তৃতীয় পরিচ্ছেদ

কীর্তিমান পুরুষ বটে মালেক সাহেব। এম. এ. পাস করেছেন ১৯৪৫-এর দিকে। সে সময়ে তিনি কমিউনিস্টদের গাল দিয়ে মাসিক ‘মোহাম্মদী’তে কবিতা লিখতেন। কেন না ঐটেই সবচেয়ে নিরাপদ ছিল সেই সময়। দেশ স্বাধীন হ’লে মুসলিম লীগ অথবা কংগ্রেসের রাজত্বে বাস করতে হবে। অতএব তাদের কাউকে ঘাটানো নিরাপদ নয়। আবার একান্তই দেশ যদি স্বাধীন নাই হয় তা হ’লে বাস করতে হবে বৃটিশ রাজত্বে। অতএব বৃটিশের বিরুদ্ধেও কিছু লেখা যায় না। অথচ সেকালে পলিটিক্যাল বিষয়ে কবিতার বেশ বাজার দর ছিল। এবং বৃটিশ-কংগ্রেস-মুসলিম লীগ সকলকেই খুশি করা যায় এমন বিষয় ছিল কমিউনিস্ট-বিরোধিতা। তাই লিখলেন “লাল বন্দুকের গান।” স্বাধীনতা লাভের পর পাকিস্তানে শুরু করলেন মুসলিম তাহজীব ও তামুদুন নিয়ে গবেষণা। সেই সময় তিনি একটি প্রবন্ধ লিখলেন। তার আরম্ভটা এইরকম “মাঝে মাঝে কবিতা লিখিয়া থাকি। কবিতা আমি ভালবাসি কিন্তু তদপেক্ষাও আমি বেশি ভালোবাসি আমার দেশকে। দেশ আগে। তারপরে সাহিত্য। দেশের স্বার্থ অগ্রে বিবেচনা করিতে হইবে পরে সাহিত্যের কথা আসিবে। আমি সাহিত্যের ছাত্র নহি। অতএব সাহিত্য সম্পর্কে সকল তত্ত্ব আমার না জানা থাকিতেও পারে। কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞান সম্পর্কে কিছু পড়িয়াছি (এম.এ. পাস করার পর রাষ্ট্রবিজ্ঞান সম্পর্কিত একখানি গ্রন্থও তিনি পড়েন নি)।—রাষ্ট্র বিজ্ঞানের মধ্যে লব্ধ জ্ঞানের দ্বারা এই দৃঢ় প্রতীতী আমার মধ্যে জন্মিয়াছে যে…।” এই ভাবে শুরু ক’রে সেই প্রবন্ধে মালেক সাহেব প্রমাণ করেছিলেন—নব গঠিত রাষ্ট্রের স্বার্থেই পাকিস্তানি জাতির জন্য রবীন্দ্র-চর্চা বিপজ্জনক। বিগত শতাব্দীর। পুঁথি সাহিত্যের আদর্শ হবে আমাদের পাকিস্তানি সাহিত্যের আদর্শ। আহা, পাক সরকার কী খুশিই তখন হয়েছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে মালেক সাহেব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি পেয়ে গিয়েছেন। প্রথমে লেকচারার, পরে তিন বছরের মধ্যেই পাঁচ জনকে ডিঙ্গিয়ে হয়েছিলেন রীডার। কিন্তু হায়! রীডার হওয়ার ছমাসের মধ্যেই এ কী কাণ্ড। অভূতপূর্ব সেই কাণ্ড ঘটল ১৯৫৪-তে। পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক নির্বাচনে মুসলিম লীগের ঘটল ভরাডুবি। পাকিস্তানের রজিনীতিক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের প্রাধান্য শুরু হল। না, সে জন্য কপাল চাপড়ে লাভ নেই। বুদ্ধি থাকলে সব নদীতেই পার হওয়া যায়। বুদ্ধিখাটাতে শুরু করলেন মালেক সাহেব। কিছুক্ষণ ভাবলেন, আওয়ামী লীগের মনের কথাটি কী?—পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের মধ্যে থেকেও আমাদের বঙ্গীয় সত্তাটিকে আমরা ভুলতে পারি নে। ভুলব না। ব্যাস, মালেক সাহেব পূর্ব বাংলা নিয়ে ভাবে গদ গদ হয়ে একটা প্যানপেনে কবিতা লিখে ফেললেন। একুশে ফেব্রুয়ারির উপর। গানও লিখে ফেললেন একটা। একটা প্রবন্ধে লিখেই ফেললেন–“পাকিস্তানের প্রথম রুদ্র (লেখক বোধ হয় ‘রুদ্র’ শব্দের মানে জানতেন না) আবির্ভাবে অনেকেই আমরা বিমূঢ় হইয়াছিলাম। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে আমরা সম্বিৎ ফিরিয়া পাইয়াছি।…” একটু মিছে কথা লেখা হয়ে গেল—লিখতে লিখতেই মালেক সাহেব ভেবেছিলেন, সত্যিকার জ্ঞানোদয়টা তার বায়ানতে হয় নি, হয়েছিল চুয়ান্নতে। তা হোক, যাহা বায়ান্ন তাহা চুয়ান্ন। এ ধরনের এক-আধটু মিথ্যা জায়েজ। এটা কলি যুগ না? কলি যুগে যোল আনা সত্য অচল। এইভাবে কিছু সত্য কিছু মিথ্যাকে আশ্রয় করে মালেক সাহেব ভারি সুন্দর সচল রইলেন চুয়ান্ন-পরবর্তী দিন গুলিতে। এমন সময় কী ভাগ্যের পরিহাস! আয়ুব খানের সেই মারশাল ল’ (গ্রাম্য উচ্চারণে মারশালা) জারি করলেন। আয়ুব খান এসে মারশাল ল’ জারি হওয়ার দিন মালেক সাহেব সারাদিন রোজা থেকে খোদার কাছে কেঁদেছিলেন। হায় হায়, এমনি করে কি কেউ নিজের পায়ে কুড়াল মারে। কোন কুক্ষণে কেন এইসব কবিতা-গান লিখেছিলাম। আল্লার কাছে বিস্তর কাদাকাটা করলেন মালেক সাহেব। নামায আগে থেকেই পড়তেন, এবার নফল নামাযের সংখ্যা বাড়িয়ে দিলেন। আগে দাড়ির সঙ্গে গোঁফও কিছুটা রাখতেন। এখন খুর দিয়ে গোঁফও চেছে ফেললেন, দাড়ি রয়ে গেল বহাল তবিয়তে। গুম্ফবিহীন দাড়িতে মুখের চেহারাটা এবার খাঁটি মুসলমানের মতো দেখতে হল। কিন্তু দিলে তবু ভরসা হয় না। নির্জনে একা থাকলেই আল্লাহকে ডাকেন।

তখন আল্লাহ তাঁর উপর কৃপা করলেন। হঠাৎ একদিন আইয়ুব খানের কাছে ডাক পড়ল মালেক সাহেবের। খান সাহেব মালেক সাহেবকে সরাসরি জানিয়ে দিলেন–

‘আমি অযথা কাউকে দুঃখ দেব না। আপনাদের আগেকার সকল গুনা মাফ ক’রে দেওয়া হল। এখন আমি চাই যে, আপনারা সকলে জাতি-গঠনের কাজে আমার হাত শক্ত করুন।’

জাতি গঠনের মহান দায়িত্বের কথাগুলি আইয়ুব খান সাহেব সামনে রাখলেন। পেছনে রইল রাইফেল। চোখ বন্ধ ক’রে যারা সেই মহান দায়িত্ব পালনে পা বাড়াল সেই রাইফেল কখনো তারা দেখতে পায় নি। তারা ভাগ্যবান। কিন্তু অনেক হতভাগা একটু ইতস্তত করেছিলেন, এবং অনেকেই তারা সিধে হয়েছিলেন দু-একটা রাইফেলের গুতো খেয়ে। অনেকে তাও হন নি। তাঁদের মধ্যে ছিল দেশদ্রোহিতার শিরোপা।

বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক ও রাজনীতিকদের একটা তালিকা তৈরি করে তাঁদেরকে তিনটে ভাগে বিভক্ত করেছিলেন খান সাহেব।—এক দল সাদা, এক দল কালো এবং এক দল হলুদ। এই ভাগ কিন্তু অত্যন্ত নিরপেক্ষভাবেই করা হয়েছিল। এবং সাদা তালিকার নিষ্পাপ বোকা ভালো মানুষগুলিকে অত্যন্ত সম্মান দিয়ে দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছিল। অত ভালো মানুষ দিয়ে দেশের কাজ হয় না। তবে তোমাদের কিছু বলাও হবে না। হাজার হলেও তোমরা বোকা। ভালো মানুষ। হলুদ তালিকায় ছিলেন দুই ধরণের মানুষ—এক, নিষ্পাপ বটে, তবে বোকা নয়, এবং সঙ্কল্প সাধনে অত্যন্ত দৃঢ়চেতা। দুই, অল্প পরিমাণে দাগধরা। শয়তানীতে নেমেও বিবেকটাকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা যাঁদের আছে। এই হলুদ তালিকার মানুষগুলি ছিলেন আইয়ুব খানের কাছে অত্যন্ত ডেনজারাস, ভয়াবহরূপে বিপজ্জনক। এদের হাত-পা ভেঙ্গে দেওয়ার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করে খান সাহেব মাঠে নেমেছিলেন। তাঁর সহায়ক হয়েছিলেন কালো তালিকার মানুষগুলি। কালো তালিকায় ছিল খুব বাছা বাছা নামগুলি— পাকা চরিত্রহীন, পাকা শয়তান, পাকা বদমায়েশ, কিন্তু সেই সঙ্গে অতি ধুরন্ধর ও প্রচণ্ড রকমের বুদ্ধিমান। ভাগ্যক্রমে এই কালো তালিকায় মালেক সাহেব পড়েছিলেন। খান সাহেবের দরকার ছিল বুদ্ধিমান চরিত্রহীন মানুষ। ওদের দিয়েই উদ্দেশ্য সিদ্ধ হওয়া সম্ভব। তাই ওদের কাছেই নিজেকে ব্যক্ত করলেন খান সাহেব—দেখ হে, তোমাদের সর্বপ্রকার অতীত দুষ্কর্মের তালিকা আমার হাতে আছে। আমি তা ঠিক মতো রেখেই দেব। কিছু বলব না তোমাদের। কিন্তু তার বিনিময়ে আমি যতো দুষ্কর্ম করব সে সবের সাফাই তোমাদের গাইতে হবে। নেশান বিল্ডিংয়ের (জাতিগঠনের) কনট্রাকটরি তোমাদের দেব। তা থেকে তোমরা ক’রে খেতে পারবে কিন্তু সাবধান, বেঈমানী করার চেষ্টা করো না। মনে রেখো, আমি পাঠান। পাঠান কখনো বেঈমানী সহ্য করে না।

মালেক সাহেব শুনেই সঙ্গে সঙ্গে হাত জোড় করেছিলেন–

‘তওবা তওবা কী যে বলেন স্যার। যা বলবেন তাই করব স্যার।’

‘তোমরা বাঙালিরা তো সব হিন্দুদের গোলাম ছিলে। ছিলে না?’

‘হাঁ স্যার। ঠিক স্যার। ছিলাম বৈ কি স্যার।’

‘অত স্যার স্যার করবে না। শোনো। গোলাম তোমরা যেকালে ছিলে, সেকালে ছিলে এখন তোমরা আজাদ। এই আজাদী তোমাদের জন্যে কে এনেছে বলতে পার? এই আমি–আয়ুব খান।’

নিজের বুকে বুড়ো আঙুলের টোকা মেরে দেখিয়েছিলেন খান সাহেব। আর অমন যে চালু মাল মিঃ আব্দুল মালেক তিনিও খান সাহেবের কথা শুনে কিঞ্চিৎ ঘাবড়ে গিয়েছিলেন। তাঁর ধারণা, আমাদের আজাদী কায়েদে আজমের অবদান। সে কথা ভুলে গিয়ে বলতে হবে তা এনেছেন এই পাঠান খান সাহেব? মিঃ মালেককে চুপ থাকতে দেখে খান সাহেব ব’লে চললেন—

‘আমি তোমাদের আজাদী এনে দিয়েছি, আমি তোমাদের মুক্তিদাতা। কিন্তু মুক্তি দিলেই তা কি সকলে নিতে পারে? বল, পারে?’

‘না হুজুর। বহু কাল খাঁচার ভেতরে থাকার পর পাখিকে ছেড়ে দিলে সে উড়তে পারে না।’

‘ঠিক। তোমাদের বাঙালিদের অবস্থা হয়েছে খাঁচার পাখির মতো। দীর্ঘকাল হিন্দুয়ানীর খাঁচায় তোমরা পোষা ছিলে। এখন ছাড়া পেলেও তাই উড়তে পারছ না। মানে, হিন্দুয়ানী ত্যাগ করতে পারছ না। তোমাকে এই কাজের ভার আমি দিতে চাই বুঝতে পারছ?’

মালেক সাহেব বুঝতে চেষ্টা করলেন। খান সাহেব ব’লে চললেন—

‘আমি একটা সংস্থা গড়ব মনে করছি। কী নাম দেব বলতে পার?’

হুজুর তার কাছে সাজেশন চেয়েছেন, আহা কী সৌভাগ্য! গৌরবে ও গর্বে মালেক সাহেব স্ফীত হয়ে উঠলেন। একটু মাথা নত করে ভেবে বললেন—

‘ন্যাশনাল ইন্‌স্‌টিটিউট্ ফর দি প্রটেক্‌শান অফ্ দি বেঙ্গলিজ ফ্রম দি কাফির্‌স্’

‘রাসকেল।’

খান সাহেব রাগে ফেটে পড়লেন। আর একটু হ’লে লাথিই মেরে বসতেন। বুট সুদ্ধ পাটা লাফিয়ে উঠেছিল ফুট খানেক। মালেক সাহেব ভয় পেয়ে গেলেন। কিন্তু না। খান সাহেব আর বেশি কিছু করলেন না। একটুও না ভেবে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বললেন—

‘ওটার নাম হবে একাডেমি ফ্‌র দি ডেভেলপমেন্ট অফ্ ন্যাশনাল ইন্টেগ্রিটি অ্যান্ড মিউচুয়্যাল আন্ডারস্ট্যান্ডিং। তোমাকে এর ডিরেক্টর করব, বুঝেছ।’

আনন্দে হাত কচলাতে কচলাতে মালেক সাহেব তখন গ’লে জল হবার উপক্রম।

‘হুজুরের মেহেরবানি।’

খান সাহেব অর্থাৎ আয়ুব খান সোফা ছেড়ে উঠে পায়চারি শুরু করলেন। অগত্যা মালেক সাহেবও উঠে দাঁড়ালেন। হুজুর দাঁড়িয়ে থাকলে তিনি বসে থাকেন কী করে? কিন্তু হুজুর বাঁ হাতের একটা ইঙ্গিতে মালেককে বসতে বললেন। হুজুরকে একটু চিন্তান্বিত দেখাচ্ছে। প্রায় পঞ্চাশ সেকেণ্ড পর তিনি বললেন—

‘তোমাদের অধঃপতনের মূলটা কোথায় জান! তোমাদের ঐ ভাষা। ঐ ভাষা তোমাদের যতদিন থাকবে ততদিন হিন্দুদের গোলামী থেকে তোমরা মুক্ত হতে পারবে না।’

‘তাতে কোনো সন্দেহ নাই হুজুর।’

‘সামনে তো সবি স্বীকার কর তোমরা। কিন্তু পেছনে গেলেই উল্‌টো সুর ধরবে। তোমাদের বিশ্বাস আছে কিছু! তোমরা সব মোনাফেক আদমী আছ!’

‘এটা হুজুর হক কথা বলেছেন। কিন্তু এই বান্দা আপনার সাথে কখনো মোনাফেকী করবে না।’

‘করলেও বাঁচবে না। যতো গুনার কাম করেছ সবের তালিকা আমার ফাইলে আছে। দরকার হ’লে সেগুলি বের করা হবে। কিন্তু আশা করি তার প্রয়োজন হবে না।’

মালেক সাহেব কিছু বলার না পেয়ে মাথা নত করে চুপ ক’রে রইলেন।

খান সাহেব ব’লে চললেন–

‘তোমার একাডেমির কাজ হবে মাশরেকী পাকিস্তানে উর্দু চালু করা, আর একদল বুদ্ধিজীবী তৈরী করা যারা আমার শাসনের গুণগান করবে।’

‘মসজিদে আপনার নামে খুৎবা চালু করে দেব হুজুর।’

‘আহ্ সেটা তো বড়ো হক্ কথাই বলেছ হে। কিন্তু কথা কি জান। আরবি ভাষায় কে কী বলবে তা তো লোকে বুঝবে না। লোকে যা বুঝবে না তা আর ব’লে লাভ কী!’

‘না হুজুর, উর্দুতে খুৎবা চালু ক’রে দেব। উর্দু তো শিখতেই হবে সকলকে।’

‘শুধু শিখতে হবে মানে কী? অফিসে অন্দর মহলে সবখানে ঐ এক উর্দুই থাকবে। বাংলা বিলকুল হারাম হয়ে যাবে। কেননা বাংলা থাকা মানেই তো হিন্দুয়ানী থাকা। পাকিস্তানে আমি তো হিন্দুয়ানী চলতে দিতে পারি নে। বল, পারি?’

‘তা বটে। তবে হুজুর, ওখানে উর্দু যে কারো মাতৃভাষা নয়।’

বহু সাহস বুকে নিয়ে মালেক সাহেব এই একটিবার কিঞ্চিৎ প্রতিবাদের সুরে কথা বললেন। আর যায় কোথায়। গর্জে উঠলেন খান সাহেব—

‘হোয়াট ননসেস্। উর্দু এখানেই বা কার মাতৃভাষা? কারো না। তবু সকলে আমরা দেশের ঐক্য বজায় রাখার খাতিরে উর্দুকে মেনে নিয়েছি। তোমরা এমন কি নবাবের বাল এসেছ যে মানবে না।’

এই পাঠানী যুক্তির কাছে মিঃ আব্দুল মালেক হার মানলেন। তাই তো তিনিও তো একদা জাতীয় সংহতির খাতিরে রবীন্দ্রনাথকে পর্যন্ত বিসর্জন দিতে প্রস্তুত ছিলেন। তা’হলে? এখন তা হ’লে জাতীয় সংহতির জন্য বাংলা ভাষাকে বাদ দিতে আপত্তি থাকবে কেন? না তাঁর আপত্তি নেই। আপত্তি হবে দেশের ওই বেকুব জনসাধারণের। ভাষার প্রশ্নে কোন যুক্তি ওরা মানতে রাজী নয়। একটু ভেবে মালেক সাহেব বললেন—

‘হুজুর, আমার মনে হয়, এ ব্যাপারে কিছু চালাকির আশ্রয় নিতে হবে। প্রথমেই উর্দুর কথা বললে দেশে হট্টগোল হৈ-চৈ শুরু হয়ে যাবে।’

‘না-না, হৈ-হাঙ্গামা বাধাতে পারবে না। বাঙালি বড়ো হুজুগপ্রিয়। হৈ-হাঙ্গামা পেলে আর কিছু চায় না। তখন তাকে শান্ত করাই মুশকিল হবে। শান্তিপূর্ণভাবে কাজ হাসিল করতে হবে।’

‘হুজুর সে জন্যই বলছিলাম—প্রথমেই ওদেরকে বাংলা ভাষা ভুলিয়ে দিতে হবে। তারপর একটু একটু করে দিতে হবে উর্দু।’

বাহ্, ভারি চমৎকার প্ল্যান তো! বাঙালিকে বাঙলা ভুলিয়ে দেওয়ার একটা প্ল্যান দিলেন মালেক সাহেব। খান সাহেব তাতে উল্লসিত হলেন। কোনো হৈ-চৈ নেই। ন্যাশনাল ইন্টেগ্রিটি রক্ষার জন্য একাডেমি হয়ে গেল। মালেক সাহেব তার ডিরেক্টর হলেন। কিন্তু ঐ একাডেমির কী যে কাজ, কেউ তা জানল না। ঐ একাডেমির কথা লোকে ভুলেই গেল। তবে যথাক্রমে একদা বাংলা একাডেমি, এবং পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা হরফ সংস্কারের প্রস্তাব পাশ ক’রে বসল। মালেক সাহব কোথায় কি কলকাঠি নাড়লেন দেশবাসী তার বিন্দু-বিসর্গ কিছু জানল না। জানলেন খান সাহেব। তাঁকে জানিয়ে দেওয়া হ’ল—কেল্লা ফতে। এমনভাবে হরফ সংস্কারের প্রস্তাব পাস করানো হয়েছে যে, ঐ ভাবে হরফের সংস্কার সাধন হলে প্রচলিত বাংলা হরফে ছাপানো বই এ দেশে ভবিষ্যতে একখানিও কেউ পড়তে পারবে না। তার মানেই কলকাতার বই পাকিস্তানে সম্পূর্ণ অচল হয়ে যাবে। তার বদলে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে উর্দু বইয়ের সাপ্লাই দিতে হবে। অবশ্যই প্রথমে বাংলা অনুবাদের মাধ্যমে। দরকার হ’লে এই অনুবাদ করা বইগুলি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের পাঠ্য করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে কেবলি বাংলা বই পড়তে হবে তার কি মানে আছে? বাংলা বইয়ের নামে পড়াচ্ছো তো খালি হিন্দুয়ানীতে ভরা কলকাতার বই। কেন, লাহোরের উর্দু বই বাংলাতে তরজমা করে বাংলা অনার্সে পাঠ্য করতে পার না? এমন একটা বিতর্কও কে বা কারা বাজারে চালু ক’রে দিল। মালেক সাহেব তাঁর হুজুর আয়ুব-মোনায়েমকে জানিয়ে দিলেন—কাজ চলছে ভালো। বাংলার সিলেবাসে এইভাবে উর্দু বই চালু হ’য়ে গেলে বাঙালির মস্তিষ্কশুদ্ধির কাজ কিছুটা এগোবে, কলকাতার বইয়ের মারফতে যে সকল হিন্দুয়ানী ভাবধারা এসে আমাদের পাক মস্তিষ্ককে অনবরত না-পাক করাছে তার এবার সমাপ্তি ঘটবে। এ সব হ’ল নেপথ্য কথা। প্রকাশ্যে যেটা দেশবাসীকে জানানো হ’ল তা হচ্ছে—বাংলা হরফ অত্যন্ত অবৈজ্ঞানিক। যেহেতু আমরা সমাজের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করতে চাই সেই হেতু এই অবৈজ্ঞানিক বাংলা হরফকে কিঞ্চিৎ বিজ্ঞানসম্মত করতেই হচ্ছে। এর ফলে বাংলা ভাষার প্রসার দ্রুত হবে। ইত্যাদি….।

এইভাবে কীর্তিমান মালেক সাহেব আউয়ুব খানের আমলেও বহাল তবিয়তে উন্নতির মই বেয়ে উপরে উঠে যেতে লাগলেন। ইতিমধ্যে এল ১৯৬৯-এর গণ অভ্যুত্থান। আউয়ুবখান বিদায় নিলেন। যে দিন সন্ধ্যায় আউয়ুব খানের বিদায়বার্তা রেডিওতে ঘোষিত হ’ল সেদিন মালেক সাহেব, অন্য কেউ না জানলেও সে কথা তাঁর স্ত্রী জানেন, সারারাত কেঁদে বালীশ ভিজিয়েছিলেন। হায় হায়, এই তো ক’মাস আগেই আউয়ুব খানের বইয়ের, Friend not Master গ্রন্থের বঙ্গানুবাদ করে কয়েক হাজার টাকা কামাই করেছিলেন। এখন উপায়! সকলেই যে বলে, আব্দুল মালেক হচ্ছে আইয়ুব খানের নাম্বার ওয়ান দালাল। হায় খোদা, এখন কী হবে! মালেক সাহেবকে চান্স খোদা ঠিকই মিলিয়ে দিলেন। প্রায় দু’বছর তিনি সময় পেলেন হাতে। ১৯৬৯-এর মার্চে ইয়াহিয়া খান শীঘ্রই ক্ষমতা হস্তান্তরের যে প্রতিশ্রুতি জাতিকে দিয়েছিলেন কোনোদিনই তা পালিত হয় নি আজ-কাল ক’রে কেটে গেছে দু’টি বছর। সেই দু বছরে অতি বুদ্ধিমান আব্দুল মালেক ধীরে ধীরে কাজ গুছিয়ে ফেলেছেন। রবীন্দ্র-জয়ন্তীতে গদ গদ কণ্ঠে বক্তৃতা করে প্রচার করেছেন— রবীন্দ্রনাথ আমাদের সত্তার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। ছাত্রদের এক সাংস্কৃতিক সভায় বলেছেন, দেশের ভৌগোলিক পরিবেশ ও দেশের ভাষাই হচ্ছে জাতি-গঠনের মৌল উপাদান, জাতীয় সত্তার কোন অপরিহার্য অঙ্গরূপে ধর্মের কোনো স্থান থাকতেই পারে না। একদা প্রবন্ধ লিখে রবীন্দ্রনাথকে পাকিস্তান থেকে নির্বাসন দিতে চেয়েছিলেন। এবার তিনি বই লিখে তা জীবনানন্দের স্মৃতির উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করলেন। নজরুল ইসলাম হাজার হ’লেও গান লিখে মুসলমানিত্ব জাহির করেছেন, অতএব কঠোর ভাষায় তাঁর সমালোচনা ক’রে সাহিত্যে ধর্মনিরপেক্ষতার উপর জোর দিয়ে প্রবন্ধ লিখলেন। যে গোঁফ খুর দিয়ে চাঁছা শুরু করেছিলেন এবার আবার তাকে কিছুটা বাড়তে দিলেন। কিন্তু এতো সব করেও হালে পানি পাচ্ছেন না দেখে আওয়ামী লীগ রিলিফ ফান্ডে এক হাজার টাকা চাঁদা দিলেন। দেখাই যাক, এবার ভাইসচ্যান্সেলর যদি হওয়া যায়!

এ হেন মালেক সাহেব সেদিন প্রবন্ধ লিখছিলেন। সেই পঁচিশের রাতে। রাত নটার দিকে খাওয়া শেষ ক’রে লিখতে বসেছিলেন। বিষয়-পূর্ব বাংলার আধুনিক কবিতা। লিখতে বসেই কথাটা মালেক সাহেবের মনে হ’ল। এক ঢিলে দুটি পাখি মারতে হবে। সকলেই কবি হিসাবে জনাব আব্দুল কাসেমকে বর্তমান পূর্ব বাংলার শ্রেষ্ঠ কবি বলে থাকেন। তাঁর চেয়েও বড়ো! অসহ্য। ছোকরা কটা দিন বিশ্ববিদ্যালয়ে খালি ঘোরাফেরাই করেছিল। পাস করতে পেরেছিল একটা পরীক্ষায়? হ’তে পেরেছে তাঁর মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের রীডার? মূর্খ দেশবাসীর কাছে মূর্খরাই সম্মান পাবে। কিন্তু হায়, ছোকরার কবিতার কোনো দোষ যে ধরা যায় না। তখন কবিতা রেখে দিয়ে তিনি চোখ বুজে চিন্তা করতে শুরু করলেন। এক হাতে কলম, সামনে খাতা খোলা, চোখ বন্ধ করে মালেক সাহেব চিন্তা করছেন। দৃশ্যটা দেখলে সেই সময় মালেক সাহেবকে ধ্যানী বুদ্ধের সঙ্গে তুলনা করতে ইচ্ছে না হয়ে যায় না। ধ্যানী মালেক সাহেব হঠাৎ ধ্যান ছেড়ে লাফিয়ে উঠলেন—ইউরেকা। আবুল কাসেমের কবিতায় যে সকল চিত্রকল্প ও প্রতীকের ব্যবহার আছে তা যথেষ্ট বঙ্গীয় নয়, বহুল পরিমাণে পাশ্চাত্য দেশীয়। কিন্তু আধুনিক বাংলা কবিতার মধ্যে কি এটা দোষের? তা ছাড়া, ছোকরার সব কবিতাই যে ঐ রকম তাও তো নয়। ধূত্তোর, এ দেশীয় গবেট পাঠকেরা অতসব বুঝবে না। কথাটা যে তাঁর মাথায় এসেছে সেটা আল্লাহর রহমতের ফলেই। লাভ দুদিক থেকে সেটা বুঝতে পারছ না। প্রথমতঃ, আবুল কাসেমকে পাঠকের মন থেকে কিছুটা সরাতে পারলে যে ফাঁক সৃষ্টি হবে, সেই ফাঁকে কোনো মতে নিজেকে একটু গলিয়ে দিতে পারলে! আহ্ কী মজা। দ্বিতীয়তঃ, তিনি যে তাঁর চিন্তার সর্বস্তরে একজন বিশুদ্ধ বাঙালি এটাও প্রমাণিত হবে। অতএব চোখ খুললেন মালেক সাহেব। দ্রুত বেগে কলম চলতে শুরু করল। রাত প্রায় বারোটার দিকে মালেক সাহেবের হুঁশ হ’ল— বাইরে গুলি-গোলা চলছে। ওরে, বাবা, কী প্রচণ্ড আওয়াজ! বারান্দায় পা দিয়ে এ-পাশ ও-পাশের দৃশ্য দেখেই ব্যাপারটা তিনি বুঝে ফেললেন। তা হ’লে কি তার ছোট ভাইয়ের কথাই ঠিক হ’ল। কদিন থেকে দুভাইয়ের মধ্যে মনোমালিন্য চলছিল।

এখন থেকে পাকিস্তান, মুসলমান প্রভৃতি বুলি ভুলে গিয়ে বাংলা ও বাঙালির কথা বলতে হবে। নইলে আমাদের গোলামী ও দুর্গতি রোধ করা যাবে না!–মালেক সাহেবের মত।

ছোট ভাই খালেক সাহেবের মত হচ্ছে—পাকিস্তানের সংহতি সকলের আগে। সেজন্য আছে আমাদের সেনাবাহিনী। এই সেনাবাহিনী আমাদের গৌরব ও গর্বের বস্তু। যে-কোনো মূল্যে তারা পাকিস্তানের সংহতি রক্ষা করবে। দেশকে তারা বিচ্ছিন্ন হতে কিছুতেই দেবে না।

কিন্তু সংহতি রক্ষা পাবে কিসে? ন্যায় ও ইনসাফের ভিত্তিতে দুই অংশের মধ্যে সমতা রক্ষায়? না প্রবল গায়ের জোরে একটা অংশকে পদতলে রেখে শোষণ করায়?

শোষণ পদানত প্রভৃতি শব্দগুলি মালেক সাহেবের মুখে ইদানীং শোনা যাচ্ছিল। এতে মনে মনে খুব বিক্ষুব্ধ ছিলেন খালেক সাহেব। আপন ভ্রাতার এ হেন পদস্খলন তার কাছে গভীর মর্মপীড়ার কারণ ছিল। পাকিস্তান ও ইসলামকে বাঁচাতে গিয়ে আমরা যদি কিছুটা শোষিত হয়েই থাকি সেটা সহ্য হবে না? আমাদের ঈমান এতোই দুর্বল? কিন্তু বড় ভাইকে কী আর বলবেন! নিজে তিনি বৈজ্ঞানিক মানুষ; হলের প্রভোষ্টগিরি, ব্যবসা ও রোটারী ক্লাব নিয়ে আছেন। রাজনীতি এমন কিছু তিনি বোঝেন না। অথচ তার বড় ভাই সরাসরি রাজনীতির ছাত্র। তবু তিনি বলবেন, বড়ো ভাইয়ের ওটা ভুল। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শক্তি সম্পর্কে তার ধারণা নেই। একদিনে, হাঁ, মাত্র একদিনে আওয়ামী লীগের এই সব চ্যাংড়ামি সেনাবাহিনী ঘুচিয়ে দিতে পারে। দরকার হ’লে দেবে।

‘কিন্তু কত দিনে? গায়ের জোরে কতদিন অন্যকে পদানত রাখা সম্ভব?’

‘ধরুন এক শো বছর।’

এইটেই খালেক সাহেবের মত। ইসলামের স্বার্থে, পাকিস্তানের সংহতির স্বার্থে দরকার হলে আমাদের সেনাবাহিনী এক শো বছর পূর্ব পাকিস্তানকে পদানত রাখবে, দেশে সামরিক শাসন চালাবে। ইসলাম ও পাকিস্তানের স্বার্থে তা হবে বিলকুল জায়েজ।

খালেকের সঙ্গে সেই সব বিতর্কের কথা মালেক সাহেব এখন স্মরণ করলেন। খালেকের ধারণাই তা হলে ঠিক। গায়ের জোরে দরকার হলে বাংলাদেশকে পদানত রাখার অভিযান শুরু হয়েছে; মালেক সাহেব তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকে লিখিত প্রবন্ধটাকে টুকরো টুকরো ক’রে ছিঁড়ে ফেললেন। খুর বের করে গোঁফ চেঁছে নিলেন। অতঃপর চটপট ওজু করে মাথায় টুপি দিয়ে কোরান নিয়ে বসলেন।

কোরান শরীফের সামনেই পাওয়া গিয়েছিল মালেক সাহেবের লাশ। পাঁচ বছরের ছোট ছেলেটিকে পাওয়া গিয়েছিল বাপের পাশেই গুলিবিদ্ধ অবস্থায়। কিন্তু পাওয়া যায়নি দুই মেয়ে ও স্ত্রীকে। অবশ্য মালেক সাহেব অভিনয়ে খুব একটা ভুল করেন নি। ওদের তিনি বোঝাতে চেষ্টা করেছিলেন—

‘আমরা খাঁটি মুসলমান। সেনাবাহিনীর সমর্থক। আওয়ামী লীগের দুশমন।’

‘বেশ ঠিক আছে। আমাদেরকে তবে সাহায্যকর।’

শোনা মাত্র মালেক সাহেব সাহায্যের জন্য তৎপর হয়েছিলেন।

‘নিশ্চয় আপনাদেরকে সাহায্য করব। এক শো বার করব। বলুন কী করতে হবে। কোন দুশমনকে ধরিয়ে দিতে হবে। সব দুশমন আমার নখদর্পণে।’

‘ও সব নেহি। দুশমনের সাথে মোকাবেলা আমরাই করতে পারব। তোম রুপেয়া নিকালো।’

সঙ্গে সঙ্গে মালেক সাহেব আলমারি খুলে টাকা যা ছিল, মাত্র পাঁচ শো ছিল, সব দিয়েছিলেন। মোটেই পাঁচ শো টাকা! জওয়ানরা খুশি হয় নি। নিজেরা তন্ন তন্ন করে খুঁজেছিল সারা আলমারি। স্ত্রী কন্যাদের গহনা ছিল প্রায় চল্লিশ ভরি হবে। সেগুলো তারা হাতে নেওয়া মাত্র মালেক সাহেব বলে উঠেছিলেন—

‘যদি কিছু মনে না করেন তা হলে এগুলো আমি আপনাদেরকে সামান্য উপহার হিসেবে দিতে চাই।’

‘বহুত শুকরিয়া! আগার জেওয়ার তো মিলা, লেকিন আওরাত কাঁহা?’

গয়না তো দোস্ত দিলে, কিন্তু গয়না যে পরবে সে মেয়ে মানুষ কোথায়?

‘আওরাত কাঁহা?’–প্রচণ্ডভাবে ধমক দিয়ে উঠল একটি জওয়ান।

পাশেই বাথরুমে মেয়েরা লুকিয়েছিল। তাদের বের করা কঠিন ছিল না। দুবার জোরে লাথি মারতেই কপাট খুলে গেল। পাওয়া গেল দুই মেয়ে, এক মা! মায়ের বয়স চল্লিশ, কিন্তু ভারি মজবুত দেহের গড়ন। এখনো স্বচ্ছন্দে তিরিশ বলে চালিয়ে দেওয়া যায়, মেয়ে দুটির একটি উনিশ, একটি সতেরো। জওয়ানরা ভারি খুশি। এই বাড়িটাতে ঢোকা তাদের খুবই সার্থক হয়েছে। তিন তিনটে খুবসুরৎ আওরাত, চল্লিশ ভরি জেওয়ার, পাঞ্চ শো রুপেয়া। এ সবি মালে গণিমাৎ, অতএব হালাল।

‘তুমি বলেছ, তুমি আমাদের দোস্ত আদমী আছ। তবে এখন দোস্তের কাম কর। এই আওরাত তিনটাকে আমাদের দরকার। আমরা নিয়ে যাব। লেকিন কুচ ঘাবড়াও মাৎ, তিন দিন বাদে রেখে যাব।’

এতোটা সহ্য করার ক্ষমতা মালেক সাহেবের ছিল না। তিনি আর্তনাদ করে উঠলেন—

‘ইয়া আল্লাহ, এই জালেমের হাত থেকে বাঁচাও। লা ইলাহা……’

আর বলতে পারেন নি মালেক সাহেব। বলতে চেয়েছিলেন লা ইলাহা ইল্লা আন্‌তা……। ‘লা ইলাহা’ অর্থাৎ ‘আল্লাহ নেই’ পর্যন্ত বলতে পেরেছিলেন, বাকি অংশ ইল্লা আন্‌তা অর্থাৎ তুমি ছাড়া আর বলা হয়নি। এমন সময় খটা খট খটা খট—স্বয়ংক্রিয় রাইফেলের কাজ শুরু। অতএব মালেক সাহেবের জীবনের শেষ কথা হলো—আল্লা নেই। আল্লা নেই বলতে বলতেই ভুলণ্ঠিত হ’ল মালেক সাহেবের নশ্বর দেহ। তাঁর পাশে লুটিয়ে পড়ল পাঁচ বছরের ছোট ছেলেটি।

মালেক সাহেবের এই পরিণতির কথা সুদীপ্ত জেনেছিলেন পরে। প্রায় দিন দশেক পরে। সকল কথা ডঃ খালেকের কাছে শুনে আঁতকে উঠেছিলেন সুদীপ্ত।

‘ইস কী বর্বর নর পিচাশের দল।’

‘না না, ঐ সব বলবেন না। যে-কোনো দেশের সৈনিকদের তুলনায় আমাদের পাকিস্তানি সৈন্যদের নীতিবোধ অনেক উন্নত। ঐ একটা কাজ তারা বাই চান্স ক’রে ফেলেছে। তাও দেখুন না, ঐ ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে আমার কাছে চিঠি দিয়েছে ওরা। এবং ক্ষমা চেয়েছে।’

‘তাই নাকি!–সামান্য একটু ফোড়ন কেটে থেমে গিয়েছিলেন সুদীপ্ত। এবং এই খালেকের সঙ্গে কখনো যে তার পরিচয় হয়েছিল সে কথা মনে হয়ে গভীর ঘূণার সঞ্চার হয়েছিল তার মনে! কী অবাক! সংবাদটা দেবার সময় তাঁর একটু লজ্জাও কি হয় নি! ছী-ছী! অবলীলাক্রমে মরহুম আব্দুল মালেকের ভাই ডঃ আব্দুল খালেক বলে গেলেন—’

‘আর্মির জেনারসিটি দেখুন, মেয়েদের ফেরৎ পাঠাবার সময় চিকিৎসার জন্য তিন শো টাকাও দিয়েছে। দে আর কোয়াইট সেন্সিবল ফেলো।’

তা বটে। মনে মনে পরে সান্ত্বনা পেতে চেষ্টা করেছিলেন সুদীপ্ত। গণিমাতের মাল তো ফেরত দেবার কথা নয়। কিন্তু ওরা দিয়েছে। সেই সঙ্গে তিন শো টাকাও দিয়েছে। এই বদান্যতার কি তুলনা আছে! হাজার হ’লেও মিঃ মালেক ও ডঃ খালেক তাদের নিজেদের লোক। সাধারণ জওয়ান চিনতে না পেরে একজনকে না হয় মেরেই ফেলেছে এবং তাঁর স্ত্রী-কন্যাদের সাথে কিছুটা খারাপ কাম করেই ফেলেছে, তা ব’লে, কি ব্যাপারটাকে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখতে হবে না? রাষ্ট্রবিপ্লবের সময় এ ধরনের দু চারটে দুষ্কর্ম তো ঘটেই থাকে। তা ব’লে কি রাগ করে থাকলে চলে। ডঃ খালেক সেনাবাহিনীর উপর রাগ করেন নি। ভাবী ও ভাইঝিদের নিজের বাসায় এনে তাদের প্রত্যেককে এক বোতল ক’রে ভাইব্রোনা কিনে দিয়েছিলেন।

এ হেন ডঃ খালেক এক দিন ডঃ গোবিন্দ চন্দ্র দেবকে পাকিস্তান-বিরোধী বলে ফতোয়া দিয়েছিলেন।