ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ

কোনো মতে ডাল-ভাত খেয়ে এখন বাঁচলে হয়! এবং বাঁচতে হবেই। আর বাঁচতে হলে মরতেও হবে। মরতে শেখে নি যারা, তারা বাঁচতেও শেখেনি।

‘বাঙালিরা এখন মরতে শিখেছে, অতএব তাকে মেরে নিঃশেষ ক’রে দেবার ক্ষমতা এখন পৃথিবীতে কারো নেই। জানবে, মৃত্যুকে ভয় ক’রে যারা মৃত্যুকে এড়াতে চায় তারাই মরে।’

দলপতি তাঁর দলের ছেলেদেরকে বুঝাচ্ছিলেন কথাগুলি। সকলেই জোয়ান ছেলে। কেউ ছাত্র, কেউ পুলিশ, কেউ ই. পি. আর-এর লোক। পঁচিশে মার্চের ভয়াবহ রাত্রির নারকীয় কাণ্ডের মধ্যে কোনো মতে যারা পালিয়ে বেঁচেছে এরা তাদের মধ্যে। না, এরা বুলাদিকে চেনে না। বুলাদির কর্মক্ষেত্রের সঙ্গে এদের যোগ বিশেষ ছিল না। বুলা যে একটি গোপন বিপ্লবী সংস্থার সদস্য সে কথা জানেন এক দলপতি জামাল আহমেদ স্বয়ং। আর কেউ না। অবশ্যই জামাল আহমেদের রাজনৈতিক মত বুলাদির নয়–একজন ন্যাশনালিষ্ট হলে অন্য জন কমিনিষ্ট। জামাল সাহেব আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত। বুলাদির যোগ পূর্ব বাংলার বেআইনী গোপন কমিনিষ্ট পার্টির সঙ্গে। বিপ্লবে বিশ্বাসী জামাল সাহেবও এককালে কমিনিষ্টদের সঙ্গে অনেক উঠাবসা করেছেন–কমিনিষ্ট পার্টির কাজও করেছেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত এসে যুক্ত হয়েছেন আওয়ামী লীগের সঙ্গে।

‘জাতীয়তাবাদের চর্চা দেশে কিছুদিন চলতেই হবে, তারপর আপনিই সমাজতন্ত্রবাদের চাকা ঘুরতে শুরু করবে।’

জামাল সাহেবের এ মতের বিরোধিতা ক’রে বুলা যুক্তি দেন–

‘সারা বিশ্বে জাতীয়তাবাদ যখন মুমূর্ষ দশায় উপনীত, আমরা তখন তারই চর্চা শুরু করলে ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না। চরম লাঞ্ছনা ও দারিদ্র্য হবে দেশের মানুষের ভাগ্যলিপি।’

‘কিন্তু দেশটা আগে তো আমাদের হোক, তারপর এ সব তর্ক ওঠাবেন। এখন যখন দেশের এক বিপুল জনগোষ্ঠী কেবলই ধর্মের নামে পশ্চিমাদের ঔপনিবেশিক শাসনকে স্বাগত জানাচ্ছে তখন চিত্তের মোহমুক্তির জন্য জাতীয়তাবাদই হচ্ছে একমাত্র দাওয়াই।’

–এই ধরনের বিতর্ক জামাল আহমেদের সঙ্গে বুলাদির অনেক হয়েছে। কিন্তু সে সব অন্য দিনের কথা। নানা মতবাদ দেশের মধ্যে থাকবেই–একে অন্যের মতবাদ সম্পর্কে সহিষ্ণু হবে। এবং জনগণের সমর্থন যেদিকে যাবে, সেই পক্ষই আখেরে জয়ী হবে। কিন্তু এও তো গণতন্ত্রেরই কথা আর গণতন্ত্র ছাড়া শেষাবধি মানুষের পথই বা কই? একটা আছে লাঠির যুক্তি। সভ্যতার দাবি উপেক্ষা ক’রে একটা পক্ষ যখনই স্বেচ্ছাচারী হল অন্য পক্ষের তখনই লাঠি ধরা ছাড়া পথ থাকে না। আজ বাঙালির সেই লাঠি ধরার দিন এসে গেছে। এইখানেই বুলাদি ও জামাল সাহেব এক।

পঁচিশে মার্চের পর বাংলাদেশের দল এখন দুটো–এক, সর্বপ্রকার অসম্মান শিরোধার্য ক’রে এখনো যারা পাকিস্তানের মোহকে চিত্তে পুষে রেখে পাঞ্জাবীদের সঙ্গে মিলে মিশে থাকতে চায়। দুই, বাংলাদেশকে পুরোপুরি স্বাধীন দেখতে চায় যারা। জামাল সাহেব ও বুলাদি দুজনেই একমত যে—

‘বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে আমরা যারা একমত তাদের এখন সম্মিলিতভাবে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়া দরকার। মতাদর্শের পার্থক্য যা আছে সে নিয়ে বোঝাপড়া হবে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর।’

তাই বুলাদি এখন জামাল সাহেবের সহায়ক।

বুলাদি গোপন কমিউনিস্ট পার্টির একজন অসাধারণ কর্মী। ঢাকা শহরের অনেকেই তাকে চেনে না আবার যারা চেনার তারা ঠিকই চেনে। বাইরে তিনি একজন নিরপরাধিনী শিক্ষয়িত্রী, অত্যন্ত সংযত শোভন ব্যবহার, কারো সাতে-পাঁচে নেই। বোরখা পরে বাইরে বের হন, বাইরে তিনি জামাতে ইসলামের সমর্থক। মেয়েদের মধ্যে জামাতে ইসলামের পুস্তিকা ইত্যাদি বিতরণের জন্য রাশি রাশি বান্ডিল আসে তার কাছে। তিনি সেগুলো আগুনে পড়িয়ে বুড়ো মায়ের জন্য দুধ গরম করেন। সরকারী মহলের কোনো সন্দেহ এঁর বাড়ির ত্রিসীমানাও ঘেঁষে না। এবং সেই সুবিধাটুকুর পুরো সদ্ব্যবহার করেন। পাকিস্তান সরকারের সন্দেহভাজন বাঙালি দেশকর্মীগণ। জামাল সাহেব গতকাল থেকে সে সুবিধাটুকু না পেলে অনেকখানি বেকায়দায় পড়তেন বৈকি। কাল থেকে তিনি পুলিশ—ই. পি. আর ও ছাত্রদের যতো জনকে পেয়েছেন ঢাকা শহরের বিভিন্ন বাড়িতে লুকিয়ে রেখেছেন, এবং সুযোগ বুঝে পার ক’রে দিচ্ছেন। মফঃস্বলের বিভিন্ন এলাকায়। সেখানে এদের নিয়ে মুক্তিবাহিনী গঠন করতে হবে। হাঁ, সরাসরি যুদ্ধই করতে হবে। যুদ্ধের ভাষা ছাড়া অন্য কোনো ভাষা যখন তারা বোঝে না তখন আর উপায় কী?

সুদীপ্তরা আসার মাত্র দশ মিনিট আগে জামাল সাহেব এসেছেন এ বাড়িতে। তার আগেই একজন দুজন ক’রে তেইশ জনকে পাঠিয়েছেন। সে এক অদ্ভুত কৌশল। একটা কোড নম্বর শিখিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেই নম্বর বললে জায়গা মেলে বাড়িতে। কিন্তু সুদীপ্তরা তো কোন কোড নম্বর নিয়ে আসেননি। তদুপরি এসেছেন জামাল সাহেবের আগমনের প্রায় পরে পরেই। কে জানে জামাল সাহেবের পেছনে পেছনে কোনো গুপ্তচর এল কিনা! কিন্তু সঙ্গে স্ত্রী আছে, ছেলেমেয়ে আছে। এইভাবে কোনো গুপ্তচর আসে নাকি! কি জানি বাবা, দেশের যা অবস্থা। কিছুই তো বলা যায় না। বিশেষ ক’রে জামাল সাহেব এই তো এলেন।–এইসব ভাবনা থেকেই তো বাইরের এই অন্ধকূপে বসিয়ে রাখা হয়েছে সস্ত্রীক সুদীপ্তকে।

কিন্তু বুলার মনে সন্দেহ বিশেষ ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের তো বহু জনেরই চেনার কথা। নিজেকে সেই অধ্যাপক বলে পরিচয় দিতে যাবে এমন গবেট হলে গোয়েন্দাগিরি করা যায় না। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন ছাত্র ছিল ওই বাড়িতে আড়ালে থেকে সুদীপ্তকে তারা দেখল। এবং চিনতে পারল না। তা হলে? তা হলেও বুলা তাদেরকে সন্দেহ করলেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনিও তো এককালে পড়েছেন। পড়তেন পদার্থবিদ্যা নিয়ে। কিন্তু কলাবিভাগের ক’জন শিক্ষককে তিনি চিনতেন। ছাত্র দু’জনের ও একজন ভূগোলে, একজন রসায়নে। ইংরেজির অধ্যাপককে না চেনা তো খুবই সম্ভব। তার যুক্তি কেউ অস্বীকার করতে পারল না। কিন্তু অস্বীকার না করলেও তো কথা থাকে। এতোগুলো যে লোক এখানে আছে তাদের সম্পর্কে সরকারি মনোভাবটা কি? এরা সবাই সরকারি দৃষ্টিতে প্রচণ্ড দেশদ্রোহী না? পেলে সকলকে সার ক’রে দাঁড়িয়ে দিয়ে গুলি ক’রে মারবে। তাই এদের সম্পর্কে একটু অতিরিক্ত সাবধানতা অবলম্বনের প্রয়োজন আছে বৈ কি। সহসা এদের মধ্যে কোনো অচেনা ভদ্রলোককে নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে কি?

তা বটে। তবু কি কারফিউ-এর সময় কাউকে পথে বের ক’রে দেওয়া যায়? বিশেষ ক’রে পাশের বাড়ির জমিলা খালাদের জামাই। কথাটা সত্য হওয়া খুবই সম্ভব। তার এক বোনের জামাই বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করেন—জমিলা খালা প্রায়ই বলতেন। তবে পরিচয় হয়নি। তার কারণ যে তিন মাস হল বুলারা এ বাড়িতে এসেছেন সেই তিন মাসের মধ্যে আমিনা মাত্র দুবার এসেছিলেন তার খালার বাড়ি। এবং একবার ছিলেন মাত্র ঘণ্টা খানেক, সেবার খালাদের নতুন প্রতিবেশীর সাথে আলাপের সময় ছিল না। দ্বিতীয়বার স্বামী সন্তানসহ একটা পুরো দিন আমিনা এখানে কাটিয়ে গেছেন। কিন্তু সেদিন আবার বুলারা গিয়েছিলেন মানিকগঞ্জে দেশের বাড়িতে। অতএব তারা বুলাদের অপরিচিতই থেকে গেছেন।

কিন্তু সুদীপ্ত যে খোদ জামাল সাহেবেরই পরিচিত ব্যক্তি। সেটা জানা গেল বেশ দেরিতে। ভদ্রলোকদের যখন এ বাড়িতে থাকতেই দিতে হবে তখন একটু বাজিয়েই দেখা যাক। জামাল সাহেব ভেবেছিলেন। কিন্তু এ কী! এ যে সেই ফিরোজের বন্ধু। সেই নির্ভেজাল অধ্যাপকটি যে! কিন্তু অধ্যাপক সাহেব জামালকে চিনলেন না। কারণ পাজামা-চাপকান পরিহিত ও নকল গুম্ফশ্মশ্রুশোভিত জামাল আহমদকে সুদীপ্ত কেবল ‘কোরাইশী’ নামেই জানতেন। অবশ্যই ‘কোরাইশী’ জামাল সাহেবের পৈত্রিক পদবী। কিন্তু নিজে কখনো তিনি নামের পরে কোরাইশী লেখেন না। তবে ছদ্মবেশ নিলে জামাল সাহেব বন্ধুমহলে পারভেজ কোরাইশী হয়ে যান। কিন্তু জামাল সাহেবকে দেখে পারভেজ কোরাইশীকে কল্পনা করা ঝানু গোয়েন্দার পক্ষেও ছিল অতি কঠিন কর্ম। ইচ্ছে করেই জামাল সাহেব সুদীপ্তর কাছে তার পারভেজ কোরাইশী পরিচয়টিকে গোপন রাখলেন। এবং আলাপ শুরু করলেন নীলক্ষেত এলাকার এক ভদ্রলোকের প্রসঙ্গ তুলে। সুদীপ্ত বিস্মিত হলেন—

‘তাকে চেনেন নাকি। কিন্তু তিনি ভাগ্যবান। আগেই দেশে চলে গেছেন।’

‘তিনি যান নি। তাকে পাঠানো হয়েছিল।’

এইরকম একটা অবস্থা যে আসছে সেটা কিছু আগেই জামাল সাহেবরা আঁচ করেছিলেন। সেই জন্য বিভিন্ন জেলায় কর্মসূচী স্থির ক’রে লোক পাঠানো হচ্ছিল। মনে হচ্ছে, আর-কোন পথ না পেয়ে ওরা এবার গায়ের জোর দিয়ে বাঙালিকে পদানত করতে চাইবে। যদি তাই হয়, তার যথোচিত উত্তর এবার দিতে হবে। জোর যার মুলুক তার? ঠিক আছে, বাঙালির জোরটাই এবার তবে দেখো। বাঙালি গায়ের জোরের চেয়ে মনের মায়া-মমতাগুলোকেই এতোকাল বেশি মূল্য দিয়ে এসেছে। তার ফলে যদি তাকে মার খেয়েই যেতে হয় চিরদিন? না। সেটা মেনে নেওয়া যায় না। মার এতোকাল কাউকে দিই নি বলে কোনো কালেই দেব না। আমরা প্রস্তুত। মরতে প্রস্তুত। মারতে প্রস্তুত।

সুদীপ্ত একটি প্রশ্ন করলেন—

‘আপনারা যদি বুঝেছিলেন, এমন অবস্থা সৃষ্টি হতে যাচ্ছে তা হলে সে সম্পর্কে আমাদেরকে পূর্বাহ্নেই কিছুটা আভাস দিলেন না কেন। তা হলে নিরাপদ আশ্রয়ে পালিয়ে বাঁচতাম।’

‘এই অভিযোগ শুধু আপনার কেন, আমারও। আমরা অবস্থাটা আঁচ করলাম অথচ জনসাধারণকে সে সম্পর্কে হুশিয়ার ক’রে দেবার প্রয়োজন অনুভব করলাম না কেন? কেন জানেন। বহু বর্বরতা বাঙালি দেখেছে, কিন্তু এবারের বর্বরতা সব কিছুকে হার মানায়। আমাদের কল্পনা হার মেনেছিল।’

জামাল সাহেবদের কল্পনা ছিল সুসভ্য ভদ্রলোকের কল্পনা। আওয়ামী লীগের সক্রিয় সদস্য এবং যাদের নিয়ে সক্রিয়ভাবে প্রতিরোধে নামতে হবে কেবল তাদের উপরেই প্রতিপক্ষের সশস্ত্র হামলা প্রত্যাশা করেছিলেন তাঁরা। তাঁরা একটা সাবধান বাণী প্রত্যাশা করেছিলেন। নিশ্চয়ই চরম ব্যবস্থা কিছু নেবার আগে প্রেসিডেন্টের কোনো একটা ঘোষণা প্রচারিত হবে। তাতে নতি স্বীকারের হুমকি থাকবে— এবং নতি স্বীকার না করলে তখনই………। সত্যিই তো, একটুও সতর্ক না ক’রে নিরস্ত্র মানুষকে কোন সশস্ত্র বাহিনী আক্রমণ ক’রে এমন শুনেছ কখনো?

‘তা ছাড়াও, জামাল সাহেব বললেন, ওরা যে ঘরে ঘরে ঢুকে মানুষ মারবে, রাতের আঁধারে এসে ঘুমন্ত পল্লীকে জ্বালিয়ে দেবে এ সব ছিল আমাদের কল্পনারও অতীত। এইসব বীভৎসতার শতকরা একভাগ মাত্র কল্পনা করেই তা থেকে স্বদেশবাসীকে বাঁচাবার জন্য সে রাতে মুজিব ভাই ধরা দিয়েছিলেন।’

‘এখন মনে হচ্ছে, তিনি ধরা না দিলেই ভালো হত।’

কিন্তু ঢাকা শহরে এখন জোর গুজব, মুজিব ভাই ধরা দেন নি। অবশ্য গুজবটাকে বিশ্বাস করার কোনো কারণ সুদীপ্তর ছিল না। তিনি বরাবর ছিলেন ফিরোজের সঙ্গে, এখন জামাল সাহেবের সঙ্গে–এরা দুজনেই শেখ মুজিবুর রহমানের কাছের মানুষ। বিশেষ ক’রে জামাল সাহেব মুজিব ভাইয়ের চরিত্রকে ভালো করেই চেনেন। অতএব বিপ্লবের নেতৃত্বদানের জন্য গোপনে শহর ত্যাগ করবেন এটা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। গণতন্ত্রসম্মত রাজনীতিটুকুই তার জানা। এবং এখন যখন সেই গণতন্ত্রের পথ রুদ্ধ হয়ে গেছে তখন পরবর্তী দায়িত্ব এসে চেপেছে আমাদের উপরে। জামাল সাহেবের চিন্তায় কোন জটিলতা নেই। এবং জামাল সাহেবেরও ধারণা–মুজিব ভাই ধরা না দিলেই ভালো করতেন।

‘তিনি যে ভেবেছিলেন, তাঁকে পেলে ওরা আর সাধারণ মানুষকে মারবে না, সেটা এই দু’দিনেই মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়ে গেছে। তা ছাড়া তিনি আজ বাইরে থাকলে আমাদের কাজ কতো সহজ হ’ত।’

‘কিন্তু ভবিষ্যতে প্রমাণিত হবে, তার রাজনৈতিক দর্শন অনুসারে তিনি ধরা দিয়েই সর্বাপেক্ষা বুদ্ধিমানের কাজ করেছেন’—বলে উঠলেন বুলা।

তাই তো বুলা এসে দাঁড়িয়েছেন। দুজনের কেউ তারা টের পান নি। সেই যে খানিক আগে জামাল সাহেবকে সঙ্গে এনে সুদীপ্তর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে গেছেন সেই অবধি ঘরে তারা দুজনেই ছিলেন। বুলা যাবার সময় আমিনা ও তাঁর সন্তানদের সঙ্গে ক’রে ভেতরে নিয়েছিলেন।

আসুন দিদি, আপনাদের শোবার ব্যবস্থা ক’রে দিই গে।

এই সন্ধ্যাবেলায়? বিস্মিত হয়েছিলেন আমিনা। কিন্তু অনেকক্ষণ এই অন্ধকূপের মতো ঘরে কাটিয়ে তিনি এতোই অস্থির ছিলেন যে, অন্যত্র যাবার প্রস্তাবে তিলমাত্র প্রশ্নও তোলেন নি। বুলাকে অনুসরণ করেছিলেন। কিন্তু সুদীপ্তকে এই ঘরে ফেলে যাওয়াটা স্বার্থপরতা নয়? না, ঠিক এই প্রশ্নটাই বেলার মনে ছিল না। তবু এই ধরনের একটা অনুভূতি তার শিশুচিত্তে ছিল। সে বলে উঠেছিল—

‘মা, আব্বু।’

‘উনি এখন মানুষের সাথে কথা বলছেন, দেখছ না।’

হাঁ, সুদীপ্ত এখন গল্প করার লোক পেয়ে গেছেন। আব্বাকে ফেলে যেতে তার মন কেমন করছে। মায়ের মুখের পানে তাকিয়ে সে বলেছিল—

‘আমি আব্বার কাছে থাকি আম্মু।’

বেলার দিক থেকে কথাটা খুবই সিরিয়াস ছিল। তবু সকলে সেটা খুবই হালকাভাবে নিলেন। অন্য সময় হলে হাসতেন। কিন্তু এখন সহজে হাসি আসতে চায় না।

আমিনা তার ছেলেমেয়েদের নিয়ে ভেতরে গিয়ে দেখেন, ও মা এ কি এলাহী কাণ্ড! এতো মানুষ বাড়িতে! এতোগুলো মানুষের এত কাছাকাছি তাঁরা এতোক্ষণ ছিলেন। অথচ এতো দূরে!

‘আপনি ভীষণ ডেন্‌জারাস্ মেয়ে দেখি’, বহু মানুষের দেখা পেতেই আমিনার মধ্যে স্বাভাবিকতা ফিরে এল–‘এতো মানুষের বাড়িতে আমরা ছিলাম, অথচ এতো একাকী!’

সামান্য একটু হাসলেন বুলা। বললেন—

‘কোয়ার‍্যানটীনে রেখেছিলাম, বুঝলেন না!’

আমিনাকে তাঁর ফুফু-আম্মার ঘরে দিয়ে বুলা ফিরে গেলেন। দু’তালার ঘর, কোনো খাট কিংবা তক্তপোষ কিছু নেই। সারা মেঝেতে বিছানা পাতা। ওইখানে মেয়েরা থাকবেন। নিচে দু’খানা ঘরে থাকবেন পুরুষেরা। থাকবেন মাত্র এই এক রাত্রির জন্য।

বুলা নীচে এসে খবরটা দিলেন—

‘চারপাশে ঢাকা শহর জ্বলছে।’

সঙ্গে সঙ্গে সুদীপ্তকে নিয়ে জামাল সাহেব ছাদে চ’লে গেলেন। এ দুজনেই কেবল গেলেন, অন্যদের খবরটা দেওয়া হয়নি। এতো আগুন না দেখাই ভালো। এখনো এতো আগুন? গত তিন রাত সমানে জ্বালিয়ে পুড়িয়েও কি ঢাকা শহর শেষ হয়নি! জামাল সাহেব বললেন–

‘ঐ আগুনটা শান্তিনগরের দিকে মনে হয়!’

‘শান্তিনগরের বাজার হতে পারে।’

‘ঠিক ধরেছেন।’ জামাল সাহেব বললেন, ‘আজ ওই বাজারে লুট হয়ে গেছে খবর পেয়েছি। লুটপাট ক’রে নিয়ে এখন ওখানে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে।’

তা হ’লে লুট হয়ে যাওয়ার খবর জামাল সাহেবও জানেন। সুদীপ্ত বললেন—

‘লুটপাট না হয় করল। কিন্তু আগুন দিল কেন?’

‘ওখানেই তো মজা। কালই দেখবেন, ওরা রেডিওতে প্রচার করবে, আমরা আওয়ামী লীগের লোকেরা ওই বাজারে আগুন ধরিয়ে দিয়েছি।’

‘কিন্তু এই মিথ্যাচারে ওদের লাভ?’

লাভ? বুঝতে পারলে না অধ্যাপক। এই জন্যই অধ্যাপক হয়েছ। শয়তানদের মতলব বুঝবে সেই সাধ্য যদি তোমাদের থাকত! জামাল সাহেব বুঝিয়ে দিলেন—

‘প্রথম লাভ, বিনা পয়সায় অত গম, চিনি, কেরোসিন ইত্যাদি পেয়ে গেল ওরা। বঙ্গাল মুল্লুকে আপনাদের মারতে এসে পয়সা খরচ ক’রে খেতে হবে নাকি! দ্বিতীয় লাভ, জিনিসপত্র যে লুটপাট হয়ে গেছে সেটা বলতে হল না। তা হলে আর্মির অকর্মণ্যতা প্রমাণিত হয়। তৃতীয় লাভ, ভয় দেখানো হ’ল আপনাদের। চতুর্থ লাভ, আওয়ামী লীগের লোকেরা যে গুণ্ডা-বদমায়েশ এটা প্রচার করা গেল। পঞ্চম লাভ, খাদ্যের অভাব সৃষ্টি করা হল।’

শিক্ষকতা করলে মানুষের দৃষ্টিশক্তির একটা দিক অসাড় মেরে গিয়ে মানুষ বোধ হয় কিছুটা বোকা হয়ে যায়। সুদীপ্ত সেই বোকামীর পরিচয় দিলেন। তিনি আবার প্রশ্ন করলেন–

‘খাদ্যের অভাব সৃষ্টি করলে তো সরকারেরই অসুবিধা। সে কাজ তারা করবে কেন?’

‘এই জন্য করবে যে, ওই সরকার এখন আর আপনাদের সরকার নয়। আপনাদেরকে গায়ের জোরে পদানত রাখা ছাড়া সরকারের গত্যন্তর নেই। অতএব খাদ্যাভাব সৃষ্টি করতে পারলে সরকারের এখন ভাল হবে দু’দিক থেকে। কল্পনা করতে পারেন সেই দুটো দিক কি কি?’

‘না, আপনি বলুন।’

‘প্রথমতঃ খাদ্যাভাবে আপনারা দুর্বল হয়ে পড়বেন। তখন আর লড়াইয়ের ক্ষমতা থাকবে না। আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হবেন। দ্বিতীয়তঃ যে সকল খাদ্য এখন তারা লুট ক’রে নিয়ে রেখে দিচ্ছে, পরে তা থেকে কিছু কিছু আপনাদের ক্ষুধার মুখে তারা তুলে দেবে। এইভাবে তারা আপনাদের উপকার করবে। আপনারা উপকৃত হবেন। এবং উপকৃত ব্যক্তির মানসিকতা লাভ করবেন।’

‘অর্থাৎ কৃতজ্ঞ থাকব ওদের কাছে।’

‘ঠিক তাই। দেখছেন না, যে অবস্থা ওরা সৃষ্টি করেছে তাতে আমাদের সামনে পথ এখন দু’টি— হয় বাঁচার জন্য সংগ্রাম করতে হবে, না হয় ওদের দান হাত পেতে নিয়ে অসম্মানের জীবনে আধমরা হয়ে বাঁচতে হবে।’

জামাল সাহেবের যুক্তি, সুদীপ্তর মনে হল, অকাট্য ও অভ্রান্ত। একটু ভেবে বললেন—

‘কিন্তু যে ঘৃণা ওরা আমাদের মনে সৃষ্টি করল কোনো দিন তা কি আর প্রীতিতে রূপান্তরিত হবে?’

‘হল না হল বয়েই গেল। শুধু চাই মদ-মাগী ও হালুয়া-রুটির ব্যবস্থা। সেজন্য পূর্ব-বাংলাকে শোষণ অব্যাহত রাখতে হবে। প্রীতি চাইলে শোষণ চলে না—এটুকু বুদ্ধি ওদের আছে।’

তা আছে। এবং এই বুদ্ধির তারিফ করতে হয় বৈ কি। প্রীতি-ভালোবাসা সম্পর্ক স্থাপন করতে গেলেই সামনে মর্যাদার প্রশ্ন উঠে। অতএব ওইসব ভাবালুতাকে প্রশ্রয় দেওয়া যায় না? হরিণকে যেখানে হত্যা ক’রে মাংস খেতে হবে সেখানে কি প্রতিমন্ত্র আওড়ালে চলে? সেখানে চাই রাইফেল।

সেই রাইফেল নিয়ে ওরা পূর্ব বাংলায় নেমেছে সেই ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দেই। নেমেছে মৃগ-শিকারে—স্বর্ণমৃগ। কিন্তু স্বর্ণমৃগের সন্ধানে বেরুলে গৃহলক্ষ্মী সীতাকে হারাতে হয় না। কিন্তু সীতা থাকলে তো তাকে হারাতে হবে। সীতা থাকেন সুসভ্য মানুষ রামচন্দ্রের ঘরে। কোনো অসভ্য বা অর্ধ-সভ্যের ঘরে সীতা থাকবেন কী ক’রে এবং কোনো অর্ধ-সভ্য জোর ক’রে সীতা হরণ করতে গেলে তার পরিণতি কি হয়?……

–আপনারা স্বাধীন বাংলা বেতারের খবর শুনছেন……

স্বাধীন বাংলা? সচকিত হলেন সুদীপ্ত। বুলা কখন ট্রানজিস্টর নিয়ে উপস্থিত হয়েছেন। সেই ট্রানজিস্টরে স্বাধীন বাংলার বাণী বেজে উঠল। মা ভৈঃ। আর ভয় নেই। স্বাধীন বাংলার বাণী এখন বাংলার আকাশে ছড়িয়ে পড়েছে। ট্রানজিস্টরে কান পাতলেই তা শোনা যাবে।

সকল বঙ্গবাসি! তোমরা শোনো! অবশ্যই এখনো কণ্ঠ খুব ক্ষীণ, হয়ত এখনই দেশের আকাশ সীমা ছাড়িয়ে দূরান্তে পৌঁছানোর ক্ষমতা তার নেই। কিন্তু সেই ক্ষমতা পেতে কি তার খুব দেরী হবে? ট্রানজিস্টারে খবর শেষ হয়ে গান শুরু হল–আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।…

হ্যাঁ, এই ভালোবাসাই বাঙালিকে পথ দেখাবে। বাঙালির অস্ত্রের শক্তি আজ সীমিত হতে পারে, কিন্তু ভালোবাসার সম্পদ তো অফুরন্ত। সেই প্রীতি ভালোবাসার সঙ্গে এবার অস্ত্রের সম্মেলন হয়েছে—এবার বাঙালি দুর্জয়।…

অনেক রাতে সুদীপ্ত শুতে গেলেন। মেঝেতে ঢালাও বিছানা। সারি সারি তাঁরা শুয়েছেন যতো জনের শোয়া সম্ভব। আর এদের একজনকেও তিনি চেনেন না। সব থেকে বেশি চেনেন জামাল সাহেবকে, কিন্তু সে পরিচয়েই সূত্রপাত হয়েছে মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে। হ্যাঁ, ঠিকই, তো হয়েছে। নব পরিচয়ের সূত্রপাত হয়েছে। পুরোনো জীবনটা সেই পঁচিশের রাতেই লয় পেয়েছে। আহা তাই সত্য হোক। নতুন মানুষ, নতুন পরিচয় এবং নতুন একটি প্রভাত। সে। আর কতো দূরে। বেশি দূরে হতে পারে না। মাত্র এই রাতটুকু তো! মা ভৈঃ। কেটে যাবে।