সপ্তদশ পরিচ্ছেদ
‘আচ্ছা দুলা ভাই, এই যে আপনাদের পার্টি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হল, এর পর আপনারা করবেন কী?’
হামিদা প্রশ্নটা করতে চেয়েছিল খুবই সরল ভাবে। কিন্তু ফিরোজ সহসা যেন তাঁর চাচার মানসিকতা ঐ কণ্ঠস্বরে লক্ষ্য করলেন। সেটা অবশ্য ফিরোজেরই দোষ। তিনি যদি সকল ঝোপেই বাঘ দেখতে শুরু করেন তা হলে লোকে সে জন্য করবে কী? হামিদার একটি সরল প্রশ্নের উত্তরে ফিরোজ যা বললেন তা যেন তাঁর চাচাকে শোনানোর জন্য—
‘কী আর করব! তোমার মামাদের প্রেসিডেন্টের কাছে গিয়ে নাকে খত দিয়ে বলব—যা হবার হয়েছে, এবারের মতো মাফ ক’রে দিন; আর কখনো বলবো না যে, আমরা বাঙালি; আর কখনো গণতন্ত্র চাইব না; অর্থনীতিক ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে সমতা দাবী করব না; তা ছাড়া বাংলা ভাষা ভুলতে চেষ্টা করব। রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনলে কানে আঙ্গুল দেব। পরিশেষে তোমার মামার মতো দাড়ি রেখে দেব।’
এতো দুঃখেও সুদীপ্তর হাসি পেল। হাঁ, ফিরোজের ঐভাবে কথা বলার অধিকার আছে বটে। হামিদা তাঁর না হয় ছাত্রী, ফিরোজের তো শ্যালিকা। কিন্তু শ্যালিকার ভূমিকায় হামিদা ভয়ানক অযোগ্যা প্রমাণিত হল। হয়ত সম্মুখে একজন শিক্ষকের উপস্থিতি তার কারণ। হামিদা শুধু বলল—
‘আমি কিন্তু দুলাভাই রবীন্দ্রসঙ্গীত ভালোবাসি। এবং ইংরেজি পড়ছি বলে বাংলা ভুলতে চাই তাও নয়। অতএব আমাকে আপনার এইভাবে কথা বলা উচিত নয়।’
সুদীপ্ত দেখলেন, এবার তাঁকে হস্তক্ষেপ করতে হয়। ওরা দুজনেই পরস্পরকে ভুল বুঝেছে। এবং এতক্ষণের স্বাভাবিকতা থেকে কিছুটা বিচ্যুত হয়ে পড়েছে। একজন বন্ধু, আর একজন ছাত্রী—দুজনের কথাই মনে রেখে সুদীপ্ত বললেন—
‘ফিরোজের সঙ্গে তোমার সম্পর্কটাকে মনে রেখে কথা বল হামিদা।’
কিন্তু হায়, কি উদ্দেশ্যে তিনি কথাগুলি বললেন, আর তার ব্যাখ্যা হল কি রকম। মীনাক্ষী টিপ্পনী কাটলেন—
‘আপনি বুঝি এখানেও মাস্টারি শুরু করলেন।’
‘ওই বদ্ অভ্যাসটা যে ছাড়তে পারি নে, ভাবী।’
‘বিশেষ ক’রে ছাত্রী পেলে।’
—কণ্ঠস্বরটা ফিরোজের। কিন্তু একজন ছাত্রীর সামনে কি এমন ক’রে বলাটা ঠিক হল ফিরোজের! সুদীপ্তর তাকানোর ভঙ্গি দেখেই ফিরোজ বুঝেছিলেন, তাঁর বন্ধু মনে আঘাত পেয়েছেন। কিন্তু বন্ধু! এখন আঘাত পেলে চলবে কেন? এই তো কিছুক্ষণ আগেই বেশ উপদেশ বিতরণ চলছিল। এখন সেই উপদেশটা নিজেকে দিলেই তো হয়। হামিদা তোমার ছাত্রী হতে পারে, কিন্তু আমার তো শ্যালিকা, এবং তুমিও আমার বন্ধু। অতএব তোমাদের দুজনকে জড়িয়ে কোনো রসিকতার সুযোগ হাতছাড়া করি কেন?
কিন্তু সুদীপ্ত ঐ মুহূর্তেই অতখানি ভাবতে পারেন নি। তিনি তাই একটি গুরুতর কথা বলে ফেললেন—
‘না না, আমরা ছাত্র-ছাত্রীতে কোনো প্রভেদ মনে রাখি নে। বিশ্বাস কর।’
মীনাক্ষী ও ফিরোজ দুজনেই এবার হেসে উঠলেন। এবং কথাটা বলার পর সুদীপ্তর মনে হল, তাই তো, এতো হাল্কা কথা তিনি তো সচরাচর বলেন না। কিন্তু তিনি জানতেন না যে, গত দু-তিন দিনের ঘটনায় তাঁর সেই পরিচিত সত্তা ও ব্যক্তিত্বের সবটুকু ওলট-পালট হয়ে গেছে।
সুদীপ্ত কিছুক্ষণ আর বলতে পারলেন না। কিন্তু বোঝা গেল, হামিদা বাকপ্রিয় মেয়ে। কিছু না বলে বসে থাকা তার পক্ষে খুব কঠিন কর্ম। সে তার দুলাভাইয়ের সঙ্গে অনবরত কথা বলে যেতে লাগল। তার অনেকখানিই সুদীপ্ত শুনলেন না। এবং মাঝে মাঝে শুনলেনও। তাতে ছাত্রীটিকে তাঁর প্রিয়ংবদা মনে হল। প্রিয় কথাই হামিদা বলেছে—
‘আপনারা যে যাই বলুন দুলাভাই, শেখ সাহেবকে কিছুতেই ওরা ধরতে পারে নি।’
কিন্তু শেখ সাহেবকে তোরা তো চিনিস নে—ফিরোজ মনে মনে বললেন। মুখে বললেন–
‘স্বেচ্ছায় তিনি ধরা না দিলে কেউ তাঁকে ধরতে পারে নি, এবং পারবেও না। তবে কথা হচ্ছে, ধরা না দেওয়ার ইচ্ছাটা তিনি করেছিলেন কি না।’
ফিরোজ জানতেন, শেখ সাহেব ধরা দিয়েছেন। কেউ তাঁকে বাড়ি থেকে বের করতে পারেনি। শেষ মুহূর্তে এমন কি জোর ক’রে তাঁকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টাও ব্যর্থ হয়েছে। তবু এই মুহূর্তে ওই গুজবটার কিছু মূল্য আছে। দেশবাসী জানুক, তাদের প্রিয় নেতা তাদেরকে পথনির্দেশ করার জন্য বাইরেই রয়েছেন।
বাইরে দরজা কড়া নাড়ার শব্দ হল। ফিরোজ গিয়ে খুলে দিলেন।—
‘কাকে চাই? কোথা থেকে আসছেন?’
লোকটি ভেতরে আসতেই সুদীপ্ত তাকে চিনলেন—
‘আরে হাশমত খাঁ যে, কি খবর?’
হাশমত এক সময় তাঁদের নীলক্ষেত আবাসিক এলাকার দারোয়ান ছিল। মাত্র মাস দুয়েক আগেও ছিল। এখন করছে কি?
‘বেবসা করি হুজুর।’
হাশমত খাঁ ব্যবসা করছে! ভালোই তো। বিহার থেকে মোহাজের হয়ে এসে হাশমত খাঁ পিওনের চাকরি করত একটা অফিসে। তাতে চলত না। অগত্যা রাত্রে দারোয়ানী। রাত্রে তাঁদের এলাকা পাহারা দেবার ভার নেওয়ার ফলে আরো অতিরিক্ত ষাট টাকা আয় হত। এইভাবেই চলছিল। হঠাৎ গত জানুয়ারিতে নীলক্ষেতের চাকরি সে ছেড়ে দেয়। কেন ছাড়ল, কোথায় কি কাজ পেল ইত্যাদি কোনো প্রশ্নই তখন কারো মনে জাগেনি। কিন্তু এখন তো শুধাতেই হয়—
‘ব্যবসা করছ তুমি? কিসের ব্যবসা?’
‘মহম্মদপুরে একঠো মনিহারী দোকান পেয়েছি হুজুর।’
পেয়েছি মানে কিনে পাওয়া নয়। সে ইতিহাস কয়েকটি প্রশ্ন ক’রে জেনে নিলেন তাঁরা, অর্থাৎ সুদীপ্ত ও ফিরোজ। মীনাক্ষী ও হামিদা বাইরের লোকের সমাগম হতেই ভেতরে চলে গেছেন।
হাশমতের কাছে সংক্ষেপে যা জানা গেল তাতে হাশমতের কোনো দোষ নেই।
‘আমার কোনো দোষ নাই আছে হুজুর। জোর ক’রে আমার কাছে দিয়ে গেল।’
লোকটির বাড়ি ছিল ময়মনসিংহে। গতকাল নাকি জোর ক’রে তার মনিহারী দোকানটা সে হাশমতকে দান ক’রে গেছে। হাশমত ছিল ওই দোকানের সেল্স্ম্যান। গত জানুয়ারি মাসে সব রকমের চাকরি ছেড়ে দিয়ে সে এই কর্মে ঢুকেছিল। মহম্মদপুর এলাকায় অবাঙালি সেল্স্ম্যান ছাড়া দোকানের পসার জমানো ছিল শক্ত। অতএব হাশমতকে নিযুক্ত ক’রে ভদ্রলোক ভারি সুবুদ্ধির পরিচয় দিয়েছিলেন। তা ছাড়া হাশমত বেশ চালাক চতুর লোক; এবং ভারি বিশ্বস্ত। হাশমতের চেষ্টায় এক মাসেই দোকানের আয় প্রায় দ্বিগুন বৃদ্ধি পেয়েছিল। সবি তো বোঝা গেল। কিন্তু সেই বিশ্বাসের পুরস্কার স্বরূপ গোটা দোকানটাই একেবারে দান ক’রে গেল। ওই রকম দান কেউ ক’রে নাকি! সুদীপ্ত শুধালেন—
‘লোকটা কি আর কখনো ফিরে আসবে না বলে গেছে?’
‘তা কিছু বলেনি হুজুর। খালি কাল সকালে হামারে চাবি দিয়ে বলে গেছে—রোজ তুমি দোকান খুলবে, আর কেউ পুছ করলে কিংবা লুঠ করতে এলে তুমি বলবে দোকানটা তোমার, বুঝলে।’
‘তাই নাকি! তারপর?’
‘তারপর নিজের হাতে তিনি বাংলা হরফে লেখা সাইনবোর্ড নামিয়ে ফেললেন। হামারে বললেন, উর্দুতে একঠো সাইনবোর্ড লিখে এখানে টানিয়ে দিও।’
‘তুমি তা দিয়েছ তো?’
‘হাঁ, হাশমত সে আদেশ পালন করেছে। সে তার মনিবের অত্যন্ত বিশ্বস্ত কর্মচারি। আগে দোকানের নাম ছিল ‘মুক্তা মনিহারি’। এখন সেখানে গেলে দেখা যাবে, বাংলা হরফের কোনো চিহ্ন তার ধারে কাছে কোথাও নেই। তার পরিবর্তে উর্দু হরফে সবুজ কালি দিয়ে লেখা—‘হাশমত ইসটেশনারি’।
ফিরোজ এতক্ষণ কিছু বলেন নি। সব শুনছিলেন। এবং বুঝতে কোনোই কষ্ট হচ্ছিল না যে, দোকানটাকে নিছক বাঁচানোর জন্যই ভদ্রলোকের এতো সব চেষ্টা। দোকানের মালিক অবাঙালি—এমন একটা ধারণা বাইরে প্রচারিত থাকলে তবেই ওই এলাকায় তা লুটপাটের কবল থেকে রেহাই পেতে পারে। ঠিকই ভেবেছিলেন ভদ্রলোক। কিন্তু যে সর্ষে দিয়ে ভূত ভাগনোর আয়োজন করেছেন সেই সৰ্ষেতেই যে ভূত! ফিরোজ শুধালেন—
‘আচ্ছা ধর, কয়েকদিন পর যদি দোকানের মালিক ফিরে আসেন।’
‘তো হাম কিয়া কারে গা! দোকানের মালিক তো এখন হামি—ও তো এখন হামারা দোকান আছে।’
‘তা আছে, থাক। কিন্তু সেই ভদ্রলোক এসে যদি ফেরত চান।’
‘কিয়া বাত? খয়রাত ক’রে আবার তা ফেরত চাইবে! চাক্কু মেরে একেবারে হালাক ক’রে দিব না!’
দুজনেই অবাক হয়ে লক্ষ্য করেন, হাশমত এখন আর সেই পিয়ন নয় যেন। এখন সে যেন এই এক দিনেই তাদের সঙ্গে সমমর্যাদাসম্পন্ন ভদ্রলোক হয়ে উঠেছে।‥ তা যা খুশি হোক গে, আর ভাবা যায় না। কতো আর অত্যাচারের অবিচারের যন্ত্রণা পোহানো যায়! না, ঐ প্রশ্ন আর নয়! ফিরোজ কাজের কথা পাড়লেন—
‘এখানে এসেছ কি উদ্দেশ্যে।’
‘গাজী সাহেব কা লিয়ে একঠো খত্ হ্যায়।’
গাজী সাহেব অর্থাৎ ফিরোজের চাচার কাছে একটা চিঠি নিয়ে এসেছে হাশমত। কার চিঠি? সে কথা কি আর বলবে! এখন সে একটা দোকানে মালিক। অতএব বুদ্ধিমান হয়েছে বৈ কি। তবু একটু বাজিয়ে দেখা যাক না–
‘খত পাঠাল কে?’
‘মওলানা সাহাব ভেজ দিয়া।’
কোন্ মওলানা! দেখা গেল হাশমত খাঁ এই লাইনে একজন গবেট। সব কথা অকপটে বলে ফেলল। এমন কি যখন শুনল যে, ফিরোজ হচ্ছেন গাজী সাহেবের ভাইপো তখন বিনা দ্বিধায় চিঠিখানা ফিরোজের হাতে সঁপে দিয়ে চলে গেল সে। গাজী সাহেবের মতো লোকের ভাইপো যখন তখন সে ঈমানদার না হয়ে যায় না–হাশমতের চিন্তার দৌড় এর চেয়ে বেশি হবে কি করে?
কিন্তু হাশমত বড়ো উপকার ক’রে গেল। চিঠিখানা তাঁর চাচার নয়, তাঁরই পাওয়ার দরকার ছিল বেশি। খোদ সামরিক কর্তৃপক্ষের নির্দেশে এই ব্যক্তিগত পত্রে মওলানার একান্ত বিশ্বাসভাজন গাজী সাহেবকে অত্যন্ত জরুরি কয়েকটি কথা লেখা হয়েছে। তার সারকথা হচ্ছে, সামরিক কর্তৃপক্ষের এই মুহূর্তেই কিছু দালাল দরকার। মুসলিম লীগ বা জামাতে ইসলামের লোক হিসাবে যারা চিহ্নিত হয়ে আছে তাদের কথার এখন খুব একটা দাম হবে না। সে জন্য খোদ আওয়ামী লীগের কোনো লোক পেলে ভালো হয়! গাজী সাহেব তার ভাইপো ফিরোজকে যদি হাত করতে পারেন তাহলে মওলানা জানিয়েছেন, সরকার তাকে একটা আমদানি লাইসেন্স দিতে রাজী আছে। ফিরোজকে কি করতে হবে তারও সামান্য ইঙ্গিত পত্রে আছে। আপাততঃ সামরিক বাহিনীর কাজ সমর্থন ক’রে একটা বিবৃতি দিতে হবে—বলতে হবে, আওয়ামী লীগের কিছুসংখ্যক দুস্কৃতিকারী যে দেশকে বিচ্ছিন্ন করতে চেয়েছিল তার সাথে অধিকাংশ আওয়ামী লীগ সদস্যের কোন যোগ নেই। ওই দুস্কৃতিকারীদের দমন করতে গিয়ে সেনাবাহিনীকে যে ব্যবস্থা নিতে হয়েছে সেটা যথেষ্ট সময়োপযোগী হয়েছে; ওই ব্যবস্থা গৃহীত না হলে দেশ জাহান্নামে যেত‥ ইত্যাদি। পরিশেষে বলা হয়েছে, ফিরোজ কথা শুনতে না চাইলে তাকে যেন ভয় দেখানো হয়—তার ঘর-বাড়ি, লুটপাট করা হবে, তাকে ধরে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে গিয়ে পীড়ন চালানো হবে, পরিশেষে সামরিক আদালতে বিচার ক’রে হত্যা করা হবে।
চিঠিখানা পড়ে তা নীরবে ফিরোজ সুদীপ্তর হাতে চালান ক’রে দিলেন। ইংরেজিতে টাইপ করা একখানা চিঠি নিচে মওলানা নাম সই করেছেন আরবীতে। সুদীপ্ত পড়তে পড়তে শুনলেন, ফিরোজ বলছেন—
‘খবিশদের এটা কি রসিকতা? নাকি এ বেকুবের স্পর্ধা? যা খুশি আমাদের দিয়ে করিয়ে নেওয়া যায় বলে মনে ক’রে নাকি?’
‘আবার কাকে গালাগালি শুরু করলে?’
—বলতে বলতে মীনাক্ষী এলেন ঘরে। তাঁর সঙ্গে হামিদার হাতে চায়ের সরঞ্জাম। চাচী সঙ্গে কিছু নাশতা দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মীনাক্ষীই বাধা দিয়েছেন—
‘এই মাত্র ওরা সব খেয়ে বেরুলো। আর কিছু লাগবে না। শুধু চা দিন।’
‘স্যারকে শুধুই চা দেওয়া যায় নাকি!’
—হামিদা বাধা দিতে গিয়েছিল। কিন্তু মীনাক্ষীর ধমক খেয়ে থেমে যেতে হয়েছে তাকে।
‘তোর স্যার যখন তোর বাড়ি যাবে তখন তোর ইচ্ছে মতো খাওয়াস। এখন আমাদের বাড়িতে কি খাওয়ানো দরকার সেটা আমরা বুঝব।’
মীনাক্ষী ঠিকই বলেছেন। তখন মাত্র চায়ের পিপাসা ছিল ওদের। চা খেতে খেতেই চাচা এলেন। পরদার ফাঁক দিয়ে চাচাকে দেখা গেল। কিন্তু চাচার পেছনে ওরা কারা? সশস্ত্র ফৌজের একটা ক্ষুদ্র দল যে। সকলেই শিউরে উঠলেন? চকিতে সকলের মনেই নানা কথার বিদ্যুৎ খেলে গেল।
চাচা আমাদেরকে আর্মির হাতে তুলে দিবে নাকি! আমার জন্য আমার বন্ধুও মরবে।……
আমি এখানে! ভদ্রলোকের কোন আত্মীয় আর্মিতে থাকে নাকি! নাকি অন্য কিছু ব্যাপার আছে! কি থাকতে পারে এখানে!
ও মা মিলিটারি যে! মামার বাড়ি সার্চ করবে নাকি! তা হলেই হয়েছে। লোকগুলো এখনো তো ভরা আছে গ্যারেজে?……
লোকগুলো মানে তিনজন পুলিশ। রাজারবাগ পুলিশের লোক ওরা। আর্মির সাথে যুদ্ধ ক’রে কিছু ওদের মরেছে, কিছু পালিয়েছে। অনেকেই আশ্রয় নিয়েছে আশেপাশের বাড়িতে। চাচার বাড়িতে যে তিনজন এসেছিল তাদেরকে বেশ সমাদরেই চাচা বরণ করেছিলেন। কারফিউ ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই গতকাল ওরা পালাতে চেয়েছিল। কিন্তু চাচা বলেছিলেন—
‘না বাবারা, ওই কাজ করবেন না। অবস্থা একটু শান্ত হোক, আমি নিজে গাড়িতে ক’রে আপনাদেরকে সাভারে অথবা ডেমরার ওদিকে কোথাও রেখে আসব।’
এ কথায় খুবই আশ্বস্ত হয়েছিল পুলিশ তিনজন। আল্লাহর কাছে অশেষ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছিল মনে মনে। তারা যে এমন একজনের ঘরে ঠাঁই পেয়েছে সে একান্তই কপালের গুণে। আহা, মানুষ তো নয় গো, যেন ফেরেশতা একেবারে। নামাজ, কালাম, মুখভরা দাড়ি— দেখলেই ভক্তি হয়। গ্যারাজ থেকে অচল গাড়িখানা বের ক’রে সেইখানে জীর্ণ কম্বল ও তোসক বিছিয়ে তাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল। তাতে অসুবিধা বিশেষ ছিল না। কারণ ঘরখানা প্রথমে তৈরি হয়েছিল চাকরদের বাসের জন্যই। অতএব ছোট একটি জানলা সেখানে ছিলই। পরে ওটাকে গ্যারাজ বানানোর জন্যে সামনের দিকটা ভেঙে দরজা বড়ো করা হয়েছিল; কিন্তু জানলাটি বন্ধ করা হয় নি। পুলিশ তিনজনকে সেখানে পুরে বাইরে থেকে দরজায় তালা দিয়ে রাখা হত, যেন কেউ সন্দেহ না করে। ঘরে দেওয়া হয়েছিল পেচ্ছাব ইত্যাদির জন্য একটা খালি কেরোসিনের টিন, এবং এক কলসী পানি। অতএব ব্যবস্থাটাকে পুলিশের কাছে যতোদূর সম্ভব নিখুঁত বলেই মনে হয়েছিল। খাবারের সময় ঘরে ডেকে নিয়ে গিয়ে খাওয়ানো হত। সেইটেই ওদের নিকট প্রতীয়মান হত পরম সমাদর বলে।
আটাশে মার্চের বেলা প্রায় তিনটের দিকে পরম সমাদরে গ্যারাজের তালা খুলে ফিরোজের চাচা গাজী মাসউদ-উর রহমান বাঙালি পুলিশ তিনজনকে পাঞ্জাবি সৈনিকদের হাতে তুলে দিলেন। কর্তব্য সমাধা ক’রে একটা পরম তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলে চাচা ঘরে এসে সোফার উপর বসলেন। হামিদাকে বিজলি পাখা চালিয়ে দিতে বললেন এবং ফিরোজদের দিকে লক্ষ্য করে বললেন— ‘একটা দায় চুকল। উহ্! কী যে দুশ্চিন্তায় ছিলাম বাবা!’
অতঃপর নিজেই আনুপূর্বিক ঘটনার বিবরণ দিয়ে বললেন—
‘তোমরা হয়ত ভাবছ, আমি বেঈমানী করলাম। আশ্রিতকে রক্ষা করা আশ্রয়দাতার কর্তব্য। হাঁ বাবা, আমি সে কথা একশো বার মানি। আশ্রিত যদি আমার নিজের জীবনের শত্ৰু হত আমি তাকে জীবনের বিনিময়ে হলেও রক্ষা করতাম। কিন্তু এই পাক-ওয়াতানের সাথে বেঈমানী কিছুতেই আমরা সইবো না।’
ফিরোজ বা অন্য কেউ কিছুই বলেন না দেখে তিনি আবার বলা শুরু করলেন—
‘আগে তো দেশ। তারপর মানুষ। বল এ কথা তুমি মান কি না।’
না। আর চুপ থাকা যায় না। কিছু বলতেই হয়। কিন্তু সোজা কথা তো বলা যাবে না। কে জানে, তাঁদেরও দশা ওই পুলিশের মতো হয় কি না। ফিরোজ একটু ভেবে বললেন—
‘না চাচা, আগে ইসলাম। তারপর দুনিয়ার যা কিছু সব।’
‘বল কি বাবা! ঠেলা খেয়ে মতি ফিরল নাকি! এমন কথা তো এর আগে কখনো তোমাকে বলতে শুনিনি।—না। তা বলে সহজে বিশ্বাস করছিনে। তুমি ঠাট্টা করছ বোধ হয়।’
চাচা তবে ঠিকই ধরেছে তো। মনে মনে ফিরোজ একটু হাসলেন। এবং চুপ ক’রে গেলেন। সুদীপ্তও ব্যাপারটা বুঝে ফেলেছেন ততক্ষণে। তিনি একটু অভিনয়ের চেষ্টা করলেন। ফিরোজকে সমর্থন ক’রে বললেন—
‘জি না। ঠাট্টা করবে কেন। ঠিকই তো বলেছে। আপনাদের মতো বুদ্ধি-বিবেক যাদেরই আছে তারাই বলবেন, ইসলামকে বাদ দিলে এই পাকওয়াতানের অস্তিত্ব কোনোখানেই টেকে না।’
সুদীপ্ত ফিরোজের চাচাকে খুশি করতে চাইছিলেন। কিন্তু সব কাজ সকলে পারে? অন্ততঃ সুদীপ্ত যা করতে চাইছিলেন তা যে পারেন নি সেটা চাচার পরবর্তী কথাতেই বুঝা গেল। চাচার কণ্ঠস্বরে বেশ উত্তেজনা—
‘কি বলছেন সাহেব। আমাদের বুদ্ধি বিবেক?—বুদ্ধি বিবেক আপনাদের নেই? আপনাদের বুদ্ধি-বিবেক কি কয়?’
না, সুদীপ্তর মতো ভদ্রলোকের কাজ নয় চাচার মুখোমুখি হওয়া। অতএব সুদীপ্তকে আড়ালে দিয়ে ফিরোজ সামনে এলেন–
‘আমাদের বুদ্ধি-বিবেক দিয়ে তো চাচা আপনাদের পাকিস্তান চলবে না, সে জন্যই বলা হচ্ছে…
কিন্তু ফিরোজের আর বলা হল না। তাঁর কথায় আরো তেতে উঠে চাচা। আরো বেশি মাত্রাজ্ঞান হারালেন, এবং ফিরোজকে তাঁর বক্তব্য শেষ করতে না দিয়ে বলে উঠলেন–
‘কিয়া বাত! আপনাদের পাকিস্তান! —পাকিস্তান শুধু আমাদের তোমাদেরও নয়?’
মনে মনে চাচা এবার খুব খুশি। কেমন ঠেসে ধরেছি বাবা! পলিটিক্স আমাদেরও জানা আছে। তোমাদের ভেতরে কি আছে আমরা তা দেখতে পাই মনে কর! পাকিস্তানকে তোমরা যে কখনো মেনে নিতে পার নি সে কি আমরা জানি নে! সামান্য একটু বিরতি দিয়ে চাচা আরো বললেন–
‘সেই জন্যই তো ইয়াহিয়া খানকে এমন কঠোর ব্যবস্থা নিতে হল। এ ছাড়া দেশকে বাঁচানোর আর কি পথ ছিল বল।’
তা ঠিক। তার চাচার পক্ষে ঠিক এই রকমটাই ভাবা স্বাভাবিক। ইয়াহিয়া খানের এত নরহত্যার সমর্থনও তা হলে আছে দেশে। অবশ্যই চাচা বলবেন, ‘নরহত্যার সমর্থক আমরা নই, তবে আমাদেরই কর্মের ফলে ইয়াহিয়া খানকে যে এই নরহত্যার পথ বেছে নিতে হয়েছে সেই সত্যকে তো বাবা অস্বীকার করতে পারবে না।’
তাই নাকি চাচা! এ যে খোদ ইয়াহিয়া খানের কণ্ঠস্বর মনে হচ্ছে। এবং ইয়াহিয়া খানের শয়তানীর জবাব তো আজ একটাই, সেটা কোন মানব কণ্ঠের ভাষায় দেওয়া যাবে না আর, দিতে হবে অস্ত্রের ভাষায়। চাচা, তোমার জন্যও মনে হচ্ছে, তেমনি অস্ত্রের জবাব আবশ্যক হয়ে পড়েছে। হাঁ মাঝে মাঝে এমন এক-একটা সময় আসে যখন লাঠির যুক্তি ছাড়া আর কোনো যুক্তির পথে এগোনো যায় না। কিন্তু এই মুহূর্তেই ফিরোজ তার চাচাকে লাঠি দেখাতে চান না। তিনি প্রবল চেষ্টায় শান্ত কণ্ঠে বললেন–
‘কিন্তু এহিয়ার কর্মের ফলেই যে আমাদেরকে অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের পথ বেছে নিতে হয়েছিল সেইটাই বা আপনি অস্বীকার করবেন কী করে? অহিংস আন্দোলন দমনের জন্য…’
‘অহিংস আন্দোলন?’—ফিরোজের কথা শেষ হবার আগেই চাচা প্রায় গর্জন ক’রে উঠলেন, ‘বাঙালি-বিহারি দাঙ্গা হয় নি ঢাকা শহরে? আমি তা স্বচক্ষে দেখেছি।’
‘তবু বলব দাঙ্গা হয় নি।’ ফিরোজের কণ্ঠে উত্তেজনা আর গোপন থাকল না, ‘দাঙ্গার চেষ্টা হয়েছিল মাত্র। এবং সে জন্য গোপন উস্কানী ছিল ওই এহিয়া-সরকারের। আমরা যথাসময়ে সে চেষ্টা বানচাল ক’রে দিয়েছি। তা না করলে এই ঢাকা শহরে একজনও বিহারি বেঁচে থাকত ভেবেছেন।’
না, ওই সব ভাবতে চাচা রাজী নন। তিনি কেবল সেইটুকু ভাবতে ও বলতে পারেন যেটুকু তাঁর মনিবরা তাঁকে শিখিয়ে থাকেন। অতএব কেবল সেই শেখানো কথার পুঁজি নিয়ে তিনি ভাইপো ফিরোজের সাথে বেশিক্ষণ কথা বলতে পারেন না। কিন্তু সে তো অন্য সময়ের কথা। এখন যে সময়টা তাঁদের অত্যন্ত অনুকূলে যাচ্ছে বলে তাঁরা মনে করেন সেই সময়ও তাঁকে ভাইপোর কাছে হার মানতে হবে? যুক্তিতে না পারলে শক্তিতে হারাবে কে? চাচা তাই বলে উঠলেন—
কি বলছ বাবা! ঢাকা শহরে একজন বিহারিকেও রাখতে না! আমরা তা হলে কি বসে বসে তামাসা দেখতাম? বিহারিরা মুসলমান না! নিরপরাধ মুসলমানের রক্তে মাটি ভিজিয়ে তোমরা আমাদের হাত থেকে রেহাই পেতে ভেবেছ।’
শেষের কথাগুলি দাঁতে দাঁত চিপে এমন ভঙ্গিতে চাচা বললেন যে, মেয়েরা তো মুখে আচল দিয়ে হেসেই ফেললেন। ফিরোজ হাসলেন না। ভীষণ ক্রুদ্ধ হলেন। ভণ্ডামীর একটা তো সীমা থাকা দরকার। এখনি বললেন, আমরা বিহারি মেরেছি বলে ইয়াহিয়া সৈন্য লেলিয়ে দিয়েছে আমাদের পেছনে। এখন আবার বলছেন, আমরা যদি বিহারিদের রক্তে ঢাকার মাটি ভেজাতাম তা হলে তারা তা সহ্য করতেন না। আমরা তা হলে, চাচা, করেছি কোন কামটা? বিহারি মেরেছি? না, ভবিষ্যতে মারতাম?…কিন্তু এ প্রশ্ন ফিরোজ তুললেন না। অন্য একটি কথা তার মাথায় এসেছে। তিনি বললেন–
‘কিন্তু এখন তো, চাচা মুসলমানের রক্তে ঢাকার মাটি সয়লাব হয়ে গেল। কি করেছেন সে জন্য? বা করছেন? উঠুন, ইসলামী জোস একটু দেখান।’
চাচা সহসা গম্ভীর হয়ে গেলেন। হাতের লাঠি আস্তে মেঝের উপর ঠুকে বললেন–
‘বাবা ফিরোজ, তোমার সঙ্গে আমার রসিকতার সম্পর্ক নয়। তুমি বলছ, মুসলমানের রক্তে ঢাকার মাটি সয়লাব হয়েছে। আমি বলছি, হয় নি।’
বলতে বলতেই চাচার কণ্ঠস্বর সপ্তমে চড়ল আবার। আবার তেমনি দাঁতে দাঁত চিপে বললেন–
‘যারা সব মরেছে তারা মুসলমান বলতে চাও? তারা দেশের দুশমন? তারা কাফের।’
সহসা হামিদা কি মনে ক’রে কথা বলে উঠল–
‘কিন্তু মামা, আমাদের মনিরুজ্জামান স্যার সম্পর্কে শুনেছি, খুবই ঈমানদার ও পরহেজগার ছিলেন।’
তির্যক দৃষ্টিতে ফিরোজের চাচা হামিদার দিকে তাকালেন। কিন্তু ধীর কণ্ঠে বললেন–
‘ওটা তুই বুঝবি নে মা। আল্লাহ পাক ওটা ঈমানদারের ঈমান পরীক্ষা করেছেন।’
এই সময় বেলা এসে তার আব্বার কোলে চড়ে গলা জড়িয়ে ধরল—
‘চল, বাড়ি যাবে না আব্বু।’
তাই তো মা, ভালো কথা মনে করিয়ে দিয়েছ। চাচার সঙ্গে ফিরোজের আলোচনা এখন যে পর্যায়ে পৌঁছেছে তাতে মাঝখানে কাউকে এসে দু’জনের দু’কান ধরে দু’দিকে সরিয়ে দেওয়াই তো কর্তব্য। হ্যাঁ, সে কর্তব্য পালনের উপযুক্ত ব্যক্তি এখানে বেলাই হতে পারে।
‘হ্যাঁ মা, চল যাই। তোমার আম্মাকে ডাক।’ তারপর ফিরোজের পানে তাকিয়ে–‘চল উঠি।’
ফিরোজ এই কথাটির প্রতীক্ষাতেই ছিলেন যেন। যদিও এ বাড়িতে আজকের রাতটা থাকবেন বলেই এসেছিলেন, তবু এখন এখান থেকে বেরোতে পারলেই যেন বাঁচেন। পুলিশ তিনজনকে সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দিতে দেখেও এখানে রাত্রি যাপন করবেন এতোখানি সাহস কিংবা নির্বুদ্ধিতা কোনটাই ফিরোজের ছিল না। তিনি সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন—
‘আরে তাই তো।’ হাতের ঘড়ির পানে তাকিয়ে ঘড়ি দেখতে দেখতে ‘এখনই তো বেরোনো দরকার মীনাক্ষী, ভাবীকে ডাক।’
‘মীনাক্ষী? বৌ-মার ঐ নাম রাখা হয়েছে বুঝি?’ গাজী সাহেব কেবল নাজমা নামটাই জানতেন। কী সুন্দর নাম—নাজমা! তাও পছন্দ নয় ছেলের। ও যে মুসলমানের নাম। তা বাবা, হিন্দু মেয়ে বিয়ে করলেই পারতে, একটা মুসলমান মেয়েকে হিন্দু বানানো কেন! নাহ, কথাটা চেপে রাখা যায় না। গাজি সাহেব বলেই ফেললেন—
‘বাবা ফিরোজ, একজন মুসলমানকে হিন্দু বানানো যে কতো বড়ো কবীরা গুনাহ, তা জান?’
নাজমা ততক্ষণে ভেতরে চলে গেছেন, পেছনে পেছনে হামিদাও গেছে। বেরিয়ে পরার জন্য ফিরোজ মন প্রস্তুত ক’রে ফেললেন। হাঁ, বেরোতেই হবে। থাকবেন বলে এসেছিলেন। কিন্তু থাকাই যখন হবে না, তখন আর এক মুহূর্তও না। পথ যে কি ভয়াবহ সে অভিজ্ঞতা আসবার সময়ই হয়েছে। এতোক্ষণে তা আরো ভয়াবহ হওয়ার কথা। কারফিউ শুরু হতে কতো দেরি আর? এখনো পঁয়তাল্লিশ মিনিট। না, সময়টা কম নয়। তবু যতো তাড়াতাড়ি বেরোনো যায়–ফিরোজ ভাবছিলেন। এমন সময় চাচার ঐ প্রশ্ন-মুসলমানকে হিন্দু বানানো যে কবীরা গুনা তা কি জান? হা জানি, কিন্তু বাঙালিকে খোট্টা বানানোর চেষ্টা তার চেয়েও জবর গুনা। কিন্তু থাক, কথা বললে কথা বেড়ে যাবে। কথা বাড়িয়ে এ বাড়িতে আর তিনি সময় নষ্ট করতে চান না। তাই, তিনি যেন শুনতেই পান নি এমনিভাবে অন্যমনস্ক থাকতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু চাচা তা থাকতে দেবেন কেন। তবে চাচা আর আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে কিছু বললেন না। যেন স্বগতোক্তি করলেন—
এই জন্যই তো বাপ তোমাদের দলকে এখানে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হ’ল।’
ফিরোজ মনে মনে ঠিক করেছিলেন, কিছু বলবেন না কিন্তু স্বভাব যাবে কোথায়? বলে উঠলেন—
‘মনে হচ্ছে যেন আপনিই আমাদের দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন?’
‘আলবৎ করেছি। কেন করব না? তোমরা বসে বসে এখানকার মুসলমানগুলোকে হিন্দু বানাবে আর আমরা তাই দেখব হা করে! আমাদের ঈমান কি এতোই কমজোর হয়ে গেছে!’
না। আর কিছু বলা হবে না। তাঁর বলতে ইচ্ছে হয়েছিল, বাংলা শব্দে নাম রাখলেই যদি মুসলমানীত্ব চলে যায় তবে সে তো যাওয়াই উচিত চাচা! কিন্তু না। থাক। যাবার সময় আর তিক্ততা বাড়িয়ে লাভ নেই। ওই তো মেয়েরাও সর বেরিয়ে এসেছে। চল যাওয়া যাক।
‘আচ্ছা আসি চাচা। আস্-সালামো আলায়কুম্।’
‘ওয়া আলাইকুম্ উস্-সালাম। মাঝে মাঝে এসো বাবা। আজ এসে যা উপকারটা করেছ!’
‘কি ভাবে?’
‘ওই যে তোমার গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেলাম। শহরের যা অবস্থা। গাড়ি না হলে বেরোনোই দায় এখন। ফোনও অচল হয়ে আছে সারা শহরে। অথচ দেশদ্রোহী ক’জন গাদ্দার পুলিশকে যে বাড়িতে ধ’রে রেখেছিলাম সে খবরটা ওদেরকে দেওয়া দরকারও ছিল খুবই।’
তাই নাকি! তা সে খবরটা এতো ঘটা ক’রে দেবার দরকারটা কি শুনি। বাড়িতে আর্মি আসা দেখে তো সেটা অনুমান করা গিয়েছিল। তবে মনে কোনো বদ মতলব আছে নাকি! এখনও তোমার সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ আছে? এ জন্য তো এখনো তুমি জাত রাজনীতিক হতে পার নি—ফিরোজ নিজেই নিজেকে শোনালেন। এতোখানি বোকামির কোনো মানে হয়। চাচাজি জামাতে ইসলামের লোক, ওখানে আপাততঃ আত্মগোপন ক’রে বাইরে যাবার পথ খুঁজবেন—ছেলের কি আশা! এখনো যদি জামাতে ইসলাম না চিনে থাক রাজনীতি ছেড়ে দাও গে।
গাড়ি ছেড়ে দেবার মুহূর্তে চাচা শুধিয়ে বসলেন—
‘এখন তোমার বাড়িতেই যাচ্ছ তো বাবা। মানে, দরকার পড়লে তোমার বাড়ি গেলেই তোমাকে পাব তো?’
চাচার মুখের দিকে তাকালেন ফিরোজ। কি ধরনের দরকার চাচা? তোমার চোখে ওটা কি? ঐ ধূর্ত হায়েনাটাকে এখনো চিনতে ভুল হবে ভেবেছ? ফিরোজ মুখ ফিরিয়ে নিলেন–
‘হাঁ, পাবেন। তবে দেশ যেদিন স্বাধীন করতে পারব সেইদিন।’
বলেই তিনি সঙ্গে সঙ্গে গাড়িতে স্টার্ট দিলেন। আর একটা কাগজের ঢেলা ছুড়ে দিলেন চাচার গায়ে। ওটা সেই হাশমত খাঁনের বয়ে-আনা চিঠি। কিন্তু চিঠি চাচার হাতে রইল। কি সেটা?—সে কৌতূহলের চেয়েও বড়ো একটা বিস্ময়-বিমূঢ়তা ছিল চাচার মনে। এ্যাঁ, বেতমীজ ভাইপো বলে কি! এখনো তবে বিষদাঁত ভাঙেনি। আচ্ছা…। কিন্তু হায়, ভাইপো যে নাগালের বাইরে! এখন যে হাত-পা কামড়াতে ইচ্ছে করে। জাহেলটাকে এমনি ছেড়ে দিলাম! এটা কী দিয়ে গেল! চিঠিখানা চাচা পড়লেন। এবং সঙ্গে সঙ্গে ছিঁড়ে ফেলে দিলেন। তারপর কোরানের একটি আয়াত পড়ে বলে উঠলেন—ওরে, আল্লাহ। ওদের অন্তঃকরণ সীলমোহর ক’রে দিয়েছে, ওদের কি আর সুপথে ফেরানো যায়। ওরা জাহেল।
কিন্তু একটা জাহেলকে ছেড়ে দিলেন তিনি? হায় হায়! মিলিটারি তো এসেই ছিল বাড়িতে। একই সঙ্গে দুই কাজ হয়ে যেত। লাভের মধ্যে গাড়িখানা মাগ্না পেয়ে যেতেন। কিন্তু এখন যে পস্তানোই সার। এক কাজ করা যায়…কিন্তু ছাই ফোনও তো অচল। সচল থাকলেই বা হত কি! গাড়ির নম্বর জানা আছে? ওই দেখো, গাড়ির নম্বরটাও নেওয়া হয় নি। যাঃ, সব হাতছাড়া হয়ে গেল।
‘হামিদা আমার সঙ্গে চলে আসতে চাইছিল।’
মীনাক্ষী গাড়ির মধ্যে কথাটা ফিরোজকে জানাবার অবকাশ পেলেন। ফিরোজ খুব সহজভাবে নিলেন কথাটা। এখন আর ঐ কথার কোন মানে হয় না। অতএব যেন একটা সংবাদ শুনলেন, যেন হামিদা নামে একটি মেয়ের মনের ইচ্ছাটাকে জানা গেল মাত্র—এমনি একটা ভাব নিয়ে তিনি শুধু বললেন–
‘ওখানে থাকা তো হামিদার পক্ষে কষ্টকরই বটে।’
‘শুধুই কষ্টকর, হামিদার পক্ষে ওটা আস্ত একটা জাহান্নাম।’
–আমিনা তার অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করলেন। তিনি সারাক্ষণ অন্দরমহলে ছিলেন, বাইরের ঘরে একবারও আসেন নি। সেখানে ভেতরের ঘরের প্রতিটি জানলা পুরু পর্দা দিয়ে ঢাকা; মুহূর্তের জন্যও তার কোনো-এক প্রান্ত ও একটু ফাঁক করার হুকুম নেই। বারান্দা ঘন চিক দিয়ে ঘেরা। মানুষ ওখানে থাকে কি করে? শুধুই আলো-বাতাসের অভাব যে, তা-ই নয়, ভীষণ নোংরাও বটে। আর বাতাস ওর মধ্যে ঢুকতে না পারলেও মাছি ঠিকই ঢুকে—এতো মাছি সারা ঘরে! ছি-ছি, সারা গা ঘিন ঘিন ক’রে এখনো সেই দৃশ্য মনে পড়লে। ওর মধ্যে স্বাস্থ্য বাঁচে? কিন্তু চাচার ইসলাম তো বাঁচে। আমিনার বাঁচতে ইচ্ছা করেনি। অন্ততঃ একটা রাতও যে এখানে কাটাতে হবে মনে তেমন সম্ভাবনার উদয় হতেই আমিনার মরে যেতে ইচ্ছা করেছিল। কিন্তু প্রাণ পেয়ে যেন বেঁচেছেন। যখন মীনাক্ষী গিয়ে খবর দিয়েছেন–
‘না ভাই, এখানেও থাকা হচ্ছে না আমাদের। আবার যে কোথায় যাই।’
‘চলুন না সকলে আমার খালার বাসায় যাই। বেশ বড়ো বাড়ি ওদের।’
ফিরোজের চাচী তখন সেখানে ছিলেন না। কিন্তু হামিদা ছিল। মীনাক্ষীদের চলে যাবার কথা শুনে হামিদার মন খারাপ হয়েছিল খুবই। সে মীনাক্ষীকে অনুরোধ জানিয়েছিল–
‘আমাকেও সুদ্ধ আপনাদের সঙ্গে নিয়ে চলুন না বুবু।’
এখন মীনাক্ষীর বার বার মনে হতে লাগলো, মেয়েটাকে সঙ্গে নিয়ে এলেই ভালো হতো। কিন্তু নিজেরাই তারা কোথায় যাবেন—সেই অনিশ্চয়তার মধ্যে তখন হামিদার অনুরোধকে গুরুত্ব দেওয়া সম্ভব হয় নি।
এত বেশি নির্জনতা কি সহ্য করা সম্ভব? বড়ো রাস্তায় নামতেই নির্জনতার বিভীষিকা তাদেরকে চারপাশ ঘিরে আক্রমণ করল। এই বিভীষিকার মধ্য দিয়ে বোধ হয় তাদের এ যাত্রা আর ফুরোবে না—এমনি মনে হতে লাগল। কিন্তু সব যাত্রাই তবু ফুরোয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা মানুষের দেখা পেলেন।
শান্তিনগর বাজারের কাছে—বহু মানুষ। আসবার সময় তো এখানে একটি জনপ্রাণীও ছিল না। কিন্তু এখন এতো মানুষ! এক সঙ্গে অনেক মানুষ, মানুষের চীৎকার এবং সারি সারি ট্রাক। এ দেখে মনে বল পাবার কথা। কিন্তু ফিরোজের বুক কেঁপে উঠল। কোনো বিজন প্রান্তরে একটি মানুষের জন্য সমস্ত চিত্ত যখন পিপাসিত তখন যদি মানুষের দেখা মেলে। কিন্তু পরক্ষণেই যদি বোঝা যায়, সে মানুষেরা সব মানুষ উড়ে! প্রথমে যাদের মানুষ মনে হয়েছিল, ফিরোজরা দেখলেন, একটিও তারা স্বাভাবিক মানুষ নয়। কিছু সৈনিক এবং অধিকাংশ লুটেরা। আপনিই গাড়ির গতি মন্থর হয়েছিল—মূলতঃ ভয়ে সামান্য কৌতূহলও তার সঙ্গে ছিল। এতোগুলো মানুষ এখানে করছে কি? বাজার লুট করছে। বুঝতে বেশি বিলম্ব হয়নি ফিরোজের। প্রথমেই বুঝলেন জনতার ভাষা—বাংলা নয়। উর্দু ভাষার প্রবল বাক্যস্রোত অনর্গল প্রবাহিত হচ্ছে আর বোঝাই হচ্ছে ট্রাকগুলি গম, ছোলা, গুঁড়ো দুধের টিন, চা, চিনি, কেরোসিন, ঘি, সোয়াবিন এবং সেই সঙ্গে আরো কতো কি। পাঁচটা ট্রাক ইতিমধ্যেই বোঝাই হয়ে গেছে। যষ্ঠটি বোঝাই হচ্ছে। আর একটি জওয়ান মুভি ক্যামেরায় সেই বাজার লুটের ছবি নিচ্ছে অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে। কিন্তু কেন? কারণটা সেই মুহূর্তেই ফিরোজ বুঝতে পারেননি। বুঝেছিলেন বহু পরে যখন একটি সাংবাদিক-সম্মেলনে ইয়াহিয়া খান বলেছিলেন, বাঙালিরা বিহারীদের প্রাণ নিতে এবং সম্পত্তি লুটপাট করতে শুরু করলে তখন বাধ্য হয়ে তাঁকে সেনাবাহিনী শহরে নামাতে হয়েছিল। …ওরে হারামজাদা! ফিরোজ উত্তেজিত হয়েছিলেন সেদিন।
কিন্তু আজ কেমন যেন একটু ভয় করতে লাগল। অবশ্যই বাজারে উর্দুর সংলাপ-বিচিত্রা চিরদিনই ফিরোজের মনে একটা অদ্ভুত রসের সঞ্চার ক’রে কিন্তু আজ রসাপ্লুত হওয়ার অবকাশ ছিল কোথায়।
…আবে চান্দু, ই ধার লে আও, ই ধার…আরে চাউল নেহি, গম লে আও, ছোলা লে আও, জলদি করো জলদি…গুঁড়া দুধ? জরুর লেগা…
হরেক রকমের কথা। ফিরোজরা বুঝলেন, যেহেতু এরা অবাঙালি, অতএব লোভটা গমের প্রতি। চাল রেখে দিয়ে গম নিয়ে যাচ্ছে। তবু রক্ষে। চাল থাকলেই বাঙালির চলবে। চলবে নাকি? অবাঙালিদের এতোই বোকা পেয়েছ? তারা যুদ্ধ ক’রে ঢাকা শহর জয় ক’রে নিয়েছে না। বিজিত সম্প্রদায়ের সমুদয় মাল-মাত্তা, মায় আওরাতগুলি পর্যন্ত, বিজয়ী সম্প্রদায়ের জন্য সেরেফ হালাল। তা নিয়ে তারা যা খুশি করতে পারে। চাউল পছন্দ নয়। ভালো কথা। ইচ্ছে হলে পুড়িয়ে দেবে। তোমাদের জন্য রেখে দেবে কেন শুনি!
কিন্তু এটা কি ধরনের কাণ্ড! সামরিক বাহিনীর প্রহরায় বাজার লুট হচ্ছে!
‘কেন হবে না? সন্ধ্যার পর উঠেছিল কথাটা, ইসলামের আইনে এ তো জায়েজ।’
বলেছিলেন আব্দুল ওদুদ সাহেব। ফিরোজের চাচাত ভাইয়ের এক শ্যালক। চাচার বাড়ি থেকে ফিরোজ অন্য এক চাচাত ভাইয়ের শ্যালকের বাসায় গিয়ে উঠেছিলেন। সন্ধ্যার পর সেই বাড়ির ছাদ থেকে সকলেই তারা দেখেছিলেন, শান্তিনগর বাজার জ্বলছে। লুটপাট শেষ করতে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল। এবং লুণ্ঠন শেষ হওয়ার পরেও ছিল কয়েক শো মণ চাল ও বাঙালিদের ব্যবহার্য অন্যান্য জিনিসপত্র। সেগুলো নিয়ে অবাঙালিরা করবে কি? অতএব তাতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল তারা। এই সব লুটপাট ও আগুন সম্পর্কেই মন্তব্য করেছিলেন ওদুদ সাহেব। ফিরোজ প্রতিবাদ করেছিলেন–
‘ওই শালাদের ইসলামে ওটা জায়েজ হতে পারে। ওই ইসলাম আমরা মানি নে।’
বস্তুতঃ ফিরোজ ও ওদুদ সাহেবের মধ্যে ও-বিষয়ে বিরোধের অবকাশ প্রায় ছিলই না। অতএব কোন তর্ক ওঠেনি। এমনিই আলোচনা চলেছিল অনেকক্ষণ। কিন্তু সেটা সন্ধ্যার পরের ঘটনা।
বর্তমানের ঘটনা হচ্ছে, গাড়ির গতি মন্থর হতে দেখে একজন সৈনিক এগিয়ে এল তাদের পানে। এবং সৈনিকটিকে এগিয়ে আসতে দেখে ফিরোজের গাড়ি একেবারে থেমে গেল।
‘কিয়া মাঙ্গ্তা?’
চট ক’রে একটা বুদ্ধি খেলে গেল সুদীপ্তর মাথায়। বিশুদ্ধ উর্দুতে প্রশ্ন করলেন—এইখানে গুল আহমদ কিরমানি সাহেবের বাসাটা কোথায় বলতে পার?
স্বয়ং ফেরেশতারও সে কথা বলার সাধ্য ছিল না। কিন্তু পাকিস্তানি সৈনিকের অসাধ্য কিছু থাকে নাকি! সে নির্দ্বিধায় বলে দিল—আগে বাঢ়হ্। এগিয়ে যাও, এগিয়ে গেলেই পাবে। ফিরোজ গাড়ি নিয়ে এগোলেন। কিছু দূর এগিয়ে ফিরোজের মনে হতে লাগল, তিনি যেন একটা ভূতুড়ে শহরের মধ্যে গাড়ি চালিয়ে চলেছেন।
এইখানে একটা মসজিদ ছিল না? হাঁ, ঐ তো। ভূতুড়ে পোড়া বাড়ির মতো দাঁড়িয়ে আছে মসজিদটা। ঐ মসজিদে সারাক্ষণই মানুষ থাকত—ফিরোজ বরাবর দেখেছেন। সে একটা দেখার মতো জিনিস। হয় নামাজ চলছে, না হয় ওয়াজ, না হয় মিষ্টান্ন কিংবা গোশত-রুটি বিতরণ। তা মানুষ কি পাঁচ দশ জন? পঞ্চাশ-ষাটের কম কোনো সময়ই নয়। এ না হলে দেশ গোল্লায় যাবে কি করে—ফিরোজ ভাবতেন আর এতো যে মিষ্টান্ন-গোশত-রুটি এদের কে দেয় সেও ছিল ফিরোজের কাছে এক পরম বিস্ময়। সুদীপ্ত এ সব জানতেন না। কেন না? এ পথে কখনো তার আসার দরকার হয় নি। অতএব গোটা মসজিদ শূণ্য দেখে ফিরোজের মনে যে ভাবান্তর হল সুদীপ্তর সেটা হয় নি। এবং সেই জন্যই বোধহয় হবে, সুদীপ্তর চোখে যা পড়ল ফিরোজ তা দেখেন নি। এমন কি মসজিদের বারান্দায় একটা কুকুরকে আমিনা যে শুয়ে থাকতে দেখলেন তাও ফিরোজের নজরে পড়ে নি। চকিতের মধ্যে কেবল এটুকু তিনি দেখলেন, গোলাগুলির ভয়ে লোকে মসজিদ ছেড়েছে। আমিনা দেখলেন, হায় হায়, যে মসজিদে মুসল্লি যায় সেখানে কুকুর! কিন্তু সুদীপ্তর দৃষ্টি গিয়েছিল ওপরে, মিনারের পানে—ওই যেখানে দাঁড়িয়ে মুয়াজ্জিন আজান দিয়ে থাকেন। কিন্তু ওখানে একটা মৃতদেহ যেন। গাড়ি দ্রুত চলে গেল। বেশি কিছু দেখা গেল না আর।
তা হলে সুদীপ্ত ঠিকই দেখেছিলেন। ওরা গাড়ি থামিয়ে নেমে খোঁজ নিলে একটি মৃতদেহকেই সেখানে দেখতেন। মসজিদের মিনারে মুয়াজ্জিনের প্রাণহীন দেহ। মুয়াজ্জিন কি মিনারে উঠে রাইফেল তাক করেছিলেন শত্রুর পানে?
অবশ্যই রাইফেলের আওয়াজ ওই এলাকায় গত দু’দিনে বিস্তর শোনা গেছে। এবং একবারও আজান শোনা যায় নি। পার্শ্ববর্তী এলাকার মানুষ। ছাব্বিশে মার্চের ভোরে ফজরের আজান শোনে নি। কেউই শোনে নি? সকলের কথা ওঠে না। যারা ফজরের সময় ঘুমিয়ে থাকে তারা কোনোদিনই আজান শোনে না। কিন্তু ওই সময় ঘুমোয়নি যারা? তারা নামাজ না পড়লেও আজানটা শোনে। ওই দিন আর তা শোনে নি। একেবারেই শোনে নি বললে কিছুটা ভুল বলা হয়। পাড়ার পেনশন প্রাপ্ত সাবরেজিস্টার বৃদ্ধ আব্দুল আলিম সাহেব প্রতিদিনের মতোই শুনেছিলেন—আল্লাহু আকবার…। গোলাগুলির কর্কশ আওয়াজের মধ্যে সেই মোলায়েম আল্লাহু আকবার ধ্বনি বৃদ্ধের নিকট ঠিক রোজকার মতো সঙ্গীতময় মনে হয়েছিল কি? না ঠিক অন্য দিনের মতো নয়—সেদিনের ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি বৃদ্ধের কানে নারকীয় হত্যাযজ্ঞের মধ্যে বেহেশতের আশ্বাসবাণীর মতো মনে হয়েছিল। কিন্তু ওই পর্যন্তই। আল্লাহু আকবার আর দ্বিতীয়বার আলিম সাহেব শোনেননি। কিন্তু বিস্তর গুলিগোলার আওয়াজ শুনেছিলেন। পরহেজগার আলিম সাহেবের ভাষায় ওইগুলো ছিল শয়তানের গোঙানি—ওই শয়তানদেরকে মৃত্যুদশায় ধরেছে। তারি আলামত এই সব। কিন্তু শয়তানের গোঙানির কাছে আল্লাহর ডাক যে সয়লাব হয়ে গেল! সে থেকে আজ পর্যন্ত আর আজান পড়ে নি মসজিদে। অবসরপ্রাপ্ত জীবনে বৃদ্ধ সকল প্রকারের রাজনীতিচর্চা বাদ দিয়ে কেবলই নামাজ কালাম নিয়ে ছিলেন। কিন্তু হায় হায়, এ কি হল! জুমার নামাজের সময়ও কারফিউ উঠল না। হায় আল্লাহ, জীবনে এই প্রথম তাঁকে জুমার নামাজ বাদ দিতে হল। নাসারা ইংরাজের অধীনে দীর্ঘকাল চাকরি করেছেন, কখনো নামাজে কোনো প্রকারের বিঘ্ন সৃষ্টি হয়নি একদিনও। ওই বিধর্মীদের রাজত্বে কখনো যা হয়নি, আল্লাহ, তাই হল ইসলামী রাজ এই পাকিস্তানে। হিন্দুস্থান থেকে হিন্দুদের অত্যাচারে পালিয়ে এসেছেন এমন কিছু মুসলমানের সাথে তার দোস্তি আছে। কিন্তু তারাও কেউ কোনোদিন বলে না যে, সেখানে হিন্দুরা কোথাও মুসলমানদের জুমার নামাজ বন্ধ ক’রে দিয়েছে। হিন্দুস্থানের মুসলমানদের নসিবে যা ঘটেনি তাই ঘটল এই পাকওয়াতনে! আফসোস, ইয়া মাবুদ। সাতাশ তারিখে কারফিউ উঠে গেলে লোকে যখন আক্রান্ত এলাকা ছেড়ে দিক-বিদিকে নিরাপদ এলাকার সন্ধানে বেরিয়েছিল বৃদ্ধ আলিম সাহেব তখন বেরিয়েছিলেন মসজিদের পানে। মুয়াজ্জিন হঠাৎ আজান বন্ধ করেছিলেন কেন? কিছু ঘটেনি তো। মানে, কি আবার ঘটবে! তিনি তো আজানই দিচ্ছিলেন। আর কিছু তো করেননি। তবে?
মসজিদে ঢুকে আলিম সাহেব কেঁদে ফেলেছিলেন হাউ হাউ করে। আল্লাহর ঘরের এই দশা! মসজিদের মেঝেতে রক্তের দাগ। অনেক রক্ত। এবং রক্ত এক জায়গায় নয় সারা মসজিদ জুড়ে, নানা স্থানে। বিশেষ ক’রে থামের পাশে এবং কোণগুলোতে। মসজিদের মধ্যেও ওরা মানুষ হত্যা করেছে! আহা ওদের কি দোষ! মোয়াজ্জিন সাহেবই তো যতো গোলটা পাকালেন! আজান দিতে উঠে সকলকে জানিয়ে দিলেন, আমরা এখানে আছি। ওখানে তারা ছিলেন সংখ্যায় পনেরো-ষোল জন। যথারীতি এবাদত বন্দেগী চলছিল। শুক্রবারের রাত—এই রাতের ফজিলত বিস্তর। কেউ কোরআন পড়ছিলেন। কেউ তসবিহ্ জপ করছিলেন, কেউ পড়ছিলেন নফল নামাজ। এমন সময় বোধহয় ইসরাফিলের শিঙ্গা বেজে উঠল। দুনিয়া ফানা হতে শুরু করল নাকি! বাতি নিবিয়ে দোর বন্ধ ক’রে সকলে আল্লাহকে ডাকতে শুরু করলেন। আল্লাহকে ডাকতে ডাকতেই ভোর হল। এখন ফজরের নামাজ। সকলে চাইল, ঘরের মধ্যেই চুপি চুপি আজান দিয়ে নিঃশব্দে নামাজ সেরে নেয়া যাক। কিন্তু মোয়াজ্জিন শুনলেন না। তিনি নিয়ম-মাফিক ওজু সেরে মিনারে উঠলেন। এখন আল্লাহর নামে ঘোষণা করবেন তিনি। আল্লাহর নামে সকল বালা-মসিবত দূর হবে। হবে নাকি! তোমরা যে আসলে সবাই ভণ্ড মুসলমান তা পাকিস্তানিরা জানেন না? গভর্ণর ফিরোজ খান নুন জানতেন, তোমাদের কারো খাতনা হয় না! অতএব সেই খান সাহেবের দেশবাসিগণ জানে তোমরা আদিতেই অমুসলমান থেকে গেছ। আয়ুব খান জানতেন, তোমরা সবাই হিন্দুদের গোলাম ছিলে, এখন আজাদ হওয়ার পরও সেই গোলামীর প্রবৃত্তি তোমাদের মধ্য থেকে যায় নি। অতএব তোমাদের মুখে আজানের ধ্বনি খাঁটি মুসলমানের মতো শোনায় না। পাকিস্তানি জওয়ানদের কানে সেই রাতের আজান কেমন শুনিয়েছিল? ভূতের কানে রাম নামের মতো! অন্ততঃ খুব-অসহ্য লেগেছিল তাতে সন্দেহ নেই? এবং অসহ্যকে সহ্য ক’রে নেবার উদারতা জওয়ানদের কাছে আশা কর নাকি! অতএব এখন দেখ, সারা মসজিদ জুড়ে রক্ত। সেই রক্তের লোভেই এসে থাকবে কুকুরটা। এসে ফিরে যাবার সময় কি মনে করে মল ত্যাগ ক’রে গেছে। কিন্তু কোথায়? হায় হায়, ঐখানে দাঁড়িয়ে যে এমাম খুতবা পাঠ করেন! আলিম সাহেব শিশুর মতো কাঁদলেন খানিক। তারপর গেলেন মিনারে। মৃত মোয়াজ্জিনের রক্তে ভেজা লাশ—দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলেন। দেখলেন এবং চলে এলেন। মসজিদে কুকুর প্রবেশের দুঃখ ভুলে গেলেন। হাঁ, লাভ ওইটুকুই। একটা বেদনাকে তো চাপা দিতে পারে আর একটা বেদনাই।
ঠিক এই জন্যেই হবে, প্রেস ক্লাবের দেয়ালে যে প্রকাণ্ড গর্ত ছিল তা আর বিশেষ কিছু মনে হল না তাদের কাছে। রাজারবাগ পুলিশের সদর দপ্তর দেখার পর ওটা আর আদৌ আকর্ষণীয় ছিল না। তবু ফিরোজ তাঁর গাড়ির গতি মন্থর ক’রে এক সময় প্রায় থেমেই গেলেন।
এখানেও কামান দাগতে হয়েছিল নাকি! কেন? এখানে তো ছাত্র ছিল না, পুলিশ ছিল না। তবে?
আবার যুক্তি চাও! এই জন্যই মরেছ তোমরা। যা দেখছ সব মেনে নাও, তবে পেছনে কোনো যুক্তি দেখতে চেয়ো না।
তাই তো। সতর্ক হলেন ফিরোজ। The People, সংবাদ, ইত্তেফাঁক—এ সব সংবাদপত্র অফিস যে একেবারে ধুলিসাৎ ক’রে দিয়েছে তার হয়ত কোনো কারণ থাকতেও পারে। কিন্তু প্রেসক্লাব থেকে কোনো পত্রিকা বেরোত নাকি! তা না-বেরুলেও সাংবাদিক তো বেরুত। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঁচা ছেলেগুলো ওইখানে ঢুকে আড্ডা দিতে দিতে সব এঁচড়ে পাকা হয়ে যেত না! অতএব এটাকে মূল সুদ্ধ উপড়ে ফেলে দাও। দেশের মধ্যে বানু বদমাইশের দল হচ্ছে–শিক্ষক, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক। নচ্ছারগুলো কেবলি দেশপ্রেম দেখানোতে ব্যস্ত হয়ে উঠে। কেন? তা হলে এসো বাছাধনরা, দেশপ্রেমের পরীক্ষা দাও। কে কত মরতে পার দেখি। কতো শিক্ষক, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক ঢাকা শহরে মরেছেন?
হিসেবটা দিতে পারতেন সাংবাদিকরাই। সেই জন্যই তো সাংবাদিকদের উপর এতো রাগ। দেখলে না, যতো বিদেশী সাংবাদিক ঢাকায় ছিলেন সকলকে ঝেটিয়ে বের ক’রে দিয়ে তারপর ওরা শুরু করেছে ধংসযজ্ঞ। কিন্তু ঝাট দেবার সময়ও কিছু তো এড়িয়ে যায়। দু-একজন সাংবাদিকও যদি এড়িয়ে গিয়ে থেকে থাকেন! আল্লাহ, বিদেশের অন্ততঃ একজন সাংবাদিক যেন থাকেন শহরে। তাতে লাভ? কিচ্ছু লাভ নেই। বাইরের লোক একটু শুধু জানবে কিভাবে আমরা সবাই মরলাম—সেইটুকু শুধু জানবে সকলে।
শুধু সকলকে জানানোর জন্যই মাঝে মাঝে ছবি নিতে ইচ্ছে করছে ফিরোজের। এই স্থান ও কাল থেকে কিছু দূরে যারা আছেন, বা থাকবেন তাদের জন্য এর কিছু ছবি তো নিয়ে রাখতেই হয়। তা নইলে তারা আমাকে ক্ষমা করবেন কেন? ইতিহাস তথ্যপঞ্জী দেবে। কিন্তু কিছু দেখতে পারবে তো। দেখাতে জানে সাহিত্য এবং ছবিও। ফিরোজ তো ছবি আঁকতে জানেন না? অতএব বৃষ্টির ধারাজলের তৃষ্ণা কলের জলেই মেটানো যেতে পারে। ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলে রাখা যেতে পারে। কিন্তু মেয়েদের যে প্রবল আপত্তি।
‘ভাই, চারপাশে দেখেছেন না, একটা জনপ্রাণী নেই। গাড়ি থামাবেন না।’
‘তুমি আমাদের সকলকে মারবে। সবখানে গোঁয়ারতুমি চলে নাকি! তুমি হলফ ক’রে বলতে পার, এইখানে কোথাও আর্মি লুকিয়ে নেই।’
তা থাকতে পারে। মীনাক্ষীর যুক্তি ফেলে দেওয়া যায় না। ফিরোজ আর নামলেন না গাড়ি থেকে। তবে গন্তব্যস্থলে পৌঁছানোর সোজা পথও ধরলেন না। গন্তব্যস্থল তার কোন্টা? হাঁ, পুরোনো ঢাকাই বটে। এবং আমিনাও জানিয়ে দিয়েছেন, তিনিও পুরানো ঢাকাতেই যাবেন। স্বামী-সন্তান নিয়ে আপাততঃ খালার বাড়িতে উঠবেন। রাস্তার নাম ও বাড়ির নম্বর শুনে ফিরোজ বুঝলেন আমিনারা যেখানে যেতে চাইছেন সেটা অন্য রাস্তায় হলেও তার গন্তব্যস্থল থেকে সামান্যই দূরে। গাড়িতে দু’ তিন মিনিটের বেশি লাগবে না। অতএব হাতে যেটুকু সময় আছে এই রাস্তাটা দিয়ে একটু ঘুরে যাওয়া যাক। অবশ্যই স্বাভাবিক অবস্থায় এই ইচ্ছেটা ফিরোজের মনে জাগত না। সুদীপ্তও বাধা দিতেন। হাঁ বটে, কারফিউ আরম্ভ হতে এখনো দেরি আছে। এবং দুষ্কর্ম তারা যা শুরু করবে সেই কারফিউ শুরু হলে পর। যেন কোনো দিক দিয়ে কেউ পালাতে না পারে। তা হলেও ঘরের বাইরে এখন যত কম থাকা যায় ততই ভালো। অতএব সোজা পথ ধরে কোনো-একটা ঘরে পৌঁছানোই তো বুদ্ধিমানের কর্ম। সুদীপ্তও সেই কথা বলতেন। কিন্তু এখন কিছুই বললেন না। তাঁদের সকলকেই কেমন একটা নিশীতে পেয়েছে যেন! নিশী-পাওয়া ব্যক্তির মতো ফিরোজ গাড়ি চালিয়ে চললেন, এবং অন্যেরা দেখতে দেখতে দেখতে চললেন।
জনমানবহীন রাস্তার দু পাশে মাঝে মাঝে গুলিবিধ্বস্ত বাড়ি, মানুষের লাশ, পুড়িয়ে-দেওয়া জনপদের চিহ্ন-কয়েকটা দেখলেই আর কোনো বৈচিত্র পাওয়া যায় না। ধ্বংসের কোন বৈচিত্র্য থাকে? বৈচিত্র্য সৃষ্টির মধ্যে কিন্তু এই বৈচিত্র্য-হীন ধ্বংসলীলা দেখে বেড়ানোর মধ্যে কী একটা নেশা আছে যেন।
সারি সারি স্বল্পমূলধনের দোকান—নিম্ন মধ্যবিত্তেরা কোনোমতে টিন দিয়ে বানিয়ে ব্যবসা ক’রে খাচ্ছিল। সব ওরা পুড়িয়ে দিয়েছে।…একটা দেয়াল ঘেরা বাড়ির বিপুল আঙিনায় পোড়া মোটর গাড়ি দেখা গেল অন্ততঃ পঁচিশ ত্রিশখানা। ভিতরে একটা গাড়ি মেরামতের কারখানা ছিল। একজন রিক্সাচালকসহ রিক্সাটা পথের পাশে কাত হয়ে পড়ে আছে। দেখেই বুঝা যায়। রিক্সা নিয়ে পালিয়ে যাবার সময় পাশ থেকে গুলি করেছে। তার শিথিল মুঠিতে রিক্সার হ্যাণ্ডেল তখনও লেগে ছিল।…আহ্, ওই দেখ দেখ, গাছের ডালে কিশোর বালকের লাশ ঝুলছে ঘন ঝাঁকড়া গাছ দেখে সেখানে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজেছিল বালকটি। কিন্তু ঝাঁকড়া গাছ দেখলেই সেখানে এলোপাথাড়ি গুলি করেছে ওরা। সেই গুলিতে সে মারা গেছে। কিন্তু ঘন ডালের ফাঁকে শরীর আটকে গিয়ে মাথাটা নিচের দিকে ঝুলছে।…এখানে এটা? একটা স্কুল ছিল। আর ওখানে ওইটে দৈনিক পত্রিকার অফিস ছিল। ছিল কিন্তু নেই। আর্মি ধ্বংস ক’রে দিয়েছে। কিন্তু ধ্বংস মানে যে, এতোখানি তা এখানে না এলে বিশ্বাস করা শক্ত হত। দরজা জানলা থেকে শুরু ক’রে প্রত্যেকটি মেশিন, কাগজপত্র সব গ’লে পুড়ে একাকার হয়ে গেছে—শ্মশানের কঙ্কালের মতো উলঙ্গ দেয়াল কোনোমতে দাঁড়িয়ে।…এবং এমনি সব দৃশ্যাবলির অপূর্ব মিউজিয়াম সমগ্র ঢাকা নগরী।