» » চতুর্থ পরিচ্ছেদ

বর্ণাকার

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

সে প্রায় এক বছর আগের ঘটনা। তখন ডঃ খালেকের সাথে সুদীপ্তর পরিচয়ের সবে সূত্রপাত। সুদীপ্ত তখনও জানতেন না যে, ডঃ খালেক আধুনিক পাকিস্তানি মুসলমান। সে জন্য কথায় কথায় ভারত-বিদ্বেষ প্রচার করে থাকেন। কখনো নামাজ-রোজা করেন না। তার বিনিময়ে হিন্দুদের মালাউন বলেন। এবং একাধিক রমণী-সংসর্গকে জায়েজ বিবেচনা করেন। এমনিতে লোকের সাথে মেশেন কম। কিন্তু মেয়েদের সাথে অতি তুচ্ছ বিষয় নিয়েও গল্প করতে পারেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। সে ক্ষেত্রে তিনি পরম অসাম্প্রদায়িক। মেয়েদের জাতি-ধর্ম নিয়ে কোনো প্রশ্ন কখনো তাঁর মনে জাগে না। এবং কেবলি যে মেয়েদের সাথে তিনি গল্পই করেন এমন নয়। সেই সঙ্গে কুমারীত্ব মোচনের পটুত্বের নাহি তার সীমা।

‘একাধিক রমণী-সম্ভোগ কোন্ নবী করেন নি শুনি?–ডঃ খালেক তর্ক করে থাকেন, তাঁরা তৎকালীন যুগের রীতি অনুসারে একাধিক বিবাহ করতেন অথবা একাধিক ক্রীতদাসী রাখতেন। এখনকার সমাজে ঐ সব অচল। অতএব এখন যেটা জায়েজ আমরা তাই করবো। গোপনে প্রেম করবো আমরা।’

এ সব কথা অসার যতোই হোক, শুনতে ভালো লাগে। এবং সেই ভালো লাগার জন্যই সুদীপ্ত কখনো তর্ক করেন না। কেবল শুনেন। কথা ব’লে লাভ কী? ডঃ খালেকের মেজাজটাকে সুদীপ্ত ক্রমে ক্রমে চিনেছিলেন।

অতএব তিনি বেশি কিছু না বলে মাঝে মাঝে কেবল নিরীহ প্রশ্ন তুলে তার কথা বলার ধারাটাকে অক্ষুন্ন রাখতে সহায়তা করেন। সুদীপ্ত যে তাকে কেবলি তাতিয়ে তুলে কিছু কথা বলিয়ে নিতে চান এটা ডঃ খালেক টের পান না। বরং সুদীপ্তর মধ্যে তার একজন অনুরক্ত ভক্তকে লক্ষ্য করে পুলকিত হন। আর সুদীপ্ত প্রশ্নও করেন ভারী চমৎকার। ঐ প্রশ্ন কানে শুনেও সুখ আছে।

‘আচ্ছা ডঃ খালেক, মেয়েদের আপনি ভোলান কি করে?’

‘কথা দিয়ে। সেরেফ কথার কায়দা।’

‘বুঝতে পারলাম না? একটু নমুনা শুনিয়ে দিন।’

‘বুঝলেন না। তবে একদিনের ঘটনা বলি শুনুন। একদিন একজনকে বললাম, বাসায় আজকাল একা আছি। আজ বিকেলে এসো বেড়াতে।’

‘বললেন এ কথা! মেয়েটি চটল না।’

‘চটতে পারত। কিন্তু চটে নি। আর চটলেই বা কী? বুঝতাম এখানে সুবিধা হবে না। অন্য মেয়ের খোঁজ করতাম। আরে সাহেব, এ সব ব্যাপারে সেন্টিমেন্টাল হ’তে নেই, বুঝলেন। রাস্তার পাশে বাসের জন্য অপেক্ষা করছেন। দেখলেন, বাসটা খালি নেই। সে জন্য তখন মন খারাপ করে বাড়ি ফিরে যাবেন নাকি! পরবর্তী বাসের জন্য একটু অপেক্ষা করুন। শিগগিরই পেয়ে যাবেন।’

‘এ তো হক কথা! আচ্ছা তারপর? মেয়েটি কি বলেছিল?’

‘হাঁ, সেই মেয়েটি। মেয়েটি আমার কথা শুনে কী রকম একটা ভঙ্গি। করেছিল চোখ মুখের। তা বর্ণনার অসাধ্য। অনুকরণ করে দেখাতেও পারব না, মেয়েরাই পারে ঐ রকম করে চোখ মুখ বাঁকাতে। বাঁকা চোখে আমার পানে তাকিয়ে সে বলেছিল— বলছেন যেতে গেলে কী হবে টা শুনি?—আচ্ছা এবার বলুন তো, এ কথার উত্তরে আপনি হ’লে কী বলতেন?’

কী বলা যায় এ ক্ষেত্রে? সুদীপ্ত যেন ভেবে পেলেন না। তবু বললেন–

‘আমি হলে বলতাম কী আর হবে, গেলে ভালো লাগবে।’

‘রাবিশ! আপনি নাকি কবিতা লেখেন। ঐ কথা বললে সঙ্গে সঙ্গে সে রেগে স’রে যেত আপনার কাছ থেকে। আমি কী বলেছিলাম জানেন? সঙ্গে সঙ্গে ব’লে উঠেছিলাম—তুমি গেলে আমার সাইবেরিয়ার শীতে একহাঁটু ফাল্গুনের উদয় হবে।’

এই হচ্ছেন ডঃ খালেক। নিজেকে তিনি বৈজ্ঞানিক বলে প্রচার করে থাকেন। প্রায়ই কথায় কথায় বলে থাকেন–

‘আমরা পলিটিক্সের কি বুঝি! আর সাহিত্যেরই বা কি বুঝি! আমরা কাঠখোটা বৈজ্ঞানিক মানুষ ……ইত্যাদি।

ঠিকই তো। এম, এস-সি, ক্লাসে যখন বিজ্ঞান পড়ান তখন বৈজ্ঞানিক বৈ কি। এই বৈজ্ঞানিক সাহেব সাহিত্য কিংবা পলিটিক্স বোঝেন না।

কিন্তু একটি জিনিস বোঝেন, অন্ততঃ বোঝেন ব’লে দাবী করেন। সেটা ইসলাম। ইসলামের খেদমতের জন্য পাকিস্তান হয়েছে। আর পাকিস্তান বানিয়েছেন কায়েদে আযম, এবং পাকিস্তানের রক্ষক হচ্ছে সেনাবাহিনী। অতএব ইসলাম কায়েদে আযম, পাকিস্তান ও পাকিস্তানের সেনাবাহিনী এদেরকে বিনা বিতর্কে মেনে নিতে হবে। ঈমানদার হতে হবে। খালেক সাহেবের মতে—

‘পাকিস্তানী মুসলমানের ঈমানের পাঁচ স্তম্ভ হচ্ছে—আল্লাহ, আল্লাহর রসুল, কায়েদে আযম, পাকিস্তান আর পাকিস্তানের সেনাবাহিনী।’

এই পাঁচের উপর অগাধ আস্থা স্থাপন করে খালেক সাহেব খাঁটি মুসলমান। অবশ্যই পাকিস্তানি মুসলমান। এই পাঁচের বিরুদ্ধে কোনো সমালোচনা, খালেক সাহেবের মতে, বিলকুল হারাম। সুদীপ্ত প্রথম দিকে এতো জানতেন না। তাই, প্রথম পরিচয়ের দিনই বেধেছিল একটা গণ্ডগোল। তার আগের দিন একটি কাণ্ড ঘটে গেছে বিশ্ববিদ্যালয়ে। জামাতে ইসলামের এক দল ছাত্র অন্য একটি ছাত্র-প্রতিষ্ঠানের আয়োজিত একটি সভা পণ্ড করতে গিয়ে মারামারি বাধিয়েছিল। সেই মারামারিতে মারা গেছে জামাতে ইসলামেরই একটি ছাত্র। জামাতে ইসলামের ছাত্র মারা গেছে। পাকিস্তানের পাক মাটিতে ইসলামের এতো অপমান! ডঃ খালেক যে কি পরিমাণ ক্ষুদ্ধ হয়েছিলেন বেচারা সুদীপ্ত সেটা জানতেন না। অতএব আপন অজ্ঞাতেই সুদীপ্ত একটি গুনা ক’রে ফেলেছিলেন, ডঃ খালেকের একটি উক্তির প্রতিবাদ করেছিলেন। ডঃ খালেকের বক্তব্য ছিল–

‘শহীদের রক্ত যেখানে পড়েছে সেখানে মসজিদ বানাতে হবে।’

‘ছেলেরা তো নিজেদের মধ্যে মারামারি করে মরল! ঐ ভাবে কেউ মরলে তাকে শহীদ বলা যায় নাকি! শহীদ মানে তো…‥।’

কথা শেষ করতে পারেন নি সুদীপ্ত। কথার মাঝখানে খালেক সাহেব বলে। উঠেছিলেন–

‘আলবাৎ শহীদ বলা যায়। পাকিস্তানের সংহতি যারা নষ্ট করতে চায় তাদেরকে রুখতে গিয়েই তো মরতে হ’ল ছেলেটাকে। তা হ’লে সে শহীদ হবে না কেন?’

‘তাও হবে না।’ সূদীপ্ত তর্ক তুললেন, ‘তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নিই যে বিপক্ষ দল পাকিস্তানকে দু’টুকরো করতে যাচ্ছিল, তা হ’লেও সে শহীদ হয় না। কেননা শহীদ মানে…

‘আপনার মানে রাখুন। পাকিস্তান মানেই ইসলাম, ইসলাম মানেই পাকিস্তান। অতএব যে ছেলে ইসলামের সংহতি বাঁচাতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছে। সে শহীদ।’

না, এগোনো আর ঠিক নয়। সুদীপ্ত দেখলেন, অনেক অপ্রীতিকর প্রসঙ্গ এসে যাচ্ছে। সেটাকে এড়াবার জন্যই তিনি এবার উঃ খালেকের কথায় সায় দিয়ে বললেন—

‘হাঁ, ঐ ভাবে ভাবলে ছেলেটি অবশ্যই শহীদ হয়েছে। ওখানে এখন আপনারা আর একটা শহীদ মিনার তুলতে পারেন।’

ইতিপূর্বেই যে ডঃ খালেক সেখানে মসজিদ বানাবার কথা তুলেছেন সেটা তখন আর সুদীপ্তর মনে ছিল না। বেচারা সুদীপ্ত! বিতর্কের বদ্ধ ডোবাটাকে এড়াবার জন্য যেদিকে পা বাড়ালেন সেদিকেই ছিল সেই গর্ত। গর্তে পড়ে গেলেন সুদীপ্ত। ডঃ খালেক চিৎকার করে উঠলেন—

‘শহীদ মিনার? আমরা বানানো শহীদ মিনার! এতোই মালাউন ভাবলেন আমাদের? জেনে রাখুন, তেমন দিন এলে আপনাদের ঐ শহীদ মিনারকে ভাঙ্গব আমরা।’

‘শহীদ মিনার ভেঙ্গে দেবেন!’–বিস্ময় প্রকাশ করেন সুদীপ্ত।

‘এক শো বার ভাঙব। আপনারা সেখানে কুফরী কাম করবেন, শেরেক করবেন, আর সেটা আমরা ভাঙব না। ভেঙ্গে সেখানে বানাব মসজিদ।’

সুদীপ্ত আর নিজেকে সামলাতে পারেননি। আপনিই তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল—

‘মধ্যযুগে শোনা যায় মুসলমানেরা মন্দির ভেঙ্গে মসজিদ বানাত, সেটা তা হলে মিথ্যা নয়।’

‘হোয়াট? মুসলমানের নামে কাফের-প্রদত্ত এই কলঙ্কে বিশ্বাস করতে আপনার রুচিতে বাধল না?’

‘আপনি তা বলে চটবেন না। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের কথা নয়। কথা হচ্ছে ঢাকা শহরে এতো মসজিদ। সেখানে আবার মসজিদ বানালে……’

আলবৎ মসজিদ বানাতে হবে। দরকার হলে সারা ঢাকা শহরকেই আমরা মসজিদ বানিয়ে ছাড়বো।’

সেটা অবশ্য একটা কীর্তি হবে।’–খুব আস্তে বলেছিলেন সুদীপ্ত। এবং মৃদু হেসেছিলেন।

‘কীর্তি? আপনি ঠাট্টা করছেন?’

‘একটুও না। সারা ঢাকা শহর যদি একটা মসজিদ হয় তা হলে বিশ্বের মধ্যে সেটা কীর্তি হবে না! কী যে বলেন!’

সহসা কি ভেবে ডঃ খালেক উত্তেজনা দমন করে নিয়েছিলেন। তা দেখে অবাক হয়েছিলেন সুদীপ্ত। কী ঘটল আবার! নাকি ইচ্ছে করে রঙ বদলাচ্ছেন! ক্ষণে ক্ষণে এমন করে যারা পালটাতে পারে তারা কী ধরনের মানুষ? না, মানুষ তারা নয়। হয় শয়তান, না হয় ফেরেশতা। ডঃ খালেক কোনটা? হয়ত শেষেরটাই হবেন। ডঃ খালেক সম্পর্কে ভালো ধারণাই মনে পোষণ করতে চেষ্টা করলেন সুদীপ্ত। খালেক সাহেব খুব খাটো গলায় বলে উঠলেন—

‘যাক, এ নিয়ে আমি আর তর্ক করব না আপনার সাথে। কেউই আমরা পরস্পরকে এখনো ভালোভাবে জানি নে। তবে বন্ধুভাবে একটা উপদেশ আপনাকে দিতে পারি। হিন্দুস্থান থেকে তাড়া খেয়ে এসেছেন কেন?—এ প্রশ্নটা কখনো যেন মুছে দেবেন না মন থেকে।’

কিন্তু মুছতেই হবে যে। দূরের একটা মানুষ সম্পর্কে মনে বিরূপতা পোষণ করে হয়ত বাঁচা যায়। কিন্তু প্রতিবেশী সম্পর্কে একেবারে বেঁচে থাকার স্বার্থেই পারস্পরিক সম্প্রীতি ও বোঝাপড়া গড়ে তুলতেই হবে। সুদীপ্ত একথা অকপট ভাবেই বিশ্বাস করেন। তা ছাড়াও একটা প্রশ্নকে তিনি কখনো এড়াতে পারেন না। মানুষের সাথে কি অন্তরঙ্গতা জমে ওঠে কেবলি ধর্মবিশ্বাসের ভিত্তিতে? প্রশ্নটাকে তিনি মনেই চেপে রেখে সেদিনের মতো খালেক সাহেবের সঙ্গে আলোচনায় ইতি টেনে দিলেন।

কিন্তু খালেক সাহেবকে কোন দিনই আর প্রসন্ন মনে মেনে নিতে পারেন নি সুদীপ্ত। বিশেষতঃ হিন্দু হলেই তাকে মুসলমানের শত্রু মনে করতে হবে–এটা কি ধরনের মানসিকতা? সেখানে বিনয়দারা ছিলেন না? এখানে প্রফেসর দেবকে এরা দেখতে পায় না। একদিন প্রফেসর দেবকে সুদীপ্ত দেখেছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদে। মসজিদে হজরত মোহাম্মদের জন্মদিন উপলক্ষে অনুষ্ঠান হচ্ছিল। বিশ্বের একজন মহামানবের জন্ম দিন। তাতে যোগ দেবার অধিকার সকলেরই আছে না? সেখানে হজরত মোহাম্মদের জীবনী আলোচনা হ’ল, মিলাদ হ’ল–সবেই যোগ দিলেন ডঃ দেব। সুদীপ্ত দেখলেন। এবং ডঃ খালেকের পেড়াপীড়িতে অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আসার জন্য মনে মনে যে ক্ষোভটা ছিল তা ভুলে গেলেন। এই ধরনের অনুষ্ঠানে সুদীপ্ত কখনো যান না। এবং নামাযের জন্য কখনো মসজিদে না গেলেও এ ধরনের অনুষ্ঠানে খালেক সাহেব সর্বদাই যোগ দিয়ে থাকেন। আজ তিনি একা নিজে আসেন নি, সুদীপ্তকেও ডেকে এনেছেন। অগত্যা সুদীপ্ত এসেছেন। এবং এসেই ডঃ দেবকে দেখে প্রথমে বিস্মিত হয়েছেন, পরে ভক্তিতে শ্রদ্ধায় আপ্লুত হয়েছেন। হাঁ সত্যিকার একজন দার্শনিকের পক্ষেই এ পোড়া দেশে এমন উদার মানসিকতাকে পালন করা সম্ভব। কিন্তু ডঃ দেবের এই উদার মানসিকতাকে ডঃ খালেকেরা কী দৃষ্টিতে গ্রহণ করেছিলেন?

ফেরবার পথে ডঃ খালেকই তুলালেন কথাটা—

‘মালাউনের কাণ্ডটা দেখলেন, কেমন করে মসজিদের ইজ্জত নষ্ট করে দিলে।’

সুদীপ্তর সমস্ত চিত্ত ঘৃণায় রি-রি করে উঠল। মনে মনে ঠিক করে ফেললেন, এই লোকটার সাথে কখনো আর মেশা হবে না। গাড়িতে না হলে এই মুহূর্তেই লোকটাকে এড়িয়ে উলটো পথে হাঁটা শুরু করতেন। আপাততঃ এড়াবার পথ না পেয়ে, এবং এক সাথে চলতে বাধ্য হয়ে সুদীপ্ত বললেন—

‘আমার তো মনে হল মসজিদের ইজ্জত আরো বেড়ে গেল।’

‘কিভাবে? আমাকে বুঝান।’—কী ভেবে যেন ডঃ খালেক আজ চটলেন না। হয়ত তিনি জানেন গাড়ি চালাবার সময় চটতে নেই, কোনো বিপত্তি ঘটতে পারে। হয়ত বা অন্য কোন কারণ ছিল। যাই হোক, এদিকে সুদীপ্তও কিন্তু বাঁকা পথ ধরলেন। খালেকের কথার সরাসরি কোনো জবাব না দিয়ে বললেন—

‘বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিসাবে আপনিই তো অন্যকে বোঝাবেন। অন্যে আপনাকে বোঝাবে এটা হয় কি ক’রে?’

‘ও সব চুটকি কথা দিয়ে আমাদের ভোলাতে পারবেন না সাহেব। ফাজলামো করে আসল কথাটা এড়াতে চাইছেন তো! কিন্তু আমাদের কাছে সোজা কথাটা শুনুন। ঐ ডঃ দেব পাকিস্তানের একটা দুশমন।’

নাহ, এখানে আর কোনো কথা বলাই উচিত নয়। সুদীপ্ত চুপ করে গেলেন। কিন্তু খালেক সাহেব বোধ হয় চুপ থাকতে জানেন না। তিনি চেপে ধরলেন সুদীপ্তকে—

‘এ কথা আপনি স্বীকার করেন?’

হাঁ, এবার কিছু একটা বলতেই হয়। খুবই গম্ভীর স্বরে সুদীপ্ত বললেন—

‘ডঃ দেব সম্পর্কে যখন অন্য কিছু জানিনে তখন–’

‘তখন? থামলেন কেন, বলুন।’

‘বলছি। আজকে যে উদরতা তার মধ্যে দেখলাম সেটা…‥’

‘সেটা পাকিস্তানের পক্ষে বিপজ্জনক, সুদীপ্তকে বাক্য শেষ করতে না দিয়েই ব’লে উঠলেন ডঃ খালেক, ধর্মের জগাখিচুড়ি পাকিস্তানে চলবে না। বিশুদ্ধ ইসলামের থেকে এক ইঞ্চি স’রে গেলেই পাকিস্তান মারা পরবে—এই আপনাদের আমি ব’লে থুলাম।’

ডঃ খালেকের গাড়ি ততক্ষণে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাব-প্রাঙ্গণে এসে ঢুকেছে। গাড়ি থেকে নামতে নামতেই সুদীপ্ত প্রশ্ন করলেন–

‘কিন্তু ডঃ দেব যে আপনাদেরকে বিশুদ্ধ ইসলাম থেকে বিচ্যুত করতে চাইছেন তার প্রামাণটা কী?’

‘আমাদেরকে? আমাদেরকে ইসলাম থেকে বিচ্যুত করে কেটা? ইসলাম থেকে বিচ্যুত করবে আপনাদেরকে। বিচ্যুত করবে ঐ উদারতার টোপ গিলিয়ে। মুসলমান ছেলেকে পালিত পুত্র করেন কেন—কোন দিন ভেবে দেখেছেন সেই কথাটা?’

‘এতে ভাবার কি আছে। বাঁচার দৃষ্টিতে হিন্দু-মুসলমান সত্য নয়। সত্য হচ্ছে মানুষ। তিনি পালিত পুত্র হিসাবে গ্রহন করেন মানব-সন্তানকে, মুসলমানকে বা হিন্দুকে নয়।’

‘ঐ সবই হচ্ছে হিন্দুস্থানী চালবাজি। হিন্দু বা মুসলমানের ভেদাভেদটাই যদি না থাকল তা হলে পাকিস্তান ও হিন্দুস্তানের ভেদাভেদটাই বা থাকল কোনখানে? অতএব হিন্দু বা মুসলমানের ভেদাভেদ যারা মানবেন না তারা পাকিস্তানি আদর্শের বিরোধী। পাকিস্তানের শত্রু তাঁরা।’

এই ভাবে ডঃ খালেক সেদিন ডঃ দেবকে পাকিস্তানের শত্রু বানিয়ে ছেড়ে ছিলেন। ডঃ খালেকের দৃষ্টিভঙ্গিই কি তবে সঞ্চারিত হয়েছে পাকিস্তানি সামরিক চক্রের মধ্যে? নাকি সামরিক চক্রের কণ্ঠস্বরই সেদিন শোনা গিয়েছিল খালেক সাহেবের মধ্যে? খালেক সাহেব কি তবে সামরিক চক্রের হিজ মাষ্টারস ভয়েস? অন্ততঃ ডঃ দেব সম্পর্কে খালেক সাহেব ও সামরিক চক্রের চিন্তাধারা একই দিকে প্রবাহিত বলে মনে হয়—উভয়েই সিদ্ধান্ত হচ্ছে, ডঃ দেব পাকিস্তানের শত্রু। তাই যদি হয়, সুদীপ্তর মনে হল তা হলে আমরাও পাকিস্তানের শত্রু। ডঃ দেবের আদর্শ ও পাকিস্তানি আদর্শ (অবশ্য ডঃ খালেকদের পাকিস্তান)-এই দুয়ের মধ্যে আমাদের নিকট বরণীয় হবে কোনটি? নিঃসন্দেহে প্রথমটাই।

ডঃ দেবকে ও তার পুত্রকে একই সারিতে দাঁড়িয়ে দিয়ে ওরা গুলি করে। পাশাপাশি লুটিয়ে পড়ে দুটি দেহ। ওরা পিতা-পুত্র। কিন্তু রক্তের মিল ছিল কোথায়? ওদের রক্তের মিল হয়েছে ওদের মৃত্যুর পর। এমনি রক্তের মিল হয়েছিল আরো দুজনের। দুজন প্রখ্যাত অধ্যাপক পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যক্ষ মনিরুজ্জামান ও ইংরেজি বিভাগের রীডার ডঃ জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা। চৌত্রিশ নম্বর বিল্ডিংয়ের দুটি ভিন্ন ফ্ল্যাটে তারা থাকতেন। নিজ নিজ ধর্মে দুজনেরই নিষ্ঠা ছিল প্রবল। পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে দুজনকে গুলি করা হলে রক্তের ধারা মিশে গিয়েছিল। সিমেন্ট বাধনো মেঝেতে সেই মিশে যাওয়া রক্তের জমাটবদ্ধতা অনেকেই তো দেখেছিলেন। দেখেছিলেন সুদীপ্ত কিন্তু সে রক্তের কোন অংশ মুসলমানের, আর কোন টুকুই বা হিন্দুর তা কি চেনা গিয়েছিল? আর কতো মর্মান্তিক ছিল সেই দৃশ্য—সেই রক্তমাখা পায়ের ছাপ। একাধিক পায়ের অনেক ছাপ পড়েছে কংক্রিট-বাঁধানো আসা-যাওয়ার পথের উপর। সে যেন দেখা যায় না। কিন্তু যা দেখা যায় না তা-ই যে ঘুরে ঘুরে দেখতে হচ্ছে সারাক্ষণ।

শহীদ মিনারের সামনে এতো কী দেখার ছিল সুদীপ্তর? চৌত্রিশ নম্বর বিল্ডিংয়ের দক্ষিণ দিকে রাস্তার ওপাশে শহীদ মিনার। বিচূর্ণীকৃত শহীদ মিনারের সামনে সুদীপ্ত কাল সম্বিৎ ফিরে পেয়েছিল ফিরোজের আহ্বানে। মাত্র গত কালের কথা। কিন্তু সুদীপ্তর এখন মনে হচ্ছে সে কথা কত কালের। গাড়িতে উঠবার সময় সুদীপ্ত কোনো কথা বলেন নি। কেবল ফিরোজ বলেছিলেন–

‘যাক, তোমাকে পেলাম তাহলে।’

সুদীপ্তকে যে পাওয়া যাবে ফিরোজ সে আশা করেন নি। ফিরতি পথে তিনি তখন সুদীপ্তর সন্ধানেই যাচ্ছিলেন। আর ভাবছিলেন, ওরা কি আছে! কী অবস্থায় না জানি দেখতে হবে ওদেরকে! ভাবতে ভাবতেই সুদীপ্তকে সামনে পেয়েছিলেন। শহীদ মিনারের সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদছে।

এই জন্যই পাগলটার সাথে এতো বন্ধুত্ব ফিরোজের। কী কাণ্ড দেখ দেখি। ছত্রিশ ঘণ্টা কারফিউয়ের পর কোথায় বৌ-ছেলে ফেলে শহীদ মিনারের সামনে এখন কাঁদতে এসেছে। শহীদ মিনারের শোকটাই তার কাছে বড়ো হয়েছে। কিন্তু অস্বাভাবিক হয়েছে কি? একটুও না। শুধু সুদীপ্ত কেন। কোন্ বাঙালি আজ এই পথে যেতে চোখের পানি মুছছে না? মেডিক্যাল কলেজের পথে এইখানে ফিরোজও তো কেঁদে গিয়েছেন তখন।

‘চল, গুহঠাকুরতা স্যারের দুঃসংবাদ শুনলাম। একটু দেখি গিয়ে।’

–গাড়িতে স্টার্ট দিয়ে ফিরোজ বললেন।

কিন্তু কি আর দেখবেন তারা। কিছুই দেখার ছিল না। ছিল শুধু রক্ত, রক্তের ছাপ, রক্তের বন্যা। প্রবেশপথের প্রশস্ত চাতালের মধ্যে এক চুল স্থানও পাওয়া গেল না যা রক্ত প্লাবিত নয়। সদর রাস্তা থেকে প্রবেশদ্বার পর্যন্ত পথটুকু সবটাই রক্ত-চিহ্নিত। রক্তের ধারা গড়িয়ে গেছে নর্দমায়।

ফিরোজের দুর্ভাগ্য। গুহঠাকুরতা স্যারের পুরো সংবাদ পান নি। পেলে এখানে আসতেন না। যেতেন হাসপাতালে। হাসপাতালে ঢুকলে দেখতেন, স্যার তখন দিব্যি কথা বলছেন। শরীরের এক অংশ অবশ হয়ে গেছে, কিন্তু কথা বলতে পারছেন এবং ভবিষ্যত পরিকল্পনা ব্যক্ত করছেন—–বোধহয় উঠতে আর পারবো না। শুয়ে বসে কাটাতে হবে। ঠিক আছে। বসে বসে বই লিখব। তাতেই চলে যাবে আমাদের।

কিন্তু হায় চলতে দিচ্ছে কে? মাত্র কয়েক ঘণ্টার ওপারে মানব জীবনের চরম ঘটনাটি তখন প্রতীক্ষা করছে তার জন্য। ইয়াহিয়ার বর্বর সৈনিকেরা রাতেই যে কাজটি সম্পন্ন করতে চেয়েছিল তা সম্পন্ন হয়েছিল দিন দুই তিন পর। হাঁ, ইয়াহিয়ার পিচাশ সৈনিক একেবারে সাবাড় ক’রে দেওয়ার জন্যই গুলি করেছিল গুহঠাকুরতা স্যারকে। কিন্তু গুলি তাঁর ঠিক জায়গায় লাগে নি। তা হলেও সে রাতে কি রক্ষা পাওয়ার উপায় ছিল? সর্বত্রই মৃতদেহ তারা রাখেন। কোথাও কোথাও গর্ত করে আশেপাশের লাশগুলিকে তারা মাটি-চাপা দিয়েছিল। কেবলি লাশগুলিকে? ওরে বাবা, তা হলে রক্ষে থাকবে কিছু? সেনাপতি চেয়েছেন, কাউকে আধমরা করে ফেলে রাখা চলবে না। বাঙালি তবে আবার বেঁচে উঠে হাঙ্গামা শুরু করবে। অতএব একেবারে সব মেরে লাশ বানিয়ে দাও। সৈনিকদের শকুন-দৃষ্টিতে সে রাতে, তাই, আহত বলে কিছু ছিল না, ছিল কেবল লাশ। সে রাতে আহত-নিহত নির্বিচারে সকলকে পুঁতে দিয়ে অভূতপূর্ব রেকর্ড সৃষ্টি করেছিল পাকিস্তানিরা। অধ্যাপক মনিরুজ্জামান ও তাঁর পুত্রসহ অন্য দুজন আত্মীয়ের মৃতদেহ যখন টেনে নিয়ে গিয়ে জগন্নাথ হল প্রাঙ্গণে গর্তে মাটিচাপা দেয়া হয়েছিল তখন কি আহত অধ্যাপক গুহটাকুরতা অব্যাহতি পেতেন ওদের হাতে? কিন্তু হায় অব্যাহতি পেয়ে লাভ কী হ’ল? তাঁকে রাখা তো গেল না। এ বেদনা কী করে বহন করবেন বাসন্তী দি। অধ্যাপক ডঃ জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার স্ত্রী শ্রীমতী বাসন্তী গুহঠাকুরতা গেণ্ডারিয়া উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষয়িত্রী। ঐ বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষয়িত্রীর জন্য নিজস্ব বাসভবন আছে। সেখানেই তারা থাকতেন এতকাল। স্ত্রীর সুবিধার জন্য স্বামী অসুবিধা ভোগ করেছেন দীর্ঘকাল। সুদূর গেণ্ডারিয়া থেকে নীলক্ষেত আসা-যাওয়া করেছেন। অতঃপর—ডঃ গুহঠাকুরতা জগন্নাথ হলের প্রভোস্ট হলে তারা উঠে এসেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বাড়িতে। এই তো কয়েক মাস মাত্র আগে এসেছেন। যদি সেখানেই থেকে যেতেন তারা। কিন্তু গেণ্ডারিয়াতেই কি হত্যাকাণ্ড বাদ গেছে নাকি! না, সে স্থানও নিরাপদ ছিল না। অধ্যাপক মনিরুজ্জামান পূর্বে যে তেইশ নম্বর বিল্ডিংয়ের সামনে একটা ফ্ল্যাটে থাকতেন সেটাই কি নিরাপদ ছিল? তবু অনেকেই বলেছেন, বাসা বদল না করলে ওদের এই বিপত্তি ঘটত না। ও সব কথা লোকেই বলে। মনিরুজ্জামান সাহেবের স্ত্রী বলেন না। মনিরুজ্জামান সাহেবের স্ত্রীর মতো অমন মহিয়সী তেজস্বিনী মহিলা হয় না—কথাটা বাসন্তীদির। তাঁর কথা মনে হলে বাসন্তীদির সারা মন কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠে। অত সাহস তিনি পেয়েছিলেন কোথায়? তাঁর বাড়ির সকলকেই তো ওরা মেরেছিল—তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র, স্বামী, স্বামীর ছোট ভাই এবং একটি ভাইপো—কেউ রেহাই পায়নি। কোলের শিশুপুত্র নিয়ে কেবল বেঁচেছিলেন তিনি নিজে। আর বেঁচেছিল একটি বিবাহযোগ্য কন্যা—তাকে লুকিয়ে রাখা হয়েছিলো। দুবৃত্তদের নজরে পড়ে নি। বড় ছেলে এ বছর এস, এস, সি, পরীক্ষা দিত। সেই ছেলেকেও যখন ওরা মারলে তখন কি আর মাথা ঠিক থাকার কথা। কিন্তু তবু ঠিক রেখেছিলেন মহিলা। বেঁচে যাওয়া শিশু-পুত্রটি মায়ের সঙ্গে পিছে পিছে এসে মাকে প্রশ্ন কারেছিল—

‘আব্বা ভাইয়া ওরা সব এখানে শুয়েছে কেন আম্মা?’

সঙ্গে সঙ্গে পেছন ফিরে ছেলেকে বুকে নিয়ে হু হু করে চোখের পানিতে বুক ভাসিয়েছিলেন বেগম মনিরুজ্জামান। বাপ রে তোর জন্যই আমাকে বাঁচতে হবে। মনে মনে বলেছিলেন। এবং তখনো কিংকর্তব্যবিমূঢ় হন নি।

দুর্বৃত্তরা স্বামী-সন্তানকে এই রাতে নিচে নিয়ে গেল কি মারবার জন্য?— নিজের ফ্ল্যাটে কিছুক্ষণ বড়ো অস্থির হয়ে এ-ঘর ও-ঘর করেছিলেন। তারপর একাই নিচে নেমে এসেছিলেন— তাঁদের তিন তলার ফ্ল্যাট থেকে এক তলায়। তখনি কখন মায়ের সঙ্গে পিছে পিছে এসেছিল চার বছরের সেই শিশুপুত্র।

নিচে সেই দৃশ্য দেখে একটুও অবাক হন নি বেগম মনিরুজ্জামান। তাঁরা পাঁচজন পড়ে আছেন। প্রবেশপথের রক্তধৌত প্রশস্ত চাতালে পড়ে দুএকজন তখনও কাতরাচ্ছেন। কারা তারা?—এ প্রশ্ন মনে না তুলে সেই মুহূর্তেই তিনি ছুটে গিয়েছিলেন উপরে। এক বোতল পানি ও চামচ নিয়ে এসেছিলেন। তাঁর বুকের মানিক বড়ো ছেলেটি তাকাচ্ছে তখনও। মাকে দেখে চোখ দুটো একটু বড়ো-বড়ো হ’ল শুধু। তার পরেই সে যে চোখ বন্ধ করল আর তা খোলে নি কখনো। মা তাড়াতাড়ি এক চামচ পানি দিয়েছিলেন মুখে। কিন্তু খেতে পারে নি। গাল বেয়ে গড়িয়ে গিয়েছিল। বুকের স্তন্য দানে যাকে মানুষ করেছিলেন মৃত্যুকালে একটু পানি পর্যন্ত তাকে খাওয়ানোর সুযোগ পেলেন না। ছেলে চলে গেল। কিন্তু ওই ভদ্রলোক তো বেঁচে আছেন—নিচের তলার সেই হিন্দু অধ্যাপকটি জল চাইছেন। পর্দানশীন মহিলা। কখনো সামনে যান নি। কিন্তু এখন তাকে কতো কালের চেনা ভাইয়ের মতো মনে হ’ল। কাছে গিয়ে চামচ দিয়ে জল দিলেন মুখে। কয়েক চামচ খাওয়ানোর পরই মনে হ’ল এখনো তো এঁর বাঁচার সম্ভাবনা আছে। তখনি গিয়ে কপাটে ধাক্কা দিলেন—

‘দিদি, বের হন। আপনার সাহেবকে ঘরে নিন। আমার সাহেব মারা গেছেন। আপনার সাহেব এখনও বেঁচে আছেন।’

কথাগুলি বাসন্তী দি কখনও ভোলেন নি। সেই দুর্যোগের রাতে স্বামীকে ধরে নিয়ে গেলে একমাত্র কিশোরী কন্যাকে বুকে নিয়ে বাসন্তী দি যখন অতি মাত্রায় অসহায় বোধ করেছিলেন ঠিক তখনই যেন তাঁর বোনের ছদ্মবেশে কোন দেবী এসে তাঁকে ডাক দিলেন—দিদি বের হন, আপনার সাহেব এখনো বেঁচে আছেন। কিন্তু আরো কি একটা কথা বলল যেন— আমার সাহেব মারা গেছেন। বোন আমার, এ তুই কী শোনালি। হু-হু করে কেঁদে উঠেছিল বাসন্তী দির বুকের ভিতরটা।

বাসন্তী দি কয়েকবার ডাক দিতেই তাঁর গাড়ির ড্রাইভার সাহস করে বেরিয়ে এসেছিল। গ্যারেজের উপর তলার একটি কামরায় সে থাকত। তার সাহায্যে মা ও মেয়েতে মিলে স্বামীকে ঘরে তুলেছিলেন তাঁরা।

অতঃপর কিছুক্ষণের মধ্যে আবার জওয়ানরা এসেছিল। ধ’রে এনেছিল বস্তির কয়েকজন লোক। লাশগুলি টেনে নিয়ে যাবার হুকুম হয়েছিল তাদের পর। হায় হায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক—একটি বিভাগের প্রধান তাঁর ঠ্যাং ধরে এমনি ক’রে টানতে টানতে নিয়ে গেল। তিনি জানলা দিয়ে দেখলেন। বস্তিবাসীদের দোষ ছিল না। তারা ধরাধরি করে নিয়ে যেতে চেয়েছিল; কিন্তু চাওয়ার তাদের কোন মূল্য আছে? বর্বরদের গুঁতোর চোটে তাদেরকেও বর্বর কাম করতে হয়েছিল। তবু শেষ রক্ষা হয় নি। তাঁরা বাঁচেনি একজনও।

জগন্নাথ হলের মাঠে আরো অনেকগুলি বস্তিবাসী বিভিন্ন দিক থেকে মৃত দেহ কুড়িয়ে এনে একত্রে জড়ো করছিল। তাদের পিছে পিছে সঙ্গিন উঁচিয়ে এসেছিল জওয়ানেরা। অতঃপর হুকুম হয়েছিল গর্ত কর। ঝুড়ি কোদাল কোথা থেকে জওয়ানেরাই দিয়েছিল, এবং সে জওয়ানদেরকে খুবই কষ্ট করে কয়েক ঘণ্টা অনবরত প্রবল গালি ও বুটের লাথি চালাতে হয়েছিল। তবেই না শেষ পর্যন্ত মনমত হয়েছিল গর্তটা। তখনও কাতরাচ্ছে এমন কিছু আহত ব্যক্তিকেও অনেক শবের সঙ্গে সেই গর্তে ফেলে দেওয়ার পর এসেছিল বস্তিবাসীদের পালা। লম্বা গর্তটার পাশে তাদেরকে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়াতে বলে জওয়ানরা চাঁদমারি অভ্যাস করেছিল। একটি একটি করে সব কটি বস্তিবাসী গর্তে পড়ে গেলে বাকি কাজটুকু করতে হয়েছিল জওয়ানদের। পাশের স্তুপীকৃত মাটি ঠেলে দিয়ে জায়গাটা ভরাট করতে হয়েছিল তাদেরকে।

জায়গাটা সুদীপ্ত ও ফিরোজ দেখলেন। চৌত্রিশ নম্বর থেকে বেরিয়ে এখানেই এলেন তারা। একটু আগেই ফিরোজ এ স্থানের কথা শুনে এসেছেন এবং স্বচক্ষে জায়গাটা দেখবেন বলে মন ঠিক করেই এদিকে এসেছেন। না, এখানে তো সেই ভয়টা নেই।

কিন্তু চৌত্রিশ নম্বরের সিঁড়ির কাছে অত ভয় পেয়েছিলেন কেন তাঁরা! এক খণ্ড ভয়ের পাথর কে যেন বুকের উপর ঝুলিয়ে দিয়েছিল। শরীর-ভারী হয়ে আসছিল। যন্ত্রণার অতলে ইহজীবনটাই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে না-কি। হায়, রাস্তায় তবু মানুষ দেখা যাচ্ছিলো। ওখানে একটা মশাও নেই। শহীদ মিনারের এতো কাছে এতো নির্জনতম এ স্থান ঢাকা শহরে ছিল! মনে হচ্ছিলো যেন কোনো রাক্ষসপুরীতে এসেছেন তারা! যেসব হতভাগা রাক্ষসের মুখের গ্রাস হয়েছেন ঐ সব রক্ত বোধ হয় তাদের। একটা অস্বাভাবিক ভীতিকবলিত অবস্থায় তাড়াতাড়ি তাঁরা বেরিয়ে এসেছিলেন সেখান থেকে। অবস্থাটা ছিল সহ্যের অতীত।

মরহুম আবদুল হাইয়ের ছেলে-মেয়েরা ঐ দালানেই থাকতেন। ডঃ গুহঠাকুরতার বিপরীত ফ্ল্যাটটাতে! তাঁরাই বা সব গেছেন কোথায়! বেঁচে আছেন তো! কেনো নিরাপদ এলাকায় তাঁরা চলে যেতে পেরেছেন তো! আহা, বেঁচে থাকুন তাঁরা! প্রফেসর হাইয়ের মৃত্যুর দিনটি মনে হ’লে সুদীপ্ত এখনো শিউরে উঠেন। এমন দুর্ভাগ্যও মানুষের হয়! মৃত্যু নির্মম কিন্তু তা যে কখনো অতি বীভৎসও হতে পারে সে কথা সেদিন সেই রেল লাইনের ধারে প্রফেসর হাইয়ের দুর্ঘটনা কবলিত লাশ দেখার পূর্বে সুদীপ্তর ধারণাতীত ছিল। হলই বা তার নাম মৃত্যু, এতো হৃদয়হীন হতে হবে তাকে! সেই লাশ যেন ছিল জীবনের প্রতি একটি নিষ্ঠুর ব্যঙ্গ।–সমস্ত জীবনটাকেই একটা তীব্র বিদ্রুপ বলে সুদীপ্তর মনে হ’ল যখন তিনি জগন্নাথ হলের মাঠে সদ্য পুঁতে দেওয়া নারী-পুরুষের কারো হাতের আঙ্গুল, কারো পায়ের কিয়দংশ মাটি-কুঁড়ে বেরুনো বৃক্ষ-শিশুর মতো মাথা তুলে থাকতে দেখলেন! কতো শব এইখানে পুঁতেছে ওরা? এবং এমনি কতো স্থানে? তবু এখনো ঘরে-বাইরে এতো! মেরেছে তাহলে কতো! ঢাকা শহরে কতো মানুষ মেরেছে ওই জানোয়ারের দল?—প্রশ্নটা একটা হাতবোমার মতো এসে ফেটে পড়ল ফিরোজের চিন্তার মধ্যে।

না, বেশি মারে নি। সংখ্যাটা হাজারের ঘরে ছাড়িয়ে লাখের ঘরে ওঠে নি। সেনাপতির আদেশ পুরোপুরি পালন করা ওদের সৈনিকদের পক্ষে সম্ভব হয় নি। কী আদেশ ছিল ওদের প্রচণ্ড সেনাপতির? সুদীপ্ত কিংবা ফিরোজ কেউই তা জানেন না। কল্পনা করতে বললেও তাঁরা ফেল মারবেন। সেনাপতি টিক্কা খাঁ আদেশ দিয়েছিল বাঙালিদের তোমরা হত্যা কর, তাদের দোকানপাট লুট কর, বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দাও, তাদের মেয়েদের ধর্ষণ কর। এই আদেশ দেবার আগে ছোট একটি ভূমিকাও দিয়েছিল টিক্কা খাঁ—জওয়ান ভাই সব, তোমাদের জন্য প্রেসিডেন্ট স্বয়ং তোমাদের গর্ব বোধ করেন। তোমরা পাকিস্তানের গৌরব। পাকিস্তান ও ইসলামকে রক্ষার মহান দায়িত্ব তোমাদের উপর। এই যে সব বাঙালিদের দেখছো, এরা শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ইসলামকে ভুলে গিয়ে সকলে হিন্দু হয়ে যাচ্ছে। অতএব এদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ সাধারণ যুদ্ধ হবে না, তা হবে পুরোপুরি জেহাদ।

জেহাদের সওয়াব-লাভে উদ্বুদ্ধ হয়ে পাক-জওয়ানরা ঝাপিয়ে পড়েছিল বাঙালিদের উপর। কয়েক লক্ষ নিরস্ত্র বাঙালিকে মারতে বেরিয়েছিল আধুনিকতম মারণাস্ত্রে সুসজ্জিত বীর পুরুষের দল পাকিস্তানি বীর পুরুষ।

‘চল যাই। আমিনা বোধহয় চিন্তিত হয়ে পড়বে।’

সুদীপ্ত চ’লে যাইতে চাইলেন। আমিনার চিন্তা অবশ্যই আর একটা কারণ। ওপরে নিচে সামনে চতুর্দিকে মৃতদেহ—মাঝখানে একা তিনটি শিশুসন্তান নিয়ে একটি মহিলা। দুশ্চিন্তা স্বাভাবিক, বৈ কি। কিন্তু তা ছাড়াও সুদীপ্তর নিজেরও এখন কেমন অস্বস্তি লাগছে।

ফিরোজ সুদীপ্তকে নিয়ে সোজা চ’লে এলেন নীলক্ষেতের তেইশ নম্বর বিল্ডিংয়ে। গাড়ি থেকে নামতে নামতেই ফিরোজ বললেন—

‘তুমি ওপরে চল। আমি একটু চট ক’রে ইকবাল হলের ভেতরটা দেখে আসি। দেরী হবে না। তোমরা গোছগাছ করতে করতেই এসে পড়ব।’

বলতে বলতেই ফিরোজ ইকবাল হলের দিকে লম্বা পা ফেলে হাঁটতে শুরু ক’রে দিলেন। কিন্তু গাড়ি নিয়ে গেলেন না যে! ওরে বাবা ইকবাল হলের সামনে গাড়ি রেখে ভেতরে ঢোকা মানে তো বিজ্ঞাপন ঝুলিয়ে রেখে যাওয়া। সুদীপ্ত একবার ফিরোজের হেঁটে-যাওয়া দেখলেন। চার পাশে চেয়ে দেখলেন, নীলক্ষেত এলাকা তখন প্রায় ফাঁকা। তেইশ নম্বর বিল্ডিংকে দেখলেন। তার সারা অঙ্গে বসন্তের ক্ষতচিহ্নের মতো বুলেটের দাগ।

ইকবাল হলে ঢুকবার মুখে একজনের সঙ্গ পেলেন ফিরোজ। তাঁর পরিচিত এক সাংবাদিক। এই সাংবাদিক ভদ্রলোকের কাছেই ফিরোজ খবর পেলেন—The people নেই। সেই অকুতোভয় ইংরেজি দৈনিক The people তার সব কিছু সহ আগাগোড়া ভস্মীভূত। ‘ইত্তেফাক’ ও ‘সংবাদ’-এর খবর আগেই পেয়েছিলেন। বর্বরদের যতো আক্রোশ যে শিক্ষায়তন ও প্রেসগুলির উপর। ওরা আমাদের চিন্তাবৃত্তির মেরুদণ্ডটাই ভেঙে দিতে চায় নাকি। সাংবাদিক ভদ্রলোক নিজে থেকেই খবরটা দিলেন—

‘The people-এর কয়েকজন কর্মী ও সাংবাদিককেও গুলি ক’রে হত্যা করেছে ওরা।’

‘আবিদুর রহমান সাহেব?’

‘আবিদুর রহমান সাহেবের খবর আমরা এখনো কেউ জানি নে। তবে পঁচিশ তারিখে রাত দশটার দিকে কোনো কাজে তিনি বাইরে গিয়েছিলেন।’

আল্লাহ্, তিনি যেন বেঁচে থাকেন। মনে মনে তাঁর দীর্ঘায়ু কামনা করলেন ফিরোজ। কতজনের দীর্ঘজীবনই তো গতকাল থেকে তিনি কামনা করেছেন। কিন্তু তাদের মধ্যে কয়জনেরই বা খোঁজ পেয়েছেন। বা খোঁজ নিতে পেরেছেন। একদিন সব হিসেব নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। তখন কি শামসুর রাহমানের সেই কবিতার চরণটাই সত্য হবে—সারা বাংলাটাই তখন শহীদ মিনার হয়ে যাবে।

তাঁরা দু’জনেই কিছুক্ষণ ঘুরে ঘুরে হলটা দেখলেন। কিন্তু দেখবার কিছু ছিল না। এই দিনটিতে ঠিক যেমনটি দেখবেন ব’লে প্রস্তুত হয়ে আছেন সারা ইকবাল হল হ’য়ে আছে ঠিক তেমনি। কোনো ব্যতিক্রম নেই। ঘরে-বারান্দায় ইতস্তত পড়ে আছে কয়েকটি শব। কিন্তু সে নেই। হয়ত বেঁচে গেছে। মীনাক্ষীর এক খালাতো ভাই। চব্বিশে মার্চেও হলে ছিল ছেলেটি। তাঁর খোজেই বিশেষ ক’রে হলে ঢুকেছেন ফিরোজ। মীনাক্ষী যা হোক একটা সত্য সান্ত্বনা পাবে এখন। সে যে হলের মধ্যেই মারা পড়ে নি সে কথা এখন সত্য বলেই মনে হচ্ছে। অন্ততঃ মীনাক্ষীর শোকাহত চিত্তকে কিছুটা সান্ত্বনা দেওয়া তো যাবে। ছাদের উপর থেকে শুরু করে একেবারে নিচের তলার ঘরগুলি পর্যন্ত সবটাই যতোটা সম্ভব দেখে নেবার চেষ্টা করলেন ফিরোজ। অবশ্য দ্রুত এবং কিছুটা সন্ত্রস্তভাবে। হাঁ বেশ ভয় করছে। স্ত্রীর ভাইয়ের ব্যাপার না হ’লে এখানে তিনি ঢুকতেন না। কী করেছে খবিশগুলো হলটাকে। মাঝে মাঝে দু একটা ঘরে বই কাগজ, বিছানা-বালিশ সব কিছু পুড়িয়ে দেওয়া ছাই ছড়িয়ে আছে। বহু-ঘরের জানলা-দরজা ভাঙ্গা। দেয়ালের গায়ে-কামানের গোলায় তৈরী বিরাট ছিদ্রগুলি তাঁরা দেখলেন। দেখলেন, হল অফিসের আসবাব-পত্র খাতা-কাগজ ফাইল কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। তার পরিবর্তে গাদাগাদা ছাই শুধু। সমস্ত মনকেই এমনি ছাই ক’রে সেখান থেকে বেরিয়ে এলেন ফিরোজ।–সুদীপ্তর ফ্ল্যাটে ঢুকে দেখেন, তিনি খাচ্ছেন এবং ছোট মেয়ে বেলাকে খাওয়াচ্ছেন। কী আশ্চর্য! এখানে বসে সুদীপ্ত খাচ্ছে! ইকবাল হলের মসজিদের ছাদে পড়ে থাকা শবগুলি এখান থেকে দেখা যাচ্ছে। একটা কাক এসে বসেছে শবের উপর। এই দৃশ্য সামনে রেখে খাওয়া যায়। কিন্তু ফিরোজ জানতেন না যে, সুদীপ্তর ঠিক মাথার উপরে ছাদে অমন বিশ তিরিশটা শব পড়ে আছে। নিচে মরে পড়ে আছেন ডঃ ফজলুর রহমান ও তার ভাগ্নে কাঞ্চন। সুদীপ্ত সবি জানেন। সবি তাঁর চোখের সামনে ভাসছে। আর তিনি খেয়ে যাচ্ছেন। গত সন্ধ্যায় কিন্তু খেতে পারেননি। সামনের মাঠে অচেনা লাশগুলি তাঁর ক্ষিধে নষ্ট করেছিলো। অমনি আরো অনেক লাশ আজ তিনি দেখেছেন একেবারে কাছে থেকে। এবং দেখতে দেখতেই কি ক্ষিধে ফিরে পেয়েছেন? মানুষ কতখানি বিধ্বস্ত হয়ে গেলে এটা সম্ভব! ফিরোজ ভাবলেন। আমিনার সাথে স্বভাবসিদ্ধ কৌতুকটুকুও করলেন না। আর আমিনাও কেবলি একটা চেয়ার এগিয়ে দিয়ে বললেন–

‘ভাই বসুন।’

কিন্তু বসতে ইচ্ছে করল না। ফিরোজ ঘুরে ঘুরে ফ্ল্যাটটা দেখলেন। রেলিঙে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন ইকবাল হলের দিকে। ইকবালের স্বপ্নের পাকিস্তানে বাংলাদেশের স্থান ছিল না। অথচ সেই বাঙালিই তাদের দেশে ইকবালের নামে হল বানিয়েছে। না না, এর্কে উদারতা বলে না। নিরেট বোকামি এটা। বোকামি করলেই তার খেসারত দিতে হয়। কিন্তু আর না।

‘ভাই চা খান একটু।’

ফিরোজের চা শেষ হ’তে হ’তেই সুদীপ্ত খাওয়া শেষ করলেন। তেইশ নম্বরে এই বোধ হয় তাঁর শেষ খাওয়া। গত পরশু পঁচিশে মার্চের রাতের খাওয়াটাই তাঁর জীবনের শেষ খাওয়া হতে পারত। হয় নি যে সেটা সত্যই একটা—কী? দৈব ঘটনা? নাকি অর্থহীন ঘটনা? অদ্ভুতভাবে ঘটে যাওয়া অর্থহীন আকস্মিক ঘটনার উপর দৈব ঘটনার উপর নির্ভরশীল হ’য়ে যে জীবনকে রক্ষা পেতে হয় তার মূল্য কতটুকু? না না, ঐ জন্যই তার মূল্য অপরিসীম। কিভাবে কতখানি কতদূর-বিস্তৃত অধিকার জীবনের উপর আমার আছে আমি তা জানিনে বলেই তো তার মূল্য আমার কাছে অনেক। সুদীপ্তর জীবনের প্রতি ভালোবাসা সহসা যেন শতধামুখি শ্রাবণের মেঘ হয়ে উঠল। নতুন মাটির বুকে জীবনের নবান্ধুর প্রত্যাশায় তাঁর চিত্ত উচ্চারিত হল। বেরিয়ে পড়। ছত্রিশ ঘণ্টার বেশি উপোস থাকার পর বিনা স্নানে দু’টো ভাত গিলে নিয়ে বেরুবার জন্য তৈরী হতে পাঁচমিনিট লাগল না সুদীপ্তর। আর আমিনা? তিনি তো তৈরী হয়েই ছিলেন। তাঁর সামনে প্রশ্ন ছিল কেবলি তো পালিয়ে বাঁচার। কেবলি যেখানে পালানোর প্রশ্ন সেখানে আবার প্রস্তুতির ঘটা! একটা সুটকেসে জামা কাপড় টাকা-কড়ি ও গয়না এবং একটা ব্যাগে গুঁড়ো দুধের টিন, চিনি ও বিস্কুট। এ ছাড়া আর একটা সাইড ব্যাগে ছেঁড়া কাপড়ে জড়ানো কয়েক জোড়া স্যান্ডেল, চিরুনী, দাঁতের মাজন ইত্যাদি কয়েকটা টুকিটাকি জিনিস, আর ছোট ট্রানজিস্টার সেট। আমিনার ক্যারাভান প্রস্তুত। প্রস্তুত? মাত্র এই নিয়ে যদি চলে তবে এতো কিছু নিয়ে এতদিন কি ছেলেখেলা করেছেন।

বেরুবার মুখে সুদীপ্ত একবার ড্রয়ইংরুমে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের ছবিখানার দিকে তাকালেন। বইয়ের আলমারির কাছে একবার দাঁড়ালেন। সহসা মনে পড়ল বারান্দার টবে ফুল গাছগুলির কথা। আমি তখন ঘরে তালা দিয়ে ফেলেছেন। চাবি চেয়ে নিয়ে ছুটলেন বাথরুমে। পরপর কয়েক বালতি জল এনে ঢাললেন গাছগুলির গোড়ায়। কতোদিন আর ফেরা হবে না ঘরে! ততদিন এরা কে কেমন থাকবে—এই গাছগুলি? আলমারিতে ওই বইগুলি? বইগুলির দিকে শেষবারের মত একবার তাকালেন সুদীপ্ত। একজন করুণ রিক্ত ভিখেরীর দৃষ্টি তাঁর চোখে। এদের কাউকে সঙ্গে নেওয়া যায় না? কিছুই সঙ্গে নেওয়া গেল না। আমিনার তাড়া খেয়ে আবার ছুটলেন উত্তরের বারান্দায়। আর একবার গাছগুলিকে দেখলেন। এতো বিভীষিকার মধ্যেও কী সুন্দর একটি গোলাপ ফুটেছে। বন্ধুর শেষ দান গোলাপটিকে তুলে নিয়ে সুদীপ্ত বুকে ঠেকালেন। কেউ দেখল না তো! পেছন ফিরে দেখেন বেলা এসে দাঁড়িয়েছে তার কাছে।

‘আব্বু, আমি নেব।’

‘হ্যাঁ মা, তোমার জন্যই তো।’

বেলার এক হাতে ফুল দিয়ে অন্য হাতখানি ধরে ধীরে ধীরে বেরিয়ে এলেন সুদীপ্ত। আর আমিনা? তাঁর এতো সবের বালাই নেই। তার রান্নাঘরে এখনো পাঁচটা মাগুর মাছ জিয়ানো আছে হাঁড়িতে—আছে শজনে খাড়া, বেগুন, টমেটো, বিবিধ মশলাপাতি আর চাল-ডাল তো বটেই। একবারও কোন কিছুর কথা তিনি ভাবলেন না। একটা সাইড ব্যাগ ঘাড়ে ঝুলিয়ে সুটকেসটা হাতে নিলেন এবং অন্য ব্যাগটা নিতে বললেন বড় ছেলে অনন্তকে। বোধহয় মনে মনে সুদীপ্তর কাণ্ডজ্ঞানহীনতায় ক্ষুদ্ধ হয়েছিলেন। এই অভিশপ্ত বাড়িতে এখনি কখন কি ঘটে তার ঠিক আছে! আর উনি এখন গাছে পানি ঢালতে বসলেন। ফুল নিয়ে উচ্ছ্বসিত হওয়ার এইটে সময় নাকি! বেশ তো ফুল নিয়েই তোমরা থাক, বাক্সপেটরা আমিই বইব।

ফিরোজ হয়ত ব্যাপারটা কিছু আঁচ করে থাকবেন। তিনি আমিনার হাত থেকে সুটকেসটা এক রকম ছিনিয়ে নিলেন—

‘আমাকেও আপনাদের কিছু কাজে লাগতে দিন। এতে অকর্মণ্য ভাবছেন কেন।’

তাঁরা নিচে নেমে এলেন। নিচে দুজন ভদ্রলোক দাঁড়িয়েছিলেন। দাঁড়িয়ে ছিল একটা এ্যাম্বুলেন্স এবং আরও একটা গাড়ি। ডঃ ফজলুর রহমানকে তাঁর আত্মীয়রা নিতে এসেছেন। সহসা নিজেকে অত্যন্ত অপরাধী মনে হল সুদীপ্তর। ডঃ রহমানের আত্মীয়দের কাছে কেবলি খবর পাঠিয়েই তাঁরা কর্তব্য সমাধা করেছিলেন। আর কিছুই কৃত্য ছিল নাকি? সারা নীলক্ষেত এলাকার সকলের অপরাধ নিজের ঘাড়ে নিয়ে নীরবে মাথা নত করলেন সুদীপ্ত।

উপস্থিত আগন্তুকদ্বয়ের একজন ফিরোজকে চিনতেন। তিনি বিস্ময় প্রকাশ করলেন… ‘আপনি! এখনো আছেন ঢাকায়?’

ইয়াহিয়ার গত সন্ধ্যার বেতার বক্তৃতার পর সত্যিই আওয়ামী লীগের কোনো সক্রিয় সদস্যের পক্ষেই আর পাক-কবলিত এলাকা নিরাপদ নয়। কিন্তু এই মুহূর্তেই ফিরোজ নিজের নিরাপত্তার কথা ভাবছিলেন না। দেশের এতো মানুষ ওরা মারল। এর কোনো একটা প্রতিশোধ গ্রহণ করা কি এতোই অসম্ভব? কাকে ওরা ছেড়ে কথা বলেছে? বস্তির সাধারণ মানুষ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অবধি সর্বশ্রেণীর মানুষের প্রতি ওদের সমান আক্রোশ। অতএব কেবলি আওয়ামী লীগার বলে বিশেষ করে কোনো বিপদ অনুভব করার কারণ তো এখনো তিনি দেখতে পাচ্ছেন না। তিনি বললেন—

এ প্রশ্ন তো আমি আপনাকেও করতে পারি। ওদের খায়েশ তো দেখছি সকলকেই নির্মূল করার।

‘এটা ঠিক বলেছেন। কিন্তু শয়তানদের খায়েশ এবার মেটাতে হবে ভালো ক’রে। দরকার হ’লে ওপারে চলে গিয়ে সেখান থেকে ভালো ক’রে তৈরী হ’য়ে এসে বেটাদের বাঙালি-হত্যার খায়েশ মেটাতে হবে।’

দরকার হ’লে ওপারে যেতে হবে—একটা মত। আর-একটা মতও ছিল। সেটা তৃতীয় কণ্ঠে শোনা গেল। খদ্দরের পাঞ্জাবি-পরা ছিপছিপে দৃঢ় চেহারার ভদ্রলোকটি বললেন–

‘যা কিছু করতে হবে দেশের অভ্যন্তরে থেকে। দেশকে মুক্ত করার জন্য। দেশ ছেড়ে পালানোতে আমরা বিশ্বাসী নই।’

দুটি মত পরস্পর বিরোধী। কিন্তু তাহলেও তর্কের অবকাশ বা ইচ্ছা কোনোটাই কারোর ছিল না। সঙ্গের লোকজন লাশ আনতে গেছেন ওপরে। এরা তাঁদের অপেক্ষায় আছেন। এবং মানসিক অবস্থার যে স্তরে আছেন তাতে দু’একটা মন্তব্যের অতিরিক্ত কিছুর সাধ্য তাঁদের ছিল না।

তা ছাড়াও বিশ্বাস-অবিশ্বাস নিয়ে কোনো কিছু ভাববার অবকাশ তখন সাধারণ মানুষের ছিল নাকি! প্রাণভয়ে ভীত মানুষ যে যেদিক পেরেছে পালিয়েছে। কোথায় কোনদিকে পালাচ্ছি সে বিবেচনাও তারা বহু ক্ষেত্রে করে নি।

নীলক্ষেত আবাসিক এলাকা ছেড়ে বেরোবার সময় সদর রাস্তায় তাঁরা ডঃ খালেকের গাড়ির মুখোমুখি হলেন। সুদীপ্তকে দেখে হাত ইশারায় গাড়ি থামাতে বললেন ডঃ খালেক। দুটো গাড়ি পাশাপাশি হতেই খালেক সাহেব গলা বাড়িয়ে দিলেন, অগত্যা এদিক থেকেও যতোটা সম্ভব গলা বাড়াতে হল সুদীপ্তকেও। কিন্তু ডঃ খালেক নিজের কথা কিছু বললেন না। তার ভাইয়ের মৃত্যু-সংবাদ পেয়েছেন, ভাবী ও ভাই-ঝিদের সন্ধান এখনো পান নি—সে সব কথাও চেপে গেলেন। অবশ্য কয়েকদিন পরে খালেক সাহেবের মুখেই সুদীপ্ত সব শুনেছিলেন। কিন্তু এখানে আজ শুনলেন ছোট একটি প্রশ্ন–

‘আপনার খবর কি?’

‘কোন মত বেঁচে গেছি। তবে ডঃ ফজলুর রহমান বাঁচেন নি। ছাদের উপর বস্তির লোক মারা গেছে-বিস্তর। সারা তেইশ নম্বর একেবারে তছনছ করে ছেড়েছে।’

আশ্চর্য, ডঃ খালেক ইতিপূর্বেই এসব শুনেছেন। তিনি মন্তব্য করলেন–

‘আপনাদের দুর্ভাগ্যের কারণ হচ্ছে, আপনাদের বিল্ডিংয়ের ছাদে ওঠে একজন ই. পি. আর. আমাদের পাক-বাহিনীর উপর গুলি করেছিল।’

“আমাদের” কথাটা খট্ করে কানে বাজল সুদীপ্তর। ফিরোজেরও। পাক বাহিনী এখনো আমাদের। কপালে দুঃখ তাহলে এখনো কিছু আছে। ফিরোজ খালেকের অপরিচিত হলেও এ কথা শুনে চুপ থাকতে পারলেন না। সরাসরি দৃঢ় স্বরে প্রতিবাদ জানালেন–

‘কে বললে আপনাকে এ কথা?’

‘প্রত্যক্ষদর্শীর মুখে শোনা। তিনি নিজে দেখেছেন ছাদে একটা ই. পি. আর. এর লাশ পড়ে থাকতে।’

‘আমিও তো নিজে গিয়েছিলাম ছাদে’ সুদীপ্ত সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন ‘ঐ রকম কিছু তো দেখি নি।’

‘আপনি চিলে-কোঠার ছাদে উঠেছিলেন? সেইখানে ছিল।’

উহ্, কি ঘড়েল রে বাবা! সাধারণত চিলেকোঠার ছাদে কেউ উঠবে না। অতএব ঐভাবে সাজানো হয়েছে গল্পটাকে। কিন্তু সুদীপ্ত সেখানেও যে উঠে দেখেছেন। সেখানে ছিল সেই বাপ-ছেলে এক সাথে। বাপ তার বুকের নিচে লুকিয়ে বাঁচাতে চেয়েছিলেন আপন প্রাণপ্রিয় পুত্রকে। নিজের শরীরকে ঢালের মত করে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন পুত্রের উপর। সেই অবস্থাতেই গুলিবিদ্ধ হয়েছেন তাঁরা। গুলি বাপের শরীর ভেদ করে গিয়ে ঢুকেছে ছেলের বুকে। সুদীপ্ত যখন দেখেন তখনও বাপ বুকে জড়িয়ে আছেন ছেলেকে। সেই দৃশ্য! সামান্য ক’ঘণ্টা আগে দেখা। ওদেরই কেউ ই. পি. আর. এর লোক নাকি! সুদীপ্ত হতবাক হয়েছিলেন বিস্ময়ে। এবং বিস্ময় কাটিয়ে কিছু বলার আগেই ডঃ খালেক পুনরায় বলে উঠলেন—

‘যেখানে সেনাবাহিনীকে প্রতিরোধ করা হয়েছে কেবল সেখানেই তারা হামলা করেছে। সেনাবাহিনীকে সেজন্য বিশেষ দোষ দেওয়া যায় না।’

‘তাই নাকি।‘ ফিরোজ বললেন, ‘ইকবাল হল, জগন্নাথ হলের ছাত্ররাও সেনাবাহিনীকে বাধা দিয়েছিল নাকি! তারা লাঠি নিয়ে তাড়া করেছিল বুঝি।’

ফিরোজের ব্যঙ্গোক্তি খালেক সাহেব গায়ে মাখলেন না। অথবা তা বুঝবার বোধই তাঁর নেই। তিনি ব’লে উঠলেন—

‘ওরে বাবা কী যে বলেন! রাইফেল হাতবোমা এ্যাসিড বাল্‌ব-এই সবের ডিপে ছিল ঐ দু’টি হল। মর্টারও ছিল কিছু কিছু। সেনাবাহিনী হল থেকে সে সব উদ্ধার করেছে।’

কোনো অপরিচিত ব্যক্তিকে সহসা কোনো কড়া কথা শোনানো যায় না। অন্ততঃ ফিরোজ পারেন না শোনাতে। কণ্ঠে প্রবল বিরক্তি প্রকাশ ক’রে তিনি শুধু বললেন–

‘এইসব গাঁজা বিশ্বাস করতে বলেন!’ বলেই গাড়িতে স্টার্ট দিলেন।

নিউ মার্কেটের চৌমাথার মোড়ে তাদের গতিরুদ্ধ হ’ল। সামনের দু-তিন খানা গাড়ি দু’জন পাকিস্তানি সৈনিকের নির্দেশে দাঁড়িয়ে গেছে। অগত্যা তাদেরকেও দাঁড়াতে হ’ল। পেছনে এসে পর পর দাঁড়াল কয়েকটি গাড়ি।

অতঃপর সৈনিক দুজন এসে প্রত্যেক গাড়ি থেকে পুরুষ আরোহীদের নামাতে শুরু করল। অগত্যা নামতে হ’ল সুদীপ্ত ও ফিরোজকেও। সকলকে সার করে দাঁড় করাল তারা রাস্তার পাশে। প্রায় বিশ-পঁচিশ জন। একজন সৈনিক এসে গুণতে শুরু করল—এক, দো তেন…এগারা, বারা। ব্যস, আর দরকার নেই। এই বারোজন বাদে আর সবাই গাড়িতে গিয়ে ওঠ। সুদীপ্ত ছিলেন তেরো নম্বরে, চৌদ্দতে ফিরোজ। অতএব রেহাই পেয়ে তাঁরা চলে এলেন। কিন্তু ঐ বারো জন?

তোম লোক রাস্তার জঞ্জাল সাফা কর।

গাড়ি-হাঁকিয়ে চলা মানুষ। কে কোন্ মর্যাদার লোক কে জানে। সবকে এখন রাস্তার জঞ্জাল সাফ করতে হবে। পায়ে-হাঁটা মানুষের সংখ্যা কিছুক্ষণ আগেও অনেক ছিল এখন যথেষ্ট কম। এবং এখনি ওদের খেয়াল হয়েছে। রাস্তার জঞ্জাল সাফ করতে হবে। জঞ্জাল সাফ মানেই সেই মাজার ভেঙ্গে ফেলতে হবে।

মাজার? কয়েকদিন আগে সুদীপ্ত মাজার দেখেছিলেন। সন্ধ্যার দিকে নিউ মার্কেটে যাচ্ছিলেন সামান্য কেনাকাটার জন্য। মোড়ের ভিড়টাকে তিনি ঠিকই লক্ষ্য করেছিলেন। কিন্তু চিরকালের অভ্যাস মতোই ভিড় এড়িয়ে অন্য দিকে সরে যাচ্ছিলেন। সহসা কানে এলো—

‘আপনারা মাজারে যে যা পারেন দান করে যাবেন।’

এই রাস্তার মাঝখানে মাজার? অগত্যা দাঁড়াতে হল। ভিড়ের কাছে এগিয়ে দেখেন সত্যি সত্যিই চৌরাস্তার ঠিক কেন্দ্রস্থলে পাশাপাশি দুটি কবর। বালি ও ইট-পাথর সংগ্রহ করে সত্যকার কবরের মতো করেই বানানো হয়েছে। তার উপর শক্ত কাগজের দুটো সাইনবোর্ড—একটাতে নাম লেখা ইয়াহিয়া খানের, অন্যটাতে জুলফিকার আলি ভুট্টোর। একটা লোককে, বোধ হয় সে ফকির হবে, সেবায়েত সাজানো হয়েছে। সে মাঝে মাঝে চিৎকার করছে—

‘আপনারা যে যা পারেন মাজারে দান ক’রে যাবেন।’

বাহ্, কৌতুকটা জমিয়েছে বেশ তো। এ না হ’লে বাঙালি! গুপ্ত কবি ঠিকই লিখে গেছেন, এতো ভঙ্গ বঙ্গদেশ তবু রঙ্গ ভরা। সেদিন ভারি পুলকিত হয়েছিলেন সুদীপ্ত।

আজ সকালে সদ্য ঘুম-ছাড়া শয্যায় সেদিনের কথা সুদীপ্তর মনে হল। সেই মাজার সাফা করার জন্য গতকাল গাড়ি থেকে নামিয়ে কাজে লাগানো হয়েছিলো ভদ্রলোকদেরকে। কুলি-মজুর লাগানো যেত না? কিয়া বাত? কাজে লাগানো হয়েছে বাঙালিকে। তারি মধ্যে আবার ভদ্রলোক-কুলিমজুর ভেদাভেদ করতে হবে নাকি।

কথাটা সুদীপ্ত গতকালই গাড়িতে আসতে ফিরোজের কাছে তুলেছিলেন—

‘মানুষের কার কি মর্যাদা সেটা বিচার না করেই।’…‥

‘কী যে বল।’ সুদীপ্তকে কথা শেষ করতে না দিয়েই ফিরোজ বলে উঠেছিলেন ‘জানো না, রক্ত পায়িদের কাছে সব মানুষই সমান।’