড়াচ্ছি কেন আমরা? বাঁচতে চাই বলে? প্রতি মুহূর্তে শঙ্কা বুকে বয়ে বেঁচে থাকা যায় নাকি! বাঁচার নাম আনন্দ-সে জন্য শঙ্কা-পোষণ কেন? আনন্দ কুসুমের জন্ম সাহসের বৃন্তে। অতএব সাহস সঞ্চয়ের চেষ্টা করলেন সুদীপ্ত। সাহস প্রার্থনা করলেন। তাও ব্যর্থ হল। এখন কেবলি তার শঙ্কিত হওয়ার পালা?…

সে কে? তার ভিক্ষাপাত্রে এক সের চাল ছিল, সেই যুবতী জননীর কোলে শিশুকন্যাটি ছিল। সব ফেলে তারা চলে গেছে। বাসায় এক বস্তা চাল ও কয়েক হাজার টাকার বই ও আসবাবপত্র ফেলে সুদীপ্তও চলে এসেছেন। কিন্তু সেই শঙ্কাটাকে সঙ্গে এনেছেন ঠিকই।

সেই শঙ্কাটা এখানেও সুদীপ্তকে তাড়া করল—ফিরোজের এই সুসজ্জিত ড্রয়িং রুমের মধ্যেও। দেয়ালে ঝুলে থাকা সেই চুলের গোছা সুদীপ্তর চোখের সামনে ভেসে উঠল। কে যেন একখণ্ড ভারি পাথর ঝুলিয়ে দিল বুকের উপর। আমিনা কখন উঠে চলে গেছেন। এখন তিনি ঘরে একা। এবং সেইটেই সব চেয়ে যন্ত্রণার। সামনের সাদা দেয়াল ফুঁড়ে এখনি যদি অমনি দীর্ঘ চুল গজায়? আরো তীক্ষ্ম একটা ভয় তাকে আক্রমণ করতে এগুচ্ছিল। কিন্তু তিনি বাঁচলেন একজন ভদ্রলোকের আগমনে। ভদ্রলোকের মুখভরা দাড়ি। মৌলভী সাহেব বোধ হয়। পরিধানে পাজামা ও সেরওয়ানী, মাথায় টুপি। তিনি এসেই পরিষ্কার উর্দুতে ফিরোজ সাহেব ভেতরে আছেন কি না জিজ্ঞাসা করলেন। সুদীপ্ত একেবারে অবাক। এই ধরনের মানুষের সাথেও ফিরোজের দোস্তি আছে নাকি। সুদীপ্ত একটু বিস্ময় অনুভব করলেন। এবং বিস্ময় তার সপ্তমে চড়ল যখন। ফিরোজ এসে আগন্তুককে দেখেই বুকে জড়িয়ে ধরলেন।—

‘যাক তুমি এসে গেছ তবে। এখন খবর কি বল?’

কিছু বলতে আগন্তুক ইতস্তত করছিলেন। ঘরে তৃতীয় ব্যক্তি আছেন। ফিরোজ তা বুঝতে পেরে বললেন—

‘হ্যাঁ, এর সামনে স্বচ্ছন্দে মুখ খুলতে পার। আমার অন্তরঙ্গ বন্ধু। তদুপরি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। চেষ্টা করলেও আমাদের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।’

‘বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের সম্পর্কে তোমার ধারণা তো বেশ উচ্চমানের বোধ হচ্ছে।’

আগন্তুক ভদ্রলোক এবার পরিষ্কার বাংলায় বলে উঠলেন—

‘আপনি ভাই রাগ করবেন না, আপনাদের কিছু সংখ্যক অধ্যাপক সম্পর্কে আমাদের ধারণা সত্যই খুব নিম্নমানের। উপকার-অপকারের প্রশ্ন বাদ দিন, কোনো কিছু করার ক্ষমতাই তাঁরা রাখেন না। কয়েকটা কথা মুখস্থ ক’রে সেইগুলি বছরের পর বছর ধরে আওড়ে অর্থোপার্জনটা একজন যথার্থ তোতা পাখির কর্ম ছাড়া কি?’

এ্যাঁ। এই মৌলভী সাহেব ধরনের লোকটি বলছেন এ কথা! চমকে উঠতেই তো হয়। মৌলভী সাহেব হলেই কেবলি হাদিস কোরানের কথা জানবেন তার কি মানে আছে। সুদীপ্ত বললেন, ‘সে কথা, ধরুন, আলাদা ভাবে বলে কিছু লাভ নেই। কর্মজীবনের নানা স্তরে অমনি তোতা পাখিদেরই তো সংখ্যাধিক্য। যেমন দেশ, দেশের মানুষ যেমন, তেমনি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরাও তেমনি। সমাজের কোনো-একটা অংশকে বিচ্ছিন্ন ক’রে দেখতে পারেন কি?’

‘বুঝলে হে কোরায়শী’, ফিরোজ বললেন, ‘এই জন্যই এ ভদ্রলোক আমার বন্ধু। তুমি যতোই ঘা দিয়ে কথা বল, চটবেন না। তুমি রাগাতে চাইলেই উনি রাগবেন ভেবেছ!’

সুদীপ্ত বুঝলেন, ফিরোজ কথার মোড় অন্য দিকে ফেরাতে চাইছেন। অতএব তিনি চুপ মেরে গেলেন। এবং যথারীতি আলোচনা অন্য মোড় নিল।

কোরায়শী নামক আগন্তুকটি জানালেন।–

‘তোমার বাড়িতে থাকা চলবে না। ওদের প্ল্যান হচ্ছে, আওয়ামী লীগের সকলকে ওরা হয় সাবাড় করবে, না হয় নীতি বিসর্জন দিয়ে দালালির কাজে লাগতে বলবে। সামনে খুব দুর্দিন।’

‘কিন্তু পালাতে হলে তো আণ্ডারগ্রাউণ্ডে যেতে হয়। সে সব কলাকৌশল তো আমার জানা নেই।’

মুশকিল ঐখানে। আওয়ামী লীগ সোজাসুজি গণতান্ত্রিক পদ্ধতির রাজনীতি জানে। তার শ্রেষ্ঠ অস্ত্র ধর্মঘট, অসহযোগ আন্দোলন ইত্যাদি নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তগত করার কৌশলটুকুই তার আয়ত্তে। কিন্তু এর প্রত্যেকটিই হচ্ছে ভদ্রলোকের দেশে উদ্ভুত পন্থা। কোরায়শী একদিন তর্ক করেছিলেন ফিরোজের সঙ্গে—

‘তোমাদের নির্বাচন, অসহযোগ আন্দোলন—এ সবের কোনটা দিয়ে তুমি মধ্যযুগে ক্ষমতায় যেতে পারতে শুনি!’

হ্যাঁ, কথাটা ঠিক। মধ্যযুগের রাজনীতি ছিল যুদ্ধের রাজনীতি। কোরায়শী, ভুল বলেন নি। ফিরোজদের পথ এ কালের পথ। একালের ধ্যান-ধারণায় যারা বিশ্বাসী হবে কেবল তাদের সঙ্গেই একত্রে এই পথে যাওয়া চলে। তর্ক করব, আলোচনা চালাব, এবং জনগণের মত যাচাই ক’রে যদি দেখি আমার পেছনে তাদের সমর্থন নেই তা হলে নিঃশব্দে সরে দাঁড়াব; কিন্তু কোনো অবস্থাতেই গায়ের জোর খাটাব না।—এই নীতি মধ্যযুগে কেউ কি মানত? এবং এখনো কি মানবে যারা মধ্যযুগে বাস করে? তাদের জন্য তো সেই মধ্যযুগীয় পন্থাই উত্তম। এসো, যে যাকে পারি, জোর যার, মুলুক তার। এই কথাই মাও-সে-তুঙ বলেছেন একটু আধুনিক ভাষায় ক্ষমতার উৎস হচ্ছে বন্ধুকের নল। বন্ধুকের নল দেখিয়ে বিগত চব্বিশ বছর পাকিস্তানের একটি সংখ্যালঘু অংশ সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়কে শাসন ও শোষণ ক’রে আসছে। কি কচুটা তোমরা করতে পেরেছ শুনি। আওয়ামী লীগের মধ্যে কোরায়শী ছিলেন সশস্ত্র বিপ্লবের পক্ষপাতি। পঁচিশে মার্চের রাতের পর কোরায়শী সাহেবের মর্যাদা বহু গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন কোরায়শী সাহেবের যুক্তি-পরামর্শ সকলের কাছেই গুরুত্ব পাচ্ছে। ফিরোজকে তিনি পরামর্শ দিলেন—

‘আণ্ডারগ্রাউণ্ডে তোমার যাওয়ার দরকার নেই। আপাততঃ কেবল ঢাকা ছাড়লেই চলবে। কিন্তু বাড়ি ছাড়তে হবে আজই।’

‘আজ বাড়ি ছাড়ব, কাল ঢাকা ছাড়ব। তারপর? দেশ ছাড়ব কবে?’

‘দরকার হলে তাও ছাড়তে হবে। কিন্তু সে পরের কথা। আমরা আপাততঃ চেষ্টা করব, পাকিস্তানিদের কেবলি ঢাকা শহরে আবদ্ধ রাখতে।’

না পারলে? সে সম্ভাবনা কোরায়শী সাহেব একেবারে অস্বীকার করেন না। তখন বাংলার যে-কোন খানিকটা অঞ্চলকে মুক্ত ক’রে রেখে সেইখানে স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক বাংলাদেশ সরকার করতে হবে এবং ধীরে ধীরে সারা বাংলাকে মুক্ত করতে হবে।

কথাগুলো শুনতে শুনতে সুদীপ্তর মনে হচ্ছিল, তিনি যেন স্বপ্ন দেখছেন। স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক বাংলাদেশ সরকার—স্বাধীন সার্বভৌম বাংলা—এ সব কি বলছেন কোরায়শী সাহেব! এ সব তো তাঁর নিজের মনের কথা। বোধ হয় শুধু তাঁরই নয় প্রত্যেকটি বাঙালির মনের কথা। যে মন স্বপ্ন দেখে সেই মনের কথা। এবং একদিন যে তা সত্য হবে তাতেও সন্দেহ নেই। কিন্তু এখন সে কথা ভাবা যায়!

কেন, দু’দিন আগে সে কথা তোমরা ভাববা নি? সেই শিল্পী-সাহিত্যিকদের মিছিল। রাইটার্স গিল্ড থেকে শহীদ মিনার পর্যন্ত শোভাযাত্রা। কিংবা ঢাকা শহরের সকল শিক্ষায়তনের শিক্ষকদের সেই মিলিত শোভাযাত্রা—বায়তুল মোকাররম থেকে শহীদ মিনার। সেখানে তোমরা শ্লোগান কি দিয়েছিলে, মনে আছে? মনে আছে। পাক-বাহিনী খতম কর—বাংলাদেশ স্বাধীন কর। বাংলাদেশ স্বাধীন কর—বীর বাঙালি অস্ত্র ধর। সেই স্বাধীনতার কথাই তো। এখন বলছেন কোরায়শী সাহেব। অস্ত্রবলে স্বাধীনতাকে ছিনিয়ে আনার কথা বলছেন। তা হলে? তা হলে আর কী! ভালো কথাই বলেছেন। কিন্তু? একটা কিন্তু কিছুতেই মন থেকে দূর হতে চায় না।

কোরায়শী সাহেব চলে যেতেই ফিরোজের তাড়া খেয়ে সুদীপ্ত স্নানের ঘড়ে ঢুকলেন। পেছনে পেছনে ওরাও ঢুকল। সেই ভাবনাগুলি। ছেলেবেলায় সুদীপ্ত একবার একটা কুকুর পুষেছিল। কিছুতেই সে পেছন ছাড়তে চাইত না। লাথি মেরে তাড়াতে চাইলে সে আরো বেশি ক’রে পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়ে লেজ নাড়ত। আজ তার ভাবনাগুলি তেমনি অনুগত কুকুরের মতো হয়ে উঠেছে। ঐ দেখো, সে জল ভরতি টবে লাফিয়ে পড়ে গলা বাড়িয়ে দিয়েছে। চৈত্র মধ্যাহ্নের তপ্ত আবহাওয়াতে ঐ জলটুকু লোভনীয় ছিল বৈ কি। কিন্তু এখন যেন তা অস্পৃশ্য হয়ে গেছে। তিনি দাঁড়িয়ে পড়লেন সেই টবের সামনে।…‥এখন তবে যাই কোথায়! ফিরোজের তো নিজেরই এখন অত্যন্ত দুর্দিন। তার স্ত্রী একটু আগেই যা বলেছিলেন সেটা তা হলে খুবই সত্যি কথা। আমিনার কাল সকালের যুক্তিটাই বোধ হয় ভালো ছিল। কিন্তু কাল সকালে তখন কোনটা যে ভালো ছিল, আর কোনটা খারাপ, সে সব চিন্তার কোন অবকাশ ছিল নাকি! কী তাড়াতাড়ি তখন এক চক্কর ঘুরে এসেছিলেন! তাও আবার ফিরেছিলেন ফিরোজের গাড়িতে। কিন্তু তার জন্যই কতো রাগ আমিনার।

‘তোমার আক্কেলের বলিহারী যাই। কই, তাকিয়ে দেখ দেখি একবার, নীলক্ষেত এলাকায় কারা এখনও বসে আছে!’

সত্যি কথা! ইতিমধ্যেই তখন নীলক্ষেত এলাকা প্রায় ফাঁকা হয়ে গেছে। কিন্তু পথে এতোখানি বুঝা যায় নি। সেখানে অনেক মানুষ তখনও ছিল। অনেক অস্বাভাবিক মানুষ। আতঙ্ক-অঙ্কিত ললাট নিয়ে নিরাপদ আশ্রয় সন্ধানে পথে-বেরুনো আদম-সন্তানেরা। তার মধ্যে তার মতো কেবলি দেখতে বেরিয়েছে এমন মানুষও ছিল। দেখলেই চেনা যাচ্ছিল তাদের। তাদের হাতে কোনো বোচকা নেই বা সঙ্গে কোন স্ত্রীলোক কি শিশু নেই। যানবাহনের দুর্ভিক্ষই সব চেয়ে বেশি। ভদ্র ঘরের নবনীকোমল মেয়েরাও ভারি ব্যাগ হাতে ঝুলিয়ে হেঁটে চলেছেন। তাদের অনেকেরই হয়ত গাড়ি আছে। কিন্তু গাড়ির তেল নেই। পেট্রোল পাম্পগুলি পাকিস্তানিরা নষ্ট ক’রে দিয়েছে, অথবা ঐ রাতে ওখানকার কর্মচারীদের সব মেরে ফেলেছে। দরিদ্র রিক্সাচালক কিংবা স্কুটার-ড্রাইভার বেশির ভাগই বোধ হয় মারা পড়েছে গত দু’দিনে। তা না হলে এখানে-ওখানে রিক্সা-স্কুটার অনেক পড়ে আছে, কিন্তু চালক নেই কেন?

সুদীপ্ত অবশ্য বেশি দূর যান নি। ইকবাল হল পেছনে ফেলে, সলিমুল্লাহ্ হল-জগন্নাথ হলের পাশ দিয়ে গিয়েছিলেন শহীদ মিনার পর্যন্ত। এবং ঐ পর্যন্তই আর এগোতে পারেন নি। ফিরেছিলেন ফিরোজের সঙ্গে। হায় হায়, ঐ, সব কি চোখে দেখা যায়! না, চোখে দেখে এগোনো যায়। জগন্নাথ হলের লাশগুলি অধিকাংশই ওরা পুঁতে দিয়েছিল। কিন্তু ইকবাল হল ক্যান্টিনের কাছে স্থূপীকৃত লাশগুলি ওরা সরায় নি। সেই লাশের স্তুপের মধ্যে একটা গুলি-করে-মারা কুকুরও দেখা গেল। কি বলতে চায় ওরা? আমরা ওদের চোখে কুকুরের সমান? কোনো বাঙালির এ দৃশ্য সহ্য হবার কথা নয়। যারা দাঁড়িয়ে দেখছিল তাদের মধ্যে একজন কুকুরটার একটা ঠ্যাং ধরে একটু দূরে সরিয়ে রেখে এল। সুদীপ্ত সরে ইকবাল হল সংলগ্ন দিঘির দক্ষিণ দিকের রাস্তায় গিয়ে দাঁড়ালেন। কয়েকজনকে সেখানে দাঁড়াতে দেখেই তিনি গেলেন। কী দেখছে ওরা? ওরে বাবা, কি বিরাট গর্ত ইকবাল হলের দেয়ালে।

‘কামান দেগেছে ঐখানে।’—ভীড়ের মধ্যে একজনের মন্তব্য।

আর একজনের মন্তব্য শোনা গেল—

‘ওরে বাবা, ঐ দিকেও কামান দেগেছে দেখা যায়। এ বিল্ডিং দুটোতেও ছাত্র থাকত নাকি!’

দিঘির দক্ষিণ-পশ্চিম কোণের বিল্ডিং দুটোর কথা। ওইখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিস-কর্মচারিগণ থাকেন। ওদের বিল্ডিংয়ের দেয়াল যে একেবারে ঝাঁঝরা ক’রে দিয়েছে। ওখানে কেউ থাকলে তিনি কি বেঁচে আছেন। তাদের তেইশ নম্বরেও তা হলে এমনি ক’রে কামান দাগতে পারত। পারত বৈ কি। সুদীপ্ত আল্লাহ্‌র কাছে কৃতজ্ঞতা জানালেন। তাঁরা তেইশ নম্বরে অনেকের চেয়েই সুখে ছিলেন। তাঁদের সেই অবস্থাটা যদি সুখের অবস্থা হয় তা হলে, হায় গো, দুঃখ কাকে বলে? জগন্নাথ হলের দেওয়ালের গায়েও অমনি কামানের গোলার আঘাতে প্রকাণ্ড ছিদ্র সুদীপ্ত দেখলেন। এ হলের অবস্থা কি হয়েছিল? কে বলবে কি হয়েছিল! কিছু বলার জন্য কেউ বেঁচে আছে নাকি! কিন্তু মরে গিয়েও তো অনেক কথা বলা যায়। যেমন বলছেন এই মেয়েটি। সামাজিক মর্যাদার কোন ধাপের এ মেয়ে তা এখন আর বুঝবার উপায় নেই। কেননা অঙ্গে বস্ত্র অলংকার কিছু নেই! তবে উলঙ্গ শরীরে অলঙ্কারের চিহ্ন আছে। কানের মাকড়ি খুলে নেবার ধৈর্য দুবৃত্তদের ছিল না। কান ভেঁড়া দেখেই বুঝা যায়, কী পৈশাচিক প্রক্রিয়াতে সেটা তারা হস্তগত করেছিল! চুড়ি খোলার সময় হাতের মাংস ছিঁড়ে ছিঁড়ে গেছে—সে সব স্থানে রক্ত জমাট বেধে আছে। আর মুখের মধ্যে দাঁতে লেগে আছে কাঁচা মাংস। কামড়ে তুলে নিয়েছিলেন বোধ হয়। বোধ হয় কেন, সুদীপ্ত যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন, সম্ভ্রম রক্ষার শেষ চেষ্টায় অসহায় নারী প্রাণপণে কামড়ে ধছেন বর্বরের পূতি-দুর্গন্ধ দেহ। দাঁতে লেগে থাকা মাংস তারই সাক্ষ্য। ঠিক এমনি কিছু না হলে তো ক্যান্টনমেন্টের গণিকাবৃত্তি ভাগ্যে জুটত। পেটের অবস্থা দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, রমণী সন্তান সম্ভবা ছিলেন। এবং পাষণ্ডরা গুলি করেছে পেটের মধ্যে সন্তান থাকার সেই জায়গাটিতেই—তলপেটে, আর একটা বুকে। পেটের সন্তানকেও গুলির হাত থেকে রেহাই দেয় নি ওরা। ওই শবের পানে অধিকক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারলেন না সুদীপ্ত। মা গো, তোমার লজ্জা আমরা ঢাকব কি দিয়ে।— দু’হাতে চোখ ঢেকে সেখান থেকে সরে এলেন সুদীপ্ত।

কোথায় এলেন তিনি। এখানে শহীদ মিনার ছিল না। সেটা কোথায় কোন চিহ্নই নেই। তবু চিহ্ন আছে। পড়ে আছে বালি-সিমেন্টের স্তূপ। ডিনামাইট দিয়ে গোড়াসুদ্ধ নির্মূল ক’রে দিয়েছে বাঙালির মর্যাদার প্রতীক সেই প্রাণ প্রিয় শহীদ মিনার। এই তো ক’দিন আগে এইখানে শপথ নিয়েছিলেন তারা—ঢাকার শিল্পী-সাহিত্যিকেরা। কবিবন্ধু শামসুর রাহমানের কণ্ঠে সুদীপ্তদের সকলের দৃপ্ত শপথ বেজে উঠেছিল—আমরা লেখনীকে আজ দেশের স্বাধীনতা-সংগ্রামের হাতিয়ার করব। তা করতেই হবে যে। আর তো ফুল খেলবার দিন নয়, ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা। সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে এখন যেন নতুন ক’রে আবিষ্কার করলেন সুদীপ্ত। হাঁ তো, অবিকল সেই সুভাষদার কণ্ঠস্বর। সুদীপ্তর কানের কাছে মুখ রেখে তিনি বলে যাচ্ছেন— মৃত্যুর ভয়ে ভীরু বসে থাকা, আর না/পরো পরো যুদ্ধের সজ্জা/ প্রিয়, ফুল খেলবার দিন নয়, অদ্য/এসে গেছে ধ্বংসের বার্তা/দুর্যোগে পথ হোক দুর্বোধ্য/চিনে নেবে যৌবন-আত্মা।

এবারের একুশে ফেব্রুয়ারিতে রাত দুপুরের অনুষ্ঠানে সুদীপ্ত এখানে এসেছিলেন। কেননা শুনেছিলেন, স্বয়ং শেখ সাহেব ঐ সময় আসবেন। এসেছিলেনও শালপ্রাংশু বজ্রমানব শেখ মুজিবুর রহমান। কেমন যেন ম্লান দেখাচ্ছিল না মুজিব ভাইকে? ওকে ম্লান বলে নাকি! ঠিক কেমন যে দেখাচ্ছিল কোনো শব্দ দিয়ে তা যেন প্রকাশ করা যায় না। দুর্জয় সেনাপতির প্রতিজ্ঞা, জননীর মমতা এবং ষড়যন্ত্রসঙ্কুল ভবিষ্যতের আশঙ্কা—সবকে এক পাত্রে ঢেলে মিশালে যা দাঁড়ায় মুজিব ভাইয়ের মুখে-চোখে ছিল সেই ভাবের অভিব্যক্তি। বাইরের শত্রুর কাছে এতো কঠোর এতো দুর্দমনীয় যে ব্যক্তিত্ব, ঘরের লোকের কাছে তার একি রূপ! সুদীপ্ত তার চোখের দিকে তাকালেন। সেখানে তো কৈ সেই আগুন নেই! তবু আগুন আছে। আগুন চাপা দেওয়া আছে এবং চারপাশে আপন জনের উদ্দেশ্যে উৎসারিত হচ্ছে বন্ধুর প্রীতি, শিশুর সারল্য আর বয়স্ক হৃদয়ের বাৎসল্য। এখন তিনি অকঠোর, কিন্তু সেই সঙ্গে অনমনীয় শপথে আকীর্ণ। সেই আত্মপ্রত্যয়বিদ্ধ দুর্দমনীয়তার সঙ্গে কি-একটা এসে মিশেছে যেন। কি তার নাম? অপার্থিব দীপ্তি? স্বর্গীয় আভা? নাম যাই হোক, তিনি যে তখন ঐশীবাণীর আশীর্বাদ প্রাপ্ত ছিলেন তাতে তো কোনোই ভুল নেই। তা না হলে কি ক’রে তখন উচ্চারণ করেছিলেন সেই অমোঘ বাণী!–

‘এই শহীদ মিনারে আপনাদের সাথে এই বোধ হয় আমার শেষ দেখা।’

শহীদ মিনারের সামনে থেকে এক মুঠো মাটি নিয়ে কপালে ঠেকিয়ে বঙ্গবন্ধু আরো বলেন—

‘আমি যদি নাও থাকি, আপনারা থাকবেন। এই শহীদ মিনারকে ওরা যদি গুঁড়িয়ে দেয়, তবু থাকবে আপনার দেশের ধুলো-কাদা-মাটি। কখনো এই দেশের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবেন না।’

কি কোমল প্রীতিস্নিগ্ধ কণ্ঠস্বর! ইনিই কি সেই দু সপ্তাহ পরের বজ্রমানব শেখ মুজিব। একুশে ফেব্রুয়ারির ঠিক দু সপ্তাহ পর। রমনা রেসকোর্সে সাতই মার্চের সেই বজ্রকণ্ঠ। সেই কণ্ঠ বিধ্বস্ত শহীদ মিনারের পাদদেশে দাঁড়িয়ে আবার স্মরণ করলেন সুদীপ্ত। কাল থেকে কতো বারই তো স্মরণ করলেন। সেই কণ্ঠ ইতিপূর্বে কখনো কোনো বাঙালি শুনেছে? হয়ত কখনো শুনেছে শশাঙ্কের কণ্ঠে, হুসেন শাহের কণ্ঠে কিংবা সিরাজের সেনাপতি মোহনলালের কণ্ঠে। অতঃপর এই সেদিন নেতাজী সুভাষের কণ্ঠে। নেতাজীর প্রয়াস ব্যর্থ হয়েছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধু! তোমার প্রয়াস ব্যর্থ হবে না। আমরা ব্যর্থ হতে দেব না। সাতই মার্চের রমনা রেসকোর্সে যারা গিয়েছিল তারা কি জীবনের মতো অন্য মানুষ হয়ে যায় নি? অন্ততঃ সুদীপ্ত হয়েছিলেন। রাজনীতির ডামাডোলে সুদীপ্ত কখনো ছায়া মাড়ান না। কিন্তু সাতই মার্চের রমনা রেসকোর্সের দৃশ্য দেখার পর এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বক্তৃতায়, তার সমস্ত চিত্ত ও দেহের প্রতি রক্ত কণা একটি দৃঢ় প্রত্যয়ের বৃন্তে সংহত সূর্যমুখি হয়ে উঠেছে। স্বাধীনতা-উন্মুখ অনির্বাণ সূর্যমুখি।

আমাদের এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম…এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।….

সুদীপ্ত দাঁড়িয়ে ছিলেন। কিন্তু অন্যেরা কেউ দাঁড়াচ্ছেন না। তবে রুমাল বের ক’রে চোখ মুছে নিচ্ছেন সকলেই। সুদীপ্ত চোখ মুছলেন না। দুই গাল বেয়ে জলের ধারা গড়িয়ে গেলেও তিনি সেই ভগ্নস্তূপের পানে ফ্যাল ফ্যাল ক’রে চেয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেন। বরকত-সালামের মুখ মনে পড়ল। একই সময়ের ছাত্র তারা। তাঁর জীবনের কতো স্মৃতির ইতিহাস গাঁথা হয়ে আছে ওদের ঘিরে। বরকতের বৃদ্ধা জননীর সেই কান্না মনে পড়ল। না, তিনি তো শুধুই বরকতের মা নন। কোটি কোটি বাঙালির অসহায় বঙ্গজননীর প্রতীক। নিজের মুখের ভাষা সন্তানকে শেখানোর অধিকার তোমার নেই, তোমার আম-কাঠালের ছায়া-ঢাকা প্রাঙ্গণে নিজের মতো হয়ে বাঁচার অধিকার তোমার সন্তানের নেই, তোমার ভাঁড়ারের রত্নসামগ্রী বিদেশীরা অপহরণ ক’রে নিয়ে যাবে, তা আগলে রাখার অধিকার তোমার সন্তানের থাকবে না। রবীন্দ্রনাথ যথার্থই লক্ষ্য করেছিলেন—আমাদের মা দেবতার মেয়ে, কিন্তু দেবতার ক্ষমতা তাঁর নেই, তিনি ভালোবাসেন, কিন্তু রক্ষা করতে পারেন না।…কিন্তু মা গো, তোমার ছেলেরা এখন বড়ো হয়েছে না! এখনো সন্তানকে রক্ষার প্রশ্ন ওঠে নাকি! এবার আমরাই তোমাকে রক্ষা করব।

‘এই সুদীপ্ত।’

সুদীপ্ত তাকিয়ে দেখেন ফিরোজ। গাড়ির জানলা দিয়ে হাত বের ক’রে তাকে ডাকছেন।